0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















১৬

ফাইনহাল্‌স্‌ শহরে গিয়েছিল পিন, কার্ডবোর্ডের বাক্স এবং কালি কিনতে। তবে শেষ অবধি পেয়েছিল শুধু কার্ডবোর্ড। যে ধরণের গোলাপি কার্ডবোর্ডের উপরে সার্জেন্ট নানা ধরণের সাইনবোর্ড আঁকতে ভালবাসেন, শুধু সেই ধরণের কার্ডবোর্ড পেল সে। শহর থেকে ফিরবার পথে বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টির জল খুব গরম। ফাইনহাল্‌স্‌ নিজের ইউনিফর্মের জামার নিচে কার্ডবোর্ডের রোলটা ঢুকিয়ে সেটা ভিজে যাওয়া থেকে বাঁচাতে চাইছিল। কিন্তু রোলটা এতটাই বড় আর মোটা যে সেটা জামার নিচে রাখা অসম্ভব। রোলের মোড়কের কাগজটা পুরো ভিজে গিয়েছিল। আরেকটু হলেই গোলাপি কার্ডবোর্ডও ভিজে নষ্ট হবে ভেবে সে দ্রুত হেঁটে রাস্তার কোণে একটা ছাউনি দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে দেখতে পেল ট্যাঙ্কগুলো মন্থর চালে গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। নল এবং পেছনের প্রান্ত ধীরে ধীরে নাড়াতে নাড়াতে ট্যাঙ্কগুলি দক্ষিণ পূর্ব দিকে চলে গেল। রাস্তার মানুষজন শান্ত, নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে ট্যাঙ্কগুলির দিকে তাকিয়ে রইল। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল বেশ কিছুক্ষণ। বৃষ্টি থেমে যাবার পরেও গাছের গা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ছিল। কালো এবড়োখেবড়ো রাস্তায় বিশাল আকারের জলভর্তি গর্ত সামলেসুমলে অবশেষে সে অস্থায়ী হাসপাতালে পৌঁছাতে পারল।

একটা বিরাট সাদা রঙের সাইনবোর্ড ঝুলছে দরজায়, যেটাতে হাল্কা লাল পেন্সিল দিয়ে লেখা আছে ‘জেন্টগিয়োর্‌গি হাসপাতাল’। শীগগির ওই জায়গায় এর চেয়ে ভালো দেখতে একটা সাইনবোর্ড ঝোলানো হবে। গোলাপি রঙের বোর্ডের উপরে কালো কালিতে গোটা গোটা গোল গোল অক্ষরে স্পষ্টভাবে লেখা হবে, যাতে সবাই দেখতে পায়। চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে আছে। ফাইনহাল্‌স্‌ ঘণ্টি বাজাল। বাইরে মালবাহকের ঘরে উঁকি দিয়ে হাঁকডাক করেও কারো দেখা পেল না। দরজা চাপ দিতেই খুলে গেল। করিডরে ঢুকে পড়ল সে। দরজার পাশের দিকে ছোট ছোট ফুটো আছে, কাচে ঢাকা- যেগুলোর পিছনে থারমোমিটার রাখা আছে। ভিতরে সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার এবং চুপচাপ। ফাইনহাল্‌স্‌ ধীরে ধীরে নিশ্চুপে প্রবেশ করল। প্রথম ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় সে শুনতে পেল সার্জেন্ট ভেতরে ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছেন। শিক্ষকশিক্ষিকাদের ছবি আর জেন্টগিয়োর্গি জায়গাটার একটা সুন্দর রঙিন নিসর্গচিত্র করিডরের দেওয়ালে টাঙ্গানো আছে।

ফাইনহাল্‌স্‌ ডানদিকে বেঁকে একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল একটা উঠোনের মধ্যে। স্কুলবাড়ির উঠোন। উঠোনের চারদিকে উঁচু উঁচু গাছ। গাছের পেছনে উঁচু বাড়ি। ফাইনহাল্‌স্‌ বাড়িটার চারতলায় একটা জানালার দিকে তাকাল। জানালাটা খোলা। সে তাড়াতাড়ি বাড়িটার ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। সিঁড়ির দেওয়াল জুড়ে পাশ করে যাওয়া প্রাক্তনীদের ছবি ঝোলানো। বাদামি আর সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো মেয়েদের ছবি। তাদের মধ্যে একটা মেয়ের ছবি ডিম্বাকৃতি ফ্রেমে আটকানো।

প্রথম বছর ১৯১৮। হয়তো এই স্কুল থেকে প্রথম ফাইনাল পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল ১৯১৮ সালের ব্যাচ। মেয়েরা কড়কড়ে মাড় দেওয়া সাদা ইউনিফর্ম পরে আছে; সবাই বিষণ্ণ হাসি হাসছে। ফাইনহাল্‌স্‌ রোজ ছবিগুলো দেখে। গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে রোজ দেখছে সে ছবিগুলো। মেয়েদের ছবির মাঝে এক গম্ভীর মহিলার ছবি আটকানো। গায়ের রঙ একটু ময়লা; প্যাঁশনে চশমা পরিহিতা। হয়তো তিনি প্রিন্সিপাল। ১৯১৮ থেকে শুরু করে ১৯৩২ পর্যন্ত সব কটা ফ্রেমে ওঁর ছবি আছে। চোদ্দ বছরে আলাদা কোনো ছবি নয়। হয়তো একবারই ছবিটা তুলে রাখা হয়েছিল। প্রত্যেকবার ফটোগ্রাফার ওঁর ছবির কপি ফ্রেমের মাঝে সেঁটে দিয়েছে। ১৯২৮ সালের ব্যাচটার সামনে ফাইনহাল্‌স্‌ একটু দাঁড়ায়। এই ফ্রেমের মধ্যে একটা মেয়ের মুখশ্রী তাকে ভীষণ টানে। মারিয়া কার্টক। মেয়েটার লম্বা চুল। কপালের সামনের দিকে চুলের গুচ্ছ ভ্রু অবধি নেমে এসেছে। সুন্দর মুখে একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস। ফাইনহাল্‌স্‌ নিজের মনে একটু হেসে ওঠে। সে প্রায় তিনতলা অবধি উঠে এসেছে। ১৯৩২ সাল। সে নিজেও ১৯৩২ সালে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিল। সে ছবির মেয়েগুলো, যাদের বয়স তখন উনিশ ছিল, তাদের দেখতে থাকে। তার নিজের বয়স এখন বত্রিশ। মেয়েগুলোরও তাই এখন। ১৯৩২ সালের ছবিতে একটা মেয়ে আছে, যার খুব ঘন চুল। চুলের গুচ্ছ ভ্রু অবধি না হলেও কপালের সামনে অনেকখানি নেমে এসেছে। নাম ইলোনা কার্টক, বোনের সাথে মুখের খুব মিল। তবে একটু রোগাটে গড়ন আর ততটা আত্মবিশ্বাসী নয়। মাড় দেওয়া সাদা পোশাক খুব মানিয়েছে মেয়েটিকে। গোটা ফ্রেমের মধ্যে একমাত্র সে এতটুকুও হাসছে না। ফাইনহাল্‌স্‌ ছবিটার সামনে দু সেকেন্ড দাঁড়ায়, একটু হাসে। তারপর আবার সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। তার খুব ঘাম হচ্ছে, কিন্তু দু হাত ভর্তি জিনিসপত্র আছে বলে সে মাথার টুপিটা খুলতে পারছে না। সিঁড়ির শেষের চাতালে মা মেরির মূর্তি। প্লাস্টারে তৈরি। সামনে ফুলদানিতে রাখা টাটকা ফুল। সকালে টিউলিপ রাখা ছিল। এখন হলদে আর লাল আধফুটন্ত গোলাপের কুঁড়ি রাখা আছে। ফাইনহাল্‌স্‌ একটু থেমে নিচের সিঁড়ির দিকে তাকাল। দেওয়ালে মেয়েদের ছবিগুলো কিছুটা একঘেয়ে লাগছে দেখতে। মনে হচ্ছে অজস্র প্রজাপতি যেভাবে সংগ্রহশালায় ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা হয়, সেভাবে রাখা, তফাতের মধ্যে শুধু এদের মাথাগুলো কালচে। সবগুলো প্রায় একই রকম প্রজাতির, শুধু মাঝের প্রজাপতিটা মাঝে মাঝে বদলেছে। ১৯৩২, ১৯৪০ আর ১৯৪৪ – তিনবার বদলেছে মাঝের ছবিটা। চারতলার শেষ পর্যায়ের সিঁড়িতে বামদিকের কোণে একদম উপরে ১৯৪৪ সালের ব্যাচ। পালিশ করা কড়কড়ে সাদা ইউনিফর্মে মেয়েরা বিষণ্ণ হাসি হাসছে। ওদের মাঝে এক বয়স্ক মহিলা, তিনিও হাসছেন, তবে তাকেও খুব প্রসন্ন দেখাচ্ছে না। যেতে যেতে ফাইনহাল্‌স্‌ ১৯৪২ সালের ছবিটার দিকে একবার তাকাল। আরেকজন কার্টক আছে এই ব্যাচে। নাম জোর্না। তবে সেরকম আকর্ষণীয় মুখশ্রী নয়। চুলের কায়দা অন্যদের থেকে আলাদা কিছু নয়; গোল, সাদামাঠা চেহারা।

চারতলাটাও গোটা বাড়িটার মতই নিঝুম, চুপচাপ। চারতলায় উঠে হঠাৎ সে রাস্তায় গাড়ির শব্দ পেল। একটা জানালার তাকে হাতের জিনিসপত্র রেখে জানালাটা খুলে রাস্তার দিকে উঁকি দিল সে। অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। গাড়িগুলোর ইঞ্জিন এখনও বন্ধ করা হয়নি। সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে আছেন প্রধান দরজার সামনে। এক ইউনিট সৈন্যদল লাফিয়ে নামল রাস্তায়। অনেকে সৈন্য বিশাল, লাল রঙের মালবাহী ট্রাক থেকে জিনিসপত্র নামাতে শুরু করেছে। রাস্তাটা ভরে গিয়েছে মানুষে।

সার্জেন্ট জোরে জোরে চিৎকার করছেন… ‘এদিকে, ওদিকে… না… সব মালপত্র সামনের করিডরে রাখো। দাঁড়াও… অপেক্ষা করো’…

ধূসর রঙের ইউনিফর্ম পরা মানুষগুলোর একটা এলোমেলো লাইন দরজা দিয়ে ঢুকতে লাগল এই বাড়িতে।

রাস্তার দুপাশের সব বাড়িগুলি থেকে জানালা খুলে যাচ্ছে। সবাই দেখছে। দূরে দাঁড়িয়ে অনেকে জটলা করছে। কিছু মহিলা হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ফাইনহাল্‌স্‌ জানালাটা বন্ধ করে দিল। বাড়িটার ভেতরটা এখনও চুপচাপ। শুধু নিচে একতলার বড় হলঘর থেকে কলরবের শব্দটা এখানে আবছা একটা গুঞ্জনের মত শোনা যাচ্ছে।

সে চারতলার হলের শেষ প্রান্তে গিয়ে একটা বন্ধ দরজা খুলবার জন্য পা দিয়ে লাথি মারল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে একজন মহিলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল… ‘হ্যাঁ, আসুন।’

ফাইনহাল্‌স্‌ কনুই দিয়ে দরজার হাতলটা ঠেলতে গিয়ে ঘেমে লাল হয়ে উঠল। সে প্রথমে লক্ষ্য করেনি যে ঘরটা নানান কিসিমের জিনিসপত্রে ঠাসা। স্টাফড জন্তু জানোয়ার, সেলফগুলোর মধ্যে ভর্তি ম্যাপের লম্বা লম্বা রোল, কাচের ঢাকনাওয়ালা গ্যালভানাইজড ধাতব বাক্সের মধ্যে নানা ধরণের পাথরের নমুনার সংগ্রহ, দেওয়ালে বিবিধ সূচিশিল্পের নকশা এবং শিশু লালনপালনের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্দেশিকাসমেত ছবি।

‘আসতে পারি?’ ফাইনহাল্‌স্‌ বলে উঠল।

হ্যাঁ… উত্তর করল মহিলা। ফাইনহাল্‌স্‌ জানালার কাছে চলে গেল। আলমারি আর সেলফের ফাঁক দিয়ে সরু একফালি পথ আছে জানালা অবধি যাওয়ার জন্য। মহিলা একটা ছোট টেবিলে বসে আছে। নিচের ছবিটার তুলনায় মুখটা অনেকখানি ভারি, গোল। মুখের কৌণিক রেখা নরম হয়ে গেছে, লাবণ্য বেড়েছে। ফাইনহাল্‌স্‌ ‘আসতে পারি’ বলাতে সে অস্বস্তি বোধ করছে, আবার খুশি হয়েছে যে সেটাও বোঝা যাচ্ছে। ‘হ্যাঁ’ উচ্চারণ করবার সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল মহিলা।

ফাইনহাল্‌স্‌ জানালার তাকে কার্ডবোর্ডের রোল এবং তার বামহাতের প্যাকেট দুটোই রেখে দিল। একপাশে খুলে ফেলে দিল মাথার টুপিটা; জানালার সামনে বাতাসে দাঁড়িয়ে শুকিয়ে নিতে লাগল নিজের ঘাম।

‘ইলোনা, আমাকে একটু সাহায্য করবেন আপনি? সে বলে উঠল… ‘আমাকে একটু টুশে* দিতে পা্রেন?’

মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে তার সামনে যে বইটা ছিল, সেটা সশব্দে বন্ধ করে রাখল।

-‘টুশে!! টুশে কী বস্তু? সে আমি জানি না। আমার মনে হয় জার্মান ভাষা আপনার অন্যতম বিষয় ছিল।’… মহিলা হেসে ওঠে।

-‘টুশে অর্থ *ভারতীয় কালি। সাধারণ কালি কিম্বা রঙের মত। আপনি কি জানেন ক্যালিগ্রাফির কলম কী বস্তু?’

-‘আমি এবার কিছুটা ধারণা পেলাম।’ মহিলা মুচকি হাসে… ‘হ্যাঁ, ক্যালিগ্রাফির কলম… জানি আমি।’

-‘আমায় একটা ধার দিতে পারেন?’

-‘মনে হয় পারবো।’ মহিলা ফাইনহাল্‌সের পিছনে একটা আলমারির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করল। কিন্তু টেবিলের ঘেরাটোপ ছেড়ে বেরিয়ে এল না।

তিন দিন আগে ফাইনহাল্‌স্‌ এই ঘরে ইলোনাকে আবিষ্কার করেছে। রোজ বেশ কয়েক ঘণ্টা করে কথা বলছে। কিন্তু একবারও সে তার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়নি। ফাইনহাল্‌স্‌ বুঝতে পারছে যে তার মনের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করছে কোথাও। ইলোনা খুব ধর্মপরায়ণা, বুদ্ধিমতী। চেহারায়, মনে এক অদ্ভুত পবিত্র ভাব। কখনই ফাইনহাল্‌সের খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় না সে, যাতে অতর্কিতে আলিঙ্গন বা চুম্বন না ঘটে। তারা প্রচুর কথা বলেছে এই ক’দিনে। ধর্মবিষয়ক আলোচনাও হয়েছে। ফাইনহাল্‌সের খারাপ লাগত না যদি চুম্বন করতে পারতো ইলোনাকে। কিন্তু সে কখনই খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় না।

ফাইনহাল্‌স্‌ কাঁধ ঝাঁকায়। মুখটা ব্যাজার করে একটু।

‘একটা কথা’… সে গম্ভীর ভাবে বলে ওঠে… ‘একটাই কথা ছিল। আপনি উত্তর দিলে আমি আর এই ঘরে এসে আপনাকে বিরক্ত করব না।‘

ইলোনার মুখটাও গম্ভীর হয়ে ওঠে। চোখের পাতা নামায় সে। ঠোঁট চেপে মুখ বন্ধ করে। একটু পরে মুখ তুলে বলে…

‘আমি জানি না‘… সে নরমভাবে বলে…’আমি বললে, আমি সম্মতি দিলে কী উপকার হবে? কোনো লাভ আছে কি?’

-‘না।’

ইলোনা মাথা নাড়ে।



(চলবে)

0 comments: