Next
Previous
2

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in




















বই - চরের মানুষ
লেখক - তৃষ্ণা বসাক
প্রকাশক - ধানসিড়ি
মুল্য - ২৫০/-

বাঙালির জীবনে যে কয়েকটি জাতীয় বিপর্যয় ঘটেছে, তার মধ্যে প্রধান দুটি। প্রথম হল ১৯৪৭ সালের দেশভাগ। ধর্মের ভিত্তিতে সজীব শরীরকে কাটাছেঁড়া করলে যে পরিমাণ যন্ত্রণা, রক্তপাত ও মৃত্যু ঘটতে পারে তাই হয়েছে তখন। দ্বিতীয়টি ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ হয়ে ওঠা। সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বভাবগুণ কিন্তু বাংলাদেশকে প্রতীক্ষিত শান্তি দিতে পারেনি। অজস্র পারস্পরিক স্বার্থ সংঘাত, ধর্মের নামে হানাহানি, বর্ণবিদ্বেষ, এইসব কাটাকুটির দাগ নিয়ে এই নবীন দেশ বাঁচতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু দেশের মানুষই তো শেষ পর্যন্ত দেশ।

আমরা দেশভাগের ওপরে নানা প্রামাণ্য দলিল পাই। ইতিহাস, ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস, সিনেমা ইত্যাদি নানা মাধ্যম আমাদের চোখের সামনে এনে দেয় সেই সময় যখন ওপার থেকে হাজারে হাজারে মানুষ সব খুইয়ে শুধু ধর্মের বিভিন্নতার অপরাধে এপারে এসেছেন। সব কৌলীন্য সব সম্পদ ফেলে রিফিউজি কলোনিতে আশ্রয় নিয়েছেন। রেশনের চালে ভরসা করে খড়কুটো ধরে বাঁচতে চেয়েছেন। প্রথম প্রজন্মের এই শিকড়ছেঁড়া মানুষজন কিন্তু আজকের পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতের একটি বড় অংশ। তাঁরা লড়াই করে মাথা তুলেছেন।

কিন্তু পরবর্তী সময়, মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে যারা চলে এলেন, পালিয়ে এলেন, পালাতে গিয়ে মারা পড়লেন, তাঁদের যুদ্ধ জটিল। তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবেই সেখানে থাকবেন, এমনটাই আশা ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, তাঁরা বাঙালি হলেও হিন্দু হবার অপরাধে টিকতে পারছেন না। রাজাকার নামক এক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক ও মৌলবাদী ধর্মযাজকদের সঙ্গে মিলে সেখানে নিদারুণ অবস্থার সৃষ্টি করে। এসবই আমাদের জানা ইতিহাস। গ্রাম কে গ্রাম লুঠতরাজ, নারী নির্যাতন, শিশুহত্যা, এক নারকীয় বাতাবরণ তৈরি করে।

এত ইতিহাসের মধ্যে একটি কাহিনী লেখা হল না। যেসব হিন্দু পরিবার ওপার বাংলা ছেড়ে এপারে এলেন না, কোনোভাবে আশ্রয় পেয়ে গেলেন, বা ‘কেন আমি দেশ ছাড়ব?’ এই ভেবে রয়ে গেলেন, তাঁদের জীবনযাত্রা কেমন হল? তৃষ্ণা বসাকের উপন্যাস চরের মানুষ এই অন্য যাপনের কথা বলে। এই আপাতদৃশ্য কাহিনীর স্রোতের মধ্যে অন্তঃসলিলা আর একটি ধারা তাঁর লেখায় বর্তমান। সেটি হল, মেয়েদের অবস্থান। এই যে সমাজে ও রাষ্ট্রে নিরন্তর বদল, সংগ্রাম, এর মধ্যে তাঁদের স্থানটি কোথায়? তাঁরা এই যুদ্ধে যুধিষ্ঠির বা শকুনি, কার হাতের পাশা? চালে জিতলে তাঁদের অবস্থা কী হল? হারলেই বা কি হল?

উপন্যাসের মূল চরিত্র টুনু। তার বাবা ডাক্তার। ডাক্তার বলে সমাজে তিনি সম্মান পান। পরোপকারী সদাশয় মানুষ। তাঁর নিজের ছেলেটি মুসলমানের হাতে খুন হয়, সেকথা জেনেও তিনি কখনও কাউকে দোষারোপ করেননি। এ কি তাঁর মহত্ত্ব? নাকি নিরাপত্তাহীনতা? মুসলমানের দেশে ভিটে আঁকড়ে থাকতে গেলে এ মেনে নিতে হবে। ফলে, দেশের অন্যান্য সংকটের সময় তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যেরা কেউই অংশ নিলেন না। মূলস্রোতে মিশলেন না। দেশের মধ্যে থেকেও যেন তাঁরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে গেলেন। নদীর ধারার মাঝে বিচ্ছিন্ন চর। তাঁরা সেই চরের মানুষ।

টুনুর মায়ের অনেকগুলি সন্তান। মেয়ের সংখ্যাই বেশি। এই টুনুর শৈশব, বাবার স্বচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও, কেমন বদলে গেল। সে তিনবেলা এখনও ভাত খায়, মাছ খায়, কিন্তু দাদার মৃত্যুর পর জীবনকে দেখার স্ফূর্তি রইল না। মনে পড়ে ঠাকুমা প্রভাসুন্দরীর কথা, “সংসারে ভাতের কষ্ট ছাড়া আরও কত কষ্ট আছে, বড় হলে বোঝবা”। যদিও দাদা স্বরাজের বন্ধুরা স্মরণসভা ডেকেছে ও তার বন্ধু ইদ্রিস, শামিম স্বরাজকে হারিয়ে কষ্ট পেয়েছে তবুও কোথাও একটা বিভেদরেখা টের পাওয়া যায়। উপন্যাসের প্রথম পর্বে এর পাশাপাশি টুনুর বন্ধু পপির মা, নুসরত খালার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। মেয়েসন্তানের জননী হবার দোষে তাঁর স্বামী ইন্ডিয়া থেকে আসা একটি মেয়েকে বিয়ে করে। নুসরতখালা রাতারাতি মেয়েদের নিয়ে চলে যান। কেউ টের পায় না কোন চরে তাঁর ডিঙি ভিড়েছিল। নিরুদ্দেশে গেলে কি আর দেশ থাকে? মেয়েদের দেশ নেই, নিরুদ্দেশ আছে।

দ্বিতীয় পর্বে টুনুর বিয়ে, শ্বশুরঘরের পাশাপাশি, ময়মনসিংহ টাউনে বড় হওয়া টুনুর লৌহজঙ্গ নদীর কিনারে ধুপতারা এসে গ্রাম্য নীচতা দেখে স্তব্ধ হবার পালা। তার ডাক্তার স্বামী অমর, যে কিনা নিজের মৃত ছোট ভাইটিকে এক মুহূর্ত ভুলতে পারে না, সে পর্যন্ত নিজের চারিত্রিক স্খলনকে পুরুষের ফুর্তির স্বাধীনতা মনে করে। এ দেশের মুক্তির সংগ্রামে তার যে কোনো ভূমিকা থাকতে পারে সেকথা সে স্বীকার করে না। অথচ সে চাকরি পায় এমনই এক হিন্দু ভূমিপুত্রের হাসপাতালে। যিনি সেবাকে পরম ধর্ম মনে করেছিলেন, ও শেষ পর্যন্ত, পাকিস্তানের সেনারা যাকে হত্যা করে। অমরের চরিত্রের বৈপরীত্য একান্ত স্বাভাবিক। সে তাই ইন্ডিয়া চলে আসতে চায়। সরল টুনু ধীরে ধীরে শিখতে থাকে। মেয়েমানুষের জীবন এমনই হয়।

কখনও কখনও দেশ আঁকড়ে পড়ে থাকা মানুষের মনে ইন্ডিয়া পাকিস্তান জোড়া লাগার স্বপ্ন ভাসে। নাগরিক অধিকার স্পষ্ট হয় যে! নইলে যে নিজভূমে পরবাসী!

এই উপন্যাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় চট্টগ্রাম। জেসমিন ইমাম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা সেলাই করছেন। বেগম সুফিয়া কামাল, মালেকা বেগম ও বিশিষ্ট মহিলারা চট্টগ্রামে মিছিল করেছেন। সেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রান্তর। বিদ্রোহ যে মাটির স্বভাব। ডক্টর দেব, প্রফেসর সাগিরুদ্দিন, জেসমিন ইমাম, এঁরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক! সে এক বিভীষিকাময় রাতে আক্রান্ত হল বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বর। খুন হলেন ডক্টর দেব। বহু বহু মেয়ে ধর্ষিত ও খুন হল। তবু সেই রাতের কথা আমার বুকের মধ্যে নিরাময়হীন ক্ষত তৈরি করল। অথচ এর মধ্যেও জেগে রইলেন জয়ন্তী, টুনুর মেজোবউদি। জ্যাঠতুতো দাদার খৃষ্টান বউ। আদিবাসী খৃষ্টান। কিন্তু শিক্ষায় সভ্যতায় সে শহুরে মেয়েদের থেকে অনেক এগিয়ে।

অসংখ্য নারীচরিত্র, কেউ সিনেমার নামকরা নায়িকা হয়ে পাকাপাকি লাহোরে প্রতিষ্ঠিত, কেউ বা খানসেনাদের হাতে ধর্ষিত ও খুন হবার আগে হাসপাতালে যুক্ত ছিলেন। কেউ গ্রামের তাঁতিবাড়ি থেকে কাপড় নিয়ে শহরে সওদা করেন। কেউ পরিবারের দারিদ্র কি করে ঘোচে সেই ভেবেই দিনপাত করেন। অদ্ভুত নকশিকাঁথার মতো ভেসে ওঠে এক অলৌকিক চর। মেয়েরাই যার বাসিন্দা।

সবশেষে বলব বসাক তাঁতিদের কথা। এত গবেষণা করে লেখা যখন তখন অবশ্যই লেখিকা জেনেছেন, এখনও ঢাকিয়া বসাক বা ঢাকাই বসাকদের প্রতিপত্তি অব্যাহত। তারা ধনী। তাদের বিগ্রহ এখনও পূজা পায়। এই যে তথ্য উপন্যাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে তা পরবর্তীতে ইতিহাসের উপাদান হবে।

তৃষ্ণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। বাংলাদেশের এক একটি জেলার ডায়ালেক্ট, খাদ্যের বৈচিত্র্য, জীবিকার নানা ধরণ, উৎসবের কথা তিনি নিপুণভাবে উপন্যাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করেছেন। অথচ ভূমিকায় জানা যাচ্ছে, তিনি ঢাকিয়া বসাক তো ননই, তিনি শেকড়সুদ্ধু এপার বাংলার। তবু যে কত মমতায় ত্তিনি এ কাজ করেছেন ভাব্লে মুগ্ধ হই। তাঁর এ কাজটি থেকে যাবে। তবে প্রত্যাশাও থাকল, পরের পর্ব হয়ত আসবে। বাঙালি হয়ে বাঙালির এই ইতিহাসের ওপরে আরও লেখা পড়ার ইচ্ছেটা রয়ে গেল।