Next
Previous
0

গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in







রাত সাড়ে আটটা। সমাবেশ ভেঙ্গে গেছে। পার্টি সমাবেশের খবর টবর, খিচিক খিচিক ফটো তোলা, লোকেদের ইন্টারভিউ এসব ফিনিস। এবার ঘরে ফিরবো ফিরবো করছি।

তখনই দেখি রাস্তার সামনের ফুটপাথে যুবতী মেয়েটা। হাতে একটা থলি। মুখে ক্লান্তির ছাপ। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। সন্দেহ হোলো। মেয়েটিকে পরিচয় দিলাম - আমি একজন কাগজের রিপোর্টার।

জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি জানালো - কর্তার সাথে সে মেলায় এসেছিল। তেনাকে খুঁজে পাচ্ছেন না!

বাড়ি কোথায়?

অনেক দূরে বাবু! ওই সুন্দরবনের কাছে। রাঙাসুন্দরি গ্রাম। বিদ্যানদীর ধারে।

তা যাবে কি করে?

তাই তো বুঝতে পারছি না। আমি তো কোলকাতার রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না। আমাদের সাথে আরো যারা মিটিনে এসেছিলো, তাদের কাউকেই দেখছি না।

মেয়েটার কথাবার্তায় গ্রাম্যভাব, চেহারায় নিখাদ সরলতা। ওর জন্যে করুণা হলো। এই অচেনা মেয়েটার জন্যে আমি কিই বা করতে পারি! ঘরে ফেরার জন্যে কয়েক কদম এগোলাম। পেছনে ফিরে দেখলাম, মেয়েটার কাছে আরো কয়েকটা অল্প বয়েসী ছোকরা জড়ো হচ্ছে। কি মনে হলো, আবার পেছনে ফিরে এলাম।

মেয়েটাকে বললাম,- আমার সাথে আসুন। কাছেই পিসির বাড়ি। এ রাতটা সেখানে থেকে যেতে পারেন। এতো রাতে এই শহরে, চেনেন না জানেন না, কোথায় ঘুরতে থাকবেন।

কাঁধে আমার বিশাল ক্যামেরা আর হাতে রাইটিং প্যাড দেখে উপস্থিত ছেলে ছোকরা কয়েকজন একটু উসখুস করলেও আমার গন্তব্য নিয়ে কেউ কিছু প্রশ্ন করতে সাহস পেলো না।

মেয়েটাকে মোটর সাইকেলের পেছনে কোনরকমে বসিয়ে আমার পিসির ঘরে নিয়ে এলাম। সব ঘটনা খুলে বললাম। পিসি খুব উদারমনা, এককালে পার্টি-টার্টি করতো। তিনি আমার কথাটা বুঝলেন। যদিও গোপনে আমাকে বললেন, - আমার পাশের খালি ঘরে দু’এক দিন থেকে যেতে পারে। দেখিস কোনো গড়বড় কেস না তো। মেয়েটা কোনো বিপদে ফেলবে না তো? দরকার হলে থানায় একটা ডায়েরী করিয়ে রাখিস।

রাইকমলিনী পিসির কাছে থেকে গেলো। পিসিও ওর খাবার দাবার ব্যবস্থা করে দিলো। খোঁজ খবর নিতে লাগলো। জানা গেলো, ওর বাড়ি ক্যানিং হয়ে যেতে হয়। লঞ্চে নদী পেরিয়ে ওপারে অনেকটা হেঁটে ওদের গ্রামটা! ওর কর্তা নৌকার মাঝি। জেলেদের সাথে নৌকায় মাছ ধরে। গ্রামের কোনো নেতার অনুরোধে ওরা স্বামী-স্ত্রী আরো অনেকের সাথে কোলকাতায় পার্টি মিটিং-এ এসেছিল।

দিন তিনেক বাদে আমি ক্যানিং লোকালে। তারপরে লঞ্চ। সেখান থেকে হেঁটে আর সাইকেল ভ্যানে একটা নিথর গ্রাম। পৌঁছে গেলাম রাঙাসুন্দরি গ্রামে। দু চারটে বাড়ি। রাইকমলিনীকে নিয়ে গ্রামে পৌঁছাতেই সবাই খুব খুশি। ওর বর নস্কর মাঝিকে খবর দেয়া হলো।

নস্কর মাঝি ঘরে ফিরতেই রাইকমলিনী আমাকে দেখিয়ে বললো, ‘এই দাদাবাবুটার কৃপাতে ঘরে ফিরতে পারলাম! বুড়ো, তোর কি আক্কেল বল তো? তুই কি করে আমাকে ছেড়ে চলে এলি?’

বুড়ো নস্কর মাঝি তরুনী বউটাকে পেয়ে খুব খুশী। সে জানালো, কেমন করে ভীড়ে দল ছুট হয়ে কত খুঁজেছে। পার্টির লোকেরা দল বেঁধে কতগুলো ট্রাকে এসেছিলো। বউকে খুঁজে না পেয়ে ভেবেছে, তার বউ দলের মধ্যেই কোথাও আছে, কিংবা অন্য কোনো ট্রাকে শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে গেছে। শেষমেষ নস্কর মাঝি শেয়ালদা যাবার জন্যে মুখ চেনা দুএকজনের সাথে একটা ট্রাকে উঠে পড়েছিলো। স্টেশনে পৌছে বুঝেছে তার বউ হারিয়ে গেছে! রাত হয়ে গেছিলো। চেনে না জানে না, বয়স্ক মানুষ, তাই সমাবেশের মাঠে দুবারা ফিরে যাবার সাহস হয়নি। রাইকে খুঁজতে গত পরশু কোলকাতায় লোক পাঠিয়েছে। পাশের গ্রামে থাকে পার্টির দাদারা, তাদেরকেও ধরেছে।

বুড়োটা আরো বললো - গতকাল পুলিশে এফআইআর করার জন্যে গেছিলাম; শালারা বললো, যেখানে নিঁখোজ হয়েছে সেখানকার থানায় গিয়ে ডায়েরি করতে হবে।

দেখলাম মাটির দেয়াল, খড়ের চালা। দুটো ঘর আর একটা বারান্দা, দু’জন মানুষ, কয়েকটা গরু-বাছুর ছাগল মুরগী। বুঝলাম, এরা নিঃসন্তান। এদের সংসারে তৃতীয় আর কোনো মানুষ নেই।

রাইকমলিনীকে গ্রামে পৌঁছে দিয়েছি, আমার কাজ শেষ। ফেরত আসার প্লান করছি, বাধ সাধলো রাই। আমার দুহাত ধরে বললো – ‘তোমরা খুব ভালো মানুষ গো। তোমাদের জন্যে আমি এতো ভালো ভাবে ঘরে ফিরে আসতে পারলাম। এয়েছো যখন, দু’তিন দিন এখানে থেকে যাও। তুমি তো সুন্দরবনের নদী-জঙ্গল দেখো নি, নদীর উপরে জেগে থাকা চর দেখোনি। তোমাকে এসব দেখিয়ে আনবো নি।’ সে খুব আবদার, আমার উপরে।

অগত্যা আমার ফেরা হলো না।

ওদের ঘরের পাশেই নদী। সেদিন বিকেলে আমি বিদ্যাধরী নদীর পারে বসে আছি। একা একা। হুহু হাওয়া। নদীর কিনারে কয়েকটা নৌকা বাঁধা। আমি উপভোগ করছি নদী ও নিসর্গের সৌন্দর্য। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। ওপারে জোনাকির মতো জেগে উঠছে দুচারটে আলোর বিন্দু।

দেখলাম, রাইকমলিনী হাতে একটা লন্ঠন নিয়ে নদীর কিনারায় চলে এসেছে। বললো, বুড়োকে খাইয়ে দাইয়ে আসতে ওর একটু সময় লাগলো। নইলে আরো আগেই চলে আসতো!

রাইকমলিনী নিসঙ্কোচে আমার পাশে এসে বসলো। যেন আমার কতদিনের চেনা!

বললো, ‘বাবু তোমার পিসিমা খুব ভালো লোক।’ আমি আর কি বলবো।

বললো, ‘চলো বাবু, আমার সঙ্গে। তোমাকে নদীতে একটু ঘুরিয়ে আনি!’ রাই একটা নৌকায় উঠে গিয়ে লন্ঠনটা ডিম করে রাখলো। খুটায় বাঁধা নৌকার দড়িটা আলগা করলো।

আমার ভয় ভয় করছিল। বললাম – ‘নস্কর বাবুকে ডাকো। রাতে দুজনে যাওয়া সেফ নয়, তিনজনে মিলেই যাই। তাছাড়া তুমি রাতের নৌকা সামলাতে পারবে না!’

-‘ক্লান্ত বুড়োটা মালটাল টেনে ঘুমিয়ে পরেছে। ভয় নেই, আমি পারবো নি। এই মেয়ে নৌকার দাড় বাইতে পারে, হাল ধরতেও জানে। আমার বাপও যে নৌকা চালাতো। নামখানায় আমার বাপের বাড়ি।’

যে মেয়েটা দিশা হারিয়ে কোলকাতার সমাবেশে রাস্তায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো, এখন তার এতো সাহস দেখে অবাক হলাম।

নৌকাতে গিয়ে বসলাম। রাইকমলিনী নদীর কিনার ঘেসে বেশ শক্ত হাতেই নৌকা বাইছে। নদীতে তখন জোয়ারের টান। ফাটাফাটি জ্যোৎস্না আর নদীর দুধারে জঙ্গল। জলে এসে মাথা নুইয়েছে সুন্দরী, গরাণ, ম্যানগ্রোভের পাতা। পুরো পৃথিবীটাকে রহস্যময় মনে হচ্ছিলো। সেদিন কিছুক্ষণ পরেই আমরা ভাটার টানে ঘরে ফিরে এলাম।

পরের দিন আমি কোলকাতায় ফেরত আসবো, কিন্তু রাইকমলিনী আমাকে আবার আটকে দিলো – ‘না বাবু, তোমাকে আজও ফিরে যেতে দেবো না! আজকে তোমাকে নিয়ে যাবো নতুন একটা জায়গায়। বিদ্যার বুকে সুন্দর একটা চর - আমরা বলি সুখচর।’

সেদিন খুব ভোরে নস্কর মাঝি বেরিয়ে গেলো।

আমি ঘুরে বেড়ালাম নদীর পাড়ে, গ্রামে গ্রামে। জঙ্গলকে কাঁপিয়ে ভেসে আসছে জলো হাওয়া। গ্রামের বাড়িঘর কাঁচা, একজায়গায় দেখলাম বনবিবির থান। ঘরে ফিরে দুপুরের খাওয়া দাওয়া হলো। বাকী সময়টা রাইএর সাথে গল্প আর খুনসুটি চললো।

নস্কর মাঝি নৌকা নিয়ে ফিরে এলো বিকেলে। খাওয়া দাওয়া করলো, অভ্যেসমতো বেশ কিছুটা দেশি গিলে বকবক করতে করতে এক সময়ে লোকটা ঘুমিয়ে পড়লো। মানুষটা ঘুমিয়ে পড়তেই রাইকমলিনী আমাকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লো।

গতরাতের মতোই আবার আমাদের নৌকা অভিসার। রাইকমলিনী দাঁড় বাইছে, হাল সামলাচ্ছে।

দূর থেকে আরো একটা নৌকা ফিরছিলো। অন্ধকারে ঠাহর করতে না পেরে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘এতো রাতে নদীতে কে যায় গো?’

রাই গলাটাকে পুরুষালি করে চেঁচিয়ে বললো – ‘রাঙাসুন্দরি গ্রামের নৌকা গো!’

জ্যোৎস্নায় চিক চিক করছে নদীর জল। আমার গলায় শচীন কর্তার ভাটিয়ালি গান। তখন ভাটার টান। আকাশে একটু একটু মেঘ। মাঝে মাঝে হাওয়ায় দিচ্ছে। প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা পরে নৌকাটা ভিড়লো জোছনা-ধবধবে বালু চিক চিক একটা নদীর চরে।

‘ও বাবু গো, নৌকা থেকে নেমে আসো। এর নাম সুখচর।’

জলে পা ভিজিয়ে কোনোমতে নৌকা থেকে নামলাম। রাই একটা মোটা দড়ি দিয়ে চরে পুতে রাখা একটা বাঁশের খুটোর সাথে বেঁধে রাখলো নৌকোটা।

চরটা বিশাল, একদিকে প্রচুর গাছপালা, কিন্তু সমস্তটাই জনশূন্য। মাঝখানে কিছুটা জায়গায় কয়েকটা কংক্রিটের পিলার। মনে হলো, চরের এখানে কোনো সিগন্যাল টাওয়ার বসানোর পরিকল্পনা ছিল। আপাতত সে কাজ অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। কংক্রিটের পিলারগুলোর মাঝে সিমেন্টের ছোট্ট একটা চাতাল।

তার পাশেই শক্ত গাছের গুঁড়ি আর বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরী একটা ছাউনি দেয়া মাচান। মই লাগানো সিঁড়ি। যেখানে দুদন্ড বসা যায়, বিশ্রাম করা যায়।

রাই বললো, এখানে দিনের বেলায় নৌকা নিয়ে মানুষজন ঘুরতে আসে। কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আবার ফেরৎ চলে যায়। সিমেন্টের চাতাল আর মাচানের আশে পাশে ছড়ানো ছিটানো কাগজের টুকরো, মদের বোতল। মানুষের আনাগোনার চিহ্ন।

‘রাই, এতো রাতে তুমি আমাকে নিয়ে এখানে একলা একলা এলে! তোমার ভয় করে না!’

গোলগাল চাঁদ। সমুদ্রগামী নদী মোহনার দিকে তাকিয়ে রাই বলে উঠলো - ‘আমাদের ছোট্ট জীবনটা! এমনি করেই নদীর বুকে নৌকা বাইলে আমাদের জীবনটাও নদীর লম্বা হবে গো! বাবু, এত ভয় করলে নদীর শ্যাওলার মতো আমরাও একদিন হারিয়ে যাবো।’

রাই নৌকার ভেতরে রাখা একটা হোগলার পাটি তুলে এনে চরের বালিয়ারিতে বিছিয়ে দিলো। আমরা বসলাম। ঘর থেকে বানিয়ে এনেছিলো ভাত, কাঁকড়া-চিংড়ি-আলুর তরকারি। শালের পাতায় আমরা খেলাম। নদী চরের নির্জনতা আর ফটফটে জ্যোৎস্নার বাহার আমাকে বিস্মিত করলো।

খোলামেলা চাঁদটার উপর মেঘের লুকোচুরি শুরু হয়েছে। সমুদ্রের দিক থেকে ভেসে আসছে শনশন হাওয়া!

ওই যে কক্ষচ্যুত হয়ে ছোট ছোট জলজ শ্যাওলা ভেসে যাচ্ছে, ওরা কি আর কখনো নিজের জন্মস্থানে ফিরে যেতে পারবে? কোন জেলায় ওদের ঘর ছিলো! কোনটা ওর দেশ? নাকি সেই অর্থে জীবজগতে একটাই দেশ আছে – সেটা এই পৃথিবী! এই চরাচরের কোন এক ক্ষুদ্র বিন্দুতে আমরা দুজন বসে আছি। এখানে আমি আমার কোলকাতা ঠিকানা, বিগত জীবনের সমস্ত পরিচয়পত্র হারিয়ে ফেলেছি!

চরের পাশের সমুদ্রমুখী বিশাল নদী, শন শন হাওয়া, একটা থমমারা খোলা আকাশ। চাঁদ আর ছুটে বেড়ানো মেঘের খেলা – অবাক হওয়ার ক্লান্তিতে আমি হোগলা পাটির উপর শুয়ে পড়লাম। পাশেই বসে রাইকমলিনী। দুহাতের বেড়ে হাঁটুটাকে জড়িয়ে, নিজের মনে গুনগুন করে গাইছে – ‘ও চাঁদ আগলে রেখো জোছনাকে!’ সময় ঘনাতেই দেখলাম, চাঁদে উপরে আছড়ে পড়ছে খন্ড খন্ড মেঘ। মনে হচ্ছে হাওয়ার বেগ বাড়ছে!

এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলো। হাওয়ার বেগ কমবার নামটি নেই – আমার ভয় - আবার কি কোনো ঘূর্নিঝড়, বুলবুল আসছে?চলো ফিরে যাই।

রাইকমলিনী সান্ত্বনা দিয়ে বললো- আরেকটু বসো, বাবু। হাওয়াটা কমলেই আমরা ফিরবো।

আর কিছু সময়ের মধ্যেই থম মারা আকাশের নীচে গর্জন করে ছুটে এলো পাগল হাওয়া। নদীর জল উথাল পাথাল। আমরা দুজনেই উঠে দাঁড়ালাম। সমুদ্রের দিক থেকে উঁচু উঁচু ঢেউ শব্দ করে চরভূমিতে আছড়ে পড়তে লাগলো। রাই আমাকে টাওয়ারের পিলারগুলোর মাঝখানে উঁচু সিমেন্টের চাতালে উঠে যেতে বললো। চাতালের উঁচু জায়গাতে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম, টাল মাটাল নৌকাটাকে রাই পাটের দড়িটা দিয়ে আরো শক্ত করে বাঁধছে! নৌকাটা জলের ঢেউতে নাচছে। নদী চরে অল্প সময়ের মধ্যেই উঠে এলো পায়ের গোড়ালি ডোবানো জল!

নৌকাটাকে বেঁধেসেধে জলের মধ্য দিয়ে কায়দা করে রাই উঠে এসেছে সিমেন্টের চাতালটাতে। ওর শাড়ী ভিজে গেছে। আমরা দেখলাম, ঢেউএর উচ্চতাতে জলস্তর আস্তে আস্তে বাড়ছে।

এবার আমাদের ভরসা পাশের উঁচু মাচানটা। ওটা মোটা গাছের গুড়ির উপর দাঁড়ানো, পাকা বাঁশের বেড়া আর ছাউনি ঢাকা। মুষালধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা ভিজছি! চাতাল থেকে নেমে মই লাগানো সিঁড়ি বেয়ে আমি মাচানে উঠে গেলাম। আমার পেছনে পেছনে উঠে এলো রাইকমলিনী। সাথে ব্যাগের টুকিটাকি আর নিভে যাওয়া লণ্ঠনটা।

জামা কাপড় ভিজে চপচপ করছে। রাই উলটো দিকে মুখ করে শাড়িটা খুলে নিংড়ে নিলো, ছড়িয়ে দিলো মাচানের এক কোণে। ওর দেখাদেখি আমিও ভিজে জামাটা খুলে মেলে দিলাম। ভিজে প্যান্ট, ভিজে সায়া-ব্লাউজ। আমরা দুজনে অপেক্ষা করতে লাগলাম, কখন এ ঝড় বৃষ্টি কমবে! কোন কুক্ষণে যে রাইকমলিনীর সাথে রাতের অন্ধকারে নৌকাবিহারে বেরিয়েছিলাম, নিজের উপর রাগ হলো!

ও আমাকে ভরসা দিতে লাগলো - ভয় পেয়ো না বাবু, এ জল হাওয়া একটু পরেই থেমে যাবে!

ওদিকে রাত বাড়তে লাগলো। নদীর পাগলামি আর কমে না। সাথে হাওয়ার দাপট। মনে হচ্ছে আমাদের মাচানটা ভেঙেচুড়ে উড়ে যাবে। ওদিকে খুটিতে বাঁধা নৌকাটাও পাগলের মতো দাপাচ্ছে।

হঠাৎ দেখতে পেলাম জলের তোড়ে উপড়ে যাওয়া বাঁশের খুটি আর দড়ি সমেত নৌকাটা ভেসে চলেছে! গেলো গেলো বলে চেঁচিয়ে উঠলো রাই! ওকে দেখলাম সায়াটা খুলে উঁচু বুক পর্যন্ত বেঁধে নিল। মুহূর্তের মধ্যে মাচান থেকে নদীর জলে ঝাঁপ দিলো। প্রাণপণে সাঁতরে সাঁতরে ভেসে যাওয়া নৌকোটার দিকে এগোতে লাগলো। কিন্তু মেয়েটার গতির চাইতে হাওয়ার গতিবেগ আরো কয়েকগুন বেশী।

আমি শহুরে মানুষ। ভয়ে চেঁচাতে লাগলাম, ‘রাই ফিরে এসো, জলে ভেসে যাবে, রাই, রাইকমলিনিইই – !’

নৌকাটা জলের তোড়ে অনেকটা দূরে এগিয়ে গেছে। ওটাকে আর বাঁচানো যাবে না। অগত্যা রাই মুখ ঘোরলো। নদীর স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে সাঁতরে ও চরের দিকে এগিয়ে আসছে! শরীরে সমস্ত জান্তব শক্তিকে নিঃশেষিত করে নদীর তীব্র শাসনের বুকে হাতের থাপ্পর আর পায়ের লাথি কষাতে কষাতে মেয়েটি যখন মাচানের খুটি ধরে নদীর চরায় পা রাখলো, তখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, রাই ফিরে এসেছে! মই বেয়ে ও মাচানে উঠে এলো। অর্ধ উলঙ্গ মেয়েটিকে মনে হলো কোনো আদিম যুগের মানবী।

মাচানে উঠে ও আমার দু’হাতে ওর মুখটা গুঁজে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো – ‘বাবু নাওটাকে বাঁচাতে পারলাম না। বাবু, কি করে আমরা ঘরে ফিরবো! কি করে আমি বুড়োমাঝিকে আমার এ পোড়া মুখ দেখাবো!’

নস্কর মাঝিকে ও না বলে পালিয়ে এসেছিলো! ওদের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন নৌকাটা ভেসে সমুদ্রের দিকে হারিয়ে গেছে। ওর ডুকরে ওঠা কান্নাগুলো হাওয়ার গর্জন আর জলস্রোতের কলকলানিতে কোথায় যে হারিয়ে যেতে লাগলো, আমি ছাড়া আর কেউ তার সাক্ষী রইলো না!

আমি রাইকমলিনীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। ‘রাই, চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি নস্কর মাঝিকে বুঝিয়ে বলবো, আমিই তোমাকে নিয়ে জোড়াজুড়ি করে নৌকাতে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম, আমিই তোমাকে নিয়ে এই সুখচরে এসেছি। রাই, কান্না থামাও! ......... নতুন একটা নৌকা বানানোর টাকা আমি তোমাদের জোগাড় করে দেবো। ব্যাঙ্কেও আমার খাতায় কিছু টাকা আছে! আমার পিসিমাও চাইলে নিশ্চয়ই কিছু টাকা দেবে। ভরসা রাখো!’

কিন্তু রাইকমলিনীকে শান্ত করা কি সোজা কথা! ভিজে সায়া ব্লাউজ গায়ে, ও অসহায়ের মতো ফোঁফাতে লাগলো!

চরের মাচানের উপর আমরা আরো ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করলাম। ধীরে ধীরে ঝড় থেমে আসছে। তখন বোধ হয় রাত চারটে হবে।

আমরা এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। কোথাও কোনো জলযান দেখা যাচ্ছে কি? এখন বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়া থেমে গেছে। চাঁদটাকেও পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের নৌকাটা যে জলে ভেসে গেছে! কি করে আমরা ডাঙায় ফিরবো!

আমি আর রাইকমলিনী। একজন আরেকজনের কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে এই নির্জন মাচানে বসে আছি। এই সুখচরের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে, বিদ্যাধরী নদীর খলখল জলস্রোত পেরিয়ে, আমরা কিভাবে কখন ওই রাঙাসুন্দরি গ্রামে ফিরে আসবো?

ভোর হয়ে আসছে! হঠাৎ রাইকমলিনী চেঁচিয়ে উঠলো – ওই, ওই তো একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে, অনেক দূরে, ওই দিকে!