0

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

 












উনবিংশ শতকের বাংলা। ১৮৩৬ সাল সতীদাহ প্রথা রদ হওয়া থেকে বেশি দূরে নয়। প্রিন্স দ্বারকানাথ সতীদাহের বিরুদ্ধে মামলায় টাকা ঢেলেছেন। এই কুপ্রথা সমাজ থেকে সরে যাক। বিল পাস হয়ে গেছে। রাজা রামমোহন রায় কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলেছেন। প্রভুদের দিয়েই কুপ্রথা রদ করিয়েছেন।

কিন্তু তখনও বাংলার গ্রামে গ্রামে সব সতী এই হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পায়নি। এমন অন্ধকারে ঢাকা দেশের আকাশ। সেখানে রাজত্ব করছে বিদেশী এক জাতি। পরাধীন দেশের মানুষের নগ্ন পা, ক্ষুধার্ত শরীর, অশিক্ষা ও অস্বাস্থ্যে জরজর মরমর দশা। প্রায় দুশো বছর আগের সেই বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ম্যালেরিয়া কালাজ্বর এমনকি আমাশায় পর্যন্ত মানুষ মরে। মানুষ ইংরেজ শাসকের সামনে নতশির। তাদের যাবতীয় দুর্দশার জন্য যেন তাদের ভাগ্যই দায়ী। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অদ্ভুত বিধানে তখন কিছু কিছু ভারতীয় ইংরিজি ভাষা শিখে অনভ্যস্ত শরীরে চোগা চাপকান চাপিয়ে প্রভুদের দাসত্ব করতে শুরু করেছে। না করে উপায়ও নেই। সেই দাসত্বের বোধ, অধীনতার শৃঙ্খল তাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। বাস্তবে, মননে, আত্মিকে, কোথাও সে এতটুকু আলোর রেখা আর দেখতে পেল না। প্রভুর সামনে বাঁদর নাচ নাচতেও তাকে রাজি থাকতে হবে। অবশ্য স্বার্থান্ধ কিছু মানুষ এই সুযোগে ধনী হলেন। অভিজাত বলে গণ্য হলেন। তাদের অট্টালিকার ছাদে পায়রা উড়ল। যদিও আপামর সাধারণ মানুষ সেই উৎসবে সামিল হল না। 

এমন সময়ে খৃষ্ট ধর্মের উদারতা ও প্রেম, ইসলামের সাম্য, ও বেদান্তের একেশ্বরবাদকে মিলিয়ে রাজা রামমোহন রায় জন্ম দিলেন এক ধর্মমতের। জবরদস্ত মৌলবি নামে বিখ্যাত, হিন্দু পণ্ডিতরা যার পাণ্ডিত্যের ছটায় থরহরি, খৃষ্টীয় যাজকেরা যার খৃষ্ট ধর্মের তত্ত্বানুধাবন দেখে মুগ্ধ, সেই রাজা জন্ম দিলেন এমন এক মতের যার অনুসারী হলে হিন্দু ধর্মের তৎকালীন পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি পাবে মানুষ। ব্রাহ্ম ধর্ম। নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক ব্রাহ্মদের মধ্যে জাতপাতের কোনো ভেদ রইল না। তারা কুঁকড়ো (মুরগী) খায়। ডিম খায়। তারা প্রতিমাপূজক হিন্দুদের সমকালীন ‘সদ্ধর্মে’ আনতে প্রয়াসী। বলা বাহুল্য, এই ভাবধারার পেছনে রাজার পাশ্চাত্য শিক্ষা কাজে লেগেছিল। ইওরপীয়ান রেনেসাঁ ঘটে গিয়েছে আগেই। ফলে, যারাই পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞান দর্শনের আলোয় মনের আঁধার দূর করতে পারছেন তারাই রাজার প্রবর্তিত এই নব্য সনাতন ধর্ম, নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাই যার একমাত্র পূজা, সেই ধর্মের অনুগত হচ্ছেন। স্পষ্ট যে, শহরের শিক্ষিত ও ধনী সম্প্রদায়ের মধ্যে, যেখানে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, সেখানেই ব্রাহ্ম ধর্মের আবেদন বেশি হল। রাজার পতাকা বইলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এমতাবস্থায়, কলকাতার তদানীন্তন শিক্ষিত যুবক ও বাবু সম্প্রদায় যে ব্রাহ্ম সমাজের দিকে ঝুঁকবেন সে যেন স্বতঃসিদ্ধ।

কিন্তু কলকাতা ছাড়ালেই পল্লীগ্রামের অবস্থা যথা পূর্বম তথা পরম। সেই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষ। উচ্চবর্ণের হিন্দু যেখানে গ্রামের পঞ্চ। এই সময়ে আমরা পেলাম এক গ্রাম্য নিরীহ নিরক্ষর যুবককে। যিনি কী এক অদ্ভুত উপায় রানি রাসমণি ও তাঁর জামাই মথুরবাবুকে আকৃষ্ট করেছিলেন। তাঁর সরলতা, তাঁর ঈশ্বরে বিশ্বাস, তাঁর সততা, নির্লোভ মন ও আচরণ, কেমন করে যেন প্রভাবিত করেছিল রানি ও তাঁর জামাইকে। কে এই যুবক? যাকে জমি দিতে গেলে নেন না? যাকে অলংকার জরির সাজ দিলে একবার গায়ে দিয়ে ফেলে দেন? কে ইনি? মথুরবাবুই তাঁকে প্রথম চিনলেন। এ যুবক সামান্য নন। ইনি নৌকোর মাঝিদের কাছে গিয়ে খেতে দ্বিধা করেন না। ইনি রসিক মেথরের বাড়ির রান্না খেতে ভালোবাসেন। ইনি সাধনার জন্য তন্ত্র বৈষ্ণব ধারার সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম মতেও আরাধনা করেন। একজন অতি সাধারণ গ্রাম্য নিরক্ষর যুবক, যার পক্ষে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন থাকাই ভবিতব্য, তিনি এমন উদারতা পেলেন কোথায়? সর্বোপরি, সব মতের, সব ধর্মের, সমাজের উঁচু নীচু সবতলার মানুষের প্রতি তাঁর এমন ভালোবাসা!

আমরা পেলাম শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসকে।

দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস সামান্য লোক নন। শ্রীযুক্ত কেশবচন্দ্র সেন ঘোষণা করলেন। হইচই পড়ে গেল ব্রাহ্মসমাজে। কেশব এক সামান্য পৌত্তলিক নিরক্ষর পুরুতের কাছে যান?

গঙ্গার ধারে বরাহনগরের কাছে এক বাগানে কৈবর্ত রাসমণি রানি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। দক্ষিণা কালী, মা ভবতারিণীর মন্দির। আছে দ্বাদশ শিবের মন্দির। আছে রাধাকৃষ্ণের মন্দির। রানি ধনী বটে, কিন্তু জাতে কৈবর্ত। পুরোহিত মেলে না। কোন ব্রাহ্মণ আবার যাবে পুরোহিত হতে? সমাজে তার স্থান কী হবে? খোঁজ করে পাওয়া গেল এক মাঝবয়সী ব্রাহ্মণকে। তিনি স্বীকার করলেন পৌরোহিত্য। ছিলেন ঝামাপুকুরে মিত্রদের বাড়ি। ছিল একখানা ছোট টোল। চলে এলেন দক্ষিণেশ্বরে। সঙ্গে আনলেন কনিষ্ঠটিকে। মাত্র ষোলর কিশোর এলেন পুরোহিতের অনুচর হয়ে। তারপর তো আমূল পরিবর্তন। দাদার মৃত্যুর পর তিনি হলেন কালীঘরের পুরোহিত। কিন্তু তখন তাঁর আত্মিক জীবনে এক বিপুল পরিবর্তন। তাঁর মুখের কথায়, “আশ্বিনের ঝড়ের মতন কী একটা এসে সব উড়িয়ে নিয়ে গেল। পৈতে টইতে আর কিছু রইল না”। বাহ্য চিহ্ন, যা দিয়ে হিন্দু ব্রাহ্মণ সন্তানকে চেনা যায়, সেসব উড়ে গেল। তাঁর দেশের মানুষ জানল, দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে গদাই উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। ধর্মবাই তার তো ছোট থেকেই। সেই যেবারে, মাত্র এগারো বছর বয়সে আনুড় গ্রামে বিশালাক্ষী যাবার সময় মাঠে অচৈতন্য হয়ে যায়, সেই তখন থেকেই। লাহাদের মুখ্যু মেয়ে প্রসন্ন বলেছিল, ওর ভগবানের আবেশ হয়েছে। খানিক সময় যাক। ঠিক হয়ে যাবে। ওকে ভগবানের নাম শোনাও। পরিণত বয়সে তিনি বলেছিলেন, “আকাশ থেকে একটা জ্যোতি এসে যেন ঢেকে ফেলল, হুঁশ রইল না”। বেদে একেই বলেছে আত্মার বরণ করা। এবমেষ সম্প্রসাদ পরমজ্যোতি উপসম্পদ্য। এই পরমজ্যোতিই সম্প্রসাদকে বরণ করেন। কেন? কারণ, যমেবৈষ বৃনুতে তেন লভ্য। যাকে বরণ করেন তিনিই এই পরমজ্যোতি লাভ করেন। কাকে বরণ করেন? সম্প্রসাদকে। সম্প্রসাদ কে? যিনি বিশেষরূপে প্রসন্নতা লাভ করেছেন। কে এই বিশেষ প্রসন্নতা লাভ করেন? যার দেহটি প্রকৃতিতে এমনভাবে বিকশিত হয়েছে যে আত্মার বরণ তিনি ধারণ করতে পারবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, তিনি নিজে তখন একথা জানতে পারেন না। জানতে যে পারেন না তার প্রমাণ, তিনি বলছেন, দশ এগারো বছরের পাড়াগেঁয়ে ছেলে ওর কী বোঝে? কিন্তু এর ফল সুদূরপ্রসারী।

    সরল তরুণ তখন আবিষ্ট। একে একে তাঁর কাছে আসছেন ভৈরবী, তোতাপুরী, ব্রাহ্মণী। তাঁর সাধন জগতের গুরু। কিন্তু কী সাধন করবেন তিনি! তাঁর সিদ্ধ অবস্থা দেখে গুরু হতবাক। বলছেন, ‘আরে এ কেয়া দৈবী হ্যায় রে’! তাহলে সাধন করে নয়, ওই স্বতঃস্ফূর্ত আত্মিক বিকাশই তাঁর সিদ্ধির কারণ! তাহলে এমন কঠোর সাধনা কেন? বলছেন, ‘আমার সব নজিরের জন্য’। কিসের নজির? জগতে এমন একটি মানুষ জন্মাবেন যার চৈতন্য স্বতঃজাগ্রত, তাঁর অবস্থা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এমন নিদর্শন থাকবে।

এ সময়ের অনেক পরে, তখন হৃদয়রাম কালীঘরে বহাল। একদিন দেখলেন একটি গৌরবর্ণ পুরুষ এসে জিজ্ঞেস করছেন-পরমহংসদেব কোথায়। হৃদয় তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন-আপনি কোথা থেকে আসছেন? লোকটি বললেন-সূর্যমণ্ডল থেকে। হৃদয় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন নির্দিষ্ট ঘরটি। লোকটি সেই ঘরের কাছে যেতেই দরজা খুলে গেল। শ্রীরামকৃষ্ণ যেন তাঁর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। লোকটি ঘরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিলেন। হৃদয়ের হুঁশ ফিরতে তিনি স্তম্ভিত হলেন। লোকটি ঘরে ঢুকলেও বেরিয়ে আর এলেন না তো?  আর সূর্যমণ্ডল কি কারোর ঠিকানা হয়? এর উত্তর পাই শ্রীরামকৃষ্ণের নিজের কথায়ই। বলছেন—সেসময় এক পরমহংস মূর্তি আমার দেহ থেকেই বেরুত। খেলা করতুম। তাহলে এই মূর্তিও তাঁর দেহ থেকে বেরিয়ে হৃদয়ের দৃষ্টিপথে পড়েছে। নজির রেখেছে, আমাদের এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কঠিন জগতের অন্দরে আর একটি অতীন্দ্রিয় জগত আছে। সেই জগতের স্থান-কাল-পাত্র অন্য নিয়মে অস্তিত্ব রক্ষা করে। সেই আত্মিক জগতে ক্রমাগত বিবর্তন হয়ে চলেছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এমন একটি বিবর্তনের আধিকারিক পুরুষ। কিন্তু বাস্তব জগত সেই বিবর্তনকে ধরতে পারে না। কারণ, কঠিন বস্তুর গতি আর তেজোময় পদার্থের গতি এক নয়। এ কথার প্রমাণ পাই বহু পরে। ভূধরের দাদা এসেছেন দক্ষিণেশ্বরে। মা ভবতারিণীকে দেখে বলছেন—শুনেছি নবীন ভাস্করের নির্মাণ। উত্তরে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—তা জানি না। জানি মা আমার চিন্ময়ী। একথার মর্মার্থ কি? ‘মা’ এই দেহ, কারণ এই দেহ আমরা মায়ের থেকেই পাই। তিনি বলছেন, তাঁর দেহ চিন্ময়, অর্থাৎ চৈতন্যময়। তাহলে তাঁর দেহ যে আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুসারে অল কনশাস, এ কথাই তো তিনি বললেন! তাঁর সেই চৈতন্যময় দেহের গতি তো কঠিন পদার্থের সঙ্গে সমান নয়! সে যে আলোর গতির সমান!

 তিনি সেসময় জন্মেও ভবিষ্যতের পুরুষ ছিলেন। ওপরের ঘটনাটি অলৌকিক কিছু নয়। বিজ্ঞান স্বীকার করে নিয়েছে এই স্তর উন্মোচনকে। 

আমরা আবার সেসময়ের প্রেক্ষিতে ফিরব। মথুরবাবু ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সহপাঠী। শ্রীরামকৃষ্ণের ঐকান্তিক ইচ্ছেয় তিনি তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোয়। মহর্ষি তখন তাঁর দশ/বারোটি সন্তানের পরিচর্যা করছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সেটি লক্ষ করলেন। তাঁকে দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম সমাজে নিমন্ত্রণ জানালেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবের আবেশে বা সমাধি অবস্থায় গায়ে জামা রাখতে পারেন না শুনে তিনি নিমন্ত্রণ বাতিল করলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সমাজে গেলেন না। ব্রাহ্ম ধর্মের এক অদ্ভুত অন্তঃসারশূন্যতা, মেকি আভিজাত্য ও সম্মানবোধ এই একটি ঘটনার মধ্যে দিয়েই স্পষ্ট হয়ে দাঁড়াল। ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা ব্রাহ্ম ধর্মে যে বেশ ভালো পরিমাণেই ছিল তা এই ঘটনায় প্রমাণ হয়।

সিঁথির বেণী পালের বাগানবাড়িতে প্রথম শ্রী কেশবচন্দ্র সেনকে দেখলেন তিনি। হৃদয় নিয়ে গেছে সঙ্গে করে। মলিন এক কাপড় পরনে, এক পুরোহিত এসেছেন ব্রাহ্ম উৎসবে? উপস্থিত অনেকেই বিরক্ত। কে ইনি? কেন এসেছেন? তখন মথুরবাবু নেই। কেউ চেনেনা তাঁকে। হৃদয় বললেন-আমার মামা। ঈশ্বরীয় কথা যেখানে হয় সেখানেই ছুটে যান। ঈশ্বরের নামে পাগল। ইনি দেখতে এসেছেন আপনারা কী করে উপাসনা করেন। দেবেন্দ্রনাথের সমাজে গেলেন না। নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে নেওয়া হল। কিন্তু সিঁথির বাগানে নিজেই চলে গেলেন। লোকমান্য হবার তো তাঁর কোনো সাধ ছিল না! সাধ ছিল, মানুষ কেমন করে ঈশ্বরকে ডাকে, তাই দেখবেন। বেদান্ত বলছে, যে ঈশ্বর ঈশ্বর করে সে নিজেই ঈশ্বর হয়ে যায়। তাহলে? তিনি মানুষের এই ঈশ্বরত্ব দেখার জন্যই উন্মুখ হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখলেন তাঁদের উপাসনা। মুহুর্মুহু সমাধি হল। এই বস্তুজগত থেকে বারবার সেই জ্যোতির্ময় জগতে চলে যেতে থাকলেন। আর তারই মধ্যে লক্ষ করলেন, এক কেশবেরই ফাতনা ডুবেছে। অর্থাৎ অন্তরে সে ঈশ্বরের সন্ধান পেয়েছে। সেইদিন থেকে তিনি কেশবের অনুরক্ত হলেন। আর কেশবচন্দ্র? তিনি তো নামেই ব্রাহ্ম রইলেন! কুক সাহেব থেকে শুরু করে সেসময়ের গুরুত্বপূর্ণ সকলকে জানিয়ে দিলেন, এসময়ে জগতে যদি বড়লোক কেউ থাকেন তো তিনি দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস। ইন্ডিয়ান মিরার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংবাদ পত্রের পাতায় ছাপিয়ে দিতে থাকলেন, হিন্দু ধর্মের প্রত্যন্ত প্রান্ত সন্ধান করলে আজও এমন অমূল্য রত্নের সন্ধান মেলে। বেদের যুগের ঋষিদের কথা সত্য। বেদ সত্য। ১৮৩৬ থেকে ১৮৭৫ সাল। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর আত্মিক ঐশ্বর্য নিয়ে প্রকাশ হলেন। কেশবচন্দ্র সেন সেই ঐশ্বর্যের সন্ধান পেলেন প্রথম। অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন হল। শ্রীরামকৃষ্ণ যান, কেশবচন্দ্রও আসেন। ক্রমে কেশবের সাঙ্গোপাঙ্গরাও আকৃষ্ট হলেন।

তাহলে কি একান্ত এই ব্যক্তিগত সম্পর্ককেই শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাবের অন্যতম কারণ ভাবা ঠিক? না। প্রমাণ রাখছেন কথামৃতকার শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্ত ওরফে শ্রীম। কেশবের প্রথম অসুখের সময় শ্রীরামকৃষ্ণ মা কালীর কাছে ডাব চিনি মেনেছিলেন। দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘কেশব না থাকলে আমি কার সঙ্গে কথা কব?’ সে যাত্রা কেশব সেরে উঠেছিলেন। ১৮৮২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যে সাতাশ বছরের মাস্টারটি (শ্রীম) পৌঁছেছিলেন দক্ষিণেশ্বরে তিনিও তো কেশবের খুব ভক্ত ছিলেন। এতটাই, যে কেশব আজ বক্তৃতা দেবেন শুনলে সেই কিশোরবেলা থেকে সেখানেই ছুটে যেতেন। বস্তুত, পরবর্তীতে তাঁর অন্তরঙ্গ সন্তান বলে যাঁদের চিহ্নিত করা হয় তাঁদের অধিকাংশ ওই কেশব সেনের ব্রাহ্ম সমাজে যাতায়াত করতেন। সিমলের দত্ত বাড়ির নরেন্দ্রনাথ তো সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যই ছিলেন বহুদিন। সেই কেশব যখন অন্তিম শয়ানে তখন শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে দেখতে গিয়ে বলে এলেন—বসরাই গোলাপের গাছ মালী গোড়াশুদ্ধ উপড়ে দেয়, ভালো হিম পাবে বলে। ফিরে ফিরতি একটা বড় কাণ্ড হবে। অর্থাৎ কেশবের জীবনকুসুম ঝরে যাবে এবার। জগতে নতুনের আবির্ভাব হবে। সে এক বিপুল আয়োজন হবে। কেশবের ভূমিকা এখানেই শেষ। মাস্টারমশাইকে বলছেন—আগের বারে যেমন কষ্ট হয়েছিল এবারে তা হয়নি।   

    তবু জানা ভালো যে, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসকে জগতের সামনে প্রথম প্রকাশ্যে এনেছিলেন কেশবচন্দ্র সেন। তাঁর আরব্ধ কর্ম ব্রাহ্ম সমাজ স্থাপন নয়, জগতের দরবারে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের মহিমা প্রকাশ করা। ব্রাহ্ম সমাজ যদি শাশ্বত হতো তবে আজ নববিধানকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না কেন?

       শ্রীরামকৃষ্ণের সিদ্ধাবস্থা সম্পর্কে ধারণা সেসময় কারোরই ছিল না। তাঁর অন্তরঙ্গ পার্ষদই হোক, বা বিরূপভাবাপন্ন মানুষই হোক। অনেকেই নিতান্ত কৌতূহল বশে এসেছেন। এসেছেন দেখতে, তাঁদের গগনচুম্বী পাণ্ডিত্য ও শাস্ত্রাধিকার থাকা সত্ত্বেও কী করে এক মূর্খ উন্মাদ পুরোহিত হঠাৎ অবতার, পরমহংস ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত হতে পারেন? যারা বিশেষণ দিচ্ছেন তারা কোন বৈশিষ্ট্য দেখে এসব দিচ্ছেন? এই প্রসঙ্গে আমরা পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণির নাম উল্লেখ করতে পারি। ১৯২০ সালে অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত সারথি পত্রিকার ফাল্গুন সংখ্যায় তর্কচূড়ামণির একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। তিনি পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু প্রশ্নের উত্তরস্বরূপ চিঠিটি দেন। উল্লেখ্য, কথামৃতে বর্ণিত পণ্ডিতমশাই ও শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎকার সম্পর্কে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় পণ্ডিতমশাইকে লিখেছিলেন, তাঁর সঙ্গে আলোচনায় যা শুনেছিলেন তার সঙ্গে কথামৃতের কথার সাদৃশ্য নেই। চিঠিতে কী লিখেছিলেন চূড়ামণি মশাই? লিখেছিলেন, তিনি যা বলেছেন তাইই সত্য। কথামৃত মিথ্যা। এইসব উপাধির ভিত্তি নেই। রামকৃষ্ণ শাস্ত্রানুসারে বড় জোর অবধুত হতে পারেন। পণ্ডিত মশাই তাঁর মধ্যে শাস্ত্রবর্ণিত লক্ষণ কিছুই দেখেননি। কথামৃতে শ্রীম লিখেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, যে আদেশ পায় নাই তার উপদেশে কী হবে? চাপরাস পেলে তবে উপদেশ দেওয়া চলে। কথামৃতের কথাটি সরাসরি শশধর পণ্ডিতের উদ্দেশ্যে নয়। বরং সেসময় যে গির্জা ও ব্রাহ্মসমাজ থেকে ঘোষণা করে ধর্মোপদেশ দান করা হতো সে সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণ বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছিলেন—ও আবার কি? সাইনবোর্ড লাগানো সাধু? অমুক সময়ে লেকচার হইবে? তোমাদের কলকাতার লোকেদের ওই এক, কেবল লেকচার দেওয়া, নিজেকে কে বোঝায় তার ঠিক নেই! স্পষ্টতই তাঁর এই মনোভাব চূড়ামণি মহাশয়ের স্বার্থে আঘাত করেছে। তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন নিজের অহংকারকে বড় করবেন বলে। জাগতিক স্বার্থসিদ্ধির বিষয়টাও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি তাঁর পছন্দ হবার কথা নয়।

       চূড়ামণি মশাই লিখছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন তাঁর পুঁথিগত বিদ্যা নেই, আর চূড়ামণি বহু শাস্ত্র পড়ে পণ্ডিত। সুতরাং শ্রীরামকৃষ্ণ একজন মূর্খ হয়ে আদেশ বা চাপরাস সম্পর্কে তাঁকে কী উপদেশ দেবেন? তাঁর সে অধিকার কই? চিঠির ছত্রে ছত্রে চূড়ামণি মহাশয়ের বিদ্বেষ উপচে পড়েছে। তিনি লিখছেন, শাস্ত্র বিষয়ে যাহারা একেবারেই অজ্ঞ, তাহাদের পক্ষেই তাহা উপযোগী হইতে পারে। তিনি একথা লিখছেন কথামৃত সম্পর্কে। তিনি পণ্ডিত, কিন্তু ঈশ্বরতত্ত্ব কী, ব্রহ্মত্বই বা কী, সে সম্পর্কে চূড়ামণি মহাশয় একেবারেই অজ্ঞ, তা নিশ্চিত। কারণ, কথামৃতের কথার মর্মার্থ অনুধাবন করে এমন পণ্ডিত জগতে নেই। একমাত্র স্তর উন্মোচন হলে তবেই জানা যায়। এই লেখার পরিশিষ্ট অংশে আমরা তেমন কয়েকটি উদাহরণ দেব।

       এখানে শশধর তর্কচূড়ামণির প্রসঙ্গের অবতারণা এই কারণে যে, শুধু ব্রাহ্ম সমাজ নয়, হিন্দু পণ্ডিতদের মধ্যেও শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে কম বিদ্বেষ কাজ করেনি। অবাক হতে হয় যে, ১৯২০ সালে চূড়ামণি যখন চিঠি লিখে পত্রিকায় ছাপাচ্ছেন তখনও কথামৃতকার বেঁচে। চূড়ামণিমহাশয় যদি সত্যিই এই কথাকে মিথ্যা বলে জানতেন তবে তো অনায়াসে তা শ্রীম’র  নজরে আনতেন! তা তিনি করলেন না কেন? শ্রীম’র প্রামাণ্য গ্রন্থ সম্পর্কে সঙ্গকারীদের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। সেখানে শশধর তর্কচূড়ামণি (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, তৃতীয় ভাগ, নবম খণ্ড) ও শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ নিয়ে যা লেখা হয়েছে তা শুধু শ্রীম’র মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। কারণ, তাঁর লেখায় সাক্ষীর কখনও অভাব ঘটেনি। তিনি অত্যন্ত সতর্কভাবে প্রতিটি পরিচ্ছেদে একাধিক নাম উল্লেখ করেছেন। শশধর সেদিন একা ছিলেন না। ছিলেন ভূধরের দাদা। ইনি শ্রীরামকৃষ্ণের একান্ত অনুরাগী হয়েছিলেন শেষ জীবনে। এত কিছু সত্ত্বেও দম্ভের বশে শশধর তর্কচূড়ামণি শ্রীরামকৃষ্ণকে নস্যাৎ করলেন। শাস্ত্র তাঁর পাঠের প্রয়োজন ছিল না। তিনি নিজেই মূর্ত বেদান্ত। শশধর তর্কচূড়ামণিকে কেউ মনে রাখেনি।

       ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম আর এক বিপ্লবী সদস্যের নাম করি। ইনি কেশবচন্দ্রের সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গ করার জন্য বলে অনেকেই মনে করেন। যদিও কেশবচন্দ্র  কুচবিহারের মহারাজার সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন বলে তাঁর অখ্যাতি রটে ও অনেকেই তাঁকে ত্যাগ করেন। কিন্তু আসল কারণ, কেশবের অসম্ভব জনপ্রিয়তা। সকলেই তো ক্ষমতা চায়! কজন আর শ্রীরামকৃষ্ণ হন! যিনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করেছেন অজস্রবার। বলেছেন, গুরু বাবা, কর্তা তিন কথায় আমার গায়ে কাঁটা বেঁধে। বলেছেন, সচ্চিদানন্দই গুরু। বলেছেন, সাইনবোর্ড লাগানো সাধু, সাধু নয়। 

       ইনি শিবনাথ শাস্ত্রী। শ্রীরামকৃষ্ণ এঁকে ব্রাহ্মসমাজে দেখেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন ইনি একেবারে অন্তঃসারশূন্য নন। তাই মাঝে মাঝে তাঁকে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। কলকাতায় গিয়ে তাঁকে খবর দিয়েছেন, অনেক সময় শিবনাথ আসেননি। জরুরি কাজে অন্যত্র গিয়েছেন বলে খবর দিয়েছেন। নিরহংকার শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুই মনে রাখেননি। একবার দেখে নেব, শিবনাথ শাস্ত্রী শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে কী মনোভাব পোষণ করতেন।

       তাঁর নিজের স্মৃতিচারণে কিন্তু তিনি অকুণ্ঠ লিখছেন—বৈরাগ্য তাঁহার সমগ্র চেতনায় একেবারে ওতপ্রোত হইয়া গিয়াছে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন—এ দেহ থেকে জীব-জীবনের কামনা বাসনার মূল উৎপাটিত হইয়া গিয়াছে। শিবনাথ জানিয়েছেন, এ উক্তির তাৎপর্য তিনি সেদিন বোঝেননি। নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের মতানৈক্য থাকলেও, বিশেষত কামিনীকাঞ্চন বিষয়ে, কারণ ব্রাহ্ম উপাসকেরা বিবাহিত ও সন্তানের জনক হয়েও সমাজের গদীতে বসতে পারতেন, তিনি স্বীকার করছেন, শ্রীরামকৃষ্ণের দেহে এক বিস্ময়কর স্নায়বিক পরিবর্তন তিনি প্রায়ই লক্ষ করতেন। যদিও শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবতন্ময়তাকে তিনি অতিরিক্ত কৃচ্ছসাধন ও কঠোর সাধনার কারণে মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ বলে উল্লেখ করেছেন, তবু তাঁর স্মৃতিচারণ সশ্রদ্ধ। এ থেকে বোঝা যায়, শিবনাথের সার ছিল। তিনি শুষ্ক পণ্ডিত ছিলেন না। তবু উল্লেখ করতে হয়, কথামৃতে এক জায়গায় শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—শিবনাথ নাকি বলেছে বেশি ঈশ্বর চিন্তা করে উনি বেহেড হয়ে গেছেন? চৈতন্যকে চিন্তা করে কি কেউ অচৈতন্য হয়? তাহলে সুপণ্ডিত হলেই হয় না। তথাকথিত মূর্খ শ্রীরামকৃষ্ণ জানিয়ে দিলেন, চৈতন্যকে চিন্তা করলে চৈতন্য লাভ হয়। অচৈতন্য হয় না সে। তাহলে মস্তিষ্ক বিকৃতির কথাটা শিবনাথ শাস্ত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত।

 

সমসাময়িক দৃষ্টিতে তাঁর প্রতি সেসময়ের মানুষ ও সমাজ কী ভেবেছে তা আমাদের আলোচনার উপজীব্য নয়। আমরা মহামানবকে যেটুকু সম্ভব ধারণা করতে পারি তারই চেষ্টা করব। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, তিনি শাস্ত্র পড়েননি বটে তবে শুনেছেন অনেক। বলেছেন, “ওগো আমি শুনেছি কত!”

    তাঁর আবির্ভাবকে উনবিংশ শতকের নবজাগরণের অন্যতম একটি বিশেষ পর্যায় বলেন অনেকে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তাঁর দিকে তাকালে বারবার মনে হয়েছে, তিনি আসবেন, তাই উনিশ শতকের আলো এসে পড়েছিল বাংলাদেশে। তাঁর কথা অনুসারে, “বাবু আসবেন তার আগে পথ পরিষ্কার করে আলো দেওয়া হয়। খানসামা চাকর বাকর এসে ঘর সাজিয়ে দেয়। নইলে বাবু এসে বসবেন কোথায়?” তিনি আসবেন তাই সেই সময়ের সমাজে কুসংস্কার আচ্ছন্ন অন্ধকারে নব জাগরণের আলো এসে পড়েছিল।

একথার মধ্যে আবেগ নয় অন্যতর পর্যবেক্ষণ আছে। ১৮৭৫ থেকে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত, এই এগারো বছরের সময়কালে তাঁর উপস্থিতি, তাও দক্ষিণেশ্বর ও কলকাতার কিছু অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তিনি পর্যটক ছিলেন না। কোথাও ধর্ম প্রচার করতে যাননি। এ বিষয়ে তাঁর গভীর অনীহা ছিল। সাধারণত অবতারদের আমরা ধর্ম প্রচার করতেই দেখেছি। লব্ধ বস্তু তাঁদের স্থির থাকতে দিতো না। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ এ অবস্থা থেকে ওপরে গিয়েছিলেন। অথচ গভীর প্রত্যয়ে তিনি নিজের কথা বলে গেছেন। সেসব কথা বলতে বলতে বারবার উল্লেখ করেছেন—আমি বলছি না, মা বলছে। এই ‘মা’ কে? বলছেন—তোমরা যাকে ব্রহ্ম বলো আমি তাঁকে ‘মা’ বলে কই। তাহলে তিনি বলছেন না। বলছেন ‘মা’। তাঁর আর একটি কথা—‘মরা মরা শুদ্ধ মন্ত্র ঋষি গিয়েছেন বলে। ‘ম’ মানে ঈশ্বর, ‘রা’ মানে জগত’। তাহলে এই ‘ম’ বা ঈশ্বর বা ব্রহ্ম, যিনি কিনা বাক্যমনের অতীত, অতএব নিরাকার, সেই ‘ম’য়ে আকার দিলে ‘মা’ হয়। অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্ম সাকারে ‘মা’ হলেন। নির্গুণ ব্রহ্ম সগুণ হলেন। তাঁর ভেতর থেকে এই সগুণ ব্রহ্ম কথা বলতেন কি? ঠিক তা নয়। আসলে তিনি নিজেই সগুণ ব্রহ্মে পরিবর্তিত হতেন, এবং তা ঘটত তাঁর অজ্ঞাতসারেই।

তাঁর জন্মের পাঁচশ বছর আগে এই বাংলাদেশেই এক মহামানবের আবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে যে বিবর্তনের সূত্রপাত শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে দিয়ে সেই বিবর্তনের অগ্রগতি। বস্তুত শ্রীচৈতন্যদেবের কথা বহুবার উল্লিখিত আছে শ্রীরামকৃষ্ণের কথায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—চৈতন্যের প্রেম হয়েছিল, বস্তুলাভ হয়নি। এখানে বেদের ধারাবাহিক সাধনের উল্লেখ করতে হয়। বেদের আগম বলতে দেহে যে সপ্তভূমি আছে তার কথা বলা হয়েছে। এই দেহের প্রতি কোষে যে প্রাণশক্তি ছড়িয়ে আছে তা সংকলিত হয়ে আমাদের সুষুম্নাদ্বারে আসে। সবচেয়ে প্রথমে মূলাধার। সংকলিত প্রাণশক্তি মূলাধারে এলে মানুষটা শান্ত হয়। এই সংকলিত প্রাণশক্তি, তন্ত্রে যাকে বলে কুণ্ডলিনী, বেদে বলছে মহাবায়ু, সেই শক্তি উর্ধগতি লাভ করে একে একে ভূমি অতিক্রম করতে থাকে। মেরুদণ্ডের কশেরুকাতে এই ভূমিগুলির অবস্থান। এই একেকটি ভূমি অতিক্রম করার সময়ে দেহীর নানাবিধ অনুভূতি ও দর্শন হতে থাকে। আসলে যে পঞ্চভুতে এই শরীর গঠিত, সেই পাঁচটি ভূত অন্যটিতে পরিবর্তিত হয়। এই দেহ আসলে ‘মাটি’, বা ক্ষিতি। অন্নময় কোষ বলছে বেদ। দেহের প্রথম তিনভূমি এই অন্নময় কোষের অন্তর্গত। লিঙ্গ গুহ্য ও নাভি। অন্নময় কোষে আমাদের প্রাণশক্তি এই বস্তুজগতেই সংকলিত হতে পারে। সেখানে কোনো অনুভূতি নেই। শুধু অন্নময় কোষ প্রাণময় কোষে পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ ‘মাটি’ ‘জলে’ বা ‘অপ’ এ পরিবর্তিত হয়। মাটি যেমন কঠিন, নির্দিষ্ট সীমায় বদ্ধ, জল তা নয়। দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমার বাইরেও তা ছড়িয়ে যায়। শক্তি এখানে সীমাকে অতিক্রম করছে।  তারপর চতুর্থ ভূমি, হৃদয়ে মন এলে জল বায়ুতে পরিবর্তিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—তখন যেদিকে চোখ পড়ে সাধক জ্যোতি দেখতে পায়। গাছের ডালের দিকে চোখ পড়লেও রূপা বা পারা গলার মতো দেখা যায়। অর্থাৎ সাধক সব চৈতন্যময় দেখেন। কেন? কারণ তাঁর অন্তরচৈতন্য তাঁর দৃষ্টিকে লিপ্ত করছে। তিনি যেদিকে চোখ ফেলছেন সেইদিকেই সেই চৈতন্য জ্যোতিরূপে লিপ্ত হচ্ছে। এরপরে পঞ্চমভূমি বা কণ্ঠে মন গেলে সাধকের মন আর জাগতিক কিছুতে লিপ্ত হয়না। তখন বায়ু আকাশে বা ‘ব্যোম’ এ পরিবর্তিত হয়েছে। এই ভূমিতে সাধকের আকাশ দর্শন হয়। জল থেকে বায়ু ত্রিমাত্রিক পরিবর্তন। শক্তি তখন অসীমে যেতে পারে। কিন্তু পঞ্চমভূমি বা আকাশে মন গেলে তাঁর আর পদার্থস্বরূপ থাকছে না। পদার্থের শক্তিত রূপান্তর শুরু হয়েছে। ষষ্ঠভূমিতে সাধকের ইষ্টদর্শন হয়। কিন্তু দেশকাল ভেদে ইষ্টদর্শনের প্রভেদ আছে। তাই একেই পরমসত্য বলে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এরপর সপ্তমভূমি। সেখানে মন গেলে দেহী সম্পূর্ণভাবে তেজে পরিবর্তিত হন। পঞ্চভূতের শেষ। পদার্থ শক্তিতে পরিণত। আত্মিক গতি শক্তিতে পরিণত করে। দেহীর দেহবোধ সম্পূর্ণ লুপ্ত। শুধু চেতনা থাকে। সেই চেতনায় তিনি নিজের স্বরূপ দেখতে পান। সূর্যস্বরূপ জ্যোতির মধ্যে নীল রেখা দ্বারা সীমায়িত জ্যোতিপুঞ্জ। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠবৎ জ্যোতি, যাকে বেদে বলছে ‘আত্মা’। এইখানেই বেদের আগম সাধন শেষ। এরপর নিগম। এই জ্যোতি এরপর অবতীর্ণ হয় দেহে। প্রথমে কণ্ঠ পর্যন্ত, তারপর কটিদেশ পর্যন্ত। এই অবতীর্ণ জ্যোতি বা চৈতন্য তখন দেহীকে শক্তিমান করে। তাঁর দেহের প্রতিটি কোষ তখন চৈতন্যে পরিবর্তিত। অল কনশাস। শ্রীরামকৃষ্ণ চৈতন্যদেব সম্পর্কে যখন বলছেন, চৈতন্যের প্রেম হয়েছিল, বস্তুলাভ হয়নি, তখন তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে চৈতন্যদেবের এই জ্যোতিস্বরূপ আত্মা সাক্ষাৎকার হয়নি, কিন্তু চৈতন্যের দেহে শক্তির অবতরণ হয়েছিল। সে প্রমাণ তাঁর নামেই রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। তাঁর দেহে সাকারে চৈতন্যের অবতরণ হয়েছিল। দেহের মধ্যে আর একটি জ্যোতির্ময় উপস্থিত। সেই প্রেমের কথাই ঠাকুর বলেছেন। শ্রীচৈতন্যদেবের অপূর্ব কৃষ্ণপ্রেম ও বিরহ দেখে জগত স্তম্ভিত ও মোহিত হয়েছিল। কিন্তু তাঁর অবস্থা অনুধাবন করতে পারেনি। কারণ ঠাকুর বলছেন অবতার প্রত্যক্ষসিদ্ধ। এই অবতীর্ণ শক্তির কাছে বড় বড় পণ্ডিত পর্যন্ত কেঁচো হয়ে যায়—শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত। চৈতন্যদেবের জীবনে এ সত্য বারবার প্রকাশিত।

অবতারত্ব তাহলে একটি কন্ডিশান বা অবস্থা। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের জীবনে আত্মা সাক্ষাৎকারের কথা আছে। তিনি বলছেন—জোর করলে মা বাপ পরামর্শ করে দু তিন বছর আগে হিস্যে ফেলে দেয়। বাইশ/তেইশ বছর বয়সে তাঁর ভগবান দর্শন হয়। তিনি বলছেন দেহের মধ্যে ফাল চালানোর মতন কষ্ট হয়েছিল। কারণ দেহের পরিপূর্ণ বিকাশের কিছু আগেই এ ঘটনা ঘটেছিল। তাঁর অবতারত্বের কথায় বলছেন—তোমরা বেশ আছ। সারে মাতে। আমি বেশি কাটিয়ে জ্বলে গেছি। অর্থাৎ তাঁর ‘আমি’ সম্পূর্ণরূপে নাশ হয়ে জ্যোতিতে অবতরণ করেছে। এই অবতারত্ব অবস্থায় দেহী একাই থাকেন। কসমিক ম্যান। তাঁর তখন এক অদ্ভুত প্রেম জন্মায়। বিশুদ্ধ অদ্বৈত অবস্থায় যেমন দেহস্থ চৈতন্যের প্রতি প্রগাঢ় প্রেম বা আকর্ষণ জন্মায়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—তোমাদের কাছে বলতে নাই, কিন্তু এ অবস্থায় সচ্চিদানন্দকে আলিঙ্গন চুম্বন করতে ইচ্ছা করে। সচ্চিদানন্দ তো বাইরে নয়! নিজের অভ্যন্তরে! এই দেহাতীত প্রেমের কথা তিনি কাকে বলবেন? কে উপলব্ধি করবে? সাধারণত মানুষ তো প্রেম ভাবলেই পাত্র বা আধার ভাববে। এই দেহ আধার আর দেহস্থ চৈতন্য আধেয়, একথা সে কেমন করে বুঝবে? যার দেহে কাম এতটুকুও আছে, মানুষ মাত্রই তা থাকে, সে এই প্রেম ধারণা করতে পারবে না। বৈষ্ণব মহাজনেরা এই প্রেম বোঝাতে চেয়েছেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে তো চৈতন্যের অবতরণ ঘটেনি! তাহলে সবটাই কল্পনা। সত্য অপ্রকাশ থেকে গেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ এই অবতারত্বের পরবর্তী অবস্থান্তর প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি জানতেন, অবতার ব্যষ্টি। “তোমার কথা লবে কে?” কিন্তু এই অবতীর্ণ শক্তি যখন চৈতন্যে পরিবর্তিত হয় তখন তা প্রবাহিত হয় জগতে। শ্রীরামকৃষ্ণ তা জেনেছিলেন। যখন তিনি বলছেন আগে ‘ম’ পড়ে ‘রা’, তখন তিনি আগে আত্মা তারপর জগত, আত্মার মধ্যে জগত, এই কথা বলতে চেয়েছেন। এই বিশ্বরূপ দর্শন। এ অবস্থায় স্থান কালের নাশ হয়। স্পেসটাইম অ্যানিহিলেশনের কথায় জ্যোতিপদার্থ বিদ্যা বলছে, সময় নামক মায়া বা ইলিউশন ফোর্থ ডাইমেনশানের পরবর্তী অবস্থায় বোঝা যায়। একে বলা হয় তুরীয়। আশ্চর্য এই যে, শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, জাগ্রত স্বপ্ন সুষুপ্তি ও তুরীয়, দেহের এই চারটি অবস্থা। তাহলে অবস্থান্তরের সঙ্গে সঙ্গে দেহী সেই তুরীয় অবস্থার অনুভূতি লাভ করে। তুরীয় অনেকটা কৃষ্ণ গহ্বরের মতন। কী আছে তা বলা যায় না। অসীম। যতটুকু প্রকাশ হয় ততটুকুই আমাদের জ্ঞানের আলোয় আসে। তাহলে প্রত্যেক মানুষের দেহেই এই তুরীয় আছে। তা প্রকাশের অপেক্ষায়। কিন্তু একটি দেহে ‘অসীম’ প্রকাশ হতে পারে না। ‘অসীম’ অসীমেই প্রকাশ হয়। তাই জগত। জগতেই এই অসীম প্রকাশ হয়। হবে। বিবর্তনের এই পর্যায় আমরা এখন দাঁড়িয়ে। 

 

মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে শ্রীরামকৃষ্ণ দেহত্যাগ করেন। অনেকের ধারণা তাঁর রোগের ও অকালে চলে যাওয়ার কারণ পাপী তাপী অধম মানুষদের (গিরিশের পাপ নিয়েই অসুখ) পাপ গ্রহণ। কিন্তু এ সর্বৈব মিথ্যা। তাঁর সামনে কেউ নিজেকে পাপী বলে করুণা প্রার্থনা করলে  তিনি অসন্তুষ্ট হতেন। সৎ অসৎ, পাপ পুণ্য, ব্যবহারিক জগতের ক্ষেত্রে, সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একান্তই সাব্জেকটিভ। বলতেন—যে রাতদিন পাপ পাপ করে সে শালাই পাপী হয়ে যায়। আসলে মনের রং বুদ্ধিতে বর্তায়। বুদ্ধি মলিন হয়। বরং একথা মনে করা ভালো, “আমি ভগবানের নাম করেছি, আমার আবার পাপ কী?” সুতরাং মানুষের অন্তরে যে মানুষরতন আছে তা তিনি জেনেছিলেন। তাই যেকোনো রকম ভেদাভেদ নির্বিশেষে তাঁর প্রেম জগতের প্রতি ধাবিত হয়েছে। কারণ তাঁর মধ্যেই তো জগত! বস্তুত প্রতিটি মানুষের মধ্যেই জগত। সে তাকে বিক্ষেপ করে বাইরে দেখছে। বেদে যেমন মাকড়সা আর তার জালের কথা বলেছে। কিন্তু আমাদের এ ধারণা হয়না। কেন? আমরা পরবর্তী অবস্থায় যাই। এখন আর শ্রীরামকৃষ্ণ স্থুল শরীরে নেই। আছেন তাঁর প্রিয় সন্তান নরেন্দ্রনাথ দত্ত। একমাত্র স্বামীজী এখন আলোকবর্তিকাটি ধরেছেন।

কী বলেছেন স্বামীজী নিজের কথা? বাহ্যিক পূজা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করছেন। প্রথম জীবনে নাস্তিক মত ও বুদ্ধবাদে আস্থা রেখেছিলেন এই ওজস্বী সন্ন্যাসী। কিন্তু তাঁর ঠাকুর যখন বললেন—দুটো আছে। অস্তি আর নাস্তি। অস্তিটাই লও না কেন? তখন তিনি অস্তিত্বের খোঁজ করলেন। বিস্তর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন পড়ে কুল কিনারা পেলেন না। তখন অদ্ভুতভাবে তাঁর মস্তিষ্কের স্তর উন্মোচন হল। দেখলেন, অস্তিই সত্য। যা কিছু আছে তাইই সৎ, নিত্য, বোধস্বরূপ। অসৎ অনিত্য বলে কিছু নেই। ক্রমাগত পরিবর্তনশীল এই বিশ্ব। কারণ গতিই সত্য। গতি অর্থাৎ ভাইব্রেশান। যা এখন স্ট্রিং থিয়োরি বলছে।

জীবনের প্রান্তে এসেছেন স্বামীজি। তাঁর এক শিষ্য জিজ্ঞেস করছেন—আপনি কি করে এত দূর ভবিষ্যতের কথা বলতে পারেন? স্বামীজী বলছেন—কী হয়েছে জানিস? আমার মাথার চামড়াটা গুড়িয়ে গেছে। কী বলছেন স্বামীজী? ডাহা দেহতত্ত্ব! তাঁর ব্রেনের মেমব্রেনটি গুটিয়ে গেছে। সরে গেছে। সামনে যে দৃশ্যমান জগত, তার মায়ার চাদর সরে গেছে। প্রত্যেক মানুষের মাথার মধ্যেই তো জগত! কিন্তু মায়ায় বা মেমব্রেনে ঢাকা। স্বামীজীর উন্মুক্ত মস্তিষ্ক। একে বেদ বলছে, বস্তুতত্ত্বে ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার। বস্তুতত্ত্বে, প্রতীকে নয়! এত বড় একটা অবস্থা সম্পর্কে আমরা কতটুকু ধারণা করতে পেরেছি? জগতের প্রতি তাঁর অদ্ভুত ভালোবাসা এই কারণেই। তিনি জগতকে ভেতরে পেয়েছিলেন। সেই কারণেই বাইরের ‘ভগবান’ নামক কাল্পনিক অস্তিত্বকে তীব্র তিরস্কার করেছেন। বলেছেন—দূর আহাম্মক! যে ভগবান ইহলোকে দুটো অন্ন দিতে পারেন না তিনি স্বর্গে তোকে কী সুখে রাখবেন? এই কথায় তিনি যে ইহকাল পরকাল স্বর্গ নরক এমনকি কল্পিত ভগবানকেও উচ্ছেদ করছেন সে বোঝে কার সাধ্য?

আর একদিনের কথা। তাঁর প্রিয় শিষ্য শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী তাঁকে জিজ্ঞেস করছেন—আচ্ছা, কৃপা মানে কি? শ্রীরামকৃষ্ণদেব এতবার বলেছেন কৃপা ছাড়া আত্মিক উন্মেষ হয়না, ঈশ্বরের কৃপায় ঈশ্বরলাভ, যে স্বাভাবিক ভাবেই কৃপা কী তা জানতে অনেকেই উৎসুক ছিলেন। এর উত্তরে স্বামীজী বলছেন—কৃপা মানে কী জানিস? কোনো আত্মবিৎ সাধুর চারিধারে একটি আত্মিক তরঙ্গ থাকে। কিছু না জেনেও সেই বৃত্তের মধ্যে যদি কেউ এসে পড়ে তবে কিছু সাধন ভজন না করেও সে প্রভূত আত্মিক ঐশ্বর্য লাভ করে। একে যদি কৃপা বলিস তো বল।

তাহলে কৃপা দান বা গ্রহণ নয়, একটি উচ্চতর আধ্যাত্মিক তরঙ্গ। যা একটি বৃত্তের মতন একটি দেহকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়। সেই বৃত্তের মধ্যে যো সো করে ঢুকে যাওয়া। স্বামীজীর কৃপার এই অপূর্ব ব্যাখ্যা জগতে আর কেউ দিতে পারেননি। তাঁর এই ব্যাখ্যার পরবর্তী উন্মেষ দেখা যায় নীচের উক্তিতে, যেখানে তিনি মানুষের ধর্ম বলতে কী বোঝাতে চাইছেন, সেই কথা বলছেন।

Mankind ought to be taught that religions are but varied expressions of THE RELIGION, which is Oneness.

(letter written to Mohammed Sarfaraz Hussain of Ninital)

তাহলে একত্বই ধর্ম! সে একত্বে মানুষের উপলব্ধি হয়, আমি ও আমার সামনে এই জগত আসলে এক। একই আত্মিক চৈতন্যের বহুত্বে প্রকাশ। স্বামীজী এভাবেই এগিয়ে দিলেন আমাদের। আবার এরপর কী বলছেন? বলছেন--

Granted that you attain personal liberation by means of Advaita, but what matters it to the world? You must liberate the whole universe before you leave this body. Then only you will be established in the Eternal Truth. Has that bliss any match, my boy?

(Complete Works Vol. vii page 161)

তুমি নিজে নয় সাধনা করে মুক্তি লাভ করলে, জানতে পারলে তুমি শুধু মাত্র এই দেহ নও, তুমি সেই নিত্যশুদ্ধ বোধস্বরূপ অসীম অস্তিত্ব। কিন্তু তাতে জগতের কী হল? জগতের একটি মানুষও যদি সেই বোধ থেকে বঞ্চিত হয় তবে তোমার ব্যক্তিগত মুক্তির দাম কী? তোমার মৃত্যুর আগেই যদি তোমার মুক্তি তুমি জগতবাসীকে দান করতে পারো তবেই প্রকৃত মুক্তি। জীবন্মুক্তি। সেই আনন্দের কি কোনো তুলনা হয়?

তাহলে স্বামীজী বিশ্বব্যাপী মুক্তির কথা বলছেন। ব্যষ্টি তিনি ত্যাগ করছেন। শুধুমাত্র নিজের হলেই হল না। জগতের প্রতিটি মানুষের হওয়া চাই। নাহলে তোমার একক মুক্তি মুল্যহীন।

এই কথার মধ্যে দিয়ে স্বামীজী প্রচলিত অবতারত্বকে উচ্ছেদ করছেন। বলছেন, কোনো একক মহামানব আর আসবেন না। ধর্মগ্লানি দূর করতে এমন ঘটনার আর প্রয়োজন নেই। কারণ জগত জুড়ে এবার চৈতন্যের ক্রিয়া চলবে। কেউ যদি একক মুক্তির দাবী করে তবে সে নিজের অহংকেই বড় করবে।

সুতরাং, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস শেষ অবতার। তাঁর পরে আর কেউ জন্মাবেন না। অবতারত্বের অবস্থা আমরা পেরিয়ে গিয়েছি। এরপর স্বামীজী যা বলছেন তা চূড়ান্ত।

Being one with Divinity there cannot be any further progress in that sense.  

মানুষটা ঈশ্বরত্ব পেলে তার আর চাওয়ার কিছু থাকেনা। পূর্ণর অভাব বোধ থাকে না। পূর্ণ থেকে পূর্ণ নিলে পূর্ণই পড়ে থাকে। আর এই পূর্ণত্ব একা কারোর সম্পদ নয়। এ জগতের সম্পদ। 

তাহলে তাঁর অবদান কী রইল? এই আত্মিক বিবর্তনে তাঁর ভূমিকা কী? আমরা আলোচনা করে নেব তাঁর ভগবানের ব্যাখ্যা কী। স্বামীজী বলছেন-- 

There is one thing to be remembered—The assertion—I am God—that cannot be made with regard to the sense world. So the affirmation of your divinity applies to the Noumenon. 

এর অর্থ, বস্তুজগত থেকে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগত থেকে ‘আমি ভগবান’ এই অবস্থা অনুভব করা যায় না। যায় আত্মিকে। অর্থাৎ, আত্মিক উপলব্ধি নাহলে এ অবস্থার কথা বলা যায় না।

এরপরে ঈশ্বরত্বের ব্যাখ্যা।

In reply to a question—'Ishwara’—I give the following definition. ‘ishwara’ is the sum total of individuals, yet he is an individual. Samoshthi or collected equals God. Byasthi equals ‘Jiva’. The exixtance of Ishwara therefore depends on that of Jiva. Thus Jiva and Ishwara are co-existant beings. When one exists the other must. Also because except on our earth in all the higher spheres the amount of good being vastly in excess to the amount of evil. The sum-total—Ishwara may be said to be all good.

সরলার্থঃ জগতের প্রতিটি মানুষের প্রাণের সমষ্টিই হলেন ঈশ্বর। আবার তিনি একজন ব্যক্তিও বটে। সমষ্টি মাত্রই ঈশ্বর। ব্যষ্টি মাত্রই জীব। ঈশ্বরত্ব অতএব জীবের ওপরেই নির্ভরশীল। জীব ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব পরস্পরের ওপরে নির্ভরশীল, বা দুটি অস্তিত্ব ওতপ্রোত। একটি থাকলে অপরটিও আছে। তবে এই বাস্তব জগতে যে অসৎ আছে তার চেয়ে অনেক অধিক পরিমাণে সৎ উর্ধতন স্তরে আছে। অতএব ঈশ্বরত্ব বলতে আমরা যেন সেই সর্বাত্মক ‘সৎ’কেই বুঝি।

       স্বামীজী তো একক মুক্তি একক উপলব্ধি বা বিকাশে বিশ্বাসী নন! তাঁর কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ব্যক্তিমানুষের ওপরে নির্ভরশীল! জীব ছাড়া শিব নয়! জীবই শিব! তবে এই উপলব্ধি, অসৎ বলে কিছু নেই, সবই সেই সৎ, একথায় তিনি বলছেন, এই বস্তুজগতের ওপরের স্তরে  যেখানে ইন্দ্রিয়ের কাজ নেই, সেখানেই এই উপলব্ধি সম্ভব। 

       তাহলে এতদূর বলে যাওয়া সত্ত্বেও জগতের অধিকাংশ মানুষ সে ঈশ্বরত্বের সন্ধান পেল না কেন? কারণ সেই বিশুদ্ধ একক স্বরূপ বা একত্ব, যাকে স্বামীজী বলেছেন Religion is Oneness, তা এখনও প্রকাশের অপেক্ষায়। যে স্তরে বিজ্ঞান বলছে চেতনার স্তর এককে পৌঁছবে সেখানে প্রত্যেক মানুষ অনুভব করবে, আদতে অস্তিত্ব এক, প্রকাশে বিভিন্নতা। দেহে ভিন্ন হলেও আত্মিকে এক। এটি আমাদের মস্তিষ্কের উন্নত অবস্থায় ধরা দেবে। কিন্তু এত বড় একটি আত্মিক বিবর্তন, যা বৈপ্লবিক তো বটেই, তা আমরা ধারণা করতে পারলাম না, এর চেয়ে দুঃখের আর কী আছে!

       পরাধীন দেশ সম্পর্কে স্বামীজীর ক্ষোভ ছিল। কারণ ব্রেনে দাসত্বের সেল থাকলে সে মানুষ দ্বৈতবাদের বাইরে যেতে পারেনা। ফলে বিশুদ্ধ অদ্বৈত সে মাথায় ধারণা হয় না। সম্ভবত সে কারণেই ভারতবর্ষের মুক্তির জন্য তাঁর বড় উদ্বেগ ছিল। ব্রেনের সেল থেকে দাসত্ব সরলেই চেতনার মুক্তি ঘটে।

       স্বামীজীর সম্পর্কেও আমাদের ধারণা তাই বড় অস্পষ্ট।

পরিশিষ্টঃ

এই অংশে শ্রীরামকৃষ্ণের কিছু কথার মর্মার্থ লেখা যাবে বলে কথা দেওয়া ছিল। কথামৃত থেকে কটি উক্তি ও ব্যাখ্যা পরপর সাজানো গেল।

১ শ্রীরামকৃষ্ণ—দেহের সুখ দুঃখ আছেই। যার ঈশ্বর লাভ হয়েছে সে মন, প্রাণ, দেহ আত্মা সমস্ত তাঁকে সমর্পণ করে। পম্পা সরোবরে স্নানের সময় রাম লক্ষ্মণ সরোবরের নিকট মাটিতে ধনুক গুঁজে রাখলেন। স্নানের পর উঠে লক্ষ্মণ তুলে দেখেন যে ধনুক রক্তাক্ত হয়েছে। রাম দেখে বললেন, ভাই, দেখ দেখ, বোধ হয় কোনো জীব হিংসা হল। লক্ষ্মণ মাটি খুঁড়ে দেখেন একটা বড় কোলা ব্যাং। মুমূর্ষু অবস্থা। রাম করুণস্বরে বলতে লাগলেন, ‘কেন তুমি শব্দ কর নাই, আমরা তোমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করতাম। যখন সাপে ধরে তখন তো খুব চিৎকার করো!’ ভেক বললে, ‘রাম! যখন সাপে ধরে তখন আমি এই বলে চিৎকার করি—রাম রক্ষা করো, রাম রক্ষা করো। এখন দেখছি রামই আমায় মারছেন। তাই চুপ করে আছি’।

অর্থঃ শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, দেহের সুখ দুঃখ আছেই। দেহ থাকলে রোগ শোক দুঃখ আছেই। তার সঙ্গে ঈশ্বরীয় বিকাশের কোনো সম্পর্ক নেই। যার ঈশ্বরত্ব লাভ হয়েছে তার মন প্রাণ দেহ আত্মা সব ঈশ্বরে পরিণত হয়েছে। তার অহং পর্যন্ত ঈশ্বরে পরিবর্তিত। দেহবোধ না থাকলে সুখ দুঃখের বোধও থাকবে না। এরপরের অংশে ব্যাং মানে জীবের ক্ষুদ্র অহংকে বলছেন। সে মাটিতে গর্তে আছে। অর্থাৎ দেহে আবদ্ধ হয়ে আছে। ‘মাটি’ স্থুল দেহ। সেখানে যখন সাপে ধরে, অর্থ, কুণ্ডলিনী যখন তার জীবত্বকে নাশ করতে যায়। সাপ অর্থ কুণ্ডলিনী শক্তি। এটি কারেন্ট বিশেষ। গতিকে উর্ধমুখী করে। এই শক্তি যখন জীবকে তাড়া করে তখন সে প্রতি ভূমি অতিক্রম করতে করতে নানারকম দর্শন করে। সেই হল চিৎকার। এবার স্বয়ং রামের ধনুক তাকে বিঁধেছে। রামের ধনুক শূন্য থেকে মাটিতে গিঁথেছে। অর্থ, শূন্য বা নির্গুণ থেকে রাম বা এক, বা ব্রহ্ম ক্রিয়া করছেন। একডাকে ব্যাঙের জীবত্ব বা অহং ‘রামে’ বা ব্রহ্মে পরিবর্তিত।

‘রাম’ শব্দে শ্রীরামকৃষ্ণ যে ‘ঈশ্বর’ বা ‘ব্রহ্ম’কেই বোঝাতেন তার আর একটি উদাহরণ, তিনি বলছেন—তুমি জানো আর না জানো, তুমি রাম। অর্থাৎ তুমি ব্রহ্ম, এ তোমার জানা বা না জানার ওপরে নির্ভর করেনা। স্বয়ংপ্রকাশ ব্রহ্মকে জানতে পারলে তুমি তোমার স্বরূপ জানতে পারবে। তা নাহলেও তোমার স্বরূপ সেই ব্রহ্মই।  

 আমি আর পরব্রহ্ম এক, মায়ার দরুন জানতে দেয় না। 

এই ‘আমি’ উত্তমপুরুষ। সকলেই নিজেকে ‘আমি’ বলে সম্বোধন করে। এই ‘আমি’ সেই পরব্রহ্ম। জানতে পারলে আর মায়ায় বদ্ধ হতে হয়না। মায়াতেই বিভিন্ন দেখায়। বস্তুত একই আছেন। দুই নেই।

 একটি লোকের ছেলের খুব অসুখ। মরমর অবস্থা। এমন সময় তাকে একজন বললে, একটি কাজ করতে পারলে হয়। সে ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলে—কি? লোকটি বললে, অমাবস্যার রাত হবে, স্বাতী নক্ষত্রে বৃষ্টি পড়বে, তখন একটা সাপ একটি ব্যাংকে তাড়া করবে, ব্যাংটি পালাতে যাবে। সে যেই একটি মড়ার মাথার খুলি পেরোতে যাবে, তখনই সাপের বিষটা মড়ার মাথার খুলিতে পড়ে যাবে। সেই ওষুধ যদি আনতে পারো তো ছেলে বাঁচে।

অর্থঃ ছেলের অসুখ। অর্থাৎ জীব ‘আমি এই দেহ’ এই বিকারে আক্রান্ত। অমাবস্যার রাত—নির্গুণ। স্বাতী নক্ষত্রও নির্গুণ, কারণ একে দেখা যায় না। বৃষ্টি কৃপাবাড়ি। আত্মার প্রসন্নতা লাভ। সাপ কুণ্ডলিনী, সে জীবত্বকে তাড়া করছে। মড়ার মাথা হল যে মাথায় অহং নাশ হয়েছে। ‘আমি’ মরে গেছে। ব্যাং লাফ দিয়ে পেরল। জীবত্ব সপ্তম ভূমি অতিক্রম করল। জীব আত্মায় পরিবর্তিত হল। কখন? যখন কুণ্ডলিনীর সারাংশ আত্মায় পরিবর্তিত হল। এটি প্রতীকে শ্রীরামকৃষ্ণ আত্মা সাক্ষাৎকারের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন।

 যিনি ঈশ্বর দর্শন করেছেন তিনি দেখেন যে ঈশ্বরই জীব জগত হয়ে আছেন। সবই তিনি।

অর্থঃ যিনি ঈশ্বর দর্শন করেছেন তিনি নিজেই ঈশ্বর হয়েছেন। ঈশ্বরত্ব লাভ করেছেন। ‘মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ’। তখন তাঁর কাছে জগত ঈশ্বরেরই প্রতিবিম্ব মাত্র। সুতরাং তখন স্পষ্ট বোধ হয়—আমি আর আমার সামনে এই জগত আসলে এক। বাইরে বহু হলেও আত্মিকে এক।

এমন নানা কথাই শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের বলে গিয়েছেন। 

এখন প্রতীক্ষা।

কথাশেষঃ

শিবনাথ শাস্ত্রীর স্মৃতিচারণটি তাঁর ‘মহান পুরুষদের সান্নিধ্যে’ গ্রন্থ থেকে পঠিত। 

কথামৃতের মর্মার্থ অংশ ও স্বামীজীর উক্তির অর্থ, নামপ্রকাশে একান্তভাবেই নিষেধ, এমন একজনের অনুভূতি থেকে নেওয়া। তিনি মহাসমুদ্রের মতো আমার মতন এমন বহু নগণ্য ও অগণ্য ব্যক্তির কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ ও স্বতঃস্ফূর্ত আত্মিক বিবর্তন ও বিকাশের কথা জানিয়েছেন। কিন্তু প্রচারে মিথ্যা থাকে। সত্যের প্রতিষ্ঠা হয় আপন অন্দরে। আপন মস্তিষ্কে। তাই তুচ্ছ নামরূপ প্রকাশে তাঁর নিষেধ ছিল। সেকথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। তাঁর কাছে আমি আজীবন ঋণী।            

[মাতৃশক্তি কল্পতরু সংখ্যা ২০২২]  

0 comments: