গল্প - শেলী ভট্টাচার্য
Posted in গল্পআমি কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি যে, এইভাবে নিজের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা পাপের ঘড়াটা এক ধাক্কায় উলটে যেতে পারে। আর তার থেকে পোকার মতো কিলবিল করে বের হয়ে আসতে পারে আমার কুপ্রবৃত্তিগুলো। ঘটনাটা ঘটেছিল তখন, যখন জনমানবহীন গৃহ, সেক্সকে সোচ্চার করে সাজিয়ে রাখা গার্গী আর আমার প্রতিশোধস্পৃহার ত্র্যয়স্পর্শ ঘটেছিল। তার আগেতো বেশ চলছিল জীবন। সংসার, চাকরি, সম্পর্ক, সমাজ ... সবকিছুর সঙ্গে দিব্যি সমান্তরালে হাঁটছিলাম আমি। ঘরে অমৃতা, আর বাইরে গার্গী আমাকে নিপাট সাদামাটা গৃহপালিত পুরুষ বলেই মনে করত। সাত চড়ে রা করেনা টাইপ ঠিক না হলেও, কাউকে চড় মারার ক্ষমতা বা ক্ষিপ্ততা যে আমার নেই, তা মনে মনে বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গে বিশ্বাসও করত ওরা। তাই হয়তো শেষ মুহূর্তে নিজের কাজগুলোর স্বীকারোক্তি করে আমার কাছে একটু হাল্কা হতে চেয়েছিল গার্গী।
অন্যদিকে, আমি ওর দুঃখের ক্ষততে প্রলেপ লাগানোর বদলে নিজের এতদিনের আফসোসগুলোকে জড়ো করে ফেলেছিলাম। ফলতঃ রিপুর ধাক্কাধাক্কিতে নিরুপদ্রব নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ঘরের অবাধ্য হাতছানি আমায় পাগল করে তুলেছিল। একবারের জন্যও মাথায় আসেনি অমৃতার কথা, বাবাইয়ের কথা, সমাজ সংসারের কথা, লোকলজ্জার মতো অদৃশ্য কিন্তু পুরু কাচের আয়নার মতো সম্মানের কথা। সবকিছুকে এক নিমেষে পিষে দিয়ে আমি রবীনের উপর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। ব্যাটা ভাবেটা কি আমায়? কাপুরুষ? নাকি মনে করে, নারীর উপর ও একাই হিংস্র হতে পারে! কথায় কথায় আমার কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্রীভাবে দাঁত বের করে হাসত ও। আর হদ্দ বোকার মতো নিজের রূপটাকে প্রকাশ করে ঠুনকো হাতে কলার তুলত। গার্গীর নিসঙ্গতাকে নাকি ও একাই উপভোগ করার ক্ষমতা রাখে। বুঝত না, আনন্দ উপভোগ শুধু শরীরে নয়, মনের দ্বারাও করা সম্ভব। এই যে এতোদিন আমি আমার মৃত বন্ধুর স্ত্রীয়ের সঙ্গে মনে মনে পরকীয়া করে গেছি। আর সূক্ষ্মস্তরে মনের গভীরে সুখ পেয়েছি। তা কি কম আনন্দের? আমার এই প্রমাণহীন পরকীয়ার আনন্দটা কিন্তু রবীনের মতো খোলামেলা বাতাসে না হলেও, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের গভীরে দিব্যি টের পাচ্ছিলাম আমি।
হঠাৎই আমার সব অভিনয় যেন ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল। একটা অপরাধকে আড়াল করতে গিয়ে আরেকটা অপরাধকে চোখের সামনে হতে দিতে হল। এক ধাক্কায় রবীনের চেয়েও নিচে নেমে আসতে হল আমাকে।
রবীন
পরেশ মারা গেছে আজ প্রায় ছয় বছরের উপর হবে। পরেশ একটা বেসরকারি অফিসে কাজ করত। টাকাপয়সার যে খুব টানাটানি ছিল তা নয়। তবু সারাজীবন পা ছড়িয়ে বসে খাওয়ার মতোও ছিল না। তাই পরেশের মৃত্যুর পর খরচে রাশ টেনেছিল ওর স্ত্রী গার্গী। ছেলেটাকে বড় করার তাড়া ওকে তাড়না দিচ্ছিল। সে বিষয়ে আমার সঙ্গে ভরসা যোগ্য আলোচনা করেছিল। তাই আমিও কম ভাড়ায় ওর জন্য একটা বাড়ি খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। অবশেষে পেয়েও গিয়েছিলাম। বাড়িটা ছিল আমার পাড়াতুতো বন্ধু রবীনের। রবীন পোস্ট অফিসে চাকরি করে। আমার বেসরকারি চাকরি। তাই রবীনের চাকরি সূত্রে ফ্রি সময় হিসেব করেই ওকে বলেছিলাম, মাঝেমধ্যে গার্গীর খোঁজখবর নিতে। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে ও অনৈতিকভাবে রাতের অন্ধকারে যখনতখন পরেশ হয়ে উঠবে, সেটা সেসময় তলিয়ে ভাবিনি।
গার্গীর বয়স ত্রিশের ঘরের মধ্যদিক পেরিয়ে গেলেও, মেদহীন ছিমছাম চেহারা। মাথার একঢাল চুল সৌন্দর্যের নিরিখে একটু বাড়তি আকর্ষণ জোগাতো। অল্পবয়সী প্রমাণ করার তাগিদে, নিজেকে কর্মঠ দেখাতে চাইত গার্গী। রঙিন ডানা ঝাপটে এদিকওদিক টুকটাক কাজ করতে বের হ'ত। রবীনের ভাষায়, গার্গীকে এসব কাজের যোগাযোগ ওই নাকি করে দিত। তারপর দাঁত বের করে আমার কাছে এসে শোনাত, গার্গী কৃতজ্ঞ ও বুঝদার মেয়ে। তাই কৃতজ্ঞতার পাওনাটুকু ও নাকি সুযোগ পেলে যেচেই মিটিয়ে দেয়।
এসব শোনার পর ইগো নামক শব্দটা আমার উপর মারাত্মকভাবে সোচ্চার হ'ত। ভাবতাম, গার্গীতো কখনও ওর নিসঙ্গতার জন্য আমার উপর ভরসা করেনি। তবে কি আমি সত্যি ম্যারমেরে? বেসরকারি কাজের চাপ আর বিপুল সংসার তরী সামলে চলতে গিয়ে ক্লান্ত?
সেদিক থেকে বিচার করলে রবীনের জীবন একেবারে ঝরঝরে। স্ত্রী আর একমাত্র কন্যাকে নিয়ে ওর ছিমছাম নিউক্লিয়ার পরিবার। তার উপর বৌ প্রায়শই ছুটিছাটাতে নিজের মা বাবার দেখভাল করতে কালনা চলে যায়। তাতে রবীনের নিঝঞ্ঝাট জীবনের অলস সময় ওর বুদ্ধিতে কাম রিপুর ঘরকুটো জোগায়।
রবীনের দাঁতাল হাসির কদর্যতার আড়ালে গচ্ছিত আমার পৌরুষের প্রতি ওর ধিক্কারটাকে আমি কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিলাম না। আমিও তো মনে মনে গার্গীর নিসঙ্গতার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলাম। প্রথমদিকে রবীনের মতো করে না ভাবলেও, ওর ক্রমাগত সঙ্গদোষে একটা শার্দূল মৌরসীপাট্টা হচ্ছিল আমার ভেতরে। সামনে গিয়ে হয়তো লোকলজ্জার ভয়ে শামুকের মতো গুটিয়ে যেতাম।
বেশ বুঝতে পারছিলাম, এসব দ্বন্দ্বের জালে পেঁচিয়ে গিয়েই ঘটনাটা হুড়মুড়িয়ে ঘটে গিয়েছিল। রবীন আর গার্গীর ব্যঙ্গচিত্রগুলোকে খানখান করে দিতেই আমি নির্মোক ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ভাবনাটা ভেতরে পাক খেতেই একজনের নিষ্পাপ মুখ আমার অপরাধী চোখের আয়নায় ভেসে উঠল ... অমৃতার।
অমৃতা
আজ থেকে প্রায় এগারো বছর আগের এক সন্ধ্যায় অমৃতা আমার জীবনসঙ্গী হয়েছিল। বিয়ের পর থেকে নিপাট ভক্তিশ্রদ্ধার সঙ্গে শুধু আমার নয়, আমার সম্পূর্ণ সংসারের দেখভাল করে যাচ্ছে ও। দিনের সাংসারিক কাজে বা রাতে আমায় ভালোবাসায় তৃপ্ত করতে কখনও ওকে ক্লান্ত হতে দেখিনি। ওর ভোলেভালা মন একচেটিয়া বিশ্বাস করত আমায়। তাই হয়তো বাকি গৃহবধূদের মতো আমার গতিবিধির উপর ঘড়ির কাটা মেপে তেমন নজরদারি করত না ও। আমিও তো ওর প্রতি এতোদিন একনিষ্ঠই ছিলাম। এই ক'মাস ধরে আমার মধ্যে একটা দ্বিচারিতার উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল।
রবীনের শ্বাপদসংকুল নজরটা অমৃতার মতো সরল মনের মেয়ের চোখেও পড়েছিল। একদিন নিভৃতে বলছিল আমায় 'রবীনদার গার্গীদির প্রতি কথাবার্তাগুলো কেমন যেন! গায়ে গুলিয়ে ওঠে আমার।'
যদিও রবীনের এই স্বভাবদোষ আজ নতুন নয়। আগে অমৃতার প্রতিও ওর নজরের খুঁটিনাটি খেয়াল করেছিলাম আমি। তবে স্পর্ধাটার উপর একটা লাগাম ছিল তখন। গার্গীর নিসঙ্গ উপস্থিতিটা যেন অনুঘটকের মতো কাজ করেছিল।
রবীনের কথা না ভেবে এখন বরং নিজের কথাই ভাবা উচিত আমার। অমৃতাকে আমি এই ক'মাস ধরে টানা ঠকিয়েছি। যখনই অমৃতা আমার সঙ্গে নৈতিক সম্পর্কের সূত্রে কাছে এসেছে, আমি অনৈতিকভাবে গার্গী ভেবে ওর উপর হিংস্র রূপে চড়াও হয়েছি। নিজের ক্ষয়িষ্ণু পৌরুষত্বের পরীক্ষা নেওয়ার খেলায় গিনিপিগ করেছি ওকে। ধিক আমায়। আমি রবীনের চেয়েও কুৎসিত কাজ করেছি।
গার্গী
শুরুর দিকে সত্যি স্নেহশীল ছিলাম আমি মেয়েটির প্রতি। ওকে ঘিরে শোকাচ্ছন্ন ঘরোয়া একটা মলিনতা ছিল তখন। তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে সাজগোছ করে বাইরে পা রাখল ও। রবীন সেসময় থেকেই গার্গীর প্রতি ওর মনোভাবগুলোকে আমার সামনে বসে বিস্তারে ব্যাখ্যা করত। আমিও কেমন যেন দিন কে দিন গিরগিটি হয়ে উঠতে লাগলাম। অবচেতনেই আমার অপরাধ প্রবণতার ঝোঁক সুযোগে আর প্রশ্রয়ে বাড়তে লাগল।
গার্গী রবীনের প্রবৃত্তিগুলোকে টের পেলেও, আমার পরিবর্তনগুলোকে বুঝে উঠতে পারত না। তাই আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই ও স্নেহসম্বোধন করত। রবীনের সামনে হয়ে উঠত বাধ্য বেশ্যা।
সেদিন রবীনেরই যাওয়ার কথা ছিল ওর ঘরে। গার্গীর নামে সুপারিশ করে একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করেছিল ও। গার্গী তাই একটু অন্যরকম পোষাকে নিজেকে সাজিয়ে রেখেছিল। ওর ছেলেটা বড় হচ্ছিল কলকাতার হোস্টেলে। স্বামীর মৃত্যুর পরে গার্গী ছেলেকে তার বাবার অভাব বুঝতে দিতে চাইত না। তাই আর্থিক দায়ভার সামাল দিতে নিজেকেই একটু একটু করে বদলে নিচ্ছিল।
তখন সন্ধ্যার আকাশ রাতের ঘরে পাকাপাকিভাবে পা ফেলেছে। অন্ধকারের কুটিল ইঙ্গিতে আমি বুঝিনি গার্গীর ঘরে কোন নিয়তি আমার জন্য ওৎ পেতে বসে রয়েছে।
'শ্বশুরের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। খবরটা হঠাৎই এল। আর বাড়ি ফিরছি না। চাবিটা গার্গীর হাতে দিয়ে ওকে জানাস সব। ও তালা খুলে বারান্দার গাছগুলোতে জল দিতে পারবে।' এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই চলে গিয়েছিল রবীন। আমি সংবাদবাহক হয়ে পৌঁছেছিলাম গার্গীর ঘরে।
দরজায় কড়া নাড়াতেই গার্গী ভেবেছিল, রবীন এসেছে। এদিকে আষাড়ের ঝড়বৃষ্টির প্রকোপে হঠাৎই বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটেছিল। আমার গলার আওয়াজ কেমন যেন সেই মুহূর্তে বদলে গিয়েছিল। গার্গীর সাজগোছের ঝলকানি অন্ধকারেও ঝিলিক দিচ্ছিল আমার চোখে। চাক্ষুষ করলাম, সত্যিই রবীন আসার আগে গার্গী নিজেকে প্রস্তুত করে রাখে। উপকারী তো আমিও। তবে আমার প্রতি একই ভাষায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন ও? নাকি রবীনের মতো গার্গীও আমাকে কাপুরুষ বলে অবজ্ঞা করে?
নিজের উপর নিজের নাকি গার্গীর প্রতি নাকি আদৌ রবীনের ব্যঙ্গের প্রতি ফোঁস করে ওঠার রোশে উগ্র হয়ে উঠেছিলাম আমি ... সেটা আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। গার্গী আচমকা আমায় দেখে পিছনে সরে যাচ্ছিল। দ্বন্দ্বে ধীরে বলছিল 'বিনয়দা আপনি? এসময়? রবীনদার তো আমার চাকরির খবর নিয়ে আসার কথা ছিল আজ।'
আমাকে নিরুত্তর দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা নিচু করেছিল ও। অপরাধবোধে স্বগতোক্তি করছিল 'আমি একলা মেয়ে মানুষ। অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেককিছুই করতে বাধ্য হই।'
ওর কথাগুলো কানে তোলার মতো বিনয় তখন আমার নামে বা স্বভাবে বিন্দুমাত্রও ছিল না। আমি ক্রমশ রবীনের চোখে নিজেকে পাকাপোক্ত প্রমাণ করার তাগিদে অবচেতনে রবীনের প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলাম। গার্গী বুঝে ওঠার আগেই শিকারী বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম ওর উপর। মুখ আর মুখোশ মুহূর্তে একাকার হয়ে গিয়েছিল আমার। অমৃতার সঙ্গে মিলনের সময়ে গার্গীকে চিন্তা করলেও, গার্গীর সঙ্গে নগ্ন ধ্বস্তাধস্তি করার মুহূর্তে আমি কিন্তু একবারও অমৃতার কথা চিন্তা করলাম না।
বরং চোখের সামনে বারবার রবীনের দাঁতাল হাসিটা ভেসে উঠছিল। গার্গী প্রতিরোধহীন মিনতি করছিল আমার কাছে 'প্রকাশের দায়িত্ব নিন বিনয় দা। আমি শান্তিতে মরতে চাই।'
কথাটা শুনে মুহূর্তে ছিটকে এসেছিলাম আমি। বুঝতে পেরেছিলাম, গার্গীর মনে আমার প্রতি একটা বিশ্বাস ছিল। যেটা রবীনের প্রতি ছিল না। তাই সেই পরিস্থিতিতেও এই অনুরোধটুকু ও আমাকে করতে পারছিল। আর আমি কিনা এতদিন ধরে মনে মনে গার্গীর যোগ্য পুরুষ করে তুলছিলাম নিজেকে?
পরিস্থিতি
আমি জানতাম আমি পাকা অপরাধী নই। ভীতু অপরাধী। অপরাধকে সোচ্চার করে বলা বা সুনিপুণ হাতে তাকে ঢাকার ক্ষমতা আমার নেই। আজ নিজেকে শেষ করে না দিলে একদিন আমিই অজান্তে নিজের কুকর্মের প্রমাণ তুলে ধরব সমাজের বুকে।
তাই রান্নাঘরের দিকে ছুটে গিয়ে অন্ধকারে হাতড়াতে লাগলাম ছুরি জাতীয় কিছুকে। পাপের চেয়ে পাপীকে শেষ করার তাগিদে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলাম তখন আমি। ঠিক সেই সময়েই ঘরের আলো জ্বলে উঠল। সেই আলোতে নিজের নগ্নতাকে দেখে শিউরে উঠছিলাম আমি। কী বিশ্রী, কী অসহনীয় এই আদিম রূপ। পেছনে চেয়ে দেখি গার্গী আলগোছে ওর আধখোলা কাপড়চোপড় সামলে নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করছে। দুজনেই যেন দুজনের অন্ধকার রূপকে লুকিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম সেই মুহূর্তে। গার্গীর চোখে এতক্ষণ অন্ধকারেও আমার প্রতি যে বিশ্বাসটা বেঁচেছিল, এখন আলোতে যেন তার শেষটুকুরও পরিসমাপ্তি ঘটল। আমি সহন করতে পারছিলাম না নিজের এই অবনতিকে। চোখ পড়ল সামনে রাখা ছুরিটার উপর। নিজের প্রতি চরম বিদ্বেষে ছুরিটাকে মুষ্ঠিবদ্ধ করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। ঠিক তখনই দৌড়ে এল গার্গী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শক্ত হাতে নিজের পেটে ছুরিটাকে বসিয়ে দিল ও।
চোখের সামনে ছটফট করে মরতে দেখলাম নয় বছরের বাচ্চার অসহায় মাকে।
নয় বছর পর
প্রকাশ এই বছর উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেছে। ইইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় ভালো র্যাঙ্ক করেছে। আজ জেলার বাইরে ভালো জায়গায় পড়তে যাবে ও। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আমার অপরাধী পা'দুটোকে ভক্তিভরে প্রণাম করল ও। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে ওকে আশীর্বাদ করলাম। আজ নয় বছর হল আমার নার্ভের সমস্যা হয়েছে। ভুল ভাবি, অস্বচ্ছ দেখি মাঝেমধ্যে।
প্রকাশের দিকে চেয়ে দেখলাম, গার্গীকে যেদিন রবীনের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম, সেদিনের মতো আমার প্রতি আস্থা ওর দু'চোখে।
সেদিনের পর রবীনের বাড়িতে আর কখনওই যাইনি আমি। ওই বাড়িতে ঘটনাটা ঘটেছিল বলে, থানা পুলিশ সব রবীনকেই সামলাতে হয়েছিল। সেই সূত্রে আমারও কয়েকবার ডাক পড়েছিল থানায়। কিন্তু নিয়তি বরাবরই একটু বেশি সদয় ছিল আমার প্রতি। তাই আমার অপরাধ কোনোভাবেই আমার অপাপবিদ্ধ সংসারের গায়ে কাদা ছিটাতে পারেনি। সেদিন কেউ আমাকে রবীনের বাড়িতে ঢুকতে বা সেখান থেকে বের হতেও দেখেনি। আমিও রবীনকে বেমালুম মিথ্যে বলেছিলাম, বৃষ্টির কারণে আর সেদিন ওপথে যাওয়া হয়ে ওঠেনি আমার। বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। এছাড়াও সেদিনের প্রাকৃতিক বারিরাশি ধৌত করে দিয়েছিল আমার গায়ে লেগে থাকা অল্পবিস্তর পাপের প্রমাণগুলোকে। গার্গীর পোস্টমর্টেম রিপোর্টে পরিষ্কার সত্যটা লেখা ছিল .... আত্মহনন। তবে সেদিন ছুরিটাকে ফেরার পথে বটতলার মন্দিরের পাশের পুকুরটাতে সাবধানী হাতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম আমি।
আজ সেই পুকুরের পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলাম। ট্রেন ধরার তাড়া ছিল। প্রকাশকে দেখলাম, পুকুরটার দিকে চেয়ে কী একটা যেন দেখছিল।
আমি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে জলের ঢেউয়ের দিকে চেয়ে মুহূর্তে কেঁপে উঠলাম। মনে হল রোদ পরে কী যেন একটা চকচকে শানিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে। সেটাকে পাশ কাটিয়ে আমি দ্রুত পা চালালাম।
প্রকাশকে ট্রেনে তুলে দিয়ে হাত নেড়ে বললাম "যখন যা লাগবে নিসঙ্কোচে জানাবি আমায়।"
ফেরার পথে পুকুরটার পারে কিছুক্ষণ বসলাম আমি। বিশেষভাবে আর কিছুই চোখে পড়ল না। শুধু মনে হল, আমি অবিরাম ডুবছি আর ভাসছি সেই জলের মধ্যে। স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড়িয়ে বললাম 'গার্গীর প্রতি আমার নীরব প্রতিশ্রুতিটা যেন পালন করতে পারি ... আজীবন।'
0 comments: