0

সম্পাদকীয়

Posted in






বিচারের আশায় ইতিমধ্যে দু'মাস অতিক্রান্ত। প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রিতার যাবতীয় আয়োজন চূড়ান্ত হয়েছে নিয়ম মেনেই। প্রাথমিকভাবে দোষীদের চিহ্নিত করা এবং তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্বে যাঁদের থাকার কথা ছিল, অনেক আগেই তাঁরা নিজগুণে নিষ্কৃতিলাভ করেছেন। এখন দোষারোপ এবং পাল্টা দোষারোপের খেলা চলছে। অবশ্য আগেই বলা হয়েছিল, 'খেলা হবে'। সে প্রতিশ্রুতির অন্যথা হয়নি।

মুশকিল হল কয়েকটি অবাধ্য ছেলেমেয়েকে নিয়ে। যারা প্রশাসনিক রদবদল এবং আরও কিছু অস্বস্তিকর দাবিদাওয়া নিয়ে আজ দু'সপ্তাহব্যাপী অনশনে। অনেক বিদ্রূপ, প্রলোভন এবং চাপের মুখেও এরা অনড়। অনমনীয়। এদের মূল শক্তি তারুণ্য এবং আদর্শবোধ। যার ভিত্তি নিশ্চিতভাবেই এক ধরনের মূল্যবোধের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা।

এমন দৃশ্য এ রাজ্য তো বটেই, এ দেশও দেখেনি কখনও। জটিল রাজনীতির আবহে এবং আবর্তে ভবিষ্যতে এই আন্দোলনের অভিমুখ কী হবে, তা অনুমান করা সহজ নয়। তবু টগবগে এই ছেলেমেয়েগুলি যে নতুন করে আমাদের ভাবতে শেখালো, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। মেকি অনেক সম্পর্কের খোলস খসে গেল দমকা এই হাওয়ায়। আগলহীন হয়ে পড়ল দম্ভের অট্টালিকাগুলি।

সুস্থ থাকুন। মননে থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান।

0 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in


 



         

চারপাশে গাছপালা ঘেরা একটি পুকুর। চাঁদনী রাতের আলোতে তার টলটলে জলে মায়াবী ঝিলিমিলি খেলা। পুকুরের ঘাটে বসে এক তরুণ আনমনে বাজিয়ে চলেছে বাঁশি। তার মূর্চ্ছনা পৌঁছে যায় এদিক সেদিক। পাশের একটি বাড়ির জানালায় এক কিশোরীর মুখ। বাঁশির সুর তাকে করেছে সম্মোহিত। পরদিন দুজনের দেখা। মেয়েটি বললো, “কাল রাতে আপনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন ? আমি শুনেছি।“

যুবকটি গাছের ছায়ায় শীতলপাটিতে বসে দিনের পর দিন অবলীলায় রচনা করে কবিতা,অনায়াসে বেঁধে চলে কত গান। মেয়েটিকে শেখায় সে গান, গ্রামের অন্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও। স্বল্পশিক্ষিতা গ্রাম্য তরুণীটি এমন প্রতিভা, এমন অনাবিল স্বতস্ফূর্ত সৃজনী আগে দেখেনি। তার চোখেমুখে বিস্ময়, মুগ্ধতা। আর তরুণটি অভিভূত ঐ ষোড়শী কন্যাটির অনন্যা রূপে। তার সৌন্দর্য্, সৌষ্ঠভ তরুণটির হৃদয়ে এনে দিলো এক অনাস্বাদিত আলোড়ন। জাগিয়ে তুললো সৃষ্টিসুখের উল্লাস।

আর এক দৃশ্য। মেয়েটি জ্বরাক্রান্ত। যুবকের মন ব্যাকুল। সে চায় তার পাশে বসে তার তপ্ত কপালে হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু রীতিনীতির বাঁধা। অবশেষে সুযোগ হলো। অনেক বছর পরে লিখেছিলো,”বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি। তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে ? আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুণ মিনতি।“

এরা কালিদাসের কোন কাব্য, সেক্সপীয়রের কোন নাটক, বা শরৎচন্দ্রের কোন উপন্যাসের পাত্রপাত্রী হতে পারত অনায়াসে। কিন্তু এই চরিত্ররা কাল্পনিক নয়, নেহাতই বাস্তব। গ্রামটির নাম কুমিল্লা জেলার দৌলতপুর। তরুণীটির নাম সৈয়দা খাতুন। আর যুবকটি কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুলের বন্ধু কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, একদিন নজরুল সৈয়দা খাতুনকে বললেন, “এমন ফুলের মত যার সৌন্দর্য, তার এ নাম কে রেখেছে ? আজ থেকে তোমার নাম নার্গিস।“ সেই থেকে তাঁর নাম হয়ে গেলো নার্গিস, পুরো নাম নার্গিস আসার খানম। পারস্যদেশের একটি গুল্মের অতি সুগন্ধী শ্বেতবর্ণা ফুলের ফারসি ভাষায় নাম নার্গিস।

প্রেমের এই আলোড়ন নজরুলের সৃজনীসত্বাকেও উদ্বেলিত করেছিল এক বিপুল আবেগে। দৌলতপুরে অবস্থানকালেই নজরুল প্রায় ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা রচনা করেছিলেন। ‘পাপড়ি খোলা’, ‘অবেলায়’, ‘অনাদৃতা’, ‘বিদায় বেলায়’, ‘হারমানা হার’, ‘হারামণি’, ‘বেদনা অভিমান’, ‘বিধুরা’, ‘পথিক প্রিয়া’ ইত্যাদি কবিতা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই পর্বের অনেক বছর পরেও একাধিক বিরহ-বেদনা-অভিমানের গান তিনি সৃষ্টি করেছেন, যা এই সময়ের প্রতিফলন বলে অনেকে মনে করেন।

হ্যাঁ, এই প্রেম পূর্ণতা পায়নি। এর ব্যাপ্তি ছিলো মাত্র আড়াই মাস, বা তারও কম। অথচ নজরুল-নার্গিসের বিবাহ অনুষ্ঠানও অতি সমারোহে আয়োজিত হয়েছিল। কিন্তু সেই অনুষ্ঠান থেকে কোন কারণে নজরুল নিজেকে প্রত্যাহৃত করেন। ঠিক কি ঘটেছিল তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। অনেক নজরুল গবেষক বা জীবনীকাররা অনেক কথাই লিখেছেন। ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, অসততা ইত্যাদির উপাদান সম্বলিত বেশ কিছু কাহিনী প্রচলিত। সে সবের সত্যাসত্য নিয়েও মতভেদ আছে। কিন্তু এই প্রেমপর্বের যে ঘটনাক্রম নিয়ে দ্বিমত নেই, তাই প্রথমে বিবৃত করা যাক।

বিশ্বযুদ্ধের শেষে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পেয়ে নজরুল তখন কলকাতায়। ফজলুল হকের নবযুগ পত্রিকায় কিছুদিন সম্পাদনার কাজ করেছিলেন,তখন তাও নেই। এদিক ওদিক কিছু কিছু লেখা বেরিয়েছে কয়েকটি পত্রপত্রিকায়। তবে খ্যাতি-পরিচিতি তখনও তেমনভাবে আসেনি। তিনি তখন যুক্ত ছিলেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে, থাকতেন ৩২ কলেজ স্ট্রীটে তাদেরই ভবনে। সেখানে মোহম্মদ মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওয়াদুদ, মহম্মদ শহীদুল্লাহ ইত্যাদি তখনকার তরুণ মুসলিম লেখকরা তাঁর বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন। সদা প্রাণোচ্ছল, হাস্যময় নজরুলের বান্ধববৃত্ত বিস্তৃতই ছিল।

এদেরই মধ্যে একজন ছিলেন আলী আকবর খান। তিনি নজরুলের থেকে বয়সে বেশ কিছুটা বড় ছিলেন। কলেজ স্ট্রীটেই দুজনের পরিচয়। আলী আকবর কিছু কিছু লেখালেখি করতেন, একটা নাটক ও কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন, কিন্তু তার মান বিশেষ উঁচু ছিল না। তিনি নিজেই সে সব ছাপিয়ে বিক্রী করার চেষ্টা করতেন। ঐ পাড়ায় তাঁর একটি প্রকাশনা ছিল, মূলত পাঠ্যপুস্তকের। অবশ্য নজরুলের সম্ভাবনাময় প্রতিভা চিনে নিতে তাঁর দেরী হয়নি।

এই আলী আকবর খান ছিলেন কুমিল্লার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামের এক সম্পন্ন ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। গ্রামে বিষয়-সম্পত্তি তাঁদের কম ছিল না। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে নজরুলকে তাঁদের গ্রামের বাড়ীতে যাবার আমন্ত্রণ করছিলেন। শেষে আলী আকবরের অগ্রজ নেজাবৎ আলীর মেয়ে আম্বিয়া খানম মানিকের বিবাহ উপলক্ষ করে নজরুল দৌলতপুর যেতে রাজি হন।

১৯২১ সালের ৩রা এপ্রিল নজরুল ও আলী আকবর রেলপথে যাত্রা করে পরদিন রাতে কুমিল্লা পৌঁছান। কুমিল্লা শহর থেকে দৌলতপুরের দূরত্ব আরও প্রায় ৪০ কিলোমিটার। সে সময়ে রাতের বেলায় অত দূর পাড়ি দেওয়া নিরাপদ ছিল না। কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকায় আলী আকবরের এক স্কুলের সহপাঠী বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়ীতে দুজনে থাকা মনস্থ করেন। বাড়ীটি ছিল বীরেন্দ্রর বাবা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের। তাঁর স্ত্রী এবং ইন্দ্রকুমারের মা’র নাম বিরজাসুন্দরী। এই পরিবারটি ছিল সুশিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক এবং উদারমনা। নজরুল-নার্গিস পর্বে এবং নজরুলের পরবর্তী জীবনেও বিরজাসুন্দরী ও তাঁর পরিবারের একটি বিশেষ ভুমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। এক রাত মাত্র নয়, নজরুলরা এ বাড়ীতে আরও দু-চার দিন অতিবাহিত করেন। এই স্বল্প পরিসরেই নজরুল এই পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, এবং বিরজাসুন্দরীকে ‘মা’ সম্বোধন করতেন।

কান্দিরপাড় ছেড়ে নজরুল ও আলী আকবর অবশেষে দৌলতপুরে পৌঁছোন। সেখানে আলী আকবরের পরিবার ও দৌলতপুরবাসীরা নজরুলকে অতি সমারোহে অভ্যর্থনা করেন বলে কথিত আছে।

বিয়ের আসর নজরুল মাতিয়ে দিয়েছিলেন গান গেয়ে আর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ উচ্ছলতা দিয়ে। সেই বিয়েতে গান গেয়েছিল আরেকটি মেয়ে – আলী আকবরের ভাগ্নী সৈয়দা খাতুন। সেই প্রথম পরিচয়। দুই তরুণ মনের পারস্পরিক আকর্ষণের সুত্রপাত। সৈয়দা খাতুন আলী আকবরের বোন আসমাতুন্নিসার ছয় সন্তানের পঞ্চম। তাদের বাড়ী পাশেই ছিল। শৈশবেই অনাথা হওয়ায় মেয়েটি আলী আকবরের পরিবারের স্নেহ-দাক্ষিণ্য অর্জন করেছিল, তাদের বাড়ীতে অবাধ যাতায়াত ছিল। নজরুলের সঙ্গে পরিচয়ের পর সেই যাওয়া আসা আরও বেড়ে গেল। নজরুলের কোঁকরা বাবরি চুল, তীক্ষ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, স্বভাবের উষ্ণতা আর সাহিত্য-সঙ্গীতের প্রতিভা যে কোন তরুণীকে বশীভূত করার জন্য পর্যাপ্ত ছিল। আর নজরুল নিজে ? অগ্রজ বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা সেই সময়ের এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “এক অচেনা পল্লীবালিকার কাছে এত বিব্রত ও অসাবধান হয়ে পড়েছি যা কোন নারীর কাছে হইনি।“

প্রথম পরিচয় থেকে পুরোদস্তুর প্রেম রূপায়িত হতে এক-দেড় মাসের বেশী সময় লাগেনি। এরই মধ্যে বদলে গেল মেয়েটির নাম, ভালবাসা উদযাপিত হতে লাগল নতুন নতুন গানে কবিতায়, অদম্য হয়ে উঠল দুজনে দুজনকে বেশী করে কাছে পাওয়ার আকুতি। এ সব দৃষ্টি এড়ালো না একজনের। তিনি মামা আলী আকবর খান। অনেকের মতে ঘটনাক্রমের এই বিবর্তনে তাঁর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল। অচিরেই তিনি দুজনের বিয়ের প্রস্তাব পেশ করলেন। শোনা যায় তখনকার ‘চালচুলোহীন’ নজরুলকে নিয়ে খান পরিবারে একটু আপত্তি ছিল। কিন্তু শিক্ষিত বিএ পাশ আলী আকবরের সিদ্ধান্ত শেষে সকলকেই মেনে নিতে হল। আর মিয়াঁ-বিবিকে রাজী করাতেও বেশী সময় লাগেনি। অতএব বিয়ের দিন ধার্য হল ১৭ই জুন ১৯২১ (৩রা আষাঢ় ১৩২৮)।

নজরুল নার্গিসের এই বিবাহানুষ্ঠান বেশ ধুমধাম করেই আয়োজিত হয়েছিল। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতবিশারদ ওস্তাদ আলাউদ্দিন।

খাঁ ও তাঁর ভাই ওস্তাদ আফতাবুদ্দিন ফকির যিনি সেই অনুষ্ঠানে বাঁশিও বাজিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আনা হয়েছিল ২০ জনের একটি গাইয়ে-বাজিয়ের গোষ্ঠি। স্থানীয় গণ্যমান্যদের মধ্যে বাঙ্গরার জমিদার রায়বাহাদুর রূপেন্দ্রলোচন মজুমদার, সেখানকার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অবনীমোহন মজুমদার ইত্যাদিরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নজরুলের কলকাতার বন্ধুবান্ধবরা কেউই গিয়ে উঠতে পারেননি। অবশ্য কান্দিরপাড়ের বিরজাসুন্দরী, তাঁর স্বামী ইন্দ্রকুমার ও পুত্র বীরেন্দ্রকুমার সহ সেই পরিবারের বেশ কয়েকজন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সমগ্র অনুষ্ঠানের জন্য নাকি ১৫০০০ টাকা খরচা হয়েছিল। আর,

দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাসভবন যেখানে নজরুল-নার্গিসের প্রেম প্রস্ফুঠিত হয়েছিল
      



এমনও শোনা যায় যে নার্গিসের জন্য দেনমোহর ধার্য্য হয়েছিল ২৫০০০ টাকা (মতান্তরে ২০০০০ টাকা)!

কিন্তু বিয়ের আকদ পর্বেই কাবিননামা নিয়ে শুরু হলো সমস্যা, বাঁধল বিরোধ। ঐস্লামিক বিবাহে কাবিননামা বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের সম্মতিক্রমে নির্ধারিত একটি চুক্তিপত্র। এই কাবিননামায় একটি শর্ত ছিল এই যে, বিয়ের পর নার্গিসকে নিয়ে নজরুল কোথাও যেতে পারবেন না, তাঁদের দৌলতপুরেই থাকতে হবে। এই শর্তটি নিয়ে বিশেষ মতবৈষম্য কোন বিবরণীতে পাইনি। স্বাধীনচেতা, উচ্ছল বোহিমিয়ান স্বভাবের নজরুলের পক্ষে এই শর্ত মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁর কাছে এ ছিল তাঁকে ঘরজামাই করে রাখার প্রস্তাব। তিনি অসম্মতি জানালে শুরু হয় প্রবল বাকবিতন্ডা। বরপক্ষে নজরুল ছিলেন একা। অন্যপক্ষ থেকে বর্ষিত হয় নানা কটূক্তি। কিছু আমন্ত্রিত বয়স্কদের মধ্যস্থতায় আবহাওয়া সামান্য শান্ত হলেও নজরুল প্রচন্ড অপমানিত বোধ করেন এবং বিবাহ অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।

কোন কোন গবেষকদের মতে নজরুল নার্গিসকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর সঙ্গে চলে যেতে, কিন্তু তরুণী নার্গিস এত বড় ফয়সালা করে উঠতে পারেননি। অগত্যা অসীম তিক্ততা নিয়ে ক্ষুব্ধচিত্ত নজরুল উপস্তিত হন বিরজাসুন্দরীর কাছে, এবং তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানান। সব শুনে বিরজাসুন্দরীর মনে হয়, সেই মুহুর্তে নজরুলের মনের যা অবস্থা, তাতে তাকে বিরত করা সম্ভব নয়। তখন ঘোর রাত, বাইরে ঝড়বৃষ্টি চলছে। বিরজাসুন্দরী তাঁকে অনুরোধ করেন বীরেন্দ্রকুমারকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। অতঃপর নজরুল ও বীরেন সেই বৃষ্টিবাদলার মধ্যে কর্দমাক্ত রাস্তা খেতখামার পায়ে হেঁটে পার করে কান্দিরপাড় পৌঁছলেন। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়ায় কয়েকদিন অতিবাহিত করার পর মুজফ্ফর আহমেদের অর্থসহায়তায় নজরুল কলকাতা ফেরৎ যান।

সেই যে গেলেন, আর কখনো দৌলতপুরে ফিরে যাননি। নার্গিসের সঙ্গে দেখা হওয়া তো দূরের কথা, তাঁকে লেখা নার্গিসের একাধিক চিঠির উত্তর পর্যন্ত দেননি। অথচ ব্যর্থ প্রেমের জ্বলনে দগ্ধ চিত্তে রচনা করেছেন কখনো ট্র্যাজিক, কখনো ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী গান-কবিতা। বন্ধুকে লিখেছেন, “এই বন্ধন ছিন্ন করে দুঃখ পেয়েছি আমিই সব চেয়ে বেশি। আমার নিজের বুকই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে. হিয়ায় হিয়ায় আমার এক বীভৎস খুন-খারাবি . . খানখান খুন! কেমন এক বিদ্রোহ অভিমানে আমার দুচোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ছে। নাই নাই, এ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা নিয়ন্তা কেউ নাই।“

দৌলতপুরে না গেলেও কুমিল্লায় কিন্তু নজরুল এর পরও গিয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। কখনো সাহিত্য সভায় যোগ দিতে, কখনো ইংরেজদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সভায় মিছিলে অংশ নিতে। তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন এই কুমিল্লাতেই। কিন্তু অন্য আরেকটি কারণও ছিল কুমিল্লা আসার। তা হল বীরেন্দ্রকুমারের বিধবা জ্যেঠিমা গিরিবালা দেবীর কন্যা আশালতা সেনগুপ্তা। কান্দিরপাড় থেকে বিরজাসুন্দরীর পরিবারের যে সদস্যরা নজরুল-নার্গিসের বিবাহ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই আশালতাও ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ১৩ বছর। প্রথম প্রেমের শোচনীয় পরিনতির পর নজরুল যখন কুমিল্লায় আসতে লাগলেন তখন আশালতার সঙ্গে ক্রমে ক্রমে পরিচয়, সখ্যতা পেরিয়ে পুনরায় ভালবাসার উদ্ভব হল, এবং পরিশেষে ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় তাঁদের অনাড়ম্বর বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিরজাসুন্দরী ও তাঁর পরিবার এই পরিণয়ের পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু বিধবা গিরিবালার অত্যাশ্চর্য্য দৃঢ়তা এই আন্তরধর্মীয় বিবাহ সম্ভব করেছিল। বিয়ের পর নজরুল আশালতার নাম রাখেন প্রমীলা। প্রমীলাই আমৃত্যু নজরুলের জীবনসঙ্গিনী ছিলেন।

আর নার্গিস ? তিনি সুদীর্ঘ ১৭ বছর অপেক্ষা করেছিলেন। নজরুলকে গোটাচারেক চিঠি লিখেছিলেন। শেষ চিঠিটি ছাড়া আগেরগুলির কোন উত্তর নজরুল দেননি। নার্গিসের চিঠিগুলির বয়ান নজরে আসেনি। তবে শেষ চিঠিতে তিনি নাকি লিখেছিলেন যে প্রমীলাকে বিয়ে করার জন্য তাঁর কোন অনুযোগ নেই, কিন্তু একবার তিনি নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে চান। এমনকি আত্মহত্যার ইচ্ছাও নাকি প্রকাশ করেছিলেন। এর উত্তরে নজরুল একটি বিস্তারিত চিঠি লেখেন। এই গুরত্বপূর্ণ নথিটি কিন্তু সর্বত্র উপলব্ধ। তার থেকে সামান্য উদ্ধৃতি শুরুতে দিয়েছি, প্রয়োজন মত অন্য জায়গায় আবার উল্লেখ করা যাবে। নার্গিস অবশ্য আত্মহত্যার পথে যাননি। দীর্ঘ প্রতীক্ষা এবং দু-একটি ঘটনার পর তিনিও বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হন, ১৯৩৮এর ১২ই ডিসেম্বর, আলী আকবর খানের ঢাকার গ্রন্থন ব্যবসায়ের সহযোগী সাহিত্যিক আজিজুল হাকিমের সাথে।

য়ৌবনে নজরুল
                   



বিবরণীর এই পর্যায়ে আলোচনায় আসি বিবিধ বিতর্কিত বাদ-প্রতিবাদের বিষয়গুলিতে।

নজরুলের গুণগ্রাহীরা তাঁর প্রেমের এই কঠিন বেদনাসম্পৃক্ত পরিণতির জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেছেন আলী আকবর খানকে। এঁদের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোঘ্য নজরুলের অভিভাবকস্থানীয় সুহৃদ কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের স্মৃতিচারণা ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’। তিনি সরাসরি আরোপ করেছেন, ‘আলী আকবর খান দাম্ভিক, মিথ্যাভাষী ও শঠ’। স্বপক্ষের অভিমত পোষণকারীরা বলেন, আলী আকবর খানের হাবভাব এবং কোন কোন ক্রিয়াকলাপ নজরুলের কলকাতার বন্ধুরা মোটেই ভাল চোখে দেখতেন না। তাঁর সঙ্গে দৌলতপুর যাওয়া থেকে বিরত করার জন্য নজরুলকে বন্ধুরা উপদেশ দিয়েছিলেন। মুজফ্ফর আহমেদের ভাষায় তিনি স্পষ্টতই কবিকে বলেছিলেন, ‘কি মতলবে তিনি তোমায় তাঁদের বাড়ী নিয়ে যেতে চান তা কেউ জানেন না। তিনি তোমাকে একটা বিপদেও ফেলতে পারেন।‘ সরলমতি কবিকে কিন্তু নিরস্ত করা যায়নি। এঁদের মতে, আলী আকবরের অভিসন্ধি ছিল নজরুলের বিরল প্রতিভাকে নিজের প্রকাশনা ব্যবসার একচেটিয়া স্বত্বাধীন করা, এবং সেই উদ্দেশ্যেই পারিবারিক আবদ্ধতার চক্রান্ত ও কাবিননামার ওই শর্ত রচিত হয়েছিল। এই যুক্তির সমর্থনে তৎকালীন দৌলতপুরবাসী মুন্সি আবদুল জব্বারের জবানি উল্লেখযোগ্য: “অন্যদিকে আলী আকবর খান বড় বোন নার্গিসের মাকে যেয়ে বলেছেন, ভাগিনীকে আমরা বিবাহ দিব। .......আমাদের বাড়ীর একটি মেয়েও এই পাত্রের পছন্দ হয় নাই। তোমার মেয়েকে পাত্র পছন্দ করেছে। বর্তমানে যে কোন উপায়ে এই কাজীকে আটকিয়ে রাখতেই হবে। এই কাজী নজরুল ইসলাম পৃথিবী বিখ্যাত এক দার্শনিক কবি হইবে। .....তাহার নমুনা আমরা পাইয়াছি। তাহাকে হাতছাড়া করা যায় না। ......তাহাকে আটকাইয়া রাখিলে ভবিষ্যতের জন্য একটা পথ আবিষ্কার হইতে পারে, তাহাতে সারা জীবনে সুখ থাকিতে পারিবে।“

নজরুল তাঁর বিবাহের সিদ্ধান্ত পত্রযোগে কলকাতার কয়েক বন্ধুদের জানিয়েছিলেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর প্রথম চিঠিতে (৫ই জুন ১৯২১) এই সিদ্ধান্তের সঠিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছিলেন, “.... তোর বয়েস আমাদের চাইতে ঢের কম, অভিজ্ঞতাও তদনুরূপ, feeling-এর দিকটা অসম্ভব রকম বেশী। কাজেই ভয় হয় যে হয়ত বা দুটো জীবনই ব্যর্থ হয়। ....... যৌবনের চাঞ্চল্যে আপাতঃ মধুর মনে হলেও ভবিষ্যতে না পস্তাতে হয়।” এর উত্তরে নজরুল নার্গিস সম্বন্ধে তাঁর যে অসহায় মনোভাবের কথা ব্যক্ত করেছিলেন তা আগেই বলেছি। অগত্যা পবিত্রবাবু তাঁর দ্বিতীয় চিঠিতে (২৫শে জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮) নজরুলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েও শেষে লিখেছিলেন, “তুই যে এরূপ একটা আজগুবি কান্ড বাঁধিয়ে বসবি, তা সকলে আমরা জানতুম।“ তাঁর কলকাতার বন্ধুরা যে অকস্মাৎ বিয়ের ফয়সালায় বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না, তা বুঝতে পেরে নজরুল তাঁর আর এক সুহৃদ সাহিত্যিক ও সম্পাদক মোহম্মদ ওয়াজেদ আলীকে একটি পত্রে সম্ভবত কিঞ্চিত দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তার উত্তরে ওয়াজেদ আলী লেখেন (১৩ই জুন ১৯২১), “আমার বোধ হয় আপনার বন্ধুরা অসন্তুষ্ট হয়েছেন একটা কারণে। আপনি ‘নারায়ণে’ ‘দহন-মালা’ লিখে নারীর কাছে ক্ষমা চাইলেন; তার পরই এত সত্বর প্রেমের ফাঁদে ধরা পড়লেন। ‘যৌবনের জোয়ার’ বড় সাংঘাতিক; তাকে ঠেলে রাখা বড় দায় – এ আমি স্বীকার করছি।“

স্বপক্ষীয়রা বলেন, বিবাহ অনুষ্ঠানে নজরুলের বিস্ফোরণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এর প্ররোচনা কিছু দিন ধরে ক্রমাগত দানা বাঁধছিল। আলী আকবর ও তাঁর পরিবারের কোন কোন কথায় আচরণে নজরুল বিরক্ত হয়েছিলেন, এমন কি অপমানিতও বোধ করেছিলেন। কিন্তু নার্গিসের প্রতি সেই সময়ে তাঁর সুগভীর অনুভুতি তাঁকে সহ্যশীল থাকতে বাধ্য করে। শোনা যায়, নার্গিসের আগে আলী আকবর তাঁর এক ভাইঝি হেনার সঙ্গে নজরুলের বিয়ের প্রস্তাব রেখেছিলেন। নজরুল রাজী হননি। কিন্তু হেনা বা নার্গিস, কারোর সঙ্গেই নজরুলের বিয়েতে অধিক অমত ছিল আলী আকবরের পরিজনদেরই। তাঁরা এই অদ্ভুত স্বভাবের ছন্নছাড়া নিঃসম্পদ ছেলেটিকে ঘরের জামাই করা মেনে নিতে পারেননি, এবং প্রায়শই নজরুলের সামনেই তাঁদের এ অভিমত প্রকাশ হয়ে পড়ত। নজরুল স্বাভাবিক ভাবেই ব্যথা পেয়েছিলেন। কুমিল্লার সাপ্তাহিক লালমাই পত্রিকার ১লা জুন ১৯৬৯ সংখ্যায় অধ্যাপক বদরুল হাসান লিখেছেন, “.....নজরুলের বাঁধনহারা ভাব তাঁর পরিবারের গুরুজনদের চোখে তাচ্ছিল্যের কারণ ছিল। সম্প্রতি নেজামত আলী খান (আলী আকবরের বড় ভাই) একথা অকপটেই স্বীকার করেছেন।” কিন্তু আগেই বলেছি, শিক্ষিত আলী আকবরের জেদের কাছে তাঁদের নতিস্বীকার করতে হয়। আলী আকবর খান তাঁর সম্বন্ধে নজরুলের কলকাতার বন্ধুদের মনোভাব ভালোই জানতেন। তাই বিয়ে ঠিক হবার পর নাকি তাঁদের চিঠিপত্র নজরুলের হাতে দিতেন না, এবং নজরুলের লেখা চিঠিগুলিও ডাকে তাঁদের কাছে পাঠাতেন না। অনেক বছর পরে নার্গিসের স্বামী আজিজুল হাকিমের উদ্যোগে সে সব চিঠি প্রকাশিত হয়। স্বপক্ষের লোকেরা এমনও বলেন যে বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্রও আলী আকবর কলকাতার ঠিকানাগুলিতে ইচ্ছাকৃতভাবেই দেরী করে পাঠান যাতে সেখান থেকে কেউ বিয়ের অনুষ্ঠানে পৌঁছতে না পারেন। অন্য একটি ব্যাপারও নজরুলের কাছে বিসদৃশ লেগেছিল। বিয়ের দিন যখন পাকা, তখন থেকে নার্গিসকে তাঁর মামা নিজের বাড়ীতে এনে রাখেন এবং স্বল্পশিক্ষিতা মেয়েকে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই নজরুলের উপযুক্ত করে তোলার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। তিনি শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের ও অন্য বিশ্বসাহিত্য থেকে বেছে বিভন্ন নারীচরিত্রের কাহিনী, শহুরে আদবকায়দা ইত্যাদি নার্গিসকে সারাদিন ধরে শেখানো-পড়ানোর ঝোঁক ধরে বসলেন। নজরুল তো নার্গিসকে সেইভাবেই ভাল বেসেছিলেন যেমনভাবে তিনি তাঁকে দেখেছিলেন, পেয়েছিলেন। তাঁর কাছে এ সব নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়েছিল।

কিন্তু এই সব মতের বিপক্ষেও কিছু দৃষ্টিকোণ সময়ের সাথে সাথে প্রকাশ পেয়েছে।

একটি ধারণা এমন আছে যে প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের বিবাহ অনেকেই ভালো ভাবে নিতে পারেননি। তাঁকে ধর্মান্তরিত না করে বিয়ে করা, এবং বিয়ের পর শাঁখা সিঁদুর উপাসনা ইত্যাদি আচারাদি পালনের অনুমতি দেওয়া মুসলমান সম্প্রদায়ের একাংশকে ক্ষুব্ধ করেছিল। উল্টোদিকে ব্রাহ্ম সমাজের মেয়ের আন্তর্ধমীয় বিবাহ নিয়ে ব্রাহ্ম ও হিন্দু সমাজের অনেক মাতব্বরও রূষ্ট হয়েছিলেন। তবে নজরুল-নার্গিস পর্বের নজরুল-স্বপক্ষের মতগুলিকে খন্ডন করতে মাত্র এঁরাই যে সচেষ্ট হয়েছিলেন, তা নয়। দু’পক্ষেরই দৃষ্টিকোণের সমর্থন বা অন্যথায় স্বতন্ত্র গবেষকরাও আছেন।

বিপক্ষীয়রা বলেন মুজফ্ফর আহমেদের বৃত্তান্ত আলী আকবর খানের প্রতি তাঁর নেতিবাচক পক্ষপাতের ফসল। ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার এক ঈদ সংখ্যায় ‘নার্গিস’ নামে একটি উপন্যাসের লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর মত: “নজরুলের বই প্রকাশ করে রাতারাতি ধনী হওয়ার পরিকল্পনা আলী আকবরের মনে আসবে কেন ? বই বিক্রী করে প্রচুর অর্থ উপার্জন কি নজরুলের জীবনে আদৌ ঘটেছিল ? তাঁর পেছনে প্রকাশকেরা সারি বেঁধে অপেক্ষা করতেন, এমন তথ্যও তো ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায় না। বরং এক-দুই শ টাকার বিনিময়ে বইয়ের স্বত্ব বিক্রী করার জন্য নজরুল দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, এই নির্মম বাস্তবতাই তো বিভিন্ন জীবনী গ্রন্থ থেকে পাই।“ এই বিপক্ষীয়দের মত, নজরুল ও নার্গিসের বৈবাহিক জীবনে আর্থিক সুরক্ষা এবং মাথার ওপর আচ্ছাদন সুনিশ্চিত করতেই আলী আকবর মোটা রকমের দেনমোহর ও কাবিননামার ঐ শর্ত প্রস্তাব করেন। সুলতান মাহমুদ মজুমদার দাবী করেন, নার্গিসের সাথে তাঁর একবার সাক্ষাত হয়েছিল, এবং সেই সাক্ষাতের বিবরণী তিনি ‘কবিপ্রিয়ার সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন (‘সাপ্তাহিক আমোদ’, ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৭)। সেখানে, এমন ছিল নার্গিসের জবানী: “আমাকে সে নিয়ে যেত কোথায় ? চুরুলিয়ার বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। থাকতো পরের আস্তানায়। তখনও লেখায় তেমন পয়সা পেতো না। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে খরচ দিতে হতো অন্যের......। কুমিল্লায় আসার সময় মামার অতিথি হিসাবে আমার মামাই খরচ দিয়েছিলেন। এই লোক বউ নিয়ে তুলতো কোথায় ? খাওয়াতো কি ? ......আমাদের সামাজিক মান সম্ভ্রম ও আমার মনের দিকটা একবারও কি সে ভেবে দেখেছে ? .....ঘরছাড়া এক পথিক যুবাকে বর করে নিলাম। তাই আমি দোষী, আর সে বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে লিখছে কবিতা, আর আমি জ্বলছি দুঃখ দহনে। স্ত্রী পুত্র নিয়ে সে হাসে, আমি চোখের জলে ভাসি।“ বিপক্ষগোষ্ঠী বরং নজরুলের দৌলতপুর থেকে পবিত্রবাবুকে লেখা চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাতে চান যে তিনি কেবল নার্গিসের রূপগুণেই বিভোর হয়েছিলেন এমন নয়, সে পরিবারের দৌলতও তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। নার্গিসের বর্ণনায় কবি লিখেছিলেন: “চিরজনমের হারানো গৃহলক্ষী, প্রিয়া..... তার বাইরের ঐশ্বর্যও যথেষ্ট।” নার্গিসকে সারাদিন আলী আকবরের প্রশিক্ষণের প্রসঙ্গে বিপক্ষের অভিমত, নজরুলের ভাবাবেগ তখন এতই প্রবল যে তিনি সর্বদাই প্রিয়ার সঙ্গসুখ চাইতেন, যা তখন সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু ছিল, এবং নার্গিসকে দূরে রাখার জন্যই আলী আকবরের এই ছিল পদ্ধতি। অধ্যাপক মিলন দত্ত তাঁর ‘প্রথম প্রেম ও নার্গিস বেগম’ প্রবন্ধে বলেছেন, “আলী আকবর খান নার্গিসকে ..... নজরুলের সঙ্গে মেশার সুযোগ না দেওয়ার ইচ্ছায় অধিকাংশ সময় নিজের কাছেই রাখতেন, বিয়ের পূর্বে তাঁদের মেলামেশা নিয়ে সমাজের নানা আলোচনা চলছিলো। মানুষের মুখও তো তাঁকে বাঁচিয়ে চলতে হবে। কিন্তু এ অবস্থা নজরুলের অসহনীয় ছিল - ......”। বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র দেরীতে বিয়ের অনুষ্ঠানের পর কলকাতার বন্ধুদের কাছে পৌঁছনোর কারণ হিসেবে বিপক্ষবাদীদের যুক্তি, তখন রেলপথ ও জলপথ পরিবহন কর্মীদের ধর্মঘট চলার জন্যই এমন হয়েছিল।

নজরুল-নার্গিস উপাখ্যানের যে মাত্র দু-তিনটি নথি জনসমক্ষে পাওয়া যায়, এই নিমন্ত্রণ পত্রটি তার মধ্যে বিশেষ কৌতুহলোদ্দীপক। কলকাতার বন্ধুদের কাছে যথাসময়ে না পৌঁছলেও সে পত্র ‘মোহম্মদী’ পত্রিকার সম্পাদক মোহম্মদ ওয়াজেদ আলীর হাতে যে করেই হোক পৌঁছয়, এবং তিনি তাঁর পত্রিকায় তা অবিলম্বে ছাপিয়ে দেন। ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণ পত্র’ শিরোনামে তা ‘বাঙালী’ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়। এই দীর্ঘ পত্রটি শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের গান ‘জগতের পুরোহিত তুমি’র প্রথম দু’ ছত্র দিয়ে। পাত্রের পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছিল এই ভাবে: “বর্ধমান জেলার ইতিহাস প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশ বিখ্যাত পরম পুরুষ, আভিজাত্য গৌরবে পরম গৌরবান্বিত, আয়মাদার, মরহুম মৌলবী কাজী ফকির আহমদ সাহেবের দেশ বিশ্রুত পুত্র মুসলিম কুলগৌরব মুসলিম বঙ্গের ‘রবি’ কবি সৈনিক নবযুগের ভূতপূর্ব সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম.........বাণীর দুলাল দামাল ছেলে, বাংলার এই তরুণ সৈনিক কবি ও প্রতিভাবান্বিত লেখকের নতুন করে নাম বা পরিচয় দেবার দরকার নেই।“ এমনও প্রচারিত হয় যে এর বয়ান নাকি স্বয়ং নজরুলের ‘মুসাবিদা’ করা।

পত্রিকায় প্রকাশিত এই নিমন্ত্রণ পত্র কলকাতার বন্ধুদের গোচরে অবশ্যই আসে। কেউ কেউ নজরুলকে চিঠিতে অভিনন্দন ও শুভকামনা জানালেও, অনেকেই তার ভাষ্য নিয়ে অখুশী ছিলেন। নজরুলের ঐ বর্ণনা, বিশেষ করে ‘মুসলিম বঙ্গের রবি’ উপাধি (যা তাঁকে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ দাবী করার তরলমতি প্রয়াস বলে অনেকে মনে করেন), এবং পত্রিকায় এমন নিমন্ত্রণ প্রকাশের ঔদ্ধত্য অনেকের কাছেই অসমর্থনীয় ছিল। মুজফ্ফর আমেদ (২৬শে জুন ১৯২১) এক ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ চিঠিতে নজরুলকে স্পষ্টতই তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে লিখেছিলেন: “পত্রখানা আপনারই মুসাবিদা করা দেখিলাম। পত্রের ভাষা দু’এক জায়গায় বড় অসংযত হইয়াছে। একটু যেন কেমন দাম্ভিকতা প্রকাশ পাইয়াছে। আপনার হাত দিয়া অমন লেখা বাহির হওয়া কিছুতেই ঠিক হয় নাই। আমার বড় ভয় হইতেছে যে, খান সাহেবের সংস্রবে থাকিয়া আপনিও না শেষে দাম্ভিক হইয়া পড়েন। অন্যে বড় বলিলে গৌরবের কথা হয়, আর নিজেকে নিজে বড় বলিলে অগৌরবের মাত্রাই বাড়িয়া যায়। ‘মোহম্মদী’কে বিবাহের কথা ছাপিতে অনুরোধ করাটা ঠিক হইয়াছে কি ? তাঁরা ত নিজ হইতেই ও খবর ছাপিতে পারিতেন। .... বাস্তবিক আমার প্রাণে বড় লাগিয়াছে বলিয়া আমি এত কথা বলিলাম। এই নিমন্ত্রণ পত্র আবার ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণ পত্র’ শিরোনামে ‘বাঙালী’তে মুদ্রিত হইয়াছে, দেখিলাম। ‘বাঙালী’কে এই নিমমন্ত্রণ পত্র কে পাঠাইল ?”

এ চিঠি যখন লেখা হল, ততদিনে অবশ্য গোমতি দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। নজরুল দৌলতপুর ছেড়েছেন, এবং সন্পূর্ণ তথ্য বোধহয় তখনও মুজফ্ফর আহমেদের অজানা। এর কিছুদিন পরে, সাপ্তাহিক ‘বিজলী’র ২২শে জুলাই সংখ্যায় ‘কবিবরের প্রতিবাদ’ শিরোনামে নজরুলের লেখা একটি চিঠি ছাপা হয়। ঢাকার বাংলা একাডেমী সম্পাদিত ‘নজরুল-রচনাবলী’র টীকায় বলা হয়েছে, “এই চিঠিটি নজরুল-নার্গিস বিবাহ সংক্রান্ত প্রতিবাদলিপি। নজরুল-বিবাহে আলী আকবর খান যে নিমন্ত্রণ-পত্র ছাপান, নজরুল-বন্ধুরা ধারনা করেছিল সেটা নজরুলের মুসাবিদায় ছাপা হয়। নজরুল ইসলাম তার প্রতিবাদ করেন।“ নজরুলের বিবৃতি ছিল: “প্রথমেই বলে রাখি, আমার এই ‘কবি-বরে’র অর্থ ‘কবি-শ্রেষ্ঠ’ নয়, এ ‘কবি-বরের’ মানে – ‘যে কবি বিয়ের বর’। কারণ, দিন কতক আগে আমি বাস্তবিকই – অন্তত ঘন্টা কয়েকের জন্যে ‘বর’ সেজেছিলুম, যদিও বরের এখনো বধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ নেই। যাক সে কথা, আমার ঐ ‘ত্রিশঙ্কু বিয়েতে’ শ্বশুরকুলের কর্তৃপক্ষগণ এক কাব্যিক নিমন্ত্রণপত্র ছাপিয়েছিলেন এবং সেটি চরমে গিয়ে পৌঁছেছে এই জন্যে যে, সেটা আবার আমার সাহিত্যিক ও কবি বন্ধুবর্গকে পাঠানো হয়েছে। সেটা একপ্রকার জামাই বিজ্ঞাপন বললেও হয়। ওতে আমার নামের আগে ও পিছনে এত লেজুড় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, কোনো চতুষ্পদ জীবেরই অতগুলো ল্যাজ থাকে না।“

নজরুল-নার্গিসের বিবাহ কি সম্পূর্ণ হয়েছিল ?

এই প্রশ্নের উত্তরেও মতান্তর আছে। নজরুলের উপরোক্ত ‘প্রতিবাদ’ পড়লে দেখা যাবে যে, নিমন্ত্রণপত্র তাঁরই রচনা, এ কেবল সে কথারই খন্ডন নয়। মূলত বিয়ের সামগ্রিকতাকেই যেন তিনি অস্বীকার করেছেন। বিয়ের অসম্পূর্ণতার ইঙ্গিত দিয়ে যে ‘ত্রিশঙ্কু বিয়ে’ শব্দ তিনি ব্যবহার করলেন, তা আবার বিরজাসুন্দরী দেবীর একটি রচনায়ও পাওয়া যায়। প্রায় বছরখানেক পরে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র শ্রাবণ ১৩২৯ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘নৌকাপথে’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে দৌলতপুর যাত্রা ও ঐ বিবাহ অনুষ্ঠানের বর্ণনা প্রসঙ্গে বিরজাসুন্দরী লিখেছিলেন, “বিয়ে তো ত্রিশঙ্কুর মত ঝুলতে লাগলো মধ্য পথেই, এখন আমাদের বিদায়ের পালা .....।“ স্বপক্ষীয়রা বলেন, যেহেতু বিরজাসুন্দরী স্বয়ং অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, তাই তাঁর সাক্ষ্য প্রমাণ করে যে বিবাহ পর্ব সম্পন্ন হয়নি।

মুজফ্ফর আহমেদ মুসলিম বিবাহ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, তা আধ্যাত্মিক নয়, মূলত হবু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একধরণের চুক্তি যার কিছু শর্ত থাকে। এই বিয়েতেও শর্ত ছিল, এবং নজরুল তা অনুমোদন করতে অস্বীকার করেন। তাছাড়া বিয়ের পরে সহবাস না হলে বিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে না। নজরুল বাসর রাত্রিও যাপন করেননি। মুজফ্ফরের মতে, “কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে যে সৈয়দা খাতুন ওর্ফে নার্গিস বেগমের বিয়ে (আকদ) হয়নি এ সম্বন্ধে আমি স্থির নিশ্চিত হয়েছি।“

কিন্তু বিপক্ষীয়রা বলেন, বিরজাসুন্দরীর প্রবন্ধ নজরুলেরই সম্পাদিত, তাতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া যায় না। তাঁরা বরং একটি চিঠির উপস্থাপনা করেছেন। এটি ‘বিয়ে’র কিছুদিন পরে নজরুল কান্দিরপাড়ে অবস্থানকালীন আলী আকবর খানকে লিখেছিলেন বলে দাবী করা হয়। এটিতে তিনি আলী আকবরকে ‘বাবাশ্বশুর’ সম্বোধনে শুরু করে লিখেছেন, “আপনাদের এ অসুর জামাই পশুর মত ব্যবহার ক’রে এসে যা কসুর করেছে, তা ক্ষমা করো সকলে, অবশ্য যদি আমার ক্ষমা চাওয়ার অধিকার থাকে।........আমার মান-অপমান সম্বন্ধে কান্ডজ্ঞান ছিল না বা ‘কেয়ার’ করিনি ব’লে, আমি কখনো এতবড় অপমান সহ্য করিনি, যাতে আমার ‘ম্যানলিনেসে’ বা পৌরুষে গিয়ে বাজে-যাতে আমাকে কেউ কাপুরুষ বা হীন ভাবতে পারে। আমি সাধ ক’রে পথের ভিখারী সেজেছি বলে’ লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্রআত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি।.....বাবা, আমি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। দোওয়া করবেন, আমার এ ভুল যেন দুদিনেই ভেঙে যায়, এ অভিমান যেন চোখের জলে ভেসে যায়।..... বাকী উৎসবের জন্য যত শীগগীর পারি বন্দোবস্ত করব।.......চির সত্য, স্নেহ সিক্ত, নুরু।“ বিপক্ষের মত, চিঠিতে আলী আকবরকে বাবাশ্বশুর বা বাবা এবং নিজেকে জামাই সম্বোধন, এবং পুরো চিঠির ভাষা ও বিষয়বস্তু প্রমাণ করে যে নজরুল মেনে নিয়েছিলেন তিনি বিবাহিত, নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত এবং তাঁর অভিমান যে ভুল সে কথা স্বীকার করতে প্রস্তুত। কিন্তু স্বপক্ষীয় গোষ্ঠী ঠিক এই কারণেই এ চিঠির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। যিনি বড়জোড় ‘মামাশ্বশুর’ হতে পারতেন, তাঁকে ‘বাবাশ্বশুর’ বা ‘বাবা’ সম্বোধন কতটা গ্রহণযোগ্য ? চিঠির সম্বোধনা বা ভাষ্য, কোনটাই নজরুলের প্রকৃতিগত স্বাভাবিক ভাষা নয় বলে তাঁদের দাবী। তা ছাড়া আরও একটি অসঙ্গতিও ছিল। এই চিঠি কবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে তা জানা যায় না। মুজফ্ফর আহমেদ যখন এ চিঠি দেখেন, তখন তার তারিখ ছিল ২৩ জুলাই ১৯২১, আর স্থান উল্লেখিত ছিল কান্দিরপাড়। কিন্তু ঐ তারিখে নজরুল ছিলেন কলকাতায়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত চিঠিতে তারিখ দেখা যায় ২৩শে জুন। মূল চিঠি কোথাও পাওয়া গেছে বলে জানা যায়নি। স্বপক্ষীয়রা আরও বলেন, যদি ধরেও নেওয়া হয় যে এই চিঠি নজরুলেরই লেখা, তবে তার শেষভাগের বাক্য প্রমাণ করে যে বিবাহের কিছু উৎসব ‘বাকী’ ছিল, অর্থাৎ বিবাহ অসম্পূর্ণ ছিল।

ঐ চিঠি যদি নজরুলেরই লেখা হয়, তা হলেও তিনি সম্ভবত ‘শীগগীর’ কোন ‘বন্দোবস্ত’ করেননি। ফলত আলী আকবর সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় এসে উপস্থিত হ’ন। তালতলা লেনের বাসায় নজরুলের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে মুজফ্ফর আহমেদও থাকতেন। তাঁর জবানীতে, “নজরুলের স্বভাব ছিল যে নূতন কেউ এলে চেঁচিয়ে আনন্দ প্রকাশ ক’রে সে তাকে গ্রহণ করত।.....সেদিন আলী আকবর খান আসাতে নজরুল কোন উচ্ছাস প্রকাশ তো করলই না, একবার বসতেও বলল না তাকে। শক্ত হয়ে চুপ ক’রে বসে থাকল সে। ..... খান সাহেব নিজেই নজরুলের পাশে তখৎপোশের ওপর বসলেন। তাঁর হাতে বেশ পুরু একতাড়া দশ টাকার নোট ছিল। খুব নীচু আওয়াজে কথা বলছিলেন তিনি, আর নোটের তাড়াটি নাড়ছিলেন-চাড়ছিলেন। অকারণে নাড়াচাড়ার মত দেখালেও আসলে ভাবখানা ছিল এই যে এই নোটের তাড়াটি তোমারই জন্যে।“ এই বিবরণীর সমর্থন বিরজাসুন্দরী দেবীকে লেখা নজরুলের একটি চিঠিতেও পাওয়া যায়, যেখানে তিনি লিখেছেন, “মা, আলী আকবর খান আমাকে নোটের তাড়া দেখিয়ে গেল।“ শেষমেষ নজরুলের কী প্রতক্রিয়া ছিল তা স্পষ্ট নয়, তবে মোটামুটি ধরা যায়, খান সাহেব যদি কোন একটা মীমাংসার অভিপ্রায়ে এই সাক্ষাতে উদ্যোগী হয়ে থাকেন, তবে তা ফলপ্রসু হয়নি।

দিন কাটতে লাগল। বছর গড়িয়ে গেল। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ লিখে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন, ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হল, তাঁর সম্পাদনায় ‘ধূমকেতু’র আবির্ভাব হ’ল। অচিরেই রাজদ্রোহের অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হলেন, জেলে অনশন করলেন, কিছু মাস পরে মুক্তিও পেলেন। কবি, সঙ্গীতকার, বিদ্রোহী হিসেবে তাঁর খ্যাতি প্রসারিত হ’ল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করলেন। প্রমীলা এলেন জীবনে। এক সন্তানের মৃত্যু, আরও দুই পুত্রের জন্ম হল। নজরুল গ্র্যামোফোন কোম্পানীতে গীতিকার-সুরকার হয়ে চাকরী করতে লাগলেন।

একদিন যখন তিনি এচ এম ভির স্টুডিওয় বসে কাজ করছেন, বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁকে একটি চিঠি এনে দিলেন। নার্গিসের লেখা। আগেও এসেছে তাঁর চিঠি, নজরুল উত্তর দেননি। এবারও চিঠি পড়ে শৈলজানন্দকে ফিরিয়ে দিলেন। শৈলজানন্দ বললেন, একটা উত্তর তো দিতে হবে। নজরুল অবিলম্বে লিখে দিলেন একটি গান, “যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তা’রে”। বললেন, এটাই তাঁর উত্তর।

এই গানটির রচনাকাল স্পষ্ট নয়। আগেই বলেছি, নার্গিস মোট চারটি চিঠি লিখেছিলেন, সুদীর্ঘ ষোল বছরে। নজরুল উত্তর দিয়েছিলেন মাত্র একটি, ১লা জুলাই ১৯৩৭ তারিখে। সে পত্রটিতেও স্থানের উল্লেখে আছে ১০৬ আপার চিতপুর রোড, গ্রামাফোন রিহার্সাল রুম, কলকাতা। তাই অনুমান করা যায়, ঐ গানটিও এই একই সময়ে রচিত। অর্থাৎ, কেবল গান নয়, একটি পত্রও অবশেষে নার্গিস পেয়েছিলেন নজরুলের কাছ থেকে। চিঠির শেষের দিকে লিখেছিলেন, “তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ ছিঠি হোক।“ এই চিঠির ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে আবেগ, অভিমান, অনুযোগ, আবার আশ্বাসও। কিছু নির্বাচিত উদ্ধৃতিমাত্র দিলাম:

“তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখের শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা ক’রে থাকো, তা হলে আমায় ভুল বুঝবে – আর তা মিথ্যা।

“তোমার উপর আমি কোন জিঘাংসা পোষণ করি না – এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা। কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি - তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না – আমি ‘ধূমকেতু’র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। .......ভুলে যেও না আমি কবি – আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। ..... আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জান বা শুনেছ, জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই।

“আমি কখনো কোন ‘দূত’ প্রেরণ করিনি তোমার কাছে। আমাদের মাঝে যে অসীম ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে, তার ‘সেতু’ কোন লোক ত’ নয়ই – স্বয়ং বিধাতাও হতে পারেন কিনা সন্দেহ। ..... আমি যদিও গ্রামোফোনের ট্রেড মার্ক ‘কুকুরের’ সেবা করছি, তবুও কোন কুকুর লেলিয়ে দিই নাই। তোমাদেরই ঢাকার কুকুর একবার আমাকে কামড়েছিল আমার অসাবধানতায়, কিন্তু শক্তি থাকতেও আমি তার প্রতিশোধ গ্রহণ করিনি-তাদের প্রতি আঘাত করিনি।

“সেই কুকুরদের ভয়ে ঢাকায় যেতে আমার সাহসের অভাবের উল্লেখ করেছ, এতে হাসি পেল। তুমি জান, ছেলেরা (যুবকেরা) আমায় কত ভালবাসে। আমারই অনুরোধে আমার ভক্তরা তাদের ক্ষমা করেছিল। নৈলে তাদের চিহ্ন-ও থাকত না এ পৃথিবীতে। .... তুমি রূপবতী বিত্তশালিনী, গুণবতী, কাজেই তোমার উমেদার অনেক জুটবে – তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। আমি কোন্ অধিকারে তোমায় বারণ করব-বা আদেশ দিব ? .....

“তোমার আজিকার রূপ কি, জানি না। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মত আমার হৃদয়বেদীতে অনন্ত প্রেম অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলে না। পাষাণ-দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদী-পীঠ। ....

“দেখা ? নাই হ’ল এ ধুলির ধরায়। .... তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালবাস, আমাকে চাও, ওখান থেকেই আমাকে পাবে। .... আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও পরম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাক, তা হলে তোমার মত ভাগ্যবতী কে আছে ? .....

“...... তুমি সুখী হও, শান্তি পাও – এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস কর, আমি তত মন্দ নই – এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ।“

চিঠি শেষ করেও আবার একটি PS. দিয়ে লিখেছেন, “আমার ‘চক্রবাক’ নামক কবিতা-পুস্তকের কবিতাগুলো পড়েছ ? তোমার বহু অভিযোগের উত্তর পাবে তাতে। তোমার কোনো পুস্তকে আমার সম্বন্ধে কটূক্তি ছিল।”

ঐ সময় নার্গিস ঢাকায় থাকতেন। তাঁর চিঠির বয়ান তো উপলব্দ্ধ নয়। তবে নজরুলের উত্তর থেকে তার কিছুটা আন্দাজ হয়তো করা যায়। নজরুল তাঁকে নিজের সম্বন্ধে ‘লোকের কথায়’ বিশ্বাস না করতে বলেছেন। বলেছেন আপোষের জন্য কোন বার্তাবাহক তিনি পাঠাননি। একদা তিনি নার্গিসকে ‘দেবীমূর্তি’তে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও নার্গিস স্বেচ্ছায় সেদিন ‘পাষাণ-দেবী’ হয়েছিলেন, এমন অনুযোগ করেও বলছেন সে বেদনার আগুনে তিনিই দগ্দ্ধ হয়েছেন, এবং সেই দহন থেকেই তাঁর বিদ্রোহী সৃজনী সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে নার্গিসের প্রতি তাঁর কোন ‘জিঘাংসা’ নেই। ‘আত্মহত্যা’র বিশ্লেষণও আছে যার উল্লেখ আগে করেছি। ‘চক্রবাক’ পুস্তকে যে অভিযোগের উত্তরের কথা কবি বলেছেন, তা সম্ভবত তাঁর ‘হিংসাতুর’ কবিতাটিকে নির্দেশ করে।

এই পত্রালাপের মধ্যে একটি ‘ঢাকার কুকুরের’ প্রসঙ্গও এসেছে। এর সম্বন্ধে একটি ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। ১৯২৮ সালে ঢাকার রাস্তায় একদিন রাতের অন্ধকারে নজরুল তাঁর কিছু অনুরাগীদের সঙ্গে পথ চলার সময় কয়েকজন দুর্বৃত্ত দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ক্যাপ্টেন নজরুলের বাহুবলের কাছে আক্রমণকারীরা অচিরেই পরাস্ত হয়ে পলায়ন করে। খুব সম্ভবত এই কান্ডেরই ইঙ্গিত এসেছে চিঠিতে। এখানে ‘তোমাদেরই ঢাকার কুকুর’ এই বর্ণনা লক্ষণীয়। নজরুল স্বপক্ষবর্গের অনেকেরই বিশ্বাস, ঐ আক্রমণের পিছনে আলী আকবর খানের ভূমিকা ছিল, যদিও তার সমর্থনে কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে বলে জানা নেই।

কিন্তু নার্গিস ও তাঁর পরিবারের কাছে চিঠিটির সব থেকে গুরত্বপূর্ণ বাক্য অবশ্যই: “তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। আমি কোন্ অধিকারে তোমায় বারণ করব-বা আদেশ দিব ?” যদিও নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকার পঞ্চদশ সংকলনে ‘কুমিল্লায় নজরুল-নার্গিস প্রসঙ্গ’ শীর্ষক নিবন্ধে শান্তিরঞ্জন ভৌমিক লিখেছেন যে বিয়ের অনুষ্ঠানের সে রাতের পর দুজনের “জীবনে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়নি”, কিন্তু অন্য কতিপয় বিবরণীতে আবার পাওয়া যায় যে নজরুলের ঐ চিঠি পাওয়ার পর সে বছরেই ৪ঠা নভেম্বর কলকাতায় এসে নার্গিস তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। দুই মামাতো ভাইকে নিয়ে নার্গিস শিয়ালদদহের কোন হোটেলে এই সাক্ষাৎ করেন বলে তাঁরই জবানীতে দাবী করা হয়েছে। তিনি নজরুলকে নাকি অনুরোধ করেন, তাঁকে প্রথমা স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে, কিন্তু ‘অপ্রস্তুত’ নজরুলের মত ছিল তা প্রমীলার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, এবং নার্গিসের ফিরে যাওয়া উচিত। তিনি এও নাকি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে শীঘ্র ঢাকায় গিয়ে তিনি কোন ব্যবস্থা করবেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। কোন কোন ভাষ্যে অবশ্য বলা হয়েছে যে ঐ সাক্ষাৎকারের সময়েই দুজনের ‘তালাক’ পর্ব সম্পন্ন হয়। আবার অন্য কয়েকটি বিবরণে পাওয়া যায় যে, নজরুল-নার্গিসের ‘তালাকনামা’ কলকাতায় সাক্ষীদের উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৩৭এর ডিসেম্বরে (ডঃ রফিকুল ইসলাম: নজরুল জীবনী, ১৯৭২), অথবা অন্যমতে, পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৮এর ২০শে এপ্রিল (এ.এফ.এম মাহবুবুর রহমান, দৈনিক জনকণ্ঠ, ২০২৩), এবং সেখানে নার্গিস উপস্থিত ছিলেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ, এই বিষয়ে হয়ত কিছু ধুসর এলাকা আছে।

স্বপক্ষীয়রা বলেন, যখন বিয়েই সম্পন্ন হয়নি, তখন তালাকের প্রশ্নই আসে না। বিয়ে হয়নি বলেই নজরুল চিঠিতে নার্গিসকে লিখেছিলেন যে তাঁর প্রতি কোন অধিকার নেই এবং তিনি স্বয়ম্বরা হলে আপত্তি নেই। যদি বিয়ে হয়েই থাকত, তবে নার্গিস ও আলী আকবরের পরিবার এত দীর্ঘ অপেক্ষার পরিসরে বিচ্ছেদের ও আর্থিক দাবীর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারতেন, যা তাঁরা করেননি। যদি ‘তালাক’ও হত, তবে নার্গিসের প্রাপ্য ‘মাহর’ নজরুল তাঁকে দিয়েছিলেন, এমন প্রমাণ বা সাক্ষ্য কোথাও পাওয়া যায় না। তবে এমন ‘তালাক’ কি করে সিদ্ধ হয় ? সর্বোপরি, বিরজাসুন্দরীর বর্ণনায় ‘ত্রিশঙ্কু বিয়ে’, এবং নজরুলের নিজের ভাষ্য ‘বর সেজেছিলুম’ প্রমাণ করে যে এই তথাকথিত বিয়ে তাঁরা স্বীকার করেননি।

বিপক্ষীয়রা বলেন, ঐ বিবাহ সিভিল ম্যারেজ ছিল না, কারণ আইনত নার্গিস তখন নাবালিকা ছিলেন। তাই আইনানুগ উপায়ে বিচ্ছেদ সম্ভব ছিল না। বিয়ে ছিল কাজীর পড়ানো ঐস্লামিক পদ্ধতিগত (যদিও এই মতও স্বপক্ষ মানেন না, আগেই উল্লেখ করেছি)। সেই জন্যই তালাকনামার প্রয়োজন ছিল। তাঁরা এও বলেন, নার্গিস ও নজরুল, দুজনেই দুজনকে ভাল বেসেছিলেন, সাময়িক ভুল বোঝাবুঝি দূর করে নার্গিস যন্ত্রণা সহ্য করেও একটা মীমাংসা করতে বহুকাল অপেক্ষা করেছিলেন। তা ছাড়া সেই সময়ে সামাজিক সম্মানেরও একটা গন্ডী ছিল। তাই নজরুলের চিঠির পর যখন তাঁরা বুঝলেন যে করণীয় আর কিছুই নেই, তখন তালাকই শেষ উপায় ছিল। নজরুলের প্রতি নার্গিসের অনুরাগবশতই এবং নজরুলের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে তাঁরা দেনমোহর বা মাহর পরিত্যাগ করেন।

কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ স্পষ্টতই বলেছেন বিয়ে হয়নি। নজরুল জীবনীকার রফিকুল ইসলামও মোটামুটি এই বক্তব্য সমর্থন করেছেন। অন্যদিকে বেগম সামসুন্নাহার, মো. ওয়াজেদ আলী, আব্দুল কাদির প্রভৃতির লিখন ইঙ্গিত করে যে বিয়ে হয়েছিল। কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দস্তাবেজ, যেমন নার্গিসের চিঠিগুলি, কাবিননামা বা স্বাক্ষরিত তালাকনামার মূল লিপিগুলির বা কোন অনুলিপির কোন হদিস পাওয়া যায়নি, যা হয়তো এই বিষয়ে আলোকপাত করতে পারত। বিষয়টি তাই বিতর্কিতই রয়ে গেছে।

সুদীর্ঘ ১৭ বছরের অপেক্ষার শেষে, কিছু মাস পরে, ১৯৩৮এর সম্ভবত ১২ই ডিসেম্বর ঢাকায় নার্গিস বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হন আজিজুল হাকিমের সাথে। আলী আকবর খান তখন ঢাকায় তাঁর পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রীর ব্যবসা করতেন। আজিজুল হাকিম তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও নিজ প্রতিভাগুণে একজন কবি, অনুবাদক ও সম্পাদক ছিলেন। তিনি আবার নজরুলের অত্যন্ত গুণগ্রাহীই শুধু ছিলেন না, তাঁর পরিচিত ও স্নেহধন্যও ছিলেন। নার্গিসের এই পরিণয় উপলক্ষে ১৯৩৮এর ১লা ডিসেম্বর নজরুল তাঁকে আরেকটি সংক্ষিপ্ত পত্রে লিখেছিলেন, “তোমাকে পেয়েও হারালাম। তাই মরণে পাবো – সেই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকব। প্রেমের ভুবনে তুমি বিজয়িনী, আমি পরাজিত। আমি আজ অসহায়। বিশ্বাস করো -আমি প্রতারণা করিনি। আমাদের মাঝে যারা এ দূরত্বের সৃষ্টি করেছে, পরলোকেও তারা মুক্তি পাবে না।“ সঙ্গে একটি কবিতাও ছিল: ‘তোমার প্রিয় যদি পাশে রয় / মোরও প্রিয় সে করিও না ভয় / কহিব তারে, আমার প্রিয়ারে আমারো অধিক ভালবাসিও।‘

এই বিচিত্র প্রেমপর্ব আর তার পরের সুদূরবিস্তৃত বিরহ-বেদনা নজরুল-সৃষ্ট কাব্যে ও সঙ্গীতে গভীর প্রভাব রেখে গেছে, তা বহু বিশ্লেষিত। শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের ভাষায়, “নজরুলের কবিতায় ও গানে নানা অনুষঙ্গে নার্গিস তাঁর সৃষ্টিশীলতায় সবসময় জাগ্রত ছিল। নজরুলের সৃষ্টিশীল রচনায় পূর্ণতার ক্ষেত্রে পরোক্ষে নার্গিসের অবদান অসীম।“ এ বিষয়ে আলোচনায় গেলে একটি ভিন্ন নিবন্ধ হতে পারে।

কাজী নজরুল ইসলাম সুবিখ্যাত। কিন্তু সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস আসার খানমের লোকপরিচিতি সীমায়িত। তবে তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিও সৃজনীতে পরবর্তী সময়ে প্রমাণ করেছিলেন যে তিনিও এক বহু গুণসম্পন্না রমণী ছিলেন। নজরুলের সঙ্গে পরিচয়ের সময়ে তিনি ছিলেন অল্পশিক্ষিতা, হয়তো নিজ সিদ্ধান্তে দ্বিধাগ্রস্তা। সতেরো বছরের নিদারুণ সময় তিনি যে স্থৈর্য ও আত্মস্থতায় অতিবাহিত করেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে উল্লেখনীয়। সময়ের কঠিনতাকে অতিক্রম করে তিনি নিজেকে উন্নততর করার প্রয়াস করেছিলেন। স্বেচ্ছায় ঘরে বসেই তিনি পড়াশোনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৩৫ সালে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন, এবং ১৯৩৭ সালে ইডেন গার্লস কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইতিমধ্যে আলী আকবর খান তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেখানে বাংলাবাজার এলাকায় একটি বাড়ী নির্মাণ করে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়। নার্গিস মামার পুস্তক ব্যবসাও পরিচালনা করতে শুরু করেন, সম্ভবত সে সময়ের একমাত্র সফল মহিলা ব্যবসায়ী।

নার্গিস সাহিত্য রচনায়ও লেখনী ধরেছিলেন। তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাস, ধর্মীয় গ্রন্থ এবং কবিতা ও গান রসিক পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে। বিচ্ছেদের বেদনা, জ্বালা ও হয়তো কিছুটা তিক্ততা তাঁর রচনাকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর উপন্যাস ‘তাহমিনা’য় তিনি বর্ণনা

  পরিনত বয়সে নার্গিস



করেছেন বীর রুস্তমের স্ত্রী তাহমিনার একাকীত্ব ও দুরূহ সংগ্রামের কথা, যাকে নিঃসঙ্গ করে তার স্বামী যুদ্ধ করতে চলে যায়। প্রচলিত ধারণা এই যে এই উপন্যাসটিই নজরুলকে ‘হিঁংসাতুর’ কবিতা রচনায় প্ররোচিত করেছিল। তেমনি ‘ধূমকেতু’ উপন্যাসে নার্গিস লিখেছেন কোন নারীর শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবনে কেমন করে ধূমকেতুর মত এক পুরুষের অযাচিত আবির্ভাব ও প্রস্থান সব কিছু ছাড়খার করে দিয়ে চলে যায়। ‘পথের হাওয়া’র নায়কের চরিত্রেও বোহেমিয়ান স্বভাবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। ১৯৮০ সালে নার্গিস যমুনা সাহিত্য গোষ্ঠী প্রদত্ত ‘বিদ্যাবিনোদিনী’ সম্মাননা লাভ করেন।

নার্গিসের সংস্পর্শে এসেছেন এমন কয়েকজনের বিবরণীতে, এবং তাঁর দেওয়া কতিপয় সাক্ষাৎকারে, এই নারীর স্বভাব ও চরিত্রের বিবিধ দিক উন্মোচিত হয়েছে। এই বিষয়ে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া রচিত ‘কবিপ্রিয়া নার্গিস: তোমাকে যেমন দেখেছি’ (অভিনন্দন, ১৯৯৬) প্রবন্ধ থেকে কিছু উধৃতি এখানে প্রাসঙ্গিক: “যখনই তাঁর সান্নিধ্যে যেতাম, তখনই আমার মনে হতো: আমি এক যন্ত্রণাদগ্ধ মহিয়সী নারী এবং ইতিহাসের কিংবদন্তী নায়িকার মুখোমুখি। নার্গিস যেভাবে এবং যে সকল বিষয়ে আলোচনা করতেন, আমি বিশ্বাস করি: সমকালে কোনো মুসলিম মহিলার সাথে তাঁর তুলনা হয় না। রূপের রাণী নার্গিস অতিথিপরায়ণা, রুচিশীল, পরিচ্ছন্নপ্রিয়তা, স্বল্পভাষিণী ছিলেন। তাঁর হাসি ছিলো মধুর, মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না।......নিজের হাতে রান্না করতেন, নামাজ পড়তেন এবং তিনি অবিশ্বাস্য রকম দায়িত্বশীল ছিলেন। স্বামীর প্রতি তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিলেন।.....নার্গিস প্রায় নিয়মিত নজরুলসংগীত শুনতেন। বিশেষ করে, নজরুলের বিরহদীর্ণ প্রেমাশ্রয়ী সংগীতমালা শুনে তাঁকে আমি নিরবে কাঁদতেও দেখেছি। নিজে ছিলেন সুকণ্ঠি । শৈশবে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানও গাইতেন, সে কথা নিজেই বলেছেন আমাকে।“

আজিজুল হাকিম ও নার্গিসের দুই সন্তান – পুত্র ডঃ ফিরোজ আজাদ ছিলেন ম্যানচেস্টারে চিকিৎসক, এবং কন্যা ডঃ শাহনারা অক্সফোর্ডে বাস করতেন। ১৯৬২ সালে আজিজুল হাকিমের মৃত্যু হয়। ১৯৭১ সালের প্রারম্ভে নার্গিস ম্যানচেস্টারে ছেলের কাছে চলে যান। সেখানেই ১৯৮৫ সালে ৮১ বছর বয়সে তাঁর দেহাবসান হয়, এবং নজরুল-প্রিয়াকে সমাধিস্থ করা হয়।

2 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in






কবিতায় জাদুবাস্তবতা এবং কবিতায় তার অবস্থান প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই কবিতা কি এবং কবিতা কাকে বলে তার ওপর আলোচনা করতে হয় ।
কবিতার ইংরেজি শব্দ poetry যা প্রাচীন গ্রীক শব্দ ποιεω ,Poetry শব্দটি Greek শব্দ poiesis থেকে এসেছে যার অর্থ হলো নির্মাণ বা তৈরি, যা শিল্পের একটি শাখা, এই শাখায় ভাষায় নান্দিক কবিতা মানুষের ভাষার বিশেষ কলা, যা সাধারণ গদ্যরীতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
প্রকৃতপক্ষে, কবিতার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া বড়ই কঠিন ! বিশ্বসাহিত্যে খ্যাতিমান কবিরা বিভিন্নভাবে একে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘ প্রগাঢ় আবেগগুলোর স্বত:ফুর্ত উচ্ছ্বাস’ তাঁর মতে, কবিতা সব জ্ঞানের মূল্যবোধ, সৌন্দর্যের প্রকাশ। নিভৃতচারী নারী কবি এমিলি ডিকিনসন বলেন,'যদি আমি একটি বই পড়ি তবে তা আমার ঠান্ডা শরীর উষ্ণতায় ভরে উঠে, আমি জানি ওইটাই কবিতা ' ডিলান টমাস কবিতার সংজ্ঞা দেন এভাবে;'কবিতা, যা আমাকে হাসায় কিংবা কাঁদায় অথবা হাই তোলায়, যা পায়ের আঙুলের নখ শিহরিত হয়, যা আমার দিয়ে এটা কিংবা ওটা কিংবা কিছু করাতে চায়।' খ্যাতিমান ইংরেজ কবি কোলেরিজের মতে , শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসের শব্দগুলোর বিন্যাসই কবিতা। কবিতায় মূল্যবোধ,সৌন্দর্য প্রকাশ করতে গেলে কবিতায় তন্ময়তা, সঙ্গীতের মন্ময়তা এবং একটা বাণী। তাছাড়া ছন্দময়তা তো অবশ্য থাকতে হবে।
ইংলিশ রেঁনেসার প্রাক্কালে জন মিলটন, ক্রিস্ট্রোফার মার্লো, শেক্সপিয়ার প্রমুখ কবিরা যে সমস্ত কাব্যিক নাটক রচনা করেন, যা চিরকালীন । ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক কালপর্বে গেটের “ফস্ট”,কোলেরিজের “ কুবলাই খান” এবং জন কিটসের
"Ode on a Grecian Urn." কাব্য অন্তরঙ্গ অনুষঙ্গে কাব্যানুরাগী মানুষকে বিমোহিত করে। জন কিটস বলেছেন ,"Beauty is truth. Truth, beauty.
That is all ye know on Earth and all ye need to know."
'সৌন্দর্য হচ্ছে সত্য, সত্য হচ্ছে সৌন্দর্য পৃথিবীতে তোমরা এ সব জান আর তোমাদের এ সব জানার প্রয়োজন।"
সত্য আর সৌন্দর্যের বহি:প্রকাশই কবিতা এটাই প্রকাশ পেয়েছে জন কিটসেই এই কবিতায় । কবিতা সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল। এবার আমাদের আলোচ্য বিষয় কবিতায় জাদুবাস্তবতা। আমরা দেখার চেষ্টা করবো জাদুবাস্তবতা আসলে কী?
জাদুবাস্তবতা হলো সাহিত্যের একটি ফর্মেট, নমুনা বা গঠন। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ম্যাজিক রিয়ালিজম। বর্তমান বিশ্বসাহিত্যের গল্প এবং উপন্যাসে যার প্রভাব লক্ষণীয় হলেও মূলত ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যিকরা একে বেড়ে উঠতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তারা এটি করেছে ইংরেজি সাহিত্য হতে নিজেদের আলাদা করতে। যা মূলত তাদের সাহিত্যের একটি আন্দোলন।
বিশ্বসাহিত্যে জাদুবাস্তবতার ব্যবহারে মার্কেজকে বলা যায় ’দ্যা ফাদার অফ ম্যাজিক রিয়ালিজম’। কেননা তিনি
তার গল্প এবং উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার যে ব্যবহার করেছেন তার ফলেই বিশ্বসাহিত্য তাকে সাদরে গ্রহণ করেছে।এছাড়া ইসাবেল এবং কার্পেন্তিয়ারও ছিলেন এ বিষয়ে সিদ্ধহস্ত। তবে জাদুবাস্তবতার ধারণাটির জন্মদাতা কোনো ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যিক নয়। জার্মান চিত্রকলা বিষয়ক সমালোচক ফ্রাঞ্জ রোহ তার নবীন ইউরোপীয় চিত্রকলা বিষয়ক বইটিতে প্রথম জাদুবাস্তবতা শব্দের বিষয়বস্তু তুলে ধরেন। চিত্রকলায় যা ব্যবহার হত। পাঠকগণদের নিকট উদাহরণস্বরূপে বলা যায়, পাঠকগণ মোনালিসার হাসির সঠিক ব্যাখ্যা এ পর্যন্ত বিভিন্ন বিশারদগণ বিভিন্ন অর্থে বলেছে। যাকে জাদুবাস্তবতা বলা চলে।
জাদুবাস্তবতা সাহিত্যে প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৯৫৫ সালে এঞ্জেল ফোর্স নামে স্পেনীশ উপন্যাসে। পরবর্তী সময়ে মার্কেজ, ইসাবেল, কার্পেন্তিয়ারা একে বিশ্বসভার আসরে স্থান করে নিতে সাহায্য করেন তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে। যদি আমরা ১৭ শতক বা আঠার শতকের বিশ্বসাহিত্য নিয়ে কথা বলি, তাহলে দেখা যায়- ১৭২৬ সালে প্রকাশ হওয়া জনাথন সুইফটের উপন্যাস ‘গালিভার ট্রাভেলস’ এবং ১৮৪২ সালে প্রকাশিত হওয়া নিকোলাস গোগল এর উপন্যাস ‘নোজ’ এ জাদুবাস্তবতার ব্যবহার ছিল। কিন্তু তখন এর কোনো ধারণা ছিল না। এর ধারা প্রমাণ হয় যে, জাদুবাস্তবতা কোনো মৌলিক বিষয় নয়। লেখকের কল্পনা শক্তিই মূলত তার প্রকৃতরূপ। এছাড়া ওই সময়ের পরে ডিকেন্স, বালজাক আর কালভিনোর উপন্যাসেও জাদুবাস্তবতার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় কবিতায় জাদুবাস্তবতা ব্যবহারের চেষ্টা করছেন সাহিত্যিকরা। কিন্তু যা করা হচ্ছে তা কী জাদুবাস্তবতা হচ্ছে নাকি তা বিচার সাপেক্ষ? কেননা কোনো অবাস্তব ঘটনার অবতারণা, পৌরাণিক কাহিনি বা মিথ ইত্যাদি বিষয়কে জাদুবাস্তবতা বলা যায় না। জাদুবাস্তবতা সেটা যা বাস্তবতাকে বিশেষ কিছু শক্তিমত্তায় বা অলৌকিক রূপে প্রকাশ করা হবে। যাতে বাস্তবতার সাথে অদ্ভুত বা বিস্ময়কর কোনো বিষয়ের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়। এই জাদুবাস্তবতা মূলত গড়ে ওঠে কাহিনিকে কেন্দ্র করে। যার জন্য গল্প বা উপন্যাসে এর প্রয়োগ হয়ে থাকে কবিতায়ও এটি ব্যবহার করা যায়। তবে তা সবার দ্বারা সম্ভব নয়। কেননা অদ্ভুত কোনো বিষয়ের অবতারণা করলেই সেটা জাদু বাস্তবতা হয় না। আর কবিতা তো কাহিনি নির্ভর না।বাংলা সাহিত্যে কেউ কেউ এটা ব্যবহার করতে গিয়ে এমন কিছু লিখে যে তাতে কবিতার কোনো মৌলক বিষয় বা মূলভাব থাকছে না। কবিতার যদি মূলভাবনাই না থাকে তাহলে ওই লেখার কি কোন মূল্য আছে? আমাদের মনে রাখা উচিত যে কবিতায় তার বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ।
পাঠক কবিতার মাঝে একটি রহস্য খুঁজে পায় বা ঘোরের মাঝে আবর্তিত হয়, কীভাবে এটি সম্ভব? ঠিক এই বিষয়টিরই নাম দেয়া হয়েছে জাদুবাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়ালিজম। অর্থাৎ কবিতার রহস্যতাকেই কবিতায় জাদুবাস্তবতা বলা চলে।
জাদুবাস্তবতার আগে সাহিত্যে পরাবাস্তবতার অবতারণা করেছেন সাহিত্যিকরা। পরাবাস্তবতা হচ্ছে এমন এক ধরনের বাস্তবতা যার সঙ্গে চাক্ষুষ বাস্তবতার কোন মিল নেই। ইংরেজীতে সুররিয়েলিজম (surrealism) বলা হয়। বস্তুত চেতনার মূল ভিত্তি হলো অযুক্তি ও অবচেতন। ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক ধারণা মিলানো যায় এখানে। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের ভাবনা- মানুষ অবচেতন মনে অনেক কিছুই করে বা ভাবে। তিনি বলেন- এ ভাবনা চেতন মনের চেয়ে অবচেতন মনেরই বেশি। পরাবাস্তবতা হচ্ছে মানুষের চেতনটা যখন শিথিল হয় তখন মানব মনে অবচেতন প্রভাব ফেলে। এটি হচ্ছে- কবির প্রতীক ও চিত্রকল্পসমূহের মধ্যে যোগসূত্র। মূলত সুইজারল্যান্ড থেকে উঠে আসা ‘ডাডাইজম’ এর পরবর্তী আন্দোলন হচ্ছে ‘সুররিয়েলিজম’ বা ‘পরাবাস্ততা’। এখন আবার তাকে জাদুবাস্তবতা বলছেন অনেকে। জাদুবাস্তবতাবাদ এবং পরাবাস্তবতাবাদ উভয়ই ১৯২০ সালের দিকে তাত্ত্বিক রূপ পায়। এবং প্রায় সমসাময়িক সময়েই এদের ইশতেহার রচিত হয়। সে সময়টা ১৯২৫ সালের দিকে ফ্রাঞ্জ রোহ জাদুবাস্তবতাবাদ এবং এর কিছুদিন আগেই আন্দ্রে ব্রেতঁ প্রকাশ করেন পরাবাস্তববাদের ইশতেহার। এখন যাকে জাদুবাস্তবতা বলছেন অনেকে।
মার্ক আর্নেস্টের সংজ্ঞা আমরা তুলে ধরতে পারি। সুররিয়েলিজমকে তিনি বলেছেন সুররিয়ালিস্টের লক্ষ্য হচ্ছে অবচেতনার বাস্তব চিত্র আঁকা নয় কিংবা অবচেতনার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে কল্পনার আলাদা এলাকা সৃষ্টি করাও নয়। এর লক্ষ্য হলো চেতন ও অবচেতন মনের সাথে বাইরের জগতের সব দৈহিক ও মনের বেড়া তুলে দেয়া। এই পরিপ্রেক্ষিত, আসলে পরাবাস্তবতাই জাদুবাস্তবতা। একারণে আমরা পরাবাস্তবতার কবিতাগুলোর। আলোকপাত করতে পারি।
ইতালিতে জন্মগ্রহণ করা ফ্রেঞ্চ আপোলিনিয়ার (১৮৮০-১৯১৮) সুররিয়েলিজম’ শব্দটি উল্লেখ করেন। তাঁর লেখা কবিতায় আদি-সুররিয়েলিজম কাব্যের নিদর্শন রয়েছে। ‘টাইরেসিয়াম-এর 'স্তন’ নাটকে প্রথম সুররিয়েলিজম প্রয়োগ করেন তিনি। পরে তা ইংরেজী ও জার্মান সাহিত্যেও এ ধারা সম্প্রসারণ হয়। ‘চাঁদের আলো’ কবিতায় তিনি পরাবাস্তবতাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন এভাবে-
‘ক্রোধীর ঠোঁটে শ্রবণসুখকর চাঁদ
আর রাতের লোভার্ত নগর ও উদ্যান
মৌমাছির মতো নক্ষত্রদের ভ্রম হয়
এই আলোকময় মধুতে আঙুরবাগান আহত
আকাশ থেকে ঝরছে মধুর মধু
চাঁদের রশ্মি যেন মধুর ঝিকিমিকি
.হাওয়ায় গোলাপে মিশছে মধুর চন্দ্রিমা।’
বাঙলা সাহিত্যে অনেকে পরাবাস্তবতা, যা জাদুবাস্তবতার বেশ কিছু প্রয়োগ করেছেন। বর্তমানকালের প্রায় সব কবিই পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বা কাজী নজরুল কবিতা ও গানে সামান্য পরাবাস্তবতার উপাদান ব্যবহার করেছেন। যেমন ‘আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই, সেই পাহাড়ের ঝরনা আমি...।’ বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, শক্তি চট্টপাধ্যায়, সুনীল, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, মান্নান সৈয়দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ কবিতায় পরাবাস্তবতা এনেছেন মাঝে মধ্যে।
আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি বিষ্ণু দে তাঁর ‘ঊর্বশী ও আর্টেমিস’ কাব্যগ্রন্থে প্রথম সার্থক সুররিয়েলিজম বা পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেন। তবে পরাবাস্তবতার উপাদান সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তাঁর ‘ঝরাপালক’, ‘বনলতা সেন’, ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থে পরাবাস্তবতার ব্যবহার অনেক বেশি। তাঁকে ‘পরাবাস্তবতার কবি’ বলা হয়ে থাকে। পরাবাস্তবতার সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন পরাবাস্তবতার কয়েকটি উদাহরণ দিতে পারি নিচের কবিতায়।
‘জানতাম তোমার চোখে একদা জারুলের বন
ফেলেছে সম্পন্ন ছায়া, রাত্রির নদীর মতো শাড়ি
শরীরের চরে অন্ধকারে জাগিয়েছে অপরূপ’- (কোন এক পরিচিতাকে, শামসুর রাহমান)
‘অনেক আকাশ’ কবিতায় সৈয়দ আলী আহসান ধরা দিয়েছেন এভাবে-
‘... সোনার ঘাসের পাতা ঘুমের মতো
অজস্র পাতার ফাঁকে হৃদয়ের নদী হয় চাঁদ নেমে ঘাসে’- -------
আল মাহমুদ বেশ কয়েক জায়গায় পরাবাস্তবতার উপাদান ব্যবহার করেছেন। ‘নদীর ভেতরে নদী’ কবিতায় পরাবাস্তবতার একটু প্রয়োগ দেখি-
‘নদীর ভেতরে যেন উচ্চ এক নদী --------।
তিতাসের স্বচ্ছ জলে প্রক্ষালনে নেমেছে তিতাসই।
নিজের শাপলা লয়ে নেমে নদী নদীর ভেতরে
ঠাট্টা বা বিদ্রুপ নেই, শ্যেনচক্ষু, নেই চারণের বালি।’
মান্নান সৈয়দ বলতেন- সুররিয়েলিজমই হলো প্রকৃত বাস্তবতা। তিনিও কবিতায় সার্থক পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেছেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ ’(১৯৬৭)। এখানে সুররিয়েলিজমের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তিনি জীবনান্দ দাশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা লিখেছেন এবং গবেষণা করেছেন। আর এ কারণে জীবনান্দের প্রভাব কবির মনে। আরো কয়েকটি কবিতায়।যেমনঃ
১) ‘দেখেছি ঘাসের মেঝে ছিন্ন
লাল মুন্ডু নিয়ে খেলে বিনা অপব্যয়ে
সূর্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে কালো রেলগাড়ি।’ (কবিতা, রাত্রপাত)
২) ‘জ্যোৎসনা হয় জল্লাদের ডিমের মতো জলহীন মুন্ডু
জোড়া-জোড়া চোখ
সাতটি আঙুলের ও একমুষ্টি হাত
রক্তকবরীর অন্ধকার
এবং একগুচ্ছ ভুল শিয়ালের সদ্যোমৃত যুবতীকে ঘিরে জ্বলজ্বলে চিৎকার’- ( জ্যোৎসনা কবিতায়)
৩) ‘একেকটি দিন একেকটি সবুজভুক সিংহ’ কবিতায়-
‘পরিবর্তনের ছাদ বিড়ালের মতো
অন্যমনস্ক হওয়ার সুযোগে পা টিপে-টিপে এগোল
বরফের মানুষ নাজেহাল ছোটো-ছোটো নুড়ির আওয়াজ ---- কবি জীবনানন্দ দাশের কয়েকটি কবিতার কিছু চরণ তুলে ধরলে তাঁর কবিতায় আমরা দেখতে পাই তিনি জাদুবাস্তবতার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত। লক্ষ করুন------ তিনি পাঞ্জাবির পকেটে চাঁদের উঁকি দেয়া দেখতে পান-
‘দেখি তাঁর চুলে রাত্রি থেমে আছে
চোখে সবুজ প্রিজমের ভেতর থেকে লাফিয়ে পড়ে ফড়িং
... বেরিয়ে আসছে সান্ধ্যবেলার সবগুলো তারা
দেখি তার পাঞ্জাবির ঢোল পকেটে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ।’
‘বনলতা সেন’ কবিতাগ্রন্থের ‘তুমি’ কবিতায় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতা সম্বন্ধে যা বলেন তার মধ্যে কবিতার সংজ্ঞা অবশ্যই নিহিত আছে। ’
জীবনান্দ দাশ তাঁর বিপুল কবিতাসম্ভারে প্রেম ,প্রকৃতি রোমান্টসিজিমরে নিবিড় সমারোহ ! জাদুবাস্তবতাবাদ নামটি সাহিত্যতত্ত্বে বিংশ শতকীয় সংযোজন হলেও সাহিত্যে এর ব্যবহার বহুপ্রাচীন। ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ প্রভৃতি প্রাচীন মহাকাব্যগুলোকেও জাদুবাস্তবতার আলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। অনেক সাহিত্য সমালোচক বলেন---- জাদুবাস্তবতাবাদের সাথে অনেকের পরাবাস্তবতাবাদকে (Surrealism) মিলিয়ে ফেলেন, যদিও দু’টি ধারণায় খুবই কাছাকাছি, কিন্তু এক নয়। বলা যেতে পারে একটি গাছের দু’টি শাখা, জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় দু’টি ব্যাপারকেই খুব দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছেন । জীবনানন্দ অন্যান্য কবিতায় পরাবাস্তবতা ও জাদুবাস্তবতার অনেক অনেক উদাহরণ যথাস্থানে দেবো। আগেই বলা হয়েছে,কবিতায় জাদুবাস্তবতা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে জাদুবাস্তবতা কাকে বলে। সত্যি কথা বলতে জাদুবাস্তবতার সংজ্ঞা দেওয়া বড়ই কঠিন। আমরা তুলে ধরবো বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য সমালোচকের উক্তি। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য সমালোচকরা জাদুবাস্তবতা বা Magical realism নানা সংজ্ঞা প্রদান করেছেন নানা ভাবে।
বিশ্বসাহিত্যের গল্প,উপন্যাস ও কবিতায় খ্যাতনামা লেখকদের রচনায়রিয়ালিজম, ক্রিটিক্যাল রিয়ালিজম, সোস্যালিস্ট রিয়ালিজম, সুররিয়ালিজম, স্ট্রাকচারালিজম, পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম, মডার্নিজম, পোস্টমডার্নিজম, পোস্ট কলোনিয়ালিজম, ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতা অনুষঙ্গ আমরা লক্ষ্য করি। আমাদের আলোচ্য বিষয় কবিতায় জাদুবাস্তবতা। জাদুবাস্তবতাকে তুলে ধরার শৈল্পিক রীতি হল জাদুবাস্তবতাবাদ। কবিতায় জাদুবাস্তবতা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে আমাদেরকে জাদুবাস্তবতাবাদের বৈশিষ্টগুলোর উপর নজর দিতে হয়। স্বপ্ন ও কল্পনার মিশেলে অতিপ্রাকৃত, অলৌকিকত্ব, কল্প কাহিনী, রহস্যময়তা ইত্যাদি জাদুবাস্তবতাবাদে দেখা যায়।
সমকালীন বিশিষ্ট ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও সমালোচক-গবেষক ডেভিড লজের মতে, ‘নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে বাস্তবতা লক্ষণীয় হলেও অনেক সময় ঘটনার বাস্তব অনুষঙ্গের ভেতরে চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটে তখন তাকে জাদুবাস্তবতাবাদ আখ্যায়িত করা হয়,যার বিশেষ সংশিষ্টতা আছে লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের লেখায়, এসম্বন্ধে আগেই আভাস দেওয়া হয়েছে। যদিও এর দেখা পাওয়া যায় অন্যান্য মহাদেশের লেখকদের গল্প-উপন্যাসে, যাঁদের মধ্যে আছেন গুন্টার গ্রাস, সালমান রুশদি এবং মিলান কুন্দেরা। এই লেখকদের প্রত্যেকেই নানান ঐতিহাসিক ঘটনার সহিংস আলোড়ন এবং ব্যক্তিগত জীবনেও নানান উত্থান-পতনের তীব্র সংক্ষোভের ভেতর দিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের সেই অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে প্রকাশের জন্য বাস্তববাদ যথেষ্ট ধারণক্ষম নয় বলেই তাঁরা মনে করেছেন। Lodge,1992:114)
লজ আরো মনে করেন, ‘অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিমাণ ব্রিটিশ লেখকের মধ্যে এর প্রভাব রয়েছে এবং বাইরে থেকে এর আগমন ঘটলেও কয়েকজন একে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছেন; তাঁদের মধ্যে আছেন ফে ওয়েল্ডন, অ্যাঞ্জেলা কার্টার এবং জেনেটি উইন্টারসন। Lodge,1992:114) জাদুবাস্তবতাবাদ দৃষ্টান্ত হিসেবে মিলান কুন্দেরার ‘দ্যা বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’র একটা অংশ উপস্থাপন করেন। আমরা সেই অংশটিতে দেখি একদল নৃত্যরত মানুষ নাচতে নাচতে মাটি থেকে হাওয়ায় ভাসতে থাকে এবং ভাসতে ভাসতে আকাশে উড়ে যায়। জাদুবাস্তবতাবাদ একদিক থেকে মূলত এমন একটি রচনারীতি ও প্রকাশভঙ্গি যাতে অনেক বিষয়কে নতুন করে বর্ণনা করা হচ্ছে। এই রীতিটিকে প্রায়শই মিশিয়ে ফেলা হয় অতিপ্রাকৃত, উদ্ভট, আজগুবি ঘটনার সঙ্গে।
জাদুবাস্তবতার কথা আলোচনা করতে ডেভিড লজ যে প্রধান চারজন লেখক নাম উল্লেখ করেছেন তারা হচ্ছে: গাবরিয়াল গার্সিয়া মার্কেস গ্যুন্টার গ্রাস , , মিলান কুন্দেরা এবং সালমান রুশদি । জাপানের হারুকি মুরাকামিএর ’দ্য উইন্ড- আপ বার্ড ক্রেনিকেল ’ , রাশিয়ান লেখক মিখাইল বুলগাকভের ‘ দ্য মাস্টার এন্ড মারগারিটা’,চিলির ইসাবেলা আলেন্দের ‘ দ্য হাউস অফ দি স্পিরিট, আমেরিকান- আফ্রিকান লেখিকা টনি মরিশনের ‘ বিলাভেড’ এ magical realism বা.জাদুবাস্তবতা পুরোমাত্রায় বর্তমান।
উপন্যাসে জাদুবাস্তবতাবাদের পুরোধা গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সম্বন্ধে না বললে সাহিত্যে জাদুবাস্তবতা সম্বন্ধে সম্যক জানা সম্ভব নয়। মূর্তিমান কলোম্বিয়ান লেখক গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ৮৭ বছর বয়সে মারা যান, কিন্তু তিনি তাঁর উপন্যাসগুলোতে উজ্জ্বল ভাবে আবিষ্কার করে গেছেন জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গে। তাঁর মাস্টারপিস‘ ওয়ান হান্ডের্ড ইয়ারস অফ সোলিচিউড ’ ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়, যার জন্য ১৯৮২ সালে নোবেল প্রাইজ লাভ করেন। তিনি নোবেল ভাষণে বলেন যে তিনি চেষ্টা করেছিলেন কেন জাদুবাস্তবতা লাতিন আমেরিকায় এতটা চমৎকার। তিনি বলেন,“ কবি ও ভিক্ষুক, সঙ্গীত শিল্পী ও ভবিষ্যত দ্রষ্ট্রা , যোদ্ধা ও বদমায়েস এবং সব প্রাণীর মাঝে উদ্দাম বাস্তবতা আছে,আমরা তার মাঝে সামান্য কল্পনার মেলবন্ধন ঘটিয়েছি-----’
জাদুবাস্তবতা প্রসঙ্গে আরো বলা যায়, জাদুবাস্তবতা একটা অনুষঙ্গ যাতে অপ্রাকৃত উপাদানের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। প্রথম কালপর্বে কবি সাহিত্য ও চিত্রকরা সাহিত্য ও চিত্রকলায় শুধুমাত্র বাস্তববাদিকতাকে তুলে ধরতেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশ শতকে ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকজন লেখকের লেখায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গের উপস্থিতি বিশেষ ভাবে উঠে আসে। Magical realism শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় ফ্রাৎস রো(১৮৯০- ১৯৫৫) নামে একজন কলা সমালেচকের বইয়ে ১৯২৫ সালে। এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রের লক্ষ্য ছিল দৈনন্দিন জীবনের রহস্যজনক উপাদানগুলোকে মেলে ধরা। রো যদিও সাহিত্যের রচনা শৈলিতে Magical realism হিসাবে বলে মনে করেননি। তাঁর মতে এই শব্দটির ব্যবহারিক ভিত্তি ছিল রোজকার জীবনের চমকের সামনে মানুষের বিস্ময়েরই অভিব্যক্তি।
আমেরিকার প্রখ্যাত মহিলা কবি এমিলি ডিকিনসন( ১৮৩০- ১৮৮৬) কাব্য প্রতিভার কথা উপেক্ষিত থেকে গেছে। উনিশ শতকের এমিলির কবি জীবনের কালপর্বে বিশ্ব সাহিত্যের গদ্য ও পদ্যে জাদুবাস্তবতার কথা না উঠলেও কবি এমিলি ডিকিনসন তাঁর লেখা কবিতায় পরবর্তীকাল পর্বে সাহিত্য সমালোচকরা জাদুবাস্তবতা এর অনুষঙ্গ লক্ষ করেন। উনিশ শতকের উত্তর আমেরিকার প্রখ্যাত কবিদের মধ্যে অন্যতম মহিলা কবি এমিলি ডিকিনসন এর কাব্য প্রতিভার ওপর আলোকপাত করা যেতে পারে। এমিলি ডিকিনসন উত্তর আমেরিকার বিখ্যাত কবি, তাঁর জীবিতকালে ২০০০ এর অধিক কবিতা রচনা করলেও বেঁচে থাকাকালে তাঁর কবিতা তেমন প্রকাশিত হয় না।
এমিলি ডিকিনসনের কবিতাগুলো বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তাঁর লেখা কবিতার অর্থ তাৎপর্যপূর্ণ এবং জাদুবাস্তবতায় বর্ণনামূলক কাব্যিক অনুষঙ্গে ভরপূর । তাঁর লেখা কবিতায় ধ্যানমগ্নতা, বিশ্বজনীনতা, প্রেম ভালবাসা ও প্রকৃতি বন্দনায় ঋদ্ধ। এমিলি ডিকিনসনের কাব্যপ্রতিভার স্বাক্ষর ছড়িয়ে আছে তাঁর অসংখ্য কবিতায় জাদুবাস্তবতা বা magical realism অনুষঙ্গে , যদিও গল্প উপন্যাসে জাদুবস্তবতা বা উপস্থিতি বিশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশ শতকে ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকজন গদ্য লেখকের লেখায় জাদুবাস্তবতার শব্দটির কথা শোনা যায়। পদ্য গদ্য না হলেও কোন কবির কবিতায় কাব্যিক অনুষঙ্গ সাথে সাথে তা বর্ণনামূলক যে হতে পারে, তা এমিলি ডিকিনসনের কবিতায় উঠে এসেছে। তাঁর অনেক কবিতায় magical realism বা জাদুবাস্তবতার উপস্থাপিত হয়েছে গদ্যের আঙ্গিকে। প্রসঙ্গক্রমে তাঁর সে ধরনের কবিতার দুটো স্তবক উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা যেতে পারে ।
THE CHARIOT.|
Because I could not stop for Death,
He kindly stopped for me;
The carriage held but just ourselves
And Immortality.
We slowly drove, he knew no haste,
And I had put away
My labor, and my leisure too,
For his civility.
My labor, and my leisure too,
For his civility
রথ
কারণ আমি মৃত্যুর জন্য থামতে পারলাম না,
সে আমার জন্য অনুগ্রহ করে থামল;
রথটি ছিল ঠিক আমাদের আর অমরত্বের কাছাকাছি।
আমরা ধীরে ধীরে চালিত হলাম, সে জানতো কোন তাড়াহুড়ো নেই,
আর আমি দূরে ছিলাম
আমার পরিশ্রম, আর আমার অবসরও,
তার সৌজনের জন্য। (প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)
মূলত এক নজরে একে সহজ বলে মনে হতে পারে। মানুষ প্রায়ই ভুলে যায় বর্ণনার কথা যার মাঝে কবিতার অর্ন্তনিহিত ভাব উপস্থিত থাকে। সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখলে অনুধাবন করা যাবে এমিলি ডিকিনসন সময় নিয়েছিলেন একটা গল্প সৃষ্টিতে তাঁর THE CHARIOT কবিতায় । সম্ভবত এমনটা লেখায় এমিলি ডিকিনসনের ছিল একটা সুনির্দিষ্ট সাঙ্কেতিক উদ্দেশ । এই কবিতাটিতে তিনি সধমরপ ৎবধষরংস বা জাদুবাস্তবতার উপস্থাপন করেছেন সজ্ঞানে। আর একটি কবিতায় এমিলি ডিকিনশন কিভাবে magic realism বা জাদুবাস্তবতাকে উপস্থাপন করেছেন তা তাঁর magic realism কবিতায় দেখা যেতে পারে। আমরা এই কবিতার প্রথমাংশ এখানে উদ্ধৃত করে magic realism এর উপস্থিতি লক্ষ করার চেষ্টা করব।
PLAYMATES
God permits industrious angels
Afternoons to industrious.
I met one, -- forgot my school-mates,
All, for him, straightway.
God calls home the angels promptly
At the setting sun;
I missed mine. How dreary marbles,
After playing Crown!
ঈশ্বর অনুমতি দেন পরিশ্রমী দেবদূতদেরকে
বিকালগুলোতে পরিশ্রমী খেলা খেলতে।
আমি একজনের সঙ্গে মিলিত হলাম-ভুলে গেলাম আমার স্কুলের সহপাঠীদের,
সবাই, তার জন্য সোজাসুজি এল।
ঈশ্বর দেবদূতদেরকে দ্রুত
সূর্য অস্তমিত হবার সময় ফিরে আসার জন্য ডাকলেন;
আমি নিজেকে হারালাম। বিষণœ মার্বেলগুলো,
খেলায় বিজয়মুকুট লাভের পর। ( প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)
আপনি দেখতে পাবেন এই কবিতাটিতে একটি শিশু, (যে হতে পারে একটা ছোট্ট মেয়ে) যার মুখ দিয়ে ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে। কবিতাটির প্রথম স্তবকের তৃতীয় লাইনে মেয়েটি ঘোষণা করে একজন দেবদূতের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা।
God calls home the angels promptly
At the setting sun;
I missed mine. How dreary marbles,
After playing Crown
আমরা এই পৃথিবীতে বসবাস করি আমাদের মত । এই পৃথিবীতে আমরা স্কুলে শিশু, তাদের মার্বেল এবং সূর্যের উদয় এবং অস্ত অবলোকন করি। একটি ছোট্ট মেয়ে দেবদূতদের সঙ্গে খেলা করে। এখানেই এমিলি ডিকিনসন জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ উপস্থাপন করেছেন বিশেষ নৈপুন্যে, একথা স্বীকার করতেই হবে।
এমিলি ডিকিনসনের কবিতায় বর্ণনামূলক অনুষঙ্গ বিশেষ ভাবে উঠে এসেছে তা দেখা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। My Life had stood – a Loaded Gun –এই কবিতায় এমিলি ডিকিনসন আগের দুটো কবিতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন । আমরা এখানে এই কবিতাটির অংশ তুলে ধরছি।
My Life had stood – a Loaded Gun –
In Corners – till a Day
The Owner passed – identified –
And carried Me away –
And now We roam in Sovereign Woods –
And now We hunt the Doe –
And every time I speak for Him –
The Mountains straight reply –
আমার জীবনটা দাঁড়িয়েছিল - গুলিভরা একটা বন্দুকের সামনে-
কোণগুলোতে- পুরো একটা দিন
আমাকে শনাক্ত করে মালিক আমাকে এখানে নিয়ে আসে -
এখন আমরা সার্বভৌম বনে বনে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরছি-
আর এখন আমরা হরিণ শিকার করছি-
প্রত্যেবার আমি ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলি- পর্বত সোজাসুজি জবাব দেয়- ( প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)
এমিলি ডিকিনসনের এই কবিতার কিছুটা ক্ষোভ আছে। বর্ণনায় উঠে এসেছে বন্দুকের কথা। এখানে তিনি অনুশোচনাহীনভাবে হরিণ হত্যা করে গর্ববোধের আভাস দিয়েছেন। বন্দুকের গুলির শব্দ পর্বতে পর্বতে প্রতিধ্বনিত হয়। দেবদূতদের সঙ্গে একটা শিশুর মিলিত হওয়া এবং একজন মহিলার মৃত্যুর তারিখের দিকে যাওয়ার মধ্যে এই কবিতার পার্থক্য আছে My Life had stood – a Loaded Gun কবিতাটিতে। এই কবিতাটির বর্ণনায় একজন অনুশোচনাহীন যৌনতা ও রিরংসা জারিত শয়তানের বিপথগামীতার কথা কবিতায় উঠে এসেছে। এটা এমিলির লেখা একটি অসাধারণ কবিতা। ঘেরাটোপে আবদ্ধ আগ্রাসনের শিকার মুক্তিকামী মহিলার মুখ দিয়ে এমিলি ডিকিনশন উৎপীড়নের কথা উপস্থাপন করেছেন। তিনি এই কবিতায় বন্দুক ও পুরুষ শিকারীর মধ্যে আক্ষরিক নয় এমন সম্পর্ক স্থাপন করেছেন কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা আধিপত্যবাদী এক মহিলাকে তুলে ধরেছেন।
এমিলি ডিকিনসনের অন্যান্য কবিতার মত এক কবিতাটিতে অনেক না বলা কথা , অব্যাখ্যাত বর্ণনার সমারোহ দেখতে পাওয়া যায়। কোথা থেকে বন্দুক আসে? কেন এটার মধ্যে বোধশক্তি আছে? সত্যি কথা বলতে এ কবিতায় অপ্রকৃত অনুষঙ্গে গল্প উঠে এসেছে। এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় এমিলি ডিকিনসনের কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম, ফ্যান্টাস্টিক অনুষঙ্গ সহ নানা ধরনের বিষয় উঠে এসেছে।
গত শতকের পৃথিবীর নানা ভাষার কবিরা তাদের কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম বা জাদুবস্তবতার অনুষঙ্গ উপস্থাপন করেছেন সচেতন ভাবে অরিজোনার কবি আলবার্তো আলভারো রিওস । আলবার্তো আলভারো রিওস এর জন্ম অরিজোনার নোগালসে ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫২ সালে। তিনি আগস্ট ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অরিজোনার স্টেট পোয়েট হিসাবে বিবেচিত হন। দশটি কাব্য, তিনটি ছোটগল্প সংকলন ও একটি স্মৃতিকথা প্রকাশ পেয়েছে।তিনি তাঁর কবিতায় magic realism বা জাদুবাস্তবতাকে উপস্থাপন করেছেন সচেতন ভাবে। আলবার্তোর লেখা কবিতা Domingo Limon ,Nani,Teodoro Luna’s Two kisses ইত্যাদি কবিতায় জাদুবস্তবতা বিশেষ ভাবে দৃশ্যমান। জাদুবাস্তবতাবাদের পুরোধা গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এর জাদুবস্তবতার অনুষঙ্গকে আলবার্তো তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন।আমরা একটি কবিতার উদ্ধৃত দিতে পারি।
Teodoro Luna’s Two Kisses
Alberto Alvaro Rios
Mr. Teodoro Luna in his later years had taken to kissing
His wife
Not so much with his lips as with his brows.
This is not to say he put his forehead
Against her mouth--
Rather, he would lift his eyebrows, once, quickly:
Not so vigorously he might be confused with the villain
Famous in the theaters, but not so little as to be thought
A slight movement, one of accident. This way
He kissed her
Often and quietly, across tables and through doorways,
Sometimes in photographs, and so through the years themselves.
This was his passion, that only she might see.
He might feel some movement on her lips
Toward laughter.
থিওডোরো লুনার দুটো চুম্বন
আলবার্তো আলভারো রিওস
মি. থিওডোরো লুনা তার পরবতী বছরগুলোতে চুম্বন দিয়েছিলেন
তার পতœীকে
তেমনটা তার ওষ্ঠ আর ভ্রæদ্বয় দিয়ে নয়।
এটা বলি না তিনি তার কপাল রাখেন
তার মুখে-
বরং, তিনি তার ভ্রæদ্বয় উপরে তুলতেন,একবার,দ্রæততার সঙ্গে;
তেমনটা তেজদ্বীপ্ত ভাবে তিনি বিভ্রান্ত ছিলেন না
বিখ্যাত খিয়েটারের ভিলেনের দ্বারা,কিন্তু খুব সামান্য নয় তেমন ভাবনার
একটা অল্পস্বল্প গতি,একটা দুর্ঘটনা। এই ভাবে
তিনি তাকে চুমু দিয়েছিলেন
বারবার শান্তভাবে, টেবিল পেরিয়ে আর দ্বার দেশে,
মাঝমধ্যে ফটোগ্রাফে, এই ভাবে বছর রছর তারা নিজেরা
এটাই ছিল থিওডোরো লুনার উত্তেজনা, যা একমাত্র তার পত্নীই উপলব্ধি করেন।
তিনি অবশ্যই উপলব্ধি তার পত্নীর ওষ্ঠদ্বয়ে কিছুটা স্পন্দন
আর হাসি। (প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)
বিশ শতকে আরো অনেক কবির কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম বা জাদুবস্তবতার উঠে এসেছে। এই সমস্ত কবিদের মাঝে
হাঙ্গেরিয়ান কবি জর্জ এসর্টিস (George Szirtes) অন্যতম। তিনি তাঁর কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম বা জাদুবস্তবতাকে উপস্থাপন করেন। কবি জর্জ এসর্টিস এর জন্ম হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ১৯৪৮ সালে ২৯ নভেম্বর। তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালে রিফুজি হিসাবে ইংল্যান্ডের লন্ডনে চলে আসেন পরিবারের সঙ্গে। তিনি ফাইন আর্টস নিয়ে লন্ডন ও লীডসে পড়াশোনা করেন। লীডসে পড়াশোনা কালে তিনি কবি মার্টিন বেলের সংস্পর্শে এসে কবিতা লেখায় সম্পৃক্ত হন। তিনি তাঁর কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজমকে তুলে ধরেছেন বিশেষ অনুষঙ্গে । মানুষের কল্পনাকে
জাদুবাস্তবতায় উপস্থাপন করেছেন তিনি তাঁঁর নিচের ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম কবিতায়।
Magic Realism
When she opened her hands the butterflies emerged
from her palms. This was the first chapter.
In the second she was speaking butterflies.
In the third her eyelids opened on butterflies.
Soon enough she would become a butterfly
since this was the story, the story behind the self
made of butterflies.
ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম
যখন মেয়েটি তার হাতদ’খানা খুলল তখনই প্রজাপতিগুলো নির্গত হল
তার হাতের তালু দুটোর মাঝ থেকে। এইটাই ছিল প্রথম অধ্যায়।
দ্বিতীয়ে মেয়েটি কথা বলছিল প্রজাপতিগুলো।
তৃতীয়ে তার চোখের পাতাদুটো প্রজাপতিগুলোর ওপর নিবদ্ধ হল।
সামান্য সময়ের মধ্যে মেয়েটি একটা প্রজাপতি হয়ে গেল
এ থেকে গল্পটিতে। ( প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)হ
আমরা এখন বাংলা কবিতায় জাদুবস্তবতা সম্বন্ধে আলোচনা করার চেষ্টা করব। তার আগে হাজার বছরের ঐতিহ্যে বাংলা ভাষায় কবিতা ক্রমবিকাশের ধারায় নানা পরিক্রমা সম্বন্ধে কথা বলতে হয়। কবিতার রূপ-নির্মাণে কবিরা কবিতাকে সব সময়ই নিজের মতো করে গ্রহণ করেছেন। চর্যাপদ থেকে শুরু করে কবিতার যাত্রা পথ দীর্ঘতর। মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমিতাক্ষর ছন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও কাব্যের মধ্যে কবিতাকে অনেক চড়াইউৎরাই পার করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এই পঞ্চ কবি বাংলা কবিতাকে ঋদ্ধ করেছেন। পঞ্চকবি বাংলা কবিতা ও গানে ভগবতপ্রেম, মানবিক প্রেম, দেশপ্রেম ও বিদ্রোহের বহি:প্রকাশ ঘাটান। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম পরাধীন ভারতবর্ষেও ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন তাঁর কবিতা ও গানে। পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য তাঁর অগ্নিবীণার কবিতা ও গানে অবিভক্ত ভারতের আপামর জনগণ মুক্তির মন্ত্রে। তাদের কবিতায় তেমন ভাবে জাদুবাস্তবতা বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যায় না। আমরা প্রথমে জীবনানন্দের কবিতা উপর আলোচনা করবো। তাঁর ‘সূর্যতামসী’তে আমরা দেখতে পাই মরণের - জীবনের কথা:‘কোথাও পাখির শব্দ শুনি;/কোনো দিকে সমুদ্রের সুর;/কোথাও ভোরের বেলা রয়ে গেছে - তবে।/অগণন মানুষের মৃত্যু হ'লে - অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়/বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে;এ কোন সিন্ধুর সুর:/মরণের - জীবনের?/এ কি ভোর? (সাতটি তারার তিমির)------ সত্যি কথা বলতে জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় নিজস্ব ঘরণায় উপস্থাপন করেছেন। এর মাঝে আমরা জাদুবাস্তবতা খুঁজে পাই।
তাঁর ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যের ‘সপ্তক’কে আমরা জাদুবাস্তবতা খুঁজে পাই। ‘সপ্তক’কের কয়েক পঙ্তি আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি:‘এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে; -/ জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা।/অনেক হয়েছে শোয়া;/- তারপর একদিন চ'লে গেছে/কোন দূর মেঘে।/অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে ----------- ’কবি যেন এখানে জাদুকরী মননের ফসল বপন করেছেন। পরের পঙ্তিগুলোতে জীবনানন্দ আরো জাদুকরী!
সরোজিনীর চলে গেলো অতদূর? ----/পাখিদেরমত পাখা বিনা?/হয়তো বা মৃত্তিকার জ্যামিতিক ঢেউ আজ? জ্যামিতির/ভূত বলে: আমি তো জানি না।/জাফরান - আলোকের বিশুষ্কতা সন্ধ্যার আকাশে আছে লেগে:/লুপ্ত বেড়ালের মত; শূন্য চাতুরির মূঢ হাসি নিয়ে জেগে।-----
বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের হাতেই তৈরি হলো এ ধরনের কবিতা। এর বৈশিষ্ট্য হলো, তা একাধারে বহির্বাস্তবতা অন্যদিকে মনোবাস্ততাকে ধারণ করে পাঠককে জাদুবাস্ততার মধ্যে নিয়ে যায়।আঙ্গিকের এই যে নিরীক্ষা, এটাই হলো জীবনানন্দের সেই নান্দনিকতা, যার মাধ্যমে বাংলা কবিতায় ঘটল বাঁকবদল।
জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় যে রূপকল্পের অবতারণা করেছেন তাকেই রবীন্দ্রনাথ তাকে বলেছেন ‘চিত্ররূপময়তা’। দার্শনিক মনন ও মনোবাস্তবতার জন্যও জীবনানন্দের কবিতা নান্দনিকতায় যেমন ঋদ্ধ। আমাদের জানা যে বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতার সূচনা ঘটে জীবনানন্দের হাতে, সেই সঙ্গে ম্যাজিক রিয়্যালিজম বা জাদুবাস্তবতা । জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন‎, আকাশলীনা, আট বছর আগে একদিন, আবার আসিব ফিরে, কার্তিক মাঠের চাঁদ, আমি যদি হতাম, আমি যদি হতাম, ক্যাম্পে, গোধূলিসন্ধির নৃত্য, নির্জন স্বাক্ষর, রূপসী বাংলা, লোকেন বোসের জার্নাল,আকাশলীনা,শঙ্খমালা,সুদর্শনা ইত্যাদি কবিতায় অবশ্যই জাদুবাস্তবতা আছে।
জীবনানন্দের ‘ ক্যাম্পে ’ কবিতায় ম্যাজিক রিয়্যালিজম বা জাদুবাস্তবতা আছে কিনা বোদ্ধা কবিতা পাঠক ও সমালোচকরাভেবে দেখবার চেষ্টা করবেন। এই কবিতাটি নিয়ে অশ্লীলতার অভিযোগে বিতর্কের ঝড় ওঠে। আমরা এখানে এই কবিতা থেকে উদ্ধৃত করতে পারি । ‘ ক্যাম্পে ’ ‘একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে/সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে/দাঁতের-নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে অই/সুন্দরী গাছের নীচে জ্যোৎস্নায়!
মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে/হরিণেরা আসিতেছে।’/তাদের পেতেছি আমি টের/অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায়,/ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়।/ঘুমাতে পারি না আর;/শুয়ে শুয়ে থেকে বন্দুকের শব্দ শুনি;-------------------------------কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;/বনের ভিতরে আজ শিকারীবা আসিয়াছে,/আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন,/এইখানে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে/ঘুম আর আসেনাকো/বসন্তের রাতে।’
জীবনানন্দ দাশের এই কবিতায় জাদুবাস্তবতার আভাস ফুটে উঠেছে। ‘চারিপাশে বনের বিস্ময়,/চৈত্রের বাতাস,/জ্যোৎস্নার শরীরের স্বাদ যেন;/ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে;/কোথাও অনেক বনে যেইখানে জ্যোৎস্না আর নাই/পুরুষহরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার;/তাহারা পেতেছে টের,/আসিতেছে তার দিকে/।আজ এই বিস্ময়ের রাতে/তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে;/তাহাদের হৃদয়ের বোন/বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়/পিপাসার সান্তনায় আঘ্রাণে আস্বাদে;/
কবি নিজেই এই কবিতা সম্বন্ধে কী বলেছেন তা দেখার আগে এই কবিতার আরো কিছুটা দেখে নিতে পারি।
“আমার ক্যাম্পে কবিতাটি সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলা দরকার মনে করি। কবিতাটি যখন শেষ হয় তখন মনে হয়েছিল সহজ শব্দে শাদা ভাষায় লিখেছি বটে, কিন্তু তবুও কবিতাটি হয়তো অনেকে বুঝবে না। বাস্তবিকই ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটির মানে অনেকের কাছে এতই দুর্বোধ্য রয়ে গেছে যে এ কবিতাটিকে তাঁরা নির্বিবাদে অশ্লীল বলে মনে করেছেন।
কিন্তু তবুও ক্যাম্পে কবি নিজেই এই কবিতা সম্বন্ধে কী বলেছেন তা দেখার আগে এই কবিতার আরো কিছুটা দেখে নিতে পারি। নয়। যদি কোনো একমাত্র স্থির নিষ্কম্প সুর এ কবিতাটিতে থেকে থাকে তবে তা জীবনের মানুষের কীট-ফড়িঙের সবার জীবনেরই নিঃসহায়তার সুর। সৃষ্টির হাতে আমরা ঢের নিঃসহায় ক্যাম্পে কবিতাটির ইঙ্গিত এই; এইমাত্র। কবিতাটির এই সুর শিকারী, শিকার, হিংসা এবং প্রলোভনে ভুলিয়ে যে হিংসা সফল-পৃথিবীর এই সব ব্যবহারে বিরক্ত তত নয়, বিষণœ যতখানি বিষণœ নিরাশ্রয়। ক্যাম্পে কবিতায় কবির মনে হয়েছে তবু যে স্থূল হরিণ শিকারীই শুধু প্রলোভনে ভুলিয়ে হিংসার আড়ম্বর জাঁকাচ্ছে না, সৃষ্টিই যেন তেমন এক শিকারী, আমাদের সকলের জীবন নিয়েই যেন তার সকল শিকার চলেছে; প্রেম-প্রাণ-স্বপ্নের একটা ওলটপালট ধ্বংসের নিরবচ্ছিন্ন আয়োজন যেন সবদিকে---”
জীবনানন্দ পুরুষ হরিণ ও মেয়ে হরিণের সঙ্গে মানব মানবীর অনুষঙ্গকে যে ভাবে উপস্থাপন করেছেন তাতে অবশ্য জাদুবাস্তবতার পরশ আছে। তিনি এই কবিতার শেষ স্তবকে নিজের হৃদয়ের কথা বলছেন এই ভাবে:
‘কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে/তাদের মতন নই আমিও কি?/কোনো এক বসন্তের রাতে/জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের রাতে/আমারেও ডাকেনি কি কেউ এসে জ্যোৎস্নায় দখিনা বাতাসে./অই ঘাইহরিণীর মতো?/
আমার হৃদয় এক পুরুষহরিণ/পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে/চিতার চোখের ভয় চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে/
তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে?’
জীবনানন্দের ‘ লোকেন বোসের জর্নাল ’এক নস্টালজিক অনুষঙ্গের কবিতা।
সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি -/এখনো কি ভালোবাসি?/সেটা অবসরে ভাববার কথা,/অবসর তবু নেই;/তবু একদিন হেমন্ত কাল এলে অবকাশ পাওয়া যাবে/এখন শেলফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভলভ ভাবে/সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না।/পুরোনো চিঠির ফাইল কিছু আছে:/সুজাতা লিখেছে আমার কাছে,/বারো তেরো কুড়ি বছর আগের সে-সব কথা;/ফাইল নাড়া কি যে মিহি কেরানীর কাজ;/নাড়বো না আমি/নেড়ে কার কি লাভ;/মনে হয় অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব,
সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে/মানে এই অমিতা বলছি যাকে -/কিন্তু কথাটা থাক;/কিন্তু তবুও -/আজকে হৃদয় পথিক নয়তো আর,/নারী যদি মৃগতৃষ্ণার মতো - তবে/এখন কি করে মন কারভান হবে।/প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি/সেই সব -------------প্রেম নয় তবু প্রমেরই মতন শুধু।/অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে?/অমিতা নিজে কি তাকে?/অবসর মতো কথা ----------------সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে;/অমিতা কি মিহিজামে?/বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে সবই।
একাধারে বহির্বাস্তবতা অন্যদিকে মনোবাস্ততাকে ধারণ করে পাঠককে জাদুবাস্ততার মধ্যে নিয়ে যায় ।
জীবনানন্দ দাশ, মাত্রাচেতনা, কবিতার কথা। জনপ্রিয় জননন্দিত কবি তিনি। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাঙালির হৃদয়াসনে স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত। নারীকে ঘিরে ভাবনায় তো জাগে, ‘প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, / হয় নাকি?’ প্রেম মুছে যায়, কিন্তু সত্যিই কি মুছে যায়, এই যে টানাপড়েন, এই যে অনিশ্চয়তার বোধ, এটাই তো এখনকার পাঠককে আকর্ষণ করে। বনলতা সেন, কিংবা সুরঞ্জনা এভাবেই পাঠকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। সুরঞ্জনার সংস্পর্শেই নারীর প্রতি সমর্পণের সৌন্দর্যটা বিচ্ছুরিত হয় এভাবে, ‘আরো আলো : মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়’। কিন্তু এই নারীকে ঘিরেই ঘনিয়ে ওঠে বেদনা : ‘আহা, ইহাদেরই কানে / অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেল যুবকের দল; / একবার নক্ষত্রের পানে চেয়েÑ একবার বেদনার পানে।’ তবে এতকিছুর পরেও কী মধুর জীবনানন্দের নারীভাবমূর্তি, ‘এই জীবনের সত্য তবু পেয়েছি এক তিল : / পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল। / আকাশ নীল, পৃথিবী এই মিঠে, / রোদ ভেসেছে, ঢেঁকিতে পাড় পড়ে; / পদ্মপাতা জল নিয়ে তারÑ জল নিয়ে তার নড়ে; / পদ্মপত্রে জল ফুরিয়ে যায়।’ সময়চেতনাও তার কবিতায় স্পষ্ট।জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় বনলতা সেন, সরোজিনী, সুরঞ্জনা, সুচেতনা, সবিতা, সুদর্শনা প্রভৃতি নারীর নাম ব্যবহার করেছেন। তারা একই নারীর ভিন্ন ভিন্ন নাম, নাকি প্রকৃত অর্থেই তারা স্বতন্ত্র নারী ছিলেন- এ রহস্য আজো অনির্ণীত। বনলতা সেনকে নিয়ে রহস্য আরো গাঢ় অন্ধকার।
জীবনানন্দের কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সব মহৎ কবিতারই আছে বহুমাত্রিকতা। ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’ কবিতাটিকে ঘিরে যে বিতর্ক ঘনিয়ে উঠেছিল, সেই বিতর্ক থেকেই বোঝা যায় একটি মাত্র অর্থ নয়, বহুমাত্রিক অর্থারোপের দিকেও পাঠককে টেনে নেয় জীবনানন্দের কবিতা। কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখলেন, ‘জীবনানন্দ আমাদের কালের ইতিহাসের অতীত ও ভবিষ্যতের সন্ধিক্ষণকে যে প্রতীক-নৃত্যে ধরেছেন তারই নাম ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য।’ ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য-
দরদালানের ভি— পৃথিবীর শেষে/যেইখানে পড়ে আছে-শব্দহীনভাঙ্গা/সেইখানে উঁচু উঁচু হরীতকী গাছের পিছনে
হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোলরাঙা-/-------------সেইখানে যুথচারী কয়েকটি নারী/ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে./মেধাবিনী; দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা/যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে-----------------
জীবনানন্দ তাঁর এ কবিতে জাদুবাস্তবতাকে তুলে ধরেছন আপন চিন্তাচেতনায়। জীবনানন্দ দাশ কবিতায় এক নতুন ধারা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। সেক্ষেত্রে তাঁরা ‘হয়ে উঠেছিলেন নগরমনস্ক’। এই নগরমনস্কতায় তাঁরা শুধু নিজেদের নগরেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নগরযন্ত্রণাকে কবিতায় এনে নতুন এক ধারা নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। এ ধারাতেই পরবর্তী কয়েক দশক প্রবাহিত হয়েছে।
পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতি সম্পূর্ণভাবে ধরা পড়েছে। বাংলার গ্রামীণ অনুষঙ্গ যিনি সম্পূর্ণভাবে কবিতায় ধারণ করেছেন, তিনি কবি ওমর আলী। এ ক্ষেত্রে ওমর আলী নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। ওমর আলী অন্যতম কবি যিনি গভীর মমতায় কবিতায় জাদুবাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। তাঁর সব কাব্যের কবি জাদুবাস্তবতাকে নিখাদ অনুষঙ্গে তুলে ধরেছেন । একই সাথে গ্রামের মানুষের আনন্দ-বেদনা, দুঃসহ জীবন যন্ত্রণাকে সূ²ভাবে দেখেছেন, দেশ-কাল, সমাজ-রাষ্ট্র-স্বাধীনতা, জৈবিকতা-প্রবৃত্তি নানা বিষয় উপজীব্য করেছেন কবিতায়। বেদনার্ত মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা নিজের করে পাশে থেকেছেন। তাঁর প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থই এর সত্যতা বহন করে। তাঁর কবিতার নামের প্রতি দৃষ্টি দিলে বোদ্ধা পাঠক সহজেই বুঝতে পারবে তাঁর কবিতার জাদুবাস্তবতাবাদকে। তাঁর কবিতার নামগুলো হল: ‘হৃদয় ছুঁয়ে আছে ঝড়’ ,‘এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’, ‘হৃদয় ছুঁয়ে আছে ঝড়’, ‘তোমাকে দেখলেই’, ‘ডাকছে সংসার’ ‘আমার ভেতর খুব ভাঙচুর হচ্ছে’, ‘ফেরার সময়’, ‘তেমাথার শেষে নদী’, ‘অরণ্যে একটি লোক’, ‘ছবি’, ‘স্বদেশে ফিরছি’,‘ যে তুমি আড়ালে’, ‘আমার ভেতর খুব ভাঙচুর হচ্ছে’, ‘গ্রামে ফিরে যাই’, ’অরণ্যে একটি লোক’,‘ তেমাথার শেষে নদী’, ‘আত্মার দিকে’, ‘নদী, নরকে বা স্বর্গে’, ‘এখনো তাকিয়ে আছি’, ‘নিঃশব্দ বাড়ী’, ‘ভালোবাসার প্রদীপ’‘লুবনা বেগম’, ’একটি গোলাপ’ ইত্যাদি ।
‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি/আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;/সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকোয় রোদ্দুরে,/রূপ তার এ দেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা-------’ কবি ওমর আলী গ্রামের সহজ-সরলা নারীদের চিত্র একেছেন। ওমর আলী পাঠককে তার কবিতায় জাদুবাস্ততার মধ্যে নিয়ে যান গেছেন তার প্রমাণ মেলে এই ভাবে:
‘তার ললিত যৌবনের/ক্ষয় কিংবা নতি দেখতে শুরু করে/কিংবা অনেকেই যুবতী হতে হতে আর যুবতী হয় না।/কিংবা,/নগরকান্দার শাহানারা শুয়ে চিন্তার ওপরে মাথা রেখে/তেলমাখা বালিশেই আলুথালু জন্মের প্রথম ভ্রƒণগর্ভে ধরেছে,/অপরিষ্কৃত দেহে মৃত্তিকাগন্ধি তার শাড়িতে শস্যের ধুলো মেখে/কুণ্ঠিত জন্ম দিতে গিয়ে বুঝি কাঁঠালিয়ার দেলোয়ারা অকালে মরেছে------’ ওমর আলী তাঁর কবিতায় প্রেমও রোমান্টিকতার স্পর্শ গন্ধ বর্ণের উপস্থিত। তাঁর ওমর কবিতায় অনেক নারীর নাম ব্যবহৃত হয়েছে। তাদের রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতিকেই ব্যবহার করেছেন। গ্রাম-বাংলার নানা উপকরণের সঙ্গে তাদের রূপের তুলনা করেছেন। হাসিনা, জিনিয়া হোসেন, সালেহা, শাহানারা প্রভৃতি নামের উলে¬খ রয়েছে। পুরাণাশ্রিত নায়িকার নামও আছে তাঁর কবিতায়। ওমর আলী যেসব নারীর নাম ব্যবহার করেছেন, তা গ্রামীণ মেয়েদেরই নাম।কিন্তু তাঁর কবিতায় যে একাধিক নারীর নাম উলে¬খ আছে, এগুলো একই নারীকে তিনি বিভিন্ন নামে উপস্থাপন করেছেন, নাকি কবির জীবনে এসব নারী স্বতন্ত্রভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁর প্রেমিক-মানসস্বরূপটি নির্ণীত হওয়া জরুরী। যে রহস্যটি রয়ে গেছে জীবনানন্দ দাশের ক্ষেত্রেও । ওমর আলীর কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ বর্তমান আছে। বাংলা কবিতায় কবি আল মামুদ ঋদ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি নিজেই এক স্বাক্ষাৎকারে বলেছিলেন , আমার কবিতা রহস্য সৃষ্টি না করে আসঙ্গলিপ্সার কথা বলে। কবি আল মামুদ বাংলা কবিতাকে নতুনমাত্রা দান করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ‘ লোক লোকান্তর ’ ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল: ‘ সোনালী কাবিন’,‘ মায়াবী পর্দা’ দুলে ওঠো,’‘ দোয়েল ও দয়িতা’, দ্বিতীয় ভাঙ্গন’ ,‘ তুমি তৃষ্ণা তুমিই পিপাসার জল’,‘ তোমার রক্তে তোমার গন্ধ’, ইত্যাদি। তিনি তাঁর অনেক কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ বর্তমান আছে। এটা বোঝানোর জন্য তাঁর কবিতা অবশ্যই উদ্ধৃত করতে হবে।
‘সোনালী কাবিন ’ থেকে:‘ সোনার দিনার নেই কাবিন চেয়ো না হরিণী/যদি চাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি----- কবি আল মামুদ কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গের কথা না বললেও তাঁর উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার কথা বলেছেন এভাবে: ‘আমার উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আছে। স্বপ্ন , অলৌকিক, অশরীরি অনেক বিষয়কে গল্প বা উপন্যাস করে তুলেছি। আমি যেটা দিয়ে বলাতে চেয়েছি, সেটাই হয়ে উঠেছে এটা আমার বিশ্বাস।’তিনি তাঁর কবিতা প্রসঙ্গে জাদুবাস্তবতার কথা না বললেও জাদুবাস্তবতাকে তিনি এড়িয়ে যেতে পারেননি। তিনি এক সাক্ষাৎকারে কী বলেছেন আমরা দেখতে পারি। কবি আল মামুদ বলেন,‘ আমার কবিতায় রয়েছে দেহজ প্রেমের আধুনিক রূপান্তর।------ আধুনিক সাহিত্য ্ এটাকেই আমি মনে করি, যেখানে হয়তো মিলও আছে, ছন্দও আছে, গন্ধও আছে, সব কিছু মিলিয়ে একটা স্থাবর বা অস্থাবর কিছু তৈরি হবে। একটা ম্যাজিক তৈরি হবে। ’ তাঁর কবিতায় নারী বিশেষ অনুষঙ্গে উঠেছে। তিনি নিজেই বলেছেন,‘ নারী তো একটা কাঠামো। কবি বিভিন্ন্ জায়গা থেকে নারীকে এনে সেই কাঠামোতে বসিয়ে দেয়। কারো হাত, কারো চোখ, কারো কেশ , করো বক্ষস্থল, কারো মুখ, পা, কারো কোমর ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থেকে এনে কাঠামোতে জোড়া লাগিয়ে দেয়। আমি সেটাই করেছি।--------’ তাঁর কবিতায় আমরা দেখতে পাই: ‘নদীর সিকস্তি কোনো গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে কেউ/যেমন শুনতে পেলে অকস্মাৎ জলের জোয়ার,/হাতড়ে তালাশ করে সঙ্গিনীকে, আছে কিনা সেও/যে নারী উন্মুক্ত করে তার ধন-ধান্যের দুয়ার----- ’দুই বাংলার অন্যান্য কবিদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ,অমিতাভ দাশগুপ্ত ,উৎপল কুমার বসু ,জয় গোস্বামী,নবারুন ভট্টাচার্য , নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী,পূর্ণেন্দু পত্রী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়. মল্লিকা সেনগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ, সুবোধ সরকার, সুভাষ মুখোপাধ্যায়,শামসুর রহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, মাকিদ হায়দার, রফিক আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল, শহীদ কাদরী, হুমায়ূন আজাদ,হেলাল হাফিজ প্রমুখের কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আছে কিনা বোদ্ধা কবিতা পাঠক অনুসন্ধান করার চেষ্টা করবেন বলে আশা করি।
শামসুর রাহমান এর ‘পূর্বরাগ’ কবিতায় কী বলতে চেয়েছেন তা আমরা দেখতে পারি। এ কবিতায় জাদুবাস্তবাদতার অনুষঙ্গ
আছে কিনা বোদ্ধা কবিতা পাঠক যাচাই কওে দেখবেন।
জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে
নিমেষে শরতের খুশির জ্যোতিকণা;
কাঁপি না ভয় আর দ্বিধার নেই দোলা
এবার তবে রাতে হাজার দীপ জ্বেলে
সাজাবো তার পথ যদি সে হেঁটে আসে।
যদি সে হেঁটে আসে, প্রাণের ছায়াপথ
ফুলের মতো ফুটে তারার মতো ফুটে
জ্বলবে সারারাত, ঝরবে সারারাত।
জেনেছি কাকে চাই, বলি না তার নাম
ভিড়ের ত্রিসীমায়া স্বপ্ন-ধ্বনি শুধু
হৃদয়ে বলে নাম, একটি মৃদু নাম।
সৈয়দ শামসুল হকের অন্যান্য কবিতায় জাদুবাস্তবাদতার অনুষঙ্গ বর্তমান আছে। আমরা তাঁর পরানের গহীর ভিতর-১১ কবিতায় জাদুবাস্তবাদতার অনুষঙ্গ এখানে তুলে ধরতে পারি।
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,/চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,/মানুষ বেকুব চুপ,হাটবারে সকলে দেখুক/কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷/চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়েও,/বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,/নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও/অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান৷/সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না----------------------- ’
সৈয়দ আব্দুল মান্নান বাংলা কবিতায় ঋদ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর কবিতায়ও জাদুবাস্তবাদতার অনুষঙ্গ বর্তমান আছে তার প্রমাণ পাই তাঁর লেখা‘পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ ’কবিতায়:‘পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ ঝর্না থেকে নেমে এসেছিলো। /এখন, রহস্যময় জলে, খেলা করে অবিরল। /পদ্মায় গিয়েছে একটি-- মেঘনায়-যমুনায়-সুরমায়-- /আর-একটি গোপন ইচ্ছায়। পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ /ঝর্না থেকে নেমে এসে সাঁতরে চলে বিভিন্ন নদীতে। /পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ জলের রহস্য ভেদ করে /এখন একাকী এক শব্দহীন সমুদ্রে চলেছে। ’
হেলাল হাফিজ এর কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আমরা দেখতে পাই।
কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট !
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
'মালটি-কালার' কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,জয় গোস্বামী ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তিনটি কবিতার কিছুটা তুলে ধরব। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ’কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার এই অংশকে দেখতে পারি জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আছে কিনা।
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালওবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি
দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীলপদ্ম
তবু কথা রাখে নি বরুণা , এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী!
কেউ কথা রাখে নি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখে না!
জয় গোস্বামীর কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আছে কিনা তা আমরা দেখতে পারি তাঁর ‘মেঘবালিকার জন্য রূপকথা ’ কবিতা থেকে। ‘আমি যখন ছোট ছিলাম/খেলতে যেতাম মেঘের দলে/একদিন এক মেঘবালিকা প্রশ্ন করলো কৌতুহলে/
‘এই ছেলেটা, /. নাম কি রে তোর?”/আমি বললাম,/. “ফুসমন্তর !”/মেঘবালিকা রেগেই আগুন,/“মিথ্যে কথা । নাম কি অমন হয় কখনো ?”/.আমি বললাম,/“নিশ্চয়ই হয় । আগে আমার গল্প শোনো ।”/সে বলল, “শুনবো না যা-./সেই তো রাণী, সেই তো রাজা/সেই তো একই ঢাল তলোয়ার/সেই তো একই রাজার কুমার পক্ষিরাজে শুনবো না আর ।/. ওসব বাজে ।”/আমি বললাম, “তোমার জন্য নতুন ক’রে লিখব তবে ।”/সে বলল, “সত্যি লিখবি ?/বেশ তাহলে
মস্ত করে লিখতে হবে।/মনে থাকবে ?----------“তুমি কি সেই ? মেঘবালিকা /তুমি কি সেই ?’/
জয় গোস্বামীর কবিতায় জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে। এই কবিতার শেষ স্তবকে অবশ্যই জাদুবাস্তবতা আমরা লক্ষ করতে পাই। ‘কেউ যায় না কোনদিনই/আজ সে কবি দেখতে পাচ্ছে/সেই দেশে সেই ঝরনাতলায়/এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়/সোনায় মোড়া মেঘহরিণী/কিশোর বেলার সেই হরিণী ।’
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বাংলা কবিতায় স্বমহিমার প্রতিষ্ঠিত। তাঁর কবিতায় জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আমরা দেখতে পাাই। এখানে তাঁর ‘মাঠের সন্ধ্যা ’ কবিতায় দেখবো জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ।
‘অন্যমনে যেতে যেতে হঠাৎ যদি/মাঠের মধ্যে দাঁড়াই,/হঠাৎ যদি তাকাই পিছন দিকে,/হয়তো দেখতে পাওয়া যাবে /বিকেলবেলার নদীটিকে।/ও নদী, ও রহস্যময় নদী,/অন্ধকারে হারিয়ে যাসনে, একটু দাঁড়া;/এই যে একটু-একটু আলো, /এই যে ছায়া ফিকে-ফিকে,/এরই মধ্যে দেখে নেব সন্ধ্যাবেলার প্রথম তারাটিকে।/ও তারা, ও রহস্যময় তারা,/একটু আলো জ্বালিয়ে ধর, দেখে রাখি/আকাশী কোন্ বিণœতা ছড়িয়ে যায় দিকে-দিকে,/দেখে রাখি অন্ধকারে উড়ন্তওই ক্লান্ত পাখিটিকে।/ও পাখি, ও রহস্যময় পাখি।/হারিয়ে গেল আকাশ-মাটি, কান্না-পাওয়া/এ কী করুণ সন্ধ্যা! এ কোন্ হাওয়া লেগে/অন্ধকারে অদৃশ্য ওই নদীর দুঃখ হঠাৎ উঠল জেগে।/ও হাওয়া, ও রহস্যময় হাওয়া! ’
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর আরো অনেক কবিতায় জাদুবাস্তবতা উপস্থাপিত হয়েছে। পশ্চিম বাংলার ও বাংলাদেশের অনেক কবিতায়ই জাদুবাস্তবতা অনুষঙ্গ বর্তমান আছে। সীমাবদ্ধতার কারণে বক্ষ্যমান নিবন্ধ নির্দিষ্ট আয়তনের মধ্যে রাখতে হচ্ছে।
তবুও পরিশেষে বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘ স্বয়ম্ভূ ঈশ্বর’ নামের কবিতায় জাদুবাস্তবতা খোঁজার চেষ্টা করবে।‘যতক্ষণ জেগে থাকি, দরোজাটা বন্ধ করি না।/কেবলই মনে হয় কেউ একজন আসবে।/আমার প্রত্যাশায় এমন একজন নারী আছে,/কোনো শিল্পী যাকে আঁকতে পারেনি।/লিওনার্দো দা ভিঞ্চি,আঁরি মাতিস,/পাবলো পিকাসো অথবা যামিনী রায়,/কেউ-ই আঁকতে পারে নি তাকে।/মারকন্যার উদাস দৃষ্টির মধ্যে মুহূর্তর জন্য/আমি তাকে মূর্ত হতে দেখেছিলাম খাজুরাহে।/ব্যর্থ শিল্পী, আমার বাবার আঁকা একটি জলরঙ/ছবির ভিতরে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম তার/পেছন ফিরে তাকানোর উদ্দীপক সলজ্জ ভঙ্গিটি।/যদিও আমি জানি যে, সে-ছবির মডেল ছিলেন/আমার সিক্তবসনা মাতা, আমার জননী।/এভাবেই কুড়িয়ে পাওয়া খন্ড দৃশ্যগুলোকে/মালার মতো গেঁথে যদি তাকে আঁকা যায়,/আমার মনে হয় না তাতেও খুব একটা লাভ হবে।/কেননা, শিল্পমাত্রই তো অনুকৃতি, বাস্তবের/অথচ আমি যার কথা ভাবি, যার জন্য/অন্ধকারের দুয়ার খুলে দিয়ে বসে থাকি অপেক্ষায়-/তাকে আমি কোনদিন বাইরে দেখিনি।/তাই কেমন করে বলি, তাকে কেমনতরো দেখায়?/সে তো গাছের ফুলের মতো নয়,/সে তো আকাশের বৃষ্টি ভেজা/সহজলভ্য চাঁদের মতো নয়।,/সে অন্যরকম। ভীষণ অন্যরকম।/তার যুগলস্তনের দুর্গে মাথা কোটে অরন্য-পর্বত।/তার উড়ন্ত ঊরুযুগে পদানত মেঘের উর্বশী।
প্রজননের সঙ্গে অসম্পৃক্ত তার গর্ভদেশ।/তার যুগলব্যাকুলবাহু পুরুকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে/রাখা ছাড়া আর কোনো জাগতিক কর্তব্য শিখেনি।/আমি চাই সে আমার জাগরণের মধ্যে আসুক।
কারো কন্যারূপে নয়, কারো ভগ্নিরূপে নয়,/কারো বধূররূপে নয়, কারো মাতৃ রূপে নয়,/জগৎ-সংসারের সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে/সে আসুক, স্বয়ম্ভূ সুন্দর।
কবি নির্মলেন্দু গুণ এই কবিতায় নিচের অংশে তিনি তাঁর মন মননের সাহার্যে কল্পনার যা তুলে ধরেছেন তার মাঝে জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে।‘সে যখন সম্পূর্ণ নিরাভরণ, তখন যেমন/উলঙ্গতার আচ্ছাদনে সে চিরআবৃতা, তেমনি,/যখন সে কল্পনার অন্ধকারে ছায়াবৃতা;/তখনও আমার দৃষ্টির মধ্যে সে চির-নগ্ন।/আমি যাচ্ঞা করি সেই চির-নগ্নিকাকে।’কবিতায় পোস্ট মর্ডানিজম বা উত্তরাধুনিকতার সূত্রপাত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন আশির কবিতা। এ দশকের বেশ কিছু কবিতায় নির্মিত হয়েছে নিজস্ব স্বপ্নের, কাঙ্খার। কবি খালেদ হোসাইনের ‘জলজ পাথর’ কবিতাটি আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি। অজস্র স্বাক্ষর শেষে মৃত্যুকে যথার্থ মনে হয় গøাস বোতলের পাশে ছাইদানি, /একা মোমবাতি /উৎসব শেষ হলে সবকিছু ক্লান্তিকর লাগে /জলেরও আকাশ আছে পাতালের অযুক্তি আবেগ।
সত্তরের রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আবিদ আজাদ, ত্রিদিব দস্তিদার, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, নাসির আহমেদ, আবু হাসান শাহরিয়ার প্রমুখ এ আন্দোলনের অগ্রপথিক ছিলেন। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ সত্তরের দশকের শেষদিক থেকে শুরু করে আশির পুরোটা সময়ে জুডয়েই বাংলাদেশের স্বৈরশাসন, অত্যাচার নিপীড়েনের বিষয়গুলোকে নথিভুক্ত করতে শুরু করেন আশির কবিরা কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে তাদের কবিতায় ঢুকে যায় পোস্টমর্ডানিজম বা উত্তরাধুনিকতার যার অন্যতম প্রধান কারণ লিটল ম্যাগাজিন চর্চা। অস্বীকার করার পথ নেই বাংলাদেশের কবিতার প্রথম আধুনিকতার সূচনালগ্নে লিটল ম্যাগাজিনের চর্চা বলবৎ ছিল এবং যার কারণে বাংলা কবিতা ক্রমাগত উৎকর্ষে পথে হেঁটেছে কিন্তু উত্তরাধুনিকতার নামে পশ্চিমা সংস্কৃতি আর সেই ঘরানার কবিতা চর্চা আশির দশকে পুরোপুরি শুরু হয়। আশির দশকে কবিদের মধ্যে সাজ্জাদ শরিফ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, রেজাউদ্দিন স্টালিন, ফকির ইলিয়াস,আবদুল হাই সিকদার, সুহিতা সুলতানা, মাসুদ খান, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
তাদের অনেকের কবিতায়ই জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে।খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতায় জাদুবাস্তবতার পরশ পাই : তোমাকে দেখেছি অলিম্পাসের তুষারধবল /চূড়ার মহিমায়/ তুমি ধরে আছ দুই হাতে বজ্র আর অশনির চাবুক /তুমি সেমিলির ঘরে যখন স্বর্ণবৃষ্টি/হয়ে নেমেছিলে, অপার তৃষ্ণায় /তোমার প্রেমের দান ভেবে ঘরে নিয়ে- /ছিলাম আগুন। রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি
সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।'
জাতিসত্তার কবি ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহাম্মদ নূরুল হূদার কবিতায় অবশ্য জাদুবাস্তবতা ছোঁয়া আছে। তিনি লিখেছেন-----
রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি
সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।'(


অনেক কবিই তাদের কবিতায় যা যা লিখেছেন তার মাঝে তাদের অজান্তেই জাদুর ছোঁয়া ফুটে উঠেছে। আমরা প্রসঙ্গক্রমে প্রবাসী সাহিত্যিক সালেহা চৌফুরীর বলতে পারি।তিনি মূলত অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক হলেও সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে‘ দলছুট শব্দরা’।তার একটি কবিতার এক অংশ----- ’বিন্দুর মাঝেসিন্দু আবিষ্কারের অভীপ্সায়’----- ‘ বালতিতে এক হাঁটুজল/ সেই দিকে চেয়ে/ সকালেরআলোতে ভাবছি সাগরের তল।’


ফকির ইলিয়াসের ‘ভরচৈত্রের ছায়াগ্রহণ’ কবিতায় জাদুবাস্তবতা লক্ষ করা যায়।
পথ্য হাতে চাঁদসুন্দরীরা-/হাত বুলায় মেঘের মাথায়। দীর্ঘজীবী হও/
রাতের শূন্যতা,/বলতে বলতে তারাগুলো হারিয়ে যায় জোনাক সংসারে/আগামী বসন্তে ভরচৈত্রের ছায়াগ্রহণ শেষ হলে/
যে পাখি দেশান্তরি হবে-/তার জন্য কয়েকটি পাপড়ি জমিয়ে রাখে সতীর্থরা/জমিয়ে রাখে কয়েকটি পাথর।
এখন আমরা নব্বইয়ের দশক কবিদের কবিতায় জাদুবাস্তবতা দেখার চেষ্টা করব। নব্বইয়ের দশকে মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাউদ আল হাফিজ, আলফ্রেড খোকন, ওবায়েদ আকাশ, কুমার চক্রবর্তী, চঞ্চল আশরাফ, টোকন ঠাকুর, পাবলো শাহি, মজনু শাহ, মুজিব ইরম, শাহনাজ মুন্নী, সরকার আমিন, হেনরী স্বপন, কচি রেজা, কবির হুমায়ুন, কামরুজ্জামান কামু, তপন বাগচী, ব্রাত্য রাইসু, মতিন রায়হান, মাতিয়ার রাফায়েল, মারজুক রাসেল, মুজিব মেহদী, রণক মুহম্মদ রফিক, রহমান হেনরী, রিষিণ পরিমল, সাখাওয়াত টিপু, সৌমিত্র দেব প্রমুখ, তুষার গায়েন, সুনীল আচার্য প্রমুখ।
দাউদ আল হাফিজ নব্বইয়ের দশক কবিদের অন্যতম।দাউদ আল হাফিজের বাংলা কবিতার সবুজ মাঠে নব্বইয়ের দশক এ বিচরণ। তাঁর ‘পাতাঝরার গান এবং ঝরাপাতার সঙ্গীত’, ‘আলো, আরো আলো’ ও ‘জেরুজালেমে একদিন তিনহাজার বছর আগে’ কবিতাত্রয় ঋদ্ধতার স্বাক্ষর বহন করে। পরবর্তীতে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘আনাবাস অথবা দ্বিধার গন্ধম’ । ‘ হঠাৎ বৃষ্টিতে’,‘নারী(রহস্য)’,‘ হাওয়াসম্বাদ’, ‘ অনঙ্গরঙ্গ’, ‘ অনাবাস’ ইত্যাদি কবিতায় জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে ।
তাঁর ‘হঠাৎ বৃষ্টিতে’ কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করতে পারি। রমণীর নগ্নহাত/বুকে মাখে বৃষ্টির তুমুল/ আদর। কটিতে যুবতীপ্রহর/ নীলিমায় বোনে অন্ধকার/মেঘনীল চুলের বাহার!’ তাঁর লেখা‘ হাওয়াসম্বাদ’ কবিতায় জাদুবাস্তবতা আছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব বোদ্ধা পাঠক হাতে ছেড়ে দিলাম। ‘ হাওয়াসম্বাদ’-‘একটি কুমারী পাতা ছটফট কেবল কাঁপে/ আশরীর স্বপ্নশিহরণ/একটি
অনূঢ়া পাতা টলমল উচাটন হাওয়ায়/ অনঙ্গ-অঞ্জন চোখে/ একপাতা ছিন্নযোনি শান্ততপোধীর স্বপ্নে দেখে/ অনাঘাতা যোনি/একটি হলুদ পাতা শুধুই হু হু করে হুহু কাঁপে/ হিমেল হাওয়ায়--------’
কবি টোকন ঠাকুরও নব্বইয়ের দশকের কবি। তাঁর একটি কবিতা আমরা এখানে তুলে ধরলাম জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে কিনা দেখার চেষ্টা করব।
দেখি রাক্ষসের মুখ, পাই ডাইনির নিঃশ্বাস
আয়নার মধ্যে তাকিয়ে নিজেকে রাক্ষস মনে হলো!/
সঙ্গে সঙ্গে রাক্ষসের মানে, সংক্ষিপ্ত বাঙলা অভিধানে পাওয়া গেল- নরখাদক জাতি, নিশাচর,. কর্বূর, প্রাচীন অনার্যজাতি ইত্যাদিৃ যদিও, রাক্ষসের একটা অপ্রত্যাশিত ভয়ঙ্কর মুখচ্ছবি /আঁকা আছে মনুষ্যকুলের মনে।/ এটা জানি, কারণ এদ্দিন আমিও মানুষের রোল /প্লে করে এসেছি। এদ্দিন আমিও মানুষ ছিলাম।/
কিন্তু আজ! আজই, নাকি কয়েকদিন ধরেই, যখনই আয়নার/সামনে গিয়ে নিজেকে দাঁড়াই, বিলিভ ইট, আমার চোখেই ধর./পড়ে আমি একটা রাক্ষস! আমার সারামুখে ডাইনিদের/ মিহি-নিঃশ্বাসের আঁচে পৃথিবীগ্রহের মায়াময় ম্যাপ আঁকা হয়ে /চলেছে, মুখ বিভাজিত হয়ে পড়েছে---
কবি ও সাহিত্য সম্পাদক ওবায়েদ আকাশের কবিতায় আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে জাদুবাস্ততাকে আমরা খুঁজে পাই। তাঁর ওবা
আঙুল কবিতার একটা অংশ এখানে তুলে ধরতে চাই।যেমন এক্ষুণি পালাল বৃষ্টিদৃশ্য, ফাঁকি দিয়ে/
তার পিঠভর্তি মেঘ, অনন্য আঙুলের ক্রাচ/দেখো, উড়ন্ত নীল, অসীমে--/বলেছি আগুনের ঘোড়া/আজ নমস্য বৃষ্টির দিনে পালাতে চেয়েছে--/আজ, উৎসব তাই--/আমরা বিস্তৃত অরণ্যের ঘুমে/আগুনের ঘোড়াগুলো উড়ে যেতে দেখি/
একুশ শতকের প্রথম দশকের কবিরা বাংলা কবিতায় নতুন মাত্রা দান করেন। প্রথম দশকের কবিদেও মধ্যে নাম থেকে অতনু তিয়াস, অবনি অনার্য, এহসান হাবীব, কাজী নাসির মামুন, তারেক আহসান, পিয়াস মজিদ,, মনির ইউসুফ, মাসুদ হাসান, রনি অধিকারী প্রমুখ। তাদের কারো কারো কবিতায় জাদুবাস্ততা উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। রনি অধিকারী একজন উদীয়মান কবি। তাঁর অনেক কবিতায়ই জাদুবাস্ততা ছোঁয়া আছে। উদাহরণ হিসাবে তাঁর লেখা রনি অধিকারী এই কবিতার কথা বলা যেতে পারে।
পথের মাঝেই পথ খুঁজে ফেরা
পথভোলা এক নির্মম রহস্য
যা ছুঁয়ে যায় হাজার রহস্যের কল্পতরু বীজ
এক-দুই-তিন এভাবে কেটেছে...
দিন-মাস-বছর- শতাব্দী।
আগুনের নদী হয়ে এভাবে জীবন
চলে বোধহয়!
অনিষ্ট সাধনে যেন বদ্ধ পরিকর
গুপ্ত হত্যাকারী মৃত্যুর উপহার সাজায়,
অতঃপর সমাধি।
কী এক অদ্ভুত মৃত্যু কুড়াতে কুড়াতে,
মৃত্যু কুড়ানি ছেলে... রহস্যময় হয়ে ওঠে,
সে এক সুন্দর সর্বনাশ!
মৃত্যু -সমাধি-শান্তি। শান্তি শান্তি
হত্যাকারী অনুশোচনায় থমকে দাঁড়ায়
দ্রাবিড় সভ্যতায়।আর আমি!
ভীরু ভালবাসায় ভৈরবীতে ভেসে
এসেছিলাম যেন নিদারুণ বেশে,
তখন অনুতাপের আগুনে পুড়ে
স্বর্গ হলো নিষিদ্ধ নগরী।
এভাবে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মগডাল উঠে
আচানক ভাবি -
মৃত্যুর মাঝেই যেন ফিরে আসে,
অনন্ত জীবন।
বাংলা কবিতায় জাদুবাস্তবতার অবস্থানের কথা বলতে হয় জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, কবি অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওমর আলী, আল মামুদ, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ কবিরা তাদের কবিতায় সচেতন কিংবা স্বভাবিক ভাবেই জাদুবাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। তরুণ প্রজন্মে অনেক কবিদের কবিতায় জাদুবাস্তবতা উপস্থাপন করে বাংলা কবিতায় নতুন মাত্রা দান করেছেন এবং করছেন। বারান্তরে তাদের কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ উপস্থাপনে সচেষ্ট হবো বলে আশা করি।

0 comments: