Next
Previous
0

পথে প্রবাসে - অসীম দেব

Posted in



















 ১


তানিয়া,

চারদিনের জন্য অমৃতসর ঘুরে এলাম। হঠাৎই ঠিক করলাম, অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না, তাই বাড়ির লোকজন মিলে কাছাকাছি কোন একটা জায়গা থেকে একটু ঘুরে আসি। মাত্র দু’দিনের নোটিশে ট্রেনের টিকিট, হোটেল, ট্রাভেল প্ল্যান সবই ঠিক করে ফেললাম।

অমৃতসর প্রসঙ্গে সবার আগে তানিয়া, এই শহরের ইতিহাসটা তোকে একটু বলি। অনেকেরই ইতিহাস ভালো লাগে না। তবু, কোনো ঐতিহাসিক জায়গায় যাওয়ার আগে তার ইতিহাস খানিকটা জেনে রাখা ভালো। নেটে দেখলাম, সাড়ে চার’শ বছরের ইতিহাস। এটাকে ছোট্ট করে লেখা সহজ নয়, তবু যতটা পারি ছোট করেই লিখলাম। প্রথম পর্যায়ে শুধু অমৃতসর শহরের ইতিহাস্টুকু। পরের পর্ব থেকে কি দেখলাম, কি খেলাম, এসব না হয় লেখা যাবে। ইতিহাসটা ছোটর মধ্যে মোটামুটি এইরকম দাঁড়ায়-

১৫৭৪-৭৭ সালে মুঘল সম্রাট আকবর চতুর্থ শিখ গুরু শ্রীরামদাসকে জমি দান করেন, এবং সেই স্থানেই অমৃতসর শহরের পত্তন হয়। আবার গেজেটের কিছু তথ্য অনুযায়ী শিখ সম্প্রদায় চাঁদা তুলে ৭০০ টাকায় তুং গ্রামের (Tung) জমিদারের থেকে এই জমিটি কেনেন। সেইসময় অঞ্চলটি ছিলো গভীর জঙ্গল, ও অনেক জলাশয়ে ভরা। গুরু শ্রীরামদাস ৫২ জন বিভিন্ন দ্রব্যের ব্যাবসায়ী আর কিছু বিভিন্ন শিল্পীকে (traders and artisans) এখানে ডেকে আনেন। এইভাবেই শহরটির পত্তন হয়। একদম শুরুতে যে ৩২ টি দোকান ছিলো, বংশানুক্রমে সেইগুলি এখনও আছে (Batisi Hatta, 32 shops). গুরু নিজেও এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। এর থেকেই এই স্থানটির নামকরন হয় রামদাসপুর। গুরু গ্রন্থসাহিবে এর উল্লেখ আছে। কথিত আছে যে বুদ্ধদেবও এখানে কিছুদিন সাধনা করেছিলেন। সেই সময়ও এই অঞ্চলে গভীর জঙ্গল ও জলাশয় ছিলো।

ষোড়শ শতাব্দীতে অমৃতসরে দুর্গিয়ানা হিন্দু মন্দিরটি তৈরি হয়। ছবি দিলাম তানিয়া, খেয়াল কর, এই হিন্দু মন্দিরটির স্থাপত্য অনেকটাই হরমন্দির সাহিবের ঘরানায় তৈরি, চূড়ার সোনার পাতও সেই একই ঘরানার। (বলে রাখি, অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরের প্রকৃত নাম হরমন্দির সাহিব)। এই দুর্গিয়ানা মন্দিরের চারিপাশে পুষ্করিণীও খনন করা হয়েছে। দেবী দূর্গার নামে এই মন্দিরটি, এখানে বিষ্ণু ও লক্ষীর পূজা হয়। সূর্য্যদেবের পৌত্র ইক্ষভাকু এখানে যজ্ঞ করতেন বলে স্থানীয় লোকের বিশ্বাস। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী অমৃতসর শহরের তীরথস্থল (Valmiki Tirath Sthal) অঞ্চলে মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রম ছিলো। লোকের বিশ্বাস, রামায়ণের লব ও কুশের জন্ম হয় এই আশ্রমে। জনশ্রুতি এই যে রামের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়াকে ও হনুমানকে লব-কুশ এখানের দুর্গিয়ানা মন্দিরের একটি গাছের সাথে বেঁধে রেখেছিলো। জনশ্রুতি আছে নিকটবর্তী লাহোর ও কাসুর শহরের নামকরণও এখান থেকেই হয়।

মহিমা প্রকাশ বার্তাক (Mahima Prakash Vartak) নামের একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থে ১৫৭৪-১৬০৪ সালের বিভিন্ন তথ্যের উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থটি, আনুমানিক ১৭৪১ সালে লেখা, এবং এটিকেই শিখদের সর্বপ্রাচীন তথ্যমূলক গ্রন্থ মানা হয়। (A semi-historical Sikh hagiography text. এর মানে biography of a saint or an ecclesiastical leader, an idealized biography of a founder, saint, monk, nun or icon in any of the world's religions). এই গ্রন্থেই দশজন শিখ গুরুর উল্লেখ আছে।

চতুর্থ শিখ গুরু রামদাসের নির্দেশে অমৃত সারস পুষ্করিণী (Amrita Saras “Pool of Nectar”) খননের কাজ শুরু হয়। সুতরাং এই পুষ্করিণী প্রকৃতির সৃষ্টি নয়, এটিকে খনন করা হয়েছিলো। এই অমৃত সারস নাম থেকেই অমৃতসর নামকরনের উৎপত্তি। ১৫৭৭ সালে পুষ্করিণীর কাজ শেষ হয়, আর ১৫৮৯ সালে পুস্করিণীর কেন্দ্রে হরমন্দির সাহিব প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন এই হরমন্দির সাহিবকেই আমরা স্বর্ণমন্দির বলি। ১৬০৪ সালে পঞ্চম শিখ গুরু অর্জুন গ্রন্থসাহিব রচনা করে হরমন্দির সাহিবে স্থাপন করলেন। বাবা বুদ্ধ সাহিব ছিলেন এর প্রথম গ্রন্থী।

১৭৬২ সালে আহমেদ শাহ দুররানী অমৃতসর শহর আক্রমণ করে এখানের সম্পদ লুঠ করে ও শহরটি ধ্বংস করে দেয়। এরপর ১৭৬৫ সালে জাঠ নেতা জাসা সিং আহলুওয়ালিয়ার নেতৃত্বে সম্মিলিত পঞ্জাব বাহিনী আফগান রাজা আহমেদ শাহ আবদালীকে পরাস্ত করেন। তারপর ১৮০২ সালে মহারাজা রণজিৎ সিং পঞ্জাবের বিভিন্ন ছোট ছোট রাজাকে একত্রিত করে শিখ ও পঞ্জাবের শক্তিশালী বাহিনী তৈরি করেন। পঞ্জাবের সামগ্রিক উন্নয়নে মহারাজা রণজিৎ সিং এর উল্লেখযোগ্য অবদান আছে। পঞ্জাবের লোকজন তাই ওনাকে শের-ই-পঞ্জাব নামে সন্মান দেয়। তাঁরই শাসনকালে হরমন্দির সাহিবের দেওয়াল স্বর্ণখচিত করা হয়। আর রামবাগ প্রাসাদ, আর গোবিন্দগড় দুর্গের সংস্কার করা হয়। ১৮২২ সালে তিনি অমৃতসর শহরের চতুর্দিকে সুরক্ষিত দেওয়ালের প্রাচীর সীমানা (walled city) তৈরি শুরু করেছিলেন, যে কাজটি পরবর্তীকালে শের সিং সম্পূর্ন করেন। তিনি ১২ টি তোরনদ্বার তৈরি করেছিলেন। এখন তার একটিমাত্ররই অস্তিত্ব আছে, রামবাগ দ্বার। বাকিগুলি ব্রিটিশরা ধ্বংস করে দেয়। ১৮৪০ সালে ব্রিটিশরা এই সুরক্ষিত শহর আক্রমণ করে। এইসময়ই টাউন হল তৈরি হয়, আর রামবাগ বাগানের নামকরণ করে কোম্পানি বাগ। ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশরা পঞ্জাব দখল করে নেয়, আর আরেকটি দ্বার তৈরি করে Hall Gate
ইন্দো-ব্রিটিশ স্থাপত্য এর সেরা উদাহরণ খালসা কলেজ।


ব্রিটিশ আমলে পঞ্জাবের সিং সভা মুভমেন্ট (ingh Sabha Movement) ও প্রধান খালসা দেওয়ান পঞ্জাবে উচ্চ শিক্ষার জন্য একটি প্রতিষ্ঠা স্থাপনের জন্য তখনের শিখ মহারাজা ও সাধারণের থেকে আর্থিক সহায়তার আবেদন করেন, এবং জমি দানের অনুরোধ করেন। এর ফলে আর্থিক সাহায্য যেমন আসে, তেমনি অনেকেই জমি দান করেন।

১৮৯০ সালে Khalsa College Establishment Committee তৈরি হয়, প্রেসিডন্ট ছিলেন Colonel W. R. M. Holroyd, Director of Public Instruction, Punjab, আর সেক্রেটারি ছিলেন W. Bell, লাহোর গভর্নমেন্ট কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। কমিটিতে পঞ্জাবের ১২১ জন সদস্য ছিলেন। তাঁদের মধ্যে পাতিয়ালা, নাভা, কাপুরথালা আর মাজিথিয়ার মহারাজারাও ছিলেন। অনেক আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত হয় যে কলেজটির স্থাপনা হবে অমৃতসর শহরেই, এবং দ্বিতীয় একটি হবে লাহোর শহরে।

১৮৯২ সালে অমৃতসর খালসা কলেজের নির্মানকার্য শুরু হয়। স্থপতি ছিলেন রাম সিং। ১৯১১-১২ সালে নির্মানকার্য শেষ হয়।

প্রসঙ্গত, রাম সিং ছিলেন ইন্দো-ব্রিটিশ স্টাইলের বিখ্যাত স্থপতি। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাজ অসবোর্ন হাউসে রানী ভিক্টোরিয়ার দরবার হল, মাইশোর ও কাপুরথালা প্রাসাদের দরবার হল, ও লাহোর কলেজ। এছাড়াও পঞ্জাবের পিঞ্জারা কাঠের কাজ তিনি বিশ্বের বহু দেশে জনপ্রিয় করেন।

তানিয়া,

এবার তোকে গুরু গ্রন্থসাহিব নিয়ে দু’কথা বলি। এটাও তোদের জানা দরকার। স্বর্ণমন্দিরের প্রকৃত নাম হরমন্দির সাহিব। গুরুদ্বারার নাম হয় বাংলা সাহিব, পাটনা সাহিব। খেয়াল করেছিস নিশ্চয়ই যে শিখেরা নিজেদের ধর্মগ্রন্থকে বলে গুরু গ্রন্থ সাহিব। এই সাহিব কথাটির অর্থ হৃদয়ের গভীর সম্মান উৎসর্গ করা। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, কোরাণে সাহিব কথাটির অর্থ সম্মানিত সঙ্গী।

এই গুরু গ্রন্থসাহিব গ্রন্থনায় মূলত ছ’জন শিখ গুরু - গুরু নানক, গুরু অঙ্গদ, গুরু অমর দাস, গুরু অর্জন, ও গুরু তেগবাহাদুরের বিশেষ অবদান আছে। এ ছাড়াও রামানন্দ, কবীর, নামদেভ এবং মুসলিম সুফি শেখ ফরিদের বিভিন্ন বাণী ও উপদেশও এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এটি রচিত হয়েছে গুরমুখী ভাষায়। এছাড়া লাহন্দা (পশ্চিম পাঞ্জবী), ব্রজভাষা, কৌরবী, সংস্কৃত, সিন্ধি ও পারসী ভাষায়ও গুরু গ্রন্থ সাহিবের অনুবাদ হয়েছে। সাধারণভাবে এই অনুবাদগুলিকে বলা হয় সন্ত ভাষা। এই ধর্মগ্রন্থের বাণীকে বলা হয় গুরবাণী।

১৬০৪ সালের ২৯শে আগস্ট আদি গ্রন্থটির রচনা সম্পন্ন করেন পঞ্চম শিখ গুরু, গুরু অঙ্গদ, এবং তিনদিন পরে ১লা সেপ্টেম্বর গ্রন্থটি হরমন্দির সাহিবে স্থাপন করা হয়। এই হরমন্দির সাহিব মন্দিরটি আজ স্বর্ণমন্দির নামে পরিচিত। হরমন্দির সাহিবের প্রথম গ্রন্থী ছিলেন বাবা বুদ্ধ। এরপর গুরু হরগোবিন্দ যোগ করেন রামকলি কি ভার, ও গুরু তেগবাহাদুরের কিছু বাণী। ১৭০৪ সালে মুঘল সম্রাট ঔরংজেবের সাথে যুদ্ধকালীন সময়ে গুরু গোবিন্দ ও ভাই মান সিং দমদমা সাহিবে গুরু তেগবাহাদুরের বানী ও উপদেশ সংযোজন করেন। এই নতুন খন্ডের নতুন নামকরণ হয় গুরু গ্রন্থ সাহিব। গুরু গ্রন্থ সাহিবের স্লোকগুলি ৩১ টি রাগের সুরে গাওয়া হয়ে থাকে। প্রথম ন’টি স্লোকের সুরকরন করেন গুরু হরগোবিন্দ। গুরু তেগবাহাদুরের হত্যার পরে গুরু গোবিন্দও অনেকগুলির সুরযোজন করেন।

ছোট করে এই হলো গ্রন্থসাহিবের ইতিহাস। এই ধর্মগ্রন্থটি এখন প্রতিটি গুরুদ্বারায় প্রতিষ্ঠা করা হয়।

তানিয়া,

তুই ভাবছিস একটু আগের উল্লেখ করা এই দমদমা সাহিব কি? কোথায়? তাহলে শোন। এর পুরো নাম শ্রী দরবার সাহিব দমদমা সাহিব তখত। দমদমার অর্থ বিশ্রামস্থল। আর তখত কথাটির অর্থ অস্থায়ী আসন। জুউজায়গাটি পঞ্জাবের ভাতিন্ডা অঞ্চলে। শিখধর্মে আরও চারটি অস্থায়ী আসন আছে – অকাল তখত, কেশরগড় সাহিব তখত, পাটনা সাহিব তখত ও হুজুর সাহিব তখত। ১৯৬৬ সালে শিখদের সর্বোচ্চ শিরোমণি গুরুদ্বারা প্রবন্ধক কমিটি এই দমদমা সাহিবকে পঞ্চম তখত হিসেবে স্বীকৃতি দান করেন।

এতক্ষণ তোকে অমৃতসরের শুধু ভূমিকাটাই দিলাম। এতক্ষণে আমাদের ট্রেন অমৃতসর স্টেশনে ঢুকে গেছে।

শতাব্দী এক্সপ্রেসে গিয়ে রাত এগারোটায় হোটেলে পৌছালাম।

পাল্কি সাহিব

এবার আমাদের প্রথম দিনের, সঠিক বললে প্ল্যানমাফিক প্রথম রাত বলি, বা পরের দিনের ভোর তিনটের সময় বলি, আমরা স্বর্ণমন্দিরে গিয়ে পাল্কি সাহিব অনুষ্ঠান দেখতে যাবো। মানে রাত আড়াইটে নাগাদ হোটেল থেকে রওয়ানা দিতে হবে।

এটি একটি অনুষ্ঠান, দিনে দু’বার হয়। রাত পৌনে দশটা নাগাদ হরমন্দির সাহিবে দিনের শেষ হুকুমনামা (Order of the Day) পাঠ হয়ে গেলে, এরপর রাত দশটা নাগাদ গুরু গ্রন্থসাহিবকে হরমন্দির সাহিব থেকে স্বর্ণখচিত পালকি সিংহাসনে সাজিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে অকাল তখত সাহিবে নিয়ে যাওয়া হয়। এই পালকিকেই বলে পালকি সাহিব। সকলের আগে একজন ট্রাম্পেট বাজিয়ে আসেন। পিছনে ভক্তরা কাঁধে সেই পালকি বহন করেন। সকলের বিশ্বাস, অকাল তখতে গুরু গ্রন্থসাহিব ঐসময় রাত্রির বিশ্রাম নেন। অকাল তখতে সেইসময় গ্রন্থসাহিব বন্ধ রাখা হয়, উনার নির্বিঘ্নে বিশ্রামের জন্য কীর্তন বন্ধ থাকে, শুধু কিছু বিশেষ স্লোক উচ্চারিত হয়। অন্যদিকে এইসময় হরমন্দির সাহিবের দৈনন্দিন পরিস্কারের কাজ চলে। ভক্তরাই এটি করেন। শীত গ্রীষ্মের সময় অনুযায়ী এই অনুষ্ঠানের সময়ের কিছুটা পরিবর্তন হয়।

পরদিন ভোররাতে চারটে নাগাদ ভক্তরা আবার গুরু গ্রন্থসাহিবকে পালকি সাহিবে স্থাপন করে অকাল তখত থেকে হরমন্দির সাহেবে শোভাযাত্রা করে নিয়ে আসেন। সেখানে পীড়া সাহেবের (পবিত্র শয্যা) উপর গুরু গ্রন্থসাহিব স্থাপন করা হয়। উপস্থিত সকল ভক্তরা গুরবাণী কীর্তন করেন। তারপর গ্রন্থ সাহিব খুলে তাঁর দিনের প্রথম বিশেষ অধ্যায় হুকুমনামা (Order of the Day) পাঠ করা হয়। একটু বেলার দিকে অর্দাস (শিখদের প্রার্থনা) শেষ হলে কড়া প্রসাদ সকলের জন্য বিতরন করা হয়। এই পালকি সাহিব শোভাযাত্রা দেখতেই দেশ বিদেশের অনেকে এখানে আসেন। আমরাও সেজন্যই ভোররাতেই এসেছি।

আমরা যখন রাত তিনটের সময় পৌছালাম, তানিয়া, দেখি অসংখ্য লোক। আসলে স্বর্ণমন্দির প্রাঙ্গণ চব্বিশ ঘণ্টা দিনে রাতে সকলের জন্যই উন্মুক্ত। আন্দাজ দেশ বিদেশের লক্ষখানেক দর্শনার্থী প্রতিদিন এখানে আসেন। এঁরা সকলেই যে শিখধর্মীয়, তা নয়। সর্বধর্মের লোকজনই এখানে আসেন। ভারতবর্ষের শিখদের সেবাধর্মের মানসিকতা এখন সারা বিশ্বে সমাদৃত। যে কোনো গুরুদ্বারে গেলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আর অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে সকলেই বিশেষভাবে সেটি উপলব্ধি করতে পারে।

আমরা রাতের বেলায় পালকি সাহিব দর্শনে গিয়েছিলাম কারন এক, তখন ভীড় কম থাকে। কম মানে হাজার পাঁচ সাতেক তো হবেই। আর দ্বিতীয় কারন, ঐ ভোররাতের স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় পরিবেশ থাকে অত্যন্ত মনোরম। আমরা অকাল তখতের এক কোণে গিয়ে বসলাম। রাত তিনটের সময় গিয়েও আমরা তখন অনেক লোকের পিছনে। জায়গাটা মনঃপূত হলো না, এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে আমরা হরমন্দির সাহিবের একদম প্রবেশদ্বারের কাছে গিয়ে বসে পড়লাম। সামনেই রেলিং, অর্থাৎ আমাদের ঠিক সামনে দিয়েই পালকি সাহিব শোভাযাত্রা যাবে। চারটে নাগাদ পালকি সাহেব এলো, অকাল তখতের সামনে পালকি রেখে অনেকক্ষন, প্রায় আধঘন্টা ধরে গুরবানী কীর্তন ও স্তোত্রপাঠ হলো। এরপর আমাদের সামনে দিয়ে স্বর্ণখচিত পালকি সাহিব ভক্তদের কাঁধে চড়ে হরমন্দির সাহিবে ফিরে এলেন।

এই পালকিযাত্রা আমার কাছে এককথায় ইউনিক (unique) মনে হয়েছে। দেবতাকে (এখানে দেবতা কিন্তু কোনো মূর্তি নয়) রাতের বিশ্রামের জন্য প্রতিদিন মূল মন্দির থেকে বিশ্রামস্থলে নিয়ে যাওয়া আবার প্রতিদিন সকালবেলা নিদ্রাভঙ্গের পরে মূল মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে আসা, এর দ্বিতীয় ধর্মীয় উদাহরণ হয়তো আছে, কিন্তু নেট বা এনসাক্লোপিডিয়া ঘেঁটে দ্বিতীয়টি আর পেলাম না। আরও জানলাম, ভক্তরা গুরু গ্রন্থসাহিবকে স্বর্ণমন্দির প্রাঙ্গনে নিয়মিত প্রদক্ষিণ করান।

পালকি দর্শনের পর আমরা আবার হরমন্দির সাহিবে ফিরে আসি। এই হরমন্দির সাহিব সর্বধর্মের জন্য উন্মুক্ত। এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন সুফি সন্ত মিয়াঁ মীর। এই মন্দিরের যদিও একটিমাত্র প্রধান দ্বার, কিন্তু সর্বমোট চারটি দ্বার আছে, যা সর্বধর্মকে সন্মান করে। স্থাপত্যের কথা ধরলে এটি ভারতীয় ও মুঘল ঘরানার মিশ্রন। তাজমহলের মার্বেল পাথরের কারুকার্য্যে এর অনেক মিল পাওয়া যায়। আরও একটি বিশেষত্ব, জলের উপরে আমরা মন্দিরের দ্বিতলটা দেখি, এর নীচের অংশ আছে জলের মাঝে। অনেকেই বলে স্বর্ণপমন্দির নাকি রাতের আলোয় বেশি সুন্দর লাগে। আমারও সেইরকমই মনে হলো।

তানিয়া,

যা দেখলাম, কতকগুলি বৈশিষ্ট তুলে ধরতে চাই। আমরা হিন্দুধর্মে মূর্তিপুজায় বিশ্বাস করি। আমাদের হিন্দুদের গীতার মতন শিখদের গুরু গ্রন্থসাহিব। এই গুরু গ্রন্থসাহিবকেই এঁরা পূজা করেন।

কিন্তু শিখদের প্রধান ব্যাবহারিক ধর্ম হলো সেবাধর্ম। সেসময় এঁরা জাতি-ধর্মের উচ্চ-নীচের ভেদাভেদ রাখেন না। সকলকেই এঁরা একনজরে দেখেন। এই স্বর্ণমন্দির প্রাঙ্গণে যারা যারা সেবক আছেন, বিভিন্ন সেবায় নিযুক্ত, তাঁরা প্রত্যেকেই পরিস্কার পোষাক পড়েছেন। কারোর পোষাকেই সামান্যতমও অপরিচ্ছন্নতা নেই। সকলকেই এখানে জুতো খুলে মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে হয়। জুতো জমা দেওয়ার কাউন্টার আছে, কোনো পয়সা দিতে হয় না। রাত তিনটের সময় কাউন্টারে যারা আছেন, দেখেই বুঝতে পারি উনারা প্রত্যেকেই ভদ্র, সমাজে প্রতিষ্ঠিত, আর কেউ কেউ হয়তো উচ্চবিত্তও। দিনের বেলায় ব্যাস্ততার মধ্যে সময় করতে পারেন নি, তাই রাতের দর্শনার্থীদের সেবা করতে এসেছেন। এনারা নির্দ্বিধায় খালি হাতে জুতোগুলো তুলে নিলেন। ভেতরে দেখি কয়েকজন জুতো পালিশ করছেন। এনাদের চেহারা আর পোষাকেও ভদ্র পরিবারের ছাপ। জানলাম, যদি জুতোয় ময়লা থাকে, এই সেবকেরা নিজেরাই সেটা পরিস্কার করে দেন।

স্বর্ণমন্দির প্রাঙ্গনের পুরোটাই মার্বেল পাথরে বাঁধানো। একনজরেই দেখা যায় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। প্রাঙ্গনের বিভিন্ন স্থানে ঝাড়ু রক্ষিত আছে। সেই পরিস্কার রাস্তায় অনেকেই হাতে ঝাড়ু নিয়ে সেটাকে আরও পরিস্কার করছেন, কেউ কেউ ভিজে কাপড় দিয়েও রাস্তা মুছে দিচ্ছেন। সারাদিন সারারাত একের পর এক দর্শনার্থী এসে সেই ঝাড়ু নিয়ে নিজেদের সেবাদান করছেন। সুতরাং এখানে অপরিচ্ছন্ন হওয়ার কোনো অবকাশই নেই। আমার জামার পকেটে জুতো জমা রাখার টোকেনটা ছিলো। পকেট থেকে মোবাইল বার করার সময় টোকেনটা পড়ে গিয়ে গড়িয়ে কিছুটা দূর চলে যায়। আমি কিছু করার আগেই দেখি একজন বয়স্ক মহিলা সেটি তুলে আমাকে দিলেন। আমি স্বভাবসিদ্ধ প্রথায় সুক্রিয়া (ধন্যবাদ) বলতেই তিনি প্রশ্ন করলেন, কিউ, সুক্রিয়া কিউ? অর্থাৎ এটি একটি সেবা, উনার মতে আমার ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ নয়।

এবার আসি গুরু কি লঙ্গরে। এটি চালু করেন গুরু নানক, পরবর্তীকালে তৃতীয় শিখগুরু গুরু অমরদাস এটি প্রথা হিসেবে চালু করেন। আবার অনেকে বলেন ১৫৭৭ সালে চতুর্থ গুরু রামদাস এটিকে প্রথা হিসেবে চালু করেন। মহারাজা রণজিৎ সিং ও পরবর্তীকালে পঞ্জাবের অনেক রাজা ও ধনী ব্যাক্তিরা এই লঙ্গরের জন্য বিশাল অংকের অর্থদান করেছিলেন। কথিত আছে, শিখরা সেবাদানে বিশ্বাস রাখেন এবং তাঁদের অর্জিত অর্থের দশ শতাংশ গুরুদ্বারা কমিটির উদ্যোগে সমাজের বিভিন্ন সেবামূলক কাজে দান করেন। এই সেবা শুধুমাত্র শিখদের নিজেদের জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে যে কোনো কল্যানমূলক কাজে।

এই গুরু কি লঙ্গরের সেবায় মহিলা, কিশোরবয়সী ও যুবক যুবতীদের অংশগ্রহণ এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। সারা দিনেরাতে এই লঙ্গর চালু থাকে, এবং আনুমানিক ষাট সত্তর হাজার দর্শনার্থী প্রতিদিন এখানে ভোজন করেন। বিশেষ বিশেষ দিনে এর দ্বিগুণ দর্শনাথীও লঙ্গরে আসেন। আমাকে একজন স্থানীয় জানালেন, দিনে ১২,০০০ কিলো ময়দা লাগে। আর লাগে দিনে অন্তত একশ’ গ্যাস সিলিন্ডার আর ৫,০০০ কিলো জ্বালানী। অটোমেটিক রুটি তৈরির মেশিনে ঘন্টায় ২৫,০০০ রুটি তৈরি হয়। অনেক দর্শনার্থীরা দূর দূরান্ত থেকে এসে স্বর্ণমন্দিরের মার্বেলে সারা রাত ঘুমিয়ে থাকেন বা বিশ্রাম নেন। এঁদের জন্য সকাল ৪টে থেকে ৫টা পর্যন্ত আনুমানিক ২৫ হাজার কাপ চা বিতরণ করা হয়।

তানিয়া, জানি না শুধু লিখে কলমের জোরে তোকে কতটা বোঝাতে পারবো। এ জিনিষ নিজের চোখে দেখতে হয়। তবু চেষ্টা করলাম যদি বোঝানো যায়। লঙ্গরে প্রবেশ করলেই দেখা যায় পরিস্কার পরিচ্ছন মার্বেলের জমিতে ততটাই পরিস্কার টানা লম্বা আসন পাতা। আসনের যেখানে খুশি বসা যায়, তবে সকলকেই আসন করে বসা এবং মাথা ঢেকে বসা বাধ্যতামূলক। সেবকেরা স্টিলের থালায় রুটি, ডাল, তরকারি আর ক্ষীর (ঘন দুধের মতন) পরিবেশন করেন। একটু পরে পরেই ধ্বনি ওঠে, যো বোলে সো নিহাল, সৎ শ্রী অকাল। একদিকে যখন খাদ্য পরিবেশন হয়, অন্যদিকে প্রায় একশ’ জন মহিলা আর পুরুষ তরকারি কেটে পরিস্কার করে ধুয়ে রাখেন, আর তারই পাশাপাশি লঙ্গরের বাইরে তখন আরেকদল মহিলা আর পুরুষরা এঁটো বাসন মেজে পরিস্কার করে রাখেন। প্রতিটি সেবা এঁরা আন্তরিকভাবে করেন, কোনো ফাঁকি থাকে না। তবে এও দেখলাম, অনেকেই ঘুরতে এসে শুধুমাত্র সেবা করার একটা ফটো তুলে নিয়ে চলে গেলো। হয়তো একটা মাত্র রুটি বেলে দিয়েই ফটো তুলে চলে গেলো, এরপর ফেসবুকে ছাপিয়ে দেবে।

তানিয়া,

আজ এই গুরু কি লঙ্গর শুধুমাত্র দুনিয়ার সবথেকে বড় কমিউনিটি কিচেনের স্বীকৃতিই অর্জন করেনি, তাঁরা বিভিন্ন সেবার মাধ্যমে অন্যদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনেও সক্ষম হয়েছে।

স্বর্ণমন্দির ঘুরে যা দেখলাম, এখানের মোটামুটি পুরো সেবাই বিনা পারিশ্রমিকের। শ্রমদান বলতে জুতো সংরক্ষণ, চলার পথের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, পুষ্করিণী পরিচ্ছন্ন রাখা ও লঙ্গর সেবা। এই গুরু কি লঙ্গর সেবা আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। তরকারি ইত্যাদি কেটে পরিস্কার করে যোগান দেওয়া, রান্না করা, পরিবেশন করা, ও থালাবাসন পরিস্কার করা। আর বিশেষ উর্দি পরা ভলান্টিয়াররা তো সর্বত্রই আছে। এছাড়া আছে সময় বিশেষে মন্দিরের রক্ষনাবেক্ষন, (maintenance)। এই সেবাও ওরা নিজেরাই করেন। তবে হ্যাঁ, এখানে প্রায় চারশ’ বেতনভোগী কর্মচারী আছেন। আর দিনেরাতের বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমদান করেন আরও চার পাঁচশো জন।

তানিয়া, আজ এইটুকুই থাক। এরপর আমরা জালিয়ানওয়ালাবাগ যাবো, পাকিস্তান বর্ডারে বিএসএফের ড্রিল দেখতে হবে, পুরনো শহরের হাতীদ্বারের কাছে রাজপুরা গলিতে ১১৮ বছরের পুরনো কেশর দা ধাবায় গিয়ে পরোঠা খেতে হবে। ঘুরে ঘুরে পঞ্জাবী লসসি, কুলচা, তন্দুরী, খেতে হবে। শহরটাও তো একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছে আছে। এখন অনেক কাজ রে তানিয়া।

আজ এইটুকুই, গুড নাইট।