Next
Previous
12

গল্প - নন্দিনী বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in





ট্যাম্পায় আসাটা আমার নিতান্তই কাকতালীয়। রুমের প্রাণের বন্ধু জিজা থাকে ট্যাম্পায়। আমি কাজে এসেছিলাম মায়ামিতে। জিজার জোরাজুরিতে কাল রাতে এসে পৌঁছেছি এখানে। উইকেন্ডটা থেকে সোমবার দুপুরের ফ্লাইটে মন চল নিজ নিকেতনে – কলকাতা।

জিজা এখানে একটা কমিউনিটি কলেজে কেমিস্ট্রি পড়ায় আর অশেষ একটা কনসালটেন্সি ফার্মে কাজ করে। ওদের ৭ বছরের মেঘনা নদীর মতোই চলিষ্ণু। ওকে মুহূর্তের জন্যও কোথাও বসিয়ে রাখা যায় না। খাবার টেবিল, রাতের বিছানা, ও নড়ছে, চড়ছে, হাঁটছে, ছুটছে, দৌড়াচ্ছে, লাফাচ্ছে কথা বলছে অনর্গল, হাসছে খিলখিলিয়ে, কাঁদছে ঝরঝরিয়ে যেন অফুরন্ত এনার্জির একটা চলন্ত কারখানা। আর ওদের আড়াই বছরের ছেলে বোধি আবার তেমনি শান্ত। টলটলে চোখ আর লাজুক হাসি মেখে চুপচাপ খেলা করে। ছোট ছোট গাড়ি, রঙিন পেন্সিল, চৌকোনো লোগোর ব্লকের মাঝে বুঁদ হয়ে থাকে।

আজ শুক্রবার। ওরা দুজনেই ছুটি নিয়ে আমাকে সারাদিন Anna Maria Island আর Salvador Dali-র মিউজিয়াম ঘুরিয়েছে, থাই দোকানে চমৎকার নারকেল চিংড়ি খাইয়েছে। এত আন্তরিক ওদের ব্যবহার যে আমার ভীষণ সংকুচিত লাগে। মা মারা যাওয়ার পর রুম যা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করে। অবশ্য আমাকে নিয়ে মাতামাতি করা খুব ঝামেলা, আমি এত গুটিয়ে যাই যে যে বা যারা করে তারাই হাল ছেড়ে দেয়।

আগামীকাল এখানে কালীপুজো। কলকাতায় অবশ্যই মঙ্গলবারই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখানে তো উইকেন্ড না হলে এসব করা যায় না। উইকেন্ডে সকলের ছুটি থাকে, অনেকেই দূর থেকে আসে তাই সপ্তাহের মাঝে অসুবিধা হয়ে যায় বলে অনাবাসীরা পালা পার্বণের আগে পিছে উইকেন্ড বুঝে এগুলো করে। আমরা যারা দেশে থাকি তাদের কাছে এগুলো অবশ্য প্রথম প্রথম খুব অবাক লাগতো। এখন আর লাগে না যদিও।

দেশে ফেরার আগে একটু আধটু চকলেট কেনার কথা জিজাকে বলেছিলাম। তাই রাতে ডিনার সেরে ফেরার পথে ওরা বলল, "ওয়ালমার্ট তো ২৪ ঘণ্টা খোলা, চলো তোমাকে ওখানেই নিয়ে যাই কেনাকাটা করতে।" জিজা কাল সকালে ব্যস্ত থাকবে আর রাতে Auburndale-এ কালী পুজোয় যাওয়া তাই ওটাই ঠিক হল।

গাড়িটা যখন পার্ক করছে তখন জিজা বলল, "মনে হয় মৃত্তিকাদির গাড়ি।" একটা লাল রঙের Camry দেখলাম আলো-আঁধারিতে, আর আমার ভেতরে মনে হচ্ছিল যেন কেউ দুরমুস পেটাচ্ছে। মৃত্তিকা... মৃত্তিকা... কতগুলো মৃত্তিকা আছে এই পৃথিবীতে? যে মৃত্তিকা একসময় প্রান্তরের খুব কাছের ছিল এই কি সেই মৃত্তিকা? জিজা কি রুমের কাছ থেকে কখনও মৃত্তিকার কথা জানে? মাটি বলে ডাকতাম ওকে। এই মৃত্তিকা কি আমার মাটি?

Walmart-এ গিয়ে সব গোলমাল লাগছিল। লিস্টটা জিজা আগেই চেয়ে নিয়েছিল। আমি প্রতিটা রমণীর মুখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছিলাম। মাটিকে পেলাম না। যখন বাজার ছেড়ে গাড়িতে উঠলাম পাশের Camryটা ছিল না। আমার ভেতরটা শুকনো পাতার মতো কাঁপছিল। মাটি কি তবে আমার এত কাছে? কতদিন মাটিকে দেখিনি...

কিছুতেই মুখ ফুটে জিজাকে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না মৃত্তিকার কথা। যদি না হয়? ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি যে ট্যাম্পায় সবাই কালীপুজোয় যায় কিনা? কিন্তু কেমন বাধো বাধো লাগল। সারারাত কেবল টুকরো টুকরো দলছুট স্মৃতিতে মনটা ভিজে রইল।

সাদা সালোয়ার আর ম্যাজেন্টা ওড়না পরা মাটি ময়দানে খিলখিল করে হাসছে, থোকা থোকা চুলে ঢেকে যাচ্ছে মুখ চোখ, কালো মেঘের হঠাৎ গর্জন আর ঝমঝম বৃষ্টিতে শক্ত হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে আমায়। ঘুমটা ভেঙে গেল। কতদিন পরে মাটিকে স্বপ্ন দেখলাম! কত কাছে!

পরদিন ভোরে মনটা উসখুস করছিল। উঠে দেখলাম এক কাপ চা নিয়ে জিজা Patioতে বসে দূরের দিকে চেয়ে আছে। ছোট ছোট নীল ফুলেতে ওর বাগানের পিছন দিকটা কি মায়া-ময়, ফুলের নাম জানলাম Plumbago , তার মাঝে নরম সবুজ রাত পোশাকে ওকে পরিবেশটায় খুব মানিয়ে গিয়েছিল।

আমায় দেখতে পেয়ে বলল, "প্রান্তর দা চা রেডি করা আছে। নিয়ে বাইরে চলে এসো। এই সময়টা খুব আরামদায়ক।" অশেষ নাকি বরাবরই ঘুমকাতুরে, আর বাচ্চারাও কেউ এত সকালে জাগে না তাই এটা নাকি ওর একান্ত নিজস্ব সময়। আমি বললাম, "তবে তুমি আমায় ডাকলে যে? আমি না হয় ঘরে বসেই চা খেতাম।" ও হেসে বলল, "তুমি যে কলকাতার লোক, বাপের বাড়ির লোক, রুমের দাদা, তোমার সঙ্গে এই সময়টা আমি ভাগ করতে পারি, কিন্তু আর কারো সঙ্গে ভাগ করতে বোলো না।" কত সহজে কথাটা বলল আর আমি সাধারণ একটা কথা কিছুতেই জিজ্ঞাসা করতে পারছি না। মনে মনে কথার পর কথা সাজালাম, "জানো জিজা আমিও না মৃত্তিকা বলে... আচ্ছা জিজা, কাল রাতে তুমি মৃত্তিকা বলে একজনের কথা..." বুঁদ হয়ে রইলাম। ভেতরে ভেতরে অস্থির লাগছিল কিন্তু বাইরে চায়ের কাপে মেপে মেপে চুমুক দিলাম, জিজাও চুপচাপ ছিল। সকালটা বয়ে যাচ্ছিল নিজস্ব ছন্দে।

একটু পরে জিজা তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল। ও যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থানের সঙ্গে কাজ করে Thanksgiving এর আগে ওরা বিভিন্ন ব্যবসা ও দোকানের সামনে বড় বড় বাক্স রেখে আসে। গ্রাহকরা অনেক সময় ক্যানের বা 'তৈরি' খাবারের বাক্স রেখে দেয় ওখানে। তারপর উইকেন্ডে যেসব জায়গায় বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হয় সেখানে ওরা ওই বাক্সগুলো নামিয়ে দেয়। আবার ক্রিসমাসের সময় বাচ্চার জন্য খেলনা, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, শীতের পোশাক, খাবার ইত্যাদি এমনভাবে সংগ্রহ করে আরো বড় বড় সেচ্ছাসেবী সংস্থানে দিয়ে আসে। আবার স্কুল শুরু হওয়ার আগে, কাগজ পেন্সিল, ব্যাকপ্যাক, জুতো, জামা-র জন্য দরজায় দরজায় ঘোরে। ও যখন Beach থেকে ফেরার সময় এইসব বলছিল, আমায় ওর আবেগটা ছুঁয়ে যাচ্ছিল।

মনে মনে ভাবছিলাম এবার দেশে ফিরে আলমারি খুলে যত জামা কাপড় আছে, যা আর পরা হয় না, কোনও না কোনও কারনে সব ভারত সেবাশ্রম বা রামকৃষ্ণ মিশনে দিয়ে দেব। রুম অবশ্য খুব একপ্রস্থ চটাচটি করবে। আমি নাকি কিছুই কিনি না নিজের জন্য। ওরা যেগুলো দেয় তাও নাকি পরি না, বস্তা পচা জামা কাপড় পরি বছরের পর বছর। রুমের আমার আর্য্য কে নিয়ে যত শাসন। দু-দুবার মিসক্যারেজের পর কোনও শিশু মুখ তো আর এলো না। তাই আর্য্য দিনকে দিন আরও ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছে আর ও দিনরাত গম্ভীর মুখে আমাদের দুজনকে বকাঝকা করে যাচ্ছে। আমার থেকে ও ৭ বছরের ছোট হলেও ও আমাকে বরাবরই শাসন করে এসেছে, সেই ছোট্টবেলা থেকে আর এখন আর্য্যকেও ছাত্র পেয়েছে।

দুপুরের খাবার সময় হল। অশেষ খাবার গরম করলো সহজ হাতে। কিচ্ছু চলকালো না, পুড়লো না। আমার আবারও নিজেকে খুব অকেজো মনে হল। বাচ্চাদের কেমন ভাত মেখে দিল আর ওরা কেমন সুন্দর করে খেয়ে নিল। দুপুরের খাওয়া সাধারণত খুব সিম্পল হয় এখানে। স্যুপ, স্যান্ডউইচ, স্যালাড যাহোক কিছু খেয়ে নেয়। কিন্তু আজ আমি আছি বলে আর অশেষ ভাত ভালোবাসে বলে জিজা রান্না করে রেখেছিল। মেথি ধনেপাতা দিয়ে মসুর ডাল, ব্রকলি ভাজা কালোজিরা-তিল ছড়িয়ে আর আদা জিরের মাছের ঝোল। দিব্য খেলাম। বাচ্চারাও একই খাবার খেলো, কোনও ঝামেলা করল না।

খাওয়ার পর বাচ্চারা বাইরের Yard এ খেলা করতে শুরু করল আর অশেষ বসে আমার সঙ্গে কথা বলছিল। ওর বাড়ির কথা, ছোটবেলার কথা, এদেশে আসার প্রথম দিকের কথা। আমাদের কথাবার্তার মধ্যেই জিজা এল। বাচ্চারা ওকে দেখে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আর ও কেমন ঘাসের মধ্যে ওদের সঙ্গে বসে হুটোপুটি করতে লাগল।

মেঘনার কথার ফোয়ারা চলল, চোখ বড় বড় করে কত কি বলল, ঝর ঝর করে হাসলো, ভাই যে মাঝে মাঝে কি বোকাবোকা কাজ করে আর ড্যাডি ওদের ব্লুবেরিজ আর আইসক্রিম লাঞ্চের আগে দিয়েছে আর মাম্মা যে কেন কখনও দেয় না... অশেষ এদিক থেকে জীভ ভ্যাঙাতে লাগলো।

নিজেকে হঠাৎ খুব বেমানান লাগছিল। ওদের নিজস্ব ছন্দে যেন মূর্তিমান ছন্দপতন। অশেষ কী বুঝলো কে জানে, হেসে বলল, "প্রান্তর দা চলুন আমরা একটু হেঁটে আসি। একটা ছোট হাঁটার trail আছে ক্লাব হাউজের কাছে, ওখানটা মনে হয় আপনার ভালো লাগবে।"

জিজা বলল, "প্লিজ তোমরা বেশি দেরি কোরো না।" আর তারপরেই বাচ্চাদের সঙ্গে মশগুল হয়ে গেল।

ওদের হাসির রিনরিন বহুদূর পর্যন্ত কানে ভাসছিল। অনেকেই হাঁটছে বা দৌড়চ্ছে দেখলাম। মস্ত বড় বড় কুকুর নিয়ে হাঁটছে কিছু মানুষ। অশেষ বলছিল যে এদিকটায় প্রচুর ভারতীয় আছে। বেশিরভাগই প্রফেশনাল। প্রাক চল্লিশ।

ক্লাব হাউজে পৌঁছানোর আগেই বাচ্চাদের কলরব কানে এলো। জলেতে ঝাপাঝাপি, কচি গলায় হইচই, বড়দেরও গলা পাওয়া যাচ্ছিল। দেখলাম দুটো হিটেড পুল ছাড়াও বাচ্চাদের ও বড়দের জন্য নানারকম খেলার জায়গা আছে। ফুটবল খেলার বড় মাঠ, বাস্কেটবল কোর্ট, টেনিসের জন্য আটটা কোর্ট, জিম কত কী যে আছে।

অশেষকে দেখে হইচই করে উঠলো কিছু অল্পবয়সী ভদ্রলোক – ওরা ভলিবল খেলছিল। অশেষ আলাপ করিয়ে দিল। সবাই ভারতীয়। অশেষ মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গে খেলে। মাঝে অনেক দিন আসতে পারেনি তাই আজ অশেষকে পেয়ে ওরা আর ছাড়তে চাইছিল না। অশেষ কাঁচুমাঁচু হয়ে ওদের বোঝাতে চেষ্টা করছিল যে ও আমাকে দেখাতে নিয়ে এসেছে ইত্যাদি...। আমি বললাম, "তুমি একটা গেম খেলো। আমি ঘুরে আসছি।" সবাই হই হই করে উঠল। অশেষের প্রতিবাদ ডুবে গেল। আমি হেসে মাথা নেড়ে হাঁটতে শুরু করলাম।

এদিকটা ছায়া ছায়া আর একটু নিঝুম। চুপচাপ হাঁটছে মানুষজন। একটা অল্প বয়সী ছেলে আর মেয়ে দুজনে বসে আছে কাঠের সাঁকোর ওপর। জলের দিকে মুখ করে। আমার পায়ের তলায় পাইনের ডাল আর অসংখ্য পাইনকোণ। ধূসর খরগোশ চুপটি করে বসে আছে দেখলাম। ভারী শান্ত পথটা। আমার কাল থেকে যে অশান্ত ভাবটা শুরু হয়েছে সেটা ক্রমশ আলগা ভালোলাগায় বদলে যাচ্ছিল। আমার সামনে একটু দূরে একজন মহিলা হাঁটছিলেন। মাথার চুলে রুপালি তারের ঝিলিক। হাঁটার ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছে যে উনি হাঁটতে অভ্যস্ত, একটা স্বাভাবিক ছন্দ আছে।

একটা অচেনা পাখি ডাকছে আর আমি ভাবছি, আচ্ছা যদি আজকে মাটি সত্যিই কালী পুজোতে যায় তবে ২৩ বছর পরে আমি যখন ওকে দেখব (আমি তো তাও মনে মনে প্রস্তুত) কিন্তু ও কী করবে? সেই হাসি যেটা ওর চোখকে ছুঁয়ে যেত সেই হাসিটা হাসবে? আর ওর সেই হরিণের মতো চোখ দুটো সেগুলো ঠিক সেরকমই আছে? আর ও কি বিবাহিতা? ওর স্বামী সন্তানেরা? আমি কী যেন কিছুই হয়নি বলে ভদ্র হেসে সামাজিকতা করব? পারব? বুকের মধ্যে সেই বহুদিন আগের কষ্টটা হঠাৎ এতদিন পরে মনে হল আবার দম বন্ধ করে দেবে। চারপাশে গভীর অন্ধকার নেমে আসছে যেন।

আমি তাড়াতাড়ি পা চালালাম। যাব না কালীপুজোয়। পারব না মৃত্তিকার সামনে ওর স্বামী সন্তানের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করতে। এতদিন যে যন্ত্রনা বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছি হঠাৎ এক ঘর লোকের মাঝে আমি কিছুতেই মাটির চোখে চোখ রাখতে পারব না।

পর মূহুর্তেই ভাবলাম এত কাছে মাটি, জেনেও ওকে না দেখে ফিরে যাব? আর হয়তো কোনওদিন দেখা হবে না। কো-ন-ও-দি-ন না! কেমন যেন ভাবনাটার মধ্যে একটা অমোঘ ভাব আছে। ভাল লাগল না। ভাবলাম, যাই দেখেই আসি। প্রান্তরকে ছেড়ে মাটি আজকাল কেমন আছে!

সন্ধ্যেতে যখন Auburndale যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠলাম, তখন ভেতর ভেতর খুব অস্থির অস্থির লাগছিল। মনটা এত বিক্ষিপ্ত ছিল যে সহজ প্রশ্নের বা কথার পিঠে কথা কোনওটাই সহজে আসছিল না। খালি খালি মন জুড়ে মাটি। শেষ যেবার দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে আমি ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম হাত, ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম পথ। ও বাসে ওঠার আগে আমার দু-হাত আঁকড়ে ধরে বলেছিল, "প্রান্তর, আমার উপর বিশ্বাস রাখো, আমি পারব, আমরা পারব, আমাকে এত খেলো কোরো না।" আমি ওর নরম মুঠোর থেকে ভেজা রুমালটা নিয়ে নিয়েছিলাম কিন্তু ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সহজ ভাবে হাত নেড়েছিলাম, ওর ভেজা চোখের দিকে শুকনো চোখে তাকিয়েছিলাম।

আমি কিছুতেই আমার জীবনের সঙ্গে ওকে জুড়তে পারলাম না। আমার তখন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। আমার সাতাশ বছরের জীবনে হঠাৎ একটা চোরা বাঁক এসে সব তছনছ করে দিয়েছিল। তার সাড়ে তিন মাস আগে পিএইচডির থিসিস জমা দেওয়ার আগে আগে খুব অনিয়ম চলছিল। রাতের পর রাত ঘুম হচ্ছিল না, তখনও অনেক কাজ বাকি ছিল আর লাইব্রেরীতে হঠাৎ সমস্ত ঘরটা চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ফিরে দেখলাম মেঝেতে শুয়ে আমি, জামার সামনেটা, মুখ চোখ ভেজা, কয়েকটা চেনা অচেনা উৎসুক মুখ, লাইব্রেরিয়ান জিজ্ঞাসা করল, "তোমার কি মৃগী আছে নাকি?"

জীবনটা হঠাৎ পাল্টে গেল। হাইস্কুলে ফুটবল খেলতে গিয়ে একবার পড়ে গিয়ে মাথার পিছনে খুব আঘাত পেয়েছিলাম। অনেকদিন লেগেছিল স্বাভাবিক হতে। ১০ বছর পরে সেই আঘাতের স্বরূপ যে মৃগী হয়ে দেখা দেবে তা কে ভেবেছে? সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে বোঝা গেল যে এটা এক ধরনের Epileptic seizure, traumatic brain injury থেকে হতে পারে। অনেক সময় মাথার আঘাত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হতে পারে আর কারো কারো ক্ষেত্রে অনেক দিন পরেও হতে পারে।

অনিয়ম, ঘুম কম, পিএইচডির জন্য টেনশন এসব কারণ মিলিয়ে এটা হয়েছে। কিছু বোঝার আগেই আবার হল, তার ছয় দিনের মাথায় ডাক্তারের চেম্বারেই আবার।

চেনা ছক, পরিচিত রাস্তা বদলে গেল। সারা জীবন ওষুধ খাওয়া, উত্তেজনা কম, পরিমিত জীবন, মাটির সঙ্গে প্রান্তরের পথ চলা যে শেষ সেই সিদ্ধান্তও নিয়ে নিলাম।

মাটি অনেক জেদ করেছিল, কিন্তু উত্তেজনা হীন জীবনের দোহাই দিয়েছিলাম ওকে। বলেছিলাম, যে ও না চলে গেলে সেটা কখনওই সম্ভব নয়। ও তর্ক করেছিল অনেক কিন্তু হার মেনেছিল শেষ পর্যন্ত আমার জেদের কাছে।

সেই মাটি যাকে এসপ্ল্যানেডের মোড় থেকে এক চোখ জল নিয়ে বাসের জানালার ফ্রেমে দেখেছিলাম শেষ, তার সঙ্গে আজ আবার দেখা হতে পারে ভেবে এক ধরনের উত্তেজনা হচ্ছিল। মাটিকে দেখলেই কলসির জলের মতো ছলাৎ ছলাৎ করত আমার ভেতরটা। আজ ২৩ বছর পর ৫০ এর কোঠায় পা দিয়েও সেই একই অনুভূতি? এমনও হয়?

গাড়ি থামল। পা দুটোতে যেন কেউ শীসে ঢেলে দিয়েছে। অসম্ভব ভারী। কোনও রকমে দাঁড়ালাম। ভেতরে একটা ভয়ের কাঁপন দিচ্ছিল। সংযত করলাম মনটাকে খানিকটা। শান্ত পায়ে ওদের সঙ্গে পা মেলালাম।

আর হঠাৎ দেখলাম লাল কালো হলুদ শাড়ির মাঝে বাচ্চাদের চেঁচামেচি হুটোপাটার মধ্যে ভদ্রলোকদের বাহারি শেরওয়ানি আর সৌজন্য বিনিময়ের ভেতর দিয়ে সাদা কালো শাড়িতে, একরাশ কাঁচা-পাকা চুলে দৃপ্ত পায়ে হেঁটে আসছে মাটি। ঐ চোখ তো আমি মরে গিয়েও ভুলতে পারব না।

দু-হাত বাড়ালো অসংকোচে। চোখ ছুঁয়ে হেসে বলল, "এসো প্রান্তর, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।" আমি বিহ্বল চোখে তাকাতেই বলল, "সকালে জিজার সঙ্গে যখন দেখা হল, তখন ও বলল, ওর ছোটবেলার বন্ধু রুমের দাদা প্রান্তর এসেছে। আজ কালীপুজোয় নিয়ে আসবে। ক-জন প্রান্তরের আর রুম বলে বোন থাকে বলো? ওকে অবশ্য আমি কিছুই বলিনি।"

আমার চারপাশ ক্রমশ অন্ধকার রাতে শুরু করল। ওষুধ খাইনি আজ? মনে করতে পারলাম না। আজ ২৩ বছর পর মাটির সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকব? খিচুনি আর ফেনা? এই করুণা চাইনি বলেই তো হাত ছাড়িয়েছিলাম।

আর মাটি সবার সামনে আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, "আমি জানতাম তুমি আসবে।"

আমার চারপাশের কোলাহলরা ফিরে এলো। ধোঁয়াটে মুখগুলো আদল ফিরে পেল। আর আমি পরম আশ্লেষে বুঁদ হয়ে গেলাম ওর মধ্যে।