প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধমানবসভ্যতার জাগরণের পর থেকেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিতে মানুষ চিরকাল প্রাথমিকভাবে প্রাকৃতিক বৈচিত্র, যা তার জীবন যাপনের সঙ্গে মেলেনা, তাকে অস্বীকার করেছে। এর একটা প্রধান কারণ, যে কোনও জীবের চেয়ে মানুষ প্রকৃতিকে যেভাবে পরিচালনা করতে চেষ্টা করেছে ও কিয়দংশে সফল হয়েছে, তা থেকেই তার একটা অহমিকা জন্মেছে। সে চাইলে সব পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে যে সমস্ত সাফল্যের কাহিনী আমরা দেখতে পাই তার উৎস মানুষের এই ধরণের জয় থেকেই জন্মেছে। কখনও সে প্রকৃতিকে নিজের কাজে লাগিয়েছে, কখনও স্বৈরাচারীর মতো তার শক্তিকে সংহত করেছে। আমাদের এই নিবন্ধের বিষয় এমনই এক প্রাকৃতিক বৈচিত্র, যা সংখ্যাগুরু মানুষ একটি প্রাকৃতিক বিকৃতি হিসেবেই ভাবতে অভ্যস্ত। মানবিক চিন্তাধারার এই প্রস্তরীভূত বৈশিষ্ট্যকে আমূল বদলে দেওয়া শক্ত ব্যাপার। তবু আলোচনা হওয়া দরকার। একমাত্র সুস্থ ও স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গিই পারে আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতাকে মুক্তি দিতে।
আসুন বিষয়ে প্রবেশ করি। আজ আমরা আলোচনা করতে চলেছি একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে। স্পর্শকাতর, কেননা, বিষয়টির সঙ্গে আমাদের নিকট দূর, প্রিয়জন ও বন্ধুও এই শিরোনামে যুক্ত হয়ে যায়। আর তখন তাদের এই একটিই পরিচয় আর সব কিছুকে ছাপিয়ে আমাদের দৃষ্টিকে অস্বচ্ছ করে তোলে। সেই পরিচয় হলো তার যৌনচেতনা। আমাদের অনেককালের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠত্বের মানসিকতা দিয়ে আমরা ভিন্ন যৌনচেতনার মানুষকে প্রান্তিক করে তুলি। তাদের আর সব পরিচয়, সমাজে তাদের অবদান, সব ভুলে তাকে অপরাধী করে ফেলি। অপরাধ? সে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে এক ধরণের পরিচয় বহন করে, এমনটিই আমরা মনে করি। সমকাম বলে প্রকৃতিতে কিছু নেই। যা আছে তা হলো বিকৃতি। অসুস্থতা। অনেকেই মুক্তকণ্ঠে বলেন, কেউ কেউ বা নিজের মনে এরকম ধারণা পোষণ করেন, মুখে বলেন না। সেরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে তখন তাঁর প্রতিক্রিয়া থেকেই তাঁর অবস্থান পরিষ্কার হয়। কিন্তু সত্যি বলতে আমরা নিজেরা কতটুকু জানি? প্রাকৃতিক নিয়মে কি কি বলে? জানিনা। সমাজ ও রাষ্ট্র আমাদের নির্দিষ্ট মাপকাঠি দিয়ে চিনিয়ে রেখেছে। পারিবারিক গণ্ডীর মধ্যে, নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলা ভাবনা আমাদের সীমিত করেছে। এইটুকু প্রাকৃতিকভাবে সম্ভব। বাকিটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ। কেন? কারণ, প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী বিষম লিঙ্গের প্রাণীর মিলনেই প্রাণ উৎপাদন সম্ভব। সমলিঙ্গের মিলন বলে কিছু নেই, ওটা বিকৃতি। আর প্রকৃতির রাজ্যে নিয়মই হলো, সৃষ্টির ধারাকে অব্যাহত রাখা। সেখানে সমকাম একধরণের অপরাধ বৈকি!
কিন্তু আমাদের ঐতিহ্য তা বলেনা। ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস বলে, আমরা চিরকালই সহিষ্ণু উন্নতমনের মানুষ। সেভাবে সমকামী মানুষকে কখনও চরম শাস্তি মাথা পেতে নিতে হয়নি। যেসব ক্ষেত্রে শাস্তি নিদারুন, সেখানে দেখা যাবে সমকাম নয়, সঙ্গে অন্য কোনও অপরাধ লুকিয়ে ছিল। হ্যাঁ, সেভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হতোনা ঠিকই, কিন্তু এমন মানুষদের আলাদা করে চিহ্নিত করে তাদের সমাজের মূল স্রোতে মিলতে না দেওয়ার ইতিহাস আমাদের নেই। পরিস্থিতি বদলেছে ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে।
দেখি সমকাম সম্পর্কে অন্তত ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস বা পুরাণ কি বলে। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে, যেখানে রাম ও রাবণের জন্মান্তরের কাহিনী বলছেন বাল্মীকি, সেখানে একটি কাহিনী আছে। সেই কাহিনীর রাজা দিলীপ। তিনি তাঁর দুই স্ত্রীকে রেখে মারা যান। তিনি অপুত্রক অবস্থায় মারা যেতে রাজ্যে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সংকট উপস্থিত হলো। তখন শিব রাণীদের স্বপ্নে আবির্ভূত হলেন এবং আজ্ঞা দিলেন, তারা যেন দুজনে মিলিত হন। এই আজ্ঞা পেয়ে তারা মিলিত হলেন এবং একজন স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হলেন। তাঁর পুত্র হলেন ভগীরথ। যিনি গঙ্গাকে মর্ত্যে এনেছিলেন। কাহিনীটির একটু বিশ্লেষণ হোক। শিবের আজ্ঞা দুই রাণী যুগপৎ স্বপ্নে দেখলেন। সেই সময় কিন্তু উত্তরাধিকারের সংকট থেকে রক্ষা পেতে নিয়োগ প্রথা সামাজিক ভাবে গ্রহণীয় ছিল। অথচ কোনও ঋষি বা মুনির দ্বারস্থ না হয়ে দুই রাণী এভাবে মিলিত হবার স্বপ্ন দেখলেন? আবার দুজনে একসাথে? আবার একজন গর্ভধারণও করলেন! কী বিস্ময়! বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এ জিনিস অসম্ভব। তবে কি হয়েছিল? যে রাণী গর্ভধারণ করলেন তাঁর নিশ্চয় কোনও পুং সংসর্গ ঘটেছিল। সে থেকে রাজ্যের সংকট মিটেছিল। কিন্তু দুই নারী, যারা একে অপরের প্রতি আসক্ত ছিলেন বোঝাই যাচ্ছে, নাহলে এরকম স্বপ্নকাহিনীর অবতারণার কোনও জাগতিক প্রয়োজন ছিলোনা, তারা এই স্বপ্নের দ্বারা পুত্রার্থে মিলনের পবিত্রতা বাদে আপন খুশিতে মিলনকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলেন। এবং সমাজ তাতে সীলমোহর দিয়েছিল। যদিও বুদ্ধিমান লোকেরা বুঝেই ছিলেন রাণীদের গোপন কথা।
এবার আসি মহাভারতে। মহাভারতের অত্যন্ত বিখ্যাত কাহিনী শিখণ্ডীর কাহিনীটি। যদিও বলা হয়, পিতামহ ভীষ্মর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাঁর প্রতি ক্রুদ্ধ অম্বা আত্মহত্যা করেন। এবং জন্মান্তরে অম্বা রাজা দ্রুপদের ঘরে পুত্র হয়ে জন্মান। সে যাই হোক, পুত্র শিখণ্ডী বীর ছিলেন। বহু বছর শিক্ষা ও তপস্যার কারণে রাজ্যের বাইরে ছিলেন। কিন্তু দ্রুপদ তাঁকে পাঞ্চালে বেশিদিন রাখেননি। মোট কথা, পাঞ্চাল রাজ্যে আমরা যাজ্ঞসেনী আর ধৃষ্টদ্যুম্নকে যেভাবে উপস্থিত থাকতে দেখি, শিখণ্ডীকে সেভাবে দেখিনা। কারণ কি তবে তাঁর লিঙ্গের অস্পষ্টতা? দ্রুপদ হয়ত মানসিক ভাবে রক্ষণশীল ছিলেন, কিংবা, সেসময় রাজারা যেমন প্রজারা কি বলবে তাই নিয়ে ভাবিত থাকতেন সেই চিন্তায় শিখণ্ডীকে দূরে রেখেছেন। প্রথমে রাজা দ্রুপদ কিন্তু সমাজ মেনে তাঁর বিবাহ দেন। তখনও শিখণ্ডী পাঞ্চাল ছেড়ে যাননি। এবং যা ঘটার তাইই ঘটে। পত্নী তাঁকে নপুংসক বলে ঘোষণা করেন ও পরিত্যাগ করেন। লোকচক্ষুর আড়ালে, কোনও নির্জন স্থানে, শিখণ্ডী তাঁর লিঙ্গ পরিবর্তন করেন। স্পষ্টতই রাজা দ্রুপদের এতে সায় ছিল। তিনি পুরুষ থেকে নারীতে পরিবর্তিত হন। এবং সেই নারী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্মর সঙ্গে সম্মুখ সমরে আসেন। যেহেতু ভীষ্ম আজীবন ব্রহ্মচারী, তাই তিনি শিখণ্ডীর সঙ্গে যুদ্ধ করলেন না। এইই ভীষ্মর পতনের কারণ। কাহিনীর আড়ালে কি আছে দেখা যাক। শিখণ্ডীকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। নারীর সঙ্গে তাঁর সমর অসম্ভব জেনে ভীষ্মর সম্মুখে শিখণ্ডীকে আনার চক্রান্ত যুদ্ধের অন্যতম পরিকল্পনা ছিল। এবং সেভাবেই তাঁকে ক্রমাগত মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে, শিখণ্ডী যে একটি মহৎ কর্তব্যে মর্ত্যে এসেছেন, সেটি হাতুড়ি দিয়ে মাথায় ঢোকানো হয়। তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ ছিল এই, যে, তাঁর লিঙ্গ অস্পষ্টতা তাঁকে সমাজে সাধারণের সঙ্গে মিশবার স্বাধীনতা হরণ করেছিল। তিনি শরীরে পুরুষ হয়েও মনে নারী। এবং তাঁকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল পূর্বজন্মে তিনি অপরূপা অম্বা ছিলেন। ভীষ্ম তাঁকে ব্রহ্মচর্যের দোহাই দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর মনের ক্ষোভকে জাগিয়ে দেয় এই কাহিনী। তিনি নিজের অজ্ঞাতেই ভীষ্মর প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁর রুদ্ধ আবেগ তাঁকে কুরুক্ষেত্রে টেনে আনে নারীসত্ত্বাকে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে বলে। আর যুদ্ধ পরিকল্পকরা এই অবসরে তাঁকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করেন।
আরেকটি কাহিনী বলি। বৈবস্বত মনুর কন্যা ইলা। ইক্ষ্বাকুর ভগ্নী। যদিও বায়ুপুরাণ ও ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে ইলাকে মেয়েই বলেছে, বিষ্ণুপুরাণ কিন্তু জানাচ্ছে, ইলা প্রথমে পুরুষ হয়েই জন্মেছিলেন। পরে নারী হন। বা কিম্পুরুষ। যার নাম সুদ্যুম্ন। এই সুদ্যুম্ন চন্দ্র বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার প্রতিষ্ঠিত বংশ ঐল বংশ নামেও পরিচিত। রামায়ণে আছে, ইলা নাকি মৃগয়াতে গিয়ে ভুলবশত সহ্যাদ্রি পর্বতে অবস্থিত পার্বতীর শরবনকুঞ্জে ঢুকে পড়েছিলেন। সেখানে শিব ছাড়া অন্য পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। তাই পার্বতীর অভিশাপে তিনি নারী হয়ে যান। ওই কুঞ্জে নাকি বৃক্ষলতা পর্যন্ত নারী। এই অভিশাপের ফলে ইলার সঙ্গের পারিষদেরাও নারী হয়ে যান। বা কিম্পুরুষ। ইলা বাধ্য হয়েই বনে রয়ে গেলেন। এখন নারী ইলাকে দেখে বনে তপস্যারত চন্দ্রপুত্র বুধ মোহিত হয়ে পড়েন। তিনি নাকি প্রগাঢ় তপস্বী। তবুও সংযমের বাঁধ ভাঙছে। তিনি ইলাকে প্রেম নিবেদন করলেন। সম্ভবত ইলারও এছাড়া কোনও উপায় ছিলনা সমাজে ফেরবার। তাই তিনি বিবাহ করলেন বুধকে। এরপর নাকি একমাস অন্তর অন্তর ইলার লিঙ্গ পরিবর্তিত হতে থাকে। যেসব মাসে তিনি নারী সেসব মাসে তিনি বুধের সঙ্গে দাম্পত্যে মেতে থাকতেন। আর যখন তিনি পুরুষ তখন তিনি ব্রহ্মচর্যে কাল কাটাতেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলনা। কিম্পুরুষ রূপে ইলার অস্তিত্ব সিদ্ধ হলনা। কারণ ন মাস পর তার একটি পুত্র হল। নাম পুরুরবা। তাহলে কাহিনীর আড়ালে কি আছে? ইলা জন্মেছেন পুরুষ হয়ে। কিন্তু অন্তরে নারী তিনি। হয়ত তাঁর দৈহিক কিছু স্ত্রীচিহ্নও ছিল। রাজা তাঁকে সিংহাসনে বসাবার জন্য যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়না। তিনি সহ্যাদ্রি পর্বতের নিভৃতে কোনও চিকিৎসকের দ্বারা নারীতে পরিবর্তিত হন। এবং বুধ তাঁর প্রেমে পড়েন। দুজনে সেই অরণ্যে সংসার পাতেন। এবং তাঁদের পুত্রসন্তান জন্মায়। এর প্রত্যক্ষ ফল, রাজা সুদ্যুম্ন বা ইলাকে রাজ্য থেকে বঞ্চিত করেন। সে কিম্পুরুষ বলে নয়, সে নারী বলে। কিন্তু ইলা সুখে বুধের সঙ্গে ঘরকন্না করতে থাকেন।
প্রাচীন ভারতে তাহলে সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী সমকামীদের কি কোনও শাস্তি ছিল? ছিল, কারণ মনুস্মৃতি বলছেন, দুই নারী যদি মিলিত হয় তবে শাস্তিস্বরূপ দশটি চাবুক এবং দুশত দিনার দিতে হবে। কিন্তু যদি দুজনের মধ্যে একজন বয়স্কা হন, তবে তার মাথা নেড়া করে গাধায় বসিয়ে নগর প্রদক্ষিণ করানো হবে। এবং দুটি আঙুল কেটে নেওয়া হবে। এই আইনটি পড়লে একটু অবাক হতে হয়। কেন একই অপরাধে দুরকম শাস্তি? লক্ষ করলে দেখব, প্রথম ক্ষেত্রে শাস্তি খুবই নগণ্য। যেন সেভাবে শাস্তিই নয়। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তা এমন অপমানকর কেন? এখানে একটি কথা। প্রথম ক্ষেত্রে সম্ভবত দুই নারী প্রেমেই মিলিত হয়েছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দুই নারীর একজন বয়স্কা। তবে কি দ্বিতীয়জন কুমারী? সে কি নিজের যৌনচেতনা সম্পর্কে অজ্ঞান? তাকে সেই নারী তার সম্পূর্ণ অজান্ত্বে প্রায় ধর্ষণ করছে? আর তাই বয়স্কা নারীটিকে এমন শাস্তি দেওয়া হচ্ছে যা একজন পুরুষকেও অনুরূপ অপরাধে দেওয়া হয়। অর্থাৎ সমকামে উৎসাহ দেওয়া হতোনা বটে তবে সমাজ একে এত ঘৃণার চোখেও দেখতনা।
এই ছোট্ট পরিসরে একটি বিষয় স্পষ্ট। সমকাম সেসময় বেশ পরিচিত ও চর্চিত ছিল। সমাজে এটি একটি ছোটখাট অপরাধ হিসেবে গন্য হয়েছে। কখনও কখনও বৃহত্তর স্বার্থে একে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। বাৎস্যায়নের কামসূত্রে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে, মনুস্মৃতিতে একে নিরুৎসাহ করা হয়েছে। বুদ্ধের সংঘে, বুদ্ধ নিজে দুই বালকের এমন মিলনকথা শুনে তাদের কেবল পিতামাতার কাছে ফেরত পাঠিয়েছিলেন এবং ভিক্ষুদের একটির অধিক শ্রাবক রাখতে নিষেধ করেছিলেন। অতএব এটি লঘুপাপ। কিন্তু সমাজে বহুল প্রচলিত বিষয় বলেই, এবং কখনও কখনও দেবের কাম্য বলেও খাজুরাহো সহ বেশ কিছু মন্দিরের গায়ের ভাস্কর্যে আমরা সমকামের মিলনদৃশ্য খোদিত আছে দেখতে পাই। দেবের কাম্য কারণ, কথিত আছে, সমুদ্র মন্থনকালে বিষ্ণু এক মোহিনী নারীর রূপ ধরে উঠে আসেন। আর শিব তাই দেখে এমন আকৃষ্ট হয়ে পড়েন যে দুজনের মিলন ঘটে। তা থেকে আয়াপ্পা নামের পুত্র জন্ম নেয়। কাহিনীর আড়ালে কি এজাতীয় যৌনমিলনকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়াস? দেবতা স্বয়ং যখন আকৃষ্ট হন তখন কুতো মানব!
অথচ এই ভারতবর্ষের এমন ঐতিহ্যের অধিকারী আমরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে আইনের ৩৭৭ ধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছি। ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছি দুটি প্রেমাসক্ত মানুষের জন্য। সমাজ তো তাদের পরিত্যাগ করেই, নিজের ঘরে পরিবারেও তারা ব্রাত্য। কখনও চিকিৎসার নামে, কখনও স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ফিরিয়ে দেবার নামে অকথ্য অত্যাচার চলে। সমকামী বোনের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলার তাগিদে নিজের দাদা তার বন্ধুদের দিয়ে বোনকে ধর্ষণ করায়, খবরে দেখেছি। বেশ কিছু চিকিৎসক আধুনিক বিজ্ঞানে শিক্ষিত হয়েও মনে করেন সমকাম একধরণের বিকৃতি। কেন এরকম মনে করেন? মনে করেন কারণ, পিতৃতন্ত্রের বদ্ধমুল ধারনাই হলো, নারী পুত্রের জন্ম দেয়। সেই পুত্র আসে পুরুষের বীজ থেকে। সুতরাং যে মিলন পুত্রার্থে নয় তা অপবিত্র। এখানে ধর্মের সীলমোহর লাগিয়ে দেওয়া হয়। কে না জানে সব ধরমেই দৈহিক আনন্দ পাওয়ার জন্য মিলনকে অপরাধ বলা হয়েছে! শুধু পুত্রার্থে মিলনকেই পবিত্র বলা হয়েছে। তা সে ধর্ম নব্য হিন্দুধর্মই হোক বা খৃষ্ট ধর্মই হোক বা ইসলাম হোক। তবু মনে রাখতে হবে উপনিবেশের প্রভুদের গোঁড়া ক্যাথলিক ধর্মই সবচেয়ে বেশি এর বিরোধিতা করেছে। আর এই বিখ্যাত আইনটি তাদেরই প্রচলন।
এবার দেখি প্রকৃতির ভাঁড়ার। প্রকৃতির রাজ্যে কোন কোন প্রাণী সমকামী আচরণ করে। এটি প্রয়োজনীয়। কারণ সৃষ্টি অব্যাহত রাখার জৈবিক তাগিদ তাদেরও কম নয়। দেখা যাচ্ছে, জিরাফ সিংহ কুকুর সহ, পাখিদের মধ্যে বহুল প্রচলিত এটি। হাতী বা গণ্ডার পর্যন্ত এমন আচরণে অভ্যস্ত। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন পেঙ্গুইন আফ্রিকান ডাক ইত্যাদি পাখিরা সমকামী আচরণ করে থাকে। বহু ক্ষেত্রে শুধু মাত্র সন্ততিজন্মের কারণে তারা স্ত্রী পাখিটির সঙ্গে মিলিত হয়। ডিম দেওয়া হয়ে গেলে তারা তাকে ছেড়ে অন্য পুরুষসঙ্গীকে গ্রহণ করে ও বাসা বাঁধে। সেখানেই ডিম ফুটে বের হওয়া ছানাদের বড় করে। তাহলে এটি প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়! এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রবৃত্তি। আর তার জন্য লজ্জার কিছুই নেই। ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই নারীসুলভ এবং পুরুষসুলভ গুনাগুণ ও চিহ্ন বর্তমান। কোনটি প্রকট থাকে তার ওপরেই নির্ভর করে সেই মানুষটির লিঙ্গপরিচয়। কখনও প্রকট গুণের সঙ্গে সঙ্গে দুএকটি প্রচ্ছন্ন গুণ ভেসে ওঠে। তখনই মানুষটি নিজের যৌনচেতনা নিয়ে বিহ্বল হয়। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি বিশয়কে তাই অকারণে জটিল করা হয়েছে এতকাল।
এই সামাজিক ও পারিবারিক চাপের ফলে আমরা সেভাবে সমকামী মানুষের অস্তিত্ব টেরই পাইনা। কখনও, যখন তার পক্ষে নিজের পরিচয় গোপন করে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছেনা তখনই আমরা জানতে পারি, এই মানুষটি সমকামী। তাই এভাবে সামগ্রিক চিত্র আঁকা অসম্ভব বটে, তবে আমি যে তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সমাজের একজন, তার দুটি খণ্ডচিত্র হাজির করি।
সে কেন জলের মতো একা একা ঘুরে ঘুরে কথা কয়?এক নির্জনতার কবি এরকমই একটি লাইন লিখেছিলেন মনে পড়ে। একা কৈশোর যখন নিজের সঙ্গে নিজে একা কথা বলে। আত্মমগ্ন বিষাদে কাল কাটায় তখন আমরা যে নির্দিষ্ট ছাঁচে তাকে ফেলি, তা হলো অন্তর্মুখ স্বভাব। সে একা থাকতে ভালোবাসে। মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালবাসেনা। নিজেকে নিয়ে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই একা কিশোর বা কিশোরী হয়ত নিজেকে নিয়ে শঙ্কিত। কি একটা সে আবিষ্কার করে ফেলেছে যা পরিচিত গণ্ডীতে নজরে পরেনা। এমন এক আলোছায়ার মধ্যে সে বাঁচছে যে সে কথা খুলে কাউকেই বলা যায়না।
এই গল্প কিছুকাল আগের। এই ধরা যাক পঁচিশ বছর আগের। তখনও পৃথিবী একটি মাত্র গ্রামে পরিণত হয়নি। তখনও বিদেশের সংবাদ পেতে টেলিভিশন এবং খবরের কাগজই ভরসা। বিদেশী সাহিত্যের আনাচে কানাচে পৌঁছে যাওয়াও সহজ ছিলোনা। সেই সময়ের কথা। এক কিশোরী, যার পরিবার মধ্যবিত্ত আর পাঁচটা পরিবারেরই মতন। যার বড় হবার পর সৎপাত্রে পাত্রস্থ হওয়াই একমাত্র গতি ছিল। বিয়ে যথাসময়ে হলো। কলেজ স্কুলে কখনও ছেলেদের সঙ্গে সেইভাবে না মেশার ফলে প্রেম করে সে বাবা মায়ের অস্বস্তি তৈরি করেনি বলে পরিচিত মহলে বেশ সুনাম ছিল। আহা, কি ভালো মেয়ে। কারোর দিকে চোখ তুলে তাকায়না। স্বভাবটাও কি ভালো। বাচাল নয়। শান্ত চুপচাপ। এমন মেয়ের পাত্র জুটতে দেরি হয়নি। তার বিয়ের পর সে যথানিয়মে মা হলো। কিন্তু আপাতসুখের আড়ালে তার ক্রমশ ম্রিয়মাণ ক্লান্ত চেহারা দেখে আত্মীয়রা অবাক হয়েছে। ‘কেন রে? তুই এমন হয়েছিস কেন? কেমন সুন্দর স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার!’ তরুণী তো নম্র চাপা। সে ম্লান হেসেছে। মেয়েকে এরকম শুকিয়ে যেতে দেখে তার আলোকপ্রাপ্তা অধ্যাপিকা মা তাকে কাছে বসিয়ে অন্তরঙ্গ জীবনের খেদ নিয়েও প্রশ্ন করেছেন। এবং জেনেছেন স্বামীটি অত্যন্ত ভদ্র। তার দিক থেকে কোনও নিরানন্দের কারণ ঘটেনি। তবে? তিনি তাকে কাছে এনে রেখেছেন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চেয়েছেন দুঃখ কেন। তার একা ঘরে তাকে তো যন্ত্রণা দেবার কেউ নেই? অবশেষে আদরে নরম হয়ে মেয়েটি বলেছে তার যন্ত্রণার কথা। স্বামী সংসর্গ তার ভালো লাগেনা। পুরুষের সঙ্গে দৈহিক সংসর্গে তার বিরক্তি জাগে। জন্ত্রনা হয়। দিনের পর দিন বছরের পর বছর এরকম যন্ত্রণা সে সহ্য করে চলেছে। বলা বাহুল্য স্বামীটি তার এসব কিছুই জানেনা। সে ছেলে নিজেও তো বোঝেনা। সে ভেবেই নিয়েছে তার স্ত্রী হয়ত তত আগ্রহী নয়। শরীর ভালবাসেনা। কখনও ঠাট্টা করে বলেছে- দেখো সন্ন্যাসী হয়ে যেওনা। মেয়েটিও যে তাকে ভালোবাসেনি তা নয়। এ সংসারে ভালোবাসা আছে, প্রেম নেই। অগত্যা মা তাকে মনোবিদের কাছে নিয়ে গেলেন। এমন স্বামী তার! অথচ তাকে ভালো লাগেনা? অন্য কাউকে ভালোবেসে থাক্লেও তো কথা ছিল! এমন বৈরাগ্য কেন? সেই প্রথম মেয়েটি বন্ধু পেলো। মনোবিদের কাছে সে নিজেকে মেলে ধরল। তিনি তাকে চিকিৎসা করেছিলেন মুলত দুটি কারণে। প্রথম, তার বাস্তব পরিস্থিতি সহনীয় করতে। দ্বিতীয়, মেয়েটি যাতে তার ব্যক্তিগত প্রবৃত্তিকে মেনে নিতে পারে, নিজেকেই ঘেন্না না করে, সেই কারণে। নানা আলোচনার মধ্যে থেকে মনোবিদ বুঝেছিলেন সে চিরকাল সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছে। আর সেই কারণে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। তার ওপরে নিত্যকার দাম্পত্যের যন্ত্রণা মুখ বন্ধ করে সহ্য করে এসেছে এতকাল। চিকিৎসায় উপকার হয়েছিল। মেয়েটি নিজের দিকে তাকিয়ে আর ঘেন্না করেনি। মনোবিদের নিভৃত ঘরের বাইরে আমরা গুটিকয় ভাইবোন তার এই কষ্টের কথা জেনেছিলাম। কিন্তু এতকাল পর, তার কষ্টের কথা ভেবেই কোনোদিন তাকে প্রশ্ন করতে পারিনি যে কে সেই মেয়ে যার প্রেমে সেই কিশোরী প্রথম ডুবেছিল। তবে তার পারিবারিক পরিস্থিতি অন্য অনেকের চেয়ে অনুকুল ছিল। সেও নিজেকে বিষাদ থেকে বের করে আনতে পেরেছিল। মনোবিদের পরামর্শে সে সৃষ্টিশীল কাজে জড়িয়েছিল। কারণ, তখন তার আর সেই নিরাপদ সাংসারিক পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব ছিলোনা। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও তো আমাদের মানসিক বিকাশে প্রয়োজন!
এসময়ের একটি ঘটনা বলি। এক চিত্রশিল্পী বাবা মায়ের আদরের সন্তান। ছেলেটিও প্রতিভাবান। মেধাবী। ভারী মিষ্টি চেহারার ছেলে সে। মায়ের সঙ্গেই বেশি ভাব তার। সুন্দরী মায়ের সাজের সময় সে মুগ্ধ হয়ে মাকে দেখত। মা কখনও হেসে একটা টিপ পরিয়ে দিয়েছেন। সেই ছেলেটি বড় হবার সময়ে তার বন্ধুবৃত্তের মধ্যেই একজনকে ভালোবেসে ফেলে। এখন দিন বদলেছে। নিজের ভালো লাগা বা ভালোবাসার কথা বলতে ইতস্তত করার কিছু নেই। এই ছেলেটিও চুপচাপ। বন্ধুবৃত্তটি ছোট। তাই তার ভালোলাগার কথাটি ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলনা। বন্ধুদের একজন তার মনের কথাটি সেই ভালোবাসার পাত্রটিকে জানিয়ে দিলো। কিন্তু বিপদ অন্যভাবে দেখা দিলো। ভালোবাসার পাত্রটি হতবাক হয়ে গেলো। সে স্বপ্নেও ভাবেনি যে কোনও ছেলে তাকে প্রেম নিবেদন করতে পারে। সে কি তবে যথেষ্ট পুরুষালি নয়? প্রত্যাখ্যানের পর সে স্বাভাবিক ভাবেই সেই কিশোরের সঙ্গ এড়িয়ে চলতে লাগল। সমানে অনুরোধ, কান্নাকাটি, দেখাকরার আবদার চললেও সে ছেলে পাত্তা দিলনা। সে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো, তাকে বন্ধু হিসেবেই দেখেছে এতকাল। সে একটি মেয়েকে ভালোবাসে। তাকে নয়। এরপর বন্ধুদের মধ্যে সবাই যে তার প্রতি সহানুভূতিশীল রইল তা নয়। অনেকেই আড়ালে বলতে লাগল- ও যে এরকম তা তো জানতাম না? হাসিঠাট্টা তির্যক মন্তব্য শুরু হয়ে গেলো। এই ছেলেটি শেষ পর্যন্ত অন্য স্কুলে ভর্তি হলো। মনোবিদের কাছেও গেল মায়ের হাত ধরে। মা সেখানে বললেন- ও ছোট থেকে আমার শাড়ি নিয়ে খেলতে ভালবাসত। কিন্তু ভেবেছিলাম মনের মধ্যে হয়ত একটা মেয়েও বাস করে। এমন তো কতই হয়। মেয়েলি পুরুষেরা দারুন ভালো মনের হয়। মনোবিদ খুব খুশি হয়েছিলেন। মা নিজে শিল্পী বলেই হয়ত এতটা ভাবতে পেরেছিলেন। ছেলেটিকে তিনি বুঝিয়েছিলেন, একজন নিশ্চয় আছে যে তাকে ভালবাসবে। তার সেই সঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
এই দুটি ঘটনা বলে দিচ্ছে আপাত স্বাভাবিক জীবন যাপনের অন্তরালে প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে কিছু কিছু এমন বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। আর ঘটনা দুটির মধ্যে পার্থক্য এই, যে সমাজ এখন এই তৃতীয় চেতনাটিকে মান্যতা দিচ্ছে। তাই বা কম কি? এই মানুষগুলো আমাদেরই প্রিয়জন। এদের জন্য আরও অনেক ভালোবাসা প্রয়োজন। ঠিক যেমন দেখতে পাচ্ছি মিস ট্রান্সজেন্ডার ইন্ডিয়া অ্যানি দত্ত চক্রবর্তী একজন প্রেমিক স্বামী পেয়েছেন। পরিবারের সহানুভূতি পেয়েছেন। তাঁর মতো স্বপ্নের জীবন যদি সবার হয় তার চেষ্টাই করা উচিত। নিছক একটা বিরুদ্ধ মিথ্যে ধারণার বশবর্তী হয়ে সহদেশবাসী বা পৃথিবীবাসীকে বিষাদে ঠেলে দেওয়া অপরাধ।
[শারদীয়া আত্মজা ২০১৯]