Next
Previous
0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in

 


অচেনা চুনার

একটা কথা বলা হয়, এই দুর্গটির প্রতিটি ইঁটে ইতিহাস গাঁথা আছে সেই আদিকাল থেকে। মানে সেই খ্রিস্টপূর্ব ছাপান্ন সাল।

নদীর ধারে খাড়া পাহাড় চিরকালই রাজাদের কেল্লা বানাতে আকর্ষণ করে। গঙ্গার পারে নিচু পর্বতশ্রেণী কাইমুর থেকে চুনার। নদী স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেছে বারাণসীর দক্ষিণ-পশ্চিমে এই প্রান্তটিতে। পুরাণে বলে রাজা বলীকে বর দিতে দেবতা বিষ্ণু নাকি বামন অবতারের রূপে এসে এই পাহাড়টিতে পা রেখেছিলেন। সেইসূত্রে এর নাম হয় চরণাদ্রি। পরে তা চুনার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার কিংবদন্তির বিখ্যাত রাজা উজ্জয়িনীর বিক্রমাদিত্যও নাকি তাঁর সংসারত্যাগী ভাই ভর্তৃহরির জন্য এই পাহাড়ের চূড়ায় একটি দেবালয়ও বানিয়ে দিয়েছিলেন। এই পাহাড়টি নাকি পৃথ্বীরাজ চৌহানের রাজত্বের শেষ সীমা ছিলো। তাঁর মৃত্যুর পর এটি সুবুক্তগিনের খাস তালুক হয়ে যায়। বিখ্যাত হিন্দি কাহিনী ‘চন্দ্রকান্তা’য় চুনার দুর্গের নাম দেওয়া হয়েছিলো ‘তিলস্মিকিলা’।
অর্থাৎ জাদু দুর্গ। এই দুর্গ নিয়ে নানা অতিপ্রাকৃত কল্পকাহিনী বাতাসে ভেসে বেড়ায়। গল্প কথা যাই বলুক, এই পাহাড়ে অতি প্রাচীনকাল থেকে মানুষের বসবাস রয়েছে, এটা প্রমাণিত।

জিলার নাম মির্জাপুর।গঙ্গার দক্ষিণে, মুঘল সরাই থেকে পৌনে এক ঘন্টার পথ। চিনেমাটির কাজ আর নদীর ওপারে ভদোহিরকালিন শিল্প। পশ্চিমে কিছুদূরেই মির্জাপুর আর বিন্ধ্যাচলের মন্দির। গঙ্গার দক্ষিণ দিয়ে ইলাহাবাদ লাইনের সব রেলগাড়ি এখান দিয়েই যায়। ইতিহাসের আদিকাল থেকে আর্যাবর্তের যা কিছু পাথরের নির্মাণ, প্রায় সবকিছুই বিখ্যাত চুনার পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছিলো। সারনাথের স্থাপত্য, ভাস্কর্য থেকে দিদারগঞ্জের যক্ষী, ইলাহাবাদের কিলা থেকে বারাণসীর গঙ্গারঘাট, মন্দির, প্রাসাদ, সবই। দূর অতীতে মৌর্য, শুঙ্গ থেকে গুপ্তযুগেও কৈমুর পাহাড় থেকে পাথর কেটে নির্মাণের কাজ করা হতো।

নথিবদ্ধ ইতিহাস বলে ১৫২৯ সালে জহিরুদ্দিন শাহ বাবরের সৈন্যবাহিনী এই পাহাড়টিও তার উপরের দুর্গটি অধিকার করে ফেলে। কিন্তু ১৫৩২ সালে শেরখান বা পরবর্তীকালের শেরশাহ সুরিমুঘলদের হাত থেকেএই দুর্গটি ছিনিয়ে নেয়। এই পাহাড়টির নীচের দিকে সেই সময়ের কিছু মুঘল সৈন্যের সমাধিও দেখতে পাওয়া যায়। আফঘানি পঠান শেরখান শুধু বিরাট যোদ্ধাই ছিলেন তাই নয়, রাজনৈতিক কৌশলেও বিশেষ দক্ষ শাসক ছিলেন। তিনি যুদ্ধে মৃত চুনারের কিলাদার তাজ খান সারঙ্গখানির দুই বিধবা পত্নীকে বিবাহ করে দুর্গটিও বিশাল নজারতের মালিকও হয়ে গেলেন। সাসারামের একজন অখ্যাত আফঘান কিলাদার শেরশাহ সুরি এই বিবাহের সূত্রে চুনার দুর্গের তোষাখানায় রাখা দু’শো আশি কিলো রত্ন সামগ্রী আর প্রায় দু’হাজার কিলো সোনার মালিকানা লাভ করেছিলেন। তিনি এমনিতেই ছিলেন বীর ও উচ্চাশী। এই ধনলাভের ফলে তিনি দিল্লির মসনদে নবাগত মুঘলদের উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন।পরে হুমায়ুঁর চাপে অস্থায়ীভাবে দুর্গটি ছাড়লেও প্রথম সুযোগেই শেরশাহ এই দুর্গটি আবার অধিকার করে নে’ন এবং আমৃত্যু দখল করে রাখেন ১৫৭৫ সাল পর্যন্ত। 
মির্জাজলালুদ্দিন অকবর তারপরে এটির দখল নে’ন এবং আহমেদ শাহ দুর্রানির আক্রমণ পর্যন্ত চুনার দুর্গ মুঘলদেরই ছিলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেজর মুনরো ১৭৬৮ সালে চুনার দুর্গের মালিক হ’ন। কিছুদিনের জন্য বারাণসীর রাজা চেত সিংও দখল নিয়েছিলেন। তবে ১৭৯১ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস স্থায়ীভাবে দুর্গটি অধিকার করেন। অওধ এলাকায় চুনার দুর্গই ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান সেনাবাস ও অস্ত্রাগার হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। এখানে যুদ্ধে আহত ও অক্ষম সৈন্যদের আশ্রয় দেওয়া হতো। পঞ্জাবের মহারাজা
রণজিৎ সিংহের বিধবা রাণী জিন্দন কাউরকে এখানে বন্দী রাখা হয়েছিলো। ১৮৪৯ সালে মহারানি জিন্দন কাউর চুনার কিলা থেকে পরিচারিকার ছদ্মবেশে অরণ্যসংকুল পথে প্রায় আটশো’ মাইল দূর নেপাল রাজ্যে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সে আবার আর এক রোমহর্ষক অভিযানের গল্প। সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে বহু যোদ্ধাদের এখানে বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছে। এমন কি আধুনিককালে কাইমুর অরণ্যের সন্ত্রাসবাদীরাও এই দুর্গের বিশাল অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করার চেষ্টা করেছিলো।

এর ভৌগলিক অবস্থিতি এককথায় দুর্ভেদ্য। বহুদূর থেকে গঙ্গা বেয়ে আসা নৌবহরকে এখান থেকে নজর রাখা যেতো। বিহার ও বাংলামুখী সব বাণিজ্য তরীকে চুনারে খাজনা দিয়ে যেতে হতো। ফলে এই কিলার মালিকের অর্থ সম্পত্তি ছিলো প্রবাদ প্রতিম। রেলগাড়ি আসার পর নদীপথের প্রয়োজন কমে যায়। ফলে চুনারের অর্থনৈতিক গুরুত্ব শেষ হয়ে গিয়েছিলো। পাহাড়ের খাড়া দিকটি থেকে দেখলে শিবাজীর সিংহগড় ও রায়গড়ের কিলা মনে পড়ে যাবে। মূল দুর্গটি উত্তরপূর্বে, যেখানে বহু কামান ও বারুদখানার অবশেষ দেখা যায়। মাঝখানে সোনওয়া মণ্ডপ একটি হিন্দু পূজাস্থল। চতুর্দশ শতকে নেপালের রাজকন্যা সোনওয়া নাকি এই মণ্ডপটির নীচে সুড়ঙ্গটি দিয়ে গঙ্গা স্নান করতে যেতেন। বৃটিশরা এখানে গভর্নরস হাউস, বেশ কিছু বাংলো বাড়ি, গারদখানা ও প্রশাসনিক দফতর তৈরি করেছিলো।

এই দুর্গের কোনও একটা জায়গায় চুনারের রাজা নাকি বিপুল ধনরত্ন লুকিয়ে রেখেছিলেন। এখনও তাঁর পরেশান আত্মা ভূত হয়ে সেসব আগলে রাখে। আমরা পাতি লোক। অত ধনরত্ন দিয়ে আর কী করবো? জানতে পারলে পুলিশ ধরবে। তার থেকে ভালো দুর্গের র‌্যামপার্টে বসে ডাইনে-বাঁয়ে শুধু গঙ্গাকে দেখে যাওয়া। আহা, চুনার কিলা থেকে নীচে গঙ্গার দৃশ্য অতি বড়ো বেরসিকেরও প্রাণের আরাম হয়ে উঠতে পারে।

আগ্রহীরা পরেরবার বারাণসী গেলে চুনারকে লিস্টিতে যোগ করে নেবেন।