‘জিগীষা দেবী কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ হইয়া রহিলেন, তারপর শিষ দিয়া ডাকিলেন "সুষু, সুষু-"। একটি ছোট প্রাণী গুটগুট করিয়া ঘরে আসিল। কুত্তা নয়। ইনি সুষেণবাবু, জিগীষা দেবীর স্বামী। রোগা, বেঁটে, চোখে চশমা, মাথায় টাক, কিন্তু গোঁফ জোড়া বেশ বড় এবং মোম দিয়ে পাকানো। সতী সাধ্বী যেমন সর্বহারা হইয়াও এয়োতের লক্ষণ শাঁখা-জোড়াটি শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে, বেচারা সুষেণবাবুও তেমনি সমস্ত কর্তৃত্ব খোয়াইয়া পুরুষত্বের চিহ্ন স্বরূপ এই গোঁফ জোড়াটি সযত্নে বজায় রাখিয়াছেন।’
‘প্রবাদ আছে - প্রজা যেমন, তার ভাগ্যে শাসনও তেমনই জোটে। আমাদের দেশের কর্তব্যজ্ঞান না বাড়ালে শাসনের উৎকর্ষ হবে না। দেশের শিক্ষিত জনের সংখ্যা যতই হোক, তারাই উদ্যোগী হয়ে জনসাধারণকে সুবুদ্ধি দিতে পারেন, যাতে তারা প্রজার অধিকার আর কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন হয়। কিন্তু শিক্ষিত সম্প্রদায় উদাসীন, তাঁদের অধিকাংশ নিজের ধান্দা বা শখ নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু একটা প্রবল মানসিক মাদক এদেশের জনসাধারণকে অভিভূত করে রেখেছে, শিক্ষিত সম্প্রদায়ও তার কবল থেকে মুক্ত নয়। আমরা ধর্মপ্রাণ জাতি বলে গর্ববোধ করি, কিন্তু আমাদের ধর্মের অর্থ প্রধানত বাহ্য অনুষ্ঠান, নানা রকম অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস এবং ভক্তির চর্চা। অর্থাৎ পুরোহিত মারফত পূজা, কবচ-মাদুলি, আর যদি ভক্তি থাকে তবে ইষ্টদেবের আরাধনা। যদি সাধারণ জীবনযাত্রা অন্ধ সংস্কারের বশে চলে তবে জাতির অধোগতি অবশ্যম্ভাবী।’
‘বাংলা ভাষার জননী সংস্কৃত হতে পারেন, কিন্তু গ্রীক ফারসি আরবী পর্তুগিজ ইংরেজিও আমাদের ভাষাকে স্তন্যদানে পুষ্ট করেছে। যদি প্রয়োজনসিদ্ধির জন্য সাবধানে নির্বাচন করে আরও বিদেশী শব্দ গ্রহণ করি, তবে মাতৃভাষার পরিপুষ্টি হবে, বিকার হবে না। অপ্রয়োজনে আহার করলে অজীর্ণ হয়, প্রয়োজনে হয় না। যদি বলি - 'ওয়াইফের টেম্পেরটা বড়োই ফ্রেটফুল হয়েছে' তবে ভাষাজননী ব্যাকুল হবেন। যদি বলি - 'মোটরের ম্যাগনেটোটা বেশ ফিনকি দিচ্ছে', তবে আমাদের আহরণ শক্তি দেখে ভাষাজননী নিশ্চিন্ত হবে।’
এই তিনটি লেখাই যখন একজনের হতে হয়, তখন মানুষটা পরশুরাম না হয়ে উপায় নেই। যাঁর সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন “আমি পৃথিবীর কোনো সাহিত্য আমার পড়া থেকে বাদ দিইনি। রাজশেখরবাবু যে কোনো সাহিত্যে পদার্পণ করলে সে সাহিত্য ধন্য হত। এ কথা বলার অধিকার আমার আছে।”
পরশুরাম এমনই একজন মানুষ যার জন্য আমাদের অতি প্রিয় এবং ক্লিশে হয়ে যাওয়া 'রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি' প্রবাদটা খাটে না। পেশাগত জীবনে চূড়ান্ত সফল হয়েও যে মাতৃভাষার চর্চা করা করা সম্ভব সেটা উনি সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বাঙালিও ছিলেন আবার মানুষও হয়েছিলেন।
২৩ বছর বয়সে ১৯০৩ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ, সেই বছরই বেঙ্গল কেমিক্যালসে কেমিস্টের পদে যোগদান আর অল্প কয়েক বছরে মধ্যেই ম্যানেজার পদে উন্নীত। ১৯৩২ সালে ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে একপ্রকার অবসর নিতে বাধ্য হন, কিন্তু সংস্থার টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসর পদে রইলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
৪২ বছর বয়সে প্রথম গল্প প্রকাশ, যা বাংলার সাহিত্যের মৌচাকে সরাসরি ঢিল মারে। এরপর আসতে থাকে একের পর এক সরস সাহিত্যের মণিমাণিক্য, যেখানে হাস্যরস বা ব্যঙ্গের তাগিদে গুণগত মানের কোথাও কোনো চ্যুতি ঘটে না, কোনো ছ্যাবলামি প্রকাশ পায় না। অথচ প্রতিটি রচনার পটভূমিতে থাকে তাঁর পাণ্ডিত্যের এক বিশাল ব্যাপ্তি, কোনো বাড়তি দেখানদারি ছাড়াই। এর পাশাপাশি চলতে থাকে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধকরণের কাজ— কখনও বা চলন্তিকা সৃষ্টিতে, কখনও পরিভাষা রচনায়, আবার কখনো বা রামায়ণ বা মহাভারতের মতো মহাকাব্যের বাংলায় সাবলীল অনুবাদে। সাহিত্য রচনার সেই প্রবাহ চলতে থাকে আজীবন, চরম পারিবারিক দুঃসময়ও কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
প্রথম বই 'গড্ডালিকা' প্রকাশের পর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লেখেন “পিতৃদত্ত নামের উপর তর্ক চলে না কিন্তু স্বকৃত নামের যোগ্যতা বিচার করিবার অধিকার সমালোচকের আছে। পরন্তু অস্ত্রটা রূপধ্বংসকারীর, তাহা রূপসৃষ্টিকারীর নহে। পরশুরাম নামটা শুনিয়া পাঠকের সন্দেহ হইতে পারে যে লেখক বুঝি জখম করিবার কাজে প্রবৃত্ত। কথাটা একেবারেই সত্য নহে। বইখানি চরিত্র চিত্রশালা। মূর্তিকারের ঘরে ঢুকিলে পাথর ভাঙার আওয়াজ শুনিয়া যদি মনে করি ভাঙাচোরাই তাঁর কাজ, তবে সে ধারণাটা ছেলেমানুষের মতো হয়, ঠিকভাবে দেখিলে বুঝা যায় গড়িয়া তোলাই তাহার ব্যবসা।”
প্রথম লেখা ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’-এ খুব স্পষ্ট হয়ে যায় তাঁর জ্ঞানের পরিধি। একটা ভাঙা মন্দিরের আধুনিকীকরণের নাম করে কোম্পানি খোলা হয়, আর তার প্রসপেক্টসে লেখা থাকে “ধর্মই হিন্দুদের প্রাণস্বরূপ। ধর্মকে বাদ দিয়া এ জাতির কোনও কর্ম সম্পন্ন হয় না। অনেকে বলেন - ধর্মের ফল পরলোকে লভ্য। ইহা আংশিক সত্য মাত্র। বস্তুত ধর্মবৃত্তির উপযুক্ত প্রয়োগে ইহলৌকিক ও পরলৌকিক উভয়বিধ উপকার হইতে পারে। এতদর্থে সদ্য সদ্য চতুবর্গ লাভের উপায়স্বরূপ এই বিরাট ব্যাপারে দেশবাসীকে আহ্বান করা হইতেছে।
ভারতবর্ষের বিখ্যাত দেবমন্দিরগুলির কিরূপ বিপুল আয় তাহা সাধারণে জ্ঞাত নহেন। রিপোর্ট হইতে জানা গিয়াছে যে বঙ্গদেশের একটি দেবমন্দিরে দৈনিক যাত্রীসংখ্যা গড়ে ১৫ হাজার। যদি লোক-পিছু চার আনা মাত্র আয় ধরা যায়, তাহলে বাৎসরিক আয় প্রায় সাড়ে তেরো লক্ষ টাকা দাঁড়ায়। খরচ যতই হউক, যথেষ্ট টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। কিন্তু সাধারণে এই লাভের অংশ হইতে বঞ্চিত।
দেশের এই বৃহৎ অভাব দূরীকরণার্থে 'শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড' নাম একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি স্থাপিত হইতেছে। ধর্মপ্রাণ শেয়ার হোল্ডারগণের অর্থে একটি মহান তীর্থক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠা হইবে, জাগ্রত দেবী সমন্বিত সুবৃহৎ মন্দির নির্মিত হইবে। উপযুক্ত ম্যানেজিং এজেন্টের হস্তে কার্য-নির্বাহের ভার ন্যস্ত হইয়াছে। শেয়ার হোল্ডারগণ আশাতীত দক্ষিণা বা ডিভিডেন্ড পাইবেন এবং একাধারে ধর্ম অর্থ মোক্ষ লাভ করিয়া ধন্য হইবেন।”
এই ধরণের start up এর ধারণা একশো বছর আগে নিয়ে এসেছিলেন, যা আজও কিছু শ্রেণীর মানুষের কাছে সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক।
কিন্তু এ তো গেল কোম্পানির প্রসপেক্টসের কথা। এবার আসল গ্যাঁড়াকল হল কোম্পানির ভেতরে, যেখানে কোম্পানির কিছু ডিরেক্টর শলা করে নিজেদেরকে ম্যানেজিং এজেন্টস বলে ঘোষণা করলো। বাকি ডিরেক্টররা বললো যে তারা ম্যানেজিং এজেন্টদের থেকে ধার করে নিজের নিজের শেয়ারের টাকা কোম্পানিকে দিচ্ছে, আবার কোম্পানি ওই টাকা ম্যানেজিং এজেন্টদের কাছে গচ্ছিত রাখছে। অর্থাৎ কিনা গাঁট থেকে কারোর কোনো টাকা বেরোলো না, শুধু খাতায় জমা থাকলো।
কর্পোরেট স্ট্রাকচার আর কর্পোরেট ফান্ডিং নিয়ে কত জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা থাকলে কেউ এই ধরণের চিন্তা এতো সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। আজ ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে বড়ো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন নতুন ভেঞ্চারগুলো শুরু করে সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় উদ্যোক্তাদের পরিকল্পনায় ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ ছায়া প্রকটমান।
এরপরেই যখন দেখি ‘চিকিৎসা বিভ্রাট’, সেখানে বোঝা যায় চিকিৎসাবিদ্যার সব বিভাগের ওপর তাঁর সুস্পষ্ট ধারণার কথা। তার সাথে থাকে সমস্ত বিভাগীয় চিকিৎসকদের চিকিৎসার ধরনধারন, নিজেদের সীমাবদ্ধতা আর তার সাথে রোগী ঠকানোর পদ্ধতি। রোগের নাম জানতে চাইলে অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার বলে Cerebral Tumour with Strangulated Ganglia, যাতে নাম শুনেই রোগী ভিরমি খেয়ে যায়। সেখানে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক যথারীতি এড়িয়ে গিয়ে বলে, "তা জেনে তোমার চারটে হাত বেরোবে নাকি?" কবিরাজ বলে, "এটা উদুরি। আবার উর্ধশ্লেষাও কইতি পার।" আর হাকিম মাথা টিপে বলে 'হড্ডি পিলপিলায় গয়া'। এতো কাণ্ডের পরও কিন্তু রোগীর রোগ আর ধরা পড়ে না। শেষমেশ অনামা কিন্তু বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন মিস মল্লিক আসল কারণ ধরে ফেলে বলেন, “আপনার একজন অভিভাবক দরকার।”
'ভুশণ্ডীর মাঠে' গিয়ে তো জন্মান্তর নিয়ে একটা আস্ত time series analysis করে ফেলেন। ব্রহ্মদত্যি শিবু মরার পর বিয়ে করতে গেল এক ডাকিনীকে, বিয়ের পিঁড়িতে উঠে বুঝতে পারে পাকেচক্রে সেই তার হালের বউ নৃত্যকালী। তখন কোথা থেকে এক পেত্নী আর শাঁকচুন্নি এসে বলে তারা নাকি শিবু আগের জন্মগুলোর বিয়ে করা বউ। চুলোচুলি যখন প্রায় ক্লাইম্যাক্সে তখন সেই নৃত্যকালীও দেখে তার আগের জন্মের স্বামীরা এসে হাজির। যথারীতি কেউ কারোর পাওনাগণ্ডা একচুল ছাড়তে নারাজ। এই জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি পরজন্মবাদীদেরকে তাদের বিশ্বাসের বা চিন্তার দৈন্যটা নতুন করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
এর সঙ্গে জুড়ে আছে তাঁর স্বভাবজাত অভিনব হাস্যরস, যেখানে হাসির আড়ালে কটাক্ষ থাকে এই অন্ধবিশ্বাসীদের জন্য। নাস্তিকের আত্মা মরলে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন প্রভৃতি গ্যাসে পরিণত হয়। সাহেবদের আস্তিক আত্মারা বিচারের আগে বড়ো ওয়েটিং রুমে জমায়েত হয়। আর হিন্দুদের জন্য অন্য ব্যবস্থা, কারণ তাঁরা তো স্বর্গ, নরক, কর্মফল, ঋষিকেশ, নির্বাণ, মুক্তি সবই মানে। তাই ভূতেদের থেকে থেকে স্বর্গ নরকের মাঝে চেঞ্জে পাঠানো হয়।
আরও একটু বিশদে দেখলে দেখা যায় যে এই Time Series নিয়ে ইচ্ছামতো খেলা করাটা বোধকরি পরশুরামের খুব প্রিয়। তাঁর লেখায় আকছার কোনো এক সময়ের পৌরাণিক চরিত্র অন্য timezone এ চলে যায় অথবা অন্য সময়ের প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে স্বচ্ছন্দে কথা বলতে শুরু করে দেয়। যেমন 'গন্ধমাদন-বৈঠক' গল্পে দেখা যায় পুরাণের সাতজন চিরজীবী একদিন গন্ধমাদন পাহাড়ে দেখা ক’রে নিজেদের সুখ দুঃখের গল্প শুরু করে; পরে তা গড়ায় ধর্মযুদ্ধ নিয়ে গভীর তাত্ত্বিক আলোচনায়।
আবার 'নির্মোক নৃত্য' গল্পে উর্বশী যখন স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে যেতে চায়, তখন ইন্দ্র আর নারদের সঙ্গে বাদানুবাদের মধ্যে উর্বশী অনায়াসে রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশী’ কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে বলে, "মর্ত্যের এক কবি লিখেছেন 'মুনিগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল, তোমারি কটাক্ষপাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল।' অমরাবতীর কোন কবি এমন লিখতে পারে?"
তাঁর লেখায় পরতে পরতে এমন প্রচুর উদ্ভাবনী চিন্তার ছাপ পাওয়া যায় যেখানে পুরাণ বা ঐতিহাসিক জীবনধারায় ঢুকে পড়ে আধুনিক জীবনের কথা বা তার চলতি সমস্যার অনুরূপ প্রকাশ। 'তিন বিধাতা' গল্পে ব্রহ্মাকে দেখেই গড ভ্রুকুটি করে বললেন, "তুমি কী করতে এসেছ? তোমাকে তো আজকাল কেউ মানে না, শুধু বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রে তোমার ছবি ছাপা হয়।"
'জাবালি' গল্পে জাবালির স্ত্রী হিন্দ্রলিনী মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আক্ষেপ করেন যে তিনি 'তাঁর বাবার কাছে শুনেছিলেন, সত্যযুগে এক কপর্দকে সাত কলস খাঁটি হৈয়ঙ্গবীন মিলিত, কিন্তু এই দগ্ধ ক্রেতাযুগে মাত্র তিন কলস পাওয়া যায়, তাও ভয়সা।' এই রকম অভিনবত্বের ধাক্কায় পাঠককুল বিহ্বল হয়ে পড়ে, আবার মেতে ওঠে এক নির্মল হাসির আনন্দে। এই ভালোলাগার আবেশের মধ্যে থেকে সবকিছুকে নতুন করে চিনতে বা ভাবতে বাধ্য করেন লেখক।
জাবালি চরিত্রটাকে খুঁটিয়ে দেখলে মনে হয় সে যেন পরশুরামেরই আত্মস্বরূপ। জাবালি এমন একটি ব্যক্তিত্ব যে কিনা নিজের ভাবমূর্তি সম্পর্কে উদাসীন, ব্যক্তিজীবনের সুখ-দুঃখে অবিচল, ধর্মবোধে বিশ্বাস রাখে, কিন্তু কোনো দৈবে বিশ্বাসী নয়। কোনো প্রচলিত প্রতিষ্ঠানকে সে কোনো বাড়তি গুরুত্ব দিতে নারাজ, চোখে চোখ রেখে তাদেরকে অস্বীকার করে, হেয় করে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তাদের দুর্বলতাগুলো। বালখিল্য মুনিরা এসে যখন তাকে অভিসম্পাত করে চন্দ্র, সূর্য, তারা, দেবগণ, পিতৃগণ ইত্যাদিকে সাক্ষী রেখে তখন জাবালি তার জবাবে বলে 'শৌণ্ডিকের সাক্ষী মদ্যপ, তস্করের সাক্ষী গ্রন্থিছেদক।'
দক্ষ প্রজাপতি এসে যখন তার কাছে জানতে চায় যে সে নাস্তিক কিনা আর কীই বা তার মার্গ বা শাস্ত্র, তখন জাবালি বলে 'আমি নাস্তিক কী আস্তিক তাহা আমি নিজেই জানি না। বিধাতা যে সামান্য বুদ্ধি দিয়েছেন তাহারই বলে কোনও প্রকারে কাজ চালাইয়া লই। আমার মার্গ যত্র তত্র, আমার শাস্ত্র অনিত্য, পৌরুষেয়, পরিবর্তনসহ।' দক্ষ যখন এই কথার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারে না, তখন জাবালি বলে 'হে ছাগমুণ্ড দক্ষ, তুমি বুঝিবার বৃথা চেষ্টা করিও না।' আবার স্বয়ং ব্রহ্মা তাকে বর দান করতে এলে জাবালি উল্টে বলে 'ঢের হয়েছে, আর বরে কাজ নাই। আপনি সরিয়া পড়ুন, আর ভেংচাইবেন না।'
অথচ তার নিজস্ব কর্তব্য জ্ঞান প্রখর, আর দূরদৃষ্টিও বাকি সবার থেকে স্বতন্ত্র। সেই কর্তব্যবোধ থেকে জাবালি বনবাসী রামকে অনুরোধ করে রাজ্যশাসন পিতৃআজ্ঞা উপেক্ষা করে ফিরে এসে রাজ্যের ভার নিতে। তাকে বলে 'দশরথ তোমার কেহ নহেন; তিনি অন্য, তুমিও অন্য। যাহারা প্রত্যক্ষ সিদ্ধ পুরুষার্থ পরিত্যাগ করিয়া কেবল ধর্ম লইয়া থাকে, আমি তাহাদিগের নিমিত্ত ব্যাকুল হইতেছি, তাহারা ইহলোকে বিবিধ যন্ত্রণা ভোগ করিয়া অন্তে মহাবিনাশ প্রাপ্ত হয়। যে সমস্ত শাস্ত্রে দেবপূজা যজ্ঞ তপস্যা দান প্রভৃতি কার্যের বিধান আছে, ধীমান মনুষ্যেরা কেবল লোকদিগকে বশীভূত করিবার নিমিত্ত সেইসকল শাস্ত্র প্রস্তুত করিয়াছে। অতএব রাম, পরলোকসাধন ধর্ম নামে কোনো পদার্থই নাই, তোমার এইরূপ বুদ্ধি উপস্থিত হউক।'
কবিশেখর কালিদাস রায় পরশুরামকে নিয়ে বলেছিলেন "তিনি কাহারো স্তব প্রশস্তি গান করেন নাই, ভূমিকা, পরিচায়িকা, প্রশংসা ইত্যাদির পুটে প্রসাদ বিতরণ করেন নাই, অযোগ্যকে মিথ্যা স্তোকবাক্যে আশ্বস্ত করেন নাই, আচার্য সাজিয়া সহস্রের প্রথাগত প্রাণিপাত ও মুদ্রিত অর্ঘ্য গ্রহণ করেন নাই।"
স্ত্রীর মৃত্যুর পর পরশুরাম চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যকে লিখছেন 'আমার স্বভাব কতকটা অসাড়, সেজন্য মনে হয় এই অন্তিম বয়সে সামলাতে (শোক) পারব।' সেই দেখে চারুচন্দ্রের মনে হয়েছিল যে কথাটা ঠিক নয়, তিনি গীতা উদ্ধৃত করে বলেন—
“যাঁহার চিত্ত দুঃখপ্রাপ্ত হইয়াও উদ্বিগ্ন হয় না ও বিষয়সুখে নিস্পৃহ এবং যাঁহার রাগ ভয় ও ক্রোধ নিবৃত্ত হইয়াছে, সেই মননশীল পুরুষ স্থিতপ্রজ্ঞ। অনেকদিন অনেকবার অতি নিকট হইতে তাঁহাকে দেখিয়াছি। তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ।”
স্থিতপ্রজ্ঞ না হলে একই দিনে কন্যা আর জামাতার মৃত্যুসংবাদে কেউ অবিচল থাকতে পারেন না। তিনি শুধু স্থিতপ্রজ্ঞই নন, তিনি কর্মযোগীও বটে। তাই জীবনের কোনো ঘাত প্রতিঘাতেই নিজস্ব জীবনদর্শন থেকে তিনি বিচ্যুত হন না, একমাত্র কর্মেই তাঁর চরম মোক্ষপ্রাপ্তি।
হাস্যরসে মোড়া পরশুরামের লেখাগুলো সব সময় যে পৌরাণিক চরিত্রগুলোকে ব্যঙ্গ করেছে তাই নয়, কখনো কখনো কাল্পনিক বা আমাদের চারপাশের বাস্তব চরিত্রগুলোও রেহাই পায়নি। এর সঙ্গে পরতে পরতে রয়েছে সূক্ষ্মমাত্রার রসিকতা, ব্যঙ্গ-শ্লেষের মিশেলে। পাঠকের কাছে যা আসে এক সুমধুর ধাক্কা হয়ে। তাঁর চরিত্রগুলোকে দেখলে মনে হয় এতদিনের চেনা পুরোনো, আমাদের চারপাশেই দিনরাত্রি দেখতে পাই। হয়তো পাঠক নিজেও এই রকম কোনো না কোনো দোষে দুষ্ট, অথচ এই তিরস্কারগুলো কারোর গায়ে লাগে না, বরং একটা আত্মসমালোচনার জায়গা তৈরী করে।
দেখা যায় শর্টকাটে পুণ্য অর্জন করতে কোনো ধর্মের ব্যবসায়ী ১২ লাইনের দুর্গানাম লেখা স্ট্যাম্প খোদাই করে, যাতে ৯ বার ছাপলেই ১০৮ বার সম্পূর্ণ হয়। আছে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর পুণ্যের দালালির খেলা, কোনো বউপাগল স্বামী বাঘের দৈর্ঘ্য নিয়ে কথা বলতে গিয়েও বউকে টেনে আনে, আবার আপাত নাস্তিক বাঙালি সবার আড়ালে চেয়ে বসে মানমর্যাদা বাড়ানোর কোনো মাদুলি।
'সরলাক্ষ হোম' গল্পে সরলচন্দ্র সোম কাজকর্ম জোটাতে না পেরে গোয়েন্দা হবার চেষ্টায় শার্লক হোমসকে নকল করে নাম নিয়ে বসে সরলাক্ষ হোম, সাকরেদ জোটায় ডাক্তার বটুক সেনকে। বটুক নিজে মুখেই বলে দেয় 'আমি ওয়াটসনের মতো হাঁদা নই।'
আবার নীলতারা গল্পে এই শার্লক হোমসকে দেখে আধপাগলা মাস্টার রাখাল মুস্তাফি হোমসের বিখ্যাত সায়েন্স অফ ডিডাকশন তারই ওপর চালিয়ে রীতিমতো ভিরমি খাইয়ে দেয়। হোমসকে দেখেই রাখাল এক এক করে বলে দেয় যে হোমস এদেশে প্রথম এসেছে, কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি, আগের দিন লঙ্কা খেয়েছিলো ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসবের সাথে কোথাও পরতে পরতে রয়েছে ঋতু বিশেষে প্রকৃতির মনোরম বর্ণনা। যেখানে প্রকৃতি, প্রাণী আর মানুষের বিবরণ এতটাই সম্পূর্ণ যে সেটা শুধু সুদৃশ্যই নয়, পাঠকের মনে এক মুগ্ধতার আবেশ তৈরী করে।
কচি সংসদে শরৎকাল নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন রৌদ্রে কাঁসার রং, রোগা রোগা ফুলকপির বাচ্ছা বিকোচ্ছে, পানাপুকুর থেকে জুঁই ফুলের গন্ধে চারদিক ম-ম করছে, ছাতিম ফুলের উগ্র গন্ধ নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে, পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যাতারা যেন পথ প্রদর্শক হয়ে চলছে সবার সাথে সাথে।
ভুশণ্ডীর মাঠে বসন্তের বিকেলের বর্ণনা করতে গিয়ে লিখছেন — 'গঙ্গার বাঁকের উপর দিয়া দক্ষিণ হাওয়া ঝির-ঝির করিয়া বহিতেছে। সূর্যদেব জলে হাবুডুবু খাইয়া এইমাত্র তলাইয়া গেছেন। ঘেঁটুফুলের গন্ধে ভুশণ্ডীর মাঠ ভরিয়া গিয়াছে। শিবুর বেলগাছে নতুন পাতা গজাইছে। দূরে আকন্দ ঝোপে গোটাকতক পাকা ফল ফট করিয়া ফাটিয়া গেলো, একরাশ তুলোর আঁশ হাওয়ায় উড়িয়া মাকড়শার কঙ্কালের মতো ঝিকমিক করিয়া শিবুর গায়ে পড়িতে লাগিল। একটা হলদে প্রজাপতি শিবুর সূক্ষ্মশরীর ভেদ করিয়া উড়িয়া গেল। একটা কালো গুবরে পোকা ভররর করিয়া শিবুকে প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল। অদূরে বাবলা গাছে একজোড়া দাঁড়কাক বসিয়া আছে। কাক গলায় সুড়সুড়ি দিতেছে, কাকিনী চোখ মুদে গদগদ স্বরে মাঝে মাঝে ক-অ-অ করিতেছে। একটা কটকটে সাদা ব্যাঙ সদ্য ঘুম থেকে উঠিয়া গুটিগুটি পা ফেলিয়া বেলগাছের কোটর হইতে বাহিরে আসিল, এবং শিবুর দিকে ড্যাবড্যাবে চোখ মেলিয়া টিটকিরি দিয়া উঠিল। একদল ঝিঁঝিপোকা সন্ধ্যার আসরের জন্য যন্ত্রে সুর বাঁধিতেছিল, এতক্ষণে সংগত ঠিক হওয়ায় সমস্বরে রিরিরিরি করিয়া উঠিল।" এইসব বর্ণনা তখন আর কেবলমাত্র গল্প থাকে না, পল্লীবাংলার পটভূমিতে যেন ভ্যান গঘের ক্যানভাস আর বেঠোভেনের সিম্ফনি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
লেখার ধরণ ব্যঙ্গাত্মক হলে সেখানে সাধারণভাবে প্রেম আসাটা দুষ্কর। কিন্তু পরশুরামের লেখায় প্রেম আসে সূক্ষ্ম স্তরে, কোনো উন্মাদনা ছাড়াই তা হয়ে যায় এক মিষ্টিমধুর উপাখ্যান। তাঁর গল্পে প্রেমিক-প্রেমিকারা পার্কে বসে থাকে না, গঙ্গার ধারে ঘুরে বেড়ায় না, হাত ধরাধরি করে প্রেমের গান গায় না। প্রেম থাকে নিঃশব্দে, সবার মধ্যে থেকেও অলক্ষ্যে খুব নিচু তারে চলতে থাকে মন দেওয়া নেওয়ার পালা। উনি নিজেই এক গল্পে সেটা প্রকারান্তরে বলেছেন সে কথা। 'এই প্রেমই কি নিকষিত হেম?' উত্তরে এক চরিত্র বলে, 'আজ্ঞে না। স্টেইনলেস স্টিল বলতে পারেন। সোনার জৌলুস নেই, লোহার মরচে নেই, ইস্পাতের ধার নেই।'
'বিরিঞ্চিবাবা'য় বুঁচকির শুধু 'যাঃ' বলাতেই যেন সব কিছু বলা হয়ে যায়। শুনে সত্য যতই ভেবলে যাক, পরিস্থিতি কিন্তু একটা মধুরেণ সমাপয়েৎ-মুহূর্ত সৃষ্টি করে।
'রটন্তীকুমার' গল্পে খগেনের প্রেম এগোয় ধীর গতিতে। সেখানে খগেনের চেয়ে প্রেমিকার ভাই রটাইয়ের উত্তেজনা বেশি। শেষে খগেন যখন বলে "এইবার হব হব(প্রেম)। তোমার দিদিমণিকে বলেছি, টাকার জন্য ভাবছো কেন, ও তো বাবার টাকা। আমার কাছে এলে তিন দিনে ফুঁকে দেব। তারপর হাত খালি করে কপোত কপোতী যথা উচ্চবৃক্ষচুড়ে বাঁধি নীড় থাকে সুখে, সেই রকম ফুর্তিতে থাকা যাবে।” পাঠকদের মনও রটাইয়ের মতো উতলা হয়ে পড়ে, দু’জনের গাঁটছড়া বাঁধা না হলে যেন তাদেরও শান্তি নেই। শেষে রটাইয়ের স্বরে পাঠকই যেন বলে ওঠে অনেক হয়েছে, নিন এবার চটপট ভাব করে ফেলুন দেখি।
পরশুরামের সৃষ্টির বেশিরভাগ লেখার মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায় তাঁর সুচিন্তিত সামাজিক চেতনার বিভিন্ন দিকগুলো। তাই পাপ-পুণ্য, ধর্ম-অধর্ম, রাজতন্ত্র-গণতন্ত্র, মানুষের অবিবেচক লোভ, ওপরচালাকি— এ সব কিছু বাইরের হাসির আড়ালে সুস্পষ্টভাবে উপস্থিত তাঁর লেখাগুলোতে। সবকিছুর মধ্যেই থাকে এক অনাবিল হাস্যরসের মোড়ক, যা তিরস্কারের ছলে সাবলীল ছন্দে বুঝিয়ে দেয় সমাজের গূঢ় তত্ত্বগুলোকে।
'রামরাজ্য' গল্পে হনুমানকে গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তার উত্তরে সে বলে, “তন্ত্রে রাজ্যশাসন হয় না, মানুষই রাজ্য চালায়। গণতন্ত্র বা যে তন্ত্রই হোক, তা শব্দ মাত্র, লোকে ইচ্ছানুসারে তার ব্যাখ্যা করে।... শাসনপদ্ধতির নাম যাই হোক দেশের জনসাধারণ রাজ্য চালায় না, তারা কয়েকজনকে পরিচালক রূপে নিযুক্ত করে, অথবা ধাপ্পায় মুগ্ধ হয়ে একজনের বা কয়েকজনের কতৃত্ব মেনে নেয়। এই কর্তারা যদি সুবুদ্ধি সাধু নিঃস্বার্থ ত্যাগী কর্মপটু হয় তবে রোজার সুখে থাকে। কিন্তু কর্তারা যদি মূর্খ হয় অথবা ধূর্ত অসাধু স্বার্থপর ভোগী আর অকর্মণ্য হয় তবে প্রজারা কষ্ট পায়, কোনো তন্ত্রেই ফল হয় না।”
আবার 'অটলবাবুর অন্তিম চিন্তা'য় লিখছেন, “পাপ পুণ্য তো যুগে যুগে বদলাচ্ছে। পঞ্চাশ ষাট বৎসর আগে মুরগি খেলে পাপ হত, এখন আর হয় না। সবাই বলে নরহত্যা মহাপাপ, কিন্তু এই সেদিন শান্তশিষ্ট ভদ্রলোকের ছেলেরাও বেপরোয়া খুন করছে, বুড়োরা উৎসাহ দিয়ে বলছে— এ হলো আপদধর্ম। পাপ পুণ্যের যখন স্থিরতা নেই তখন স্বর্গনরক অবিশ্বাস্য।”
'গামানুষ জাতির কথা'তে পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন পরিবেশের ওপর যথেচ্ছারের পরিণাম। “মৃতবৎসা বসুন্ধরা একটু জিরিয়ে নেবেন তার পর আবার সস্বত্তা হবেন। দুরাত্মা আর অকর্মণ্য সন্তানদের বিলোপে তাঁর দুঃখ নেই। কাল নিরবধি, পৃথিবীও বিপুলা। তিনি অলসগমনা, দশ-বিশ লক্ষ বৎসরে তাঁর ধৈর্য্যচ্যুতি হবে না, সুপ্রজাবতী হবার আশায় তিনি বারবার গর্ভধারণ করবেন।” এমন উপলব্ধি প্রায় ১০০ বছর পরে আজকের এই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠছে।
'ভীমগীতা' গল্পে ভীম আর কৃষ্ণের কথোপকথনে কৃষ্ণ যখন বলেন রিপু দমন করার কথা তখন ভীম একে একে যুক্তি সাজান এই বলে যে, "প্রথম তিনটি না থাকলে বংশরক্ষা হয় না, আত্মরক্ষা হয় না, ধনাগম হয় না।" কৃষ্ণ যখন বলেন যে অনেক যোগী তপস্বী আছেন যাঁদের মোটেই ক্রোধ নেই, তা শুনেও ভীম নিজ বক্তব্যে অটল। "তাঁদের কথা ছেড়ে দাও। তাঁদের স্বজন নেই, আত্মরক্ষার দরকার হয় না। সকলেই জানে তাঁরা শাপ দিয়ে ভস্ম করে ফেলতে পারেন, সেই জন্য কেউ তাঁদের ঘাঁটায় না, তারাও নির্বিবাদে অক্রোধী অহিংস হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু আমরা তপস্বী নই, তাই দুর্যোধন শত্রুতা করতে সাহস করে। অন্যায়ের প্রতিকার আর দুষ্টের দমনের জন্যই বিধাতা ক্রোধ সৃষ্টি করেছেন।”
কৃষ্ণ বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ধর্মযুদ্ধে ক্রোধ আর প্রতিশোধের প্রবৃত্তি বর্জনীয়। এই কারণেই দুর্যোধনের অপরাধের কথা অর্জুনকে মনে করিয়ে দেওয়া (যুদ্ধের আগে) আবশ্যক মনে করিনি। তাই শুনে ভীম বলেন, "প্রকাণ্ড ভুল করেছ। দু’ ঘন্টা ধরে তত্ত্বকথা শুনিয়ে অতি কষ্টে অর্জুনকে যুদ্ধে নামাতে পেরেছ। যদি তাকে রাগিয়ে দিতে তবে তখনই কাজ হত, কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ কিছুই দরকার হত না।"
এইখানে উল্লেখযোগ্যভাবে হনুমান আর ভীমের মতো চরিত্র নির্বাচনেও তাঁর নিজের ব্যক্তিত্বের একটা স্বরূপ কিন্তু দেখা যায়। দুটো চরিত্রই জাবালির মতো নিজ ক্ষমতার ওপর ভরসা করেছে, কোনো দৈবে নয়। সে চরিত্র ওঁর নিজের দর্শনের সাথেও সম্পূর্ণ সমঞ্জস। তিনি নিজেই এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন— 'আমাদের যেটুকু পুরুষকার আছে, দৈবের উপর নির্ভর করে তাও বিনষ্ট হচ্ছে।’
লেখকের যখন পরশুরাম থেকে রাজশেখর বসুতে রূপান্তর ঘটে, তখন চিন্তাধারা বা বক্তব্যে থাকে সেই একই রকম সুস্পষ্ট বুদ্ধিমত্তা ও সাবলীল গতি। তবে তার মধ্যে পরশুরামের হাস্যরসের বা ব্যঙ্গাত্মক মোড়কটা আর থাকে না। সেখানে রাজশেখরের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব যেন লক্ষণীয় ভাবে ফুটে ওঠে।
‘জাতিচরিত্র’ প্রবন্ধে 'রামরাজ্য'র মতো ঠিক একই রকম কথা ব্যক্ত হয়েছে, যদিও তা পুরোটাই রাশভারী ঢঙে, যেটা তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেখানে উনি বলছেন, “আমরা ধর্মপ্রাণ জাতি বলে গর্ব করি, কিন্তু আমাদের ধর্মের অর্থ প্রধানত বাহ্য অনুষ্ঠান, নানা রকম অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস, এবং ভক্তির চর্চা। অর্থাৎ পুরোহিত মারফৎ পূজা, কবচ-মাদুলি, আর যদি ভক্তি থাকে তবে ইষ্টদেবের আরাধনা। যদি সাধারণ জীবনযাত্রাও অন্ধ সংস্কারের বশে চলে তবে জাতির অধোগতি অবশ্যম্ভাবী।
মহাভারতে কৃষ্ণ ধর্মের এই অর্থ বলেছেন–- ধারণাদ্ধর্মমিত্যাহু ধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ–- ধারণ (রক্ষণ বা পালন) করে এজন্যই ধর্ম বলা হয়, ধর্ম প্রজাগণকে ধারণ করে। অর্থাৎ সমাজহিতকর বিধি সমূহই ধর্ম। প্রজার যা সর্বাঙ্গীন হিত তাই সমাজের হিত। প্রজা বলবান বিদ্যাবান বুদ্ধিমান নীতিমান বিনয়ী হবে, আত্মরক্ষায় ও দেশরক্ষায় প্রস্তুত থাকবে, দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করবে, সর্বপ্রকারে জনহিত চেষ্টা করবে - এই হল ধর্ম, এতেই লোকের কর্ম প্রবৃত্তি চরিতার্থ হয়।”
শুরুতেই ওঁর মাতৃভাষার যে পরিপুষ্টির কথা উল্লেখিত ছিল, সেই মাতৃভাষার সমৃদ্ধিকরণের জন্য উনি অক্লেশে কাজ করে গেছেন আজীবন। 'বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান' প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, 'বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চায় এখনো নানা রকম বাধা আছে। বাংলা পারিভাষিক শব্দ প্রচুর নেই। অনেক বৎসর পূর্বে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েক জন বিদ্যোৎসাহী লেখক নানা বিষয়ের পরিভাষা রচনা করেছিলেন। তাঁদের উদ্যোগের এই ত্রুটি ছিল, যে তাঁরা একযোগে কাজ না করে স্বতন্ত্রভাবে করেছিলেন, তার ফলে সংকলিত পরিভাষায় সাম্য হয়নি, একই ইংরেজি সংজ্ঞার বিভিন্ন প্রতিশব্দ রচিত হয়েছে। ১৯৩৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যে পরিভাষা-সমিতি নিযুক্ত করেছিলেন তাতে বিভিন্ন বিজ্ঞানের অধ্যাপক, ভাষাতত্ত্বজ্ঞ, সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এবং কয়েক জন লেখক একযোগে কাজ করেছিলেন, তার ফলে তাঁদের চেষ্টা অধিকতর সফল হয়েছে।'
১৯৩৪ এ প্রকাশিত চলন্তিকায় ২৬,০০০ বাংলা শব্দের সঙ্গে যোগ করেন কয়েক হাজার পারিভাষিক শব্দ। সেখানে বিজ্ঞান বা গণিতের সব বিভাগের অন্তর্ভুক্তির সাথে সহাবস্থানে ছিল অর্থনীতি, দর্শন এমনকী পাবলিক সার্ভিসেরও কিছু প্রয়োজনীয় পরিভাষা। ‘বীজগণিত’, ‘পাটীগণিত’, ‘পদার্থবিদ্যা’র মতো শব্দের সংযোজনের পাশাপাশি সেই তালিকায় সংযোজিত হয়ে যেমন symmetry প্রতিসাম্য হয়, paleontology হয় প্রত্নজীববিদ্যা কিংবা altruism হয় পরার্থবাদ, আবার ঠিক তেমনই লগারিদম, অরোরা, প্রোটোপ্লাজম মূল রূপে অবিকৃত থাকে।
চলন্তিকা প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, "এতদিন পরে বাঙলা ভাষার অভিধান পাওয়া গেল।" এমন এক সময় এই স্বীকৃতি এল যখন খোদ রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-এর কাজ চলছে পুরো মাত্রায়।
এরপর বাংলা ভাষায় রামায়ণ মহাভারত লিখতে গিয়ে তাঁর উপলব্ধি— “রামায়ণ রাম-রাবণ প্রভৃতির এবং মহাভারত ভরতবংশীয়গণের জীবনবৃত্তান্ত। এই দুই গ্রন্থের রচয়িতারা নির্লিপ্ত সাক্ষীর ন্যায় অনাসক্তভাবে সুখদুঃখ মিলনবিরহ প্রভৃতি জীবন দ্বন্দ্বের বর্ণনা করেছেন। তাঁদের পরোক্ষ উদ্দেশ্য পাঠকের মনেও অনাসক্তি সঞ্চার করা। তাঁরা শ্মশানবৈরাগ্য প্রচার করেন নি, বিষয়ভোগও ছাড়তে বলেন নি, শুধু এই অলঙ্ঘনীয় জাগতিক নিয়ম শান্তচিত্তে মেনে নিতে বলেছেন।”
শেষ বয়সে নিজের মূল্যায়ন করতে বসে বলেন, “আসলে আমি আধা মিস্ত্রী, আধা কেরানী। অভিধান তৈরী আর পরিভাষা নিয়ে নাড়াচাড়া মিস্ত্রীর কাজ, রামায়ণ মহাভারত অনুবাদ কেরানীর কাজ।” আরও একবার যেন মনে করিয়ে দেন সেই কবেকার কথা— 'বিদ্যা দদাতি বিনয়ং'।
এমন মানুষের মূল্যায়ন সব সময় আমাদের মতো আমপাঠকের পক্ষে করা সম্ভব নয়। যথার্থ বিবৃতি এসেছিল রবীন্দ্রনাথের থেকে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন "আমি রস যাচাইয়ের নিকষে আঁচড় দিয়ে দেখলাম আপনার বেঙ্গল কেমিক্যালের এই মানুষটি একেবারেই কেমিক্যাল গোল্ড নন, ইনি খাঁটি খনিজ সোনা।"
রাজশেখর বসু থাকুন বাঙালির জীবনে সুখে-দুঃখে, উত্থানে-পতনে পরশুরামের মতো অমর হয়ে। সৃষ্টিগুলো হয়ে থাকুক হাতের কুঠার, তার শানিত আঘাত আমাদেরকে বারে বারে মনে করিয়ে দিক তাঁর জীবনদর্শন, মূল্যবোধ আর উৎকর্ষের কথা।
0 comments: