প্রচ্ছদ নিবন্ধ - পল্লববরন পাল
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
গেছোদাদাদিদিদের হ য ব র ল
পল্লববরন পাল
- গরম লাগে তো তিব্বত গেলেই পার
- তিব্বত? ধ্যাৎ, ও সব বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না
- কেন? সে আর মুশকিল কি?
- কি করে যেতে হয় তুমি জানো?
- তা আর জানিনে? কলকেতা ডায়মণ্ডহার্বার রানাঘাট তিব্বত – ব্যাস্ - সিধে রাস্তা,
সওয়া ঘন্টার পথ – গেলেই হল।
- তাহলে তোমার সেই সিধে রাস্তাটা আমায় বাতলে দিতে পার?
এই আকুল প্রশ্ন আমাদের সর্বকালীন ও সার্বজনীন। মোক্ষের সর্টকাট বা সিধে রাস্তার গুগুল রোডম্যাপ। লক্ষ্য করুন, উল্লিখিত কথোপকথনে আমাদের এই প্রশ্ন করার ঠিক আগের অবস্থাটা – আমরা কিন্তু বিশ্বাস করে ফেলেছি যে তিব্বতে গেলে সত্যিসত্যিই এই গরম থেকে চিরকালীন নিষ্কৃতি হবে এবং এটাও বিশ্বাস করেছি যে, কলকাতা থেকে ডায়মণ্ডহার্বার রানাঘাট হয়ে তিব্বতের ব্যবধান দুরত্ব মাত্র সোয়া ঘন্টার। কার কথা বিশ্বাস করলাম? – মাত্র পাঁচ মিনিট আগে আলাপ হওয়া এক বিড়ালরূপী তপস্বীর, যিনি আবার আসলে বিড়ালও নন, একটু আগে অবধি যিনি ছিলেন রুমাল, আমারই নিজের পকেটের একান্ত বিশ্বাসী নিজস্ব ঘাম মোছার রুমাল – অর্থাৎ এইরকম একজন ক্ষণে ক্ষণে অসম্ভব অসম্ভব রূপবদলকারী, যার এই রূপবদলের যুক্তি হিসেবে ‘চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, রুমালের মা’ও আমরা ঘাড় নেড়ে অকাট্য বলে মেনে নিয়েছি। এই সিধে রাস্তার কথাটা হিজিবিজবিজ বা কাকেশ্বর বললে আমরা থোড়াই বিশ্বাস করতাম। উল্টে তর্কাতর্কি বাধিয়ে দিতাম। যেমন ‘সাত দু-গুনে কত হয়’ ইস্যুতে অথবা বয়সের বাড়তি কমতির তত্ত্ব কিম্বা ন্যাড়ার গানের পদ নিয়ে তো বিস্তর ঝগড়া-ঝঞ্ঝাট করেছি। বিনা যুদ্ধে মেদিনী ছাড়িনি। কিন্তু বিড়ালের সঙ্গে কেন করলাম না? কারণ, বিড়াল অত্যন্ত বিদ্বান ঋষিতুল্য। বিড়াল তপস্বী। যে কেউ তো আর তপস্বী হয় না। সাধু-সন্ন্যাসীদের আমরা ত্রিকালজ্ঞ দূরদর্শী বলে জানি। যুগ যুগ ধরে বিশ্বাস ও ভক্তি করে আসছি। গৈরিক বসন আর রাবীন্দ্রিক দাড়ি দেখলেই আমাদের দু’হাত আপনাআপনি জোড় হয়ে কপালে এসে ঠেকে। তাই রাস্তা বাতলানোর প্রশ্ন আমরা যুগে যুগে সেই মাননীয় বিড়ালতপস্বীকেই করে চলেছি। আর তপস্বীও সর্বযুগেই এর উত্তরে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে একইভাবে বলে উঠেছেন –
- সে আমার কম্মো নয়। আমার গেছোদাদা যদি থাকত, তাহলে সে ঠিক ঠিক বলতে পারত।
- গেছোদাদা? সে আবার কে? থাকেন কোথায়?
- গেছোদাদা আবার কোথায় থাকবে? গাছেই থাকে।
গাছ মানেই জঙ্গল – নো ম্যানস্ ল্যান্ড - রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে। কালীঘাটে নইলে নবান্নে। হরিশ চ্যাটার্জী নয় মুরলিধর সেন। আলিমুদ্দিন নয় বিধানভবন। সুখচর নয় দেওঘর। মক্কা কিম্বা কৈলাশ। মন্দির নয় মসজিদ নইলে গির্জা। আশ্রম নয় দরগা। বিভিন্ন নামে বিভিন্ন জঙ্গল এলাকায় থাকেন এই সব গেছোদাদা নয় গেছোদিদি।
ইদানিং অবশ্য অনেক ইয়াব্বড়োবড়ো স্বর্ণকন্ঠহার ও দামি সিল্কঝিকমিক বস্ত্রশোভিত দেড়েল বুড়োটে গেছোদাদা গজিয়ে উঠছে এলাকায় এলাকায়। সবচেয়ে পপুলার ও সহজ জীবিকা। সাফল্য গ্যারান্টিড্। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের থেকে অনেক সুখসমৃদ্ধি এবং সম্মানীয় জীবিকা। এখন অবধি কেউ গণধোলাই খেয়েছে বলে শুনিনি। দশ হাতে ইনকাম, জিএসটি-ফিএসটি নেই, ট্যাক্স-ফ্যাক্সেরও বালাই নেই। আইটি-ইডি-সিবিআইরা এসে পায়ের মোজার ছেঁড়া অংশের থেকে উঁকি দেওয়া বুড়ো আঙুলের ধুলো ভক্তিভরে নিজেদের মাথার চুলে মিশিয়ে নেবেন – সাষ্টাঙ্গে প্রণামরত সকল ভক্তের মাথায় হাত ঠেকিয়ে শুধু বিড়বিড় করলেই হবে। বিভূতি কিম্বা পুরিয়া। অমাবস্যার রাত্রিশেষে সূর্যোদয়ের আগে গঙ্গাস্নান করে তেত্রিশবার ঈশানমুখো চোখ বুঁজে ‘ওং তৎসৎ’ উচ্চারণ করে কোঁত করে গিলে খেলেই সাত খুন মাপ। এনারা সকলেই কিন্তু মানুষের মোক্ষের সিধে রাস্তার ঠিকানা বিলক্ষণ জানেন আর সোয়া ঘন্টার গুগুলম্যাপের জিপিএস আঁকা খাতাটা সারাক্ষণ সুগন্ধি-বগলে চেপে বসে আছেন।
- তো কোথায় তার সঙ্গে দেখা হয়?
- উহুঁ, সেটি হচ্ছে না, সে হবার যো নেই
- সে কিরকম?
এই উত্তরটা গত বিরানব্বই বছরব্যাপী প্রায় প্রত্যেক বাঙালীর মুখস্থ। বিরানব্বই সংখ্যাটা কিন্তু ফেসবুকের মতো ভার্চুয়াল ঢপবাজি নয়। আসলে সুকুমার রায়ের হাতে গেছোদাদার জন্ম হয়েছিলো আজ থেকে ওই বিরানব্বই বছর আগেই তো, তাই বলছি – বিরানব্বই বছর ব্যাপী মুখস্থ। কিন্তু, ঐ – মুখস্থ পর্যন্তই, তার বেশি কিছু আর নয়। আমরা আজও কথাটার আসল মর্মার্থ বুঝিনি। বোঝার চেষ্টা করিনি। বোঝানোর চেষ্টাও অবশ্য করেননি কোনো বিড়ালতপস্বী।
- সে কী রকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারি। যদি মতিহারি যাও, তাহলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টিপুর। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেছেন কাশিমবাজার। কিছুতেই দেখা হবার যো নেই।
এই উত্তরটা আমাদের মুখস্থ হলেও সঠিক সময়ে আমরা ঠিক স্মরণে রাখতে পারি না। আর এর মর্মার্থও বোধগম্যতার পাঁচিল টপকাতে পারেনি। তাই আমরা নেশাগ্রস্তের মতো জোড়হাতে গিয়ে দাঁড়াই মন্দিরে জাগ্রত বিগ্রহের সামনে – ‘অমুকটা করে দাও বাবা’। কে বাবা? কোথায় বাবা? আমি যখন মন্দিরে বাবা-বাবা করছি, তখন যে উনি কানের হেডফোনে ‘নাচ মেরি বুলবুল’ শুনতে শুনতে হাইওয়ের ধারের ধাবায় বসে চুপিচুপি বিফ্টিফ্ প্যাঁদাচ্ছেন না – কেউ বুক ঠুকে বলতে পারবে কি? একইরকমভাবে মসজিদ থেকে পালিয়ে আর একজনের বাবা হয়তো টেবিলের উল্টোদিকে বসে কবজি ডুবিয়ে পর্কের ঝোলভাত খাচ্ছেন। দুই বন্ধু হয়তো মাঝেমাঝেই এরকম একসাথে টুক করে বেরিয়ে নন্দনে বা আইনক্সে সলমনের ঢিসুমঢিসুম দেখেটেখে পার্কস্ট্রিটে ট্রিঙ্কাসে বসে ... বেয়ারা, চালাও ফোয়ারা, জিন শেরি শ্যাম্পেন রাম ...
এই যে ক’দিন আগে কচুয়ায় এক বাবার মন্দিরে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেলেন কিছু ভক্ত – এ সম্পর্কেও তো আমার প্রশ্নের উত্তরে সেদিন এক তিলককাটা রণে-বনে-জলে-জঙ্গলের ভক্ত বললেন – বাবা তখন কচুয়ায় থাকলে কি আর ওদের মরতে হতো নাকি, বাবা ঠিক অলৌকিক উপায়ে বাঁচিয়ে দিতেন, কিন্তু বিপুল সংখ্যক ভক্তরা যখন কচুয়া গেছে বাবার দর্শনের অভিপ্রায়ে, তখন উনি চাকলা বা তেঘরিয়ার বনে জঙ্গলে ভক্তদের উদ্ধারে ব্যস্ত। ঐ, উলুবেড়ে-মোতিহারি-রামকিস্টিপুর-কাশিমবাজার - গেছোদাদা কেস। দর্শন বা গোদা বাঙলায় যাকে বলে পলিসি - সে তো একই।
আট বছরের বাচ্চা আসিফা বানো। শ্রীনগরের কাঠুয়া গ্রামের এক মন্দিরের মধ্যে একদল মানুষের ছদ্মবেশী জানোয়ার আটদিন ধরে মেয়েটির ওপর অকথ্য অত্যাচার করে তারপর পাথর দিয়ে থেঁৎলে থেঁৎলে তাকে হত্যা করে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে। এ খবর মুখবই মারফৎ ভাইরাল হয়েছে। সেখানে আমরা আসিফার নিষ্পাপ মুখের ছবিও দেখেছি। যে মন্দিরে এই ঘটনা ঘটেছিলো, সেটা কালীমন্দির। মা কালী তো মহাশক্তি – আদ্যাশক্তি মহামায়া – “দশ ভুজ দশ দিকে প্রসারিত, তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত, পদতলে শত্রু বিমর্দিত, পদআশ্রিত, বীরকেশরী, শত্রুনিপিড়নে নিযুক্ত”। ব্রহ্মাণ্ড নাকি চলে তাঁর নির্দেশে। তো সামান্য ঐ শিশু মেয়েটি তাঁর নিজের বাড়িতেই সুরক্ষা পেলো না কেন সেই আদ্যাশক্তির কাছে? মা তাঁর নিরীহ নিষ্পাপ শিশুসন্তানকে তাঁর চোখের সামনে আটদিন ধরে ঘটে যাওয়া অন্যায় থেকে কোনো লৌকিক বা অলৌকিক উপায়েও বাঁচাতে পারলেন না? হাসপাতালে রোগী মারা গেলে আমরা সগৌরবে ডাক্তার প্যাঁদাই, অথচ ঐ ফুটফুটে তাজা মেয়েটির মৃত্যুতে আমরা মা কালীকে – না না, প্যাঁদাপেঁদি উচিৎ কাজ নয়, আমি তা বলছিও না - কিন্তু নিদেন একটা কৈফিয়তও চাইলাম না, নিজের মনের মধ্যেও এ প্রশ্নটা তুললামনা কেন? কারণ, ঐ গেছোদাদা থিয়োরি। আমাদের স্থির বিশ্বাস, মা নিশ্চয়ই তখন অন্য কোনো ব্রহ্মাণ্ডের চলন নির্ধারণ করছিলেন। অন্য কোথাও সিক্সপ্যাক দেখাচ্ছিলেন। তাছাড়া দেশ জুড়ে লক্ষাধিক কালীমন্দির। ট্যুরে ট্যুরেই থাকতে হয় আমাদের দেশের বর্তমানে একনম্বর গেছোদাদার মতো। সব মন্দিরেই তাঁকে ঘুরেফিরে হাজিরা দিতে হয় – দেবত্বের চাকরি-শর্ত সম্ভবত। ঐ, উলুবেড়ে-মোতিহারি-রামকিস্টিপুর-কাশিমবাজার। যে যতো বড়ো গেছো, তার লিস্টি ততো বড়ো। তান্ত্রিক বা জ্যোতিষীদের মতো। তফাৎ শুধু, জ্যোতিষীরা কবে কোথায় কখন – তা নিয়মিত বিজ্ঞাপিত – মায়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা গোপনে – ঐ গেছোদাদার মতো।
এরকম শিউরে ওঠার মতো বিপর্যয়ের ঘটনা হররোজ ঘটছে – সারা পৃথিবী জুড়ে। আমরা কেউ কোনোদিন কোনো অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করিনি, কিন্তু আমরা সবাই জানি অমুকে দেখেছে চোখের সামনে। সেই অমুককে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে, সে নিজে দেখেনি, কিন্তু তমুকে যে দেখেছে, সেটা সে জানে। এখানেও গেছোদাদা তত্ত্ব। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো – আমাদের সকলেরই এই অলৌকিকে বিশ্বাসটা কিন্তু অটুট। এটাই যুগ যুগান্তর ধরে এই গেছোদাদা-তত্ত্বের ম্যাজিক। এই ম্যাজিকের ওপরেই ভরসা করে শয়তান রাজত্ব করে আমাদেরই মনের গভীরে এবং সমাজে, পৃথিবীর সর্বত্র।
আশারাম বাপু, গুরমিত রাম-রহিম সিং, রামপাল, প্রেমানন্দ, স্বামী অমৃতচৈতন্য, স্বামী সদাচারি, নিথয়ানন্দ, ভিমানন্দ প্রমুখ স্বঘোষিত ঈশ্বররা তো হযবরল পড়েননি। তাই গেছোদাদা থিওরি ওনাদের জানা ছিলো না। তাই ধর্ষণ হত্যা কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে ধরা পড়ে গেছেন ও অধুনা জেল খাটতে হচ্ছে। এরকম স্বঘোষিত আরো ঈশ্বর হাজারে হাজারে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাথা উঁচু করে। আরে বাবা, লোকের বিশ্বাস অর্জন করে ঠকানো যাদের জীবিকা, তাদের এরকম একাধিক ডেরা বা বাসস্থান রাখা বাধ্যতামূলক। উলুবেড়ে-মোতিহারি-রামকিস্টিপুর-কাশিমবাজার। পোলিটিক্যাল নেতা থেকে শুরু করে ঠাকুর দেবতা সকলেই এই প্রাথমিক ব্যাপারটা সন্তর্পনে মাথায় রাখেন। নইলে দৃষ্টিকটু হলেও বাধ্য হয়েই নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাড়ির বাইরে চব্বিশ গুন সাত নিশ্ছিদ্র একেসাতচল্লিশ-প্রহরার ব্যবস্থা করতে হয়।
প্রত্যেক গেছোদাদা বা দিদির আবার নিজস্ব নিজস্ব রোডম্যাপ অর্থাৎ ঐ উলুবেড়ে-মতিহারি-রামকিস্টিপুর-কাশিমবাজার থাকে। এক একজনের একাধিক ডেরা। বিভিন্ন শহরে বা দেশে। কারো তেঘরিয়া-কচুয়া-চাকলা-বারদি, কারুর তিলজলা-মেদিনীপুর-কৃষ্ণনগর-দিনহাটা, একটু বড়ো গেছোদাদার আবার দেওঘর-হেমায়েতপুর-সোনামুখী-কুড়িয়ানা-ঢাকা, আরো বড়োদাদার মুম্বাই-পুনে-অস্ট্রিয়ার ওয়াস্কো-আমেরিকার অরেগন – বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ গেছোদাদা?
গুগুল ঘাঁটলে বিভিন্ন ধর্মের এরকম লক্ষ লক্ষ গেছোদাদা ও তাঁদের একাধিক উলুবেড়ে-মোতিহারি-রামকিস্টিপুর-কাশিমবাজারের ডেরার উদাহরণ বার করা যায়।
আমাদের পুরানে তেত্রিশকোটি দেবদেবীর এরকম অন্তত তেত্রিশকোটি গুণ চার সংখ্যক ডেরা আছে – এই ব্যাপারটার অনুসন্ধান করতে হলে পুরাণবাগীশ পণ্ডিত চাই – যাদের থেকে আমার তেত্রিশকোটি হস্ত দূরে অবস্থান। তবে তাঁদের মধ্যে যাঁরা মেগাস্টার, কলকাতারই বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁদের অসংখ্য ডেরা বা মন্দির আছে – যাতায়াতে দেখতে পাই, মানুষজন ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ বুঁজে গদগদভক্তিতে প্রণাম ঠোকে। যেমন মা কালীর কথাই ধরা যাক। কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বরে তো নিজের নামেই আছেন, আবার বেনামে তারাপীঠ(তারা মা), বোলপুর কঙ্কালীতলা, শিবপুর (হাজারহাতকালী), বাঁশবেড়িয়া (হংসেশ্বরী), বোড়াল (ত্রিপুরাসুন্দরী), বউবাজার (ফিরিঙ্গিকালী), পুরুষোত্তমপুর সিঙ্গুর (ডাকাতকালী), চায়নাটাউন (চীনাকালী), বড়োবাজার (পুঁটেকালী), ঠনঠনিয়া (সিদ্ধেশ্বরী) – কালীঠাকুরের স্বনামে ও বেনামে আনুমানিক কয়েকলক্ষ ডেরার পুরো তালিকা প্রকাশ করতে অন্তত পঞ্চাশ বছর ধরে কয়েক শো মানুষের অনর্গল চব্বিশগুনসাত ঘন্টার গবেষণা দরকার – অত ধৈর্য, স্যরি, আমার নেই। আর এই কুড়ি-বিশ যুগে কারুরই অত সময়ও নেই।
কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন জাগে – গুষ্টির পিণ্ডি, এই এত এত নাম কেন? ছদ্মনাম কবি-সাহিত্যিকেরা রাখেন – যেমন সমরেশ বসু-কালকূট, সুনীল গাঙ্গুলি-নীললোহিত। এনাদের ব্যাপারটা বোঝা যায়। একটা বিশেষ ধরণের লেখার জন্য তাঁরা অন্যনাম ব্যবহার করছেন। সেও তো একজনের ছদ্মনামও একটাই। কিন্তু, এই মা কালীর কথাই ধরুন। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে উপস্থিতি কেন? আমাদের পরিচিত মহলে এই অভ্যেস যাদের, সমাজে তারা খুব সম্মানিত মানুষজন নন। ইদানিং আমরা আমাদের প্রায় প্রত্যেকেরই এলাকায় এরকম গেছো্দাদাদিদি দেখি, যাদের একাধিক নামে পরিচিতি। মূলত ঠগ জোচ্চোরদের এই একাধিক নামের অর্থ বোঝা যায়। আর একটা বিশেষ রকম আছে – ট্যাক্স বাঁচাতে একই মানুষ অনেক নামে টাকা জমায়। এদের মধ্যে অনেকে অবশ্য সমাজে বিশিষ্ট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু মা কালী? ওনার পিছনে তো ইডি আইটি সিবিআইদের লাগার সম্ভাবনা নেই যে, আইন ও সম্পত্তি বাঁচাতে নাম ভাঁড়াতে হবে! কালীর মতোই দুর্গা শিব কৃষ্ণ গণেশ ইত্যাদি বহু ঠাকুরের নাম ও ডেরার সংখ্যাও – এ বলে আমায় দ্যাখ তো ও বলে ...
ইদানিং আরো বিভিন্ন দেবদেবী জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন বিভিন্ন সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণে – সেই অনুযায়ী তাঁদেরও ডেরার সংখ্যা বাড়ছে ব্যাঙের ছাতার মতো। কারোর কালীঘাট-সিঙ্গুর-ডেলোপাহাড়-নবান্ন আবার কারুর আমেদাবাদ-গোধরা-দিল্লি-নিউইয়র্ক। কেউ বলেন – রণে বনে জলে জঙ্গলে..., কেউ বলেন – সততার প্রতীক, আবার কেউ বলেন – অচ্ছে দিন।
সম্প্রতি এক গেছোদিদি জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থা করেছেন। একেবারে সরাসরি। ফোন তুলুন, কথা বলুন। কিন্তু শোনা যাচ্ছে সেখানেও ওই গেছোদাদা তত্ত্ব। ওই যে, গেছোদাদার দর্শন পেতে গেলে যা করণীয় বলে লেখা আছে –
- আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই; তারপর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তারপর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তারপর হিসেব করে দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দাদা কোথায় থাকবে। তারপর হিসেব করে দেখতে হবে...
হে ভক্তগণ, আপনারা ‘হ্যালো হ্যালো’ বলতে থাকুন। যুগ যুগ ধরে বিশ্বাস রাখুন। আজ কাল পরশু বা আগামী দু’হাজার বছরে যদি নাও হয়, অচ্ছেদিন একদিন না একদিন নিশ্চয়ই আসবে। গেছো দাদাদিদিরাই তো ভরসা আমাদের।
জয় শ্রী গেছোদাদা।
জয় শ্রী, থুড়ি শ্রীমতী, ধ্যাৎ... মিস্ গেছোদিদি।
আমি বলি – জয় শ্রী সুকুমার রায়।