ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক১৩
খুব জোরে ব্রেকে চাপ দিল লোকটা নিচ থেকে। পরিষ্কার বোঝা গেল। ছন্দবদ্ধ একটা ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে থামতে লাগলো নৌকার দুলুনি। দোলনাটা থেমে গেল একদম। সে বুঝতে পারছে যে তাকে ভীষণ হাস্যকর দেখাচ্ছে, শোচনীয় অবস্থা তার। সে ধীরে ধীরে উঠে নেমে এলো দোলনাটা থেকে। পেট গোলানো বন্ধ হয়েছে, কিন্তু জিভে একটা বিশ্রী স্বাদ। মাথাটা এখনও ঘুরছে। সে চোখ বন্ধ করে একটা সিঁড়ির উপরে বসে পড়ল। এই দুলুনির ছন্দটা এখনও রয়েছে তার চোখের মধ্যে। সে বুঝতে পারছে তার চোখের তারা এখনও ঘুরছে। সে থুথু ফেলল একটু। ধীরে ধীরে চোখের তারা স্থির হতে লাগলো। সে উঠে গিয়ে তুলে নিয়ে এলো উড়ে যাওয়া টুপিটা। লোকটা তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা নির্বিকারভাবে তাকে দেখছিল। তারপর লোকটার বউ হঠাৎ দৌড়ে এলো। সামনে আসার পরে গ্রেক অবাক হয়ে গেল বউটাকে দেখে। কী ছোটখাট চেহারা! কালো গায়ের রঙ, মুখচোখ একদম হাভাতে ধরনের। হাতে একটা মগে করে কী যেন নিয়ে এসেছে। ব্লন্ড লোকটা মগটা গ্রেকের হাতে ধরিয়ে দিল।
‘খেয়ে নিন!’ অদ্ভুত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল লোকটা। গ্রেক মাথা নাড়ল।
‘খেয়ে নিন।’ আবার বলে উঠল লোকটা… ‘একটু ভালো বোধ করবেন।’
গ্রেক মগটা নিল। পানীয়টা খেতে তিতকুটে, কিন্তু বেশ ভালো লাগছে ওর এখন। লোকগুলো হাসল। ওরা যান্ত্রিকভাবে হাসল। আসলে মানুষের চোখে চোখ পড়লে হাসতে হয়। এটাই নিয়ম। এমন নয়, যে তোমাকে ওরা ভালবাসে কিম্বা সংবেদনশীল, এই কারণে হাসছে। গ্রেক উঠে দাঁড়ালো।
‘ধন্যবাদ’ বলে উঠল গ্রেক। তারপর পকেট হাতড়াতে লাগলো। কিন্তু পকেটে টাকাকড়ি কিছু ছিল না। ছিল সেই বিশাল অঙ্কের বিলটা। সে নিরুপায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল। সে বুঝতে পারল যে তার মুখচোখ লাল হয়ে উঠছে।
‘ঠিক আছে।’… বলল লোকটা… ‘ঠিক আছে।’
‘হাইল হিটলার!’* বলে উঠলো গ্রেক।
লোকটা শুধুমাত্র মাথা নাড়ল।
গ্রেক পিছনে ফিরে তাকাল না। খুব ঘামছে সে আবার। রোমকূপ থেকে ফেটে ফেটে বেরচ্ছে স্বেদ। মনে হচ্ছে সে নিজেই ফেটে পড়বে বিস্ফোরণের মত। বাজারের কাছেই একটা সরাইখানা আছে। একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে পারলে ভালো হত।
সরাইখানার ভেতরে খাবার ঘরটা আশ্চর্যজনকভাবে ঠাণ্ডা, অথচ একটা বাসি টকগন্ধে ভরা। ঘরটা প্রায় ফাঁকা। গ্রেক লক্ষ্য করলো যে কাউনটারের ওপাশে বসে থাকা লোকটা তার বুকের কাছে মেডেলগুলোর দিকে তাকাল। লোকটার চোখগুলো নির্লিপ্ত, কিন্তু রাগত শত্রুসুলভ নয়। না, চোখগুলো ঠিকঠাক। বাঁ দিকের কোণের টেবিলে এক প্রেমিকযুগল বসে আছে। সামনে এঁটো প্লেট, ওয়াইনের ডিক্যানটার, আবার বিয়ারের বোতলও আছে। গ্রেক ডানদিকে বসল, যাতে রাস্তাটা দেখতে পাওয়া যায়। একটু ভালো বোধ করছে সে এখন। তার ঘড়িতে এখন একটা বাজে। সে ভোর ছটা নাগাদ বেরিয়েছে। কাউন্টারের পিছন থেকে লোকটা বেরিয়ে ধীরে ধীরে এসে তার কাছে দাঁড়াল। গ্রেক ভাবতে লাগলো কী খাবে। আসলে তার সেরকম কিছু খাবার ইচ্ছেটাই নেই। একটু পরিষ্কার হতে পারলে ভালো হত। সে মদ খাওয়া নিয়ে ভাবিত নয়, তাছাড়া সে মদ পছন্দ করেনা সেরকম। তার মা কোনো কারণ ছাড়াই তাকে ওসব খেতে বারণ করে দিয়েছিলেন, বা নাগরদোলা চড়তে বারণ করেছিলেন, ব্যাপারটা এতখানি সহজ নয়। যে লোকটা তার সামনে দাঁড়িয়েছিল, সে আবার তার বুকের বাঁ দিকে প্রথমে তাকাল।
‘হ্যাঁ, বলুন’ বলে উঠলো লোকটা… ‘কী নেবেন?’
-‘কফি’ বলল গ্রেক… ‘আপনারা কফি রাখেন তো?’ লোকটা গ্রেকের বুকের বাঁ দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই মাথা নাড়ল ইতিবাচকভাবে। ‘আর একটা ব্রাণ্ডি’… বলে উঠল গ্রেক। কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে। প্রথমেই যদি বলতো সেটার একটা অর্থ হত।
-‘কোন ব্রাণ্ডি?’ লোকটা প্রশ্ন করল।
- ‘অ্যাপ্রিকট’
লোকটা চলে গেল। লোকটা মোটা। ভুঁড়ির নিচে ট্রাউজারটা ফুলে ফুলে উঠছে আর লোকটা চপ্পল পরে আছে। একদম অস্ট্রিয়ানদের স্বভাবসিদ্ধ অগোছালো ব্যাপারস্যাপার যতসব, ভাবল গ্রেক। সে প্রেমিকযুগলের দিকে তাকাল। প্লেটে উচ্ছিষ্ট খাবারের উপরে মাছি উড়ছে। কাটলেটের হাড়, মুষড়ে পড়া লেটুসপাতা, সব্জির স্তুপ পড়ে আছে সামনে বাটিতে। এত খাবার নষ্ট করেছে। অসহ্য… ভাবল গ্রেক।
এক সৈনিক ঢুকল। উদ্বিগ্নচোখে তাকাল চারদিকে। গ্রেককে সম্ভাষণ জানাল। চলে গেল বারের দিকে। সৈনিকটির কোনও মেডেল নেই। কিন্তু তার চোখে এক অদ্ভুত দাক্ষিণ্য, যেটা গ্রেককে বিরক্ত করে তুলল। হয়ত সৈনিকটা ভাবছে অফিসার হিসেবে আমার আরও মেডেল থাকা উচিত ছিল। সুন্দর সুন্দর সোনা রূপা, হাঙ্গেরির শিশুদের মাথার মতন বড় বড়… ধুত্তোর। এসব কেন ভাবছে সে? তার কি মেডেলগুলো পরে থাকা উচিত নয়? সে সুন্দর, ব্লন্ড, লম্বা… ধুর… যত বাজে ব্যাপার। সে বাইরের দিকে তাকাল।
যে মহিলা অ্যাপ্রিকট বেছে বেছে গুছিয়ে রাখছিল, তার কাজ প্রায় শেষের দিকে। গ্রেক হঠাৎ বুঝতে পারল এই মুহূর্তে তার ঠিক কী খেতে ইচ্ছে করছে। ফল- হ্যাঁ, ফল খেলে তার উপকার হবে। ফলের দাম সস্তা হলেই মা সবসময় তাকে অনেক ফল খেতে দিতেন। হ্যাঁ, তার শরীরের জন্য ফল খুব উপকারী। ফল এখানে সস্তা ছিল, তাছাড়া তারও পয়সাকড়ি ছিল… ফল, তার হঠাৎ ফল খেতে ইচ্ছা করল খুব। পয়সাকড়ির কথা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে বাধা পড়ল তার চিন্তার স্রোতে। হঠাৎ থেমে গেল তার ভাবনাটা। আবার ভীষণ ঘাম হতে লাগল। কিছু হবে না যদি সে অস্বীকার করে… হ্যাঁ নির্মমভাবে ব্যাপারটা অস্বীকার করতে হবে। কেউ ওই নোংরা ইহুদীগুলোকে বিশ্বাস করবে না, যদি ওরা বলে যে ওদের কাছেই গ্রেক নিজের প্যান্ট বিক্রি করে এসেছে।
কেউ বিশ্বাস করবে না, যদি সে ব্যাপারটা অস্বীকার করে। যদি কখনো ভবিষ্যতে এটা ধরা পড়ে যে প্যান্টের মালিক সে, এরকম কিছু বলে দেবে যে ওটা চুরি গেছে… কিম্বা যাহোক কিছু একটা বলবে। কিন্তু এত ঝামেলা হবেই বা কেন? কীভাবে ধরা পড়বে ব্যাপারটা? এই চিন্তাটা হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মত তার বুদ্ধিকে আঘাত করল। হ্যাঁ, সবাই তো কিছু না কিছু বিক্রি করছে। সবাই। ট্যাঙ্কের ফুয়েল থেকে শুরু করে শীতের জামাকাপড়--- এসব গেল কোথায়? তাছাড়া সে তো নিজের প্যান্ট বিক্রি করেছে, অন্য কারো বাপের সম্পত্তি তো নয়। তার নিজের খরচে মাস্টার টেলার গ্রুঙ্ককে দিয়ে বানিয়েছিল প্যান্ট।
এই এত পেংগো আসছে কোথা থেকে? যেমন এই যে নির্লজ্জ ছোটলোক লেফটেন্যান্ট, নিজের ঘরে শুয়ে থাকে। বিকেলে ক্রিম কেক খায়, সন্ধেবেলা আসল হুইস্কি খায়, মেয়েমানুষদের ঘরেও যাতায়াত আছে, যেকোনো সিগারেটে মন ওঠে না, কেবলমাত্র একটা বিশেষ ব্র্যান্ড, যেটার দাম খুব বেশি- সেটাই খায়। এসব লপচপানি, এত ফুটানি কীভাবে করছে? যা বেতন পায় তারা, তাতে এতসব হয়?
গোল্লায় যাক সব, সে ভাবে। আমিই বোকা, সবসময় ভীষণ বোকা। সবসময় ভদ্র আর নিয়মানুবর্তী। আর বাকিরা সব আহ্লাদে থাকে। আমারই অভিশপ্ত জীবন।
‘ধন্যবাদ’- বলে ওঠে গ্রেক।
কফি আর ব্রাণ্ডি নিয়ে এসেছে লোকটা… ‘আর কিছু খাবেন?’
কফির স্বাদটা অদ্ভুত। চুমুক দেয় সে। হাল্কা, অদ্ভুতরকমের হাল্কা যেন কফির মত সহানুভূতি জানাবার একটা বিকল্প। ব্রাণ্ডিটা ঝাঁঝালো বেশ। কিন্তু সেটা খেয়ে ভালো লাগলো তার। সে ধীরে ধীরে, ফোঁটা ফোঁটা করে পান করতে লাগল।
সেটাই। ওষুধের মত খেয়ে যেতে হবে তাকে মদ… সেটাই করতে হবে। বাজারে অ্যাপ্রিকটের লালচে কমলা স্তূপটা উধাও হয়ে গেছে। গ্রেক লাফ দিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। মুখ ফিরিয়ে সরাইখানার কাউনটারে বসে থাকা লোকটাকে বলে সে… ‘এক মিনিট, এখুনি আসছি।’
বুড়ি মহিলা, যে অ্যাপ্রিকট বেছে গুছিয়ে রাখছিল, সে তার গাড়িটা নিয়ে ধীরে ধীরে বাজারের চৌমাথায় নাগরদোলার কাছে পৌঁছে গেছে। গ্রেক তাকে থামাল। বুড়ির চওড়া, কাটাকাটা মুখ রোদ্দুরে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। এককালে খুব সুন্দরী ছিল, সেটা বোঝা যায়।
-‘ফল’--গ্রেক গাড়ির কাছে গিয়ে বলে… ‘আমাকে অ্যাপ্রিকট দিন।’
বুড়ি হেসে ওঠে। হাসিটা কেমন যেন শীতল।
(চলবে)
* হাইল হিটলার- শব্দবন্ধের অর্থ ‘হিটলার দীর্ঘজীবী হোন। নাৎসিবাহিনীর প্রতিদিনের জীবনযাপনের সম্ভাষণ ছিল এই শব্দবন্ধটি।
0 comments: