ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিকএবার ইউরোপ – ২
এর আগের কিস্তিতে পাশ্চাত্য খাদ্য সংস্কৃতির সঙ্গে আমার সরাসরি মোকাবিলার প্রথম অভিজ্ঞতার কথা লিখতে আরম্ভ করেছিলাম। এখন পিছন ফিরে তাকালে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকে না যে ১৯৯০ সালের সেই ভ্রমণ এক ধাক্কায় আমাকে বদলে দিয়েছিল অনেকটাই। আজ তিন দশক কেটে যাওয়ার পর তা বিলক্ষণ বুঝতে পারি।
শুধু খাওয়া-দাওয়া নয়, জার্মানি শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যে কটি ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার মধ্যে তিনটি বিষয় ইতিমধ্যেই ছুঁয়ে গেছি – বিয়ার, সসেজ আর রুটি। এছাড়া যেটি, তার সঙ্গে অবশ্য উদরপূর্তির কোনও সম্পর্ক নেই, সেটি হৃদয়পূর্তির বিস্ফোরণ – ফুটবল! আর সত্যি কথা বলতে কি খাদ্য সংস্কৃতির কৌলীন্যের বিচারে ইউরোপ মহাদেশে ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন বা পর্তুগালের তুলনায় জার্মানি বেশ পিছিয়ে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও জার্মান হেঁশেল প্রতিবেশী রান্নাঘরগুলির তুলনায় কম জনপ্রিয়। এর মধ্যে উত্তর জার্মানি সমুদ্রজাত খাবার, মাছ ইত্যাদির জন্য বিখ্যাত আর দক্ষিণের খ্যাতি সসেজ আর বিয়ারের কারণে। এসব নিয়ে ওদেশে অনেক লড়াই আছে, আমাদের ঘটি-বাঙালের মতো। আবহাওয়ার কারণে মানুষজনের স্বভাবও নাকি আলাদা। উত্তরের আবহাওয়া ঠাণ্ডা, স্যাঁতসেঁতে আর দক্ষিণের আবহাওয়া রোদ ঝলমলে। খাবার-দাবারও সেইরকম। উত্তরের মানুষ একটু চুপচাপ, কম কথা বলতে ভালোবাসেন আর দক্ষিণের লোকেরা আমুদে, মিশুকে। জার্মানির যে ‘অক্টোবরফেস্ট’ পৃথিবী-বিখ্যাত, প্রতিবছর তা অনুষ্ঠিত হয় দক্ষিণেই, বাভারিয়াতে। বিশাল বিশাল বিয়ার মাগ হাতে সুন্দরী মহিলারা পরিবেশন করেন বিয়ার আর প্রেৎসেল বা ব্রেৎসেল। এই ব্রেৎসেল বস্তুটি প্রথমবার দেখে খুব মজা লেগেছিল। লম্বাটে অথবা গোলাকার (জিলিপির সঙ্গে খুব আকৃতিগত মিল), একটি বিনুনি যেন, যাকে দুদিক মুচমুচে এই বিস্কুটটির সারা শরীরে বড় বড় নুনের দানা। আপাত-সাধারণ এই বস্তুটি সাধারণ নয় মোটেই। ইউরোপীয় সংস্কৃতির বা আরও সঠিকভাবে বলতে চাইলে খৃষ্টধর্মের সঙ্গে বহু যুগ ধরে প্রবলভাবে জড়িয়ে ব্রেতসেল। জন্ম ইতালিতে কিন্তু ক্রমে ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশে, বিশেষত জার্মানিতে। ইস্টার এর আগে যে উপবাসপর্ব চলে, সেই সময়ের প্রার্থনার প্রতীক হয়ে ওঠে। কোনও এক তরুণ সন্ন্যাসীর হাতে রুটি তৈরির সময় আকস্মিকভাবে জন্ম নেয় এই ব্রেৎসেল। প্রভু যীশুর সামনে দাঁড়িয়ে দুটি হাত আড়াআড়িভাবে দুই কাঁধের দিকে প্রসারিত করে প্রার্থনার যে ভঙ্গী, সেটিই উঠে এসেছে এর আকৃতির মধ্যে। শিশুদেরও উপাসনায় উদ্বুদ্ধ করার একটা সচেতন প্রয়াস এক্ষেত্রে কাজ করেছিল। এই প্রথাটি ধীরে ধীরে আধুনিক কালে ইস্টার এর দিন জার্মান ছেলেমেয়েদের বাড়ি বা বাগানে দিনভর লুকোনো ব্রেৎসেল আর ডিম খোঁজার এক খেলায় বদলে গেছে। জার্মানিতে ইস্টার এর দিন নৈশভোজে ব্রেৎসেলের দুই ফাঁকে দুটি ডিম – কমবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে তো বটেই, বড়দের মধ্যেও এই দৃশ্য আজও অতি উত্তেজনা-সঞ্চারী। সৌভাগ্য আর সমৃদ্ধির প্রতীক এই নিরীহ-দর্শন অথচ আকর্ষণীয় স্ন্যাকটিকে নিয়ে লিখতে শুরু করলে থামা মুশকিল। লিখে ফেলা যায় আস্ত একটা বই!
আমরা সেবছর জার্মানি পৌঁছেছিলাম যখন, সারা দেশে তখন উৎসবের মেজাজ। দুই জার্মানি এক হয়ে যাচ্ছে। এই এক হয়ে যাওয়াটা যে অনেকটাই বাহ্যিক ছিল, তার একটা আঁচ পাওয়া গিয়েছিল তখনই, কিন্তু আসল গোলমালটা বোঝা গেল অনেক পর। এই যেমন ভাগ হয়ে যাওয়া বঙ্গদেশ যদি আবার কোনও যাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় এক হয়ে যায়, ধর্মীয়, সামাজিক আর রাজনৈতিক সব বাধা দূরে ঠেলে এক কি হতে পারবে সুবৃহৎ এই জনগোষ্ঠী? বজায় রাখতে পারবে আঞ্চলিক নিজস্বতা? খাদ্য সংস্কৃতি যার একটি অবিচ্ছেদ্য দিক? সহজ নয় এইসব প্রশ্নের উত্তর।
ওখানে পৌঁছেছিলাম আমরা একটা শুক্রবারে আর তার দুদিনের মধ্যেই আমরা নৈশভোজে আমন্ত্রিত হলাম কুর্ট আর মারথেডিসের বাড়ি। ওদের কথা আগেই বলেছি। আগের বছরই কলকাতায় আলাপ এবং বন্ধুত্ব। এই নেমন্তন্ন করার ক্ষেত্রেও একটা অভিজ্ঞতা হলো সেদিন। পারবারিক বন্ধুত্ব ছাড়াও উরবান (বারবারার স্বামী) আর কুর্ট বাল্যবন্ধু। তা সত্ত্বেও সেদিন আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল আমাদের দুজনকেই। এটাই ওই সমাজের রীতি। এতে অবাক হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। খাঁটি জার্মান খাবারের সঙ্গে মোলাকাত সেই সন্ধ্যায় প্রথম। আর পানীয় যে খাবারের সঙ্গেই পরিবেশন করতে হয়, বিশেষ কিছু আলাদাভাবে পান করা যায় খাওয়া হয়ে যাওয়ার পরই, এ শিক্ষা অবশ্য আগের দুদিনেই হয়ে গিয়েছিল, তাই সেদিন আর অবাক হইনি। ‘পেহলে দর্শনধারী পিছে গুণ বিচারী’ – এই প্রবাদটির কথা জানা ছিল আগে থেকেই কিন্তু তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম সম্ভবত সেদিনই প্রথম। আমাদের টেবিলে যে পদটি সেদিন প্রথম দেখা দিল, তার জার্মান নাম ‘গেবাকেনার লাক্স’ (gebackener Lachs) অর্থাৎ ‘বেকড স্যামন’। স্যামন! মৎস্যবিলাসীদের মধ্যে এই মাছটির কদর সাঙ্ঘাতিক। তার মধ্যেও নরওয়েজাত স্যামনের স্বাদ ভুবনবিদিত এবং তাকে নিয়ে আদিখ্যেতার সীমা নেই। আমাদের যেমন ইলিশ মাছ। মজার কথা এই যে প্রথমবার খাওয়ার পরই আমার মনে হয় ইলিশ মাছের অনেক রেসিপিই স্যামন দিয়ে চমৎকার হয়, বিশেষত সর্ষের ব্যবহার যেখানে আছে। পরে জানতে পেরেছিলাম যে কুর্ট- মারথেডিস সেদিন আমাদের যে এই মাছের যে রান্নাটি খাইয়েছিলেন, তার সূত্রপাতই করতে হয় স্যামন ফিলের সর্বাঙ্গে সর্ষেবাটা মাখিয়ে দিয়ে। তারপর ওপর দিয়ে ছড়িয়ে দিতে হয় অলিভ অয়েল-সিক্ত ব্রেড ক্রাম, যাকে আমরা বিস্কুটের গুঁড়ো বলে থাকি। আরও ভালো হয় যদি ওই ব্রেড ক্রামের সঙ্গে আগে-ভাগেই মিশিয়ে নেওয়া যায় আন্দাজমতো পারমেজান চিজ। এরপর শুধু নির্দিষ্ট তাপমাত্রা আর সময়ের হিসাবে বেকিং করার পালা। শ্রেষ্ঠ ভোজন বিলাসীর পক্ষেই একমাত্র এর ফলাফল অনুমাণ করা সম্ভব। যে বস্তুটি না থাকলে এমন সুখাদ্যও অসম্পূর্ণ মনে হবে, তা হলো যুতসই একটা স্যালাড। আবার দেখুন এমন একটি পদের উল্লেখ করলাম, যার ব্যাপ্তি সীমাহীন। স্যালাড মানে যে শুধুই কয়েক টুকরো সশা, পেঁয়াজ আর টমেটোর সমন্বয় নয় এটা বুঝতে গেলে পশ্চিমী হেঁশেল সংস্কৃতির অনেক গহন গভীরে প্রবেশ করতে হবে। সেদিন অবশ্য সেই স্যালাডের চরিত্র কেমন ছিল এখন আর মনে নেই। ডেসার্ট হিসেবে অতঃপর যিনি পরিবেশিত হলেন, জিগ্যেস করে জানলাম তাঁর নাম ‘রোটে গ্র্যুৎসে’ (Rote Gruetze) – অর্থাৎ ‘লাল বেরি’ (বা ওটস্ জাতীয় একধরণের শস্য দানা)। এই পর্যন্ত ঠিক আছে আবার নেইও। কারণ সবই বোঝা গেল আবার কিছুই বোঝা গেল না। কারণ এইরকম একটি বস্তু দিয়ে তৈরি হয় উত্তর জার্মানির এই বিখ্যাত ডেসার্টটি। আর যদিও বলা হচ্ছে লাল বেরি, এর সঙ্গে অন্যান্য ধরণের বেরি (এমনকি কালো চেরিও) মেশানো হয়ে থাকে। মৃদু আঁচে বেরিগুলিকে অল্প জল বা ফলের রস দিয়ে ফোটানো হয়, স্বাদ অনুযায়ী মেশানো হয় চিনি, লেবুর রস, ফেলে দেওয়া হতে পারে এক টুকরো ভ্যানিলা-দণ্ড। তারপর ঠাণ্ডা হয়ে এলে মিশ্রণটি পাত্রে ঢালা হয়। শেষে ওপর থেকে দিয়ে দেওয়া হয় ক্রিম। কিংবা আইস ক্রিম। প্রকারভেদে ভ্যানিলা সস। উহ্ লা লা!
বার্লিনের পর্ব মিটিয়ে আমরা যাবো হ্যোক্সটার, হান্সের মা বাবার কাছে, যেখানে হবে আমাদের তিনজনের যৌথ অনুষ্ঠান। কিন্তু তার আগে বার্লিনেই বারবারা-উরবান ওদের বাড়িতে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য নেমন্তন্ন করল ওদের জনা তিরিশেক বন্ধু-দম্পতিকে। আমরা বললাম অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্ব আমাদের। মেনু ঠিক হলো লুচি, আলুর দম আর সেমুইয়ের পায়েস। ওদের বিশাল বসার ঘরের সব আসবাব সরিয়ে দেওয়া হলো সুলগ্নার নাচের জন্য। চারপাশে গোল করে দর্শকদের বসার ব্যবস্থা করা হলো। অনুষ্ঠানের আগেই খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন সেরে ফেলার জন্য বিকেল থেকেই আমরা লেগে গেলাম আলু সিদ্ধ করে আলুর দম রান্না, ময়দা মাখা আর পায়েস করার কাজে। সে এক হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার! বারবারা আর উরবান তখন দর্শকের ভূমিকায়। শেষ পর্যন্ত লুচি ভাজা শুরু হলো যখন আর স্বাভাবিক কারণেই একটু ধোঁয়া হলো রান্নাঘরে, ওদের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখলাম!
বার্লিন থেকে আমরা চলেছি পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। ঠিক হয়েছে গ্যোটিঙ্গেন এ হান্স আসবে আমাদের নিতে আর তার আগে বার্লিন থেকে গ্যোটিঙ্গেন পর্যন্ত আমরা যাবো কারও ‘সহযাত্রী’ হয়ে। এই যাত্রার আইডিয়াটা আমাদের দারুণ লেগেছিল। ধরা যাক আপনি কলকাতা থেকে যাবেন আসানসোল। আপনার গাড়ি নিয়ে একা। আপনি চাইলেন একজন বা দুজন সহযাত্রী নিয়ে যেতে, যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে। মুল ব্যাপারটা হলো দীর্ঘ যাত্রাপথে আপনি সঙ্গী চান। যাতে ক্লান্ত না হয়ে পড়েন, মনঃসংযোগ থাকে। সেইমতো নির্দিষ্ট জায়গায় আপনার নাম নথিভুক্ত করলেন। অপরদিকে আমাকেও ওইদিন, ওইসময় আসানসোল যেতে হবে। আমিও খোঁজ নিয়ে জানলাম আপনার কথা। ব্যস্! হয়ে গেল! সেদিনও তেমনই হয়েছিল। আমরা যাঁর সহযাত্রী হয়েছিলাম, পরে আর কখনও তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। অসাধারণ মানুষ! পুরোটা রাস্তা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গেলেন, নানান কথা, বেশির ভাগই ব্যাক্তিগত। শেষে আমরা যখন গ্যোটিঙ্গেন স্টেশনে হান্স তখনও আসেনি। আমাদের বসিয়ে রেখে তিনি বললেন, ‘আসছি’! একটু পরেই এলেন। হাতে দুটো পিৎসার বাক্স। বললেন, ‘খাও, কোনও চিন্তা নেই, নিরামিষ, তোমরা হিন্দু তো!’ এই যাত্রার জন্য যে টাকা আমাদের দেওয়ার কথা ছিল, দিতে চাইলাম যখন, হেসে বললেন, যাই, আবার দেখা হবে। আমরাও বললাম, ‘আউফ হ্বিদারজেন!’