Next
Previous
2

ধারাবাহিক : সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


বানরায়ণ
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



ফাঁদটা আগের দিন পাতা হয়েছিলো। একটা ছোট ঝোপের উপর একটা ছাগলের দেহ। নিচের মাটি ঝুরঝুরে নরম। বিশালকায় পশুটা যেই সেই মাটির উপর পা রাখবে, অমনি তার চাপে মাটি সরে গিয়ে ছাগল সমেত সে পড়বে নীচের খুঁড়ে রাখা গর্তে, এবং পরদিন আমরা আসা অবধি আটকে থাকবে সেখানেই। 

বিশালাকৃতি হিংস্র পুরুষ বাঘটা আমাদের গ্রামের ছ’জন কে মেরেছিলো। একটা বনবরার সঙ্গে লড়াইতে যখম হওয়ার পর থেকেই নরখাদক হয়ে উঠেছিলো জন্তুটা। পিছনের পায়ের গভীর ক্ষতটা তাকে আকৃষ্ট করে তুলেছিলো মানুষের মতন সহজ শিকারের প্রতি। আর সেই সঙ্গে তার ভাগ্য তাকে আকর্ষণ করছিলো নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। সব নরখাদকের নিয়তিই মানুষের হাতে নিষ্ঠুর মৃত্যু।

আমরা এমনিতে অরণ্যের কোনও শিকারি পশুকে কখনও মারতাম না। শিকারিদের মারা আমাদের সমাজে অপরাধ ছিলো। শুধুমাত্র নিজেদের জীবন বিপন্ন হলে আমরা অরণ্যের শিকারিদের, অর্থাৎ বাঘ, ভালুক, নেকড়ে, সাপদের মারতে বাধ্য হতাম। আমরা, অর্থাৎ বিন্ধ্যপর্বতের অরণ্যবাসী জাতিরা। আমাদের গ্রামটা ছিলো একেবারে প্রান্তিক। গ্রামের চৌহদ্দির পর শুধু গভীর, ছায়াঘণ জঙ্গল, যেখানে দিনের বেলাও সূর্যালোকের প্রবেশ নিষেধ। সে জঙ্গলের ওপারে কি আছে, আমরা জানতাম না। জানার প্রয়োজনও বোধ করিনি কখনও। আমরা আমাদের সহজ সরল গ্রামীণ জীবন নিয়ে ব্যস্ত, নিশ্চিন্ত আর সুখী ছিলাম।

আমাদের গ্রামটার নাম ছিলো তাম্বলি। বট-পাকুড়-অশ্বত্থের ছায়ায় ঘেরা ছোট্ট একটুখানি গ্রাম। সাকুল্যে পঞ্চাশ ঘর মানুষের বাস। তাদের মধ্যে আমাদের পরিবার ছিলো ক্ষমতায় ও প্রতিপত্তিতে দ্বিতীয়। সর্দারের পরিবারের পরেই। আমার পূর্বপুরুষরা ছিলেন আমাদের গ্রামের ওঝা-বৈদ্য। আমি ঠাকুর্দাকে দেখতাম গাঁয়ের মাঝে আঙিনায় জ্বালানো আগুনের সামনে পশু-পাখির রক্ত, হাড় আর নিজের ছোট মাদলটা নিয়ে ভূত, দানো আর অসুখ তাড়ানোর তুক করতে। ঠাকুর্দা সারা গায়ে রক্ত মেখে মাথায় পাখির হাড়ের মুকুট পরে মাদল বাজিয়ে আগুনের চার পাশে নাচতো। মাঝে মাঝে কোঁচড় থেকে গুঁড়ো মতন কি যেন বার করে ছুঁড়ে দিতো আগুনের মধ্যে। তাতে ধোঁয়া হতো প্রচূর। পুরো আবহাওয়াটা হয়ে উঠতো গা ছমছমে, ভূতুড়ে।

এই সব করার উদ্দেশ্য ছিলো দানো তাড়ানো। দানোয় ভর করলেই মানুষ অসুস্থ হয় – এই রকমই ধারনা ছিলো আমাদের লোকজনের। নাচ থামার পর ঠাকুর্দা এই সব দানোয় পাওয়া লোকেদের ওষুধ দিতো। এক এক রকম দানোর জন্য একেক রকম ওষুধ – তা-ই বলতো ঠাকুর্দা লোকজনকে। শুধু আমরা জানতাম, দানো-টানো সব ভুয়ো। প্রকৃতির নিয়মেই মানুষ অসুস্থ হয়। ঠিক ঠিক ওষুধ পড়লে সেরেও যায়। ওসব দানো-তাড়ানোর ভড়ং ছিলো শুধু গুণীন ও তার অলৌকিক ক্ষমতা সম্বন্ধে মানুষের মনে ভয় সৃষ্টি করার তোড়জোড়। আমদের পরিবারের কিছু সদস্য আর গাঁয়ের সর্দার ছাড়া আর কেউ এই গুপ্তকথাটা জানতো না। ওই বয়সে আমারও জানার কথা ছিলো না। কিন্তু ঠাকুর্দার মনে হয়েছিলো আমার থেকে কথাগুলো লুকিয়ে রাখা নিরাপদ নয়। যদি কোনওভাবে আমি নিজেই একদিন সত্যিটা আবিষ্কার করে ফেলি, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই আমাকে আগুনের সামনে মন্ত্রগুপ্তির প্রতিজ্ঞা করিয়ে কথাগুলো বলা হয়েছিলো। সেটার যদিও খুব দরকার ছিলো না। পারিবারিক ব্যবসার গোপন কথা গোপন রাখার তাৎপর্য আমি ততদিনে দিব্যি বুঝে গেছি।

ব্যবসার খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও আমি ততদিনে শিখে নিয়েছি। আমার তখন চোদ্দ বছর বয়স। আমাদের গ্রামের ছেলেরা আরও অনেক আগে থেকেই বড়দের কাজে সাহায্য করতে শিখতো। আমাদের বয়সে কাজে লেগে পড়তে হতো পুরোদস্তুর। আমি ঠাকুর্দার ওষুধ বানানোর কাজে সাহায্য করতাম। ‘‘ঋচিক!’’ ঠাকুর্দা হাঁক দিতো, ‘‘পিপলপাতা এনে দে একগোছা।’’ ওমনি আমি ছুটতাম দক্ষিণের জঙ্গলের বটগাছের পানে। জানতাম, এখন ঠাকুর্দা তৈরি করবে মশার কামড় থেকে যে জ্বর হয়, তার ওষুধ। জ্বরটা গাঁয়ে ঘরে ঘরে হতো। আমি পাশে বসে বসে দেখতাম, ঠাকুর্দা পাতাগুলো পিষে তার সঙ্গে গন্ধক আর আরও কিছু শিকড়-বাকড়ের গুঁড়ো মিশিয়ে একটা বড় কড়াইতে সেদ্ধ করতো। জিনিসটা এক সময়ে একটা ঘণ সবুজ থকথকে তরলে পরিণত হতো। রীতিমতন কড়া, ঝাঁঝালো গন্ধ আর বিটকেল তেতো স্বাদ। কিন্তু মশার কামড় থেকে হওয়া জ্বরের একেবারে অব্যর্থ ওষুধ।

ঠাকুর্দা আরও অনেক ওষুধে পিপলপাতা ব্যবহার করতো। অস্ত্র বা হিংস্র জানোয়ারের দাঁত-নখের আঘাতে হওয়া, বিষিয়ে যাওয়া ক্ষত সারানোর জন্য ঠাকুর্দা যে মলমটা ব্যবহার করতো, যেটার জন্য আশপাশের গ্রাম থেকেও লোক আসতো ঠাকুর্দার কাছে, সেটাতেও পিপলপাতা মেশানো হতো। তার সঙ্গে সঙ্গে যে সব শিকড়, বাকল, পাতা, ফুল, ফল, পশু-পাখির হাড় আর দু’এক রকমের দুষ্প্রাপ্য পাথরের গুঁড়োও মেশাতো ঠাকুর্দা, সে সব সংগ্রহ করার জন্য আমাদের কাকা-জ্যাঠারা প্রায়ই যেতো গভীর জঙ্গলে। মেশানোর অনুপাতগুলোও আস্তে আস্তে শিখে নিচ্ছিলাম আমি।

সেই সঙ্গে আর যেটা শিখছিলাম, সেটা হলো গাছ আর পাহাড় বাওয়া। পাহাড়-চড়া আমাদের জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিলো। প্রায়ই আমাদের উপর দিকে উঠতে হতো শিকারের খোঁজে। ব্যাপারটা আমার সহজাত ছিলো। সবাইকে পিছনে ফেলে তরতর করে উঠে যেতাম শাল গাছের টঙে, বা পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে সোজা চূড়োয়, যেখানে জন্মায় চক্রপর্ণীর ঝোপ। ঘণ সবুজ ছোট ছোট পাতার উপর হালকা সোনলি রঙের গোল গোল চাকতির মতন। চক্রপর্ণীর রস ছাড়া ক্ষতের ওষুধ তৈরি হতো না। কিন্তু সে ঝোপ ছিলো দুষ্প্রাপ্য। পাহাড়ের মাথায় ছাড়া আর কোথাও জন্মাতো না। আর সেই পাতা সংগ্রহ করার জন্য আমার উপর অনেকখানি নির্ভর করতো ঠাকুর্দা। কারণ, আমার মতন অত তাড়াতাড়ি পাহাড়ের উপর থেকে চক্রপর্ণী নিয়ে আসতে আর কেউ পারতো না।

বাঘটার জন্য ফাঁদ ওইরকমই একটা পাহাড়ের খাড়াইয়ের উপর পাতা হয়েছিলো। আমাদের শিকারিরা পশুটার গতিবিধি জরিপ করে ওই জায়গাটাই বেছেছিলো ফাঁদ পাতার জন্য। এমনিতে আমি হয়তো এইরকম একটা অভিযানে যেতাম না। কিন্তু বাঘটা চানুকে খেয়েছিলো। চানু ছিলো আমার সব থেকে ভালো বন্ধু। প্রায় গাঁয়ের মধ্যে থেকে তুলে নিয়ে গেছিলো চানুকে একদিন রাত্রিবেলা। কেউ কিছু বুঝতেই পারেনি। আধ-খাওয়া শরীরটা জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া গেছিলো দু’দিন পরে। আমিই পেয়েছিলাম শিকড় আনতে গিয়ে। সেদিন থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম, যেদিন পশুটার শাস্তি হবে, সেদিন আমিও যাবো দেখতে।

কিন্তু সেই শাস্তি ঠিক করে উপভোগ করা হলো না আমাদের। 

ফাঁদটার দিকে যেতে যেতেই কিরকম যেন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছিলো। চারপাশ স্বাভাবিকের চাইতে একটু বেশি থমথমে। বাতাস যেন কেমন একটা চাপা উদ্বেগে ভারি। দূর থেকে মানুষখেকোর গর্জন শোনা যাচ্ছিলো। কিন্তু সেটাও যেন কেমন অবরুদ্ধ, সাবধানী। বন্দী বাঘের তেজ নেই তাতে।

আমাদের জনা দশেকের দলটা একটু অবাক হয়েই এগোচ্ছিলো পাহাড়ের ঢালের উপর ফাঁদটার দিকে। কাছাকাছি পৌঁছতেই হঠাৎ চারপাশের গাছপালা গুলো যেন মনে হলো জ্যান্ত, সচল হয়ে উঠলো। এবং পরক্ষণেই দেখলাম, আমরা একদল অদ্ভূত পোশাক পরা সশস্ত্র মানুষের মাঝখানে বন্দী হয়ে পড়েছি।

এই রকম মানুষ আমরা এর আগে কখনও দেখিনি। সব মিলিয়ে প্রায় একশোজন। গায়ের রঙ আমাদেরই মতন। প্রত্যেকে লম্বা-চওড়া, বলিষ্ঠ। যোদ্ধা যে, তাই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পরনের জঙলা সবুজ রঙের বর্মচর্মগুলো যে জঙ্গলের সঙ্গে চট করে মিশে যাওয়ার জন্য, সেটাও স্পষ্ট। অস্ত্রশস্ত্রের অনেকগুলোই আমরা এর আগে চোখে দেখিনি। ধনুকগুলো আমাদের ধনুকের থেকে অনেক বড়। তীরগুলো ধাতুর তৈরি। বর্শা আর তলোয়ার ছাড়াও বিরাট বড় বড় কুড়ুলের মতন জিনিস কয়েকজনের হাতে। তাদের চেহারাগুলোও বকিদের তুলনায় বড়। আর যাদের শরীর সব থেকে বড়, তাদের হাতে লোহার ডাণ্ডার মাথায় বসানো বিশাল বড় আর ভারি ধাতব গোলক, যার একটার বাড়ি পড়লে বোধহয় ওই ফাঁদে আটকে থাকা অত বড় বাঘটারও মুণ্ডু চূর্ণবিচূ্র্ণ হয়ে যাবে!

যেরকম নিঃশব্দ ক্ষিপ্রতায় লোকগুলো আমাদের ঘিরে ফেললো, বুঝলাম এরা চূড়ান্ত প্রশিক্ষিত। নাহলে আমাদের কানকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়। নিমেষের মধ্যে দেখলাম প্রায় গোটা পঞ্চাশেক তীর, খান কুড়ি বর্শা, তলোয়ার আর ওই সব নাম-না-জানা অস্ত্র আামাদের দিকে তাগ করা আছে। অস্ত্র আমাদের সঙ্গেও ছিলো, বলাই বাহুল্য। কিন্তু সংখ্যায় আর কার্যকারিতায় ওদের তুলনায় আমাদেরগুলো খেলনা। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার ছিলো না।

নৈঃশব্দ ভাঙলো ওদেরই একজনের কন্ঠস্বরে। একটু পিছন থেকে এগিয়ে এলো সে। ‘‘কোথা থেকে আসছো তোমরা?’’

লোকটার পোষাক, চেহারা আর কথা বলার ভঙ্গিতেই পরিস্কার বোঝ যাচ্ছিলো, সে-ই এই দলটার নেতা। আমাদের তরফ থেকে কথা বললো মোহক। সে আমাদের অভিযানের নেতা।

‘‘তাম্বলি গ্রাম।’’

‘‘সেটা কোথায়?’’

মোহক আঙুল তুলে দিকনির্দেশ করলো। ‘‘ওই পূবে যোজন খানেক দূরে।’’

‘‘এই ফাঁদটা তোমরা পেতেছো?’’

‘‘হ্যাঁ। জন্তুটা মানুষখেকো। আমাদের গাঁয়ের ছ’জনকে মেরেছে।’’

‘‘কি ভাবে মারবে ওকে?’’ লোকটার কন্ঠস্বরে অবৈরিতার আশ্বাস।

‘‘এই বর্শা আর তীর দিয়ে।’’ হাতের বর্শাটা একটু উঁচু করে ধরলো মোহক। 

‘‘না।’’ মাথা নাড়লো লোকটা। ‘‘ওতে ওর চামড়াটা নষ্ট হবে। আমরা ওটা কিনে নেবো তোমাদের কাছ থেকে। আস্ত থাকলে অনেক দাম পাবে।’’

আমরা অবাক। এমন প্রস্তাব এর আগে কেউ দেয়নি কোনওদিন আমদের। তাহলে কি ভাবে মারবো বাঘটাকে? প্রশ্নটা মোহকই করলো।

‘‘বিষ খাইয়ে।’’ একটু সময় নিয়ে বললো লোকটা। ‘‘তাতে চামড়াটা আস্ত থাকবে।’’

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর মোহকের বিস্ময়াবিষ্ট গলা শোনা গেলো। ‘‘তোমরা কারা?’’

‘‘আমরা রাজার লোক।’’ লোকটার ঠোঁটের কোনে হাল্কা হাসির আভাস।

‘‘কোন রাজা?’’ প্রশ্নটা করলো আমাদের পাগলা পাহান। এই দলটায় সেই বয়ঃজ্যেষ্ঠ।

‘‘কিষ্কিন্ধার রাজা, পরমভট্টারক শ্রীমন্মহারাজ সুগ্রীব।



-চলবে