Next
Previous
0

গল্প - তপন রায়চৌধুরী

Posted in






বিজ্ঞাপন শুরু হয়েছিল প্রায় চারমাস আগে থেকে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় দূর্গাপ্রতিমা দর্শন করুন, স্থান সোনালি পার্ক। চলতে ফিরতে, রাস্তাঘাটে, মেট্রো কমপার্টমেন্টে – প্রায় সর্বত্র পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ। প্রচারমাধ্যম হিসেবে টিভি, খবরের কাগজও বাদ যায়নি এই বিজ্ঞাপনের আওতা থেকে। ট্রামে-বাসে-ট্রেনে সকলের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে এই বিজ্ঞাপন নিয়ে। তার উপর বলিউড একজন সুপারস্টার ট্যুইট করেছেন, এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্গাপ্রতিমা। সাধারণ মানুষের কাছে এই মানুষটি একেবারে দেবতুল্য। সুতরাং তাঁর মন্তব্য নিঃসন্দেহে এক নিখাদ সত্য। তাই যেতেই হবে, দেখতেই হবে এই দুর্গাঠাকুর। সাজো সাজো রব পড়ে গিয়েছে চারিদিকে।

সংবাদে প্রকাশ, নিয়ম অনুযায়ী নাকি চল্লিশ ফুটের বেশি উচ্চতার মণ্ডপ তৈরি করা যাবে না, কিন্তু সেইসব বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে এই পুজোমণ্ডপের উচ্চতা নাকি আশি ফুট করা হয়েছে। নিষিদ্ধ বা নিয়ম বহির্ভূত যে-কোনো বিষয়ের প্রতি প্রত্যেক মানুষের একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে। সুতরাং দুর্গাপ্রতিমা দর্শনের বিষয়টি আরো দশগুণ জোরালো হল জনমানসে।

পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা বা কলকাতা পুলিশ আশা করতে পারেনি যে চতুর্থী থেকেই এই পুজোকে কেন্দ্র করে এমন মারাত্নক ভিড় শুরু হয়ে যাবে। কলকাতাসহ মহানগরীর সংলগ্ন হাওড়া, হুগলী, উত্তর চব্বিশ পরগণা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে বা গাড়ি রিজার্ভ করে ভিড় জমাতে শুরু করে সোনালি পার্কে। এর ফলে রাস্তাঘাটের জ্যামজট চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। যে-পথ বাসে অতিক্রম করতে মোটে পাঁচ-সাত মিনিট সময় লাগার কথা তা অতিক্রম করতে দুঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে গাড়িগুলোর। সার সার গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

পঞ্চমীতে এই অচলাবস্থা চরম আকার ধারণ করল। কলকাতা তো বটেই, সুদূর গ্রামাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষ বহু আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন, সোনালি পার্কের এই দুর্গাঠাকুর কিছুতেই মিস করা চলবে না। এছাড়া গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার সূত্রে প্রায় প্রত্যেকেরই এটা ধারণা হয়ে গেছে যে ষষ্ঠী থেকে নবমী সাংঘাতিক ভিড় হতে পারে, সুতরাং পঞ্চমীতেই এই প্রতিমাদর্শন সেরে ফেলা দরকার। ফলে পঞ্চমীর বিকেল থেকেই ব্রিগেডের জনসভার চেহারা নিল দক্ষিণ কলকাতার রাস্তাগুলো। আশপাশের সমস্ত রাস্তা একেবারে মুক্তাঞ্চল হয়ে গেল হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে। যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হল একরকম। সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ কমিশনারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিলেন। যানবাহনের অবস্থা এমনই শোচনীয় আকার নিল যে পুলিশ কমিশনার নিজের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে মেট্রোতে চেপে এবং পায়ে হেঁটে সোনালি পার্কের পুজোমণ্ডপে উপস্থিত হলেন। শেষে এমনই নাজেহাল অবস্থা দাঁড়াল যে পুজোকমিটির উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে ক্রমাগত মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে, জনসাধারণ যেন পুজোমণ্ডপের মাঠে না ঢুকে রাস্তা থেকে প্রতিমা দর্শন করেন। কিন্তু উদ্যোক্তাদের এই ঘোষণা একেবারেই অর্থহীন ছিল, কারণ বড় বড় বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ে সম্পূর্ণভাবে ঢেকে যাওয়াতে রাস্তা থেকে প্রতিমা দেখার কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে অনিবার্যভাবে যা ঘটার তাই ঘটলো। পুজোপ্রাঙ্গণে প্রবেশ করার জন্য ছিল অত্যন্ত ছোট দুটো গেট। তার উপর সিকিওরিটির ব্যবস্থাও ছিল যথেষ্ট ঢিলেঢালা। কাতারে কাতারে মানুষ ঢুকে পড়ছে মণ্ডপের মাঠে। সেই বিপুল জনস্রোতে ছিটকে গেল বহু মানুষ। ভিড়ের চাপে আর্তনাদ করে উঠলেন অনেকে। পেছন ফিরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন বেশ কিছু লোক। কিন্তু প্রবল ভিড়ে তখন সামনে ধাক্কা দিচ্ছে জনতা। সেই ভিড়কে লক্ষ্য করে প্রাণভিক্ষা চাইলেন অনেকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! নারী-পুরুষ সকলেই দুর্গাপ্রতিমা দর্শন করতে এসেছেন। হঠাৎ সেই ভিড়ের মধ্যে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের এক সুন্দরী সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা তখন করজোরে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে ঠিক তার পেছনে দাঁড়ানো অল্পবয়সি কিছু ছেলের কাছে অনুরোধ করলেন বেরিয়ে যাওয়ার একটা পথ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এক বিদ্রুপাত্নক অশ্লীল অট্টহাসি ছাড়া ভদ্রমহিলার ভাগ্যে কিছুই জুটল না। ওদের কুৎসিত মূর্তি দেখে মহিলাটি বেশ ভয় পেয়ে গেলেন এবং সামনের দিকে ফিরলেন। ভিড়ের চাপ কখনও বাড়ছে, কখনও বা একটু কমছে। ভদ্রমহিলা আশপাশে তাকাচ্ছেন যদি কোনোমতে বেরিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বৃথা তার চেষ্টা। ভিড়ের চাপে তাঁর শাড়ির আচল ক্রমাগত গা থেকে খসে পড়ছিল, আর তিনি বারবার সেটা গায়ে জড়িয়ে নিচ্ছিলেন অত্যন্ত অস্বস্তি নিয়ে। হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন তাঁর পেটে কেউ হাত দিয়ে চাপছে। তিনি বলে উঠলেন, “আহ্, কি হচ্ছে কি, অসভ্য কোথাকার!”

পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “দিদি, আমাকে বলছেন কি ?”



মহিলা তার কোন উত্তর দিলেন না। ভিড়ের চাপ আরও বাড়তে থাকল। এবার একেবারে পিষ্ট হচ্ছেন মহিলাটি। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন তার ঘাড়ের উপর কোনো একজনের নোংরা নিঃশ্বাস পড়ছে। মহিলাটি বলে উঠলেন, “কী হচ্ছে? ঠিকমতন দাঁড়ান।“ কেউ কোন সাড়া দিল না তাতে। ঠেলাঠেলিতে এবার হঠাৎ কিছুটা ফাঁকা হয়ে গেল সামনে। মহিলা দৌড়ে সামনে চলে গেলেন। পেছনের ছেলেগুলোও ছুটল সামনে। এবার ভিড়ের ঠেলাতে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবেই ভদ্রমহিলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কিছু ছেলে। মহিলাটি আর্তনাদ করে উঠলেন। কিন্তু কে কাকে বাঁচাবে! কারুর কিছু বলার নেই তখন। শোভন-অশোভন বলে কিছু নেই। সেই জান্তব ভিড়ের মধ্যে ‘সমাজ’ বলে কোনো শব্দ থাকে না। সবাই যে-যার মতন নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। ভদ্রমহিলাকে তখন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে দুজন প্রায় উন্মত্ত অল্পবয়সি দুটি ছেলে। তাদের বয়স কুড়ি-বাইশের বেশি হবে না।



মহিলাটি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, “এই, এই, কী হচ্ছে? ছিঃ ছিঃ! ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি ।“



কিন্তু কে শোনে কার কথা ! প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বোধ হয় একটা পশু ঘুমিয়ে থাকে । সুযোগ পেলে সেই পশুটা জেগে ওঠে। এই দুটি ছেলে প্রায় আক্ষরিক অর্থে সেই মুহূর্তে পশু হয়ে উঠল। সেই উন্মত্ত ভিড়ের মধ্যে বড় অসহায়ভাবে, বড় করুণভাবে ধর্ষিত হয়ে চললেন সম্ভ্রান্ত ঘরের সুন্দরী মহিলাটি। একসময়ে থাকতে না পেরে অস্ফুটে আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি – “আহ্! আমার লাগছে, আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমাদের দিদির বয়সি, আমি তোমাদের মায়ের বয়সি। তোমরা প্লিজ ছেড়ে দাও আমাকে। আমার স্বামী আছে, পুত্র আছে। মাগো!”



কথাগুলো ছাড়া ছাড়া ভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছিল সেই বাঁধভাঙা জনতার ভিড়ে। কাকস্য পরিবেদনা! পশুশক্তি তখন পেয়ে বসেছে ছেলেদুটোকে। একটি ছেলে বড় নৃসংশভাবে কামড়ে ধরেছে মহিলাটির গাল, অন্য ছেলেটি তার দাঁত বসিয়ে দিয়েছে মহিলার গলায়। আশপাশের আরো দু-একটি নরপশু অসহায় মহিলাটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সুযোগ বুঝে। তখন আর চিৎকার করার শক্তি নেই ভদ্রমহিলার। প্রবলভাবে গণধর্ষণ হয়ে চলেছে। ভিড়ের মধ্যে তখন নানাদিক থেকে ভেসে আসছে অজস্র আর্তনাদ আর পৈশাচিক উল্লাস। ভদ্রমহিলা ছটপট করছেন সেই উন্মত্ত পশুদের নিষ্ঠুর বেষ্টনীর মধ্যে।



হঠাৎ দেখা গেল মহিলার দুটি হাত ঊর্ধমুখী। ছেলেদুটি তখন তাকে জাপটে ধরে তাদের জান্তব স্বাদ মেটাচ্ছে প্রাণভরে। ঠিক তারপরই ঘটল এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। মহিলাটি তীব্র আওয়াজ করে চেঁচিয়ে উঠলেন – “জয় মা !”

আর, ঠিক সেই মুহূর্তে মহিলার শরীরে লেপটে থাকা দুটো হিংস্র এবং উন্মত্ত পশু এক তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ঢলে পড়ল ভিড়ের মধ্যে। মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে গেল জায়গাটা। সবাই বিস্ময়ে দেখল, আক্রান্ত মহিলাটি তার মাথায় লাগানো দুটো শলাকার একটা বসিয়ে দিয়েছে ওই দুজনের একজনের পেটে এবং অপর শলাকাটি আমূল বিদ্ধ করেছে অন্য ছেলেটির বুকের পাঁজর। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। ভদ্রমহিলার এহেন সংহারমূর্তি দেখে জনতার ভিড় এলোপাথাড়িভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিলিয়ে গেল। ধারেকাছে কোথাও কোনো পুলিশ নেই তখন। পুজো কমিটির উদ্যোক্তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ভিড় সামলাতে না পেরে সবাই পালিয়ে গিয়েছিল সম্ভবত। দুটো তাজা নিঃস্পন্দ শরীর বলিপ্রদত্ত হয়ে পড়ে রইল সিংহবাহিনী, অসুরদলনী দেবী দুর্গার সামনে।