0

সম্পাদকীয়

Posted in



একেকটা ক্ষণ আসে, যাকে নিয়ন্ত্রক মুহূর্ত বলা হয় বা defining moment.। এর ব্যাখ্যা ব্যক্তিগত পরিসর থেকে ছড়িয়ে যেতে পারে বহুদূর। আবার অনেক ক্ষেত্রে বৃহত্তর ক্ষেত্রে যা নিয়ন্ত্রক, আপন গণ্ডির মধ্যে তাকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। এবছর আমাদের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি। সরকারিভাবে যাকে 'অমৃত মহোৎসব' বলা হচ্ছে। অনেক রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এসেছিল, সেই স্বাধীনতাই কাম্য ছিল কি আমাদের সকলের? দেশবাসীকে কোন অমৃতভান্ড উপহার দিয়েছিল সে স্বাধীনতা? এই ৭৫ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে প্রাত্যহিক জীবন ধারণ সাধারণ মানুষকে যে তুমুল চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, সেই পরিস্থিতিতে এই উদযাপন কি বীভৎস মজা নয়? 

৭৫ বছর আগের প্রথম স্বাধীনতা দিবসে আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে চরম শাস্তি ঘোষণায় প্রতিশ্রুত হয়েছিলাম। আর আজ? ন'হাজার কোটি টাকা প্রতারণার সাজা হয় অকিঞ্চিৎকর অর্থমূল্যে! একে হাস্যকরও বলা যায় না। এটি খবর হিসেবে ততটা গুরুত্ব পায় না, যতটা পায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কোনও এক রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রের দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং উস্কানিমূলক মন্তব্যের জেরে তৈরি হওয়া পরিস্থিতিকে সামাল দিতে না পেরে তার রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ানো। এইভাবেই কি জরুরি বিষয়গুলি থেকে আমাদের মনোযোগের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়ে আসেনি ৭৫ বছর ধরে?

এরই মধ্যে পেরিয়ে গেল অনেকগুলো বছর। আজ প্রকাশিত হলো ঋতবাক অষ্টম বর্ষ দ্বাদশতম সংখ্যা। বিরতিহীন আট বছর একসঙ্গে পথচলা। আপনাদের শুভেচ্ছা হোক আমাদের পাথেয়।

সচেতন থাকুন, সৃজনে থাকুন

শুভেচ্ছা অফুরান

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in



সুপ্রীম কোর্ট ও উর্বশীরা

ইদানীং সুপ্রীম কোর্টের একটি বক্তব্য নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত নাকি পুলিশ প্রশাসনকে বলেছে ভারতে যৌনকর্মীদের সঙ্গে সম্মান দিয়ে কথা বলতে, মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার করতে , কথায় কথায় ওদের টানা হ্যাঁচড়া করে অপদস্থ না করতে। ওরা একটি পেশায় রয়েছে, কোন অপরাধ তো করেনি। আর নিজের পছন্দমত জীবিকা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত। তাহলে?

আমরা এ নিয়ে উলুত পুলুত। কেন? ওই বক্তব্যের থেকে আমরা মানে করেছি যে ভারতে আদিম জীবিকাটি বেআইনি নয়। ব্যস, আমরা এখন মাসের প্রথমে মাইনেটা হাতে এলেই বুক ফুলিয়ে হানা দেব হাড়কাটা গলি, সোনাগাছি, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে, গড়িয়ার পুলের নীচে—ঠিকানা ও ঠেক কি কিছু কম পড়িয়াছে?

ঠিক এমনই ভাবে আমরা লাফালাফি করেছিলেম আগস্ট ২০১৯শে, যখন ভারত সরকার কলমের এক খোঁচায় ধারা ৩৭০ বাতিল করে দিলেন। তখন জনৈক সাংসদের মুখে অনেকের সুপ্ত ইচ্ছার প্রতিধ্বনি শোনা গেছলঃ এবার আমরা অনায়াসে কাশ্মীর সুন্দরীদের বিয়ে করতে পারবো!

খেয়াল করুন, কোথাও কাশ্মীর সুন্দরীদের বিয়ে করে ঘরে তোলা এবং মনের আনন্দে বুক ফুলিয়ে বারমুখো হওয়া দুটোর মধ্যে একই সুপ্ত ইচ্ছে কাজ করছে— মন নয়, শরীরের দখল নেওয়া। কাশ্মীরিদের মন জয়ের বদলে জমির দখল চাই, তেমনই পয়সা দিয়ে নারী শরীরের দখল চাই। দরকার শুধু আইনের সমর্থন, ব্যস।

এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় পরে আসছি। আগে দেখা যাক মূল দুটো ইস্যু।

এক, সুপ্রীম কোর্ট ঠিক কী বলেছে? দুই, সুপ্রাচীন জীবিকাটি ভারতে সত্যিই বে-আইনী কিনা।

সুপ্রীম কোর্ট কী বলেছে?

প্রথমেই এটা স্পষ্ট করে বলা দরকার যে সুপ্রীম কোর্ট কোন আইন পাশ করেনি, কোন আইনে সংশোধনও করেনি। তাহলে করেছেটা কী?

গত মাসের ১৯ তারিখে শুনানির সময় বিচারপতি এল নাগেশ্বর রাও এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ অভিমত প্রকাশ করেছে যে যৌনকর্মীর কাজটাও একটি ‘পেশা’ (‘profession’), কাজেই তাঁরা পেশাগত ব্যাপারে অন্যদের সমান আইনী সুরক্ষা ও সম্মান পাওয়ার অধিকারী। তাঁদের বক্তব্যঃ যদি যৌনকর্মীরা এবং তাঁদের খদ্দের , দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক হন এবং বিনা জোর জবরদস্তি স্বেচ্ছায় মিলিত হন তাহলে পুলিশ যেন অকারণ হস্তক্ষেপ না করে এবং পেনাল কোড না লাগায়। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১ অনুযায়ী, সবাই- -পেশা যেমনই হোক—মর্য্যাদাসম্পন্ন জীবন যাপনের অধিকার রাখে। কাজেই বেশ্যালয় (brothel) খানা তল্লাসি করার সময় যৌনকর্মীদের গ্রেফতার করা, শাস্তি দেওয়া, উৎপীড়ন করা এবং দোষী বানিয়ে দেওয়া চলবে না। কারণ আইনে স্বেচ্ছায় পেশাগত যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া কোন অপরাধা নয়, বেশ্যাগৃহ চালানোটা অপরাধ।

পুলিশকে বিশেষ সতর্ক এবং সজাগ থাকতে হবে যাতে বেশ্যাগৃহে তল্লাসি চালানোর সময় বা সেখান থেকে কাউকে গ্রেফতার বা উদ্ধারের সময় যেন যৌনকর্মীদের , অভিযোগকারী বা অভিযুক্ত যাই হোন, পরিচয় প্রকাশিত না হয়। তাঁদের কোন ফোটো যেন ছাপা বা টেলিকাস্ট করা না হয়। বিচারপতি রাও এ’ব্যাপারে মিডিয়াকেও সংবেদনশীল হতে বলেছেন । এটাও বলেছেন যে কোন যৌনকর্মীকে যেন তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংশোধনাগার বা আশ্রয় গৃহে আটকে রাখা না হয়। মা যৌনকর্মী বলে তাঁদের সন্তানদের যেন জোর করে মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন না করা হয়। এছাড়া সরকারের দায়িত্ব যৌনকর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা।

বিচারপতিত্রয় (নাগেশ্বর রাও, গবই এবং বোপন্না) এভাবে পুলিশের জন্য গাইডালাইন জারী করে কেন্দ্র সরকারকে নোটিস পাঠিয়েছেন এবং ২৭ জুলাই, ২০২২ নাগাদ, অর্থাৎ পরবর্তী শুনানির দিন, এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে বলেছেন।

এই রায় দুটি কাজ করল।

এক, যৌনকর্মীদের সংবিধান সম্মত অধিকারের ব্যাপারে আমাদের সচেতন করালো। হ্যাঁ, আমরা মনে করি যৌনকর্মীদের কাজ কর্ম্ম অনৈতিক , অতএব ওদের কোন সামাজিক মর্যাদা এবং আইনে সমান ব্যবহার পাওয়ার অধিকার থাকতে পারেনা। তাই তারা কোন অভিযোগ করলে ও তো বেশ্যা বললেই তার সঙ্গে যেমন ইচ্ছে ব্যবহার করা যায়। চুল কেটে মুখে কালি মাখিয়ে রাস্তায় ঘোরানো যায়, পাড়াছাড়া করা যায় এবং প্রকাশ্যে জুতোপেটা করা যায়। এককথায়, তাদের সুরক্ষা কেড়ে নেয়া যায়।

ঠিক যেমন অনেকে মনে করেন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত আসামীর জেলের মধ্যে কোন মৌলিক অধিকার থাকতে পারেনা।

দুই, সর্বোচ্চ আদালতের এই পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে এবং স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত রাজনৈতিক দলকে এই আইনি এবং নৈতিক প্রশ্নে তাদের নিজস্ব অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করল। মুম্বাইয়ের কামাঠিপুরা লালবাতি এলাকার গঙ্গুবাঈ হরজীবনদাস নামের বিখ্যাত সামাজিক কার্যকত্রীর জীবন অবলম্বনে নির্মিত ‘গঙ্গুবাঈ কাথিয়াওয়াড়ি’ নামের বাণিজ্যিক সিনেমাটি একটি প্রশ্ন তুলেছে—কেন যৌনকর্মীর পেশাকে অন্য যে কোন পেশার সমতুল্য মনে করা হয় না?

সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের সদস্যীয় বেঞ্চের পুলিশের উদ্দেশে জারী করা এই আচরণবিধি যেন এরই জবাব।

ভারতে যৌনকর্মীর পেশা কি বে-আইনী?

এর উত্তর আমার মতে একইধারে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। কোন আইনে বেশ্যাবৃত্তিকে অবৈধ বলা হয় নি। আবার এই পেশার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত আনুষঙ্গিক কাজকর্মকে বে-আইনি বলা আছে। যেন গান গাইতে মানা নেই, কিন্তু তবলা সঙ্গতে, মাইকের সামনে গাইতে এবং রেওয়াজ করতে আপত্তি।

উত্তর যখন সোজাসুজি ‘না’ নয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে তবে কেন ধরপাকড়? কেন লুকিয়ে চুরিয়ে এই পেশার কারবার? একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।

বিশ্বে কিছু দেশ এই পেশাকে খোলাখুলি আইনী স্বীকৃতি দিয়েছে যেমন—নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া নেদারল্যান্ড ইত্যাদি। কিছু দেশ একেবারে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে যেমন কেনিয়া, মরক্কো, আফগানিস্তান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি ফেডারাল কানুন নয়, রাজ্যের আইনের আওতায় পড়ে। সামান্যতঃ নেভাডা ছাড়া কোন রাজ্যে এই পেশাটি বৈধ নয়। তবে আটটি রাজ্যে আংশিক বা শর্তাধীন স্বীকৃতি আছে।

আবার কিছু দেশের অবস্থান হল ধরি- মাছ- না- ছুঁই -পানি গোছের। এরা পেশাটিকে বে-আইনি বলেনি কিন্তু এমন সব বেয়াড়া শর্ত রেখেছে যে মুশকিলের অন্ত নেই। ভারত এই তৃতীয় দলে।


ভারতীয় দণ্ডবিধির কোন ধারাতেই দু’জন প্রাপ্তবয়স্কের পারস্পরিক যৌনমিলন নিষিদ্ধ নয়। এমনকি অর্থের বিনিময়ে হলেও। কিন্তু এ’ব্যাপারের একটিই আইন আছে— THE IMMORAL TRAFFIC (PREVENTION) ACT, (1956). তার কোন ধারাতেই পেশাটিকে দণ্ডনীয় বলা হয়নি বটে, কিন্তু এমন সব শর্ত রাখা হয়েছে যে খোলা মনে এই পেশায় নিযুক্ত হওয়া মুশকিল। কী সেই শর্তগুলি?

ইমমর‍্যাল ট্র্যাফিক অ্যাক্ট

বেশ্যাবৃত্তি কী? যৌনশোষণ অথবা ব্যবসায়ের জন্য কারও সঙ্গে অসদ্বব্যবহার (ধারা ২ফ)। দেখতেই পাচ্ছেন, কেমন ভিক্টোরীয় লজ্জা লজ্জা গোছের সংজ্ঞা। এমন ‘ব্রড’ ডেফিনেশন হলে পুলিশ ইচ্ছেমত অনেক কিছুকেই দণ্ডের আওতায় ফেলতে পারে।

এই আইনে বলা হয়েছে যে আইন্ মেনে দেহব্যবসা চালাতে মানা নেই কিন্তু আইনের কিছু শর্ত মানতে হবে, তবেই না! যেমন,

বেশ্যাগৃহ চালানো বা ভাড়া দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ (ধারা-৩)। আর বেশ্যাগৃহ মানে ওই কাজটি করা হয় এমন কোন বাড়ি, ঘর বা জায়গা। মানে পার্কও হতে পারে।


বেশ্যাবৃত্তির পয়সায় বসে খাওয়া অপরাধ, তাতে পরিবারের লোকজন বুড়ো বাপ-মা কাউকেই ছাড় দেয়া হয়নি। (ধারা-৪)


বেশ্য্যবৃত্তির জন্য কাউকে ফুসলানো, ফুসলে আনা, সাপ্লাই দেওয়া শাস্তিযোগ্য ( ধারা-৫)। এর লক্ষ্য বাড়িউলি, দালাল এবং কুটনি ।


বেশ্য্যবৃত্তির জন্য কাউকে কোন বাড়ি বা ঘরে আটকে রাখা অপরাধ (ধারা-৬)। এর উদ্দিষ্ট বাড়িউলি ও দালালেরা।


‘পাবলিক প্লেসে’ বেশ্যাবৃত্তি শাস্তি যোগ্য। পাবলিক প্লেস বলতে বোঝাবে ঘনবসতির লোকালয়, স্কুল, হাসপাতাল, নার্সিং হোম, হোস্টেল, ধর্মস্থান এবং পুলিশ কমিশনার, জেলা বা রাজ্য প্রশাসন দ্বারা বিজ্ঞাপিত এলাকা। যৌনকর্মীকে এখান থেকে ২০০ মিটার দূরে দাঁড়াতে হবে ( ধারা -৭)।


যৌনকর্মীরও নিস্তার নেই। ও কাউকে এই কাজের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারবে না। চোখের ইশারা, হাতছানি অথবা ‘যাবেন নাকি’ বলা –সবই শাস্তি যোগ্য (ধারা-৮)।

শেষ দুটো ধারা মন দিয়ে দেখলেই বোঝা যায় কেন এই কর্মটি গোপনে চলে, কেন পুলিশ এই ব্যবসা থেকে তোলাবাজি করতে পারে।

খদ্দেরের দিক থেকে ভাবলে আপনি কোন পাবলিক প্লেসের থেকে ২০০ মিটার দূরে কেন যাবেন? ছিনতাইয়ের ভয় নেই? কী করে বুঝবেন কে যৌনকর্মী? ভুলভাল প্রপোজ করে মার খাবেন?

যৌনকর্মীর দিক থেকে ভাবলে—কী করে সে কোন সম্ভাব্য খদ্দেরকে বেছে নেবে? ডেকে আনবে? নিয়ে যাবে কোথায়? অন্ধকারে? নিজের বাড়িতে? বাড়িভর্তি লোকজন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে মেয়ে কোন অফিসে চাকরি করে আমাদের ভাত জোগাচ্ছে।

এছাড়া এই পিতৃতান্ত্রিক আইনটি ভীষণভাবে নারীবিদ্বেষী। উক্ত ধারাদুটো ভাঙলে নারীর যে শাস্তি হবে, পুরুষটির শাস্তি হবে তার অর্ধেক। কেন? সেই ‘নারী নরকের দ্বার’?

গোমাংস নিষিদ্ধ করার আইনের সঙ্গে তুলনা

ভারতে কিন্তু গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ নয়। চমকে যাবেন না। উত্তর, মধ্য এবং পশ্চিম ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে যে আইন আছে তাহল গোহত্যা নিষিদ্ধ, গোধন হত্যার উদ্দেশ্যে কেনা-বেচা-রপ্তানি নিষিদ্ধ। অর্থাৎ দুধেল গাই যদি গোয়ালারা কেনে বা বেচে এবং হালের বলদ যদি লাঙল দেবার জন্যে কেউ বেচাকেনা করে তাতে আপত্তি নেই। এবং মোষের মাংসে আপত্তি নেই। কেরল, বঙ্গ , তামিলনাড়ু, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মেঘালয় এবং গোয়ায় এ’নিয়ে কোন নিষেধ নেই।

আর গোমাংস ভক্ষণ ভারতের কোন রাজ্যেই আইনতঃ নিষিদ্ধ নয়। শুধু গোহত্যায় আপত্তি!

কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? দাদরির আখলাকই বলুন অথবা অমুক পাড়ার তমুক। ওরা যতই অস্বীকার করুক যে ওরা গোমাংস খায় নি,মোষের মাংস খেয়েছে—প্রমাণ করতে পেরেছে? কোর্টে কেস চলবে, ঢিমে তেতালায়। তার আগে তো সন্দেহের চোটে মার খেয়ে মরে ভূত! তেমনই কোন মেয়েকে যদি পুলিশ ধরে বলে যে তার সঙ্গে কাস্টমার ছিল মানেই সে আগে ইশারা করে ডেকেছে, তাও চৌরঙ্গীর কাছে বাস স্টপেজে –সে কী করে নিজেকে ডিফেন্ড করবে?

এ হল মার্চেন্ট অফ ভেনিসের প্যাঁচ—এক পাউন্ড মাংস কেটে নাও আইন মেনে, কিন্তু খবর্দার! এক ফোঁটা রক্ত যেন না বেরোয়। তেমনি যদি মাংস কাটা নিষিদ্ধ, পশু কেনা বেচা নিষিদ্ধ—তাহলে খাওয়ার মাংস জুটবে কী করে? একইভাবে, যৌনকর্মীর পক্ষে কাস্টমারকে ইশারায় ডাকাও চলবে না, তবে তিনি নাকি আইন মেনে পেট চালাতে পা্রেন।

কাজেই অতি উৎসাহীদের বলি--সাধু সাবধান!

সুপ্রীম কোর্টের উক্ত নির্দেশিকা তাহলে বিশেষ কী করল?

বর্তমান ভারতে যৌনকর্মীর সংখ্যা আনুমানিক ৩ মিলিয়ন যার অধিকাংশই হচ্ছে ১৫-৩৫ বছর বয়েসের। দেখাই যাচ্ছে এঁদের স্বাভাবিক সম্মানের জীবনে ফিরিয়ে আনা এবং শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষা প্রদান করার জন্যে ওই ক’টি নির্দেশ যথেষ্ট নয়।

কারণ, আইনের ধারাগুলো মহিলাকে পাবলিক প্লেসের ২০০ মিটার দূরে ঠেলে দিয়ে এবং কাউকে আমন্ত্রণ জানানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তাঁদের যথেষ্ট অপমানিত করেছে এবং মুখ্য জীবনধারার সীমানার বাইরে স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। দরকার ওই পিতৃতান্ত্রিক কলোনিয়াল আইনের জায়গায় একটি সুস্পষ্ট নতুন আইন।

আরও প্রশ্ন রয়েছে।

সোনাগাছিতে একজন যৌনকর্মীকে দেয়াল বারবার মাথা ঠুকে হত্যার অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত বুদ্ধদেব কার্মাসকার সুপ্রীম কোর্টে আপীল করে। বিগত ২ অগাস্ট, ২০১১ তারিখে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বুদ্ধদেব কারমাস্করের আপীল( নং ১৩৫/২০১০) খারিজ করে বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু বলেন – যৌনকর্মীরা অপরাধী নয়, তারা মুখ্যতঃ দারিদ্র্যজনিত পরিস্থিতির শিকার। তাদের আর্টিকল ২১ ( রাইট টু লাইফ) অনুযায়ী সুরক্ষা পাবার সমান অধিকার রয়েছে। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের কর্তব্য তাদের রক্ষা করা এবং অন্য পেশায় ট্রেনিং দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। একজন যৌনকর্মীরও দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে সমস্ত মৌলিক অধিকার আছে।

বিগত ২০১১ সালে গঠিত একটি প্যানেল তাদের রেকমেন্ডেশনে বলেছিল যে যৌনকর্মীদের এবং পারস্পরিক সহমতিতে যৌনকর্মে লিপ্ত প্রাপ্তবয়স্ককদের যেন অপরাধী হিসেবে গণ্য না করা হয় এবং শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় ।

উপরোক্ত প্যানেলের পরামর্শের কথা মাথায় রেখে আমাদের সর্বোচ্চ আদালত গত ১৯শে মে সংবিধানের আর্টিকল ১৪২ এর থেকে প্রাপ্ত অধিকারের প্রয়োগ করে উপরোক্ত নির্দেশিকা জারি করেছে। এর উদ্দেশ্য পুলিশ তন্ত্রকে যৌনকর্মীদের সঙ্গে দৈনন্দিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ সংবেদনশীল করে তোলা এবং সরকারকে একটি নতুন যুক্তিযুক্ত মানবিক আইন প্রণয়নে প্রেরিত করা।

সেই অর্থে এটি যৌনকর্মীদের সম্মান ও মর্যাদা প্রাপ্তির দিকে স্বাধীন ভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম পদক্ষেপ।

উপসংহার

আমার মনে হয় আসল গন্ডগোল আমাদের মানসজগতে যা শুধু আইন করে বদলানো যাবে না। আমরা এখনও মেয়েদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের কথা মন থেকে স্বীকার করি না। কোন মহিলাকে মাতৃ অথবা ভগিনী হতেই হবে। নতুন কাউকে পরিচয় করিয়ে দিই—অমুকের মা, তমুকের বোন, তমুকের মেয়ে বা মিঃ অমুকের মিসেজ বলে। কাজেই তাকে দখল করতে চাই, বিশেষ করে তার শরীরকে। তার নিজস্ব অনুভূতি বা মতের ধার ধারিনে। ফলে তাদের নিজের পছন্দমত জীবিকা বেছেছে নেওয়ার অধিকার মন থেকে মেনে নিতে পারি নে। তাই তাদের সুরক্ষার কথা ভাবি কিন্তু সোজাসুজি আইন করে যৌনকর্মীর পেশাকে বৈধতার মর্যাদা দিতে কোথায় যেন বাধে। আবার ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ব্যাপারটার অস্তিত্বই স্বীকার করতে চাই না।

সুপ্রীম কোর্টের মার্গদর্শিকা সত্ত্বেও যে ইকোসিস্টেমে ভারতে যৌনকর্মীদের কাজ চালিয়ে যেতে হয় তাতে হাতে গরম সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সমীক্ষণ সেনগুপ্ত

Posted in




উপক্রমণিকা

শুষ্ক মরুভূমির মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে যদি আচমকা অপ্রত্যাশিত ভাবে মরূদ্যানের সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে পথিকের মনের অবস্থাটা যেরকম হয়, একরাশ "রবীন্দ্রনাথ..., ড্রাকুলা, একেন, ভিঞ্চি দা" ইত্যাদি দেখার পর যখন "মন্দার" দেখলাম তখন আমার মনের অবস্থাটা ঠিক সেরকম হয়েছিল।

এরকম নয় যে বাংলায় একেবারেই আলোচনার অযোগ্য ভালো সিনেমা হয় না, নিশ্চয়ই হয়, কিন্তু তার ব্যাপ্তি এতোটাই কম যে বেশিরভাগ মানুষ তাদের কথা জানতেই পারে না। তাদের বিষয় বৈচিত্রও খুব বেশি নয়, আর সবচেয়ে বড় কথা - সেই এক কুশীলবদের চরিত্রে না মানালেও বারংবার মঞ্চে অবতরনা, সেই এক অভিনেতা-অভিনেত্রীর দল (বা ঢল)।

বাংলা সিনেমায় পরিচালকরা যেন চরিত্রের চাহিদায় একদম নতুন মুখকে সুযোগ দিতে পরাঙ্মুখ, নতুন বিষয়ে ছবি করতে যে ঝুঁকি নেওয়া প্রয়োজন, সেটিও তাঁরা নিতে চান না। চটকদার চমকদার থ্রিলার, যেখানে প্রচুর গা-গুলানো ভায়লেন্স থাকবে (এবং যেটায় কখনই Scorcese বা Tarrantinoর মতো শৈল্পিক গুণ থাকবে না) বা সাধারণ মানের ফ্যামিলি ড্রামা বা ত্রিকোণ (বা চতুষ্কোণ) প্রেম যেখানে থাকবে সেক্সের বাড়বাড়ন্ত। এর বাইরে সিনেমার বিষয় কিছু উদ্ভট কিছু গল্পের প্লট আর নাহলে সত্যজিৎ রায়- কাকাবাবু- কিরীটী- ব্যোমকেশ। সোজা কথায় বলতে গেলে নতুন কিছু যেমন নেই বললেই চলে, তেমনি সহজ ভাষায় একটি নিটোল গল্পের উপস্থাপনাও আজকাল চোখে পড়ে না, "মাল্টি-লেয়ারড" ছবির কথা তো বাদই দিলাম।

এরকম অবস্থায় "মন্দার"-এর আবির্ভাব একেবারে "বিনা মেঘে বজ্রপাত" !

এই স্বল্পপরিসরে আমরা এখানে শুধু সিনেমার গল্পটি নিয়েই আলোচনা করবো। কারণ অভিনয়, পরিচালনা বা সিনেমাটিক কোয়ালিটি বাদ দিয়েও বহু কিছু
"মন্দার"-এর পোস্টারেই লেখা রয়েছে "Based on Macbeth", কিন্তু কেউ যদি ম্যাকবেথ নাও পড়ে থাকেন, মন্দার একটি "স্বাধীন" গল্প হিসাবেই নিজের জায়গা বানিয়ে নিতে সক্ষম।


আকাশ যখন ডাকে…

জোড়াভেড়ির মালিক ডাবলু ভাইয়ের একনম্বর হেঞ্চম্যান মন্দার। গল্পের শুরুতেই তাকে দিয়ে মন্দারেরই ছেলেবেলার বন্ধু মকাইকে খুন করান ডাবলু ভাই। মকাই ডাবলু ভাইয়ের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করছিল ঠিকই, কিন্তু তাকে "ডায়লগ" (অর্থাৎ ওয়ার্নিং) না দিয়ে সরাসরি "অ্যাকশন" নেওয়ার কারণ মকাইয়ের তাঁর ফোন না ধরে কেটে দেওয়া। এই সামান্য কারণে খুনের থেকে বোঝা যায় মানুষটা কতটা egoist এবং নির্দয়।


মন্দারের চরিত্র সেখানে বেশ অদ্ভুত।

সে যেন ডাবলু ভাইয়ের হাতের পুতুল। সেও নির্দয়, কিন্তু সেটা যেন শুধুমাত্র ডাবলু ভাইয়েরই নির্দেশে, তাই একেবারে ছোটবেলার বন্ধুকেও খুন করতে সে দ্বিধা বোধ করল না। তার কোন উচ্চাকাঙ্খ্যা নেই, তার আশেপাশের সবাই মনে করে সে চাইলেই গেইলপুরের মালিক হতে পারে, কিন্তু সে এসব নিয়ে ভাবেই না। শুধু ডাবলু ভাইয়ের নির্দেশে খুন করে আর বাংলা মদ খেয়ে তার দিন কাটে। আর হ্যাঁ, সে হল "ধ্বজ", অর্থাৎ নপুংসক। মন্দার তার বউ লায়লিকে অবশ্যই ভালোবাসে, কিন্তু কামুক ডাবলু ভাই যখন লায়লির অঙ্কশায়নি হতে চান, তখন মন্দার নির্দ্বিধায় সে পথ ছেড়ে দাঁড়ায়। এমনকি ডাবলু ভাই তার কাছেই লায়লির খবর নিলেও তাকে রাগতে দেখা যায় না।

তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমরা যারা অভ্যস্ত, অবাক হয়ে যাই এই চরিত্রটিকে দেখে।

সিনেমায় মন্দারের আশেপাশের লোকে একে চূড়ান্ত বোকামি, নপুংসতা বা দালালী হিসাবে দাগিয়ে দিলেও মন্দারের হিসাব এখানে সহজ - সে নিজে যেহেতু তার বউকে আনন্দ দিতে পারে না এবং যেহেতু তার বউয়ের সেটা প্রাপ্য, তাই ডাবলু ভাই যদি সেটা দিয়ে থাকে, তাহলে তার আপত্তি নেই।

এখন এই নপুংসতার জন্যই তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা-হীনতা, নাকি উচ্চাকাঙ্ক্ষা-হীনতার কারণেই তার নপুংসতা - সেটা মনস্তত্ববিদেরাই বলতে পারবেন। এমনও হতে পারে মন্দারের নপুংসতা একটি মানসিক অবস্থান মাত্র, একটি অচলায়তন, যেটি থেকে কোনভাবে বেরিয়ে আসতে পারলেই বাঁধভাঙ্গা জলোচ্ছ্বাসের মতো এসে যেতে পারে মালিক হওয়ার উচ্চাশা, রাগ, এবং ক্ষমতার প্রতি লোভ।

আমাদের গল্পে ঠিক সেটারই শুরুয়াত হল একটি স্বাভাবিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দিয়ে - লায়লির সন্তানাকাঙ্খা।


কালের কোলে কপাল ফেরে…

অনেকের মনে হতে পারে মন্দারের মাথায় "রাজা" হওয়ার স্বপ্ন ঢুকেছিল ডাইনিদের ভবিষ্যৎবাণী শুনে। এখানেও কার্যকারণ সম্পর্কটি দেখবার মতো। ভবিষ্যৎবাণীর সঙ্গে মিলিয়েই মন্দার রাজা হোল, নাকি ভবিষ্যৎবাণী হোল বলেই মন্দারের সুপ্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা উস্কানি পেল সেটাও বলা মুশকিল।

যাইহোক, আমরা এখানে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো ভবিষ্যৎবাণী এবং মকাইকে খুনের আগের ঘটনাবলির দিকে। লায়লি সন্তান চায়, তার নপুংসক স্বামী মন্দারের সন্তান। সে তাকে বারে বারে বলে চিকিৎসা করানোর জন্য, কিন্তু তার স্বামী অপারগ কিংবা গুরুত্ব দেয় না। ডাইনিদের ভবিষ্যৎবাণীর প্রথমটি মিলে যেতে মন্দার আশ্চর্য হয়ে যায়, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই দর্শক বুঝতে পারবেন এই মিলে যাওয়া এমন কিছু বড় "মিরাকেল"নয়। মকাইকে খুন করার জন্য ডাবলু ভাই যে মন্দার আর বঙ্কাইকে সমান সমান টাকা ভাগ দেবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি? আর তিনি টাকা দিয়ে বলতেই পারেন "তোর পঞ্চাশ, ওর পঞ্চাশ..." এটা কি সত্যিই বিশাল কিছু আশ্চর্যের ব্যাপার?

কিন্তু না, এই ভবিষ্যৎবাণী মিলে যেতেই মন্দার আর বঙ্কাই যেন নড়েচড়ে বসল। "রাজা" মন্দারের মনের গভীরে উচ্চাশার এক ঘুমন্ত সাপ যেন একটা চোখ খুলে চাইল, আর "রাজার বাপ" বঙ্কাইয়ের মনে জন্মাল ভয়। এর পরে যখন ডাবলু ভাই মন্দারের বদলে বঙ্কাইয়ের ছেলে ফন্টুসকেই জোড়াভেড়ির দায়িত্ব দিলেন, তখন সেই লোভ আর ভয় ধীরে ধীরে কব্জা করে নিল মন্দার আর বঙ্কাইকে।


“অ্যান্ড আই অ্যাম এ ক্যাট !”

মন্দার গল্পটি একান্ত ভাবেই একটি masculinityর গল্প।

এর একদিকে আছে শক্তিশালী, দামাল কিন্তু "ধ্বজ" মন্দার, যার মধ্যে পুরুষত্ব চেগে ওঠে বাবা হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়, ডাবলু ভাইকে সরিয়ে ভেড়ির "রাজা" হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়, তেমনি অন্যদিকে আছে পেলব, শান্ত, পরিশীলিত কিন্তু অত্যন্ত কামুক এবং অসৎ পুলিশ অফিসার মুকাদ্দার। ম্যাকবেথের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নাম দুটোর মিলও দেখার মতো। মন্দার- মুকাদ্দার যেন মুদ্রার দুই পিঠ। দুজনেরই "সিগনেচার" বাহন মোটরসাইকেল, মুকাদ্দারের সারথি তার কনস্টেবল। স্বভাবগত দিক থেকেও মন্দার- মুকাদ্দার সম্পূর্ণ উলটো। মন্দার ডাকাবুকো কিন্তু বোকা, মুকাদ্দার শান্ত, জন্তু জানোয়ারের প্রতি তার প্রায় ফেমিনিন একটা স্নেহ বেশ লক্ষণীয়, কিন্তু সে গভীর জলের মাছ। গানের পছন্দ- অপছন্দ, বেশভূষা - সব দিক থেকেই তারা বিপরীত।

এখানে মুকাদ্দারের সম্বন্ধে একটি কথা না বলে থাকতে পারছি না।

ম্যাকবেথে যেমন আমরা দেখি তিনটি ডাইনিকে, মন্দারে আপাতদৃষ্টিতে আছে কিন্তু দুজন ডাইনি - মজনু আর পেদো। প্রশ্ন হচ্ছে তিন নম্বর ডাইনিটি কে? এর উত্তর রয়েছে সিনেমার শুরুতেই মজনুর প্রথম ছড়াটির মধ্যেই।


আকাশ যখন ডাকে, চাতক তাকায় থাকে,
সাগরের ছানা বাছা, বদ্ধি ঠেকে রাজা।
রাক্ষস লিছে বাপ, তাও থামেনি পাপ।
এই সাগরের রাক্ষস, বরণ করবো কাকে,
গেইলপুরের রূপমারানী বাসছে ভালো যাকে।
মানুষ ভালো মন্দ, রাক্ষস পায় গন্ধ,
সাগরের জল নোনা, তলপেটে কামনা।
পিত্তি দিয়ে গাঁথবো মালা, পচা রজনীগন্ধার,
মিলবো যেদিন চারজনেতে,
আমি পেদো কালা মন্দার...

"কালা" অর্থাৎ কালো বেড়ালটি হচ্ছে তিন নম্বর ডাইনি।


সে কিছু কথা বলে না, কিন্তু প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় তার উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী। লায়লির মনে ডাবলু ভাইকে মারার পরিকল্পনা, এমনকি শেষ দৃশ্যে নৌকায় মন্দার যেখানে বর্শা গাঁথা অবস্থায় মারা গেছে, সেখানে। বস্তুত,"কালা"ই মন্দার আর বঙ্কাইকে মজনুর ডেরায় প্রথমবার নিয়ে আসে, সেখান থেকেই সমস্ত কাহিনীর সূত্রপাত।

মুকাদ্দারের প্রথম দৃশ্যেই কালার সাথে দৃষ্টিবিনিময় একটি গভীর ইঙ্গিতবাহি।


দর্শকের এখানে যেন মনে হবে - কালা তার নিজের সত্ত্বা যেন মুকাদ্দারের মধ্যে চালান করে দিল এই দৃষ্টিবিনিময়ের মাধ্যমে। এর পরেই মুকাদ্দার নিজেকে "cat" হিসাবে পরিচয় দিতে শুরু করে, এবং বলে "he likes fishes". বস্তুত ভেড়ি অঞ্চলের পটভূমির এই কাহিনীতে প্রতিটা চরিত্রকেই যেন মাছের রূপক দেওয়া হয়েছে।

এপিসোড গুলির নাম লক্ষ্য করে দেখুন - "গভীর জলের মাছ", "বঁড়শি গাঁথা মাছ", "ভেড়ির মাছ সমুদ্রে"...এছাড়া বড় ভেটকি মাছটিকে সামনে রেখে মজনুর ভবিষৎবাণী, পেদোর নাচ, এবং সবশেষে জ্যান্ত মাছটিকে এক টিপে বঁড়শি দিয়ে গেঁথে দেওয়া, যেন মন্দারই হচ্ছে ভেড়ির অনেক ছোট মাছগুলির মধ্যে বড় মাছটি এবং সেই-ই ডাইনিদের লক্ষ্যবস্তু। সে এতদিন ছাড়া মাছ ছিল, উচ্চাকাঙ্খ্যা-হীন কিন্তু জীবিত। তারা তার মধ্যে "লোভ"-রূপী বড়শি ঢুকিয়ে তাকে গেঁথে ফেলেছে।

এছাড়া বলা যায় নৌকার ভেতরে মুকাদ্দারের সাথে যে গণিকা ছিল, তার গায়েও মাছের গন্ধ, ডাবলুদা আর মকাইয়ের দেহ পাওয়া গেল ঠিক একই ভাবে সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে, মরা মাছের মতো। সব মিলিয়ে যদি গেইলপুরের মানুষ মাছ হয়ে থাকে, মুকাদ্দার সেখানে কিন্তু বেড়াল, অর্থাৎ তারা যথাক্রমে "hunted" এবং "hunter"।

এই শিকার কিন্তু তথাকথিত অত্যাচারীর অত্যাচারিতদের উপরে পাশবিক ক্রিয়া নয়। এটি আরও সূক্ষ্ম ক্ষমতার। এটি হচ্ছে সবার সম্বন্ধে গোপন খবর জেনে নিয়ে তাদেরকে হাতে রাখা, প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করিয়ে নেওয়া এবং, হ্যাঁ, নিজের কাম-লালসা চরিতার্থ করতে মাঝে মাঝে কিছু "ভেট" নেওয়া।

ভেবে দেখুন, গোটা সিনেমায় একমাত্র এক জায়গায় মন্দারের মধ্যে যেন সামান্য মনুষ্যত্ববোধ দেখতে পাই, তার চোখে জল এসে যায়, যখন সে বুঝতে পারে মুকাদ্দারের লায়েলির সাথে শুতে চাওয়ার প্রস্তাব সে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। সে ক্ষমতা তার নেই। সে ডাবলু ভাইকে মেরে গেইলপুরের রাজা হতে পারে, সবাই তার ভয়ে কাঁপতে পারে, কিন্তু ঠিক এখানে দাঁড়িয়ে সে মুকাদ্দারের সামনে সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন "ধ্বজ"। তার একটাই বড় কারণ - সবার মতো মুকাদ্দারও তার দুষ্কর্মের কথা জানে, এবং সে তাকে বিপদে ফেলতে পারে, তার উচ্চাশন থেকে সোজা নামিয়ে আনতে পারে মাটিতে।

এতদিন ডাবলু ভাইয়ের কাছে তার বউকে পাঠাতে তার কোন বিবেক দংশন হয়নি, কিন্তু আজকে হোল। কারণ এতদিন সে ছিল বাঁজা, আজকে সে হয়েছে রাজা। এই যে একান্ত ভাবে "ফেমিনিন" হয়েও মুকাদ্দারের মন্দারের উপর ছড়ি ঘোরানো - এটাও যেন গল্পের "alpha-male"-এর দ্বৈরথকে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে।


লাল চশমা, লাল জগত…

গল্পের ঠিক এই জায়গা থেকেই হয় মন্দার-লায়েলির বিবাদের সূত্রপাত, যার শেষ হয় লায়েলির পাগলামিতে এবং সব শেষে আত্মহত্যায়।

যে নৌকায় শৃঙ্গারকালে রচিত হয়েছিল তাদের সন্তান-স্বপ্ন, সেখানেই শেষ হোল লায়েলির জীবন। আসলে ক্ষমতার লোভ এমনই একটা জিনিস, মানুষকে নেশার মতো পেয়ে বসে। নেশায় মত্ত হয়ে যখন সে তার অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছে যায়, তখন আবিস্কার করে তার ইমারত আসলে সম্পূর্ণ ফাঁপা।

মন্দারেরও ঠিক তাই-ই হোল। সে অকস্মাৎ বুঝতে পারল লোকজন তাকে "রাজা" হিসাবে একটুও মানে না, শুধু ভয়ে চুপ করে আছে। এবং এই ভয়টা বজায় রাখার দায় তার। লায়েলি, যে তার মনে লোভের প্রথম অগ্নিস্ফুলিঙ্গটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল, সেও তাকে অত্যন্ত নিচু নজরে দেখে, বউয়ের দালাল ছাড়া কিছু মনে করেনা সে তাকে।

এরকম অবস্থায় ঘটতে থাকে তার একটার পর একটা ভুল। যেন নোঙরহীন ভাবে মন্দার একটার পর একটা খুন-ধর্ষণ করতে থাকে, কোন কারণ ছাড়াই। নিজেই সে হয়ে ওঠে তার প্রতিদ্বন্ধী - সাগরের "রাক্ষস"।


পচা রজনীগন্ধার মালা

সিনেমার একদম শেষে ক্ষমতার হাতবদলের পর্বটিও দেখার মতো।

মৃত মন্দারের ঘাড়ের উপর উঠে আসে কালা, যে কিনা লায়েলির প্রথম পরিকল্পনার সময়েও আত্মপ্রকাশ করেছিল।

শুরু এবং শেষ - দুটোরই যেন সে সাক্ষী থাকল।ডাবলু ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছিল "গেইলপুরের রূপমারানী" লায়েলির সামনে, তেমনি মন্দারের মৃত্যু হোল লাখমনির সামনে, যে কিনা ফন্টুসের স্ত্রী এবং ফন্টুসকে একই ভাবে "রাজা" হওয়ার স্বপ্ন দেখায়।

লায়েলি এবং লাখমনির টিভিতে চলা গানের মিলটাও চোখে পড়ার মতো। এছাড়া মঞ্চা আর ফন্টুসের লাখমনিকে টানাপড়েন যেন ডাবলু ভাইয়ের আর মন্দারের লায়েলিকে নিয়ে টানাপড়েন কে মনে পড়িয়ে দেয়। যেন সম্পূর্ণ একই নাটক (যাদের কুশীলব হয়তো আলাদা) ভবিষ্যতে আবার মঞ্চস্থ হওয়ার পটভূমি তৈরি হয়ে গেল ছবির শেষে।

শুধু তাই-ই নয়, এ গল্পে যেন সব কিছুই বার বার করে ফিরে আসে। ডাবলু ভাই এবং ডাবলু ভাইয়ের বাবার একভাবে সমুদ্রের কোলে মৃত্যু, ডাবলু ভাইয়ের এবং মন্দারের প্রতি তাদের স্ত্রীদের চাপা ঘৃণা, এমনকি মজনুর ভবিষ্যৎবাণীর রাতে এবং ডাবলু ভাইয়ের খুনের রাতে একই রকম বৃষ্টি - ছবিতে এরকম বহু element আছে যেগুলি আলোচনার অপেক্ষা রাখে।


যাদের কাল নেই…

বস্তুত আমরা যদি মজনুর প্রথম ছড়াটি ভালো করে বোঝার চেষ্টা করি (যেটি রচনার শুরুর দিকে আছে),তার মধ্যেই যেন গোটা গল্পটি সাঁটে বলা আছে।

হয়তো আদি-অনন্তকাল ধরে একই গল্প চলে আসছে গেইল্পুরে, মজনু-পেদো-কালা বা তাদেরই মতো কেউ, যাদের কাল নেই, নির্নিমেষ নেত্রে এসব ঘটনাপ্রবাহ দেখে চলেছে এবং জায়গা মতো অল্পস্বল্প "catalyst" এর কাজ করছে।

কে জানে, কে বলতে পারে?

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

 












উনবিংশ শতকের বাংলা। ১৮৩৬ সাল সতীদাহ প্রথা রদ হওয়া থেকে বেশি দূরে নয়। প্রিন্স দ্বারকানাথ সতীদাহের বিরুদ্ধে মামলায় টাকা ঢেলেছেন। এই কুপ্রথা সমাজ থেকে সরে যাক। বিল পাস হয়ে গেছে। রাজা রামমোহন রায় কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলেছেন। প্রভুদের দিয়েই কুপ্রথা রদ করিয়েছেন।

কিন্তু তখনও বাংলার গ্রামে গ্রামে সব সতী এই হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পায়নি। এমন অন্ধকারে ঢাকা দেশের আকাশ। সেখানে রাজত্ব করছে বিদেশী এক জাতি। পরাধীন দেশের মানুষের নগ্ন পা, ক্ষুধার্ত শরীর, অশিক্ষা ও অস্বাস্থ্যে জরজর মরমর দশা। প্রায় দুশো বছর আগের সেই বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ম্যালেরিয়া কালাজ্বর এমনকি আমাশায় পর্যন্ত মানুষ মরে। মানুষ ইংরেজ শাসকের সামনে নতশির। তাদের যাবতীয় দুর্দশার জন্য যেন তাদের ভাগ্যই দায়ী। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অদ্ভুত বিধানে তখন কিছু কিছু ভারতীয় ইংরিজি ভাষা শিখে অনভ্যস্ত শরীরে চোগা চাপকান চাপিয়ে প্রভুদের দাসত্ব করতে শুরু করেছে। না করে উপায়ও নেই। সেই দাসত্বের বোধ, অধীনতার শৃঙ্খল তাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। বাস্তবে, মননে, আত্মিকে, কোথাও সে এতটুকু আলোর রেখা আর দেখতে পেল না। প্রভুর সামনে বাঁদর নাচ নাচতেও তাকে রাজি থাকতে হবে। অবশ্য স্বার্থান্ধ কিছু মানুষ এই সুযোগে ধনী হলেন। অভিজাত বলে গণ্য হলেন। তাদের অট্টালিকার ছাদে পায়রা উড়ল। যদিও আপামর সাধারণ মানুষ সেই উৎসবে সামিল হল না। 

এমন সময়ে খৃষ্ট ধর্মের উদারতা ও প্রেম, ইসলামের সাম্য, ও বেদান্তের একেশ্বরবাদকে মিলিয়ে রাজা রামমোহন রায় জন্ম দিলেন এক ধর্মমতের। জবরদস্ত মৌলবি নামে বিখ্যাত, হিন্দু পণ্ডিতরা যার পাণ্ডিত্যের ছটায় থরহরি, খৃষ্টীয় যাজকেরা যার খৃষ্ট ধর্মের তত্ত্বানুধাবন দেখে মুগ্ধ, সেই রাজা জন্ম দিলেন এমন এক মতের যার অনুসারী হলে হিন্দু ধর্মের তৎকালীন পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি পাবে মানুষ। ব্রাহ্ম ধর্ম। নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক ব্রাহ্মদের মধ্যে জাতপাতের কোনো ভেদ রইল না। তারা কুঁকড়ো (মুরগী) খায়। ডিম খায়। তারা প্রতিমাপূজক হিন্দুদের সমকালীন ‘সদ্ধর্মে’ আনতে প্রয়াসী। বলা বাহুল্য, এই ভাবধারার পেছনে রাজার পাশ্চাত্য শিক্ষা কাজে লেগেছিল। ইওরপীয়ান রেনেসাঁ ঘটে গিয়েছে আগেই। ফলে, যারাই পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞান দর্শনের আলোয় মনের আঁধার দূর করতে পারছেন তারাই রাজার প্রবর্তিত এই নব্য সনাতন ধর্ম, নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাই যার একমাত্র পূজা, সেই ধর্মের অনুগত হচ্ছেন। স্পষ্ট যে, শহরের শিক্ষিত ও ধনী সম্প্রদায়ের মধ্যে, যেখানে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, সেখানেই ব্রাহ্ম ধর্মের আবেদন বেশি হল। রাজার পতাকা বইলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এমতাবস্থায়, কলকাতার তদানীন্তন শিক্ষিত যুবক ও বাবু সম্প্রদায় যে ব্রাহ্ম সমাজের দিকে ঝুঁকবেন সে যেন স্বতঃসিদ্ধ।

কিন্তু কলকাতা ছাড়ালেই পল্লীগ্রামের অবস্থা যথা পূর্বম তথা পরম। সেই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষ। উচ্চবর্ণের হিন্দু যেখানে গ্রামের পঞ্চ। এই সময়ে আমরা পেলাম এক গ্রাম্য নিরীহ নিরক্ষর যুবককে। যিনি কী এক অদ্ভুত উপায় রানি রাসমণি ও তাঁর জামাই মথুরবাবুকে আকৃষ্ট করেছিলেন। তাঁর সরলতা, তাঁর ঈশ্বরে বিশ্বাস, তাঁর সততা, নির্লোভ মন ও আচরণ, কেমন করে যেন প্রভাবিত করেছিল রানি ও তাঁর জামাইকে। কে এই যুবক? যাকে জমি দিতে গেলে নেন না? যাকে অলংকার জরির সাজ দিলে একবার গায়ে দিয়ে ফেলে দেন? কে ইনি? মথুরবাবুই তাঁকে প্রথম চিনলেন। এ যুবক সামান্য নন। ইনি নৌকোর মাঝিদের কাছে গিয়ে খেতে দ্বিধা করেন না। ইনি রসিক মেথরের বাড়ির রান্না খেতে ভালোবাসেন। ইনি সাধনার জন্য তন্ত্র বৈষ্ণব ধারার সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম মতেও আরাধনা করেন। একজন অতি সাধারণ গ্রাম্য নিরক্ষর যুবক, যার পক্ষে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন থাকাই ভবিতব্য, তিনি এমন উদারতা পেলেন কোথায়? সর্বোপরি, সব মতের, সব ধর্মের, সমাজের উঁচু নীচু সবতলার মানুষের প্রতি তাঁর এমন ভালোবাসা!

আমরা পেলাম শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসকে।

দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস সামান্য লোক নন। শ্রীযুক্ত কেশবচন্দ্র সেন ঘোষণা করলেন। হইচই পড়ে গেল ব্রাহ্মসমাজে। কেশব এক সামান্য পৌত্তলিক নিরক্ষর পুরুতের কাছে যান?

গঙ্গার ধারে বরাহনগরের কাছে এক বাগানে কৈবর্ত রাসমণি রানি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। দক্ষিণা কালী, মা ভবতারিণীর মন্দির। আছে দ্বাদশ শিবের মন্দির। আছে রাধাকৃষ্ণের মন্দির। রানি ধনী বটে, কিন্তু জাতে কৈবর্ত। পুরোহিত মেলে না। কোন ব্রাহ্মণ আবার যাবে পুরোহিত হতে? সমাজে তার স্থান কী হবে? খোঁজ করে পাওয়া গেল এক মাঝবয়সী ব্রাহ্মণকে। তিনি স্বীকার করলেন পৌরোহিত্য। ছিলেন ঝামাপুকুরে মিত্রদের বাড়ি। ছিল একখানা ছোট টোল। চলে এলেন দক্ষিণেশ্বরে। সঙ্গে আনলেন কনিষ্ঠটিকে। মাত্র ষোলর কিশোর এলেন পুরোহিতের অনুচর হয়ে। তারপর তো আমূল পরিবর্তন। দাদার মৃত্যুর পর তিনি হলেন কালীঘরের পুরোহিত। কিন্তু তখন তাঁর আত্মিক জীবনে এক বিপুল পরিবর্তন। তাঁর মুখের কথায়, “আশ্বিনের ঝড়ের মতন কী একটা এসে সব উড়িয়ে নিয়ে গেল। পৈতে টইতে আর কিছু রইল না”। বাহ্য চিহ্ন, যা দিয়ে হিন্দু ব্রাহ্মণ সন্তানকে চেনা যায়, সেসব উড়ে গেল। তাঁর দেশের মানুষ জানল, দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে গদাই উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। ধর্মবাই তার তো ছোট থেকেই। সেই যেবারে, মাত্র এগারো বছর বয়সে আনুড় গ্রামে বিশালাক্ষী যাবার সময় মাঠে অচৈতন্য হয়ে যায়, সেই তখন থেকেই। লাহাদের মুখ্যু মেয়ে প্রসন্ন বলেছিল, ওর ভগবানের আবেশ হয়েছে। খানিক সময় যাক। ঠিক হয়ে যাবে। ওকে ভগবানের নাম শোনাও। পরিণত বয়সে তিনি বলেছিলেন, “আকাশ থেকে একটা জ্যোতি এসে যেন ঢেকে ফেলল, হুঁশ রইল না”। বেদে একেই বলেছে আত্মার বরণ করা। এবমেষ সম্প্রসাদ পরমজ্যোতি উপসম্পদ্য। এই পরমজ্যোতিই সম্প্রসাদকে বরণ করেন। কেন? কারণ, যমেবৈষ বৃনুতে তেন লভ্য। যাকে বরণ করেন তিনিই এই পরমজ্যোতি লাভ করেন। কাকে বরণ করেন? সম্প্রসাদকে। সম্প্রসাদ কে? যিনি বিশেষরূপে প্রসন্নতা লাভ করেছেন। কে এই বিশেষ প্রসন্নতা লাভ করেন? যার দেহটি প্রকৃতিতে এমনভাবে বিকশিত হয়েছে যে আত্মার বরণ তিনি ধারণ করতে পারবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, তিনি নিজে তখন একথা জানতে পারেন না। জানতে যে পারেন না তার প্রমাণ, তিনি বলছেন, দশ এগারো বছরের পাড়াগেঁয়ে ছেলে ওর কী বোঝে? কিন্তু এর ফল সুদূরপ্রসারী।

    সরল তরুণ তখন আবিষ্ট। একে একে তাঁর কাছে আসছেন ভৈরবী, তোতাপুরী, ব্রাহ্মণী। তাঁর সাধন জগতের গুরু। কিন্তু কী সাধন করবেন তিনি! তাঁর সিদ্ধ অবস্থা দেখে গুরু হতবাক। বলছেন, ‘আরে এ কেয়া দৈবী হ্যায় রে’! তাহলে সাধন করে নয়, ওই স্বতঃস্ফূর্ত আত্মিক বিকাশই তাঁর সিদ্ধির কারণ! তাহলে এমন কঠোর সাধনা কেন? বলছেন, ‘আমার সব নজিরের জন্য’। কিসের নজির? জগতে এমন একটি মানুষ জন্মাবেন যার চৈতন্য স্বতঃজাগ্রত, তাঁর অবস্থা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এমন নিদর্শন থাকবে।

এ সময়ের অনেক পরে, তখন হৃদয়রাম কালীঘরে বহাল। একদিন দেখলেন একটি গৌরবর্ণ পুরুষ এসে জিজ্ঞেস করছেন-পরমহংসদেব কোথায়। হৃদয় তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন-আপনি কোথা থেকে আসছেন? লোকটি বললেন-সূর্যমণ্ডল থেকে। হৃদয় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন নির্দিষ্ট ঘরটি। লোকটি সেই ঘরের কাছে যেতেই দরজা খুলে গেল। শ্রীরামকৃষ্ণ যেন তাঁর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। লোকটি ঘরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিলেন। হৃদয়ের হুঁশ ফিরতে তিনি স্তম্ভিত হলেন। লোকটি ঘরে ঢুকলেও বেরিয়ে আর এলেন না তো?  আর সূর্যমণ্ডল কি কারোর ঠিকানা হয়? এর উত্তর পাই শ্রীরামকৃষ্ণের নিজের কথায়ই। বলছেন—সেসময় এক পরমহংস মূর্তি আমার দেহ থেকেই বেরুত। খেলা করতুম। তাহলে এই মূর্তিও তাঁর দেহ থেকে বেরিয়ে হৃদয়ের দৃষ্টিপথে পড়েছে। নজির রেখেছে, আমাদের এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কঠিন জগতের অন্দরে আর একটি অতীন্দ্রিয় জগত আছে। সেই জগতের স্থান-কাল-পাত্র অন্য নিয়মে অস্তিত্ব রক্ষা করে। সেই আত্মিক জগতে ক্রমাগত বিবর্তন হয়ে চলেছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এমন একটি বিবর্তনের আধিকারিক পুরুষ। কিন্তু বাস্তব জগত সেই বিবর্তনকে ধরতে পারে না। কারণ, কঠিন বস্তুর গতি আর তেজোময় পদার্থের গতি এক নয়। এ কথার প্রমাণ পাই বহু পরে। ভূধরের দাদা এসেছেন দক্ষিণেশ্বরে। মা ভবতারিণীকে দেখে বলছেন—শুনেছি নবীন ভাস্করের নির্মাণ। উত্তরে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—তা জানি না। জানি মা আমার চিন্ময়ী। একথার মর্মার্থ কি? ‘মা’ এই দেহ, কারণ এই দেহ আমরা মায়ের থেকেই পাই। তিনি বলছেন, তাঁর দেহ চিন্ময়, অর্থাৎ চৈতন্যময়। তাহলে তাঁর দেহ যে আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুসারে অল কনশাস, এ কথাই তো তিনি বললেন! তাঁর সেই চৈতন্যময় দেহের গতি তো কঠিন পদার্থের সঙ্গে সমান নয়! সে যে আলোর গতির সমান!

 তিনি সেসময় জন্মেও ভবিষ্যতের পুরুষ ছিলেন। ওপরের ঘটনাটি অলৌকিক কিছু নয়। বিজ্ঞান স্বীকার করে নিয়েছে এই স্তর উন্মোচনকে। 

আমরা আবার সেসময়ের প্রেক্ষিতে ফিরব। মথুরবাবু ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সহপাঠী। শ্রীরামকৃষ্ণের ঐকান্তিক ইচ্ছেয় তিনি তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোয়। মহর্ষি তখন তাঁর দশ/বারোটি সন্তানের পরিচর্যা করছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সেটি লক্ষ করলেন। তাঁকে দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম সমাজে নিমন্ত্রণ জানালেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবের আবেশে বা সমাধি অবস্থায় গায়ে জামা রাখতে পারেন না শুনে তিনি নিমন্ত্রণ বাতিল করলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সমাজে গেলেন না। ব্রাহ্ম ধর্মের এক অদ্ভুত অন্তঃসারশূন্যতা, মেকি আভিজাত্য ও সম্মানবোধ এই একটি ঘটনার মধ্যে দিয়েই স্পষ্ট হয়ে দাঁড়াল। ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা ব্রাহ্ম ধর্মে যে বেশ ভালো পরিমাণেই ছিল তা এই ঘটনায় প্রমাণ হয়।

সিঁথির বেণী পালের বাগানবাড়িতে প্রথম শ্রী কেশবচন্দ্র সেনকে দেখলেন তিনি। হৃদয় নিয়ে গেছে সঙ্গে করে। মলিন এক কাপড় পরনে, এক পুরোহিত এসেছেন ব্রাহ্ম উৎসবে? উপস্থিত অনেকেই বিরক্ত। কে ইনি? কেন এসেছেন? তখন মথুরবাবু নেই। কেউ চেনেনা তাঁকে। হৃদয় বললেন-আমার মামা। ঈশ্বরীয় কথা যেখানে হয় সেখানেই ছুটে যান। ঈশ্বরের নামে পাগল। ইনি দেখতে এসেছেন আপনারা কী করে উপাসনা করেন। দেবেন্দ্রনাথের সমাজে গেলেন না। নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে নেওয়া হল। কিন্তু সিঁথির বাগানে নিজেই চলে গেলেন। লোকমান্য হবার তো তাঁর কোনো সাধ ছিল না! সাধ ছিল, মানুষ কেমন করে ঈশ্বরকে ডাকে, তাই দেখবেন। বেদান্ত বলছে, যে ঈশ্বর ঈশ্বর করে সে নিজেই ঈশ্বর হয়ে যায়। তাহলে? তিনি মানুষের এই ঈশ্বরত্ব দেখার জন্যই উন্মুখ হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখলেন তাঁদের উপাসনা। মুহুর্মুহু সমাধি হল। এই বস্তুজগত থেকে বারবার সেই জ্যোতির্ময় জগতে চলে যেতে থাকলেন। আর তারই মধ্যে লক্ষ করলেন, এক কেশবেরই ফাতনা ডুবেছে। অর্থাৎ অন্তরে সে ঈশ্বরের সন্ধান পেয়েছে। সেইদিন থেকে তিনি কেশবের অনুরক্ত হলেন। আর কেশবচন্দ্র? তিনি তো নামেই ব্রাহ্ম রইলেন! কুক সাহেব থেকে শুরু করে সেসময়ের গুরুত্বপূর্ণ সকলকে জানিয়ে দিলেন, এসময়ে জগতে যদি বড়লোক কেউ থাকেন তো তিনি দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস। ইন্ডিয়ান মিরার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংবাদ পত্রের পাতায় ছাপিয়ে দিতে থাকলেন, হিন্দু ধর্মের প্রত্যন্ত প্রান্ত সন্ধান করলে আজও এমন অমূল্য রত্নের সন্ধান মেলে। বেদের যুগের ঋষিদের কথা সত্য। বেদ সত্য। ১৮৩৬ থেকে ১৮৭৫ সাল। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর আত্মিক ঐশ্বর্য নিয়ে প্রকাশ হলেন। কেশবচন্দ্র সেন সেই ঐশ্বর্যের সন্ধান পেলেন প্রথম। অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন হল। শ্রীরামকৃষ্ণ যান, কেশবচন্দ্রও আসেন। ক্রমে কেশবের সাঙ্গোপাঙ্গরাও আকৃষ্ট হলেন।

তাহলে কি একান্ত এই ব্যক্তিগত সম্পর্ককেই শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাবের অন্যতম কারণ ভাবা ঠিক? না। প্রমাণ রাখছেন কথামৃতকার শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্ত ওরফে শ্রীম। কেশবের প্রথম অসুখের সময় শ্রীরামকৃষ্ণ মা কালীর কাছে ডাব চিনি মেনেছিলেন। দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘কেশব না থাকলে আমি কার সঙ্গে কথা কব?’ সে যাত্রা কেশব সেরে উঠেছিলেন। ১৮৮২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যে সাতাশ বছরের মাস্টারটি (শ্রীম) পৌঁছেছিলেন দক্ষিণেশ্বরে তিনিও তো কেশবের খুব ভক্ত ছিলেন। এতটাই, যে কেশব আজ বক্তৃতা দেবেন শুনলে সেই কিশোরবেলা থেকে সেখানেই ছুটে যেতেন। বস্তুত, পরবর্তীতে তাঁর অন্তরঙ্গ সন্তান বলে যাঁদের চিহ্নিত করা হয় তাঁদের অধিকাংশ ওই কেশব সেনের ব্রাহ্ম সমাজে যাতায়াত করতেন। সিমলের দত্ত বাড়ির নরেন্দ্রনাথ তো সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যই ছিলেন বহুদিন। সেই কেশব যখন অন্তিম শয়ানে তখন শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে দেখতে গিয়ে বলে এলেন—বসরাই গোলাপের গাছ মালী গোড়াশুদ্ধ উপড়ে দেয়, ভালো হিম পাবে বলে। ফিরে ফিরতি একটা বড় কাণ্ড হবে। অর্থাৎ কেশবের জীবনকুসুম ঝরে যাবে এবার। জগতে নতুনের আবির্ভাব হবে। সে এক বিপুল আয়োজন হবে। কেশবের ভূমিকা এখানেই শেষ। মাস্টারমশাইকে বলছেন—আগের বারে যেমন কষ্ট হয়েছিল এবারে তা হয়নি।   

    তবু জানা ভালো যে, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসকে জগতের সামনে প্রথম প্রকাশ্যে এনেছিলেন কেশবচন্দ্র সেন। তাঁর আরব্ধ কর্ম ব্রাহ্ম সমাজ স্থাপন নয়, জগতের দরবারে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের মহিমা প্রকাশ করা। ব্রাহ্ম সমাজ যদি শাশ্বত হতো তবে আজ নববিধানকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না কেন?

       শ্রীরামকৃষ্ণের সিদ্ধাবস্থা সম্পর্কে ধারণা সেসময় কারোরই ছিল না। তাঁর অন্তরঙ্গ পার্ষদই হোক, বা বিরূপভাবাপন্ন মানুষই হোক। অনেকেই নিতান্ত কৌতূহল বশে এসেছেন। এসেছেন দেখতে, তাঁদের গগনচুম্বী পাণ্ডিত্য ও শাস্ত্রাধিকার থাকা সত্ত্বেও কী করে এক মূর্খ উন্মাদ পুরোহিত হঠাৎ অবতার, পরমহংস ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত হতে পারেন? যারা বিশেষণ দিচ্ছেন তারা কোন বৈশিষ্ট্য দেখে এসব দিচ্ছেন? এই প্রসঙ্গে আমরা পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণির নাম উল্লেখ করতে পারি। ১৯২০ সালে অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত সারথি পত্রিকার ফাল্গুন সংখ্যায় তর্কচূড়ামণির একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। তিনি পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু প্রশ্নের উত্তরস্বরূপ চিঠিটি দেন। উল্লেখ্য, কথামৃতে বর্ণিত পণ্ডিতমশাই ও শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎকার সম্পর্কে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় পণ্ডিতমশাইকে লিখেছিলেন, তাঁর সঙ্গে আলোচনায় যা শুনেছিলেন তার সঙ্গে কথামৃতের কথার সাদৃশ্য নেই। চিঠিতে কী লিখেছিলেন চূড়ামণি মশাই? লিখেছিলেন, তিনি যা বলেছেন তাইই সত্য। কথামৃত মিথ্যা। এইসব উপাধির ভিত্তি নেই। রামকৃষ্ণ শাস্ত্রানুসারে বড় জোর অবধুত হতে পারেন। পণ্ডিত মশাই তাঁর মধ্যে শাস্ত্রবর্ণিত লক্ষণ কিছুই দেখেননি। কথামৃতে শ্রীম লিখেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, যে আদেশ পায় নাই তার উপদেশে কী হবে? চাপরাস পেলে তবে উপদেশ দেওয়া চলে। কথামৃতের কথাটি সরাসরি শশধর পণ্ডিতের উদ্দেশ্যে নয়। বরং সেসময় যে গির্জা ও ব্রাহ্মসমাজ থেকে ঘোষণা করে ধর্মোপদেশ দান করা হতো সে সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণ বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছিলেন—ও আবার কি? সাইনবোর্ড লাগানো সাধু? অমুক সময়ে লেকচার হইবে? তোমাদের কলকাতার লোকেদের ওই এক, কেবল লেকচার দেওয়া, নিজেকে কে বোঝায় তার ঠিক নেই! স্পষ্টতই তাঁর এই মনোভাব চূড়ামণি মহাশয়ের স্বার্থে আঘাত করেছে। তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন নিজের অহংকারকে বড় করবেন বলে। জাগতিক স্বার্থসিদ্ধির বিষয়টাও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি তাঁর পছন্দ হবার কথা নয়।

       চূড়ামণি মশাই লিখছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন তাঁর পুঁথিগত বিদ্যা নেই, আর চূড়ামণি বহু শাস্ত্র পড়ে পণ্ডিত। সুতরাং শ্রীরামকৃষ্ণ একজন মূর্খ হয়ে আদেশ বা চাপরাস সম্পর্কে তাঁকে কী উপদেশ দেবেন? তাঁর সে অধিকার কই? চিঠির ছত্রে ছত্রে চূড়ামণি মহাশয়ের বিদ্বেষ উপচে পড়েছে। তিনি লিখছেন, শাস্ত্র বিষয়ে যাহারা একেবারেই অজ্ঞ, তাহাদের পক্ষেই তাহা উপযোগী হইতে পারে। তিনি একথা লিখছেন কথামৃত সম্পর্কে। তিনি পণ্ডিত, কিন্তু ঈশ্বরতত্ত্ব কী, ব্রহ্মত্বই বা কী, সে সম্পর্কে চূড়ামণি মহাশয় একেবারেই অজ্ঞ, তা নিশ্চিত। কারণ, কথামৃতের কথার মর্মার্থ অনুধাবন করে এমন পণ্ডিত জগতে নেই। একমাত্র স্তর উন্মোচন হলে তবেই জানা যায়। এই লেখার পরিশিষ্ট অংশে আমরা তেমন কয়েকটি উদাহরণ দেব।

       এখানে শশধর তর্কচূড়ামণির প্রসঙ্গের অবতারণা এই কারণে যে, শুধু ব্রাহ্ম সমাজ নয়, হিন্দু পণ্ডিতদের মধ্যেও শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে কম বিদ্বেষ কাজ করেনি। অবাক হতে হয় যে, ১৯২০ সালে চূড়ামণি যখন চিঠি লিখে পত্রিকায় ছাপাচ্ছেন তখনও কথামৃতকার বেঁচে। চূড়ামণিমহাশয় যদি সত্যিই এই কথাকে মিথ্যা বলে জানতেন তবে তো অনায়াসে তা শ্রীম’র  নজরে আনতেন! তা তিনি করলেন না কেন? শ্রীম’র প্রামাণ্য গ্রন্থ সম্পর্কে সঙ্গকারীদের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। সেখানে শশধর তর্কচূড়ামণি (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, তৃতীয় ভাগ, নবম খণ্ড) ও শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ নিয়ে যা লেখা হয়েছে তা শুধু শ্রীম’র মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। কারণ, তাঁর লেখায় সাক্ষীর কখনও অভাব ঘটেনি। তিনি অত্যন্ত সতর্কভাবে প্রতিটি পরিচ্ছেদে একাধিক নাম উল্লেখ করেছেন। শশধর সেদিন একা ছিলেন না। ছিলেন ভূধরের দাদা। ইনি শ্রীরামকৃষ্ণের একান্ত অনুরাগী হয়েছিলেন শেষ জীবনে। এত কিছু সত্ত্বেও দম্ভের বশে শশধর তর্কচূড়ামণি শ্রীরামকৃষ্ণকে নস্যাৎ করলেন। শাস্ত্র তাঁর পাঠের প্রয়োজন ছিল না। তিনি নিজেই মূর্ত বেদান্ত। শশধর তর্কচূড়ামণিকে কেউ মনে রাখেনি।

       ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম আর এক বিপ্লবী সদস্যের নাম করি। ইনি কেশবচন্দ্রের সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গ করার জন্য বলে অনেকেই মনে করেন। যদিও কেশবচন্দ্র  কুচবিহারের মহারাজার সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন বলে তাঁর অখ্যাতি রটে ও অনেকেই তাঁকে ত্যাগ করেন। কিন্তু আসল কারণ, কেশবের অসম্ভব জনপ্রিয়তা। সকলেই তো ক্ষমতা চায়! কজন আর শ্রীরামকৃষ্ণ হন! যিনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করেছেন অজস্রবার। বলেছেন, গুরু বাবা, কর্তা তিন কথায় আমার গায়ে কাঁটা বেঁধে। বলেছেন, সচ্চিদানন্দই গুরু। বলেছেন, সাইনবোর্ড লাগানো সাধু, সাধু নয়। 

       ইনি শিবনাথ শাস্ত্রী। শ্রীরামকৃষ্ণ এঁকে ব্রাহ্মসমাজে দেখেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন ইনি একেবারে অন্তঃসারশূন্য নন। তাই মাঝে মাঝে তাঁকে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। কলকাতায় গিয়ে তাঁকে খবর দিয়েছেন, অনেক সময় শিবনাথ আসেননি। জরুরি কাজে অন্যত্র গিয়েছেন বলে খবর দিয়েছেন। নিরহংকার শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুই মনে রাখেননি। একবার দেখে নেব, শিবনাথ শাস্ত্রী শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে কী মনোভাব পোষণ করতেন।

       তাঁর নিজের স্মৃতিচারণে কিন্তু তিনি অকুণ্ঠ লিখছেন—বৈরাগ্য তাঁহার সমগ্র চেতনায় একেবারে ওতপ্রোত হইয়া গিয়াছে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন—এ দেহ থেকে জীব-জীবনের কামনা বাসনার মূল উৎপাটিত হইয়া গিয়াছে। শিবনাথ জানিয়েছেন, এ উক্তির তাৎপর্য তিনি সেদিন বোঝেননি। নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের মতানৈক্য থাকলেও, বিশেষত কামিনীকাঞ্চন বিষয়ে, কারণ ব্রাহ্ম উপাসকেরা বিবাহিত ও সন্তানের জনক হয়েও সমাজের গদীতে বসতে পারতেন, তিনি স্বীকার করছেন, শ্রীরামকৃষ্ণের দেহে এক বিস্ময়কর স্নায়বিক পরিবর্তন তিনি প্রায়ই লক্ষ করতেন। যদিও শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবতন্ময়তাকে তিনি অতিরিক্ত কৃচ্ছসাধন ও কঠোর সাধনার কারণে মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ বলে উল্লেখ করেছেন, তবু তাঁর স্মৃতিচারণ সশ্রদ্ধ। এ থেকে বোঝা যায়, শিবনাথের সার ছিল। তিনি শুষ্ক পণ্ডিত ছিলেন না। তবু উল্লেখ করতে হয়, কথামৃতে এক জায়গায় শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—শিবনাথ নাকি বলেছে বেশি ঈশ্বর চিন্তা করে উনি বেহেড হয়ে গেছেন? চৈতন্যকে চিন্তা করে কি কেউ অচৈতন্য হয়? তাহলে সুপণ্ডিত হলেই হয় না। তথাকথিত মূর্খ শ্রীরামকৃষ্ণ জানিয়ে দিলেন, চৈতন্যকে চিন্তা করলে চৈতন্য লাভ হয়। অচৈতন্য হয় না সে। তাহলে মস্তিষ্ক বিকৃতির কথাটা শিবনাথ শাস্ত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত।

 

সমসাময়িক দৃষ্টিতে তাঁর প্রতি সেসময়ের মানুষ ও সমাজ কী ভেবেছে তা আমাদের আলোচনার উপজীব্য নয়। আমরা মহামানবকে যেটুকু সম্ভব ধারণা করতে পারি তারই চেষ্টা করব। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, তিনি শাস্ত্র পড়েননি বটে তবে শুনেছেন অনেক। বলেছেন, “ওগো আমি শুনেছি কত!”

    তাঁর আবির্ভাবকে উনবিংশ শতকের নবজাগরণের অন্যতম একটি বিশেষ পর্যায় বলেন অনেকে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তাঁর দিকে তাকালে বারবার মনে হয়েছে, তিনি আসবেন, তাই উনিশ শতকের আলো এসে পড়েছিল বাংলাদেশে। তাঁর কথা অনুসারে, “বাবু আসবেন তার আগে পথ পরিষ্কার করে আলো দেওয়া হয়। খানসামা চাকর বাকর এসে ঘর সাজিয়ে দেয়। নইলে বাবু এসে বসবেন কোথায়?” তিনি আসবেন তাই সেই সময়ের সমাজে কুসংস্কার আচ্ছন্ন অন্ধকারে নব জাগরণের আলো এসে পড়েছিল।

একথার মধ্যে আবেগ নয় অন্যতর পর্যবেক্ষণ আছে। ১৮৭৫ থেকে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত, এই এগারো বছরের সময়কালে তাঁর উপস্থিতি, তাও দক্ষিণেশ্বর ও কলকাতার কিছু অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তিনি পর্যটক ছিলেন না। কোথাও ধর্ম প্রচার করতে যাননি। এ বিষয়ে তাঁর গভীর অনীহা ছিল। সাধারণত অবতারদের আমরা ধর্ম প্রচার করতেই দেখেছি। লব্ধ বস্তু তাঁদের স্থির থাকতে দিতো না। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ এ অবস্থা থেকে ওপরে গিয়েছিলেন। অথচ গভীর প্রত্যয়ে তিনি নিজের কথা বলে গেছেন। সেসব কথা বলতে বলতে বারবার উল্লেখ করেছেন—আমি বলছি না, মা বলছে। এই ‘মা’ কে? বলছেন—তোমরা যাকে ব্রহ্ম বলো আমি তাঁকে ‘মা’ বলে কই। তাহলে তিনি বলছেন না। বলছেন ‘মা’। তাঁর আর একটি কথা—‘মরা মরা শুদ্ধ মন্ত্র ঋষি গিয়েছেন বলে। ‘ম’ মানে ঈশ্বর, ‘রা’ মানে জগত’। তাহলে এই ‘ম’ বা ঈশ্বর বা ব্রহ্ম, যিনি কিনা বাক্যমনের অতীত, অতএব নিরাকার, সেই ‘ম’য়ে আকার দিলে ‘মা’ হয়। অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্ম সাকারে ‘মা’ হলেন। নির্গুণ ব্রহ্ম সগুণ হলেন। তাঁর ভেতর থেকে এই সগুণ ব্রহ্ম কথা বলতেন কি? ঠিক তা নয়। আসলে তিনি নিজেই সগুণ ব্রহ্মে পরিবর্তিত হতেন, এবং তা ঘটত তাঁর অজ্ঞাতসারেই।

তাঁর জন্মের পাঁচশ বছর আগে এই বাংলাদেশেই এক মহামানবের আবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে যে বিবর্তনের সূত্রপাত শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে দিয়ে সেই বিবর্তনের অগ্রগতি। বস্তুত শ্রীচৈতন্যদেবের কথা বহুবার উল্লিখিত আছে শ্রীরামকৃষ্ণের কথায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—চৈতন্যের প্রেম হয়েছিল, বস্তুলাভ হয়নি। এখানে বেদের ধারাবাহিক সাধনের উল্লেখ করতে হয়। বেদের আগম বলতে দেহে যে সপ্তভূমি আছে তার কথা বলা হয়েছে। এই দেহের প্রতি কোষে যে প্রাণশক্তি ছড়িয়ে আছে তা সংকলিত হয়ে আমাদের সুষুম্নাদ্বারে আসে। সবচেয়ে প্রথমে মূলাধার। সংকলিত প্রাণশক্তি মূলাধারে এলে মানুষটা শান্ত হয়। এই সংকলিত প্রাণশক্তি, তন্ত্রে যাকে বলে কুণ্ডলিনী, বেদে বলছে মহাবায়ু, সেই শক্তি উর্ধগতি লাভ করে একে একে ভূমি অতিক্রম করতে থাকে। মেরুদণ্ডের কশেরুকাতে এই ভূমিগুলির অবস্থান। এই একেকটি ভূমি অতিক্রম করার সময়ে দেহীর নানাবিধ অনুভূতি ও দর্শন হতে থাকে। আসলে যে পঞ্চভুতে এই শরীর গঠিত, সেই পাঁচটি ভূত অন্যটিতে পরিবর্তিত হয়। এই দেহ আসলে ‘মাটি’, বা ক্ষিতি। অন্নময় কোষ বলছে বেদ। দেহের প্রথম তিনভূমি এই অন্নময় কোষের অন্তর্গত। লিঙ্গ গুহ্য ও নাভি। অন্নময় কোষে আমাদের প্রাণশক্তি এই বস্তুজগতেই সংকলিত হতে পারে। সেখানে কোনো অনুভূতি নেই। শুধু অন্নময় কোষ প্রাণময় কোষে পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ ‘মাটি’ ‘জলে’ বা ‘অপ’ এ পরিবর্তিত হয়। মাটি যেমন কঠিন, নির্দিষ্ট সীমায় বদ্ধ, জল তা নয়। দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমার বাইরেও তা ছড়িয়ে যায়। শক্তি এখানে সীমাকে অতিক্রম করছে।  তারপর চতুর্থ ভূমি, হৃদয়ে মন এলে জল বায়ুতে পরিবর্তিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—তখন যেদিকে চোখ পড়ে সাধক জ্যোতি দেখতে পায়। গাছের ডালের দিকে চোখ পড়লেও রূপা বা পারা গলার মতো দেখা যায়। অর্থাৎ সাধক সব চৈতন্যময় দেখেন। কেন? কারণ তাঁর অন্তরচৈতন্য তাঁর দৃষ্টিকে লিপ্ত করছে। তিনি যেদিকে চোখ ফেলছেন সেইদিকেই সেই চৈতন্য জ্যোতিরূপে লিপ্ত হচ্ছে। এরপরে পঞ্চমভূমি বা কণ্ঠে মন গেলে সাধকের মন আর জাগতিক কিছুতে লিপ্ত হয়না। তখন বায়ু আকাশে বা ‘ব্যোম’ এ পরিবর্তিত হয়েছে। এই ভূমিতে সাধকের আকাশ দর্শন হয়। জল থেকে বায়ু ত্রিমাত্রিক পরিবর্তন। শক্তি তখন অসীমে যেতে পারে। কিন্তু পঞ্চমভূমি বা আকাশে মন গেলে তাঁর আর পদার্থস্বরূপ থাকছে না। পদার্থের শক্তিত রূপান্তর শুরু হয়েছে। ষষ্ঠভূমিতে সাধকের ইষ্টদর্শন হয়। কিন্তু দেশকাল ভেদে ইষ্টদর্শনের প্রভেদ আছে। তাই একেই পরমসত্য বলে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এরপর সপ্তমভূমি। সেখানে মন গেলে দেহী সম্পূর্ণভাবে তেজে পরিবর্তিত হন। পঞ্চভূতের শেষ। পদার্থ শক্তিতে পরিণত। আত্মিক গতি শক্তিতে পরিণত করে। দেহীর দেহবোধ সম্পূর্ণ লুপ্ত। শুধু চেতনা থাকে। সেই চেতনায় তিনি নিজের স্বরূপ দেখতে পান। সূর্যস্বরূপ জ্যোতির মধ্যে নীল রেখা দ্বারা সীমায়িত জ্যোতিপুঞ্জ। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠবৎ জ্যোতি, যাকে বেদে বলছে ‘আত্মা’। এইখানেই বেদের আগম সাধন শেষ। এরপর নিগম। এই জ্যোতি এরপর অবতীর্ণ হয় দেহে। প্রথমে কণ্ঠ পর্যন্ত, তারপর কটিদেশ পর্যন্ত। এই অবতীর্ণ জ্যোতি বা চৈতন্য তখন দেহীকে শক্তিমান করে। তাঁর দেহের প্রতিটি কোষ তখন চৈতন্যে পরিবর্তিত। অল কনশাস। শ্রীরামকৃষ্ণ চৈতন্যদেব সম্পর্কে যখন বলছেন, চৈতন্যের প্রেম হয়েছিল, বস্তুলাভ হয়নি, তখন তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে চৈতন্যদেবের এই জ্যোতিস্বরূপ আত্মা সাক্ষাৎকার হয়নি, কিন্তু চৈতন্যের দেহে শক্তির অবতরণ হয়েছিল। সে প্রমাণ তাঁর নামেই রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। তাঁর দেহে সাকারে চৈতন্যের অবতরণ হয়েছিল। দেহের মধ্যে আর একটি জ্যোতির্ময় উপস্থিত। সেই প্রেমের কথাই ঠাকুর বলেছেন। শ্রীচৈতন্যদেবের অপূর্ব কৃষ্ণপ্রেম ও বিরহ দেখে জগত স্তম্ভিত ও মোহিত হয়েছিল। কিন্তু তাঁর অবস্থা অনুধাবন করতে পারেনি। কারণ ঠাকুর বলছেন অবতার প্রত্যক্ষসিদ্ধ। এই অবতীর্ণ শক্তির কাছে বড় বড় পণ্ডিত পর্যন্ত কেঁচো হয়ে যায়—শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত। চৈতন্যদেবের জীবনে এ সত্য বারবার প্রকাশিত।

অবতারত্ব তাহলে একটি কন্ডিশান বা অবস্থা। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের জীবনে আত্মা সাক্ষাৎকারের কথা আছে। তিনি বলছেন—জোর করলে মা বাপ পরামর্শ করে দু তিন বছর আগে হিস্যে ফেলে দেয়। বাইশ/তেইশ বছর বয়সে তাঁর ভগবান দর্শন হয়। তিনি বলছেন দেহের মধ্যে ফাল চালানোর মতন কষ্ট হয়েছিল। কারণ দেহের পরিপূর্ণ বিকাশের কিছু আগেই এ ঘটনা ঘটেছিল। তাঁর অবতারত্বের কথায় বলছেন—তোমরা বেশ আছ। সারে মাতে। আমি বেশি কাটিয়ে জ্বলে গেছি। অর্থাৎ তাঁর ‘আমি’ সম্পূর্ণরূপে নাশ হয়ে জ্যোতিতে অবতরণ করেছে। এই অবতারত্ব অবস্থায় দেহী একাই থাকেন। কসমিক ম্যান। তাঁর তখন এক অদ্ভুত প্রেম জন্মায়। বিশুদ্ধ অদ্বৈত অবস্থায় যেমন দেহস্থ চৈতন্যের প্রতি প্রগাঢ় প্রেম বা আকর্ষণ জন্মায়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—তোমাদের কাছে বলতে নাই, কিন্তু এ অবস্থায় সচ্চিদানন্দকে আলিঙ্গন চুম্বন করতে ইচ্ছা করে। সচ্চিদানন্দ তো বাইরে নয়! নিজের অভ্যন্তরে! এই দেহাতীত প্রেমের কথা তিনি কাকে বলবেন? কে উপলব্ধি করবে? সাধারণত মানুষ তো প্রেম ভাবলেই পাত্র বা আধার ভাববে। এই দেহ আধার আর দেহস্থ চৈতন্য আধেয়, একথা সে কেমন করে বুঝবে? যার দেহে কাম এতটুকুও আছে, মানুষ মাত্রই তা থাকে, সে এই প্রেম ধারণা করতে পারবে না। বৈষ্ণব মহাজনেরা এই প্রেম বোঝাতে চেয়েছেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে তো চৈতন্যের অবতরণ ঘটেনি! তাহলে সবটাই কল্পনা। সত্য অপ্রকাশ থেকে গেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ এই অবতারত্বের পরবর্তী অবস্থান্তর প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি জানতেন, অবতার ব্যষ্টি। “তোমার কথা লবে কে?” কিন্তু এই অবতীর্ণ শক্তি যখন চৈতন্যে পরিবর্তিত হয় তখন তা প্রবাহিত হয় জগতে। শ্রীরামকৃষ্ণ তা জেনেছিলেন। যখন তিনি বলছেন আগে ‘ম’ পড়ে ‘রা’, তখন তিনি আগে আত্মা তারপর জগত, আত্মার মধ্যে জগত, এই কথা বলতে চেয়েছেন। এই বিশ্বরূপ দর্শন। এ অবস্থায় স্থান কালের নাশ হয়। স্পেসটাইম অ্যানিহিলেশনের কথায় জ্যোতিপদার্থ বিদ্যা বলছে, সময় নামক মায়া বা ইলিউশন ফোর্থ ডাইমেনশানের পরবর্তী অবস্থায় বোঝা যায়। একে বলা হয় তুরীয়। আশ্চর্য এই যে, শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, জাগ্রত স্বপ্ন সুষুপ্তি ও তুরীয়, দেহের এই চারটি অবস্থা। তাহলে অবস্থান্তরের সঙ্গে সঙ্গে দেহী সেই তুরীয় অবস্থার অনুভূতি লাভ করে। তুরীয় অনেকটা কৃষ্ণ গহ্বরের মতন। কী আছে তা বলা যায় না। অসীম। যতটুকু প্রকাশ হয় ততটুকুই আমাদের জ্ঞানের আলোয় আসে। তাহলে প্রত্যেক মানুষের দেহেই এই তুরীয় আছে। তা প্রকাশের অপেক্ষায়। কিন্তু একটি দেহে ‘অসীম’ প্রকাশ হতে পারে না। ‘অসীম’ অসীমেই প্রকাশ হয়। তাই জগত। জগতেই এই অসীম প্রকাশ হয়। হবে। বিবর্তনের এই পর্যায় আমরা এখন দাঁড়িয়ে। 

 

মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে শ্রীরামকৃষ্ণ দেহত্যাগ করেন। অনেকের ধারণা তাঁর রোগের ও অকালে চলে যাওয়ার কারণ পাপী তাপী অধম মানুষদের (গিরিশের পাপ নিয়েই অসুখ) পাপ গ্রহণ। কিন্তু এ সর্বৈব মিথ্যা। তাঁর সামনে কেউ নিজেকে পাপী বলে করুণা প্রার্থনা করলে  তিনি অসন্তুষ্ট হতেন। সৎ অসৎ, পাপ পুণ্য, ব্যবহারিক জগতের ক্ষেত্রে, সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একান্তই সাব্জেকটিভ। বলতেন—যে রাতদিন পাপ পাপ করে সে শালাই পাপী হয়ে যায়। আসলে মনের রং বুদ্ধিতে বর্তায়। বুদ্ধি মলিন হয়। বরং একথা মনে করা ভালো, “আমি ভগবানের নাম করেছি, আমার আবার পাপ কী?” সুতরাং মানুষের অন্তরে যে মানুষরতন আছে তা তিনি জেনেছিলেন। তাই যেকোনো রকম ভেদাভেদ নির্বিশেষে তাঁর প্রেম জগতের প্রতি ধাবিত হয়েছে। কারণ তাঁর মধ্যেই তো জগত! বস্তুত প্রতিটি মানুষের মধ্যেই জগত। সে তাকে বিক্ষেপ করে বাইরে দেখছে। বেদে যেমন মাকড়সা আর তার জালের কথা বলেছে। কিন্তু আমাদের এ ধারণা হয়না। কেন? আমরা পরবর্তী অবস্থায় যাই। এখন আর শ্রীরামকৃষ্ণ স্থুল শরীরে নেই। আছেন তাঁর প্রিয় সন্তান নরেন্দ্রনাথ দত্ত। একমাত্র স্বামীজী এখন আলোকবর্তিকাটি ধরেছেন।

কী বলেছেন স্বামীজী নিজের কথা? বাহ্যিক পূজা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করছেন। প্রথম জীবনে নাস্তিক মত ও বুদ্ধবাদে আস্থা রেখেছিলেন এই ওজস্বী সন্ন্যাসী। কিন্তু তাঁর ঠাকুর যখন বললেন—দুটো আছে। অস্তি আর নাস্তি। অস্তিটাই লও না কেন? তখন তিনি অস্তিত্বের খোঁজ করলেন। বিস্তর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন পড়ে কুল কিনারা পেলেন না। তখন অদ্ভুতভাবে তাঁর মস্তিষ্কের স্তর উন্মোচন হল। দেখলেন, অস্তিই সত্য। যা কিছু আছে তাইই সৎ, নিত্য, বোধস্বরূপ। অসৎ অনিত্য বলে কিছু নেই। ক্রমাগত পরিবর্তনশীল এই বিশ্ব। কারণ গতিই সত্য। গতি অর্থাৎ ভাইব্রেশান। যা এখন স্ট্রিং থিয়োরি বলছে।

জীবনের প্রান্তে এসেছেন স্বামীজি। তাঁর এক শিষ্য জিজ্ঞেস করছেন—আপনি কি করে এত দূর ভবিষ্যতের কথা বলতে পারেন? স্বামীজী বলছেন—কী হয়েছে জানিস? আমার মাথার চামড়াটা গুড়িয়ে গেছে। কী বলছেন স্বামীজী? ডাহা দেহতত্ত্ব! তাঁর ব্রেনের মেমব্রেনটি গুটিয়ে গেছে। সরে গেছে। সামনে যে দৃশ্যমান জগত, তার মায়ার চাদর সরে গেছে। প্রত্যেক মানুষের মাথার মধ্যেই তো জগত! কিন্তু মায়ায় বা মেমব্রেনে ঢাকা। স্বামীজীর উন্মুক্ত মস্তিষ্ক। একে বেদ বলছে, বস্তুতত্ত্বে ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার। বস্তুতত্ত্বে, প্রতীকে নয়! এত বড় একটা অবস্থা সম্পর্কে আমরা কতটুকু ধারণা করতে পেরেছি? জগতের প্রতি তাঁর অদ্ভুত ভালোবাসা এই কারণেই। তিনি জগতকে ভেতরে পেয়েছিলেন। সেই কারণেই বাইরের ‘ভগবান’ নামক কাল্পনিক অস্তিত্বকে তীব্র তিরস্কার করেছেন। বলেছেন—দূর আহাম্মক! যে ভগবান ইহলোকে দুটো অন্ন দিতে পারেন না তিনি স্বর্গে তোকে কী সুখে রাখবেন? এই কথায় তিনি যে ইহকাল পরকাল স্বর্গ নরক এমনকি কল্পিত ভগবানকেও উচ্ছেদ করছেন সে বোঝে কার সাধ্য?

আর একদিনের কথা। তাঁর প্রিয় শিষ্য শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী তাঁকে জিজ্ঞেস করছেন—আচ্ছা, কৃপা মানে কি? শ্রীরামকৃষ্ণদেব এতবার বলেছেন কৃপা ছাড়া আত্মিক উন্মেষ হয়না, ঈশ্বরের কৃপায় ঈশ্বরলাভ, যে স্বাভাবিক ভাবেই কৃপা কী তা জানতে অনেকেই উৎসুক ছিলেন। এর উত্তরে স্বামীজী বলছেন—কৃপা মানে কী জানিস? কোনো আত্মবিৎ সাধুর চারিধারে একটি আত্মিক তরঙ্গ থাকে। কিছু না জেনেও সেই বৃত্তের মধ্যে যদি কেউ এসে পড়ে তবে কিছু সাধন ভজন না করেও সে প্রভূত আত্মিক ঐশ্বর্য লাভ করে। একে যদি কৃপা বলিস তো বল।

তাহলে কৃপা দান বা গ্রহণ নয়, একটি উচ্চতর আধ্যাত্মিক তরঙ্গ। যা একটি বৃত্তের মতন একটি দেহকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়। সেই বৃত্তের মধ্যে যো সো করে ঢুকে যাওয়া। স্বামীজীর কৃপার এই অপূর্ব ব্যাখ্যা জগতে আর কেউ দিতে পারেননি। তাঁর এই ব্যাখ্যার পরবর্তী উন্মেষ দেখা যায় নীচের উক্তিতে, যেখানে তিনি মানুষের ধর্ম বলতে কী বোঝাতে চাইছেন, সেই কথা বলছেন।

Mankind ought to be taught that religions are but varied expressions of THE RELIGION, which is Oneness.

(letter written to Mohammed Sarfaraz Hussain of Ninital)

তাহলে একত্বই ধর্ম! সে একত্বে মানুষের উপলব্ধি হয়, আমি ও আমার সামনে এই জগত আসলে এক। একই আত্মিক চৈতন্যের বহুত্বে প্রকাশ। স্বামীজী এভাবেই এগিয়ে দিলেন আমাদের। আবার এরপর কী বলছেন? বলছেন--

Granted that you attain personal liberation by means of Advaita, but what matters it to the world? You must liberate the whole universe before you leave this body. Then only you will be established in the Eternal Truth. Has that bliss any match, my boy?

(Complete Works Vol. vii page 161)

তুমি নিজে নয় সাধনা করে মুক্তি লাভ করলে, জানতে পারলে তুমি শুধু মাত্র এই দেহ নও, তুমি সেই নিত্যশুদ্ধ বোধস্বরূপ অসীম অস্তিত্ব। কিন্তু তাতে জগতের কী হল? জগতের একটি মানুষও যদি সেই বোধ থেকে বঞ্চিত হয় তবে তোমার ব্যক্তিগত মুক্তির দাম কী? তোমার মৃত্যুর আগেই যদি তোমার মুক্তি তুমি জগতবাসীকে দান করতে পারো তবেই প্রকৃত মুক্তি। জীবন্মুক্তি। সেই আনন্দের কি কোনো তুলনা হয়?

তাহলে স্বামীজী বিশ্বব্যাপী মুক্তির কথা বলছেন। ব্যষ্টি তিনি ত্যাগ করছেন। শুধুমাত্র নিজের হলেই হল না। জগতের প্রতিটি মানুষের হওয়া চাই। নাহলে তোমার একক মুক্তি মুল্যহীন।

এই কথার মধ্যে দিয়ে স্বামীজী প্রচলিত অবতারত্বকে উচ্ছেদ করছেন। বলছেন, কোনো একক মহামানব আর আসবেন না। ধর্মগ্লানি দূর করতে এমন ঘটনার আর প্রয়োজন নেই। কারণ জগত জুড়ে এবার চৈতন্যের ক্রিয়া চলবে। কেউ যদি একক মুক্তির দাবী করে তবে সে নিজের অহংকেই বড় করবে।

সুতরাং, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস শেষ অবতার। তাঁর পরে আর কেউ জন্মাবেন না। অবতারত্বের অবস্থা আমরা পেরিয়ে গিয়েছি। এরপর স্বামীজী যা বলছেন তা চূড়ান্ত।

Being one with Divinity there cannot be any further progress in that sense.  

মানুষটা ঈশ্বরত্ব পেলে তার আর চাওয়ার কিছু থাকেনা। পূর্ণর অভাব বোধ থাকে না। পূর্ণ থেকে পূর্ণ নিলে পূর্ণই পড়ে থাকে। আর এই পূর্ণত্ব একা কারোর সম্পদ নয়। এ জগতের সম্পদ। 

তাহলে তাঁর অবদান কী রইল? এই আত্মিক বিবর্তনে তাঁর ভূমিকা কী? আমরা আলোচনা করে নেব তাঁর ভগবানের ব্যাখ্যা কী। স্বামীজী বলছেন-- 

There is one thing to be remembered—The assertion—I am God—that cannot be made with regard to the sense world. So the affirmation of your divinity applies to the Noumenon. 

এর অর্থ, বস্তুজগত থেকে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগত থেকে ‘আমি ভগবান’ এই অবস্থা অনুভব করা যায় না। যায় আত্মিকে। অর্থাৎ, আত্মিক উপলব্ধি নাহলে এ অবস্থার কথা বলা যায় না।

এরপরে ঈশ্বরত্বের ব্যাখ্যা।

In reply to a question—'Ishwara’—I give the following definition. ‘ishwara’ is the sum total of individuals, yet he is an individual. Samoshthi or collected equals God. Byasthi equals ‘Jiva’. The exixtance of Ishwara therefore depends on that of Jiva. Thus Jiva and Ishwara are co-existant beings. When one exists the other must. Also because except on our earth in all the higher spheres the amount of good being vastly in excess to the amount of evil. The sum-total—Ishwara may be said to be all good.

সরলার্থঃ জগতের প্রতিটি মানুষের প্রাণের সমষ্টিই হলেন ঈশ্বর। আবার তিনি একজন ব্যক্তিও বটে। সমষ্টি মাত্রই ঈশ্বর। ব্যষ্টি মাত্রই জীব। ঈশ্বরত্ব অতএব জীবের ওপরেই নির্ভরশীল। জীব ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব পরস্পরের ওপরে নির্ভরশীল, বা দুটি অস্তিত্ব ওতপ্রোত। একটি থাকলে অপরটিও আছে। তবে এই বাস্তব জগতে যে অসৎ আছে তার চেয়ে অনেক অধিক পরিমাণে সৎ উর্ধতন স্তরে আছে। অতএব ঈশ্বরত্ব বলতে আমরা যেন সেই সর্বাত্মক ‘সৎ’কেই বুঝি।

       স্বামীজী তো একক মুক্তি একক উপলব্ধি বা বিকাশে বিশ্বাসী নন! তাঁর কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ব্যক্তিমানুষের ওপরে নির্ভরশীল! জীব ছাড়া শিব নয়! জীবই শিব! তবে এই উপলব্ধি, অসৎ বলে কিছু নেই, সবই সেই সৎ, একথায় তিনি বলছেন, এই বস্তুজগতের ওপরের স্তরে  যেখানে ইন্দ্রিয়ের কাজ নেই, সেখানেই এই উপলব্ধি সম্ভব। 

       তাহলে এতদূর বলে যাওয়া সত্ত্বেও জগতের অধিকাংশ মানুষ সে ঈশ্বরত্বের সন্ধান পেল না কেন? কারণ সেই বিশুদ্ধ একক স্বরূপ বা একত্ব, যাকে স্বামীজী বলেছেন Religion is Oneness, তা এখনও প্রকাশের অপেক্ষায়। যে স্তরে বিজ্ঞান বলছে চেতনার স্তর এককে পৌঁছবে সেখানে প্রত্যেক মানুষ অনুভব করবে, আদতে অস্তিত্ব এক, প্রকাশে বিভিন্নতা। দেহে ভিন্ন হলেও আত্মিকে এক। এটি আমাদের মস্তিষ্কের উন্নত অবস্থায় ধরা দেবে। কিন্তু এত বড় একটি আত্মিক বিবর্তন, যা বৈপ্লবিক তো বটেই, তা আমরা ধারণা করতে পারলাম না, এর চেয়ে দুঃখের আর কী আছে!

       পরাধীন দেশ সম্পর্কে স্বামীজীর ক্ষোভ ছিল। কারণ ব্রেনে দাসত্বের সেল থাকলে সে মানুষ দ্বৈতবাদের বাইরে যেতে পারেনা। ফলে বিশুদ্ধ অদ্বৈত সে মাথায় ধারণা হয় না। সম্ভবত সে কারণেই ভারতবর্ষের মুক্তির জন্য তাঁর বড় উদ্বেগ ছিল। ব্রেনের সেল থেকে দাসত্ব সরলেই চেতনার মুক্তি ঘটে।

       স্বামীজীর সম্পর্কেও আমাদের ধারণা তাই বড় অস্পষ্ট।

পরিশিষ্টঃ

এই অংশে শ্রীরামকৃষ্ণের কিছু কথার মর্মার্থ লেখা যাবে বলে কথা দেওয়া ছিল। কথামৃত থেকে কটি উক্তি ও ব্যাখ্যা পরপর সাজানো গেল।

১ শ্রীরামকৃষ্ণ—দেহের সুখ দুঃখ আছেই। যার ঈশ্বর লাভ হয়েছে সে মন, প্রাণ, দেহ আত্মা সমস্ত তাঁকে সমর্পণ করে। পম্পা সরোবরে স্নানের সময় রাম লক্ষ্মণ সরোবরের নিকট মাটিতে ধনুক গুঁজে রাখলেন। স্নানের পর উঠে লক্ষ্মণ তুলে দেখেন যে ধনুক রক্তাক্ত হয়েছে। রাম দেখে বললেন, ভাই, দেখ দেখ, বোধ হয় কোনো জীব হিংসা হল। লক্ষ্মণ মাটি খুঁড়ে দেখেন একটা বড় কোলা ব্যাং। মুমূর্ষু অবস্থা। রাম করুণস্বরে বলতে লাগলেন, ‘কেন তুমি শব্দ কর নাই, আমরা তোমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করতাম। যখন সাপে ধরে তখন তো খুব চিৎকার করো!’ ভেক বললে, ‘রাম! যখন সাপে ধরে তখন আমি এই বলে চিৎকার করি—রাম রক্ষা করো, রাম রক্ষা করো। এখন দেখছি রামই আমায় মারছেন। তাই চুপ করে আছি’।

অর্থঃ শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, দেহের সুখ দুঃখ আছেই। দেহ থাকলে রোগ শোক দুঃখ আছেই। তার সঙ্গে ঈশ্বরীয় বিকাশের কোনো সম্পর্ক নেই। যার ঈশ্বরত্ব লাভ হয়েছে তার মন প্রাণ দেহ আত্মা সব ঈশ্বরে পরিণত হয়েছে। তার অহং পর্যন্ত ঈশ্বরে পরিবর্তিত। দেহবোধ না থাকলে সুখ দুঃখের বোধও থাকবে না। এরপরের অংশে ব্যাং মানে জীবের ক্ষুদ্র অহংকে বলছেন। সে মাটিতে গর্তে আছে। অর্থাৎ দেহে আবদ্ধ হয়ে আছে। ‘মাটি’ স্থুল দেহ। সেখানে যখন সাপে ধরে, অর্থ, কুণ্ডলিনী যখন তার জীবত্বকে নাশ করতে যায়। সাপ অর্থ কুণ্ডলিনী শক্তি। এটি কারেন্ট বিশেষ। গতিকে উর্ধমুখী করে। এই শক্তি যখন জীবকে তাড়া করে তখন সে প্রতি ভূমি অতিক্রম করতে করতে নানারকম দর্শন করে। সেই হল চিৎকার। এবার স্বয়ং রামের ধনুক তাকে বিঁধেছে। রামের ধনুক শূন্য থেকে মাটিতে গিঁথেছে। অর্থ, শূন্য বা নির্গুণ থেকে রাম বা এক, বা ব্রহ্ম ক্রিয়া করছেন। একডাকে ব্যাঙের জীবত্ব বা অহং ‘রামে’ বা ব্রহ্মে পরিবর্তিত।

‘রাম’ শব্দে শ্রীরামকৃষ্ণ যে ‘ঈশ্বর’ বা ‘ব্রহ্ম’কেই বোঝাতেন তার আর একটি উদাহরণ, তিনি বলছেন—তুমি জানো আর না জানো, তুমি রাম। অর্থাৎ তুমি ব্রহ্ম, এ তোমার জানা বা না জানার ওপরে নির্ভর করেনা। স্বয়ংপ্রকাশ ব্রহ্মকে জানতে পারলে তুমি তোমার স্বরূপ জানতে পারবে। তা নাহলেও তোমার স্বরূপ সেই ব্রহ্মই।  

 আমি আর পরব্রহ্ম এক, মায়ার দরুন জানতে দেয় না। 

এই ‘আমি’ উত্তমপুরুষ। সকলেই নিজেকে ‘আমি’ বলে সম্বোধন করে। এই ‘আমি’ সেই পরব্রহ্ম। জানতে পারলে আর মায়ায় বদ্ধ হতে হয়না। মায়াতেই বিভিন্ন দেখায়। বস্তুত একই আছেন। দুই নেই।

 একটি লোকের ছেলের খুব অসুখ। মরমর অবস্থা। এমন সময় তাকে একজন বললে, একটি কাজ করতে পারলে হয়। সে ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলে—কি? লোকটি বললে, অমাবস্যার রাত হবে, স্বাতী নক্ষত্রে বৃষ্টি পড়বে, তখন একটা সাপ একটি ব্যাংকে তাড়া করবে, ব্যাংটি পালাতে যাবে। সে যেই একটি মড়ার মাথার খুলি পেরোতে যাবে, তখনই সাপের বিষটা মড়ার মাথার খুলিতে পড়ে যাবে। সেই ওষুধ যদি আনতে পারো তো ছেলে বাঁচে।

অর্থঃ ছেলের অসুখ। অর্থাৎ জীব ‘আমি এই দেহ’ এই বিকারে আক্রান্ত। অমাবস্যার রাত—নির্গুণ। স্বাতী নক্ষত্রও নির্গুণ, কারণ একে দেখা যায় না। বৃষ্টি কৃপাবাড়ি। আত্মার প্রসন্নতা লাভ। সাপ কুণ্ডলিনী, সে জীবত্বকে তাড়া করছে। মড়ার মাথা হল যে মাথায় অহং নাশ হয়েছে। ‘আমি’ মরে গেছে। ব্যাং লাফ দিয়ে পেরল। জীবত্ব সপ্তম ভূমি অতিক্রম করল। জীব আত্মায় পরিবর্তিত হল। কখন? যখন কুণ্ডলিনীর সারাংশ আত্মায় পরিবর্তিত হল। এটি প্রতীকে শ্রীরামকৃষ্ণ আত্মা সাক্ষাৎকারের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন।

 যিনি ঈশ্বর দর্শন করেছেন তিনি দেখেন যে ঈশ্বরই জীব জগত হয়ে আছেন। সবই তিনি।

অর্থঃ যিনি ঈশ্বর দর্শন করেছেন তিনি নিজেই ঈশ্বর হয়েছেন। ঈশ্বরত্ব লাভ করেছেন। ‘মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ’। তখন তাঁর কাছে জগত ঈশ্বরেরই প্রতিবিম্ব মাত্র। সুতরাং তখন স্পষ্ট বোধ হয়—আমি আর আমার সামনে এই জগত আসলে এক। বাইরে বহু হলেও আত্মিকে এক।

এমন নানা কথাই শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের বলে গিয়েছেন। 

এখন প্রতীক্ষা।

কথাশেষঃ

শিবনাথ শাস্ত্রীর স্মৃতিচারণটি তাঁর ‘মহান পুরুষদের সান্নিধ্যে’ গ্রন্থ থেকে পঠিত। 

কথামৃতের মর্মার্থ অংশ ও স্বামীজীর উক্তির অর্থ, নামপ্রকাশে একান্তভাবেই নিষেধ, এমন একজনের অনুভূতি থেকে নেওয়া। তিনি মহাসমুদ্রের মতো আমার মতন এমন বহু নগণ্য ও অগণ্য ব্যক্তির কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ ও স্বতঃস্ফূর্ত আত্মিক বিবর্তন ও বিকাশের কথা জানিয়েছেন। কিন্তু প্রচারে মিথ্যা থাকে। সত্যের প্রতিষ্ঠা হয় আপন অন্দরে। আপন মস্তিষ্কে। তাই তুচ্ছ নামরূপ প্রকাশে তাঁর নিষেধ ছিল। সেকথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। তাঁর কাছে আমি আজীবন ঋণী।            

[মাতৃশক্তি কল্পতরু সংখ্যা ২০২২]  

0 comments:

0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in



আমার ভারতবর্ষ

মুসম্মন বুরুজ (শাহি বুরুজ)



নসিব-এ-হিন্দৌস্তাঁ

পর্তুগিজ যাজক বুজিও এদেশের লোককে খুব ভালো চিনতেন। সেই কবে মানুচ্চিকে বলেছিলেন, ' দারা অত্যন্ত ভালো লোক, উদার, বুদ্ধিমান, সুশাসক। কিন্তু সেটাই এদেশের লোকের কাছে তাঁর প্রধান দোষ। হিন্দুস্তানের লোকেরা নীচ স্বভাবের। তারা দারা শুকোহের মতো মহান, হৃদয়বান শাসককে ভক্তি করেনা। তাদের জন্য দরকার তাদের মতো'ই নীচ, নৃশংস, অত্যাচারী স্বভাবের শাসক।

বের্নিয়ার আর ত্যাভারনিয়েরও খুব অবাক হয়েছিলেন। তাঁরা জানতেন, দিল্লি-আগ্রার সব প্রভাবশালী আমির-ওমরাহরা সারা জীবন বাদশা শাহজাহানের থেকে কী ধরনের সাহায্য, অনুকম্পা লাভ করেছিলেন। বাদশা শাহজাহানের দৌলতেই তাঁরা লাভ করেছিলেন ধনসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, শক্তি-সামর্থ্য। কিন্তু অসুস্থ, অসহায় বাদশাকে পুত্র অওরঙ্গজেব যখন আগ্রা দুর্গে অত্যন্ত অপমানজনক ভাবে গৃহবন্দি করলেন, তাঁরা কেউ টুঁ শব্দ করলেন না। পিতৃপ্রতিম বাদশাহকে তাঁরা নীরবে, সভয়ে, সশংক ত্যাগ করলেন।


হিন্দুস্তানের সর্বকালের সবচেয়ে বিলাসী, সম্পদশালী, জাঁকালো রাজা নির্বাসিত হলেন আগ্রা দুর্গের এককোণে। তখন তাঁর রাজত্ব বলতে শুধু মুসম্মন (শাহি) বুরুজ আর শাহজহানি মহল। শুশ্রূষা বলতে কন্যা জহানারা বেগম। তবে অওরঙ্গজেব বাদশাহের জনানা মহলকেও সেখানে থাকতে দিয়েছিলেন। সঙ্গে থাকতেন তাঁর দুই জীবিত বেগম আকবরি মহল আর ফতেহপুরি মহল। শাহজহানের প্রথম সন্তান শাহজাদী পরহুনর
বেগমও ছিলেন সেখানে। ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিলোনা। শাহজাদা মহম্মদ সুলতান দেখাশোনা করতেন বাদশাহ এবং সঙ্গিসাথিদের। তিনি চলে যেতে দায়িত্বে আসেন একজন নীচ স্বভাবের খোজা সর্দার, মুতমদ। মানুচ্চির ভাষায়, 'বেবুনে'র মতো চেহারা তাঁর। প্রতিপদে বাদশাকে অপদস্থ করাই ছিলো তাঁর প্রিয় কাজ।
বাদশাহ শাহজহান তখন খুবই ধর্মমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। কোরান পড়তেন, জপ করতেন, পণ্ডিতদের সঙ্গে ধর্মীয় আলোচনা করতেন। বাকি সময় শাহজহানি মহলের ঝরোখা থেকে তাজের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকতেন। বাইরের কারুর সঙ্গে দেখা করা মানা ছিলো। একে ওকে চিঠি লিখতেন বলে অওরঙ্গজেবের আদেশে বাদশার মহলে কালি-কলম সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন চিঠি বলতে শুধু অওরঙ্গজেব আর তাঁর মধ্যে পরস্পর দোষারোপ করে লেখা পত্ররাজি। যার মধ্যে শুধু অওরঙ্গজেবের চিঠিগুলি উদ্ধার হয়েছিলো। তিনি সমানে দোষারোপ করতেন দারা আর তাঁর ওয়ালিদসাহেবকে। একমাত্র বক্তব্য, যদি তাঁরা ক্ষমতায় থাকতেন, তবে এতোদিনে হিন্দুস্তান থেকে ইসলাম বিতাড়িত হয়ে যেতো।

বাদশা শাহজহান পূর্বপুরুষ, যেমন আকবর আর জহাঙ্গিরের সূর্যদর্শনের জন্য নির্মিত লালপাথরের বুরুজটিকে নতুন ভাবে বানিয়েছিলেন বেগম মমতাজ মহলের যমুনা নদীর শোভা দেখার জন্য। আগ্রা দুর্গের এটিই সব চেয়ে উঁচু নির্মাণ। সতেরো শতকে তিনের দশকে তৈরি আটকোনা মর্মর পাথরের এই প্রাসাদটির সৌন্দর্য এক কথায় অনুপম। এই প্রাসাদটির মর্মর পাথরের জাফরি, কুলুঙ্গি আর দেওয়ালের ইনলে কারুকাজ পিয়েত্রা দুরা শৈলীর। চারদিকে বারান্দা ঘেরা, মাঝখানে গোল বুরুজ আর চমৎকার ফোয়ারা। বন্দি বাদশা শাহজাহান এখানেই কাটিয়েছিলেন তাঁর জীবনের শেষ আট বছর। এই প্রাসাদের ঝরোখা থেকেই তিনি তাকিয়ে থাকতেন তাজের দিকে। তাঁর অন্তিম শয্যাও পাতা হয়েছিলো ঠিক এর মাঝখানে। গ্রেট মুঘলদের উপযুক্ত একটি কীর্তি, মুসম্মন বুরুজ।

তখন বয়স চুয়াত্তর। পয়লা ফেব্রুয়ারি, ১৬৬৬। সোমবার। বাদশাহ বুঝতে পারলেন দিন শেষ হয়ে এলো। কিন্তু তিনি সজ্ঞানে, সচেতন আছেন। জহানারার অনুরোধে লিখলেন পুত্র অওরঙ্গজেবের অপরাধ মার্জনা পত্র। লিখলেন তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রটিও। কীভাবে অন্ত্যেষ্টির কাজ করতে হবে, তার নির্দেশ। জহানারা কাঁদছিলেন। তাঁকে স্বান্ত্বনা দিয়ে বাকিদের বললেন জহানারার যত্ন করতে। রাতের থেকেই তাঁর জন্য কোরান পাঠ শুরু হলো। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে তিনিও শেষ প্রার্থনা সমাপন করলেন। ভোর তিনটে নাগাদ বাদশাহ শাহজাহানের ইন্তেকাল হলো।

জহানারা অনুরোধ করলেও অওরঙ্গজেব 'শাহি দাফন' মঞ্জুর করলেন না। আগ্রা থেকেই সইয়দ
মহম্মদ কনৌজি আর কাজি কুরবান এসে তাঁর মরদেহের পরিচর্যা করে একটি চন্দন কাঠের কফিনে স্থাপন করলেন। অওরঙ্গজেব এলেন না। পুত্র মোয়াজ্জামকে পাঠালেন। যমুনা নদীতে বজরা করে নিয়ে যাওয়া হলো তাজমহলে। মমতাজমহলের পাশের কবরে বাদশা শাহজহান সমাহিত হলেন দুপুর নাগাদ।

এসবই মনে পড়ছিলো যখন মুসম্মন বুরুজের ঝরোখায় দাঁড়িয়ে বাদশাহের সাড়ে তিনশো বছর পর তাজকে দেখছিলুম আমরা। শাহজহানকে মনে পড়ছিলো। তাঁর শান-শওকত, অজেয় প্রতাপ, অপার ধনসম্পদ। এভাবেই শেষ হয়। মনে পড়ছিলো পাদরি বুজিওর ভবিষ্যদবাণী। এদেশের লোক ইতিহাসের সব সন্ধিক্ষণেই বেছে নেয় অওরঙ্গজেবের মতো শাসক। দারাশুকোহ তাদের জন্য অপাংক্তেয়। ইতিহাস বার বার পুনরাবৃত্ত হয়। আমাদের নসিবও এক নরক থেকে অন্য নরকের কুম্ভীপাকে আবৃত্ত হতে থাকে। পরিত্রাণ পেতে অনেক রক্তক্ষয়, শহাদৎ….


আমরা হয়তো ভুলিনা। আবার মনেও রাখিনা। এই আমাদের ভারতবর্ষ...

0 comments: