Next
Previous
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in






















প্রথম পর্ব 
মার্চ সংখ্যায় 
https://rritobak.blogspot.com/2023/03/blog-post_51.html 



রাজা হল সিরাজ

অন্য সবদিনের মতই সেদিনও আলিবর্দি খান রাত্রি তৃতীয় প্রহরের শেষে প্রায় অন্ধকার থাকতে থাকতে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে, কোরান পাঠ করে সকাল সাতটায় বন্ধুদের সঙ্গে কফি-পান সেরে রাজদরবারে গিয়ে বসলেন। প্রতিদিনকার মত প্রায় দু’ঘন্টা সেনাবাহিনীর অধ্যক্ষ ও বিভিন্ন বিভাগের আধিকারিকদের সঙ্গে জরুরি আলোচনা সেরে বৈঠকখানায় যাবার আগে অন্দরমহলে খবর পাঠালেন যে আজ সন্ধ্যায় প্রাসাদের সকলে যেন বৈঠকখানায় আসে। আফসার রাজপরিবারের প্রত্যেক সদস্য যেন অবশ্যই হাজির থাকে। আগুনের গতিতে খবর ছড়িয়ে পড়ল রাজপ্রাসাদের সর্বত্র। সকলে চিন্তিত এবং উৎসুক হয়ে উঠল। সকলের মনে একই প্রশ্ন, কী ঘোষণা করতে চলেছেন নবাব আলিবর্দি খান? আবার কোনও দুঃসংবাদ নয় তো? আবার কোনও আসন্ন মারাঠা আক্রমনের প্রস্তুতি নয় তো? প্রাসাদ ছেড়ে কোনও গোপন আস্তানায় চলে যেতে হবে না তো? মারাঠারাজ রঘুজি ভোঁসলের আক্রমনে বারবার কেঁপে উঠেছে বাংলার মসনদ। এই বৃদ্ধ বয়সেও নিজের লোকেদের বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজের বুদ্ধি আর নিপুণ রণকুশলতায় বাংলা , বিহার, উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দি খান নিজের সাম্রাজ্য এবং পরিবারকে বারবার রক্ষা করেছেন শত্রুদের হাত থেকে বিশেষ করে রঘুজি ভোঁসলের হাত থেকে। বিগত পাঁচ বছর ধরে রঘুজির সৈন্য ক্রমাগত আক্রমন করেছে আলিবর্দির সাম্রাজ্য। সেবার যখন মারাঠা সৈন্যরা উড়িষ্যা আক্রমন করল নিজের ভাগ্নে মিরজাফর উড়িষ্যার সুবেদার হওয়া সত্ত্বেও হাত-পা গুটিয়ে বসে রইল যতক্ষণ পর্যন্ত না মিরজাফরকে সরিয়ে এই বৃদ্ধ বয়সে সত্তরোর্দ্ধ আলিবর্দি নিজে মোগলরাজের সাহায্য নিয়ে রণক্ষেত্রে পৌঁছলেন। শেষ অবধি ফল খুব একটা আশাপ্রদ হয়নি। অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌল্লার সহায়তা সত্ত্বেও উড়িষ্যা হাতছাড়া হয়ে গেল। গতবছর মোগলরাজ আহমেদ শা বাহাদুর উড়িষ্যার বিনিময়ে ত্রিপাক্ষিক যুদ্ধবিরোধি চুক্তিতে রাজি করালেন রঘুজিকে। আহমেদ শা, আলিবর্দি আর রঘুজির স্বাক্ষরসম্বলিত এই শান্তিচুক্তি সত্ত্বেও রাজপরিবারের সকলের মন থেকে সন্দেহ সম্পূর্ণ দূর হয়নি। মারাঠারা তো শত্রু, নিজের বাড়ির লোকেরাই তো বারবার বিব্রত করেছে আলিবর্দিকে। এই দু’বছর আগে মাত্র সতের বছর বয়সের আদরের নাতি সেনাবিহিনীর কিছু লোককে ভয় দেখিয়ে জোর করে পাটনা দখল করে নিল। আলিবর্দির অত্যন্ত স্নেহের পাত্র এই ছোট নাতি। খেলাচ্ছলে এমন কান্ড করে ফেলেছে এই সব বলে বুঝিয়ে সুজিয়ে সে যাত্রায় সিরাজকে নিরস্ত করে শান্তি বজায় রেখেছিলেন আলিবর্দি। বাইরে তো শত্রুর অভাব নেই। তার ওপর নিজের নাতি এসব কান্ড করলে শত্রুরা যে তার সুযোগ নেবে সে কথা বলে নাতিকে ফিরিয়ে আনেন আলিবর্দি। কিন্তু দাদুর প্রশ্রয়ে দিন দিন অনাচারী হয়ে উঠছে সে। বিশেষ করে নারীদের প্রতি তার আসক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে চিন্তাও হয় আলিবর্দির। এই একই আসক্তিতে আক্রান্ত আলিবর্দির পূর্বসুরী নাসিরি বংশের শেষ নবাব সরফরাজের পরিণতির কথা তো সবাই জানে। তবুও এই নাতির মধ্যে কী যে দেখেন আলিবর্দি কে জানে? শুধুই কি অন্ধ দৌহিত্রস্নেহ না আরও কিছু?

বৈঠকখানায় একঘন্টা ধরে একটু হাসিমজা, একটু সাহিত্যচর্চা সেরে মধ্যাহ্নভোজের মেনুতে মনোনিবেশ করলেন আলিবর্দি। মধ্যাহ্নভোজ আলিবর্দির একটা বড় দুর্বলতার জায়গা। কিসের মাংস আর কী মশলা দিয়ে তৈরি হবে প্রতিটি ব্যঞ্জন তা নিজেই প্রতিদিন ঠিক করেন আলিবর্দি। তারপর তাঁর নিজের তত্ত্বাবধানে সেইসব পদ রান্না করেন দেশ বিদেশ থেকে আগত রন্ধনকুশলীরা। সুবিস্তৃত খাদ্যসম্ভার যখন নবাবের সামনে পরিবেশিত হত সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠত সমস্ত রাজপ্রাসাদ। নবাব আলিবর্দি তাঁর তত্ত্বাবধানে তৈরি পদগুলি একটু একটু করে মুখে দেন আর রন্ধনকুশলীরা দমবন্ধ করে অপেক্ষা করে থাকেন নবাব কী বলবেন তা শোনার জন্য। প্রতিটি পদের স্বাদ এবং গন্ধের বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যায় আলিবর্দির দক্ষতা অনবদ্য। সে ব্যাখ্যা অনেক কবিতাকেও হার মানায়। এই সময় কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকেন আলিবর্দি। দীর্ঘ মধ্যাহ্নভোজপর্বের পর একঘন্টাব্যাপী দিবানিদ্রা আলিবর্দির অভ্যাস। এই নিদ্রা সহজে আসে না। পেশাদার গল্পকথকের গল্প শুনতে শুনতে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যান আলিবর্দি প্রতিদিন। গল্পকথকের বড় অভাব । একে তো হাজারজনে একজন পড়তে পারে। দশলক্ষে একজনের প্রতিদিন পড়ার অভ্যাস আছে। তাই গল্পকথকের বড় আদর রাজপরিবারে। কিন্তু কেন? জ্ঞান আহরণের জন্য? না, ঘুম পাড়ানোর জন্য। নবাবকে ঘুম পাড়ানোর জন্য তাই দুর্লভ নিত্যনতুন গল্পকথকদের খুঁজে নিয়ে আসা হত রাজপ্রাসাদে। এই মহামূল্যবান রাজকীয় দিবানিদ্রার পর প্রক্ষালনের পর্ব। প্রক্ষালন ও পোশাক পরিবর্তনের পর নিয়মমাফিক প্রার্থনা এবং কোরানপাঠ সম্পূর্ণ করে আলিবর্দি এক পাত্র সোরামিশ্রিত জল পান করেন। এই সোরামিশ্রিত পানীয়জল বিশেষ পদ্ধতিতে দুইফুট গভীর মৃৎপাত্রে নির্মল শীতল বাতাসে জারিত করে প্রস্তুত করা হয় প্রতিদিন। মৃৎপাত্রের মধ্যভাগ থেকে এই পানীয় একটি পানপাত্রে পরিবেশন করা হয় নবাববাহাদুরকে। এরপর শুরু হয় রাজদরবারের দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বে রাজদরবারে উপস্থিত থাকেন আমন্ত্রিত শিক্ষিতজনেরা। কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, কোরানবিশারদ ইত্যাদি নক্ষত্র সমাগমে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রাজদরবার। ধূমপায়ীরা নানাবিধ হুকা থেকে ধূমপান করেন। আলিবর্দির ধূমপানের অভ্যাস নেই তাই বিলাতি কফির বিশেষ ব্যবস্থা আলিবর্দির জন্য। নানা বিষয়ে আলোচনা বিশেষ করে কোরানের ব্যাখ্যা চলতে থাকে যতক্ষণ না সকলে গাত্রোত্থান করেন। তারপর সারাদিনের প্রশাসনিক কাজকর্মের হিসাব নিকাশ,গুপ্তচরদের কাছ থেকে শত্রুদের গতিবিধি, জগৎশেঠের কাছ থেকে আর্থিক খবরাখবর এবং নবাবের বেতনভোগী সাংবাদিকদের কাছ থেকে সাম্রাজ্যের বিভিন্নপ্রান্তের খবর শুনে সেদিনের মত দরবারের কাজ শেষ হয় আলিবর্দির। এই দরবারের কাজ রাজপরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানত একাই করেন আলিবর্দি। মাঝে মধ্যে আসে বড় জামাই নওয়াজিস মহম্মদ খান। এই বড় জামাই হচ্ছে আবার আলিবর্দির বড় ভাই হাজি আহমেদের ছেলে। আলিবর্দির তিন কন্যার মধ্যে দুই কন্যার বিবাহ হয় আলিবর্দির বড় ভাই হাজি আহমেদের দুই পুত্রের সঙ্গে। আলিবর্দির কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র তথা জামাতারাই ছিল তাঁর পুত্রসম। বড় মেয়ে মেহেরুন্নিসা বা ঘসেটি বেগমের সঙ্গে বিবাহ হয় নওয়াজিসের। সেই সুবাদে রাজদরবারে অবাধে আসার অধিকার অর্জন করেছিল নওয়াজিস। নবাব বড় আদরের মেহেরুন্নিসা এবং নওয়াজিশের জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন এক অপূর্ব সুন্দর প্রাসাদ। এই প্রাসাদের নাম ছিল সঙ্গ-ই- দালান। কিন্তু মতিঝিলের তীরে অবস্থিত বলে এই প্রাসাদকে সকলে মতিঝিল প্রাসাদ বলেই জানে। নবাবের স্নেহ , নিজস্ব রাজপ্রাসাদের মালিকানা এবং রাজদরবারে অবাধ প্রবেশের অধিকার অর্জন করে নিজেকে মুকুটহীন নবাব বলেই মনে করে নওয়াজিস। রাজপরিবারে আর একজনের অবাধ প্রবেশের অনুমতি ছিল নিজের ইচ্ছেমত রাজদরবারে আসার। সে হচ্ছে আলিবর্দির অত্যন্ত স্নেহের নাতি সিরাজ, আলিবর্দির দ্বিতীয় কন্যা আমিনা বেগমের সন্তান। তার বয়স এখন উনিশ। সিরাজের প্রতি আলিবর্দির দুর্বলতার কথা সর্বজনবিদিত। আলিবর্দির নিজে ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ, দূরদর্শী এবং সংবেদনশীল। শিল্প এবং শিল্পীর প্রতি তাঁর অনুরাগ এবং সম্মান ছিল আন্তরিক এবং গভীর। দক্ষ প্রশাসক এবং সেনাপ্রধান হিসাবে সেই সময়ে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই। প্রয়োজনে ঘোড়ায় চড়ে, অস্ত্রহাতে নিজেও সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পিছপা হতেন না আলিবর্দি। পরিবারের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল অপরিসীম। তাঁর স্ত্রী এবং তিন কন্যার মাতা সারফুন্নিসাকে আজীবন আগলে রেখেছিলেন সব শক্তি এবং ভালোবাসা দিয়ে। অন্য নবাবদের মতো বহুবিবাহে আবদ্ধ হননি আলিবর্দি। তাঁর উত্থানের পথে যারা তাঁর প্রতি সাহায্য এবং সহায়তার হাত বাড়িয়েছিল তাদের হাত ভরে দিয়েছেন আলিবর্দি। তারা রাজপ্রাসাদের দাস-দাসীই হোক বা কোনও দপ্তরের সাধারণ কর্মচারি বা সামান্য কোনও মদ্য পরিবেশক। তারা আজও আলিবর্দিকে পিতার মত শ্রদ্ধা করে। আলিবর্দির আশ্রয় তাদের কাছে মাতৃক্রোড়ের চেয়েও নিরাপদ।আসলে এই মানুষগুলির প্রতি তাঁর দুর্বলতার প্রধান কারণ এই যে তিনি নিজেও একসময় এই শ্রেণীর মানুষদের অন্তর্গতই ছিলেন। তাঁর বাবা মির্জা মহম্মদ মাদানি ছিলেন মোগলরাজ আওরঙ্গজেবের পিতা শাহজাহানের এক পালিত পুত্রের সন্তান। কর্মসূত্রে তিনি ছিলেন আওরঙ্গজেবের ছেলে আজম শাহের অত্যন্ত বিশ্বাসী মদ্য পরিবেশক। আজম শাহের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিল মাদানির দুই সন্তান মহম্মদ আলি এবং মির্জা আহমেদ। মহম্মদ আলি থেকে নবাব আলিবর্দি খান হয়ে ওঠার গল্প এক কঠিন জীবনসংগ্রামের কাহিনী। অনেক পথ পেরিয়ে , অজস্র বাধা অতিক্রম করে আলিবর্দি যখন বাঙলার নবাবিয়ানা দখল করলেন তখন তাঁর বয়স প্রায় সত্তর। সেও আজ থেকে বারো তেরো বছর আগেকার কথা।

নবাব আজম শাহ মহম্মদ আলিকে হাতিশালা এবং অপরূপ সূচীকার্যে অলঙ্কৃত রাজপোশাক ভান্ডারের রক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেন। অত্যন্ত দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করে অচিরেই আজম শাহের কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন মহম্মদ আলি। কিন্তু আজম শাহের অকস্মাৎ মৃত্যুতে মহম্মদ আলির জীবনে নেমে এল প্রচন্ড আঘাত এবং দারিদ্র। বেশ কিছুদিন চরম দারিদ্রের মধ্যে কাটিয়ে কটকে এক পারিবারিক আত্মীয় সুজাউদ্দিনের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে সস্ত্রীক মির্জা মহম্মদ মাদানি এবং তার দুই সন্তান মহম্মদ আলি , মির্জা আহমেদ এবং তাদের পরিবার। মির্জা মহম্মদের স্ত্রী এবং সুজাউদ্দিনের স্ত্রী দুজনেই ছিল আফসার সম্প্রদায়ভুক্ত। মোগলসম্রট আওরঙ্গজেবের অত্যন্ত প্রিয় পাত্র বাঙলা ,বিহার এবং উড়িষ্যার স্বঘোষিত প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খানের জামাতা সুজাউদ্দিন তখন উড়িষ্যার ডেপুটি গভর্নর। নবাবের সঙ্গে নানা কারণে সুজাউদ্দিনের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। নারী এবং সুরায় আসক্ত সুজাউদ্দিনকে রাজধানী থেকে দূরে রাখার জন্য নবাব তাকে উড়িষ্যার দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেন। সুজাউদ্দিনের দপ্তরে নিজেদের কর্মদক্ষতা এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জন্য মহম্মদ আলির ভাগ্য খুলতে থাকে ক্রমশ। বেশ কাটছিল সময় কিন্তু অকস্মাৎ সুজাউদ্দিনের জীবনে নেমে আসে বিপদ। নবাব মুর্শিদকুলি খানের দুই কন্যা আজমউন্নিসা এবং জিনাতুন্নিসাকে বিবাহ করেছিল সুজাউদ্দিন। সুতরাং মুর্শিদকুলি খানের মৃত্যুর পর রাজসিংহাসনের একমাত্র অধিকার যে তারই সে বিষয়ে নিঃসংশয় ছিল সুজাউদ্দিন। নবাব মুর্শিদকুলি খানের বড় মেয়ে আজমুন্নিসা ছিল মানসিক বিকারগ্রস্ত। কথিত আছে মৃত মানুষের বিশেষত পুরুষমানুষের কলিজা ছিল তার অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য। লোকে তাকে কলজেখাকি বেগম বলে ডাকত। এক অজ্ঞাত অসুখে অত্যন্ত অল্পবয়সে কোনও সন্তানের জন্ম না দিয়েই মারা যায় আজমুন্নিসা। মুর্শিদাবাদের দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যায় যে আজমুন্নিসাকে জীবন্ত কবর দিয়েছিল ক্রোধান্ধ সুজাউদ্দিন। এরপর নবাবের ছোট মেয়ে জিনাতুন্নিসাকে বিবাহ করে সুজাউদ্দিন এবং তাদের একটি পুত্রসন্তান হয় যার নাম সরফরাজ। মুর্শিদাবাদের রাজপ্রাসাদে পিতামহ পিতামহীর কাছেই বড় হতে থাকে সরফরাজ। জিনাতুন্নিসাও রয়ে গেল মুর্শিদাবাদে। এরপর অনেকটা সময় কেটে গেল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদকুলি খানের সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়তে থাকল সুজাউদ্দিনের। ইতিমধ্যে জিনাতুন্নিসার সঙ্গেও সম্পর্কও খারাপ হতে থাকল সুজাউদ্দিনের। মহম্মদ আলি নিজের কর্মদক্ষতা ও বুদ্ধিতে সুজাউদ্দিনের কাছের মানুষ হয়ে উঠল। প্রশাসন এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য মহম্মদ আলির ওপর সুজাউদ্দিনের নির্ভরতা ক্রমাগত বেড়েই চলল। সে কথা রাজপরিবারের কারও অজানা ছিল না। এদিকে মুর্শিদকুলির শরীর আস্তে আস্তে খারাপ হতে হতে এমন অবস্থায় এসে পৌঁছল যে তিনি সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। সুজাউদ্দিনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যখন রাজধানী থেকে খবর এল যে মৃত্যুশয্যায় শায়িত নবাব মুর্শিদকুলি জামাতাকে রাজ্যভার সমর্পণ না করে সাতাশ বছরের দৌহিত্র এবং সুজাউদ্দিনের পুত্র সরফরাজকে পরবর্তী নবাব হিসাবে ঘোষণা করেছেন। রাগে দুঃখে কাতর সুজাউদ্দিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। সেই সময় তার পাশে এসে দাঁড়াল মহম্মদ আলি। এই বিপদের দিনে মহম্মদ আলি আর হাজি মহম্মদ এই দুই ভাই ছাড়া তার কাছে আর কেউ নেই। মহম্মদ আলি সুজাউদ্দিনকে বোঝাল যে নবাবের এই সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক এবং কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। পুত্রের অধীনস্থ কর্মচারী হয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব। সুজাউদ্দিনের উচিৎ এই মুহূর্তে উড়িষ্যার দায়িত্ব টাকি খানের হাতে সমর্পণ করে সসৈন্যে মুর্শিদাবাদের দিকে এগিয়ে যাওয়া।জিনাতুন্নিসার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর আরও একবার বিবাহ করে সুজাউদ্দিন। টাকি খান সেই তৃতীয় স্ত্রীর সন্তান। মহম্মদ আলি বোঝাল যে বাঙলার মসনদ সুজাউদ্দিনের অধিকার এবং সে অধিকার ছিনিয়ে নেবার জন্য নিজের সন্তানের সাথে যুদ্ধে পিছপা হওয়া উচিৎ হবে না সুজাউদ্দিনের। এই ব্যাপারে দিল্লির সমর্থন সংগ্রহ করার জন্য যা করার তা করবে মহম্মদ আলি। মহম্মদ আলির ভরসায় মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল সুজাউদ্দিন। ওদিকে মাতামহের ইচ্ছা অনুযায়ী কাতরা মসজিদের সিঁড়ির নিচে নবাবের দেহ সমাধিস্থ করে এসে সিংহাসনে আরোহণের প্রস্তুতি শুরু করে দিল সরফরাজ। সুজাউদ্দিনের রক্ত বইছে সরফরাজের ধমনীতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পিতার মতই সুরা ও নারীর প্রতি সরফরাজের আসক্তি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। সুজাউদ্দিন মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করতে আসছে শুনে পিতৃহত্যার পরিকল্পনা শুরু করে দিল সরফরাজ। সুজাউদ্দিনের সেনাবাহিনী মেদিনীপুর পৌঁছবার আগেই দিল্লির সম্মতিপত্র নিয়ে পৌঁছে গেল মহম্মদ আলি। দ্বিগুন উৎসাহে মুর্শিদাবাদের দিকে ধেয়ে চলল সুজাউদ্দিনের বাহিনী। সরফরাজ ঠিক করল মুর্শিদাবাদের অনেক আগে কাটোয়াতেই প্রতিহত করতে হবে সুজাউদ্দিনের বাহিনীকে। সবকিছু দেখেশুনে প্রমাদ গুনলেন মুর্শিদকুলির স্ত্রী সদ্যবিধবা নাসিরি বানু বেগম। নাতি সরফরাজকে ডেকে বললেন হাজার হলেও সুজাউদ্দিন সরফরাজের জন্মদাতা পিতা। পিতৃহত্যা পাপ এবং তার ফল কখনই ভাল হতে পারে না। তাছাড়া সুজাউদ্দিনের কাছে দিল্লির অনুমতিপত্র আছে। রাজপরিবারের আস্থাভাজন কর্মচারি এবং সুজাউদ্দিনের একান্ত অনুচর মহম্মদ আলি নিজে এ কথা জানিয়েছে তাকে। সুজাউদ্দিনের বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে। উশৃঙ্খল জীবনযাপনের ফলে তার আয়ুও হয়ত খুব একটা বেশি নয়। খুব বেশি হলে হয়ত আর দশ বারো বছর। তারপর সরফরাজের নবাব হওয়ার আর কোনও বাধা থাকবে না। শত্রুর সাথে লড়াই আর নিজের জন্মদাতা পিতার সঙ্গে লড়াই এক নয়। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় সম্মানের কিন্তু পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় সম্মানের নয়। আর তাছাড়া কে বলতে পারে যুদ্ধে কী ঘটে। যদি সরফরাজের কোনও অঘটন ঘটে তবে সমস্ত রাজপরিবার বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই এই কঠিন সময়ে যুদ্ধের পথ থেকে সরে এসে সুজাউদ্দিনকে নবাব হিসাবে মেনে নেওয়া অনেক বেশি দূরদর্শিতার কাজ হবে। এই সিদ্ধান্তের ফল হবে সুদূরপ্রসারী। পিতা পুত্রের সুসম্পর্ক রাজ্যচালনার ক্ষেত্রেও অনেক বেশি সহায়ক হবে। প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও মাতামহীর পরামর্শ মেনে নিল সরফরাজ। বাঙলার সিংহাসনে বিনা বাধায় আসীন হল সুজাউদ্দিন। আর তার প্রধান পরামর্শদাতা হিসাবে মুর্শিদাবাদে এল মহম্মদ আলি। নবাবিয়ানা দখল করেই মহম্মদ আলিকে রাজমহলের ফৌজদার পদে নিযুক্ত করল সুজাউদ্দিন। মহম্মদ আলির নতুন নাম হল আলিবর্দি খান। এর পরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি আলিবর্দিকে। পাঁচ বছর যেতে না যেতেই সুজাউদ্দিন আলিবর্দিকে বিহারের নায়েব নাজিম বা ডেপুটি গভর্নর পদে নিযুক্ত করল। কথিত আছে সুজাউদ্দিন তার প্রতিদ্বন্দী পুত্র সরফরাজকে বিহারের নাবিব নাজিম হিসাবে নিযুক্ত করে পাটনা পাঠিয়ে দেবার পরিকল্পনা করে। এই খবর মুর্শিদকুলির কন্যা সরফরাজের মা জিনাতুন্নিসার কানে পৌঁছতেই তিনি আলিবর্দিকে রাজপ্রাসাদে ডেকে পাঠান এবং ফটকের বাইরে দাঁড় করিয়ে তাকে বিহারের নায়েব নাজিম পদে নিযুক্ত করেন। আদরের সরফরাজকে পিতা সুজাউদ্দিনের প্রতিশোধস্পৃহার হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই দ্রুত এই সিদ্ধান্ত নেন জিনাতুন্নিসা।

যে বছর আলিবর্দি বিহারের নায়েব নাজিম পদে নিযুক্ত হন সে বছরেই জন্ম হয় সিরাজের। তাই সিরাজের প্রতি এক অন্ধ ভালোবাসা জন্মায় আলিবর্দির। শত অপরাধ সত্ত্বেও সিরাজ ছিল স্নেহান্ধ আলিবর্দির চোখের মণি। আলিবর্দি কিন্তু এতেই সন্তুষ্ট রইলেন না। তাঁর চোখ ছিল বাংলার মসনদের প্রতি দৃঢ়নিবদ্ধ। ছয় বছর কেটে গেল। সত্তর বছর বয়সী সুজাউদ্দিন দেহত্যাগ করল। স্বাভাবিকভাবেই বাংলার মসনদে বসল সুজাউদ্দিনের ছেলে সরফরাজ। তখন তার বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। মা আর দিদিমার আদরে সরফরাজ দিনে দিনে দুশ্চরিত্র এবং লম্পট হয়ে উঠেছিল। মসনদে বসার পর তার লাম্পট্য সীমাহীন হয়ে উঠল। রাজসভার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও ছাড় পেল না সরফরাজের হাত থেকে। যে বছর সরফরাজ নবাব হল সেই বছরেই ধনকুবের জগৎশেঠ ফতেচাঁদ তার নাতি ভাবী জগৎশেঠ মাধব রাই এর বিবাহ স্থির করেন একাদশবর্ষীয়া এক অসাধারণ রূপসী কন্যার সঙ্গে।এই খবর সরফরাজের কাছে পৌঁছনোমাত্রই সরফরাজ সেই সুন্দরীকে দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠল। জগৎশেঠের কাছে লোক পাঠিয়ে সেই রূপসীকে তার কাছে পাঠানোর আদেশ জানাল। অশীতিপর জগৎশেঠ সরফরাজকে বিরত করার জন্য কাতর অনুরোধ জানিয়ে বলল যে শেষবয়সে এই ভয়ঙ্কর লজ্জার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র পথ মৃত্যু। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরফরাজ কোনো অনুনয় বিনয়ে কান না দিয়ে রাতের অন্ধকারে সৈন্য পাঠিয়ে সেই রূপসীকে নিজের প্রাসাদে তুলে নিয়ে আসে। যদিও সরফরাজ কথা দিয়েছিল যে সে জগৎশেঠের ভাবী পৌত্রবধূকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত পাঠাবে কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল তা কেউ জানে না। এই ঘটনার পর ক্ষমতাশীল জগৎশেঠের পরিবার সরফরাজকে মসনদ থেকে সরানো এবং হত্যা করার গভীর চক্রান্তে মেতে উঠল। এই সুযোগে তার সঙ্গে হাত মেলাল আলিবর্দির বড় ভাই হাজি আহমেদ। আলিবর্দিও কিন্তু চুপচাপ বসেছিল না। উড়িষ্যার ডেপুটি গভর্নর থাকার সময় টাকি খান এবং সরফরাজের মধ্যে তুমুল গন্ডগোল বাধে। দুই বৈমাত্রেয় ভাই এর মধ্যে বিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে যুদ্ধ লাগার পরিস্থিতি তৈরি হয়। শোনা যায় এই বিরোধ সৃষ্টির নেপথ্যনায়ক ছিল আলিবর্দি। যুদ্ধ শুরু হবার আগেই সুজাউদ্দিনের হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় রক্তপাত হয়নি। টাকি খানকে তীব্র ভর্ৎসনা করে কটকে ফেরত পাঠায় সুজাউদ্দিন। এর কিছুদিন পরে অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু হয় টাকি খানের। এদিকে রাজদরবারের অভ্যন্তরে চক্রান্ত ঘনীভূত হতে থাকে। কিছু ক্ষমতালোভী পার্শ্বচরের বদমতলবে সরফরাজ তার প্রয়াত পিতার খুব কাছের মানুষ বিশ্বাসী পরামর্শদাতা হাজি আহমেদকে মুখ্য উপদেষ্টার পদ থেকে সরিয়ে মির মুর্তাজাকে তার স্থলিভিষিক্ত করে। হাজি আহমেদের জামাতা আতাউল্লা খানকে রাজমহলের সেনাধ্যক্ষের পদ থেকে সরিয়ে নিজের জামাতা হাসান মহম্মদ খানকে সেই পদে বসায় সরফরাজ। সুজাউদ্দিনের আর এক ঘনিষ্ট সভাসদ এবং বাংলার দেওয়ান রায় রায়ান আলমচাঁদকেও সরিয়ে দেয় সরফরাজ। বাইরে নবাবের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করলেও ভিতরে ভিতরে জগৎশেঠ ফতেচাঁদ, রায় রায়ান আলমচাঁদ আর হাজি আহমেদ সরফরাজকে গদিচ্যুত করার গোপন চক্রান্তে লিপ্ত হয়। এই ত্রিমূর্তি গোপনে সিদ্ধান্ত নিল যে সরফরাজকে সরিয়ে আলিবর্দিকে নবাব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলে দেশের এবং তাদের নিজেদের মঙ্গল।

এদিকে আলিবর্দি তার এক বন্ধু মোগল দরবারের সভাসদ ইশাক খানের সহযোগিতায় মোগলসম্রাটের সঙ্গে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে তুলল। সরফরাজের দৌরাত্মের কথা সর্বজনবিদিত হলেও রাজকোষে নিয়মিত অর্থসমাগমের জন্য মোগলসম্রাট চোখ বুজে ছিল। সুযোগ বুঝে আলিবর্দি মোগলরাজকে প্রস্তাব পাঠাল যে তাকে যদি সরফরাজের জায়গায় নবাবের পদে বসানো হয় তাহলে নগদ এক কোটি টাকা নজরানা ছাড়াও সরফরাজের বিপুল বেআইনি লুটের সম্পত্তি দিল্লিসম্রাটের হাতে তুলে দেবে। এই প্রস্তাব শুনে নড়ে বসল মোগলরাজ মহম্মদ শাহ। অন্যদিকে ত্রিমূর্তির চক্রান্তে ঘটল আর এক ঘটনা যা সরফরাজের কফিনে পুঁতে দিল শেষ পেরেক। সরফরাজ নবাবের গদিতে বসার কিছুদিন আগে ইরানের নবাব নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে। নাদির শাহের সৈন্যদের হাতে প্রায় তিরিশহাজার দিল্লিবাসীর মৃত্যু হয়। মোগলরাজের রাজসভা এবং কোষাগার থেকে লুন্ঠিত হয় প্রচুর ধনসম্পদ । এর মধ্যে ছিল হীরকখচিত স্বর্ণসিংহাসন যার নাম ছিল ময়ূরসিংহাসন এবং মহামূল্যবান কোহিনূর। নাদির শাহের ভয়ে সারা দেশজুড়ে ত্রাহি ত্রাহি রব। আতঙ্কগ্রস্থ নবাব সরফরাজ অন্য কোনও উপায় না দেখে রাজদরবারে ত্রিমূর্তির কাছে পরামর্শ চাইল। ত্রিমূর্তি এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তাদের পরামর্শে সরফরাজ নাদির শাহের নামাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা প্রস্তুত করার জন্য ট্যাঁকশালে আদেশ জারি করল। মসজিদে মসজিদে হুকুমনামা জারি হল যে নাদির শাহের নামে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। যে কোনও ভাবেই হোক নাদির শাহের স্তুতি এবং তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে যেন কোনও ত্রুটি না থাকে। এ ছাড়া নাদির শাহের হাত থেকে বাঁচার কোনও উপায় নেই। প্রচুর ধনসম্পদ এবং দাসীর বিনিময়ে সে যাত্রা প্রাণে বাঁচে গেল মোগলসম্রাট মহম্মদ শাহ। নাদির শাহ দিল্লি ছেড়ে চলে যাবার অব্যবহিত পরেই মহম্মদ শাহের সঙ্গে দেখা করে সরফরাজের কর্মকান্ডের কথা জানালেন আলিবর্দি। প্রমাণ হিসাবে নাদির শাহের নামাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা মহম্মদ শাহকে দেখায় আলিবর্দি। প্রকারান্তরে এর অর্থ যে নাদির শাহকে নবাব হিসাবে মেনে নেওয়া সে কথা বুঝতে অসুবিধে হয় না নবাব মহম্মদ শাহের। রাজদরবারের অনুমতিক্রমে আলিবর্দি খানকে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার নবাব নিযুক্ত করে জারি হল আদেশনামা এবং ঘোষিত হল সরফরাজের মৃত্যুদন্ড।

নানাবিধ বিলাসব্যসনে এবং দুষ্কর্মে ব্যস্ত সরফরাজ এর বিন্দুবিসর্গ টের পেল না। ত্রিমূর্তি পরামর্শ দিল যে এই অর্থনৈতিক দুরাবস্থার সময় সেনাবাহিনীতে এত সৈন্য রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। অর্থলোভী সরফরাজ এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। নবাবের সৈন্যসংখ্যা প্রায় অর্ধেক করে দেওয়া হল। যে সমস্ত সৈন্যদের বরখাস্ত করা হল আলিবর্দি তাদের বিহারের সৈন্যবাহিনীতে নিযুক্ত করে নিজের সৈন্যসংখ্যা অনেকগুন বাড়িয়ে নিলেন। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আলিবর্দি ঘোষণা করলেন যে ভোজপুরের বিদ্রোহ দমনের জন্য কিছুদিনের মধ্যেই সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি ভোজপুরের দিকে রওনা দেবেন। সরফরাজের রাজদরবারের সমস্ত খবর ত্রিমূর্তির প্রতিনিধি হয়ে হাজি আহমেদ পাঠাতে থাকল আলিবর্দিকে। আস্তে আস্তে কয়েকদিনের মধ্যে মুর্শিদাবাদ প্রবেশের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হল এবং পত্রবিনিময়ের ওপর কড়া নজরদারি চালু করা হল গোপনে। আলিবর্দি নিজের সেনাধ্যক্ষদের কাছেও এই অভিযানের আসল কারণ জানালেন না। অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে অভিযানের মাঝপথে আসল সত্য জানিয়ে সেনাবাহিনীর আনুগত্য আদায় করে নিলেন আলিবর্দি। ওদিকে সরফরাজের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে আসল সত্য জানিয়ে গোপনে নাশকতা চালিয়ে যেতে লাগল ত্রিমূর্তির গুপ্তচরেরা। সরফরাজের কাছে যখন খবর পৌঁছলো ততক্ষণে আলিবর্দি রাজমহলের পাহাড় অতিক্রম করে প্রায় বাংলার সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছেন। সরফরাজ আর কোনও উপায় না দেখে আলবর্দির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে একটি ছোট্ট গ্রাম গিরিয়াতে ছাউনি পাতল। পরের দিন শুভক্ষণ দেখে সরফরাজের সৈন্য আলিবর্দির সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাল। প্রথম দফায় ঘাউস খান এবং এবং রাজপুত বাজি সিং-এর নেতৃত্বে আলিবর্দির সৈন্যদের ছত্রভঙ্গ করে দিল সরফরাজের সেনাবিহিনী। অবস্থা বেগতিক দেখে রায় রায়ান আলমচাঁদ সরফরাজকে পরামর্শ দিল যে এই প্রচন্ড গরমে যুদ্ধ চালিয়ে গেলে সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে। সুতরাং প্রয়োজন সাময়িক বিরতির। সরফরাজ এই পরামর্শ মেনে নিল। সেই সুযোগে আলিবর্দি নিজের পরিকল্পনা বদল করে অন্য পথে আক্রমণের আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেলল। সরফরাজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রভূত দুর্বলতা ছিল। সেই কারণে হাজি মহম্মদের উদ্দেশ্যের কথা জেনেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বা তাকে রাজদরবার থেকে সরাতে পারেনি সরফরাজ। এমনকি হাজি মহম্মদের আত্মীয় এবং খুব কাছের লোক শারিয়ার খানকে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি করে ফেলেছিল সরফরাজ। যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার পর সরফরাজ দেখতে পেল কামানের মধ্যে গোলার বদলে ইটপাটকেল আর বারুদের বদলে সুরকি ভরা আছে।

ঠিক এই সময়ে চতুর আলিবর্দি সরফরাজকে খবর পাঠালেন যে তার এই অভিযানকে যুদ্ধ ভেবে ভুল করেছে সরফরাজ। তিনি আসলে এসেছিলেন নবাব সরফরাজকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দন ও সম্মান প্রদর্শন করতে। সরফরাজের মনে তখন গভীর সন্দেহ। এই খবরে বিশ্বাস না করে সরফরাজ নিজের দুই বিশ্বস্ত অনুচর সুজাকুলি খান এবং খোজা বসন্তকে পাঠাল আলিবর্দির কাছে। আলিবর্দি কোরানে হাত রেখে শপথ করলেন যে তাঁর উদ্দেশ্য অসৎ নয়। তিনি সত্যিই নবাব সরফরাজকে অভিনন্দন জানাতে এসেছেন। আলিবর্দির কথায় সন্তুষ্ট হয়ে দুই অনুচর ফিরে গিয়ে সরফরাজকে জানাল আলিবর্দির কোরান স্পর্শ করে শপথের কথা। নবাব বা তার অনুচরেরা কেউই ভাবতেও পারেনি যে সুদৃশ্য মোড়কটি স্পর্শ করে আলিবর্দি শপথ নিয়েছিলেন তার ভিতরে কোরান ছিলনা, ছিল একটি ইট। আনন্দে উদ্বেল হয়ে সরফরাজ সবাইকে ডেকে খানপিনা নাচগানের ব্যবস্থা করতে হুকুম করল। আলিবর্দির সৈন্যরাও এসে হাজির হল। জমে উঠল খানাপিনা নাচগানের আসর। রাত যখন গভীর আলিবর্দির সৈন্যরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে সরফরাজের ছাউনিতে হাজির হল। একদলের সঙ্গে চলল আলিবর্দির হাতি আর একটি ছোটদল গোপনে সরফরাজের তাঁবুকে পিছন দিক থেকে ঘিরে ফেলল। ভোরের আলো দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই সরফরাজের দেহরক্ষীদের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল আলিবর্দির সেনা। চলল হত্যালীলা আর আগুনের গোলাবর্ষণ। তাড়াতাড়ি কোরানপাঠ সেরে সরফরাজ হাতির পিঠে চেপে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওনা দিল কিন্তু হঠাৎ এক বন্দুকের গোলা এসে সরফরাজের কপালের ঠিক মাঝখানে আঘাত করল। হাতির পিঠেই লুটিয়ে পড়ল সরফরাজের মৃতদেহ। সরফরাজের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই দাঙ্গা লেগে গেল মুর্শিদাবাদে। গিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রেও শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। কিন্তু দিশাহীন সৈন্যবাহিনী অল্পসময়ের মধ্যেই পরাজয় স্বীকার করে নিল। কেউ লক্ষ্য করল না যে সরফরাজের বিশ্বাসী মাহুত হাতির পিঠে প্রভুর মৃতদেহ সারাদিন ধরে বহন করে মধ্যরাতে মুর্শিদাবাদে পৌঁছল। সরফরাজের ছেলে হাফিজুল্লাহ এবং জামাতা ইয়াসিন খান তড়িঘড়ি সরফরাজের দেহ কবরস্থ করে রাজধানী রক্ষার জন্য পথে নেমে পড়ল। কিন্তু ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস যে সরফরাজের বিশ্বস্ত সেনাবাহিনী হাফিজুল্লাহ এবং ইয়াসিন খানকে কোনওরকম সাহায্য করলনা। আলিবর্দি খান দু’দিন দু’রাত গিরিয়াতে তাঁবু পেতে বসে রইলেন। হাজি মহম্মদ শহরে এসে সকলকে শান্তির জন্য আবেদন জানানোর পর যখন শহর মোটামুটি শান্ত হল তখন আলিবর্দির বিজয়রথ মুর্শিদাবাদ এসে পৌঁছল। সরফরাজের বোন নাফিসা বেগমের সঙ্গে দেখা করার জন্য এত্তেলা পাঠাল আলিবর্দি। অনুরোধ জানাল যে পূর্বতন রাজপরিবারের কাছে সরফরাজের মৃত্যুর জন্য দুঃখপ্রকাশ এবং সমবেদনা জানাতে চায় সে । কিন্তু নাফিসা বেগম রাজি না হওয়ায় গেটের সামনে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে সরফরাজের মৃত্যুর জন্য দুঃখপ্রকাশ এবং সমবেদনা জানিয়ে আলিবর্দি চেহেল সেতুন অর্থাৎ রাজপ্রাসাদের চল্লিশ স্তম্ভশোভিত সভাগৃহে নিজেই নিজেকে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার নবাবপদে অভিষিক্ত করল।আলিবর্দির বয়স তখন প্রায় সত্তর। অপরিবর্তিত রইল বিশ্বাসঘাতকতা, অন্তর্ঘাত আর চক্রান্তের পথ ধরে ক্ষমতা দখলের ইতিহাস। সেদিন আলিবর্দি নিজেও জানতেন না যে তার উত্তরাধিকারীর জন্য অপেক্ষা করে আছে এই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। তারপর আজ দীর্ঘ বারোবছরের পর শুধুমাত্র রাজপরিবারের সদস্যদের এই একান্ত পারিবারিক সান্ধ্যবৈঠকে আলিবর্দি কেন জগৎশেঠ মোহতাবচাঁদ রাইকে ডেকে পাঠালেন সে কথা জানতে গেলে আর একটু পিছন ফিরে তাকাবার প্রয়োজন আছে।

জগৎশেঠ কোনও ব্যক্তির নাম নয়। এটি একটি পারিবারিক উপাধি যার অর্থ আন্তর্জাতিক অর্থব্যবসায়ী। হীরানন্দ সাহু নামে এক রাজস্থানী হীরক ব্যবসায়ী সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি দেশ ছেড়ে পাটনায় এসে হীরা এবং সুদের ব্যবসা শুরু করে। হীরানন্দ নিজের ছেলেদের বিভিন্ন শহরে ব্যবসাবিস্তারের জন্য পাঠায়। তারই এক ছেলে মানিকচাঁদ ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করে। ঢাকা তখন অবিভক্ত বাংলার রাজধানী। ঢাকায় এসে তার ব্যবসা ক্রমশ ফুলে ফেঁপে ওঠে এবং ঘটনাচক্রে নবাব মুর্শিদকুলির কাছে এই নতুন ধনকুবেরের খবর পৌঁছয়। ধীরে ধীরে নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে মানিকচাঁদের। মুর্শিদকুলি যখন রাজধানী ঢাকা থেকে মুকুসুদুবাদে সরিয়ে নিয়ে এসে নিজের নাম অনুসারে শহরের নাম মুর্শিদাবাদে পরিবর্তন করল তখন তার সঙ্গে মানিকচাঁদও মুর্শিদাবাদে এসে মহিমাপুরে প্রাসাদোপম অট্টালিকা তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করে দিল। নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা যত বাড়তে থাকল ততই তার প্রতি নবাবের নির্ভরতা বৃদ্ধি পেতে লাগল। দেখতে দেখতে মানিকচাঁদ নবাবের খাজনা সংগ্রাহক এবং রাজকোষাধ্যক্ষ হয়ে উঠল। রাজপরিবারের অর্থ ব্যবসায় নিয়োগ করে বহুগুন বাড়িয়ে রাজকোষাগারে ফিরিয়ে দিয়ে নবাবের পরিবারের প্রায় একজন হয়ে উঠল মানিকচাঁদ। কালক্রমে পৃথিবীর বড় বড় ধনকুবেরদের মধ্যে একজন হয়ে উঠল মানিকচাঁদ। মানিকচাঁদের পালিতপুত্র ফতেচাঁদ এই ব্যবসাকে নিয়ে গেল এক অকল্পনীয় উচ্চতায়। সেই সময়ের যত রাজা জমিদার সবাই পরম বিশ্বাসে তাদের অর্থ গচ্ছিত রাখত ফতেচাঁদের কাছে আর ফতেচাঁদও তাদের অর্থ সুদের ব্যবসায় খাটিয়ে অনেকগুন করে ফিরিয়ে দিত তাদের। সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে খাজনা সংগ্রহ, অর্থ বিনিয়োগ, বিদেশি মুদ্রা আমদানি এবং রাজা জমিদারদের কোষাগার পরিচালনার একচ্ছত্র অধিকার অর্জন করল ফতেচাঁদ। দিল্লির নবাব মহম্মদ শাহ ফতেচাঁদকে জগৎশেঠ উপাধিতে ভূষিত করল। আলিবর্দির নবাব হওয়ার পিছনে ত্রিমূর্তির এক মূর্তি জগৎশেঠ ফতেচাঁদের অবদানের কথা আমরা আগেই জেনেছি। আলিবর্দি নবাব হওয়ার চার বছর পরে দেহত্যাগ করল ফতেচাঁদ। মোহতাবচাঁদ রাই হল নতুন জগৎশেঠ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মোহতাবচাঁদও হয়ে উঠল নবাবদরবার এবং নবাবপরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আজ সন্ধ্যাবেলায় প্রতিদিনের মত রাজপ্রাসাদে এসে হাজির হল চাটুকার, কৌতুক অভিনেতা এবং খোজারা। তারা প্রতিদিন এই সময়ে আসে নবাবের চিত্তবিনোদনের জন্য। কোনওদিন আসেন ওস্তাদ আর বাইজিরা। তাদের নাচে গানে বাজনায় জমে ওঠে সন্ধ্যার আসর। নবাবকে খুশি করে কে পুরস্কার পাবে তারই প্রতিযোগিতা চলে এই আসরে। কিন্তু আজ দ্বাররক্ষক তাদের ফিরিয়ে দিল। সারাদিনের কাজ সেরে অশিতিপর বৃদ্ধ আলিবর্দি বৈঠকখানায় প্রবেশ করে সকলকে আসন গ্রহণ করতে বলে নিজের জায়গায় বসতে বসতে বললেন,’ তোমরা নিশ্চয় খুব অবাক হয়েছ এই কথা ভেবে কেন আমি তোমাদের এখানে ডেকেছি। ভয়ের কিছু নেই। কোনও বিপদ হয়নি। কোনও আক্রমণের মুখোমুখি হইনি আমরা। আমার শত্রুবিড়ম্বিত শাসনকাল এখন একটু শান্তির মুখ দেখেছে। আমার জন্য তোমাদের অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। হারাতে হয়েছে প্রিয়জনদের। তার জন্য আমার কষ্ট কিছু কম হয়নি তোমাদের থেকে। এখন আমি বৃদ্ধ হয়েছি। হয়ত আর বেশিদিন রাজ্যপাট সামলানো সম্ভব হবে না। তাই এই সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর নাম ঘোষণা করার জন্য আজ এই সভায় তোমাদের ডেকেছি। আমি আশা করব আমার মৃত্যুর পর তার মসনদে বসার ক্ষেত্রে যেন কোনও বাধার সৃষ্টি না হয়। আজকের এই সভায় তোমরা প্রত্যেকে এই শপথ গ্রহণ করবে যে তার রাজত্বকালে তোমরা সবাই তার পাশে থাকবে এবং সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। কোনও অবস্থাতেই তোমরা কেউ তার বিরুদ্ধাচরণ করবে না।‘ নবাবের কথা শেষ হতে না হতেই জগৎশেঠ মোহতাবচাঁদ রাই বললেন,’ নবাববাহাদুর , যাকেই আপনি আপনার উত্তরাধিকারীর স্থলাভিষিক্ত করুন না কেন রাজসিংহাসনের প্রতি আমার আনুগত্য অবিচল থাকবে চিরকাল । আমার পূর্বপুরুষেরাও চিরকাল তাই করে এসেছেন।‘ আলিবর্দি বলল,’ ধন্যবাদ, জগৎশেঠ। আপনার আচরণ সত্যই শিক্ষণীয়। আপনি প্রকৃতই একজন শুভাকাঙ্খী পার্ষদ। আপনার নিঃশর্ত সমর্থন আমাকে মুগ্ধ করেছে।‘

আলিবর্দির জ্যেষ্ঠাকন্যা মেহেরুন্নিসা ওরফে ঘসেটি বেগম নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল তার। বলে উঠল,’ আমার আর তর সইছে না। কাকে আপনি ভাবী নবাবের পদে অভিষিক্ত করতে চান জানতে আমার মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।‘ আলিবর্দি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। সভায় এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। কান পাতলে সকলের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাওয়া যাবে এমন গভীর সেই শব্দহীনতা। তারই মাঝে বেজে উঠল নবাব আলিবর্দির জলদ্গম্ভীর কন্ঠস্বর ,’ সিরাজদৌল্লা।‘ সে কন্ঠস্বর যেন রুদ্ধদ্বার সভাকক্ষ অতিক্রম করে মুর্শিদাবাদের আকাশ বাতাস আলোড়িত করে তুলল। ঘোষণা শোনামাত্র ঘসেটি বেগমের ফর্সা সুন্দর মুখ রক্তের মত লাল হয়ে উঠল। চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেছে তার। কী যেন বলতে চাইছে সে কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। সভাসুদ্ধ সকলে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। বেশ খানিকক্ষণ পরে চিৎকার করে বলে উঠল,’ এ অন্যায় , ভয়ঙ্কর অন্যায়। এ হতে পারে না। আপনি সিরাজের প্রতি স্নেহে অন্ধ হয়ে গেছেন। সিরাজের মত একজন দুশ্চরিত্র মদ্যপ লম্পটকে আপনি রাজ্যভার অর্পণ করে শুধু রাজপরিবারের নয় সমস্ত দেশের বিপদ ডেকে আনছেন। তার বয়স এখনও কুড়ি পার হয়নি। এর মধ্যেই সে সুরা এবং নারীতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে প্রজাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। সিরাজ নবাবের আসনে বসলে দেশসুদ্ধ লোক রাজপরিবারের বিরুদ্ধে চলে যাবে। একাজ আপনি করবেন না।‘

আলিবর্দি বললেন,’ তুমি আমার জ্যেষ্ঠাকন্যা। সেই জন্য তোমার কুকথা আমি এতক্ষণ সহ্য করছি। কান খুলে শুনে রাখ, অনেক ভেবে আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মসনদে বসতে গেলে একজন মানুষের যা যা গুন থাকা দরকার সবই আছে সিরাজের মধ্যে। যারা মূর্খ তারা বিশ্বাস করে একজন রাজার প্রধান গুন প্রজাবাৎসল্য। প্রজাবাৎসল্য নয় প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা এবং কর আদায় করার সমস্ত উপায় যার জানা আছে সেই নবাবের আসনে বসার যোগ্য। প্রয়োজনে অধীনস্থ জমিদার এবং প্রজাদের প্রতি অত্যাচার রাজধর্মবিরোধী নয়। রাজকোষাগারে অর্থ এবং সম্পদ বৃদ্ধি করাই রাজার মুখ্য কাজ। তার জন্য প্রয়োজন হলে কঠোর থেকে কঠোরতম পথ অনুসরণ করতে হবে। নিজের সাম্রাজ্যকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার অর্থ সম্পদবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা। তাই যে কোনও উপায়ে সাম্রাজ্যরক্ষা এবং সাম্রাজ্যবিস্তার রাজকর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। তাই যখন আমাদের সেনাবাহিনীর আফগান বিদ্রোহীরা আহমাদ শাহের উস্কানিতে পাটনা আক্রমণ করেছিল তখন আমি নিজে আমার বেতনভোগী সেই সমস্ত বিদ্রোহীদের নির্দ্ধিধায় হত্যা করেছিলাম। সিরাজের পিতা, আমার শ্রেষ্ঠ জামাতা জইনুদ্দিন আহমেদকে আমি ওদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারিনি। সিরাজের শরীরেও জইনুদ্দিনের রক্ত প্রবহমান। সে তার পিতার মতই নির্ভীক এবং সাহসী। অতি অল্প বয়সেই আমাকে বন্দি করে পাটনা দখল করে নেবার মত বুদ্ধি এবং সাহসের প্রমাণ সে দিয়েছে। জইনুদ্দিনের অবর্তমানে সিরাজ ছাড়া আর কাকে আমি এই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করতে পারি?’

ঘসেটি বেগম দমবার পাত্রী নয়। বলল,’ কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনি কি আমাকে বঞ্চিত করলেন না? আপনার জামাতা নওয়াজিস এখনও জীবিত।‘

আলিবর্দি – ‘ঈর্ষা তোমার স্বাভবিক বুদ্ধিকে গ্রাস করেছে। দেশশুদ্ধু সমস্ত লোক জানে সিরাজের আপন ভাই এবং তোমাদের পালিতপুত্র ইক্রমের অকালমৃত্যুর পর থেকে নওয়াজিস শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। দুঃখের হলেও সত্যি তার জীবনকাল সীমিত হয়ে আসছে। তার আচরণ পুরুষোচিত নয়। অনেক বিশ্বাস করে ঢাকার দায়িত্ব আমি তাকে দিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে কোনও রাজস্ব রাজকোষাগারে আসে না আজ অনেকদিন হল। আদায়ের টাকা কোথাইয় যাচ্ছে তাও আমি জানিনা। সে নিজেও মুর্শিদাবাদ ছেড়ে ঢাকা যেতে চায় না। এক লোভী বহিরাগতকে সব দায়িত্ব দিয়ে বিলাসব্যসনে মত্ত থাকে সে। সব জেনেও তাকে এই দেশের দায়িত্বভার আমি কী করে দিয়ে যেতে পারি?’

ঘসেটি- ‘তার সমস্ত কাজ তো আমিই এখন করছি। আমি কি তার রাজত্বভার চালনা করতে পারব না বলে আপনার মনে হয়?’

আলিবর্দি –‘জমিদারি চালানো আর দেশ চালানো এক নয়। তুমি মূর্খ এবং লোভী। তোমার সঙ্গে অযথা বাক্যব্যয় করে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আর একটা কথা শুনে রাখ সাময়িক শান্তি দেখে একথা ভেবে বিভ্রান্ত হয়ো না যে আমরা নিরাপদ। কোম্পানির লোকেরা অচিরেই দেশের শাসনভার নিজেদের হাতে নেবার জন্য প্রস্তুতি চালাচ্ছে। কোম্পানির সঙ্গে আপস করে আর তাদের হাতে প্রভূত অর্থ তুলে দিয়ে যে ভাবে এতদিন চলেছে সে ভাবে আর চলবে না। কোম্পানি এখন মসনদে বসতে চায়। এই ভয়ঙ্কর সময়ে মসনদ রক্ষা করার মত সাহস একমাত্র সিরাজের আছে। ইংরেজদের কাছে বারবার অপমানিত হয়ে সিরাজ ঘোরতর ইংরেজবিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। সিরাজের এই তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা ওর যুদ্ধজয়ের পথে ওকে সাহায্য করবে।

ঘসেটি- কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না সিরাজ নবাব হলে আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না। আমাদের ধনসম্পত্তি, প্রাসাদ সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পথের ভিখারি করে দেবে।

আলিবর্দি- তুমি ক্রোধে আর বিরোধিতায় অন্ধ হয়ে উঠেছ। সিংহাসনের প্রতি তোমার লোভ যে কতদূর সে কথা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে? সিরাজের ভাই ইক্রমকে দত্তক নেওয়ার পিছনে তোমার অভিসন্ধির কথা সর্বজনবিদিত। ইক্রমের অকালমৃত্যু তোমার অভিসন্ধিকে বাস্তব হতে দেয়নি। অক্ষম নওয়াজিস তোমাকে নিজের সন্তানধারণ থেকে বঞ্চিত করেছে। তাই ইক্রমকে দত্তক নিয়ে তুমি ভেবেছিলে সেই হবে মসনদের দাবিদার। সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে বলে তুমি পাগলের মত অন্য পথের সন্ধান করছ আর নওয়াজিস শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। সিরাজই রাজপরিবারের সন্তান এবং নবাব হবার উত্তরাধিকারী। এই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আমি যতদিন বেঁচে আছি তুমি এবং নওয়াজিস সম্মান এবং মর্যাদার সঙ্গে মতিঝিল প্রাসাদে বাস করবে। আমার মৃত্যুর পর কী হবে তা তোমাদেরই ঠিক করতে হবে। রাজকার্যে নাক না গলানোই তোমাদের পক্ষে শুভ হবে।

প্রচণ্ড ক্রোধে এবং দুঃখে নিজেকে আর স্থির রাখতে না পেরে একদৌড়ে রাজসভা ত্যাগ করল ঘসেটি বেগম। কিন্তু সেদিন ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে গেলেও সিরাজকে যেভাবেই হোক রাজসিংহাসন থেকে বঞ্চিত করার গভীর চক্রান্তে মেতে উঠল ঘসেটি বেগম। শয্যাশায়ী নওয়াজিস অনেক দিন আগে থেকেই ঢাকার দায়িত্ব সহকারী এবং বন্ধু হুসেন কুলি খানের হাতে ছেড়ে মতিঝিল প্রাসাদে নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছিল। ঢাকা থেকে খাজনা আর উৎকোচের টাকা আলিবর্দির কোষাগারের বদলে পৌঁছে যাচ্ছিল মতিঝিল প্রাসাদে। অভিজ্ঞ নবাব আলিবর্দির সে কথা বুঝতে কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরের এই কথা বাইরে যেতে পারে এবং নিজের মেয়ে-জামাইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সমীচিন হবে না ভেবে চুপ করেই ছিল আলিবর্দি। শোনা যায় এই সময় হুসেন কুলির সঙ্গে ঘসেটি বেগমের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। মতিঝিল প্রাসাদে বন্ধুকে দেখতে আসার আছিলায় হুসেন কুলির যাতায়াত বাড়তে থাকে। অক্ষম নওয়াজিসের নানাবিধ বিকৃত চাহিদা পূরন করে তাকে একেবারে বশ করে ফেলেছিল হুসেন কুলি। আলিবর্দির আমলে ঢাকাতে আরও একজন অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছিল । তার নাম রাজবল্লভ। রাজবল্লভের সম্বন্ধে জানতে হলে একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। মুর্শিদকুলি যখন নবাব তখন নিজের দৌহিত্র সরফরাজকে ঢাকার নায়েব নাজিম হিসাবে নিযুক্ত করে। সরফরাজ তার বোন নাফিসা বেগমের অনুরোধে তার ভাগ্নে মুরাদ আলির সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দেয় এবং মুরাদ আলিকে ঢাকার কেয়ারটেকার হিসাবে নিযুক্ত করে। মুরাদ আলির দপ্তরে মুন্সির কাজ করত রাজবল্লভ। অর্থলোভী মুরাদ আলিকে রাজকোষ থেকে অর্থ সরাতে সাহায্য করত রাজবল্লভ। চুরির টাকা ভাগ করে নিত দু’জনে। কিছুদিনের মধ্যেই পদোন্নতি হল রাজবল্লভের। বিক্রমপুরের রাজবল্লভ হল মুরাদ আলির পেশকার। এরপর রাজবল্লভকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ঢাকার খাজনা আর বিদেশি ব্যবসায়ীদের ঘুষের টাকা আত্মসাৎ করে প্রভূত ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে গেল রাজবল্লভ। ইতিমধ্যে সরফরাজকে হত্যা করে আলিবর্দি নবাব হয়েছেন বাংলার। আলিবর্দির আনুকূল্যে একদিকে ঢাকায় ফুলে ফেঁপে উঠল রাজবল্লভ আর অন্যদিকে মুর্শিদাবাদে বেড়ে উঠল ফতেচাঁদ জগৎশেঠ আর আলমচাঁদ। নওয়াজিসের বকলমে ঢাকায় রাজত্ব করছিল হুসেন কুলি। কিছুদিন পর হুসেন কুলিকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসে আলিবর্দি আর হুসেন কুলির জায়গায় ঢাকার দায়িত্ব সামলাতে থাকে হুসেন কুলির ভাইপো এবং জামাই হুসেনুদ্দিন। কাকা-ভাইপো অথবা শ্বশুর-জামাই মিলে রাজবল্লভের সঙ্গে একজোট হয়ে সমস্ত খাজনার টাকা ভাগ করে নিতে থাকল নওয়াজিস আর ঘসেটির সঙ্গে। আলিবর্দির ঘোষণার কথা জানার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের রক্ষার জন্য নওয়াজিস, ঘসেটি, হুসেন কুলি, হুসেনুদ্দিন আর রাজবল্লভের মধ্যে গড়ে উঠল অশুভ আঁতাত। লক্ষ্য সিরাজকে যে ভাবেই হোক সরাতে হবে।

এদিকে মসনদে বসা নিশ্চিত জেনে সিরাজ হয়ে উঠল আরও ভয়ঙ্কর। জাতি,ধর্ম,‌বয়স, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সিরাজের অত্যাচার বেড়েই চলল।কঠোর পরিশ্রমে তিলতিল করে যে সাম্রাজ্য সৃষ্টি করেছিলেন আলিবর্দি তাকে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে আস্তে আস্তে ঠেলে দিতে লাগল সে। অত্যাচার এবং হত্যার মধ্যে পাশবিক আনন্দের সন্ধান পেত সিরাজ। মানুষের প্রতি অত্যাচার এবং নির্মম হত্যালীলা ক্রমশ তার কাছে প্রতিদিনকার খেলা হয়ে উঠল। স্নেহান্ধ আলিবর্দি সিরাজের এই অস্বাভাবিক মানসিকতার কথা জানতেন নিশ্চয়ই । তাহলে কি বহু অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ বৃদ্ধ আলিবর্দি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণে বা প্রয়োজনে হত্যা করতে যার হৃদয় এতটুকু বিচলিত হয়না সেই রাজসিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকারী? সিরাজের অনুচর আর সাঙ্গপাঙ্গরাও ছিল সিরাজের মতই। একবার সিরাজের বিশ্বাসী অনুচর মোহনলাল সিরাজের অনুরোধে তার বোন সুন্দরী আলেয়াকে পাঠিয়েছিল সিরাজের কাছে। আলেয়া ছিল পরমা সুন্দরী এবং সুন্দরী হিসাবে তার খ্যাতি ছিল যথেষ্ট । মাত্র ২২সের ওজনের এই বালিকা নিজের রূপকে অর্থ উপার্জনের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। এমনই ফর্সা ছিল তার গায়ের রঙ আর এমনই মসৃণ আর পাতলা ছিল তার গাত্রচর্ম যে সে যখন পান খেত আর পানের লাল রস তার গলা দিয়ে নামত তা পরিস্কার দেখা যেত বাইরে থেকে। সিরাজ আলেয়াকে তার নিজের প্রাসাদের নর্তকী করে রাখে। সিরাজের কাছে থাকতে থাকতেই সিরাজের সুদর্শন শ্যালকের সঙ্গে তার গোপন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সিরাজের কানে একথা পৌঁছতেই ক্রোধান্ধ সিরাজ আলেয়াকে সকলের সামনে কটুভাষায় দেহোপজিবিনী বলে সম্বোধন করে। উদ্ধত আলেয়াও পরিস্কার জানিয়ে দেয় যে সত্যিই দেহোপজিবিনী আর সে জন্যেই সে সিরাজের অঙ্কশায়িনী হতে রাজি হয়েছে। তার মানে এই নয় যে সিরাজের কোনও অধিকার জন্মে গেছে তার শরীরের প্রতি। তার শরীর সে যাকে খুশি বিক্রী করতে পারে। সিরাজ আর তার মায়ের তাতে কোনও আপত্তি থাকলে তার কিছু করার নেই। প্রত্যাশিতভাবেই আলেয়ার জায়গা হয় কারাপ্রাচীরের অন্তরালে। তারপর আর আলেয়ার খোঁজ কেউ পায়নি। সিরাজের অমানবিক ক্রূরতার আরও অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে মুর্শিদাবাদের পথে প্রান্তরে নদীতে। মুর্শিদাবাদের হিন্দু মহিলাদের রীতি ছিল ভাগিরথীতে স্নান করবার। সিরাজের গুপ্তচরেরা লক্ষ্য রাখত তাদের মধ্যে যারা সুন্দরী এবং অল্পবয়সী তাদের প্রতি। তারপর সময় বুঝে অতর্কিতে ছোট ছোট নৌকায় জোর করে তুলে নিয়ে চালান করে দিত সিরাজের প্রাসাদে। বর্ষায় যখন ভাগিরথী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত তখন নদীতে মাঝে মাঝেই ঘটত নৌকাডুবি। নৌকাডুবিতে একসঙ্গে শ’য়ে শ’য়ে অসহায় নারী, শিশু, পুরুষের সলিল সমাধির দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত নররূপী রাক্ষস সিরাজ। যখন কোনও অবাধ্য জমিদার জোর করে খাজনার টাকা আদায়ে রাজি হত না অথবা যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ রাজকোষে সময়ে জমা দিত না অথবা গোপনে বিপ্লবের কাজে মদত দিত তখন তাকে হত্যা করতে পিছপা হতোনা সিরাজ। আলিবর্দি যখন বিশ্রামের জন্য মুর্শিদাবাদের বাইরে কোনও বাগানবাড়িতে আমোদপ্রমোদে দিন কাটাতেন তখন তার অতি প্রিয় বিশ্বস্ত নাতি সিরাজ একা কোনও গোপন কক্ষে এই হত্যাকান্ড সংঘটিত করত যাতে আর্তনাদের স্বর পরম ধার্মিক নবাব আলিবর্দির কানে না পোঁছয়। সুতরাং কেবলমাত্র অন্ধ স্নেহের বশবর্তী হয়ে আলিবর্দি যে সিরাজকে রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী করেছিলেন এবং নিজে জীবিত থাকতে থাকতেই সিরাজের সমস্ত পথের কাঁটা নির্মূল করেছিলেন সে কথা ভাবা অন্যায় হবে। সিরাজকে নবাবের পদে বসানোর পিছনে ছিল আলিবর্দির সুচিন্তিত পরিকল্পনা। যে নিষ্ঠুরতা, ক্রূরতা এবং নির্মমতা একজন রাজাকে সাফল্য এনে দিতে পারে সেই সব রাজকীয় গুনাবলীতে সিরাজকে সমৃদ্ধ করে তবেই তাকে পরবর্তী নবাব হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন আলিবর্দি। ভেবেছিলেন রাজ্যের সীমা আর রাজকোষাগারের অর্থ বৃদ্ধি করার ক্ষমতা আছে একমাত্র তাঁর নিজের প্রশিক্ষণে বেড়ে ওঠা দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌল্লার। আফসার সাম্রাজ্যের একাধিপত্য এবং উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির জন্য সিরাজের বিকল্প আর কেউ নেই। নিষ্ঠুরতা এবং ক্রূরতায় আলিবর্দিও কম ছিলেন না। কেবলমাত্র সরফরাজকে হত্যা করে নবাব হওয়াই নয় যে কঠোর নির্মমতার সঙ্গে মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পন্ডিত আর তার সেনাপ্রধানদের আলোচনা বৈঠকে ডেকে এনে হত্যা করেছিলেন ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার।

আলিবর্দি জানতেন যে সেদিন আসতে আর বেশি দেরি নেই যেদিন বণিকের মানদণ্ড দেখা দেবে রাজদণ্ড রূপে। ইংরেজরা যে বাংলার মসনদ দখলের জন্য ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছে বিচক্ষণ আলিবর্দির তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। ব্রিটিশদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ না থাকলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে রাজকোষাগার আর মসনদ রক্ষা করা সম্ভব নয়। সিরাজের সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্ক অনেকদিন থেকেই খারাপ। ব্যবসার সুবিধার জন্য নানা বিষয়ে রাজসভার সম্মতির প্রয়োজন হত ব্রিটিশদের। সেইজন্য ইংরেজদের বেতনভুক উকিলেরা কোনও রাজসভাসদ বা নবাবের কোনও নিকট আত্মীয়ের শরণাপন্ন হত। প্রয়োজনে তাদের ঘুষ দিয়ে হাত করত নিজেদের কার্যসিদ্ধির জন্য। কিন্তু ব্রিটিশ ব্যবসায়ী বা তাদের উকিলেরা কোনওদিন সিরাজের শরণাপন্ন হতনা। সিরাজের প্রতি আলিবর্দির দুর্বলতার কথা জেনেও ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা অনেক সময় সিরাজকে তাদের কারখানায় বা বাড়িতে ঢুকতে দিতনা। সবাই ভয়ে ভয়ে থাকত কখন সিরাজ কোনও তুচ্ছ কারণে বাড়াবাড়ি শুরু করবে। আসবাবপত্র ভাঙচুর করবে বা ইচ্ছে হলে কোনও দামি আসবাব তুলে নিয়ে চলে যাবে। এই অপমানের আগুনে সিরাজ জ্বলে পুড়ে মরত সবসময় আর অপেক্ষায় থাকত প্রতিশোধের। নবাব হয়ে সে যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাবে সে কথা সবাই জানত। কিন্তু অন্য বিদেশি ব্যবসায়ী যেমন ফরাসি বা ড্যানিসদের সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ ছিলনা। ফরাসি এবং ড্যানিস ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সিরাজকে তোয়াজ করত, নানারকম উপঢৌকন দিত এমনকি আলিবর্দির কাছ থেকে সম্মতি আদায়ের জন্য তাকে ব্যবসার লভ্যাংশও দিত। সব জেনেশুনেও আলিবর্দি কিছু বলতেন না উপরন্তু নানা বিষয়ে মধ্যস্থতা করার জন্য সিরাজের প্রশংসা করতেন। রাজকোষাগারের অর্থবৃদ্ধি করার নতুন নতুন পদ্ধতি অবলম্বনের জন্য সিরাজকে উৎসাহিত করতেন।

আলিবর্দি নিজে কিন্তু ব্রিটিশদের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতেন। মারাঠা আক্রমণে বিধ্বস্ত এবং বয়সের ভারে ক্লান্ত আলিবর্দি অযথা ব্রিটিশদের সঙ্গে ঝামেলায় যেতে চাইতেন না। যতটা সম্ভব ব্রিটিশদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতেই চাইতেন। একবার আলিবর্দির খুব আস্থাভাজন এক সেনাপতি মুস্তাফা খান আলিবর্দির কাছে ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করে কলকাতায় তাদের সবকিছু দখল করার পরামর্শ দেয়। সিরাজ তখন খুব ছোট। দশ-এগার বছরের হবে। আলিবর্দির দুই জামাই সেখানে উপস্থিত ছিল এবং তারা মুস্তাফার কথায় সায় দিচ্ছিল। আলিবর্দি কোনও কথা না বলে মুস্তাফার প্রস্তাব শুনলেন কিন্তু কিছু বললেন না। মুস্তাফা চলে যাবার পর জামাইদের উদ্দেশ্যে গম্ভীরভাবে বললেন,’ শোন, আমি নিজের কোনও পুত্রসন্তান নেই এবং তোমরাই আমার পুত্র। মুস্তাফা একজন বেতনভোগী সৈনিক। সে প্রয়োজনে আমাদের হয়ে যুদ্ধ করেছে এবং অনেক সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। এটা তার পেশা এবং চাকরি। নিজের যোগ্যতার পরিচয় যখনই সে দিয়েছে তখনই সে পুরস্কৃত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ হবে কি হবে না সে সিদ্ধান্ত নেব আমরা। যদি যুদ্ধ হয় তাহলে মুস্তাফা আমাদের হয়ে যুদ্ধ করবে। সেটাই মুস্তাফার কাজ। তোমাদের মনে রাখা উচিৎ তোমরা রাজপরিবারের সদস্য। এই সাম্রাজ্যের ভাবী কর্ণধার তোমরা। সামান্য এক বেতনভুক সেনাপ্রধানের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া তোমাদের মানায় না। মুস্তাফা কী মনে করে কী করে না তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না। এর আগেও সে মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ জিতে বিহারের গভর্নর হওয়ার জন্য আমার কাছে দরবার করেছিল। আমি রাজি হইনি। একটা কথা মনে রাখ যুদ্ধ বাধানোর পিছনে মুস্তাফার যে স্বার্থ আছে তা আমাদের স্বার্থের বিরোধী। মুস্তাফা চায় তার প্রতি আমাদের নির্ভরতা বৃদ্ধি পাক।যুদ্ধ লাগলে তার লাভ আমাদের নয়। উপরন্তু আমরা আরও বেশি করে তার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ব। কিন্তু ওকে আমাদের প্রয়োজন, তাই ওর মুখের ওপর আমি কিছু বলতে চাইনি। চুপ করে থাকাই ঠিক মনে করেছি। তোমরা বল ব্রিটিশরা আমাদের কী করেছে যে তাদের ওপর এখনি আক্রমণ করতে হবে। সে সময় যখন আসবে তখন দেখা যাবে। বিনা কারণে আগুন জ্বালালে সেই আগুনে নিজেদের পুড়তে হবে।আমাদের নিজেদের মাঠে ঘাটের আগুন নিয়েই আমরা ব্যতিব্যস্ত আর তোমরা সমুদ্রে আগুন জ্বালাতে চাইছ? ‘ তবে একথা মনে করা ঠিক হবে না যে আলিবর্দি ব্রিটিশদের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যা খুশি করার। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ব্রিটিশদের নিজের জায়গা দেখিয়ে দিতে ছাড়তেন না। একবার এক ব্রিটিশ সৈনিক নিজেকে অত্যন্ত ক্ষমতাবান মনে করে হুগলি অভিমুখী একটা বাণিজ্য জাহাজে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে মুসলমান এবং আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীদের অনেক মূল্যবান সামগ্রী লুঠ করে পালায়। সেই লুঠের জিনিসের মধ্যে নবাবেরও কিছু মূল্যবান সামগ্রী ছিল। খবর আলিবর্দির কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নরকে পরোয়ানা জারি করে নিজের শুধু নিজের বিরক্তির কথাই জানালেন না ,কলকাতা এবং ঢাকায় কোম্পানির কাজকর্ম প্রায় বন্ধ করে দেবার ব্যবস্থা করলেন।পরোয়ানাতে লিখলেন,’ সিয়াদ,মোগল এবং আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীরা আমার কাছে অভিযোগ জানিয়েছে যে আপনারা তাদের লক্ষাধিক মূল্যের সামগ্রী এবং অলঙ্কার লুন্ঠন করেছেন।এর মধ্যে বিদেশ থেকে আমাকে প্রেরিত বেশ কিছু মূল্যবান উপহারসামগ্রীও আছে। আপনাদের ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে , জলদস্যুবৃত্তির নয়।এই ব্যবসায়ীরা আমাদের বিশিষ্ট নাগরিক এবং এনাদের অর্থে এই রাজ্যের অনেকে প্রতিপালিত হয়। সুতরাং এনাদের অভিযোগ শোনবার এবং তার চিরস্থায়ী সমাধানের জন্য আমি দায়বদ্ধ। আমার এই পরোয়ানা আপনার হাতে পৌছনোর সঙ্গে সঙ্গে আপনি সমস্ত লুন্ঠিত সামগ্রী ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবেন অন্যথায় আপনাদের সামনে এমন বিপদ অপেক্ষা করে আছে যা আপনারা কল্পনাও করতে পারছেন না। ‘ পরোয়ানা পাবার সঙ্গে সঙ্গেই একটি সুন্দর আরবি ঘোড়া উপঢৌকন হিসাবে আলিবর্দির কাছে পৌছে দিল ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর। কিন্তু তাতে আলিবর্দির শান্ত হওয়াতো দূরের কথা আরও ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলেন তিনি। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের সমস্ত জলযান স্তব্ধ করে দেওয়া হল। কাশিমবাজারের ফ্যাক্টরি ঘিরে রইল নবাবের সৈন্যবাহিনী এবং ফ্যাক্টরির ভিতর এবং বাইরে থেকে যাতে কোনও সামগ্রী বেরুতে এবং ঢুকতে না পারে তার দিকে কড়া দৃষ্টি রইল তাদের। বারো লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে অবস্থা স্বাভাবিক করল ব্রিটিশরা সেযাত্রা। এরমধ্যে চার লক্ষ টাকা দেওয়া হল কেবল আলিবর্দিকেই। তবে নরমে গরমে ব্রিটিশদের যে বেশিদিন আটকে রাখা যাবে না সে কথা নিজে জানলেও সিরাজকে বলেননি। সিরাজের তীব্র ব্রিটিশবিরোধিতাতে তিনি ইন্ধন জুগিয়েছেন যাতে তাঁর শেষবয়সে এবং তাঁর অবর্তমানে নিজের হাতে তৈরি করা সাম্রাজ্য এবং বিপুল অর্থ সিরাজের হাতে সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় অন্যকিছু।

এদিকে ঘসেটি বেগম তার প্রেমিক হুসেন কুলিকে বোঝায় যে তার নবাব হবার পথে একমাত্র অন্তরায় সিরাজ এবং সিরাজকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারলে হুসেন কুলির নবাব হবার পথ পরিস্কার। ঘসেটি আর হুসেন কুলির এই গোপন প্রেমের কথা আস্তে আস্তে প্রকাশ্যে চলে এল। হুসেন কুলিকে নিয়ে ঘসেটি আর নওয়াজিসের বিবাদ চরমে পৌঁছল। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে ঘসেটির মা অর্থাৎ সিরাজের দিদা সারফুন্নিসা তাঁর স্বামী আলিবর্দির কাছে রাজবংশের সম্মান রক্ষার জন্য বহিরাগত হুসেন কুলি খান আর তার ভাই হায়দর আলি খানকে হত্যা করার অনুরোধ জানালেন। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল আলিবর্দি। আলিবর্দি বলল,’ হুসেন কুলি আর তার ভাই নওয়াজিসের কর্মচারী।সুতরাং এ ব্যাপারে নওয়াজিসের মতামত জানা প্রয়োজন।‘ আলিবর্দির উত্তর শুনে সারফুন্নিসা ঘসেটি আর নওয়াজিসের কাছে এলেন। হুসেন কুলির স্পর্ধা এবং লোভ নওয়াজিস এবং ঘসেটির প্রশ্রয়ে ততদিনে আরও বেড়ে গেছে। হুসেন কুলির নজর ঘসেটির থেকে সরে এখন পড়েছে সিরাজের মা, আলিবর্দির বিধবা কন্যা আমিনার দিকে। এ কথা ঘসেটির কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে হুসেন কুলির প্রতি ক্রোধে অন্ধ হয়ে উঠল ঘসেটি। নওয়াজিস এবং ঘসেটি ভাবল যে আমিনার সঙ্গে হসেন কুলির সম্পর্ক তৈরি হলে তাদের বিপদ। ঘসেটি এতদিনের প্রেমিক বিশ্বাসঘাতক হুসেন কুলিকে হত্যার ছক কষা শুরু করে দিল। এদিকে সিরাজের কানে একথা যেতেই সে একেবারে সৈন্য সামন্ত নিয়ে আলিবর্দির দরবারে হাজির হয়ে গেল সেখানেই এবং সেইক্ষণেই হুসেন কুলিকে হত্যা করবে বলে। সিরাজের আসার কারণ বুঝতে পেরে বিচক্ষণ আলিবর্দি সিরাজকে আলাদা করে ডেকে হুসেন কুলি আর হুসেনুদ্দিনকে মারার পরিকল্পনা বাতলে দিল। রাজদরবারে হত্যাকাণ্ড ঘটলে তা যে আখেরে সিরাজের পক্ষে ভাল হবেনা সে কথা বুঝিয়ে বলে সেযাত্রা সিরাজকে শান্ত করে ফেরাল আলিবর্দি।

ওদিকে ঢাকায় হুসেনুদ্দিনের দরবারের দুই সদস্য বরিশালের জমিদার আগা বকর আর তার ছেলে মন্ত্রী আগা সাদেকের সঙ্গে হুসেন কুলির মনোমালিন্য ক্রমশই বেড়ে চলছিল। বাবা আর ছেলে অনেক ভেবে ঠিক করল মুর্শিদাবাদে গিয়ে নওয়াজিসের কাছে হুসেন কুলির অপকীর্তির কথা ফাঁস করে দেবে। তারা বুঝতেও পারেনি এই অপকীর্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নওয়াজিস এবং হুসেনুদ্দিন দু’জনেই। মুর্শিদাবাদে এসে নওয়াজিসকে একথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই বন্দি করা হল আগা বকর আর আগা সাদেককে। সিরাজের মধ্যস্থতায় ছাড়া পেয়ে বাবা-ছেলে সিরাজের হয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঢাকা ফিরে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই সিরাজের নির্দেশে হুসেনুদ্দিনের প্রাসাদে ঢুকে তাকে হত্যা করল আগা বকর আর আগা সাদেক। এই খবর ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই উত্তেজিত জনতা শ’য়ে শ’য়ে প্রাসাদে ঢুকে জানতে চাইল কোন অধিকারে আগা বকর আর তার ছেলে হুসেনুদ্দিনের প্রাসাদে ঢুকে তাকে হত্যা করেছে। হুসেনুদ্দিনের রক্তমাখা তরোয়াল হাতে জনতার দিকে তেড়ে আসে আগা সাদেক। উল্টে জনতা তাড়া করে বাবা আর ছেলেকে। আগা সাদেক কোনক্রমে পালিয়ে বাঁচলেও জনতার রোষে প্রাণ হারায় আগা বকর। এই ঘটনার কিছুদিন পরে দূর্ভাগ্য নেমে আসে হুসেম কুলির জীবনেও। বিচক্ষণ আলিবর্দি এর কিছুদিনের মধ্যে রাজমহলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল শিকারের আছিলায়। আসল উদ্দেশ্য মুর্শিদাবাদ থেকে কিছুদিন দূরে থাকা যাতে হুসেন কুলির হত্যাকাণ্ড তার অনুপস্থিতিতে ঘটে। আলিবর্দির বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই সিরাজ এসে পৌঁছল মতিঝিলে নওয়াজিসের কাছে। নওয়াজিসের কাছে অনুমতি নিয়ে ফেরার পথে সিরাজের ঘোড়া আর সৈন্যসামন্ত এসে দাঁড়াল হুসেন কুলির বাড়ির সামনে। হতভাগ্য হুসেন কুলি তখন বাড়িতেই ছিল। বাড়ির বাইরে সিরাজের উপস্থিতির খবর পেয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকল হুসেন কুলির সমস্ত শরীর। হুসেন কুলির বাড়ির পাশেই থাকত নওয়াজিসের একান্ত বিশ্বস্ত সহকারি হাজি মেহেদি। যা হোক করে পাশের বাড়িতে হাজি মেহেদির কাছে গিয়ে হুসেন কুলি তাকে বলল নওয়াজিসকে যে ভাবেই হোক তার বিপদের কথা জানাতে। হাজি মেহেদি পিছনের রাস্তা দিয়ে লুকিয়ে নওয়াজিসের কাছে গিয়ে সব জানানো সত্ত্বেও কোনও লাভ হল না। ইতিমধ্যে সিরাজের বাহিনী সমস্ত চত্বরে তল্লাশি চালিয়ে হুসেন কুলিকে হাজির করল সিরাজের কাছে। হত্যা না করার জন্য হুসেন কুলির অশ্রুসজল কাতর আবেদন উপেক্ষা করে নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর দানব সিরাজ তার শরীর টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ছড়িয়ে দিল। এর পরে সিরাজের অনুচরেরা ধরে নিয়ে এল হুসেন কুলির ভাই জন্মান্ধ হায়দর আলিকে। ভ্রাতৃহত্যায় ক্রোধান্ধ হায়দর আলি অকথ্য ভাষায় সিরাজকে এবং তার বাবা মাকে গালি দিতে শুরু করল। পাশবিক উল্লাসে মত্ত সিরাজ তলোয়ারের এক কোপে চিরকালের মত স্তব্ধ করে দিল তাকে। একেই ইক্রমের মৃত্যুর পর থেকে নওয়াজিস প্রায় শয্যাশায়ী তার ওপর এই ভয়ঙ্কর ঘটনা নওয়াজিসকে আরও দুর্বল করে তুলল। এদিকে আলিবর্দি এবং সিরাজ দু’জনেই খাজনার টাকা আত্মসাৎকারী নওয়াজিসকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৃথিবী থেকে সরিয়ে ঘসেটির কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছে দেবার মনস্থ করল। খাদ্যরসিক আলিবর্দি জামাতা নওয়াজিসকে মধ্যাহ্ণভোজে আমন্ত্রণ জানাল। আলিবর্দি নিজের হাতে বানানো স্যুপ পরিবেশন করল নওয়াজিসকে। নওয়াজিস পরম তৃপ্তিতে স্যুপসহ মধ্যাহ্ণভোজ সেরে ফিরে গেল মতিঝিলে। তার কয়েকদিনের মধ্যেই নওয়াজিসের দেহে আসন্ন মৃত্যুর লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠল। আলিবর্দি নওয়াজিস, ঘসেটি, তাদের সমস্ত পরিচারক , পরিচারিকা এবং নওয়াজিসের প্রিয় এক অভিনেত্রীকে মতিঝিল থেকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এল। ঘসেটি নিজের বাবার বাড়িতে এসেও স্থির থাকতে পারল না। সিরাজের অতর্কিত আক্রমণের ভয়ে কাঁটা হয়ে রইল সবসময়। অবশেষে সিরাজের কাছ থেকে তার কোনও রকম ক্ষতি না করার কথা আদায় করে সকলের অগোচরে মৃত্যুপথযাত্রী নওয়াজিসকে নিয়ে মতিঝিলে নিজের বাড়িতে ফিরে এল ঘসেটি। তার কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হল নওয়াজিসের। পালিতপুত্র ইক্রমের সমাধির পাশেই সমাধিস্থ করা হল নওয়াজিসকে।

আতঙ্কিত ঘসেটি নিজেকে মতিঝিলে বন্দি করে রাখল বেশ কিছুদিন। তারপর গোপনে নওয়াজিসের সেনাপ্রধানদের হাতিশাল থেকে হাতি আর নিজের কোষাগার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে আলিবর্দির অবর্তমানে সিরাজের হাত থেকে তাকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিল। আস্তে আস্তে আলিবর্দির শরীর ভেঙ্গে পড়তে লাগল। আলিবর্দির কাছের লোকেরা তার সঙ্গে দেখা করে সিরাজের কাছে তাদের সম্বন্ধে বলে যাওয়ার অনুরোধ জানাল। আলিবর্দির অবর্তমানে নিজেদের অবস্থা নিয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ল সবাই। সিরাজের হাতে তাদের কার যে কী দশা হবে সে কথা ভেবে রাতের ঘুম চলে গেল সবার। আলিবর্দি তার কাছের লোকেদের বলল তার মৃত্যুর পর তারা যেন সারফুন্নিসার সঙ্গে সিরাজের সম্পর্কের দিকে নজর রাখে। যদি সারফুন্নিসা আর সিরাজের সম্পর্ক ভাল থাকে তাহলে তাদের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। কয়েকদিনের মধ্যেই দেহ রাখলেন আলিবর্দি খান। তার বয়স তখন ছিয়াশি।

ঘসেটি আশা করেছিল আলিবর্দির মৃত্যুর পর মুর্শিদাবাদের সাধারণ মানুষ সিরাজের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামবে। জনরোষে নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাবে অত্যাচারী সিরাজ এবং তার দলবল। যে সব সেনাপ্রধানদের দুহাতে টাকা বিলিয়ে আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিল সে তারা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে সিরাজের বিরুদ্ধে। কিন্তু বিল্পব দূরের কথা বিন্দুমাত্র বাধা এবং বিরোধিতার মুখোমুখি না হয়ে আলিবর্দির মৃত্যুর পর মহাসমারোহে মসনদে বসল নবাব সিরাজদৌল্লা। সিরাজের বয়স তখন তেইশ।