0

সম্পাদকীয়

Posted in








সদ্য অতীত হয়ে গেল একটি দিন। ১৬ ডিসেম্বর। তিপ্পান্ন বছর আগে এই দিনটিতেই পরিসমাপ্তি ঘটেছিল তেরো দিনের এক যুদ্ধের। ভাষার গরিমা বজায় রাখার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা এক আন্দোলন থেকে অনেক প্রাণের বিনিময়ে জন্ম নিয়েছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। দিনটি তাই অর্জন করেছিল এক অনন্য মর্যাদা। দিনপঞ্জিতে চিহ্নিত হয়েছিল 'বিজয়-দিবস' রূপে। ইতিহাসে এমন তুলনা মেলা ভার, যখন দুই পড়শি দেশ যৌথভাবে একটি দিনের উদযাপন করে। পাকিস্তানি বাহিনীর অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের যে প্রতিরোধ তৈরি হয়েছিল, ভারত তার সর্বশক্তি নিয়ে সেই লড়াইয়ে সামিল হয়। চেতনায় এক হয়ে যায় একদা রাজনৈতিক বিভাজনের শিকার এক সংস্কৃতি, একটি ভাষা। যার নাম বাংলা। দুই বাংলায় একই উদ্দীপনায় আজও পালিত হয় ভাষাদিবস। একই কবির কথা দিয়ে গাঁথা দুদেশের জাতীয়সঙ্গীত। এও এক বিরল দৃষ্টান্ত।

এবছর 'বিজয় দিবস'-এ ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন স্মরণ করলেন সেইসব বীর সেনানীর কথা, যাঁদের বলিদান ছাড়া ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতে পারত, সীমান্তের ওপার থেকে থেকে ভেসে এল বৈরিতার বাতাস। সরকারি প্রতিক্রিয়ায় বলা হল, ভারত রক্তস্নাত সেই দিনগুলির এক বন্ধুভাবাপন্ন অংশীদারমাত্র। তার বেশি কিছু নয়।

ঔপনিবেশিক প্রভুরা একদিন উপমহাদেশের মানচিত্রটি নতুনভাবে এঁকেছিলেন। আজ আবার যেন আরেকটি মানচিত্র রচিত হল। এবার আর ভৌগলিক নয়, মানসিক। আবার প্রমাণ হল রাজনীতির দায় বড় বিষম। প্রয়োজনে তা অস্তিত্বের মূল শিকড়টিতেই করতে পারে কুঠারাঘাত।

সুস্থ থাকুন। সচেতন থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান।

0 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - স্মৃতিকণা সামন্ত

Posted in








শ্মশানের জমিটা ঘাসে ঢেকে আছে। ছোটছোট গর্তে সকালের বৃষ্টিজমা জল। ব্যাঙ লাফিয়ে বেড়াচ্ছে দেদার। জমির পুবে তালপুকুরের পাড়, উত্তরের ঝোপঝাড় আর বাঁশবন ছুঁয়ে চলে গেছে মোরাম ফেলা বড় রাস্তা। রাস্তার উল্টোদিকের ঝুরো বটগাছ, আর গাছের ওপারে ডোমদীঘির কালো জল। বিকেলের রঙ নীলচে সবুজ।


দাদুর সাথে এসে বসি ওই বটের তলায়, শ্মশানের দিকে স্থির চেয়ে থাকে দাদু। দাদুর বাবা সূর্যনারায়ণ, তার বাবা সহদেব, তার বাবা এবং তার আর তারও আগের সব পুরুষের চলে যাওয়া দেখেছে এই সবুজ জমি, তালপুকুর, ডোমদীঘি আর ওই রাস্তা। চোদ্দপুরুষের সালতামামি লেখা আছে এই বংশের খেরোর খাতায়, দলিলে, পাট্টায়।

কোনও এক অখ্যাত দিনে এই গ্রামে এসেছিল আমাদের পূর্বজ, খড় মাটি বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়েছিল আমাদের প্রথম বসত। জমিজিরেত, ঠাকুর দেবতার নামে কাটা হয়েছিল মন্দিরের ভিত, শিকড় চারিয়ে যাচ্ছিল মূল, আমাদের শাখাপ্রশাখারা বাড়ছিল ডালপালায়।


চৈতন্যদেব যখন দন্ডভুক্তির রাস্তা ধরে পৌঁছে যাচ্ছিলেন শ্রীক্ষেত্র তখনই কোনও এক মেঠোপথ ধরে রাস্তায় হাঁটছিল আমার পূর্বপুরুষ, পূর্বনারী আর তাদের বংশজ সন্তানরা। জাতিতে সদগোপ, পেশায় চাষী পেয়েছিল মল্লভূমের রাজস্ব আদায়ের ঠিকা। ডোম বাগদী দুলেরা ছিল তাদের সেপাই। কিন্তু তার আগে? তার, তার কিংবা তারও আগে কোন পাটক, বাটক কিংবা নগরীর কোণে ছিল আমাদের মেটে ঘর, গোয়ালঘর, চাঁপাফুলের উঠোন? কোন ভুক্তি, কোন দন্ড, কোন ভূমি?


বিকেল রঙ বদলাচ্ছে হনহন করে। দাদুর সাথে হাঁটছি ওই মেটে রাস্তায়। পায়ে পায়ে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি শতকের পর শতক। হাজার হাজার বছরের ধুলো জমছে আমাদের পায়ে, জামায়, চুলে। এই রাস্তা দেখেছে বর্গীর দল, কালা পাহাড়। তারও আগে কোনও আদিম কৌম জনগোষ্ঠীর পায়ের ছাপ পড়ে আছে এইখানে, এই ধুলোর আস্তরণে।


প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ বলছেন কায়স্থ, সদগোপ আর কৈবর্ত সমাজ বাঙালীর প্রকৃত প্রতিনিধি। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ আর বৃহদ্ধর্মপুরাণ লিখেছে বর্ণসংকর বাঙালির কুল গোত্রের তালিকা। নৃতাত্ত্বিক সেই তালিকা হাতে খুঁজতে বেরিয়েছে বাঙালির জন্মসূত্র, আমার বাপ, দাদা, ঠাকুরদা, তস্য এবং তস্য ঠাকুরদার উৎসমুখের কথা।


ঝুরঝুরে সন্ধ্যা নামছে দীঘির জলে, বুনো ঝোপে, বাঁশের বনে, রাস্তায়। হুন হুনা, হুন হুনা, হুন হুনা রে, হুন হুনা...

পালকি চড়ে নতুন বউ আসছে গাঁয়ে। এসেছিল আমার ঠাকুমা, দিদি ঠাকুমা এবং আরও আরও সমস্ত প্র প্র প্রপিতামহীর দল। নববধূর সাজে, অলক্ত পা ফেলেছিল লালমাটির গায়ে, কাজল টানা চোখ তুলে প্রথম দেখেছিল এ গাঁয়ের গাছপালা, টলটলে দীঘি আর খোড়ো ছাউনির মেটে বসত। নৈষধ চরিতের দময়ন্তী সেদিন নববধূ। লাক্ষারসে রাঙানো ঠোঁট, পায়ে লাল আলতা, কানে মণিকুন্ডল, হাতে কেয়ুর কাঁকন, শঙ্খের বালা। তেমনই কি আমার সেই অজানা কোনও পিতামহীর ছিল– হাতে শঙ্খের বালা, কানে তালপাতার কুন্ডল, পরনে আটপৌরে সুতোর কাপড়, ঘোমটা ঢাকা আয়ত একজোড়া চোখ?


‘দ্য এনালস অফ রুরাল বেঙ্গল’ লিখতে গিয়ে হান্টার আক্ষেপ করেছেন বাঙালির এমন কোনও লিখিত ইতিহাস নেই যা দেখে তার আদিকথা জানা যায়। যা আছে, যেটুকু আছে তা প্রায় সবই রাজাদের দলিল, দানপত্র। সেখানে সাধারণের কথা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিছু লিপি আছে, সেও সমাজের ছবি নয়। তবুও ইতিহাসবিদ খোঁজে সেইসব অন্ধগলিতে, সেইসব লিপি, দানপত্র, সাহিত্য, পুরাণ কিংবা পোড়ামাটির ফলকে। পাহাড়পুর আর ময়নামতীর বিহারে মন্দিরের গায়ে শিল্পী ঢেলে সাজিয়েছে সমাজের কথা, সাধারণ জীবনের কথা, মাঠেঘাটে কাজ করা মানুষের দিনযাপনের অনাড়ম্বর সব দলিল।


হাওয়া বইছে। বাঁশের পাতায়, তালগাছের মাথায় ঘষা খেয়ে শব্দ হচ্ছে শরশর, শনশন।দীঘির জলে ছোটছোট ঢেউ। মাটির দাওয়ায় বসে কুটনো কুটছে আমার পিতামহী কোনও এক প্রাগৈতিহাসিক সন্ধ্যায়। বেগুন, লাউ, কাঁকরোল, কচু, ইচা, বাচা, শকুল, রোহিতের ঝোলে ঝালে ভাজায় ম ম করছে আমাদের উঠোন, টুপটাপ ঝরে পড়ছে গোলকচাঁপার ফুল। পুকুরঘাটে বর্ষা নেমেছে।


প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোয় তো বটেই; বর্মা, চীন, ইন্দোনেশিয়া, জাপান জুড়ে প্রধান খাবার ভাত মাছ– বাংলা আসাম উড়িষ্যারও তাই। মধ্য ভারত থেকে দক্ষিণে সিংহল অব্দি, পূর্বে উড়িষ্যা বাংলা আসাম পর্যন্ত, সিংহল থেকে অস্ট্রেলিয়া অব্দি ছড়িয়ে ছিল এক আদিম কৌমগোষ্ঠী। নৃতাত্বিকরা বললেন এই সেই আদি অস্ট্রালয়েড জন, যে জনের গঠনগত মিল পাওয়া গেছে কোল মুন্ডা সাঁওতাল শবর হো ভূমিজ উপজাতির শরীরে। করোটি, কপাল, নাক, চোখ, চুল, উচ্চতার খুঁটিনাটি বিচারে জানা গেছে এই আদি অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর সাথে মিশেছে আর এক ভূমধ্যসাগরীয় জনস্রোত আলপাইন, এলপো দিনারীয় স্রোত। এক প্রাগৈতিহাসিক ভোরে মিলেমিশে যাওয়া সেই সংকর স্রোতে জন্ম নিল আমার প্রথম পূর্বজ।


পশ্চিমের গুজরাট থেকে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু হয়ে একটা অ্যালপো দিনারীয় দল পৌঁছেছিল হয়ত উড়িষ্যা, বাংলার মাটিতে। তারও আগে কোনসময় এসেছিল ভূমধ্যসাগরিয় কোন নরগোষ্ঠী। এদের সঙ্গে মিশে গেছিল বাংলার সেইসব আদিম সাঁওতাল, ওঁরাও কিম্বা মুন্ডা জনজাতির আদি অস্ট্রালয়েড রক্ত। রক্তের সাথে রক্তের মিশেলে যেমন জন্ম নেয় নতুন প্রজন্ম তেমনই মিশে যায় রীতিনীতি, আর বিশ্বাস।


জল থৈ থৈ জমি। জল টুপটুপ মেঘ। বীজধান দুলছে হাওয়ায়। তার আগে লাঙল চলেছে, মসৃণ কাদামাটি। সাতপুরুষের জমি, নিজের হাতে লাঙল চষে আমার পূর্বপুরুষ, ফালাফালা মাটি। মাটি ঘাঁটতে ঘাঁটতে আরও আরও বহুদূর হেঁটে যায় আমাদের দাদু,তস্য এবং তস্য বাপ দাদারা। লাঙল নামানোর আগে পুজো দেয় হারান কাকা,পূজো দেয় আমার পূর্বপুরুষ। গোলায় ধান তুলে এনে লক্ষ্মীর বেড় পড়ে মরাইয়ের গায়ে; তেল সিঁদুরের ফোঁটা, গোবর নিকোনো মরাইতলায় অল্পনার আঁকিবুকি। ধানের ছড়া, কলার পাতা, কলা গাছ, হলুদ, পানে আমাদের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। ভেজা চুল, এলো খোঁপায় আসন সাজায় আমারই কোনও দিদিঠাকুমা।


প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে দ্বীপে জ্বলে ওঠে প্রদীপ। সুপারি, হলুদবাটা, ধানের ছড়া,কলার পাতার গন্ধ মেখে ভেসে যায় শাঁখের আওয়াজ, দূরে বহুদূরে গ্রাম নদী সাগর পেরিয়ে অজানা কোন দেশে। বাঙালির পুজোপার্বনে আদি নর্ডিক আর্য সভ্যতার ছাপ অল্পই, বাঙালির জীবন এবং চরিত্রেও তাই। যেটুকু বা তাও ওপরে, তার গভীরেও সেই আদি অস্ট্রেলিয় ধারা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলিতে এই পান সুপারি, ধানের ছড়া, কলাপাতা, হলুদের ব্যবহার সমস্ত মাঙ্গলিক কাজে, ধানের ছড়ায় পুজো করে নাগা আর মুন্ডারী জনজাতি। পুজো করে বাঙালি আর তার ব্রাহ্মণ।


সামাজিকভাবে বাঙালি ব্রাহ্মণ উত্তরভারতীয় ব্রাহ্মণের মর্যাদা পায়নি কখনও। বাঙালী ব্রাহ্মণের নিকটতম সম্পর্ক বাংলার কায়স্থ আর বৈদ্যের সাথে। আর বাংলার নমঃশূদ্র চন্ডাল গোষ্ঠীর শরীর গঠনগতভাবে ঘনিষ্ঠ মিল খুঁজে পায় উত্তরের বর্ণব্রাহ্মণের সঙ্গে। ঠিক তারই পাশে বাংলার কায়স্থ কৈবর্ত আর সদগোপ দেহগত বৈশিষ্টে বাঙালির সব বর্ণের সবচেয়ে কাছের জন। বিহারের কিছু গোত্র ছাড়া এই তিন দলের আর কারোর সঙ্গে কোনও মিল তেমন পাওয়া যায়নি, নৃবিজ্ঞানীরা এমনটাই বলেন।


চাষ করে আমার সদগোপ পূর্বপুরুষ। ফালাফালা মাটি, আকাশ ছেঁচা জল, মাটি ঘেঁটে ঘেঁটে ফসল তোলে ঘরে। লাঙলের ফালে তেল সিঁদুরের পূজো অম্বুবাচীর দিনে। লাঙলের ব্যবহার অস্ট্রালয়েড জনের ধারা। লাঙল শব্দও এসেছে এদেরই ভাষা থেকে। অস্ট্রালয়েড ভাষায় লাঙল শব্দের মানে চাষ করা, কিংবা হল। এই একই অর্থে লাঙল শব্দের ব্যবহার সংস্কৃতে। ভাষাতাত্বিক যুক্তি দিলেন যদি কোনও জিনিসের ব্যবহার অজানা হয় তবে তার নির্দেশক শব্দও অভিধানে থাকেনা। আদি নর্ডিক আর্যরা কৃষিকাজ শিখেছে এদেশে এসে, লাঙল শব্দও তখন জুড়ে গেছে সংস্কৃত ভাষার অভিধানে। একই ভাবে দা, করাত, কানি, চোঙা, চিখিল, চোঙ, লেবু, কামরাঙা, ডুমুর ঝোপঝাড় ইত্যাদি এসেছে অস্ট্রিক শব্দ থেকে। দামলিপ্তি(তাম্রলিপ্ত) আর পৌন্ড্র, বঙ্গ এসব শব্দও অস্ট্রিক। নদী পাহাড় জঙ্গলেও পড়ে আছে অস্ট্রালয়েড জনের ছাপ। দাক্ হলো জল, দাক্ থেকে সংস্কৃত উদক। দাম-দাক্ দামোদর। আমাদের ভরা বর্ষার দামোদর।


মেঘ নামছে পাকুড় গাছের মাথায়। রাখাল ফিরে আসছে, দীঘির জলে ডোঙা বেয়ে ঘোরে হারান কাকার ছেলে পরেশ। মাথায় তালের টোকা। পেরিয়ে যাচ্ছি ফণীমনসার ঝোপ, মনসার থান, বর্গী’র মাঠ। বীজধান রোয়ার সময় এখন। চিকচিকে সবুজ ঢেউ ধানি জমির গায়ে। লাঙলের ফালে মাটি কেটে কেটে চাষ করে সেইসব অস্ট্রালয়েড মানুষ, সমতল জুড়ে, ধাপ কেটেকেটে পাহাড়ের গায়ে। চাষ করে আমার চৌদ্দপুরুষ, চাষ করে হারান বাগদী, কানন দুলে, শিবু ডোম।


পণ, গন্ডা, কাহনের হিসেবে বীজ রুইছে। মাড়াই করা খড়ের হিসেব হচ্ছে কাহন দরে। আজ নয়, কাল নয়, হাজার হাজার বছর ধরে আমার চাষী পূর্বজ শিখেছে এই হিসাব। প্রতি চারে এক গন্ডা, কুড়ি গণ্ডায় এক পণ, ষোল পণে এক কাহন। কাহনে পণে আঁটি গুনছে আমাদের ঠাকুরদা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের আদিম মানুষ গোনে দু হাতের দশ আঙুল, কুড়ির হিসাবে। গন্ডা হল একক, গন্ডা হল চার। চার কুড়িতে এক পণ। বিড়বিড় করে বীজধানের হিসাব কষে দাদু, বীজতলা জুড়ে সবুজ বিছায় হারান কাকা।


ভুবনেশ্বর শিবের ভাঙ্গা মন্দিরের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াই। স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা। কবেকার এই মন্দির ছিল জানেনা আমার দাদু, জানেনা গ্রামের কেউ। হয়ত মন্দির নয় ,বৌদ্ধ বিহার। বৌদ্ধ জৈন ব্যবসায়ীরা আসতো দ্বারকেশ্বরের ঘাটে ঘাটে, সওদা হত ধুনো, কাঁসার বাসন, আখের গুড়। ক্রিট দ্বীপের সাথে বাঙালির ব্যবসা ছিল মশলা, হাতির দাঁত, কাপড়ের।

দেবরাজ ইন্দ্র পণিদের কাছে শিখছেন পনীর আর ছানা তৈরির হালহকিকত। পণি থেকে আসা পণ্য কিম্বা বণিক শব্দের সূত্র আমাদের নিয়ে যায় দূরে, ভূমধ্য সাগরের দেশে। এই সেই ভূমধ্যসাগরীয় দল যারা হয়ত এসেছিল তামা'র খোঁজে। প্রফেসর এলিয়ট স্মিথ এই তামার ব্যবহারকেই দায়ী করেছেন মধ্যপ্রাচ্য আর ভূমধ্যসাগর উপকূলের মানুষগুলোর ভারত সহ নানান দেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে, ঠিক যে কারণে মেগালিথ কাল্টে বিশ্বাসী সূর্যপূজারী লোকেরাও ছড়িয়ে যাচ্ছিল পৃথিবীর নানান কোণায়। আর্যভাষী অ্যালপো দিনারীয় দলগুলোও হয়ত এসেছিল এদেরই পিছু পিছু, সম্ভবতঃ নর্ডিক আর্যদেরও আগে।


বর্ধমানের আউস গ্রামের কাছে যে পাণ্ডু রাজার ঢিবি, সেই ঢিবিতেই পাওয়া গেছে ক্রিট দ্বীপে ব্যবহার হওয়া লিপিতে লেখা এক সিলমোহর। মিশরীয় এক নাবিকও তাঁর 'পেরিপ্লাস" বইয়ে লিখছেন প্রায় তিন হাজার বছর আগে ক্রিট দ্বীপে বাঙালি উপনিবেশের কথা।


বর্ষা ছিল সেদিন, উপুড় হয়ে পড়েছে আকাশ। লাল চেলি, চন্দনের টিপ– কড়ি খেলে ঠাকুমা, কড়ি খেলে আমার দিদিঠাকুমা। কড়ি খেলে ফিজি, নিউগিনি, পাপুয়ার মেয়েরা। মাঠঘাট ভাসছে বৃষ্টিফোঁটায়, বৃষ্টি নাচছে দীঘির জলে। কলার ডোঙায় ভেসে বেড়ায় কালু ডোম, পদ্মপাতায় টলটলে জল। পাড়ে ভিজছিল ডোমনি রাধু আর তার বাঁশের চুপড়ি। রাধুর চিকন সবুজ গা, ভ্রমরকালো চোখ, ছড়ানো নাক, ছোট্ট কপাল।


“এক সো পদমা চউসট্‌ঠী পাখুড়ি।

তহিঁ চড়ি নাচই ডোম্বি বাপুড়ি॥”


ডিঙ্গা ভাসছিল জলে। কাঠের সাথে কাঠ জুড়ে জুড়ে মস্ত ডোঙা ভেসে যাচ্ছিল জলে, প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউয়ের মাথায়। ভেসে যাচ্ছিল আদি অস্ট্রালয়েড মানুষ আর তাদের জলজ অভিসার সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, মেলানেশিয়া ছাড়িয়ে আরও দূরে অস্ট্রেলিয়ার আদিম মাটিতে, প্রাগৈতিহাসিক এক সন্ধ্যার উপকূলে।


বৃষ্টি পড়ছিল খুব… বৃষ্টি পড়ছে জোরে। ভেসে যাচ্ছে মাঠ, দীঘির পাড়। দূর ,অতি দূর থেকে বিনবিন শব্দ উড়ে আসে হাওয়ায় এক কুড়ি, দু কুড়ি... চার কুড়ি পণ…

1 comments:

0

প্রবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in









জলকে 'জীবন' বলা নতুন কিছু নয়, এই তথ্য- সর্বজনবিদিত যেমন অ এর পর আ।পৃথিবীর তিনভাগ জল একভাগ স্থল এও আমাদের জানা।ত্রিপুরার মহিমময় জলভাণ্ডার তার নদী, খাল, হাওড়- বাওড়,দিঘি,ছোট বড় পুকুর সবই রাজ্যের মানুষের জীবন বেঁচে থাকা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে জড়িত।ত্রিপুরার অতিবিখ্যাত গোমতী নদী রবীন্দ্রনাথের লেখায় অমর হয়ে আছে।এখন কথা হল ত্রিপুরার এই যে জলসম্পদ- জল তা নীর-বাসনা হয়ে অবিরত আমাদের কাছে এক শিল্পরূপ তুলে ধরে।ত্রিপুরার রাজারা ছিলেন বিদ্ব্যোৎসাহী।শিল্প ও সাহিত্য প্রেমী সংস্কৃতি বোধ সম্পন্ন মানুষ। রবীন্দ্রনাথকে তারা কীভাবে আপন করে নিয়েছিলেন তা ইতিহাসের সাক্ষ্য কণা হয়ে জেগে আছে।আমরা জলের কথা বললাম।এবার আমরা ত্রিপুরার কিছু জল সম্পদের কথা বলি।

ত্রিপুরায় যে যে নদী আছে মনু,হাওড়া,গোমতী, খোয়াই, দেও, জুড়ি, ধলাই ইত্যাদি প্রভৃতি সবই ত্রিপুরার মানুষের জীবনে সভ্যতার বহতা আঙ্গিক হিসাবে জড়িত।ত্রিপুরার রাজারা নদীর বুকে প্রাসাদ তৈরি করে জল ও জল শিল্পকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন।রাজস্থানের যে জলাশয় কেন্দ্রিক প্রাসাদ তার তুলনায় 'নীরমহল' একেবারেই স্বতন্ত্র। হয়তো স্থাপত্যের নিরিখে শিল্পের কলাকৌশলে সূক্ষ্মতায় রাজস্থানের প্রাসাদেরা যে শৈল্পিক চূড়া স্পর্শ করে নীরমহল হয়তো তার তুলনায় কিঞ্চিৎ ঊন হলেও তার শোভা এবং বৈশিষ্ট্য অনন্য।বিশেষ করে রাতে যখন আলো জ্বলে উঠে নীরমহল- এর মনুষ্যবিহীন ঘর ও বারান্দায় তখম মনে হয় স্বপ্ন লোকের কোনও অলৌকিক চাবি আমাদের সামনে এসে দোল খায়।তাকে ধরে নিয়ে স্বপ্ন ও কল্পনা এবং বাস্তবের দরজাটুকু খুলে ফেললে আনন্দ ও শৈল্পিক জাগরণে।আবার দিনে নীরমহলের শোভা অন্যরকম।

পৃথিবীর কোলে জলের শোভার মধ্যে জেগে থাকা সে যেন এক অলৌকিক রাজহংস।দূর থেকে ধীরে নৌকো পথে যত তার কাছে যাওয়া যায় তর তার মহিমময় রূপ যেন ফুটে ওঠে চোখের সামনে।শীত সকালের অলৌকিক কুয়াশার মধ্যে এই মহল যেন এক কুহক যাত্রার কথা বলে।নৌকো করে নেমে এসে ধীরে ধীরে ভেতরে এলে রাজার বিশ্রাম কক্ষ,নর্তকীদের নাচের জায়গা, বারান্দা, ঝরোখা, রাজাদের ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট স্বতন্ত্র নৌকো- ঘাট সবই আমাদের বোধ ও শৈল্পিক ভাবনাকে নবরসে জাড়িত করে।মুঘলরা ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তারের পর দিল্লিকে রাজধানী করলে অনেক ধরনের বাগান তারা বানিয়েছিলেন।মুঘল শাসকদের কাছে বাগান-বিলাস এবং জল একটা বড় ব্যাপার ছিল।সব ধরনের বাগানেই ছিল পরিকল্পনার ছাপ এবং জলের ব্যবস্থা। এমনকি তারা অতি বিখ্যাত সব স্থাপত্য জলের আয়োজন রাখতেন।মধ্য এশিয়ায় জলের অভাবে কি এই জল তৃষ্ণার অন্যতম কারণ? তাই স্থাপত্য নির্মাণ করলেই জলের আয়োজন। যেমন তাজমহল।ত্রিপুরার রাজাদের ব্যাপারটি স্বতন্ত্র। তারা জলের ভেতর শিল্প গড়েছেন।শিল্পের স্বপ্নের সঙ্গে জলের স্বপ্নও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

এবার আসি আমরা নীরমহল প্রসঙ্গে।বোটে করে নীরমহল যেতে যেতে অজস্র পাখি এবং মাছ ধরার নৌকো চোখে পড়ে আমাদের। এর প্রাকৃতিক শোভা অনবদ্য। সৌন্দর্য মুগ্ধ টুরিস্টরা এই জলশোভার ছবি নেন অকাতরে।এই প্রাসাদের গম্বুজ ও ঝরোখা ইসলামিক ও হিন্দু স্থাপত্য শৈলীর সমন্বয়বাদী এক ধারাবাহিকতার কথা বলে।

নীরমহল যার অর্থ “জল প্রাসাদ”। এটি ১৯৩০ সালে রুদ্রসাগরের হ্রদের মধ্যবর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুর কর্তৃক নির্মিত একটি রাজকীয় প্রাসাদ এবং এটি ১৯৩৮ সালে সম্পন্ন হয়। এটি ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে ৫৩ কিলোমিটার দূরে মেলাঘরে রুদ্রসাগর লেকের মাঝখানে অবস্থিত এবং হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্য শৈলীর সমাহার করে।এই প্রাসাদটি ভারতের সবচেয়ে বড় এবং পূর্ব ভারতে একমাত্র। ভারতে শুধু দুটি জল প্রাসাদ আছে অন্য আরেকটি রাজস্থান রাজ্যের “জল মহল“। ত্রিপুরার ‘হ্রদ প্রাসাদ‘ হিসাবে পরিচিত, নীরমহল একটি গ্রীষ্ম বসবাসের স্থান হিসাবে নির্মিত হয়েছিল। সুন্দর রুদ্রসাগর হ্রদে প্রাসাদ নির্মাণের জন্য মহারাজা বীর বিক্রম মাণিক্য বাহাদুরের ধারণা ছিল এবং ১৯২১ সালে তিনি তাঁর প্রাসাদ নির্মাণের জন্য ব্রিটিশ কোম্পানি “মার্টিন ও বার্নসকে” স্বীকৃতি দেন। কাজটি সম্পন্ন করার জন্য কোম্পানিটি নয় বছর সময় নেয়। মহারাজা বীর বিক্রম মাণিক্য বাহাদুর ‘মাণিক্য রাজবংশের‘ ছিলেন, যা আজ বিশ্বের একক শাসক লাইন থেকে দ্বিতীয় বলে মনে করা হয়।

প্রাসাদ হল মহারাজার মহান দূরদর্শিতা এবং হিন্দু এবং মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মিশ্রণের তার চিত্তাকর্ষক ধারণা।

প্রাসাদটিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রাসাদটির পশ্চিমাঞ্চল অন্দর মহল নামে পরিচিত। এটা রাজকীয় পরিবার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। পূর্ব দিকের একটি খোলা আড়ম্বরপূর্ণ থিয়েটার যেখানে নাটক, থিয়েটার, নাচ এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলি মহারাজা এবং তাদের রাজকীয় পরিবারের আনন্দ উপভোগের জন্য সংগঠিত হয়।

রুদ্রসাগর লেকে অবতরণে নীরমহল দুটি স্টারওয়েজ ঢুকিয়েছে। ‘রাজঘাট‘ থেকে হাতে চালানো নৌকা দিয়ে মহারাজ প্রাসাদে যান।

১২২ মিটার লম্বা কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে দুধ-সাদা রঙের প্রাসাদে রয়েছে সর্বমোট ২৪টি কক্ষ, যাকে ঘিরে রয়েছে সুন্দর বাগান। প্রাসাদের গম্বুজ আকৃতির মিনারগুলি, বিরাট ‘দরবার কক্ষ’, রাজা-রানির বিশ্রামকক্ষ, সুউচ্চ নজরমিনার সবই চমৎকৃত করবে। রুদ্রসাগরের পাড় থেকে জলের মধ্যে থাকা নীরমহলকে দেখে রাজস্থানের উদয়পুরের লেক-প্যালেস ‘জলনিবাস’-এর পিছোলা লেকের উপর অবস্থিত কথা মনে পড়বে। রুদ্রসাগর লেকের জলেও পড়ে নীরমহলের প্রতিবিম্ব। ৫.৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রুদ্রসাগর সরোবর বিভিন্ন ধরনের পাখির বিশেষত পরিযায়ী জলকেলির এক নিরাপদ ঠাঁই। নীরমহলের প্রশস্ত ছাদ থেকেও রুদ্রসাগরের এক দারুণ দৃশ্য চোখে পড়ে।

যেটুকু সৌন্দর্য কথা,সৌন্দর্য মালা আমাদের সামনে দিয়ে যেন বা আমাদের সামনে কোনো সিনেমার ছবি হয়ে ছুটে গেল সেই শব্দমালাদের যে শিল্পিত রূপ তার বর্ণনায়।নীরমহলের ছায়ার আলোয় ইতিহাসে ভূগোলে করার চেষ্টা হল তা হয়তো অসম্পূর্ণই।প্রকৃত প্রস্তাবে যেকোনো রস ও সৌন্দর্য তো আসলে অপূর্ণই।অপূর্ণতাই তার সুন্দর হয়ে উঠার বহুমাত্রিক গুণ।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অম্লান রায় চৌধুরী

Posted in






এখন ফোন ইন্টারনেট সহ অন্যান্য ডিভাইস আমাদের জীবনের এতখানি
দখল করে নিচ্ছে যে বাস্তবের সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়ে চলতে পারছিনা।
প্রতিক্ষণ আমাদের মনে হচ্ছে দুনিয়ায় হরেক রকমের ইভেন্ট ঘটে
চলেছে । সে সবের সঙ্গে সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত না থাকতে পারলে বেঁচে থাকা
অর্থহীন । তাই আমি আইসক্রীম কিনতে গিয়ে ভারচুয়াল দুনিয়ায় একটানা
সফর করতে থাকি , আর এমনটা বুঁদ হয়ে যাই , শেষ মেশ আইসক্রীম আর
কেনা হয়না । হয়তা অন্য কিছু করে বাড়ি এলাম , আসল কাজটা এভাবেই
হয়না। এই প্রবণতা কে বলা হয় ‘ফোমো’ – যার অর্থ -- ফিয়ার অফ
মিসিং আউট । যার সঙ্গে মিশে থাকে বেশ মিঠে কড়ায় দানা বাঁধা আশঙ্কা
, উদ্বেগ ।

‘ফোমো’ র আগের ধাপ ‘ইয়েলো’ (ইউ অনলি লিভ ওয়ান্স)।
‘ফেমো’ র স্রষ্টা প্যাট্রিক ম্যাকগিনিস এর বিবরণ দিয়েছেন নিজের
জীবনের আখ্যান দিয়ে । নতুন শতকের একেবারে শুরুর পর্ব সেটা।
এই ফোমোর বিষয়টা এখন বেশ চালু। দেখা যায় সব সময় । একসময় আমি
ভাবতাম ‘ফোমো’র সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশাল কোনো অঘটন বা আঘাত বা
এমন কিছু ঘটনা যা অনুমেয় যোগ্যও নয় – যেমন ৯/১১ দিনটির
ভাঙ্গচুরময় অভিজ্ঞতা। কিন্তু দেখলাম সেটা ঠিক নয় । ভুল ভেবেছিলাম ।
ফোমো মানুষের চেতনে অনেক আগে থেকেই বিরাজ করছে । বহু মানুষ আছে
যাদের দেখা যায় দিনের শুরু থেকেই শুধু খুঁজে ফেরে সুযোগ , সে কম পয়সায়
খাবার পাওয়া থেকে আরম্ভ করে , বেশী ডিসকাউন্টে ইলেকট্রনিকস
গুডস পাওয়া – সব কিছুর খোঁজ তার নখ দর্পনে। তাদের পাওয়ার জন্য
মরিয়া , এদের কাছে হারিয়ে যাওয়ার অপশন অনেক , কোনোটাকেই তাই
ছাড়তে চায়না , হয়ত মোবাইলের মতন এক জায়গায় দেখতে পায়না কিন্তু
খোঁজ পায় , কথা বলে , নিজের জীবনের ঝুঁকিকে সামনে রেখেও চলে এই
বাক্যালাপ , এটা তার আনন্দ , না হারিয়ে ফেলার আনন্দ , একেবারেই
‘ফোমো’য় আকৃষ্ট নিবিষ্ট – এক প্রকৃষ্ট বা ক্লাসিকাল উদাহরণ ।
তবে ঐ ‘ফোমো’ ও তার কনসেপ্টকে -- সোস্যাল মিডিয়া – এখনকার
ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম – সম্ভবত আগুনের শিখার মতন একেবারে উসকে
দিয়েছে । করে তুলেছে ফোমোকে একটা ভয়াল ‘মডার্ন এপিডেমিক’ ।
প্যাট্রিক জে ম্যাকগিনিস, এই ফোমো কনসেপ্টের স্রষ্টা , দেখতেন তার
বন্ধুদের মধ্যে , যখন তিনি হার্ভার্ডে পড়তেন , কি ভীষণ রকমের
উত্তেজনা – ঐ ফেসবুক , ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি নিয়ে । কি অপরিমিত সময়
তারা ব্যবহার করত সেই সময় । এটাকেই উনি দেখতেন একটা ‘ক্রনিক
সিন্ড্রোম’ হিসাবে , এবং পরবর্তী কালে তাদেরকেই দেখতেন , যে তারা
আর পারছেনা তাল মিলিয়ে চলতে জগতের সঙ্গে ।এটা ক্ষতি , চরম
ক্ষতি। এই প্রসঙ্গে একটা ব্যাঙ্গাত্মক লেখা ম্যাকগিনিসের খুব মনে
পড়ে , সেখানে তিনি Two Fo’s নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন , একটা
ফো হলো ‘ফোমো’ যা আগেই বলেছি আর একটি হলো ‘ফোবো’ – ফিয়ার
অফ আ বেটার অপশন।

আরও আশ্চর্য লাগে যখন ম্যাকগিনিস সম্বন্ধে পড়ি এবং জানতে পারি
যে উনি বেশী চিন্তিত ছিলেন ‘ফোবো’ নিয়ে অথচ সারা দেশ চিন্তিত ছিলো
‘ফোমো’ নিয়ে। ওনার যুক্তি ছিল, যে, ফোমো কখনও আপনাকে নষ্ট করে
দেবেনা, আপনাকে আত্মা অবধি ব্যার্থ ও ক্ষয়িষ্ণু করে তুলবেনা ।
কিন্তু ফোবো তা করতে পারে । তার মতে, ফোবো আসলে মানুষকে কমিটেড
হতেই দেয়না। তাকে একটা সংশয়ের মধ্যে রাখে, সম্ভবত, হয়তো, এই
দোলায় সারাক্ষণ দোলায় । আসলে ফোবো একটি সিদ্ধান্তহীনতার
অভিশাপ ।

কোনো পরিকল্পনাকেই স্বতস্ফুর্ত ভাবে গ্রহণ করবার মতন মানসিকতা
তৈরি করতে দেয়না । এই ভয়টা আছে । অনেকেই বা বহু ক্ষেত্রেই মনের
মধ্যে একটা ‘আরো ভালো’ অথবা বোধ হয় ‘আরও একটু দেখা’ যেতে পারে
– এই সমস্ত ভাবনাগুলোকে প্রশ্রয় দেয়। তারা সব সময় ‘আরো ভালো’র
সন্ধানে মত্ত থাকে , আসল কাজের জিনিষটা শেষে পাওয়া হয়না । এই
ভীতিটা ম্যাকগিনিসের আছে এবং তার ব্যাক্ষায় বেশ দেখা যায় ।
দেখা যায়, দুটো চাকরীর অফার, ঠিক করতেই পারলোনা, দ্বীধায়,
সিদ্ধান্ত নিতে পারলোনা -- কোনোটাতেই শেষে জয়েন করা হলোনা । কিংবা
বেড়াতে যাওয়ার জন্য নানান জায়গার অপশন, বাছাবাছি করতে করতে
ভ্যাকেশন শেষ, যাওয়া হলোনা – এমনটা হয় , হচ্ছে , আর এটাই ‘ফোবোর’
ফল।

আসলে দ্বীধার মাত্রাটাকে বড় বেশী জোড় দেওয়া হয়, তাই সিদ্ধান্তের
ক্ষেত্রেও ততটাই শিথিলতা ।

‘ফোমো’ তে ব্যাক্তি মানুষ নিজে কষ্ট পায় । কিন্তু ফোবোর যাতনা সইতে
হয় আরও অনেক মানুষকে । ‘ফোবো’ ছেড়ে চলে যায়না, ফলটা চলতে থাকে
জীবনের অনেক দুর পর্যন্ত, কাজেই কাছ ছাড়েনা। অবচেতনকে কখনো
ছাড়েনা । বেশী বয়সে গিয়ে মনে পড়ে, ভুল সিদ্ধান্ত, জ্বালায়, করার কিছুই
থাকেনা । মানুষকে আরও আত্মসর্বস্ব বানায় ।

এখন দেখা যাক উপায় কী ? দেখা যাক না যে জীবন , শান্ত , বাগানে
দোয়েলের টানে --ফড়িংয়ের হুটোপুটিতেও শান্তভাবে পাখী শিস দিয়ে গান
গায় – এমন অবস্থাটাকে বরণ করা যায় কিনা । আরো ভাল কিছু না পাওয়া
অবধি পক্ষ অবলম্বন করবনা, এমন নির্বোধ আচরণ না হয় নাই–ই বা
করলাম । কারন আরো ভালোর কোনো নিশ্চয়তা নেই – এটাকে মাথায়
রাখতে হবে – ভবিষ্যতের উপর নিজের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়
, ফল ভালো হয়না , তার প্রমাণ আছে ঝুড়ি ঝুড়ি – সমাজ থেকে কিংবা
পুরান থেকে - অনেক আছে জীবনে – তাই ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ বলতে পারা অনেক
ভালো , ‘হয়তো’ বলার চেয়ে।

এতেই জীবন সহজ ও আনন্দময় হয় । গ্যারান্টি দিচ্ছেন কিন্তু সেই
মানুষটিই যিনি ‘ফোমো’ আর ‘ফোবো’, এই দুইয়েরই স্রষ্টা।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in












নবনীতা দেবসেন: নারীকেন্দ্রিক জীবনদৃষ্টি




প্রিয় বাসু,

গতকাল সন্ধ্যায় তোমার চিঠি পেলাম। আকাশ কাঁসার বাসনের মতো রঙে ধূসর হয়ে আছে। কিছু পাখপাখালি আকাশে উড়লে মনে হয় খড়কুটো উড়ছে। কর্পোরেট জীবনের ব্যস্ততায় আগের মতন পড়তে পারি কোথাায় বলো! বিগতা যৌবনা শব্দটা ব্যবহার করে খোঁচা দিলে মনে হলো তবে তা তুমি বলতেই পারো। আগের মতন রোজ কবিতা পড়া হয়না তাই বলে ভেবো না সব ভুলে গেছি। খুব প্রিয় একটা কবিতার শেষ কটি লাইন তোমার সমস্ত চিঠির উত্তর হতে পারে।

আমি তোমার হই
তুমি
আমার কোলের শিশু হ'য়ে আমাকে বরণ করো
আমাকে হরণ করো
পূরণ করো।

বিংশ-একবিংশ শতকের বাংলা সাহিত্যে নবনীতা দেবসেন একজনই। তিনি উচ্ছল, সহাস্য, সুদূরপিয়াসী, কখনো তির্যক, কখনো ক্রুদ্ধ, প্রয়োজনে কঠোর। ছেলেভোলানো রূপকথা থেকে অচঞ্চল কবিতা, সরস ট্রাভেলগ থেকে প্রশ্নাত্মক অ্যাকাডেমিক রচনা – সবকিছুতেই তাঁর অনায়াস বিচরণ। তিনি ঠিক যতটাই ধ্রুপদি, ততটাই আধুনিক বা সমকালীন। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম প্রত্যয়‘ প্রকাশ পায় ১৯৫৯ সালে। তখন তাঁর মাত্র একুশ বছর বয়স। এই কাব্যগ্রন্থের ‘বৃন্তহীন একটি গোলাপ‘ কবিতাটির কথা মনে আছে? কবিতার শুরু এই রকম: “কিন্তু, তুমি এখন তো জানো/ বর্ণ গন্ধ ফুলের জঞ্জালে/ বুক রেখে কিংবা মুখ রেখে/ কোনো লাভ নেই।” বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। কিন্তু চোখে লাগে ‘জঞ্জালে‘ শব্দটি। বর্ণ গন্ধ ফুল তাঁর পূর্ববর্তী সব কবিদের কাছে মহার্ঘ ছিল। নবনীতা এক কালোপযোগী তিক্ততা হানেন বর্ণ গন্ধ ফুলের প্রতি, ওই ‘জঞ্জালে‘ শব্দটি প্রয়োগ করে। কবিতাটিতে শুধুমাত্র ওই একটি শব্দই আধুনিকতার নিশান ওড়ায়। নবনীতা দেবসেনকে পড়তে গিয়ে কোথাও মনে হবে না প্রতিবাদী চেতনার বিস্ফোরণ আছে। দুঃসাহসী দামাল নবনীতার অকুতোভয় প্রকৃতি সেখানে ডালপালা মেলেনি। এজন্য তাঁর নারীবাদী চেতনায় বিদ্রোহী বিকার নেই, রয়েছে স্বাধিকারবোধে অসহনীয় আত্মপ্রত্যয়। ‘নারীবাদী লেখক’ তকমা আঁটাতে আপত্তি। কিন্তু, মেয়েদের অধিকার আদায়ের পক্ষে, অন্যায়ের প্রতিবাদে তাঁর প্রিয় টেম্পলপেড়ে মেরুন শাড়ির আঁচলের তলার প্রদীপটি মশাল হয়ে জ্বলে ওঠে। সে মশালের আলো ও আগুন ঝরে অক্ষরে। বাংলার রক্ষণশীল সমাজে নবনীতা আজীবন ডানপিটে পরিচয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন। নিজের মতো করে বেঁচেছেন হার না-মানা প্রকৃতিতে। ব্যক্তিত্বের বহুমুখী বিস্তারে নবনীতা মা রাধারানিকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন কখনও কখনও। নবনীতার কবিতাগুলিকে মনে হয় তাঁর স্পষ্টশ্রুত স্বগতোক্তি। কবিতার মধ্যে দিয়ে নবনীতা আসলে যেন নিজের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, তাঁর সব দুঃখ-শোক বা প্রণয়বাণী নিজেকেই শোনাতে চেয়েছেন। নবনীতার কবিসত্তাতেও নারীজীবনের বহুমাত্রিক প্রতিবাদী চেতনা সবাক্‌মূর্তি লাভ করেছে। পিতৃতান্ত্রিকতা থেকে মুক্তিপিয়াসী নবনীতা ত্রাতা হিসাবে পুরুষের রাজকীয় ভূমিকাকে মেনে নিতে পারেননি। ওঁর সারাজীবনের কবিতাতেই এক অতৃপ্ত প্রেমতৃষ্ণা ধিকিধিকি জ্বলতে দেখা যায়। প্রেমের রাশ হাতে রেখে পুরুষই বলতে চেয়েছে শেষকথা, নারী বাধ্য হয়েছে তা পালন করতে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আত্মস্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে অর্জিত প্রেমের রাজদণ্ডধারী রূপ ক্রমে প্রকট হবার সঙ্গে সঙ্গে, নিঃস্বার্থ সমর্পণের অবমূল্যায়ন বুঝতে শিখেছে নারী। এর মধ্যেকার ‘ঐতিহ্যপ্রসূত’ মহনীয়তা শিকারি ও শিকারের বাস্তব সম্পর্কে জর্জরিত। প্রেমিক হলেন প্রভু, নারীর আত্মোপলব্ধি ‘শিকার’ হিসাবে। নবনীতা তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম রাখলেন ‘লায়নটেমারকে’ (১৯৮৯-১৯৯৫)। নামকরণের মধ্যে পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত। তবে এই আক্রমণ, প্রতিবাদ ধ্বনিত হল নারীর নিজস্ব যন্ত্রণার সমাজতাত্ত্বিক প্রকাশে। কবি যেন নিজের থেকে এক নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব বজায় রেখে নিজের চোখে আঙুল দিয়ে নিজেকেই চেনাতে চাইলেন প্রহার-দগ্ধ নারীর বিকৃত স্বরূপ। নবনীতার কবিতার আরও একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, তার একাকীত্বের সুর। প্রেমের ডাকে সাড়া দিতে আকুল কবি। কিন্তু প্রণয়মুকুটের বদলে তাঁকে যেন চিরদিন শিরোধার্য করতে হয়েছে বিরহের বা নিঃসঙ্গতার কাঁটা। নবনীতা সেই শ্রেণির কবি, যিনি নিজের বক্তব্যকে পাঠকের কাছে জটিল অস্পষ্টতায় পেশ করতে চান না। তাই তাঁর কাব্যভাষা খুব সহজ। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, তাঁর কবিতা সবলে সমস্ত পেশি ফুলিয়ে এক অত্যাশ্চর্য শক্তিরূপ প্রকাশ করতে পারে না। বড় বিনম্র তাঁর কাব্যভাষা। তাঁর উৎকৃষ্ট কবিতাগুলির সঠিক পরিচয় পাঠককে পেতে হয় সেই নম্রতা স্পর্শ করে। কবিতার প্রচ্ছন্ন ব্যঞ্জনার ছটা আটপৌরে প্রকাশভঙ্গিতে হয় হৃদয়ের সম্পদ।

তোমাকে এত বছর পর এইসব কেন লিখছি, লেখার কোন মানে আছে কিনা তাও জানিনা। তবে তোমার চিঠি অজান্তেই উস্কে দিচ্ছে অনেক কিছু। নবনীতা দেবসেনের কোন এক লেখায় পড়েছিলাম ‘সংসারের কোনো কোনো বাসন কোসন, কাপ পিরিচ সম্ভাব্য বন্ধুরতা অতিক্রম করে বিস্ময়করভাবে বহুদিন টিকে থাকে, কিন্তু একদিন হয়ত দেখা যায় যে জন্য এত আয়োজন, সেই সংসারটাই টেকে না, সম্পর্ক ভেঙে যায়।’ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিয়ে এবং বিচ্ছেদ সম্পর্কে রসিকতার ছলে এক হৃদয়গ্রাহী স্বীকারোক্তি, অনেকটা জীবন পেরিয়ে এসে মনে হয় না কি চরম সত্য খেলাচ্ছলে লিখে দিলেন? আমাদের সম্পর্কটাও…

বিদ্রোহের সরবতাই বিপ্লবের আগমনী বার্তা বয়ে আনে। অথচ সেই সরবতা উচ্চকিত না হয়েও যে বৈপ্লবিক চেতনার বিস্তার করা যায়, তা লেখিকা নবনীতা দেবসেন দেখিয়ে দিয়েছেন। নারীবাদী লেখিকা হিসাবে কখনই তিনি সরব হয়ে ওঠেননি। অথচ, তার অবকাশ ছিল। তাঁর পরিবারের মধ্যেই সে রসদ মজুত ছিল। তাঁর মধ্যে পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের বৈষম্যপীড়িত জীবনবোধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চেতনায় নারীবাদের পরিচয় নানা ভাবেই প্রকাশমুখর। ছোটবেলায় ছোট ভাই দিদিকে মারলেও দিদি মারতে পারবে না, দিদিকে তা সহ্য করার চেতাবনির মধ্যে তাঁর মেয়েদের অন্যচোখে দেখার চেতনা জেগে উঠেছিল। সমাজে পুরুষের আধিপত্যে নারীদের আনুগত্যবোধের মধ্যে তাঁর প্রতিবাদী চেতনাই তাঁর বৈদগ্ধপূর্ণ বনেদি অবস্থানে আত্মপরিচয়ের সোপান হয়ে উঠতে পারত। সেখানে তাঁর আমৃত্যু ডাকাবুকো চরিত্রপ্রকৃতিই তাঁর সঙ্গতের পক্ষে যথেষ্ট সরব ছিল। বাংলার রক্ষণশীল সমাজে নবনীতা আজীবন ডানপিটে পরিচয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন।

হাসতে হাসতে এক কাপড়ে ট্রাকে চড়ে অরুণাচল সীমান্তে ভারত-চিনের ম্যাকমোহন লাইন ছুঁয়ে এসেছিলেন। তাঁর ভ্রমণকাহিনি ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমোহনে’। আবার হায়দরাবাদে সেমিনারে গিয়ে কুম্ভমেলায় গিয়েছেন একাকী। তাঁর লেখনীর পরশে তাই ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’ ভ্রমণসাহিত্যে প্রতিমায়িত হয়েছে। এ ভাবে দুরারোগ্য ব্যধিকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়েছেন পৃথিবীর দুর্গম পথে, বাংলা সাহিত্যে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতায় অসংখ্য ফসল ফলিয়েছেন অবলীলায়।

তোমার মনে আছে আমাদের বমডিলা ভ্রমণের কথা। পাহাড়ের গায়ে অজস্র স্ট্রবেরি গাছে লাল স্ট্রবেরি ঝুলে রয়েছে। অয়ন, তুমি আর সোমজা পাকদণ্ডি পথে পাহাড়ের উপরে উঠে হারিয়ে গেছিলে। হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি সহসাই আকাশ সোনালী রোদে ঝলমল। কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তোমাদের খুঁজে পেলাম পাহাড়ের উপরে মনস্ট্রিতে। প্রার্থনা কক্ষে শাক্যমুনি বুদ্ধের বিশাল মূর্তি। মূর্তির একপাশে অবলোকিতেশ্বর ও অন্যপাশে রিনচেংপংযের মূর্তি। মনস্ট্রির মধ্যে ছায়াছন্ন বন্য ধুপের গন্ধ বাতাসে মিশে গিয়ে এক রহস্যময় প্রাচীনত্বের আভাস ছড়িয়ে পড়ছিল। আচ্ছা, আমাদের যে দিন গেছে সে কি একেবারই গেছে?

নবনীতার গল্পে অধিকাংশ নারী মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তারা একদিকে আজন্ম-লালিত সংস্কারকে আঁকড়ে থেকেছে আবার সেই সংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে উত্তরণের পথ খুঁজেছে। যেমন ‘বিমাতা’ গল্পের তাপসী। তাঁর গল্পের নারীরা জীবনের কথা বলে। ‘গদাধরপুর উইমেন্স কলেজ’ গল্পের কথক একজন নারী। সে চায় আত্মপ্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক মুক্তি। স্বামীর সংসারে অস্তিত্বহীন স্ত্রীর চরিত্র প্রথমদিকে তার ভালো লাগলেও একসময় খারাপ লাগতে থাকে। সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়; কিন্তু সংসার ভেঙে নয়, সংসারে থেকেই। ‘এক্সপেন্স একাউন্ট’ গল্পটিতে একজন ছোট পিসিকে পাই আমরা, যিনি বৈশ্বিক আবহাওয়ায় বদলে যাওয়া কলকাতাকে দেখে ব্যথা পান। মেনে নিতে পারেন না। সুকৌশলে তিনি চারপাশের মানুষগুলোকে পুরনো দিনের ঐতিহ্যের কথা শোনান। ‘দাদামনির আংটি’ এক সাধারণ গৃহবধূর অসাধারণ হয়ে ওঠার কাহিনি। দাদামনির আংটি চুরি গেলে এই বধূ থানায় ডায়েরি করতে যায়। থানা ডায়েরি নিতে আপত্তি করে। বধূ প্রতিবাদ করে। সাফ সাফ বলে দেয়, ডায়েরি না নিলে তিনি নিজেই কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তার নামে এফআইআর করবেন। ‘পরীর মা’ গল্পের মা নিজের সন্তানকে ঘটনাচক্রে হারিয়ে ফেললেও অন্যের সন্তানকে বুকে টেনে নেন।
‘শুভমিতা প্রোপ্রাইটার’ গল্পে শুভমিতা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেও প্রথম সন্তান শুভকে ভুলতে পারে না। এমন অনেক মানবিক বার্তা আছে তাঁর গল্পে। আবার আধুনিক গল্পও রয়েছে। ‘আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন’ তেমন একটি গল্প। এ-গল্পে এলিজাবেথ এক অসাধারণ নারী। সে অন্য পন্থায় সন্তান ধারণ করে কারো বাধা না মেনে। একটি অসাধারণ বাক্য আছে এ-গল্পে, ‘মায়ের মুখের একটা কথার ওপরে বাবার বাবাত্ব টলমল করছে। আর তো কেউ জানে না প্রকৃত বাবাটি কে!’ তাঁর গল্পে নারীর বহুমাত্রিক রূপ আমরা দেখি। গল্পের নারীরা হিংস্র নয়। পুরুষের ব্যাপারে তাদের অনীহা বা অশ্রদ্ধা নেই। প্রতিহিংসাও তারা দেখায় না। তাদের প্রতিবাদ পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। যা কিছু পুরনো তার বিরুদ্ধে। পুরনো ঐতিহ্যের মাঝে যে ভালো থাকে সেই ভালো বার্তাই পাই আমরা তাঁর সাহিত্যে।

পড়ন্ত বেলার রোদ্দুর পশ্চিমের জানলা দিয়ে লাল মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দিনগুলি আর হয়ত ফিরবে না। পিছনের দিকে ফিরে গিয়ে ভাবলে মনে হয় কোন রূপকথার গল্পে হারিয়ে যাচ্ছি। অনেকদিন ধরেই একটা সন্ধ্যাজুড়ে তোমাকে চিঠি লিখতে চাচ্ছিলাম। ‘মাঝে মাঝে ভাবি। সবই কি তাহলে মিথ্যা? সব ভাবনা কি মিথ্যা? আমি আমার আত্মাকে জিজ্ঞেস করি। আমি কত যে খুশি হতাম যদি তুমি আমার মনের এই আর্তিটাকে বুঝতে পারতে! সন্ধ্যার সব হৈ হুল্লোড়, আড্ডায় কেন জানি বড় একা লাগে মনে হয় প্রেমহীন নাগরিক জীবনে, হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে আজ সবাই খুব নিঃসঙ্গ।

রূপকথার কথায় মনে পড়ল নবনীতা দেবসেনের রূপকথা। তাঁর প্রিয় বিষয় রূপকথা। আদর্শ জীবন, আদর্শ মানুষ, আদর্শ সমাজ তৈরির সুযোগ আছে রূপকথায়। তাঁর রূপকথায় মেয়েরা কুশীলব। রানি এসে রাজাকে উদ্ধার করে। রূপকথায় পুরুষরাই চিরদিন মেয়েদের উদ্ধার করে। মেয়েদের বন্দি করে, পেটায়, কাটে আবার উদ্ধারও করে। পুরুষই তাদের কষ্ট দেয়, আবার তারাই উদ্ধার করে। মেয়েদের আসল চেহারা নেই, তারা শুধুই বন্দিনী। ছেলেদের তুলনায় প্যাসিভ। তাঁর রূপকথায় মেয়েদের পজিটিভ ও অ্যাকটিভ রোল তুলে ধরা হয়েছে। তারা উদ্ধার করে যুদ্ধ করে নয়, অস্ত্রবলে নয়, বুদ্ধির অস্ত্রবলে। কেন রূপকথা লেখেন তা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, "আমার রূপকথার গল্পগুলি সেই পড়ুয়াদের জন্যে, যাদের বুকের মধ্যে শৈশব অমলিন আছে"। ‘চন্দনরাজার বউ’ গল্পে দেখা যায়, চন্দনরাজা সারাদিন মৃত্যু কোলে ঢলে থাকেন, শুধু মধ্যরাত্রে বেঁচে ওঠেন। কয়েক ঘণ্টা পর আবার মৃত মানুষে পরিণত হন। চন্দনরাজাকে এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে মুক্ত করেন রাজকন্যা চন্দনী। ‘পদ্ম কদম’-এ রাজপুত্র কদমকুমারকে পহ্লবী রাজার কারাগার থেকে জেলেবাড়ির মেয়ে পদ্মকুঁড়ি উদ্ধার করেন। ‘সুসনি-কল্মি’ গল্পে রয়েছে, গরিব দুই বোন ছাগলের দুধ খাইয়ে রাজার দুরারোগ্য ব্যাধী সারিয়ে দেন। দুই রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে হয় সেই দুই বোনের। আবার, ‘বোকা রাজার বুদ্ধিমতী রানি’ গল্পে দেখা যায়, রাজা যতবার বেরোন যুদ্ধ করতে, রানি ততবারই স্বপ্নের গল্প ফেঁদে রাজাকে বিরত করেন। রাজকর্মচারীরা বিপদে পড়লে তাঁদের পরামর্শ দিয়ে রক্ষা করেন পাশের রাজ্যের রাজকন্যা। রানির উদ্যোগের সেই রাজকন্যা রাজার বৌমা হলেন। বিয়ের পর একদিন ওই মেয়ে তাঁর শ্বশুরকে দিয়ে অঙ্গীকার করিয়ে নিলেন, তিনি কখনও আর যুদ্ধযাত্রা করবেন না। এইভাবে নবনীতা তাঁর রূপকথার গল্পগুলোতে নারীশক্তির জয়গান গেয়েছেন। ইচ্ছেমতী, রূপসা, পদ্মমুখী, পুঁটুরানী সব চরিত্ররাই যেন আসলে নবনীতার ছায়া হয়ে ওঠে। তারা যুদ্ধ করে না। অস্ত্র ধরে না। কিন্তু জয় করে নেয় শক্রুকে। শুধুমাত্র মেধা, মনন আর ভালোবাসা দিয়ে।

বৃষ্টি থেমে গেছে। শেষ বিকেলের নিস্তেজ শীর্ণ আলোতে প্রকৃতি, তার সবুজ, হলুদ, লাল, কালো নানা-রঙা নিশান উড়িয়ে দেয় আকাশে আকাশে, বহুবর্ণ গালচে বিছিয়ে দেয় জমিতে, উজ্জ্বল, অগণিত স্পন্দিত তারা আর জোনাকির ঝাড়লণ্ঠন ঝুলিয়ে দেয় আকাশের চাঁদোয়ার নীচে; অন্ধকার রাতে। জঙ্গলের মধ্যে জঙ্গল, গাছের মধ্যে গাছ, পাতার মধ্যে পাতা, ফুলের মধ্যে ফুল, স্মৃতির মধ্যে স্মৃতি সেঁধিয়ে যায়। মেয়েদের ভিতরে একটা আলাদা চোখ থাকে জানো তো? সেই চোখ দিয়ে দেখছি। তুমি গেট ঠেলে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলে না। জানো, প্রথম প্রথম তোমার কথা মনে পড়লে কী কষ্ট যে হত, তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। সেইজন্য আমি আস্তে আস্তে তোমার মুখচ্ছবিখানি বদলে দিয়েছি। এই যে পাহাড়, এই যে ছোটো নদী, ফুলের সমারোহ, প্রজাপতি এমনকি কাঠঠোকরা পাখিটির মধ্যেও ভাগ ভাগ করে দিয়েছি তোমাকে। ভাালো থেকো নিরন্তর। আশা করি দ্রুতই তোমার চিঠি পাবো।

শুভেচ্ছান্তে-

সুস্মি

২৪ নভেম্বর,২০২৪


0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in






ওরা কোনো কথা শোনে না। হাসতে থাকে সবাই। একসঙ্গে অন্তত গোটাদশেক হাত বের্শেনকে বয়ে নিয়ে যেতে থাকে। বসার ঘরে যেখানে টেলিফোন আছে, সেখানে সবাই মিলে ওকে নিয়ে যায়। সেখানে গের্ট একটা চওড়া চামড়া দিয়ে মোড়া আরামকেদারাতে বসে টেলিফোনে ডায়াল করছে। গের্ট বের্শেনকে নিজের হাঁটুর উপরে বসিয়ে হাতে টেলিফোনের রিসিভার ধরিয়ে দেয়।

‘হ্যালো’… বের্শেন কণ্ঠ থেকে বিরক্তির ছাপ এখনও মুছে ফেলতে পারেনি… ‘আমি কি ফ্রয়লাইন ইনেসের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’

কেউ একজন ওপাশ থেকে পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কে কথা বলছেন ফোনে?’

‘বের্নহার্ড’ বলে কয়েকমুহূর্ত পরে বের্নহার্ডের খেয়াল হয় যে তার একটা ডাকনাম আছে এবং ইনেস তাকে সেই নামেই ডাকে। ইনেস তাকে জিজ্ঞেস করে যে সে ঠিকঠাক আছে কি না।

-‘না’ বলে বের্শেন, ‘কিন্তু তোমার আজ আসা উচিত ছিল একবার। সবাই ভেবেছিল তুমি আসবে। গের্ট, ফার্দিনান্দ… ‘

-‘কিন্তু তাতে তোমার কী, বের্শেন?’ ইনেসের কণ্ঠস্বরে শীতলতা, বন্ধুত্বের উষ্ণতা একটু কম মনে হয়।

-‘আ… আমি জানি না, জানি না’ বের্শেন তুতলে যায়… ‘আমি… আমরা ফেয়ারওয়েল পার্টি করছি।’

-‘আচ্ছা, বুঝলাম। সেইজন্য সবাই মাতাল হয়ে গেছে! কিন্তু বের্শেন, তুমিও?’

বের্শেন থমকে যায়….

-‘আরে… কথা তো বলো। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ বাকিরা সমস্বরে চেঁচিয়ে বের্শেনের হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিয়ে কথা বলবার চেষ্টা করে। কিন্তু ইনেস লাইন কেটে দিয়েছে ততক্ষণে। সমস্বরে চিৎকার এবং এরকম অদ্ভুত অভিযোগ সে একেবারে পছন্দ করে না।

কিন্তু ফার্দিনান্দকে থামানো যাচ্ছে না। সে বসবার ঘরের সিঁড়ি দিয়ে সমানে ওঠানামা করছে। তার মুখটা সাঙ্ঘাতিক ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বড় বড় চোখদুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে।

‘একবার, অন্তত একবার কি সে আসতে পারত না আমায় বিদায় জানাবার জন্য?’ বন্ধুদের সামনে দাঁড়িয়ে ফার্দিনান্দ বলে যায়… ‘তোমাদের কি মনে হয় না যে তার আসা উচিত ছিল?’ ঘরের সিলিঙের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে অভিযোগ জানাবার ভঙ্গিতে সে বলে আর পায়চারি করে।

ছেলেরা প্রায় কেউই খেয়াল করেনি কখন দরজার বেল বেজেছে। হঠাৎ লুডভিগ তাড়াতাড়ি নিচে দৌড়ে গেল আর সবাই ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝে উঠবার আগেই দেখল যে ইনেস এসে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছে। ফার্দিনান্দের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সে। ফার্দিনান্দের দৃষ্টি একদম শূন্য।

‘শুভ সন্ধ্যা, ভদ্রমহোদয়গণ!’ ইনেস বলে… ‘শুভ সন্ধ্যা ফার্দিনান্দ! কিন্তু আপনার কী হয়েছে? আপনাকে অপ্রকৃতিস্থ দেখাচ্ছে।’

ফার্দিনান্দ হঠাৎ হেসে উঠল। তার কাঠখোট্টা মুখটা একেবারে বদলে গেল এই হাসিতে। দেখে মনে হল বেদনাদায়ক অন্ধকার রাত অতিক্রম করে হঠাৎ এক আলোকোজ্জ্বল ভোরের সময়ে কেউ তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে। সে অনেকক্ষণ ধরে ইনেসের দিকে তাকিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। এক অসুস্থ মানুষের দিকে লক্ষ্য রাখার মত করে বাকিরা দূর থেকে একদৃষ্টে তার দিকে নজর রাখে…

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ফার্দিনান্দের ফেয়ারওয়েল পার্টির সন্ধ্যাতেই বের্নহার্ডের বাবা হঠাৎ করেই আগেভাগে কিছু না জানিয়ে শহরে এসে উপস্থিত হন এবং ছেলেকে বাড়িতে না পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যান। যদিও বের্নহার্ডের বিষয়ে ঠাকুমা সবসময় ভাল ভাল কথাই বলে থাকেন, তবুও ক’দিন ধরেই তার বাবার মনে বেশ কিছু সন্দেহ দানা বেঁধেছিল। তাঁর মনে এই ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে বের্নহার্ড যথেষ্ট পরিশ্রমী ছাত্র। কারণ স্কুল এবং সঙ্গীতশিক্ষালয়, এই দুই জায়গা থেকেই ভাল ফল করছে সে বরাবর। কিন্তু অল্পসংখ্যক যে পরিবারগুলির সঙ্গে বের্নহার্ডকে মেলামেশা করতে বলা হয়েছিল, সে তাদের কারো সঙ্গেই যোগাযোগ রাখে না। শুধু স্কুলের বন্ধু কার্লের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে তার। সাধারণভাবে সবাই তার সম্বন্ধে বলছে যে ‘আকর্ষণীয় এবং আদবকায়দাদুরস্ত ছেলে’; কিন্তু কেউই তাকে বেশি দেখতে পায় না। এলাকার সম্মানীয় মানুষজন, সরকারি অফিসার, যাদের বেশ ভাল পরিবার আছে, বের্নহার্ডের বয়সী বাচ্চাকাচ্চা আছে, তাদের কারো সঙ্গে বের্শেন মেশে না। তাছাড়াও সন্ধেবেলায় তাকে বলা হয়েছিল নাচের স্কুলে ভর্তি হবার জন্য। সে বলেছিল যে তার নাকি সময় নেই। সে কথা যে ডাহা মিথ্যে, সেটাও পরিষ্কার।

বের্নহার্ডের ঠাকুমা অবশ্য তার পক্ষেই দাঁড়ালেন এবং বললেন যে বের্নহার্ড মিথ্যে কথা বলেনি। সাধারণত প্রতিদিন সে রাত এগারটা অবধি খাটে। সন্ধ্যায় মাঝেমধ্যে বেরয়, যদি কোথাও বাজনার অনুষ্ঠান থাকে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে বের্শেন লক্ষ্য করল যে এর বেশি আর ঠাকুমা কিছুই বললেন না। উল্টে তার বন্ধুদের সম্বন্ধে বেশ আপত্তিজনক কথা বলতে লাগলেন, বিশেষত গের্ট আর ইনেস সম্বন্ধে। কারণ, বের্নহার্ডের বাবা তাদের সম্বন্ধেই জানতে চাইছিলেন। পরিষ্কার বললেন ঠাকুমা যে আজকালকার ছেলেমেয়েদের ব্যাপারস্যাপার তার মাথায় ঢোকে না বিশেষ। বের্শেন এই বন্ধুদের পছন্দ করে, করতেই পারে; এদের সঙ্গে লং ড্রাইভে যায়, সেটাও আলাদা ব্যাপার। কিন্তু এদের তিনি ঠিকঠাক বোঝেন না। ঠাকুমা নিজেও অল্পবয়সে খুব ভাল পিয়ানো বাজাতেন। তার প্রতিভাও ছিল। বের্শেন যখন বাজায়, তার ভারি ভাল লাগে। বের্শেনকে তিনি ভালবাসেন, এটাও ঠিক। বের্শেন যথেষ্ট প্রতিভাশালী। কিন্তু বের্শেনকে নিয়ে তিনি চিন্তিত। তাঁর অন্যান্য নাতিনাতনিদের থেকে বের্শেন অনেকখানি আলাদা স্বভাবের। তাঁর নাতিনাতনিদের মধ্যে অনেকেই বের্শেনের থেকে বয়সে বড়; অনেকেরই বেশ ভাল শিক্ষাদীক্ষা, অনেকেই যথেষ্ট প্রতিভার অধিকারী ( এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বের্শেনের দিকে তাকিয়ে তাঁর একথা আরও বেশি করে মনে হচ্ছে)। কিন্তু কেউই বের্শেনের মত স্বাধীনচেতা নয়। জীবনে কী করতে চায়, সেসব ভাবনার বিষয়ে তারা অনেক সহজ। যেমন, রল্‌ফ… সে তো কখনই ভাবেনি যে সঙ্গীতজ্ঞ হবে; স্কুলের পড়াশুনা শেষ করে সোজা বাবার আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায় যোগ দিয়েছে।

কিন্তু বের্নহার্ড? সে স্কুলের পাশাপাশি সঙ্গীতের পাঠ নিচ্ছে এবং সেটা নিয়েই সে ভবিষ্যতে এগোতে চায়। বাইরে খুব নরমশরম চেহারার হলেও এই ছেলে ভিতরে ভিতরে যা ভাবে, সেটাই করে। নিজের ভাবনাচিন্তার বিষয়ে অত্যন্ত একগুঁয়ে এবং উদ্ধত। সব থেকে ভয়ের ব্যাপার হল যে সে সবসময় নিজে বন্ধু নির্বাচন করে থাকে এবং এক্ষেত্রে কারো উপদেশ মানে না। বের্শেনের এইধরণের আচরণে ঠাকুমাও বাবার মতই চিন্তিত। মাত্র সতের বছর বয়সের এক কিশোরের পক্ষে এই আচরণ অত্যন্ত বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছে অভিভাবকদের। তাছাড়াও, চেনাজানা যে বিশিষ্ট পরিবারগুলির সঙ্গে তাকে যোগাযোগ রাখতে বলা হয়েছিল, সে তাদের ধারকাছ দিয়ে যায় না। বের্শেনদের মত সম্মানিত পরিবারে এহেন অদ্ভুত আচরণ একেবারেই প্রত্যাশিত নয়। এটাই ঠাকুমার আসল চিন্তা, যেটা একটা চাপা তিক্ততার জন্ম দিচ্ছে। আসলে এমন একজনকেও পাওয়া যাচ্ছে না যে বলবে যে বের্শেন ভাল ছেলে নয়। বের্শেনের সুন্দর মুখ, খোলামেলা বন্ধুত্বপূর্ণ এবং আদবকায়দাদুরস্ত ব্যবহার সবার মন টানে। তবুও যখনই বের্শেনের প্রসঙ্গ উঠছে, কোথায় গিয়ে যেন তাল কাটছে। সবাই বলে যে সে খুবই ভাল ছেলে… তবে…; এই তবে অব্যয়টাই অভিভাবকদের ভাবিয়ে তুলেছে। কোথাও কি অবিশ্বাসের একটা বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে? প্রত্যেকে বলছেন যে বের্শেনের প্রতিভা এবং অন্যান্য ক্ষমতা নিঃসন্দেহে তুলনাহীন, কিন্তু কোনো একটা জায়গায় সম্ভবত তাকে কেউ বুঝতে পারছে না। সে যেন এই জগতসংসারে এক অচেনা আগন্তুকের মত অদৃশ্য সুতোর বাঁধনে বাঁধা আছে। বাঁধনটা অদৃশ্য, তাই তাকে কেউ বুঝতে পারছে না ঠিকঠাক এবং পুরোপুরি বিশ্বাসও করতে পারছে না। এই অবিশ্বাসের জায়গা থেকেই অনেকের কাছে বের্শেনকে বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছে।

(চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in








কুড়ি

রিমির পাশের বাড়িতে রাজু আর রাজুর বউ প্রজ্ঞা থাকে।রিমি না থাকলেই বিপিন প্রজ্ঞার কাছে যায়,কথা বলে।বিপিন গান করে,"গোলেমালে, গোলেমালে পিরীত কোরো না"। প্রজ্ঞা বলে,খুব তো সাহস দেখাও।বিয়ের আগে তো কিছু বলতে পারো নি। এখন তো আমি পরের বউ গো।বিপিন বলে,অপরজনা এখন আমার আপনজন হয়ে বসে আছে।বিপিন অতীতের কথা বলে প্রজ্ঞাকে,যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। ১৯৮০ সালের কথা এগুলি।এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।

বিপিন বলে,এবার আসি কবিতার কথায়। নব্বই দশকের বাংলা কবিতার যে প্রধান বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ছান্দিক কাঠামোর মধ্যে থেকে বিষয় ভিত্তিক কবিতা লেখা, বা বলা যায় ভাবপ্রধান বাংলা কবিতার এক প্রবর্ধন, তা শূন্য দশকে এসে বেশ খানিকটা বদলে যায়। আমরা লক্ষ্য করি লিরিক প্রধান বাংলা কবিতার শরীরে কোথাও একটা অস্বস্তি সূচিত হয়েছে। হয়ত নব্বই দশকের লেখা থেকে নিজেদের আলাদা করার তাগিদ থেকেই এই উত্তর। হয়ত সত্তর দশকের ছায়ায় লালিত বাংলা কবিতার পাঠাভ্যাস থেকে নিজেদের আলাদা করার এক সচেতন প্রচেষ্টা। যেখানে নব্বই দশকের সংকলন করতে গিয়ে সম্পাদক সে দশকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখেন প্রেম এর সঙ্গে এটিএম এর অন্ত্যমিল, সেখানে শূন্য দশকের সম্পাদককে ঘাঁটতে হবে নির্মাণের ইতিহাস। যেখানে নব্বই দশকের কবি খুঁজে বেড়িয়েছেন গল্প বলার ছান্দিক দক্ষতা, সেখানে শূন্য দশকের কবি খুঁজেছেন ভাষা প্রকরণ। হয়ত এর পিছনে কাজ করেছে এক গভীর সত্য যে কবিতা আর জনপ্রিয় হয় না। কবি আর চটুল মনোরঞ্জন করবেন না। আর এই কাজে শূন্য দশক অনেকাংশই তাদের শিকড় পেয়েছে আশির দশকের নতুন কবিতা আন্দোলনে।

এছাড়া বাঙালীর দুর্গাপুজে এক ভালোলাগার দলিল।ঘুরে ঘুরে সারারাত কলকাতার ঠাকুর দেখা আর খাওয়াদাওয়া, ধুনুচি নাচের স্মৃতি জড়িয়ে বেঁচে থাকুক অমলিন স্মৃতি।কুমোরপাড়ার খ্যাতি ছিল হাঁড়ি কলসি ও অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য বাসনপত্র তৈরির জন্যই। এখানকার পুরনো অধিবাসীদের কথায় জানা যায়, বিশ শতকের গোড়ার দিকেও নাকি এখানে কিছু মাটির হাঁড়ি-কলসি নির্মাতার দেখা পাওয়া যেত। প্রথমে হাঁড়ি-কলসি, তার পরে ঘর সাজাবার পুতুল এবং একটা সময়ের পরে, যখন দুর্গাপুজো ক্রমে আমজনতার উৎসবে পরিণত হল, তখন থেকে ছোট্ট সেই কুমোর পাড়া রূপান্তরিত হয়ে উঠতে লাগল প্রতিমা নির্মাণের প্রধানতম কেন্দ্র,কুমোরটুলিতে।

বাসস্টপেজেই অতনুর বাড়ি।সে বলে, রাত বাড়লে বাসস্ট্যান্ড একটা আমোদের জায়গা হয়ে যায়। অন্ধকারে শুয়ে থাকা কিশোরী থেকে বুড়ি ভিখারির পাশে শুয়ে পড়ে মাতালের দল। তারা তো জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি খায় না। শুধু একগ্রাস ভাত জোগাড় করতেই তাদের দিন কেটে যায়। তারপর রাতচড়াদের বাজার। কেউ ওদের মালিক নয়। বাজারি মাল দরিয়া মে ঢাল। ঠিক এই পদ্ধতিতে পৃথিবীর আলো দেখেছিল অতনু। কে তার বাপ সে জানে না। আর জন্মদাত্রী ফেলে দিয়েছিল বাসের ছাদে। সেখানে শকুনের মত ওৎ পেতে থাকে হায়েনার মত ভয়ংকর অমানুষের দল। তারা অনাথ ছেলেমেয়েদের নিয়ে বড় করে। বড় হলে চুরি বা ভিক্ষা করে তারা যে টাকা আয় করে তার বৃহৎ অংশ নিয়ে নেয় হায়েনার দল। না খেতে পাওয়ার প্রবাহ চলতেই থাকে। এর থেকে মুক্তি পায় না অনাথ শিশুরা।

অতনু এখন বেশ স্মার্ট, বুদ্ধিমান। সে নিজের চেষ্টায় মেকানিকের কাজ শিখে নিয়েছে। মাথা উঁচু করে চলা ছেলেদের সকলেই সমীহ করে।

অতনু চুরি করে না, ভিক্ষাও করে না। সে বলে, হাত পা আছে। খেটে খাব। আর তোদের যা পাওনা মিটিয়ে দেব। সে বলে হায়েনার দলকে, বেশি ঘাঁটালে আমাকে, দেব শালা খালাস করে। আমার বাঁধন শক্ত বে। ওসব মাস্তানী তোর পকেটে রেখে দে।

যতই হোক শয়তানদের সাহস কিন্তু বেশি হয় না। অতনু একটা দল করেছে ছেলে মেয়েদের। সে বলে, শালা, কোন শালা রাতে খারাপ কাজ করতে এলে একসঙ্গে আ্যটাক করব। ওদের দৌড় বেশিদূর নয়। অতনু থাকতে আর অনাথের দল বাড়াতে দেব না বাসস্টপে। এই এলাকা এখন নতুন প্রজন্মের। ওরা আমাদের বড় করেছে তাই ওদের পাওনাটুকু দেব।

হায়েনার দল সাবধান হয়ে গেছে। এখন আর অনাথ বাচ্চা কম পায় এইস্থানে। অতনুর বিরুদ্ধে কাজ করে ওরা অনেকবার ঠকেছে।অতনুর দলবল দেখে ওরা অন্য জায়গায় ডেরা বাঁধে।

অতনু সকলকে নিজের পরিবারের সদস্যের মত দেখে।

এই পরিবারের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সুনীতা। সে পাশের পাড়ায় থাকে। অতনু তার আদর্শ। কিন্তু অতনুর বংশ পরিচয় নেই। তা না থাক তবু সে সমাজসেবী।

অতনু দেখেছে মারামারি বা লড়াই করে জেতার থেকে ভালবাসার জোর বেশি। ভালোবেসে কথা বললে শয়তানও বশ হয়ে যায়। এখন সে একদম আনন্দে থাকে। এলাকার লোকজন তাকে ভালবাসে।

সুনীতা ভাবে, অতনুদা এত বড় মন পেল কোথা থেকে।

সকলের উপকারে ছুটে যায় অতনু। হাসপাতাল,শ্মশান যেখানে যার প্রয়োজন প্রথমেই ডাকে তাকে। সুনীতা ভাবে, সে কি অতনুর প্রেমে পড়েছে। সবসময় অতনুকে দেখতে পায় খাতায়, জলে, দেওয়ালে, আয়নায়। তবু অতনুকে বলতে সাহস হয় না। যদি রেগে যায়। যা ব্যক্তিত্ব ছেলেটার, শ্রদ্ধা হয়। সুনীতা সবসময় এখন এইসব ভাবে।

অতনু বলে তার বন্ধুকে, আমি তো অনাথ, বেজন্মা। ভদ্র সমাজে আমার স্থান হবে না। আমি কি চিরদিন এই বাসস্টপেজেই থেকে যাব?

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in










১৮ (১) 

“ অনেকদিন আগের কথা। এক ছিলেন নবাব সাহেব, আর তাঁর ছিল এক শাহজাদা, বাপের সুপুত্তুর।

“ ভাল হল তোমরা পঞ্চায়েতের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছ। সেই প্রসঙ্গেই আমার এই কিসসা মনে পড়ল। ছোটে পালোয়ান সরপঞ্চকে মুখের উপর চ্যালেঞ্জ করেছে—বেশ করেছে। পঞ্চায়েত আদালতের বিচার ছোটেলালের মত লোকের জন্যে নয়। ও হল বড়মাপের মানুষ। এত বড় পালোয়ান! তায় আমাদের কলেজ কমিটির মেম্বার। ওখানকার বিচার তো গেঁয়ো লোকদের জন্য। কানাকড়ি দাম নেই এসব বিচারের। কোড়িল্যা মার্কা বিচার। হেঁ—হেঁ –হেঁ, কোড়িল্যা কাকে বলে জানো? রুক্ষ উষর জমিতে আপনা থেকেই জন্মায়। গ্রীষ্মকালে দেখে থাকবে—সাদা সাদা ফুল।

“আরে তুমি হলে শহুরে বাবু, এসব কী করে দেখবে? এই পঞ্চায়েতী আদালত? ওরা ওই কোড়িল্যা-ছাপ রায় দেয়। আর ওই সরপঞ্চ? সবাইকে কিছু একটা ফালতু গুরুগম্ভীর লেকচার দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। কিন্তু এবার পালা পড়েছিল ছোটে পালোয়ানের সাথে—একেবারে কুপোকাত! ও যেমন বুনো ওল, ছোটে তেমনি বাঘা তেঁতুল! ----

“কুসহরপ্রসাদকে আগেই বলেছিলাম-- পঞ্চায়েতী আদালতে যেওনা। শুনলে তো! এখন মাথায় ঢুকেছে। সরপঞ্চ চার-পাঁচটা কাঁচাপাকা শুনিয়ে দিতেই সব শুধরে গেল। ওখানেই ছোটেলালজীর সঙ্গে মিটমাট করে নিল।

“ ঠিকই হল, বাপ-বেটার মধ্যে কীসের আকচা-আকচি?

যা বলছিলাম, ওঁর ছিল এক শাহজাদা। কার? নবাব সাহেবের। হ্যাঁ, হ্যা; ওই কিসসাটাই তো বলছি। একবার ওর হল খুব অসুখ। জ্বর কিছুতেই নামছে না। কয় মাস ধরে ভুগছে; অনেক দামি দামি ওষুধ, বড় বড় কবিরাজ, হাকিম, ডাক্তার। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। কোটি কোটি টাকা নর্দমার জলের মত খরচ হচ্ছে, কিন্তু শাহজাদার হাল যে কে সেই।

“নবাব সাহেব মাথা চাপড়াচ্ছেন। চারদিকে ডঙ্কা বাজানো হল—কেউ এসে আদ্দেক সম্পত্তি নিক, শাহজাদিকে বিয়ে করুক,--কিন্তু শাহজাদাকে সারিয়ে তুলুক! এবার দূর দূর থেকে হাকিমের দল এলেন। অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু শাহজাদা চোখ মেললেন না।

“শেষে এলেন এক বুড়ো হাকিম। শাহজাদাকে দেখে বললেন, ‘আদ্দেক সম্পত্তি ও শাহজাদীতে আমার লোভ নেই, ভোগ-বিলাসে রুচি নেই। যদি আমার একটা দরখাস্ত মঞ্জুর করেন তো শাহজাদাকে সারিয়ে তোলার দায়িত্ব আমার। কিন্তু দরখাস্ত গোপনে পেশ করব’।

“তো নবাবের হুকুমে দরবার খালি হয়ে গেল। হাকিম বললেন, ‘বন্দাপরবর! দাসের প্রতি আপনার অনেক কৃপা। এবার বেগমকে এখানে আসতে হবে। যা জিজ্ঞেস করব তার জবাবে সত্যি কথা বলতে হবে।‘

“নবাব সাহেবও সেখান থেকে চলে গেলেন। বেগম সাহেবার দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে হাকিম বললেন, ‘যদি শাহজাদার প্রাণ বাঁচাতে চান তো সত্যি কথা বলুন। শাহজাদা আসলে কার সন্তান? কার ঔরসে জন্ম’?

“বেগমা সাহিবা কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ‘কাউকে বলবেন না! একসময় মহলে কাজ করত এক ভিস্তি, শাহজাদা তার ছেলে। তরতাজা জোয়ান, গ্রাম থেকে নতুন নতুন এসেছিল, তারপর কী করে যে কী হয়ে গেল তা’ জানিনা’।

“এটা শোনামাত্র হাকিম বললেন, ‘শুক্রিয়া! আর কিছু বলতে হবে না’। চুটকি বাজিয়ে বললেন, ’কথায় কথায় বুঝে গেছি শাহজাদা কীভাবে সারবেন’।

“তারপর হাকিম সাহেব আগের সব ওষুধ ফেলে দিলেন। কত দামি দামি দ্রব্যের অনুপান! হীরেমোতি, সোনাচাঁদি! কত রকমের অদ্ভুত সব আরক! সব নর্দমায় বয়ে গেল। তারপর উনি শাহজাদার চোখে জলের ছিঁটে দিয়ে বললেন, ‘আবে উঠ! ভিস্তির ব্যাটা! উঠে পড়’।

“ব্যস্‌, শাহজাদা চমকে উঠে চোখ খুললেন। তারপর হাকিম গেলেন মাঠে। সেখান থেকে কয়েকটা কৌড়িল্যার চারা উপড়ে এনে জলের ছিটিয়ে পিষে শাহজাদাকে গিলিয়ে দিলেন। তিনদিন নিয়মিত কৌড়িল্যার রস খেয়ে শাহজাদা চাঙ্গা!”

এই কিসস্যাটি বৈদ্যজীর দরবারে বসে শোনাচ্ছিলেন -প্রিন্সিপাল। মুখ্য শ্রোতা -রঙ্গনাথ। মুখ্য বিষয়—পঞ্চায়তী আদালত। গল্পের প্রেরণাশক্তি—ভাঙের শরবত।

উনি বলছিলেন, ‘তো রঙ্গনাথ বাবু, এই হল কৌড়িল্যামার্কা ন্যায়বিচার। দেহাতিদের এরকমই ধরে নেওয়া হয়—যত্ত নীচু জাতের লোকজন! ওদের আর কী চাই? চলে এসো পঞ্চায়তী আদালতে আর কৌড়িল্যামার্কা ন্যায়বিচার পেয়ে বাড়ি যাও!

“আর যারা বড় মানুষ, রঈস-টইস, হাকিম-হুকাম, উঁচু জাতের লোকজন। ওদের চাই দামি বিচার। ঘাস কাটার সরপঞ্চ নয়, মোটা চশমা পরা ইংরেজের মতন ইংরেজিবলা জজসাহেব। বড় মানুষদের জন্য রয়েছে জেলার বড় বড় আদালত, যেমনটি চাই তেমন।

“ওদের চেয়েও বড়দের জন্য রয়েছে অনেকগুলো হাইকোর্ট। সবচেয়ে উঁচু জাতের জন্য সুপ্রীম কোর্ট। কেউ একবার বাঁকাচোখে তাকিয়ে দেখুক তো! তাতেই সোজা দিল্লি গিয়ে রিট পিটিশন লাগিয়ে দেয়া হয়।

“কৌড়িল্যামার্কা আদালত আর যত নীচু জাতের লোক! ওখানে যদি একবার ফেঁসে যায় তো ধরে নাও বসা অবস্থা থেকে উঠে সোজা দাঁড়াতে পারবে না। এক দানা খাবারের জন্য ভিক্ষে করে বেড়াবে।

“হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট—এসবের শখ কী সবাইকে পোষায়? এক-একজন উকিলের পেছনে একশটা বেশ্যা পোষার খরচ!

“তাই গেঁয়ো লোকজনের জন্যে কৌড়িল্যা-মার্কা ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা। না হিং-লবঙ্গ, না ফিটকরি! তাতেও রঙ চোখা! এক দাগ খেয়ে দেখ, জ্বর নেমে যাবে। আমাদের দেশের কানুন একদম পাকা, --যেমন লোক, তার তেমনই আদালত”।

হঠাৎ উনি হিন্দি ছেড়ে অবধী বোলিতে চলে গেলেন। ‘যেমন পশু, তেমনি করে বাঁধা’।


গাঁয়ের বাইরে এক লম্বা চওড়া ময়দান যা ধীরে ধীরে ঊষরভূমি হয়ে গেছে। আজ একগাছি ঘাসও গজায় না। দেখলেই মনে হবে -আচার্য বিনোবা ভাবেকে ভূদান দেবার জন্য একেবারে আদর্শ জমি। আসলে তাই হয়েছিল। বছর দুই আগে এটাকে ভূদান-আন্দোলনে দিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে ওটা ফিরতি দান হয়ে গ্রামসভার অধিকারে এল। গ্রামসভা আবার ওটা প্রধানকে দান করে দিল।

প্রধান এটাকে কয়েক ভাগ করে নিজের আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবকে দিল। তারপর একটু আধটু টুকরো যা বেঁচে ছিল সেগুলো বাজারের কেনাবেচার নিয়ম মেনে কিছু গরীব ও ভূমিহীনকে “দান” করে দিল। পরে জানা গেল যে গরীব এবং ভূমিহীনকে দেয়া জমির টুকরোগুলো আসলে ওই ময়দানের অংশ নয়, বরং অন্য কোন কৃষকের জমির অংশ। সুতরাং এটা নিয়ে মোকদ্দমা শুরু হল, এখনও চলছে, ভরসা আছে—পরেও চলতেই থাকবে।

যাই হোক, ভূদান-যজ্ঞের ধোঁয়া এখনও ময়দানের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে। ওখানে খেত তৈরি হয়ে গেছে। তার প্রমাণ বলতে প্রতি পদে একএকটা আল বাঁধা হয়েছে, তার উপর বিছিয়ে দেয়া বাবলা গাছের কাঁটাওলা ডাল। সার-জল-বীজ বিনা স্রেফ ইচ্ছাশক্তির জোরে, গত বছর থেকে নাকি ভাল করে চাষ শুরু হয়েছে। আর স্রেফ পাটিগণিতের জোরে এটা প্রমাণ করা গেছে যে গ্রামসভায় গত বছর-- আগের সব বছরের থেকে – অনেক বেশি অন্ন উৎপাদন হয়েছে।

গাঁয়ের পশুর পাল কখনও কখনও ওই ময়দানকে নিজেদের চরে খাবার স্থান ভেবে পুরনো অভ্যাসে এদিকে চলে আসে। কিন্তু তারপরেই চাষিদের মধ্যে গালাগালি, মারপিট, পঞ্চায়েতের খোঁয়াড়, থানাপুলিশ, কোর্ট-কাচারি সব শুরু হত। তাই ধীরে ধীরে ওদিকে পশুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেল।

ময়দান আজকাল নিঃশব্দ নীরব। আশাবাদী কেউ যদি ওদিকে পা ফেলে তবে তার মনে হবে যে এই নীরবতার মধ্যেই প্রগতির শঙ্খ বেজে উঠল বলে!

ময়দানের এক কোণে বন-সংরক্ষণ, বৃক্ষারোপণ এসব শুরু হয়েছিল। যোজনা সফল হল কি বিফল—সেটা বিতর্কের বিষয়। চোখে পড়ে যে নালা কাটা হয়েছে আর শোনা যায় যে ওখানে বাবলা গাছের বীজ বোনা হয়েছে। এটাও শোনা যায় যে এই ‘গঁজহা’ লোকগুলো যদি অমন ‘গঁজহা’ নাহয়ে আশপাশের গাঁয়ের মত উদ্যোগী পুরুষসিংহ হত তাহলে এই উষর মরুতেও এতদিনে বাবলা গাছের বন গজিয়ে উঠত।

কিন্তু মাটি ভালো নয়, তাই নালার পাশে বাবলা গাছ গজালো না, কিন্তু পুরো যোজনা থেকে শিবপালগঞ্জের লোকেদের একটা লাভ হল। নালাগুলো ওদের সার্বজনিক শৌচালয় হয়ে গেল। এই ধরণের সরকারী স্কীম বানানো হয়েছিল বন নির্মাণের জন্য, এখন হয়ে গেল ঘরোয়া কাজের।

ময়দানের অন্য কোণে শূন্যতাকে ধর্ষণ করার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল বটগাছ। তারপাশে একটি কুয়ো। ওই কুয়োর বাঁধানো পাড়ে রঙ্গনাথ বসে আছে। হিন্দুস্তানের লেখাপড়া জানা লোকেদের মাঝে মাঝে একটা অসুখ হয়, তার নাম ‘ক্রাইসিস অফ কনশান্স’—বিবেকের দংশন! কোন কোন ডাক্তার এর মধ্যে ‘ক্রাইসিস অফ ফেথ’ বা বিশ্বাসের সংকট নামক অন্য একটা অসুখের লক্ষণও কষ্ট করে খুঁজে পান।

এইসব অসুখ সাধারণতঃ শিক্ষিত লোকের মধ্যেও তাদেরই হয় যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী মনে করে। মজার ব্যাপার হল এরা কেউ বুদ্ধির ভরসায় বাঁচে না, বরং আহার-নিদ্রা-ভয়-মৈথুনের মাধ্যমেই বাঁচে। (কারণ, শুধু বুদ্ধির ভরসায় বাঁচা অসম্ভব)।

এই অসুখের রোগী মানসিক চিন্তা এবং অবসাদে ভোগে, লম্বা লম্বা লেকচার ঝাড়ে এবং চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তর্ক করে। নিজেকে --বুদ্ধিজীবী হয়েছে তাই অসুস্থ, এবং অসুস্থ হয়েছে সুতরাং বুদ্ধিজীবী-- বলে প্রমাণ করত চায়। শেষে এই অসুখ নিরাময় হয় কফি হাউসের বিতর্কে, চঞ্চল মেয়েদের বাহুবন্ধনে, সরকারি চাকরি পেয়ে, কখনও কখনও আত্মহত্যায়।

কলেজে ম্যানেজারের নির্বাচন দেখার দিন থেকে রঙ্গনাথের মনে ওই অসুখের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিল। ওর মামা বৈদ্যজীকে দেখামাত্র ওর মনে সেদিনের এক দৃশ্য ভেসে ওঠে—প্রিন্সিপাল সাহেব শূলে বেঁধা শুয়োরের মতন চিঁচিঁ করতে করতে কলেজের গেট থেকে বেরোচ্ছেন আর জয়ধ্বনি করছেন। ওর মনে হল বৈদ্যজীর সঙ্গে থাকতে থাকতে ও যেন কোন ডাকাত দলের সদস্য হয়ে গেছে। যখন প্রিন্সিপাল সাহেব দাঁত বের করে ওকে কোন রগরগে কিসসা শোনাতে থাকেন---ওনার ভাণ্ডারে এমন কিসসা অগুনতি—তখন ওর মনে হয় এই লোকটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে কারও গলা টিপে দিতে পারে।

শহরে থাকলে এখন ও কফি হাউসে বন্ধুদের সামনে বসে এই নির্বাচন নিয়ে একটা লম্বাচওড়া লেকচার ঝাড়ত। বলত—কীভাবে দেশি পিস্তলের জোরে ছংগামল ইন্টার কলেজের ম্যানেজারি কব্জা করা হল। আর টেবিল চাপড়ে বলত যে মুলুকে ছোট ছোট জায়গায় ছোট ছোট ক্ষমতা হাতিয়ে নিতে এমন সব করা হয়, সেখানে বড় বড় ক্ষমতা লাভের জন্য কী না হতে পারে!

তারপর ঠিক বা ভুলে ভরা দু-চারটে ইংরেজি কোটেশন আউড়ে কফির কাপ খালি করার পর শান্তি পেত এই ভেবে যে ও একজন খাঁটি বুদ্ধিজীবী, এবং চারটে অকম্মার ঢেঁকির সামনে গণতন্ত্রের পক্ষে এক জ্বালাময়ী বক্তিমে ঝেড়ে ধরে নিত যে এবার ও ভেতরের জমে থাকা উষ্মা বের করে নিজের ‘ক্রাইসিস অফ ফেথ’কে ধামাচাপা দিতে পেরেছে।

কিন্তু এটা তো শহর নয়, নেহাত পাড়া -গাঁ, এখানে রূপ্পনবাবুর ভাষায়, নিজের বাপকেও বিশ্বাস নেই। এছাড়া , শনিচরের ভাষায়, এখানে কাটা আঙুলে পেচ্ছাপ করার মতও কেউ নেই। তাই রঙ্গনাথ এখানে নিজের মানসিক অসুখ থেকে রেহাই পেল না। ওর মাথায় দিনরাত একটা জিনিসই ঘুরছে----ও কোন ডাকাত দলে ফেঁসে গেছে। ডাকাতগুলো হামলা করে কলেজ লুট করেছে। এবার অন্য কোথাও আচমকা হামলা করার তালে আছে। ওর শরীরমন চাইছে বৈদ্যজীকে গালি দিতে আর তার চেয়েও বেশি উসখুস করছে কার সামনে বিশ্বাস করে গালি দেয়া যায়?

এমন বন্ধু আর কে আছে? খান্না মাস্টারের পেটে কথা থাকে না। ওর সামনে বললে পরের দিন গোটা গাঁও জেনে যাবে যে বৈদ্যজীর ভাগ্নে নিজের মামাকে গালি দেয়! দেখে নাও, আজকালকার লেখাপড়া জানা ছেলেগুলোক-- ভদ্রতা শেখেনি। হ্যাঁ, মালবীয় মাস্টারের কাছে বলা যেতে পারে। ও দলবাজিতে যুক্ত হলেও বড্ড সাদাসিধে। ওর সামনে গাল দিয়ে মজা নেই। বাকি রইল কে? রূপ্পনবাবু?

রঙ্গনাথের রূপ্পনবাবুর উপর খানিক ভরসা ছিল। কারণ, ওমাঝে মাঝে প্রিন্সিপালকে গাল দিয়ে বলত—কলেজের দুর্ভাগ্য! ওনার অভিযোগ—প্রিন্সিপাল লেখাপড়ায় গবেট, কিন্তু দুনিয়াদারিতে মহা ওস্তাদ! পাক্কা ছকবাজ! বাবাকে এমন ফাঁদে ফেলেছে যে সব কাজ ওই ব্যাটার ইচ্ছেতে হলেও বাবা ভাবে বাবার কথায় হচ্ছে। ব্যাটা খান্না মাস্টারের সঙ্গে খুব বাড়াবাড়ি করেছে। মানছি, খান্না মহাবেকুব। কিন্তু ওকে এত বেশি অপমান করা ঠিক নয়। আমার বাবার কাঁধে বন্দুক রেখে এক ব্যাটা বেকুব অন্য বেকুবকে মেরে দেয়া? এটা অনুচিত।

আজ ওই বটবৃক্ষের ছায়ায় কুয়োর পাড়ে বসে রঙ্গনাথ প্রশান্ত চিত্তে এক লম্বা শ্বাস টানল। অনেক দিন পরে আজ ওর সেই অসুখ ওকে বিচলিত করছে না। হল কি,আজ ও হিম্মত জুটিয়ে রূপ্পনবাবুর কাছে নিজের আত্মসংকট নিয়ে খোলাখুলি কথা বলল। স্পষ্ট করে বলল যে মামাজীর এমনটা করা ঠিক হয়নি। আগ্নেয়াস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ম্যানেজারি হাসিল করলেন বটে, কিন্তু চারদিকে অপযশ তো রটেছে!

রূপ্পনবাবু ওনার ‘ধর -তক্তা- মার- পেরেক’ ভঙ্গিতে বললেন—‘দেখ দাদা, এসব তো পলিটিক্স। এটা তো কিছুই নয়। এ’লাইনে অনেক বড় বড় বদমাইশি হয়। পিতাজি যে পথে এগিয়ে চলেছেন তাতে আরও কিছু করতে হতে পারে। দুশমনকে –সে যেই হোক—চিৎ করতে হয়। না পারলে উনি নিজেই চিৎ হবেন, তারপর বসে বসে কবরেজি পুরিয়া বানাতে থাকবেন। কেউ ফিরেও তাকাবে না।

‘তবে কলেজটাকে অনেক শোধরাতে হবে। প্রিন্সিপাল ব্যাটা মহা হারামী। সারাদিন দলবাজি, সারাদিন কিচকিচ। খান্না মাস্টারও একনম্বরের গর্দভ, কিন্তু হারামী নয়। শালার প্রিন্সিপাল ওকে অনেক অপমান করেছে, নীচে নামিয়েছে। এবার ওকে টেনে তুলতে হবে। আমি পিতাজীর সঙ্গেও কথা বলেছি। কিন্তু উনি প্রিন্সিপালকে খাটো করতে চান না।

‘ভেবেছি , কিছুদিন বাবাকে কিছু না বলে খান্না মাস্টারকে একটু হাওয়া দেব। তাতেই প্রিন্সিপাল চিতপটাং হবে। ও শ্যালক ফুলে ঢোল হয়েছে। এখন ওর ফাটার সময়। একবার ব্যাটা চিৎ হলে বাবাও টের পাবেন ব্যাটা কত তালেবর---‘!

এইসব শুনে রঙ্গনাথ বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে নিঃশ্বাস টানল। এটা তো বোঝা গেছে যে রঙ্গনাথ এই বিষয়ে রূপ্পনবাবুর সঙ্গে কথা বলতে পারে। এটাও স্পষ্ট হল যে রূপ্পনবাবুর সামনে ও খান্না মাস্টারের জন্য সহানুভূতি দেখাতে পারে, যে পড়ে গেছে তাকে টেনে তুলতে পারে, যে ফুলে গেছে তাকে ফাটিয়ে দিতে পারে। সোজা কথায়, অন্যায়ের সামনে মুখোমুখি দাঁড়াতে না পারলেও চোরাগোপ্তা ভাবে লড়াই করে ফের সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ওর থেকে প্রায় এক ফার্লং দূরে রূপ্পনবাবু একটা গাছের পেছনে অনেকক্ষণ ধরে বসে থেকে পেটের ভেতরের গণ্ডগোল সাফ করছিলেন। এভাবে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার সার্বজনিক সমাধান করে যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন রঙ্গনাথও কুয়োর পাড়ে উঠে দাঁড়ালো। রূপ্পনবাবু ওর দিকে আসছিলেন না, তাই রঙ্গনাথই ওনার দিকে এগিয়ে গেল।

(চলবে)

0 comments:

0

গল্প - মনোজ কর

Posted in








পর্ব ২০

বণিকের মানদণ্ড দেখ দিল রাজদণ্ডরূপে

(সময়ানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত বিবরণী)-প্রথম অংশ

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন হয়েছিল বাঙলাতেই। এশিয়াতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার ষাট শতাংশ উপকরণই ছিল বাঙলার। ভারতবর্ষে কোম্পানির ব্যবসা ত্বরান্বিত হতে থাকল যখন আওরঙ্গজেব ১৬৯০ সালে বার্ষিক তিনহাজার টাকার বিনিময়ে কোম্পানিকে নিঃশুল্ক ব্যবসার অনুমতি দিল। ১৬৯৬ সালে কলকাতায় দূর্গ নির্মানের অনুমতি এবং তার দু’বছর পরে কলিকাতা, সূতানুটি এবং গোবিন্দপুর গ্রামের জমিদারি কোম্পানিকে লিখে দিল মোগলসম্রাট আওরঙ্গজেব। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সাময়িকভাবে কিছু সমস্যা দেখা দিলেও ১৭১৭ সালে সম্রাট ফাররুক্সিয়ার আবার নিঃশুল্ক ব্যবসার এবং কলকাতার নিকটবর্তী আটত্রিশটি গ্রামের জমিদারির অনুমতি দিল কোম্পানিকে।সেই সঙ্গে নবাবের ট্যাঁকশাল ব্যবহারের অনুমতি পেল কোম্পানি। কিন্তু অনতিবলম্বেই এই অনুমতি নিয়ে কোম্পানির বিবাদ শুরু হলো বাঙলার নবাব মুর্শিদকুলি খানের সঙ্গে। কোম্পানির আধিকারিকেরা কোম্পানির ব্যবসার বাইরে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসাও চালাত। এই ব্যক্তিগত ব্যবসাগুলিকে নিঃশুল্ক ব্যবসার বাইরে রাখার জন্য কড়া আইন প্রবর্তন করলো মুর্শিদকুলি। কোম্পানি আধিকারিকরা কিন্তু নানা ছলছুতোয় নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসাগুলির থেকে কর ফাঁকি দিতে থাকলো। ক্রুদ্ধ মুর্শিদকুলি আটত্রিশটি গ্রামের জমিদারি এবং ট্যাঁকশালের ব্যবহার সম্পর্কিত আদেশনামা প্রত্যাহার করে নিল। ১৭১৭ সাল থেকেই বাঙলার নবাব এবং কোম্পানির মধ্যে বৈরিতার সূত্রপাত।

১৭৪০ সালে অস্ট্রিয়া উত্তরাধিকার যুদ্ধের ফলস্বরূপ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। বাঙলার নতুন নবাব আলিবর্দি খান ব্রিটিশ এবং ফরাসি উভয়পক্ষকেই কড়া নিয়ন্ত্রনে রাখে এবং কোনওরকম যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু দাক্ষিনাত্যে ফরাসিদের বিজয়লাভ ব্রিটিশদের বাঙলার ফরাসিদের প্রতি সন্দিহান করে তোলে। যদি কোনওভাবে ফরাসিদের হাতে ব্রিটিশরা আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে আলিবর্দি কতটা তাদের সাহায্য করতে পারবে সে ব্যাপারেও অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকতে থাকে ব্রিটিশরা। এছাড়াও ব্যবসার ক্ষেত্রে এশিয়ার ব্যবসায়ীদের সাহচর্যে ফরাসিদের ব্যবসাও বৃদ্ধি পেতে থাকায় কোম্পানির ব্যবসাও বেশ বড়রকমের ধাক্কা খেয়েছে। সব মিলিয়ে ফরাসিদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উত্থানে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ১৭৫৫ সালে নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করে কলকাতা দূর্গকে আরও শক্তিশালী করার জন্য খনন এবং নির্মাণের কাজ শুরু করে ব্রিটিশরা। এমনকি নবাবের দরবার থেকে বহিষ্কৃত এবং পলাতক লোকেদেরও কলকাতায় নিরাপদ আশ্রয় দিতে থাকে ব্রিটিশরা। বাঙলার নবাবের সঙ্গে বিরোধ চরম আকার নেয় যখন ১৭৫৬ সালে সিরাজদ্দৌল্লা নবাবের আসনে বসে। সিরাজ কোম্পানি আধিকারিকদের ব্যক্তিগত ব্যবসাকে নিঃশুল্ক ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য নতুন করে আদেশ জারি করে। সিরাজের সঙ্গে বিরোধিতা চরম পর্যায়ে পৌঁছোয় মূলতঃ দু’টি কারণে প্রথমত রাজস্ব আত্মসাৎ করার দায়ে অভিযুক্ত কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয়দান এবং দ্বিতীয়ত নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করে দূর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করা। এই দু’টিকেই রাজদ্রোহিতার সামিল বলে ঘোষণা করে সিরাজ। সিরাজের সাবধাবাণীতে কর্ণপাত না করার শাস্তি হিসাবে সিরাজ কাশিমবাজারে কোম্পানির ফ্যাক্টরি দখল করে নেয়। সিরাজের ক্ষমতা সম্পর্কে গভর্নর ডেকের ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে ২০শে জুন সিরাজ কলকাতা দখল করে নেয়।

এই সঙ্কটের হাত থেকে ব্রিটিশদের রক্ষা করতে মাদ্রাজ থেকে বিশাল সৈন্যসমভিব্যাহারে কলকাতায় এসে পৌঁছোয় রবার্ট ক্লাইভ। ব্রিটিশদের ভয় ছিল যে সিরাজ ফরাসিদের সহায়তায় তাদের ব্যবসার ক্ষতি করতে পারে এবং ফরাসিদের সঙ্গে মিলে তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। তাই কোনওরকম ঝুঁকি না নিয়ে রবার্ট ক্লাইভ আক্রমণের রাস্তা বেছে নেয় এবং হুগলি ও চন্দননগর ফরাসিদের কাছ থেকে দখল করে নেয়। আবদালির নেতৃত্বে আফগান আক্রমণের আশঙ্কায় সিরাজ ব্রিটিশদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে মীমাংসা প্রক্রিয়া শুরু করতে চাইলে ক্লাইভ তা প্রত্যাখ্যান করে এবং যুদ্ধের পথেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কোম্পানির আধিকারিকেরা কোনওভাবেই কমবয়সী সিরাজের অত্যাচারের কাছে মাথা নত করে নিজেদের ব্যবসা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সঙ্গে আপস করতে রাজি হলোনা। এছাড়াও নবাবের দরবারে সিরাজের বিরুদ্ধে একটা শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। সিরাজের ঔদ্ধত্য এবং অপমানজনক ব্যবহারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে বেশ কিছু ব্যবসায়ী এবং জমিদার ক্লাইভের সঙ্গে হাত মেলালো। এদের মধ্যে প্রধান ছিল জগতশেঠ মোহতাব রাই, স্বরূপচাঁদ, রাজা জানকিরাম, রাইদুর্লভ, রাজা রামনারায়ণ, রাজা মাণিকচাঁদ প্রমুখ। তাছাড়া অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী ব্রিটিশদের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসায় নিযুক্ত ছিল এবং অনেকে ব্যবসার জন্য ব্রিটিশ জলযান ব্যবহার করতো। এরা সকলেও ব্রিটিশদের পক্ষে ছিল। জগতশঠের কথামতো সিরাজের জায়গায় তার অন্যতম সেনাধিপতি মিরজাফরকে নবাব করার পরিকল্পনা করে চক্রান্ত দানা বেঁধে উঠলো। নবাবের দরবারে চক্রান্ত আগে থেকেই চলছিল যার সদ্ব্যবহার করেছিল ব্রিটিশরা না ব্রিটিশরাই এই ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল সে প্রশ্ন অবান্তর। এই ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশির যুদ্ধে ক্লাইভের হাতে পরাজিত হলো সিরাজ। পলায়নরত সিরাজকে বন্দি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো এবং ব্রিটিশদের হাতের পুতুল মিরজাফরকে নবাবের আসনে বসালো ক্লাইভ। এখানেই শুরু হলো ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক উত্থানের ইতিহাস।

এরপরে শুরু হলো বহু আলোচিত ‘পলাশি পরবর্তী লুন্ঠন’ । যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই তখনকার হিসাবে ২,৭৫,০০০ পাউন্ড ভাগ করে দেওয়া হলো জল এবং স্থলবাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০সালের মধ্যে কোম্পানি মিরজাফরের কাছ থেকে আদায় করলো তখনকার হিসাবে আড়াই কোটি টাকা। ক্লাইভ ব্যক্তিগতভাবে মিরজাফরের কাছ থেকে যে ভূখন্ডের জায়গিরদারি পেয়েছিল তার মূল্য তখনকার হিসাবে প্রায় ৩৫০০০ পাউন্ড। কোম্পানি তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে বেশ বড় রদবদল নিয়ে এলো। ১৭৫৭ সালের আগে কোম্পানি বাঙলায় ব্যবসা করার জন্য দেশ থেকে বুলিয়ন আমদানি করতো। পলাশি যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শুধু বুলিয়ন আমদানি বন্ধ হলো না , তার পরিবর্তে বাঙলা থেকে চিনে এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে বুলিয়ন রপ্তানি শুরু হলো। ব্রিটিশরা এর ফলে অন্যান্য ইউরোপিয়নদের থেকে বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছে গেল। অন্যদিকে পলাশি যুদ্ধের পর কোম্পানি আধিকারিকদের সৌভাগ্যের দরজা খুলে গেল। প্রজাদের ওপর সরাসরি নিপীড়ন ছাড়াও নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় কোম্পানিকে প্রদত্ত কর সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধার অপব্যবহার করে টাকার পাহাড় গড়ে তুললো। কিছুদিনের মধ্যেই মিরজাফরের পক্ষে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়লো। ১৭৬০ সালের অক্টোবর মাসে মিরজাফরকে সরিয়ে মসনদে বসানো হলো তার জামাতা মিরকাসিমকে। অল্পদিনের মধ্যেই আবার দ্বন্দ্বের শুরু হলো কোম্পানিকে দেওয়া করছাড়ের সুযোগের ব্যক্তিগত ব্যবসায় যথেচ্ছ অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে। উপায় না দেখে মিরকাসিম করপ্রথা বিলোপ করে দিল যাতে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও সমান সুযোগ পায়। ব্রিটিশরা নবাবের এই স্বাধীন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলো না। ফলস্বরূপ মিরকাসিমকে সরিয়ে আবার মিরজাফরকে নবাবের আসনে বসানো হলো।

১৭৬৩ সালের ডিসেম্বরে মিরকাসিম বাঙলা থেকে পালিয়ে মোগলসম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এবং অবধের রাজা সুজাউদ্দৌল্লার সঙ্গে জোট বাঁধলো। যুবরাজ দ্বিতীয় শাহ আলম পূর্ব ভারতে স্বাধীন সাম্রাজ্য গড়ার লক্ষ্যে ১৭৫৮ সালে দিল্লী ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৭৫৯ সালের ডিসেম্বরে পিতার হত্যার সংবাদ পেয়ে সে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে এবং সুজাউদ্দৌল্লাকে নিজের উজির হিসাবে নিযুক্ত করে। মিরকাসিম যখন বাঙলা থেকে পালিয়ে তার কাছে আশ্রয় চায় তখন দীর্ঘ আলোচনার পর তারা যৌথভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহমত হয়। সুজাউদ্দৌল্লা বিহারের রাজত্ব, রাজকোষের পূর্ণ অধিকার এবং যুদ্ধজয়ের পর নগদ তিন কোটি টাকার শর্তে যুদ্ধে যোগদান করতে রাজি হয়। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে এই তিনজনের জোট ব্রিটিশদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ব্রিটিশরা পরাজিত সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের সঙ্গে কারারুদ্ধ করে। যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে মুক্তিলাভের পরিবর্তে ১৭৬৫ সালে এলাহাবাদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে সম্রাট বাঙলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দিওয়ানি ব্রিটিশদের লিখে দেয়। এই চুক্তির বলে ব্রিটিশরা বাঙলা, বিহার এবং উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করে। মুর্শিদাবাদের দরবারে ব্রিটিশরা এসে গেল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এবং ১৭৭২ সালে বাঙলায় পরোক্ষভাবে কোম্পানিরাজ চালু হয়ে গেল। এলাহাবাদ চুক্তির শর্তানুযায়ী সুজাউদ্দৌল্লা এবং ব্রিটিশরা নিজ নিজ সাম্রাজ্যরক্ষার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলো এবং সম্মানের সঙ্গে মুক্তিলাভের বিনিময়ে সুজাউদ্দৌল্লা ব্রিটিশদের ৫০ লক্ষ টাকা নজরানা দিল। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অবধের দরবারে একজন ব্রিটিশ প্রতিনিধি নিযুক্ত হলো এবং কোম্পানি অবধে নিঃশুল্ক ব্যবসার অধিকার লাভ করলো। চুক্তির এই বিশেষ শর্তের কারণেই পরবর্তীকালে অবধ সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে।

১৭৬৫ সালে পূর্ব ভারত কোম্পানির সম্পূর্ণ অধিকারে আসে এবং দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশ আগ্রাসনের প্রস্তুতি শুরু হয়। ব্রিটেন-ফ্রান্স বিরোধ এই আগ্রাসনে অণুঘটকের কাজ করে। ইউরোপিয়ানদের মধ্যে ফরাসিরা সবার শেষে ভারতে আসে এবং সর্বপ্রথম এই উপমহাদেশে নিজেদের শাসন কায়েম করার পরিকল্পনা শুরু করে। ফরাসিদের মূল কেন্দ্র পন্ডিচেরিতে স্থাপিত হয় ১৬৭৪ সালে। ডুপ্লেইক্সের গভর্নর জেনারেল থাকার সময় ফরাসিরা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৭৩১ সালে ডুপ্লেইক্স প্রথমে চন্দননগরের গভর্নর হয়। দশ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে ফরাসি ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। ডুপ্লেইক্স কাজপাগল লোক ছিল। যদিও ভারতবর্ষকে সে ঘৃণার চোখেই দেখতো তবুও এই সুযোগে নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসা থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ডুপ্লেইক্স। ১৭৪২ সালে পন্ডিচেরির দায়িত্ব পায় ডুপ্লেইক্স। কালবিলম্ব না করে ডুপ্লেইক্স নিজের ব্যবসা এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপকে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে চলে। ডুপ্লেইক্সই প্রথম ইউরোপিয়ন রাজনীতিক যে ভারতীয় শাসকদের অন্তর্কলহকে ব্যবহার করে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বিস্তার করে। পরবর্তীকালে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশরাও একই পথ অনুসরণ করে নিজেদের প্রতিপত্তি কায়েম করে।১৯৭০ সালে ইউরোপে অস্ট্রিয়ান উত্তরাধিকার যুদ্ধ ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। সেই বিভেদের প্রভাব ভারতবর্ষেও এসে পৌঁছোয়। বাঙলায় এই বিভেদকে কড়া হাতে দমন করে আলিবর্দি খান। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে মরিশাস থেকে আগত নৌসেনা ফরাসিদের হাত শক্ত করে এবং ফরাসিরা মাদ্রাজে ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ চালায়। ব্রিটিশরা ফরাসিদের হাতে মাদ্রাজ সমর্পণ করে এবং কর্ণাটকের নবাবের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করে। নবাব ফরাসিদের আক্রমণের জন্য সৈন্য পাঠায় কিন্তু সেই সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু এই সময়ে ডুপ্লেইক্স এবং মরিশাস থেকে আগত অ্যাডমিরাল লা বোরদোনেয়ার্সের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ হয় এবং বোরদোনেয়র্স ব্রিটিশদের হাতে মাদ্রাজ সমর্পণ করে মরিশাস ফিরে যায়। ১৭৪৬ সালে ডুপ্লেইক্স আবার মাদ্রাজ আক্রমণ করে এবং দক্ষিণ পন্ডিচেরিতে ব্রিটিশ অধিকৃত সেন্ট ডেভিড ফোর্ট দখল করে নেয়। ইতিমধ্যে আইক্স লা চ্যাপেল চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ এবং ফরাসি বৈরিতার সমাপ্তি ঘটে। চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা ভারতে তাদের ফরাসিদের হাতে হারানো অধিকার ফিরে পায় এবং উত্তর আমেরিকায় ফরাসিরা তাদের ব্রিটিশদের হাতে হারানো অধিকার ফিরে পায়। যুদ্ধ আর আগে এগোতে পারেনা।

ভারতবর্ষে সিংহাসন দখলের জন্য পারিবারিক বিবাদ সর্বজনবিদিত। সেই বিবাদের কারণেই ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে বিবাদ বাড়তে থাকে দক্ষিণ ভারতে। কর্ণাটক এবং হায়দ্রাবাদে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিবাদের সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে নেয় ফরাসি গভর্নর জেনারেল ডুপ্লেইক্স। কর্ণাটকে চন্দা সাহিব এবং হায়দ্রাবাদে মুজফফর জংকে রাজা হবার লড়াইতে সমর্থন করে ফরাসিরা। ব্রিটিশরা সমর্থন করে এদের বিরোধি নাসির জং এবং মহম্মদ আলিকে। ফরাসি সমর্থিত দু’জনেই বিজয়ী হয় এবং নাসির জং-এর মৃত্যু হওয়ায় হায়দ্রাবাদের নতুন নিজাম হয় মুজফফর জং। মুজফফর ফরাসিদের মাসুলিপটম এবং আরও বেশ কয়েকটি গ্রামের জায়গির দান করে। এমনকি নিজের দরবারেও ফরাসি প্রতিনিধির জন্য একটি আসন নির্দিষ্ট করে দেয়। অবশ্য মুজফফর জংও বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেনি। ১৭৫১ সালের ফেব্রয়ারিতে মুজফফর মারা যায় এবং সালাবত জং নতুন নিজাম হয়। আতঙ্কিত ব্রিটিশদের সহায়তার জন্য কলকাতা থেকে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী কর্ণাটক এসে পৌঁছোয় এবং ১৭৫২ সালের শুরু হয় দ্বিতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধ। ব্রিটিশরা জয়ী হয় এবং মহম্মদ আলি কর্ণাটকের সিংহাসনে বসে। ডুপ্লেইক্স দক্ষিণ ভারত পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাতে চায় কিন্তু প্রচুর অর্থনৈতিক লোকসানের কারণে ফরাসি সরকার ডুপ্লেইক্সকে যুদ্ধ বন্ধ করে দেশে ফিরে যেতে বলে । ১৭৫৪ সালে ডুপ্লেইক্স দেশে ফিরে যায়। নতুন গভর্নর জেনারেল হয় চার্লস গডেহিউ। গডেহিউ ১৭৫৪ সালেই ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং মুজফফর প্রদত্ত জায়গির এবং রাজদরবারের আসন নিজেদের জন্য সংরক্ষণ করে।

১৭৫৬ সালে ইউরোপে সপ্তবর্ষীয় যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষে আবার ব্রিটিশ ফরাসি বিরোধ শুরু হয় এবং তৃতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। ফরাসিদের আর্থিক দুর্বলতার কারণে সৈন্যদের বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ফরাসি সরকার উপায়ান্তর না দেখে কাউন্ট ডি লালির নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী পাঠায় ভারতবর্ষে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফরাসিরা একের পর এক জায়গা হারাতে থাকে ব্রিটিশদের হাতে। প্রথমে হাতছাড়া হয় চন্দননগর। বাসিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় লালিকে সাহায্যের জন্য কিন্তু নর্দান সরকারের অন্তর্গত বিস্তীর্ণ অঞ্চল, মাসুলিপটম, ইয়ানাম এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা ফরাসিদের হাত থেকে দখল করে নেয় ব্রিটিশরা।১৭৬০ সালের জানুয়ারিতে তৃতীয় কর্ণাটকি যুদ্ধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ওয়ান্ডুইশ যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজয়ের অব্যবহিত পরেই ব্রিটিশরা পন্ডিচেরি দখল করে। মালাবার উপত্যকার মাহে এবং কর্ণাটকের জিঞ্জি ও থিয়াগড়ের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই ফরাসিদের পায়ের তলার মাটি বরাবরের মত সরে যায়।

ফরাসিদের পরাজয়ের মূল কারণগুলি হল, প্রথমত কাউন্ট ডি লালির ঔদ্ধত্য এবং অসংযত আচরণ যে কারণে পন্ডিচেরির অন্যান্য ফরাসি আধিকারিকারেরা লালির থেকে দূরে সরে যায় এবং কার্যত নিষ্ক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। দ্বিতীয়ত প্রচন্ড অর্থাভাবের কারণে সামরিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত বিপর্যয়। তৃতীয়ত বাসিকে দক্ষিণ ভারত থেকে সরিয়ে নেওয়ার ভুল সিদ্ধান্ত এবং সর্বোপরি সদ্য যুদ্ধজয়ী ব্রিটিশ নৌবাহিনীর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। ১৭৬৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত হয় প্যারিস চুক্তি এবং সেই চুক্তি অনুসারে ফরাসিরা ১৭৪৯ সালের আগে নির্মিত সমস্ত কারখানা এবং অন্যান্য সম্পত্তি ফেরত পায়। শুধুমাত্র চন্দননগরের দূর্গনির্মাণ সংক্রান্ত কোনও রকম কাজের অধিকার ফরাসিদের দেওয়া হলোনা। ক্ষমতার এই নতুন বন্টনের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ ব্রিটিশ কোম্পানির অগ্রগতি ঘটতে থাকলো অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এবং ভারতবর্ষ থেকে ফরাসি কোম্পানি ১৭৬৯ সালে সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্ত হয়ে গেল। ব্রিটিশরাই কার্যত কর্ণাটকের আধিপত্য লাভ করলো যদিও প্যারিস চুক্তির শর্তানুযায়ী নবাবকেই তার সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হল। নবাবের জীবদ্দশায় ব্রিটিশরা তাকে নবাবের স্বীকৃতি ও প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত না করলেও ১৮০১ সালে তার মৃত্যুর পরে তার সাম্রাজ্য ব্রিটিশরা দখল করে নিল এবং নবাবের উত্তরাধিকারীদের জন্য ভাতা ব্যবস্থা চালু হল। হায়দ্রাবাদের নিজাম শক্তিশালী প্রতিবেশীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে বাধ্য হল এবং তার পরিবর্তে নর্দার্ন সরকারের অধিকার ব্রিটিশদের দান করে দিল। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর শক্তি যেহেতু ভারতবর্ষের অন্য সমস্ত প্রদেশের মিলিত শক্তির চেয়ে অনেক বেশি ছিল সেইজন্য ভারতবর্ষে ক্ষমতার ভারসাম্য ব্রিটিশদের দিকেই ঝুঁকে রইলো।

অষ্টাদশ শতকে ভারতবর্ষের প্রদেশগুলি ছিল পারষ্পরিক দন্দ্বে বিদীর্ণ। প্রদেশগুলি রাজস্ব বৃদ্ধি করার জন্য একে অপরের অঞ্চল অধিকার করার জন্য সবসময়ে যুদ্ধে মেতে থাকতো। সমস্ত প্রদেশ একত্রিত হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একেবারেই সম্ভব ছিল না। বরঞ্চ পার্শ্ববর্তী প্রদেশকে দখল করার জন্য অনেকেই কোম্পানির দ্বারস্থ হত। ব্যবসায়িক স্বার্থ ছাড়াও প্রদেশগুলির মধ্যেকার এই পারষ্পরিক বৈরিতা ব্রিটিশদের সুযোগ করে দিল ভারতবর্ষের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার।

0 comments:

0

গল্প - অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in






আজ পয়লা এপ্রিল। আজ থেকেই শুরু করব খেলাটা। আমার বেডসাইড টেবিলে একটা স্বচ্ছ কাঁচের শিশি। শিশির মধ্যে একই রকম দেখতে তিরিশটা ক্যাপসুল। রাত বারোটায় প্রতিদিন শুতে যাওয়ার আগে একটা করে ক্যাপসুল খাব। তারপর টেবিলেই রাখা ডেস্ক-ক্যালেন্ডারে সেই তারিখের পাশে একটা টিক দিয়ে শুয়ে পড়ব। খেলাটায় একটা সাসপেন্স আছে। কতগুলো তারিখে টিক পড়বে তা অনিশ্চিত। একটা মাত্র পড়তে পারে আবার তিরিশটাও পড়তে পারে। তবে ক্যালেন্ডারের এই পাতাটা ওলটাতে হবে না কোনোদিনই। পয়লা মে আমাকে দেখতে হবে না সেটা নিশ্চিত। এই তিরিশটার মধ্যে ঊনত্রিশটা ভিটামিন ক্যাপসুল হলেও একটার খোলে ভরা আছে পটাসিয়াম সায়ানাইড।

***

ইন্ডিয়ান সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটে সিনিয়ার সায়েন্টিস্ট হিসাবে কাজ করছি আজ প্রায় পনের বছর হয়ে গেল। তার আগে এখানেই জুনিয়ার সায়েন্টিস্ট পদে ছিলাম পাঁচ বছর। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার বছরখানেক পর আমাকে সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মন্ত্রকের প্রধান সচিব পদে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আমি সেই পদ নিতে অস্বীকার করে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সরকার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে বিশেষ বেতনক্রম দিয়ে আমাকে এই পদেই রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা প্রায় তিন বছর আগের কথা। বিশেষ বেতনক্রম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার আমকে একটি বিশেষ প্রোজেক্টের দায়িত্বও অর্পণ করে। চূড়ান্ত গোপনীয় প্রোজেক্ট। তিন মাস অন্তর এই প্রোজেক্টের প্রোগ্রেস রিপোর্ট বিভাগীয় মন্ত্রীর হাতে আমাকে নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে। কাজ শুরুর আগে এই গবেষণায় আমার সহকারী হিসাবে একজন জুনিয়ার বিজ্ঞানীকে নিযুক্ত করেছে সরকার। নিয়ম অনুসারে ইউপিএসসি একটি ইন্টারভিউ বোর্ড গঠন করেছিল ঠিকই। কিন্তু বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে সেই পদে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করার সম্পূর্ণ অধিকার ও দায়িত্ব আমাকেই দেওয়া হয়েছিল। কোনো সন্দেহ নেই আমিই পছন্দ করেছিলাম মধুমিতাকে। সে অক্সফোর্ডের ডক্টরেট। অবশ্য সে ছাড়া আরও দুজন প্রার্থী বিষয়ের উপর যাবতীয় প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিয়েছিল। কিন্তু কোঁকড়ানো চুলের মেয়েটির হাই-পাওয়ার চশমার পিছনে বুদ্ধিদীপ্ত দুই চোখের আত্মবিশ্বাসী চাহনিই শেষ পর্যন্ত পার্থক্যটা গড়ে দিল। কাজ শুরু হওয়ার পর উপলব্ধি করেছিলাম আমার প্রার্থী-নির্বাচন নির্ভুল। মধুমিতা মেধাবী, পরিশ্রমী, দায়িত্ববান এবং বিষয়ের উপর যথেষ্ট দখল আছে তার। আমি ভাবতেই পারিনি সে আমার বিশ্বাসভঙ্গ করতে পারে।

***

আমি নিজেও বুঝি আর পাঁচজন মানুষের সঙ্গে আমার মিলের চাইতে অমিল অনেক বেশি। আমি অমিশুক, সামাজিকতায় স্বচ্ছন্দ নই, এবং কোনো ঘনিষ্ঠ বা আন্তরিক সম্পর্কে ঢুকে পড়ায় আমার স্বাভাবিক অনীহা আছে। আমার বাল্য ও কিশোরকাল অত্যন্ত অবহেলায় কেটেছে বলেই হয়তো আমার চরিত্রটা এমনই গড়ে উঠেছে। অত্যন্ত ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে অনাগ্রহী কাকার পরিবারে আশ্রয় জুটেছিল। সেখানে দুবেলা খাওয়ার বিনিময়ে সংসারের বহুরকম কাজ করতে হত। আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ রাখতে বাড়ির কাছে একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন কাকা। ভাগ্য ভালো, মেধা আর ইচ্ছের জোরে পড়াশুনাটা অব্যাহত ছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতে অসাধারণ রেজাল্ট করার পর আমাকে আর ভাবতে হয়নি। কাকার বাড়ি ছেড়ে ছাত্রাবাসে উঠেছিলাম। সেখানে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একজন স্বাভাবিক তরুণের মতো হয়ে উঠতে পারলাম না। পড়াশোনার জগতে একা একা কাটানোই আমার নিয়তি হয়ে উঠল। একজন সাধারণ মানুষের মতো বিয়ে-থা, সংসার ইত্যাদির চিন্তা কোনোদিনই আমার মনে ঠাঁই পায়নি। এই করেই প্রৌঢ়ত্বে প্রায় পৌঁছে গেলাম। আগামী পয়লা মে পঁয়তাল্লিশে পা দেওয়ার কথা। সেদিন আমার এই প্রোজেক্টের কাজের সময়সীমাও অতিক্রান্ত হবে। আর ঠিক তিরিশ দিন বাকি আছে সেই দিনটি আসতে। সে-পর্যন্ত যেতে পারলে জন্মদিনই হতে পারে আমার মৃত্যুদিন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা তিরিশের মধ্যে মাত্র এক।

***

এই ইন্সটিটিউটে মধুমিতার যোগদান করার দিন থেকেই আমি প্রোজেক্টের কাজ শুরু করেছিলাম। এর জন্যে বিশেষভাবে তৈরি ল্যাবরেটরিটি ইন্সটিটিউট-চত্বরের এক প্রান্তে অবস্থিত। এখানে আমরা দুজন ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের একজন সিনিয়ার ইনস্পেকটরকে এই পরীক্ষাগারের সুরক্ষা-ব্যবস্থা তদারকি করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। আমার থাকার জন্য পরীক্ষাগারের লাগোয়া দুই-ঘর বিশিষ্ট একটি আবাসও আছে। খাবারের ব্যবস্থা ইন্সটিটিউটের ক্যান্টিনে।

প্রথম বছরটা প্রায় শেষ হয়েছিল গবেষণার কাজে নিমগ্ন থেকে। আমার স্বভাব অনুযায়ী মধুমিতার সঙ্গে সম্পর্কটা কাজের স্তরেই আটকে ছিল। মধুমিতা চেষ্টা করেও আমার নিরাসক্তির বর্মে আঁচড় কাটতে পারেনি। আমি তার কাজে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলাম কিন্তু সে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তোলার উপক্রম করলেই আমার দীর্ঘকালীন অভ্যাসে রপ্ত করা উদাসীন চাহনিটি ঝুলিয়ে দিতাম চোখে।

আমার রক্ষণ আলগা হতে শুরু করল ঠিক দশ মাসের মাথায় যখন অপ্রত্যাশিত অল্প সময়ে প্রোজেক্টের প্রথম ধাপে সফলতা এসে গেল। এই ধাপে আমার লক্ষ্য ছিল মানুষের জেনোমে এমপ্যাথি বা সহমর্মিতার জিনগুলিকে শনাক্ত করা। পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই ‘অপর’ একজনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, ব্যথাযন্ত্রণাইত্যাদি নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারে। তার জন্যে যে-জিনগুলি দায়ি সেগুলিই হল এমপ্যাথির জিন। এগুলো শনাক্ত করা খুব সহজ কাজ ছিল না। আমার অবশ্য একটা সুবিধে ছিল যে আমার পুরনো কাজের সূত্রেই আমি নিশ্চিত ছিলাম এই জিনগুলো কেবলমাত্র মস্তিস্কের নিওরন-কোষেই অবস্থান করে। ফলে আমার অনুসন্ধানের কাজটা একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও আমার ধারণা ছিল প্রোজেক্টের সিংহভাগ সময় নেবে এই শনাক্তকরণ। দ্বিতীয় ধাপের কাজটা তুলনায় সহজ। এই ধাপে এমপ্যাথির জিনে মিউটেশন ঘটিয়ে সেগুলোকে স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে হবে। এটা সহজ, কারণ মাইক্রোইভোলিউশন ন্যাচারাল সিলেকশনের একটা অঙ্গ, যার ফলে কোনো কোনো কার্যক্ষম জিন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, আবার উলটোটাও ঘটে থাকে। অর্থাৎ, যেটা স্বাভাবিকভাবে এবং দীর্ঘ সময়ান্তরে ঘটে সেটা আমাকে কৃত্রিমভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে হবে।

যেদিন এই শনাক্তকরণ নিঃসংশয়ে প্রতিষ্ঠিত হল, সেদিন আনন্দের আতিশয্যে আমি বোধহয় খানিকটা লঘুচিত্ত হয়ে পড়েছিলাম। সেই সুযোগে মধুমিতা আমার কাছে একটা প্রস্তাব রেখেছিল। বলেছিল, - এই সাফল্যটা আমাদের সেলিব্রেট করা উচিত স্যার।

সেদিনই সম্ভবত প্রথম আমি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে মধুমিতাকে লক্ষ করলাম। তার দৃষ্টিতে একটা সহজ আন্তরিকতা ছিল, সে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। চশমা খোলার জন্যেই কি না জানি না, তার চোখের পাতা ভারী, দৃষ্টি গভীর। সহসা তার মুখটিকে আকর্ষণীয় মনে হল আমার। উদার হয়ে বললাম, - বেশ, কী করতে চাও বলো।

সে বলল, - কাল কোনো কাজ নয়, আমাদের অনেক ছুটি পাওনা হয়ে গেছে। ক্যান্টিনে খেতে খেতে আপনার জিভে নিশ্চয়ই কড়া পড়ে গেছে। কাল বাড়ি থেকে আমাদের দুজনের জন্য একটা স্পেশাল ডিশ বানিয়ে এনে একসঙ্গে বসে খাব। আর সারাদিন গল্প করব। কাজের কথা কিন্তু নয় স্যার। সেটা বাদ দিয়ে আমাদের দুজনের যা ইচ্ছে হবে সেসব নিয়েই কথা হবে।

আমার অস্বস্তি হলেও আপত্তি জানাতে পারলাম না।

***

সেই শুরু। আস্তে আস্তে দেখা গেল প্রতি সপ্তাহে একটা দিন তার বাড়ির রান্না-করা খাবার নিয়ে এসে একসঙ্গে খাওয়াটা রুটিন করে ফেলেছে মধুমিতা। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত কথাবার্তার আদানপ্রদান খুবই সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগল। একদিন সে দুম করে জিজ্ঞেস করে বসল, - আপনি বিয়ে করেননি কেন স্যার?

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা ছিল না। আমি চুপ করে বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলাম। সেই অবসরে আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টুকটাক প্রশ্ন করে যাচ্ছিল মধুমিতা। আমি আনমনা হয়ে উত্তর দিয়ে চলেছিলাম। পরে বুঝলাম আমার ছেলেবেলা থেকে শুরু করে এ-পর্যন্ত আমার জীবনকাহিনির পুরোটাই জেনে নিল সে। আমার বিয়ে না করা নিয়ে আর কোনোদিন কোনো প্রশ্ন সে করেনি। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে মধুমিতার ব্যক্তিজীবন নিয়ে আমারও একটা আগ্রহ জন্মাচ্ছিল। জানতে চাওয়ার ব্যাপারে আমি সংকোচহীন হতে পারিনি ঠিকই কিন্তু মধুমিতা যেন টের পেয়ে গিয়েছিল আমার আগ্রহটা। ফলে ধীরে ধীরে জেনে গেলাম তার মা-বাবা কর্মসূত্রে ইউ কে-তে আছেন দীর্ঘকাল। মধুমিতার স্কুলশিক্ষা কলকাতায় হস্টেলে থেকে সমাপ্ত হলেও গ্র্যাজুয়েসন, মাস্টার্স এবং ডক্টরেট ডিগ্রি সে অক্সফোর্ড থেকে করেছে। কিন্তু তারপরেই সে মা-বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এদেশে চলে এসে কর্মজীবন শুরু করে আজ থেকে বছর ছয়েক আগে। এখানে সে পৈতৃক ফ্ল্যাটে একাই থাকে। একদিন বলল, - আপনি তো বাইরে বেরনই না। চব্বিশ ঘণ্টা কাজ আর পড়াশোনা নিয়ে থাকতে একঘেয়ে লাগে না? একদিন চলুন না আমার ফ্ল্যাটে?

আমি বললাম, - তুমি একা থাকো – যাওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না।

মধুমিতা কৌতুকের সুরে বলল, - একা থাকি না স্যার। সঙ্গে থাকে একজন। তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। চলুন না –

একটি যুবতী মেয়ের প্রাইভেট লাইফ নিয়ে কৌতূহল হওয়া ঠিক নয় কিন্তু অন্যায্যভাবে সেটাই জেগে উঠল মনে।

একদিন সে নিয়ে গেল তার ফ্ল্যাটে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তার সেই ‘একজন’-কে। পাঁচ-ছ’ বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে। ঢলোঢলো মুখে মায়াভরা চোখ নিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সেই মেয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, - কে?

একচোখ হাসি নিয়ে মধুমিতা বলল, - আমার মেয়ে।

--তুমি বিবাহিতা – বলোনি তো –

--মা হতে গেলে বিবাহিত হতেই হবে স্যার?

--না – মানে – আমি কথা খুঁজে গেলাম না।

মাধুমিতার ফ্ল্যাটে একজন সাহায্যকারীও আছেন। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। চব্বিশ ঘণ্টাই থাকেন। মধুমিতা জানাল তিনি প্রশিক্ষিত পালিকা। মেয়ের দেখাশোনা করাই তাঁর প্রধান কাজ। চুক্তির বাইরে গিয়ে গৃহকর্মের কাজেও সাহায্য করেন। মেয়ের সঙ্গে স্কুলে যাতায়াত তাঁকেই করতে হয় বেশির ভাগ সময়।

সেদিন তার বাড়িতে দুপুরের খাওয়া শেষে তার মা হওয়ার গল্প শোনাল মধুমিতা। অক্সফোর্ডের পড়াশুনা শেষ করে মা-বাবার সঙ্গে এক মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিল মধুমিতা। ওখানে কয়েকটা কাজের অফার ছিল। ফিরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এমনটাই ঠিক ছিল। এখানে থাকতে একদিন পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সুন্দরবন ঘুরতে গিয়েছিল মধুমিতা। একটা লঞ্চ ভাড়া করে তিনদিনের ভ্রমণ। সেই লঞ্চে চালকের সহযোগীদের মধ্যে তার বউও ছিল। বউ-এর কোলে তিন-চার মাসের একটা বাচ্চা। মধুমিতা লক্ষ করল বয়স্ক চালকের যুবতী বউটি প্রায়ই বাচ্চাটাকে ইঞ্জিন ঘরের মেঝেতে শুইয়ে রেখে অন্য একজন তরুণ সহযোগীর সঙ্গে হাসিগল্পে মজে থাকছে। বাচ্চাটা তারস্বরে কেঁদেই চলেছে, কোনো হুঁশ নেই বউটার। বাচ্চাটার কান্না মধুমিতার বুকে এসে বিঁধতে লাগল। থাকতে না পেরে বউটাকে গিয়ে ধরল, - তোমার বাচ্চা কাঁদছে, শুনতে পাচ্ছো না?

বউটা বলল, - আমার বাচ্চা কেনে হবে, ননদটা বিয়োতে গিয়ে মরেচে, তার সোয়ামিটাও খ্যাপাপাগলা। কেউ দায়িত্ব নিলনিকো – আমার ইনি সাধু সেজে মেয়েটাকে আমার ঘাড়ে চাইপ্পে দিল। আমার নিজেরই তিনটা আছে। সেগুলাকে ঘরে থুয়ে এসচি, এই কচিটার ভার কে লেবে? খিদার জ্বালায় কেন্দে মচ্চে, কত আর দুধ গুলে খাওয়াই!আমার মাই তো শুককে গেছে।

বাচ্চাটার কান্না মধুমিতার বুকে স্থায়ী হয়ে গেল। ফেরার সময় চালকের সঙ্গে কথা বলে তার ফোন নম্বর নিয়ে এসেছিল। কলকাতায় ফিরেই একজন অ্যাডভোকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করল। দত্তক নেওয়ার আইনকানুন বুঝে নিয়ে চালককে সব জানাল। এদিকে লন্ডনে ফেরার সময় এসে গিয়েছিল। মধুমিতা গেল না। এই নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে তিন দিন ধরে বাদানুবাদ চলল। মধুমিতা সংকল্প থেকে নড়ল না। তাঁরা ফিরে যাওয়ার পর দত্তক দলিল তৈরি হল। নির্দিষ্ট দিনে চালক মেয়েটাকে নিয়ে একাই এসেছিল। রেজিস্ট্রি হওয়ার পর লোকটির চোখে জল। বলল, - আমার অভাগী বুনের আত্মাটা শান্তি পাইল মা। একটা সোন্দর জীবন অনাথ মেয়েটার কপালে লেখা হয়ে গেল।

একটা বিখ্যাত পালিকা কেন্দ্রের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করেছিল মধুমিতা। এই ভদ্রমহিলা সেদিন থেকেই বাচ্চাটির দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন।

***

প্রোজেক্টের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ বেশ উৎসাহের সঙ্গে শুরু করেছিলাম। একের পর এক উৎসেচকের ব্যবহার এবং ডিএনএ-এর বেস বদল করতে করতে এগিয়ে চলেছিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই পদ্ধতিতেই জিন ফ্রিকোয়েন্সির এমন পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব যাতে উদ্দিষ্ট জিনগুলি স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় হবে। বছরখানেকের মধ্যেই আংশিক সফলতা এল। এমপ্যাথির জিন নিষ্ক্রিয় হল কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সেগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠল। আমি বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা চালিয়েও নিস্ক্রিয়তাকে স্থায়ী করতে পারছিলাম না। দিনের পর দিন একই ফল পেতে পেতে আমার মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধল। ভালো করে খতিয়ে দেখে মনে হল, নিষ্ক্রিয় জিনের সক্রিয় হয়ে ওঠা স্বাভাবিক নয়, কেউ যেন এদের উপর রিভার্স পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করছে। একটু ভাবতেই যেন ইলেকট্রিক শক লাগল মাথায়! মধুমিতা ছাড়া আর কারোর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। তবে কি মধুমিতাই! কিন্তু কেন?

নিমেষেই মনে পড়ে গেল মধুমিতা একদিন কথাপ্রসঙ্গে বলেছিল, - এই প্রোজেক্টের পিছনে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে ভেবেছেন স্যার? সহমর্মিতাহীন মানুষ মানে তো ভয়ংকর এক জীব। তাদের বুদ্ধি থাকবে, দক্ষতা থাকবে অথচ মানবিক বোধ থাকবে না। যে কোনও ধরনের পৈশাচিক কাজে তাদের ব্যবহার করতে পারবে সরকার। ধরুন এদের নিয়ে কোনো গুপ্ত বাহিনী গঠন করল সরকার। তারপর সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের সব ধরনের প্রতিবাদ, বিক্ষোভে এদের ব্যবহার করতে লাগল।

আমি বলেছিলাম, - এসব তো রাজনীতির কথা। আমরা বিজ্ঞানী, প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করাই আমাদের একমাত্র কাজ।

তর্ক না বাড়িয়ে চুপ করে গিয়েছিল মধুমিতা। প্রসঙ্গ পালটে অন্য কথায় ঢুকে পড়েছিল। এই মুহূর্তে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। মধুমিতা আগেভাগেই আমাকে সন্দেহপরায়ণ করে তুলতে চায়নি। তাহলে তাকে গবেষণা থেকে ছেঁটে দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

প্রোজেক্টের সময়সীমা শেষ হতে দুটো মাসও বাকি নেই। মধুমিতাকে ছেঁটে দিয়ে নতুন করে আরম্ভ করার সুযোগ মিলছে না। আমার ক্যারিয়ারে এর আগে কোনোদিন ব্যর্থতার মুখ দেখতে হয়নি। সরকারের অগাধ আস্থা ছিল আমার উপর। সেটা তো গেলই, সেই সঙ্গে বিজ্ঞানী হিসাবে আমার বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে। এতখানি বিশ্বাসঘাতকতা করল মধুমিতা! নিমেষে সব রক্ত যেন মাথায় উঠে গেল আমার। রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠলাম। দ্রুত পায়ে ল্যাব থেকে বেরিয়ে অফিস ঘরে ঢুকলাম। মধুমিতা তার চেয়ারে বসে কিছু একটা করছিল। আমি তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিলাম, তারপর ডান আর বাঁ হাত দিয়ে সপাটে চড় কষাতে লাগলাম তার দুই গালে।

কতক্ষণ পরে থেমেছিলাম জানি না। মধুমিতা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি, যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে এক চুলও সরেনি। আমি থামার পর ধীরে ধীরে বসল চেয়ারে। তার রক্তলাল দুই গাল বেয়ে ঝরে চলল অশ্রুধারা। তার ভেজা চোখ তখনও নিবদ্ধ আমারই দু-চোখে। জানি না সহসা কী দেখলাম সেই দৃষ্টিতে, তীক্ষ্ণ কিছু একটা এসে বিঁধে গেল আমার বুকে। আর আমার মন জুড়ে অনুভবের পরিব্যক্তি ঘটে চলল। আমি মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে মধুমিতার কোলে মুখ গুঁজে দিলাম।

***

সেদিনের পর মধুমিতা আর আসেনি। ক্যুরিয়ার মারফৎ তার পদত্যাগপত্র আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেটা আজ অব্দি আমার ড্রয়ারেই পড়ে আছে। ইতিমধ্যে ঠাণ্ডা মাথায় আমি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। ল্যাবে উপাদান ছিলই। পটাসিয়াম সায়ানাইড তৈরি করতে সময় লাগেনি। দোকান থেকে পঞ্চাশটা ক্যাপসুলের একটা শিশি কিনলাম। ল্যাবে গিয়ে কুড়িটা ক্যাপসুল বের করে বাস্কেটে ফেলে দিয়ে একটা ক্যাপসুলের খোল খুলে সেটা খালি করে তার মধ্যে পটাসিয়াম সায়ানাইড ভরে নিলাম। শিশির বাকি ঊনত্রিশটা ক্যাপসুলের সঙ্গে সেটা মিশিয়ে বিছানার পাশের টেবিলে রেখেছি। বিজ্ঞানী হিসেবে আমি অনির্দেশ্য তত্ত্বে বিশ্বাসী। মৃত্যু নিশ্চিত করেছি বলে তার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করার অধিকার আমার নেই।

আজ পয়লা এপ্রিল। বেশ কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা হয়েছে। ফাঁকা মগজ, শরীরময় আলস্য। মোবাইল বেজে উঠল। হাতে নিয়ে দেখি এখানের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা ইনস্পেকটর। বললেন, - মধুমিতা ম্যাডাম এসেছেন, কিন্তু সঙ্গে একটি ছোটো মেয়ে। কোনো অসুবিধে নেই তো স্যার?

অবাক হওয়ার উদ্যমও বুঝি অবশিষ্ট নেই আমার। একটি পরেই মধুমিতা তার মেয়েকে নিয়ে ঢুকল। আমি তাদের শোয়ার ঘরে নিয়ে এসেই বসালাম। নিচু হয়ে মেয়ের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। মধুমিতা বলল, - সরি স্যার।

কেন দুঃখপ্রকাশ জানতে চাইলাম না। মধুমিতা বলল, - সেকেন্ড ফেজের কাজ নতুন করে শুরু করেছেন তো স্যার। আমার মনে হয় বাকি এই এক মাসেই আপনি লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন।

মধুমিতা সোফায়। মেয়েটি আমার গা ঘেঁষে বিছানায় বসেছে। আমি তার চুলে হাত ডুবিয়ে বললাম, - মন্ত্রকে আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নেওয়াও অসম্ভব হবে না, কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত বদল করেছি মধুমিতা। তোমার মতো আমিও পদত্যাগপত্র লিখে রেখেছি। দুটো চিঠি একসঙ্গেই অফিসের ড্রয়ারে রাখা আছে। দুটোর স্বাক্ষর একই তারিখের। আমি দৈবাৎ ভুলে গেলে তুমি মন্ত্রকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিও।

মধুমিতার চোখে যেন একটা চমক দেখলাম। তারপরেই তার চঞ্চল দৃষ্টি সারা ঘরে ঘুরতে লাগল। এই প্রথম এই ঘরে ঢুকেছে সে। তাই কি খুঁটিয়ে দেখছে? একটু পরে সোফা আর বিছানার মাঝখানে রাখা টেবিলে তার দৃষ্টি স্থির হল। সামান্য অস্বস্তি বোধ করলাম আমি। সে একটু ঝুঁকে ক্যাপসুলের শিশিটা খুঁটিয়ে দেখল। বলল, - রোজ খান?

উত্তর দিতে গিয়ে একটু থমকালাম। সামলে নিয়ে বললাম, - মাঝে মাঝে।

কয়েক মিনিট নীরবতা। মধুমিতার মেয়ে একটা মোটা বই খুঁজে বের করেছে। রঙিন ছবিওলা অ্যানাটমির বই। একমনে পাতা উলটে উলটে ছবি দেখে চলেছে। খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে। হঠাৎ মধুমিতা উঠে দাঁড়াল। বলল, - একবার ল্যাবে যেতে পারি স্যার?

আমি হাসলাম, - যাও না – স্যাবোটেজ করার কোনো সুযোগ তো আর নেই।

কোনো কথা না বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল মধুমিতা। তখনই আমার মাথায় একটা দুশ্চিন্তা ঢুকল। ক্যাপসুলের কাজ করে আসার পর থেকে আর তো যাইনি ল্যাবে। সব এলোমেলো পড়ে আছে। বাস্কেটে অতগুলো ক্যাপসুল - কেসিএন তৈরির কোনো ক্লু ছেড়ে আসিনি তো?

বোধহয় মিনিট পনেরো পরে ফিরে এল মধুমিতা। সোফায় বসে খানিক আনমনা স্বরে বলল, - আপনার কোনোদিন কোনো মেজর অপারেশন হয়েছে স্যার?

--হঠাৎ এই প্রশ্ন?

--না, অচেতন থেকে চেতনায় ফেরার কথা ভাবছিলাম। একটা অপূর্ব অভিজ্ঞতা!

--তুমি কী অর্থে বলছো?

মধুমিতা কেমন যেন একটা হাসল। বলল, -- না না, অন্য কিছু নয়। মেজর অপারেশনের আগের অ্যানেস্থেসিয়ার কথাই বলছি। আমার হয়েছিল। লন্ডনে। তখন মাস্টার্স করছি। য়ুফেরেক্টমি, সিস্টের জন্য ওভারি বাদ দিতে হল। দুটোই।

আমি হতভম্ব। যতোটা না এই নিদারুণ সংবাদে, তার চেয়ে বেশি সেটা জানানোর সময় বাছার জন্য। কোনো একটা কার্যকারণ সম্পর্কের হদিশ হাতড়াচ্ছিলাম। তখনই সোফা থেকে উঠে এল মধুমিতা। যেন ছোঁ মেরে ক্যাপসুলের শিশিটা তুলে নিল হাতে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শিশি হাতে ঘরের লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে গেল। একটু পরেই ফ্লাশ টানার শব্দ পেলাম। চোখের সামনে দ্বিতীয় অন্তর্ঘাতটি ঘটাল মধুমিতা।

***

বারটা বাজল বোধহয়। ইংরাজি ‘বোকা দিবস’ অস্তে গেল। পয়লা মে যে আমার জন্মদিন সে-খবরটাও মধুমিতার জানা। এই মুহূর্তে সে সোফায় আধশোয়া। তার মেয়ে আমার কোলে মাথা রেখে বহুক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি মধুমিতা এবং আমার মাঝখানে থাকা টেবিলের শূন্যজায়গাটার দিকে তাকিয়ে মধুমিতার চূড়ান্ত অন্তর্ঘাতের প্রতীক্ষা করছি।


সৃষ্টির একুশ শতক, মার্চ ২০২১

0 comments: