Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















নতুন মহারাজের আমলে রান্নার স্বাদ বদলে গেছে। রান্নাঘর আর ডাইনিং হলের পিঁড়িগুলো বেশ পরিষ্কার। এখন প্রত্যেক রোববারে ওসব গরম জল আর সোডা দিয়ে ধোয়া হয়। তদারক করেন ব্রহ্মচারী সুবীর আর ব্রহ্মচারী বরেন। বড় মহারাজ ওঁদের কড়া করে বলেছেন-- তোমরা রান্নার ঠাকুর আর চাকরকে খাটাও না? এখন ডাইনিং হলেই রাত্তিরে দুধ দেওয়া হয়।
আমরা কখনও ওতে লেবু চিপে ছানা বানাই বা কলাই করা মগে দইয়ের সাজা দিয়ে পেতে দিই। সকালে উঠে যখন দেখি জমে গেছে তখন কী ভালো লাগে।
ক্লাস ইলেভেনের অসীমদাকে মহারাজ বিশেষ পারমিশন দিলেন -- ও স্টেনলেস স্টিলের থালায় খাবে আর রোজ ওর পাতে একটা করে ডিম দেওয়া হবে। এটা ওর বাবা স্বামীজিকে অনুরোধ করে রাজি করিয়েছেন। এর পয়সাটা উনিই প্রতিমাসে জমা করে দেবেন।
আমি বুঝতে পারি--অসীমদা বেশ বড়লোক ঘরের ছেলে। ও পাঁচটাকা দামের চটি পরে , আমরা আট আনার হাওয়াই চটি বা বারো আনার চপ্পল। ওর কাছে বেশ নগদ পয়সা থাকে। যদিও নিয়ম হল কোন আবাসিক ছাত্রের হাতে পয়সা দেওয়া যাবে না। যা দেওয়ার অফিসে জমা রাখতে হবে।
ডাইনিং হলের দেওয়ালে বেশ বড় করে দুটো লাইন বাঁধিয়ে উঁচুতে টাঙিয়ে রাখা আছে। কানাইদা করে গেছলেন।
গীতার থেকে নেওয়া দুটো শ্লোকঃ
"ওঁ ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্মহবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণাহুতং,
ব্রহ্মৈবতেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্ম সমাধিনা।
হরি ওঁ তৎ সৎ।"
[ ব্রহ্মরূপী অগ্নিতে ব্রহ্মহবিঃ ব্রহ্মকে অর্পণ করে ব্রহ্মদ্বারা আহুতি দেওয়া হল। এই নৈবেদ্য ব্রহ্মকর্ম সমাপনের উদ্দেশে ব্রহ্মএর কাছেই যাবে।]
কাগজটা হলদেটে, ফ্রেমটা একদিকের দড়ি ছিঁড়ে কেতরে রয়েছে। কেউ ঠিক করছে না। ওয়ার্ডেন অচ্যুতদাকে বলে কোন লাভ হল না, দুটো হুঁ আর হাঁ শোনা ছাড়া।
কিন্তু আমাকে যে রোজ ডাইনিং হলে গীতা পড়তে হয় --জোরে জোরে পাঠ করি।--যতক্ষণ ভাত ডাল ও একটা তরকারি পরিবেশন সম্পূর্ণ হচ্ছে ততক্ষণ। দুবেলা। তারপর পকেট গীতা বন্ধ করে পাশে রেখে ওই দুইলাইন জোরে জোরে টেনে টেনে বলি। অনেকেই গলা মেলায়। তারপর হাপুশ হুপুশ করে খাওয়ার শব্দ। সেকেন্ড কোর্স , বেশির ভাগ দিন মাছের ঝোল দেওয় হয়।
খাওয়া শেষ হলেও কেউ আগে উঠবে না। আমি খেয়াল করে দেখব অধিকাংশের খাওয়া হয়েছে কি না। তারপর উঁচু আওয়াজে শ্লোগান দেওয়ার মতন বলবঃ
" জয়, গুরু মহারাজ কী জয়, --জয়!
জয়, সাধূমহারাজ কী জয়,--জয়!
জয়, গঙ্গা মাঈকী জয়,--জয়!"
কখনও সখনও এই বিশেষ ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করি। মাসে একদিন মাংস আর গুঁড়োদুধের পায়েস। সেদিন কী যে হয়! পঞ্চা ঠিক করে রাঁধতে পারে না, তায় দুশো জনের রান্ন। মাংস পুড়ে যায়, পায়েসে দুধ তলায় লেগে যাওয়ায় পোড়া গন্ধ টের পাই। তবু আমরা উলুত পুলুত করে খাই।
সেদিন মাংসটা আগে দেয়। বন্ধুরা চোখের ইশারায় বলে এবার গীতাপাঠ শেষ করে "ব্রহ্মার্পণং" বল্‌ দিকি!
আমি দেখেও দেখি না, পাঠ চালিয়ে যাই। ওরা চোখ বড় করে, পাতে রাখা মাংসের দিকে ইশারা করে করুণ ভাব ফুটিয়ে তোলে। আমি আরও মগ্ন হয়ে সাংখ্যযোগের অধ্যায়ে ডুবে যাই--
গম্ভীর আওয়াজে পড়িঃ
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবক;ঃ,
ন চৈনং ক্লেদয়ন্তাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।
ওরা দাঁত কিড়মিড় করে ইশারায় বলে ক্যালাবে, কিন্তু জানে যে কিছুই হবে না। কারণ এই দায়িত্বটি আগে যিনি পালন করতেন সেই অমল নাগ পাশ করে যাওয়ায় কাজটা বন্ধ হয়ে গেছল। তখন ক্লাস সেভেনের প্রদ্যুম্ন গিয়ে কানাইদাকে বলেছিল-- আমি এটা পারব। ছোটবেলায় দাদুর সঙ্গে করে শিখেছি।
রামকানাইদা হেসে বলেছিলেন-- পারবি? বেশ, একবার পড়ে শোনা।
শুনে বললেন --ঠিক আছে, তবে তোর তিনটে স , মানে সন্দেশের স, শালগমের শ আর ষাঁড়ের ষ,-- সব একরকন শোনাচ্ছে। আর র ও ড়, এবং ণ। আয় ব্যাটা, দেখে নে। অভ্যাস কর। তারপর সোমবার থেকে লেগে পড়।
নীচুক্লাসের ছেলে ডাইনিং হলে রোজ গীতাপাঠ করছে-- হল্লা হয়ে গেল। কেলটে এবং পুকুরের পচা জলে হাতে পায়ে খোস-পাঁচড়া হওয়া ঘেয়ো বাচ্চা প্রদ্যুম্ন ওরফে পোদোকে সবাই সম্ভ্রমের চোখে দেখতে লাগল।
সেভেনের বাচ্চারা গর্বিত।
--অ্যাই পোদো, আমাকেও শিখিয়ে দে না!
--- আচ্ছা, পোদো, প্রথম থেকে না দেখে কতটা বলতে পারবি? একবার করে দেখা! বইটা কিন্তু আমার হাতে থাকবে।
--ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ,
মামকাপান্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বতঃ সঞ্জয়?
-- বারে পোদো, বেশ তো! হ্যাঁরে পোদো, তুই কি বড় হয়ে সন্ন্যাসী হবি? আমাদের কানাইদার মতন?
পোদো অহংকারী ভঙ্গিতে ঘ্যাম লইয়া গম্ভীর হইয়া যায়। বিধাতাপুরুষ সেদিন অলক্ষ্যে হাসিয়াছিলেন বোধহয়।
****************************************************
গায়ের ব্যথাট্যাথা সারিয়ে ক্রিকেটে মন দিয়েছি। বছরের প্রথম, এখনও পড়ার চাপ নেই। কিন্তু ক্লাস টেনের ম্যাথস যে রকেটের স্পীডে এগিয়ে চলেছে। ক্লাস নাইনের সময় প্রদ্যুম্নকে হিউম্যানিটিজ অথচ সংস্কৃত, অর্থনীতির সঙ্গে ইলেক্টিভ ম্যাথস্‌ জাতীয় বেয়াড়া কম্বো নেওয়ায় ভুগতে হয়েছিল। ওকে ম্যাথস্‌ ক্লাস করতে হয়েছিল টেকনিক্যাল স্ট্রিমের সঙ্গে। ক্লাস টেনে ওকে বসতে দেওয়া হল সায়েন্সের সঙ্গে। ও আর বিপ্লব পাশাপাশি বসে।
কিন্তু ও যে স্কুলের সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব নিয়েছে আর এর ফলে অংকের ক্লাস হরবখত মিস হচ্ছে। চাঁদার হিসেব, কুমোরটুলি গিয়ে প্রতিমার বায়না, ঢাকি ঠিক করা, ঠাকুর আনতে যাওয়া--কত কাজ। এই ফাঁকে হরদম গেটপাস বানাতে হচ্ছে আর অচলায়তনের পাথরের দেয়ালের বাইরে গিয়ে মাঠ, গরু-ছাগল চরছে , কর্পোরেশনের কলের থেকে জল ভরার লাইনে চুলোচুলি হচ্ছে --এইসব প্রাণভরে দেখতে পাচ্ছে।
মাঝে মাঝে , যেন ভুল করে, অংকের ক্লাসে ঢুকে পড়ছে। কিন্তু ঢুকে মনে হচ্ছে যেন বানের জলে সাঁতার কাটা!
আগের ক্লাসটায় এপি সিরিজ বোঝানো হচ্ছিল, সে একরকম। কিন্তু তারপর জিপি একটু খটোমটো আর এইচ পিটা কেমন যেন জালিমার্কা।
আজ তো দেখছে দুটো তিনটে সিরিজ জড়িয়ে মড়িয়ে একটা। তোমাকে সেগুলো আলাদা করতে হবে। মরেছে! এরচেয়ে ঘুড়ির মাঞ্জার জট ছাড়ানো অনেক সোজা।
ওকে স্যার ব্ল্যাকবোর্ডে ডাকলেন। ও অসহায় চোখে একবার বোর্ডের মধ্যে সংখ্যা আর সাইনগুলোর দিকে তাকায় আবার লাস্ট দুটো বেঞ্চ আলো করে বসে থাকা আশ্রমের আবাসিক বন্ধুদের দিকে।
পেছন থেকে কিছু ধরতাই এল বটে, ফিসফিস করে, কিন্তু ধরতে জানতে হয়। ওর মনে বাজছে 'তারে ধরি ধরি মনে করি ধরতে গিয়ে আর পেলাম না'।
অংকের স্যার কেন যে ওকে টার্গেট করলেন?
ওরও দোষ আছে, সব ব্যাপারে পট্পট করে উত্তর দেওয়ার রোগ।
ওর বন্ধু রমেন শেষ বেঞ্চে বসে একটা বই পড়ছিল। তার বাদামী রঙের কভারে বেশ বড় বড় অক্ষরে লেখা "আদর্শ বাংলা ব্যাকরণ"; কিন্তু ভেতরে আসল বইটা হল লাইব্রেরি থেকে আনা "চরিত্রহীন"। একবার মনে হল স্যার ওকে দেখছেন। পোদো সতর্ক করায় ও বলল-- দাঁড়া, এখন কিরণময়ী বৌদি দেওরকে লুচি ভেজে দিতে দিতে লাইন মারছে-- ডিস্টার্ব করবি না। স্যার-ফ্যার তুই সামলে নিস।
ধেত্তেরি!
কিন্তু একটু পরে চোখে পড়ল স্যার পড়াতে পড়াতে চক ভেঙে ছোট ছোট টুকরো করছেন। সব ক্লাসেই উনি এটা করেন। এর মানে হচ্ছে উনি এবার ওই টুকরো অন্যমনস্ক ছাত্রের কপালে ছুঁড়ে মারবেন। আর গোটা স্কুল জানে, ওঁর টিপ ফস্কায় না। গাঁয়ের আম পাড়া টিপ।।
স্যার তাকিয়ে আছেন রমেনের দিকে, মুখে বলছেন -- র‌্যাশনাল আর ইর‌্যাশনাল নাম্বারের ব্যাপারটা ভাল করে বোঝ, আর রিয়েল ও ইমাজিনারি। বেশ!
বলতে বলতে উনি রমেনের সামনের দুই সারির ছেলেদের মাথা সরিয়ে নিতে ইশারা করলেন।
প্রদ্যুম্ন কী করবে? কী করে রমেনকে সাবধান করবে? ও তো পোদোর ভরসাতেই ক্লাসে গল্পের বইটা পড়ছে। কিন্তু কোন উপায় নেই। স্যার যে ওকেও কড়া নজরে রেখেছেন।
এবার উনি রাইফেল শ্যুটারদের মত লক্ষ্যস্থির করছেন। মুখ চলছে- ইয়েস, ইন্টিজার--পজিটিভ অ্যান্ড নেগেটিভ--। বুলেটের মত চকটা ছুটে এল। কিন্তু পোদোর হাতের লাল বাঁধানো খাতা ওর অজান্তেই চকটাকে স্যারের টেবিলে টেবল টেনিসের মত ব্যাকহ্যান্ড রিটার্ন করে দিল।
ভাগ্যিস স্যারের গায়ে লাগে নি, শুধু ওঁর টেবিলে পড়েছে।
এতক্ষণ দম বন্ধ করে তামাশা দেখা গোটা ক্লাস হো-হো হাসিতে ফেটে পড়েছে।
কিন্তু পোদোর মুখ শুকিয়ে গেছে। ও এটা কী করল? স্যারের কিল যে বিখ্যাত। উনি দোষী ছেলেদের ঘাড় ধরে ঝুঁকিয়ে পিঠটা উঁচু করিয়ে তারপর গোয়ালাদের মত গদাম করে মারেন।
--- লালখাতা কার? উঠে এস। উঠে এস, আমার সময় নষ্ট কর না।
গোটা ক্লাসে আবার সন্নাটা। মহা ল্যাবা পক পক করে বাতেলা দেওয়া পোদোর কপালে আজ দুঃখু আছে।
এক পা এক পা করে এগোতে থাকি। স্যারের টেবিল ও আমার মধ্যের দুরত্ব ক্রমশঃ কমে আসছে। মার থেকে বাঁচার কি কোন উপায় নেই? আছে, একটা আছে। ও সহজে চোখে জল আনতে পারে। কী করে পারে কে জানে! কিন্তু পারে।
একটা নাটকের রিহার্সালে অমন রেডিমেড চোখের জল দেখে কানাই মহারাজ খুব তারিফ করেছিলেন। তারপর থেকেই ও আশ্রমের নাটকের দলে রেগুলার।
উঃ, এখন কানাইদা মাথায় থাকুন, ওঁর আশীর্বাদ পেলেই যথেষ্ট। পোদো পা মেপে মেপে ফেলার ফাঁকে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কোন দুঃখের ঘটনা মনে মনে রি-ওয়াইন্ড করে সিনেমার মত দেখতে থাকে।
অংকের স্যার হতভম্ব। একী, ক্লাস টেনের ছেলের চোখে জল কেন? আরে আমি তো মারি টারি নি, শুধু উঠে আসতে বলেছি।
বন্ধুপ্রীতি ভাল, কিন্তু ভাল কাজের জন্যে। ও যে ক্লাস ফলো করছে না, তুমি ওর পক্ষ নিচ্ছ? এটা কি ভালো?
পোদোর মুখে কথা নেই।
কিন্তু স্যারের নরম গলা শুনে গোটা ক্লাসের সংহতি বোধ জেগে উঠল। ওরা শামলা পরে আর্গুমেন্ট শুরু করল।
-- স্যার! ও খুব ভাল ছেলে স্যার। ওকে ছেড়ে দিন স্যার। ভুল করে করে ফেলেছে স্যার। নাইনে হাফ ইয়ার্লিতে অংকে টপ করেছিল স্যার। সায়েন্সের ছেলেদের থেকেও বেশি পেয়েছিল।
স্যার কড়া চোখে প্রদ্যুম্নকে মেপে নিয়ে বললেন--বেশ, ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু বোর্ডে এই অংকটা কষে দেখাক, কেমন অংকের ছেলে!
পোদোর প্রাণপাখি উড়িয়া গেল, ও মাথা নাড়ল।
কিন্তু গোটা ক্লাস উৎসাহের সঙ্গে--হ্যাঁ স্যার , হ্যাঁ স্যার, ও পারবে স্যার বলে পোদোর গলা হাঁড়িকাঠে ঢুকিয়ে দিল।
না, পোদো ওরফে প্রদ্যুম্ন কৃষ্ণপুত্র হলেও সেদিন কোন দেবতার বরাভয় পায় নি।
ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়লে স্যার উঠে দাঁড়িয়ে ওকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে উঁচু গলায় বললেন--গোটা ক্লাস মিথ্যেবাদী। এ ড্যাম লায়ার! এই ছেলে ভবিষ্যৎ অংকে নয়, চিৎপুরের যাত্রাদলে।


স্যার যাই বলুন আমার তো স্বপ্ন রণজি ট্রফিতে অফস্পিনার হিসেবে খেলার। বেশ ভালই টার্ন করাচ্ছি। ফ্লাইট আর ফ্লিপারটা একটু কন্ট্রোল হলে--, তবে আশ্রমের আঙিনায় টেনিস বলে খেলাটাও ছাড়ি নি। এতে আমার মত ভীতুর ফিল্ডিং শুধরে যেতে পারে। কভার বা গালিতে দাঁড়াতে থাকি।
কিন্তু কোথাকার জল যে কোথায় গড়ায়!
আজ রোববার। ন'টার থেকে ধর্মক্লাস, দশটায় টেনিস বলে কোর্টইয়ার্ড ক্রিকেট।
তবে সেদিনের ঘটনার পর থেকে বড় ও মেজোমহারাজ আমাদের এই সাপ্তাহিক ধর্মক্লাস নেওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ওটা এখন ছোট মহারাজ সুনীলদার দায়িত্ব। সুনীলদা আজকে একটু বেশি জমে গেছেন। শুরু করেছিলেন বেদের হোমাপাখির গল্প দিয়ে , কিন্তু খেই হারিয়ে রবীন্দ্রনাথের বোলপুর প্রবন্ধের 'গাড়ি ছুটিয়া চলিল। সবুজ তরুশ্রেণী" এই সব বলতে লাগলেন। এরমধ্যে ক্লাস এইটের এক কারবাইড-পাকা ছেলে ফিনিক্স আর হোমাপাখির গল্পের কম্পারেটিভ স্টাডিতে মেতে উঠল, সুনীলদা শুনলেন। ভাবলাম ছুটি দেবেন। কোথায় কি?
সবাই উসখুস করছে, কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু আজ সুনীলদা কোন ওপেনিং দিচ্ছেন না।
আমি নিচুগলায় কিছু বলার চেষ্টা করতেই বিপ্লব জোরে চিমটি কেটে বলল-- মুখ বন্ধ রাখ। তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার, ওরে ভীরু!
দূর! সময় চলে যাচ্ছে, আজকের খেলার কী হবে? কী যে হবে তা প্রশান্ত হস্তমুদ্রায় বুঝিয়ে দিল।
এরপর যা ঘটল তাকে স্বতঃস্ফুর্ত বললে কম বলা হয়।
সুনীলদা প্রশ্ন করেছেন--মানুষ কখন চারপেয়ে হয়?
বিপ্লব নীচু গলায়-- যখন চারপাইয়ে শোয়, এটা কোন প্রশ্ন হল?
--- কী? পারলে না তো? যখন বিয়ে করে। বৌয়ের দায়িত্ব নেয়।
-- তাহলে মহারাজ, যখন বিয়ের পর বৌয়ের বাচ্চা হবে তখন কি ছ'পেয়ে হবে? আর দুটো বাচ্চা হলে?
-- তোমার এসব জেনে লাভ?
-- না, কোন লাভ নেই। মিনিমাম কৌতূহল। মানে জানতে চাইছি ঠাকুর এ নিয়ে কিছু বলে গেছেন কি না?

ধর্মক্লাসে বিরতি। না, বিরতি নয়, পূর্ণচ্ছেদ। সুনীলদাও আর নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার উৎসাহ দেখান না। আমাদের ব্যাচটা বেয়াড়া। ইলেভেনের ছেলেরা বোর্ডের চিন্তায় মগন। ধর্মক্লাসে আসতে চায় না।
কিন্তু সেদিন সবাই খুশি। দশ-দশ ওভার খেলা হতেই পারে।
ফটাফট টস করে ফিল্ডাররা দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমার ব্যাটিং সাইড, শেষের দিকে নামি। দশ ওভারে চান্স নেই। তাই আম্পায়ারিং করছি। উইকেট কিপার ও আমি হাফপ্যান্টের উপর গামছা জড়িয়ে নেমেছি।

সবাই পজিশন নিয়ে নিয়েছে, কিন্তু বোলার বল করতে এসে থেমে গেল।
শর্ট লেগ কোথায় গেল? টেনিস বলের ম্যাচে শর্ট লেগ অনেক বেশি ইম্পর্ট্যান্ট, কারণ এখানে ফিল্ড করলে ব্যাকফুটে খেলা ডিফেন্সিভ স্ট্রোকের থেকেও বল তুলে নেওয়া যায়। আর কোন চোট খাওয়ার ভয় নেই। ওখানে তো আমাদের গ্রেট রমেনের দাঁড়াবার কথা। গেল কোথায়? বাথরুমে? কী বিরক্তিকর!
তখন নিখিলেশ বলে উঠল--ওই তো রমেন! ডাক শালাকে!
ডাইনিং হলের বারান্দায় বড় থামের পাশে রমেন প্রায় কোণঠাসা করে কড়া চোখে নিচুগলায় কিছু বলছে সোমেশ দত্তকে। আমাদের ব্যাচে সোমেশকে নিয়ে একটু হাসাহাসি হয়। বড় ঘরের ছেলে।নিষ্পাপ স্বপ্নালু চোখ, আদরে বড় হয়েছে। ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছিল।
ওর নরম সরম ভাব দেখে আশ্রমের ছেলেরা ওর নাম দেয় মাদী দত্ত। কয়েক বছর পরে ওই নামটা ওর সঙ্গে সেঁটে যায়।
সেবার ক্লাস সিক্সে নতুন ভর্তি হওয়া একটা ফচকে ছেলে ওকে খ্যাপাবার জন্যে তাসাপার্টির বাদ্যের অনুকরণে মুখে বোল তৈরি করেঃ
মাইদ্যা মাদী কুড় কুড় কুড়!
মাইদ্যা মাদী কুড় কুড় কুড়!
কুড়ুকুড় -- ঝুংকুরুকুর,
মাইদ্যা মাদী কুড় কুড় কুড়!

বিব্রত সোমেশকে ঘিরে তিনটে বাচ্চা নেচে বেড়ায় আর মুখে ওই বোল তোলে। সেটা সুনীল মহারাজের চোখে পড়ে যায় । উনি এসে সোমেশকে একতরফা হেনস্থার থেকে রক্ষা করেন।
বাকি তিনটেকে ভালকরে থাপড়ে সিধে করেন আর মারতে মারতে বলতে থাকেন-- অসভ্য কথা বলছ, অসভ্য কথা বলছ? মাইদ্যা মাদী কুড় কুড় কুড়! অসভ্য কথা বলছ?
তারপর থেকে সবার সামনে কুড় কুড় বোল তোলা বন্ধ হয়ে গেছল। কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা কখনও কখনও ওকে মাদী বলে সম্বোধন করে মজা পেত।
এহেন সোমেশ বিব্রত মুখে থামে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আর রমেন ওর দিকে ঝুঁকে একটা হাত ওই থামে কায়দা করে ঠেকিয়ে কী যে বিড় বিড় করছে বোঝা যাচ্ছে না। যেটুকু বুঝতে পারছি যে ওদের মধ্যে একটা কথা কাটাকাটি চলছে। আমি একবার চেঁচালাম-- আব্বে রমেন! ওসব প্রেমলাপ শেষ কর। ঝুড়ি চাপা দে। শর্ট লেগে আয়, নইলে--।
ও ক্রুদ্ধ বাইসনের মত মাথা তুলে আমাকে দেখে হাত তুলে ইশারা করে--আসছি!
ধেত্তেরি! আর ভাল লাগে না। ঘরে গিয়ে একটা সিগ্রেট খেলে কেমন হয়! কিন্তু আম্পায়ার যে সরতে পারে না।
একটা আর্ত চীৎকার! সবাই একসঙ্গে সেদিকে তাকিয়ে দৌড়্লাম।
বাইসনের শিং দিয়ে গুঁতিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে ঘাড় গুঁজে মাথা নীচু করে রমেন সমানে ঘুষি মারছে সোমেশ দত্তের মুখে। সোমেশ প্রানপণে ঠেকাতে চেষ্টা করছে, দুহাত তুলে মুখ আড়াল করছে, কিন্তু এর্মধ্যেই ওর ঠোঁট ফেটে কষ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে!
কী কান্ড!
-- কী রে রমেন ? দত্তকে অমন করে মারছিলি কেন?
রমেন রাগী মোষের মত ফোঁস ফোঁস করে, উত্তর দেয় না।
--সোমেশ , তুই বল।
-- আমি কি বলব? ও খালি বলছে-- তুই আমাকে ভালবাসিস কি না বল? আমি ওর কথা বুঝতেই পারছি না। বল্লাম , তোরা সবাই আমার বন্ধু। আমি সবাইকেই ভালবাসি।এতে জিগ্যেস করার কি আছে?
কিন্তু ---কিন্তু ও জিদ করছে যে আমি ওকে ছাড়া কাউকে ভালবাসতে পারব না। আমি নাকি শুধু রমেনের!
যেই বলেছি যে এরকম কিছু হয় না, আমি কাউকে আলাদা করে স্পেশাল ভালবাসতে পারব না, অমনি ও আমাকে মারতে লাগল আর বিড়বিড় করছিল -- আমাকে ভালবাসতেই হবে, তুই শুধু আমার! অন্য কাউকে ভালবাসলে মেরে ফেলব। এ কী পাগলামি বলত! এখন আমি কী করি, তোরাই বলে দে।
ও ফোঁপায়। আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। রমেন নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। আর আমাদের ক্রিকেট খেলার সেদিন তিল-আলোচাল -কলা দিয়ে মেখে পিন্ডদান হয়।