ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক১৯
স্মৃতির শহর – ৫
সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন, তাঁকে যদি কখনও নির্বাসিত হতে হয়, যেকটি জিনিস তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতে চান, তার মধ্যে একটি হবে মোৎজার্টের একটি কম্পোজিশন। সম্ভবত ম্যাজিক ফ্লুট। বিশ্ববন্দিত সেই অপেরা। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি ওঁর অসীম ভালোবাসার কথা আমাদের সকলেরই জানা। মণি-মানিক্য সম তাঁর চলচ্চিত্রগুলিতে ছড়িয়ে আছে এর প্রয়োগের অজস্র নিদর্শন, যার মধ্যে মোৎজার্টের উপস্থিতি ধরা পড়ে বারবার। আল্পসের পাদদেশে ছবির মতো সুন্দর শহর, সালৎস্বুর্গে ১৭৫৬-র ২৭ জানুয়ারি জন্ম হ্বোলফ্গাং আমাদিউস মোৎজার্টের। কলকাতা যে অর্থে রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান, সালৎস্বুর্গ তার চেয়ে অনেক বেশি মোৎজার্টের। এই একান্ত ব্যক্তিগত উপলব্ধি হয় বছর দশেক আগে, বন্ধু হানসের সঙ্গে ঐ স্মৃতির শহরে এক সপ্তাহান্ত কাটানোর সূত্রে।
সে বছর দশেক আগেকার কথা। কেমব্রিজে এক কনফারেন্স শেষে কিছুটা সময় চুরি করে নিয়ে পৌঁছে গেলাম হানসের কাছে। বন্দোবস্ত করাই ছিল। সেইমতো আমরা এক শুক্রবার সকালে হাইডেলবার্গ থেকে চেপে বসলাম স্টুটগার্ট অভিমুখী ট্রেনে। অনেকদিন পর সেবার আবার স্টুটগার্ট যাওয়া – যদিও থাকা হবে না কারণ অল্পক্ষণের মধ্যেই ওখান থেকে সালৎস্বুর্গের ট্রেন। গন্তব্যে পৌঁছলাম যখন, আকাশের মুখ তখন ভার, বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে। তারই মধ্যে আমরা হাঁটাপথেই পৌঁছলাম হোটেলে।
এ এক সত্যি আশ্চর্য শহর! নুনের ব্যবসার জন্য একদা বিখ্যাত এই জনপদের ৯ নম্বর গেট্রাইডেগাসে-তে জন্ম হয়েছিল তাঁর। বাকিটা ইতিহাস। মাত্র ৩৫ বছরের আয়ুষ্কালে করলেন এমন কিছু কাজ, সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ তাঁকে মনে রাখবে সভ্যতার অন্তিম ক্ষণ পর্যন্ত। ২০০৬ সালে মোৎজার্টের জন্মের আড়াইশো বছর উদযাপন উপলক্ষে সালৎস্বুর্গ যখন উত্তাল, ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীতে আমার মতো অনেকেরই কান তৈরি করেছেন যিনি, সেই কিশোর চট্টোপাধ্যায়, কিশোরদা আমি আবার ইউরোপ যাচ্ছি শুনে বলেছিলেন, ‘পারলে সালৎস্বুর্গটা ঘুরে এসো।’ সে বছর হয়নি। হল আরও বছর পাঁচেক পর।
সেই অপরাহ্নে হানস্ আর আমি যখন সব পথশ্রম সরিয়ে রেখে শহরের আনাচ-কানাচ একটু সরেজমিনে দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম, তখনও জানা ছিল না পরবর্তী দুদিনে ঠিক কীধরনের অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই যে এক ক্ষণজন্মা স্রষ্টার জগতে সেই ভালোলাগার সিংহভাগ দখল করে নিল এক অপূর্ব রন্ধন-সংস্কৃতি। সেদিকে একটু তাকানো যাক।
ভিনার শ্নিৎজেল-এর কথা ইতিপূর্বেই লিখেছি। অস্ট্রিয় হেঁশেলের এই রত্নটির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বারবারা, বার্লিনে, অনেক আগেই। এই বস্তুটির প্রতি তীব্র আকর্ষণ তখন থেকেই। ভালো লাগা নিঃশব্দে কবেই ভালবাসায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে! তাই প্রথমদিন সন্ধ্যায় হানস্ আর আমি যখন আমাদের হোটেলের কাছেই একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাওয়া সারতে গেলাম, শ্নিৎজেল ছাড়া আর কিছু খাওয়ার কথা ভাবতেই পারিনি। এইখানে চুপিসারে একটা বিশয় মনে করিয়ে দেওয়া ভালো। ভিনার শ্নিৎজেল- কে তখনই ভিনার শ্নিৎজেল বলা যাবে, যখন তা ভিল অর্থাৎ বাছুরের মাংস থেকে হবে। শুয়োরের মাংস থেকে হলে তাকে আর টেকনিক্যালি ভিনার শ্নিৎজেল বলা চলে না। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টির সঙ্গে কনকনে হাওয়াকে সামাল দিতে আমাদের টেবিলে প্রথম এল অস্ট্রিয়ান লাল ওয়াইন আর পার্বত্য চিজ। আল্পসের গা-ঘেঁষা দেশগুলিতে এই চিজের সমাহার সত্যিই বিস্ময়কর! আরও বিস্ময়কর এই যে প্রতিটি দেশে আলাদা আলাদা ঘরাণা। স্বাদ এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রত্যেকেই অনন্য। কিন্তু চিজ এমন এক সংবেদনশীল বিষয়, তাকে নিয়ে আলোচনা আলাদা পরিসরেই হওয়া উচিত। সেদিনের পরবর্তী অধ্যায় প্রসঙ্গে একটাই কথা উল্লেখ্য। তা হচ্ছে সেদিনের শ্নিৎজেলটি ছিল শুয়োরের মাংসের। যথেষ্ট উপাদেয় হওয়া সত্ত্বেও তাকে সেরা উপাধি দেওয়া যাবে না কিছুতেই। আরেক সেরার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল পরদিন প্রাতরাশের সময়। তিনি ‘আপফেলস্ট্রুডেল’। নাম থেকেই মোটামুটি মালুম হচ্ছে বিষম এই খাদ্যটি আপেল পরিবারভুক্ত। যা একেবারে বোঝা সম্ভব নয়,তা হল এর অন্তরালে লুকিয়ে থাকা মুনশিয়ানা। ফিলো পেস্ট্রি শিটের মোড়কে বিশেষভাবে তৈরি আপেলের পুরকে ভরে দেওয়া হয় আর লম্বাটে সেই বস্তুটিকে দেওয়া হয় ঘোড়ার খুরের আকৃতি। অতঃপর ওপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় মিহি চিনির গুঁড়ো। এবার নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বেকিং-এর পালা। মুচমুচে হয়ে তিনি যখন আভেন থেকে আত্মপ্রকাশ করেন, তাঁর সেই সোনালি শোভার প্রেমে না পড়ে উপায় কী? এ তো গেল বাহ্যিক ব্যাপার! আসল খেলা ফিলো পেস্ট্রি শিট তৈরি করার মধ্যে। রুমালি রুটির চেয়েও অনেক ফিনফিনে ময়দার (শুধু ময়দা অবশ্যই নয়, আছে আরও অনেক উপকরণ) এই চাদরের এপাশ-ওপাশ দেখা যায়, কাচের জানালার মতো। তাই যখন আপেলের পুরকে ঢেকে দেওয়া হয় এই চাদর দিয়ে, বাইরে থেকে দিব্যি দেখা যায় অন্দরমহলকে। বেকিং-এর পর তাই এমন বস্তুকে কাটার জন্য ইলেকট্রিক ছুরি লাগবে, তা কি খুব আশ্চর্যের?
আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকা থেকে অস্ট্রিয় রান্নাঘরের যে পদটিকে তুলে আনতে চাই, তার আস্বাদন করতে হয় সাধারণত কফির সঙ্গে, কিন্তু শেষপাতে তাকে হাজির করানো হলে কেউই খুব আপত্তি করবে বলে মনে হয় না। ‘সাখারটর্টে’। কিংবদন্তিসম খ্যাতি আছে এই চকোলেট কেকের। এমন একটি জিনিসের দেখা পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে তিন বছর আগে পর্যন্ত। কষ্ট না করলে কেষ্ট না মেলার কথা জানা ছিল অবশ্য আর এই বিশেষ সুনামসম্পন্ন কেকটির অপরূপ কৃষ্ণবর্ণের বর্ণনা করা মুশকিল। তার চেয়ে মনমাতানো কফির সঙ্গে অসামান্য এই কেকটি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার চেয়ে ভালো কিছুই হতে পারে না। ভিয়েনা শহরের এক পড়ন্ত বিকেলে হাজির হয়েছিলাম এমন এক রাস্তার মোড়ে, যেখানে অনেকগুলি পথ এসে মিশেছে। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি ক্যাফে। সামনে দাঁড়িয়ে সুসজ্জিত, সুভদ্র চেহারার একজন মানুষ। রোদ চশমার আড়াল থেকেও যেন তাঁর পুরো মুখখানি দেখতে পেলাম। তিনি আমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।
এ এক রূপকথা। ১৮৩২ সন। প্রিন্স ক্লেমেন্স হ্বেন্সেল ভন মেটারনিশ তাঁর পাচকদের বিশেষ অভ্যাগতদের জন্য একটি ডেসার্ট তৈরির আদেশ দিলেন। ভাগ্যের আশ্চর্য পরিহাসে অনুষ্ঠানের আগের দিন প্রধান রাঁধুনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন আর সেই পদটি তৈরির দায়িত্ব বর্তাল বারো বছর বয়সী ফ্রানৎস্ সাখার-এর ওপর। চকোলেট আর ক্রিমের যুগলবন্দীতে সেই বালক সৃষ্টি করল এমন এক ডেসার্ট, আজ প্রায় দুশো বছর পরও আকাশছোঁয়া যার জনপ্রিয়তা। একে অস্ট্রিয়ান জাতীয় খাবার আখ্যা দিলেও কোনও অত্যুক্তি হবে না। বহুদিন পর্যন্ত ‘হোটেল সাখার’ এই কেকটির একমাত্র সত্ত্বাধিকারী ছিল এবং সারা অস্ট্রিয়ায় চূড়ান্ত গোপনীয়তায় মোড়া এদের রেসিপি থেকে তৈরি একমাত্র ‘সাখারটর্টে’ হিসেবে পাওয়া যেত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর আগে ‘ডেমেল পেস্ট্রি শপ’ ‘এডুয়ার্ড সাখারটর্টে’ নাম দিয়ে এর আরেকটি সংস্করণ বাজারে নিয়ে আসে। এই এডুয়ার্ড ছিলেন ফ্রানৎস্ সাখার-এর পুত্র। স্বভাবতই সৃষ্টি হয় এক দ্বন্দ্বের, যা গড়ায় কোর্ট পর্যন্ত এবং শেষ অবধি তাতে জয়লাভ ঘটে ‘হোটেল সাখার’-এর। এসব নিছক তথ্য। নির্যাসটা হল ‘সাখারটর্টে’ একটি চকোলেট কেক। সারা পৃথিবীতে চকোলেট কেক অনেক থাকলেও ‘সাখারটর্টে’একটিই। রসনার পক্ষপাতিত্বের কি কোনও কারণ হয়? সেদিন সেই ক্যাফেতে কফি আর সাখারটর্টের পর্ব শেষ করে বেরিয়ে আসার সময়ও দেখলাম সেই ভদ্রলোক রোদচশমা খোলেননি আর ঠোঁঠের কোণে আলগোছে লেগে রয়েছে একচিলতে হাসি। গর্বের?
0 comments: