প্রবন্ধ - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
শ্রীমান কমলাকান্ত উবাচ
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী
আমাদের প্রবাসী বাঙালী ক্লাবে নতুন ম্যানেজিং কমিটি ঠিক করেছে এবার পুজোয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি কমলাকান্তের ওপর নাটক মঞ্চস্থ করা হবে বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মদিনে। নাটকটি শুধু “কমলাকান্তের জোবানবন্দী”র ওপর মঞ্চস্থ হবে না, পুরো কমলাকান্তের চরিত্রের ওপর আলোকপাত করা হবে। বুদ্ধিজিবী কমলাকান্ত, দার্শনিক কমলাকান্ত, লেখক কমলাকান্ত, খাদ্যবিলাসী কমলাকান্ত, অলস কমলাকান্ত ইত্যাদি কমলাকন্তের সকল দোষ-গুনেরই ৩৬০ ডিগ্রী পর্যালোচনা এই নাটকের মাধ্যমে আজকের দর্শকের কাছে তুলে ধরা হবে।
আমাদের ক্লাবে প্রতিবছরই বারো মাসে আঠারো পার্বণ। প্রতিবছর রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ আর নেতাজী’র জন্মদিন পালন করা হয় এবার যুক্ত হলেন ঋষি বঙ্কিম। আসলে প্রবাসে রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালনের পর একটা শূন্যতা’র সৃষ্টি হয় যেটার পরিপূরক হিসেবে এবার ঋষি বঙ্কিম জন্মোৎসব পালন।
যাইহোক দ্বায়িত্বটা যখন নিতেই হলো তখন কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম। বইয়ের তাক থেকে বঙ্কিম রচনাবলীর দ্বিতীয় খণ্ডটাকে ধুলো-টুলো ঝেড়ে নামানো হলো। রাতের খাবার তাড়াতাড়ি সেরে কমলাকান্তকে নিয়ে বসলাম।
কমলাকান্ত আর আফিম একে অপরের পরিপূরক। তাই স্ত্রী’র শ্যেন দৃষ্টিকে বোকা বানিয়ে একটা নরম পাণীয়ের সঙ্গে দশরথের বড় পুত্রকে একটি পানপাত্রে নিমজ্জিত করে সেই মিশ্রণটাকেসঙ্গী করে আমার লেখার টেবিলের সামনে থাকাআমার অতি প্রিয় ঘুরন্ত চেয়ারটাতে বসলাম।
গিন্নীকে বললাম আজ আমাকে একটু রাত জাগতে হবে। আমার এই দেশ উদ্ধার কর্মকাণ্ডের সাথে যথেষ্ট পরিচয় হবার ফলেগিন্নী আগের মতো আমায় এখন আর বিব্রত করেন না।
একটু গভীর রাতে আমার লেখার টেবিলের পরিবেশটা বেশ মধুর। রাতে শব্দদূষণ কমে এলে টেবিল ল্যাম্পের আলো-আঁধারিতে আমার মনঃসংযোগটা ভাল হয়। কালি, থুড়ি, কম্পিউটার-কলম-আর মন এদের মধ্যে coordination-টা বেশ ভালো হয়।
টেবিলে রাখা মিশ্রণটিতে একটি লম্বা চুমুক দিয়ে শ্রীভীষ্মদেব খোশনবীস কমলাকান্তের যে মুখবন্ধ লিখেছেন তাতে মনোনিবেশ করলাম।
“কমলাকান্তকে লোকে পাগল বলিত। সে কখন যে কি বলিত, কি করিত, তাহার স্থিরতা ছিল না। লেখাপড়া না জানিত, এমত নহে…”
কমলাকান্ত সম্পর্কে যতই পড়া এগোতে থাকল ততই যেন এই চিরত্রটিকে ভালবেসে ফেলতে লাগলাম। আনন্দের আতিশয্যে কখন যে গেলাসের পাণীয়টির প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটিয়ে দিত্বীয় পর্যায়ে চলে এসেছি সেটা নিজেই জানিনা। ইতিমধ্যে কমলাকান্তের দপ্তরটির ভেতরে ঢুকে পড়েছি। প্রতি মুহূর্তে তার লেখার সেই অনির্বচনীয় দার্শনিকতার স্বাদ আমার মুদ্ধ করে তুলতে লাগল।
এর মধ্যে আলো আঁধারির রৌদ্রছায়ায় মনে হলো কেঊ যেন আমার চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখ তুলে তাকাতেই দেখি অশীতিপর এক বৃদ্ধ খালি গায়ে একটি সাদা উড়নি জড়িয়ে আমার ঠিক ডান পাশে দন্ডায়মান। পড়নে হাঁটু পর্যন্ত সাদা খেটো ধুতি। উড়ুনিটির ফাঁক দিয়ে তাঁর কাঁধে ঝকঝকে সাদা উপবীতটি দেখা যাচ্ছে। এই আলো আঁধারিতেও তাঁর দুধে-আলতা গায়ের রঙের আভাস পাচ্ছি। ঋজু শরীরটির মধ্যপ্রদেশ ঈষৎ স্ফীত।
২/-
(২)
মুহূর্তেই চিনতে পারলাম। বুঝতে পারলাম শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী এখন আমার সামনে দণ্ডায়মান।
কোনওরকম ভনিতা ছাড়াই, জলদগম্ভীর স্বরে তিনি আমাকে শুধোলেন, “আমাসম্পর্কে চর্চা হইতেছে বুঝি?”
অস্বীকার করবার উপায় নাই। একেবার বমাল সমেত ধরা পড়েছি।
বলতেই হলো, “আজ্ঞে হ্যাঁ”।
“আমার সম্পর্কে ওই খোশনবীস কতটুকুই বা জানে। সে ব্যাটা তো আমার দপ্তরটি চুরি করিয়া স্বনামে বঙ্গদর্শণ পত্রিকার সম্পাদকের নিকট বিক্রয় করিয়া দু-পয়সা কামাইয়া আমাকে বঞ্চিত করিয়াছে।”
“আজ্ঞে তাই নাকি?”
“হ্যাঁ, আজিকার দিন হইলে প্লেগারিজম জগতে ইহা সর্ববৃহৎ স্ক্যাম বলিয়া বিবেচিত হইত। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইহা ভাইরাল হইয়া যাইত।”
আমি যৎপরনাস্তি অবাক হলাম। এই ঊনবিংশতি শতাব্দীর ব্রাহ্মণ সোশ্যাল মিডিয়ারও খবর রাখে!আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবটি কমলাকান্তের নজর এড়াল না।
“কি ভাবিতেছ বৎস্য, আমি তোমাদের ফেসবুক, হোয়াটসয়্যাপ, টুইটার, স্ন্যাপচ্যাট ইত্যাদি সকল বিষয়েই আলোকপ্রাপ্ত হইয়াছি।”
আমি আরও অবাক হয়ে মূর্খের মতো জিজ্ঞেস করে বসলাম, ”কি ভাবে?” প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারলাম যে অসাধারণ বুদ্ধিধারী এই ব্রাহ্মণটিকে অর্বাচীনের ন্যায় এই প্রশ্নটি করা একেবারেই উচিৎ হয়নি।
তবে কমলাকান্ত আমার মূর্খামিকে বিশেষ আমল না দিয়ে মহাভারত সিরিয়ালের শ্রীকৃষ্ণের সেই সবজান্তা বাঁকা হাসিটা হেসে বলল, “স্বীকার করিতে আমার কুন্ঠা নাই যে এই বিষয়ে জ্ঞান লাভের জন্য আমি প্রসন্ন গোয়ালিনীর নিকট অতিমাত্রায় ঋণী।”
গল্পের গন্ধে আমি ঝুলে পড়লাম বলা যায়।
কমলাকান্ত আমার দিকে একটু কৃপা দৃষ্টি দিয়ে বলতে থাকে, “শুনো বৎস্য, একদা আফিমের আকাল পড়িয়াছিল। এক-আধ ভরি আফিমের জন্য চতুর্দিকে ত্রাহি-ত্রাহি রব। আমার রাতে ঘুম নাই, দিনে শরীরে বল পাই না, চারিদিকের জগৎ বিষময় ঠেকিতেছে। সরকারি আবগারি বিভাগের রক্তচক্ষুর জ্বালায় আমার এতদিনকার অতি আদরের তোয়াজের নেশাটির সমাধি আসন্ন লাগিতেছে। কেহ কহিল আফিমের বদলে সুরার নেশা ধর। ধরিলাম। কিন্তু শান্তি পাইলাম না। সসেমিরা অবস্থায় আবগারি বিভাগের এক ডেপুটির কাছে আধভরি আফিম ভিক্ষা করিতে গিয়া লাঠ্যাষৌধির সন্মুখীন হইয়াছিলাম।”
আমি রাত্রির সেই আলো-আঁধারিতেও কমলাকান্তের চোখে এক বিন্দু অশ্রু কালের কপোলতলে শুভ্রসমুজ্জ্বল মক্তোর মতো চমকাচ্ছে দেখতে পেলাম।
একটু দম নিয়ে কমলাকান্ত বলে চলে, “আমার এই অর্ধমৃতপ্রায় অবস্থায় একদিন প্রসন্ন আসিয়া উপস্থিত। আমার জীবন্মৃত অবস্থা দেখিয়া সে প্রশ্ন করে ঠাকুর তোমার এ-দশা কেন। আমার নিকট হইতে সমস্ত অবগত হইয়া প্রসন্ন আমায় আশ্বাস দিয়া বলে যে ঠাকুর তুমি অতি সত্বর আফিম নামক এই স্থুল নিকৃষ্ট নেশা পরিত্যাগ কর। আমি তোমাকে একটি অতি উচ্চাঙ্গের নেশার সন্ধান দিতেছি। সমস্ত জগৎ আজি এই নেশার আস্বাদে আহ্লাদিত। তুমিই বা ঠাকুর ইহা হইতে বঞ্চিত হইবে কেন। এই বলিয়া সে আমাকে তোমাদিগের হোয়াটসয়্যাপ এবং ফেসবুক নামক দুইটি নেশার সন্ধান দেয়। আর তাহারপর আমি চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করিয়া এই নেশাতে ডুবকি মারিতেই এই দেব প্রদত্ত নেশাটি আমায় যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াইয়া ধরিয়া আমায় একান্ত আপন করিয়া লইল।”
(৩)
আমার বাকরহিত অবস্থা দেখিয়া কমলাকান্ত একটু মৃদু হাসিয়া আবার শুরু করে, “এই নেশা সত্যই দেব প্রদত্ত। এই নেশার ক্ষয় নাই, লয় নাই, স্থান-কালের বিচার নাই। শ্মশানে-মশানে, বিদ্যালয়ে-মন্দিরে-মসজিদে-গীর্জায়-শয়ণ কক্ষে, আদালতে-কারাগারে, হাসপাতালে-মর্গে জগতের সকল সম্ভাব্য স্থলে, অন্তরীক্ষে ব্যোমযানে, রেলগাড়িতে, গো-শকটে সর্বস্থলে এই নেশার আস্বাদ লওয়া যায়। ইহার জন্য আবগারি বিভাগের রক্তচক্ষুর পরোয়া নাই।”
নেশাগ্রস্তের ন্যায় কমলাকান্ত বলিয়া চলে,”এই নেশার প্রচণ্ডতা অতুলনীয়। ইহার ফলস্বরূপ আমি দিনমানে, রাত্রি জাগরণে সতত জঙ্গম। ইহার আখড়া সারা পৃথিবী ব্যাপী। এই নেশার www জালের জগতে আমি নিজেকে পূর্ণ নিমজ্জিত করিয়াছি।
অহো… কি হেরিতেছি স্বপ্নসম এই জগতে!! ইধার কা মাল উধার করিবার নেশায় নেশাড়ুগণ রাত্রি জাগরণ করিয়া রক্তবর্ণ চক্ষু লইয়া সতত শ্যেণ দৃষ্টিতে সকল পোষ্টের দিকে চাহিয়া আছে যাহাতে তৎকাল সেইসকল পোষ্ট অপর কেহ অন্য নেশাড়ুকে পাচার করিবার পুর্বেই তিনি এই সৎকার্যটি তিনি সর্বাগ্রে করিতে পারেন। অপর কোন নেশাড়ু’র পূর্বে এই মাল পাচার না করিতে পারিলে সেই পোষ্টের কোনো মূল্য নাই, কোন like নাই। বরং অন্য নেশাড়ুগণ দুয়ো দিবে এবং ঊহা অতীব অপমানকর বলিয়া বিবেচিত হইবে। ইহাতে নেশা ছুটিয়া যাইবার প্রবল সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে।“
আমার হতচকিত অবস্থায় হাঁ-করা মুখে এক টুকরো কাঁচা সুপুরি ঢুকিয়ে দিয়ে কমলাকান্ত বলে চলে, “হোয়াটসয়্যাপ আর ফেসবুক নামক নেশার ফাঁসে আজ সমস্ত জগৎ আটকা পড়িয়াছে। আজ আমি বুঝিতে পারিয়াছি এই উচ্চমার্গের নেশাটি চক্রব্যুহের ন্যায়। এই নেশার কবলে একবার পড়িলে ইহা হইতে কাহারও মুক্তি নাই। ইহা তোমাদিগের ঐ হকিং সাহেবের কৃষ্ণ গহ্বরের ন্যায়। অতএব দিবা-রাত্রি সকল কর্ম ত্যাগ করিয়া আজ সমস্ত জগতের মনুষ্য সকল তাহাদের মস্তক অবনত করিয়া দলমত, জাতি-ধর্ম, স্ত্রী-পুরুষ, খোকা-খুকুসহ সকল মনুষ্য সম্প্রদায় এই নেশার নিকট তাহার পদতলে আত্মসমর্পন করিয়াছে। সকল মনুষ্যকে একত্রিত করিয়া একই ছত্রের নিচে লইয়া আসিবার এই মহান কার্যটি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ পারেন নাই, ভগবান যীশু পারেন নাই, মহম্মদ পারেন নাই এমন কি আলেকজান্ডার সাহেবও হাল ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। এই কারনে আমি জুকেরবার্গ মহাশয়কে সর্বশক্তিমান মহাপুরুষ বলিয়া মান্য করিয়া থাকি। এই কারনে আমার গৃহদেবতার সিংহাসনের ওপরে ওনার একটি হাফ-বাষ্ট চিত্র বাঁধাইয়া রাখিয়া প্রতিদিন ধূপধুনো দিয়া অঞ্জলি প্রদান করিয়া থাকি। এই প্রসঙ্গে একটি কথা তোমাকে শুনাইতে চাই। মনে রেখ কোন ভিড়ের মধ্যে যদি কোনো মনুষ্যকে তুমি উচ্চশির অবস্থায় দেখিতে পাও তবে তাহাকে নেশা মুক্ত ভাবিবার কোনো কারন নাই। ইহার বদলে তুমি অতি অবশ্যই জানিবে যে সেই মনুষ্যটির পৃথিবী ব্যাপী www মাকড়সার জালে জড়াইবার জন্য যে সংযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন তাহাতে কিছু বিঘ্ন ঘটিয়াছে, হয় সে প্রয়োজনীয় রৌপ্য মুদ্রা জমা করে নাই অথবা তাহার যন্ত্রে কোন প্রকার যান্ত্রিক গোলোযোগ ঘটিয়াছে।“
আমিও এই সকল নেশার আস্বাদ নিয়ে থাকি। তবে এত গভীর ভাবে কখনও ভেবে দেখিনি। তবে হঠাৎ করে একটা কথা মনে পড়ল। ইস্কুলে আমাদের বাঙালী মহাপুরুষদের জীবনী পড়াবার দ্রুতপঠন ক্লাসটি আমাদের হেডমাষ্টার মহাশয় স্বয়ং পড়াতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে এই মহাপুরুষদের জীবনী ছাত্রদের চরিত্র গঠনে সাহায্য করে আর এই কারণেই তিনি তাঁর সকল ব্যস্ততার মধ্যেও এই দ্রুত পঠনের ক্লাসটি তিনি নিজের দায়িত্বে রেখেছিলেন।
এই ক্লাসে তিনি একবার রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী পড়াতে-পড়াতে বলেছিলেন যে সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন অত্যন্ত বিদগ্ধ এমন একজন মহাপুরুষ ছিলেন যে তিনি কোনদিনই কারো কাছে মাথা নত করেননি এমনকি প্রবল প্রতাপ সম্পন্ন ইংরেজ সরকার বাহাদুরের কাছেও নয়!
আমাদের ক্লাসে পাগলা দাশুর ন্যায় একজন ছাত্র ছিল, তার নাম ছিল পল্টু।
(৪)
রাজা রামমোহন রায়ের এই প্রতিভার কথা শুনে পল্টুদাঁড়িয়ে উঠে প্রতিবাদ করেছিল। সে বলেছিল সে নাকি এমন একজনকে জানে যার কাছে রাজা রামমোহন রায়কেও তাঁর জিবীত অবস্থায় মাথা নত করতে হয়েছিল এবং একবার নয় অনেকবার।
রাশভারী হেডমাষ্টার মহাশয়সহ সমস্ত ক্লাসের সবাই নিশ্চুপ।পরিস্থিতিটা যাকে বলে যাকে বলে একটা সূঁচ পড়লেও শব্দ শোনা যাবে গোছের। আমাদের কারুর মুখে কোনো কথা নেই। আমরা সবাই সভয়ে হেডমাষ্টার মহাশয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখবার জন্য। বোঝা যাচ্ছে হেডমাষ্টার মহাশয় ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভাবে উত্তজিত। কিন্তু নিজের সমস্ত উত্তেজনা সামলে তিনি পল্টুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,”আচ্ছা তুই যখন বলছিস তখন তোর কাছ থেকেই সেই মহাপুরুষটির নামটি আমরা সকলে শুনে নি যাঁর কাছে স্বয়ং রাজা রামমোহন রায়কেও মাথা নত করতে হয়েছিল!”
এতটুকু না ঘাবড়ে মনে পড়ছে পল্টু সেদিন আমাদের রাসভারী হেডমাষ্টার মহাশয়কে বলেছিল,”মাষ্টারমশাই, আমি এমন একজনকে জানি যাঁর কাছে শুধু রাজা রামমোহনকেই নয় সমস্ত মহাপুরুষকেই যুগে যুগে মাথা নত করে আস্তে হয়েছে, হচ্ছে এবং হবেও।“
ধৈর্য আর ধরে রাখতে না পেরে হেডমাষ্টার মহাশয় পল্টুকে ধমকে বললেন,”আর হেঁয়ালি না করে সেই মহান ব্যক্তিটির কথা আমাদের তুই তাড়াতাড়ি বল।“
পল্টু বলেছিল।
পল্টু তারপর আর কোনো হেঁয়ালি না করেই বলেছিল,”আজ্ঞে মাষ্টারমশাই, রাজা রামমোহন রায় যখন সেলুনে মাথার চুল কাটাতে যেতেন তখন তাঁকে অতি অবশ্যই নরসুন্দরের কাছে মাথা নোয়াতে হত।“
আমরা সবাই আবার কয়েক মূহুর্তের জন্য বোবা হয়ে গেছিলাম। সমস্ত ক্লাসে সে এক অসহ্যকর পরিস্থিতি। অবশেষে রাশভারী গম্ভীর হেডমাষ্টার মহাশয় হো হো করে হেসে উঠতেই সারা ক্লাস যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে সেই হাসিতে যোগ দিল।
ঘটনাটা মনে পড়তেই সেটা শোনাবার জন্য ঘাড় ঘোড়াতেই কমলাকান্তকে আর দেখতে পেলাম না। খোলা জানালাটার দিকে তাকাতেই দেখি পুব আকাশে রং ধরেছে। আমাদের সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটাতে একটা কোকিল থাকে। শুনতে পেলাম সে কুহুস্বরে সে নতুন দিনের আগমন ঘোষনা করছে। মনে পড়ে গেল কমলাকান্তের সেই বিখ্যাত উক্তি,”তুমি বসন্তের কোকিল, শীত, বর্ষার কেহ নও।“
তাহলে এতক্ষণ কমলাকান্ত আমাকে যা শুনিয়ে গেল তা কি সবটাই আমার পাণীয়ের কল্যাণে! কিন্তু কমলাকান্তের যুক্তিটা তো একেবারে ফেলনা নয়।
ফেসবুক আর হোয়াটসয়্যাপ নেশার কল্যাণে সারা জগৎ সত্যি সত্যিই তো আজ ভগবান জুকেরবার্গের পদতলে মাথানত করে দণ্ডায়মান!