Next
Previous
0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in



টোটো-কোম্পানি
আমার ভারতবর্ষ- ৮
দক্ষিণকাশীর দানসাগর


কী রকম লাগে? যখন হঠাৎ আপনি নিজেকে আবিষ্কার করছেন পুরাণযুগের একটা নিখুঁত আবহে? দেড় হাজার বছর পিছিয়ে গেছেন অদৃশ্য টাইমমেশিনে? দুর্ভেদ্য প্রাচীরঘেরা একটা দেবতার গ্রাম। ছায়াঘেরা আবহে স্বপ্নের মতো চারদিকে শুধু মন্দির আর মন্দির। শিবপুরাণের পরম্পরা মেনে তৈরি হয়েছে তারা। বয়সহীন বৃক্ষরাজির সজল শুশ্রূষা। পাথর দিয়ে গড়ে তোলা একটা মন্দিরময় প্যানোরামা। নিজেকে মনে হবে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের পাতা থেকে বেরিয়ে আসা একটা চরিত্র। এতো প্রামাণ্য তার পরিবেশ। ভাবতেই পারছিনা, আমি একুশ শতকের একজন পোকামাকড় টাইপ, শহুরে মানুষ। কিন্তু হয়। সেই রোমাঞ্চ হয়, সেই অনুভূতি, জেগে থাকা স্মৃতিময় মেদুরতা।
পঞ্জিকায় তখন ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দ। সদ্য উজ্জৈনের রাজপাট থেকে স্কন্দগুপ্তের পতন হয়েছে। মধ্য এশিয়া থেকে আসা শ্বেতাঙ্গ অশ্বারোহী হুন জাতির যোদ্ধারা দখল করে নিয়েছে উত্তরাপথ। এদেশে এসেই তারা গ্রহণ করেছে আর্যধর্ম। তারা আর ম্লেচ্ছ নেই। তাদের রাজ্য থেকে বহুদূরে দাক্ষিণাত্যে জেগে উঠছে আদি চালুক্যদের রাজপাট। তাদের রাজধানী আজকের বাদামি, জেলা বাগলকোট, উত্তর কর্ণাটক। তাদের রাজা ইতিহাস বইয়ে পড়া বিখ্যাত সম্রাট পুলকেশিন। রানি দুর্লভা তাঁর সম্রাজ্ঞী। দেবতা মহাকূটেশ্বরের মন্দির নির্মাণের জন্য সম্রাজ্ঞী দান করলেন দশটি গ্রাম। তাঁর পুত্র মঙ্গলেশ শুরু করলেন মহাকূটেশ্বর আর অন্য মন্দির স্থাপনের কাজ। ধারাটি চলেছে প্রায় একশো বছর। সপ্তম শতকের শেষে রাজা বিজয়াদিত্যের উপপত্নী বীণাপোটী মহাকূটেশ্বরকে দান করলেন অনেক রত্নসামগ্রী। শিলাপটে এটুকুই পাওয়া যায়। এটি ছিলো পুরাণযুগের শীর্ষকাল। সারাদেশে নানা বিদ্বান শিবপুরাণ রচনা করছেন। মন্দির ভাস্কর্যে তাকে গড়ে তুলছেন স্থপতি আর শিল্পীরা।মহাকূটেশ্বর শিবতীর্থটি শেষ পর্যন্ত প্রসিদ্ধ হলো দক্ষিণকাশী নামে।

সবই মন্দিরই বিভিন্নরূপে শিবকে নিবেদিত। মহাকূটেশ্বর, সঙ্গমেশ্বর, মল্লিকার্জুনেশ্বর, বিরূপাক্ষেশ্বর আরও অনেক। একটি বিষ্ণুমন্দির।মন্দির জলাশয়টির নাম পাপনাশন। সঙ্গে নান্দী, অর্ধনারীশ্বর, বরাহ, দ্বারপাল, বেতাল, বীরভদ্র, কালিকা, হরগৌরী ইত্যাদি শৈবতন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোত অসংখ্য মূর্তিস্থাপত্য। পাথরের শরীরে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। দক্ষিণের দ্রাবিড় আর উত্তরের নাগর শৈলী, সব মন্দির হয়ে মিলেমিশে পাশাপাশি। নাহ, বিশাল, বিপুল কোনও আয়োজন নেই মহাকূটেশ্বরের। কিন্তু কী দরকার তার? রোমাঞ্চিত বিস্ময় কি শুধু প্রাচুর্যের মধ্যে থাকে? একেবারে নয়। ইতিহাস আর বর্তমানের সীমারেখা কখন ধুয়েমুছে যায়, ঠাহরই হয় না।

আমার ভারতবর্ষ...