0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















৪১

ফাইনহালস ভাবছিল যে সে পরে কখনো কাজকর্ম শুরু করবে। আপাতত একদম বিশ্রাম। সে কয়েকটা দিন খালি ঘুমোবে। মায়ের আদরে প্রশ্রয়ে সময় কাটাবে সে। মা খুব খুশি হবে। দীর্ঘ সময়ের পর সে ফিরেছে এবং শীগগিরই তার কোথাও যাবার নেই। বাড়িতে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু ব্যবস্থা আছে ধূমপানের জন্য। সে গড়িয়ে গড়িয়ে শুধু বই পড়বে আর ধূমপান করবে। ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখ নিশ্চয়ই এখন আগের চেয়ে ভালো পিয়ানো বাজাতে পারে। অতীতে এমন হয়েছে যে সে বাগানে বসে বই পড়ছে আর পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখের অপটু হাতের বাজনার শব্দ তাকে শুনতে হয়েছে। সে বড় সুখের সময় ছিল। যদিও সেই মুহূর্ত যে সুখের, এমন কথা অবশ্য সেই সময়ে মনে হয়নি তার। আজ সে জানে সে কথা। অনেক বিল্ডিং বানানোর স্বপ্ন দেখত সে আগে। ভাবত যে এমন সব বিল্ডিং বানাবে যেগুলো অতীতে কেউ বানায়নি। কিন্তু পরে তাকে এমন সব বিল্ডিং বানাতে হয়েছিল, যেগুলো তার কল্পনার সৃষ্টি থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। সে একজন মধ্যমানের আর্কিটেক্ট হয়ে উঠেছে। তবে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ধ্যানধারণা থাকা খারাপ কিছু নয়। তাই সে এখন খুব সাদাসিধে বাড়িঘর বানাতে চায়, যেগুলো বানানো শেষ হলে তার মনে একটা অদ্ভুত তৃপ্তি হবে। জীবনে সব বিষয়ে নিজেকে নিয়ে গুরুগম্ভীর ভাবনা ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই।

ঘরে ফিরবার পথটা এখন তার কাছে বড় দীর্ঘ মনে হচ্ছে। তবে খুব বেশি হলেও আর আধ ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না তার। শরীর বড় ক্লান্ত ঠেকছে। কেউ যদি এইটুকু পথ গাড়ি করে পৌঁছে দিত তাকে, খুব ভালো হত। সে বিছানায় শুয়ে এতক্ষণে ঘুম লাগাতো। যে পথটা এখন তাকে ধরতে হবে, এই ঘুরপথে যাওয়াটাও তার কাছে বিরক্তিকর। আমেরিকান ফ্রন্টের সামনে দিয়ে যেতে হবে তাকে। সমস্যা হতে পারে কিছু। সে এখন কোনো ঝামেলা চায় না। বড় ক্লান্ত লাগছে। সবকিছুই বিরক্তিকর বলে মনে হচ্ছে।

সে তার টুপি খুলে হাত জোড় করে মুঠো করে দাঁড়াল মধ্যাহ্নের ঘণ্টা শুনে। বুড়ো ফিঙ্ক আর বাচ্চাটাও ঘণ্টা শুনে তাই করল। কফিন বানাচ্ছিল যে ছুতোর, সেও কাজ ফেলে, যন্ত্রপাতি দূরে সরিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়াল। যে মহিলা সব্জি বেছে কাটছিল উঠোনে বসে, সেও ঝুড়ি সরিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়াল উঠোনে। সর্বসমক্ষে প্রার্থনা করতে মানুষ আর আজকাল লজ্জা পায় না। যদিও পুরো ব্যাপারটা অসহ্য বিরক্তিকর মনে হল তার নিজের কাছেও। সে নিজেও অতীতে প্রার্থনা করেছে, তবে একান্তে। ইলোনাও প্রার্থনা করতো। ভারি ধর্মপ্রাণ বুদ্ধিমতী মহিলা ছিল সে। সে খুব সুন্দরী ছিল, জ্ঞানগম্যি বেশ ভালো ছিল। ইলোনার এতটাই ধর্মে মতি ছিল যে পুরোহিত বা ধর্মযাজকদের দেখেও তার ধর্মবিশ্বাস এতটুকু টলে যায়নি। ফাইনহালস নিজে যখন প্রার্থনা করত, সে লক্ষ্য করেছে অভ্যাসবশত সে ঈশ্বরের কাছে কিছু না কিছু চাইতো, যদিও তার সেরকম বিশাল কোনো চাহিদা ছিল না। এখন তো ইলোনা আর নেই, সে মৃত। ফলে এখন ফাইনহালস যদি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, তাহলে সে কী চাইবে? ইলোনা যাতে তার কাছে ফিরে আসে, সেইজন্য সে অতীতে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতো। সে এখন বাড়ি ফিরতে চায় শান্তিতে; তাই নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরবার জন্য প্রার্থনা করল ঈশ্বরের কাছে। যারা নিয়মিত প্রার্থনা করে ঈশ্বরের কাছে, ফাইনহালসের সন্দেহ হয় যে তারা প্রতিদিন কোনো না কোনও ইচ্ছে পূর্ণ হবার জন্য, ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য ঈশ্বরের প্রার্থনা করে। কিন্তু ইলোনা তাকে বলেছিল… ‘আমাদের ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা উচিত, যাতে ঈশ্বরের কষ্ট না হয়।’ ইলোনা নাকি কোথায় পড়েছিল এমন ভাবনার কথা; অভূতপূর্ব মনে হয়েছিল তার। এখন ফাইনহালস নিজে প্রার্থনা করছে। প্রার্থনা ঠিকঠাক তখনই হওয়া সম্ভব, যখন মানুষ সেভাবে নিজের ইচ্ছাপূরণের জন্য কিছুই চায় না। সে অতীতে গির্জায় গিয়েছে; কিন্তু কেন কে জানে ধর্মযাজকদের চেহারা, মুখচ্ছবি, তাদের বক্তৃতা দেওয়া ধর্মের বাণী… সবকিছুই তার কাছে অসহ্য বোধ হত। তবে সে ঈশ্বরকে কষ্ট দিতে চায়নি। ঈশ্বর হয়তো ধর্মযাজকদের মুখচ্ছবি এবং বাণী ইত্যাদিতেই ভালো থাকেন। নিজের অজান্তে তার মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। প্রার্থনা শেষ করে হাতজোড়ের মুঠো খুলে টুপিটা ফের পরে নিল সে।

‘ওই যে দেখুন!’ বলে উঠলেন বুড়ো ফিঙ্ক… ‘এখন আবার ওদের অন্য কোথাও চালান করে দিচ্ছে।’ হাইডেসহাইমের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন তিনি। ফাইনহালস দেখতে পেল কফিনের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ট্রাক। ট্রাকে তোলা হচ্ছে সেই অফিসারদের যারা ফিঙ্কদের বাড়িতে ছোট হলঘরে ছিল। সেই অফিসারদের বুকে আঁটা মেডেলগুলো অবধি পাহাড়ের উপর থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তারপর সেই ট্রাকটা খুব তাড়াতাড়ি গাছে গাছে ঢাকা গ্রামের পথ ধরে দূরে মিলিয়ে গেল পশ্চিমদিকে, যেখানে কোনো যুদ্ধের চিহ্নমাত্র নেই…

‘ওরা অবশ্য বলেছিল যে খুব শীগগির একটা পদক্ষেপ নেবে’ বলে উঠলেন ফিঙ্ক, ‘ট্যাঙ্কগুলো দেখতে পাচ্ছেন আপনি?’

‘আশা করি ভাইডেসহাইম শীগগির জয় করে নেবে ওরা’ বলে ফাইনহালস। মাথা নাড়েন বুড়ো ফিঙ্ক, ‘বেশি সময় লাগবে না… তারপর আমাদের সঙ্গে আবার দেখা করতে আসবেন তো?’

‘হ্যাঁ’ বলে ফাইনহালস, ‘মাঝেমাঝেই এসে আপনাদের সঙ্গে দেখা করব।’

‘খুব খুশি হব,’ বলেন বুড়ো ফিঙ্ক… ‘একটু তামাক চলবে নাকি?’

‘ধন্যবাদ!’ বলে ফাইনহালস, সে নিজেই তামাক নিয়ে ভর্তি করে পাইপ। বুড়ো ফিঙ্ক অগ্নিসংযোগ করে দেন তাতে। সবাই তাকিয়ে থাকে পাহাড়ের নিচে ফুলে ফুলে ঢাকা উপত্যকার দিকে। বুড়ো ফিঙ্ক নাতির মাথায় হাত রাখেন।

‘এখন এগোব আমি’ হঠাৎ বলে ওঠে ফাইনহালস, ‘আমাকে যেতে হবে, আমি ঘরে ফিরতে চাই…’

‘যান’ বলে ওঠেন বুড়ো ফিঙ্ক, ‘ধীরে সুস্থে চলে যান, এখন কোথাও কোনো বিপদ নেই।’

ফাইনহালস করমর্দন করে, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!’ বলে সে তাকায় বুড়োর দিকে… ‘অনেক অনেক ধন্যবাদ… আশা করি শীগগির আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে পারব।’ ফাইনহালস শিশুটির সঙ্গেও করমর্দন করে। শিশুটি ভাবুক এবং সন্দিগ্ধ ঘন কালো সরু চোখে তার দিকে চেয়ে থাকে।

‘আপনি কাস্তেটা সঙ্গে নিন’… বলেন বুড়ো ফিঙ্ক, ‘তাহলে আরও ভালো হবে।’

‘ধন্যবাদ’ বলে ফাইনহালস। ফিঙ্কের হাত থেকে কাস্তেটা নিয়ে পথ চলতে শুরু করে সে। একমুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল যে সে কফিনের দোকানের দিকের পাহাড়ের ধাপে চড়তে শুরু করেছে। কিছুদূর গিয়ে একদম পরিষ্কার চকচকে হলদে কাঠের বাক্স দেখা যাচ্ছিল। দূরবিন দিয়ে দেখলে যেমন আরও বড়, আরও পরিষ্কার দেখা যায়, তেমনি পরিষ্কার সে দেখতে পাচ্ছিল খালি চোখেই কফিনের দোকানের উঠোনটা, যতক্ষণ না সে ডানদিকে বেঁকে গ্রাম পেরিয়ে যাবার পথটা ধরল। ধীরে ধীরে স্কুল থেকে ছুটির পর বেরিয়ে আসা ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ের মধ্য দিয়ে গিয়ে বেরিয়ে গেল সে হাইডেসহাইম থেকে। বাদাবনের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যাবার কোনো ইচ্ছে ছিল না তার। খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার সেটা তার কাছে। তাছাড়া একবার ডানদিকের পথ ধরে আবার ঘুরপথে বাঁয়ে গেলেই লোকজনের সন্দেহ আরও বেশি হবে।

সোজা পথটা যেটা উপত্যকার ফলের বাগানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটা ধরল সে। পথটা শান্ত, চুপচাপ। তার একশ মিটার সামনেই সে কাস্তে হাতে আরেকজন মানুষকে দেখতে পেল।

ভাইডেসহাইমে ঢুকবার মুখে আমেরিকান প্রহরী আছে দু জন। স্টিলের হেলমেট খুলে সিগারেট খাচ্ছে তারা। ফুলে ফুলে ঢাকা গাছগাছালির মাঝে দাঁড়িয়ে খুব একঘেয়ে লাগছে তাদের, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ফাইনহালসের দিকে তাকালই না তারা। তিন সপ্তাহ ধরে তারা এখানে থানা গেড়ে বসে আছে, তার মধ্যে গত দুই সপ্তাহে ভাইডেসহাইমের দিকে একটাও গুলিগোলা চলেনি। ফাইনহালস শান্তভাবে প্রহরীদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় একবার মাথা নাড়ল। প্রহরীরাও নির্বিকারভাবে মাথা নাড়ল তার দিকে চেয়ে।

আর মাত্র মিনিটদশেক যেতে হবে তাকে। বাগানের মধ্য দিয়ে সোজা, তারপর বাঁয়ে হয়সার আর হোপেনরাথের বাড়ি পেরিয়ে প্রধান সড়ক দিয়ে একটু নিচু ঢালে গেলেই বাড়ি। পথে হয়তো চেনা কারো সঙ্গে দেখা হতে পারে। কিন্তু কারো সঙ্গেই দেখা হল না পথে। চারদিক অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ। শুধু দূরে ট্রাকের শব্দ শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। তবে এখন মনে হয় না কেউ গুলিগোলা ছুঁড়বার কথা ভাবছে। প্রতিদিন যেমন হুঁশিয়ারি দেবার মত করে গ্রেনেড ছোঁড়ে এরা, সেসবও আজ বন্ধ।

ইলোনার কথা মনে এলো তার। এই মনে হওয়ার সঙ্গে কিছুটা তিক্ততা লেগে আছে। তার মাঝে মাঝে মনে হয় যে ইলোনা তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। কোথাও পালিয়ে গেছে হয়তো। মরে গেছে? মরে গেছে… মরে যাওয়াটাই যেন একমাত্র সোজা কাজ। এখন তো ইলোনার তার সঙ্গেই থাকার কথা ছিল। তার মনে হয়েছিল যে একমাত্র ইলোনাই তার সঙ্গে থাকতে পারে। কিন্তু হয়তো সেও বুঝেছিল, যে প্রেম অল্প কিছু মুহূর্তের জন্য সত্যি, তার উপর ভর করে জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়া চলে না। একসঙ্গে বৃদ্ধ না হওয়াই ভালো। তাহলে সে প্রেম নষ্ট হয়ে যায়। চিরদিন একসঙ্গে কাটাবার মত যে প্রেম, সেটা কিছুটা আলাদা রকমের হবে হয়তো। ইলোনা অনেক কিছু জানত, যেটা সে জানে না। তার হঠাৎ নিজেকে বঞ্চিত বলে মনে হল। কারণ, সে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি ফিরবে, সেখানে থাকবে, খুব বেশি কাজ করবে না, পড়বে, এবং প্রার্থনা করবে যাতে ঈশ্বরের কষ্ট না হয়, এমন কিছু চাইবে না ঈশ্বরের কাছে নিজের ক্ষুদ্রস্বার্থের জন্য… টাকাকড়ি, সাফল্য, আর যা কিছু মানুষ জীবনে চায় আর কি! তাছাড়া এমন কোনো বিল্ডিং বানানো, যেটা শুধুমাত্র সে বানাতে পারে, এরকম কিছু অবশ্য যে কোনো মধ্যমেধার আর্কিটেক্ট বানিয়ে দেবে। ফলে কী আর চাইবে সে?

হোপেনরাথদের বাগানের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে তার মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল… এরা এখনও বাগানের গাছে সাদা রঙের মিশ্রণটা লাগিয়ে দেয়নি, যেটা ফাইনহালসের বাবা গাছে দিতে বলতেন সবাইকে, সেটা দেওয়া নাকি ভীষণ দরকারি। বুড়ো হোপেনরাথের সঙ্গে এই নিয়ে ঝামেলা হত তাঁর। কিন্তু বুড়ো হোপেনরাথ এখনও রঙ লাগায়নি গাছগুলোতে।

এখন আর খুব বেশি দূরে নয় তার ঘর। বাঁয়ে হয়সারদের বাড়ি, ডাইনে হোপেনরাথদের। এখন মাঝের সরু গলিটা দিয়ে কিছুটা যেতে হবে। তারপর প্রধান সড়ক ধরে একটু বাঁয়ে নিচু ঢালে নামলেই তাদের বাড়ি। হয়সারদের বাগানের গাছে সাদা রঙটা লাগানো হয়েছে। সে মুচকি হাসল। তারপরেই সে গোলার শব্দ শুনতে পেল পরিষ্কার। সে সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল মাটিতে। একটু হাসবার চেষ্টা করল, কিন্তু আবার একই সঙ্গে ভয় পেয়ে গেল, কারণ গোলাটা হোপেনরাথদের বাগানে পড়েছে। গোলাটা বাগানের কোনো একটা গাছে গিয়ে পড়েছে, আর গাছগুলো থেকে ঝরঝর করে বৃষ্টির মত সাদা ফুল ঝরে পড়ছে উপত্যকার মাটিতে। দ্বিতীয় গোলাটা অনেকটা দূরে কোথাও পড়ল, সম্ভবত বয়মারদের বাড়ির কাছাকাছি, যেটা তাঁর বাবার বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে। তৃতীয় এবং চতুর্থটাও ওইদিকেই পড়ল, তবে আরেকটু বাঁয়ে এবং এই দুটো ততটা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নয় আগেরগুলোর মত। সে ধীরে ধীরে উঠল। পঞ্চমটাও ওই দিকেই পড়ল। সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। সব চুপচাপ। কেবলমাত্র সারা গ্রামের কুকুরগুলো ডাকতে শুরু করেছে। হয়সারের খামারের হাঁসমুরগিগুলো সন্ত্রস্ত হয়ে ডানা ঝাপটে যাচ্ছে। অন্য কোনো খামারে গরুর দল প্রবল ভীত কণ্ঠে হাম্বারব জুড়ে দিয়েছে। সে ভাবতে লাগল… এই গোলাগুলি বর্ষণ একেবারে অর্থহীন… অর্থহীন।

তবে হয়তো ওরা সেই আমেরিকান গাড়িটাকে লক্ষ্য করে গোলা ছুঁড়ছে। সেই গাড়িটা ফিরে যাবার শব্দ পায়নি সে। কিন্তু বড় রাস্তার কোণে যখন সে পৌঁছালো, সেখানে কোনো গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল না। ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখের প্রেমিক এতক্ষণে ফিরে গেছেন। রাস্তাটা একদম খালি। শুধু গরুদের হাম্বারব এবং কুকুরের ঘেউঘেউ ছাড়া পথে বাকি কয়েকটা পদক্ষেপে তাঁর সঙ্গে আর কেউ বা কিছুই নেই।

এই পথে শুধুমাত্র তার বাবার বাড়িটাতেই সাদা পতাকা টাঙ্গানো আছে। পতাকাটা বেশ বড়। মাঝেমধ্যে বাড়িতে অনুষ্ঠান হলে, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব এলে যে টেবিলক্লথটা আলমারি থেকে মা বের করতেন, সেই টেবিলক্লথ দিয়েই পতাকাটা বানানো হয়েছে। মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠল তার আবার। কিন্তু হঠাৎ পরক্ষণে মাটিতে শুয়ে নিজেকে ছুঁড়ে দিতে দিতেও বুঝতে পারল সে যে একটু দেরি হয়ে গেছে। এসব গোলাগুলি একদম অর্থহীন… ভাবল সে… একেবারে অর্থহীন।

ষষ্ঠ গোলাটা গিয়ে লেগেছে তার বাবার বাড়ির ত্রিকোণ ছাদের গায়ে। বাড়ির দেওয়াল থেকে পাথর, প্লাস্টার খুলে রাস্তায় ছিটকে ছিটকে পড়ছে। সে শুনতে পেল বাড়ির মাটির নিচে সেলারের ঘর থেকে তার মায়ের আর্তচিৎকার। সে তাড়াতাড়ি হামাগুড়ি দিয়ে বাড়িটার দিকে যাবার চেষ্টা করল। সপ্তম গ্রেনেডটা পড়বার আগে সে নিজেই চেঁচিয়ে উঠেছিল জোরে। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল তার যে মরে যাওয়াটা একেবারেই সোজা ব্যাপার নয়। ওই গোলাটা তার শরীরে আঘাত করবার কয়েক সেকেন্ড আগে সে আর্তনাদ করে গড়াতে গড়াতে পৌঁছে গিয়েছিল তার বাড়ির চৌকাঠের ঠিক সামনে। পতাকার দণ্ডটা ভেঙে সাদা কাপড়টা উপর থেকে মাটিতে পড়ে ঢেকে দিয়েছিল তার শরীর। (শেষ)

0 comments: