Next
Previous
2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in


 



         

চারপাশে গাছপালা ঘেরা একটি পুকুর। চাঁদনী রাতের আলোতে তার টলটলে জলে মায়াবী ঝিলিমিলি খেলা। পুকুরের ঘাটে বসে এক তরুণ আনমনে বাজিয়ে চলেছে বাঁশি। তার মূর্চ্ছনা পৌঁছে যায় এদিক সেদিক। পাশের একটি বাড়ির জানালায় এক কিশোরীর মুখ। বাঁশির সুর তাকে করেছে সম্মোহিত। পরদিন দুজনের দেখা। মেয়েটি বললো, “কাল রাতে আপনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন ? আমি শুনেছি।“

যুবকটি গাছের ছায়ায় শীতলপাটিতে বসে দিনের পর দিন অবলীলায় রচনা করে কবিতা,অনায়াসে বেঁধে চলে কত গান। মেয়েটিকে শেখায় সে গান, গ্রামের অন্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও। স্বল্পশিক্ষিতা গ্রাম্য তরুণীটি এমন প্রতিভা, এমন অনাবিল স্বতস্ফূর্ত সৃজনী আগে দেখেনি। তার চোখেমুখে বিস্ময়, মুগ্ধতা। আর তরুণটি অভিভূত ঐ ষোড়শী কন্যাটির অনন্যা রূপে। তার সৌন্দর্য্, সৌষ্ঠভ তরুণটির হৃদয়ে এনে দিলো এক অনাস্বাদিত আলোড়ন। জাগিয়ে তুললো সৃষ্টিসুখের উল্লাস।

আর এক দৃশ্য। মেয়েটি জ্বরাক্রান্ত। যুবকের মন ব্যাকুল। সে চায় তার পাশে বসে তার তপ্ত কপালে হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু রীতিনীতির বাঁধা। অবশেষে সুযোগ হলো। অনেক বছর পরে লিখেছিলো,”বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি। তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে ? আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুণ মিনতি।“

এরা কালিদাসের কোন কাব্য, সেক্সপীয়রের কোন নাটক, বা শরৎচন্দ্রের কোন উপন্যাসের পাত্রপাত্রী হতে পারত অনায়াসে। কিন্তু এই চরিত্ররা কাল্পনিক নয়, নেহাতই বাস্তব। গ্রামটির নাম কুমিল্লা জেলার দৌলতপুর। তরুণীটির নাম সৈয়দা খাতুন। আর যুবকটি কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুলের বন্ধু কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, একদিন নজরুল সৈয়দা খাতুনকে বললেন, “এমন ফুলের মত যার সৌন্দর্য, তার এ নাম কে রেখেছে ? আজ থেকে তোমার নাম নার্গিস।“ সেই থেকে তাঁর নাম হয়ে গেলো নার্গিস, পুরো নাম নার্গিস আসার খানম। পারস্যদেশের একটি গুল্মের অতি সুগন্ধী শ্বেতবর্ণা ফুলের ফারসি ভাষায় নাম নার্গিস।

প্রেমের এই আলোড়ন নজরুলের সৃজনীসত্বাকেও উদ্বেলিত করেছিল এক বিপুল আবেগে। দৌলতপুরে অবস্থানকালেই নজরুল প্রায় ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা রচনা করেছিলেন। ‘পাপড়ি খোলা’, ‘অবেলায়’, ‘অনাদৃতা’, ‘বিদায় বেলায়’, ‘হারমানা হার’, ‘হারামণি’, ‘বেদনা অভিমান’, ‘বিধুরা’, ‘পথিক প্রিয়া’ ইত্যাদি কবিতা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই পর্বের অনেক বছর পরেও একাধিক বিরহ-বেদনা-অভিমানের গান তিনি সৃষ্টি করেছেন, যা এই সময়ের প্রতিফলন বলে অনেকে মনে করেন।

হ্যাঁ, এই প্রেম পূর্ণতা পায়নি। এর ব্যাপ্তি ছিলো মাত্র আড়াই মাস, বা তারও কম। অথচ নজরুল-নার্গিসের বিবাহ অনুষ্ঠানও অতি সমারোহে আয়োজিত হয়েছিল। কিন্তু সেই অনুষ্ঠান থেকে কোন কারণে নজরুল নিজেকে প্রত্যাহৃত করেন। ঠিক কি ঘটেছিল তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। অনেক নজরুল গবেষক বা জীবনীকাররা অনেক কথাই লিখেছেন। ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, অসততা ইত্যাদির উপাদান সম্বলিত বেশ কিছু কাহিনী প্রচলিত। সে সবের সত্যাসত্য নিয়েও মতভেদ আছে। কিন্তু এই প্রেমপর্বের যে ঘটনাক্রম নিয়ে দ্বিমত নেই, তাই প্রথমে বিবৃত করা যাক।

বিশ্বযুদ্ধের শেষে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পেয়ে নজরুল তখন কলকাতায়। ফজলুল হকের নবযুগ পত্রিকায় কিছুদিন সম্পাদনার কাজ করেছিলেন,তখন তাও নেই। এদিক ওদিক কিছু কিছু লেখা বেরিয়েছে কয়েকটি পত্রপত্রিকায়। তবে খ্যাতি-পরিচিতি তখনও তেমনভাবে আসেনি। তিনি তখন যুক্ত ছিলেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে, থাকতেন ৩২ কলেজ স্ট্রীটে তাদেরই ভবনে। সেখানে মোহম্মদ মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওয়াদুদ, মহম্মদ শহীদুল্লাহ ইত্যাদি তখনকার তরুণ মুসলিম লেখকরা তাঁর বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন। সদা প্রাণোচ্ছল, হাস্যময় নজরুলের বান্ধববৃত্ত বিস্তৃতই ছিল।

এদেরই মধ্যে একজন ছিলেন আলী আকবর খান। তিনি নজরুলের থেকে বয়সে বেশ কিছুটা বড় ছিলেন। কলেজ স্ট্রীটেই দুজনের পরিচয়। আলী আকবর কিছু কিছু লেখালেখি করতেন, একটা নাটক ও কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন, কিন্তু তার মান বিশেষ উঁচু ছিল না। তিনি নিজেই সে সব ছাপিয়ে বিক্রী করার চেষ্টা করতেন। ঐ পাড়ায় তাঁর একটি প্রকাশনা ছিল, মূলত পাঠ্যপুস্তকের। অবশ্য নজরুলের সম্ভাবনাময় প্রতিভা চিনে নিতে তাঁর দেরী হয়নি।

এই আলী আকবর খান ছিলেন কুমিল্লার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামের এক সম্পন্ন ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। গ্রামে বিষয়-সম্পত্তি তাঁদের কম ছিল না। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে নজরুলকে তাঁদের গ্রামের বাড়ীতে যাবার আমন্ত্রণ করছিলেন। শেষে আলী আকবরের অগ্রজ নেজাবৎ আলীর মেয়ে আম্বিয়া খানম মানিকের বিবাহ উপলক্ষ করে নজরুল দৌলতপুর যেতে রাজি হন।

১৯২১ সালের ৩রা এপ্রিল নজরুল ও আলী আকবর রেলপথে যাত্রা করে পরদিন রাতে কুমিল্লা পৌঁছান। কুমিল্লা শহর থেকে দৌলতপুরের দূরত্ব আরও প্রায় ৪০ কিলোমিটার। সে সময়ে রাতের বেলায় অত দূর পাড়ি দেওয়া নিরাপদ ছিল না। কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকায় আলী আকবরের এক স্কুলের সহপাঠী বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়ীতে দুজনে থাকা মনস্থ করেন। বাড়ীটি ছিল বীরেন্দ্রর বাবা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের। তাঁর স্ত্রী এবং ইন্দ্রকুমারের মা’র নাম বিরজাসুন্দরী। এই পরিবারটি ছিল সুশিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক এবং উদারমনা। নজরুল-নার্গিস পর্বে এবং নজরুলের পরবর্তী জীবনেও বিরজাসুন্দরী ও তাঁর পরিবারের একটি বিশেষ ভুমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। এক রাত মাত্র নয়, নজরুলরা এ বাড়ীতে আরও দু-চার দিন অতিবাহিত করেন। এই স্বল্প পরিসরেই নজরুল এই পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, এবং বিরজাসুন্দরীকে ‘মা’ সম্বোধন করতেন।

কান্দিরপাড় ছেড়ে নজরুল ও আলী আকবর অবশেষে দৌলতপুরে পৌঁছোন। সেখানে আলী আকবরের পরিবার ও দৌলতপুরবাসীরা নজরুলকে অতি সমারোহে অভ্যর্থনা করেন বলে কথিত আছে।

বিয়ের আসর নজরুল মাতিয়ে দিয়েছিলেন গান গেয়ে আর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ উচ্ছলতা দিয়ে। সেই বিয়েতে গান গেয়েছিল আরেকটি মেয়ে – আলী আকবরের ভাগ্নী সৈয়দা খাতুন। সেই প্রথম পরিচয়। দুই তরুণ মনের পারস্পরিক আকর্ষণের সুত্রপাত। সৈয়দা খাতুন আলী আকবরের বোন আসমাতুন্নিসার ছয় সন্তানের পঞ্চম। তাদের বাড়ী পাশেই ছিল। শৈশবেই অনাথা হওয়ায় মেয়েটি আলী আকবরের পরিবারের স্নেহ-দাক্ষিণ্য অর্জন করেছিল, তাদের বাড়ীতে অবাধ যাতায়াত ছিল। নজরুলের সঙ্গে পরিচয়ের পর সেই যাওয়া আসা আরও বেড়ে গেল। নজরুলের কোঁকরা বাবরি চুল, তীক্ষ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, স্বভাবের উষ্ণতা আর সাহিত্য-সঙ্গীতের প্রতিভা যে কোন তরুণীকে বশীভূত করার জন্য পর্যাপ্ত ছিল। আর নজরুল নিজে ? অগ্রজ বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা সেই সময়ের এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “এক অচেনা পল্লীবালিকার কাছে এত বিব্রত ও অসাবধান হয়ে পড়েছি যা কোন নারীর কাছে হইনি।“

প্রথম পরিচয় থেকে পুরোদস্তুর প্রেম রূপায়িত হতে এক-দেড় মাসের বেশী সময় লাগেনি। এরই মধ্যে বদলে গেল মেয়েটির নাম, ভালবাসা উদযাপিত হতে লাগল নতুন নতুন গানে কবিতায়, অদম্য হয়ে উঠল দুজনে দুজনকে বেশী করে কাছে পাওয়ার আকুতি। এ সব দৃষ্টি এড়ালো না একজনের। তিনি মামা আলী আকবর খান। অনেকের মতে ঘটনাক্রমের এই বিবর্তনে তাঁর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল। অচিরেই তিনি দুজনের বিয়ের প্রস্তাব পেশ করলেন। শোনা যায় তখনকার ‘চালচুলোহীন’ নজরুলকে নিয়ে খান পরিবারে একটু আপত্তি ছিল। কিন্তু শিক্ষিত বিএ পাশ আলী আকবরের সিদ্ধান্ত শেষে সকলকেই মেনে নিতে হল। আর মিয়াঁ-বিবিকে রাজী করাতেও বেশী সময় লাগেনি। অতএব বিয়ের দিন ধার্য হল ১৭ই জুন ১৯২১ (৩রা আষাঢ় ১৩২৮)।

নজরুল নার্গিসের এই বিবাহানুষ্ঠান বেশ ধুমধাম করেই আয়োজিত হয়েছিল। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতবিশারদ ওস্তাদ আলাউদ্দিন।

খাঁ ও তাঁর ভাই ওস্তাদ আফতাবুদ্দিন ফকির যিনি সেই অনুষ্ঠানে বাঁশিও বাজিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আনা হয়েছিল ২০ জনের একটি গাইয়ে-বাজিয়ের গোষ্ঠি। স্থানীয় গণ্যমান্যদের মধ্যে বাঙ্গরার জমিদার রায়বাহাদুর রূপেন্দ্রলোচন মজুমদার, সেখানকার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অবনীমোহন মজুমদার ইত্যাদিরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নজরুলের কলকাতার বন্ধুবান্ধবরা কেউই গিয়ে উঠতে পারেননি। অবশ্য কান্দিরপাড়ের বিরজাসুন্দরী, তাঁর স্বামী ইন্দ্রকুমার ও পুত্র বীরেন্দ্রকুমার সহ সেই পরিবারের বেশ কয়েকজন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সমগ্র অনুষ্ঠানের জন্য নাকি ১৫০০০ টাকা খরচা হয়েছিল। আর,

দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাসভবন যেখানে নজরুল-নার্গিসের প্রেম প্রস্ফুঠিত হয়েছিল
      



এমনও শোনা যায় যে নার্গিসের জন্য দেনমোহর ধার্য্য হয়েছিল ২৫০০০ টাকা (মতান্তরে ২০০০০ টাকা)!

কিন্তু বিয়ের আকদ পর্বেই কাবিননামা নিয়ে শুরু হলো সমস্যা, বাঁধল বিরোধ। ঐস্লামিক বিবাহে কাবিননামা বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের সম্মতিক্রমে নির্ধারিত একটি চুক্তিপত্র। এই কাবিননামায় একটি শর্ত ছিল এই যে, বিয়ের পর নার্গিসকে নিয়ে নজরুল কোথাও যেতে পারবেন না, তাঁদের দৌলতপুরেই থাকতে হবে। এই শর্তটি নিয়ে বিশেষ মতবৈষম্য কোন বিবরণীতে পাইনি। স্বাধীনচেতা, উচ্ছল বোহিমিয়ান স্বভাবের নজরুলের পক্ষে এই শর্ত মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁর কাছে এ ছিল তাঁকে ঘরজামাই করে রাখার প্রস্তাব। তিনি অসম্মতি জানালে শুরু হয় প্রবল বাকবিতন্ডা। বরপক্ষে নজরুল ছিলেন একা। অন্যপক্ষ থেকে বর্ষিত হয় নানা কটূক্তি। কিছু আমন্ত্রিত বয়স্কদের মধ্যস্থতায় আবহাওয়া সামান্য শান্ত হলেও নজরুল প্রচন্ড অপমানিত বোধ করেন এবং বিবাহ অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।

কোন কোন গবেষকদের মতে নজরুল নার্গিসকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর সঙ্গে চলে যেতে, কিন্তু তরুণী নার্গিস এত বড় ফয়সালা করে উঠতে পারেননি। অগত্যা অসীম তিক্ততা নিয়ে ক্ষুব্ধচিত্ত নজরুল উপস্তিত হন বিরজাসুন্দরীর কাছে, এবং তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানান। সব শুনে বিরজাসুন্দরীর মনে হয়, সেই মুহুর্তে নজরুলের মনের যা অবস্থা, তাতে তাকে বিরত করা সম্ভব নয়। তখন ঘোর রাত, বাইরে ঝড়বৃষ্টি চলছে। বিরজাসুন্দরী তাঁকে অনুরোধ করেন বীরেন্দ্রকুমারকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। অতঃপর নজরুল ও বীরেন সেই বৃষ্টিবাদলার মধ্যে কর্দমাক্ত রাস্তা খেতখামার পায়ে হেঁটে পার করে কান্দিরপাড় পৌঁছলেন। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়ায় কয়েকদিন অতিবাহিত করার পর মুজফ্ফর আহমেদের অর্থসহায়তায় নজরুল কলকাতা ফেরৎ যান।

সেই যে গেলেন, আর কখনো দৌলতপুরে ফিরে যাননি। নার্গিসের সঙ্গে দেখা হওয়া তো দূরের কথা, তাঁকে লেখা নার্গিসের একাধিক চিঠির উত্তর পর্যন্ত দেননি। অথচ ব্যর্থ প্রেমের জ্বলনে দগ্ধ চিত্তে রচনা করেছেন কখনো ট্র্যাজিক, কখনো ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী গান-কবিতা। বন্ধুকে লিখেছেন, “এই বন্ধন ছিন্ন করে দুঃখ পেয়েছি আমিই সব চেয়ে বেশি। আমার নিজের বুকই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে. হিয়ায় হিয়ায় আমার এক বীভৎস খুন-খারাবি . . খানখান খুন! কেমন এক বিদ্রোহ অভিমানে আমার দুচোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ছে। নাই নাই, এ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা নিয়ন্তা কেউ নাই।“

দৌলতপুরে না গেলেও কুমিল্লায় কিন্তু নজরুল এর পরও গিয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। কখনো সাহিত্য সভায় যোগ দিতে, কখনো ইংরেজদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সভায় মিছিলে অংশ নিতে। তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন এই কুমিল্লাতেই। কিন্তু অন্য আরেকটি কারণও ছিল কুমিল্লা আসার। তা হল বীরেন্দ্রকুমারের বিধবা জ্যেঠিমা গিরিবালা দেবীর কন্যা আশালতা সেনগুপ্তা। কান্দিরপাড় থেকে বিরজাসুন্দরীর পরিবারের যে সদস্যরা নজরুল-নার্গিসের বিবাহ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই আশালতাও ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ১৩ বছর। প্রথম প্রেমের শোচনীয় পরিনতির পর নজরুল যখন কুমিল্লায় আসতে লাগলেন তখন আশালতার সঙ্গে ক্রমে ক্রমে পরিচয়, সখ্যতা পেরিয়ে পুনরায় ভালবাসার উদ্ভব হল, এবং পরিশেষে ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় তাঁদের অনাড়ম্বর বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিরজাসুন্দরী ও তাঁর পরিবার এই পরিণয়ের পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু বিধবা গিরিবালার অত্যাশ্চর্য্য দৃঢ়তা এই আন্তরধর্মীয় বিবাহ সম্ভব করেছিল। বিয়ের পর নজরুল আশালতার নাম রাখেন প্রমীলা। প্রমীলাই আমৃত্যু নজরুলের জীবনসঙ্গিনী ছিলেন।

আর নার্গিস ? তিনি সুদীর্ঘ ১৭ বছর অপেক্ষা করেছিলেন। নজরুলকে গোটাচারেক চিঠি লিখেছিলেন। শেষ চিঠিটি ছাড়া আগেরগুলির কোন উত্তর নজরুল দেননি। নার্গিসের চিঠিগুলির বয়ান নজরে আসেনি। তবে শেষ চিঠিতে তিনি নাকি লিখেছিলেন যে প্রমীলাকে বিয়ে করার জন্য তাঁর কোন অনুযোগ নেই, কিন্তু একবার তিনি নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে চান। এমনকি আত্মহত্যার ইচ্ছাও নাকি প্রকাশ করেছিলেন। এর উত্তরে নজরুল একটি বিস্তারিত চিঠি লেখেন। এই গুরত্বপূর্ণ নথিটি কিন্তু সর্বত্র উপলব্ধ। তার থেকে সামান্য উদ্ধৃতি শুরুতে দিয়েছি, প্রয়োজন মত অন্য জায়গায় আবার উল্লেখ করা যাবে। নার্গিস অবশ্য আত্মহত্যার পথে যাননি। দীর্ঘ প্রতীক্ষা এবং দু-একটি ঘটনার পর তিনিও বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হন, ১৯৩৮এর ১২ই ডিসেম্বর, আলী আকবর খানের ঢাকার গ্রন্থন ব্যবসায়ের সহযোগী সাহিত্যিক আজিজুল হাকিমের সাথে।

য়ৌবনে নজরুল
                   



বিবরণীর এই পর্যায়ে আলোচনায় আসি বিবিধ বিতর্কিত বাদ-প্রতিবাদের বিষয়গুলিতে।

নজরুলের গুণগ্রাহীরা তাঁর প্রেমের এই কঠিন বেদনাসম্পৃক্ত পরিণতির জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেছেন আলী আকবর খানকে। এঁদের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোঘ্য নজরুলের অভিভাবকস্থানীয় সুহৃদ কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের স্মৃতিচারণা ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’। তিনি সরাসরি আরোপ করেছেন, ‘আলী আকবর খান দাম্ভিক, মিথ্যাভাষী ও শঠ’। স্বপক্ষের অভিমত পোষণকারীরা বলেন, আলী আকবর খানের হাবভাব এবং কোন কোন ক্রিয়াকলাপ নজরুলের কলকাতার বন্ধুরা মোটেই ভাল চোখে দেখতেন না। তাঁর সঙ্গে দৌলতপুর যাওয়া থেকে বিরত করার জন্য নজরুলকে বন্ধুরা উপদেশ দিয়েছিলেন। মুজফ্ফর আহমেদের ভাষায় তিনি স্পষ্টতই কবিকে বলেছিলেন, ‘কি মতলবে তিনি তোমায় তাঁদের বাড়ী নিয়ে যেতে চান তা কেউ জানেন না। তিনি তোমাকে একটা বিপদেও ফেলতে পারেন।‘ সরলমতি কবিকে কিন্তু নিরস্ত করা যায়নি। এঁদের মতে, আলী আকবরের অভিসন্ধি ছিল নজরুলের বিরল প্রতিভাকে নিজের প্রকাশনা ব্যবসার একচেটিয়া স্বত্বাধীন করা, এবং সেই উদ্দেশ্যেই পারিবারিক আবদ্ধতার চক্রান্ত ও কাবিননামার ওই শর্ত রচিত হয়েছিল। এই যুক্তির সমর্থনে তৎকালীন দৌলতপুরবাসী মুন্সি আবদুল জব্বারের জবানি উল্লেখযোগ্য: “অন্যদিকে আলী আকবর খান বড় বোন নার্গিসের মাকে যেয়ে বলেছেন, ভাগিনীকে আমরা বিবাহ দিব। .......আমাদের বাড়ীর একটি মেয়েও এই পাত্রের পছন্দ হয় নাই। তোমার মেয়েকে পাত্র পছন্দ করেছে। বর্তমানে যে কোন উপায়ে এই কাজীকে আটকিয়ে রাখতেই হবে। এই কাজী নজরুল ইসলাম পৃথিবী বিখ্যাত এক দার্শনিক কবি হইবে। .....তাহার নমুনা আমরা পাইয়াছি। তাহাকে হাতছাড়া করা যায় না। ......তাহাকে আটকাইয়া রাখিলে ভবিষ্যতের জন্য একটা পথ আবিষ্কার হইতে পারে, তাহাতে সারা জীবনে সুখ থাকিতে পারিবে।“

নজরুল তাঁর বিবাহের সিদ্ধান্ত পত্রযোগে কলকাতার কয়েক বন্ধুদের জানিয়েছিলেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর প্রথম চিঠিতে (৫ই জুন ১৯২১) এই সিদ্ধান্তের সঠিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছিলেন, “.... তোর বয়েস আমাদের চাইতে ঢের কম, অভিজ্ঞতাও তদনুরূপ, feeling-এর দিকটা অসম্ভব রকম বেশী। কাজেই ভয় হয় যে হয়ত বা দুটো জীবনই ব্যর্থ হয়। ....... যৌবনের চাঞ্চল্যে আপাতঃ মধুর মনে হলেও ভবিষ্যতে না পস্তাতে হয়।” এর উত্তরে নজরুল নার্গিস সম্বন্ধে তাঁর যে অসহায় মনোভাবের কথা ব্যক্ত করেছিলেন তা আগেই বলেছি। অগত্যা পবিত্রবাবু তাঁর দ্বিতীয় চিঠিতে (২৫শে জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮) নজরুলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েও শেষে লিখেছিলেন, “তুই যে এরূপ একটা আজগুবি কান্ড বাঁধিয়ে বসবি, তা সকলে আমরা জানতুম।“ তাঁর কলকাতার বন্ধুরা যে অকস্মাৎ বিয়ের ফয়সালায় বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না, তা বুঝতে পেরে নজরুল তাঁর আর এক সুহৃদ সাহিত্যিক ও সম্পাদক মোহম্মদ ওয়াজেদ আলীকে একটি পত্রে সম্ভবত কিঞ্চিত দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তার উত্তরে ওয়াজেদ আলী লেখেন (১৩ই জুন ১৯২১), “আমার বোধ হয় আপনার বন্ধুরা অসন্তুষ্ট হয়েছেন একটা কারণে। আপনি ‘নারায়ণে’ ‘দহন-মালা’ লিখে নারীর কাছে ক্ষমা চাইলেন; তার পরই এত সত্বর প্রেমের ফাঁদে ধরা পড়লেন। ‘যৌবনের জোয়ার’ বড় সাংঘাতিক; তাকে ঠেলে রাখা বড় দায় – এ আমি স্বীকার করছি।“

স্বপক্ষীয়রা বলেন, বিবাহ অনুষ্ঠানে নজরুলের বিস্ফোরণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এর প্ররোচনা কিছু দিন ধরে ক্রমাগত দানা বাঁধছিল। আলী আকবর ও তাঁর পরিবারের কোন কোন কথায় আচরণে নজরুল বিরক্ত হয়েছিলেন, এমন কি অপমানিতও বোধ করেছিলেন। কিন্তু নার্গিসের প্রতি সেই সময়ে তাঁর সুগভীর অনুভুতি তাঁকে সহ্যশীল থাকতে বাধ্য করে। শোনা যায়, নার্গিসের আগে আলী আকবর তাঁর এক ভাইঝি হেনার সঙ্গে নজরুলের বিয়ের প্রস্তাব রেখেছিলেন। নজরুল রাজী হননি। কিন্তু হেনা বা নার্গিস, কারোর সঙ্গেই নজরুলের বিয়েতে অধিক অমত ছিল আলী আকবরের পরিজনদেরই। তাঁরা এই অদ্ভুত স্বভাবের ছন্নছাড়া নিঃসম্পদ ছেলেটিকে ঘরের জামাই করা মেনে নিতে পারেননি, এবং প্রায়শই নজরুলের সামনেই তাঁদের এ অভিমত প্রকাশ হয়ে পড়ত। নজরুল স্বাভাবিক ভাবেই ব্যথা পেয়েছিলেন। কুমিল্লার সাপ্তাহিক লালমাই পত্রিকার ১লা জুন ১৯৬৯ সংখ্যায় অধ্যাপক বদরুল হাসান লিখেছেন, “.....নজরুলের বাঁধনহারা ভাব তাঁর পরিবারের গুরুজনদের চোখে তাচ্ছিল্যের কারণ ছিল। সম্প্রতি নেজামত আলী খান (আলী আকবরের বড় ভাই) একথা অকপটেই স্বীকার করেছেন।” কিন্তু আগেই বলেছি, শিক্ষিত আলী আকবরের জেদের কাছে তাঁদের নতিস্বীকার করতে হয়। আলী আকবর খান তাঁর সম্বন্ধে নজরুলের কলকাতার বন্ধুদের মনোভাব ভালোই জানতেন। তাই বিয়ে ঠিক হবার পর নাকি তাঁদের চিঠিপত্র নজরুলের হাতে দিতেন না, এবং নজরুলের লেখা চিঠিগুলিও ডাকে তাঁদের কাছে পাঠাতেন না। অনেক বছর পরে নার্গিসের স্বামী আজিজুল হাকিমের উদ্যোগে সে সব চিঠি প্রকাশিত হয়। স্বপক্ষের লোকেরা এমনও বলেন যে বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্রও আলী আকবর কলকাতার ঠিকানাগুলিতে ইচ্ছাকৃতভাবেই দেরী করে পাঠান যাতে সেখান থেকে কেউ বিয়ের অনুষ্ঠানে পৌঁছতে না পারেন। অন্য একটি ব্যাপারও নজরুলের কাছে বিসদৃশ লেগেছিল। বিয়ের দিন যখন পাকা, তখন থেকে নার্গিসকে তাঁর মামা নিজের বাড়ীতে এনে রাখেন এবং স্বল্পশিক্ষিতা মেয়েকে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই নজরুলের উপযুক্ত করে তোলার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। তিনি শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের ও অন্য বিশ্বসাহিত্য থেকে বেছে বিভন্ন নারীচরিত্রের কাহিনী, শহুরে আদবকায়দা ইত্যাদি নার্গিসকে সারাদিন ধরে শেখানো-পড়ানোর ঝোঁক ধরে বসলেন। নজরুল তো নার্গিসকে সেইভাবেই ভাল বেসেছিলেন যেমনভাবে তিনি তাঁকে দেখেছিলেন, পেয়েছিলেন। তাঁর কাছে এ সব নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়েছিল।

কিন্তু এই সব মতের বিপক্ষেও কিছু দৃষ্টিকোণ সময়ের সাথে সাথে প্রকাশ পেয়েছে।

একটি ধারণা এমন আছে যে প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের বিবাহ অনেকেই ভালো ভাবে নিতে পারেননি। তাঁকে ধর্মান্তরিত না করে বিয়ে করা, এবং বিয়ের পর শাঁখা সিঁদুর উপাসনা ইত্যাদি আচারাদি পালনের অনুমতি দেওয়া মুসলমান সম্প্রদায়ের একাংশকে ক্ষুব্ধ করেছিল। উল্টোদিকে ব্রাহ্ম সমাজের মেয়ের আন্তর্ধমীয় বিবাহ নিয়ে ব্রাহ্ম ও হিন্দু সমাজের অনেক মাতব্বরও রূষ্ট হয়েছিলেন। তবে নজরুল-নার্গিস পর্বের নজরুল-স্বপক্ষের মতগুলিকে খন্ডন করতে মাত্র এঁরাই যে সচেষ্ট হয়েছিলেন, তা নয়। দু’পক্ষেরই দৃষ্টিকোণের সমর্থন বা অন্যথায় স্বতন্ত্র গবেষকরাও আছেন।

বিপক্ষীয়রা বলেন মুজফ্ফর আহমেদের বৃত্তান্ত আলী আকবর খানের প্রতি তাঁর নেতিবাচক পক্ষপাতের ফসল। ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার এক ঈদ সংখ্যায় ‘নার্গিস’ নামে একটি উপন্যাসের লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর মত: “নজরুলের বই প্রকাশ করে রাতারাতি ধনী হওয়ার পরিকল্পনা আলী আকবরের মনে আসবে কেন ? বই বিক্রী করে প্রচুর অর্থ উপার্জন কি নজরুলের জীবনে আদৌ ঘটেছিল ? তাঁর পেছনে প্রকাশকেরা সারি বেঁধে অপেক্ষা করতেন, এমন তথ্যও তো ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায় না। বরং এক-দুই শ টাকার বিনিময়ে বইয়ের স্বত্ব বিক্রী করার জন্য নজরুল দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, এই নির্মম বাস্তবতাই তো বিভিন্ন জীবনী গ্রন্থ থেকে পাই।“ এই বিপক্ষীয়দের মত, নজরুল ও নার্গিসের বৈবাহিক জীবনে আর্থিক সুরক্ষা এবং মাথার ওপর আচ্ছাদন সুনিশ্চিত করতেই আলী আকবর মোটা রকমের দেনমোহর ও কাবিননামার ঐ শর্ত প্রস্তাব করেন। সুলতান মাহমুদ মজুমদার দাবী করেন, নার্গিসের সাথে তাঁর একবার সাক্ষাত হয়েছিল, এবং সেই সাক্ষাতের বিবরণী তিনি ‘কবিপ্রিয়ার সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন (‘সাপ্তাহিক আমোদ’, ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৭)। সেখানে, এমন ছিল নার্গিসের জবানী: “আমাকে সে নিয়ে যেত কোথায় ? চুরুলিয়ার বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। থাকতো পরের আস্তানায়। তখনও লেখায় তেমন পয়সা পেতো না। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে খরচ দিতে হতো অন্যের......। কুমিল্লায় আসার সময় মামার অতিথি হিসাবে আমার মামাই খরচ দিয়েছিলেন। এই লোক বউ নিয়ে তুলতো কোথায় ? খাওয়াতো কি ? ......আমাদের সামাজিক মান সম্ভ্রম ও আমার মনের দিকটা একবারও কি সে ভেবে দেখেছে ? .....ঘরছাড়া এক পথিক যুবাকে বর করে নিলাম। তাই আমি দোষী, আর সে বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে লিখছে কবিতা, আর আমি জ্বলছি দুঃখ দহনে। স্ত্রী পুত্র নিয়ে সে হাসে, আমি চোখের জলে ভাসি।“ বিপক্ষগোষ্ঠী বরং নজরুলের দৌলতপুর থেকে পবিত্রবাবুকে লেখা চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাতে চান যে তিনি কেবল নার্গিসের রূপগুণেই বিভোর হয়েছিলেন এমন নয়, সে পরিবারের দৌলতও তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। নার্গিসের বর্ণনায় কবি লিখেছিলেন: “চিরজনমের হারানো গৃহলক্ষী, প্রিয়া..... তার বাইরের ঐশ্বর্যও যথেষ্ট।” নার্গিসকে সারাদিন আলী আকবরের প্রশিক্ষণের প্রসঙ্গে বিপক্ষের অভিমত, নজরুলের ভাবাবেগ তখন এতই প্রবল যে তিনি সর্বদাই প্রিয়ার সঙ্গসুখ চাইতেন, যা তখন সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু ছিল, এবং নার্গিসকে দূরে রাখার জন্যই আলী আকবরের এই ছিল পদ্ধতি। অধ্যাপক মিলন দত্ত তাঁর ‘প্রথম প্রেম ও নার্গিস বেগম’ প্রবন্ধে বলেছেন, “আলী আকবর খান নার্গিসকে ..... নজরুলের সঙ্গে মেশার সুযোগ না দেওয়ার ইচ্ছায় অধিকাংশ সময় নিজের কাছেই রাখতেন, বিয়ের পূর্বে তাঁদের মেলামেশা নিয়ে সমাজের নানা আলোচনা চলছিলো। মানুষের মুখও তো তাঁকে বাঁচিয়ে চলতে হবে। কিন্তু এ অবস্থা নজরুলের অসহনীয় ছিল - ......”। বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র দেরীতে বিয়ের অনুষ্ঠানের পর কলকাতার বন্ধুদের কাছে পৌঁছনোর কারণ হিসেবে বিপক্ষবাদীদের যুক্তি, তখন রেলপথ ও জলপথ পরিবহন কর্মীদের ধর্মঘট চলার জন্যই এমন হয়েছিল।

নজরুল-নার্গিস উপাখ্যানের যে মাত্র দু-তিনটি নথি জনসমক্ষে পাওয়া যায়, এই নিমন্ত্রণ পত্রটি তার মধ্যে বিশেষ কৌতুহলোদ্দীপক। কলকাতার বন্ধুদের কাছে যথাসময়ে না পৌঁছলেও সে পত্র ‘মোহম্মদী’ পত্রিকার সম্পাদক মোহম্মদ ওয়াজেদ আলীর হাতে যে করেই হোক পৌঁছয়, এবং তিনি তাঁর পত্রিকায় তা অবিলম্বে ছাপিয়ে দেন। ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণ পত্র’ শিরোনামে তা ‘বাঙালী’ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়। এই দীর্ঘ পত্রটি শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের গান ‘জগতের পুরোহিত তুমি’র প্রথম দু’ ছত্র দিয়ে। পাত্রের পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছিল এই ভাবে: “বর্ধমান জেলার ইতিহাস প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশ বিখ্যাত পরম পুরুষ, আভিজাত্য গৌরবে পরম গৌরবান্বিত, আয়মাদার, মরহুম মৌলবী কাজী ফকির আহমদ সাহেবের দেশ বিশ্রুত পুত্র মুসলিম কুলগৌরব মুসলিম বঙ্গের ‘রবি’ কবি সৈনিক নবযুগের ভূতপূর্ব সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম.........বাণীর দুলাল দামাল ছেলে, বাংলার এই তরুণ সৈনিক কবি ও প্রতিভাবান্বিত লেখকের নতুন করে নাম বা পরিচয় দেবার দরকার নেই।“ এমনও প্রচারিত হয় যে এর বয়ান নাকি স্বয়ং নজরুলের ‘মুসাবিদা’ করা।

পত্রিকায় প্রকাশিত এই নিমন্ত্রণ পত্র কলকাতার বন্ধুদের গোচরে অবশ্যই আসে। কেউ কেউ নজরুলকে চিঠিতে অভিনন্দন ও শুভকামনা জানালেও, অনেকেই তার ভাষ্য নিয়ে অখুশী ছিলেন। নজরুলের ঐ বর্ণনা, বিশেষ করে ‘মুসলিম বঙ্গের রবি’ উপাধি (যা তাঁকে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ দাবী করার তরলমতি প্রয়াস বলে অনেকে মনে করেন), এবং পত্রিকায় এমন নিমন্ত্রণ প্রকাশের ঔদ্ধত্য অনেকের কাছেই অসমর্থনীয় ছিল। মুজফ্ফর আমেদ (২৬শে জুন ১৯২১) এক ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ চিঠিতে নজরুলকে স্পষ্টতই তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে লিখেছিলেন: “পত্রখানা আপনারই মুসাবিদা করা দেখিলাম। পত্রের ভাষা দু’এক জায়গায় বড় অসংযত হইয়াছে। একটু যেন কেমন দাম্ভিকতা প্রকাশ পাইয়াছে। আপনার হাত দিয়া অমন লেখা বাহির হওয়া কিছুতেই ঠিক হয় নাই। আমার বড় ভয় হইতেছে যে, খান সাহেবের সংস্রবে থাকিয়া আপনিও না শেষে দাম্ভিক হইয়া পড়েন। অন্যে বড় বলিলে গৌরবের কথা হয়, আর নিজেকে নিজে বড় বলিলে অগৌরবের মাত্রাই বাড়িয়া যায়। ‘মোহম্মদী’কে বিবাহের কথা ছাপিতে অনুরোধ করাটা ঠিক হইয়াছে কি ? তাঁরা ত নিজ হইতেই ও খবর ছাপিতে পারিতেন। .... বাস্তবিক আমার প্রাণে বড় লাগিয়াছে বলিয়া আমি এত কথা বলিলাম। এই নিমন্ত্রণ পত্র আবার ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণ পত্র’ শিরোনামে ‘বাঙালী’তে মুদ্রিত হইয়াছে, দেখিলাম। ‘বাঙালী’কে এই নিমমন্ত্রণ পত্র কে পাঠাইল ?”

এ চিঠি যখন লেখা হল, ততদিনে অবশ্য গোমতি দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। নজরুল দৌলতপুর ছেড়েছেন, এবং সন্পূর্ণ তথ্য বোধহয় তখনও মুজফ্ফর আহমেদের অজানা। এর কিছুদিন পরে, সাপ্তাহিক ‘বিজলী’র ২২শে জুলাই সংখ্যায় ‘কবিবরের প্রতিবাদ’ শিরোনামে নজরুলের লেখা একটি চিঠি ছাপা হয়। ঢাকার বাংলা একাডেমী সম্পাদিত ‘নজরুল-রচনাবলী’র টীকায় বলা হয়েছে, “এই চিঠিটি নজরুল-নার্গিস বিবাহ সংক্রান্ত প্রতিবাদলিপি। নজরুল-বিবাহে আলী আকবর খান যে নিমন্ত্রণ-পত্র ছাপান, নজরুল-বন্ধুরা ধারনা করেছিল সেটা নজরুলের মুসাবিদায় ছাপা হয়। নজরুল ইসলাম তার প্রতিবাদ করেন।“ নজরুলের বিবৃতি ছিল: “প্রথমেই বলে রাখি, আমার এই ‘কবি-বরে’র অর্থ ‘কবি-শ্রেষ্ঠ’ নয়, এ ‘কবি-বরের’ মানে – ‘যে কবি বিয়ের বর’। কারণ, দিন কতক আগে আমি বাস্তবিকই – অন্তত ঘন্টা কয়েকের জন্যে ‘বর’ সেজেছিলুম, যদিও বরের এখনো বধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ নেই। যাক সে কথা, আমার ঐ ‘ত্রিশঙ্কু বিয়েতে’ শ্বশুরকুলের কর্তৃপক্ষগণ এক কাব্যিক নিমন্ত্রণপত্র ছাপিয়েছিলেন এবং সেটি চরমে গিয়ে পৌঁছেছে এই জন্যে যে, সেটা আবার আমার সাহিত্যিক ও কবি বন্ধুবর্গকে পাঠানো হয়েছে। সেটা একপ্রকার জামাই বিজ্ঞাপন বললেও হয়। ওতে আমার নামের আগে ও পিছনে এত লেজুড় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, কোনো চতুষ্পদ জীবেরই অতগুলো ল্যাজ থাকে না।“

নজরুল-নার্গিসের বিবাহ কি সম্পূর্ণ হয়েছিল ?

এই প্রশ্নের উত্তরেও মতান্তর আছে। নজরুলের উপরোক্ত ‘প্রতিবাদ’ পড়লে দেখা যাবে যে, নিমন্ত্রণপত্র তাঁরই রচনা, এ কেবল সে কথারই খন্ডন নয়। মূলত বিয়ের সামগ্রিকতাকেই যেন তিনি অস্বীকার করেছেন। বিয়ের অসম্পূর্ণতার ইঙ্গিত দিয়ে যে ‘ত্রিশঙ্কু বিয়ে’ শব্দ তিনি ব্যবহার করলেন, তা আবার বিরজাসুন্দরী দেবীর একটি রচনায়ও পাওয়া যায়। প্রায় বছরখানেক পরে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র শ্রাবণ ১৩২৯ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘নৌকাপথে’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে দৌলতপুর যাত্রা ও ঐ বিবাহ অনুষ্ঠানের বর্ণনা প্রসঙ্গে বিরজাসুন্দরী লিখেছিলেন, “বিয়ে তো ত্রিশঙ্কুর মত ঝুলতে লাগলো মধ্য পথেই, এখন আমাদের বিদায়ের পালা .....।“ স্বপক্ষীয়রা বলেন, যেহেতু বিরজাসুন্দরী স্বয়ং অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, তাই তাঁর সাক্ষ্য প্রমাণ করে যে বিবাহ পর্ব সম্পন্ন হয়নি।

মুজফ্ফর আহমেদ মুসলিম বিবাহ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, তা আধ্যাত্মিক নয়, মূলত হবু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একধরণের চুক্তি যার কিছু শর্ত থাকে। এই বিয়েতেও শর্ত ছিল, এবং নজরুল তা অনুমোদন করতে অস্বীকার করেন। তাছাড়া বিয়ের পরে সহবাস না হলে বিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে না। নজরুল বাসর রাত্রিও যাপন করেননি। মুজফ্ফরের মতে, “কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে যে সৈয়দা খাতুন ওর্ফে নার্গিস বেগমের বিয়ে (আকদ) হয়নি এ সম্বন্ধে আমি স্থির নিশ্চিত হয়েছি।“

কিন্তু বিপক্ষীয়রা বলেন, বিরজাসুন্দরীর প্রবন্ধ নজরুলেরই সম্পাদিত, তাতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া যায় না। তাঁরা বরং একটি চিঠির উপস্থাপনা করেছেন। এটি ‘বিয়ে’র কিছুদিন পরে নজরুল কান্দিরপাড়ে অবস্থানকালীন আলী আকবর খানকে লিখেছিলেন বলে দাবী করা হয়। এটিতে তিনি আলী আকবরকে ‘বাবাশ্বশুর’ সম্বোধনে শুরু করে লিখেছেন, “আপনাদের এ অসুর জামাই পশুর মত ব্যবহার ক’রে এসে যা কসুর করেছে, তা ক্ষমা করো সকলে, অবশ্য যদি আমার ক্ষমা চাওয়ার অধিকার থাকে।........আমার মান-অপমান সম্বন্ধে কান্ডজ্ঞান ছিল না বা ‘কেয়ার’ করিনি ব’লে, আমি কখনো এতবড় অপমান সহ্য করিনি, যাতে আমার ‘ম্যানলিনেসে’ বা পৌরুষে গিয়ে বাজে-যাতে আমাকে কেউ কাপুরুষ বা হীন ভাবতে পারে। আমি সাধ ক’রে পথের ভিখারী সেজেছি বলে’ লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্রআত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি।.....বাবা, আমি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। দোওয়া করবেন, আমার এ ভুল যেন দুদিনেই ভেঙে যায়, এ অভিমান যেন চোখের জলে ভেসে যায়।..... বাকী উৎসবের জন্য যত শীগগীর পারি বন্দোবস্ত করব।.......চির সত্য, স্নেহ সিক্ত, নুরু।“ বিপক্ষের মত, চিঠিতে আলী আকবরকে বাবাশ্বশুর বা বাবা এবং নিজেকে জামাই সম্বোধন, এবং পুরো চিঠির ভাষা ও বিষয়বস্তু প্রমাণ করে যে নজরুল মেনে নিয়েছিলেন তিনি বিবাহিত, নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত এবং তাঁর অভিমান যে ভুল সে কথা স্বীকার করতে প্রস্তুত। কিন্তু স্বপক্ষীয় গোষ্ঠী ঠিক এই কারণেই এ চিঠির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। যিনি বড়জোড় ‘মামাশ্বশুর’ হতে পারতেন, তাঁকে ‘বাবাশ্বশুর’ বা ‘বাবা’ সম্বোধন কতটা গ্রহণযোগ্য ? চিঠির সম্বোধনা বা ভাষ্য, কোনটাই নজরুলের প্রকৃতিগত স্বাভাবিক ভাষা নয় বলে তাঁদের দাবী। তা ছাড়া আরও একটি অসঙ্গতিও ছিল। এই চিঠি কবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে তা জানা যায় না। মুজফ্ফর আহমেদ যখন এ চিঠি দেখেন, তখন তার তারিখ ছিল ২৩ জুলাই ১৯২১, আর স্থান উল্লেখিত ছিল কান্দিরপাড়। কিন্তু ঐ তারিখে নজরুল ছিলেন কলকাতায়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত চিঠিতে তারিখ দেখা যায় ২৩শে জুন। মূল চিঠি কোথাও পাওয়া গেছে বলে জানা যায়নি। স্বপক্ষীয়রা আরও বলেন, যদি ধরেও নেওয়া হয় যে এই চিঠি নজরুলেরই লেখা, তবে তার শেষভাগের বাক্য প্রমাণ করে যে বিবাহের কিছু উৎসব ‘বাকী’ ছিল, অর্থাৎ বিবাহ অসম্পূর্ণ ছিল।

ঐ চিঠি যদি নজরুলেরই লেখা হয়, তা হলেও তিনি সম্ভবত ‘শীগগীর’ কোন ‘বন্দোবস্ত’ করেননি। ফলত আলী আকবর সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় এসে উপস্থিত হ’ন। তালতলা লেনের বাসায় নজরুলের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে মুজফ্ফর আহমেদও থাকতেন। তাঁর জবানীতে, “নজরুলের স্বভাব ছিল যে নূতন কেউ এলে চেঁচিয়ে আনন্দ প্রকাশ ক’রে সে তাকে গ্রহণ করত।.....সেদিন আলী আকবর খান আসাতে নজরুল কোন উচ্ছাস প্রকাশ তো করলই না, একবার বসতেও বলল না তাকে। শক্ত হয়ে চুপ ক’রে বসে থাকল সে। ..... খান সাহেব নিজেই নজরুলের পাশে তখৎপোশের ওপর বসলেন। তাঁর হাতে বেশ পুরু একতাড়া দশ টাকার নোট ছিল। খুব নীচু আওয়াজে কথা বলছিলেন তিনি, আর নোটের তাড়াটি নাড়ছিলেন-চাড়ছিলেন। অকারণে নাড়াচাড়ার মত দেখালেও আসলে ভাবখানা ছিল এই যে এই নোটের তাড়াটি তোমারই জন্যে।“ এই বিবরণীর সমর্থন বিরজাসুন্দরী দেবীকে লেখা নজরুলের একটি চিঠিতেও পাওয়া যায়, যেখানে তিনি লিখেছেন, “মা, আলী আকবর খান আমাকে নোটের তাড়া দেখিয়ে গেল।“ শেষমেষ নজরুলের কী প্রতক্রিয়া ছিল তা স্পষ্ট নয়, তবে মোটামুটি ধরা যায়, খান সাহেব যদি কোন একটা মীমাংসার অভিপ্রায়ে এই সাক্ষাতে উদ্যোগী হয়ে থাকেন, তবে তা ফলপ্রসু হয়নি।

দিন কাটতে লাগল। বছর গড়িয়ে গেল। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ লিখে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন, ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হল, তাঁর সম্পাদনায় ‘ধূমকেতু’র আবির্ভাব হ’ল। অচিরেই রাজদ্রোহের অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হলেন, জেলে অনশন করলেন, কিছু মাস পরে মুক্তিও পেলেন। কবি, সঙ্গীতকার, বিদ্রোহী হিসেবে তাঁর খ্যাতি প্রসারিত হ’ল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করলেন। প্রমীলা এলেন জীবনে। এক সন্তানের মৃত্যু, আরও দুই পুত্রের জন্ম হল। নজরুল গ্র্যামোফোন কোম্পানীতে গীতিকার-সুরকার হয়ে চাকরী করতে লাগলেন।

একদিন যখন তিনি এচ এম ভির স্টুডিওয় বসে কাজ করছেন, বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁকে একটি চিঠি এনে দিলেন। নার্গিসের লেখা। আগেও এসেছে তাঁর চিঠি, নজরুল উত্তর দেননি। এবারও চিঠি পড়ে শৈলজানন্দকে ফিরিয়ে দিলেন। শৈলজানন্দ বললেন, একটা উত্তর তো দিতে হবে। নজরুল অবিলম্বে লিখে দিলেন একটি গান, “যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তা’রে”। বললেন, এটাই তাঁর উত্তর।

এই গানটির রচনাকাল স্পষ্ট নয়। আগেই বলেছি, নার্গিস মোট চারটি চিঠি লিখেছিলেন, সুদীর্ঘ ষোল বছরে। নজরুল উত্তর দিয়েছিলেন মাত্র একটি, ১লা জুলাই ১৯৩৭ তারিখে। সে পত্রটিতেও স্থানের উল্লেখে আছে ১০৬ আপার চিতপুর রোড, গ্রামাফোন রিহার্সাল রুম, কলকাতা। তাই অনুমান করা যায়, ঐ গানটিও এই একই সময়ে রচিত। অর্থাৎ, কেবল গান নয়, একটি পত্রও অবশেষে নার্গিস পেয়েছিলেন নজরুলের কাছ থেকে। চিঠির শেষের দিকে লিখেছিলেন, “তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ ছিঠি হোক।“ এই চিঠির ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে আবেগ, অভিমান, অনুযোগ, আবার আশ্বাসও। কিছু নির্বাচিত উদ্ধৃতিমাত্র দিলাম:

“তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখের শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা ক’রে থাকো, তা হলে আমায় ভুল বুঝবে – আর তা মিথ্যা।

“তোমার উপর আমি কোন জিঘাংসা পোষণ করি না – এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা। কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি - তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না – আমি ‘ধূমকেতু’র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। .......ভুলে যেও না আমি কবি – আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। ..... আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জান বা শুনেছ, জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই।

“আমি কখনো কোন ‘দূত’ প্রেরণ করিনি তোমার কাছে। আমাদের মাঝে যে অসীম ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে, তার ‘সেতু’ কোন লোক ত’ নয়ই – স্বয়ং বিধাতাও হতে পারেন কিনা সন্দেহ। ..... আমি যদিও গ্রামোফোনের ট্রেড মার্ক ‘কুকুরের’ সেবা করছি, তবুও কোন কুকুর লেলিয়ে দিই নাই। তোমাদেরই ঢাকার কুকুর একবার আমাকে কামড়েছিল আমার অসাবধানতায়, কিন্তু শক্তি থাকতেও আমি তার প্রতিশোধ গ্রহণ করিনি-তাদের প্রতি আঘাত করিনি।

“সেই কুকুরদের ভয়ে ঢাকায় যেতে আমার সাহসের অভাবের উল্লেখ করেছ, এতে হাসি পেল। তুমি জান, ছেলেরা (যুবকেরা) আমায় কত ভালবাসে। আমারই অনুরোধে আমার ভক্তরা তাদের ক্ষমা করেছিল। নৈলে তাদের চিহ্ন-ও থাকত না এ পৃথিবীতে। .... তুমি রূপবতী বিত্তশালিনী, গুণবতী, কাজেই তোমার উমেদার অনেক জুটবে – তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। আমি কোন্ অধিকারে তোমায় বারণ করব-বা আদেশ দিব ? .....

“তোমার আজিকার রূপ কি, জানি না। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মত আমার হৃদয়বেদীতে অনন্ত প্রেম অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলে না। পাষাণ-দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদী-পীঠ। ....

“দেখা ? নাই হ’ল এ ধুলির ধরায়। .... তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালবাস, আমাকে চাও, ওখান থেকেই আমাকে পাবে। .... আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও পরম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাক, তা হলে তোমার মত ভাগ্যবতী কে আছে ? .....

“...... তুমি সুখী হও, শান্তি পাও – এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস কর, আমি তত মন্দ নই – এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ।“

চিঠি শেষ করেও আবার একটি PS. দিয়ে লিখেছেন, “আমার ‘চক্রবাক’ নামক কবিতা-পুস্তকের কবিতাগুলো পড়েছ ? তোমার বহু অভিযোগের উত্তর পাবে তাতে। তোমার কোনো পুস্তকে আমার সম্বন্ধে কটূক্তি ছিল।”

ঐ সময় নার্গিস ঢাকায় থাকতেন। তাঁর চিঠির বয়ান তো উপলব্দ্ধ নয়। তবে নজরুলের উত্তর থেকে তার কিছুটা আন্দাজ হয়তো করা যায়। নজরুল তাঁকে নিজের সম্বন্ধে ‘লোকের কথায়’ বিশ্বাস না করতে বলেছেন। বলেছেন আপোষের জন্য কোন বার্তাবাহক তিনি পাঠাননি। একদা তিনি নার্গিসকে ‘দেবীমূর্তি’তে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও নার্গিস স্বেচ্ছায় সেদিন ‘পাষাণ-দেবী’ হয়েছিলেন, এমন অনুযোগ করেও বলছেন সে বেদনার আগুনে তিনিই দগ্দ্ধ হয়েছেন, এবং সেই দহন থেকেই তাঁর বিদ্রোহী সৃজনী সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে নার্গিসের প্রতি তাঁর কোন ‘জিঘাংসা’ নেই। ‘আত্মহত্যা’র বিশ্লেষণও আছে যার উল্লেখ আগে করেছি। ‘চক্রবাক’ পুস্তকে যে অভিযোগের উত্তরের কথা কবি বলেছেন, তা সম্ভবত তাঁর ‘হিংসাতুর’ কবিতাটিকে নির্দেশ করে।

এই পত্রালাপের মধ্যে একটি ‘ঢাকার কুকুরের’ প্রসঙ্গও এসেছে। এর সম্বন্ধে একটি ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। ১৯২৮ সালে ঢাকার রাস্তায় একদিন রাতের অন্ধকারে নজরুল তাঁর কিছু অনুরাগীদের সঙ্গে পথ চলার সময় কয়েকজন দুর্বৃত্ত দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ক্যাপ্টেন নজরুলের বাহুবলের কাছে আক্রমণকারীরা অচিরেই পরাস্ত হয়ে পলায়ন করে। খুব সম্ভবত এই কান্ডেরই ইঙ্গিত এসেছে চিঠিতে। এখানে ‘তোমাদেরই ঢাকার কুকুর’ এই বর্ণনা লক্ষণীয়। নজরুল স্বপক্ষবর্গের অনেকেরই বিশ্বাস, ঐ আক্রমণের পিছনে আলী আকবর খানের ভূমিকা ছিল, যদিও তার সমর্থনে কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে বলে জানা নেই।

কিন্তু নার্গিস ও তাঁর পরিবারের কাছে চিঠিটির সব থেকে গুরত্বপূর্ণ বাক্য অবশ্যই: “তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। আমি কোন্ অধিকারে তোমায় বারণ করব-বা আদেশ দিব ?” যদিও নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকার পঞ্চদশ সংকলনে ‘কুমিল্লায় নজরুল-নার্গিস প্রসঙ্গ’ শীর্ষক নিবন্ধে শান্তিরঞ্জন ভৌমিক লিখেছেন যে বিয়ের অনুষ্ঠানের সে রাতের পর দুজনের “জীবনে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়নি”, কিন্তু অন্য কতিপয় বিবরণীতে আবার পাওয়া যায় যে নজরুলের ঐ চিঠি পাওয়ার পর সে বছরেই ৪ঠা নভেম্বর কলকাতায় এসে নার্গিস তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। দুই মামাতো ভাইকে নিয়ে নার্গিস শিয়ালদদহের কোন হোটেলে এই সাক্ষাৎ করেন বলে তাঁরই জবানীতে দাবী করা হয়েছে। তিনি নজরুলকে নাকি অনুরোধ করেন, তাঁকে প্রথমা স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে, কিন্তু ‘অপ্রস্তুত’ নজরুলের মত ছিল তা প্রমীলার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, এবং নার্গিসের ফিরে যাওয়া উচিত। তিনি এও নাকি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে শীঘ্র ঢাকায় গিয়ে তিনি কোন ব্যবস্থা করবেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। কোন কোন ভাষ্যে অবশ্য বলা হয়েছে যে ঐ সাক্ষাৎকারের সময়েই দুজনের ‘তালাক’ পর্ব সম্পন্ন হয়। আবার অন্য কয়েকটি বিবরণে পাওয়া যায় যে, নজরুল-নার্গিসের ‘তালাকনামা’ কলকাতায় সাক্ষীদের উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৩৭এর ডিসেম্বরে (ডঃ রফিকুল ইসলাম: নজরুল জীবনী, ১৯৭২), অথবা অন্যমতে, পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৮এর ২০শে এপ্রিল (এ.এফ.এম মাহবুবুর রহমান, দৈনিক জনকণ্ঠ, ২০২৩), এবং সেখানে নার্গিস উপস্থিত ছিলেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ, এই বিষয়ে হয়ত কিছু ধুসর এলাকা আছে।

স্বপক্ষীয়রা বলেন, যখন বিয়েই সম্পন্ন হয়নি, তখন তালাকের প্রশ্নই আসে না। বিয়ে হয়নি বলেই নজরুল চিঠিতে নার্গিসকে লিখেছিলেন যে তাঁর প্রতি কোন অধিকার নেই এবং তিনি স্বয়ম্বরা হলে আপত্তি নেই। যদি বিয়ে হয়েই থাকত, তবে নার্গিস ও আলী আকবরের পরিবার এত দীর্ঘ অপেক্ষার পরিসরে বিচ্ছেদের ও আর্থিক দাবীর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারতেন, যা তাঁরা করেননি। যদি ‘তালাক’ও হত, তবে নার্গিসের প্রাপ্য ‘মাহর’ নজরুল তাঁকে দিয়েছিলেন, এমন প্রমাণ বা সাক্ষ্য কোথাও পাওয়া যায় না। তবে এমন ‘তালাক’ কি করে সিদ্ধ হয় ? সর্বোপরি, বিরজাসুন্দরীর বর্ণনায় ‘ত্রিশঙ্কু বিয়ে’, এবং নজরুলের নিজের ভাষ্য ‘বর সেজেছিলুম’ প্রমাণ করে যে এই তথাকথিত বিয়ে তাঁরা স্বীকার করেননি।

বিপক্ষীয়রা বলেন, ঐ বিবাহ সিভিল ম্যারেজ ছিল না, কারণ আইনত নার্গিস তখন নাবালিকা ছিলেন। তাই আইনানুগ উপায়ে বিচ্ছেদ সম্ভব ছিল না। বিয়ে ছিল কাজীর পড়ানো ঐস্লামিক পদ্ধতিগত (যদিও এই মতও স্বপক্ষ মানেন না, আগেই উল্লেখ করেছি)। সেই জন্যই তালাকনামার প্রয়োজন ছিল। তাঁরা এও বলেন, নার্গিস ও নজরুল, দুজনেই দুজনকে ভাল বেসেছিলেন, সাময়িক ভুল বোঝাবুঝি দূর করে নার্গিস যন্ত্রণা সহ্য করেও একটা মীমাংসা করতে বহুকাল অপেক্ষা করেছিলেন। তা ছাড়া সেই সময়ে সামাজিক সম্মানেরও একটা গন্ডী ছিল। তাই নজরুলের চিঠির পর যখন তাঁরা বুঝলেন যে করণীয় আর কিছুই নেই, তখন তালাকই শেষ উপায় ছিল। নজরুলের প্রতি নার্গিসের অনুরাগবশতই এবং নজরুলের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে তাঁরা দেনমোহর বা মাহর পরিত্যাগ করেন।

কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ স্পষ্টতই বলেছেন বিয়ে হয়নি। নজরুল জীবনীকার রফিকুল ইসলামও মোটামুটি এই বক্তব্য সমর্থন করেছেন। অন্যদিকে বেগম সামসুন্নাহার, মো. ওয়াজেদ আলী, আব্দুল কাদির প্রভৃতির লিখন ইঙ্গিত করে যে বিয়ে হয়েছিল। কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দস্তাবেজ, যেমন নার্গিসের চিঠিগুলি, কাবিননামা বা স্বাক্ষরিত তালাকনামার মূল লিপিগুলির বা কোন অনুলিপির কোন হদিস পাওয়া যায়নি, যা হয়তো এই বিষয়ে আলোকপাত করতে পারত। বিষয়টি তাই বিতর্কিতই রয়ে গেছে।

সুদীর্ঘ ১৭ বছরের অপেক্ষার শেষে, কিছু মাস পরে, ১৯৩৮এর সম্ভবত ১২ই ডিসেম্বর ঢাকায় নার্গিস বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হন আজিজুল হাকিমের সাথে। আলী আকবর খান তখন ঢাকায় তাঁর পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রীর ব্যবসা করতেন। আজিজুল হাকিম তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও নিজ প্রতিভাগুণে একজন কবি, অনুবাদক ও সম্পাদক ছিলেন। তিনি আবার নজরুলের অত্যন্ত গুণগ্রাহীই শুধু ছিলেন না, তাঁর পরিচিত ও স্নেহধন্যও ছিলেন। নার্গিসের এই পরিণয় উপলক্ষে ১৯৩৮এর ১লা ডিসেম্বর নজরুল তাঁকে আরেকটি সংক্ষিপ্ত পত্রে লিখেছিলেন, “তোমাকে পেয়েও হারালাম। তাই মরণে পাবো – সেই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকব। প্রেমের ভুবনে তুমি বিজয়িনী, আমি পরাজিত। আমি আজ অসহায়। বিশ্বাস করো -আমি প্রতারণা করিনি। আমাদের মাঝে যারা এ দূরত্বের সৃষ্টি করেছে, পরলোকেও তারা মুক্তি পাবে না।“ সঙ্গে একটি কবিতাও ছিল: ‘তোমার প্রিয় যদি পাশে রয় / মোরও প্রিয় সে করিও না ভয় / কহিব তারে, আমার প্রিয়ারে আমারো অধিক ভালবাসিও।‘

এই বিচিত্র প্রেমপর্ব আর তার পরের সুদূরবিস্তৃত বিরহ-বেদনা নজরুল-সৃষ্ট কাব্যে ও সঙ্গীতে গভীর প্রভাব রেখে গেছে, তা বহু বিশ্লেষিত। শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের ভাষায়, “নজরুলের কবিতায় ও গানে নানা অনুষঙ্গে নার্গিস তাঁর সৃষ্টিশীলতায় সবসময় জাগ্রত ছিল। নজরুলের সৃষ্টিশীল রচনায় পূর্ণতার ক্ষেত্রে পরোক্ষে নার্গিসের অবদান অসীম।“ এ বিষয়ে আলোচনায় গেলে একটি ভিন্ন নিবন্ধ হতে পারে।

কাজী নজরুল ইসলাম সুবিখ্যাত। কিন্তু সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস আসার খানমের লোকপরিচিতি সীমায়িত। তবে তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিও সৃজনীতে পরবর্তী সময়ে প্রমাণ করেছিলেন যে তিনিও এক বহু গুণসম্পন্না রমণী ছিলেন। নজরুলের সঙ্গে পরিচয়ের সময়ে তিনি ছিলেন অল্পশিক্ষিতা, হয়তো নিজ সিদ্ধান্তে দ্বিধাগ্রস্তা। সতেরো বছরের নিদারুণ সময় তিনি যে স্থৈর্য ও আত্মস্থতায় অতিবাহিত করেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে উল্লেখনীয়। সময়ের কঠিনতাকে অতিক্রম করে তিনি নিজেকে উন্নততর করার প্রয়াস করেছিলেন। স্বেচ্ছায় ঘরে বসেই তিনি পড়াশোনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৩৫ সালে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন, এবং ১৯৩৭ সালে ইডেন গার্লস কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইতিমধ্যে আলী আকবর খান তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেখানে বাংলাবাজার এলাকায় একটি বাড়ী নির্মাণ করে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়। নার্গিস মামার পুস্তক ব্যবসাও পরিচালনা করতে শুরু করেন, সম্ভবত সে সময়ের একমাত্র সফল মহিলা ব্যবসায়ী।

নার্গিস সাহিত্য রচনায়ও লেখনী ধরেছিলেন। তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাস, ধর্মীয় গ্রন্থ এবং কবিতা ও গান রসিক পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে। বিচ্ছেদের বেদনা, জ্বালা ও হয়তো কিছুটা তিক্ততা তাঁর রচনাকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর উপন্যাস ‘তাহমিনা’য় তিনি বর্ণনা

  পরিনত বয়সে নার্গিস



করেছেন বীর রুস্তমের স্ত্রী তাহমিনার একাকীত্ব ও দুরূহ সংগ্রামের কথা, যাকে নিঃসঙ্গ করে তার স্বামী যুদ্ধ করতে চলে যায়। প্রচলিত ধারণা এই যে এই উপন্যাসটিই নজরুলকে ‘হিঁংসাতুর’ কবিতা রচনায় প্ররোচিত করেছিল। তেমনি ‘ধূমকেতু’ উপন্যাসে নার্গিস লিখেছেন কোন নারীর শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবনে কেমন করে ধূমকেতুর মত এক পুরুষের অযাচিত আবির্ভাব ও প্রস্থান সব কিছু ছাড়খার করে দিয়ে চলে যায়। ‘পথের হাওয়া’র নায়কের চরিত্রেও বোহেমিয়ান স্বভাবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। ১৯৮০ সালে নার্গিস যমুনা সাহিত্য গোষ্ঠী প্রদত্ত ‘বিদ্যাবিনোদিনী’ সম্মাননা লাভ করেন।

নার্গিসের সংস্পর্শে এসেছেন এমন কয়েকজনের বিবরণীতে, এবং তাঁর দেওয়া কতিপয় সাক্ষাৎকারে, এই নারীর স্বভাব ও চরিত্রের বিবিধ দিক উন্মোচিত হয়েছে। এই বিষয়ে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া রচিত ‘কবিপ্রিয়া নার্গিস: তোমাকে যেমন দেখেছি’ (অভিনন্দন, ১৯৯৬) প্রবন্ধ থেকে কিছু উধৃতি এখানে প্রাসঙ্গিক: “যখনই তাঁর সান্নিধ্যে যেতাম, তখনই আমার মনে হতো: আমি এক যন্ত্রণাদগ্ধ মহিয়সী নারী এবং ইতিহাসের কিংবদন্তী নায়িকার মুখোমুখি। নার্গিস যেভাবে এবং যে সকল বিষয়ে আলোচনা করতেন, আমি বিশ্বাস করি: সমকালে কোনো মুসলিম মহিলার সাথে তাঁর তুলনা হয় না। রূপের রাণী নার্গিস অতিথিপরায়ণা, রুচিশীল, পরিচ্ছন্নপ্রিয়তা, স্বল্পভাষিণী ছিলেন। তাঁর হাসি ছিলো মধুর, মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না।......নিজের হাতে রান্না করতেন, নামাজ পড়তেন এবং তিনি অবিশ্বাস্য রকম দায়িত্বশীল ছিলেন। স্বামীর প্রতি তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিলেন।.....নার্গিস প্রায় নিয়মিত নজরুলসংগীত শুনতেন। বিশেষ করে, নজরুলের বিরহদীর্ণ প্রেমাশ্রয়ী সংগীতমালা শুনে তাঁকে আমি নিরবে কাঁদতেও দেখেছি। নিজে ছিলেন সুকণ্ঠি । শৈশবে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানও গাইতেন, সে কথা নিজেই বলেছেন আমাকে।“

আজিজুল হাকিম ও নার্গিসের দুই সন্তান – পুত্র ডঃ ফিরোজ আজাদ ছিলেন ম্যানচেস্টারে চিকিৎসক, এবং কন্যা ডঃ শাহনারা অক্সফোর্ডে বাস করতেন। ১৯৬২ সালে আজিজুল হাকিমের মৃত্যু হয়। ১৯৭১ সালের প্রারম্ভে নার্গিস ম্যানচেস্টারে ছেলের কাছে চলে যান। সেখানেই ১৯৮৫ সালে ৮১ বছর বয়সে তাঁর দেহাবসান হয়, এবং নজরুল-প্রিয়াকে সমাধিস্থ করা হয়।