0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৩

আমাদের শিবপালগঞ্জ মহকুমা সদর বটে, কিন্তু এমন কিছু বড় গ্রাম নয় যে ওকে টাউন বলা যাবে। ওখানে একটা গ্রামসভা রয়েছে আর শিবপালগঞ্জের বাসিন্দাদের ইচ্ছে যে ওটা টাউন নয়, গ্রামসভাই থাকুক, নইলে ঘরদোরের জন্যে বেশি ট্যাক্স দিতে হবে। এই গ্রামসভার প্রধান হলেন স্বভাবকবি রামাধীন ভীখমখেড়ীর ভাই।

ওনাকে তারিফ করতে হয়, কারণ সাতবার লাগাতার উনি গ্রামসভার প্রধান রয়েছেন, অথচ জেলেও যাননি, পাগলাগারদেও নয়। ‘গঞ্জহা’দের মধ্যে উনি নিজের মূর্খামির জন্য প্রসিদ্ধ। এইজন্যেই উনি ‘প্রধান’ পদে অভিষিক্ত হওয়ার আগে সবার প্রিয় ছিলেন। বাইরে থেকে কোন আধিকারিক এই গ্রামে পরিদর্শনে এলে এরা প্রধানকে অফিসারদের সামনে যেন থালায় চড়িয়ে পেশ করত। কখনও কখনও এমনও বলত—সাহেব, শহর থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তো আপনারা হাজারবার দেখেছেন, এবার না হয় এখানকার মাল কেমন দেখে নিন।

গ্রামসভার নির্বাচন হবে আগামী জানুয়ারি মাসে, আর এখন নভেম্বর। প্রশ্ন হল এবার কাকে ‘প্রধান’ করা যায়। গতবারের নির্বাচনে বৈদ্যজী বিশেষ আগ্রহ দেখাননি, কারণ উনি তখন গ্রামসভার কাজটাজকে মহা-ফালতু টাইপের ভাবতেন। এক হিসাবে ফালতু তো বটেই, কারণ গ্রামসভাতে যেসব সরকারি আধিকারিকেরা আসতেন তাঁরা সব ওই দুধভাত গোছের, মানে ফালতু অফিসার। ওনাদের না ছিল পুলিসের ডান্ডা, না তহসীলদারের দাপট।

তাই রোজ রোজ অমন সব অফিসারের কাছে কাজের হিসেব পেশ করা মানে নিজেদের মান-ইজ্জত খোয়ানো। গ্রামসভার প্রধানকে জমিটমির জন্যে মামলা করতে হত, কিন্তু শহরের আদালতে হাকিম এবং উকিলদের সঙ্গে এনার তেমন কোন ওঠাবসা ছিল না যেমনটি এক চোরের সঙ্গে অন্য চোরের থাকে। মামলাবাজির দুনিয়ায় লোকজনের সঙ্গে দুশমনি বেড়ে যায়, অথচ, মুশকিলে পড়লে পুলিস ব্যাটারা শুধু মুচকি হাসে আর কখনও কখনও মোটা আওয়াজে “পরধানজী” ডেকে থানার বাইরের ভূগোল শেখাতে থাকে।

ইদানীং, গ্রামসভার কাজকর্মে বৈদ্যজীর রুচি বেড়ে গেছে, কারণটি প্রধানমন্ত্রীজির একটি বক্তৃতা - যা উনি খবরের কাগজে পড়ে থাকবেন। ওই বক্তৃতায় বলা হয়েছে—গ্রামের উন্নয়ন শুধু স্কুল, সহকারী সমিতি এবং গ্রাম-পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই হতে পারে। হঠাৎ বৈদ্যজীর খেয়াল হল—এতদিন উনি পল্লী উন্নয়নের কাজ শুধু কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন এবং কলেজের মাধ্যমেই করে এসেছেন। গ্রাম-পঞ্চায়েত তো ওনার নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে!

“আহা! এজন্যেই বুঝি শিবপালগঞ্জের ঠিকমত বিকাশ হচ্ছে না। তাই ভাবি, ব্যাপারটা কী”?

খেয়াল হতেই কতকগুলো বিষয় স্পষ্ট হল। এক, রামাধীনের ভাই তো গ্রামসভার সর্বনাশ করে ছেড়েছে। গ্রামের পতিত জমিতে লোকজন ইচ্ছেমত জবরদখল করে ঘর তুলেছে--নিঘঘাৎ প্রধান ব্যাটা ঘুষ খেয়েছে। গ্রাম-পঞ্চায়েতের ভাঁড়ারে মা-ভবানী, নিশ্চয় প্রধান তহবিল-তছরূপ করেছে। গ্রামের এখানে সেখানে জঞ্জাল জমেছে, প্রধান ব্যাটা যে একটা শুয়োরের বাচ্চা –এ’নিয়ে কোন সন্দেহ আছে? থানাদার প্রধানের নালিশ শুনে বেশ ক’জনকে হাজতে পুরেছে—এর মানে ও এখন পুলিশের দালাল!

প্রধানজী বন্দুকের লাইসেন্স পেয়েছে! ওটা নিশ্চয়ই ডাকাতির জন্য ভাড়া খাটে! আরে গতবছর যে আমাদের গাঁয়ে বজরঙ্গী খুন হল, তার রহস্য কি এখনও অজানা?


যারা ভাঙ খায় তাদের সমাজে তরিবত করে ভাঙ বাটাকে এক শিল্প, কাব্য, বা সংস্কৃতির সম্মান দেওয়া হয়। অবশ্যি, একটু ভাঙের পাতা চিবিয়ে নিয়ে এক লোটা জল খেলেই বেশ জম্পেশ নেশা হয় । তবে ওটা হল শস্তার নেশাখোরি। আদর্শ ভাঙ তৈরির রেসিপি হল ওর সঙ্গে বাদাম, পেস্তা, গোলাপের পাপড়ি, দুধ-সর মেশানো। ভাঙের পাতাকে এমন পিষতে হবে যে শিল-নোড়া এক হয়ে এ’ওর গায়ে আঠা হয়ে লেগে থাকবে। আর ভাঙের শরবতে চুমুক দেওয়ার আগে ভোলানাথ শিবের বন্দনায় দু’ছত্র শোনাতে হয়। অর্থাৎ, পুরো ব্যাপারটা ব্যক্তিগত না হয়ে সমষ্টিগত বা গোষ্ঠীগত হতে হবে।

শনিচরের কাজ হল বৈদ্যজীর দরবারে ভাঙের সামাজিক চরিত্রকে রূপ দেওয়া। এই সময় ও অন্যদিনের মতই বৈঠকখানার বারান্দায় বসে শিলনোড়ায় ভাঙ পেষায় ব্যস্ত ছিল। এমন সময় ভেতর থেকে কেউ ডাকল—শনিচর!

শনিচর ফোঁস করে ফণা তোলার মত মাথা তুলে তাকালো। বৈদ্যজী বললেন—ভাঙ পেষার কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে তুমি ভেতরে চলে এস।

শনিচরের মনে হল যেন ওকে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করতে বলা হচ্ছে। ও বিরক্তিতে গজগজ করতে লাগল—কাকে দেব? এই কাজটা করার আর কেউ আছে? আজকালকার ছোঁড়াগুলো ভাঙ পেষার কী জানে! হলুদ-লংকা বাটার মত করে পিষে ছাড়বে!

কিন্তু এসব বলে শেষে ও’ একজন অল্পবয়েসীর হাতে শিলনোড়ার দায়িত্ব সঁপে দিল। তারপর হাত-টাত ধুয়ে আন্ডারওয়ারের পেছনে মুছতে মুছতে বৈদ্যজীর সামনে হাজির হল।

তক্তপোষের উপর বৈদ্যজী, রঙ্গনাথ, বদ্রী পালোয়ান এবং কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেব বসে আছেন। প্রিন্সিপাল একটু কোণের দিকে সরে গিয়ে বললেন—বসে পড়ুন, শনিচরজী।

এই কথায় শনিচর সতর্ক হয়ে গেল। ওর মুখের ভাঙা দাঁত বাইরে বেরিয়ে এল আর ও খসখসিয়ে বুকের লোম চুলকাতে লাগল। ওর চেহারা এখন একটু বোকা-বোকা লাগছে বটে, তবে, চালাকির মোকাবিলা কীভাবে করতে হয় সেটা ওর জানা আছে। ও মুখ খুলল—আরে প্রিন্সিপাল সাহেব, আপনাদের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে আমাকে নরকে পাঠাবেন না।

বদ্রী পালোয়ান হেসে ফেলল। --শালা! গঞ্জহাপনা ঝাড়ছিস্‌? প্রিন্সিপাল সাহেবের সঙ্গে বসলে নরকে যাবি?

তারপর আওয়াজ পরিবর্তন করে বলল—ও’ পাশে গিয়ে বসে পড়্‌।

বৈদ্যজী এবার শাশ্বত সত্য উচ্চারণের ভঙ্গিতে বললেন—এভাবে কথা বলো না বদ্রী। মঙ্গলদাসজী এবার কী হতে চলেছেন তার কোন আভাস পেয়েছ?

মঙ্গলদাস! শনিচর কত বছর পরে নিজের বাপ-মা’র দেয়া নাম শুনল! ও বসে পড়ল এবং বেশ মুরুব্বি চালে বলল—পালোয়ানকে আর কত অপমান করবেন , মহারাজ? কতই বা বয়েস। সময় হলে সব বুঝতে পারবেন।

বৈদ্যজী মুখ খুললেন—তাহলে প্রিন্সিপাল সাহেব, যা বলার বলে ফেলুন।

উনি এবার অবধী বোলিতে শুরু করলেন—বলার আর আছেটা কী? আপনারা সব জানেন।

এরপর খড়িবোলী হিন্দিতে – গ্রামসভার নির্বাচন আসন্ন। সভার প্রধান বা সভাপতি পদমর্যাদায় এখানকার গুরুত্বপূর্ণ লোক। উনি কলেজ-কমিটিরও সদস্য, মানে আমারও অফিসার।

বৈদ্যজী হঠাৎ বলে উঠলেন—শোন মঙ্গলদাস, এ বার আমরা তোমাকেই গ্রামসভার প্রধান করব।

শনিচরের চেহারা বেঁকেচুরে গেল। ও হাত জোড় করল। কোন সতরঞ্জি- বিছানেওয়ালা গুপ্তরোগে পীড়িত তুচ্ছ কার্যকর্তাকে হঠাৎ যদি মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হতে বলা হয় তাহলে তার যা অবস্থা হয় আর কি! নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে বলল—না না মহারাজ! আমার মত নালায়েক অধমকে আপনি যে এই পদের লায়েক ভেবেছেন –তাই যথেষ্ট। কিন্তু আমি এই ইজ্জতের যোগ্য নই।

হঠাৎ করে এত উন্নত ভাষা এবং উর্দু শব্দ মুখে থেকে বেরিয়ে আসায় শনিচর নিজেই হতভম্ব। তবে বদ্রী পালোয়ান বলতে ছাড়ল না।–আবে! এখন থেকেই এত বাতেলা মারিস না। এসব তো লোকে পদ পাওয়ার পর বলে। সেই সুদিনের জন্যে এসব বাঁচিয়ে রাখ।

এতক্ষণ পরে রঙ্গনাথ ময়দানে নামল। শনিচরের কাঁধ থপথপিয়ে বলল—প্রশ্নটা লায়েক-নালায়েকের নয়, শনিচর। আমরা জানি যে তুমি নালায়েক। কিন্তু তুমি কি নিজের ইচ্ছেয় প্রধান হবে? এবার জনগণ তোমাকে ‘প্রধান’ বানিয়ে ছাড়বে। জনগণ যা চাইবে, সেটা মানতে হবে। তুমি-আমি বলার কে?

পালোয়ান উবাচ,-- ছেলে-ছোকরার দল দিনরাত তোমাকে বোকা বানায়। তখন তুমি কর কী? কেবল বোকা সেজে থাকো, এই না?

প্রিন্সিপাল সাহেব শিক্ষিত ব্যক্তির মত বোঝাতে লাগলেন—‘’হ্যাঁ ভাই, দেশে প্রজাতন্ত্র চলছে। সব এভাবেই হয়ে থাকে’। শনিচরকে আরও উৎসাহ দিতে গিয়ে উনি বল্লেন—‘ সাবাস শনিচর! তৈরি হও’! এসব বলে উনি ‘বাঢ় খেয়ে ক্ষুদিরাম হও’ স্টাইলে শনিচরের দিকে তাকালেন। শনিচরের ঘনঘন মাথা নড়া বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রিন্সিপাল শেষবারের মত ‘হেঁইও’ করলেন, “কোন হেঁজিপেঁজি প্রধান হতে পারে না। গ্রামসভার প্রধান হয় কোন দমদার লোক। খুব সম্মান। পুরো গাঁয়ের জমিন-জায়দাদের মালিক। চাইলে একদিনেই লাখ টাকা এদিক -সেদিক করতে পারে। ও’ স্থানীয় হাকিমও বটে! ইচ্ছে হলে গোটা গাঁয়ের লোককে ধারা ১০৭ লাগিয়ে চালান করে হাজতে বন্ধ করে দেয়। বড় বড় অফিসার ওর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। যার নামে চুকলি করে তার হাতে হ্যারিকেন।

“কাগজে একটা সীল লাগিয়ে যখন ইচ্ছে যত ইচ্ছে তেল আর চিনি বের করে নেয়। ওর সবাই আদেশ ছাড়া গ্রামের কোন লোক নিজের ঘরের পেছনের আস্তাকুঁড়ে ময়লাও ফেলতে পারেনা।

সবাই ওর বুদ্ধিতে চলে। সবার চাবি ওর কাছে গচ্ছিত। ওই হল অনাথের নাথ। কী বুঝলে”?

রঙ্গনাথের মনে হল এসব যেন আদর্শবাদের মাপকাঠিতে কিঞ্চিৎ খেলো হয়ে যাচ্ছে। ও বলল,

“আপনি তো মাস্টারমশাই, গ্রামপ্রধানকে একেবারে ডাকু বানিয়ে ছাড়লেন”।

প্রিন্সিপাল ‘হেঁ-হেঁ-হেঁ’ করে ভাব দেখালেন যেন উনি জেনেবুঝে এইসব বোকার মত কথাবার্তা বলছেন। এটাই ওনার স্টাইল। বোকার মত কথা বলতে বলতে উনি শ্রোতাকে এটাও বুঝিয়ে দেন যে নিজের বোকামির সম্বন্ধে উনি বিলকুল অবগত আছেন এবং তার মানে—উনি আদৌ বোকা নন।

“হেঁ-হেঁ-হেঁ রঙ্গনাথ বাবু। আপনিও ভুল বুঝলেন? আমি তো এখন যিনি গ্রামসভার প্রধান তাঁর কথা বলছিলাম”।

রঙ্গনাথ প্রিন্সিপালকে খেয়াল করে দেখল। এ তো নিজের ক্যাবলামির কাদাও দুশমনের মাথায় লেপে দেয়। তার নামে কলংক রটায়। বুদ্ধির হাতিয়ার দিয়ে শত্রুনিধন সবাই করে। এখানে তো বোকামির হাতিয়ার দিয়ে বিরোধীদের নাস্তানাবুদ করার খেলা চলছে। খানিকক্ষণ খান্না মাস্টার আর তার বন্ধুদের কথা ভেবে রঙ্গনাথের মন খারাপ হয়ে গেল। ও বুঝতে পেরেছে যে প্রিন্সিপালের মোকাবিলা করা এদের কম্মো নয় , আরও অভিজ্ঞ খেলুড়ে চাই।

শনিচর বলছিল-- ‘বদ্রী ভাইয়া, এতসব বড় বড় হাকিম গ্রামপ্রধানের দরজায় আসে। কিন্তু আমার ঘরে তো কোন দরজাই নেই। দেখছ তো, ভাঙা ছাত আর—‘।

বদ্রীর মতে শনিচরের সঙ্গে বেশি মুখ চালানো মানে নিজের ইজ্জত কম করা। ওর সন্দেহ যে আজ সুযোগ পেয়ে ব্যাটা বড্ড গায়ে পড়া ভাব দেখাচ্ছে। ও তক্তপোষ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কোমর থেকে খসে পড়া লুঙিটা কষে বাঁধতে বাঁধতে বলল—ঘাবড়াও মৎ, একটা দেশলাইকাঠি তোমার চালে ফেলে দেব, ব্যস্‌--সব চিন্তা দূর।

এসব বলে ও বাড়ির ভেতরে চলে গেল। কথাটাকে ঠাট্টা ভেবে প্রিন্সিপাল সাহেব হেসে উঠলেন। তারপর শনিচরও হেসে ফেলল। কথাটা বুঝতে রঙ্গনাথের কিছু সময় লাগল। ততক্ষণে আলাপ-আলোচনা অন্যদিকে ঘুরে গেছে।

বৈদ্যজী বললেন—কেন? আমার বৈঠকখানা তো রয়েছে। এখানেই মনের আনন্দে বসে কাজ কর। সরকারি আধিকারিকরা এলে এখানেই অভ্যর্থনা করবে। কিছুদিন যাক, পঞ্চায়েতের পাকা ঘর তৈরি হবে। তখন তুমিও ওই ঘরে থাকবে। ওখান থেকেই গ্রামসভার সেবা করবে।

শনিচর ফের নম্রভাবে হাতজোড় করল। শুধু এইটুকু বলল—আমার কী করার আছে? সারা দুনিয়া বলবে –আপনারা থাকতে শিবপালগঞ্জে এক চালচুলোহীনকে----।

প্রিন্সিপাল তাঁর চিরপরিচিত হেঁ-হেঁ-হেঁ এবং অবধী বোলী শুরু করলেন—আবার বাজে বকছেন শনিচরজী! আমার এলাকায় রাজাপুরের গ্রামসভায় ওখানকার ঠাকুরসাহেব নিজের রাঁধুনিকে প্রধান করেছেন। খামোকা কোন বড় মানুষ কেন এইসব ঝামেলায় নাক গলাবে?

প্রিন্সিপাল সাহেব এবার কোন রাখঢাক না করে বলতে লাগলেন—আরও শুনুন, ওই ব্যাটা রাঁধুনি গ্রামসভার চেয়ারম্যান বা সভাপতি হয়ে তামাশা পুরো জমিয়ে দিল। সবাই জানে যে একবার মহকুমায় জলসা হচ্ছিল। ডিপ্টি সাহেব এলেন। গ্রামসভাগুলোর সব প্রধান হাজির। ওদের সবাইকে মাটিতে সতরঞ্চি পেতে বসানো হয়েছে। ডিপ্টি সাহেব বসেছেন চেয়ারে। হঠাৎ ওই রাঁধুনি ব্যাটা বলে উঠল—আমাদের নেমন্তন্ন করে এনে মাটিতে বসিয়েছে আর ডিপ্টি বসেছেন চেয়ারে—এটা কেমন ন্যায়? ডিপ্টি সাহেবও নতুন পাশ করা ছোকরা, উনিও জিদ ধরে বসলেন। এবার দু’পক্ষেরই ইজ্জতের প্রশ্ন। সমস্ত প্রধান রাঁধুনির পক্ষে। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শ্লোগান শোনা যেতে লাগল। ডিপ্টি সাহেব নিজের চেয়ারে চেপে বসে খালি হাত তুলে চেঁচাচ্ছেন—শান্তি! শান্তি!

কিসের শান্তি আর কিসের শকুন্তলা! সমস্ত গ্রাম প্রধান সভা ছেড়ে উঠে পড়ল। আর সেই মুহুর্তে রাজাপুরের রাঁধুনি ব্যাটা গোটা মহকুমার নেতা হয়ে গেল। পরের দিন তিনটে পার্টি থেকে অনুরোধ এল—এস, আমাদের মেম্বার হয়ে যাও।

কিন্তু বাবুসাহেবের এক কথা—খবরদার! তাড়াহুড়ো করবি না। আমি যখন বলব যে অমুক দলে যা, তখন সেখানকার সদস্য হবি।

শনিচরের কানে বাজছে—ইনকিলাব জিন্দাবাদ! ও কল্পনায় দেখছে—এক আন্ডারওয়ার পরা অর্ধনগ্ন মানুষ—সে যাচ্ছে সবার আগে। তার পেছন পেছন শ’ দুশ’ লোক হাত মুঠো করে শ্লোগান দিতে দিতে চলেছে।

বৈদ্যজী বললে—“এটা অশিষ্টতা। আমি প্রধান হলে আগেই উঠে চলে আসতাম। ফের মাস-দুই পরে নিজের গ্রামসভায় উৎসবের আয়োজন করতাম। ডিপ্টি সাহেবকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে এসে মাটিতে শতরঞ্জি পেতে বসাতাম। তারপর নিজে চেয়ারে বসে লেকচার দিতাম—শোন ভাইসব, আমার চেয়ারে বসতে বড় অসুবিধে হয়, কষ্ট হয়।

কিন্তু কী করব, ডিপ্টি সাহেব নিজে অমুক তিথিতে আমাদের ওঁর মহকুমায় নেমন্তন্ন করে শিখিয়েছেন যে অতিথিদের মাটিতে বসাতে হয়, নিমন্ত্রণকর্তা বসবেন চেয়ারে—এটাই সরকারি দস্তুর। কাজেই আমাকে শত অসুবিধা সত্ত্বেও ওনার শেখানো নিয়মকে সম্মান করে চেয়ারে বসতে হচ্ছে”।

এটা বলে বৈদ্যজী আত্মপ্রসাদের সঙ্গে ঠা-ঠা করে হেসে উঠলেন। রঙ্গনাথের সমর্থনের আশায় বললেন—বল বেটা, এটাই উচিত হত না?

--ঠিক বলেছেন। আমাকেও এইসব প্যাঁচ-পয়জার স্কুলে থাকতে শেয়াল ও সারসের গল্প শুনে শিখতে হয়েছে।

বৈদ্যজী এবার শনিচরকে বললেন—তাহলে তো ঠিক হয়েই গেল। এখন যাও, গিয়ে দেখ ওই মূর্খ ব্যাটা সত্যি সত্যি ভাঙ পিষতে গিয়ে হলুদ বাটা না করে ফেলে। তোমার হাতের ছোঁয়া না লাগলে ভাঙের মৌতাত জমে না।

বদ্রী পালোয়ান দরজার চৌকাঠ থেকে মুচকি হেসে বলল-যাও সালে! গিয়ে ফের ওই ভাঙ ঘুটতে লেগে পড়।

খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। প্রিন্সিপাল নীচু গলায় বললেন—আপনার আজ্ঞা হলে এবার খান্না মাস্টারের বিষয়ে কিছু বলি?

বৈদ্যজীর ভুরু কপালে চড়ে গেল। প্রিন্সিপাল উবাচ—একটা ঘটনা ঘটেছে। পরশুদিন সন্ধ্যার সময় গয়াদীনের আঙিনায় একটা ঢিল উড়ে এসে পড়ল। গয়াদীন তখন ‘দিশা ময়দান’ সম্পন্ন করতে বাড়ির বাইরে। বাড়িতে বেলার পিসি ছিলেন। তিনি ঢিল কুড়িয়ে দেখলেন তাতে একটা দোমড়ানো চিঠি। উনি বেলাকে ডেকে বললেন-নে, এটা পড়ে শোনা। কিন্তু বেলা ওটা পড়তে পারল না।

রঙ্গনাথ মন দিয়ে শুনছিল, এবার জানতে চাইল যে ওটা কি ইংরেজিতে লেখা ছিল?

--ইংরেজিতে কেন কেউ লিখতে যাবে? ভাষা তো হিন্দিই ছিল। কিন্তু ওটা প্রেমপত্র, কুমারী মেয়ে কোন মুখে সেটা পিসিকে পড়ে শোনাবে?

বৈদ্যজী চুপচাপ শুনছিলেন। রঙ্গনাথের সাহস হল না যে জিজ্ঞেস করে -চিঠিটা লিখেছিল কে?

প্রিন্সিপাল নিজেই বললেন—কে লিখেছিল জানা যায়নি। তবে আমার মনে হয় ওই খান্না মাস্টারের দলেরই কারও কাণ্ড। সব’কটা গুণ্ডা! একনম্বরের গুণ্ডা! কিন্তু খান্না মাস্টার আপনার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেছে। বলে বেড়াচ্ছে যে ওই চিঠিটা লিখেছে রূপ্পন বাবু, আপনার ছোট ছেলে! ওর হিম্মত এত বেড়েছে যে আপনার বংশের মুখে কালি দিতেও পিছপা হচ্ছে না।

এই কথার বৈদ্যজীর উপর কোন প্রভাব পড়ল না। তবে উনি এক মিনিট মৌন ধারণ করলেন। তারপর মুখ খুললেন—ও আমার বংশের কী করবে? কলংক লেপছে গয়াদীনের বংশের মুখে—কন্যাটি তো গয়াদীনেরই, নয়?

প্রিন্সিপাল সাহেব খানিকক্ষণ বৈদ্যজীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু কোন ভাবান্তর চোখে পড়ল না। যেন এই প্রসংগ থেকে রিটায়ার করেছেন। প্রিন্সিপাল ঘাবড়ে গেলেন, সেটা ঢাকতে অন্য দিকে তাকিয়ে অবধী বোলীতে শনিচরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন—লাও ভাই শনিচর! জলদি ঠান্ডাই-ফণ্ডাই লে আও। কলেজ ছুটির সময় হচ্ছে।

(চলবে)

0 comments: