0

সম্পাদকীয়

Posted in







কী লিখবো আমরা এই মাসিক পরিসরে? গত এগারো-বারো দিনের ঘটনাপ্রবাহে আচ্ছন্ন হয়ে আছে সমগ্র চেতনা। 'সংবেদনশীলতা' নামে যে শব্দটি আমাদের জানা আছে, তার প্রকৃত অর্থ আমরা ভুলতে বসেছি। আমরা যে সমাজবদ্ধ কোনও জীবপ্রজাতির অংশ তাও তো মনে হচ্ছে না আর।

একথা অনস্বীকার্য যে, সভ্যতার ইতিহাস চিরকালই বর্বরতাকীর্ণ। প্রতিবারই আমরা অবলীলায় অতিক্রম করে গিয়েছি কৃতকর্মের নব নব সোপান। এইভাবেই চলে আসছিল। এভাবেই চলে আসে কিন্তু হঠাৎ আসে একটি বাঁক - এক যুগসন্ধি। যখন 'এমন ঘটনা তো কতই ঘটে!' - জাতীয় মন্তব্য করে আর স্বতস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না।

এবারও ঠিক তেমনই হল। একটি নৃশংস, ভয়াল অপরাধ সংঘটিত হল। এ প্রসঙ্গে কোনও পরিসংখ্যান টেনে আনা শুধু আরেক ধরনের অপরাধ নয়, তাতে যে হতে পারে অসন্তোষের আগুনে ঘৃতাহুতি, প্রশাসন তা হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুলে যেতে চাইলেন। চেষ্টা করলেন, জনমানসে 'অন্য গল্পে'র রসদ গুঁজে দিতে। এখানেই চরম ভুলটা হল। সমাজের নানা স্তরে, নানান বিষয়ে পুঞ্জীভূত যে আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছিল, তা যেন ছিল এই স্ফুলিঙ্গটির অপেক্ষায়। ফলত হল কী, সেই ছাইচাপা আগুন এখন দাবানলের আকার ধারণ করেছে প্রায়।

আপাতত দেখার বিষয় এটাই যে নির্যাতিতার পরিবার ন্যায় বিচার পেলেন কিনা। সমগ্র আন্দোলনের সার্থকতা সেখানেই। সৃজনী সংস্কৃতিরই বা কী মূল্য নির্ধারণ করব আমরা… 

সুস্থ থাকুন। দায়বদ্ধ থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান!

0 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in






আরও একটা হাড় হিম করা অমানবিক অত্যাচার ও মৃত্যু ঘটে গেল কলকাতা শহরের বুকে। আর জি কর হাসপাতালের এক মহিলা ডাক্তার জঘন্যতম এক মানুষের লালসার শিকার হোল। সারা দেশের সাথে এ শহরের সব ডাক্তার, পড়ুয়া নার্স স্বাস্থ্যকর্মীসহ সাধারণ নাগরিক বিক্ষুব্ধ, রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। প্রতিবাদের সবরকম ভাষায় তাদের আন্দোলন চলছে। রাজ্য-রাজনীতিতে তার আঁচ পড়ছে। রাজ্যের উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ এবং আদেশে সিবিআই অনুসন্ধান শুরু করেছে।

বেশ কিছু সময় ধরে দেখা যাচ্ছে যৌন অত্যাচারের পর কোনো মেয়েকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় সম্ভবত কোনরকম সাক্ষী না রাখার জন্য যার থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে খুনি ও হত্যাকারী অত্যাচারিতের পরিচিত। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এ ছাড়াও অত্যাচারী তথা হত্যাকারী কারোর আদেশমত অর্থের বিনিময়ে অথবা কোনও ব্যক্তির ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে তাকে দিয়ে একাজ করায়। অনেকসময় কোন গোপন তথ্য জেনে ফেলায় তাকে সরিয়ে ফেলা হয় তবে এক্ষেত্রে পুরুষ বা মহিলা যে কেউ হতে পারে। তবে মহিলা হলে যৌন অত্যাচারের সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না ঘাতক।

আমাদের সমাজে নারীরা সুরক্ষিত নয়, পুরুষের লালসার শিকার হয় হামেশাই, শহর থেকে গ্রাম একই চিত্র। আবার সময়কেও ছাড়িয়ে যায় হাজার হাজার বছর। অথচ এই সমাজেই কিছু লোক আছেন যারা নারী ও পুরুষের সমান অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু পুরুষত্ব দাবী করে নারী দুর্বল। কল্প বিজ্ঞান সাহিত্যে সুপ্রসিদ্ধ আর্থার ক্লার্কের একটা গল্পের ছবির নাম 2001 : A Space Odyssey। ১৯৬৮ সালের এই গল্পে পৃথিবীর নানা বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক ভবিতব্য সম্বন্ধে রেখাপাত করলেও নারীরা যে পুরুষের সহকারীমাত্র – এই ধারণার বাইরে বেরোতে পারেননি তিনি। ভাবী ২০০১ সালের নারীদের এভাবেই দেখেছেন সাহিত্যে। অথচ গল্প প্রকাশের দু বছর পর ১৯৭০-এই সমাজে মহিলাদের যোগ্য সম্মানের অধিকারে পশ্চিমী দেশগুলোর সাথে সাথে সারা পৃথিবী জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়। নারীরা যে শুধু গৃহবধূ, মাতৃত্ব রক্ষা এবং পুরুষদের যৌন সঙ্গী, এই ধারণা থেকে মুক্ত হওয়ার আন্দোলন। আর এর থেকেই জন্ম নেয় নারী মুক্তি আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু নারীকে তার অধিকার পাইয়ে দেবার আহ্বান জানিয়েছেন এর বহু বছর আগে কবিতায় গল্পে প্রবন্ধে। কিন্তু এবারের আন্দোলন অধিকার ও মুক্তি ছিনিয়ে নেওয়ার। এই শৃঙ্খলের বাইরে বের করে আনার আন্দোলন। সব মানুষের সমান অধিকার মুখে বলা হলেও নারীরা বঞ্চিতই থেকে যায় দেশে সমাজে পরিবারে।

সন্তান পালন আর গৃহকর্মের মত কাজের জন্য নারী আর পুরুষেরা শক্তি প্রধান কাজের জন্য শারীরিকভাবে গঠিত, এমনটাই প্রচলিত যা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে লালিত হয়ে আসছে। কিন্তু চার্লস ডারউইন মানব বিবর্তনের ব্যাখ্যায় সেরকম কিছু বলেননি। জিনগত কোনো পার্থক্য নেই। প্রাকৃতিক নির্বাচনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয় – নারী ও পুরুষ সংখ্যায় সমান, তাদের শারীরিক ও মস্তিষ্কের গঠনে পার্থক্য নেই এবং দুজনেরই বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন তাও সমান। এমনও নয় যে পুরুষের আগমন মঙ্গল গ্রহ থেকে আর নারী এসেছে শুক্র গ্রহ থেকে। মানুষের আবির্ভাব উদ্ভব বিবর্তন এবং পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার আগে বাসস্থান ছিল মূলত আফ্রিকায়। সেখানে অন্য আর সব প্রাণীর মত মানুষও এক জাতীয় প্রাণী, মস্তিষ্ক গঠনের তারতম্যে মানুষ অন্যদের থেকে স্মৃতি চিন্তা সিদ্ধান্তে উন্নত। শুধুমাত্র একটা Y-ক্রোমোজোমের পার্থক্যই মানুষের মধ্যে নারী ও পুরুষের এত ভেদ তৈরি করে দিল! অথচ এই দুই লিঙ্গের মানুষের মধ্যে চিন্তা আবেগ কাজকর্ম ভাষা শিক্ষা সবই সমান, একরকম। তবে কিছু মনোবিদের মতে পুরুষের মন নারীদের থেকে আলাদা, পুরুষের মন যৌনাবেগে পূর্ণ এবং এই কারণেই তারা হিংস্র। সন্তান পালন নারীকে অধিক ভাবাবেগ ও সহানুভূতিশীল করেছে। অথচ এসব ধারণা বিজ্ঞানসম্মত নয়। নারী ও পুরুষের প্রচলিত ভেদাভেদ মনুষ্যসৃষ্ট। আর কোনো প্রাণীর মধ্যে এই ভেদ দেখা যায় না। কিন্তু মানুষের চোখে প্রথমেই ধরা পড়ে একজন নারী না পুরুষ! প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা এই লিঙ্গ বৈষম্যর জন্যই নারী ও পুরুষের মধ্যে টক্কর, প্রতিযোগিতা।

স্ত্রী জীবকে জয় এবং তাকে বশ্যতা স্বীকার করানো প্রায় সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণিরই প্রধান চরিত্র। পুরুষ প্রাণির বহুগমন এবং বহু সঙ্গ দ্বারা সন্তান উৎপাদন প্রবণতা পূর্বতন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের থেকে জিনবাহিত হয়ে মানুষে এসেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ স্ত্রী জীবকে সন্তান ধারণ করতে হয় এবং তার জন্য পরবর্তী যৌন সঙ্গমের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। পুরুষ প্রাণী সে দায় থেকে মুক্ত। ডারউইনের যৌনেচ্ছা সংক্রান্ত বইয়ে স্ত্রী ও পুরুষের যৌন সঙ্গমের ইচ্ছায় কোনো বৈষম্য নেই, মানুষের ক্ষেত্রেও নেই। শুধুমাত্র সন্তান ধারণের জন্য নারীর ইচ্ছা দমনে কিছু সময় সংযমের বাধ্যবাধকতা। সন্তান পালনে পরিবার ও সমাজের শিক্ষাও দায়ী বৈষম্যের বীজ বপনে। মানুষ হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখানোর বদলে নারী ও পুরুষ হওয়ার মেকি-বাস্তবতার কথা বলি।

প্রতিটি প্রাণীর নিজের পছন্দমতো যৌন সঙ্গী বেছে নেওয়ার প্রথা আছে। পুরুষেরা একদিকে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে পৌরুষত্ব প্রমাণে ব্যস্ত অন্যদিকে নিজের সৌন্দর্য বিকাশ করে নারীদের প্রলোভিত করার প্রয়াস জারি থাকে। আবার স্ত্রী প্রাণিরাও নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ করে প্রভাবিত করে। আবার সেই প্রাণী জগতেই জোর করে যৌন সঙ্গমে বাধ্য করার প্রবণতা আছে। পোকামাকড় পাখি থেকে শুরু করে গরিলা ওরাংওটাং শিম্পাঞ্জিদের মধ্যেও এরকম জোর করে যৌন সঙ্গম করার প্রথা চলে আসছে। বিবর্তনের হাত ধরেই এই প্রথা মানুষের মধ্যে চলে এসেছে। কিন্তু যেহেতু মানুষের মস্তিষ্কে ভাল-মন্দ বিচারের বুদ্ধি কাজ করে তাই তার পক্ষে সংযম রক্ষা করাও সহজ। কিন্তু যংযম রক্ষায় যে পুরুষরা ব্যর্থ। তারা নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগে যে সঙ্গম করে তাকেই বলে রেপ বা ধর্ষণ। এই ধরনের যৌন সঙ্গমে শারীরিক আঘাত ও ক্ষতি তো হয়ই কিন্তু সবার চেয়ে বেশি আঘাত পায় মানবতা, যে-গুণের জন্য মানুষ মানুষ হয়ে উঠেছে। দৈহিক ধর্ষণ শুধু দেহকেই আঘাত করে না, আত্মাকে, মানবাত্মাকে খতম করে। প্রতিটি ধর্ষণ, সে পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক, প্রতিবার মানবাত্মাকে ধর্ষণ করছে, মারছে। দুঃখের কথা যে এই এত বছরের সভ্যতা সমাজ দর্শন বিজ্ঞান ধর্ম আমাদের মানবতাকে রক্ষা করার উন্নত করার কোন শিক্ষাই দিল না।

পুরুষ মানুষ কেন ধর্ষণ করে? বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী র‍্যান্ডি থর্নবিল এবং মনোবিজ্ঞানী ক্রেগ পামার তাঁদের A Natural History of Rape বইতে বলেছেন, “Rape is an abuse of power and control in which the rapist seeks to humiliate, shame, embarrass, degrade, and terrify the victim.” শুধুমাত্র যৌন ইচ্ছাই নয়, যৌনকর্মের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রদর্শন।

মানবতা প্রথম বধ হয় যখন কোনো নারীকে ধর্ষণ করা হয়। আর মানবতাকে দ্বিতীয়বার মরতে হয় যখন আদালতে দাঁড়িয়ে কোনো নারীকে জনসমক্ষে প্রমাণ করতে বলা হয় যে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আজকাল অবশ্য তৃতীয় দফায় আরও একবার মৃত ধর্ষিতার বাবা ও মা এবং পরিজনদের কাছে মানবতার মরণ হয় যখন সংবাদ, সংবাদপত্র এবং সমাজমাধ্যমে বারবার ‘ধর্ষণ’ কথাটা উল্লেখ করা হয়। যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যে তোমাদের মেয়ে ধর্ষিতা ছাড়া আর কেউ নয়, কোনো পরিচয় নেই। এ বড়ই বেদনাদায়ক হতাশাব্যঞ্জক দায়িত্বহীন সমাজের। যদিও শব্দ শব্দইমাত্র তবু তার ব্যবহার যখন সুখকর নয় তখন এই ধরনের শব্দ পরিহার করাই বাঞ্ছনীয়, প্রতিশব্দ ব্যবহার করা আবশ্যক। এই ধরনের সমাজ, আইনব্যবস্থা ও প্রচারমাধ্যম মানব সমাজের কোন অগ্রগতি বহন করবে তা আমার জানা নেই।

পুরুষেরা এটা অনেকদিন আগেই আবিষ্কার করেছে যে তার পুরুষাঙ্গই হচ্ছে নারীকে বাগে আনার বা শাস্তি দেওয়ার একমাত্র অস্ত্র। “Man’s discovery that his genitalia could serve as a weapon to generate fear must rank as one of the most important discoveries of prehistoric times, along with the use of fire and the first crude stone axe….all men keep women in a state of fear.” ব্রাউন মিলার তাঁর Against Our Will: Man, Women and Rape বইতে নির্দ্বিধায় লিখেছেন। কথাটা বিশ্বাস না করে উপায় নেই। সত্যিই যদি শুধু যৌন উপভোগের জন্য কেউ ব্যস্ত হন তাঁর জন্য পতিতালয় খোলা আছে। কিন্তু না, তা নয়। মনে ধরেছে এমন নারী সঙ্গই করতে হবে, এরকম বাসনা থেকেই প্রথমে জন্মায় সেই নারীকে কাছে পাওয়া। যখন কোনো ভাবেই তা সম্ভব হয় না তখনই জোর করে তার সঙ্গ আদায় করা হোল একটা প্রথা। অন্য প্রকার ধর্ষণও আছে যেমন বিধর্মী বা নিম্নজাতের মেয়েকে ভয় দেখিয়ে জোর করে ধর্ষণ; কোনো পরিবার বা ব্যক্তি বা কোনো নারীর ওপর প্রতিহিংসা – সেখানে সঙ্গমের ইচ্ছে থেকে বড় হোল সেই পরিবার বা ব্যক্তি বা নারীকে শিক্ষা দেবার জন্য। নিরাপত্তা রক্ষীরা যেমন পুলিশ, মিলিটারি অনেক সময় গ্রামের মহিলাকে ধর্ষণ করেছে বলে খবর আসে। সেখানে আনন্দ পাওয়ার থেকে ক্ষমতা প্রদর্শনে আতঙ্ক সৃষ্টি করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং শাসকের মধ্যে কিছু আছে যারা ক্ষমতার দম্ভে ধর্ষণের মত কামলালসায় উন্মত্ত হয়। অনেক আগে বংশ রক্ষার জন্য শ্বশুরমশাই পুত্রবধূর গর্ভে সন্তানের বীজ পুঁততেন। এটাও এক ধরনের ধর্ষণ কারণ পুত্রবধূর অমতেই বা ভুল-বুঝিয়ে জোর করে এমন কাজ করানো হোত। সামাজিক ভয়ে এইসব নারীরা মুখ বুজেই অত্যাচার সহ্য করেন। এমনকি স্ত্রীর অমতে স্বামী জোর করে যৌন মিলন করলে তা ধর্ষণের সংজ্ঞায় চলে আসে।

যৌন সঙ্গী নির্বাচন প্রতিটি প্রাণির মধ্যেই রয়েছে এবং প্রতিটি প্রাণিই ধর্ষণ প্রতিরোধের চেষ্টা করে, “প্রাণী জগতের সংসার” পাঠ করে ডারউইনের এই উপলব্ধি হয়েছিল। তবু যখন এই ধরনের কাজ করা হয় তখন স্ত্রী প্রাণির সঙ্গী নির্বাচন অধিকারকেই খর্ব করা হয়। ডারউইন দেখিয়েছেন যে স্ত্রী প্রাণির এই মানসিকতাই প্রাধান্য পায় যে তার সন্তানের যে জন্মদাতা হবে সে তার সন্তানের দায় দায়িত্বও পালন করবে। কিন্তু যে সমস্ত পুরুষ প্রাণী ধর্ষণ কার্যে লিপ্ত হয় তাদের থেকে এ ধরনের দায়িত্ব আশা করা যায় না। মানুষের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নেই।

সামাজিক হেনস্থা লজ্জা ছাড়াও এবং মানবতা হত্যা ছাড়াও অন্য সামাজিক অসম্মানের সম্মুখীন হতে হয় যখন সেই ধর্ষিতা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। সমীক্ষায় দেখা গেছে শতকরা পাঁচ শতাংশ সন্তান-গর্ভধারণ-ক্ষমতা সম্পন্ন মহিলার গর্ভে ভ্রূণ সঞ্চার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর জন্য নারীকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয় আর ধর্ষণকারী বেমালুম সমাজে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ায়। এইরকম একটা সমস্যায় নারীর গর্ভপাত করা ছাড়া উপায় থাকে না। এরকম একটা ব্যাপক ভ্রূণসঞ্চার ও গর্ভপাতের বিবরণ পাওয়া যায় ১৮৩০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত এশিয়াটিক জার্নালের প্রথম ভল্যুমের ১১ সংখ্যায়। রামু নাথি নামে এক সংস্কৃত পণ্ডিত আইডলেটরি ইন ইন্ডিয়া শীর্ষক এক বিতর্ক সভায় এটি পাঠ করেন। বিতর্ক সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ইস্ট ইন্ডিয়া হাউজের কলেজ অব ফোর্ট উইলিয়ামের হলে। সেখানে অস্বাভাবিক মাত্রায় অবৈধ সন্তান নষ্ট করে ফেলার কথা বলা হয়েছে। যে সমস্ত কুলীন ব্রাহ্মণের ঘরের মেয়েরা স্বামীহারা বা স্বামী বৃদ্ধ-অথর্ব সেসব ঘরে প্রতি বছর একটি করে অবৈধ সন্তান গর্ভে ধারণ করে সেই কন্যা এবং তাকে অবৈধভাবে দেশীয় পদ্ধতিতে নষ্ট করা হয়ে থাকে। সারা দেশেই এই কর্মকাণ্ড চলেছে এবং কেবলমাত্র বেঙ্গল প্রভিন্সেই প্রতি মাসে দশ হাজার সন্তান ভ্রূণ নষ্ট করা হয়ে থাকে। আবার এই টোটকা পদ্ধতিতে অনেক নারীর মৃত্যুও ঘটে। ১৯০ বছর আগের এই ছবিটার সাথে আজকের দিনের যে সংবাদ বিভিন্ন মাধ্যমে বেরোয় তার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। এইসব নারীদের মধ্যে অধিকাংশই ধর্ষিতা এ নিয়ে সংশয়ের স্থান নেই। এবং তখনকার মতোই আজও নারীকে এইসব অসামাজিক কাজের জন্য দোষী সাব্যস্ত করার রেওয়াজ চলে আসছে। নারীদের যৌন কর্মে জোর করা, বাধ্য করা ও ধর্ষণ করা এক শ্রেণি পুরুষদের মধ্যে বহু যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক ব্যধি। সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতি এই ব্যধিকে প্রশ্রয় দিয়ে আসছে বলে এর শেষ নেই।

ধর্ষণ নিঃসন্দেহে সহিংস জঘন্য সামাজিক ও আইনি অপরাধ। নারী অপহরণ ও ধর্ষণ অসামাজিক কার্যকলাপের মধ্যে অন্যতম প্রধান। সমাজের যে কোনো আইন শৃঙ্খলার অবনতিতে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যেমন, দাঙ্গা, যুদ্ধ, এমনকি ডাকাতির সময়ও। আবার অন্য সময় বিনা প্ররোচনায় ধর্ষণ হয়ে থাকে। সভ্যতা অগ্রগতির সাথে ধর্ষণের মত ঘৃণ্য অপরাধের সংখ্যা কমেছে কি? অনেকে বিশ্বাস করেন তাই। অনেকে মনে করেন নারীবাদী আন্দোলনের ফলে জনজাগরণ হয়েছে। আর তাই সামাজিক ও আইন কানুন অনেক শক্ত হয়েছে। কিন্তু অপরাধীর শাস্তি যদি দৃষ্টান্তমূলক না হয় তবে অপরাধের সংখ্যা কমবে না। সেইসাথে আদালতে বিচারের ব্যবস্থা যাতে ধর্ষিতার পক্ষে সম্মানজনক এবং দ্রুত বিচার হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে পুরুষ ধর্ষণ করে বলে পুরুষমাত্রই হ্যাবিচুয়াল ধর্ষক নয়।

নারীর উত্তেজক পোশাক পুরুষকে উত্তেজিত করে বলে মানে অনেকে। তাহলে অর্ধ-উলঙ্গ পুরুষও নারীকে উত্তেজিত করে কি? এশিয়াটিক জার্নালের পূর্বোক্ত সংখ্যায় আর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তৎকালীন ‘অসভ্য’ সমাজের একটা চিত্র। সে সময় কিছু জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজো হতো এবং গঙ্গায় বিসর্জনের সময় দুটো নৌকা নেওয়া হোত। একটায় প্রতিমার সাথে পুরুষেরা অন্যটায় শুধু বাড়ির মহিলারা। নৌকা ছাড়ার পর পুরুষেরা সব উলঙ্গ হয়ে ঢাকের বাদ্যির সাথে উদ্দাম নৃত্য করত। মহিলাদের নৌকা অনতিদূরেই থাকত। পুরুষদের এও এক ধরনের মানসিক বিকৃতি। এর পরিচয় পার্কে বাসে ট্রেনে সিনেমা হলে পাওয়া যায়।

হাসপাতালে মহিলা ডাক্তারের প্রতি এই নৃশংস যৌন-অত্যাচার ও হত্যার প্রতিবাদ সমাজের সমস্ত স্তর থেকে উঠে আসুক, আইনকে বাধ্য করা হোক দ্রুত বিচারের এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। কিন্তু ধর্ম, রাজনীতি, শাসক/রাষ্ট্র পোষিত এই অপরাধের শেষ কীভাবে করা সম্ভব তা সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, মানববিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞানীদের ভাবতে হবে যে কীভাবে মানুষকে বোঝানো যায় ধর্ষণ শুধু দৈহিক অত্যাচার নয়, মানবতা হত্যা। ধর্মীয় শাসক, রাষ্ট্রের শাসক, আইনের শাসক আপনারা অতি দ্রুত কাজ করুন দাবানল ছড়িয়ে পড়ার আগে একে শেষ করতে হবে। মানবতার এই চরম মৃত্যু কাম্য নয়।

1 comments:

0

প্রবন্ধ - বেবী সাউ

Posted in







কবি মণীন্দ্র গুপ্ত পাঁচ-এর দশকের শেষের ও ছ’য়ের দশকের শুরুর দিকে কবিতা লিখতে শুরু করলেও, আধুনিকতার যে ইয়োরোপীয় ভাবনায় তাঁর সমসময়ের সাহিত্য রচিত হচ্ছিল, তিনি তার থেকে একটু আলাদা ছিলেন। এমনটা নয়, তিনি তাঁর কাব্যভাষায় ও কাব্যদর্শনে প্রাচীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। বরং, তিনি তাঁর সারাজীবনের কাব্যকৃতি এবং কাব্যদর্শনে চিরায়ত সংস্কৃতিকে ধরতে চেয়েছেন দেশজ সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে। তিনি পুরনোকে অবিকল হাজির করেননি, কিন্তু পুরনোকে তার ঐতিহাসিক ভিত্তির জায়গা থেকেই নতুন ভাবে দেখেছেন। তাই বিভিন্ন লোকসাহিত্য, লোককথা, পুরাণ, টোটেম, প্রতীক ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায় আধুনিকতার অনুষঙ্গে। আমার এই গবেষণা পত্রের কাজই হল, ষাট দশকের কবিদের পাশাপাশি মণীন্দ্র গুপ্তের কাব্যভুবন কীভাবে আলাদা, তার এক পর্যালোচনা করা।

মণীন্দ্র গুপ্তের প্রয়াণের পরে ‘স্বকাল পত্রিকা’ ও ‘আদম পত্রিকা’ মণীন্দ্র গুপ্ত সংখ্যা প্রকাশ করেছে ২০১৮ সালে। সেখানে তাঁকে নিয়ে প্রচুর নিবন্ধ লিখেছেন বিভিন্ন সময়ের কবি ও লেখকরা। এ ছাড়া মণীন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে তেমন ভাবে কোনও আলোচনা বা গবেষণা হয়নি। সেভাবে বলতে গেলে, এই গবেষণাপত্রই বাংলা সাহিত্যের এই প্রখ্যাত কবিকে নিয়ে প্রথম গবেষণাপত্র।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বা প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের কবিতার মধ্যে যে স্মার্ট নাগরিকতা এবং বিপন্ন অস্তিত্বের ভাষ্য আমরা খুঁজে পেলাম, তার একধরনের পরিবর্ধন দেখা যেতে লাগল ষাটের বা ছ-এর দশকে। আমরা পেলাম ‘বালক জানে না’-এর কবি সুব্রত চক্রবর্তীকে, পেলাম ‘ব্যান্ডমাস্টার’-এর কবি তুষার রায়কে, ‘অন্ধ স্কুলে ঘন্টা বাজছে’-এর কবি দেবারতি মিত্রকে এবং 'অবশ্যই শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা'-এর কবি ভাস্কর চক্রবর্তীকে। সঙ্গে এ কথাও মাথায় রাখতে হবে, পাঁচ-এর দশকের কবিদের কবিতা অনেক বেশি সংহত রূপ ধারণ করল এই ছয়ের দশকেই। পাঁচ-এর দশকের অনেকের-ই প্রথম কবিতার বইও এই ছয়ের দশকেই বেরোন। ফলে, এ কথাও বলা যেতে পারে, যে ছয়ের দশক হল পাঁচ-এর দশকের কবিদের নিজেদের ভাবনা ও কাব্যভাষা খুঁজে পাওয়ার দশক। অনেকটা আশ্চর্যরকম ভাবেই, ভাস্কর চক্রবর্তী এবং তুষার রায় তাঁদের প্রথম কাব্যগ্রন্থেই খুঁজে পেয়েছিলেন এক অনন্য কাব্যভাষা। একদিকে তুষার রায়ের 'ব্যান্ড মাস্টারে' যেমন ছিল এক নাগরিক কবির প্রবল অস্তিত্বসংকটের ভাষ্যের সঙ্গে মৃত্যুবোধের অমোঘ মিথষ্ক্রিয়া, তেমন আরেকদিকে ভাস্করের কবিতায় ছিল জীবনানন্দ কথিত বিপন্ন বিস্ময়ের এক নাগরিক যাপনের ভাষ্য। 'শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা'র পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলিতে যেমন ভাস্কর অনেক বেশি তীক্ষ্ণ হয়েছেন। ছয়ের দশকের এই কাব্যচর্চায় কীভাবে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা ভিন্ন এক দিগন্ত তুলে ধরেছে , তা-ই এই গবেষণায় অন্যতম সূচনাবিন্দু।


কেমন ছিল তাঁর কবিকৃতি? ষাট দশকের আশেপাশে তিনি যখন কবিতা লিখতে শুরু করেন, তখন তাঁর পাশাপাশি রয়েছে কৃত্তিবাসের কবিরা। সহজেই তিনি প্রভাবিত হতে পারতেন তাঁদের দ্বারা। প্রভাবিত হতে পারতেন কৃত্তিবাসের পাশাপাশি শতভিষা পত্রিকার আবহমান নীচু স্বরে গুরুত্বপূর্ণ কাব্যব্যক্তিত্ব দ্বারাও।

কিন্তু কবি মণীন্দ্র গুপ্তের মধ্যে ছিল এক নতুন কাব্যভাষার খোঁজ। আর মানসিক ভাবে তিনি বহুস্বরে বিশ্বাসী এক কবি ছিলেন। যখন নাগরিকতার চিত্রকল্প, একাকী মানুষের বিষাদ এবং প্রকৃতির সঙ্গে উচ্ছসিত যাপনের এক ধারাবাহিক লেখার পৃথিবী ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে বাংলা কবিতায়, তিনি একটু অন্য পথে হাঁটা শুরু করলেন। বাংলার দেশজ চিত্রকল্পের কাছে ফিরে গেলেন। ফিরে গেলেন মানুষের কাছে। মানুষের কথ্য ভাষায় ব্যবহৃত নানা ঘটনা, লোককথা, লোকসংস্কৃতি, প্রবাদ, ধর্মীয় বিশ্বাস, টোটেম, আর এ সমস্ত কিছুর অনাবিল শব্দভাণ্ডার তাঁর জীবনকে এবং কাব্যভাষাকে গড়ে তুললো। তিনি অন্বেষণ করতে লাগলেন এমন সব শব্দের, এমন সব চিত্রকল্পের, যা আবহমান কাল ধরে বাংলার সংস্কৃতিকে পুষ্ট করেছে। সেই সব শিকড়ভেজা শব্দগুলিকে তিনি নতুন করে প্রাণ দিলেন তাঁর কবিতায়।


যেমন, তাঁর এই কবিতাটির মধ্যেই তাঁর স্বতন্ত্র কাব্যভাষা স্পষ্ট-


কিন্তু ফ্যাকাশে চাঁদের আলোয় দেখা যায়, সেই ভূত একলা

ভিখারিনীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।

এদিকে শেয়ালনী ছোট্ট মাথাটিকে দুই পায়ের মধ্যে রেখে

কাঁকড়া খাবার মতো করে এক কামড়ে ভেঙে দিলে

বাচ্চাটা ককিয়ে উঠল: মা!

শেয়ালনী করুণ স্বরে ‘বাছা, এই তো আমি— ’ বলে

ঘুমপাড়ানি গান গাইতে গাইতে খেতে লাগল।

(মাহাতদের মরা শিশু, লাল স্কুলবাড়ি,১৯৭৮)



কিন্তু এই প্রাণপ্রতিষ্ঠা পুরনোর কাছে ফিরে যাওয়া হল না। বরং পুরনোকে, শিকড়কে নতুন ভাষার, নতুন ব্যাখ্যার এবং নতুন দৃষ্টিকোণের প্রেক্ষিতে হয়ে উঠলো প্রকৃতই উত্তরাধুনিক এক কাব্যবীক্ষা। আলোচ্য গবেষণায় মণীন্দ্র গুপ্ত কীভাবে তাঁর অধুনান্তিক কাব্যভাষা গড়ে তুলেছিলেন এবং কেনই বা তাঁর কাব্যভাষাকে আধুনিকতার গণ্ডী ছাড়িয়ে অধুনান্তিকতার পথে উত্তীর্ণ বলে গবেষকের মনে হচ্ছে, তার এক যুক্তিগ্রাহ্য অনুসন্ধান থাকবে। এই আলোচনার পরিসরে আলোচিত হবে তাঁর প্রথম থেকে শেষতম কাব্যগ্রন্থ, তাঁর কাব্যভাবনা, কবিতা সংক্রান্ত গদ্য এবং প্রবন্ধ। আধুনিকতা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “আধুনিকতা কাকে বলে? আমি অন্তত তার সংজ্ঞা জানি না। ‘আধুনিকতা’ এই ধারণাটিকে যদি প্রগতির সঙ্গে যুক্ত করি, কিংবা উত্তরোত্তর আধুনিকের লক্ষণ অনুসন্ধান করি তবে শব্দটি ও তার অর্থ অনিত্য ও অস্থির হয়ে যাবে।

আধুনিকতার সঙ্গে আমি সময়ের স্রোত যোগ দিতে চাই না। সমকালীনতা না, ধ্রুবতাও না। আমি ভাবি ফুরফুরে চিরকালের নির্যাস— চির-জীবনবোধের তন্মাত্র, তার আভা।

এ কথা অন্য সব বিষয়ে যেমন, কবিতাতেও তেমনি। ধরা যাক পোশাকের কথা— ইন্দ্রের চক্ষুর মতো পকেটময় একালীন জিনস না কি সন্ন্যাসীর কপনি-বহির্বাস-সাপি, সীবনহীন আর্য ধুতি চাদর, রোমান টোগা, সেমাইট আলখাল্লা বা মায়া পন্‌চো? আমার তো মনে হয়, শত শত জগঝম্প জরদ্গ‌ব পোশাকের (মিউজিয়ম, রাজ্যাভিষেক ও পার্টি দ্রষ্টব্য) বিপরীতে ঐ সব পোশাকই আধুনিক। সন্ন্যাসীর কপনি আধুনিকেরও আধুনিক।

গ্রীকরা তো শেষ লড়াইয়ে যেতেন পুরো বিবস্ত্র হয়ে। তেমনি শেষ কবিতার বেলায় কোনো আভরণ, আড়াল থাকবে না। এতদিনের এত যে যুদ্ধ শেখা তা কেবল ঠিক লক্ষ্যে আঘাত করার জন্যে। হত্যার মতো মৌলিক, মৃত্যু পেরিয়ে আসার মতো সহাস্য— এ শুধু পাওয়া যাবে যদি শরীর দিয়ে শরীরকে আঘাত করি, অস্ত্রাঘাত করি এবং করতে দিই সোজা নিরাবরণ চামড়ায়।

ঐ মরণপণ যুদ্ধের কথা ভাবলে আধুনিকতার ধারণা খুঁজে পাই। নিপুণ, নির্ভয়, অপ্রমত্ত, সংস্কারশূন্য ঐ সংঘর্ষের সঙ্গে ও শেষে আছে তার প্রাপণীয়: জীবন ও জগৎ উপভোগের অনিঃশেষ আনন্দ। অবস্থাটা একটি গল্প দিয়ে স্বচ্ছ করি:

জেন গুরু রিয়োকান নির্জন পাহাড়তলিতে ছোট একটি কুটিরে সরলতম জীবন যাপন করতেন। একদিন তিনি বাড়ি নেই। সন্ধেবেলায এক চোর এসে দেখল, চুরি করার মতো কিছুই নেই সেখানে। ইতিমধ্যে রিয়োকান ফিরে এলেন এবং চোরকে ধরলেন। ‘তুমি হয়তো দীর্ঘ পথ হেঁটে আমাকে দেখতে এসেছ’, সেই নিঃশব্দচরকে বললেন তিনি, ‘তোমাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। অনুগ্রহ করে আমার পোশাকটিই উপহার হিসেবে নাও।’

প্রাসঙ্গিক ভাবেই, তাঁর সাক্ষাৎকারও আলোচিত হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর গদ্য থেকেও তুলে আনা হবে এই গবেষণার উপযোগী বিষয়। আমার এই গবেষণার উদ্দেশ্য মণীন্দ্র গুপ্ত-র এই কাব্যভুবন ও কাব্যমানচিত্রকে অনুসরণ করা। বাংলা কবিতার সরণ মণীন্দ্র গুপ্ত-র কাব্যভাষার হাত ধরেই আগামী কাব্যভাষায় প্রবেশ করতে চলেছে। তার বীজ এবং আলোকবর্তিকা রয়েছে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতাতেই।
কেন ছয়ের দশকের কবিদের থেকে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতার স্বর ভিন্ন, শুধু সে কথাই নয়, আমরা আলোচ্য গবেষণায় দেখব কীভাবে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা আগামী পাঁচ দশকের বাংলা কবিতার জগতে এক ভিন্ন স্বর আনয়ন করল।


কিন্তু ছয়ের দশকের এই কবিতাগুলির বিপ্রতীপে যেন অবস্থান করছে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা। এর একটা কারণ কবি মণীন্দ্র গুপ্ত প্রথম থেকেই এই নাগরিক বিপন্নতার বাইরের লোক ছিলেন। আর আরেকটা কারণ কবি মণীন্দ্র গুপ্তের ভাবনার ভিতরে কাজ করেছিল একধরনের অন্য বিপন্নতা। আর সেই বিপন্নতার নাম মৃত্যুবোধ। কিন্তু এই মৃত্যুবোধ কবি মণীন্দ্র গুপ্তকে মৃত্যুবিলাসী করে তোলেনি। বরং অনেক বেশি করে টেনে নিয়ে গেছে বাংলার স্বতন্ত্র ধারার যাপনের কাছে। মানুষের ভাবনা, চিন্তা, দর্শন, সংস্কৃতি, রীতি, আচার এবং নিজস্ব এক দর্শনের জগতে তিনি অবগাহন করেছিলেন। যেমন, আমরা উদাহরণ হিসেবে তাঁরই কবিতা থেকে তুলে আনতে পারি তেমনই মণিমুক্তো-

যেমন-
এক লক্ষ বছর সঙ্গে থাকার পর সাব্যস্ত হবে, তুমি আমার কি না।
এখন ওসব কথা থাক।
এখন চলো মিকির পাহাড়ে বুনো ফুল পেকেছে, চলো খেয়ে আসি।
লাল রুখু চুল
সূর্যাস্তের মধ্যে
অর্কিডের উজ্জ্বল শিকড়ের মতো উড়ছে।
--দেখি দেখি তোমার তামাটে মুখখানা দেখি!


আমরা দেখি মণীন্দ্র কবিতাপাঠ আসলে এক দীর্ঘ যাত্রা। ঠিক ওই মাধুকরীতে বেরিয়ে পড়ার মতো। যার আদি আছে অন্ত নেই।




0 comments:

0

প্রবন্ধ - দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য

Posted in







সিকিম বা দার্জিলিং তুমি কতই তো গেছ -- ম্যাডক্স স্কোয়ার থেকে পুজোর রাত্তিরে সেই যে একবার হেঁটে ফিরেছিলে! কত সময়ের কত উৎসব আর কতই না সব ছবি --- কুয়াশার ঘন পথে বাইসন নেমে আসা পাহাড়ি নদীর খাত, পাহাড় চুড়োয় প্যাগোডা থেকে নানা বর্ণের পাখনা মেলা কত পতাকা, ঝুলন্ত সেতুর ওপর প্রেমিকের গান... কিন্তু কোনো অজ গ্রামে কি কখনো তুমি যেতে চেয়েছ ? ডাঙাজমির পট ঘিরে তালসারির রূপ দেখেছ সেখানে ? মানুষজনের সঙ্গে দুটো কথা বলতে প্রাণ চেয়েছে? -- বিশেষ জায়গা ছাড়া কোথাও খুব একটা যাই না আমরা, তাই না! আমরা নামি পটভূমি খুঁজি, বরফে ঢাকা পাহাড়ের সারি কিংবা সাগরমুখো ঘর চাই। অথচ ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে গ্রামের সেই ছবি টাঙাতে ভারি ভালো লাগে আমাদের -- কী অপূর্ব খড় ছাওয়া ঘরগুলো, সামনে একটা দাওয়া, মাটির রাস্তার এক পাশে একটা হেঁটমুণ্ড গরুরগাড়ি! যা দেখায় চোখ জুড়োয়, তাকে নিকট করতে না পারার এক রহস্যময় দূরত্বেই আমাদের বাস।
.
আজকের দিনে খড় ছাওয়া এই ঘরগুলো, তাকে ঘিরে থাকা এই সামান্যের সাজ, আসলে এক অসহায়তারই ছবি। কবি দেখতে পান, 'অসহায় সেইসব ছবি থেকে নেমে আসে কিছু উদোম মানুষ। এক বোকা খাঁদানাক কালো ভগবানও নেমে আসে। সকলের হাতে তির-ধনুক কিংবা উদ্যত বর্শা'! প্রাকৃত স্বপ্নের এইসব মানুষের ঠাঁই হয় না শহুরে কোনো কবিতার উঠোনেই। এদের মুখের ভাষা কেমন হবে, খাঁদানাক কালো ভগবানকে ঘিরে তারা কোন বি-ভাষার বাঁধা শ্লোকে পুজোআচ্চা করবে, এই নিয়ে তখন আরেক ভাবনা! কবিতায় এইসব কথা বাঁধতে গেলে, কবিতার বাঁধনও যায় বদলে, কবির দৃষ্টি যায় বদলে। ... পুরোনো সংস্কৃত নাটকে দেখো না, রাজা আর পুরোহিত কেমন সংস্কৃতে কথা বলছেন, অথচ জেলে ও প্রহরীর কথা হচ্ছে মাগধীতে, অর্থাৎ কেজো রাস্তার ভাষায়! বেশ কয়েক বছর আগে ছোটো নাগপুরে রামগড় পাহাড়ের গায়ে সম্রাট অশোকের সময়ের দুটি প্রত্নলিপি পাওয়া গিয়েছিল। দুটিই কবিতা।একটি শিলালিপিতে সেই কবিতার ভাষা হল পালির কাছাকাছি, ছন্দ বৈদিক, অন্যটার ভাষা, ছন্দ, সমস্তই প্রাকৃত। সেই ছন্দের নাম 'গাথা'। মেয়েদের গানকে তখন 'গাথা' বলা হতো। এত আগে থেকেই যদি লিঙ্গভেদে, শ্রেণীভেদে ভাষা কিংবা ছন্দ বদলে বদলে নিয়ে থাকে তাদের চলন -- আজকের কোনো কবি কি আর ঘ্রাণ নেবেন না তবে সেই ঘাসমাটির, তাকাবেন না মানুষের ভাষার আদল-বদলের দিকে, তাদের চাঁচাছোলা ভণিতাহীন রুক্ষ উচ্চারণের দিকে -- নতুন ছন্দে, নতুন শৈলীতে বিকল্প এক ঈশ্বরের স্বর জাগিয়ে তুলবেন না কেউ! আজ তো পৃথিবী জুড়ে আড়-ভাবুকদেরই দিন! সময়ের তলে তলে আরও এক অতল সময়ের স্রোত!
.
তোমার মনে পড়তে পারে এক সাহিত্যসভার কথা, কল্পিত সেই সভায় 'শেষের কবিতা'র 'অমিত'-র সেই তির্যক অভিমত : 'চাই কড়া লাইনের, খাড়া লাইনের রচনা -- তিরের মতো, বর্শার ফলার মতো, কাঁটার মতো।... খোঁচাওয়ালা কোণওয়ালা গথিক গির্জার ছাঁদে, মন্দিরের মণ্ডপের ছাঁদে নয়। এমনকী যদি চটকল পাটকল অথবা সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ের আদলে হয়, ক্ষতি নেই।' এই কথাগুলো অমিতকে বলতে হচ্ছিল রবিঠাকুরের কোমল লেখালিখির প্রতিবাদে। এর মধ্যে কি সেই সময়ের নিরিখে মাত্রাহীন আধুনিকতায় মেতে ওঠা লেখালিখির বিরুদ্ধে এক ঘুরপথের প্রতিবাদও ছিল না! তাও ছিল। তা-ই বোধহয় ছিল বেশি করে। অমিতর এই প্রতিবাদ তো কোনো শৈলীকে নাকচ করতে বলা নয়, প্রকৃতপক্ষে তাকে শিরোধার্য করার তাগিদেই তার এই উচ্চারণ! একই সঙ্গে অমিতর এই কথাগুলোতে আরো ছিল, সাহিত্যের ভাষাভঙ্গির আদর্শ ছাঁচ নিয়ে তার স্রষ্টার নির্দিষ্ট এক ভাবনার পরিসর -- সৌষম্যই যেখানে পাখির চোখ।
.
সেই রুচি যে আজ একেবারে আকাশ-পাতাল বদলে গেছে, তা কি বলা যাবে? আজও আমাদের বেশিরভাগই মৃদু মেজাজের কবিতা, ছন্দে মিলে মিঠেস্বভাবের কবিতায় স্বচ্ছন্দ। মন্ত্রপাঠের মতো নিবিষ্ট হোক কবিতা, তাতেই আমাদের অনেকের আগ্রহ। কারোর কারোর ভাবনায় কবিতা যেন আমাদের বাড়ির ছোটো মেয়েটি। সে হাঁটলেই নূপুর বেজে ওঠে যেন, সেদিকে তাদের নিরন্তর লক্ষ। অথচ সত্যিই যদি কবিতা অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায় -- সেই মেঠো ভগবানের বর্শার ফলার দিকে! তার বি-ভাষার স্বরের মতো! আয়না ঘুরিয়ে আজ মাঠ-জলা-জঙ্গল আর সেই কাদামাটির দেশে হেঁটে বেড়ানো মানুষগুলোর সহজ আলো আর গাঢ় অন্ধকারে কলম ডুবিয়ে যিনি লিখতে বসেন, তাঁর কবিতা নিয়েই আলাপ করব।
.
কোনো কবিকে নিয়ে কথা বলতে গেলে, তাঁর লেখালেখির ভাবনা নিয়েও তো কথা এসে যায়, নিজের মতো করেই তাঁর রচনার আকাশের কথা বলতে হয়, নিজের বোঝাবুঝি নিয়েই তাঁর কবিতাকে পাঠকের দিকে বাড়িয়ে দিতে হয়! কিংবা হয়তো নিজের থেকে কিছুই বলা হল না -- তাঁর বলাটাই রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে নিজের কথাকে বদলে দিয়ে গেল! যাঁর ভাবনার পরতগুলো নিয়ে আমাদের আলাপ ক্রমে তাঁর কবিতার বিস্তারে মিশে যাবে, তিনি, কবি নিত্য মালাকার। --- তিনিই সেই কবি, তাঁরই সেই কবিতা, 'শেষের কবিতা'-র অমিত বাংলা কবিতার যে ছাঁচভাঙা রূপ দেখতে চেয়েছিল! আজ তাঁর যে কবিতার বইটিকে ঘিরে আমাদের কথা হবে, সেটি 'অস্ট্রিক' থেকে প্রকাশিত তাঁর 'কবিতা সংগ্রহ'। কবি নিত্য মালাকারের বাসভূমি উত্তরবঙ্গের মাথাভাঙা অঞ্চলে -- তাঁর নিভৃত উচ্চারণ পাঠকের কাছে তুলে আনছে পূর্ব মেদিনীপুরের এক প্রকাশন -- কবিতায় সবই সম্ভব! গোপন প্যামফ্লেটের মতো এইসব লেখা, নাহলে তোমার আমার মতো পাঠকের কাছে পৌঁছোবে কীভাবে!
.
তাঁর কবিতা জুড়ে নুড়িপাথরের মতো ছড়িয়ে রয়েছে ভাষা ও ভঙ্গির অজস্র জিজ্ঞাসা। 'রোদ ও মাঠের শূন্যতা ভেঙে অচেনা অক্ষর সব ক্রোধে ঝিকিয়ে' উঠুক, এই তাঁর ইচ্ছা ! 'ক্ষুর বা অগ্নির চেয়ে তীব্রতর' হোক ভাষা -- ভাষাবিষয়ে এই তাঁর খাপখোলা প্রস্তাব। 'অলংকার মালা পরানোর দিন নেই আর' --- এই তাঁর বিশ্বাস। 'কাব্যে পুস্তকে ও করে-খাওয়াদের বাক্ রীতিতে আছে ভবিষ্যৎ, এরই ভেতরে পথ করে নিতে হবে; নিজেকেই। রাশি রাশি শূন্য ও সংখ্যার জোরে চলছে যে জগৎ, তাকে বস্তু ভাবো' --- এই তাঁর শ্লেষ জড়ানো আত্মপাঠ।
.
'...উত্তমর্ণদের প্রতি শেষ কর্তব্য চুকিয়ে/ ভেঙে ফেলি শব্দ ও রূপের খাঁচা চর্যাপদ হরিণীর --/ লিখে ফেলি পুনরায় / চণ্ডাল জেনেছে বার্তা, আমি যা জানিনি' --- তাঁর চূড়ান্ত এবং অকপট বিদ্রোহ তাঁকে ভাস্কর্যের মতো গেঁথে নিতে সাহায্য করে তাঁর কবিতার গড়ন। মৃত শব্দের কাঁধে হাত রেখে চলতে আর চান না তিনি। আর যে-মানুষ একা পথ হাঁটেন, জীবনে বা কবিতায় --- গড্ডালিকায় ভেসে থাকা সুধী পাঠক যে তাঁর প্রতি অমনোযোগী হবেন, তা একরকম জানা কথাই। তাঁর লেখা যে হা-মানুষের উপাখ্যান! তাঁর ঈশ্বর যে লৌকিক। তিনি কথা বলেন সহজ ছবি থেকে নেমে আসা হা-মানুষের হয়ে! হয়তো তার নিজের হয়েও, যাকে হা-মানুষেরা দলে নেয় না, নেয় না শহুরে রম্যভব্য লেখকেরাও :
.
'সদর্থক সব শব্দই তো রবীন্দ্রনাথ আর সংবিধানে লেখা আছে... আমি গড়াতে লাগলাম নীচে, মহা নীচে। দেখলাম, জলস্থল ভেদ করে এমন পতন আমি বানিয়েছি, উত্তরণের জন্য শেষ যাত্রা, সার্থক -- কিছুই রাখিনি।'
.
'জন্মে জন্মে শব্দ তার বাচ্যার্থ ভুলতে ভুলতে ব্যঞ্জনার জন্য আরও জটিল, সুন্দর হয়।' --- কবিতার জন্য সম্ভাবনাময় প্রতিটি শব্দ একজন কবির কাছে যতটা মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে, সম্ভবত তার কানাকড়িও নয় অন্য কারো কাছে! সেই শব্দ নয় তাঁর গল্পমালার ইঁট, সেই শব্দের ভিতরঘরের জ্বোরো বা শীতল ভাবটুকু, তার অনুভূতি আর অর্থ-পেরোনো আহ্বান নিয়েই কবির জগৎ :
.
'আমি একটি শব্দে বিশ্বাস করি -- শব্দ আমাকে
আমি একটি ব্যাঘ্রে বিশ্বাস করি -- ব্যাঘ্র আমাকে
অথবা একটি পেঁচায় বিশ্বাস করি, পেঁচক আমাকে
বিচরণশীল রাখে -- ভাসমান,আমার ভেতরে
ওই শব্দ ওই বাঘ অথবা সে পেঁচা
স্বপ্নে ঘরবাড়ি গড়ে অথবা তা ভাঙে
আসবাব তৈজসে ভরা বিকারের জাহান্নাম
অথবা সে অমরাপুরীতে
ক্রমশ ডেকেই যায় টিক-টক,
টিক-টক...'
(অংশ)
.
শব্দ এক ছদ্মবেশী বাঘ, সে তোমাকে মুহূর্তে ছিঁড়েখুঁড়ে দিতে পারে, যদি তুমি কবি হও। সেই বাঘের ডাকে তোমার মনে পড়ে যায় দ্রুতধাবমান সময়ের কথা, উন্মত্ত কালসমুদ্রের কথা --- সেই বাঘের ডাকে ঘড়ির কাঁটার 'টিক টক' উঠে আসে একদিন। 'ক্ষুধা ও তৃষ্ণার পদ্য' পিঠে নিয়ে সে ছুটতে থাকে বন-বাদাড় ডিঙিয়ে। জলহীন খাদ বালি আর মানুষের পদছাপে ঘেরা অন্ত্যজদের ত্বকের মতো খসখসে ভূমিতে দাঁড়িয়ে সে ছুঁড়ে ফেলে দেয় অবাস্তব 'খোলাম কুচির স্বপ্ন' --- পেতে চায় চণ্ডালের সহজিয়া সিদ্ধি :
.
'আমি কীভাবে কলম ধরব ভয় হয়, বিভিন্ন শব্দে শিল্প, অনুরাগ
নিয়ন্ত্রণ সহজসাধ্য কি হবে? তাই ভাবি, নাহ্ --
কিছুই বলব না;
বরং এসো ভাতের গল্প করি'।
.
পেঁচার কথায় চলে আসে রাতের কথাও --- তাঁর কবিতা যে রাত্রির ভাষায় কথা বলে! হয়তো কাকজোছনার নীচে নৈশভোজের আসর জমে ওঠে সেখানে। স্বপ্নে ও সংগমে লীন হতে হতে ধু ধু নিঃসঙ্গ জ্যোৎস্নায় হাত ধরে হেঁটে যায় মানুষ শূন্য নদীর বুকে। নারীশরীরের উনোনে জ্বলে রাখ হয়ে যায় পুরুষরূপী কাঠ, লেখার টেবিল থেকে উড়ে যায় নীল পদ্য, ছাতিম গাছের নীচে পুঁতে-রাখা যত কেচ্ছা, ধুয়া আর কালের ইন্ধন'।
.
'চোখের ভেতরে চোখ বুনো মহিষের মতো
নেমে যায় জলে
ধুয়ে নেয় শেষ রিপু তারার আলোয় চিনে চলে যায় দিকশূল' ---
.
'শেকড়, স্বপ্ন ও সাপ আর মহিলাকে ভালোবাসা অন্ধকারেই খুব ক্রিয়াশীল হয়।' এই অন্ধকার তাঁর কাছে এক স্বচ্ছতার পটভূমি: 'অন্ধকার কি এর চেয়ে ভালো নয়, স্বচ্ছ নয়, অর্থপূর্ণ নয়?' মধ্যরাতের হাওয়াবাতাসের মধ্যে হেঁটে বেড়ায় অমৃতকলস-কাঁখে এক জাদুবুড়ি : 'সন্ধ্যায় বাংলোর মুখে যে ঋতুহীন চাঁপাগাছ অভ্যর্থনা করেছিল, মধ্যরাত্রিতে সেই মধুমতী হল'। কখনো আবার আত্মবিষে নীল হতে হতে শ্লেষে, অসহায়তায়, ক্রোধে, বিপন্নতায় তাঁকে বলে উঠতে হয় :
.
'এই রাত্রির যে এক একান্ত ব্যক্তিগত রস আছে তা আমি এইভাবে পাণ্ডুলিপিতে রেখে যাচ্ছি কেন? এত নীচে তলিয়ে যাচ্ছি কেন? কোন অবদমন থেকে এসব আসে? ওই তো টিলার বস্তি থেকে কালো ধোঁয়ার আকারে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে স্নেহ। কোন অনির্দেশ্যের দিকে তিন জোড়া শিশুকঙ্কালের হাত প্রার্থনা করে? আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি একটি নড়বড়ে কঙ্কালের ঘাড়ের ওপরে আরোপিত জীবন্ত মাথাটি বার বার নুয়ে পড়ছে সামনে। তারই চেতনার রঙে এ পৃথিবী কালো হচ্ছে, মহাশূন্য এদের কোথায় রাখবে?
আমাকে বাঁচার জন্য আরও দূরে সরে যেতে হবে। আমি বাঁচলেই দিব্যদৃষ্টি খুলে যাবে কাকতাড়ুয়ার।'
.
যত দিন গেছে টানা গদ্যের ওপর তাঁর ভর গেছে বেড়ে। তাঁর জোরালো উচ্চারণ, তাঁর বিকল্প ঈশ্বরের সন্ধান না হলে পথ হারাত। এই গদ্যলেখা কিন্তু অনন্য এক শৈলী! গল্প, জার্নাল, বা খবরকাগজের মতো সেটা একেবারেই নয়। তার প্রতিটি পঙ্ ক্তির আছে আগুনফড়িঙের অচেনা দুই বর্ণময় ডানা, ঘটনা পেরিয়ে যা এক কালসমুদ্রের ওপর ভেসে যেতে পারে, বিরহের অন্ধকার আরও গভীর ভাবে ছড়িয়ে দিতে পারে। ওই তো শব্দের সেই বাঘ সামনে ছোটে তাঁর, মাথায় যার আগুনভাণ্ড। -- ধূপ, না কি তার সুরভি, ধোঁয়া-ওঠা শরীরে গাছপালা ভেঙে লতাবিতানে সেজে ওঠে! আহ্ গ্রন্থাতীত! ওই যে শব্দের বাঘ সমানে ছুটে চলেছে। রাত্রির পেঁচা আজ ভয়াবহ ডাক দিয়ে ওঠে। ডেকে যায়, ডেকে নিয়ে যায় তার গর্ভগৃহ অন্ধকারে। কী যেন এক অমীমাংসিত হাওয়া খেলে বেড়াচ্ছে সেখানে...
.
ঋণ :
নিত্য মালাকারের কবিতা সংগ্রহ
অস্ট্রিক প্রকাশন

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in








ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণের স্বামী বিবেকানন্দ অন্যতম পুরোধা । তিনি হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য। তার পূর্বাশ্রমের নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত।

স্বামী বিবেকানন্দের জীবন দর্শন শিক্ষা , ধর্ম,সমাজ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে। তিনি একজন সন্ন্যাসী হয়েও
মানুষের শিক্ষা, ধর্ম, সমাজ ইত্যাদিকে নিয়ে তার অমূল্য দর্শনকে তুলে ধরেছেন মানবিক ভঙ্গিতে, যা মানব কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। এমনভাবে কোন সন্ন্যাসী মানবতার দর্শন ও সমাজ সংস্কারের বাণী প্রচার করেছেন বলে মনে হয় না।

স্বামী বিবেকানন্দ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে হিন্দুধর্ম তথা ভারতীয় বেদান্ত ও যোগ দর্শনের প্রচারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। অনেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক স্থাপন এবং হিন্দুধর্মকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্ম হিসেবে প্রচার করার কৃতিত্ব বিবেকানন্দকে দিয়ে থাকেন। বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।তার সবচেয়ে বিখ্যাত বক্তৃতাটি হল, "আমেরিকার ভাই ও বোনেরা ...," ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় প্রদত্ত চিকাগো বক্তৃতা, যার মাধ্যমেই তিনি পাশ্চাত্য সমাজে প্রথম হিন্দুধর্ম প্রচার করেন।

জীবনের দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করার আগে তার ব্যক্তি জীবনের উপর বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে করি।

বিবেকানন্দের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত (ডাকনাম ছিল বীরেশ্বর বা বিলে এবং নরেন্দ্র বা নরেন)। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ১২ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তি উৎসবের দিন উত্তর কলকাতার সিমলা অঞ্চলে ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।তার পিতা বিশ্বনাথ দত্ত কলকাতা উচ্চ আদালতের একজন আইনজীবী ছিলেন। বিবেকানন্দ একটি প্রথাগত বাঙালি কায়স্থ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যেখানে তার নয় জন ভাই-বোন ছিল।তার মধ্যম ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও বিদেশ ভ্রমণে বিবেকানন্দের সঙ্গী। কনিষ্ঠ ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বিশিষ্ট সাম্যবাদী নেতা ও গ্রন্থকার।

ছেলেবেলা থেকেই আধ্যাত্মিকতার দিকে নরেন্দ্রনাথের আগ্রহ ফুটে ওঠে।স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শন প্রধানত মানবকেন্দ্রিক। উপনিষদ থেকেই তিনি এ শিক্ষা নিয়েছিলেন। মানুষকে নানা স্তরে বিশ্লেষণ করে, প্রত্যেক স্তরের পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে অবশেষে মানুষের নিগূঢ়তম সত্যের পরিচয় প্রদানই উপনিষদের লক্ষ্য। স্বামী বিবেকানন্দ মানুষকে উপনিষদের দৃষ্টি দিয়েই দেখতেন। মানুষের দেহ-মন আশা-আকাঙ্ক্ষা কোনটাই অবহেলা করার নয়- কিন্তু তার অন্তরতম সত্য সর্বাপেক্ষা আদরণীয়। মানুষ যদি এই সত্যকে ভুলে তার বাহিরের সত্যগুলোকেই বড় করে তুলতে চায় তা হলে সে শ্রেয়ের পথ থেকে বিচ্যুত। সে নিজের ব্যক্তিগত কল্যাণকে সম্পূর্ণ সমৃদ্ধ করতে তো পারবেই না উপরন্তু সমাজকল্যাণকেও সে পদে পদে ব্যাহত করবে। কেননা, মানুষের দৈবসত্তাকে বাদ দিলে মানুষ স্বার্থপর হতে বাধ্য। হিংসা, ঘৃণা, লোভ, দম্ভ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক। স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন মানুষের দেবত্ব-উপলব্ধি ব্যাপকভাবে অভ্যাস করার সময় এসেছে। মানুষের শ্রেষ্ঠ সত্য তার জীবনের সর্বস্তরে প্রয়োগ করা যায় এবং করতে হবে। নতুবা মানবসভ্যতার সমূহ সঙ্কট। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শনে এই প্রয়োগের নাম ‘কর্ম-পরিণত বেদান্ত’ । এছাড়া স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শনে ‘অভয়’ একটি প্রকৃষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। তাঁর মতে, সাহস ও শক্তিমত্তা সর্বস্তরেই মানুষকে অগ্রগতিতে সাহায্য করে। সেজন্য তিনি কি ব্যক্তিগত, পরিবারগত অথবা সমাজগত, শিক্ষাগত কিংবা ধর্মগত সকল ক্ষেত্রেই উদ্যম, সাহস এবং নির্ভিকতার অনুশীলনের কথা বলতেন। তাঁর জীবনদর্শনের অন্যতম প্রতিজ্ঞা—সকল মানুষের অন্তরশায়ী আত্মা যিনি সর্বশক্তির আকর, চিরমুক্ত, চিরস্বচ্ছ, তাঁর জাগরণই মানুষের সকল কল্যাণের নিদান। বলেছেন তিনি, “উপায় শিক্ষার প্রচার। প্রথমত আত্মবিদ্যা—ঐ কথা বললেই যে জটাজূট, দণ্ড, কমণ্ডলু ও গিরিগুহা মনে আসে, আমার বক্তব্য তা নয়। তবে কি? যে জ্ঞানে ভববন্দন হতে মুক্তি পর্যন্ত পাওয়া যায়, তাতে আর সামান্য বৈষয়িক উন্নতি হয় না? অবশ্যই হয়। মুক্তি, বৈরাগ্য, ত্যাগ এসকল তো মহাশ্রেষ্ঠ আদর্শ; কিন্তু ‘স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ’। এই আত্মবিদ্যার সামান্য অনুষ্ঠানেও মানুষ মহাভয়ের হাত হইতে বাঁচিয়া যায়। মানুষের অন্তরে যে শক্তি রহিয়াছে, তাহা উদ্বুদ্ধ হইলে মানুষ অন্নবস্ত্রের সংস্থান হইতে আরম্ভ করিয়া সব কিছুই অনায়াসে করিতে পারি।” “এই শক্তির উদ্বোধন করিতে হইবে দ্বারে দ্বারে যাইয়া। দ্বিতীয়ত সেই সঙ্গে বিদ্যাশিক্ষা দিতে হইবে।” তার শিক্ষা দর্শন অসাধারণ, যা মানব জীবনকে পূর্ণতা দান করে।

স্বামী বিবেকানন্দ মানুষকে শুধু ইতিবাচক শিক্ষা দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। কারণ তিনি মনে করতেন, নেতিবাচক চিন্তাগুলি মানুষকে দুর্বল করে দেয়। তিনি বলেছিলেন, যদি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সবসময় দোষারোপ না করে উৎসাহিত করা হয়, তবে তারা এক সময় উন্নতি করবেই।
নিউ ইয়র্কে বিবেকানন্দ দেখেছিলেন, আইরিশ উপনিবেশ-স্থাপকরা খুবই খারাপ অবস্থায় খুব সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে ভয়ে ভয়ে সেখানে এসেছিল, কিন্তু মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই তাদের পোষাকপরিচ্ছদ আচারব্যাবহার সব পালটে যায়। তখন তাদের মধ্যে সেই ভয়ভীতির ভাব সম্পূর্ণ তিরোহিত হয়েছিল। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বিবেকানন্দ দেখেন যে, যদি বেদান্তের দৃষ্টিকোণ থেকে এটাকে ব্যাখ্যা করতে হয়, তাহলে বলতে হবে সেই আইরিশেরা স্বজাতীয়দের দেয়ারা পরিবেষ্টিত ছিল এবং সবাই তাকে বলছিল, "প্যাট, তোমার কোনো আশা নেই, তুমি ক্রীতদাস হয়ে জন্মেছো এবং তাই থাকবে।" এই কারণে তার মনে হীনম্মন্যতা এসেছিল। কিন্তু আমেরিকায় আসার পর থেকে সবাই তাকে বলতে শুরু করল, "প্যাট, তুমিও মানুষ আমাদের মতো। মানুষই সব করে। তোমার আমার মতো মানুষেরাই করে। তাই সাহসী হও!" সেই জন্যই সে মাথা তুলে আত্মমর্যাদায় ভর করে চলছে। তাই বিবেকানন্দ বলেছেন, ম্যাকলের শিক্ষাব্যবস্থা ও ভারতীয় বর্ণব্যবস্থা ছেলেমেয়েদের নেতিবাচক শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষা থেকে তারা আত্মনির্ভরতা ও আত্মমর্যাদার শিক্ষা পায় না। বিবেকানন্দের মতে, একমাত্র ইতিবাচক শিক্ষাই তাদের দেওয়া উচিত।

স্বামী বিবেকানন্দের জীবন দর্শনের পরিচয় পাই আমরা তার বাণী থেকে।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন , “ উপনিষদের প্রতি পাতায় আমাকে যার কথা বলা হয়েছে তা হল সাহস । এইটিই সবচেয়ে মনে রাখবার কথা । আমার জীবনে এই একটি বড়াে শিক্ষাই আমি নিয়েছি । হে মানুষ ! বীর্যবান হও , দুর্বল হােয়াে না ! ”

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন , “ জাতি হিসেবে আমরা যা কিছু । পেয়েছি সবই আমাদের দুর্বল করেছে । ” মনে হয় সেই সময় জাতির জীবনের একটিই উদ্দেশ্য ছিল , কী করে আমাদের দুর্বল থেকে দুর্বলতর করা যায় । শেষ পর্যন্ত আমরা কেচোতে পরিণত হয়েছি , যে কেউ তরবারি দেখিয়ে আমাদের পদানত করেছে তার । পায়ের তলায় থাকবার জন্যে ।

আমি যা চাই তা হল লৌহনির্মিত পেশী এবং স্বাস্থ্য । শক্ত ধাতুতে নির্মিত মন । পৌরুষের পূজা করাে ।

সব শক্তি তােমার মধ্যে আছে । তুমি সব কিছু করতে পার , তা বিশ্বাস করাে ভেবােনা তুমি দুর্বল । তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার । কারও নির্দেশ ছাড়াই । সবশক্তি তােমার মধ্যে আছে । উঠে দাঁড়িয়ে | তােমার ভিতরকার দেবত্বকে প্রকাশ করাে ।

তােমার দেশ বীর চায় , বীর হও । পাহাড়ের মত দৃঢ় হও । সত্য সর্বদা জয়ী হয় , দেশের লােক যা চায় তা হল জাতির ধমনীতে বিদ্যুৎ প্রবাহ , দেশের মধ্যে প্রাণশক্তি জাগিয়ে তুলতে হবে । সাহসী হও , মৃত্যু একবারই আসে । হিন্দুদের ভীরু হলে চলবে না । ভীরুতা আমি ঘৃণা করি । মনে গভীর শান্তি বজায় রাখাে । তােমার বিরুদ্ধে বালখিল্যের কী বলল তার দিকে ভ্রুক্ষেপ করাে না । অগ্রাহ্য করাে ! অগ্রাহ্য করাে অগ্রাহ্য করাে ! সমস্ত বড়াে বড়াে কীর্তিই স্থাপিত হয়েছে বিশাল বিশাল বাধা অতিক্রম করে । পুরুষ ব্যঘের মত চেষ্টা করাে ।

বন্ধু , ক্রন্দন করছ কেন ? সমস্ত শক্তি তােমার মধ্যেই আছে , তােমার সর্বশক্তিমান স্বভাবকে জাগ্রত করাে । তাহলে সমগ্র বিশ্ব তােমার পায়ের তলে লুটিয়ে পড়বে । মুর্খরা কাতরস্বরে বলে , “ দুর্বল আমরা দুর্বল ” । জাতি চায় কাজ এবং বৈজ্ঞানিক প্রতিভা । আমাদের প্রয়ােজন মহৎ আত্মা , প্রবল শক্তি এবং অসীম উৎসাহ । উদ্যোগী পুরুষসিংহেরই লক্ষ্মীলাভ হয় । পিছনে তাকানাের প্রয়ােজন নেই , আমরা চাই অসীম প্রাণশক্তি , অসীম উৎসাহ , অসীম । সাহস এবং ধৈর্য । একমাত্র তাহলেই বড়াে কিছু সাধিত হতে পারে ।

বেদ কোনও পাপ স্বীকার করে না , একমাত্র ভুল স্বীকার করে । বেদের মতে সব চেয়ে বড়াে ভুল এ কথা বলা যে তুমি দুর্বল , তুমি । পাপী , এক হতভাগ্য জীব , তােমার কোনও শক্তি নেই , তুমি এই কাজ , কি ওই কাজ করতে পার না ।

শক্তিই জীবন , দুর্বলতা মৃত্যু , শক্তি সুখ , জীবন অনন্ত মৃত্যুহীন । দুর্বলতা সর্বক্ষণের কষ্টভােগ , দুর্বলতা মৃত্যু । সদর্থক মনােভাবসম্পন্ন । হও , শক্তিশালী হও । শৈশব থেকেই এমন সব চিন্তা তােমার মস্তকে প্রবেশ করুক যে চিন্তা সহায়তাকারী । দুর্বলতাই দুঃখ ভােগের । একমাত্র কারণ । আমরা দুঃখভােগ করি , কারণ আমরা দুর্বল । আমরা মিথ্যা বলি , চুরি করি , খুন করি , অন্যান্য অপরাধ করি তার কারণ - আমরা দুর্বল , আমরা যন্ত্রণা পাই কারণ - আমরা দুর্বল । আমাদের মৃত্যু হয় কারণ আমরা দুর্বল । যেখানে দুর্বলতার কারণ । নেই , সেখানে মৃত্যু নেই , দুঃখ নেই , একমাত্র প্রয়ােজন শক্তি । শক্তি । জগতের ব্যাধির ঔষধ । প্রবলের দ্বারা অত্যাচারিত দুর্বলের ঔষধ শক্তি । বিদ্বানের দ্বারা অত্যাচারিত অজ্ঞ ব্যক্তির ঔষধ শক্তি । এক পাপী যখন অন্য পাপীর দ্বারা অত্যাচারিত হয় তার ঔষধ শক্তি । উঠে দাঁড়াও , সাহসী হও , শক্তিমান হও , সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নাও এবং জানাে , যে তুমি তােমার ভাগ্যের নিয়ন্তা । যত শক্তি , যত সহায়তা আমাদের চাই , সব তােমার নিজের মধ্যেই আছে । অতএব নিজের ভবিষ্যৎ নিজে গঠন করাে ।

সারাক্ষণ যদি মনে করি আমরা ব্যধিগ্রস্ত , ব্যাধি সারবে না । দুর্বলতার কথা মনে করিয়ে দিলে বিশেষ সহায়তা হয় না । সারাক্ষণ দুর্বলতার কথা । ভাবলে শক্তি আসে না , দুর্বলতা নিয়ে চিন্তা করলে তাতে দুর্বলতার অবসান হয় না , শক্তি নিয়ে চিন্তা করলে দুর্বলতার অবসান হয় ।

এই জগতে এবং ধর্মের জগতে এই সত্য । ভয়ই অধঃপতনের এবং পাপের নিশ্চিত কারণ । ভয়ই দুঃখকে ডেকে আনে । ভয়ই । মৃত্যুকে ডেকে আনে , ভয়ই অশুভের জন্ম দেয় ।

ভয় কোথা থেকে আসে ? আমাদের স্বভাব সম্পর্কে অজ্ঞতা থেকে । আমরা প্রত্যেকে রাজাধিরাজের অর্থাৎ ঈশ্বরের যুবরাজ । । জেনে রাখাে , সমস্ত পাপ , সমস্ত অশুভকে এক কথায় বলা যায় । দুর্বলতা । সমস্ত মন্দ কাজের পিছনে শক্তি জোগাচ্ছে দুর্বলতা । সমস্ত স্বার্থপরতার উৎস দুর্বলতা । দুর্বলতার কারণেই মানুষ মানুষকে আঘাত । করে , দুর্বলতার কারণেই মানুষ যা নয় নিজেকে সেই ভাবে দেখায় ।

আমাদের জনসাধারণের এখন যা প্রয়ােজন তা হল লােহার পেশী , ইস্পাতের স্নায়ু , প্রচণ্ড এক ইচ্ছা শক্তি , যাকে কিছুতেই প্রতিরােধ করতে পারে না , যা বিশ্বের রহস্য ভেদ করে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে , যে কোনােভাবেই হােক , তার জন্যে যদি সাগরের তলে যেতে হয় , মৃত্যুর মুখােমুখি দাঁড়াতে হয় , তবুও ।

আমরা অনেক দিন ক্রন্দন করেছি , এখন নিজের পায়ে দাড়াও , মানুষ হও । আমাদের প্রয়ােজন এমন ধর্ম যা মানুষ তৈরি করে । আমাদের প্রয়ােজন এমন তত্ত্ব যা মানুষ তৈরি করে । আমাদের এমন সর্বাঙ্গীণ শিক্ষা প্রয়ােজন যা মানুষ তৈরি করে এবং এইখানেই সত্যের পরীক্ষা । যা কিছু তােমাকে শারীরিকভাবে , বুদ্ধি বৃত্তিকে আত্মিক শক্তিকে দুর্বল করে , তাকে খারিজ করাে । যাতে প্রাণ নেই , তা সত্য হতে পারে না । সত্য শক্তি দেয় , সত্য পরিত্রাতা , সত্য । সকল জ্ঞান । সত্য অবশ্যই শক্তিদাতা আলােকদাতা ।

আমরা তােতা পাখির মতাে অনেক কথা বলি , কিন্তু কাজ করি । । কথা বলা , কাজ না করা আমাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে । তার কারণ কী ? শারীরিক দুর্বলতা । এরকম দুর্বল মস্তিষ্ক কোনও কাজ করতে পারে না । মস্তিষ্কের শক্তি আমাদের বাড়াতে হবে । সর্ব প্রথম আমাদের যুবকদের সবল হতে হবে । ধর্ম আসবে তার পরে , কৃষ্ণের । বিশাল প্রতিভা ও বিশাল শক্তি তােমরা তখনই উপলব্ধি করতে পারবে যখন তােমাদের ধমনীতে শক্তিশালী রক্ত প্রবাহিত হবে । । তােমরা উপনিষদ এবং আত্মার মহিমা আরও ভাল করে বুঝতে পারবে , যখন তােমাদের শরীর তােমাদের পায়ের উপর শক্ত হয়ে । দাঁড়াতে পারবে এবং তােমরা অনুভব করবে যে তােমরা মানুষ ।

নীতি - পরায়ণ হও , সাহসী হও , সর্বান্তঃকারণে কঠোরভাবে নীতি - পরায়ণ মানুষ হও , সাহসী হও , বেপরােয়া হও । কাপুরুষেরা পাপ করে , সাহসীরা কখনােই নয় । প্রত্যেককে , সকলকে ভালােবাসার চেষ্টা করাে ।

উঠে দাঁড়াও , জোয়ালে কাঁধ লাগাও । জীবন কত দিনের ? একবার যখন পৃথিবীতে এসেছ , একটা চিহ্ন রেখে যাও । তা না হলে গাছ আর পাথরের সঙ্গে তােমার তফাৎ কী ? তারাও জন্মায় , তারাও ক্ষয়প্রাপ্ত হয় , মারা যায় ।

সাহসী হও । আমার সন্তানেরা সবার উপরে সাসী হবে । কোনাে কারণে একটুও আপােস নয় । সর্বোচ্চ সত্য শেখাও। সম্মান হারানাের ভয় কোরাে না , অপ্রিয় সংঘাত সৃষ্টি করাকে ভয় করাে । না । জেনে রাখাে , সত্যকে ত্যাগ করার প্রলােভন সত্ত্বেও সত্যের সেবা করতে হবে ।

স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়া আর কোন সন্ন্যাসী যুবাদের উদ্দেশ্যে এমন উপদেশ দেননি, এজন্যই তিনি মানবতাবাদী সমাজ সংস্কারক।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in







বেলা বারোটা নাগাদ লোকজন বেরিয়ে এলো কাজের জায়গা থেকে। বাসে ট্রামে একেবারে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি অবস্থা। পুলিশগুলো রাজপথের চৌমাথার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে সাদা দস্তানা পরে যান নিয়ন্ত্রণ করছে। সাইকেল আরোহীরা গাড়িগুলোর ফাঁকফোকর গলে গলে সিগন্যালের সামনে গিয়ে লাইন দেবার চেষ্টা করছে। নতুন করে মানুষের স্রোত বেরিয়ে আসছে অফিসবাড়িগুলোর খোলা দরজা দিয়ে। আরও মানুষ এসে ফুটপাথের ভিড়ে অশান্ত ভাবে হেঁটে যাওয়া মানুষগুলোর সঙ্গে যোগ দিয়ে ভিড় বাড়িয়ে তুলছে।

একজন ছোটখাট চেহারার তরুণী ভিড়ে অপেক্ষমান গাড়িগুলির মধ্য দিয়ে পথ করে চলে যাবার চেষ্টা করে। একটা গাড়িতে ড্রাইভারের সিটে বসে থাকা এক তরুণ তাকে সতর্ক করে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে। সেই তরুণের মাথায় কোনো টুপি নেই। গাঢ় রঙের চুলের গুচ্ছ এসে পড়েছে কপালে; তার গায়ের রঙ রোদ্দুরে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে, এমনকি তার হাতগুলো অবধি বাদামি; স্টিয়ারিংয়ের উপরে রাখা হাতে সে কোনো দস্তানা পরেনি, ফলে তার গায়ের রঙ বোঝা যাচ্ছে। অবশেষে ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যাল ছেড়ে দেওয়ার পরে সেই তরুণ, গের্ট যার নাম, সে অধৈর্য ভঙ্গিতে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে যানজটের লাইন ধরে চৌমাথার দিকে চলে গেল। এর মধ্যে এক গলিপথ ধরে এক সদ্যতরুণ, তার নাম বের্নহার্ড, সে এসে পড়ল বড় রাস্তায়। তার পিয়ানো শেখার ক্লাস ছিল; বাঁ হাতে সে আঁকড়ে ধরে আছে স্বরলিপির ফাইলটা। তারও মাথাতেও কোনও টুপি নেই; কিন্তু তার সোনালি চুল সুন্দরভাবে আঁচড়ানো, ফলে তার ফ্যাকাশে কপালটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সে পথে কোনওদিকে বিশেষ তাকাচ্ছে না। সে মনে মনে জানে যে তার চলার পথের শেষে এক শান্ত নিরালা পাড়ায় একটা বিশাল চওড়া ফটকের পেছনে তার ঠাকুমার বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে তাকে স্বাগত জানাবার জন্য। এর মধ্যে মানুষজন এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। রাস্তাটা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেছে। কিছু বিড়াল পথে দৌড়াদৌড়ি করছে। পথের ধারে রেস্তরাঁগুলো ভরে উঠছে এখন। পথ দিয়ে যেতে যেতে থালাবাসন ছুরি কাঁটার ঠুংঠাং ঝনঝন এরকম নানা শব্দ শোনা যাবে। পরিবেশনকারী মেয়েরা, ওয়েটারেরা দৌড়াদৌড়ি করছে রেস্তরাঁয়। খাবার ডেলিভারি করবার জানালাগুলোতে উঁচু হয়ে উঠছে খাবারের ট্রের স্তর। গৃহস্থের বাড়ি হোক বা রেস্তরাঁ, রান্নাঘরের চিমনিগুলো দিয়ে একনাগাড়ে ধোঁয়া বেরচ্ছে। অপেক্ষাকৃত ফাঁকা আবাসিক এলাকাগুলোতে কালো রঙের স্যুটপ্যান্ট পরা অফিসবাবুরা নেমে যাচ্ছেন নিজেদের গাড়ি থেকে। গাড়ির চালক অভিবাদন জানিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়ি চালিয়ে, চাকার নিচে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে পথের নুড়ি পাথর, জানালার বন্ধ গ্রিলের ওপাশে কুকুরেরা চিৎকার করে কোথাও কোথাও।

সাদা কুকুর, যার নাম ফ্লক, সে ইনেস নামের তরুণীর গায়ের উপরে আহ্লাদে লাফিয়ে উঠল। ফ্লক দৈনন্দিন ভ্রমণের পরে পথের সব ধুলো গায়ে মেখে ভারি নোংরা হয়ে এসেছে। তাকে একপাশে সরিয়ে ইনেস বাড়ির সামনের দরজা খুলে ঢোকে। একজন তরুণ গৃহসহায়ক তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে ফ্লকের কলার ধরে নিয়ে যায় এবং ইনেসকে জানায় যে বাড়ির মালিক ইতিমধ্যেই খাবার ঘরে চলে এসেছেন। ইনেস নিজের ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ায়। তারপর দৌড়ে যায় খাবার ঘরে, যেখানে গৃহসহায়ক এর মধ্যেই খাবার পরিবেশন করতে শুরু করেছে। ইনেসের বাবা তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সে বাবার গালে চুমু খায়।

শহরে মধ্যদিনের শান্তি বিরাজ করে।

বের্নহার্ড… এই সদ্যতরুণ, যাকে বন্ধুমহলে সবাই ডাকে ‘বের্শেন’ বলে, সে এখন বিকেলবেলা তার ঠাকুমার বাড়িতে পিয়ানোর সামনে বসে আছে। সে পিয়ানোতে বসে অভ্যেস করছে আবার। আজকের ক্লাস ভালই হয়েছিল। কিন্তু পিয়ানোর শিক্ষক বলেছেন যে উঁচু স্কেলে গিয়ে তার বাজনা যেন ঠোক্কর খেতে খেতে যাওয়া এক এবড়োখেবড়ো পথ। শিক্ষক বলেছেন যে মসৃণ সমতল অ্যাসফাল্‌ট করা রাজপথের মত হওয়া দরকার বাজনার চলন। এমন অদ্ভুত হাতে কলমে তুলনা শুনে বের্নহার্ড স্থির করেছে যে প্রতিদিন অন্তত ঘণ্টা খানেক স্কেল অনুশীলন করা প্রয়োজন তার। স্কেল অভ্যাস করবার পরে নিজের পরিতৃপ্তির জন্য, পরিতোষের জন্য সে বাখের একটি অত্যন্ত কঠিন অথচ আনন্দদায়ক ফিউগ১ বাজাবে সে। বাখ সম্বন্ধে এই সেদিন অবধি তার কোনো উচ্চ ধারণা দূরে থাক, বিশেষ কোনও ধারণাই ছিল না। কিন্তু এখন বাখ সম্বন্ধে জানতে পেরে তার মনে হচ্ছে সে একেবারে ভেসে যাবে সুরের নদীতে। উদাহরণস্বরূপ, বাখের ‘দাস ভলটেম্‌পেরিয়ের্তে ক্লাভিয়ের’ এই কম্পোজিশনের চতুর্থ ফিউগ তার মনে এক লাজুক এবং নির্মল পবিত্রতার ভাব নিয়ে আসে। তার অনুভবে এমন চিন্তা আসে, মনে হয় যেন বাস্তব পৃথিবী থেকে অনেক দূরে এক ঐন্দ্রজালিক কল্পনার জগতের সন্ধান সে পেয়ে গেছে।

প্রথমে বের্নহার্ড স্কেল বাজানো অভ্যেস করে। তার শিক্ষক অবিরাম ধৈর্য এবং উত্তেজনাপূর্ণ স্থৈর্যের সঙ্গে তাকে যেসব জিনিস শিখিয়েছেন, সেই অনায়াস অথচ নিখুঁতভাবে পিয়ানোর রিড স্পর্শ করা, হাতের মসৃণ ও অবিশ্রান্ত চলনের ক্রিয়া, সবকিছু মনে করে বারবার প্রয়োগ করবার চেষ্টা করে যায় সে। তার শিক্ষক তাকে বুঝিয়েছেন যে প্রায় পিয়ানোর ভেতরে প্রবেশ করে যেতে হবে, যাতে প্রতিটি স্বরকে সে স্পর্শ করতে পারে, আকার দিতে পারে এবং অন্তরে ধারণ করতে পারে। ‘ইল ফো মোদলি লে পিয়ানো’২ … শিক্ষক প্রায় মুদ্রাদোষের মত বারেবারে বলেন এই কথাটা, যেটা তিনি প্যারিস থেকে তার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। তিনি জাতে ফরাসি এবং অদূর ভবিষ্যতে তিনি ফ্রান্সে নিজের অখ্যাত এবং বঞ্চিত ছোট শহরে ফিরে যাবেন। ছাত্র বের্নহার্ডকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবার ইচ্ছে আছে তার। সব ছাত্রের মধ্যে একমাত্র এই জার্মান তরুণের প্রতিভার সমাদর করেন এবং তার ভবিষ্যতের শিক্ষার দায়িত্বটুকু আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে চান তিনি।

বের্নহার্ডেরও যথেষ্ট ইচ্ছে আছে তার শিক্ষকের সঙ্গে ফ্রান্সে যাবার; কিন্তু সে জানে না যে আদৌ শেষ অবধি তার বাবা মা এই ব্যাপারটা অনুমোদন করবেন কি না, কারণ তাদের কাছে এই পরিকল্পনাটা অদ্ভুত বলে মনে হয়। তার বয়স সবে সতেরো, এখনও স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি সে এবং নিজের বাবা মাকে সে বেশ মেনে চলে। তাছাড়া এটাও হতে পারে যে দেশের বাইরে পড়াশুনো করতে যাবার জন্য যতখানি টাকাকড়ির প্রয়োজন, সেটা হয়তো তার বাবা মায়ের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। যদিও গ্রামে বেশ বড় বাড়িতে এবং গাড়ি ঘোড়া ইত্যাদি নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে তারা বসবাস করে, তবুও বাবার বেশ কিছু কথায় বের্নহার্ডের মনে হয়েছে যে টাকাপয়সা একটা বড় কারণ এই ক্ষেত্রে। নিজেদের যতখানি স্বচ্ছল বলে অতীতে তার মনে হত, আদপে যদি সেরকম সচ্ছলতা এখন নাও থাকে, সেটা নিয়ে বের্নহার্ড একেবারেই চিন্তিত নয়। তার বেশির ভাগ বন্ধুদের বিশেষ টাকাকড়ি নেই; যেমন সঙ্গীতবিদ্যালয়ের ছাত্র ফার্দিনান্দের কথাই ধরা যাক না কেন! কিন্তু তার বাজনা? আহা, তার বাজনা মনে এমন আনন্দ এবং উচ্চ ভাবনা জাগিয়ে তোলে, যার কোনো তুলনা নেই। গের্ট অবশ্য নিজে গাড়ি চালিয়ে আসে, বাবা মা যথেষ্ট ধনী। ইনেসও বেশ ধনী এবং আহ্লাদী, নাকউঁচু এবং স্বাধীনচেতা প্রকৃতির। ফলে ইনেস কোথাও কোনো সমস্যায় পড়েছে এরকম ভাবনা একেবারেই অবাস্তব। গের্ট এবং ইনেস হল ব্যতিক্রম। বাকিরা বেশিরভাগ মাসের শেষে একটা ছোট পাবে খেতে যায়, যেখানে আনা নামে একটা মেয়ে খাবার পরিবেশন করে এবং সেই পাবে সসেজ আর বিয়ার ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না।

বের্নহার্ডের চেনাজানার মধ্যে আরও অনেকেই আছে, যাদের পোশাক আশাক সবসময়ই বেশ ভালো এবং তারা নিয়মিত বেশ ভালো হাতখরচ পায় বাড়ি থেকে। এরা হচ্ছে তার স্কুলের সহপাঠী। কিন্তু এরা বেশির ভাগ তার কাছে ততখানি চেনাজানা নয়; অর্থাৎ সঙ্গীতবিদ্যালয়ের ফার্দিনান্দ এবং অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের সে তার স্কুলের সহপাঠীদের চেয়ে ভালো চেনে। অবশ্য এক দু’ জন আছে স্কুলের সহপাঠী, যারা তার বন্ধু; যেমন কার্ল নামে একটা ছেলে আছে, যার বাবা মা তাকে সপ্তাহে একদিন দুপুরে খেতে ডাকেন এবং তারা একসঙ্গে ল্যাটিন ভাষার হোমওয়ার্ক সারে। এছাড়াও আছে ছোটখাট বাচ্চা বাচ্চা দেখতে হালকা ব্লন্‌ড চুলের হান্স আহ্লব্যের্গ, যার মা বেশ সুন্দরী, লম্বা। হান্সের মায়ের হাত খুব নরম, হাতের পাতাদুটোর ভেতরের অংশ একদম ভেলভেটের মত কোমল। বের্নহার্ডের মনে আছে একবার তিনি তার জ্বর হয়েছে শুনে দেখতে এসেছিলেন, তারপর তার উত্তপ্ত কপালে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। স্কুলে কেবলমাত্র কার্ল এবং হান্স আহ্লব্যের্গের সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব; কারণ আসলে বের্নহার্ড একটা দ্বিধাবিভক্ত জীবনে বেঁচে আছে। বের্নহার্ডের জীবনে সেই অর্থে স্কুলের কোনো ভূমিকা নেই, বরঞ্চ সে সঙ্গীত, তার হৃদয়ের অভিলাষ, তার ভালো লাগা নিয়েই ভবিষ্যৎ জীবনে অগ্রসর হতে চায়। তবে বের্নহার্ড কোনো ভাবেই খারাপ ছাত্র নয়। চট করে যেকোনো জিনিস শিখতে পারে সে, যথেষ্ট পরিশ্রমী ছাত্র। তবে পাঠ্যবিষয়ের ভালোলাগার ব্যাপারটা তার ক্ষেত্রে আবার শিক্ষকের উপরে অনেকখানি নির্ভরশীল, বিশেষত অঙ্ক। অদূর অতীতে অঙ্ক নিয়ে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কোনো ধ্যানধারণা মাথায় ঢুকছিল না তার; অবশেষে এক তরুণ শিক্ষক এলেন স্কুলে, যার বোঝানোর পদ্ধতি খুব ভালো। বিশেষ কোনো চেষ্টা ছাড়াই সেই শিক্ষকের সুন্দর কণ্ঠস্বরের লেকচার শুনে সে বুঝতে পারে আজকাল সব। অতীতে যে সব অধ্যায়গুলো তার কাছে দুর্বোধ্য বলে মনে হত, এখন সেগুলো ক্রমেই সহজ বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। দৈনন্দিন জীবন থেকে নেওয়া এমন সুন্দর উদাহরণ দিয়ে এই শিক্ষক সবকিছু বুঝিয়ে দেন যে অঙ্কের মূল প্রণালীগুলো সহজেই সবাই বুঝতে পারে। এত সহজ জিনিসগুলো এত জটিল কেন ভেবেছিল তারা এতদিন, সেটা জেনেই ভারি অদ্ভুত লাগতে থাকে তার ক্লাসের সবার। অঙ্ক বিষয়টিকে ভারি রোমাঞ্চকর বলে মনে হয়। সমগ্র মহাবিশ্বের গঠনতন্ত্রের পিছনে অঙ্কের খেলা আছে, এমনটি জেনে সবাই চমৎকৃত হয়। যদিও সে সব জটিল রীতিনীতি এখনও স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে পারেনি তারা সবাই, কিন্তু বিষয়ের প্রতি ভক্তি এবং আগ্রহ দিন দিন বেড়ে চলেছে।

অঙ্কের এই ভাষণ শুনবার সময়ে বের্নহার্ডের মনে পড়ল ইয়োহান সেবাসটিয়ান বাখের কথা। বাখের স্বর্গীয়, শৈল্পিকভাবে সংযুক্ত নিখুঁত স্বরমালা, যেন পাখির মত ডানা মেলে উড়িয়ে নেওয়া সুরের কিছু ফিউগের কথা মনে পড়ল তার। মাঝে মাঝে সে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ সে খুব ঘাবড়ে গেল যখন অঙ্কের শিক্ষক তার নাম ধরে ডেকে এখন যে বিষয়টা নিয়ে তিনি বলছিলেন, সেটা পুনরাবৃত্তি করতে বললেন। সে দিশেহারা হয়ে চুপ করে রইল; আবার তার শিক্ষক জানতে চাইলেন যে সে এখন কী ভাবছে। অঙ্কের ভাষণ থেকে সে কী ভাবে বাখের সিম্ফনিতে পৌঁছে গেল, সেটা সে বলতে চাইলেও, এই যোগসূত্রটা তার কাছে একটু ঝামেলার মনে হল সেই মুহূর্তে। তাছাড়া সবাই তাকে ভুল বুঝতে পারে, এমনটাও মনে হল তার। শিক্ষক খুব স্নেহশীল ভঙ্গিতে তাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন যে সে বিষয়টা বুঝতে পেরেছে কি না। তখন সে শিক্ষকের নির্দেশ মেনে খুব সাহসের সঙ্গে নিজের জায়গা থেকে উঠে ব্ল্যাকবোর্ডে গিয়ে সেই লেকচারে শোনা সব ফর্মুলার বিশ্লেষণ লিখে ফেলল। তবে নিঃসন্দেহে বের্নহার্ডের উপর দিয়ে আজকাল বেশ ধকল যাচ্ছে। স্কুলের সময়টুকু ছাড়াও আলাদাভাবে সঙ্গীতের অভ্যাস, সন্ধ্যায় সব বিষয়ের তাত্ত্বিক পড়াশুনা, সব মিলিয়ে তার হাতে একেবারেই সময় থাকে না। সকালে সে বেশ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছিল। কিন্তু আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর লাফ দিয়ে উঠে, হাতে সময় নেই দেখে কাঁপতে কাঁপতে পোশাক পরে তাড়াহুড়ো করে ব্রেকফাস্ট না খেয়েই স্কুলে চলে এসেছে আজ। এরকম কাণ্ড সে কমই করে। তবে আজ ব্রেকফাস্ট খেতে বসলে সে কিছুতেই ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছাতে পারত না।



(চলবে)




১. ফিউগ (Fugue) সুরের সমাহারে তৈরি স্বরমালিকা২. ‘ইল ফো মোদলি লে পিয়ানো’ (Il faut modeler le piano) ফরাসি এই বাক্যবন্ধের অর্থ হল ‘পিয়ানোর মধ্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে হবে তোমাকে’।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৫.১

ছোটে পালোয়ান বলছিল—দেবীদর্শন-টর্শন করতে হবে না। আমি তো শুধু লাল-ল্যাঙোটের গোলামি করি, বাকি সব দেবীদেবতাদের গেরাহ্যি করি না। সবাই ভাবছিল যে প্রথমে মন্দিরে গিয়ে দেবীদর্শন করলে হয়। ছোটুর কথায় কেউ কান দিল না। কেউ ওকে বোঝাতে চেষ্টা করল না। কারণ সবাই জানে যে ওকে বোঝানোর একটাই পদ্ধতি—ওকে চিত করে ওর বুকের উপর চড়ে ওর হাড়-পাঁজর ভেঙে দেওয়া।

এদিকে ছোটে এইসব বলার পর এখন দেখাতে চাইছে কি ও নাস্তিক নয়। তাই দাঁড়িয়ে উঠে নিজের উরুতে ঢোলক বাজাতে লাগল। কিন্তু এতে আস্তিকতা কোথায়? এবার একটা ভজন গুনগুন করতে শুরু করলঃ

“বজরঙবলী, মেরী নাও চলী, জরা বল্লী কৃপা কী লগা দেনা”।

আমার নৌকো ভেসে যায় বজরঙ্গবলী, একটু কৃপা কর, হাল ধরে নাও।

তারপর একটা মিঠাইয়ের দোকানের দিকে ইশারা করে বলল—“আমি ততক্ষণ ওখানে গিয়ে পেটে কিছু দিয়ে আসি। ওখানেই তোমরা এসে যেও”। তারপর নিজের মনে বলতে থাকল,” সকাল থেকে মুখে কিছু না দিয়ে ঘুরছি। পেট সালা গুরগুর করছে”।

রঙ্গনাথকে বলা হয়েছে যে এই মন্দির সত্যযুগে তৈরি। ও ভাবছিল এখানে কোন পাথরের টুকরোয় ব্রাহ্মীতে লেখা শিলালিপি দেখতে পাবে। কিন্তু মন্দিরটি এক নজর দেখেই ও বুঝতে পারল যে আমাদের দেশবাসী সময় বলতে দুটি শব্দই ব্যবহার করে—অনাদি এবং অনন্ত। এছাড়াও ওরা কোন পঁচাত্তর বছরের পুরনো মন্দিরকেও অনায়াসে গুপ্ত বা মৌর্য্যযুগের বলে চালিয়ে দিতে পারে।

মন্দিরের উপর ফুল-লতা এবং কল্কেদার নকশার ফাঁকে লেখা—“মহিষাসুরমর্দিনীর এই মণ্ডপ ভীখাপুরের রাজসিংহাস নে আসীন ইকবালবাহাদুর সিংহ পিতা নরেন্দ্রবাহাদুর সিংহ কর্তৃক ১৯৫০ বিক্রম অব্দের কার্তিক মাসের সপ্তমী তিথিতে নির্মিত”। এটা পড়তেই রঙ্গনাথের সমস্ত পুরাতত্ত্ব হাওয়ায় উড়ে গেল।

এম অবধ অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ জমিদারের গৃহে এমন অনেক তখত বা ভাঙা তক্তপোষ পড়ে আছে ,যাতে সমাসীন হয়ে ওঁয়ারা দু’এক জন চাষীর নজরানা হোলি অথবা বিজয়াদশমীর দিন গ্রহণ করেন। মন্দিরের নির্মাণে যা খরচ হয়েছে সেটার আন্দাজ থেকেই রঙ্গনাথ বুঝে গেল যে এই তখত বা সিংহাসন ওইরকম লাখো তখতেরই কোন একটি। মন্দিরের ইমারতও ওই রকম। একটি মাত্র কামরা, তাতে একটাই দরজা আর ভেতরের দেয়ালে ওয়ার্ডরোব মত কিছু কুলুঙ্গি। তাতেই নানারকম দেবতার আসন।

দরজা দিয়ে ঢুকলে চোখে পড়বে সামনের ওয়ার্ডরোবে রাখা কিছু দেবমূর্তির মধ্যে মুখ্য আকর্ষণ এক দেবী প্রতিমার। দেখলে বোঝা যায় প্রতিমাটি সত্যি বেশ প্রাচীন।

জোগনাথ ভেতরে ঢুকেই এমন চটপট ঝাঁপিয়ে পড়ে সাষ্টাংগ প্রণিপাত করল যেন কোন সেপাই যুদ্ধক্ষেত্রে বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। তারপর পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে বসে এক ভজন গাইতে শুরু করল। কথাগুলো বোঝা যাচ্ছেনা, কিন্তু এটা স্পষ্ট যে ও কাঁদছে না, গান গাইছে।

জোগনাথের আবেগের পেছনে গাঁজার ছিলিম বা মদের পেয়ালার কোন যোগ নেই, যা কাজ করছিল তা’হল পুলিশের ডর। কারণ যাই হোক, ওর আবেগের চোটে অনেক ভক্ত নিজেদেরটা ভুলে ওর ভজন শুনতে লাগল।

শনিচরেরও গ্রাম-প্রধান হওয়ার আকাঙ্খা। ও দেবীর সামনে হাঁটু গেড়ে কোনরকমে বসে পড়ল আর “জগদম্বিকে, জগদম্বিকে” বলে শ্লোগান দিতে শুরু করল। দেবীমণ্ডপে মেলার লোকজনের ভারী ভীড়, হট্টগোলে কেউ কারও কথা শুনছে না। কিন্তু সে ‘গঞ্জহা’ই বা কেমন যে, কোথাও গেলে, সেখানকার পাবলিকের উপর বাতেলাবাজি করে নিজেদের জোর না ফলিয়ে ফিরে আসবে!

লোকজন শনিচরের থেকে একটু সরে গেল। ওদিকে রূপ্পনবাবুও চোখ বুঁজে বসে গেলেন এবং ধড়াক করে কোন বর প্রার্থনা করে বড় বড় চোখ খুলে তাকাতে লাগলেন। এবার তো মেলা দেখতে যেতে হয়। ওনার পাশে একটি মেয়ে কোন দেবতার সামনে চোখ বুঁজে কোন মন্ত্র বিড়বিড় করছিল। রূপ্পনবাবুর মনে হল-আসল মেলা তো এইখানে!

রঙ্গনাথ হাত জোড় করে সোজা দেবীপ্রতিমার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর যা দেখল, দেখতেই থাকল। কারণ প্রাচীন মূর্তিকলার বিষয়ে ও যা পড়াশোনা করেছিল এবার মনে হল সেসব জ্ঞান নিরর্থক, ফালতু। ভাবল—যদি এটাই দেবীমূর্তি হয় তাহলে ও যেসব মূর্তি খাজুরাহো, ভুবনেশ্বর বা ইলোরার কৈলাস মন্দিরে দেখেছে, সেগুলো তবে কী?

একবার চোখ বুঁজে প্রাণপণে নিজের সব বইপড়া বিদ্যে ভোলার চেষ্টা করতে লাগল। মনের ভিতর এক হাহাকার জেগে উঠল—বাঁচাও! বাঁচাও! আমার ভক্তির উপর যুক্তিতর্কের আক্রমণ শুরু হয়েছে। বাঁচাও!

কিন্তু যেই চোখ খুলল, অমনি টের পেল যে ওর ভক্তিটক্তি উধাও হয়ে তোতাপাখির মত মুখস্থ করা ইতিহাসের পাতা ওর উপর জেঁকে বসেছে। যারা ভক্তির চোখে না দেখে ইংরেজ ঐতিহাসিকদের লেখা বইয়ের পাতা দেখে এই মন্দিরে এসেছে তারা শুধু এই ধরণের বক্তব্য ঝাড়তে পারে—“ এই মূর্তির যতটুকু দেখতে পেয়েছি তাতে এইটুকু নিশ্চিত হয়ে বলা যায় যে এটি প্রায় বারোশো শতাব্দী আগের কোন সেপাইয়ের মূর্তি”।

আমাদের দেশের মূর্তিকলা নিয়ে যে যাই বলুক, এই অপবাদ কেউ দিতে পারবে না যে মূর্তির লিঙ্গভেদ নিয়ে কোন সন্দেহ বা অষ্পষ্টতা আছে। ছোট করে কাটা চুল এবং শার্টপ্যান্ট পরে গলফ্‌ ময়দানে ঘুরে বেড়ানো নারীদের দেখে লিঙ্গ সম্বন্ধে আমাদের চোখের ভুল হতে পারে, কিন্তু প্রাচীন নারীমূর্তি দেখে এমন ভুল হওয়া অসম্ভব।

পুরাতত্ত্বের ছাত্রদের মূর্তির গলার নীচে দুই উঁচু উঁচু পাহাড় দেখার অভ্যেস সহজেই হয়ে যায়। আরেকটু নীচে নামলে পাহাড় বদলে গিয়ে অন্য কিছু হয়ে যায়। এসব বোঝার দিব্যদৃষ্টি পুরাতত্ত্বের ভোঁদাই ছাত্ররাও সহজে অর্জন করে। তাই ওরা বৌদ্ধবিহারকে গোপুরম এবং গোপুরমকে স্তুপ ভাবার ভুল করতে পারে বটে, কিন্তু নারীমূর্তিকে পুরুষ বলে ভুল? কদাপি নহী।

রঙ্গনাথ পুরুত মশাইকে জিজ্ঞেস করল –এটা কোন দেবতার মূর্তি?

উনি খুব ব্যস্ত। চেঁচিয়ে বললেন—পকেট থেকে কিছু বের করে পূজোয় প্রণামী চড়াও, তখন নিজের থেকে টের পাবে উনি কোন দেবতা!

রঙ্গনাথের জ্ঞানপিপাসায় আকুল হয়ে এগিয়ে গিয়ে মূর্তির গলা ছুঁয়ে দেখল। পুজারী ওকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করল। তারপর শিক্ষিত লোকের ঢঙে বলল—মূর্তি ছোঁয়ার নিষেধ আছে।

মেয়েটি ততক্ষণে প্রতিমা দর্শন করে বাইরে চলে গেছে। রূপ্পনবাবুর মনে হল—মেলা শেষ, ফিরে যাই। তাই রঙ্গনাথের হাত ধরে টান মেরে বলল—দর্শন তো হয়ে গেছে, এবার চলা যাক।

ইতিহাস হচ্ছে সবচেয়ে বড় মূর্তিভঞ্জক কালাপাহাড়। এখন রঙ্গনাথের মাথায় ইতিহাসের খ্যাপামি, ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল—দর্শন আর কী হবে? এটা তো কোন দেবী মূর্তি নয়!

শোনামাত্র তিন গঞ্জহা রঙ্গনাথের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। দু-চারজন চমকে উঠে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। রঙ্গনাথ কোন মিউজিয়ামের অ্যাসিসট্যান্ট কিউরেটরের ভঙ্গীতে লেকচার দিতে শুরু করল-- “দেখছ না, এটা কোন সেপাইয়ের মূর্তি! এই দেখ ওর শিরস্ত্রাণ, আর এদিকে দেখ, পিঠের পেছন থেকে তূণ বেরিয়ে রয়েছে। আর এদিকে দেখ, বিলকুল সমতল---“।

রঙ্গনাথ সেপাইয়ের ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের বর্ণনা শেষ করার আগে পুজারী লাফিয়ে এসে এমন ধাক্কা দিল যে ও বিনা চেষ্টায় ভীড় চিরে বাইরে এসে দরজার গায়ে আটকে গেল। ওদিকে পুজারী লোকের পুজো করানো এবং প্রণামী সামলানোর দায়িত্ব ছেড়ে রঙ্গনাথকে প্রাণভরে গাল পাড়তে লাগল। ওর মুখটা ছোট, ফলে বড় বড় গালি নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করে ভাঙাচোরা অবস্থায় বাইরে পৌঁছচ্ছিল। খানিকক্ষণের মধ্যে মন্দির গালাগালিতে ভরে গেল। কারণ, ভক্তরাও পুজারীর পক্ষে দাঁড়িয়ে গালিবর্ষণ শুরু করে দিল।

শিবপালগঞ্জের গঞ্জহারা থতমত খেয়ে মন্দিরের বাইরে চলে এল। কিন্তু পুজারী মন্দিরের দরজায় এসে চেঁচাতে লাগলেন—আমি তো মুখ দেখেই বুঝে গেছি। ব্যাটা কেরেস্তান। বিলায়েতের সন্তান। একটু কী গিটপিট-গিটপিট শিখে নিয়েছে, আজ বলতে শুরু করেছে এই প্রতিমা তো দেবী নয়! কালকে নিজের বাপকে বলে দেবে আমার বাপ নয়!

শনিচর আর জোগনাথ ব্যাপারটা কিস্যু বোঝেনি। তাতে কি, হাত-পা নাড়িয়ে ওরাও খুব চেঁচাতে লাগল। এবার রূপ্পনবাবুর বাস্তববুদ্ধি জেগে উঠল। রঙ্গনাথের হাত ধরে বলল—চলো দাদা। তারপর পুজারীর দিকে ফিরে চড়া কিন্তু হিমশীতল স্বরে বলল—“দ্যাখো মহারাজ, মেলা-টেলার দিন বেশি দম লাগিও না। বয়স অনেক হল, এখন বেশি গাঁজা টানলে বড্ড তাড়াতাড়ি চড়ে যায়, বুদ্ধি ঘুলিয়ে যায়”।

পুজারী ফুসুফুস করে কিছু বলার চেষ্টা করতেই রূপ্পনবাবু হাত তুললেন—ব্যস, ব্যস; বেশি পাঁয়তারা কর না। আমরা শিবপালগঞ্জের লোক। জিভটাকে কমণ্ডলুতে ভরে রাখ।

কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর রঙ্গনাথ বলল—আমারই দোষ, এখানে মুখ খোলার দরকার ছিল না।

রূপ্পন সান্ত্বনা দিলেন—কথা তো ঠিক, কিন্তু দোষ তোমার নয়, তোমার বেশি বেশি লেখাপড়ার।

শনীচর পোঁ ধরল—বই পড়ে মানুষ লেখাপড়াজানা লোকের মত কথা বলতে শুরু করে দেয়। কথাবার্তার আসল ঢং ভুলে যায়। তুমি কি বল জোগনাথ?

জোগনাথ জবাব দিল না। ও ভীড়ের ঠেলাঠেলির মধ্যে ঢুকে যুবতী মেয়েদের ধাক্কা দিতে ব্যস্ত। ওর মুখের ভাবে স্পষ্ট যে ও খানিকক্ষণ এই কাজেই লেগে থাকতে চায়।

শনিচরও এখন মেলার মুডে এসে গেছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে একটা মিঠাইয়ের দোকানের দিকে রওনা দিল যেখানে আগে ছোটে পালোয়ান গেছে। এই যাত্রাপথে ও অনেক বুড়োমানুষকে ডাইনে বাঁয়ে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে দিল, অনেক নারীর কাঁধে ‘ভালোবেসে’ হাত রাখল, তাদের বুকের মাপজোক দেখে নিল। আর এইসব এমন স্বাভাবিক ছন্দে করে গেল যেন মেলায় এমনটাই দস্তুর।


এইসব কান্ড করতে এই রোগাপটকা তালপাতার সেপাইয়ের এমন ফুর্তি, এমন এনার্জি দেখা গেল যে কোন টনিক নির্মাতা আমেরিকান ওষুধের কোম্পানী ওকে এখন দেখলে ‘এপ্‌’ এর বিজ্ঞাপন ভেবে খাঁচা শুদ্ধ কিনে নিত। তবে শনিচরের জন্য এখনও কোন খাঁচা তৈরি হয়নি—এই যা!

রঙ্গনাথের মটকা গরম হয়ে গেছল। একবার শনিচরের হাত একটি কিশোরীর গালের দিকে এগোতেই ও হাতটা ধরে মুচড়ে দিল, আর ধমকে উঠল—‘এটা কী ধরণের বেয়াদবি’?

শনিচরের চোখ বড় বড়—‘বেয়াদবি কোথায় গুরু? এ তো মেলা চলছে’! তারপর সুর নরম করে দাঁত বের করে বলল- ‘গুরু, এসব দেহাতি মেলার চক্কর। এখানে তো এইরকম হাতের জাদু চলতেই থাকে গুরু’।

প্ল্যানিং কমিশনও কোন সমস্যার সমাধান খুঁজতে নতুন কোন ইংরেজি শব্দ আমদানি করে এত খুশি হতেন না, শনিচর যেভাবে মুখ থেকে আচমকা ‘জাদু’ শব্দ ছিটকে বেরোনোয় হল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল –একবার গ্রামসভার প্রধান হয়ে যাই, তখন দিনের মধ্যে কম করে তিনবার এই ‘জাদু’ শব্দ আউড়ে দেব।

মিঠাই আর চাটের দোকানের সামনে খুব ভীড়। ভারতীয় মিষ্টান্নের সৌন্দর্য্যের মহারাণী হল কড়াপাকের সন্দেশ। সেই সন্দেশ বা বরফির স্তুপ দোকানে সাজানো আর গাঁয়ের ছেলেপুলে জানে যে মারামারির সময় এগুলো ঢিলের মত কাজে আসে। এই মেঠাই হালুইকর এবং ফুড ইন্সপেক্টরদের অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল। অনেক পরিশ্রমের পর ওঁরা জানতে পেরেছেন যে ক্ষীরের বদলে মুখিকচু, আলু-চালের আটা, মাটি, এমনকি গোবর পর্য্যন্ত কাজে লাগে। এঁরা হলেন সমন্বয়বাদী—প্রতিজ্ঞা করেছেন যে ভ্যাজাল না দিয়ে কোন জিনিস বানাবেন না, এমনকি বিক্রিও করবেন না।

একটা দোকানের কোনায় ছোটে পালোয়ানের দেখা পাওয়া গেল। ভীড় থেকে আলাদা, একটা মোড়ায় বসে শালপাতার ঠোঙা থেকে নিমের কাঠি দিয়ে গেঁথে আলুর টুকরো খাচ্ছে। শনিচর আর জোগনাথ রূপ্পনবাবুর থেকে সরে গিয়ে ছোটুর কাছে গেল।

শনিচর বলল, ‘ গুরু, হুকুম দাও তো এক-আধ টুকরো বরফি খেয়ে নিই’?

ছোটে পালোয়ান শনিচরের দিকে করুণাঘন চোখে তাকিয়ে হাসল। তারপর বর দেওয়ার ভঙ্গীতে বলল—“ হ্যাঁ রে ব্যাটা, খা। জোগনাথকেও দে”।

রঙ্গনাথ দেখল ধূলো, মাছি আরও অনেক কিছু মিঠাইয়ের উপর বসে ওজন বাড়াচ্ছে। ব্যাজার হয়ে ও রূপ্পনকে জিজ্ঞেস করল—তুমি কিছু খেতে চাও?

জবাব এল কিঞ্চিৎ রুক্ষ স্বরে—আমি খেয়ে কী করব?

তারপর রূপ্পন ভীড়ের দিকে একবার বিহঙ্গম-দৃষ্টিতে দেখল। একটু দূরে সিংহ সাহেব দেখা দিলেন, যাকে রূপ্পন মেলায় ঢোকার সময় দেখেছিল। ওনার মাথায় এখন শোলার হ্যাট, তাই স্যানেটারি ইন্সপেক্টর নয়, সোজা পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটের মত দেখাচ্ছে। ওনাকে ঘিরে ধরেছে একগাদা লোক।

রূপ্পন বলল—‘যতক্ষণ এই হ্যাংলাগুলো মিঠাইয়ের দোকানে সেঁটে থাকবে , ততক্ষণ ওই তেএঁটে ব্যাটার হালচাল দেখে আসি, চলো,’।

রূপ্পনবাবু এখন সিং সায়েবের গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়েছেন। সায়েবের গালে চার-পাঁচ দিনের না-কামানো দাড়ি-গোঁফ, ঠোঁটের কোণ দিয়ে খৈনির পিক পড়ল বলে--- কিন্তু ওই সোলার হ্যাট কামাল করেছে।

--বলুন সিং সায়েব, কেমন চলছে? রঙ্গঢঙ কেমন?

--রঙ সব বদরঙ হয়ে গেছে ভাই। দশ-দশটা চালান কাটতে হয়েছে। এই বয়সে আমি তো এসবেরই লায়েক হয়েছি, রূপ্পনবাবু। এরপর সাক্ষী হয়ে এজলাসে হাজিরা দিতে দিতে আমার পায়ের চামড়া উঠে যাবে।

রূপ্পনবাবু গলার জোরে ভীড়ের হট্টগোল ছাপিয়ে গেলেন। --আরে এইসব চালান-টালানে আছেটা কী, সিংহ সায়েব? দশ-পাঁচ টাকা নিয়েটিয়ে কেস খতম করুন।

সিং সায়েবও অমনই উঁচু আওয়াজে বললেন—কোন সালা দশ-পাঁচ টাকা দেবে? ওদিকের খাবারের ঠেলাগুলোর চালান করলাম, সব সালাই চায় দুটো টাকা ধরিয়ে মামলা দফারফা করতে। আমিও বলেছি –চালান হোক চাচ্ছিলে তো, তাই হবে।

রূপ্পনবাবু হাত তুলে বললেন—কোথাকার ওই দোকানদারগুলো? ভারি বদমাশ তো!

একটা মোটা-তাগড়া লোক ওনার সামনেই দাঁড়িয়েছিল। দেখলে মনে হয় হেব্বি দম, কিন্তু মুখ খুলল যেন বড়সড় তরমুজ পচে গেছে। মিনমিনিয়ে বলতে লাগল—‘আমরা রোহুপুরের লোক, বাবুসাহেব। তখন থেকে নিস্পিক্টর সাহেবকে খোসামোদ করে যাচ্ছি, কিন্তু উনি দোকানপ্রতি দশটাকার নীচে নামছেন না যে’।

রূপ্পন—মেনে নিন সাহেব। দু’টাকা করে হলেও আপনার কুড়ি টাকা হচ্ছে, কম তো নয়। আপনিও কোন গমের বস্তা বেচছেন?

মোটা লোকটি রূপ্পনের হাবভাবে উৎসাহিত হয়ে বলতে লাগল—‘বাবু সাহেব , আমার অবস্থাটাও দেখুন একটু। এক বছর পরে এখানে দোকান লাগিয়েছি। দশ টাকা এনার কাছে গেলে থাকবেটা কী’?

কথাটা শুরু হয়েছিল ইয়ার্কির ছলে, কিন্তু রূপ্পনবাবুর এখন দোকানদারের ওকালতি করার মজা মাথায় চড়েছে। উনিও গলা চড়িয়ে বললেন—‘ঠিকই তো বলছে, দশটাকা গেলে থাকবেটা কী? এবার মেনে নিন সিং সাহেব, প্রতি দোকান আড়াই টাকা, ব্যস্‌। না আপনার কথা রইল, না এর’। এই বলে উনি মোটুকে হুকুম দিলেন—যাও, এক্ষুণি দশজনের পঁচিশ টাকা নিয়ে এসে সাহেবের হাতে দাও। আর কিছু মিষ্টি-টিষ্টিও।

মোটু দৌড় লাগালো। পেছন থেকে সিং সায়েব বললেন—‘দেখ, দেখ, মিঠাই এনো না যেন’।

তারপর পাবলিককে ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে লাগলেন—‘ওসব সালার রেড়ির তেলে রান্না হয়েছে নাকি মহুয়ার তেলে—কে বলতে পারে! ছাগলের নাদির মত গন্ধ ছড়ায়’।

রূপ্পন আরও ঘেঁষে এলেন। ঘরোয়া কথাবার্তা শুরু হল।

--আপনার মহল কতদূর? সেই যে বানাতে শুরু করেছিলেন?

--‘আর মহল! ওটাকে এখন বাড়ি বললেই ভালো হয়’। এই বলে সাহেব চুপ মেরে গেলেন। একটু পরে মিইয়ে যাওয়া স্বরে বললেন—আদ্দেক তৈরি হয়ে পড়ে আছে। ভাবছি, যেমন আছে থাক। নীলামে চড়িয়ে দেব’।

রঙ্গনাথ ভেতরে ভেতরে টগবগিয়ে ফুটছিল। মন্দিরে পুজারীর গালি খাওয়ার পর থেকে ও কারও না কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে মুখিয়ে আছে। বলে উঠল—‘এত এত ঘুষ খেয়েও আপনার মহল পুরো হল না’?

সিং সায়েব রাগ করলেন না। ভুরু নাচিয়ে রূপ্পনকে জিজ্ঞেস করলেন—এ কে?

রূপ্পন—‘আমার দাদা, পিসতুতো ভাই। এর কথা ধরতে নেই। একটু বেশি লেখাপড়া করেছে, তাই মাঝে মাঝে উলটো কথা বলে ফেলে। চিন্তা করবেন না, যেমনই হোক আমাদের ঘরেরই লোক তো’।

রঙ্গনাথ ঠোঁট কামড়ে বড় করে শ্বাস টানল। সিং সায়েব ওকে বোঝাতে লাগলেন—আগের দিন আর নেই ভাই। মহলের দিন গেছে। ঘুষ নিয়ে মহল হয় না। বড়জোর ঘরের উপর পাকা ছাত, তাহলেই হল। দেখলে না—“ঘুষের রেটের কী অবস্থা ! দশ-দশটা চালান লিখতে লিখতে হাতের চামড়া উঠে গেল, পেলাম কী? মারলাম বক, হাতে লাগল ওর পাখনা, ব্যস্‌”।

(চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার






















(১৯)

গভীর রাতে ঘুম ভাঙতেই গোলকপতি দেখতে পেল যে শৈলবালা তার দুটো চোখে অসংখ্য মুক্তোদানার মত অশ্রু ঝলোমলো হয়ে বাইরের ঘরের চৌকাঠে এসে চুপ করে বোবার মত একদিকে খানিক চুপ করে বসে আছে।

সে রাত্রিটিতে দিগন্তের স্তব্ধবাক আলোহীন সেই ঘনায়মান পটভূমিকায় তাকে যেন অলৌকিক জগতের একজন অতি অপরিচিত নারীর মত দেখাচ্ছে। গোলকপতির তখন যদিও ওর কাছে গিয়ে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে খুব ইচ্ছা করছিল, তাও সে সেইমুহূর্তে নিজেকে সংযত রাখতেই বেশী সচেষ্ট হল।

সে ওই ক্রন্দনরতা নারীমুখটি দেখতে দেখতে ভাবছিল যে সেদিনের পরে আরও দুটো রাত এখানে নিরাপদে কেটে গেলেও হৈমবালার বাহ্যিক আচরণটিতে তবুও যেন ঠিকমতভাবে স্বাভাবিকতা এল না।

.....

বসতবাটির পশ্চিমাস্যে রামানন্দের মূল চালাঘরটি বেষ্টন করে আছে আর একটি ছোট চালাঘর। এই ঘরটিতে এর আগে একদা সুদূরবর্তী জনপদ দেগঙ্গা থেকে আগত এক বৃদ্ধ কারিগর তার আশ্রয়ে এসে থাকত। সে পেশায় তন্তুবায় হলেও ছিল শিল্পীমনস্ক ও খামখেয়ালি প্রকৃতির। মাঝেমধ্যে কাজ ফেলে রেখে সে ভারী মিঠে গলায় বৈদ্যকবিরাজ রামপ্রসাদ সেনের কালীকীর্তনের তানকর্তবে মাতিয়ে রাখত সারাৎসারের দীনতা লাঞ্ছিত জনজীবন। তার উদাস দৃষ্টির সামনে রামানন্দ মাঝেমাঝে যেন থই খুঁজে পেতনা। তবে তার হাতে বোনা সুরুচিকর ও শৌখিন পাছাপেড়ে কাপড় এই কয়েকবছর আগেও এদিকে বেশ চলত।

যদিও আজকাল সুতীর কাপড়জামা যেন ক্রমে তার জৌলুস হারিয়ে ইংরেজদের কদর করা পোশাকেই সবার মন টানছে।

বৃদ্ধ কারিগরটি সম্প্রতি লোকান্তরিত হওয়ায় তার শূন্য চালাটির দুটি ঘরে নামমাত্র সিক্কার বিনিময়ে এদের দিনকয়েকের আশ্রয় মিলেছে।

গোলকপতিকে রামানন্দের এত খাতির করার কারণ হল যে তার হস্তক্ষেপে রাজবাড়ির অন্দরে কাপড়ের ফরমায়েশে মনযোগ দেওয়া। কেবলমাত্র প্রতিষ্ঠিত ফড়ে বা মাঝারি আড়তদারদের দৌলতে ছোট গঞ্জ এলাকায় কারবার চালিয়ে বড়লোক হওয়া বেশ কঠিন। সে উচ্চাভিলাষী হলেও অসৎ নয়।

......

শৈলবালার জীবনটিকে তার নিজের সাথে হুট করে জড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্তটি একটু হঠকারী হয়ে গেল? তখন সেই বিষাদসিন্ধুর ঢেউতোলা তার ক্রন্দন উদ্ভাসি মুখটা দেখে নিজের অন্তরে যেন তপ্ত শেলবিদ্ধের অনুভব হয়।

অবশ্য পরক্ষণেই সে এসবের পরিবর্তে শৈল'র সম্ভাব্য লেলিহান চিতাগ্নি ও সহমরণের কল্পিত দৃশ্যটি তার মনে আসলে সে তখন তার কর্মফলের চিরায়ত ভয়টিকে একটু দূরে রাখতে পারে বলে তার নিজের মনে বেশ স্বস্তি হয়।

সঙ্গে সঙ্গে তার হঠাৎ মনে উদয় হয় একটি প্রশ্নের কথা! শৈলবালার শ্বশুড়বাড়ির লোকেরা এত সহজে একটি কমবয়েসী, সতী হতে যাওয়া এবং সর্বোপরি সম্পূর্ণ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সপত্নীটির সন্ধান করা কি একেবারেই ছেড়ে দিল? পরক্ষণেই মনে হয় হয়ত ওরা টহলদার ইংরেজ কোতোয়ালের ভয়ে চুপ করে আছে!

কবে যে সব অশান্তি দূর হয়ে গৃহীজীবনে আবার ফিরতে পারবে! কে জানে ! তার ভাগ্যদেবতার যে কি অভিপ্রায়!

....

ধনী জমিদার মতিলাল শীল ইতিমধ্যেই দানবীর নামে কলকাতার দশদিকে বেশ পরিচিত নাম। অনেক ছাত্র সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এমনকি বহুসংখ্যক ভবঘুরে আর বেকার লোকজনও তাঁর বাড়িতে দু বেলা পাত পেড়ে ভরপেটে খেয়ে আসে।

এহেন ব্যক্তিটি যে অবলীলায় গোলদিঘির কাছাকাছি একটা পারিবারিক মালিকানার জমি বিনা বাধায় যে হুট করে মেডিক্যাল কলেজের জন্য দিয়ে দেবেন সেটা যেন অবধারিতই ছিল। তবে এসব কাজে হাত দেওয়ার ব্যাপারে লর্ড বেন্টিঙ্ক বড় নিয়মনিষ্ঠ। সেদিনের লাটভবনে যে ইচ্ছার বীজটি সি.জে গ্রান্ট সাহেবের সাথে সেদিন বপন করেছিলেন, তাকেই এবারে " গ্রান্ট কমিশন" এর রিপোর্টের ভিত্তিতে মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার কথাটি অবশেষে ঘোষণা করে ফেলতে আর দেরী হলনা।

বেন্টিঙ্ক জানেন যে বিলেতে আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে এইরকম একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তা এই উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনের ভিত্তিটিকেই সার্থক ও সফল করে তুলতে পারে। আর এটাও হয়ে থাকবে সতীদাহ বিরোধী বিল্ ঘোষণার পরে আরেকটি জনমুখী ইংরেজ সিদ্ধান্ত।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in





ষোলো

রবিবাবুর স্ত্রী আলো ভাবেন, এই তো কয়েকদিন আগে কলেজে রবির সঙ্গে পরিচয়। প্রথম দেখাতেই ভালোলাগা। আর এই ভালোলাগা টেনে নিয়ে গেছিলো তাদের কলকাতা চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া,বইমেলা, মিনার্ভা, কফি হাউস। তাদের দুজনের কবিতার বই আছে। কত আকুতি মেশানো প্রেমের কবিতা। তখন কি আর মনে ছিলো কর্কট রোগে কবিতা আবার নতুন করে জন্ম দেবে।

আজ আলো খোলা চুলে ছাদে গিয়ে রোদে বসে খাতা কলম নিয়ে কবিতা লিখতে বসেছে। রবিবাবু আড়াল থেকে দেখে চোখের জল ফেলতে ফেলতে আপন মনে বলে উঠলো, আমি যেন তোমার আগে মরতে পারি রত্না। তোমার কবিতা শোনার পরে তৃপ্ত হৃদয়ে আমি মরতে চাই।

নিচে বড়ছেলের চিৎকার শোনা গেলো, মা গো তুমি কোথায়? একবার নিচে এসো। এখনি আমরা কলকাতা নার্সিং হোমে যাবো। আজ ফার্স্ট কেমো নেওয়ার দিন.।তারপর চলল,বিরাট ল

আলো দেবি মারা গেলেন। রবিবাবু আলোছাড়া বাঁচতে চান না।

একদিন তিনিও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন।

প্রবাহ চলছে।বড়ছেলে ও ছোটছেলের বিয়ে হল।তাদের পুত্র, কন্যা হল।আবার শুরু হল নব প্রজন্মের নবপ্রবাহ।

(লেখক বিজয়ের জীবনপ্রবাহ ও সন্তানলাভ।)

বিজয় লেখক।চাকরী করে একটা প্রাইভেট ফার্মে। যখনই তার লেখা কোনো ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় সে রেলওয়ে স্টেশনের স্টলে গিয়ে ম্যাগাজিনটি কিনে বাড়ি ফেরে।কিন্তু রেলওয়ে স্টেশনে ঢুৃকতে গেলে প্ল্যাটফরম টিকিট কেটে ঢুকতে হয়।এখন দশ টাকা লাগে একটা প্ল্যাটফরম টিকিটে।খুব গায়ে লাগে বিজয়ের।কিন্তু কিছু করার নেই। টিকিট না থাকলে আবার টিকিট চেকার ফাইন করতে পারেন। অতএব টিকিট নিয়ে স্টেশনে ঢোকাই উচিত বলে মনে করলো বিজয়।আজ থার্ড আই পত্রিকায় বিজয়ের একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছে।খুব আনন্দিত হয়ে সে তার বন্ধু সুমনকে বললো,তুই একটু দাঁড়া, আমি প্ল্যাটফরম টিকিট কেটে বইটা নিয়ে আসি।

শুনে সুমন বললো,আরে প্ল্যাটফরম টিকিটের দাম দশটাকা। তুই দাঁইহাটের টিকিট নিলে পাঁচ টাকায় পাবি। একটা টিকিট থাকলেই হলো।

বিজয় বললো,এটা তো জানা ছিলো না। তাহলে এত দিন ধরে আমার অনেক টাকা সেভ হতো।

ঠিক আছে তাই হবে।তোকে অনেক ধন্যবাদ।

----বন্ধুকে, শালা ধন্যবাদ জানানোর কি আছে?যা, তাড়াতাড়ি যা।একসঙ্গে বাড়ি যাবো।

তারপর বিজয় একটা দাঁইহাটের টিকিট কেটে ম্যাগাজিন কিনে মহানন্দে বাড়ি চলে এলো। বন্ধুও তার বাড়ি চলে গেলো।

বাড়িতে এসেই বিজয় বৌকে বললো,বেশ ভালো করে আদা দিয়ে চা করো তো। একটু রসিয়ে সব গল্পগুলো পড়বো।বিজয় ভালো করে বিছানায় বসলো।

0 comments:

1

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















১৬শ পর্ব

মিরজাফরের সিংহাসন আরোহন।

মুর্শিদাবাদ থেকে চিঠি যেতে এবং তার উত্তর আসতে প্রায় ছ-সাত দিন লাগতো। লন্ডন থেকে মাদ্রাজ বা কলকাতায় চিঠি আদানপ্রদান ছিল সময়সাপেক্ষ। যুদ্ধের পরিস্থিতিতে তাই কোনও আদেশের বা উপদেশের অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। ক্লাইভের কাছে যখন সিরাজের সঙ্গে যুদ্ধের সম্মতি এসে পৌঁছোয় তখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ২৯শে জুন যখন ক্লাইভ কাশিমবাজার থেকে মুর্শিদাবাদ অভিযানের আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেলেছে তখন লন্ডন থেকে অভিনন্দনবার্তা এসে পৌঁছোল। ক্লাইভের এই জয় সমগ্র ব্রিটিশজাতিকে বিশ্বের কাছে সম্মানের আসনে বসিয়েছে সে কথা জানিয়ে কোম্পানির ওপরমহল থেকে জানানো হলো যে যদিও মিরজাফরকে নবাবের আসনে বসানো হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তবুও আনুষ্ঠানিকভাবে এবং ধুমধামের সঙ্গে মিরজাফরকে সিংহাসনে বসানো এখনও বাকি আছে। প্রশাসনের দিক থেকে একজন নবাবের অস্তিত্ব থাকা খুব দরকার। সেক্ষেত্রে বলা যাবে সিরাজের অভাবে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা অনাথ হয়ে যায়নি। মিরজাফরের সিংহাসন আরোহণ সম্পূর্ণ হলে যেন রাজ্য জুড়ে সারা দিনরাত্রিব্যাপী উৎসব পালন করা হয়। ২৯শে জুন ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ পৌঁছে কিছুটা অবাকই হলো। ধনসম্পদ এবং আভিজাত্যে ভরপুর এমন শহর তারা আগে দেখেনি। মানুষের ঢল দেখে ক্লাইভের বুঝতে কোনও অসুবিধে রইলো না যে চাইলে এখানকার মানুষ চাইলে কেবলমাত্র লাঠি আর পাথর দিয়েই ইউরোপিয়ানদের দেশছাড়া করতে পারে। পারেনি তার কারণ নেতৃত্ব দেবার মতো কেউ ছিলনা। এই বিশাল জনশক্তিকে সংঘবদ্ধ করার কোনও প্রয়াস ছিলনা কোনওখানে। প্রচুর রক্ষী সামনে পিছনে নিয়ে ক্লাইভ এসে পৌঁছোল মুরাদবাগ প্রাসাদে। সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানাল মির মিরান। কোথাও কোনও ষড়যন্ত্রের লেশমাত্র নেই। সেখান থেকে মির মিরানের সঙ্গে প্রচুর ব্রিটিশসৈন্য সমভিব্যাহারে ক্লাইভ পৌঁছোল হিরাঝিল প্রাসাদে যেখানে এক সপ্তাহ আগেও বীরবিক্রমে বিরাজ করতো সিরাজউদ্দৌল্লা।

মিরজাফর নিজের থেকে সিংহাসনে বসতে চাইলো না। যে সিংহাসনে আলিবর্দি এবং সিরাজ বসেছে সেই সিংহাসনে বসতে স্বাভাবিকভাবেই ইতস্তত করছিল মিরজাফর। যে নবাবের অধীনস্থ হয়ে দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেছে মিরজাফর চোরাপথে সেই সিংহাসন অধিকার করার সময় যখন এল তখন মেরুদন্ড বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে এলো তার। ক্লাইভ বুঝতে পারলো মিরজাফর দ্বিধাগ্রস্ত। ক্লাইভ এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে মিরজাফরকে মসনদের সামনে নিয়ে এসে তাকে ধরে ধরে আস্তে আস্তে মসনদে বসিয়ে দিল। প্রথামত নবাবের হাতে তুলে দিল নজরানা, রুপোর থালা ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা। এক এক করে সমস্ত গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সিংহাসনের সম্মানে নজরানা তুলে দিল মিরজাফরের হাতে। যে মিরজাফর যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থেকেছে এবং যুদ্ধ করেনি, যে মিরজাফর যুদ্ধজয় করে নয় বিশ্বাসঘাতকতা করে মসনদ দখল করলো সেই মিরজাফরকে মাহাবাত জং অর্থাৎ যুদ্ধনায়ক উপাধিতে ভূষিত করা হলো। এক এক করে পুত্র মির মিরান এবং জামাতা মির কাশিমকে ভূষিত করা হলো শামাত জং এবং হাইবাত জং ইত্যাদি উপাধিতে। তৈরি হলো নতুন শিলমোহর। মিরজাফরের সিংহাসন আরোহণ এবং নবাব হওয়ার সিদ্ধান্তে শিলমোহর দিয়েছিল ক্লাইভ, দিল্লির মোগলসম্রাট নয়। এবার থেকে দিল্লির ভারতসম্রাট নয় কোম্পানির নিয়োগকারীরাই নবাব নিয়োগ করবে সেই বার্তাই ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। এই নবাব নিয়োগের শুরু হলো বাংলায়। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি মোগল সম্রাটের কাছ থেকে মিরজাফরের নিয়োগপত্র এসেছিল অনেক পরে, ২৩শে ডিসেম্বর ১৭৫৭। ক্লাইভের চিঠি অনুযায়ী এই বিলম্বের কারণ ছিল যে সকলকে বিতরন করার পর নিয়োগপত্রের বিনিময়ে মোগল সম্রাটকে দেয় অর্থ সেই সময়ে কোষাগারে ছিলনা। কিন্তু তার জন্য মিরজাফরের নবাব হওয়ায় কোনও বাধার সৃষ্টি হয়নি। ব্রিটিশদের উপরে কথা বলার ক্ষমতা ছিলনা মোগল সম্রাটের। কার্যত ব্রিটিশরাই নবাব নিয়োগ করতে শুরু করেছিল। মোগলসম্রাটের নিয়োগপত্র কেবল প্রথাগত। মিরজাফরকে কার্যত নিয়োগ করেছিল ক্লাইভ এবং পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটলো ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং অবশেষে দিল্লির মসনদ চলে গেল ব্রিটিশদের হাতে। ক্ষমতা যে নবাবের হাতে নয় তার হাতে সে কথা নানাভাবে মিরজাফরকে বুঝিয়ে দিয়েছিল ক্লাইভ। মিরজাফরের মসনদে বসার পর ক্লাইভের মিথ্যাভাষণের কিছু অংশ শুনলেই বোঝা যায় কথায় আর কাজে কতটা ফারাক ছিল ব্রিটিশদের। ফরাসিদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার অপরাধেই যে তাকে মসনদ ছাড়তে হয়েছিল সে কথা বোঝাবার চেষ্টা লক্ষ্য করার মত।

‘আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার কোন অভিপ্রায় ছিল না। কিন্তু সিরাজদ্দৌল্লা কেবলমাত্র চুক্তিভঙ্গই করেনি সে ফরাসিদের সাহায্য নিয়ে আমাদের ধ্বংস করতে চেয়েছিল। ঈশ্বরের অভিপ্রায়ে তাকে মসনদ হারাতে হয়েছে। আপনাদের নতুন নবাব বীর, সাহসী এবং বিচক্ষণ ব্যক্তি। তার শাসনে দেশবাসী সুখেশান্তিতে থাকবে। রাজকার্যে মাথা গলানোর কোনও অভিপ্রায় আমাদের নেই। নবাব যতদিন চাইবেন ততদিন আমরা এখানে থাকবো। তারপর আমরা কলকাতা ফিরে গিয়ে আমাদের যা আসল কাজ সেই ব্যবসায় মনোনিবেশ করবো।‘

ছলচাতুরি শেষ করে এবার আসল কাজের পালা। ক্লাইভ মুরাদবাগে ফিরে এসে দেখল জগতশেঠ মাধবরাই তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। দু’জনের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর ক্লাইভ জানাল যে জগতশেঠ ভারতবর্ষের এই অঞ্চলের সবচেয়ে ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাকে দিল্লির মোগলসম্রাটও সমীহ করে। সুতরাং তার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কী আলোচনা হয়েছিল জানা না গেলেও পরেরদিন অর্থাৎ ৩০শে জুন মিরজাফর এলো ক্লাইভের সঙ্গে দেখা করতে। রায়দুর্লভ যা বলেছিল মীরজাফরও সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করে বললো যে কোষাগারে যে পরিমাণ অর্থ আছে তা দিয়ে ক্লাইভের চাহিদা সম্পূর্ণ মেটানো সম্ভব নয়। ক্লাইভ জানাল যে সে চায় জগতশেঠ মধ্যস্থতা করুক। তার দৃঢ় ধারণা যে কোষাগারের টাকা নতুন রাজসভার মন্ত্রীরা গোপনে আত্মস্থ করেছে। তাই সে চায় জগতশঠের সাহায্য নিয়ে যতটা সম্ভব ততটা উদ্ধার করতে। মিরজাফর এবং ক্লাইভ দু’জনে একত্রে জগতশেঠের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। এই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে সেই সময় কী অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিল এই জগতশেঠেরা। নবাব এবং যে ব্যক্তি আর কিছুদিন পরে দন্ডমুন্ডের কর্তা হবে তারা একত্রে শরণাপন্ন হলো জগতশেঠ মাধবরাই এবং তার খুল্লতাত ভ্রাতা মহারাজ স্বরূপচাঁদের। সঙ্গে চললো ওয়াটস, স্ক্র্যাফটন, মিরান এবং রায়দুর্লভ। উমিচাঁদও চললো সঙ্গে সঙ্গে। উমিচাঁদ ভেবেছিল সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কারস্বরূপ লাল কাগজে যে চুক্তি হয়েছিল তার মান্যতা দেবে ক্লাইভ। সে স্বপ্নেও ভাবেনি ঐ লাল কাগজের চুক্তি ছিল মিথ্যা এবং ওয়াটসনের স্বাক্ষর ছিল জাল। আলোচনা যখন শুরু হলো তখন সবাইকে ডাকা হলো কিন্তু উমিচাঁদকে ডাকা হলো না। তাকে দূরেই বসে থাকতে হলো। জগতশেঠ প্রস্তাব দিল যে কোষাগারে অর্থের অপ্রতুলতার কারণে আপাতত ব্রিটিশদের প্রাপ্য অর্ধেক অর্থ দিয়ে দেওয়া হবে। এই অর্থের দুই-তৃতীয়াংশ দেওয়া হবে মুদ্রায় এবং বাকি এক-তৃতীয়াংশ দেওয়া হবে অলঙ্কারে। বাকি অর্ধেক আগামী তিনবছরে তিনটি সমান কিস্তিতে মিটিয়ে দেওয়া হবে। এই অর্থের পাঁচ শতাংশ পাবে রায়দুর্লভ। অর্থের পরিমাণ ১ কোটি ৭৭ লক্ষ টাকা। রায়দুর্লভের প্রাপ্য হবে ৮ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা। যেহেতু রায়দুর্লভ দরবারে দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি এবং প্রধানমন্ত্রী সুতরাং ৫ শতাংশ তাকে দেওয়ার ব্যাপারে কোনও দ্বিমত হলোনা।

এছাড়াও আর যা যা ঠিক হলো তা হচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামগ্রী একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনও শুল্ক লাগবে না। এছাড়া ফরাসিদের সমস্ত সম্পত্তি ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেওয়া হবে এবং সমস্ত ফরাসিদের এই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করা হবে। কলকাতা থেকে কুলপি এবং কলকাতা বন্দর থেকে হলদিয়ার বিস্তৃত ভূখণ্ড ব্রিটিশদের দিয়ে দেওয়া হবে। যে সমস্ত ইউরোপিয়ান সিরাজের বাহিনীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের জন্য ১ কোটি ৫০ লক্ষ, স্থল এবং জলবাহিনীর ক্ষতিগ্রস্থ সৈনিকদের এবং তাদের পরিবারের জন্য ৫০ লক্ষ, আর্মেনিয়ান ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য ৭ লক্ষ এবং ভারতীয় ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য ২লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। এইসমস্ত টাকা দিয়ে দেওয়ার সময়সীমা জুলাই, ১৭৫৭। মিরজাফর জানালো যে ক্লাইভের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সিরাজের হারেম যা বর্তমানে তার হারেম তার থেকে দশজন সুন্দরী মহিলাকে ক্লাইভের মনোরঞ্জনের জন্য প্রেরণ করা হবে। ক্লাইভ এই উপহার গ্রহণ করেছিল কি না জানা যায় নি। নিজের পারিশ্রমিক বাবদ ক্লাইভ পেল ১৯ লক্ষ টাকা এবং কলকাতার কাছাকাছি একটি জায়গির যার থেকে বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ২লক্ষ ৫০ হাজার টাকা।কলকাতা কাউন্সিলের প্রতিটি সদস্যের জন্য ধার্য হলো ৬ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। ধনবন্টনের এই প্রক্রিয়া যখন তুঙ্গে এই সম্পদের মূল আধিকারী সিরাজ তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

এবার উমিচাঁদের পালা। ক্লাইভ এবং স্ক্র্যাফটন উমিচাঁদকে ডেকে পাঠালো। ক্লাইভের নির্দেশে স্ক্র্যাফটন উমিচাঁদকে জানালো যে ঐ লাল কাগজ জাল ছিল এবং এই বিপুল অর্থের কিছুই পাবে না উমিচাঁদ। এই কথা শুনে উমিচাঁদ জ্ঞান হারালো। তাকে প্রাথমিক শুশ্রুষা করে পালকি চাপিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তার কিছুদিনের মধ্যেই উমিচাঁদের আচার আচরণে অপ্রকৃতিস্থতা দেখা যেতে লাগলো। কিছুদিন পর ক্লাইভের উপদেশে উমিচাঁদকে তীর্থভ্রমণে পাঠানো হল এবং সেখান থেকে যখন ফিরে এলো তখন সে বদ্ধ পাগল। ক্লাইভ অবশ্য পরবর্তীকালে উমিচাঁদের জন্য তদ্বির করেছিল। বলেছিল উমিচাঁদ কিন্তু ওয়াটসের সঙ্গে ভালোই সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু অন্তহীন উচ্চাশা এবং অর্থলোভ তাকে এতদূর নিয়ে গিয়েছিল যে সে নবাব হতে চেয়েছিল। তাই ক্লাইভ ভেবেছিল তীর্থভ্রমণ করে এলে সে হয়ত কিছুটা স্বাভাবিক আচরণ করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা হলোনা। ফিরে এসে উন্মাদ উমিচাঁদ রাজপোশাক এবং অলঙ্কারে নিজেকে সজ্জিত করে নিজের সুদিনের অপেক্ষায় বসে থাকত। এইভাবে বছরখানেক কাটিয়ে উমিচাঁদ অসুস্থ হয়ে পরে এবং মারা যায়। সিরাজকে বিপথে চালিত করার ক্ষেত্রে উমিচাঁদের ভূমিকা কম ছিলনা সেকথা সত্য। সিরাজের কাছের লোকেরা যখন মিরজাফরের সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতকতা সম্বন্ধে সিরাজকে খবর এনে দিত উমিচাঁদ হাসিগল্পে সিরাজকে মাতিয়ে রেখে সেকথা ভালো করে শুনতে দিতনা। তাকে তার প্রাপ্য কুড়ি লক্ষ টাকা দিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল বলে পরবর্তীকালে ক্লাইভের মনে হয়েছিল। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

জগতশেঠ মাধবরাই যার বাড়ি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক ব্যবসা এবং কূটনৈতিক বিষয়ে আলোচনার এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের অন্যতম কেন্দ্র ছিল সেই মাধবরাই ক্লাইভের কাছে অনুযোগ জানালো যে ফরাসিদের কাছ থেকে তার প্রাপ্য সাত লক্ষ টাকা সে পায়নি এবং আর পাবে বলে মনে হয়না। ক্লাইভ প্রস্তাব দিল যে পরিত্যক্ত ফরাসি দপ্তর এবং কোম্পানির শাখাগুলি থেকে যা উদ্ধার করা যাবে তার উপর প্রথম অধিকার থাকবে মাধবরাই এর। তাতেও যদি কম পড়ে তাহলে জন অ্যাান্ড কোং থেকে বাকি টাকা মাধবরাইকে মিটিয়ে দেওয়া হবে। পরিবর্তে মাধবরাই সমস্ত ব্যবসায়িক বিষয়ে ক্লাইভকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিল। একথাও বললো যে দিল্লির কোষাগার থেকে যতটা সম্ভব ততটা ব্রিটিশদের পাইয়ে দেবার চেষ্টা করবে সে। মাধবরাই মিরজাফরকে অনুরোধ জানালো যে সিরাজের আমলে আলিবর্দির সময়কার যে সমস্ত সভাসদ এবং বিশিষ্টজনেদের দরবার থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল তাদের যেন ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়।

এছাড়াও ঠিক হলো যে ক্লাইভ এবং মিরজাফর যৌথভাবে সিরাজের অনুগত পাটনার নায়েব রামনারায়ণকে এই মর্মে চিঠি লিখবে যে তারা বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে প্রস্তুত যদি রামনারায়ণ সিরাজকে তাদের হাতে তুলে দেয় বা তাকে পাটনাকে থেকে বহিষ্কার করে কারণ তাদের কাছে খবর আছে সিরাজ ঐ দিকেই কোথাও আছে।

৩০শে জুন ক্লাইভ অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে লিখলো,’ সিরাজদ্দৌল্লাকে তারই এক জমিদার ত্রিশহাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছে। এই মুহূর্তে সিরাজের কাছে এত পরিমাণ অর্থ নেই যে সে কোনও প্রত্যাঘাত হানতে পারে। রামনারায়ণ সিরাজকে পাটনায় আশ্রয় দেবার ঝুঁকি নেবেনা। তদুপরি সিরাজ এখন কপর্দকশূণ্য।‘সেদিনই গভীররাতে সিলেক্ট কমিটিতে চিঠি লিখে ক্লাইভ জানালো যে মিরজাফর খবর পাঠিয়েছে যে সিরাজকে বন্দি করা হয়েছে এবং তার ছেলে মিরানকে সিরাজকে নিয়ে আসার জন্য পাঠানো হয়েছে।

তারপরের ঘটনা আমরা জেনেছি আগের পর্বে। ২রা জুলাই ১৭৫৭ গভীর রাত্রে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো সিরাজকে।

৩রা জুলাই সকালে সিরাজের ছিন্নভিন্ন দেহ একটা হাতির পিঠে চাপিয়ে শহর পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়লো মির মিরানের দলবল। মুর্শিদাবাদের অলিগলি রাজপথ পরিভ্রমণ করে হাতি এসে দাঁড়াল হুসেনকুলি খানের দরজায় যেখানে দেড় বছর আগে হুসেনকুলিকে হত্যা করে তার মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ছড়িয়ে দিয়েছিল সিরাজ। সিরাজের মৃতদেহ থেকে দু’ফোঁটা রক্ত টপটপ করে ঝরে পড়ল ঐ জায়গায়। তারপর সেই হস্তিশকট এসে পৌছলো সিরাজের মা আমিনা বেগমের প্রাসাদের সামনে। প্রাসাদের বাইরে এত হৈচৈ শুনে আমিনা বেগম জানতে চাইলো কী হয়েছে। সিরাজের হত্যার খবর শুনে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় নিজের বুক মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে প্রচন্ড আর্তনাদ করতে করতে ছুটে বেরিয়ে গেল আমিনা বেগম।বাইরে এসে সিরাজের প্রাণহীন দেহকে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল তার সমস্ত শরীর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যারা এই দৃশ্য দেখছিল তাদের চোখ জলে ভেসে যাচ্ছিল। সদ্য সন্তানহারা মায়ের এই বুকফাটা হাহাকার দেখে যদি সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে তাহলে হত্যাকারীদের বিপদ হতে পারে। সেই ভয়ে মিরজাফরের লোকেরা তড়িঘড়ি জোর করে আমিনা বেগমকে সেখান থেকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। আর সময় নষ্ট না করে সেখান থেকে সিরাজের দেহ সোজা নিয়ে গিয়ে আলিবর্দি খানের সমাধির পাশে সমাধিস্থ করে দেওয়া হলো। সমাধিস্থ হলো বাংলা, বিহার , উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব।

1 comments: