0
undefined undefined undefined

সম্পাদকীয়

Posted in



এক বইমেলা থেকে আরেক। এক বছর বিরতির পর হওয়া কলকাতা বইমেলা শেষ হতে না হতেই ডাক এল ত্রিপুরা থেকে। আবেদন করা হয়েছিল আগেই। ভাবা যায়নি ডাক আসবে অত দেরিতে! তবু কী আর করা! সবরকম পুঁজিকে একজায়গায় করে রওনা হওয়া গেল উত্তর পূর্বাঞ্চলের ওই রাজ্যটির দিকে, যেখানে ঋতবাকের পদার্পণ এই প্রথম। 

২৫ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল এই বারোটা দিন বদলে দিল আমাদের অনেকটাই। বাণিজ্যের মাপকাঠিতে না হলেও ঝুলি ভর্তি করে ফিরলাম আমরা। অসংখ্য মানুষজনের সঙ্গে পরিচিত হলাম। বন্ধু হলেন অনেকে। আমরা তাকিয়ে থাকব প্রতিশ্রুতিময় ভবিষ্যতের দিকে। 

এরই মধ্যে আবার আশঙ্কার মেঘ - করোনার চতুর্থ ঢেউ আছড়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা!

সর্বান্তকরণে কামনা করি, পৃথিবী মারী-মুক্ত হোক! আর নয়, অনেক হয়েছে! 

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন। 
শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in





কোভিড আবহের মধ্যে যেদিন থেকে স্কুলগুলোয় অনলাইন ক্লাস চালু হল আমার মনে হল আমিও দ্বিতীয় বারের জন্যে ছাত্র জীবনে প্রবেশ করলাম। আবাসনের আশপাশের ফ্ল্যাটে রোজ সকালে শুরু হয়ে যায় ক্লাস। একটা স্কুলে ঢুকলে যেমন চারিদিক থেকে নানা শ্রেণিতে পড়ানোর আওয়াজ আসে কানে সেরকম বিভিন্ন ফ্ল্যাট থেকে ক্লাসে টিচারদের পড়ানোর শব্দ ভেসে আসে। কয়েকজনের কম্পিউটারে সাউন্ড বক্সের আওয়াজ বেশি থাকায় আমার এই অবসর ও নিঃসঙ্গ জীবনে কর্ণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমিও প্রবেশ করি ক্লাসরুমে। এক এক দিন একেকটা ক্লাসের পাঠে মনোনিবেশ করি। পৃথিবীটা অ্যাকচুয়াল থাকলেও মানুষের জীবন যাপন ভার্চুয়াল। ফুল পাখিদের মত আর কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম হয় না। সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে এক অদৃশ্য ভাইরাস। আর তার মধ্যেই সব কিছু মেনে নিয়ে সকালের সময়টুকু আনন্দময় করে তুলতে আমার বিভিন্ন ক্লাসে যোগ দেওয়া। মন্দ তো নয়ই, বরং ভালো, অতি ভালো। এ যেন এক অন্য ছাত্রজীবন, অদৃশ্য অথচ সুখশ্রাব্য। শ্রবণেই কল্পনা করে নিই ক্লাসরুমের দৃশ্য। প্রথমে কলরব, তারপরেই শিক্ষক/শিক্ষিকার প্রবেশ, সমস্বরে ‘গুড মর্নিং স্যার/ম্যাডাম’। ইংরেজি-মাধ্যম স্কুল, আদবকায়দাও সেইমত। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতার বাইরে। প্রায় দিনই কোন ছাত্র বা ছাত্রীর জন্মদিন পালন; সমবেত গান ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’, আবহে পিয়ানোর মধুর ধ্বনি। গান শেষে শুভেচ্ছা জানানোর পালা। টিচারের জন্মদিনে বেশ মজা লাগে ছাত্রছাত্রীদের একাধিকবার উইশের বহর দেখে। এরপর শুরু হয়ে যায় ক্লাসের পড়াশোনা। টিচারের আগ্রহের সাথে পড়ানো, ছাত্রছাত্রীদেরও ততোধিক আগ্রহ প্রকাশ পায় প্রশ্নোত্তরে। একেকটি ছাত্র এত সুন্দর টিচারের প্রশ্নের উত্তর দেয় খুব আনন্দ পাই। আমি ছাত্র হয়েই শিখে নিই। মাঝেমধ্যে কোন ক্লাসে গান হয়। প্রথমে পিয়ানো সহযোগে একটা বা দুটো ইংরেজি গান, তারপর বাংলা মূলত রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গান। গান শেখানোও হয়। কয়েকজন ছাত্রছাত্রী সুরেলা গলায় সুন্দর গান গায়। আমিও ওদের সাথে গেয়ে উঠি। সকালগুলো সার্থক হয়। আমাদের মফঃস্বল স্কুলে সমবেত জাতীয় সংগীত ছাড়া গানের ক্লাস হত না, তাই ক্লাসে গানের অভিজ্ঞতা নেই। শোনা কথা, শহরে মিশনারি স্কুলগুলো ছাড়া হয়তো হাতে গোনা দু-একটা বাংলা মাধ্যম স্কুলে হত যেমন শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্রভারতী, রামকৃষ্ণ মিশন এবং সেই ভাবাদর্শে প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোয়। আমার এই ছাত্র জীবনের মেয়াদ শেষ হয়েছে এখন।

* * *

কোভিডের প্রথম ঢেউ দু বছর আগে যে আতঙ্কসমেত সমগ্র পৃথিবীর সাথে ভারতে এবং পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং জনজীবন প্রায় স্তব্ধ করে দিয়েছিল তার থেকে অনেকটা বেরিয়ে আসা গেছে। সতর্কমূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষেধক মানুষের মনে অনেকটা আস্থা জুগিয়েছে। মানুষ আস্তে আস্তে একধরনের নব্য-স্বাভাবিকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে খুব সতর্কতার সাথে। পশ্চিম গোলার্ধের কয়েকটা দেশের সরকার বেপরোয়া হয়ে স্কুল খুলে দিয়ে নির্বোধের মত কাজ করেছে তা তারা বুঝতে পেরেছে যখন কোভিডের থাবা শিশু-কিশোরদের আক্রমণ করে। ভারত সরকার কোভিড নিয়ে মাঝেমাঝে কয়েকটা অবৈজ্ঞানিকোচিত জনমোহিনী কাজকর্ম করলেও মোকাবিলা ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক এবং সংযমের পরিচয় দিয়েছে। সতর্ক পশ্চিমবঙ্গ সরকারও। পশ্চিম দুনিয়ায় স্কুল খোলার খবর আসা থেকেই কিছু মানুষ এ রাজ্যেও স্কুল খোলার জন্যে বিভিন্ন মাধ্যমে চর্চা শুরু করে দিয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল যদি রাজ্যে ভোট হতে পারে, ছেলেমেয়েরা রাস্তায়, মলে, দোকানে যেতে পারে, উৎসবে ভিড় জমাতে পারে তাহলে স্কুলে যেতে বাধা কোথায়। মনে রাখতে হবে কলকাতা শহরের জীবনটাই সমগ্র রাজ্যের চেহারা নয়। আমরা দেখেছি বিধানসভা ভোট এবং শারোদৎসবের পর সংক্রমণের হার বেড়েছে এবং পরে আবার অতি ধীরে তা কমেছে। অন্য কয়েকটা রাজ্যে ধাপে ধাপে স্কুল খুলে যাবার খবর আসাতে এখানেও স্কুল খোলা নিয়ে চর্চা আরও বেড়ে যায়। আবার অন্যদিকে কয়েকজন অভিভাবক চান নি তখনই, বিশেষত সন্তানদের প্রতিষেধক দেওয়ার আগেই স্কুল খুলুক। স্কুলে পড়ুয়াদের অনেকটা সময় একসাথে থাকতে হয়, তারা মেলামেশা করে, বন্ধুদের মধ্যে উচ্ছ্বাস এবং উল্লাসে তারা অসতর্ক হতে পারে। তারওপর অনেক ছাত্রছাত্রী স্কুলবাস, পুলকার বা নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করে না, অনেক দূর থেকে ট্রেনে, বাসে যাতায়াত করে। তাদের নিরাপত্তার কথাও ভাবার। মাসখানেক আগেও এমনই ভাবনা ছিল। এখন সেটা থেকে অনেকটাই মুক্ত। স্কুল খুলেছে, ধাপে ধাপে। এত কথা বলার উদ্দেশ্য – আমরা এখনও কোভিডমুক্ত হই নি, পরবর্তি ঢেউ আসার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। সতর্কবার্তা জারি আছে।

দু বছর ধরে এই কোভিড ভাইরাস নিয়ে ঘর করায় মানুষ এই রোগ নিয়ে অনেক অভিজ্ঞ হয়েছে। বিশেষজ্ঞ হবার দিন এখনও আসেনি। কোভিডের আক্রমণাত্মক চরিত্র বলে দিচ্ছে ভাইরাস যদি চলে আসে বাড়িতে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে যাদের কোমর্বিডিটি আছে তারা গুরুতর আক্রান্ত হয় কারণ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় কোভিডের বাসা বাঁধায় সুবিধে হয়। আরও একটা বিষয় হল প্রথম ঢেউয়ের পর কয়েকটা জেলায় গিয়ে জেনেছিলাম গ্রামের দিকে আক্রান্তের খবর নেই। শহরের লোকজন নানা কারণে আক্রান্ত হলেও গ্রামের লোকেদের লকডাউন পর্বে শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সংক্রমিত হবার সুযোগ হয়নি যেটা পরের ঢেউয়ে আর রক্ষে করা যায়নি। পেটের টানে কাজ জোগাড়ের জন্যে তাদের শহরে আসতেই হয়েছে এবং সংক্রমিত হয়ে ফিরে গেছে। সচেতনতা এবং প্রতিষেধক সংক্রমণের ব্যপকতা রুখতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু স্কুল খুলতে গেলে যে সব সাবধানতা মানার কথা বলা হয়েছিল সেই পরিকাঠামো পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র নেই। শহরের কিছু স্কুল সেই ব্যবস্থা নিতে সমর্থ হলেও আর্থিকসঙ্গতি না থাকায় শহর থেকে গ্রামে অনেক স্কুলেই তা সম্ভব ছিল না। অনেক স্কুল বাড়ি ভেঙে গেছে, আসবাব নষ্ট হয়ে গেছে, যেটুকু পরিকাঠামো ছিল তা আগের মত আর নেই। এইসব প্রান্তিক স্কুলের অনেক ছাত্রছাত্রীই সংসারের অভাব মেটাতে, বিশেষ করে করোনাকালে অনেক অভিভাবকেরই নিয়মিত আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, তারা রোজগারের পথ বেছে নিয়েছে। ছোট ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় এবং বাড়ির আবহ সেইভাবে না থাকায় ভাষা, অঙ্ক ইত্যাদির মত বিষয়গুলো ভুলে গেছে। তাদের আবার নতুন করে মনে পড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষকদের। গ্রাম থেকে শহরে সমাজে আর্থিক ব্যবস্থার সার্বিক অবনতি অভাবগ্রস্ত ছেলেমেয়েদের স্কুল-বিমুখ করে দেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবু কিছু ছেলেমেয়ের পড়ায় প্রবল আগ্রহ। পুরোপুরি খোলার আগে দেখা গেছে কিছু শিক্ষক গাছের তলায় ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন।

অস্তমিত কোভিডের আতঙ্ককে সরিয়ে সবরকমের সাবধানতা অবলম্বন করেই স্কুল খুলেছে। শহরের চিত্রটাই সব নয়, প্রান্তিক ছেলেমেয়েদেরও সমান অধিকার শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার আর সেই দিকে নজর রেখেই ধাপে ধাপে এগিয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা আবার আগের মত স্কুলে যাক। সন্তানেরা সামাজিক হয়ে উঠুক, বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে মানসিক বিকাশ লাভ করুক, যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে প্রায় দু বছর কাটিয়েছে তার থেকে স্বশিক্ষিত হোক সামাজিক দায়বদ্ধতায়। এর সাথেই ভাবতে হবে যারা বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন তাদের কথাও। দীর্ঘদিন গৃহবন্দি অবস্থায় অনেকে মানসিক বিপর্যস্ত। অনলাইন ক্লাসে তাদের আবেগ সব সংযমের বাঁধ ভেঙে অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছে। যে আবহে তারা স্কুলে মানব-দরদী আন্টি-আঙ্কেল এবং সহায়কদের আদর-যত্ন পেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, বন্ধুদের সাথে হাসি-কান্না ভাগ করে নিত, একটা নিয়ম এবং শৃঙ্খলতার মধ্যে দিন কাটাত সেটা নষ্ট হয়ে ঘরে আবদ্ধ জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে যা তাদের ব্যবহারিক চরিত্রের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। অনেকেরই মনোবিদের পরামর্শ ও চিকিৎসার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তাদেরও আবার আগের জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। এটা একটা বড় সমস্যা এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এইসব ছেলেমেয়েরাও আবার আস্তে আস্তে স্কুলে যেতে শুরু করেছে।

* * *

এবারে আমায় একটু বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। এতক্ষণ যা কিছু লিখলাম দুবছরের প্রায়ান্ধকার স্কুল এবং পারিপার্শ্বিক জীবনের অংশ মাত্র। কোভিড মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে তিন ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। কোভিড-পূর্ব জীবন যা জানা আছে। কোভিড-কাল সম্বন্ধে কিছুটা জানলেও এখনও অসম্পূর্ণ। হোঁচট খেতে হচ্ছে কারণ এই যুগের অবসান হয়েছে কি না তা নিশ্চিত নয়। আর কোভিডের পরের জীবন কী হতে চলেছে তার আন্দাজ খুব সামান্য হলেও বোঝা যাচ্ছে। স্কুল জীবন নিয়েই কথা যখন চলছে তখন সেইটাই আলোচনার প্রধান বিষয় হোক। কিভাবে শিশু-কিশোরের শরীর ও মনের স্বাস্থ্যের ওপর আঘাত হেনেছে তার কিছুটা আলোচনা করা দরকার।

প্রায় দুটো শতাব্দী ধরে যারা স্কুলে গিয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছে তারা একটা প্রাচীর ঘেরা নির্দিষ্ট চার দেয়ালের মধ্যে স্কুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। সেখানে ছিল কিছু নিয়ম, শৃঙ্খলা, আচার, সময়ানুবর্তিতা; ছিল নির্দিষ্ট শ্রেণি হিসেবে পাঠ্য পুস্তক, খাতায় লেখার চর্চা, শিক্ষকের শিক্ষাদান, পড়ানো এবং ছাত্রদের শিক্ষাগ্রহণ, নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের শিক্ষিত হওয়ার মূল্যায়ন; ছাত্রদের মধ্যে মেলামেশা, খেলাধুলা, শারীরচর্চা, হাতের কাজ শেখা, সামাজিক হওয়া; মতান্তর, তর্ক-বিতর্ক, রাগ, মান, অভিমান, হিংসা, ঝগড়া, মারামারি, বন্ধুতা, স্নেহ, মায়া, মমতা, সেবা। আরও হয়তো অনেককিছু আছে যা ছাত্রজীবন ভবিষ্যতের সম্পূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে, মানবিক করে তোলে। সময়ের সাথে এসবের প্রকার বদলেছে, ব্যবহারিক চরিত্র পরিবর্তন হয়েছে, স্কুলের প্রকারভেদে ছাত্রদের মানসিক গঠন এক থাকেনি। কিন্তু ছাত্রদের মধ্যে কেউ ভাল কেউ দুষ্টু বা খারাপ থাকলেও কোথাও একটা অদৃশ্য সুতোর বাঁধন থেকে গেছে। পৃথিবীর বুকে নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানুষকে বিপর্যস্ত করেছে। মনুষ্যকৃত মহামারি, যুদ্ধের মত নানাবিধ কাজ মানুষের অগ্রগতিকে মাঝেমাঝে থমকে দিয়েছে। প্লেগ, কলেরা, বসন্ত, ডেঙ্গুর মত অসুখ লক্ষ লক্ষ লোকের জীবনহানি করেছে। কিন্তু কোভিড ভাইরাসের মত একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য মানুষের জীবনকে পৃথিবীব্যাপী স্তব্ধ করে দিতে পারেনি এর আগে। জলের নিচে যেমন ক্রমাগত পলি জমতেই থাকে, কখনও বেশি আবার কখনও কম সেরকমই চলছিল। কিন্তু এই পলি আসাটাও কোন এক প্রাকৃতিক কারণে বন্ধ হয়ে যায়। একটা সময়ের ব্যপ্তি থাকে যখন কোন পলি জমা হয় না। আবার সেই সময় শেষ হলে পলি আসে, জমা হয়। এই পলিহীন অন্তর্বর্তী সময়কে বলা হয় আনকনফর্মিটি বা অসঙ্গতি। সদা চলমান সময় এখানে হারিয়ে যায়। মানুষের জীবনেও এই সময়টা সেই অসঙ্গতি, যেন কিছুটা সময় কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে। মানুষ এমন নিঃসঙ্গ এর আগে কখনও হয়েছে কিনা জানা নেই, হয়তো ডেঙ্গু, কলেরা এবং প্লেগের সময় কিছুটা তাও নির্দিষ্ট কিছু জায়গায়, এরকম সর্বনাশী বিশ্বব্যাপী নয়। প্রত্যেকটা মানুষ যেন একেকটা দ্বীপ। পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, সন্দেহ মানুষকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। সামাজিক দূরত্ব মানসিক দূরত্বের কারণ হয়েছে। শঙ্খ ঘোষের সেই বিখ্যাত উক্তি “বেঁধে বেঁধে থাকা”র বন্ধনটাই আলগা হয়ে গেছে।

সময় হিসেবে শুনতে দু বছর, মনে হতেই পারে কি আর এমন। কিন্তু মনে রাখতে হবে শিশু ও কিশোর বয়সীদের এই দু বছর মানসিক গঠনের দিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ, ভিত গড়ে ওঠার সময়। একেবারে ছোট থেকে শুরু করা যাক। শৈশবে প্রাথমিক শিক্ষা আসে বাড়ির আপনজনদের থেকে, মানে মা-বাবা ও অন্যান্য পরিজনদের থেকে। করোনাকালে যে শিশু বেড়ে উঠছে তাদের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা যে তারা ঘরের বাইরে বেরোতে পারেনি। এইসময় সামাজিক হতে শেখে শিশুরা, সেখানে বাধা পেয়েছে। প্রাকৃতিক বস্তুজগতের সাথে পরিচয় হয় নি। পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের সাথে যোগসূত্র স্থাপন হয়নি। গরুর ডাক শুনলেও গরু দেখেনি, পাখির কিচিরমিচির শুনে আনন্দে খিলখিল হাসলেও পাখিটাকে দেখেনি। গাছের সাথে পাতা ফল ফুলের সম্পর্ক শেখা হয়নি। রাস্তা, নানা রকমের গাড়ি নাগালের বাইরে। এতকিছু বলার উদ্দেশ্য, যে সময় ইন্দ্রিয়গুলো প্রবল ক্ষমতাশীল, মানুষের মস্তিষ্ক সবচেয়ে দ্রুত ও বেশি তথ্য গ্রহণের ক্ষমতা থাকে সেটায় সাংঘাতিক ব্যহত হয়েছে ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশে এটা অন্তরায় হবার সম্ভাবনা প্রবল। এইসময় তথ্য সংগ্রহের সাথে তার প্রয়োগও করে শিশুরা যখন মস্তিষ্কে যুক্তির খেলা চলে, মস্তিষ্কের নিউরনগুলো প্রবল সক্রিয় থাকে, বুদ্ধি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। নির্দিষ্ট পরিসরে ইচ্ছেমত ছোটাছুটি করা সম্ভব না হওয়াটাও অন্যতম বাধা যা শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিকে সম্পূর্ণ করে না। বাড়ির ভেতরে থাকার ফলে অন্তর্মুখী হওয়াটাও সম্ভব। এ তো গেল দু-আড়াই বছর পর্যন্ত বয়সের শিশুর কথা। এর থেকে যারা বড়, যাদের প্রি-স্কুলে যাবার সময় তারাও বসে রইল ঘরে, মেলামেশা, বন্ধু, রঙিন শিক্ষামূলক খেলা ও খেলনা, মা বাবা ছাড়া অন্য অপরিচিতদের সাহচর্য ও আপন করে নেওয়ার শিক্ষা, প্রাথমিক অক্ষর ও সংখ্যা জ্ঞান ইত্যাদি অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল। যারা সবে স্কুলে ঢুকেছিল তারা বন্ধুদের হারিয়ে ফেলল। অনেকের স্মৃতির কোটরে জমা হল শুধু অন্তরিন আতঙ্কের ছবি। আনন্দ নেবার প্রধান উৎস হল মোবাইল ফোন। অনেক বাড়িতে হয়ত অভিভাবকেরা যত্ন নিয়েছেন এবিষয়ে কিন্তু স্কুল পরিবেশই মনে হয় শিশুরা স্বচ্ছন্দ বোধ করে। শহর এলাকায় যদিও বা কিছু হয়, মফঃস্বলে তার কম আর গ্রাম্যজীবনে এগুলো স্বপ্ন।

* * *

জন্মের সময় মানুষের মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ তৈরি থাকে না এবং জন্মের পর থেকে সময়ের সাথে লক্ষ লক্ষ মস্তিষ্কের কোষ তৈরি হয় যা তার নির্দিষ্ট কাজের জন্যে তৈরি, পুষ্টি ও বৃদ্ধি হয়। প্রতিটা কোষের কাজ ‘প্রি-কোডেড’। এরকম ভাবে বয়স ভেঙে ভেঙে দেখলে জানা যাবে যে প্রতিটা ক্ষেত্রে এই দু বছরে অনেকটা শূন্যতা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা অথবা যে কর্মদক্ষতা হবার কথা সেটায় ঘাটতি রয়ে গেল। পরবর্তিকালে সেইসব কোষের অসম্পূর্ণ কাজ কতটা সক্রিয় হবে তা সময়ই একমাত্র উত্তর দেবে।

শ্রেণিকক্ষে পড়াশোনা শুরু হবার পর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নানারকম সমস্যা দেখা দিয়েছে যার কিছুটা আগে বলা হয়েছে। শহর এবং শহরাঞ্চলের কিছু প্রতিষ্ঠিত শিক্ষায়তনে নিয়মিত অনলাইন ক্লাস হওয়ায় তাদের ক্ষতির পরিমাণ হয়ত পরিপূরণ করা সম্ভব কিন্তু প্রত্যন্ত এবং গ্রামাঞ্চলে বা শহরের অন্য সাধারণ স্কুলগুলোতে যেখানে পড়ুয়ারা আর্থিক বৈষম্যের শিকার সেখানে মূলত আর্থিক কারণেই অনলাইন ক্লাসের সুবিধে ছাত্রছাত্রীরা পায়নি। সেইসব স্কুলের শিক্ষকদের থেকে ছাত্রদের সম্পর্কে বিচিত্র তথ্য জানা যাচ্ছে। কেউ বর্ণমালা ভুলে গেছে, কেউ টানা পড়তে পারছে না, কেউ লিখতে ভুলে গেছে, কারোর লেখায় ডিসলেক্সিক প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে অর্থাৎ অক্ষরের মিরর ইমেজ। সংখ্যা চিনতে পারছে না এবং নামতা ভুলে গেছে। বলা হচ্ছে দীর্ঘদিন পড়ার অভ্যেস না থাকায় এইসব সমস্যা। হতে পারে যারা সবে স্কুলে ঢুকেছিল বা পড়া শুরু করেছিল। কিন্তু যারা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে তারা কী করে অক্ষরজ্ঞান হারায় বোঝা মুশকিল। অক্ষর বা বর্ণমালা আমরা শিখি ছবির মত করে। সেই ছবি স্থায়ী হয়ে যায় মস্তিষ্কে। এমনকি আমরা যখন বই ইত্যাদি টানা পড়ি তখনও শব্দগুলো ছবি করে পড়ি, বানান করে নয়। একসময় স্বাক্ষর অভিযান শুরু হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল সত্তর শতাংশ স্বাক্ষর হয়ে গেছে। পরে দেখা গেছে অনেকেই স্বাক্ষর করতে পারলেও অক্ষর জ্ঞান নেই। স্বাক্ষরটা ছবির মত নকল করতে শিখেছে। আসল কথায় ফেরা যাক। পঞ্চম শ্রেণিতে যারা এখন পড়ছে তারা তৃতীয় শ্রেণি অবধি স্কুলে পড়েছে অর্থাৎ অক্ষর জ্ঞান হয়ে যাবার কথা। খামতিটা কোথায় থেকে গেল সেটা গবেষণার বিষয়। এছাড়াও মাধ্যমিক পরীক্ষার খাতা দেখে পরীক্ষকদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারছি। অতিমারি দেখিয়ে দিল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও পদ্ধতি কতটা গোলমেলে।

আমরা আর কখনো কোভিড-পূর্ব স্বাভাবিকতায় ফিরতে পারব কি না জানা নেই। ফিরলেও যেসব সন্তানেরা শৈশব ও কৈশোরের একটা মূল্যবান সময় হারিয়ে ফেলল তাদের যে কি ক্ষতি হল তা ভবিষ্যৎ জানাবে। তবে নব্য-স্বাভাবিক জীবন বলে যা প্রচার চলছে তার চেহারা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনও গভীর অন্ধকারে। আদৌ কিছু পরিবর্তন হবে কি না তাও ধোঁয়াশায় কারণ যেখানেই স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে সেখানেই মানুষের রিপুগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠছে। অতিমারিকালে প্রবীণ বয়সে ভার্চুয়াল ক্লাসে নব্য-শিক্ষা পদ্ধতি আমার শেষ হয়েছে তার জন্যে অবশ্য মনটা খারাপ লাগে।

0 comments:

1
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - অনিমেষ চট্টোপাধ্যায়

Posted in




















(কয়েক মাস আগে আমার এক বন্ধু জিজ্ঞস করেছিল, ‘তোমার সবচেয়ে সুখের অবকাশ কি?’ আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বলেছিলুম, ‘কি আবার? কোন কাজকম্ম না করে, ঠ্যাং ছড়িয়ে বালিশে ঠেসান দিয়ে বই পড়া! ওর থেকে সুখের আর কিছু নেই।’

‘তাহলে চেন্নাইতে যাবার পর,ওখানে কি কি বই পেয়েছ আর পড়েছ,তাই নিয়ে লেখো না। দেখি কেমন হয়।’

‘আরে, আমার সাবজেক্টের মা বাপ থাকে না, কিন্তু। যখন যা ইন্টারেস্টিং মনে হয় তাই পড়ি। পাঠক ভাবতে পারে এ আবার কি। লাল নীল বেলুন নিয়ে এই বেলুনওলা কোথা থেকে এলো।

আরে,এক্সপেরিমেন্ট হোক না ।’

এই লেখাটি সেই ‘হোক নার’ ফসল। ছড়িয়ে থাকা জীবনের কয়েকটা বই আর তার স্মৃতি।)


তখন আমি সদ্য মাদ্রাজে এসেছি। চেন্নাই নাম তখনো আসেনি। সাধারণ মানুষ তখন জানতো না যে চেন্নাইপত্তনম বলে সাবেক কালে এক নুনের বন্দর ছিল। উত্তর মধ্য পুরনো চেন্নাই জমজমাট ছিল। কিন্তু নতুন গড়ে ওঠা দক্ষিন চেন্নাই সেসময় ফাঁকাফাঁকা। তখনো মোটরগাড়ির কারখানা আর সফটওয়্যার ব্যবসা গড়ে ওঠেনি। দক্ষিনে তেমন জমাটি বইয়ের দোকানপত্তর ছিল না।সেই পুরনো মাদ্রাজে বইয়ের দোকান বলতে সবচেয়ে নামকরা ছিল হিগিনবোথাম। মধ্য চেন্নাইয়ের বিখ্যাত মাউন্ট রোডে। বিশাল কলোনিয়াল বাড়ি। খুব ফরমাল পরিবেশ। সেখানে বেশি যাওয়া হোত না।

ফাঁকা মনে দিন কাটত। কলেজ স্ট্রিট, শশীভূষন দে স্ট্রীট আর মির্জাপুরে তেলেভাজা চা। চৌরঙ্গীতে গ্র্যান্ড হোটেল আরকেডে ফরেন পাবলিশার্স, নিউ এম্পায়ার সিনেমা হলের উলটো ফুটপাতে, মডার্ন বুক। মোহন তেওয়ারীর দোকান। ভবানীপুরে সিগাল বুক—সন্ধ্যেবেলায় মন চলে যেত এইসব ফেলে আসা আড্ডায়।

এইসময়, একদিন চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশনে ট্রেনের টিকিট কাটতে গিয়ে বুকিং অফিসের পেছনের পুরনো ভাঙা মুরমার্কেটের পুরনো বই আর রেকর্ডের জগৎ প্রথমবার দেখি। মুরমার্কেটের কথা নতুন বন্ধুদের থেকে শুনতুম। রেলের নতুন বড় অফিস বিল্ডিং ওই পুরনো মুরমার্কেটের জমিতে গড়ে উঠেছে। শীতকালে এর পাশেই সার্কাসের তাঁবু পড়ে। প্রথমদিন গিয়ে দেখি, আরে এতো একদম দিল্লির দরিয়াগঞ্জের দক্ষিণী এডিশন। যে কোন বড় শহরের পুরনো বইয়ের বাজারের মতো, প্রচুর নীলমার্কা ক্যাসেট আর বই এর ভিড়। এক ছোট্ট দোকানদার। আমায় দেখে হিন্দিতে কথা বলল। নাম আমেদ। উচ্চারনে আহমেদ ছিল না। হাফ মিনিট কথার মাঝে বার করে দিয়েছিল, সমরসেট মমের মুন এন্ড দ্য সিক্স পেন্স। চার টাকায়। ত্রিশ বছরের পুরনো কপিটা আমার এখনো আছে। মুন এন্ড দ্য সিক্স পেন্স যে ১৯শতকের শেষভাগের ইউরোপিয়ান পেন্টার পল গগ্যাঁর জীবন নিয়ে লেখা, সে খবর জানতুম। পল গগ্যাঁ যে ধারার(স্টাইল-মুভমেন্ট) ছবি আঁকতেন তার নাম যে পোস্ট-ইম্প্রেজনিজম, এটাও জানতুম। সমরসেট মম দক্ষিন সমুদ্র(south seas} বেড়াতে গিয়ে এ উপন্যাস লিখেছিলেন, সেটাও জানতুম। ব্যস, আর কিছুই জানতুম না। মুরমার্কেটের চারটাকা দামের ওই বই আমাকে পোস্ট-ইম্প্রেসনিজম পেন্টিং এর প্রতি শুধু যে আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছিল তা নয়। আমেদ আমাকে বইয়ের দোকানের শুলুক সন্ধান দিয়েছিল। ওর সম্পর্কে ভাই জালাল, আমার পাড়ায়, মানে দক্ষিন চেন্নাইতে ট্রলিতে সেকেন্ড হ্যান্ডড বই বিক্রি করে সে খবরও দেয়। জালাল আমাকে তার ট্রলি থেকে দিয়েছিল এরিক হবসবমের চার ভল্যুমে ইউরোপের ইতিহাস।

সেই সময়ে সদ্য আলাপ হওয়া বন্ধুরা আমাকে নিয়ে যান, মধ্য মাদ্রাজের টিনগরে আর সানথম হাই রোডে। বসে আড্ডা মেরে বই কেনার দোকান সব টিনগরে ছিল। টিনগরের বালাজি বুক সেনটার আর সানথম হাই রোডের ধারে কাচেরি রোডে, ওয়েসিস বুক সেন্টা্র। ওয়েসিস বুক সেন্টারে প্রথমে চোখে এসেছিল নোম চোমস্কির হাল আমলের বই। চোমস্কির সিজ অন স্টেট, প্রফিট ওভার পিপল, অন এ্যানার্কিসম আর ডেটেরিং ডেমোক্রেসি। তাকের সামনেই। চোমস্কি কলকাতায় খুব পপুলার। যত না ভাষাতত্ত্বের নতুন চিন্তার জন্যে, তার থেকে বেশি পলিটিকাল ইকনমির লেখার জন্যে। একদম ফ্যাশানে পরিনত হয়েছিলেন। তবে এটাও ঠিক, মার্কিন দাদাগিরির মুখোশ খুলে অন্য চরিত্র তুলে ধরার মত যে অল্প কয়েকজন আমেরিকা্ন আছেন, চোমস্কি তাদের মধ্যমণি। চোমস্কি ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালীন ভিয়েতনামে গিয়ে মার্কিন আগ্রাসনের নিন্দে করেছিলেন। মানতেই হবে, যুদ্ধের সময় শত্রুদেশের রাজধানীতে গিয়ে নিজের দেশের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে অনেক হিম্মত লাগে। চোমস্কি সেই ধাতের মানুষ। নিজেকে তিনি এ্যানার্কিস্ট বলেন এবং এ্যানার্কিস্ট আন্দোলনের সবচেয়ে পপুলার চরিত্র মিখাইল বাকুনিনের ভাবশিষ্য ভাবেন। সোভিয়েত রাষ্ট্র ও মার্কসের তত্ত্বের খোলাখুলি সমালোচক। কিন্তু সেই সময় তাঁর রাষ্ট্র(স্টেট) বা এ্যানারকিজম নিয়ে লেখাপত্তর কলকাতায় খুব পপুলার ছিল না। কলকাতায় আমার বন্ধুরা চোমস্কির ওইসব বই এড়িয়ে যেত। এ্যানার্কিসম শব্দটাকে তখন কিছুটা খারাপ চোখে দেখার চল ছিল, কলকাতায়। চোমস্কি কিন্তু কখনো রেখেঢেকে কথা বলেননি। প্রসঙ্গত বলি চেন্নাইতে কিন্তু এ্যানারকিসমের চর্চা ভালোই ছিল। চোমস্কিপন্থী বা এ্যানারকিজম মতবাদী লোকেদের বইমেলায় দেখতে পাওয়া যায়। দ্য হিন্দু পত্রিকার আতিথ্যে চোমস্কি যখন মধ্য চেন্নাইয়ের সবচেয়ে নামকরা প্রেক্ষাগৃহ, মিউজিক এ্যাকাডেমিতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, হাউসফুল হয়ে গিয়েছিল।

চোমস্কির ভাবগুরু বাকুনিন রাশিয়ার লোক ছিলেন। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার পথীকৃৎ বলা যেতে পারে। লেনিন বা লেনিনের প্রথম জীবনের গুরু প্লেখানভের অনেক আগে বাকুনিন সমাতান্ত্রিক রাজনীতির প্রচার করেছেন। বাকুনিনের সঙ্গে কার্ল মার্কসের প্রথমে বন্ধুত্ব ছিল, পরে তুমুল মতভেদ হয়। এমনকি মার্কসের চাপের সামনে প্রথম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক থেকে বাকুনিন বহিস্কৃত হয়েছিলেন। এসব কথা কিছু কিছু কলকাতায় শুনেছিলাম। কিন্তু এই সাবজেক্টে মার্কসের বা বাকুনিনের লেখা কলকাতায় সহজে পাওয়া যেত না।

আর চেন্নাইয়ে ঠিক সেই সময়ে এক সুখকর আবিস্কার হয়েছিল। প্রথমবার টিনগরে বালাজি বুক স্টলে ঢুকে পেছনের তাকের দিকে তাকাতেই দেখেছিলাম, বাকুনিনের অন এ্যানার্কিসম, আর গড এ্যান্ড দ্য স্টেট। বাকুনিন? মানে এ্যানার্কিসিট মিখাইল বাকুনিন!! এদেশে পাওয়া যায়! লোক পড়ে! বেশ অবাক বিস্ময়ে দেখেছিলুম। বাকুনিনের লেখা মার্কসিজম, ফ্রিডাম এ্যান্ড দ্য স্টেট, রিকালেকশন অন মার্কস এ্যান্ড এঙ্গেল। মার্কস আর বাকুনিনের মধ্যে রাষ্ট্রের তত্ত্ব নিয়ে, সমাজতন্ত্রের চরিত্র নিয়ে মতবিরোধ, ছাড়াছাড়ি কেন হয়েছিল সে সব জানার কারুর ইচ্ছে থাকলে দুজনের লেখাই পড়া উচিত। আগেই বলেছি বাকুনিনের লেখা সহজে পাওয়া যেত না। আরো সমস্যা ছিল এ্যানার্কিজমের জন্মদাতা, আদিপুরুষ প্রুধোঁর(pierre joseph Proudhon) লেখা, কলকাতায় সহজলভ্য ছিল না। প্রুধোঁ এ্যানার্কিজম তত্ত্বের সৃষ্টিকর্তা। । মার্কসের প্রথম জীবনে প্রুধোঁর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। পরে মতভেদ, চরম ডিবেটে পরিনত হয়েছিল। মার্কসের প্রথম জীবনের প্রুধোঁকে আক্রমণ করে লেখা পভার্টি অফ ফিলসফি’(প্রূধোঁকে ব্যঙ্গ করে লেখা) কলকাতায় সহজেই পাওয়া যেত। কিন্তু ডিবেট শুরুর প্রথম বা অরিজিনাল লেখা, প্রুধোঁর ‘ফিলসফি অফ পভার্টি’ বা প্রপার্টি ইজ থেফট, পাওয়া যেত না। কিন্তু চেন্নাইতে পেয়েছিলাম।

আজ মনে হয় এ্যানার্কিজমের(নৈরাষ্ট্রবাদ, কিছুটা ভুলভাবে অনেকসময় নৈরাজ্যবাদ বলা হয়) মধ্যে এক স্বপ্নিল মায়াময় ইউটোপিয়া আছে। আর মার্কসিজমে আছে, দিন আনি দিন খাই গেরস্থের নির্মম বাস্তব থেকে উঠে আসা এক ভোরের বিশ্বাস। এসব গল্প পরে কোনদিন হবে।

তখন আমার আড্ডা জমে গেছে। দুবার দোকানে যাবার পর টিনগরের দোকানরা অথবা ওয়েসিস বুক সেন্টার শুধু যে বসতে চেয়ার দিত তা নয়। এখনো স্মৃতিতে আছে, মালিক চেঁচিয়ে বলছে-‘স্ট্রং কাপি কুড়ুপা’(স্ট্রং কফি নিয়ে আয়) সঙ্গে মসালা বড়া (বেসনের সঙ্গে ডাল আর শাক মেশানো চ্যাপ্টা বড়া) নিয়ে আড্ডা বসত। আপনি প্রান ভরে বই দেখুন। কেউ কোন প্রশ্ন করবে না। এইভাবে টিনগরে আর কাচেরি রোডের দোকানে আড্ডা দিচ্চি। গ্র্যান্ড হোটেল আরকেডের ফরেন পাবলিশার্সের তপনের(চট্টোপাধ্যায়) কথা মনে পড়ে। পশ্চিম ইউরোপের সোশালিস্ট আন্দোলন, তার তাত্ত্বিক আন্দোলনের পলিটিকাল ফিলসফিতে মজে আছি। সেই সঙ্গে সমসাময়িক পশ্চিম ইউরোপের সামাজিক ইতিহাস- এরিক হবসবমের এজ অফ ক্যাপিটাল, এজ অফ এমপায়্যার। এককথায় ১৯শতকের দ্বিতীয়ভাগের ইউরোপীয় পলিটিকাল ফিলসফি আর ইতিহাসে ডুব দিচ্ছি তখন একদিন আলোয়ার তাথার( তাথা মানে দাদু) দোকানে আমরা গিয়েছিলাম। আলোয়ার তাথার কথা না বললে চেন্নাইয়ের বইএর দোকানের কথা অসম্পুর্ন থেকে যাবে।

চেন্নাইয়ের বই পড়ার ঐতিহ্য আর তার ইতিহাসের সঙ্গে এই পুরনো বইয়ের দোকানটা অচ্ছেদ্য গাঁটছড়ায় জড়িয়ে আছে। যে কোণ পুরনো বইএর দোকানের কথা বলতে গেলে চেন্নাইয়ের মাইলাপুর লাজ কর্নারে (Luz corner) আলোয়ারের বইয়ের দোকানের কথা আসবেই। দোকান আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে আলোয়ার(alwar) শুরু করেছিলেন। দোকান বলতে ফুটপাতে বই থাক দিয়ে ডাঁই করা আছে। ত্রিপল ঢাকা। এখানে আসেনি এমন বিদগ্ধ তামিল বুদ্ধিজীবি প্রায় নেই। তরুণ বয়সে আন্নাদুরাই, করুনানিধি (দুজনেই তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং আধুনিক তামিল ভাষা ও চলচ্চিত্র চিত্রনাট্যের আধুনিক রুপকার বলা যেতে পারে), নাট্য ব্যক্তিত্ব চো রামস্বামী, কবি ভারতীদশন সবাই দুষ্প্রাপ্য বইয়ের খোঁজে আসতেন।

অনেকেই হয়ত ব্লসমের(blossom) কথা বলবেন। নিঃসন্দেহে পুরনো বইয়ের সবচেয়ে খানদানি দোকান ব্যাঙ্গালুরুর ব্রিগেড রোডের পাশে ব্লসম। এক ছাদের তলায় এত বড় সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের পসরা আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই।

কিন্তু চেন্নাইয়ের লাজ কর্নারের ফুটপাতের ঐ নামহীন দোকান যা আনন্দ দিয়েছে তা আর ভুলব না। একদম খোলা আকাশের নিচে ফোল্ডিং চেয়ারে বসে বই দেখুন। আলোয়ার তাথা আজ আর জীবিত নেই। তাঁর মেয়ে এখন দোকানটা চালান। আলোয়ার তাথা আমাকে দিয়েছিলেন মার্কেজের ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিচিউড। আমি তখন, ওই আগে যা লিখেছি, ইউরোপের ১৯শতকের রাজনৈতিক দর্শন, রাজনীতিআর তার সামাজিক ইতিহাসে গলা ডুবিয়ে স্নান করছি। সেই সময় আলোয়ার তাথার হাত ধরে আমার মার্কেজ জীবন শুরু। মার্কেজ আমার বিদেশী সাহিত্যের বন্ধ হয়ে যাওয়া জানলাটা আবার খুলে দেয়। এর আগে রাশিয়ান সাহিত্য পড়েছি, অনুবাদে। সেসব সস্তায় পাওয়া যেত বলে। ইংরেজি উপন্যাস বলতে হেমিংওয়ের, ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি। আর দু একটা কিছু।

(২)

গার্বিয়েল গ্রাসিয়া মার্কেজ, একটা আকাশ। চেন্নাইয়ের পরিবর্তন আর এই আকাশের ঘুড়ির দিকে লাটাই ধরে দাঁড়িয়ে থাকা একসঙ্গে আমার ঘটেছে।

মার্কেজের লেখাতে আমার একটা মানসিক বাধা বা রেসিসটেন্স ছিল। তখন মার্কেজ ভীষন পপুলার। সারা বিশ্বের বহু ভাষায় তাঁর লেখা অনুবাদ হয়েছে, হচ্ছে। প্রতিদিন কয়েক লক্ষ কপি তাঁর লেখা বই বিক্রি হয়, সারা পৃথিবীতে। ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর বন্ধু। বিল ক্লিন্টন থেকে বিল গেট তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। মেক্সিকোর বিপ্লবী গেরিলারা তাঁকে সরকারের সঙ্গে মধ্যস্ততা করতে অনুরোধ করেন। এমন লেখক তো এস্ট্যাবলিশমেন্টের কাঁধে হাত রেখে স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকে। তার লেখা কি আর পড়ব!! এরকম একটা মানসিকতা আমার ছিল। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে শুরু করেছিলুম। এবং হ্যাঁ ম্যাজিশিয়ান তার যাদুকাঠি আমার সামনে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এখনো সম্মোহন কাটেনি। সেই অমর লাইন, “ অনেক বছর পরে, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল অর্লিয়ানো বুয়েনদিয়ার মনে পড়েছিল, আরো অনেক আগের এক বিকেলে কথা, বাবা তাকে বরফ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। তখন মাকোন্দো এক দশ ঘরের নদীর ধারের গ্রাম।” এক ঝটকায় ফাতনায় আমাকে গেঁথে ফেলেছিল, বুয়েনদিয়া পরিবার। পরিবারের আদিপিতা জোস আরকাদিয়ো বুয়েনদিয়া ভেবেছিলেন, সমুদ্রের ধারে বাসা বাঁধবেন। সমুদ্র তিনি কোনদিন দেখেননি। মাঠ ঘাট পেরিয়ে একদিন একটা ছোট্ট গ্রাম দেখলেন। দশ ঘরের বাসিন্দা নিয়ে । নাম মাকোন্দো। মাকোন্দো এক কল্পনার গ্রাম। এ ঠিক আর.কে নারায়নের মালগুডি নয়। বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নালতে হরিশপুর’ বা ‘নিশ্চিন্দিপুর’ এ গ্রামের কাছাকাছি(যেখানে হরিহর, ছেলেকে নীলকন্ঠ পাখি দেখাতে নিয়ে যায়)। বাইরের জগতের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। শুধু বছরে একবার কি দুবার জিপসিরা আসে। তারা তাঁবুর মধ্যে গ্রামের লোককে দুরবিন দেখায়। বরফ দেখায়। ঘড়ি দেখায়। সময় কাকে বলে বোঝায়। ম্যাগনেট বিক্রি করে। সেই ম্যাগনেট নিয়ে সোনা খুঁজে পাবার আশায় আরকাদিয়ো পাগলের মত জঙ্গলে নদীর ধারে বালিতে ঘুরে বেড়ায়। জিপসি এমন আতর বিক্রি করে তাতে শুধু হলুদ প্রজাপতি গায়ের কাছে আসবে। হঠাৎ গ্রামের মানুষ ইনসমনিয়া বা নিদ্রাহীনতা্র শিকার হয়। সারা গ্রামের লোকের ঘুম আসেনা। তারা নিদ্রাহীনতা থেকে স্মৃতি হারাতে শুরু করে। গ্রামেরা বুড়োরা ভয় পায়, তবে বুঝি সব কিছু গ্রামের লোক ভুলে যাবে। তারা গ্রামের মুখে লিখে রাখে ‘ভগবান আছে’(God exists)। মোরগ লড়াইয়ের ঝগড়ার মাঝে হঠাৎ রাগের মাথায় একজন আরেকজনকে খুন করে। তারপর সারা জীবন সেই মৃত মানুষের প্রেতাত্মা খুনীর সঙ্গে মাঝরাতে গল্প করতে আসে। রাজমিস্ত্রি লুকিয়ে ছাদের খড় সরিয়ে বিবসনা তরুণীকে দেখতে চেষ্টা করে। তারপর ছাদ ভেঙ্গে ঘরে পড়ে মাথা ফেটে মারা যায়। ফাটা মাথা থেকে হলুদ ঘিলু বেরোয়। সেই ঘিলু থেকে নারী শরীরের গন্ধ ভেসে আসে। গ্রাম বড় হয়। আরকাদিও বুয়েনদিয়া, ম্যাকদালেনা নদীর মোহনা ধরে সমুদ্র দেখতে বেরোয়। পথ হারিয়ে উপনদীর চড়ায় পুরনো জাহাজের মাস্তুল খুঁজে পায়। আমেরিকান ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি কলা রপ্তানির ব্যবসা খোলে। হাজার হেক্টরের কলাবাগান করে। শ্রমিকরা হরতাল করলে, কয়েক শো শ্রমিককে গুলি করে মারা হয়। কতজন তার ঠিক থাকে না। এই হরতাল, শ্রমিক বস্তি,আন্দোলন, হরতাল ভাঙতে মিলিটারির পাঁচ মিনিট সময় দিয়ে দুদিক থেকে মেসিনগান চালানো, প্রায় সাত পাতা জুড়ে তার কথা। একটা বাচ্চা ছেলে খালি বেঁচে যায়। বুড়ো বয়সে তার স্মৃতি উঠে আসছে। একদম কাটা কাটা নির্মম ভাষায়। ওই সাত পাতা আমাকে একঝটকায় জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠের সামনে এনেছিল।

আমি আস্তে আস্তে ঘূর্ণিপাকে ঢুকে যাচ্ছি বুঝতে পেরেছিলুম। এই জাদুবাস্তবতা তো অবাস্তবের ঠোঙায় ঢাকা এক গভীর রিয়ালিজম। ল্যাটিনো মানুষ গ্যার্বিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, মাকোন্দোর মধ্যে দিয়ে, আমার গ্রামের কথা টেনে আনছেন। সেই হাওড়া জেলার গ্রাম, যেখান থেকে বেরিয়ে এসে সারাজীবন শহুরে হবার বেকার চেষ্টা করেছি, এতো সে গাঁয়ের কথা। আমরা, বন্ধুরা একবার প্রাচীন কৌশিকি নদীর(কাণা দামোদর) উৎসমুখ থেকে মোহনা দেখবার আশায় বেরিয়েছিলাম। বর্ধমান জামালপুর থেকে শিয়াখালা চাঁপাডাঙ্গায় ‘মরা নদীর সোঁতা’ দেখেছিম। সন্ধ্যের গল্পের আসরে, শুনেছি এই কাণা দামোদরের বালির তলায় এখনো সপ্তডিঙ্গার কাঠ পাওয়া যায়। সে হাজার মণি নৌকো যেত তাম্রলিপ্ত ছুঁয়ে শ্রীলঙ্কা। পূর্ণিমায় আমাদের বাড়ির বেলগাছের আড়াল থেকে ব্রহ্মদৈত্য এসে আমাদের বাড়ি পাহারা দিত। বাঁশবনে দপ করে জ্বলে উঠত শঙ্খমালার আগুন। বাঁকুড়ার চুয়াড় বিদ্রোহে, জালিয়ান ওয়ালাবাগে, তেভাগা্র ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। উনষাটের কার্জন পার্কে আমার গাঁয়ের ক্ষ্যাপা হাড়ি, ভোলা দুলে, ঋষি খাঁড়া গুলি খেয়েছিল। -

পাতার পর পাতা ঘন ঠাস বুনোনের কাহিনী। উপন্যাসের প্রথম লাইনের সেই, ফায়ারিং স্কোয়াডের কথা আসছে না। সে কথা আসবে অনেক পরে। তার ওপর গল্প বলার স্টাইল। একেতো ঠাস বুনোনে দম ফেলার জায়গা না রেখে কাহিনী গড়িয়েছে। তার ওপর পরিবারের সবায়ের নাম একধরনের। আমার মত সাধারন পাঠককে এ লেখা অন্তত দুবার পড়তে হবে। আমাদের প্রথম যৌবনে জেমস জয়েসের ইউলিসিস নিয়ে এরকম কথা চলত—‘ তিনবার পড়ে যে বুঝতে পেরেছে তার বুদ্ধি সাধারনের থেকে ওপরে।’ এ লেখা অবশ্য ইউলিসিসের মত দুরুহ নয়। কিন্তু যাদুবাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়ালিজম আপনাকে স্মৃতি কার্পেটে বসিয়ে দেবে। বুঝবেন কেন সলমান রুশদি এই ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিচিউড পড়ে বলেছিলেন, ‘সব শেষ হয়ে যায়। জীবন যৌবন সব। জেগে থাকে শুধু স্মৃতি। কুমারী মেয়ের তীব্র কামেচ্ছার মত স্মৃতি।’ ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অফ সলিচিউডের মধ্যে দিয়ে, আমার গ্রাম, তার টোকো আমবাগান, লাল ঠোঁট টিয়াপাখি, পেটভাতায় থাকা বাগাল, পাট পচানো গন্ধ আর রাতের জোনাকি নিয়ে উঠে আসতো।

আমি শুধু মার্কেজ পড়ে যাচ্ছি। যা পাচ্ছি তাই। তাঁর ওপর উইলিয়াম ফকনার আর হেমিংওয়ের প্রভাব, তাঁর আত্মস্মৃতি, নোবেল পুরস্কার বক্তৃতাতে-এল ডোরাডো শব্দটা নিয়ে ইউরোপিয়ানদের অকারণ রহস্য তৈরির চেষ্টা নিয়ে ঠাট্টা।

আমি বুঝতে চাইছিলুম কিভাবে এই এক লেখক বিশ্বগদ্যসাহিত্যের স্টাইলকে পালটে দিলেন। কেন দক্ষিন গোলার্ধের লেখকরা উপন্যাস শুরু করতে গেলেই ওই কর্নেল বুয়েনদিয়ার ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার বাক্যবন্ধণীকে এড়াতে পারেন না। সালমান রুশদি থেকে নাইজেরিয়ার বেন ওকেরি সবাই এই ম্যাজিক রিয়ালিজম বা যাদুবাস্তবতাকে না না রঙে ভরিয়ে তুলছেন।

আমার এরকম মানসিক সময়ে একদিন তামিল লেখক ডি দিলিপকুমারের সঙ্গে ওনার বইয়ের দোকানে(দোকানটা উনি পরে তুলে দিয়েছেন) আড্ডা মারছি। আড্ডার মধ্যে দিয়ে বুঝে ছিলুম, উত্তরউপনিবেশিক বা পোস্ট কলোনিয়াল সাহিত্যের জন্মদাতা আসলে মার্কেজ। উনিই প্রথম ন্যারেটিভ স্টাইলকে ইউরোপের হাত থেকে বার করে এনেছেন। নভেল বা ফিকশন মানেই ডিকেন্স, টমাস হার্ডি বা সমরসেটে মমের গল্প বলার স্টাইল, স্বতঃসিদ্ধ ট্রাডিশন--এখান থেকে কাহিনীকে বার করে এনেছেন। দক্ষিন গোলার্ধের সাহিত্যিকরা, আম গাছের তলায় বা মাইমোসা গাছের ছায়ায় বসে ঠাকুমা পায়ে তেল মাখতে মাখতে যেভাবে গল্প তৈরি করতেন অথবা বাবার পিসতুতো বোন মায়ের খুড়তুতো ভায়ের সঙ্গে চড়কের কি দশেরার মেলায় দেখা হয়ে গেলে যেভাবে গল্প করতো, সেই ঐতিহ্যকে ধরতে চাইছেন।

দিলিপকুমার আমাকে দিয়েছিলেন তামিল দলিত সাহিত্যের অনুবাদ। বলেছিলেন, তামিল সাহিত্য প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথ আর চেকফের দিকে তাকিয়েছে, পশ্চিম ইউরোপের দিকে নয়। সেকথা অন্য কোন দিন হবে।

অপার সমুদ্র। সাঁতার তো শেখা হয় নি।

1 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - প্রমিত বসু

Posted in





‘জিগীষা দেবী কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ হইয়া রহিলেন, তারপর শিষ দিয়া ডাকিলেন "সুষু, সুষু-"। একটি ছোট প্রাণী গুটগুট করিয়া ঘরে আসিল। কুত্তা নয়। ইনি সুষেণবাবু, জিগীষা দেবীর স্বামী। রোগা, বেঁটে, চোখে চশমা, মাথায় টাক, কিন্তু গোঁফ জোড়া বেশ বড় এবং মোম দিয়ে পাকানো। সতী সাধ্বী যেমন সর্বহারা হইয়াও এয়োতের লক্ষণ শাঁখা-জোড়াটি শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে, বেচারা সুষেণবাবুও তেমনি সমস্ত কর্তৃত্ব খোয়াইয়া পুরুষত্বের চিহ্ন স্বরূপ এই গোঁফ জোড়াটি সযত্নে বজায় রাখিয়াছেন।’

‘প্রবাদ আছে - প্রজা যেমন, তার ভাগ্যে শাসনও তেমনই জোটে। আমাদের দেশের কর্তব্যজ্ঞান না বাড়ালে শাসনের উৎকর্ষ হবে না। দেশের শিক্ষিত জনের সংখ্যা যতই হোক, তারাই উদ্যোগী হয়ে জনসাধারণকে সুবুদ্ধি দিতে পারেন, যাতে তারা প্রজার অধিকার আর কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন হয়। কিন্তু শিক্ষিত সম্প্রদায় উদাসীন, তাঁদের অধিকাংশ নিজের ধান্দা বা শখ নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু একটা প্রবল মানসিক মাদক এদেশের জনসাধারণকে অভিভূত করে রেখেছে, শিক্ষিত সম্প্রদায়ও তার কবল থেকে মুক্ত নয়। আমরা ধর্মপ্রাণ জাতি বলে গর্ববোধ করি, কিন্তু আমাদের ধর্মের অর্থ প্রধানত বাহ্য অনুষ্ঠান, নানা রকম অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস এবং ভক্তির চর্চা। অর্থাৎ পুরোহিত মারফত পূজা, কবচ-মাদুলি, আর যদি ভক্তি থাকে তবে ইষ্টদেবের আরাধনা। যদি সাধারণ জীবনযাত্রা অন্ধ সংস্কারের বশে চলে তবে জাতির অধোগতি অবশ্যম্ভাবী।’

‘বাংলা ভাষার জননী সংস্কৃত হতে পারেন, কিন্তু গ্রীক ফারসি আরবী পর্তুগিজ ইংরেজিও আমাদের ভাষাকে স্তন্যদানে পুষ্ট করেছে। যদি প্রয়োজনসিদ্ধির জন্য সাবধানে নির্বাচন করে আরও বিদেশী শব্দ গ্রহণ করি, তবে মাতৃভাষার পরিপুষ্টি হবে, বিকার হবে না। অপ্রয়োজনে আহার করলে অজীর্ণ হয়, প্রয়োজনে হয় না। যদি বলি - 'ওয়াইফের টেম্পেরটা বড়োই ফ্রেটফুল হয়েছে' তবে ভাষাজননী ব্যাকুল হবেন। যদি বলি - 'মোটরের ম্যাগনেটোটা বেশ ফিনকি দিচ্ছে', তবে আমাদের আহরণ শক্তি দেখে ভাষাজননী নিশ্চিন্ত হবে।’

এই তিনটি লেখাই যখন একজনের হতে হয়, তখন মানুষটা পরশুরাম না হয়ে উপায় নেই। যাঁর সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন “আমি পৃথিবীর কোনো সাহিত্য আমার পড়া থেকে বাদ দিইনি। রাজশেখরবাবু যে কোনো সাহিত্যে পদার্পণ করলে সে সাহিত্য ধন্য হত। এ কথা বলার অধিকার আমার আছে।”

পরশুরাম এমনই একজন মানুষ যার জন্য আমাদের অতি প্রিয় এবং ক্লিশে হয়ে যাওয়া 'রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি' প্রবাদটা খাটে না। পেশাগত জীবনে চূড়ান্ত সফল হয়েও যে মাতৃভাষার চর্চা করা করা সম্ভব সেটা উনি সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বাঙালিও ছিলেন আবার মানুষও হয়েছিলেন।

২৩ বছর বয়সে ১৯০৩ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ, সেই বছরই বেঙ্গল কেমিক্যালসে কেমিস্টের পদে যোগদান আর অল্প কয়েক বছরে মধ্যেই ম্যানেজার পদে উন্নীত। ১৯৩২ সালে ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে একপ্রকার অবসর নিতে বাধ্য হন, কিন্তু সংস্থার টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসর পদে রইলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

৪২ বছর বয়সে প্রথম গল্প প্রকাশ, যা বাংলার সাহিত্যের মৌচাকে সরাসরি ঢিল মারে। এরপর আসতে থাকে একের পর এক সরস সাহিত্যের মণিমাণিক্য, যেখানে হাস্যরস বা ব্যঙ্গের তাগিদে গুণগত মানের কোথাও কোনো চ্যুতি ঘটে না, কোনো ছ্যাবলামি প্রকাশ পায় না। অথচ প্রতিটি রচনার পটভূমিতে থাকে তাঁর পাণ্ডিত্যের এক বিশাল ব্যাপ্তি, কোনো বাড়তি দেখানদারি ছাড়াই। এর পাশাপাশি চলতে থাকে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধকরণের কাজ— কখনও বা চলন্তিকা সৃষ্টিতে, কখনও পরিভাষা রচনায়, আবার কখনো বা রামায়ণ বা মহাভারতের মতো মহাকাব্যের বাংলায় সাবলীল অনুবাদে। সাহিত্য রচনার সেই প্রবাহ চলতে থাকে আজীবন, চরম পারিবারিক দুঃসময়ও কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

প্রথম বই 'গড্ডালিকা' প্রকাশের পর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লেখেন “পিতৃদত্ত নামের উপর তর্ক চলে না কিন্তু স্বকৃত নামের যোগ্যতা বিচার করিবার অধিকার সমালোচকের আছে। পরন্তু অস্ত্রটা রূপধ্বংসকারীর, তাহা রূপসৃষ্টিকারীর নহে। পরশুরাম নামটা শুনিয়া পাঠকের সন্দেহ হইতে পারে যে লেখক বুঝি জখম করিবার কাজে প্রবৃত্ত। কথাটা একেবারেই সত্য নহে। বইখানি চরিত্র চিত্রশালা। মূর্তিকারের ঘরে ঢুকিলে পাথর ভাঙার আওয়াজ শুনিয়া যদি মনে করি ভাঙাচোরাই তাঁর কাজ, তবে সে ধারণাটা ছেলেমানুষের মতো হয়, ঠিকভাবে দেখিলে বুঝা যায় গড়িয়া তোলাই তাহার ব্যবসা।”

প্রথম লেখা ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’-এ খুব স্পষ্ট হয়ে যায় তাঁর জ্ঞানের পরিধি। একটা ভাঙা মন্দিরের আধুনিকীকরণের নাম করে কোম্পানি খোলা হয়, আর তার প্রসপেক্টসে লেখা থাকে “ধর্মই হিন্দুদের প্রাণস্বরূপ। ধর্মকে বাদ দিয়া এ জাতির কোনও কর্ম সম্পন্ন হয় না। অনেকে বলেন - ধর্মের ফল পরলোকে লভ্য। ইহা আংশিক সত্য মাত্র। বস্তুত ধর্মবৃত্তির উপযুক্ত প্রয়োগে ইহলৌকিক ও পরলৌকিক উভয়বিধ উপকার হইতে পারে। এতদর্থে সদ্য সদ্য চতুবর্গ লাভের উপায়স্বরূপ এই বিরাট ব্যাপারে দেশবাসীকে আহ্বান করা হইতেছে।

ভারতবর্ষের বিখ্যাত দেবমন্দিরগুলির কিরূপ বিপুল আয় তাহা সাধারণে জ্ঞাত নহেন। রিপোর্ট হইতে জানা গিয়াছে যে বঙ্গদেশের একটি দেবমন্দিরে দৈনিক যাত্রীসংখ্যা গড়ে ১৫ হাজার। যদি লোক-পিছু চার আনা মাত্র আয় ধরা যায়, তাহলে বাৎসরিক আয় প্রায় সাড়ে তেরো লক্ষ টাকা দাঁড়ায়। খরচ যতই হউক, যথেষ্ট টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। কিন্তু সাধারণে এই লাভের অংশ হইতে বঞ্চিত।

দেশের এই বৃহৎ অভাব দূরীকরণার্থে 'শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড' নাম একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি স্থাপিত হইতেছে। ধর্মপ্রাণ শেয়ার হোল্ডারগণের অর্থে একটি মহান তীর্থক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠা হইবে, জাগ্রত দেবী সমন্বিত সুবৃহৎ মন্দির নির্মিত হইবে। উপযুক্ত ম্যানেজিং এজেন্টের হস্তে কার্য-নির্বাহের ভার ন্যস্ত হইয়াছে। শেয়ার হোল্ডারগণ আশাতীত দক্ষিণা বা ডিভিডেন্ড পাইবেন এবং একাধারে ধর্ম অর্থ মোক্ষ লাভ করিয়া ধন্য হইবেন।”

এই ধরণের start up এর ধারণা একশো বছর আগে নিয়ে এসেছিলেন, যা আজও কিছু শ্রেণীর মানুষের কাছে সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক।

কিন্তু এ তো গেল কোম্পানির প্রসপেক্টসের কথা। এবার আসল গ্যাঁড়াকল হল কোম্পানির ভেতরে, যেখানে কোম্পানির কিছু ডিরেক্টর শলা করে নিজেদেরকে ম্যানেজিং এজেন্টস বলে ঘোষণা করলো। বাকি ডিরেক্টররা বললো যে তারা ম্যানেজিং এজেন্টদের থেকে ধার করে নিজের নিজের শেয়ারের টাকা কোম্পানিকে দিচ্ছে, আবার কোম্পানি ওই টাকা ম্যানেজিং এজেন্টদের কাছে গচ্ছিত রাখছে। অর্থাৎ কিনা গাঁট থেকে কারোর কোনো টাকা বেরোলো না, শুধু খাতায় জমা থাকলো।

কর্পোরেট স্ট্রাকচার আর কর্পোরেট ফান্ডিং নিয়ে কত জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা থাকলে কেউ এই ধরণের চিন্তা এতো সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। আজ ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে বড়ো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন নতুন ভেঞ্চারগুলো শুরু করে সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় উদ্যোক্তাদের পরিকল্পনায় ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ ছায়া প্রকটমান।

এরপরেই যখন দেখি ‘চিকিৎসা বিভ্রাট’, সেখানে বোঝা যায় চিকিৎসাবিদ্যার সব বিভাগের ওপর তাঁর সুস্পষ্ট ধারণার কথা। তার সাথে থাকে সমস্ত বিভাগীয় চিকিৎসকদের চিকিৎসার ধরনধারন, নিজেদের সীমাবদ্ধতা আর তার সাথে রোগী ঠকানোর পদ্ধতি। রোগের নাম জানতে চাইলে অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার বলে Cerebral Tumour with Strangulated Ganglia, যাতে নাম শুনেই রোগী ভিরমি খেয়ে যায়। সেখানে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক যথারীতি এড়িয়ে গিয়ে বলে, "তা জেনে তোমার চারটে হাত বেরোবে নাকি?" কবিরাজ বলে, "এটা উদুরি। আবার উর্ধশ্লেষাও কইতি পার।" আর হাকিম মাথা টিপে বলে 'হড্ডি পিলপিলায় গয়া'। এতো কাণ্ডের পরও কিন্তু রোগীর রোগ আর ধরা পড়ে না। শেষমেশ অনামা কিন্তু বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন মিস মল্লিক আসল কারণ ধরে ফেলে বলেন, “আপনার একজন অভিভাবক দরকার।”

'ভুশণ্ডীর মাঠে' গিয়ে তো জন্মান্তর নিয়ে একটা আস্ত time series analysis করে ফেলেন। ব্রহ্মদত্যি শিবু মরার পর বিয়ে করতে গেল এক ডাকিনীকে, বিয়ের পিঁড়িতে উঠে বুঝতে পারে পাকেচক্রে সেই তার হালের বউ নৃত্যকালী। তখন কোথা থেকে এক পেত্নী আর শাঁকচুন্নি এসে বলে তারা নাকি শিবু আগের জন্মগুলোর বিয়ে করা বউ। চুলোচুলি যখন প্রায় ক্লাইম্যাক্সে তখন সেই নৃত্যকালীও দেখে তার আগের জন্মের স্বামীরা এসে হাজির। যথারীতি কেউ কারোর পাওনাগণ্ডা একচুল ছাড়তে নারাজ। এই জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি পরজন্মবাদীদেরকে তাদের বিশ্বাসের বা চিন্তার দৈন্যটা নতুন করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

এর সঙ্গে জুড়ে আছে তাঁর স্বভাবজাত অভিনব হাস্যরস, যেখানে হাসির আড়ালে কটাক্ষ থাকে এই অন্ধবিশ্বাসীদের জন্য। নাস্তিকের আত্মা মরলে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন প্রভৃতি গ্যাসে পরিণত হয়। সাহেবদের আস্তিক আত্মারা বিচারের আগে বড়ো ওয়েটিং রুমে জমায়েত হয়। আর হিন্দুদের জন্য অন্য ব্যবস্থা, কারণ তাঁরা তো স্বর্গ, নরক, কর্মফল, ঋষিকেশ, নির্বাণ, মুক্তি সবই মানে। তাই ভূতেদের থেকে থেকে স্বর্গ নরকের মাঝে চেঞ্জে পাঠানো হয়।

আরও একটু বিশদে দেখলে দেখা যায় যে এই Time Series নিয়ে ইচ্ছামতো খেলা করাটা বোধকরি পরশুরামের খুব প্রিয়। তাঁর লেখায় আকছার কোনো এক সময়ের পৌরাণিক চরিত্র অন্য timezone এ চলে যায় অথবা অন্য সময়ের প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে স্বচ্ছন্দে কথা বলতে শুরু করে দেয়। যেমন 'গন্ধমাদন-বৈঠক' গল্পে দেখা যায় পুরাণের সাতজন চিরজীবী একদিন গন্ধমাদন পাহাড়ে দেখা ক’রে নিজেদের সুখ দুঃখের গল্প শুরু করে; পরে তা গড়ায় ধর্মযুদ্ধ নিয়ে গভীর তাত্ত্বিক আলোচনায়।

আবার 'নির্মোক নৃত্য' গল্পে উর্বশী যখন স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে যেতে চায়, তখন ইন্দ্র আর নারদের সঙ্গে বাদানুবাদের মধ্যে উর্বশী অনায়াসে রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশী’ কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে বলে, "মর্ত্যের এক কবি লিখেছেন 'মুনিগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল, তোমারি কটাক্ষপাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল।' অমরাবতীর কোন কবি এমন লিখতে পারে?"

তাঁর লেখায় পরতে পরতে এমন প্রচুর উদ্ভাবনী চিন্তার ছাপ পাওয়া যায় যেখানে পুরাণ বা ঐতিহাসিক জীবনধারায় ঢুকে পড়ে আধুনিক জীবনের কথা বা তার চলতি সমস্যার অনুরূপ প্রকাশ। 'তিন বিধাতা' গল্পে ব্রহ্মাকে দেখেই গড ভ্রুকুটি করে বললেন, "তুমি কী করতে এসেছ? তোমাকে তো আজকাল কেউ মানে না, শুধু বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রে তোমার ছবি ছাপা হয়।"

'জাবালি' গল্পে জাবালির স্ত্রী হিন্দ্রলিনী মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আক্ষেপ করেন যে তিনি 'তাঁর বাবার কাছে শুনেছিলেন, সত্যযুগে এক কপর্দকে সাত কলস খাঁটি হৈয়ঙ্গবীন মিলিত, কিন্তু এই দগ্ধ ক্রেতাযুগে মাত্র তিন কলস পাওয়া যায়, তাও ভয়সা।' এই রকম অভিনবত্বের ধাক্কায় পাঠককুল বিহ্বল হয়ে পড়ে, আবার মেতে ওঠে এক নির্মল হাসির আনন্দে। এই ভালোলাগার আবেশের মধ্যে থেকে সবকিছুকে নতুন করে চিনতে বা ভাবতে বাধ্য করেন লেখক।

জাবালি চরিত্রটাকে খুঁটিয়ে দেখলে মনে হয় সে যেন পরশুরামেরই আত্মস্বরূপ। জাবালি এমন একটি ব্যক্তিত্ব যে কিনা নিজের ভাবমূর্তি সম্পর্কে উদাসীন, ব্যক্তিজীবনের সুখ-দুঃখে অবিচল, ধর্মবোধে বিশ্বাস রাখে, কিন্তু কোনো দৈবে বিশ্বাসী নয়। কোনো প্রচলিত প্রতিষ্ঠানকে সে কোনো বাড়তি গুরুত্ব দিতে নারাজ, চোখে চোখ রেখে তাদেরকে অস্বীকার করে, হেয় করে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তাদের দুর্বলতাগুলো। বালখিল্য মুনিরা এসে যখন তাকে অভিসম্পাত করে চন্দ্র, সূর্য, তারা, দেবগণ, পিতৃগণ ইত্যাদিকে সাক্ষী রেখে তখন জাবালি তার জবাবে বলে 'শৌণ্ডিকের সাক্ষী মদ্যপ, তস্করের সাক্ষী গ্রন্থিছেদক।'

দক্ষ প্রজাপতি এসে যখন তার কাছে জানতে চায় যে সে নাস্তিক কিনা আর কীই বা তার মার্গ বা শাস্ত্র, তখন জাবালি বলে 'আমি নাস্তিক কী আস্তিক তাহা আমি নিজেই জানি না। বিধাতা যে সামান্য বুদ্ধি দিয়েছেন তাহারই বলে কোনও প্রকারে কাজ চালাইয়া লই। আমার মার্গ যত্র তত্র, আমার শাস্ত্র অনিত্য, পৌরুষেয়, পরিবর্তনসহ।' দক্ষ যখন এই কথার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারে না, তখন জাবালি বলে 'হে ছাগমুণ্ড দক্ষ, তুমি বুঝিবার বৃথা চেষ্টা করিও না।' আবার স্বয়ং ব্রহ্মা তাকে বর দান করতে এলে জাবালি উল্টে বলে 'ঢের হয়েছে, আর বরে কাজ নাই। আপনি সরিয়া পড়ুন, আর ভেংচাইবেন না।'

অথচ তার নিজস্ব কর্তব্য জ্ঞান প্রখর, আর দূরদৃষ্টিও বাকি সবার থেকে স্বতন্ত্র। সেই কর্তব্যবোধ থেকে জাবালি বনবাসী রামকে অনুরোধ করে রাজ্যশাসন পিতৃআজ্ঞা উপেক্ষা করে ফিরে এসে রাজ্যের ভার নিতে। তাকে বলে 'দশরথ তোমার কেহ নহেন; তিনি অন্য, তুমিও অন্য। যাহারা প্রত্যক্ষ সিদ্ধ পুরুষার্থ পরিত্যাগ করিয়া কেবল ধর্ম লইয়া থাকে, আমি তাহাদিগের নিমিত্ত ব্যাকুল হইতেছি, তাহারা ইহলোকে বিবিধ যন্ত্রণা ভোগ করিয়া অন্তে মহাবিনাশ প্রাপ্ত হয়। যে সমস্ত শাস্ত্রে দেবপূজা যজ্ঞ তপস্যা দান প্রভৃতি কার্যের বিধান আছে, ধীমান মনুষ্যেরা কেবল লোকদিগকে বশীভূত করিবার নিমিত্ত সেইসকল শাস্ত্র প্রস্তুত করিয়াছে। অতএব রাম, পরলোকসাধন ধর্ম নামে কোনো পদার্থই নাই, তোমার এইরূপ বুদ্ধি উপস্থিত হউক।'

কবিশেখর কালিদাস রায় পরশুরামকে নিয়ে বলেছিলেন "তিনি কাহারো স্তব প্রশস্তি গান করেন নাই, ভূমিকা, পরিচায়িকা, প্রশংসা ইত্যাদির পুটে প্রসাদ বিতরণ করেন নাই, অযোগ্যকে মিথ্যা স্তোকবাক্যে আশ্বস্ত করেন নাই, আচার্য সাজিয়া সহস্রের প্রথাগত প্রাণিপাত ও মুদ্রিত অর্ঘ্য গ্রহণ করেন নাই।"

স্ত্রীর মৃত্যুর পর পরশুরাম চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যকে লিখছেন 'আমার স্বভাব কতকটা অসাড়, সেজন্য মনে হয় এই অন্তিম বয়সে সামলাতে (শোক) পারব।' সেই দেখে চারুচন্দ্রের মনে হয়েছিল যে কথাটা ঠিক নয়, তিনি গীতা উদ্ধৃত করে বলেন—

“যাঁহার চিত্ত দুঃখপ্রাপ্ত হইয়াও উদ্বিগ্ন হয় না ও বিষয়সুখে নিস্পৃহ এবং যাঁহার রাগ ভয় ও ক্রোধ নিবৃত্ত হইয়াছে, সেই মননশীল পুরুষ স্থিতপ্রজ্ঞ। অনেকদিন অনেকবার অতি নিকট হইতে তাঁহাকে দেখিয়াছি। তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ।”

স্থিতপ্রজ্ঞ না হলে একই দিনে কন্যা আর জামাতার মৃত্যুসংবাদে কেউ অবিচল থাকতে পারেন না। তিনি শুধু স্থিতপ্রজ্ঞই নন, তিনি কর্মযোগীও বটে। তাই জীবনের কোনো ঘাত প্রতিঘাতেই নিজস্ব জীবনদর্শন থেকে তিনি বিচ্যুত হন না, একমাত্র কর্মেই তাঁর চরম মোক্ষপ্রাপ্তি।

হাস্যরসে মোড়া পরশুরামের লেখাগুলো সব সময় যে পৌরাণিক চরিত্রগুলোকে ব্যঙ্গ করেছে তাই নয়, কখনো কখনো কাল্পনিক বা আমাদের চারপাশের বাস্তব চরিত্রগুলোও রেহাই পায়নি। এর সঙ্গে পরতে পরতে রয়েছে সূক্ষ্মমাত্রার রসিকতা, ব্যঙ্গ-শ্লেষের মিশেলে। পাঠকের কাছে যা আসে এক সুমধুর ধাক্কা হয়ে। তাঁর চরিত্রগুলোকে দেখলে মনে হয় এতদিনের চেনা পুরোনো, আমাদের চারপাশেই দিনরাত্রি দেখতে পাই। হয়তো পাঠক নিজেও এই রকম কোনো না কোনো দোষে দুষ্ট, অথচ এই তিরস্কারগুলো কারোর গায়ে লাগে না, বরং একটা আত্মসমালোচনার জায়গা তৈরী করে।

দেখা যায় শর্টকাটে পুণ্য অর্জন করতে কোনো ধর্মের ব্যবসায়ী ১২ লাইনের দুর্গানাম লেখা স্ট্যাম্প খোদাই করে, যাতে ৯ বার ছাপলেই ১০৮ বার সম্পূর্ণ হয়। আছে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর পুণ্যের দালালির খেলা, কোনো বউপাগল স্বামী বাঘের দৈর্ঘ্য নিয়ে কথা বলতে গিয়েও বউকে টেনে আনে, আবার আপাত নাস্তিক বাঙালি সবার আড়ালে চেয়ে বসে মানমর্যাদা বাড়ানোর কোনো মাদুলি।

'সরলাক্ষ হোম' গল্পে সরলচন্দ্র সোম কাজকর্ম জোটাতে না পেরে গোয়েন্দা হবার চেষ্টায় শার্লক হোমসকে নকল করে নাম নিয়ে বসে সরলাক্ষ হোম, সাকরেদ জোটায় ডাক্তার বটুক সেনকে। বটুক নিজে মুখেই বলে দেয় 'আমি ওয়াটসনের মতো হাঁদা নই।'

আবার নীলতারা গল্পে এই শার্লক হোমসকে দেখে আধপাগলা মাস্টার রাখাল মুস্তাফি হোমসের বিখ্যাত সায়েন্স অফ ডিডাকশন তারই ওপর চালিয়ে রীতিমতো ভিরমি খাইয়ে দেয়। হোমসকে দেখেই রাখাল এক এক করে বলে দেয় যে হোমস এদেশে প্রথম এসেছে, কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি, আগের দিন লঙ্কা খেয়েছিলো ইত্যাদি ইত্যাদি।

এসবের সাথে কোথাও পরতে পরতে রয়েছে ঋতু বিশেষে প্রকৃতির মনোরম বর্ণনা। যেখানে প্রকৃতি, প্রাণী আর মানুষের বিবরণ এতটাই সম্পূর্ণ যে সেটা শুধু সুদৃশ্যই নয়, পাঠকের মনে এক মুগ্ধতার আবেশ তৈরী করে।

কচি সংসদে শরৎকাল নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন রৌদ্রে কাঁসার রং, রোগা রোগা ফুলকপির বাচ্ছা বিকোচ্ছে, পানাপুকুর থেকে জুঁই ফুলের গন্ধে চারদিক ম-ম করছে, ছাতিম ফুলের উগ্র গন্ধ নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে, পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যাতারা যেন পথ প্রদর্শক হয়ে চলছে সবার সাথে সাথে।

ভুশণ্ডীর মাঠে বসন্তের বিকেলের বর্ণনা করতে গিয়ে লিখছেন — 'গঙ্গার বাঁকের উপর দিয়া দক্ষিণ হাওয়া ঝির-ঝির করিয়া বহিতেছে। সূর্যদেব জলে হাবুডুবু খাইয়া এইমাত্র তলাইয়া গেছেন। ঘেঁটুফুলের গন্ধে ভুশণ্ডীর মাঠ ভরিয়া গিয়াছে। শিবুর বেলগাছে নতুন পাতা গজাইছে। দূরে আকন্দ ঝোপে গোটাকতক পাকা ফল ফট করিয়া ফাটিয়া গেলো, একরাশ তুলোর আঁশ হাওয়ায় উড়িয়া মাকড়শার কঙ্কালের মতো ঝিকমিক করিয়া শিবুর গায়ে পড়িতে লাগিল। একটা হলদে প্রজাপতি শিবুর সূক্ষ্মশরীর ভেদ করিয়া উড়িয়া গেল। একটা কালো গুবরে পোকা ভররর করিয়া শিবুকে প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল। অদূরে বাবলা গাছে একজোড়া দাঁড়কাক বসিয়া আছে। কাক গলায় সুড়সুড়ি দিতেছে, কাকিনী চোখ মুদে গদগদ স্বরে মাঝে মাঝে ক-অ-অ করিতেছে। একটা কটকটে সাদা ব্যাঙ সদ্য ঘুম থেকে উঠিয়া গুটিগুটি পা ফেলিয়া বেলগাছের কোটর হইতে বাহিরে আসিল, এবং শিবুর দিকে ড্যাবড্যাবে চোখ মেলিয়া টিটকিরি দিয়া উঠিল। একদল ঝিঁঝিপোকা সন্ধ্যার আসরের জন্য যন্ত্রে সুর বাঁধিতেছিল, এতক্ষণে সংগত ঠিক হওয়ায় সমস্বরে রিরিরিরি করিয়া উঠিল।" এইসব বর্ণনা তখন আর কেবলমাত্র গল্প থাকে না, পল্লীবাংলার পটভূমিতে যেন ভ্যান গঘের ক্যানভাস আর বেঠোভেনের সিম্ফনি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

লেখার ধরণ ব্যঙ্গাত্মক হলে সেখানে সাধারণভাবে প্রেম আসাটা দুষ্কর। কিন্তু পরশুরামের লেখায় প্রেম আসে সূক্ষ্ম স্তরে, কোনো উন্মাদনা ছাড়াই তা হয়ে যায় এক মিষ্টিমধুর উপাখ্যান। তাঁর গল্পে প্রেমিক-প্রেমিকারা পার্কে বসে থাকে না, গঙ্গার ধারে ঘুরে বেড়ায় না, হাত ধরাধরি করে প্রেমের গান গায় না। প্রেম থাকে নিঃশব্দে, সবার মধ্যে থেকেও অলক্ষ্যে খুব নিচু তারে চলতে থাকে মন দেওয়া নেওয়ার পালা। উনি নিজেই এক গল্পে সেটা প্রকারান্তরে বলেছেন সে কথা। 'এই প্রেমই কি নিকষিত হেম?' উত্তরে এক চরিত্র বলে, 'আজ্ঞে না। স্টেইনলেস স্টিল বলতে পারেন। সোনার জৌলুস নেই, লোহার মরচে নেই, ইস্পাতের ধার নেই।'

'বিরিঞ্চিবাবা'য় বুঁচকির শুধু 'যাঃ' বলাতেই যেন সব কিছু বলা হয়ে যায়। শুনে সত্য যতই ভেবলে যাক, পরিস্থিতি কিন্তু একটা মধুরেণ সমাপয়েৎ-মুহূর্ত সৃষ্টি করে।

'রটন্তীকুমার' গল্পে খগেনের প্রেম এগোয় ধীর গতিতে। সেখানে খগেনের চেয়ে প্রেমিকার ভাই রটাইয়ের উত্তেজনা বেশি। শেষে খগেন যখন বলে "এইবার হব হব(প্রেম)। তোমার দিদিমণিকে বলেছি, টাকার জন্য ভাবছো কেন, ও তো বাবার টাকা। আমার কাছে এলে তিন দিনে ফুঁকে দেব। তারপর হাত খালি করে কপোত কপোতী যথা উচ্চবৃক্ষচুড়ে বাঁধি নীড় থাকে সুখে, সেই রকম ফুর্তিতে থাকা যাবে।” পাঠকদের মনও রটাইয়ের মতো উতলা হয়ে পড়ে, দু’জনের গাঁটছড়া বাঁধা না হলে যেন তাদেরও শান্তি নেই। শেষে রটাইয়ের স্বরে পাঠকই যেন বলে ওঠে অনেক হয়েছে, নিন এবার চটপট ভাব করে ফেলুন দেখি।

পরশুরামের সৃষ্টির বেশিরভাগ লেখার মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায় তাঁর সুচিন্তিত সামাজিক চেতনার বিভিন্ন দিকগুলো। তাই পাপ-পুণ্য, ধর্ম-অধর্ম, রাজতন্ত্র-গণতন্ত্র, মানুষের অবিবেচক লোভ, ওপরচালাকি— এ সব কিছু বাইরের হাসির আড়ালে সুস্পষ্টভাবে উপস্থিত তাঁর লেখাগুলোতে। সবকিছুর মধ্যেই থাকে এক অনাবিল হাস্যরসের মোড়ক, যা তিরস্কারের ছলে সাবলীল ছন্দে বুঝিয়ে দেয় সমাজের গূঢ় তত্ত্বগুলোকে।

'রামরাজ্য' গল্পে হনুমানকে গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তার উত্তরে সে বলে, “তন্ত্রে রাজ্যশাসন হয় না, মানুষই রাজ্য চালায়। গণতন্ত্র বা যে তন্ত্রই হোক, তা শব্দ মাত্র, লোকে ইচ্ছানুসারে তার ব্যাখ্যা করে।... শাসনপদ্ধতির নাম যাই হোক দেশের জনসাধারণ রাজ্য চালায় না, তারা কয়েকজনকে পরিচালক রূপে নিযুক্ত করে, অথবা ধাপ্পায় মুগ্ধ হয়ে একজনের বা কয়েকজনের কতৃত্ব মেনে নেয়। এই কর্তারা যদি সুবুদ্ধি সাধু নিঃস্বার্থ ত্যাগী কর্মপটু হয় তবে রোজার সুখে থাকে। কিন্তু কর্তারা যদি মূর্খ হয় অথবা ধূর্ত অসাধু স্বার্থপর ভোগী আর অকর্মণ্য হয় তবে প্রজারা কষ্ট পায়, কোনো তন্ত্রেই ফল হয় না।”

আবার 'অটলবাবুর অন্তিম চিন্তা'য় লিখছেন, “পাপ পুণ্য তো যুগে যুগে বদলাচ্ছে। পঞ্চাশ ষাট বৎসর আগে মুরগি খেলে পাপ হত, এখন আর হয় না। সবাই বলে নরহত্যা মহাপাপ, কিন্তু এই সেদিন শান্তশিষ্ট ভদ্রলোকের ছেলেরাও বেপরোয়া খুন করছে, বুড়োরা উৎসাহ দিয়ে বলছে— এ হলো আপদধর্ম। পাপ পুণ্যের যখন স্থিরতা নেই তখন স্বর্গনরক অবিশ্বাস্য।”

'গামানুষ জাতির কথা'তে পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন পরিবেশের ওপর যথেচ্ছারের পরিণাম। “মৃতবৎসা বসুন্ধরা একটু জিরিয়ে নেবেন তার পর আবার সস্বত্তা হবেন। দুরাত্মা আর অকর্মণ্য সন্তানদের বিলোপে তাঁর দুঃখ নেই। কাল নিরবধি, পৃথিবীও বিপুলা। তিনি অলসগমনা, দশ-বিশ লক্ষ বৎসরে তাঁর ধৈর্য্যচ্যুতি হবে না, সুপ্রজাবতী হবার আশায় তিনি বারবার গর্ভধারণ করবেন।” এমন উপলব্ধি প্রায় ১০০ বছর পরে আজকের এই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠছে।

'ভীমগীতা' গল্পে ভীম আর কৃষ্ণের কথোপকথনে কৃষ্ণ যখন বলেন রিপু দমন করার কথা তখন ভীম একে একে যুক্তি সাজান এই বলে যে, "প্রথম তিনটি না থাকলে বংশরক্ষা হয় না, আত্মরক্ষা হয় না, ধনাগম হয় না।" কৃষ্ণ যখন বলেন যে অনেক যোগী তপস্বী আছেন যাঁদের মোটেই ক্রোধ নেই, তা শুনেও ভীম নিজ বক্তব্যে অটল। "তাঁদের কথা ছেড়ে দাও। তাঁদের স্বজন নেই, আত্মরক্ষার দরকার হয় না। সকলেই জানে তাঁরা শাপ দিয়ে ভস্ম করে ফেলতে পারেন, সেই জন্য কেউ তাঁদের ঘাঁটায় না, তারাও নির্বিবাদে অক্রোধী অহিংস হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু আমরা তপস্বী নই, তাই দুর্যোধন শত্রুতা করতে সাহস করে। অন্যায়ের প্রতিকার আর দুষ্টের দমনের জন্যই বিধাতা ক্রোধ সৃষ্টি করেছেন।”

কৃষ্ণ বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ধর্মযুদ্ধে ক্রোধ আর প্রতিশোধের প্রবৃত্তি বর্জনীয়। এই কারণেই দুর্যোধনের অপরাধের কথা অর্জুনকে মনে করিয়ে দেওয়া (যুদ্ধের আগে) আবশ্যক মনে করিনি। তাই শুনে ভীম বলেন, "প্রকাণ্ড ভুল করেছ। দু’ ঘন্টা ধরে তত্ত্বকথা শুনিয়ে অতি কষ্টে অর্জুনকে যুদ্ধে নামাতে পেরেছ। যদি তাকে রাগিয়ে দিতে তবে তখনই কাজ হত, কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ কিছুই দরকার হত না।"

এইখানে উল্লেখযোগ্যভাবে হনুমান আর ভীমের মতো চরিত্র নির্বাচনেও তাঁর নিজের ব্যক্তিত্বের একটা স্বরূপ কিন্তু দেখা যায়। দুটো চরিত্রই জাবালির মতো নিজ ক্ষমতার ওপর ভরসা করেছে, কোনো দৈবে নয়। সে চরিত্র ওঁর নিজের দর্শনের সাথেও সম্পূর্ণ সমঞ্জস। তিনি নিজেই এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন— 'আমাদের যেটুকু পুরুষকার আছে, দৈবের উপর নির্ভর করে তাও বিনষ্ট হচ্ছে।’

লেখকের যখন পরশুরাম থেকে রাজশেখর বসুতে রূপান্তর ঘটে, তখন চিন্তাধারা বা বক্তব্যে থাকে সেই একই রকম সুস্পষ্ট বুদ্ধিমত্তা ও সাবলীল গতি। তবে তার মধ্যে পরশুরামের হাস্যরসের বা ব্যঙ্গাত্মক মোড়কটা আর থাকে না। সেখানে রাজশেখরের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব যেন লক্ষণীয় ভাবে ফুটে ওঠে।

‘জাতিচরিত্র’ প্রবন্ধে 'রামরাজ্য'র মতো ঠিক একই রকম কথা ব্যক্ত হয়েছে, যদিও তা পুরোটাই রাশভারী ঢঙে, যেটা তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেখানে উনি বলছেন, “আমরা ধর্মপ্রাণ জাতি বলে গর্ব করি, কিন্তু আমাদের ধর্মের অর্থ প্রধানত বাহ্য অনুষ্ঠান, নানা রকম অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস, এবং ভক্তির চর্চা। অর্থাৎ পুরোহিত মারফৎ পূজা, কবচ-মাদুলি, আর যদি ভক্তি থাকে তবে ইষ্টদেবের আরাধনা। যদি সাধারণ জীবনযাত্রাও অন্ধ সংস্কারের বশে চলে তবে জাতির অধোগতি অবশ্যম্ভাবী।

মহাভারতে কৃষ্ণ ধর্মের এই অর্থ বলেছেন–- ধারণাদ্ধর্মমিত্যাহু ধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ–- ধারণ (রক্ষণ বা পালন) করে এজন্যই ধর্ম বলা হয়, ধর্ম প্রজাগণকে ধারণ করে। অর্থাৎ সমাজহিতকর বিধি সমূহই ধর্ম। প্রজার যা সর্বাঙ্গীন হিত তাই সমাজের হিত। প্রজা বলবান বিদ্যাবান বুদ্ধিমান নীতিমান বিনয়ী হবে, আত্মরক্ষায় ও দেশরক্ষায় প্রস্তুত থাকবে, দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করবে, সর্বপ্রকারে জনহিত চেষ্টা করবে - এই হল ধর্ম, এতেই লোকের কর্ম প্রবৃত্তি চরিতার্থ হয়।”

শুরুতেই ওঁর মাতৃভাষার যে পরিপুষ্টির কথা উল্লেখিত ছিল, সেই মাতৃভাষার সমৃদ্ধিকরণের জন্য উনি অক্লেশে কাজ করে গেছেন আজীবন। 'বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান' প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, 'বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চায় এখনো নানা রকম বাধা আছে। বাংলা পারিভাষিক শব্দ প্রচুর নেই। অনেক বৎসর পূর্বে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েক জন বিদ্যোৎসাহী লেখক নানা বিষয়ের পরিভাষা রচনা করেছিলেন। তাঁদের উদ্যোগের এই ত্রুটি ছিল, যে তাঁরা একযোগে কাজ না করে স্বতন্ত্রভাবে করেছিলেন, তার ফলে সংকলিত পরিভাষায় সাম্য হয়নি, একই ইংরেজি সংজ্ঞার বিভিন্ন প্রতিশব্দ রচিত হয়েছে। ১৯৩৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যে পরিভাষা-সমিতি নিযুক্ত করেছিলেন তাতে বিভিন্ন বিজ্ঞানের অধ্যাপক, ভাষাতত্ত্বজ্ঞ, সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এবং কয়েক জন লেখক একযোগে কাজ করেছিলেন, তার ফলে তাঁদের চেষ্টা অধিকতর সফল হয়েছে।'

১৯৩৪ এ প্রকাশিত চলন্তিকায় ২৬,০০০ বাংলা শব্দের সঙ্গে যোগ করেন কয়েক হাজার পারিভাষিক শব্দ। সেখানে বিজ্ঞান বা গণিতের সব বিভাগের অন্তর্ভুক্তির সাথে সহাবস্থানে ছিল অর্থনীতি, দর্শন এমনকী পাবলিক সার্ভিসেরও কিছু প্রয়োজনীয় পরিভাষা। ‘বীজগণিত’, ‘পাটীগণিত’, ‘পদার্থবিদ্যা’র মতো শব্দের সংযোজনের পাশাপাশি সেই তালিকায় সংযোজিত হয়ে যেমন symmetry প্রতিসাম্য হয়, paleontology হয় প্রত্নজীববিদ্যা কিংবা altruism হয় পরার্থবাদ, আবার ঠিক তেমনই লগারিদম, অরোরা, প্রোটোপ্লাজম মূল রূপে অবিকৃত থাকে।

চলন্তিকা প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, "এতদিন পরে বাঙলা ভাষার অভিধান পাওয়া গেল।" এমন এক সময় এই স্বীকৃতি এল যখন খোদ রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এর কাজ চলছে পুরো মাত্রায়।

এরপর বাংলা ভাষায় রামায়ণ মহাভারত লিখতে গিয়ে তাঁর উপলব্ধি— “রামায়ণ রাম-রাবণ প্রভৃতির এবং মহাভারত ভরতবংশীয়গণের জীবনবৃত্তান্ত। এই দুই গ্রন্থের রচয়িতারা নির্লিপ্ত সাক্ষীর ন্যায় অনাসক্তভাবে সুখদুঃখ মিলনবিরহ প্রভৃতি জীবন দ্বন্দ্বের বর্ণনা করেছেন। তাঁদের পরোক্ষ উদ্দেশ্য পাঠকের মনেও অনাসক্তি সঞ্চার করা। তাঁরা শ্মশানবৈরাগ্য প্রচার করেন নি, বিষয়ভোগও ছাড়তে বলেন নি, শুধু এই অলঙ্ঘনীয় জাগতিক নিয়ম শান্তচিত্তে মেনে নিতে বলেছেন।”

শেষ বয়সে নিজের মূল্যায়ন করতে বসে বলেন, “আসলে আমি আধা মিস্ত্রী, আধা কেরানী। অভিধান তৈরী আর পরিভাষা নিয়ে নাড়াচাড়া মিস্ত্রীর কাজ, রামায়ণ মহাভারত অনুবাদ কেরানীর কাজ।” আরও একবার যেন মনে করিয়ে দেন সেই কবেকার কথা— 'বিদ্যা দদাতি বিনয়ং'।

এমন মানুষের মূল্যায়ন সব সময় আমাদের মতো আমপাঠকের পক্ষে করা সম্ভব নয়। যথার্থ বিবৃতি এসেছিল রবীন্দ্রনাথের থেকে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন "আমি রস যাচাইয়ের নিকষে আঁচড় দিয়ে দেখলাম আপনার বেঙ্গল কেমিক্যালের এই মানুষটি একেবারেই কেমিক্যাল গোল্ড নন, ইনি খাঁটি খনিজ সোনা।"

রাজশেখর বসু থাকুন বাঙালির জীবনে সুখে-দুঃখে, উত্থানে-পতনে পরশুরামের মতো অমর হয়ে। সৃষ্টিগুলো হয়ে থাকুক হাতের কুঠার, তার শানিত আঘাত আমাদেরকে বারে বারে মনে করিয়ে দিক তাঁর জীবনদর্শন, মূল্যবোধ আর উৎকর্ষের কথা।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

 



কমলকুমার মজুমদারের একটি নিজস্ব ভাষা ছিল। যে ভাষায় তিনি তাঁর উপন্যাস লিখেছেন সেই ভাষা তাঁর গল্পের ভাষা নয়। উপন্যাসের ভাষা ও তার দুর্বোধ্যতা নিয়ে পাঠককুলের সমস্যা চিরকালীন। কেউ কেউ মনে করেন তাঁর এই আপাতদুর্বোধ্য ভাষা একরকমের অহংকারের ভাষা। কেউ আবার ভাবেন তাঁর ভাষার এই দুর্বোধ্যতা আসলে সাধারণ মজারু ও বিনোদনপিয়াসী পাঠককে দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়াস। এরকম মনে করার বিশেষ কারণ আছে। তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন শোনা যায় যে, তাঁর লেখার মাত্র পঁচিশটি পাঠক হলেই যথেষ্ট। অর্থাৎ তাঁর সংশয় বা প্রতীতি যাই বলি না কেন, সেটি যথার্থ। তবু কোনো কারণে তাঁর একটি উপন্যাস পাঠ করা হয় এবং অনুভব হয়, তাঁর লেখা পড়ার জন্য একটি অবস্থাকে স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। তা হল, জীবনের বহিরঙ্গের সুখবিলাস ও তৎসম্পর্কিত ধর্মীয় আচারের ভণ্ডামি থেকে নিজেকেও চাবুক মেরে জাগিয়ে দিতে হবে। নিজের সেই সব আসক্তি সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞাত থাকতে হবে। সেই উপন্যাসটি, যা কমলকুমারের ভাষার আড়ালে তাঁর গভীর জীবন দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে ছিল, তার নাম ‘অন্তর্জলী যাত্রা’। বহিরঙ্গে কুৎসিত সামাজিক ব্যাধি ও পুরুষতান্ত্রিকতার আড়ালে যা আসলে আধ্যাত্মিক জগতের গূঢ় রহস্যের কথা বলে।

       এরপর গোলাপসুন্দরী ও শ্যামনৌকা তাঁর সেই দর্শনেরই পুনঃনির্মাণ। বলা উচিত সচেতন নির্মাণ। কারণ বাস্তবে এমন বহু চরিত্রই আমাদের অদেখা। যা শুধু তাঁর দর্শনের মূল কথাটি বলতেই নির্মিত হয়েছে। ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’ আরও দুর্বোধ্য বলে জানা ছিল, যা নাকি হৃদয়ঙ্গম করা অসাধ্য, তবু আকর্ষণ বড় ভয়ানক।  তাঁর বর্মের মতো কঠিন ভাষা যেন লোহার অঙ্গরক্ষা। সে ভাষাকে ভেদ করা দুরূহ। যেন শব্দের অতীত এক অনুভূতি তিনি বারবার প্রকাশ করতে চেয়েছেন। বাস্তবের পটভূমিতে এক অবাস্তব কথামালা। হয়তো তিনি ইচ্ছে করেই একটি নিজস্ব সাহিত্যভাষা সৃষ্টি করেছিলেন এবং জনপ্রিয় সাহিত্যিকের মতো অজস্র গুণমুগ্ধ চাননি।    যা চেয়েছেন তা হল, তাঁর অন্তর্জগতে উদ্ভাসিত এক অপূর্ব উপলব্ধির প্রকাশ। 

       প্রথম কথাটি, তিনি উপন্যাসে যে মায়ের মতো নারীচরিত্রটি এঁকেছেন তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সহধর্মিণী শ্রীমা সারদার মন্ত্রশিষ্যা। সেই সময়ের নিরিখে তিনি এবং তাঁর স্বামী সংস্কারমুক্ত। একটি ডোমের ছেলে (ডোম চরিত্র কমল কুমারের অতি প্রিয়, সম্ভবত তাদের পবিত্র কাজের কথা ভেবেই তিনি তাদের প্রতি এত আকৃষ্ট, কারণ মৃতদেহ সৎকারের চেয়ে বেশি পুণ্যকাজ আর কিইবা আছে!) সুঘরাইকে তিনি  দেওঘরে বৈদ্যনাথ দর্শনে এনেছেন। বালক ভোজনের সময়ে সুঘরাই তার পাতে নিজের পোষা পাখিটিকে নিয়ে বসে। সম্ভবত পাখিটি তিতির। এই দৃশ্যে সেই রমণী যারপরনাই পুলকিত। মনে পড়ে ভারতবর্ষের অন্যতম আধ্যাত্মিক সম্পদ উপনিষদে বর্ণিত পাখিটির কথা। তৈত্তিরীয় উপনিষদে এমনই দুটি পাখির কথা আছে। একটি স্থির অপরটি চঞ্চল। স্থির পাখিটি পরমাত্মা, চঞ্চলটি জীবাত্মা। সুঘরাই যেন তার দেহপিঞ্জর থেকে মুক্ত করে আনে আত্মাকে। তারপর প্রসাদ গ্রহণ করে। এ দেহখাঁচায় সুঘরাই যেন নিজেই শুক। তার আত্মার মুক্তি কখনোই তার বাহ্যিক জগতের পরিচয়ের ওপরে নির্ভর করে না। অথচ কাহিনী যতই এগিয়েছে লক্ষ করা যায়  যে সুঘরাই আধুনিক জগতের আবর্তে যেন ডুবতে থাকা একটি মানুষের মতো এই পরিবেশ থেকে মুক্তি চাইছে। কমল কুমারও কি তাইই চেয়েছেন? একথা ভুললে চলবে না যে সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার মনস্তত্ত্বকেই খুঁজে পাওয়া যায়। যে কারণে তাঁর উপন্যাস শুরু হয় একটি প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে -জয় মাধব, তারা ব্রহ্মময়ী, মাগো—জয় রামকৃষ্ণ।  মাত্র দশ বছরের এক বালকের অনুভূতিকে তিনি হঠাৎ কাহিনীরূপ দিলেন কেন? এ প্রশ্ন মনে জাগতেই বোঝা গেল তাঁর মনের সেই গতি। তিনি আদতে শ্রীরামকৃষ্ণের সেই চিরকালীন বালকভাবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বালক, যে কিনা ইন্দ্রিয়ের দাস নয়। ভোগ যাকে বিচলিত করে না। সেই বালক সুঘরাই একটি পবিত্র পরিচয় বহন করে। সমাজ তাকে যতই অন্ত্যজ করে রাখুক। সে ডোম। আর সে একটি পোষা পাখিকে খাঁচায় নিয়ে ঘোরে। সেটি তার প্রিয়জন। কমল কুমারের এই রূপকের আড়ালে কি সেই চিরন্তন সত্যটি দেখতে পাওয়া যায়না? এই দেহ, যা মানুষের অতি প্রিয়, যা জগতে নানা ভোগের আয়োজনে মত্ত থাকে তা আসলে হাড়মাসের খাঁচাটি। অন্তরাত্মা বন্দী থাকে সেখানে। সেই অচিন পাখিটিকে চিনতে পারলে  মনোবেড়ি তার পায়ে পরানো সোজা।

       একটি বিশেষ মুহূর্তে সুঘরাই দেখতে পায় বৈদ্যনাথ ধামে শিবের সঙ্গে বিবাহ দেবার জন্য পরমাসুন্দরী গৌরী সালংকারা কন্যাকে শোভাযাত্রা করে আনা হচ্ছে। কন্যাটি শিবের পরিণীতা হতে চলেছে। এই অলৌকিক পরিণয় প্রকৃতপক্ষে দুটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তৎকালীন সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় কুসংস্কার এবং পাণ্ডারাজের ভোগের বিকট আয়োজন। আর একটি মর্মার্থ পাওয়া যায়। অলৌকিক এই শোভাযাত্রায় যে অনাঘ্রাতা নির্মল কুমারীটি ঈশ্বরকে স্বামীত্বে বরণ করতে চলেছে সে প্রকৃতপক্ষে জাগতিক নয়। তার অস্তিত্ব জাগতিক নয়। আত্মিক। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন -তাঁকে লাভ করতে গেলে একটি প্রেমের শরীর চাই। এই শরীর নয়। কিন্তু এই অন্নময় শরীরের অন্তরে আর একটি শরীর আছে। তাকে বলে ভাগবতী তনু বা কারণ শরীর। এই শরীরে ঈশ্বরীয় আনন্দের আস্বাদন হয়। সে আনন্দ রমণানন্দের চেয়ে কোটিগুণ বেশি। এই অলৌকিক পরিণয় তাই চিরন্তন, যা কমল কুমারের আধ্যাত্মিক দর্শনের নির্যাস।

       স্বল্প পরিসরে আর একটি বিশেষ দিক প্রকট হয়। সুঘরাই কিন্তু এই অন্নময় শরীর নিয়েই জগতে  বিচরণ করে। সে তার খাঁচাটিকে নানা ভূষণে সাজাতে চায়। কারণ, এই শরীরখাঁচা বিনা সে যে কোনো আনন্দই উপভোগ করতে পারবে না! তাই খাঁচাটি প্রতিনিয়ত সাজাতে চায়। রিখিয়ায় উপস্থিত সেকালের সব চেঞ্জারবাবুরা ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করার সব উপকরণ নিয়ে হাজির। অথচ সুঘরাই ব্যতিক্রম। তার পাখিটিকে মুক্ত করতে পারল কিনা স্পষ্ট বোঝা যায়না। পারা সম্ভবও নয়, কারণ সে পাখি মুক্ত হলে আকাশে বিচরণ করবে। মাটির পৃথিবী তার দেখা পায় না।

       কমলকুমার তাঁর এই সমৃদ্ধ অন্তর্দৃষ্টি দিয়েই তাই আমাদের ভাষাকে পরিত্যাগ করেন। তাঁর শব্দ শুধুই আধ্যাত্মিক উপলব্ধির বাহক।

       [অপ্রকাশিত]

0 comments:

0
undefined undefined undefined

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in






আমার ভারতবর্ষ

সুলতান ও গান্ধর্বী

---------------------

খুব গর্ব করার মতো বীরপুরুষ ছিলেন না তিনি। বাবা শুজাত খানের রাজত্ব পেয়েছিলেন তিন ভাই। ভাইদের মেরে, তাড়িয়ে দখল করেছিলেন মালওয়ার মসনদ। কিন্তু সে রাজত্ব রক্ষা করার মতো এলেম ছিলোনা। রানি দুর্গাবতীর সঙ্গে লড়াইতে সর্বস্ব খুইয়ে শুধু প্রাণটা নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন মালওয়ায়। শরীরে, মনে একেবারে ঘায়েল আশ্রয় খুঁজেছিলেন তাঁর প্রথম প্রেম সঙ্গীতের কাছে। যুদ্ধবিগ্রহ থেকে ইস্তফা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন বনে-প্রান্তরে। এমন সময় খোঁজ পা'ন সেই নারীর, যাঁর সঙ্গে তিনি জড়িয়ে তিনি একদিন হয়ে যাবেন এক রূপকথার নায়ক।

সুলতান হিসেবে অনায়াসে দখল করতে পারতেন সেই নারীকে, গায়ের জোরে। কিন্তু তাঁর ভালোবাসা'র জোর তুর্কিদের অস্ত্রের জোরের থেকে একটু আলাদা। তিনি বিবাহ করতে চাইলেন তাঁর দয়িতাকে। বাপ ঠাকুর থান সিং গুজ্জর রাজপুত, রাজি ন'ন যবনের হাতে মেয়েকে সম্প্রদানে। লড়াই একটা হলো, কিন্তু এক তরফা। আসলে কন্যা নিজেই তো রাজি ঐ সুপুরুষ, সুর-পাগল সুলতানের স্বয়ম্বরা হতে। ঐতিহাসিক ফিরিশতা ছিলেন এই কাহিনীর কথাকার। কিংবদন্তির উর্ধ্বে আমরা যা জানতে পারি, তা ফিরিশতার পুথি থেকেই। নায়িকার নাম রূপমতী। রূপকথার নায়িকাদের সব কিছুই মাত্রা-ছাড়া। রূপমতীও তাই। পাগলকরা রূপ, মজিয়ে দেওয়া গান, ডুবিয়ে দেওয়া শায়রি। সে রকমই তো বলে সবাই। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি এক হিন্দু মেয়ে আর আফঘান সুলতানের বিবাহ হয়েছিলো ব্রাহ্মণ্য ও ইসলামি রীতিতে। এখনও বিরল সে জাতীয় ঘটনা।

রাজধর্ম থেকে রুচি হারিয়েছিলেন তো আগেই, রূপমতীকে পেয়ে বাকিটাও গেলো। গান বাঁধা আর গান গাওয়া। দুজনে দুজনকে চোখে হারান। রাজত্ব উৎসন্নে যায়। আকবর বাদশা এসব দেখে পাঠালেন আধম খান ফৌজদারকে। মুঘল ফৌজের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা ছিলোনা বায়জিদ খান ওরফে বাজ বহাদুর খানের। রণে ভঙ্গ দেওয়াই সাব্যস্ত করলেন তিনি। পুরো অন্তঃপুরকে পিছনে ফেলে রেখে দেশান্তরে গেলেন। আধম খানের লক্ষ্য ছিলেন রূপমতী। কিন্তু আধম খানও বলপ্রয়োগ করেননি তাঁকে পেতে। শুধু পাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন সভ্যভাবে। রূপমতীর তা মঞ্জুর ছিলোনা। বাজ বহাদুর ছাড়া আর কেউ নয় তাঁর হৃদয়েশ্বর। সাক্ষাৎপ্রার্থী আধম খান তাঁর বিষপানে মৃত শরীরটির সাক্ষাৎ
পেয়েছিলেন। তার আর পর নেই। একটা রূপকথার জন্ম এভাবেই। লাইলা-কয়েস, শিরিঁ-ফরহাদ, হীর-রানঝা জাতীয় উপকথার অংশ হয়ে গেলো দু'টি ঐতিহাসিক রক্তমাংসের মানুষের গল্প। তার আর জোড়া পাওয়া যায়না কোথাও।

মাণ্ডুতে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। কিন্তু রূপমতী-বাজবহাদুরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা চিরকালের সুরসৌরভ আর ভালোবাসার আঘ্রাণ সব ছাপিয়ে মনে বাজে। সুলতানের হারেমে থাকতেন না রূপমতী। তাঁর জন্য একটা ছোট্টো পাহাড়ের উপর মহল বানিয়ে দিয়েছিলেন। বাজবহাদুর। সেই প্রাসাদের ছাদ থেকে নাকি কখনও নর্মদাকে দেখা যেতো। এটা জনশ্রুতি, সত্য নয়। সুলতান রূপমতীর জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন 'রেওয়া কুণ্ড'। সেই সরোবরটি থেকে জল এনে রূপমতী পুজোআচ্চা করতেন। 

বাজবহাদুরের প্রাসাদটি একটু নীচে। দূরত্ব খুব বেশি নয়। সেই প্রাসাদের অলিন্দ থেকে রূপমতীর মহল স্পষ্ট দেখা যায়। বাজবহাদুর ছোটো রাজা। মুঘলদের মতো জমকালো, বিপুল স্থাপত্য তাঁর সাধ্যাতীত ছিলো। কিন্তু সীমায়িত মাত্রায় ইসলামি স্থাপত্যকলা অনুসারী এই সব নির্মাণগুলি এখনও মুগ্ধ করে তাদের শৈল্পিক সংযমে। দূর দূর পর্যন্ত ঊষর, গৈরিক ঢেউখেলানো মাটি, উঁচুনীচু পাথুরে প্রান্তর আর সবুজ লতাগুল্মের সুতোবাঁধা মালওয়ার দিগন্তরেখা একটা অন্যধরণের উদাসসুরে মনের স্কেলটা বেঁধে দেয়। পিলু, কাফি না মুলতানি, ঠাহর করে ওঠা যায়না।

বাজবহাদুরের গানের গল্প, রূপমতীর ফারসি আর ব্রজভাষায় রচিত গীতিসম্ভার, সবার উপরে শ্রেণীনির্বিশেষ জনতাকে মজিয়ে রাখা ট্র্যাজিক প্রেমের কালজয়ী ফর্মুলা, এই সব নিয়ে মস্তো লেখা লিখে ফেলা যায়। কিন্তু এখন তা থাক। আমরা এই রাজারানির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রাচীন নির্মাণগুলির থেকেই না হয় খুঁজে নিই সেই সব লীলা অভিরাম ছবি।







0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















১৬

ফাইনহাল্‌স্‌ শহরে গিয়েছিল পিন, কার্ডবোর্ডের বাক্স এবং কালি কিনতে। তবে শেষ অবধি পেয়েছিল শুধু কার্ডবোর্ড। যে ধরণের গোলাপি কার্ডবোর্ডের উপরে সার্জেন্ট নানা ধরণের সাইনবোর্ড আঁকতে ভালবাসেন, শুধু সেই ধরণের কার্ডবোর্ড পেল সে। শহর থেকে ফিরবার পথে বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টির জল খুব গরম। ফাইনহাল্‌স্‌ নিজের ইউনিফর্মের জামার নিচে কার্ডবোর্ডের রোলটা ঢুকিয়ে সেটা ভিজে যাওয়া থেকে বাঁচাতে চাইছিল। কিন্তু রোলটা এতটাই বড় আর মোটা যে সেটা জামার নিচে রাখা অসম্ভব। রোলের মোড়কের কাগজটা পুরো ভিজে গিয়েছিল। আরেকটু হলেই গোলাপি কার্ডবোর্ডও ভিজে নষ্ট হবে ভেবে সে দ্রুত হেঁটে রাস্তার কোণে একটা ছাউনি দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে দেখতে পেল ট্যাঙ্কগুলো মন্থর চালে গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। নল এবং পেছনের প্রান্ত ধীরে ধীরে নাড়াতে নাড়াতে ট্যাঙ্কগুলি দক্ষিণ পূর্ব দিকে চলে গেল। রাস্তার মানুষজন শান্ত, নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে ট্যাঙ্কগুলির দিকে তাকিয়ে রইল। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল বেশ কিছুক্ষণ। বৃষ্টি থেমে যাবার পরেও গাছের গা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ছিল। কালো এবড়োখেবড়ো রাস্তায় বিশাল আকারের জলভর্তি গর্ত সামলেসুমলে অবশেষে সে অস্থায়ী হাসপাতালে পৌঁছাতে পারল।

একটা বিরাট সাদা রঙের সাইনবোর্ড ঝুলছে দরজায়, যেটাতে হাল্কা লাল পেন্সিল দিয়ে লেখা আছে ‘জেন্টগিয়োর্‌গি হাসপাতাল’। শীগগির ওই জায়গায় এর চেয়ে ভালো দেখতে একটা সাইনবোর্ড ঝোলানো হবে। গোলাপি রঙের বোর্ডের উপরে কালো কালিতে গোটা গোটা গোল গোল অক্ষরে স্পষ্টভাবে লেখা হবে, যাতে সবাই দেখতে পায়। চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে আছে। ফাইনহাল্‌স্‌ ঘণ্টি বাজাল। বাইরে মালবাহকের ঘরে উঁকি দিয়ে হাঁকডাক করেও কারো দেখা পেল না। দরজা চাপ দিতেই খুলে গেল। করিডরে ঢুকে পড়ল সে। দরজার পাশের দিকে ছোট ছোট ফুটো আছে, কাচে ঢাকা- যেগুলোর পিছনে থারমোমিটার রাখা আছে। ভিতরে সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার এবং চুপচাপ। ফাইনহাল্‌স্‌ ধীরে ধীরে নিশ্চুপে প্রবেশ করল। প্রথম ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় সে শুনতে পেল সার্জেন্ট ভেতরে ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছেন। শিক্ষকশিক্ষিকাদের ছবি আর জেন্টগিয়োর্গি জায়গাটার একটা সুন্দর রঙিন নিসর্গচিত্র করিডরের দেওয়ালে টাঙ্গানো আছে।

ফাইনহাল্‌স্‌ ডানদিকে বেঁকে একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল একটা উঠোনের মধ্যে। স্কুলবাড়ির উঠোন। উঠোনের চারদিকে উঁচু উঁচু গাছ। গাছের পেছনে উঁচু বাড়ি। ফাইনহাল্‌স্‌ বাড়িটার চারতলায় একটা জানালার দিকে তাকাল। জানালাটা খোলা। সে তাড়াতাড়ি বাড়িটার ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। সিঁড়ির দেওয়াল জুড়ে পাশ করে যাওয়া প্রাক্তনীদের ছবি ঝোলানো। বাদামি আর সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো মেয়েদের ছবি। তাদের মধ্যে একটা মেয়ের ছবি ডিম্বাকৃতি ফ্রেমে আটকানো।

প্রথম বছর ১৯১৮। হয়তো এই স্কুল থেকে প্রথম ফাইনাল পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল ১৯১৮ সালের ব্যাচ। মেয়েরা কড়কড়ে মাড় দেওয়া সাদা ইউনিফর্ম পরে আছে; সবাই বিষণ্ণ হাসি হাসছে। ফাইনহাল্‌স্‌ রোজ ছবিগুলো দেখে। গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে রোজ দেখছে সে ছবিগুলো। মেয়েদের ছবির মাঝে এক গম্ভীর মহিলার ছবি আটকানো। গায়ের রঙ একটু ময়লা; প্যাঁশনে চশমা পরিহিতা। হয়তো তিনি প্রিন্সিপাল। ১৯১৮ থেকে শুরু করে ১৯৩২ পর্যন্ত সব কটা ফ্রেমে ওঁর ছবি আছে। চোদ্দ বছরে আলাদা কোনো ছবি নয়। হয়তো একবারই ছবিটা তুলে রাখা হয়েছিল। প্রত্যেকবার ফটোগ্রাফার ওঁর ছবির কপি ফ্রেমের মাঝে সেঁটে দিয়েছে। ১৯২৮ সালের ব্যাচটার সামনে ফাইনহাল্‌স্‌ একটু দাঁড়ায়। এই ফ্রেমের মধ্যে একটা মেয়ের মুখশ্রী তাকে ভীষণ টানে। মারিয়া কার্টক। মেয়েটার লম্বা চুল। কপালের সামনের দিকে চুলের গুচ্ছ ভ্রু অবধি নেমে এসেছে। সুন্দর মুখে একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস। ফাইনহাল্‌স্‌ নিজের মনে একটু হেসে ওঠে। সে প্রায় তিনতলা অবধি উঠে এসেছে। ১৯৩২ সাল। সে নিজেও ১৯৩২ সালে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিল। সে ছবির মেয়েগুলো, যাদের বয়স তখন উনিশ ছিল, তাদের দেখতে থাকে। তার নিজের বয়স এখন বত্রিশ। মেয়েগুলোরও তাই এখন। ১৯৩২ সালের ছবিতে একটা মেয়ে আছে, যার খুব ঘন চুল। চুলের গুচ্ছ ভ্রু অবধি না হলেও কপালের সামনে অনেকখানি নেমে এসেছে। নাম ইলোনা কার্টক, বোনের সাথে মুখের খুব মিল। তবে একটু রোগাটে গড়ন আর ততটা আত্মবিশ্বাসী নয়। মাড় দেওয়া সাদা পোশাক খুব মানিয়েছে মেয়েটিকে। গোটা ফ্রেমের মধ্যে একমাত্র সে এতটুকুও হাসছে না। ফাইনহাল্‌স্‌ ছবিটার সামনে দু সেকেন্ড দাঁড়ায়, একটু হাসে। তারপর আবার সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। তার খুব ঘাম হচ্ছে, কিন্তু দু হাত ভর্তি জিনিসপত্র আছে বলে সে মাথার টুপিটা খুলতে পারছে না। সিঁড়ির শেষের চাতালে মা মেরির মূর্তি। প্লাস্টারে তৈরি। সামনে ফুলদানিতে রাখা টাটকা ফুল। সকালে টিউলিপ রাখা ছিল। এখন হলদে আর লাল আধফুটন্ত গোলাপের কুঁড়ি রাখা আছে। ফাইনহাল্‌স্‌ একটু থেমে নিচের সিঁড়ির দিকে তাকাল। দেওয়ালে মেয়েদের ছবিগুলো কিছুটা একঘেয়ে লাগছে দেখতে। মনে হচ্ছে অজস্র প্রজাপতি যেভাবে সংগ্রহশালায় ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা হয়, সেভাবে রাখা, তফাতের মধ্যে শুধু এদের মাথাগুলো কালচে। সবগুলো প্রায় একই রকম প্রজাতির, শুধু মাঝের প্রজাপতিটা মাঝে মাঝে বদলেছে। ১৯৩২, ১৯৪০ আর ১৯৪৪ – তিনবার বদলেছে মাঝের ছবিটা। চারতলার শেষ পর্যায়ের সিঁড়িতে বামদিকের কোণে একদম উপরে ১৯৪৪ সালের ব্যাচ। পালিশ করা কড়কড়ে সাদা ইউনিফর্মে মেয়েরা বিষণ্ণ হাসি হাসছে। ওদের মাঝে এক বয়স্ক মহিলা, তিনিও হাসছেন, তবে তাকেও খুব প্রসন্ন দেখাচ্ছে না। যেতে যেতে ফাইনহাল্‌স্‌ ১৯৪২ সালের ছবিটার দিকে একবার তাকাল। আরেকজন কার্টক আছে এই ব্যাচে। নাম জোর্না। তবে সেরকম আকর্ষণীয় মুখশ্রী নয়। চুলের কায়দা অন্যদের থেকে আলাদা কিছু নয়; গোল, সাদামাঠা চেহারা।

চারতলাটাও গোটা বাড়িটার মতই নিঝুম, চুপচাপ। চারতলায় উঠে হঠাৎ সে রাস্তায় গাড়ির শব্দ পেল। একটা জানালার তাকে হাতের জিনিসপত্র রেখে জানালাটা খুলে রাস্তার দিকে উঁকি দিল সে। অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। গাড়িগুলোর ইঞ্জিন এখনও বন্ধ করা হয়নি। সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে আছেন প্রধান দরজার সামনে। এক ইউনিট সৈন্যদল লাফিয়ে নামল রাস্তায়। অনেকে সৈন্য বিশাল, লাল রঙের মালবাহী ট্রাক থেকে জিনিসপত্র নামাতে শুরু করেছে। রাস্তাটা ভরে গিয়েছে মানুষে।

সার্জেন্ট জোরে জোরে চিৎকার করছেন… ‘এদিকে, ওদিকে… না… সব মালপত্র সামনের করিডরে রাখো। দাঁড়াও… অপেক্ষা করো’…

ধূসর রঙের ইউনিফর্ম পরা মানুষগুলোর একটা এলোমেলো লাইন দরজা দিয়ে ঢুকতে লাগল এই বাড়িতে।

রাস্তার দুপাশের সব বাড়িগুলি থেকে জানালা খুলে যাচ্ছে। সবাই দেখছে। দূরে দাঁড়িয়ে অনেকে জটলা করছে। কিছু মহিলা হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ফাইনহাল্‌স্‌ জানালাটা বন্ধ করে দিল। বাড়িটার ভেতরটা এখনও চুপচাপ। শুধু নিচে একতলার বড় হলঘর থেকে কলরবের শব্দটা এখানে আবছা একটা গুঞ্জনের মত শোনা যাচ্ছে।

সে চারতলার হলের শেষ প্রান্তে গিয়ে একটা বন্ধ দরজা খুলবার জন্য পা দিয়ে লাথি মারল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে একজন মহিলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল… ‘হ্যাঁ, আসুন।’

ফাইনহাল্‌স্‌ কনুই দিয়ে দরজার হাতলটা ঠেলতে গিয়ে ঘেমে লাল হয়ে উঠল। সে প্রথমে লক্ষ্য করেনি যে ঘরটা নানান কিসিমের জিনিসপত্রে ঠাসা। স্টাফড জন্তু জানোয়ার, সেলফগুলোর মধ্যে ভর্তি ম্যাপের লম্বা লম্বা রোল, কাচের ঢাকনাওয়ালা গ্যালভানাইজড ধাতব বাক্সের মধ্যে নানা ধরণের পাথরের নমুনার সংগ্রহ, দেওয়ালে বিবিধ সূচিশিল্পের নকশা এবং শিশু লালনপালনের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্দেশিকাসমেত ছবি।

‘আসতে পারি?’ ফাইনহাল্‌স্‌ বলে উঠল।

হ্যাঁ… উত্তর করল মহিলা। ফাইনহাল্‌স্‌ জানালার কাছে চলে গেল। আলমারি আর সেলফের ফাঁক দিয়ে সরু একফালি পথ আছে জানালা অবধি যাওয়ার জন্য। মহিলা একটা ছোট টেবিলে বসে আছে। নিচের ছবিটার তুলনায় মুখটা অনেকখানি ভারি, গোল। মুখের কৌণিক রেখা নরম হয়ে গেছে, লাবণ্য বেড়েছে। ফাইনহাল্‌স্‌ ‘আসতে পারি’ বলাতে সে অস্বস্তি বোধ করছে, আবার খুশি হয়েছে যে সেটাও বোঝা যাচ্ছে। ‘হ্যাঁ’ উচ্চারণ করবার সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল মহিলা।

ফাইনহাল্‌স্‌ জানালার তাকে কার্ডবোর্ডের রোল এবং তার বামহাতের প্যাকেট দুটোই রেখে দিল। একপাশে খুলে ফেলে দিল মাথার টুপিটা; জানালার সামনে বাতাসে দাঁড়িয়ে শুকিয়ে নিতে লাগল নিজের ঘাম।

‘ইলোনা, আমাকে একটু সাহায্য করবেন আপনি? সে বলে উঠল… ‘আমাকে একটু টুশে* দিতে পা্রেন?’

মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে তার সামনে যে বইটা ছিল, সেটা সশব্দে বন্ধ করে রাখল।

-‘টুশে!! টুশে কী বস্তু? সে আমি জানি না। আমার মনে হয় জার্মান ভাষা আপনার অন্যতম বিষয় ছিল।’… মহিলা হেসে ওঠে।

-‘টুশে অর্থ *ভারতীয় কালি। সাধারণ কালি কিম্বা রঙের মত। আপনি কি জানেন ক্যালিগ্রাফির কলম কী বস্তু?’

-‘আমি এবার কিছুটা ধারণা পেলাম।’ মহিলা মুচকি হাসে… ‘হ্যাঁ, ক্যালিগ্রাফির কলম… জানি আমি।’

-‘আমায় একটা ধার দিতে পারেন?’

-‘মনে হয় পারবো।’ মহিলা ফাইনহাল্‌সের পিছনে একটা আলমারির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করল। কিন্তু টেবিলের ঘেরাটোপ ছেড়ে বেরিয়ে এল না।

তিন দিন আগে ফাইনহাল্‌স্‌ এই ঘরে ইলোনাকে আবিষ্কার করেছে। রোজ বেশ কয়েক ঘণ্টা করে কথা বলছে। কিন্তু একবারও সে তার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়নি। ফাইনহাল্‌স্‌ বুঝতে পারছে যে তার মনের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করছে কোথাও। ইলোনা খুব ধর্মপরায়ণা, বুদ্ধিমতী। চেহারায়, মনে এক অদ্ভুত পবিত্র ভাব। কখনই ফাইনহাল্‌সের খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় না সে, যাতে অতর্কিতে আলিঙ্গন বা চুম্বন না ঘটে। তারা প্রচুর কথা বলেছে এই ক’দিনে। ধর্মবিষয়ক আলোচনাও হয়েছে। ফাইনহাল্‌সের খারাপ লাগত না যদি চুম্বন করতে পারতো ইলোনাকে। কিন্তু সে কখনই খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় না।

ফাইনহাল্‌স্‌ কাঁধ ঝাঁকায়। মুখটা ব্যাজার করে একটু।

‘একটা কথা’… সে গম্ভীর ভাবে বলে ওঠে… ‘একটাই কথা ছিল। আপনি উত্তর দিলে আমি আর এই ঘরে এসে আপনাকে বিরক্ত করব না।‘

ইলোনার মুখটাও গম্ভীর হয়ে ওঠে। চোখের পাতা নামায় সে। ঠোঁট চেপে মুখ বন্ধ করে। একটু পরে মুখ তুলে বলে…

‘আমি জানি না‘… সে নরমভাবে বলে…’আমি বললে, আমি সম্মতি দিলে কী উপকার হবে? কোনো লাভ আছে কি?’

-‘না।’

ইলোনা মাথা নাড়ে।



(চলবে)

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in




















১৯


স্মৃতির শহর – ৫
সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন, তাঁকে যদি কখনও নির্বাসিত হতে হয়, যেকটি জিনিস তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতে চান, তার মধ্যে একটি হবে মোৎজার্টের একটি কম্পোজিশন। সম্ভবত ম্যাজিক ফ্লুট। বিশ্ববন্দিত সেই অপেরা। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি ওঁর অসীম ভালোবাসার কথা আমাদের সকলেরই জানা। মণি-মানিক্য সম তাঁর চলচ্চিত্রগুলিতে ছড়িয়ে আছে এর প্রয়োগের অজস্র নিদর্শন, যার মধ্যে মোৎজার্টের উপস্থিতি ধরা পড়ে বারবার। আল্পসের পাদদেশে ছবির মতো সুন্দর শহর, সালৎস্‌বুর্গে ১৭৫৬-র ২৭ জানুয়ারি জন্ম হ্বোলফ্‌গাং আমাদিউস মোৎজার্টের। কলকাতা যে অর্থে রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান, সালৎস্‌বুর্গ তার চেয়ে অনেক বেশি মোৎজার্টের। এই একান্ত ব্যক্তিগত উপলব্ধি হয় বছর দশেক আগে, বন্ধু হানসের সঙ্গে ঐ স্মৃতির শহরে এক সপ্তাহান্ত কাটানোর সূত্রে।

সে বছর দশেক আগেকার কথা। কেমব্রিজে এক কনফারেন্স শেষে কিছুটা সময় চুরি করে নিয়ে পৌঁছে গেলাম হানসের কাছে। বন্দোবস্ত করাই ছিল। সেইমতো আমরা এক শুক্রবার সকালে হাইডেলবার্গ থেকে চেপে বসলাম স্টুটগার্ট অভিমুখী ট্রেনে। অনেকদিন পর সেবার আবার স্টুটগার্ট যাওয়া – যদিও থাকা হবে না কারণ অল্পক্ষণের মধ্যেই ওখান থেকে সালৎস্‌বুর্গের ট্রেন। গন্তব্যে পৌঁছলাম যখন, আকাশের মুখ তখন ভার, বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে। তারই মধ্যে আমরা হাঁটাপথেই পৌঁছলাম হোটেলে।

এ এক সত্যি আশ্চর্য শহর! নুনের ব্যবসার জন্য একদা বিখ্যাত এই জনপদের ৯ নম্বর গেট্রাইডেগাসে-তে জন্ম হয়েছিল তাঁর। বাকিটা ইতিহাস। মাত্র ৩৫ বছরের আয়ুষ্কালে করলেন এমন কিছু কাজ, সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ তাঁকে মনে রাখবে সভ্যতার অন্তিম ক্ষণ পর্যন্ত। ২০০৬ সালে মোৎজার্টের জন্মের আড়াইশো বছর উদযাপন উপলক্ষে সালৎস্‌বুর্গ যখন উত্তাল, ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীতে আমার মতো অনেকেরই কান তৈরি করেছেন যিনি, সেই কিশোর চট্টোপাধ্যায়, কিশোরদা আমি আবার ইউরোপ যাচ্ছি শুনে বলেছিলেন, ‘পারলে সালৎস্‌বুর্গটা ঘুরে এসো।’ সে বছর হয়নি। হল আরও বছর পাঁচেক পর।

সেই অপরাহ্নে হানস্‌ আর আমি যখন সব পথশ্রম সরিয়ে রেখে শহরের আনাচ-কানাচ একটু সরেজমিনে দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম, তখনও জানা ছিল না পরবর্তী দুদিনে ঠিক কীধরনের অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই যে এক ক্ষণজন্মা স্রষ্টার জগতে সেই ভালোলাগার সিংহভাগ দখল করে নিল এক অপূর্ব রন্ধন-সংস্কৃতি। সেদিকে একটু তাকানো যাক।

ভিনার শ্নিৎজেল-এর কথা ইতিপূর্বেই লিখেছি। অস্ট্রিয় হেঁশেলের এই রত্নটির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বারবারা, বার্লিনে, অনেক আগেই। এই বস্তুটির প্রতি তীব্র আকর্ষণ তখন থেকেই। ভালো লাগা নিঃশব্দে কবেই ভালবাসায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে! তাই প্রথমদিন সন্ধ্যায় হানস্‌ আর আমি যখন আমাদের হোটেলের কাছেই একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাওয়া সারতে গেলাম, শ্নিৎজেল ছাড়া আর কিছু খাওয়ার কথা ভাবতেই পারিনি। এইখানে চুপিসারে একটা বিশয় মনে করিয়ে দেওয়া ভালো। ভিনার শ্নিৎজেল- কে তখনই ভিনার শ্নিৎজেল বলা যাবে, যখন তা ভিল অর্থাৎ বাছুরের মাংস থেকে হবে। শুয়োরের মাংস থেকে হলে তাকে আর টেকনিক্যালি ভিনার শ্নিৎজেল বলা চলে না। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টির সঙ্গে কনকনে হাওয়াকে সামাল দিতে আমাদের টেবিলে প্রথম এল অস্ট্রিয়ান লাল ওয়াইন আর পার্বত্য চিজ। আল্পসের গা-ঘেঁষা দেশগুলিতে এই চিজের সমাহার সত্যিই বিস্ময়কর! আরও বিস্ময়কর এই যে প্রতিটি দেশে আলাদা আলাদা ঘরাণা। স্বাদ এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রত্যেকেই অনন্য। কিন্তু চিজ এমন এক সংবেদনশীল বিষয়, তাকে নিয়ে আলোচনা আলাদা পরিসরেই হওয়া উচিত। সেদিনের পরবর্তী অধ্যায় প্রসঙ্গে একটাই কথা উল্লেখ্য। তা হচ্ছে সেদিনের শ্নিৎজেলটি ছিল শুয়োরের মাংসের। যথেষ্ট উপাদেয় হওয়া সত্ত্বেও তাকে সেরা উপাধি দেওয়া যাবে না কিছুতেই। আরেক সেরার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল পরদিন প্রাতরাশের সময়। তিনি ‘আপফেলস্ট্রুডেল’। নাম থেকেই মোটামুটি মালুম হচ্ছে বিষম এই খাদ্যটি আপেল পরিবারভুক্ত। যা একেবারে বোঝা সম্ভব নয়,তা হল এর অন্তরালে লুকিয়ে থাকা মুনশিয়ানা। ফিলো পেস্ট্রি শিটের মোড়কে বিশেষভাবে তৈরি আপেলের পুরকে ভরে দেওয়া হয় আর লম্বাটে সেই বস্তুটিকে দেওয়া হয় ঘোড়ার খুরের আকৃতি। অতঃপর ওপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় মিহি চিনির গুঁড়ো। এবার নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বেকিং-এর পালা। মুচমুচে হয়ে তিনি যখন আভেন থেকে আত্মপ্রকাশ করেন, তাঁর সেই সোনালি শোভার প্রেমে না পড়ে উপায় কী? এ তো গেল বাহ্যিক ব্যাপার! আসল খেলা ফিলো পেস্ট্রি শিট তৈরি করার মধ্যে। রুমালি রুটির চেয়েও অনেক ফিনফিনে ময়দার (শুধু ময়দা অবশ্যই নয়, আছে আরও অনেক উপকরণ) এই চাদরের এপাশ-ওপাশ দেখা যায়, কাচের জানালার মতো। তাই যখন আপেলের পুরকে ঢেকে দেওয়া হয় এই চাদর দিয়ে, বাইরে থেকে দিব্যি দেখা যায় অন্দরমহলকে। বেকিং-এর পর তাই এমন বস্তুকে কাটার জন্য ইলেকট্রিক ছুরি লাগবে, তা কি খুব আশ্চর্যের?

আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকা থেকে অস্ট্রিয় রান্নাঘরের যে পদটিকে তুলে আনতে চাই, তার আস্বাদন করতে হয় সাধারণত কফির সঙ্গে, কিন্তু শেষপাতে তাকে হাজির করানো হলে কেউই খুব আপত্তি করবে বলে মনে হয় না। ‘সাখারটর্টে’। কিংবদন্তিসম খ্যাতি আছে এই চকোলেট কেকের। এমন একটি জিনিসের দেখা পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে তিন বছর আগে পর্যন্ত। কষ্ট না করলে কেষ্ট না মেলার কথা জানা ছিল অবশ্য আর এই বিশেষ সুনামসম্পন্ন কেকটির অপরূপ কৃষ্ণবর্ণের বর্ণনা করা মুশকিল। তার চেয়ে মনমাতানো কফির সঙ্গে অসামান্য এই কেকটি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার চেয়ে ভালো কিছুই হতে পারে না। ভিয়েনা শহরের এক পড়ন্ত বিকেলে হাজির হয়েছিলাম এমন এক রাস্তার মোড়ে, যেখানে অনেকগুলি পথ এসে মিশেছে। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি ক্যাফে। সামনে দাঁড়িয়ে সুসজ্জিত, সুভদ্র চেহারার একজন মানুষ। রোদ চশমার আড়াল থেকেও যেন তাঁর পুরো মুখখানি দেখতে পেলাম। তিনি আমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।

এ এক রূপকথা। ১৮৩২ সন। প্রিন্স ক্লেমেন্স হ্বেন্সেল ভন মেটারনিশ তাঁর পাচকদের বিশেষ অভ্যাগতদের জন্য একটি ডেসার্ট তৈরির আদেশ দিলেন। ভাগ্যের আশ্চর্য পরিহাসে অনুষ্ঠানের আগের দিন প্রধান রাঁধুনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন আর সেই পদটি তৈরির দায়িত্ব বর্তাল বারো বছর বয়সী ফ্রানৎস্‌ সাখার-এর ওপর। চকোলেট আর ক্রিমের যুগলবন্দীতে সেই বালক সৃষ্টি করল এমন এক ডেসার্ট, আজ প্রায় দুশো বছর পরও আকাশছোঁয়া যার জনপ্রিয়তা। একে অস্ট্রিয়ান জাতীয় খাবার আখ্যা দিলেও কোনও অত্যুক্তি হবে না। বহুদিন পর্যন্ত ‘হোটেল সাখার’ এই কেকটির একমাত্র সত্ত্বাধিকারী ছিল এবং সারা অস্ট্রিয়ায় চূড়ান্ত গোপনীয়তায় মোড়া এদের রেসিপি থেকে তৈরি একমাত্র ‘সাখারটর্টে’ হিসেবে পাওয়া যেত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর আগে ‘ডেমেল পেস্ট্রি শপ’ ‘এডুয়ার্ড সাখারটর্টে’ নাম দিয়ে এর আরেকটি সংস্করণ বাজারে নিয়ে আসে। এই এডুয়ার্ড ছিলেন ফ্রানৎস্‌ সাখার-এর পুত্র। স্বভাবতই সৃষ্টি হয় এক দ্বন্দ্বের, যা গড়ায় কোর্ট পর্যন্ত এবং শেষ অবধি তাতে জয়লাভ ঘটে ‘হোটেল সাখার’-এর। এসব নিছক তথ্য। নির্যাসটা হল ‘সাখারটর্টে’ একটি চকোলেট কেক। সারা পৃথিবীতে চকোলেট কেক অনেক থাকলেও ‘সাখারটর্টে’একটিই। রসনার পক্ষপাতিত্বের কি কোনও কারণ হয়? সেদিন সেই ক্যাফেতে কফি আর সাখারটর্টের পর্ব শেষ করে বেরিয়ে আসার সময়ও দেখলাম সেই ভদ্রলোক রোদচশমা খোলেননি আর ঠোঁঠের কোণে আলগোছে লেগে রয়েছে একচিলতে হাসি। গর্বের?

0 comments: