Next
Previous
1

স্মৃতির সরণীঃ শীলা পাল

Posted in


স্মৃতির সরণী



কিন্নর কৈলাস 
শীলা পাল



বিষণ্ণ ভোরের অস্পষ্ট আলোকে ওরা তিনজন ছায়ামূর্তির মতন দাঁড়িয়ে। একরাশ মন খারাপ নিয়ে বাসে উঠলাম। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে এলো ওদের মুখ। কানের কাছে রিনরিন করে বাজতে থাকলো গতরাতে ওদের গাওয়া গানের কলি - কলকাতার দিল দি সেম্বাদেমো মুসাফির ঘর যা।

ওরা তিন কিন্নরী। সুজাতা, সুমিতা আর ঊর্মিলা। আমাদের কল্পলোকের সঙ্গিনী। যখনই এ মহানগর বড়ো ক্লান্তি, বিরক্তি আর অবসাদে ভরে ওঠে, তখনই হিমালয়ের ডাক শুনতে পাই। ছুটে যাই। ঘুরে বেড়াই তার আনাচে কানাচে। সেবারে কিন্নর আমাদের হাতছানি দিয়েছিলো। 

উনিশ শতকে একাশির সেপ্টেম্বর। আমরা দিল্লী কালকা মেলে উঠে পড়লাম। কালকা থেকে গাড়িতে সিমলা। হিমাচল-এর রাজধানী। D.C. অফিস থেকে পারমিট নিতে হবে কিন্নর ঢুকতে গেলে। সব অফিস বন্ধ পুজোর জন্য। এতো ভীড় আর হৈ চৈ, সিমলা একটুও ভালো লাগলো না। আমরা রামপুরের দিকে এগিয়ে গেলাম ছয় সাত ঘন্টা মতন পথ। 

আমাদের সহযাত্রী মিঃ শর্মার সহায়তা চিরকাল মনে থাকবে। উনি S.D.G.M.-এর অফিস থেকে খুব সহজেই কিন্নর যাওয়ার পারমিট বার করে দিলেন। এই রকম নিভৃতে হিমালয়ের পাদদেশে ছোট্ট একটি শহরের কেন্দ্রে সুন্দর এক রাজবাড়ি সুবিস্তৃত ময়দানে রহস্যের মতন যেন অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপূর্ব কাঠের কারুকার্য করা রঙীন দুর্লভ কাঁচ দিয়ে তৈরী জানালা দরজা। 

কলেজ স্কুল হাসপাতাল কোর্ট কাছারি মিউনিসিপালিটি নিয়ে জমজমাট রামপুর। শহরের নীচ দিয়ে সরবে বয়ে চলেছে শতদ্রু। নদীর তীরে সুন্দর মন্দির। পথ ঘাট সাজানো ঝকঝকে। ঘন বসতি, দোকান পাট পুরনো সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে চলেছে। আমরা রাত কাটালাম মিউনিসিপালিটির গেস্ট হাউসে। পরের দিন ভোর ছ’টার সময় কল্পার বাসে উঠে বসলাম। কল্পার উচ্চতা নয় হাজার দুই শত আটত্রিশ ফুট। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। পাহাড়ের ধস নামায় রাস্তা বন্ধ। এগুলো যে ঘটতে পারে পাহাড়ি পথে, আমরা ধরেই রাখি।

দুর্গম পথে চলা ফেরা করার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। তবু চিন্তা হলো টাপরি রেস্ট হাউসে আমাদের কোনও বুকিং নেই। সমস্ত কিন্নর জেলার যোগাযোগ টাপরি। দু তিন ঘণ্টা পর টাপরিগামী বাস এলো। বেশ জমজমাট জায়গা। P.W.D.-র একটি রেস্ট হাউস আছে নদীর ওপারে। পারাপারের মাধ্যম ঝুলা। সন্ধ্যার একটু পরে এক মারোয়াড়ীর জীপ পাওয়া গেলো। রাত আটটা নাগাদ করছাম পৌরী পিয়ো হয়ে পৌঁছলাম চারপাশ সবুজ মখমলের মতন ঘাসে মোড়া অপূর্ব সুন্দর কল্পার বাংলোর সামনেই। আসন্ন পূর্ণিমার ভরা জোয়ারে তখন ঝকঝক করছে কিন্নর কৈলাস। 

ছায়া ছায়া সকালে পাহাড়ের ঢালে ঢালে গড়িয়ে আসা কল্পা মধুর হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে দেখা কিন্নর হয়তো অনেক পালটে গেছে। আমি সেই ফেলে আসা দিন গুলোর স্মৃতি নিয়ে বসে আছি। কী রূপ যে তার দেখেছি তা ভাষায় বর্ণনার অতীত!

সারাটা দিন ধরে ঘুরে বেড়াতাম গ্রামের ক্ষেতে ক্ষেতে। এত আপেল এর আগে আমরা কখনো দেখিনি। লালে লাল হয়ে যেন ফুল ফুটে রয়েছে। রোদ লেগে চকচক করছে ডিলিশাস রয়েল গোল্ডেন। গাছের নীচে রাশি রাশি স্তূপীকৃত আপেল। অপরূপ সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে কিন্নরীর দল বেণী দুলিয়ে পরিচর্যা করছে গাছের। পরদেশী দেখে কৌতূহলী চোখে এক পলক অবাক হয়ে তাকিয়ে আবার কাজে মন দিলো। পরনে সালওয়ার কামিজ আর মাথায় টুপি। এক একজন যেন রাজনন্দিনী। বনের পথে যেতে যেতে হঠাৎই কখন হাজির হয়ে গেছি একজনের আঙিনায়, জানি না। নমস্তে- শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি দু’হাত জোড় করে সুন্দরী এক কিন্নরী। নাম সুজাতা। ভীষণ ভীষণ ভালো লাগলো। কল্পাতে যে কটা দিন কাটিয়েছি ওরা তিন বন্ধু, সুজাতা, সুমিতা আর ঊর্মিলা আমাদের প্রায় ছায়াসঙ্গীর মতন ঘুরেছিলো।

এদের ঘরবাড়ি খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। প্রাচুর্য না থাকলেও কারুর অভাব নেই। আসলে অভাব বোধ নেই। তাই মুখগুলো যেন উজ্জ্বল সুষমা মাখা। মেয়েরা সালওয়ার কামিজ আর কোট পরে। পুরুষরা কম্বলের মতন চাদর দু’ভাঁজ করে পরে। উল নিজেরাই বোনে, পরিচ্ছদ নিজেরাই তৈরি করে। উৎসব অনুষ্ঠানে প্রচুর গহনা পরে। দামী পাথর, সোনার গয়না সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা পরে থাকে। তবে মণি মানিকের মতন হাসির অলংকার এদের সবার অফুরন্ত সম্পদ। তার সঙ্গে নাচ গান। কথায় কথায় ওরা গান তৈরী করে। সাধারণ সহজ কথাও সুরে সুরে অনায়াসে বলে যায়। ক্ষেতের কাজে, অলস মুহূর্তে, ভালো লাগার ঘোরে, মন খারাপের আর্তিতে কিন্নরের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ওদের গান। গ্রামের মেলাতে কিন্নর কিন্নরীদের মিলিত নৃত্যের অনুষ্ঠানে নির্বাচিত হয় ওদের বিবাহের পাত্র পাত্রী। মন দেওয়া নেওয়ার পালা হয় গানে গানে। সাথে মৃদঙ্গের তালে আর বাঁশির সুরে উদ্দাম উত্তাল হয়ে ওঠে নর্তকীরা। সেদিন মনে হয়েছিলো, সত্যিই যেন স্বপ্নলোক... স্বর্গ লোকের কাছে এসে পৌঁছে গেলাম। এই মধুর সুধামাখা কিন্নর আমাদের হৃদয়ে সেই যে গাঁথা হয়ে গেলো, আজও সমান উজ্জ্বলতায় সেই স্মৃতি মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। 

ওদের সমাজ ব্যবস্থা বড় অদ্ভুত। পুরুষদের ভূমিকা নিতান্তই গৌণ। চাষবাস সংসার গৃহকর্ম সবকিছুই মহিলারা করে। পুরুষেরা শুধু দারু খাবে আর ফূর্তি করবে। এই পুরুষ নিয়েই এদের গর্ব। যে যত মাতাল সে ততই 'আচ্ছা আদমী'। অনেক পাহাড়ের নিয়ম মতন এখানেও কন্যাকে পণ দিতে হয়। তাই এদের সমাজে মেয়েদের জননীরাই সুখী এবং ধনী। কন্যাপক্ষ যে পরিমাণ অর্থ চাইবে তা দিতে পাত্রপক্ষ সমর্থ হলে তবেই বিয়ে পাকাপাকি হয়। প্রেমের বিয়েতেও একই নিয়ম। সুজাতা আমাদের কাছে এইসব গল্প করতো ওদের সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে। ভালো লাগা, মন্দ লাগার কথাও বলতো। অত দিন আগে ওদের অনেক কিছু অপছন্দের ছিলো। জানি না আজকের সুজাতা সুমিতা ঊর্মিলারা কিছু পাল্টাতে পেরেছে কিনা। শুধু দারু খাওয়া আদমী তাদের অপছন্দের কিনা আর জানতে পারবোনা।

নিয়ম হলো, কোনও বাইরের লোক ইচ্ছা করলেই জমি কিনতে পারবে না বা বসবাসও করতে পারবেনা কিন্নরে। আগে কোনও কিন্নরীকে বিয়ে করতে হবে। ওদের ভীষণ গর্ব কিন্নরকে নিয়ে।

কল্পার বাইরে কোনও জগত আছে কিনা, তা নিয়ে খুব একটা জানার আগ্রহ ছিলো না ওদের। ওরা জন্ম নিয়েছে যেখানে, তার আকাশ বাতাস নদ নদী পাহাড় সব তাদের একান্ত নিজের। এক আত্মার মতন।

শীত কালে সারা কল্পা শুভ্র হয়ে যায়। বরফে ঢেকে যায় চারিদিক। ঠাণ্ডা নীরবতায় সারাদিন ভরে থাকে। এই নিস্তব্ধ ধূ ধূ করা শীতের তিনটি মাস বড় নিঃসঙ্গ লাগে। তাই এই অবকাশে বিয়ে সাদি সেরে নেয় ওরা। নাচগান হৈ হল্লা করে সারারাত কাটিয়ে দেয়। বনভোজনে মেতে ওঠে কিশোর কিশোরীর দল। নাচে গানে নীরবতার অসহ্য মুহূর্তগুলো সরবে ভরে রাখে। এই সময় আপেল আঙুর দিয়ে শীতের জন্য তৈরী করা মদ ভালো ভাবে কাজে লেগে যায়।

পরিচ্ছন্ন গ্রামটির একেবারে নীচে দেবালয়। মন্দিরটি খুব পুরনো। নারায়ণের বিগ্রহ আছে ভিতরে। হিন্দু আর বৌদ্ধদের সমান প্রভাব এখানে। দেবালয় থেকে একটু দূরে নীচু জাতির বাস। এখানে জাতিভেদ প্রকট। নীচ জাতির থেকে উচ্চ শ্রেণীর মানুষ খুব দূরত্ব রেখে চলে। মন্দির চত্বর থেকে বেরিয়ে আসার পর বাজার। সবজি, মাংস থেকে শুরু করে দরজির দোকান, হিমাচল সরকারের এমপোরিয়ামও আছে। উইভিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নেয় কিন্নরী মেয়েরা। এখান থেকে শাল রপ্তানি করা হয়। হাই স্কুল আছে। একদম উঁচুতে আছে হসপিটাল। সরকারি হসপিটাল। চিকিৎসার জন্য কোনও পয়সা খরচ হয় না। সুপরিকল্পিত কল্পাকে দেখে অত বছর আগে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। কত বছর আগে এরকম সুসভ্য সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, কে জানে।

একদিন গ্রামের শেষে একটা তোরণের মতন জায়গায় আসতে সুজাতা আমাদের বললো, মাথায় ঢাকা দাও। এটা নাকি গ্রামে কোন অপদেবতা ঢুকতে দেয় না। ভূত প্রেত বিশ্বাস করে ওরা খুব। নানারকম মন্ত্র আছে, যা ভূতেদের তাড়িয়ে দিতে পারে।

কিন্নর কৈলাসের পাশে তেইশ চব্বিশ ফুটের মতন উঁচু শিবলিঙ্গ আছে। কল্পাতে প্রতি মানুষ এঁর পুজো করে। মনে মনে সবাই বিশ্বাস করে, যে যতবার শিবলিঙ্গ দেখতে পাবে তার পরমায়ু ততো বেশী হবে। কী পরম বিশ্বাস! আমরাও দেখতে থাকতাম। ওঁর গায়ে দুটো কালো দাগ আছে। এরা বলেছিলো, শিবের পৈতে। সকাল থেকে সন্ধ্যা তিনবার রূপ পাল্টায়। সকালে শ্বেত শুভ্র, দুপুরে পীত আর সাঁঝবেলায় ধূসর হতে হতে একদম কালো। খালি চোখে যে শিবলিঙ্গ দেখতে পাবেনা বুঝে নিতে হবে তার জীবনের দীপ নিভে এসেছে। এরকম অনেক বিশ্বাস, অনেক সংস্কার নিয়ে এদের জীবন।

এখনও যেন দেখতে পাই মন্দির প্রাঙ্গণে দশেরার মেলা। যার প্রস্তুতি চলছিলো সারা পাহাড়ে। ঝর্ণার ধারে সুন্দরী তরুণীরা রঙীন জামাকাপড়ে সাজতে ব্যস্ত। প্রজাপতির মতন ডানা মেলে এখুনি বুঝি উড়ে যাবে হাওয়ায়। খুশীতে উচ্ছ্ল মন, এবার দেখা হবে সাথীদের সঙ্গে।

ওদের মেলার পোষাকে সাজিয়ে দিয়েছিলো আমাদের। চলে আসার আগের দিন সারারাত আমরা নাচে গানে আনন্দে সমস্ত পৃথিবী কিভাবে ভুলে গিয়েছিলাম জানি না। এখনও মৃদঙ্গ বাজে। বাঁশির সুর ভেসে আসে। সেই সুদূর অতীতের মোহমুগ্ধ দিনগুলো চোখের সামনে এসে স্বপ্ন দেখায়। আর কি কখনও ফিরে পাবো আমার কল্পলোক!!

ভোরের আবছা আলোতে ওরা আমাদের বিদায় জানাতে এসেছিলো। জলে ভেজা চোখ। সুজাতা, সুমিতা উর্মিলা। আমাদের চোখের জলে অস্পষ্ট হয়ে এলো ওদের মুখ। আমাদের বাস ছেড়ে দিলো। আস্তে আস্তে দূরে.. অনেক দূরে চলে গেলাম। আর কোনও দিন দেখা হবেনা। শুধু মনের মধ্যে সারাজীবন গাঁথা হয়ে রইল ওদের সৌন্দর্যে ভরা মুখগুলো ।