প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সেবিকা ধর
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধসনাতনী পুরাণ মতে- হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী দশম মহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা হচ্ছেন কালী বা কালিকা।এই কালীকে নিয়ে সারা ভারতবর্ষে যে উন্মাদনা তৈরি হয় তার পূজাকে কেন্দ্র করে বাঙালির যে আবেগ তা অনেকটাই কালী কেন্দ্রিক আসলে বাঙালি মাতৃসুখী জাতি।ফলে এখানে বৈষ্ণবী ধর্ম, শৈব ধর্ম এই যে বড় দুটি ধর্ম তার পাশাপাশি শাক্ত চিন্তার ও একটা বিপুল বিকাশ হয়েছে সমস্ত বঙ্গভুলি জুড়ে।সাধক কবি রঞ্জন রামপ্রসাদ সেন তাঁর আশ্চর্য সব পদগুলি তার সঙ্গে রাজা রামকৃষ্ণের লেখা পদ,এরা সকলেই শাক্তপদাবলীর সাধনা করেছেন।তাদের মধ্যে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সাধক প্রবণ বামাক্ষেপা রাজা রামকৃষ্ণ, কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ অত্যন্ত বিখ্যাত। রামপ্রসাদের হালিশহর মন্দির, শ্রীরামকৃষ্ণের দক্ষিণেশ্বরের সাধনভূমি, বামাক্ষেপার তারাপীঠ, রাজা রামকৃষ্ণের পঞ্চবটি আসন সবই বাঙালি জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে।এছাড়াও আছেন অনেক বড় বড় সাধক।যারা কালী সাধনা করেছেন।কালীকে ভেবেছেন মুক্তির আলয়।এই যে সাধন প্রণালী, সাধন পদ্ধতি যা কৃষ্ণানন্দ আনন্দবাগীশ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বাঙালি জীবনে এই যে দীপান্বিতা উৎসব বা দীপাবলি তার সঙ্গে শ্যামাকালী পূজার একটা অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে এবং জড়িয়ে গেছে বহু বছর ধরে।পাশাপাশি ফলহারিনী কালীপূজো এবং রটন্তী কালীপূজো এটিও বাঙালি জীবনে অত্যন্ত বড় উৎসব বলে দিনে দিনে পরিগনিত হয়েছে।ফলহারিনী কালীপূজো রামকৃষ্ণ দেব করেছিলেন।রটন্তী কালীপূজোও হয় বাঙালির জীবনের অঙ্গে হিসেবে।এবং পূর্ববঙ্গে যারা বাঙালি ছিলেন হিন্দু বাঙালিরা যেকোনো শুভ কাজে একটি কালী পূজা দিতেন।এবং সেই কালীপূজা বিবাহ উপলক্ষে হতে পারে,অন্নপ্রাশন উপলক্ষে হতে পারে,উপনয়ন হিসেবে হতে পারে,চূড়াকরণ উপলক্ষে হতে পারে।যেকোনো শুভ কাজে কালী পূজা অবধারিত। ফলে বাঙালি জীবনে কালীর মহিমা এবং বৈভব তার আধ্যাত্মিক চেতনা তা নাস্তিকের কাছে গ্রহণ যোগ্য নয় কিন্তু আস্তিকের কাছে তিনি কালী পূজাকে সর্বাগ্রে সমস্ত জায়গায় প্রচারের কাজে সহায়তা করেন।পাশাপাশি বাঙালি যেখানে গেছেন তা এলাহাবাদ হোক আর কাশীই হোক সেখানে একটি কালী মন্দির বানিয়েছেন।এবং সেই কালী মন্দিরকে কেন্দ্র করে নানা রকম কর্মকাণ্ড আজও চলে।ফলে কালী বাঙালি জীবনের এক অঙ্গ হিসেবে বাঙালি বিশ্বাসী জনের জীবনে অন্যতম উৎসব।
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। পয়লা বৈশাখে গণেশপুজো-হালখাতা দিয়ে সূচনা আর চৈত্র সংক্রান্তির গাজনে সমাপ্তি। সেই অনুসারে সারা বছরেই নানা পুজো-পার্বণ থাকলেও বাংলার প্রকৃত উৎসবের মরশুম আরম্ভ হয় দুর্গাপুজো দিয়ে আর শেষ কালীপুজোতে। তিথি নক্ষত্রের হিসেবে আশ্বিন-অমাবস্যা (মহালয়া) থেকে কার্তিক-অমাবস্যা (কালীপুজো)— এই এক মাস কাল হল বাংলার প্রধান উৎসবের মরশুম। দুর্গাপুজো শেষ হলে আসে লক্ষ্মীপুজো এবং তার পরে কালীপুজো তথা দীপাবলি।
দীপাবলি আদতে আলোর উৎসব। বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের মধ্যেই এক ধরনের আলোক উৎসবের কথা বলা আছে। তারই একটি হল হিন্দু তথা ভারতীয় সংস্করণ, দীপাবলি।
এই উৎসবে পুজোর থেকেও বেশি উল্লেখযোগ্য হল দীপমালার সজ্জা। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতীয় সংস্কৃতির নানা কাহিনি, যেগুলির সঙ্গে কালীর থেকেও বেশি সম্পর্ক লক্ষ্মীর।
প্রচলিত বিশ্বাস হল— কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতেই সমুদ্র থেকে ধন্বন্তরী উঠে এসেছিলেন। তাই এই তিথির নাম ধন্বন্তরি ত্রয়োদশী বা সহজ কথায় ধনতেরাস। সে জন্য এই দিন ধনের উপাসনা করতে হয় আর ওই দিন একই সঙ্গে দেবী লক্ষ্মীও সমুদ্র থেকে উঠে আসেন বলে লক্ষ্মীর আরাধনাও করা হয়। লক্ষ্মী পুরাণ অনুযায়ী স্বর্গে ফিরে গেলেন, কার্তিক-অমাবস্যায়। তাই লক্ষ্মীর স্বর্গে ফেরা উপলক্ষে স্বর্গকে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল আলোকমালায়। আর একটি কাহিনি অনুসারে, লঙ্কা বিজয় সেরে সীতা ও লক্ষ্মণকে নিয়ে রামচন্দ্র যে দিন অযোধ্যায় ফেরেন, তিথি হিসেবে সেটি ছিল ওই কার্তিক-অমাবস্যা। ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামের লীলাসঙ্গিনী লক্ষ্মীদেবীকে বরণ করে নেওয়ার জন্য সেই রাতে অযোধ্যা নগরীকে সাজানো হয়েছিল অগণ্য দীপমালায়। অন্য এক কাহিনি আবার বলে, কার্তিক-চতুর্দশীতে কৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করে তার কারাগারে বন্দি ১৬ হাজার গোপিনীকে মুক্ত করেন। সেই উপলক্ষে, পরের দিন অর্থাৎ কার্তিক-অমাবস্যাতে আলোকমালা সাজিয়ে উটহ হয়েছিল। দীপাবলিতে দীপ জ্বালানো নিয়ে এমন হরেক কাহিনি প্রচলিত আছে হিন্দু পুরাণ-শাস্ত্রগুলিতে।
শৈব (শিবের উপাসক), বৈষ্ণব (বিষ্ণুর উপাসক), শাক্ত (শক্তির উপাসক), গাণপত (গণেশের উপাসক), সৌর্য (সূর্যের উপাসক)— ভারতীয় হিন্দু ধর্মের এই পাঁচ উপ-বিভাগের অন্যতম শাক্তদের প্রাধান্য পূর্ব ভারতেই বেশি। প্রাচীন কাল থেকেই বাংলায় এই ধারা চলে আসছে। বাংলার উৎসবের মরশুমে এই শক্তি আরাধনাই হয় দুর্গা ও কালীপুজোর মধ্যে দিয়ে। কিন্তু মধ্যযুগে চৈতন্যদেব প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাবধারার প্রাধান্যও লক্ষ্য করা যায় বাংলার শক্তি আরাধনার ক্ষেত্রে। দেবীপক্ষের শেষ দিন অর্থাৎ আশ্বিনের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমায় হয় কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। আর তার পনেরো দিন পরে কার্তিক-অমাবস্যায় দীপাবলীর দিন হয় কালীপুজো। হিন্দু পুরাণ-শাস্ত্র অনুসারে দেবী কালিকা দুর্গারই আর এক রূপ। শক্তির উপাসকেরা দীপাবলীর দিন কালীপুজো করেন আর সে দিন সারা ভারত জুড়ে বিষ্ণুর উপাসকেরা আরাধনা করেন মহালক্ষ্মীর। বঙ্গদেশেও তার ব্যতিক্রম হয় না। কালীপুজোর রাতে দীপান্বিতায় অলক্ষ্মী বিদায় ও মহালক্ষ্মীর পুজো দিয়ে সূচনা হয় পশ্চিমবঙ্গীয়দের কার্তিক, পৌষ, চৈত্র ও ভাদ্র মাসের লক্ষ্মী পুজোর। এমনকী বাংলার অন্যতম প্রাচীন শক্তিপীঠ মহাতীর্থ কালীঘাট মন্দিরে এই কার্তিক-অমাবস্যায় দীপান্বিতা মহালক্ষ্মীর পুজো করেন হালদার বংশীয় সেবাইতরা। এর কারণ জানতে গেলে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে অতীতের দিকে।
অমাবস্যা তিথি থাকলে কালীপুজোর দিন সূর্যাস্তের ২৪ মিনিটের মধ্যে আরম্ভ হয় লক্ষ্মীপুজো। তার আগে অবশ্য সেরে নেওয়া হয় অলক্ষ্মী বিতাড়ন পর্ব। তিন বা চার ইঞ্চি মাপের অলক্ষ্মী পুতুল তৈরি করা হয় গোবর বা জলে চটকানো পিটুলি (চালবাটা) দিয়ে। সেটিকে রাখা হয় মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরে। এ বার অলক্ষ্মী পুতুলের সামনে পাটকাঠিতে আগুন লাগিয়ে সেবাইতরা তিন বার মন্দির প্রদক্ষিণ করেন। আর জোরে জোরে কুলো বাজিয়ে অলক্ষ্মী বিদায় করে আরম্ভ হয় লক্ষ্মীপুজো। এটি যেহেতু সেবাইতদের পুজো তাই নিরামিষ ভোগ আসে সেবাইতদের বাড়ি থেকেই। সেগুলি রাখা হয় কালীমূর্তির সামনেই। আবার কালীর যে হেতু আমিষ ভোগ, সেখানে মাছ-মাংসও থাকে, সেগুলিও রাখা হয় তার পাশেই, তবে লক্ষ্য রাখা হয় যেন আমিষ ও নিরামিষ ভোগ ছোঁয়াছুঁয়ি না হয়। ভোগ ছাড়াও সেবাইতরা দেন তাঁতের শাড়ি। সেগুলি কালীর অঙ্গেই পরানো হয়। ভোগ-বসন সাজানোর পরে পুরোহিত পুজো শুরু করেন। প্রায় তিন-সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে হয় কালীপুজোর সন্ধ্যার ওই দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো।
হিন্দু পুরাণ-শাস্ত্র অনুসারে লক্ষ্মী ধন-সম্পদ-সৌভাগ্যের দেবী। তাই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে লক্ষ্মীপুজোর আলাদা এক গুরুত্ব আছে। বাঙালিরাও তার ব্যতিক্রম নয়। বাঙালির ঘরে সোমবচ্ছর উপাচার, নৈবেদ্যর বাহুল্য ছাড়াই লক্ষ্মীর উপাসনা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেখানে পুরোহিতেরও প্রয়োজন হয় না। সামান্য ফল-ফুল আর পাঁচালি-ব্রতকথা দিয়েই সারা হয় বাঙালি গৃহবধূর লক্ষ্মী-আরাধনা। অনেক বনেদি বাড়িতে এখনও কালীপুজোর সন্ধ্যায় দীপান্বিতা লক্ষ্মীর পুজো হয় নিয়ম মেনে।
কালিকাপুরাণের ছাব্বিশতম অধ্যায়ে কামাক্ষার বর্ণনা রয়েছে। পূর্বে এই পর্বতের উচ্চতা ছিল শতেক যোজন। কিন্তু মহামায়া সতীর যোনি অঙ্গ পতিত হওয়ার পর এই উচ্চ পর্বত মহামায়র যোনি মন্ডলের ভার সহ্যে করতে না পেরে কেঁপে উঠলো এবং ক্রমশঃ পাতালে প্রবেশ করতে লাগলো। তখন শিব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু প্রত্যেকে একটা করে শৃঙ্গ ধারন করলেন। তাদের সঙ্গে মহামায়া স্বয়ং সমবেত হলেন।
কামরূপ কামাক্ষা মন্দিরের দেওয়ালে পাথরে খোদাই বিভিন্ন ভঙ্গিমায় কামের বিভিন্ন সূত্রের মূর্তিই এর দৃষ্টান্ত।তান্ত্রিকরা কামদেবের সাধন ভোজনে কাম কলার তন্ত্রে মন্ত্রে দীক্ষীত হোন ও আশির্বাদ প্রাপ্ত হোন। এই সময় এরা সম্পূর্ন নগ্ন হয়ে মন্দিরে অবস্থান করেন। ভক্ত নারী ও পুরুষ তাঁদের নিজ হাতে আহার করিয়ে থাকেন।তখন তাঁদের জীবন্ত লিঙ্গেরও পূজা হয়ে থাকে।তাঁদের ঘিরে কীর্তন হয় ও মন্ত্র পাঠ হয়।তান্ত্রিকরা দিগম্বর অবস্থাতেই সমস্ত উত্সব কাল মন্দিরের বাইরের সমস্ত জায়গায় ঘুরে ফিরেন।বিভিন্ন বাসনা নিয়ে আসা কিছু নারী তাঁদের কৃপা ও আশির্বাদ লাভের আশায় এই সকল তান্ত্রিকদের সাথে সহবাসে লিপ্ত হন।পুরুষ তান্ত্রিকদের পাশা পাশি অনেক নারী তান্ত্রিকদেরও দেখা যায়।পুরুষদের ন্যায় তাদেরও অবাধ নগ্ন বিচরন।পুরুষ ভক্তরা ঐ সকল দিব্যতা অর্জনকারী নারীদের যৌন সুখে তৃপ্ত করতে পারলে তাঁরা সেই সকল পুরুষ ভক্তদের তন্ত্রে মন্ত্রে দীক্ষিত করে তুলতেন।তবে এখন আর আগের মত তাঁদের প্রকাশ্য জনসম্মুখ্যে দেখা যায় না। কথিত আছে ভারতের এক সময়ের বিখ্যাত অভিনেত্রী পারভিন ববী কামরূপ কামাখ্যায় তন্ত্র মন্ত্রে দীক্ষীত হয়ে তান্ত্রিক বিদ্যা অর্জন করেছিলেন।পরবর্তীতে তিনি অবশ্য মানসিকক স্থিতি ধরে রাখতে পারেন নাই। সাম্প্রতিক কালের যোনী পূজা : উত্সবের প্রধান আকর্ষণ যোনী পূজা।পূজাটি সম্পুন্ন করেন একজন পুরোহিত।এই সময়ে একজন নারীকে সম্পুর্ণ নগ্ন অবস্থায় দেবীর শক্তি পিঠের উপর দুই পাশে দুই পা দিয়ে শক্তি পিঠের যোনী মূল নারীটির যোনী বরাবর স্থির রেখে দুই হাত হাটুর উপর রেখে বসানো হয়।এই সময় পুরোহিত পবিত্র জলে নারীর বিভিন্ন অঙ্গ মন্ত্র পাঠে ধৌত করে দেন।
পুরোহিত তাঁর ডান হাতে বৃদ্ধা ও কনিষ্ঠা আঙ্গুলী ভাজ করে পরবর্তী তিন আঙ্গুল দন্ডায়মান রেখে নারীর যৌনাঙ্গ মন্ত্র পাঠে মৈথুন করেন যতক্ষন না নারীর কাম রস বের হয়ে আসে।কাম রস শক্তি পিঠে পতিত হলে নারী দেহ নিস্তেজ হয় ও দেহ পবিত্রতা লাভ করে।নারী মা কামাখ্যাকে মনে মনে আবাহন করেন।নারীর পবিত্র দেহে তখন মা কামাখ্যা আবর্তিত হয়েছে এক অনন্ত স্ববিরোধিতার দেশ আমাদের। এই দেশে কুমারীপূজার পাশেই চলে নাবালিকা ও অশীতিপরের ধর্ষণ, শবরীমালার মন্দিরে ঋতুসম্ভব নারীর বিরুদ্ধে তাণ্ডবের বিপরীতে কামাখ্যার মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় দেবীর ঋতু-উৎসব। আজ দেশ জুড়ে নারীশক্তির আরাধনার আড়ালেও হয়তো পুনরাবৃত্ত হবে কোনও ভয়াবহ নারকীয়তা। হয়তো, সেই অপকীর্তিতে অভিযুক্ত হবেন দেবতারূপী কোনো পুরুষ। তবু, করালবদনী কালীর আধারে মানুষের তিমিরবিনাশের প্রার্থনা তো কোনওভাবেই অবহেলার নয়।
আমাদের মনে পড়ে, পিতৃতান্ত্রিক বৈদিক সংস্কৃতিতে নারীর অবস্থান ছিল প্রায়-অপ্রাসঙ্গিক। বৈদিক দেবীরা ছিলেন কেবল দেবতাদের স্ত্রীবিশেষ। প্রাচীনতর বৈষ্ণব ও শৈবধর্মে লক্ষ্মী বা পার্বতী নিছক বিষ্ণু ও শিবের শক্তিপ্রকাশক প্রতিভাস। প্রকৃতপক্ষে, মধ্যযুগীয় পুরাণ থেকেই স্বতন্ত্র দেবীভাবনার উদ্ভব ও বিকাশ। সেই পৌরাণিক আখ্যানের প্রধান সূত্র ছিল মার্কণ্ডেয়-রচিত ‘দেবীমাহাত্ম্যম’ গ্রন্থটি, যা সাধারণভাবে ‘চণ্ডীপুরাণ’ নামেও খ্যাত। দেবী দুর্গার মহিষাসুরবধের কাহিনিই এই গ্রন্থের প্রতিপাদ্য। দেবভিত্তিক হিন্দুধর্মে সেই প্রথম দেবীসত্তার স্বীকৃতি। তবু, সেই দেবী-প্রকল্পনায়ও দেবতাদের প্রভাব অপরিসীম। কেননা, অসুরবধে দেবীর সমস্ত প্রহরণগুলিই দিয়েছিল দেবতারা। ফলত, দুর্গাশক্তিও অনেকটাই পিতৃতন্ত্রেরই প্রতিভূ।
ষষ্ঠ-শতকে শাক্তধর্মই প্রথম পিতৃতন্ত্রের অধীনতা থেকে মুক্ত হল। শক্তির আধার হয়ে উঠল নারী, তিনিই পরব্রহ্ম, এক ও অদ্বিতীয়। দেবমণ্ডলীতে সেই পরম নারীশক্তির প্রকাশ পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে এক নতুন পরিসরের সূচনা করল। প্রসারিত সেই ধর্মক্ষেত্র হয়ে উঠল শূদ্রেরও আশ্রয়স্থল। তবে, নারীসত্তাবিশ্বাসী শাক্তধর্ম কোনওভাবেই পুরুষ বা জড়সত্তাকে অস্বীকার করেনি। কেননা, দেবীশক্তির সঙ্গে শিবশক্তির মিলনেই কেবল সৃষ্টি-স্থিতি-লয় সম্ভব। প্রকৃতি-পুরুষের এই যুগপৎ সক্রিয়-নিষ্ক্রিয় কল্পনাই রূপ পেয়েছে সপ্তদশ-শতকে নবদ্বীপের বাঙালি-ধর্মবেত্তা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের সৃষ্ট কালীমূর্তিতে। দেবীর এই শক্তিরূপই আবার দশমহাবিদ্যার আধারে আরও-বিকশিত। উপমহাদেশ জুড়ে সতীর একান্নপীঠের মাধ্যমে নারীশক্তির সেই রূপ সুবিস্তৃত হয়েছে। একান্নপীঠের অন্যতম কামাখ্যাপীঠ হয়ে উঠেছে স্ত্রীশক্তির অকল্পনীয় বিস্ফার। কার্তিকের অমানিশায় সেই কামাখ্যা দেবীই যেন শ্যামারূপে আমাদের দেখায় সেই অনির্বচনীয় স্ত্রী-শক্তির ভিন্নতর মহিমা। আজ তিমিরবিনাশিনীর আরাধনা আসলে সবরকম অসুরদমন ও অন্যায়েরই বিরুদ্ধাচারণ।
প্রতিটি সতীপীঠেই স্ত্রী-শক্তি ভৈরবী, পুরুষশক্তি ভৈরবরূপী শিব, সে সতীর অতন্দ্র প্রহরী। একান্নপীঠে দেবীর যেমন ভিন্ন-নাম, তেমন ভৈরবেরও। কামরূপে কামাখ্যারূপী সতীর ভৈরব উমানন্দ। উমার আনন্দরূপী সেই শিব আসলেই উমার যৌনানন্দের প্রতীক। ‘কামাখ্যা’ নামটির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে জীব ও শিবের তূরীয় আনন্দ-আধার। বলা যায়, যোনিরূপিণী কামাখ্যাই জীবের কামদেবী। সে-কারণেই আষাঢ়-মাসে অম্বুবাচী-তিথিতে তাঁর রজোকালের কল্পনা করেছে মানুষ। সাধারণভাবে অম্বুবাচী বৈধব্যের কৃচ্ছ্রসাধনকাল হলেও, কামাখ্যার বাৎসরিক ঋতুকাল বিপরীতভাবে হয়ে ওঠে নারীর উর্বরাশক্তিরই মহিমাকাল, উৎসবমুখর। নারীর ঋতুবন্দনার এমন দৃষ্টান্ত আধুনিককালেও আধুনিকতর। ‘কালিকাপুরাণ’ বলে, কামাখ্যায় দেবী পরিপূর্ণভাবে কামদা, কামিনী, কামা, কামাঙ্গদায়িনী ও কামাঙ্গনাশিনী হওয়ায় তিনি কামাখ্যা, কামাখ্যাতা। কামাখ্যায় দেবীর যোনিরূপ প্রতীকপ্রতিমা ছাড়াও রয়েছে নারীশক্তির বিভিন্ন প্রকাশরূপ কামাখ্যা, কামেশ্বরী, ত্রিপুরেশ্বরী, সারদা, মহোৎসহার বিগ্রহ। দেবীর যোগিনীশক্তিরূপ কটীশ্বরী, গুপ্তকাশী, শ্রীকামা, বিন্ধ্যবাসিনী, পাদদুর্গা, দীর্ঘেশ্বরী, ধনস্থা ও প্রজটাও এখানে সমমহিমায় বিরাজমান। নীলাচলপর্বতেই রয়েছে দশমহাবিদ্যা কালী, তারা, ষোড়শী, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলাকামিনীর মন্দির। সব মিলিয়ে নারীশক্তির এ এক পরম উৎসার। সে-কারণেই কামরূপকামাখ্যা তান্ত্রিক ভৈরব-ভৈরবীদের মহাপীঠস্থান। যোনিরূপ কামাখ্যার বিবরমুখ সততসিক্ত। দেবীর ঋতুকালে সেই বিবরে রজোস্রোত উৎসারিত হয়। ওই তিনদিন মন্দিরের গর্ভগৃহ রুদ্ধ থাকলেও, দেবীমেলা ঘিরে ভক্তেরা উদযাপন করে দেবীর উর্বরাশক্তির উৎসব। দেবীর অঙ্গসিক্ততা বা রক্তধারার প্রাকৃতিক কারণাকারণ নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়।
শাক্তধর্মের সঙ্গে কালক্রমে জুড়ে যায় তন্ত্রসাধনা। শক্তিতত্ত্বের এই পথটি আসলে প্রাতিষ্ঠানিক বৈদিক জীবনচর্যার সুস্পষ্ট বিরোধিতা। হিন্দুতন্ত্রের অনুসরণে দেশে একসময় বৌদ্ধতন্ত্রেরও প্রসার হয়েছিল। চর্যাপদের ডোম্বিনিও যেন বৌদ্ধতন্ত্রের অনুরূপ আরাধ্যা দেবী। হিন্দুতন্ত্রে মূলত দক্ষিণাচার ও বামাচারের বিধি রয়েছে। মূলগতভাবে দক্ষিণাচারীরা বেদমান্যপথে চললেও, বামাচারীরা চলে বেদবিরোধী পথে। বামাচারী-তন্ত্রসাধনার প্রধান-আধার নারী। সাধকের সঙ্গে সাধিকার মিলনে ষটচক্রভেদ হয়, সহস্রারে জাগ্রত হয় কুলকুণ্ডলিনী। এই যুগলসাধনার তন্ত্রধারাটি পরে বাংলার বাউলসাধনায়ও প্রবাহিত হয়েছে। বাউলসাধকের কাছে সঙ্গিনীর রজোকাল অতি-পবিত্র সাধনসময়, জীবনের সুসময়কাল। তখন নদীতে বান ডাকে, জোয়ার আসে, ভাসে সাধকের তরী। বাউল ব্যতীত আর-কেউ গানে-গানে ধরে রাখেনি নারীশক্তির সেই শরীরী প্রতীক।
ত্রিপুরায় পার্বতী ললিতা-ত্রিপুরাসুন্দরী-রূপী। দেবীর ভৈরব শিবশম্ভু এখানে কামেশ্বর-রূপে বিরাজমান। সমাজের প্রান্তিকস্তরের ভক্তরা সহস্রাক্ষী শ্রীবিদ্যাদেবীর আরাধনায় এই মন্দিরে বছরভর সমবেত হয়। তান্ত্রিকরা নারীকে মহাবিদ্যা-রূপে গণ্য করে। তাই দেবীপুরমে জাতপাত ও লিঙ্গভেদের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। বরং, পূজার সময় এই মন্দিরে নারীভক্তরা সরবে ঘোষণা করে থাকেন. ‘আমি দেবী, তুমি দেবী, আমরাই দেবী’। দেশের কোনও ধর্মক্ষেত্রেই নারীর এমন ঘোষিত-মহিমা দুর্লক্ষ।
ত্রিপুরায় সতীর একান্ন পীঠের সৃষ্টির পেছনে তাঁর দেহত্যাগের একটি কাহিনি রয়েছে।দক্ষযজ্ঞ ও সতীর কাহিনিটির প্রতি লক্ষ্য করলে দেখতে পাই এই কাহিনিটির মধ্যে শিব ও প্রকৃতি তত্ত্ব। তাই বলতে হয় সতী ছাড়া বা শক্তি ছাড়া পুরুষ অর্থহীন। কারণ শক্তি কখনও একা থাকতে পারেন না।কারণ তার গুণই হল প্রকৃতি। পুরুষ ও প্রকৃতির রহস্যময় এই স্বরূপ বুঝলে তবেই সতী কাহিনির সার্থকতা। ত্রিপুরার নাম আমরা প্রথম পাই কুব্জিকাতন্ত্রের ৪২টি সিদ্ধ।পীঠের তালিকায়। তন্ত্র চূড়ামণিতে একান্ন পীঠের তালিকায় রয়েছে সতী পীঠের তালিকায়।সুতরাং এবার আমরা বলতে পারি সবগুলো পীঠ একই সময়ে সৃষ্টি হয় নি।
ভারতচন্দ্রের লেখাতেই নয় পাঠ নির্ণয়ের যে দুটো পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে তাতেও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা। ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির ১৪২৩ শকাব্দে ধন্যমাণিক্য নির্মাণ করেছেন বলে কথিত আছে।১৯০৪ সালে "শিলালিপি সংগ্রহ" বই থেকে জানা যায় ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির একটি উচ্চ টিলার উপর অবস্থিত ছিল।মন্দিরের দ্বার পশ্চিম দিকে।উত্তরের দিকেও একটি ছোটো দরজা আছে।এই দরজাটি পরে তৈরি বলে মনে করা হয়।কারণ প্রাচীন মন্দিরে একটির বেশি দরজা প্রায়ই দেখা যায় না।মন্দিরের পশ্চিম দিকে একটি নাট মন্দির।নাট মন্দিরটি জীর্ণ।নতুনভাবে নির্মাণ কাজ চলছে।এর সামনে একটি ফলের বাগান।পশ্চিমে একটি দিঘি। নাম সুখসাগর।এই সুখসাগর ধন্যমাণিক্যের আমলে খনন করা।
মন্দিরের পূর্বদিকেও একটি দিঘি আছে,নাম কল্যাণ সাগর।ত্রিপুরা জেলার স্বাধীন হিন্দু রাজ্যের প্রাচীন পর্বতবেষ্টিত উদয়পুর ত্রিপুরেশ্বরী মহাপীঠক্ষেত্র পবিত্র তীর্থ।ত্রিপুরা সুন্দরীর মাহাত্ম ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এই তীর্থ অতুলনীয়। কবি নবীনচন্দ্র সেন মহাশয় রঙ্গমতীতে তার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন।
" নির্মিত কৌশলে কৃষ্ণ সিন্দর প্রস্তরে সুশীতল সমুজ্জ্বল। স্তম্ভ সারি খচিত বিচিত্র রূপে। পুষ্প লতিকায় স্বর্গীয় স্বভাব শোভা।ধরিয়াছে শিরে সুবিস্তৃত সুচিত্রিত,অর্দ্ধচন্দ্র সারি ক্রমে উর্ধে উচ্চতর।"
চন্দ্রনাথ মাহাত্ম নামক পুস্তকে লিখিত আছে - "সে সময়ে ত্রিপুরাধিপতি ধণ্যমানিক্য বাহাদুর ত্রিপুরেশ্বরীকে লইয়া যান।সেই সময় স্বয়ম্ভুনাথের মন্দিরের একাংশ অর্থাৎ যে প্রকোষ্ঠে স্বয়ম্ভুনাথ আছেন, সেই মন্দিরখানি নির্মিত হইয়াছে।সুতরাং ১৫০১ খ্রীস্টাব্দে এই মন্দির স্থাপিত হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয়।চন্দ্রনাথের তীর্থগুরু যতীন্দ্রবন মোহন্ত।চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত মহিষখালি নামক স্থানের প্রসিদ্ধ জমিদার সহ ত্রিপুরেশ্বরী দেবী দর্শনের জন্য যখন উদয়পুর গিয়াছিলেন তখন তাহাদের নিকট হইতে জানা গিয়াছিল,বর্তমান ত্রিপুরেশ্বরী বিগ্রহ চন্দ্রনাথ তীর্থ হইতে উদয়পুরে আনিত হইবার কিংবদন্তী চট্টলে প্রচলিত আছে।"
১৯৮১ খ্রীস্টাব্দে উদয়পুরের রাজনগর থেকে গণেশ চক্রবর্তী মহোদয়ের মহাতীর্থ কাহিনি থেকে জানা যায়- মহারাজ ধণ্যমানিক্য একটি জীর্ণ মন্দির সংস্কার করে সেখানে শ্রী শ্রী বিষ্ণু রাজ রাজেশ্বর শালগ্রাম শীলাকে স্থাপন করেছিলেন।সে সময় ত্রিপুরা সুন্দরী রাজাকে স্বপ্নে বললেন- স্বপ্নযোগে কহে চণ্ডী শুন শুন ধন্যরায়,চট্টল হতে ফিরে আনহ আমায়।মহারাজ তখন মাকে বলেন- আমি মন্দিরে বিষ্ণুকে স্থাপন করেছি,তোমার জন্য অন্য আরেকটি মন্দির করে তোমাকে অর্চনা করবো।কারণ মা তুমি মহাশক্তি, তান্ত্রিক পদ্ধতিতে তোমাকে পূজা দিতে হলে বলি দিতে হবে।এর পর মায়ের আশ্বাস পেয়ে ধণ্যমানিক্য মাকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করলেন।মায়ের দক্ষিণ পার্শ্বে যে রৌপ্য নির্মিত ত্রিশূল দেখা যায় তা ত্রিপুরার শেষ ও স্বাধীন মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর মহাপ্রয়াণের পূর্বে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ১১৫৬ ত্রিপুরাব্দে ১৬ বৈশাখ মাকে প্রদান করেছিলেন।ত্রিপুরার মাতা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির ও কল্যাণ সাগর নিয়ে অলৌকিক কাহিনি নিয়ে আজও নানা মত আজও প্রচলিত রয়েছে।দূর-দূরান্ত থেকে পূণ্যার্থীরা ছুটে আসেন মানসিক শান্তির জন্য। এখনো মানুষ বিশ্বাস করেন কল্যাণসাগরের মাছ ও কচ্ছপ মৃত্যুর সময় সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে উঠে তারপর মারা যায়।আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল মন্দিরে বাজনা বাজে উঠলেই মাছ ও কচ্ছপেরা দিঘির ঘাটে চলে আসে।হয়তোবা মা ত্রিপুরেশ্বরীর টানেই পূণ্যার্থীদের দৃষ্টির মধ্যে এই মাছ ও কচ্ছপেরা ঘাটে চলে আসে।তা- সত্বেও বলতে হয় বাজনার শব্দটা উপর থেকে এসে জলের মধ্যে আন্দোলিত হয় এবং মাছ পার্শ্বরেখা বরাবর ও কচ্ছপ খোলের নরম অংশ বরাবর এই কম্পন টের পায় এবং শব্দের দিকে ধাবিত হয়।ধর্ম ও বিজ্ঞান এখানে এক হয়ে গেছে বলেই কল্যাণ সাগর কল্যাণকর রূপ নিয়েই মানুষের পাশে বিরাজমান।
এবার আসা যাক আধুনিক নারী শক্তির আলোচনায়।লোকায়ত স্তরে স্ত্রীশক্তির এইসব মাহাত্ম্যই ধূলিসাৎ করতে চায় ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকদল। স্বৈরশাসকের কাছে যত-মত তত-পথ ঘোর-বিপজ্জনক। দেশের মানুষকে তারা একটি ছাঁচে ঢেলে খোপে পুরে ফেলতে চায়। সে-কারণেই এই সুপ্রাচীন সংস্কৃতির দেশে মানবীর ঋতুকালের মতো এক অনিবার্য শারীরক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে যায় আদালত, ধর্ম, রাজনীতি। অবশ্য, এমনই স্বাভাবিক। ইতিহাসের নিয়মেই যুগব্যাপী কুসংস্কারে একদিন যখন কেউ সামান্যতম নাড়া দেয়, তখনই চারদিক থেকে দাঁত-নখ বের করে তেড়ে আসে তমসাবৃত স্বার্থশক্তি। তা সে বিধবাবিবাহই হোক, সতীদাহই হোক বা সুপ্রিম কোর্টের যুগান্তকারী রায়ই হোক। প্রাক্তন-প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র কোনও বিদ্যাসাগর বা রামমোহন রায় নন, কিন্তু সাংবিধানিক পরিসরে তিনি ও তাঁর সতীর্থরা শবরীমালার মন্দিরে ঋতুসম্ভব নারীর প্রবেশাধিকারে যে-যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন, তা কেবল সংবিধানের মৌলিক-অধিকারসাপেক্ষই নয়, শক্তিরূপিণীর সাধন-অনুসারীও। কিন্তু, সামাজিক মন যদি চিরতমসাবৃতই থেকে যেতে চায়, তাহলে আদালত তাকে যতই এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুক, সে থাকবে নিজ-তিমিরেই। শবরীমালায় সেই অন্ধকার উসকে দিয়েছে মেরুকরণের রাজনীতি।
সবচেয়ে বড়কথা, ঘটনাটি ঘটছে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অগ্রসরতম কেরালায়। এমনকি, রাজ্যের মেয়েরাই থাকছে এই অন্ধকারকামীদের সম্মুখ-সারিতে। তারাই ক্রীড়নক হয়ে উঠছে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনৈতিক দলটির সার্বিক নারীবিরোধিতার। আসলে, অযোধ্যায় রামমন্দিরের মতোই আয়াপ্পামন্দিরের রন্ধ্রেই কালসাপ হয়ে ঢুকে তারা কেরালায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা চায়। তাদের সমস্ত ধর্মীয় পদক্ষেপগুলির মতোই এই নারীবিরোধী তাণ্ডবও যেমন পশ্চাদপদ রাজনৈতিক অভিসন্ধির, তেমনই আর্থিক শোষণ ও কেলেঙ্কারীর বিফল আড়ালমাত্র। ধর্মভীরু মানুষও এতদিনে এই তথাকথিত ধর্মবাদী দলটির স্বরূপ টের পেয়ে গেছে। শবরীমালায় নারীবিরোধিতা আসলে জাতপাতহীন তন্ত্রাচারেরও সুস্পষ্ট বিরুদ্ধাচারণ। কেননা, যারা জনজীবনে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা প্রসারিত করতে চায়, তাদের পক্ষে ভেদবিহীন তন্ত্র, কালী বা লোকায়ত শিবকে স্বীকার করা অসম্ভব। কিন্তু, সেই তাণ্ডবই যে শেষকথা নয়, দেশের ঐতিহ্যময় ও বহুমুখী সংস্কৃতির প্রবাহ যে পরিকল্পিত হামলায় কোনওভাবেই রুদ্ধ হওয়ার নয়, আজ নারীশক্তির আরাধনায় আবার সেই প্রমাণই দেবে দেশ।