1

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in



পর্ব (৩)

বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দী মৃত্যুশয্যায় দুটি অদ্ভূত সিদ্ধান্ত নিলেন। আমীর ওমরাহ্ এমনকি পারিবারিক অসন্তোষকে একরকম উপেক্ষা করেই তৃতীয়া কন্যা আমিনা বেগম ও ভ্রাতুষ্পুত্র জৈনুদ্দিন আহমেদের ঔরসজাত সন্তান সদ্যযুবা তাঁর প্রিয়তম দৌহিত্র মির্জাকেই নবাবী মসনদের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে দিলেন আর একই সঙ্গে সেই স্পর্ধিত উন্নাসিক যুবাটিকে তার যৌবনমদে মত্ততার সুস্থিতির জন্য কোরাণ ছুঁয়ে শরাব পান পরিহার করার অঙ্গীকারটিও আদায় করে নিলেন একইসাথে। সেই কটক অভিযানের সময়ই আলীবর্দী তাঁর সদাপ্রিয় মির্জার মধ্যে মসনদে বসার যোগ্য সম্ভাবনাটি দেখেন, কিন্তু তার উদ্ধত বেপরোয়া আর দুর্বিনীত স্বভাবটি যে তাঁর জীবদ্দশায়ও যে শেষমেশ রয়েই গেল এই আক্ষেপটির সঙ্গে অতিরিক্ত অন্ধ প্রশ্রয়দানের অভিযোগের দূর্নামটিও সাথে নিয়েই তাঁকে ভাগীরথীর অপর পাড়ে খোশবাগে চিরশয্যাটি পাততে হল।

এদিকে বাংলাদেশের সম্পদের প্রাচুর্য তখন প্রলুব্ধ করেছে ইওরোপীয় বণিকদের। চুঁচুড়ায় ওলন্দাজরা, শ্রীরামপুরে দিনেমাররা, হুগলি আর করকাতায় ইংরেজরা আর চন্দননগরে ফরাসীরা আস্তে আস্তে কুঠি তৈরী করে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এদের সবাইকে প্রতিযোগিতায় পিছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে আসছে ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীই। রাজমহল, কাশিমবাজার,কলকাতা আর পাটনা মিলিয়ে তাদের সোরা,বারুদ, নুন আর কাপড়ের ব্যবসায় তখন বেশ পালে হাওয়া লেগেছে। জোব চার্ণকের গরিমা যদিও তখন অস্তমিত। জামাতা চার্লস কোম্পানীর অ্যাডভাইসারি বোর্ডে রয়েছেন নাম কা ওয়াস্তে। নিজে আপাতত সুদের কারবারে মন দিয়েছেন। এই মুহূর্তে কোম্পানীর নতুন মুখপাত্র হল তিন নবীন শ্বেতাঙ্গ মূর্তি। ক্লাইভ, ওয়াটস্ আর উইলসন্। মূর্শিদাবাদের আকাশ বাতাসে আজকাল কান পাতলে ফিসফিসিয়ে দিনবদলের খবর ঘুরপাক খাচ্ছে। তলে তলে রফা নিষ্পত্তি হচ্ছে ভাগ বাঁটোয়ারার। নবাবী মসনদটি এবার যেন টলে উঠবে!

ভারত প্রাতঃস্নান সেরে গুড় ও চিঁড়ে দিয়ে আজ ফলার করছিল। কাল সন্ধ্যেবেলায় দত্তদের বাড়িতে পূর্ণিমার স্বস্ত্যয়ন বিহিত পুজোর সিধেটুকু সে ব্রাহ্মণ বলেই সসম্মানে লাভ করেছে। এখনো বেশ কটি মোটা মোটা সবরী কলা আর একটি ছোট ধামায় বিন্নিধানের খইও ঘরে রাখা আছে। ব্রাহ্মণভোজনের এই একটা সুবিধা খাওয়ার পরও খানিকটা ছাঁদা বেঁধেও নিয়ে আসা যায়। ইতিমধ্যে রাধা নদীঘাট থেকে সদ্য স্নান সেরে ফিরেছে। ফলার খেতে খেতেই ভারত তার সিক্তবসনা যুবতী তনুটি মুগ্ধদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে থাকে। রাধার দৈহিক রূপান্তরটি তাকে আজকাল বড়ই আনন্দ দেয়। এই কদিন আগেই সে একটি সাধারণ ছোট্ট বালিকাই ছিল বলা যায়, আজ তার সেই দেহটিকে ঘিরে পুষ্পধনুর পেলব আল্পনা জেগে উঠেছে। স্বামীর স্থির দৃষ্টিপাতে সলজ্জ রাধা চকিতে ঘরে ঢুকে দোর বন্ধ করে। সে ভালই জানে ভারতের প্রেমোদ্দীপনা জাগলে এক্ষুণি তার ক্ষুদ্র সংসারটির দৈনন্দিন সব কাজ সকাল সকাল শিকেয় উঠবে। ভারত তক্ষুণি নিমেষে উঠে গিয়ে দরজায় মৃদু করাঘাত করে ঠিক দু'বার। ভেতরে রাধা মনে মনে প্রহর গোণে একটি আসন্ন কালবৈশাখী ঝড়ের। নববধূর ব্রীড়ায় দরজাটি খুলে সে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে থাকে। সুচারু দন্ততে সে অধরটি দংশন করে আর আনত দৃষ্টিতে মাটির দিকে চেয়ে থাকে। ভারত ভাববিহ্বল হয়ে সেই ক্ষীণকটি সুতনুকাকে সবলে নিজের কোলে তুলে নিয়ে তার কানের লতিতে মৃদু মৃদু দংশন করতে থাকে । ধীরে ধীরে বস্ত্রমোচনের পর এক স্বাদু প্রণয়লীলায় উভয় নিমজ্জ্বিত হয়। মিলন শেষে রাধার কপালের অবিন্যস্ত চুলগুলি যত্নকরে নিজের হাতে সরিয়ে দিতে দিতে ভারত রাধার কানের কাছে মুখ এনে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করে,

বিনাইয়া বিনোদিয়া বেণীর শোভায়
সাপিনী তাপিনী তাপে বিবরে লুকায়
কে বলে শারদশশী সে মুখের তুলা
পদনখে পড়ি তার আছে কতগুলা
কি ছার মিছার কামধেনু রাগে ফুলে
ভুরুর সমান কোথা ভুরু-ভঙ্গে ভুলে !

এরপর দুই যৌবনউৎসুক নরনারী সকালের আকস্মিক প্রীতি ও স্মরোদ্দীপনার প্রাবল্যে একে অপরেতে আরো একবার জোরালো রতিবাসরে নিবিষ্ট হয়ে ওঠে।


আদিগঙ্গা (অন্যান্য নাম গোবিন্দপুর খাঁড়ি বা সারম্যানের নালা বা টালির নালা) হল বঙ্গদেশের প্রাণস্বরূপা। কলকাতা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একটি ছোটো নদী। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই নদীটিই ছিল হুগলি নদীর প্রধান ধারা। পরে এই ধারাটি ক্ষীণ হয়ে আসে। ভাগীরথী খাতে প্রবাহিত গঙ্গা নদীর নিম্ন প্রবাহটি একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যেমন ছিল, তেমনটি আগে ছিল না। বহু প্রাচীনকালে গঙ্গা-ভাগীরথী আরও পশ্চিম দিকে রাজমহল, সাঁওতালভূমি, ছোটনাগপুর, মানভূম, ধলভূমের তলদেশ দিয়ে সোজা দক্ষিণবাহিনী হয়ে সমুদ্রে পড়ত এবং এই প্রবাহই ছিল অজয়, দামোদর ও রূপনারায়ণের সঙ্গম। এই নদী তিনটিই তখন নাতিদীর্ঘ।ভাগীরথী প্রবাহের দক্ষিণতম সীমায় অধুনা তমলুকে ছিল একদা তাম্রলিপ্ত বন্দর। এর পরবর্তীকালে গঙ্গার ক্রমশ পূর্বদিকে যাত্রা শুরু হলে তাম্রলিপ্ত বন্দর পরিত্যক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ফরাক্কা থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত গঙ্গা-ভাগীরথী ব্যান্ডেলের কাছে ত্রিবেণীতে তিনটি শাখায় ভাগ হয়ে যেত। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সপ্তগ্রামের পাশ দিয়ে বজবজ, ফলতা, ডায়মন্ডহারবার হয়ে সমুদ্রে পতিত হত সরস্বতী নদী। তাম্রলিপ্ত বন্দর পরিত্যক্ত হওয়ায় এই নদীর তীরে গড়ে ওঠে সপ্তগ্রাম বন্দর। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বয়ে যেত যমুনা নদী (উল্লেখ্য, এই নদীটির সঙ্গে উত্তর ভারতের যমুনা নদী বা বাংলাদেশের যমুনা নদীর কোনো সম্পর্ক নেই), মাঝখান দিয়ে বইত হুগলি নদী। এখন যেখানে কলকাতা শহর সেখানে হুগলি নদী বাঁক নিত (নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে হুগলি নদী বেতড়ের কাছে বাঁক নিত যেটি বর্তমানে গার্ডেনরিচের ঠিক উল্টোদিকে শিবপুর থেকে আর কালীঘাট, বারুইপুর, মগরা, গোচরণ, জয়নগর, দক্ষিণ বিষ্ণুপুর, ছত্রভোগ, বড়াশী, খাড়ি, কাশীনগর ও কাকদ্বীপের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম সাগরদ্বীপে (সম্ভবত এই সাগরদ্বীপে প্রাচীন বীর বাঙালি জাতি গঙ্গারিডিদের রাজধানী 'গঙ্গে ' বন্দরের অবস্থান ছিল) প্রবেশ করে ধবলাট ও মনসা দ্বীপের মধ্য দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে মিশত। এই আদি খাতটিকেই বলা হয় আদিগঙ্গা। ইতিহাসের ধারার মত এই নদীটিও বারবার বদলেছে গতিপথ আর সাথে সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তথা ইংরেজদের বিজয়যাত্রায় এই নদীটির গুরুত্ব অপরিসীম। এরই একটি অংশে জলঙ্গীর বুকে দক্ষিণমুখে অদূরে একটি বজরা দেখা গেল। ওটির ভিতর অক্ষম রাগ ও অপমানে মুখটি লাল করে বসে আছেন কৃষ্ণনগরের রাজা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। সঙ্গে আছে তাঁর একমাত্র বিশ্বস্ত অনুচর হুকুমচাঁদ। আজ বিজয়া দশমী। মতিঝিলে নবাবের বন্দীশালা থেকে ছাড়া পেয়ে আজ ভোরেই কৃষ্ণনগরের পথে যাত্রা করেছেন। জলঙ্গির দুধারের গ্রাম গুলোয় দু একটা প্রতিমার নিরঞ্জন শুরু হয়ে গেছে । রাগে, আক্ষেপে তাঁর নিজের দুএকগাছা মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। আলীবর্দীর দৌহিত্রটি নবাবী মসনদে বসে হাতে মাথা কাটছে যেন সবার। আমীরচন্দ্ এর মত মানী ওমরাহ্ কেও যে অপমান করে সর্বসমক্ষে তার যে নবাবীর মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে তা বলা বাহুল্য। খোদ নবাবী কোষাগার আর কোম্পানির হুন্ডি দুটোতেই জগৎশেঠ আর আমীরচন্দ্ দের টাকা সুদে খাটে। আহাম্মকটা তাকেও চটিয়েছে। এবছর নিজের মহলের খাজনার পরিমাণে একলক্ষ টাকা কম পড়ায় সেই মহালয়ার দিন থেকে কৃষ্ণচন্দ্রকে মূর্শিদাবাদে ডেকে এনে যাচ্ছেতাই অপমান করে একরকম নজরবন্দী করেই রেখেছিল হারামজাদাটা।এই সাতদিনের বন্দীদশায় অসহায়ের মত পেরিয়ে যেতে দেখলেন শারদীয়া পূজার তিথিটি। এই প্রথমবার কৃষ্ণনগরে তাঁর ভদ্রাসন 'শিব নিবাসে' জগন্মাতা রাজরাজেশ্বরীর পূজাটি সম্ভবপর হল না। কৃষ্ণনগরে ফিরেই একবার মহারাজা নন্দকুমার, আমীরচন্দ্, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, জানকীরাম এইসব ক্ষমতাবান পয়সাওলা মানুষজনদের সাথে বসে একটা শলাপরামর্শ করে এই মির্জা বজ্জাতটাকে শায়েস্তা করতেই হবে।

এতক্ষণে বজরাটা জলঙ্গীর সীমানা পার করে চূর্ণীর বাঁকে এসে বাঁদিকে ঘুরল। আর আধবেলার মধ্যেই কৃষ্ণনগর পৌঁছনোর কথা। মাঝিদের সর্দার লতিফ মিঞা বিনীত কন্ঠে আর্জি জানায়

" হুজুর! এখানে ঘন্টাটাক নোঙর ফেলতি হয় যে! দুটো ভাতে ভাত তবে ফুটায়ে নি কত্তা!"

কৃষ্ণচন্দ্র সম্মতি দিয়ে ঘাড় নাড়লেন।অনেক ভোরে বেড়িয়েছেন বলে তাঁরও বেশ ক্ষুধাবোধ হচ্ছে। অথচ এখানকার বাজারের কোন খাবারের প্রতি তাঁর রুচি নেই। হুকুমচাঁদকে বললেন উৎকৃষ্ট দই, চিঁড়ে, গুড়, বাতাস আর কলা কিনে আনতে। আপাতত তাই দিয়েই এখনকার মতো রাজভোগটি উদরস্থ করতে হবে। কৃষ্ণচন্দ্র মানুষটি খাদ্যরসিক ও ঔদরিক। রাজবাড়িতে এই সময় তাঁর একটি হুকুমে অতিপ্রিয় গাওয়া ঘিএর লুচি, মোহনভোগ, সরভাজা আর হিং দেওয়া চাপ চাপ ছোলার ডাল সামনে এসে হাজির হতে পারতো।তার বদলে অবস্থার ফেরে পড়ে ফলারে বামুনদের মতো দইচিঁড়ে গিলতে বসতে হবে। কৃষ্ণনগরের মহারাজার বজরা ঘাটে লাগার খবরে পুরো এলাকাটিতে হুলুস্থুলু পড়ে গেল।


রতনের উচ্চারণে একটু সামান্য গ্রাম্য টান এখনো রয়ে গেছে তবে সে গানের গলার জোরে সেটুকু খামতি যে ঢেকে দেবে তা বলাই বাহুল্য। আরোহণের উঁচু পর্দাতেও তার স্বরভঙ্গ হয়না। আর অভিনয় কুশলতায় আদুরী কিন্তু এই কদিনের অনেকটাই সপ্রতিভ হয়ে উঠেছে। গোলকনাথ সবাইকে পাখি পড়ানোর মত করে পার্ট করা শেখাচ্ছে। গোলক খুব করিৎকর্মা লোক। তার সূত্রেই ক্ষ্যান্তমণি নামে একটি মেয়েকে গরাণহাটার বেশ্যাপাড়া থেকে জোগাড় করে আনা হয়েছে। গোলকের ওপাড়ায় যাতায়াত অাছে গান শেখাবার সুবাদে। এই মেয়েটিই 'হীরামালিনী'র চরিত্রটি করবে। যাত্রা বা খেমটা নাচের ব্যাপারটা ক্ষ্যান্তমণি মোটামুটি জানলেও 'থ্যাটার পালা' বিষয়টা ওর কাছে একদম নতুন। ঠিকমত পোশাকী বাংলা সংলাপ উচ্চারণ করাটাও তার কাছে ততোধিক কঠিন। লাভের মধ্যে একটাই যে তার চেহারাটা চটকদার আর গলায় একটু হলেও সুর আছে। মুজরোর আদিরসাত্মক গান তার গলায় বেশ ভালই খোলে বলে লেবেদফ তেমন একটি গান - 'রসের নাগর ধরলে যে দোর / ভেতরে এলে না ' এই গানটিও নাটকের একটি অঙ্কে রেখেছেন। কিন্তু ভুজঙ্গধরের ক্ল্যারিওনেটের বাজনার সাথে গান করে মালিনীর একটা সংলাপ আছে -

"আমারে যেমন /মারিলি তেমন/পাইবি তাহার কিয়া/নষ্টের এ বড় গুণ, পিঠেতে মাখয়ে চুন/কি দোষ পাইয়া ওরে কোটালিয়া /মারিয়া করিলি খুন ।।"

সেটা কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ক্ষ্যান্তমণি পুরো বাক্যটা একবারও ঠিকমত বলে উঠতে পারছেনা। 'নষ্টের এ বড় গুণ পিঠেতে মাখয়ে চুন' খালি তার মুখে 'নষ্ট গেল চুন ! ' হয়ে যাচ্ছে বারবার।

শেষমেশ গোলক বেশ অধৈর্য গলায় রেগে ওঠে - 'মাগীর এমনিতে কত্ত কলকলানি! অথচ মালিনীর এট্টু গানটা গাইতে গিয়ে কোঁৎ পারচে কেমন দেকো!'

লেবেদফ খুব আশাবাদী এই 'বিদ্যা সুন্দর' নিয়ে। তার খুব ইচ্ছা প্রথম রজনীর আসরেই ক্যালকাটা সোসাইটির গণ্যমান্য সাহেবদের সঙ্গে গভর্ণর জেনারেল স্যার জন স্টোর'কেও অভিনয় দেখতে আমন্ত্রণ জানানোর। বিলেতী অপেরার ধাঁচে দেশী পালা এদেশে প্রথম অভিনীত হতে চলেছে, তাও অাবার একদম নবিশ নেটিভ অভিনেতা- নেত্রীদের দিয়ে, এ যেন একটা অকল্পনীয় ব্যাপার।

জন্মাষ্টমীর বদলে নভেম্বরের সাতাশ তারিখ আসরের দিনটি ঠিক হল। কলকাতার ইওরোপীয় সমাজের সাথে সাথে অনেক দেশীয় মানুষও সেই আসরে এসে ভীড় জমালো। ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর' এর অসামান্য নাট্যপ্রয়োগ আর তার সঙ্গে ইওরোপীয় অর্কেষ্ট্রার অনুপম বাদ্যসহযোগে ১৭৯৫ এর সেই রজনীটি কলকাতার বুকে এক নতুনরকম কান্ড হয়ে রইল। গভর্ণর নিজে লেবেদফ কে আলিঙ্গন করলেন আসরের শেষে। আর কার্টেন কলের সময় বেশীরভাগ দর্শক রতন, আদুরী আর ক্ষ্যান্তমণির দিকে মুঠো মুঠো পয়সা বখশিস্ ছুঁড়তে লাগল। সফল হল লেবেদফের স্বপ্ন।সবমিলিয়ে সেই সন্ধেটি হয়ে উঠলো এক জমজমাট ব্যাপার। রুশী পন্ডিতের ভোল্গা আর ভারতচন্দ্রের গঙ্গা এসে মিশলো এক নতুন স্রোতে।


গৃহদেবতা লক্ষ্মী জনার্দনকে প্রণাম করে ভারত গৃহিণীর সামনে এসে দাঁড়ায়। গত দুটি দিনের নিগূঢ় প্রেমের বন্ধনের পর আজ স্বামীকে অনির্দিষ্টদিনের জীবিকাসন্ধানের যাত্রায় বিদায় দিতে তার মন চাইছে না। ভারত নিজেও কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত বোধ করে এই গম্ভীর পরিবেশে। ভারতের শ্যালীপতির নবাবী নিজামতে মশলা আর কাপড়ের ব্যবসার সুবাদে দু একজন বড় মানুষজনের সাথে আজকাল খাতির হয়েছে। তাই সে ফরাসডাঙায় ফরাসী সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর কাছে সে সুপারিশ করেছে ভারতের চাকরীর জন্য।এজন্য তাকে একবারটি সেখানে যেতে হচ্ছে চৌধুরী মশায়ের সাথে দেখা করে কোন চাকরীর ব্যবস্থা করতে। ভাগ্যের অনেক বিপর্যয়ের পর এই পর্যায়ে আর যে কি বাকী আছে কে জানে? রাধাকে বুকে টেনে শিরোশ্চুম্বন করে ভারত। একটি ছোট পুঁটুলিতে সে পথের জন্য চিঁড়ে, নাড়ু আর নারকেলের তক্তি বেঁধে দিয়েছে। ভারত রাধাকে জীবিকা সংস্থানের আশ্বাস দিয়ে অবশেষে প্রস্থান করে। এখনো আর একজনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া তার বাকী।

খেয়াঘাটের শঙ্করীও ভারতের বিদায়কালীন প্রতীক্ষায় ছিল। সে অবশ্য ভারতের কাব্যের অত গভীর গূঢ় তত্ত্ব- চিন্তা বোঝেনা। ভারতের সাথে তার দীর্ঘ অদর্শনটিতেই বেশ আপত্তি। সারাদিনে একটিবার তো খেয়াঘাটে মানুষটাকে কাছে পাওয়া যায় তাও তো অনেক। প্রকাশ্যে সে ভারতের অঙ্গ স্পর্শ করেনা বটে তবে নৌকাটি লতাগুল্মের আড়ালে রেখে ভারতের বক্ষে সে মাথা রেখে তীব্র কান্নায় ভেঙে পড়ে। শঙ্করীর এই আত্মসমর্পণে কোনও জড়তা নেই। আদিম প্রকৃতিবালার মতোই সে অকপট। ভারত তার জীবনে এই দুটি ভিন্নরীতির রমণীর প্রেম ঋণ আজন্ম ভুলতে পারবে না।একটি তার আসঙ্গ অন্যটিতে আসক্তি। দুটিতেই তার মনমধুপ বড় লোভী। এর ব্যাখ্যা করতে গেলে এই পদটি বরং বেশ জুতসই ভাবে মিলে যায়,

যৌবন মরম জানে না যে বা 
পন্ডিত তাহারে বলয়ে কেবা II
যৌবনে তিনঅক্ষর লেখ/যে জন পরম উত্তম দেখ II
যৌবন মরম যে জানে নাই। প্রথম ছাড়িয়া তাহার ঠাঁই II
যদ্যপি যৌবনে উদ্যম করে। প্রথমের মত গলিয়া মরে।I
ভারতচন্দ্রের ভারতী যোগ।
যৌবনেতে কর যৌবন ভোগ II 

1 comment:

  1. অসাধারণ!
    খুব সুন্দর উপস্থাপন।

    ReplyDelete