0

সম্পাদকীয়

Posted in



সম্পাদকীয়

শেষ পর্যন্ত বহু প্রতীক্ষিত সেই ঘোষণাটি হল। বইমেলা পিছিয়ে যাচ্ছে একমাস প্রায়। ৩১ জানুয়ারির পরিবর্তে শুরু হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি। এমন যে হতে পারে, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ প্রায় ছিল না বললেই হয়। সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী ধারা যদিও এই মুহূর্তে একটু থমকে রয়েছে, তবুও এর মধ্যেই এই আয়োজন করা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছিল একাধিক। সেসবের মধ্যে না ঢুকে একথা হয়ত নিঃসংশয়েই বলা যায়, এই ভালো হল।

আমরা যখন বইমেলার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকব, অনেকগুলি রাজ্যে ঘনিয়ে আসবে নির্বাচন। আগামী দিনে ভারতবর্ষের চেহারা কেমন হতে যাচ্ছে, তার রূপরেখা অনেকটাই নির্দিষ্ট করে দেবে আসন্ন এই গণতন্ত্রের উৎসব। এই বছরটি আবার স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির মহাক্ষণ। আমাদের স্বাধীনতা পরিণত হয়েছে, এমন কথা বলার সময় কি এখনও এসেছে? বলতে পারি কি, অনেক রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এল, তা আমাদের প্রকৃত স্বাধীন করেছে? আমরা হয়ে উঠেছি এক প্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারী? আসুন উত্তর খুঁজি আমরা!

শুভেচ্ছা অফুরান!

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সোমেন দে

Posted in



ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের লেখা থেকে জানা যায় হাজার বছর আগে সাধারণ বাঙালিরা কোনো জুতোই পরতেন না। তখন জুতো পায়ে দিত শুধু যোদ্ধা, দাররক্ষী এবং পেয়াদা এই ধরণের কিছু লোক।কিছু অবস্থাপন্ন বাঙালিরা খড়ম বা ঐ ধরণের পাদুকা পরতেন। আপামর বাঙালিরা খালি পায়েই চলা ফেরা করতেন।তারপর অবশ্য অনেকদিন কেটে গেছে। মানবসভ্যতা এক পা এক পা করে এগিয়েছে।বঙ্গ দেশে অনেক বিপ্লব, যুদ্ধ, নবজাগরণ, মন্বন্তর, দেশভাগ, যুগবদল,রাজাবদল হয়েছে। খালি পা থেকে জুতো পরার অভ্যেসটি আমবাঙালি ঠিক কবে রপ্ত করেছে তা বলা মুসকিল।তবে বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের বাটা কোম্পানির একটি বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে জনগণকে জুতো পরতে উৎসাহী করা হচ্ছে এই ভয় দেখিয়ে যে খালি পায়ে থাকলে ধনুষ্টংকার হতে পারে। ধরে নেওয়া যেতে পারে উনিশের দশকে এসেই বাঙালির জুতো পরার অভ্যাস করতে শুরু করে। তবে সে জুতো ছিল প্রধানত চটি।

পলাশীর যুদ্ধে জিতে ইংরেজ যখন কলকাতাকে তাদের রাজধানী করে এ দেশের শাসন ব্যাবস্থা নিজের হাতে নেওয়ার দিকে এগোতে লাগল, তখন বিলেত থেকে এ দেশের শাসক প্রতিনিধিদের জন্য যে আচরণ বিধি পাঠানো হত তাতে বলা ছিল এ দেশের ধর্ম, ভাষা এবং সংস্কৃতির ব্যাপারে ভারতে চাকরি করতে আসা ইংরেজরা যেন মাথা না গলায়। কিন্তু সমস্যা ছিল সাদা চামড়ার লোকগুলি এ দেশে এসেই নিজেদের প্রভু এবং এ দেশের সব মানুষকেই ‘নেটিভ’ নামক এক নিম্ন শ্রেণীর জীব বলেই মনে করত। তাদের ভিতরে কোথাও একটা ভয় কাজ করত যে এই নেটিভরা বুঝি তাদের ঠিক ততটা খাতিরদারি করছে না যতটা তাদের দেশীয় হুজুরদের করে থাকে। তাই মাঝে মাঝেই তাদের দেশ থেকে আসা আচরণ বিধি না মেনে এমন সব হুকুম জারি করত যা এ দেশের মানুষের সংস্কৃতির বিপক্ষে। গরীব এবং নিম্নবর্গের মানুষদের নিয়ে তাদের বিশেষ সমস্যা ছিল না। তাদের সহজেই হুকুমের দাস বানিয়ে ফেলা যেত। কিন্তু ইংরেজ তাদের দিয়ে তো সব কাজ হবে না। কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সব বাঙালিরা ঠিক ততটা ততটা নির্বিবাদী ছিল না।

স্বদেশী আন্দোলন তেমন ভাবে দানা বাঁধার আগেই কিন্তু বাঙালি তার নিজস্বতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছিল ছোটো ছোটো প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে।ব্যাক্তিগত স্তরে কিছু কিছু ব্যাপারে ইংরেজদের সংঘাত বাধাতেও পিছপা হয় নি।উনিশ শতকের শেষের দিকে কিছু কিছু সংবাদপত্র ইংরেজদের নানা কাজকর্মকে সমালোচনা করতে ভয় পেতনা।

এই সময়ে একটি সংঘাত লেগেছিল বুট জুতো এবং চটির মধ্যে। তখনকার দিনে একেবারে দেশজ পদ্ধতিতে বানানো একধরণের চটি পাওয়া যেত। যাকে বলা হত তালতলার চটি বা ঠনঠনিয়ার চটি।

বুটজুতো কোনোদিনই বাঙালির পোষাকের অঙ্গ ছিল না। তবে শহুরে শিক্ষিত বা বাবু বাঙালিদের মধ্যে এক শ্রেণীর সাহেবদের অনুকরণ করে ডবসনের জুতো পায়ে দিয়ে সাহেব সাজার চেষ্টা করলেও কিছু আত্মাভিমানী বাঙালিরা চটি জুতো ছাড়তে চাইল না। তাতে অবশ্য ইংরেজদের সরাসরি কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু গণ্ডগোলটা বাধল অন্য জায়গায়।

তখনকার বাঙালিদের মধ্যে রীতি ছিল কোনো গন্যমান্য লোকের বাড়ি গেলে চটি জুতো খুলে বাইরে রেখে সে বাড়িতে ঢোকার। সন্মান জানানো ছাড়া তার আর একটা কারণ ছিল তখনকার দিনে অবস্থাপন্ন বাড়ির গৃহসজ্জা এমন থাকত যে অতিথিদের বসার জন্যে বাড়ির মেঝেতেই গদি বা জাজিম পাতা থাকত। তাই সবাইকেই জুতো খুলে বাড়িতে ঢোকার রেওয়াজ ছিল। ইংরেজদের বাড়িতে বা দপ্তরে গদি বা জাজিম থাকত না, চেয়ার টেবিল সোফা থাকত। সেখানে চটি জুতো খোলার দরকার হত না।নেটিভদের জুতো খুলে রাখার ব্যাপারে এই ভেদাভেদ দেখে ইংরেজদের মনে হল যে লোকগুলি দেশীয় লোকেদের বাড়িতে যাবার সময় চটিখুলে ঢোকে সেই লোকগুলিই সাহেব বাড়ি বা দপ্তরে এলে জুতো না খুলেই ঢুকে যায়। এর থেকে তাদের মনে এক ধরনের ধারণা তৈরি হয় যে তাদের এই নেটিভ্রা যথাযোগ্য সম্মান করছেনা।

এই রকম ধারনা থেকে কোথাও কোথাও এক ধরনের সংঘাত তৈরি হতে থাকে। সে কালের সংবাদপত্র থেকে এই ধরণের একটি ঘটনার কথা জানা যাচ্ছে।

১৮৭৩ সালে বহরমপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ওয়েবেল সাহেব হুকুম দিয়েছিলেন – “কেহ ইংরেজি জুতা না ব্যবহার না করিয়া তাঁহার কাছারি মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিবেনা।” এই নিয়ে বেশ চারিদিকে বেশ সোরগোল পড়ে গেল। কাছারিতে তো বহু সাধারণ লোককেই যেতে হয়। সবার পক্ষে ‘ইংরেজি জুতো’ পরা সম্ভব ছিল না। কাগজেও এ নিয়ে লেখালেখি হল। ব্যাঙ্গ করে ‘ভারত-সংস্কারক’ পত্রিকা লিখল ‘ম্যাজিস্টেট সাহেবের এত জুতার প্রতি নজর কেন ?’

কিন্তু এখানে ওখানে এরকম ঘটনা ঘটতেই লাগল। ১৮৫৫ সালে এক সাহেবের বাড়িতে এক নেটিভ যখন দেখা করতে যায়, তখন তাকে বলা হয় সিঁড়ির কাছে খুলে রেখে যেতে। তিনি তাতে রাজী না হওয়াতে তাকে পদাঘাত করে সেখান থেকে বার করে দেওয়া হয়। সেই ভদ্রলোক সহজে ছেরে দেবার পাত্র ছিলেন না। সোজাসুজি সুপ্রিম কোর্টে কেস করে দিলেন। বিচারক সাহেব হলেও তিনি সুবিচার করেছিলেন, সেই সাহেবকে তিনশো টাকা জরিমানা করে দেন। এ খবর ‘সংবাদ প্রভাকর’ ফলাও করে ছেপেছিল। ইংরেজরা তখন একটা তত্ব খাড়া করার চেষ্টা করলেন – সাহেবী জুতোর যে ‘মানবর্ধনকারি’ শক্তি আছে চটি জুতোর তা নেই।

এতে ‘সোমপ্রকাশ’ কাগজের সম্পাদক লিখলেন – ‘একে মান বৃদ্ধি ও অপরের মানহানি হয়, সে কাহার গুণ ? কারিগরের না গঠনভেদের ? মনুষ্য ঈশ্বরের সৃষ্টি, সকল মনুষ্যই সমান ; এই উদার বাক্যটি কি কেবল মুখেই থাকিবে ? কার্যে পরিণত হইবে না ?’

এই চটি জুতো আর বুটজুতোর লড়াই চলতেই থাকল। উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে এ রকম ঘটনা ঘটতেইও থাকল।সব ঘটনার কথা আমরা জানতে পারিনা। তবে এক ব্রাহ্মণের লেখা চিঠিতে জানা যাচ্ছে তিনি যখন তিনি এক সাহেবের দপ্তরে একটা মামলার নিষ্পত্তির জন্যে যান, তখন সাহেব মামলার নিষ্পত্তি তো করে দিলেন। কিন্তু তারপর ব্রাহ্মণের ঠনঠনিয়ার চটি পরা পায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন তুমি কি আমার সঙ্গে এই ভাবে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারবে ? ব্রাহ্মণ জানালেন না সেখানে গেলে আমি চটি খুলেই প্রবেশ করব। সাহেব এবং সাহেবের নেটিভ কেরানী তখন ব্রাহ্মণকে প্রশ্ন করল তবে সে এখানে কেন চটি খুলে আসেনি। ব্রাহ্মণ জানাল সাহাবের দপ্তরে তো সকলেই জুতো পরেই ঢুকছে, তাই আমিও চটি পরেই ঢুকেছি। তাতে সাহেব বললেন – সে তো ইংরেজি জুতো !

রসিক ব্রাহ্মণ বিনীত ভাবে সাহেবকে জানালেন – ‘ ইংরাজী জুতায় মান থাকে, আর চটি জুতায় মান যায়, এ কথা আমি আপনার ও সাহেবের মুখেই নতুন শুনিলাম ‘

তালতলার চটি বললেই অবশ্য বিদ্যাসাগর মশাইয়ের নামটিই সব চেয়ে বেশি করে মাথায় আসে। তার অনেকগুলি কারণ আছে। তালতলার শুঁড়তোলা চটিকে বিধ্যাসাগর মশাই এখনকার ভাষায় তাঁর স্টাইল স্টেটমেন্ট করে ফেলেছিলেন। তিনি যে তাঁর ব্রাহ্মণত্বের তেজে বঙ্গদেশ কে কাঁপিয়ে রেখেছিলেন, এই চটিই তাঁর ছিল তাঁর ব্রহ্মতেজের অন্যতম প্রতীক। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ বইতে লিখেছিলেন বিদ্যাসাগর মশাই একবার তাঁকে বলেছিলেন – ‘ভারতবর্ষে এমন রাজা নাই যাহার নাকে এই চটীজুতাশুদ্ধু পায়ে টক করিয়া লাথি না মারিতে পারি।’

তা যে সত্যি তিনি পারতেন তার প্রমাণ অনেকবার পাওয়া গেছল। ১৮৭৪ সালের জানুয়ারী মাসে বিদ্যাসাগর মশাই দু জন সঙ্গী সহ গেছলেন যাদুঘর আর তার পাশেই এসিয়াটিক সোসাইটি দেখতে। বিদ্যাসাগর মশাই যথারীতি তাঁর চিরাচরিত পোষাক পরে গেছেন, থান ধুতি, থান চাদর আর সেই তালতলার চটি। যাদুঘরের দারওয়ান তাঁকে আটকে জানালো ভিতরে যেতে হলে চটি খুলে যেতে হবে। অথচ তিনি দেখলেন কিছু সাহেব জুতো পরেই ভিতরে যাচ্ছে। বিদ্যাসাগর মশাই ভিতরে না ঢুকে ফিরে চলে এলেন এবং যাদুঘরের ট্রাস্টির সম্পাদককে একটি পত্রাঘাত করলেন। লিখলেন – ‘ ... এই জুতা রহস্যের কারণ আমি কিছু বুঝতে পারছি না। যাদুঘর তো সাধারণের আরাম বিশ্রামের স্থান। এখানে জুতা বিভ্রাট দোষাবহ। জাদুঘর যখন মাদুর মোড়া, কার্পেটযুক্ত বিছানা বা কারুচিত্রিত নয় তখন এরূপ নিষেধ বিধির আবশ্যকতাই বা কি? তা ছাড়া যাদের পায়ে বিলিতি জুতো, কিন্তু এসেছে পদব্রজে, তারা যখন প্রবেশ করতে পারছে তখন তাদের সমান অবস্থাপন্ন লোকের পায় শুদ্ধ দেশী জুতা বলে প্রবেশ করতে পায় না কেন তা আমি ঠিক করিতে পারছছি না। ... এ বিষয়ে মীমাংসার জন্য আপনি পত্রখানি অনুগ্রহ করে ট্রাস্টিদের দেখাবেন।
স্বাঃ শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা।

এ বিষয়ে অনেক চিঠি চাপাটি চলেছিল সে সময়ে। সমস্যার সমাধান হয় নি। এই ব্যবস্থাই চলতে থাকল।তবে ‘ইংলিশম্যান’ কাগজে লেখা হয়েছিল – ‘বিদ্যাসাগরের মত একজন পণ্ডিতের প্রতি যখন এইরূপ ব্যবহার, তখন এসিয়াটিক সোসাইটিতে আর কোনো পণ্ডিত যাইতে চাহিবেন না।’

রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী খুব সঠিক ভাবে বলেছিলেন – ‘চটি জুতার প্রতি তাহার (বিদ্যাসাগরের) একটা আন্তরিক আসক্তি ছিল বলিয়াই তিনি যে চটিজুতা ভিন্ন অন্য জুতা পায়ে দিতেন না, এমন নহে। আমরা যে স্বদেশের প্রাচীন চটি ত্যাগ করিয়া বুট ধরিয়াছি, ঠিক তাহা দেখিয়াই বিদ্যাসাগরের চটির প্রতি অনুরাগ বাড়িয়া গিয়া ছিল, বাস্তবিকই এও চটিজুতাকে উপলক্ষ মাত্র করিয়া একটা অভিমান, একটা দর্প তাঁহার অভ্যন্তর হইতে প্রকাশ পাইত। ‘

তবে শুধু বিদ্যাসগর মশাই নন, সে সময় বুটজুতো বনাম চটিজুতো এই নিয়ে একটি অঘোষিত জাত্যাভিমান গরে উঠেছিল কিছু মর্যাদাসম্পন্ন বাঙালির হৃদয়ে। তার প্রতিফলন ঘটেছিল নানা ভাবে। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় একবার ট্রেনে যাচ্ছিলেন দেশী চটিজুতো পরে। একই কোচে এক মিলিটারি সাহেব ছিল। সাহেবের সামনে তাঁর স্বদেশী চটিটি খুলে রেখে স্যার আশুতোষ একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মিলিটারি সাহেবটির এতে প্রচন্ড অপমান বোধ হয়। তিনি চটি জুতোটি দূরে ফেলে দেন। স্যার আশুতোষ ঘুম থেকে উঠে তাঁর জুতো খুঁজে পাচ্ছেন না। বুঝতে পারলেন এটি সাহেবেরই কীর্তি। কিছুক্ষণ পরে সাহেবও ঘুমিয়ে পড়েছেন। স্যার আশুতোষ সেই সময় তাঁর কোটটি নিয়ে দূরে রেখে চলে আসেন। সাহেব উঠেই হুম্বি তুম্বি করে জিজ্ঞেস করলেন – আমার কোট কোথায় ? স্যার আশুতোষ খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন – তোমার কোট আমার জুতো আনতে গেছে।

দ্বিজেন্দলাল রায় তাঁর ‘বিলেত ফের্তা’ কবিতায় তীব্র শ্লেষের সঙ্গে লিখেছিলেন-

আমরা ছেড়েছি টিকির আসর
আমরা ছেড়েছি ধুতি চাদর
আমরা হ্যাট বুট আর প্যান্ট কোর্ট পরে
সেজেছি বিলিত বাঁদর।

সত্যেন দত্ত বিদ্যাসাগরের সে তালতলার চটি নিয়ে সোজাসুজি বন্দনা করেছিলেন একটি কবিতা দিয়ে –

সেই যে চটি –দেশী চটি- বুটের বাড়া ধন
খুঁজব তারে আনব তারে এই আমাদের পণ;
সোনার পিঁড়েয় রাখব তারে, থাকব প্রতীক্ষায়
আনন্দহীন বঙ্গভূমির বিপুল নন্দীগাঁয়।

সত্যেন্দ্রনাথের দেওয়া কথা অবশ্য আমরা রাখতে পারিনি। সোনার পিঁড়েতে কেন আমরা তাকে সামান্য সম্ভ্রমের জায়গাই দিতে পারিনি। দেশ একদিন স্বাধীন হয়েছে। ইংরেজরা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তালতলার চটির মধ্যে যে প্রতীকী স্বদেশীয়ানার অহংকার ঘোষিত হত তার ছিটে ফোঁটাও বাঙালির চরিত্রে অবশিষ্ট নেই।বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ে স্বদেশী বিদেশী বস্তুর আলাদা সীমারেখা হয়ত সরে গেছে। কোনো এক ধরণের পোশাক পরে জাত্যাভিমান দেখানোর প্রয়োজন মিটে গেছে। কিন্তু আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে জাত্যাভিমানের সদর্থক প্রকাশ বাঙালির কোনো কিছু মধ্যেই তেমন করে দেখতে পাওয়া যায় না।

তবে চটি জুতোর সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক একেবারে ঘুচে গেছে তা নয়। চটি বাঙ্গালির ক্যাসুয়াল পোষাকের অঙ্গ।

তিরিশের দশকে কোলাপুরের সওদাগর পরিবার নামে এক পরিবার এক ধরণের চপ্পল কে নতুন করে রূপান্তর করেন। পুরোপুরি চামড়া দিয়ে সম্পুর্ন দেশীয় পদ্ধতি ও অকৃত্তিম রং দিয়ে তৈরি করা চপ্পল জন্ম লগ্ন থেকেই বাঙালিদের খুব পছন্দ হয়ে গেল।
হলুদ প্যাকেটে চারমিনার সিগারেট, হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি, শান্তিনিকেতনী কাপড়ের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ‚ লিটল ম্যাগাজিন‚ কফি হাউস এই সবের সঙ্গে কোলাপুরি চপ্পলের আত্নীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল চল্লিশ পঞ্চাশের দশকে। সে সম্পর্ক আজও ছিন্ন হয়নি। তবে কলেজ স্টিটে বেশ কয়েকটি দোকান শুধু কোলাপুরি চটিই বিক্রি করতো, সেগুলি আজকাল বোধহয় অন্য চটিও বিক্রি করে। এই কিছুদিন আগেও পশ্চিমবাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে ধুতি পাঞ্জাবীর সঙ্গে কোলাপুরি চটি পরিহিত অবস্থায় দেখা যেত।

আর আমাদের এখনকার মুখ্যমন্ত্রী যে চটি জুতো পরেন, সে চটিরও কিন্তু অন্য একটা ইতিহাস আছে। এ চটি ঠিক বাঙালিয়ানার প্রতীক না হলেও এ চটি আন্তর্জাতিক চটি।নানান দেশে এর নানান নাম আছে।
আমেরিকায় ফ্লিপ ফ্লপ, জাপানে Zori, কোথাও গো এহেড, কোথাও স্ল্যাপিস ইত্যাদি।
তবে সবই সম্ভবত জাপানের Zori ই আদি হাওয়াই চটি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে আমেরিকান সৈনিকরা এটি আমেরিকায় নিয়ে আসেন। তার পর এটির নানা রকম রূপান্তর ঘটে। আমাদের দেশে পঞ্চাশের শেষের দিকে বা ষাটের দশকে বাটা কোম্পানি এটিকে ভারতের বাজারে ছাড়েন। এবং বাজারে আসতেই বাম্পার হিট হয়ে যায়। প্রথম দিকে অবশ্য এটির একটু এলিটিস্ট ইমেজ ছিল।দামও বেশী ছিল। পরে এটি নেহাতই জনগণের ঘরে পরার চটি হয়ে যায়।আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর এই বিশেষ ধরণের চটি পরা বেছে নেওয়ার কোনো প্রতীকী কারণ আছে কিনা আমার জানা নেই।

শেষ করার আগে একটি বাংলা সিনেমায় চটির প্রতীকী হয়ে ওঠার কথা বলে নিই। ঋত্বিক ঘটকের একটি সিনেমাটির কথা নিশ্চয় সবারই মনে আছে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা গেছল একটি মেয়ে কলকাতা রাস্তা ধরে হাঁটছে। মলিন শাড়ি পরা বাংলাদেশের এক সাধারণ মেয়ে, রবীন্দ্রনাথের কথায় যারা বিকিয়ে যায় মরীচিকার দামে, সেই সাধারণ মেয়েদের একজন। এই সিনেমায় দেখা গেল হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটির এক পাটি চটি ছিঁড়ে গেল, বিব্রত মেয়েটি চটি জোড়া হাতে নিয়ে আবার হাঁটতে থাকে,কারণ তাকে হাঁটতেই হবে, তার এবং হয়ত বা তার পরিবারের জীবনধারণের রসদ জোগানোর জন্য। এ ছবির প্রথম দৃশ্যেও ছবির নায়িকা নীতাকে দেখা গেছলো ছেঁড়া চটি পায়ে পা ঘষটাতে ঘষটাতে হেঁটে যেতে। আসলে এই ঋত্বিকের নীতা ঠিক কোনো বিশেষ গল্পের নায়িকা নয়।এই নীতা হল আমাদের অনেকবার দেখা সেই মেয়েটি যে টিউশনির টাকা পেয়ে নিজের ছেঁড়া চটিটা বদলে একটা নতুন চটি না কিনে সেই টাকা দিয়ে বোনের জন্যে শাড়ি, ভাইয়ের জন্যে ফুটবল, দাদার জন্যে পাঞ্জাবীর কাপড় কিনতে গিয়ে সব টাকা শেষ করে ফেলে। তার নিজের জন্যে আর কিছু কেনা হয় না।

আমি জানিনা নীতার গল্প এই একুশ শতকে আর প্রাসঙ্গিক কিনা।

তবে বাঙালির কাছে সেই চটির গল্প বোধহয় আজও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in




















বর্ধমান রাজঅন্তঃপুর---
( শেষ পর্ব)

সংসার ত্যাগের পর রাধারাণী দেবী প্রথমে হরিদ্বার ও পরে বারাণসীর ’বর্ধমান হাউসে’ বাকী জীবন কাটান। যদিও সেখানে রাজবাড়ীর লোকজন, পাইকপেয়াদা,রাজকর্মচারীরা বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ছিল, কিন্তু রাধারাণী দেবী সন্ন্যাসিনীর জীবনই বেছে নেন ও বাকি জীবন সেভাবেই কাটান। ১৯৭২ সালে এই রাণীর মৃত্যু হয়। রাজ অন্তঃপুরের অন্যান্য মহিষীরা যেমন রাণী ব্রজকীশোরী, বিষেণকুমারী (বা বিষ্ণুকুমারী) , কমলকুমারী ইত্যাদির মতো তাঁর জীবন রাজবৃত্তের মধ্যে না কাটিয়ে তিনিই এই পরিবাবের একমাত্র নারী যিনি এই রাজঐশ্বর্য্য, রাণীর বৈভবপূর্ণ জীবনের মায়া ত্যাগ করে সাধারণ সন্ন্যাসিনীর জীবন বেছে নিতে পেরেছিলেন ও সেই সাহস করেছিলেন। তাই বিজয়চাঁদ মহিষী রাধারাণী দেবী এক অনন্য নারী অবশ্যই বলা যায় এবং এই ঘটনাও এক অত্যাশ্চার্য্য ঘটনা বলা যায়।

মহারাজা বিজয়চাঁদের পর রাজা হন মহারাজা উদয়চাঁদ। মহারাজ উদয়চাঁদের বিবাহ হয়েছিল অমৃতসরের লালা ধুনিচাঁদ মেহরার কন্যা রাধারণি দেবীর সঙ্গে। তাঁর আমলেই রাজন্য প্রথা বিলুপ্ত হয় এবং তাঁর রাজত্বও চলে যায়।বিশাল রাজত্ব, রাজপ্রাসাদ, রাজকীয় সম্মান, রাজ অর্থ সবই চলে যায় সরকারের হাতে। সর্বস্ব জনসাধারণ ও একসময়ের প্রজাদের হাতে দান করে তাঁরা চিরদিনের মত চলে যান বর্ধমান ছেড়ে। একসময়ের জনদরদী রাজার সবকিছুকে দিয়ে যান জনগণের জন্যই। কিন্তু মহারাজা বিজয়চাঁদের পুত্রকন্যাদের মধ্যেও কেউ কেউ অন্যজীবন বেছে নিতে পেরেছিলেন। মহারাজার পুত্রকন্যাদের শিক্ষা হয়েছিল বিলাতে। সুতরাং তাঁরা সকলেই ইংরাজি আদব-কায়দায় অভ্যস্ত ছিলেন বলা যায়।

মহারাজা বিজয়চাঁদ জীবিত থাকতেই উদয়চাঁদের হস্তে রাজত্ব অর্পণ করে অন্যান্য পুত্র কন্যাদের নিয়ে বিলাত চলে যান। মহারাজা বিজয়চাঁদের দুই কন্যা, মহারাজকুমারী সুধারানী এবং মহারাজকুমারী ললিতারাণী। ফিরে আসার কিছুদিন পর মহারাজা বিজয়চাঁদ পরলোকগমন করেন। মহারাজা বিজয়চাঁদের কন্যা ললিতাকুমারী রাজপরিবারের প্রথম মহিলা যিনি ছায়াছবিতে অভিনয় করেন, নিজস্ব মতে বিবাহ করেন এবং প্রথম বিবাহ বিচ্ছিন্ন হলে পুনরায় বিবাহ করেন। ছায়াছবিতে অভিনয়ের সংবাদটি জানা গেল কোন ছায়াছবি, এবং ঠিক কোন সময়ে তা এখনও জানা যায় নি, আরো জানার প্রয়োজন।

সেদিক থেকে দেখতে গেলে রাজ অন্তঃপুরের এই নারীটিও অন্যদের তুলনায় অন্যরকম জীবন যাপন করেছেন। যদিও তখন আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছে, ইংরাজি শিক্ষার প্রভাবে রাজপরিবারের নারীও রাজপরিবারের পুরুষদের মত বাইরে পা রাখতে শুরু করেছেন। মহারাজা বিজয়চাঁদের পুত্র-কন্যারা সকলেই পাশ্চাত্ত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, আদবকায়দাতেও। বিবাহও হয়েছিল সেইরকম পরিবারে। সুতরাং, আধুনিকতার ছোঁয়া তো ছিলই! মহারাজা উদয়চাঁদের সময় রাজন্য প্রথা লোপ পাবার পর বর্ধমান রাজপরিবার তাঁদের রাজবাড়ি ও অন্যন্য যে সকল প্রাসাদ ছিল তা দান করেন শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে। যে সকল দেবতার স্থল এবং পূজার ব্যবস্থা ছিল তার জন্য নির্মিত হয় একটি ট্রাস্টি। যে ট্রাস্টির প্রধান হন ছোট মহারাজাকুমার এবং রাজপরিবারের আইন অনুযায়ী বড় মহারাজকুমারের অনুমতিক্রমে। মহারাজা উদয়চাঁদের পত্নীর মানও ছিল রাধারাণী দেবী। মহারাজা উদয়চাঁদের পত্নী এবং মাতা উভয়েরই নাম ছিল রাধারাণী। উদয়চাঁদ পত্নী রাধারাণী দেবী পরবর্তী সময়ে পশিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের অনুরোধে জনসাধারনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং আইনসভার সদস্যা নির্বাচিতা হন। দ্বিতীয়বার আইনসভার সদস্যার নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন এবং রাজত্ব চলে যাবার মাত্র আট বৎসরের মধ্যে ৩০শে জুন, ১৯৬৩ সালে দার্জিলিং-এ পরলোক গমন করেন। সেদিক থেকে ইনিও একজন উল্লেখযোগ্যা রাজঅন্তঃপুরবাসিনী, যিনি সর্বপ্রথম জনসাধারণের জন্য রাজমহলের ঘেরাটোপের বাইরে এসে পা রাখেন খোলা রাজপথে জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে। বর্ধমানের শেষ মহারাজা উদয়চাঁদের মৃত্যু হয় ১৯৮৪ সালের ১০ই অক্টোবর।

মহারাজা উদয়চাঁদের পুত্রকন্যাদের আর রাজা হওয়া হয়নি। তাঁরা সকলেই মহারাজকুমার ও মহারাজকুমারী এই নামেই অলঙ্কৃত। উদয়চাঁদের তিন পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ্য পুত্র রাজত্ব বিলোপের সময় বিদেশে পাঠরত ছিলেন, কিন্তু ফিরে এসে তাঁর আর রাজা হওয়া হয় নি। তিনিও পিতার মতই তাঁর প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে বর্ধমান ছেড়ে চলে যান, আর কোণদিন আসেননি। শেষ হস্তান্তরের কাজ করেন ছোটো মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদ। ইতিহাসের এক মনোযোগী ছাত্র এবং শিক্ষক এই অমায়িক, স্নেহপ্রবণ মানুষটি কিন্তু রাজত্ব না থাকায় একটুও অখুশি নন। তাঁর মতে, তিনি পরিবারের সকলের কনিষ্ঠ। তাই রাজপরিবারের আইন অনুসারে তাঁর রাজা হওয়া কোনদিনই সম্ভব ছিল না। কাজেই রাজত্ব গেল কি থাকল তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না। কিন্তু যে ভীষণ ঘেরাটোপ, যে কঠিন শৃঙ্খলিত জীবন, যে ভীষণ নিয়মানুবর্তিতার ভিতর দিয়ে রাজকুমার ও রাজকুমারীদের জীবন কাটতো, তা থেকে মুক্তি হয়েছে বলে, ব্যক্তিগত ভাবে তিনি খুবই আনন্দিত। মানুষের নিজস্ব জীবন যদি কেউ কাটাতে না পারে, ভারি বিষম দায় যদি বইতে হয়, তাহলে সত্যিকারের জীবনের পুর্ণ বিকাশ হওয়া সম্ভব নয়, হতে পারে না। শিশুদের যে কঠিন চার-দেওয়ালের মধ্যে বন্দী জীবন তাঁর মনে আছে, তা থেকে এই প্রজন্মের শিশুরা মুক্তি পেয়েছে, এতে তিনি ঈশ্বরের কছে কৃতজ্ঞ। স্বাধীনতা বলে তখন কিছু ছিল না। নিজের পছন্দ করা জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে বিবাহ করার স্বাধীনতাও ছিল না। যারা করেছেন বা পেরেছেন, সে তাঁদের অসীম সাহস বা এক উদাহরণ মাত্র, যা স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে পড়ে না।

মহারাজকুমার প্রণয়চাঁদ বিবাহ করেন অধুনা বাংলাদেশের রংপুরের মহিলাকে। নাম নন্দিনী মহতাব। মহারাজকুমারের স্ত্রীকে সকলেই ‘ছোটোমা’ বলে ডাকেন। তাঁর মা ছিলেন ত্রিপুরার রাজপরিবারের। কিন্তু বাংলাদেশ বিভাগের আগেই তাঁরা চলে আসেন এদেশে কলকাতায় ব্যবসাসূত্রে। বাংলাদেশ অপেক্ষা ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গেই ছিল বেশি যাতায়াত। মহারাজ উদয়চাঁদের তিন পুত্রই অর্থাৎ মহারাজকুমাররা তিনভাই-ই ছিলেন দুন স্কুলের ছাত্র। মহারাজকুমার দুন স্কুলে পড়াকালীন তাঁর বর্তমান স্ত্রী অর্থাৎ ছোটমার সঙ্গে পরিচয় ও প্রণয়। পরে তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে আমেরিকা যাবার পর আবার যোগাযোগ হয় এবং বিবাহ। আগে রাজপরিবারের বিবাহ হত শুধুমাত্র করকোষ্ঠীর মিল দেখে, মানসিকতার মিল দেখে নয়। মহারাজকুমারের মতে প্রথম রাধারাণীর সঙ্গে মহারাধিরাজ বিজয়চাঁদের মানিসিকতা, রুচি, চাল, চলন, শিক্ষা-দীক্ষা কোনকিছুরই মিল ছিল না, শুধুমাত্র করকোষ্ঠির মিলটূকু ছাড়া। বর্তমান প্রজন্মের পুত্র-কন্যারা সকলেই নিজমতে ও নিজ পছন্দ মতে বিবাহ করছেন, তাতে ভালই হয়েছে। নিজের রুচিমত পাত্র বা পাত্রী তাঁরা নিজেরাই নির্বাচন করে নিতে পারছেন। বস্তুতঃ উদয়চাঁদের ভগিনী ললিতাদেবীর সময় থেকেই এই পরিবারে নিজমতে বিবাহ আরম্ভ হয়েছে বলা যায়।

বর্তমানে বর্ধমানের এই রাজপরিবারটি একটি পুরোপুরি বাঙ্গালী পরিবার বলেই মহারাজকুমারও মনে করেন। প্রায় তিনশ বছর আগে পঞ্জাবের সুদূর লাহোর থেকে বঙ্গদেশে এসে বসবাস করা পরিবারটি কেউই আজ আর পিছন ফিরে তাকাতে রাজী নন। মহারাজকুমারের মতে, ঈশ্বরের অপার করুণা ও বর্ধমানবাসীদের অশেষ ভালবাসায় তিনি আপ্লুত। তাঁর এই জীবনে আর কিছু চাইবার নেই। অতুল ঐশ্বর্য্যর অধিকারী, একদা রাজ আদরে লালিত-পালিত এই মানুষটিকে আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা । তিনি ও তাঁর পরিবারের সকলে সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন।

রাজকুমারী সুধাকুমারী
রাজকুমারী ললিতাকুমারী
মহারাজা উদয়চাঁদ মহতাব, বর্ধমানের শেষ রাজা


0 comments:

0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in




টোটো-কোম্পানি

আমার ভারতবর্ষ-৯

আকবর বাদশা ও একজন বাঙালি কেরানি

যমুনা নদীর পাশে জায়গাটা আকবর নিজের সমাধির জন্য আগেই বেছে রেখেছিলেন। গ্রামটার নাম সুলতান সিকন্দর লোদির নামে ছিল, সিকন্দরা। কিন্তু কাজে হাত দেবার আগেই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে গেলো। শাহজাদা সলিম আদেশ করলেন তাঁর ওয়ালিদের সম্মানের সঙ্গে মানানসই একটা স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করার জন্য। তিন বছর কেটে যাবার পরেও ১৬০৮ সালে সলিম (তখন জহাঙ্গির) গিয়ে দেখেন কাজ অসমাপ্ত। তার উপর যতটুকু নির্মাণ হয়ে ছিল তা তাঁর পছন্দ হলো না। পুরো ভেঙে দিয়ে আবার
কাজ শুরু হলো। ঠিক কতদিন আরও লেগেছিল লেখা নেই। সম্ভবত ১৬১৩-১৪ সাল নাগাদ কাজ শেষ হয়। খরচ হয়েছিল পনেরো লাখ টাকা। লাল কোটা পাথর আর শাদা মার্বেল পাথরে তৈরি এই সৌধটির ক্যালিগ্র্যাফির দায়িত্বে ছিলেন ইরানের শিরাজ থেকে আসা শিল্পী আবদুল হকশিরাজি। এই স্থাপত্যটির বৈশিষ্ট্য এর অতিসূক্ষ্ম কারুকাজ আর সংহত বিশালত্ব। আকবর বাদশার আসল সমাধিটি রয়েছে প্রথামতো সৌধটির মেঝের নীচে।
দিল্লিতে হুমায়ুঁর সমাধিটির স্থাপত্য আর আকবরের সমাধি সৌধের নক্শা একেবারে আলাদা। হুমায়ুঁর সমাধিসৌধের পরিকল্পনা মধ্য এশিয়ার ধরনে করা হয়েছিল। যা কেতিমুরিদ স্থাপত্য বলা হয়। কিন্তু আকবর বাদশার সমাধি সৌধটি ভারতীয় ও ইসলামি স্থাপত্যের বিশ্রুত সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল। সত্যি কথা বলতে কী, তাজমহলের প্রকৃত পূর্বসূরি হিসেবে এই নির্মাণটির কথাই মনে পড়ে।

অওরঙ্গজেবের সময় ভরতপুরের বিদ্রোহী জাঠ সর্দার রাজারাম জাঠ আকবরের সমাধি লুণ্ঠন করে বহু কিছু ধ্বংস করে দেন। এমন কী আকবরের সমাধি খুঁড়ে তাঁর দেহাবশেষকেও অসম্মানিত করেন। যদিও পরে অওরঙ্গজেব রাজারামকে পরাজিত করে নৃশংসভাবে হত্যা করেন, কিন্তু আকবরের সমাধির বড়ো ক্ষতি হয়ে যায়। ইংরেজরা আসার পর প্রথমে লর্ড নর্থব্রুক ও পরে লর্ড কার্জনের পৃষ্ঠপোষকতায় সমাধিটির পূর্ণ সংস্কার করা হয়।



যাঁরা মন দিয়ে এই নির্মাণটি দেখেছেন, তাঁদের কিছু বলার নেই। কিন্তু যাঁরা দেখেননি তাঁরা প্রথম সুযোগেই যেন দেখে নেন। আমাদের ঐতিহ্যে এই সমাধি সৌধটির জুড়ি নেই।



0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





















১৩

খুব জোরে ব্রেকে চাপ দিল লোকটা নিচ থেকে। পরিষ্কার বোঝা গেল। ছন্দবদ্ধ একটা ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে থামতে লাগলো নৌকার দুলুনি। দোলনাটা থেমে গেল একদম। সে বুঝতে পারছে যে তাকে ভীষণ হাস্যকর দেখাচ্ছে, শোচনীয় অবস্থা তার। সে ধীরে ধীরে উঠে নেমে এলো দোলনাটা থেকে। পেট গোলানো বন্ধ হয়েছে, কিন্তু জিভে একটা বিশ্রী স্বাদ। মাথাটা এখনও ঘুরছে। সে চোখ বন্ধ করে একটা সিঁড়ির উপরে বসে পড়ল। এই দুলুনির ছন্দটা এখনও রয়েছে তার চোখের মধ্যে। সে বুঝতে পারছে তার চোখের তারা এখনও ঘুরছে। সে থুথু ফেলল একটু। ধীরে ধীরে চোখের তারা স্থির হতে লাগলো। সে উঠে গিয়ে তুলে নিয়ে এলো উড়ে যাওয়া টুপিটা। লোকটা তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা নির্বিকারভাবে তাকে দেখছিল। তারপর লোকটার বউ হঠাৎ দৌড়ে এলো। সামনে আসার পরে গ্রেক অবাক হয়ে গেল বউটাকে দেখে। কী ছোটখাট চেহারা! কালো গায়ের রঙ, মুখচোখ একদম হাভাতে ধরনের। হাতে একটা মগে করে কী যেন নিয়ে এসেছে। ব্লন্‌ড লোকটা মগটা গ্রেকের হাতে ধরিয়ে দিল।

‘খেয়ে নিন!’ অদ্ভুত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল লোকটা। গ্রেক মাথা নাড়ল।

‘খেয়ে নিন।’ আবার বলে উঠল লোকটা… ‘একটু ভালো বোধ করবেন।’

গ্রেক মগটা নিল। পানীয়টা খেতে তিতকুটে, কিন্তু বেশ ভালো লাগছে ওর এখন। লোকগুলো হাসল। ওরা যান্ত্রিকভাবে হাসল। আসলে মানুষের চোখে চোখ পড়লে হাসতে হয়। এটাই নিয়ম। এমন নয়, যে তোমাকে ওরা ভালবাসে কিম্বা সংবেদনশীল, এই কারণে হাসছে। গ্রেক উঠে দাঁড়ালো।

‘ধন্যবাদ’ বলে উঠল গ্রেক। তারপর পকেট হাতড়াতে লাগলো। কিন্তু পকেটে টাকাকড়ি কিছু ছিল না। ছিল সেই বিশাল অঙ্কের বিলটা। সে নিরুপায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল। সে বুঝতে পারল যে তার মুখচোখ লাল হয়ে উঠছে।

‘ঠিক আছে।’… বলল লোকটা… ‘ঠিক আছে।’

‘হাইল হিটলার!’* বলে উঠলো গ্রেক।

লোকটা শুধুমাত্র মাথা নাড়ল।

গ্রেক পিছনে ফিরে তাকাল না। খুব ঘামছে সে আবার। রোমকূপ থেকে ফেটে ফেটে বেরচ্ছে স্বেদ। মনে হচ্ছে সে নিজেই ফেটে পড়বে বিস্ফোরণের মত। বাজারের কাছেই একটা সরাইখানা আছে। একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে পারলে ভালো হত।

সরাইখানার ভেতরে খাবার ঘরটা আশ্চর্যজনকভাবে ঠাণ্ডা, অথচ একটা বাসি টকগন্ধে ভরা। ঘরটা প্রায় ফাঁকা। গ্রেক লক্ষ্য করলো যে কাউনটারের ওপাশে বসে থাকা লোকটা তার বুকের কাছে মেডেলগুলোর দিকে তাকাল। লোকটার চোখগুলো নির্লিপ্ত, কিন্তু রাগত শত্রুসুলভ নয়। না, চোখগুলো ঠিকঠাক। বাঁ দিকের কোণের টেবিলে এক প্রেমিকযুগল বসে আছে। সামনে এঁটো প্লেট, ওয়াইনের ডিক্যানটার, আবার বিয়ারের বোতলও আছে। গ্রেক ডানদিকে বসল, যাতে রাস্তাটা দেখতে পাওয়া যায়। একটু ভালো বোধ করছে সে এখন। তার ঘড়িতে এখন একটা বাজে। সে ভোর ছটা নাগাদ বেরিয়েছে। কাউন্‌টারের পিছন থেকে লোকটা বেরিয়ে ধীরে ধীরে এসে তার কাছে দাঁড়াল। গ্রেক ভাবতে লাগলো কী খাবে। আসলে তার সেরকম কিছু খাবার ইচ্ছেটাই নেই। একটু পরিষ্কার হতে পারলে ভালো হত। সে মদ খাওয়া নিয়ে ভাবিত নয়, তাছাড়া সে মদ পছন্দ করেনা সেরকম। তার মা কোনো কারণ ছাড়াই তাকে ওসব খেতে বারণ করে দিয়েছিলেন, বা নাগরদোলা চড়তে বারণ করেছিলেন, ব্যাপারটা এতখানি সহজ নয়। যে লোকটা তার সামনে দাঁড়িয়েছিল, সে আবার তার বুকের বাঁ দিকে প্রথমে তাকাল।

‘হ্যাঁ, বলুন’ বলে উঠলো লোকটা… ‘কী নেবেন?’

-‘কফি’ বলল গ্রেক… ‘আপনারা কফি রাখেন তো?’ লোকটা গ্রেকের বুকের বাঁ দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই মাথা নাড়ল ইতিবাচকভাবে। ‘আর একটা ব্রাণ্ডি’… বলে উঠল গ্রেক। কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে। প্রথমেই যদি বলতো সেটার একটা অর্থ হত।

-‘কোন ব্রাণ্ডি?’ লোকটা প্রশ্ন করল।

- ‘অ্যাপ্রিকট’

লোকটা চলে গেল। লোকটা মোটা। ভুঁড়ির নিচে ট্রাউজারটা ফুলে ফুলে উঠছে আর লোকটা চপ্পল পরে আছে। একদম অস্ট্রিয়ানদের স্বভাবসিদ্ধ অগোছালো ব্যাপারস্যাপার যতসব, ভাবল গ্রেক। সে প্রেমিকযুগলের দিকে তাকাল। প্লেটে উচ্ছিষ্ট খাবারের উপরে মাছি উড়ছে। কাটলেটের হাড়, মুষড়ে পড়া লেটুসপাতা, সব্জির স্তুপ পড়ে আছে সামনে বাটিতে। এত খাবার নষ্ট করেছে। অসহ্য… ভাবল গ্রেক।

এক সৈনিক ঢুকল। উদ্বিগ্নচোখে তাকাল চারদিকে। গ্রেককে সম্ভাষণ জানাল। চলে গেল বারের দিকে। সৈনিকটির কোনও মেডেল নেই। কিন্তু তার চোখে এক অদ্ভুত দাক্ষিণ্য, যেটা গ্রেককে বিরক্ত করে তুলল। হয়ত সৈনিকটা ভাবছে অফিসার হিসেবে আমার আরও মেডেল থাকা উচিত ছিল। সুন্দর সুন্দর সোনা রূপা, হাঙ্গেরির শিশুদের মাথার মতন বড় বড়… ধুত্তোর। এসব কেন ভাবছে সে? তার কি মেডেলগুলো পরে থাকা উচিত নয়? সে সুন্দর, ব্লন্‌ড, লম্বা… ধুর… যত বাজে ব্যাপার। সে বাইরের দিকে তাকাল।

যে মহিলা অ্যাপ্রিকট বেছে বেছে গুছিয়ে রাখছিল, তার কাজ প্রায় শেষের দিকে। গ্রেক হঠাৎ বুঝতে পারল এই মুহূর্তে তার ঠিক কী খেতে ইচ্ছে করছে। ফল- হ্যাঁ, ফল খেলে তার উপকার হবে। ফলের দাম সস্তা হলেই মা সবসময় তাকে অনেক ফল খেতে দিতেন। হ্যাঁ, তার শরীরের জন্য ফল খুব উপকারী। ফল এখানে সস্তা ছিল, তাছাড়া তারও পয়সাকড়ি ছিল… ফল, তার হঠাৎ ফল খেতে ইচ্ছা করল খুব। পয়সাকড়ির কথা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে বাধা পড়ল তার চিন্তার স্রোতে। হঠাৎ থেমে গেল তার ভাবনাটা। আবার ভীষণ ঘাম হতে লাগল। কিছু হবে না যদি সে অস্বীকার করে… হ্যাঁ নির্মমভাবে ব্যাপারটা অস্বীকার করতে হবে। কেউ ওই নোংরা ইহুদীগুলোকে বিশ্বাস করবে না, যদি ওরা বলে যে ওদের কাছেই গ্রেক নিজের প্যান্ট বিক্রি করে এসেছে।

কেউ বিশ্বাস করবে না, যদি সে ব্যাপারটা অস্বীকার করে। যদি কখনো ভবিষ্যতে এটা ধরা পড়ে যে প্যান্টের মালিক সে, এরকম কিছু বলে দেবে যে ওটা চুরি গেছে… কিম্বা যাহোক কিছু একটা বলবে। কিন্তু এত ঝামেলা হবেই বা কেন? কীভাবে ধরা পড়বে ব্যাপারটা? এই চিন্তাটা হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মত তার বুদ্ধিকে আঘাত করল। হ্যাঁ, সবাই তো কিছু না কিছু বিক্রি করছে। সবাই। ট্যাঙ্কের ফুয়েল থেকে শুরু করে শীতের জামাকাপড়--- এসব গেল কোথায়? তাছাড়া সে তো নিজের প্যান্ট বিক্রি করেছে, অন্য কারো বাপের সম্পত্তি তো নয়। তার নিজের খরচে মাস্টার টেলার গ্রুঙ্ককে দিয়ে বানিয়েছিল প্যান্ট।

এই এত পেংগো আসছে কোথা থেকে? যেমন এই যে নির্লজ্জ ছোটলোক লেফটেন্যান্ট, নিজের ঘরে শুয়ে থাকে। বিকেলে ক্রিম কেক খায়, সন্ধেবেলা আসল হুইস্কি খায়, মেয়েমানুষদের ঘরেও যাতায়াত আছে, যেকোনো সিগারেটে মন ওঠে না, কেবলমাত্র একটা বিশেষ ব্র্যান্ড, যেটার দাম খুব বেশি- সেটাই খায়। এসব লপচপানি, এত ফুটানি কীভাবে করছে? যা বেতন পায় তারা, তাতে এতসব হয়?

গোল্লায় যাক সব, সে ভাবে। আমিই বোকা, সবসময় ভীষণ বোকা। সবসময় ভদ্র আর নিয়মানুবর্তী। আর বাকিরা সব আহ্লাদে থাকে। আমারই অভিশপ্ত জীবন।

‘ধন্যবাদ’- বলে ওঠে গ্রেক।

কফি আর ব্রাণ্ডি নিয়ে এসেছে লোকটা… ‘আর কিছু খাবেন?’

কফির স্বাদটা অদ্ভুত। চুমুক দেয় সে। হাল্কা, অদ্ভুতরকমের হাল্কা যেন কফির মত সহানুভূতি জানাবার একটা বিকল্প। ব্রাণ্ডিটা ঝাঁঝালো বেশ। কিন্তু সেটা খেয়ে ভালো লাগলো তার। সে ধীরে ধীরে, ফোঁটা ফোঁটা করে পান করতে লাগল।

সেটাই। ওষুধের মত খেয়ে যেতে হবে তাকে মদ… সেটাই করতে হবে। বাজারে অ্যাপ্রিকটের লালচে কমলা স্তূপটা উধাও হয়ে গেছে। গ্রেক লাফ দিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। মুখ ফিরিয়ে সরাইখানার কাউনটারে বসে থাকা লোকটাকে বলে সে… ‘এক মিনিট, এখুনি আসছি।’

বুড়ি মহিলা, যে অ্যাপ্রিকট বেছে গুছিয়ে রাখছিল, সে তার গাড়িটা নিয়ে ধীরে ধীরে বাজারের চৌমাথায় নাগরদোলার কাছে পৌঁছে গেছে। গ্রেক তাকে থামাল। বুড়ির চওড়া, কাটাকাটা মুখ রোদ্দুরে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। এককালে খুব সুন্দরী ছিল, সেটা বোঝা যায়।

-‘ফল’--গ্রেক গাড়ির কাছে গিয়ে বলে… ‘আমাকে অ্যাপ্রিকট দিন।’

বুড়ি হেসে ওঠে। হাসিটা কেমন যেন শীতল।



(চলবে)

* হাইল হিটলার- শব্দবন্ধের অর্থ ‘হিটলার দীর্ঘজীবী হোন। নাৎসিবাহিনীর প্রতিদিনের জীবনযাপনের সম্ভাষণ ছিল এই শব্দবন্ধটি।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in




















১৭

স্মৃতির শহর – ৩

বাঙাল – ঘটি। এই দুটি শব্দের মধ্যে দিয়ে একসময়ের অবিভক্ত বঙ্গদেশ দু’ভাগে বিভক্ত স্মরণাতীত কাল থেকে। পুব আর পশ্চিম। বিশাল এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক বিভাজন পর্যন্ত এই ভাগাভাগি ছিল অনেকটা আচার-আচরণের মধ্যে আর বাকিটা মানসিক। এই আচার-আচরণের মধ্যে আবার খাদ্যের ভূমিকা নির্ণায়ক। বংশপরম্পরায়, যুগ, যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে আলাদা দুটি রন্ধনশৈলী। যেখানে নির্দেশনামা অমান্য করে কিছু করা মানে ঘোরতর অপরাধের বিষয়! আমার বরাবর মনে হয়েছে এটি অর্থহীন এক ক্রিয়াকলাপ। হেঁশেল সংস্কৃতির মধ্যে যে সৃজনশীলতার পরিসরটি রয়েছে, তা অকারণে বিঘ্নিত হয় এর দ্বারা। আমি কিন্তু স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দেওয়ার কথা বলছি না। বরং কোনও বিশেষ ঘরাণাকে মর্যাদা দেওয়ার জন্য তার নিজস্বতার রক্ষণাবেক্ষণ খুবই জরুরি। সেটা বহু ক্ষেত্রে হয়নি বলেই চিরতরে হারিয়ে গেছে অসামান্য অনেক পদ। কিন্তু বিষয়টাকে মৌলবাদের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই কিছুই। বরং নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে আদানপ্রদান সহজ হয়, যা খুবই দরকারি। কারণহীন বৈরিতা অনেকসময় স্বাভাবিক বিবর্তনের পথটি সঙ্কীর্ণ করে দিয়েছে।

আমার জন্ম হয়েছিল কলকাতার অনতিদূরে একটি ‘ঘটি’ একান্নবর্তী পরিবারে। আশেপাশে পূর্ববঙ্গের অনেক মানুষজনের বাস থাকলেও ঘনিষ্ঠজনের মধ্যে ‘বাঙাল’ শব্দটি প্রায় নিষিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হতো। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, আমাদের রান্নাঘরে এই মানসিকতার কোনও সচেতন প্রভাব লক্ষ্য করিনি। একটা আঞ্চলিক চরিত্র অবশ্যই ছিল এবং তাকেই আমি স্বাতন্ত্র্য বলে মনে করি। যেমন ধরা যাক, আলু পোস্ত। সাধারণভাবে এই পদটি ঘটি হেঁশেলের হলেও আপামর বাঙালি এর প্রেমে গদগদ। কম বয়সের স্মৃতি হাতড়ে মনে পড়ছে বর্ধমানে, মাতুলালয়ে যখনই যেতাম অন্তত তিন রকম (কখনও কখনও চারও) পোস্ত রান্না হতো। পোস্ত বাটা, পোস্তর বড়া, আলু বা ঝিঙে পোস্ত আর হয়তো মাছের কোনও একটা পদ পোস্ত দিয়ে। এইরকম আর কি!

এই পোস্ত রান্না নিয়ে অনেক নিয়মকানুন মেনে চলতে দেখেছি ছোটোবেলা থেকে। প্রথমত আলু কাটা। তার একটা নির্দিষ্ট আকার এবং আকৃতি থাকবে। তারপর বাটা। শিলে বাটতে পারলে সবচেয়ে ভালো। মিক্সির ব্যবহার স্বীকৃত হওয়ার পর মিক্সিতেও পোস্ত তৈরি করে নেওয়া হয়ে থাকে। আর সেটাই নিঃসন্দেহে আজকের পরিস্থিতিতে যথাযথ কারণ শিলের পাট অনেক বাড়ি থেকে উঠেই গেছে। আর কোনও বড় হোটেল বা রেস্তোরাঁয় শিলে বেটে পোস্ত রান্না কি সম্ভব? যাই হোক যা বলছিলাম। আলু কেটে নেওয়া হলো, পোস্ত বেটে নেওয়া হলো। এরপর কড়াইতে সরষের তেল দিয়ে সামান্য অপেক্ষা। ধোঁয়া উঠলেই আলুর টুকরোগুলো তেলে দিয়ে অল্প নাড়াচাড়া করতে হবে। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয়টা এই যে আমাদের বাড়িতে পোস্ত রান্নায় ফোড়ন দেওয়া বারণ ছিল চিরকাল কারণ মনে করা হয় যে ফোড়নের গন্ধ পোস্তর সুগন্ধকে ঢেকে দেয়। তাই আলুর কাঁচাভাবটা চলে গেলেই বাটা পোস্তটি তাতে দিয়ে দেওয়া হয়। দেওয়া হয় পরিমাণমতো নুন আর কয়েকটি পেট-চেরা কাঁচালঙ্কা। কাঁচালঙ্কা অবশ্য বাটার সময়েও দেওয়ার কথা! এরপর আর বিশেষ কিছু করণীয় থাকে না, চাপা দিয়ে কম আঁচে রান্নাটা হতে দেওয়া ছাড়া। এই পুরো প্রক্রিয়াটা এতই সরল যে কখনও যে রান্নাঘরে ঢোকেনি, তার কাছেও এটা জলভাত বলে মনে হতে পারে আর ফাঁদটা ঠিক সেখানেই। এক মাহেন্দ্রক্ষণে খুলে দিতে হবে ঢাকনা আর গ্যাসটা বাড়িয়ে কয়েকমিনিট ভালো করে নাড়তে হবে যতক্ষণ না পোস্তর রঙটা সাদা থেকে হালকা বাদামির দিকে যাচ্ছে। ছোটবেলায় বাড়িতে কয়লার উনুনে এই রান্না হতে দেখেছি বারংবার। একথাও বলা বাহুল্যমাত্র যে তার স্বাদ তর্কাতীতভাবে হতো ব্যতিক্রমী। আর হ্যাঁ বলা হয়নি হলুদের প্রয়োগ নৈব নৈব চ! কেন ? সে প্রশ্ন কাউকে করিনি কখনও। আর সত্যি কথা বলতে কি পোস্তর সঙ্গে হলুদের রং ঠিক মানায় না। কেমন যেন জাতভ্রষ্ট মনে হয়! এই পোস্ত রান্নার প্রসঙ্গে একটি বিশেষ পদের উল্লেখ করতেই হচ্ছে। যার সঙ্গে আমার আজন্মলালিত স্বাদের অনুষঙ্গ জড়িত। আলুপেঁয়াজ পোস্ত। যেকোনও দিন, যেকোনও সময় যদি আমাকে একটিই পোস্ত রান্না বেছে নিতে বলা হয়, চোখ বন্ধ করে আমি জুলিয়েন করে কাটা পেঁয়াজের সঙ্গে আলু আর পোস্তর অপূর্ব মেলবন্ধনের এই পদটিকেই নির্বাচন করে নেবো। চোখ বন্ধ করে যেকোনও মুহূর্তেই অনুভব করতে পারি বিউলির ডাল আর ধোঁয়াওঠা ভাতের সঙ্গে আলু পেঁয়াজ পোস্তর সেই অপূর্ব স্বাদ, যা সারাজীবন আমায় তাড়া করে বেড়াবে।

শুরু করেছিলাম দুই বঙ্গের হেঁশেল সংস্কৃতির আলাদা-আলাদা ধরন-ধারণের কথা দিয়ে। এ বিষয়ে মূল যে জায়গাটা আমাদের নজর এড়িয়ে যায়, তা হলো শ্রেণীবিভাগ যদি করতেই হয়, তা অঞ্চলের ভিত্তিতেই হওয়া ভালো কিন্তু সেই ভাগ যদি হয় পূর্ব এবং পশ্চিম বঙ্গের মতো কোনও বৃহৎ এলাকার ভিত্তিতে, যা আসলে একাধিক ভিন্নধর্মী অঞ্চলের সমষ্টি, তাহলে বিষয়টি একটু অন্য দৃষ্টি দিয়ে দেখতেই হয়। পুরুলিয়ার রান্না আর বর্ধমানের রান্না কি এক? অথবা ঢাকা এবং চট্টগ্রামের রন্ধনশৈলী? তাহলে পুব-পশ্চিমের হিসেবটা গৌণ হয়ে গেল না কি? ঘটি রান্না মানেই ‘মিষ্টি সরবত’ আর বাঙাল হেঁশেল মানেই ‘ঝালের ঠ্যালায় অস্থির’ – এমন নাও হতে পারে। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। তা হলো অন্য সমস্ত শিল্পের মতো রন্ধনশিল্পেও পরিমিতিবোধের প্রয়োজন অপরিসীম। পরিমিতিবোধ, ‘সেন্স অফ টাইমিং’ আর উদ্ভাবনী ক্ষমতা – যে কোনও শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই তিন মূল উপাদানের সমন্বয় জন্ম দিতে পারে ‘মির‍্যাকল’ বা অত্যাশ্চর্য কোনওকিছুর। রান্না শিল্প এর ব্যতিক্রম নয়। চূড়ান্তভাবে ঐতিহ্যনির্ভর এই শিল্পটির ইতিহাস ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসের মতোই। ভাষা যেমন বহমান নদীর মতো – এক এক অঞ্চলে তার এক এক রকম রূপ। হেঁশেলের সংস্কৃতিও তেমনই। যুগ-যুগান্ত ধরে সে হস্তান্তরের নানান পর্ব পেরিয়েই চলেছে। তার কোনও অন্ত নেই। শেষ পর্যন্ত যা বেঁচে থাকে তা হলো স্বকীয়তা আর তাকে জিইয়ে রাখা দরকার যেকোনও মূল্যে। ছোটো ছোটো উপকরণ একটা রান্নাকে এত নাটকীয়ভাবে বদলে দিতে পারে, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। পোস্তর মতোই আরেকটি খুব প্রচলিত রান্নার কথা বলি। ছোটো কচি বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল। এই রান্নাটি পূর্ববঙ্গের। আটের দশকের মধ্যভাগে এই পদটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। যে কোনও রান্নার একটি বিষয় আমাকে খুব আকৃষ্ট করে। তা হলো সারল্য। এত সহজ একটা রান্না অথচ টাটকা উপকরণ আর হাতের গুণে তা হয়ে ওঠে অনবদ্য। স্বাস্থ্যের অজুহাত দিয়ে আমার শাশুড়ি মহাশয়া তাঁর রান্নাগুলিকে করে তুলেছিলেন সহজ থেকে সহজতর। প্রচলিত বহু নিয়মেরই তিনি তোয়াক্কা করতেন না। খুব ভোরে উঠে দুবেলার রান্না করে তিনি কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তেন। সে কারণে রান্নার জন্য তাঁর সময় ছিল নির্দিষ্ট আর এই বিষয়টিই তাঁর রান্নাগুলিকে দিয়েছিল আলাদা একটি মাত্রা। বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল আমার এই বক্তব্যের সমর্থনে একটি বড় নজির। এই রান্নার পদ্ধতি বর্ণনা করে সময় নষ্ট করতে চাই না কেননা সব মাছের ঝোলের মতোই এই অবতারটি রান্নার উপকরণ এবং মৌলিক পদ্ধতি সবক্ষেত্রে প্রায় এক, তফাৎ হয় অন্যত্র। কিন্তু কাঁচালঙ্কা-কালোজিরের সেই স্বাদ, যার মধ্যে লঙ্কার গন্ধটি সদা-জাগ্রত আর প্রথমবার গলাধঃকরণ করার সঙ্গে সঙ্গে গলার মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি, যা আসলে মুখের ভিতরের পেলব অংশে কাঁচালঙ্কার অভিঘাত। আদ্যন্ত বাঙাল এই রান্নাটিকে আমি পরবর্তীকালে আমাদের ঘটি পরিবারে দায়িত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম এবং অচিরেই তা মূল স্রোতের সঙ্গে মিশে যায়। এই রান্নার ক্ষেত্রে বেগুনের জায়গায় ঝিঙে, কুমড়ো বা কাঁচকলার ব্যবহারও দেখেছি। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ফলাফল হতো অতি চমৎকার।

ঘটি – পোস্ত আর বাঙাল- ইলিশ বেগুনের ঝোল, এই দুই রান্নার মধ্যে আদতে যা লুকিয়ে আছে, তা হলো এক অদ্ভুত আবেদন, যাতে সাড়া দেওয়ার জন্য ঘটি বা বাঙাল না হলেও চলে। প্রশ্নটা এক্ষেত্রে একটু আলাদা। এই দুই পদের হাত ধরে ঠিক কোথায় পৌঁছতে চেয়েছিলাম? সেই জায়গাটি হলো, শুরুর দিকে যা বলেছি - একটি বিশেষ পদ সৃষ্টি হচ্ছে যে হেঁশেলে, তার ভৌগলিক অবস্থানও অত্যন্ত জরুরি। কলকাতা শহরে এই রান্নাগুলির বর্ণ, স্বাদ ইত্যাদি যা হবে, স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তা অনেকখানিই বদলে যেতে পারে বললে ভুল হবে, আসলে বদল অবশ্যম্ভাবী। Local Palate বা স্থানীয় স্বাদ বলে একটা বিষয় আছে না? এমনকি এক শহরের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে নাম-না-জানা কত রকমারি রান্নাঘর। তার হদিশ আমরা কজন জানি? আমার শাশুড়ির পরিবার আদতে বরিশালের। অগ্রজ তিন দাদারই জন্ম সেখানে। আর তাঁদের একমাত্র সহোদরা জন্মালেন গড়পাড়ে, বড়ো হয়ে উঠলেন হুগলিতে। অতএব ঘটলো চরম অনর্থ। সারাজীবন পূর্ববঙ্গের সঙ্গে নিবিড় আত্মিক যোগ অনুভব করেও হেঁশেলে ঢুকতে দিলেন না শুঁটকি আর ঝালের সঙ্গে ছিল তাঁর সারাজীবনের আড়ি। অথচ তাঁর হাতেরই অনেক পূর্ববঙ্গীয় রান্না আমাকে মুগ্ধ করেছিল। রান্না বিষয়টি নিয়ে অনেককে খুব বিব্রত হয়ে পড়তে দেখেছি কিন্তু তিনি কর্মক্ষেত্রে গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি হেঁশেল সামলানোর কাজটি বরাবর করে এসেছেন অনায়াসে। আমার একান্ত ব্যক্তিগত হেঁশেল-দর্শন বলে কে কত বড়ো মাপের রন্ধনশিল্পী, সেই বিচারের ক্ষেত্রে দক্ষতার পাশাপাশি রান্নাবান্নার এলাকাটিকে আমাদের জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বয়ে চলা এক সৃজনের পরিসর বলে মেনে নেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন। বাঙাল-ঘটির আঞ্চলিক আধিপত্য জাহির করার লড়াইটি সেক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





















কালকে দার্জিলিং যাওয়ার গ্রুপটা রওনা হয়ে যাবে। প্রায় ৪৫ জন। বাকি দেড়শ জন পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাব সাতদিন পরে।
অর্থাৎ এই সাতদিন লাকি একলা হয়ে যাবে, মিতা তো দার্জিলিং গিয়ে অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দে মশগুল হবে।
আমরা যথারীতি প্রেয়ার হলের পেছনের বারান্দায় হাতধরাধরি করে দেয়ালে হেলান দিয়ে কথা বলছি।
পূজোর পনের দিন ছুটি। লক্ষ্মীপূজোর পর হোস্টেলে ফিরতে হবে। বিসর্জনের পর বাড়িতে কেমন একঘেয়ে লাগবে। বাড়ির রান্না, পূজোর নতুন জামাকাপড়, পার্কসার্কাস পাড়ায় দূর্গোপূজো বা অষ্টমী-নবমীতে সকালের অঞ্জলি ও সন্ধ্যেয় ঘুরে ঘুরে বালিগঞ্জ ভবানীপুরের ঠাকুর দেখা-- তার রোমাঞ্চ আর আগের মত নেই।
মিতা বলে-- একদিন আমার বাড়িতে আয় না? দুজনে খেয়েদেয়ে ঘুরে বেড়িয়ে --।
--- কোথায়?
-- আমহার্স্ট স্ট্রীট পাড়ায়।
--বেশি চিনি না। শ্যালদা চিনি, আর কলেজ স্ট্রিটে গোপাল পাঁঠার দোকান চিনি। কয়েকবার কাকার সঙ্গে মাংস কিনতে গেছি।
--ব্যস্‌, ব্যস্‌! ওতেই হবে। তুই পার্কাসার্কাস ডিপো থেকে শ্যালদার ট্রাম ধরে আয়। তারপর হ্যারিসন রোড ধরে কলেজ স্ট্রীটের দিকে দুটো স্টপ এগিয়ে যা। ছবিঘর সিনেমার সামনে দাঁড়াবি। আমি এসে তোকে নিয়ে যাব। দুপুর একটা নাগাদ আয়।
-- মাকে বলতে হবে। ট্রামের ভাড়া চেয়ে নিতে হবে না?
-- হ্যাঁ, বলেই আসবি। তাইতো একটা নাগাদ আসতে বললাম। নইলে মাসিমা ভাববেন ম্যাটিনি শো'তে সিনেমা দেখার ধান্দা করেছিস।

আমরা বেশ উদ্দীপ্ত হই। এটা দারুণ হবে।
এমন সময় খেলার মাঠের দিক থেকে একটা বিকট চিৎকারে চমকে উঠি। নাঃ, বেশ কয়েকজনের উত্তেজিত কথাবার্তা আর চিৎকার।
আমরা উঠে পড়ি, দ্রুত পা চালাই হট্টগোলের উৎস সন্ধানে।
ফুটবল মাঠের কাছে বিশাল ভীড়। এর ওর কাঁধের ফোকর দিয়ে উঁকি মেরে দেখি--- আমাদের রুম ক্যাপ্টেন রাজকুমারদাকে দোতলার ওয়ার্ডেন সন্তোষদা বেধড়ক পেটাচ্ছেন। কিন্তু তালঢ্যাঙা আর পেস বোলার রাজুদাকে পেটানো সহজ নয়। ও প্রাণপণে মারগুলো ভোঁতা করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সন্তোষদা হাঁফিয়ে উঠেছেন। এবার বেত ফেলে দিয়ে ওর কায়দা করে সিঙাড়া করা চুলের মুঠি ধরে ঘাড়ে রদ্দা।
আর তক্ষুণি একটা তীক্ষ্ণ খ্যানখেনে গলাঃ অ্যাই ছেড়ে দিন, ওকে ছেড়ে দিন বলছি! ও কিচ্ছু করে নি। মারতে হয় আমাকে মারুন!
বিমানদা!
রাজুদার ভালবাসার পার্টনার!
বিমানদা অনুরোধ করছে না, সন্তোষস্যারের কাছে ভিক্ষে চাইছে না, বরং ওর রাগে গলা কাঁপছে, ও কাঁদছে!
সন্তোষদা হতভম্ব। ভিড়ের মধ্যে নানান আওয়াজ, অধিকাংশই সন্তোষস্যারের বেত চালানোর বিরুদ্ধে।
উনি ছেড়ে দিয়ে বললেন-- যা! ফের কখনো--!
বিমানদা, ক্লাস টেনের বিমানদা, কাঁদতে কাঁদতে সবার সামনে রাজুদাকে জড়িয়ে ধরে টানতে টানতে আমাদের রুমের দিকে নিয়ে যায় আর রাজুদা শরীরের সমস্ত ভার ওর ওপর ছেড়ে দিয়ে কেমন ঘসটে ঘসটে চলে যায়।
ভিড় পাতলা হয়। অনেকের সঙ্গে আমরাও কলতলার দিকে এগিয়ে যাই। একটু পরেই প্রেয়ারের ঘন্টা বাজবে।

প্রশান্ত আমাকে বলে--দেখলি! এই হল সত্যিকারের ভালবাসা।
-- আচ্ছা, বিমানদা ওরকমভাবে সবার সামনে রাজুদার জন্যে স্ট্যান্ড নিল, কাঁদল; তারপর মার খাওয়া রাজুদাকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে গেল।
-- গেল তো! তাতে কী হয়েছে?
-- লজ্জা করল না?
-- কেন করবে? ঠাকুর বলেছেন না?--লজ্জা-মান-ভয়, তিন থাকতে নয়!
--- ভাগ শালা! কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা?
--- হ্যাঁ হ্যা`; কোথায় নেতাজি আর কোথায় পেঁয়াজি!
বিশু ফান্ডা দেয়-- ভুল কী বলেছে! ঠাকুর যে তিনটে আকর্ষণ বা টান এক হলে ঈশ্বর থাকতে না পেরে ভক্তকে দেখা দেন বলেছেন তার মধ্যে একটা হল --নষ্ট মেয়ের উপপতির জন্যে টান।
--ঠাকুর এরম উদাহরণ দিতেই পারেন না।
-- কথামৃত পড়িস নি তো! না পড়ে তক্কো করছিস। পড়লে জানবি ঠাকুরের উদাহরণগুলো সব গ্রামের জীবনের থেকে নেওয়া। তাতে মাটির সোঁদা গন্ধ টের পাওয়া যায়।

প্রেয়ার হলে ঢোকার মুখে বিপ্লব থুড়ি মিতা আমার হাত ধরে টানে।
-- লাকি, আজ বিমানদাকে দেখে কেমন সেদিনের বিশুর বলা কথাটা একটু যেন বুঝতে পারলাম।
-- কোন কথাটা?
-- ওই যে-- "আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তারে বলি কাম,
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম"।


এরপর রাত্তিরে দরজায় ঠক্ঠক বা চাপা গলায় রাজু-রাজু ডাক শুনলে আর বিচলিত হই না। সবার আগে গিয়ে চুপচাপ দরজা খুলে দিই। তারপর বিমানদা ক্যাপ্টেনের মশারিতে ঢুকে গেলে আমিও নিজের মশারিতে সেঁদিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ওদের মশারি থেকে কথাবার্তা বা বেড়ালের দুধে চুমুক দেওয়ার আওয়াজ কিছুই আর আমার কানে ঢোকে না; আমি অঘোরে ঘুমোতে থাকি।

0 comments:

1

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in



পর্ব (৩)

বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দী মৃত্যুশয্যায় দুটি অদ্ভূত সিদ্ধান্ত নিলেন। আমীর ওমরাহ্ এমনকি পারিবারিক অসন্তোষকে একরকম উপেক্ষা করেই তৃতীয়া কন্যা আমিনা বেগম ও ভ্রাতুষ্পুত্র জৈনুদ্দিন আহমেদের ঔরসজাত সন্তান সদ্যযুবা তাঁর প্রিয়তম দৌহিত্র মির্জাকেই নবাবী মসনদের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে দিলেন আর একই সঙ্গে সেই স্পর্ধিত উন্নাসিক যুবাটিকে তার যৌবনমদে মত্ততার সুস্থিতির জন্য কোরাণ ছুঁয়ে শরাব পান পরিহার করার অঙ্গীকারটিও আদায় করে নিলেন একইসাথে। সেই কটক অভিযানের সময়ই আলীবর্দী তাঁর সদাপ্রিয় মির্জার মধ্যে মসনদে বসার যোগ্য সম্ভাবনাটি দেখেন, কিন্তু তার উদ্ধত বেপরোয়া আর দুর্বিনীত স্বভাবটি যে তাঁর জীবদ্দশায়ও যে শেষমেশ রয়েই গেল এই আক্ষেপটির সঙ্গে অতিরিক্ত অন্ধ প্রশ্রয়দানের অভিযোগের দূর্নামটিও সাথে নিয়েই তাঁকে ভাগীরথীর অপর পাড়ে খোশবাগে চিরশয্যাটি পাততে হল।

এদিকে বাংলাদেশের সম্পদের প্রাচুর্য তখন প্রলুব্ধ করেছে ইওরোপীয় বণিকদের। চুঁচুড়ায় ওলন্দাজরা, শ্রীরামপুরে দিনেমাররা, হুগলি আর করকাতায় ইংরেজরা আর চন্দননগরে ফরাসীরা আস্তে আস্তে কুঠি তৈরী করে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এদের সবাইকে প্রতিযোগিতায় পিছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে আসছে ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীই। রাজমহল, কাশিমবাজার,কলকাতা আর পাটনা মিলিয়ে তাদের সোরা,বারুদ, নুন আর কাপড়ের ব্যবসায় তখন বেশ পালে হাওয়া লেগেছে। জোব চার্ণকের গরিমা যদিও তখন অস্তমিত। জামাতা চার্লস কোম্পানীর অ্যাডভাইসারি বোর্ডে রয়েছেন নাম কা ওয়াস্তে। নিজে আপাতত সুদের কারবারে মন দিয়েছেন। এই মুহূর্তে কোম্পানীর নতুন মুখপাত্র হল তিন নবীন শ্বেতাঙ্গ মূর্তি। ক্লাইভ, ওয়াটস্ আর উইলসন্। মূর্শিদাবাদের আকাশ বাতাসে আজকাল কান পাতলে ফিসফিসিয়ে দিনবদলের খবর ঘুরপাক খাচ্ছে। তলে তলে রফা নিষ্পত্তি হচ্ছে ভাগ বাঁটোয়ারার। নবাবী মসনদটি এবার যেন টলে উঠবে!

ভারত প্রাতঃস্নান সেরে গুড় ও চিঁড়ে দিয়ে আজ ফলার করছিল। কাল সন্ধ্যেবেলায় দত্তদের বাড়িতে পূর্ণিমার স্বস্ত্যয়ন বিহিত পুজোর সিধেটুকু সে ব্রাহ্মণ বলেই সসম্মানে লাভ করেছে। এখনো বেশ কটি মোটা মোটা সবরী কলা আর একটি ছোট ধামায় বিন্নিধানের খইও ঘরে রাখা আছে। ব্রাহ্মণভোজনের এই একটা সুবিধা খাওয়ার পরও খানিকটা ছাঁদা বেঁধেও নিয়ে আসা যায়। ইতিমধ্যে রাধা নদীঘাট থেকে সদ্য স্নান সেরে ফিরেছে। ফলার খেতে খেতেই ভারত তার সিক্তবসনা যুবতী তনুটি মুগ্ধদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে থাকে। রাধার দৈহিক রূপান্তরটি তাকে আজকাল বড়ই আনন্দ দেয়। এই কদিন আগেই সে একটি সাধারণ ছোট্ট বালিকাই ছিল বলা যায়, আজ তার সেই দেহটিকে ঘিরে পুষ্পধনুর পেলব আল্পনা জেগে উঠেছে। স্বামীর স্থির দৃষ্টিপাতে সলজ্জ রাধা চকিতে ঘরে ঢুকে দোর বন্ধ করে। সে ভালই জানে ভারতের প্রেমোদ্দীপনা জাগলে এক্ষুণি তার ক্ষুদ্র সংসারটির দৈনন্দিন সব কাজ সকাল সকাল শিকেয় উঠবে। ভারত তক্ষুণি নিমেষে উঠে গিয়ে দরজায় মৃদু করাঘাত করে ঠিক দু'বার। ভেতরে রাধা মনে মনে প্রহর গোণে একটি আসন্ন কালবৈশাখী ঝড়ের। নববধূর ব্রীড়ায় দরজাটি খুলে সে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে থাকে। সুচারু দন্ততে সে অধরটি দংশন করে আর আনত দৃষ্টিতে মাটির দিকে চেয়ে থাকে। ভারত ভাববিহ্বল হয়ে সেই ক্ষীণকটি সুতনুকাকে সবলে নিজের কোলে তুলে নিয়ে তার কানের লতিতে মৃদু মৃদু দংশন করতে থাকে । ধীরে ধীরে বস্ত্রমোচনের পর এক স্বাদু প্রণয়লীলায় উভয় নিমজ্জ্বিত হয়। মিলন শেষে রাধার কপালের অবিন্যস্ত চুলগুলি যত্নকরে নিজের হাতে সরিয়ে দিতে দিতে ভারত রাধার কানের কাছে মুখ এনে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করে,

বিনাইয়া বিনোদিয়া বেণীর শোভায়
সাপিনী তাপিনী তাপে বিবরে লুকায়
কে বলে শারদশশী সে মুখের তুলা
পদনখে পড়ি তার আছে কতগুলা
কি ছার মিছার কামধেনু রাগে ফুলে
ভুরুর সমান কোথা ভুরু-ভঙ্গে ভুলে !

এরপর দুই যৌবনউৎসুক নরনারী সকালের আকস্মিক প্রীতি ও স্মরোদ্দীপনার প্রাবল্যে একে অপরেতে আরো একবার জোরালো রতিবাসরে নিবিষ্ট হয়ে ওঠে।


আদিগঙ্গা (অন্যান্য নাম গোবিন্দপুর খাঁড়ি বা সারম্যানের নালা বা টালির নালা) হল বঙ্গদেশের প্রাণস্বরূপা। কলকাতা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একটি ছোটো নদী। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই নদীটিই ছিল হুগলি নদীর প্রধান ধারা। পরে এই ধারাটি ক্ষীণ হয়ে আসে। ভাগীরথী খাতে প্রবাহিত গঙ্গা নদীর নিম্ন প্রবাহটি একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যেমন ছিল, তেমনটি আগে ছিল না। বহু প্রাচীনকালে গঙ্গা-ভাগীরথী আরও পশ্চিম দিকে রাজমহল, সাঁওতালভূমি, ছোটনাগপুর, মানভূম, ধলভূমের তলদেশ দিয়ে সোজা দক্ষিণবাহিনী হয়ে সমুদ্রে পড়ত এবং এই প্রবাহই ছিল অজয়, দামোদর ও রূপনারায়ণের সঙ্গম। এই নদী তিনটিই তখন নাতিদীর্ঘ।ভাগীরথী প্রবাহের দক্ষিণতম সীমায় অধুনা তমলুকে ছিল একদা তাম্রলিপ্ত বন্দর। এর পরবর্তীকালে গঙ্গার ক্রমশ পূর্বদিকে যাত্রা শুরু হলে তাম্রলিপ্ত বন্দর পরিত্যক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ফরাক্কা থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত গঙ্গা-ভাগীরথী ব্যান্ডেলের কাছে ত্রিবেণীতে তিনটি শাখায় ভাগ হয়ে যেত। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সপ্তগ্রামের পাশ দিয়ে বজবজ, ফলতা, ডায়মন্ডহারবার হয়ে সমুদ্রে পতিত হত সরস্বতী নদী। তাম্রলিপ্ত বন্দর পরিত্যক্ত হওয়ায় এই নদীর তীরে গড়ে ওঠে সপ্তগ্রাম বন্দর। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বয়ে যেত যমুনা নদী (উল্লেখ্য, এই নদীটির সঙ্গে উত্তর ভারতের যমুনা নদী বা বাংলাদেশের যমুনা নদীর কোনো সম্পর্ক নেই), মাঝখান দিয়ে বইত হুগলি নদী। এখন যেখানে কলকাতা শহর সেখানে হুগলি নদী বাঁক নিত (নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে হুগলি নদী বেতড়ের কাছে বাঁক নিত যেটি বর্তমানে গার্ডেনরিচের ঠিক উল্টোদিকে শিবপুর থেকে আর কালীঘাট, বারুইপুর, মগরা, গোচরণ, জয়নগর, দক্ষিণ বিষ্ণুপুর, ছত্রভোগ, বড়াশী, খাড়ি, কাশীনগর ও কাকদ্বীপের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম সাগরদ্বীপে (সম্ভবত এই সাগরদ্বীপে প্রাচীন বীর বাঙালি জাতি গঙ্গারিডিদের রাজধানী 'গঙ্গে ' বন্দরের অবস্থান ছিল) প্রবেশ করে ধবলাট ও মনসা দ্বীপের মধ্য দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে মিশত। এই আদি খাতটিকেই বলা হয় আদিগঙ্গা। ইতিহাসের ধারার মত এই নদীটিও বারবার বদলেছে গতিপথ আর সাথে সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তথা ইংরেজদের বিজয়যাত্রায় এই নদীটির গুরুত্ব অপরিসীম। এরই একটি অংশে জলঙ্গীর বুকে দক্ষিণমুখে অদূরে একটি বজরা দেখা গেল। ওটির ভিতর অক্ষম রাগ ও অপমানে মুখটি লাল করে বসে আছেন কৃষ্ণনগরের রাজা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। সঙ্গে আছে তাঁর একমাত্র বিশ্বস্ত অনুচর হুকুমচাঁদ। আজ বিজয়া দশমী। মতিঝিলে নবাবের বন্দীশালা থেকে ছাড়া পেয়ে আজ ভোরেই কৃষ্ণনগরের পথে যাত্রা করেছেন। জলঙ্গির দুধারের গ্রাম গুলোয় দু একটা প্রতিমার নিরঞ্জন শুরু হয়ে গেছে । রাগে, আক্ষেপে তাঁর নিজের দুএকগাছা মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। আলীবর্দীর দৌহিত্রটি নবাবী মসনদে বসে হাতে মাথা কাটছে যেন সবার। আমীরচন্দ্ এর মত মানী ওমরাহ্ কেও যে অপমান করে সর্বসমক্ষে তার যে নবাবীর মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে তা বলা বাহুল্য। খোদ নবাবী কোষাগার আর কোম্পানির হুন্ডি দুটোতেই জগৎশেঠ আর আমীরচন্দ্ দের টাকা সুদে খাটে। আহাম্মকটা তাকেও চটিয়েছে। এবছর নিজের মহলের খাজনার পরিমাণে একলক্ষ টাকা কম পড়ায় সেই মহালয়ার দিন থেকে কৃষ্ণচন্দ্রকে মূর্শিদাবাদে ডেকে এনে যাচ্ছেতাই অপমান করে একরকম নজরবন্দী করেই রেখেছিল হারামজাদাটা।এই সাতদিনের বন্দীদশায় অসহায়ের মত পেরিয়ে যেতে দেখলেন শারদীয়া পূজার তিথিটি। এই প্রথমবার কৃষ্ণনগরে তাঁর ভদ্রাসন 'শিব নিবাসে' জগন্মাতা রাজরাজেশ্বরীর পূজাটি সম্ভবপর হল না। কৃষ্ণনগরে ফিরেই একবার মহারাজা নন্দকুমার, আমীরচন্দ্, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, জানকীরাম এইসব ক্ষমতাবান পয়সাওলা মানুষজনদের সাথে বসে একটা শলাপরামর্শ করে এই মির্জা বজ্জাতটাকে শায়েস্তা করতেই হবে।

এতক্ষণে বজরাটা জলঙ্গীর সীমানা পার করে চূর্ণীর বাঁকে এসে বাঁদিকে ঘুরল। আর আধবেলার মধ্যেই কৃষ্ণনগর পৌঁছনোর কথা। মাঝিদের সর্দার লতিফ মিঞা বিনীত কন্ঠে আর্জি জানায়

" হুজুর! এখানে ঘন্টাটাক নোঙর ফেলতি হয় যে! দুটো ভাতে ভাত তবে ফুটায়ে নি কত্তা!"

কৃষ্ণচন্দ্র সম্মতি দিয়ে ঘাড় নাড়লেন।অনেক ভোরে বেড়িয়েছেন বলে তাঁরও বেশ ক্ষুধাবোধ হচ্ছে। অথচ এখানকার বাজারের কোন খাবারের প্রতি তাঁর রুচি নেই। হুকুমচাঁদকে বললেন উৎকৃষ্ট দই, চিঁড়ে, গুড়, বাতাস আর কলা কিনে আনতে। আপাতত তাই দিয়েই এখনকার মতো রাজভোগটি উদরস্থ করতে হবে। কৃষ্ণচন্দ্র মানুষটি খাদ্যরসিক ও ঔদরিক। রাজবাড়িতে এই সময় তাঁর একটি হুকুমে অতিপ্রিয় গাওয়া ঘিএর লুচি, মোহনভোগ, সরভাজা আর হিং দেওয়া চাপ চাপ ছোলার ডাল সামনে এসে হাজির হতে পারতো।তার বদলে অবস্থার ফেরে পড়ে ফলারে বামুনদের মতো দইচিঁড়ে গিলতে বসতে হবে। কৃষ্ণনগরের মহারাজার বজরা ঘাটে লাগার খবরে পুরো এলাকাটিতে হুলুস্থুলু পড়ে গেল।


রতনের উচ্চারণে একটু সামান্য গ্রাম্য টান এখনো রয়ে গেছে তবে সে গানের গলার জোরে সেটুকু খামতি যে ঢেকে দেবে তা বলাই বাহুল্য। আরোহণের উঁচু পর্দাতেও তার স্বরভঙ্গ হয়না। আর অভিনয় কুশলতায় আদুরী কিন্তু এই কদিনের অনেকটাই সপ্রতিভ হয়ে উঠেছে। গোলকনাথ সবাইকে পাখি পড়ানোর মত করে পার্ট করা শেখাচ্ছে। গোলক খুব করিৎকর্মা লোক। তার সূত্রেই ক্ষ্যান্তমণি নামে একটি মেয়েকে গরাণহাটার বেশ্যাপাড়া থেকে জোগাড় করে আনা হয়েছে। গোলকের ওপাড়ায় যাতায়াত অাছে গান শেখাবার সুবাদে। এই মেয়েটিই 'হীরামালিনী'র চরিত্রটি করবে। যাত্রা বা খেমটা নাচের ব্যাপারটা ক্ষ্যান্তমণি মোটামুটি জানলেও 'থ্যাটার পালা' বিষয়টা ওর কাছে একদম নতুন। ঠিকমত পোশাকী বাংলা সংলাপ উচ্চারণ করাটাও তার কাছে ততোধিক কঠিন। লাভের মধ্যে একটাই যে তার চেহারাটা চটকদার আর গলায় একটু হলেও সুর আছে। মুজরোর আদিরসাত্মক গান তার গলায় বেশ ভালই খোলে বলে লেবেদফ তেমন একটি গান - 'রসের নাগর ধরলে যে দোর / ভেতরে এলে না ' এই গানটিও নাটকের একটি অঙ্কে রেখেছেন। কিন্তু ভুজঙ্গধরের ক্ল্যারিওনেটের বাজনার সাথে গান করে মালিনীর একটা সংলাপ আছে -

"আমারে যেমন /মারিলি তেমন/পাইবি তাহার কিয়া/নষ্টের এ বড় গুণ, পিঠেতে মাখয়ে চুন/কি দোষ পাইয়া ওরে কোটালিয়া /মারিয়া করিলি খুন ।।"

সেটা কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ক্ষ্যান্তমণি পুরো বাক্যটা একবারও ঠিকমত বলে উঠতে পারছেনা। 'নষ্টের এ বড় গুণ পিঠেতে মাখয়ে চুন' খালি তার মুখে 'নষ্ট গেল চুন ! ' হয়ে যাচ্ছে বারবার।

শেষমেশ গোলক বেশ অধৈর্য গলায় রেগে ওঠে - 'মাগীর এমনিতে কত্ত কলকলানি! অথচ মালিনীর এট্টু গানটা গাইতে গিয়ে কোঁৎ পারচে কেমন দেকো!'

লেবেদফ খুব আশাবাদী এই 'বিদ্যা সুন্দর' নিয়ে। তার খুব ইচ্ছা প্রথম রজনীর আসরেই ক্যালকাটা সোসাইটির গণ্যমান্য সাহেবদের সঙ্গে গভর্ণর জেনারেল স্যার জন স্টোর'কেও অভিনয় দেখতে আমন্ত্রণ জানানোর। বিলেতী অপেরার ধাঁচে দেশী পালা এদেশে প্রথম অভিনীত হতে চলেছে, তাও অাবার একদম নবিশ নেটিভ অভিনেতা- নেত্রীদের দিয়ে, এ যেন একটা অকল্পনীয় ব্যাপার।

জন্মাষ্টমীর বদলে নভেম্বরের সাতাশ তারিখ আসরের দিনটি ঠিক হল। কলকাতার ইওরোপীয় সমাজের সাথে সাথে অনেক দেশীয় মানুষও সেই আসরে এসে ভীড় জমালো। ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর' এর অসামান্য নাট্যপ্রয়োগ আর তার সঙ্গে ইওরোপীয় অর্কেষ্ট্রার অনুপম বাদ্যসহযোগে ১৭৯৫ এর সেই রজনীটি কলকাতার বুকে এক নতুনরকম কান্ড হয়ে রইল। গভর্ণর নিজে লেবেদফ কে আলিঙ্গন করলেন আসরের শেষে। আর কার্টেন কলের সময় বেশীরভাগ দর্শক রতন, আদুরী আর ক্ষ্যান্তমণির দিকে মুঠো মুঠো পয়সা বখশিস্ ছুঁড়তে লাগল। সফল হল লেবেদফের স্বপ্ন।সবমিলিয়ে সেই সন্ধেটি হয়ে উঠলো এক জমজমাট ব্যাপার। রুশী পন্ডিতের ভোল্গা আর ভারতচন্দ্রের গঙ্গা এসে মিশলো এক নতুন স্রোতে।


গৃহদেবতা লক্ষ্মী জনার্দনকে প্রণাম করে ভারত গৃহিণীর সামনে এসে দাঁড়ায়। গত দুটি দিনের নিগূঢ় প্রেমের বন্ধনের পর আজ স্বামীকে অনির্দিষ্টদিনের জীবিকাসন্ধানের যাত্রায় বিদায় দিতে তার মন চাইছে না। ভারত নিজেও কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত বোধ করে এই গম্ভীর পরিবেশে। ভারতের শ্যালীপতির নবাবী নিজামতে মশলা আর কাপড়ের ব্যবসার সুবাদে দু একজন বড় মানুষজনের সাথে আজকাল খাতির হয়েছে। তাই সে ফরাসডাঙায় ফরাসী সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর কাছে সে সুপারিশ করেছে ভারতের চাকরীর জন্য।এজন্য তাকে একবারটি সেখানে যেতে হচ্ছে চৌধুরী মশায়ের সাথে দেখা করে কোন চাকরীর ব্যবস্থা করতে। ভাগ্যের অনেক বিপর্যয়ের পর এই পর্যায়ে আর যে কি বাকী আছে কে জানে? রাধাকে বুকে টেনে শিরোশ্চুম্বন করে ভারত। একটি ছোট পুঁটুলিতে সে পথের জন্য চিঁড়ে, নাড়ু আর নারকেলের তক্তি বেঁধে দিয়েছে। ভারত রাধাকে জীবিকা সংস্থানের আশ্বাস দিয়ে অবশেষে প্রস্থান করে। এখনো আর একজনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া তার বাকী।

খেয়াঘাটের শঙ্করীও ভারতের বিদায়কালীন প্রতীক্ষায় ছিল। সে অবশ্য ভারতের কাব্যের অত গভীর গূঢ় তত্ত্ব- চিন্তা বোঝেনা। ভারতের সাথে তার দীর্ঘ অদর্শনটিতেই বেশ আপত্তি। সারাদিনে একটিবার তো খেয়াঘাটে মানুষটাকে কাছে পাওয়া যায় তাও তো অনেক। প্রকাশ্যে সে ভারতের অঙ্গ স্পর্শ করেনা বটে তবে নৌকাটি লতাগুল্মের আড়ালে রেখে ভারতের বক্ষে সে মাথা রেখে তীব্র কান্নায় ভেঙে পড়ে। শঙ্করীর এই আত্মসমর্পণে কোনও জড়তা নেই। আদিম প্রকৃতিবালার মতোই সে অকপট। ভারত তার জীবনে এই দুটি ভিন্নরীতির রমণীর প্রেম ঋণ আজন্ম ভুলতে পারবে না।একটি তার আসঙ্গ অন্যটিতে আসক্তি। দুটিতেই তার মনমধুপ বড় লোভী। এর ব্যাখ্যা করতে গেলে এই পদটি বরং বেশ জুতসই ভাবে মিলে যায়,

যৌবন মরম জানে না যে বা 
পন্ডিত তাহারে বলয়ে কেবা II
যৌবনে তিনঅক্ষর লেখ/যে জন পরম উত্তম দেখ II
যৌবন মরম যে জানে নাই। প্রথম ছাড়িয়া তাহার ঠাঁই II
যদ্যপি যৌবনে উদ্যম করে। প্রথমের মত গলিয়া মরে।I
ভারতচন্দ্রের ভারতী যোগ।
যৌবনেতে কর যৌবন ভোগ II 

1 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in




















১০

সুমনের বাঁশি বাজানো দেখে লাইনের অনেকে হিংসা করে।রূপসী বল,ভালো কাজ করলেই শত্রু বেড়ে যায়।সুমন বল,ছেড়ে দাও ওসব কথা।এসো আমরা সাধনা চালিয়ে যাই।তারপর সুমন বাঁশি বাজানো শুরু করলো। তার বাঁশির নবসুরে রূপসীর দেহ কেঁপে উঠলো।সুমন খুশি মনে স্নান সমাপন করলো।

রূপসীর হাতের রান্না খুব ভালো।সুমন খেলো।রাতে আজ কাজ নেই।মুরারী রাতে রূপসীর ঘরে এলো।সে বললো,শোনো সবাই।যাত্রাদলের এখন কোনো কদর নেই।তাই আমি আপাতত আলকাপের দল করবো।

সুমন বললো,যাত্রাদল তাহলে উঠিয়ে দেবে।

----না। বন্ধ হলো আপাতত।আবার ডাক পেলে হবে নিশ্চয়। আলকাপের নায়িকা হবে রূপসী।

----না, দাদা রূপসী নয়। ঝুলনকে করো।

---কেন? তোমার গায়ে লাগছে না কি?

সুমন বললো,রূপসী আজেবাজে ভাষা বলতে পারবে না।

মু রা রী বললো,কি বলছো রূপসী।

রূপসী বললো,আমি নাচ করবো। কিন্তু তোমার বিপরীতে অভিনয় করবে ঝুলন ভাই।

বেশ তাই হবে।কালকে আমাদের আলকাপ হবে। বায়না দিয়ে গেছে।

সুমন বলে,এখন আলকাপ শোনার লোক বেশি। আড়ালে রাতের বেলায় ভদ্রলোকেরাও চাদর মুড়ি দিয়ে শুনতে আসে আলকাপ। খিস্তিখেউড় শুনতে মজা লাগে। মেয়েদের নগ্ননাচ দেখতে ভালো লাগে দর্শকের। টাকা পয়সাও দেয় অনেক। তাহলে যাত্রার ভবিষ্যৎ কি?

রূপসী বল,ছাড়ো তো ওসব কথা। এখন চলে গেলেই হলো।

মুরারী ভালো ব্যবসাদার। সে নিশিকান্ত কে দলে নিলো।ভালো আলকাপ করে। নাম আছে। দলের নাম দিলো,নিশিকান্তর আলকাপ।

তারপর পরের দিন রাতে শুরু হলো আলকাপ। সুমনের বাঁশির তালে নিশিকান্ত আর রূপসী নাচ আরম্ভ করলো।তারপর শুরু হলো আলকাপ। নিশিকান্ত একটা রসগোল্লার হাঁড়ি দুপায়ের ফাঁকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি এলো। তারপর ঝুলন মেয়ে সেজে নিশিকান্তর হাঁড়ি থেকে রসগোল্লা খেলো। আহা কি মি। আরও খাবো।

নিশিকান্ত বললো,তোকো হাঁড়ি উপুড় করে রস খাওয়াবো। আয় আমার শালি।

এইভাবে আসর জমে উঠলো। প্রচুর টাকা পেলো নিশিকান্ত। তার নাম শুনেই লোকে ভিড় করে আলকাপ শুনতে আসে।

মুরারী বলে,দেখো সুমন, যাত্রার থেকে টাকা বেশি আলকাপে।মানুষ যা চায় তাই করতে হবে।তা না হলে না খেয়ে মরতে হবে।

সুমন কোনো উত্তর দেয় না। শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সুমন আজ অনেক দিন পরে বাড়ি গেলো। ছেলেটি বড় হয়েছে।পাশে কুড়োর বাড়ি। বিধবা হওয়ার পর ও একা থাকে। একা রান্না করে খায়।একাদশী করে। প্রচুর উপোষ করতে হয়। সুমন একবার বলেছিলো, তুমি আমার ভায়ের বৌ।তুমি ভালো গান জানো ।চলো যাত্রাদলে গান করবে। এভাবে জীবনটা নষ্ট করে কি লাভ। খেনী রেগে গিয়ে বলেছিলো,বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না। গ্রাম থেকে বাস ওঠাবে না কি? ও ওর মত থাক। সুমন চিন্তা করে দেখলো, এখনও কুসংস্কার দূর হতে অনেক সময় লাগবে। তারপর নিজের সংসারের কথা ভেবে আর ওসব নিয়ে কথা বলে নি। কুড়ো,খেনী দুইবোন। কালোকে কুড়োর কাছে রেখে শান্তি পায় দুদন্ড খেনী। নিঃসন্তান কুড়ো কালোকে পেয়ে মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করে।

0 comments:

0

গল্প - ঝানকু সেনগুপ্ত

Posted in





সাবির আলীর রাতে ঘুম হয় না! সারারাত ছটফট করে! ঘুম আসে না! সেই ছোটবেলার কথা মনে হয়!

বৃষ্টির রাত! প্রচণ্ড ঝড়! নদীটা ফুলে ফেঁপে উঠেছে! ক্রমাগত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে! ছোট্ট সাবিরের চোখের সামনে ওদের আমবাগানের চার পাঁচটা গাছ একটু হেলে গিয়ে বসে যেতে যেতে হঠাৎই অনেকটা মাটি নিয়ে ঝপাং করে ভাঙ্গনে তলিয়ে গেল! সাবির মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল! গাজন আলী চিৎকার করে বলল- ‘ওরে ও আমিনা, সাবিররে লিয়ে বাজারের দিকি ছুইট্যে চলি যাও! আমি আইসছি! সাবির আলী ভয়ে দুটো হাত বাড়িয়ে আর্ত কান্নায় ডেকে উঠল- ‘আ-ব্বা-জান!’ মেঘের গর্জনে ছোট্ট শিশুর কান্না হারিয়ে গেল!

এমনি করেই প্রতিবছর ভাঙ্গন হয়! জমি যায়! ভিটে যায়! স্কুল বাড়ি, মসজিদ, মন্দির সব গঙ্গার গর্ভে চলে যায়! কোটি, কোটি টাকা ভাঙ্গন প্রতিরোধের জন্য খরচা হয়! সব জলে যায়! শুধু মাফিয়া আর কনট্রাক্টরের পকেট ভরে! রাজনৈতিক নেতারা ভোটের সময় এসে আবার কয়েক কোটির গল্প বলে! তাতে ভাঙ্গন থামে না! গ্রামের পর গ্রাম, এই মুর্শিদাবাদ আর মালদায় হারিয়ে যায়! শুধু স্মৃতি ভেসে থাকে! সারারাত ভাঙ্গনের শব্দে সাবির আলীরা ছটফট করে! অ্যাডভান্সড অ্যাকাউন্টেন্সির ছাত্র সাবিরের ব্যালেন্স শীট মেলে না! সাবির আলীর আর একটা নাম হয় পরিযায়ী শ্রমিক!

পরিযায়ী সিকুউরিটি গার্ড! হাঃ হাঃ! নিজের মনেই হাসে সাবির আলী! শুধুই স্থানিক পরিবর্তন! হাওড়ার নার্সিং হোম থেকে ছত্তিসগড়ের রায়পুরে একটা হোটেল! তারপর সেখান থেকে ভিলাইয়ের এই ছোট্ট কোম্পানির সিকুইরিটি গার্ড! এখানকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটে পর পর অনেক ছোট ছোট কোম্পানি! ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের উপর এই কোম্পানিগুলো নির্ভরশীল! সাবির আলীদের কোম্পানির নাম ‘কমলাক্ষ মেকানিক্স’। মালিক কমলাক্ষ ভট্টাচার্য।

রায়পুরে হোটেলে কোনও একদিন চেক আউট করার সময় ভট্টাচার্য বাবু একটি ৫০ টাকার নোট দিতে গেলে সাবির নিতে চায় না, বলে- “কিছু মনে করবেন না স্যার, আমি বিনা পরিশ্রমে টাকা নিতে চাই না! আবার আসবেন! নমস্কার!”

স্তম্ভিত ভট্টাচার্য বাবু টাকাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষন! তারপর বলেন- “তোমার, আই মিন, আপনার নাম?”

- “না-না, আপনি আমায় তুমি বলতেই পারেন, স্যার! আমি তো আপনার থেকে অনেক ছোট!”

ভট্টাচার্য বাবু একটু হাসেন!

- “আমার নাম সাবির আলী! বাবার পরিচয় ধরলে আমি মুসলমান! ব্যক্তিগত ভাবে আমি অবশ্য কোনও ধর্মীয় অনুশাসন মানি না!”

- “হিউমানিস্ট?”

- “এক্স্যাক্টলি, স্যার!”

- “বাড়ি কোথায়?”

- “আদি বাড়ি নদীগর্ভে! বর্তমানে, রঘুনাথগঞ্জ। মুর্শিদাবাদ।”

- “ন-দী গর্ভ?!”

- “মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলায় আমাদের পূর্বপুরুষের কয়েকশ বিঘা জমি, আমবাগান, পাটের ক্ষেত, দালান বাড়ি সব সবটাই গঙ্গার ভাঙ্গনে তলিয়ে গেছে! রঘুনাথগঞ্জের কাছে আমগাছি গ্রামে আমার ঠাকুর্দার বিঘা তিনেক জমি ছিল! আপাতত সেখানেই আমার বাবা সামান্য কিছু চাষ আবাদ করেন! আমিই একমাত্র ছেলে! এখন পরিযায়ী শ্রমিক! হাঃ-হাঃ!”

- “পরি-যা-য়ী শ্রমিক! হুম্‌!” ভট্টাচার্য বাবু কিছুক্ষন চুপ করে থাকেন! তারপর বলেন- “তোমার সাথে কথাবার্তা বলে মনে হচ্ছে তুমি কিছুটা পড়াশুনা করেছ!”

- “হ্যাঁ। ওই আর কী!” একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সাবির! বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছে! ভিউ পয়েন্ট’ হোটেলের সিকুরিটি গার্ড সাবির আলী, নিজের দায়িত্বে সচেতন!

- “এক মিনিট স্যার! আলোগুলো জ্বালিয়ে নি!”

কমলাক্ষ ভট্টাচার্য শিবপুর বি.ই. কলেজের পাশ আউট! মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার! এই মুহুর্তে আরোপিত গাম্ভীর্য সরিয়ে সাবির আলীর সাথে গল্পে মশগুল! কমলাক্ষ বাবু একটা সিগারেট ধরান! কী মনে করে সাবিরকে বলেন- “কী সাবির, চলবে নাকি?”

- “না, স্যার! নেশা করার মতন বিলাসিতা আমাদের থাকতে নেই! হ্যাঁ, তবে মাঝে মাঝে আমার এখানকার বন্ধুদের, মানে ওই হোটেল বয়, কুক বা আমার পার্টনার আর একজন সিকিউরিটি গার্ড লোচনরামের থেকে ওদের বানানো খৈনি একটু আধটু খাই!”

- “হুম্‌! তা ভাল! তা, পড়াশুনো কতদূর করেছ বললে না তো?”

- ‘অ্যাডভান্সড একাউন্টেসি অনার্স নিয়ে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছিলাম। পার্ট ওয়ান পরীক্ষার ঠিক আগেই মা অসুস্থ হয়ে পড়ল! গলব্লাডারে স্টোন! মায়ের চিকিৎসা, ওষুধ, পথ্য! কলেজের ফিস’ অনেকটা বাকি পড়ে গিয়েছিল! আর পড়া হল না! ভিটেমাটির পরিযায়ী বাসিন্দা থেকে পরিযায়ী শ্রমিক - হাঃ হাঃ!

সাবির আলীর কান্না চাপা উদাত্ত হাসিটা কমলাক্ষ বাবুর কানে এসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল! ভিটেমাটির পরিযান! ভিটেমাটিও কখনো কখনো পরিযায়ী হয়- কথাটা সে ভাবে মনে হয় নি, কোনোদিন! কমলাক্ষ ভট্টাচার্যের পিতৃদেব বিরুপাক্ষ ভট্টাচার্যের আদি বাড়ি ছিল ঢাকা, বিক্রমপুর রাজাবাড়ির বাহেরক গ্রামে! সেই গ্রামটা পদ্মানদীর ভাঙ্গনে হারিয়ে গেল! তারপর ঢাকার কাছে ধানমুন্ডি! সেখান থেকে এপার বাংলায়, এই সোদপুরে! সে অর্থে কমলাক্ষ বাবুও তো আর এক ভাঙ্গনের শিকার!

সে রাতে, কি জানি, কেন, কমলাক্ষ বাবু ফিরে এসেছিলেন হোটেলে! পরের দিন সাবির আলীকে নিয়েই চলে এলেন ভিলাই! তারপর থেকে সাবির আলী, কমলাক্ষ মেকানিক্সের সিকিউরিটি গার্ড এবং পার্ট টাইম অ্যাকাউন্ট্যান্ট! সাধারন ক্যাশ বুক করতে সাবির আলীর কোনও অসুবিধে হত না! ইচ্ছে করলে ব্যালেন্সশীট’টাও তৈরি করতে পারত! তবুও ব্যালেন্সশীট’টা কমলাক্ষ বাবু ইনকাম ট্যাক্স কনসালটেন্ট’কে দিয়েই করিয়ে নেন!

সাবির আলীর ডিউটি ২৪*৭! সুতরাং কোম্পানির অফিস ঘরেই রাত কাটায়! ঘর ভাড়াটাও বেঁচে যায়! সব মিলিয়ে বেশ ভালোই কাটছিল সাবির আলীর! বাড়িতেও অনেকটা টাকা পাঠাতে পারছে! সামনের ইদে একবার বাড়ি যাবে সাবির!


(২)
ইদানিং সাবির আলীর বেশ কিছু বন্ধু জুটেছে! কেউ কেউ ওর মতনই সিকিউরিটি গার্ড! কেউ লেদ মেশিন চালায়। কেউ কাস্টিং করে! এছাড়াও ইলেকট্রিশিয়ান, ফিটার, কারপেন্টার, টার্নার, ওয়েল্ডার, শিট মেটাল ওয়ার্কার!

ভিলাই টাউনশিপ থেকে ওদের এই ইডাস্ট্রিয়াল এস্টেটে আসার রাস্তাটার নাম নন্দিনী রোড! ভিলাই পাওয়ার হাউজ থেকে নন্দিনী মাইন্সের দিকে সোজা নিচে নেমে গেছে! ডান দিকে পর পর বেশ কয়েকটা সিনেমা হল! এই অঞ্চলটির আর একটি নাম ক্যাম্প-টু!

এখানে বসন্ত টকিজের গেটম্যান বদ্রে আলমের সাথে সাবিরের বন্ধুত্বটা ঘটনাচক্রে একটু বেশীই! কারণটা ওদের ফেলে আসা জীবন! মালদাতে বদ্রে আলমের ভিটে বাড়িটাও গঙ্গার ভাঙ্গনে তলিয়ে গেছে! বদ্রে আলমের ডাক নাম বাচ্চু! বাচ্চু আলমের সাথে সাবির আলীর মাঝে মাঝে দেখা হয় এই ভিলাই ক্যাম্প-টু’র রাজা জামা মসজিদে। বাচ্চু আলম ধর্মপ্রান মুসলমান! ওর মতে আল্লাই ওকে দেখবে! বাচ্চু আলম সাবিরের থেকে দু-তিন বছরের বড়! কম বয়সেই বিয়ে হয়ে গেছে! ওর বৌয়ের উপরই মা-বাবার দায়িত্ব! বাচ্চুর বৌ রিজিয়া মালদার পঞ্চানন্দপুর গ্রামে একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা! এবার ইদের সময় বাড়ি যেতে পারে নি বাচ্ছু আলম! হঠাৎ করোনা অতিমারিতে লকডাউন!

কাজ বন্ধ! ট্রেন বন্ধ! বাস বন্ধ! সিনেমা হল বন্ধ! বিনোদন নেই! আড্ডা নেই! দোকান বন্ধ! বাজার বন্ধ! মানুষের মুখ বন্ধ! মন বন্ধ!

সিনেমা হলের সব কর্মীদের চাকরি গেল! শুধু পরে রইল বদ্রে আলম! সিকিউরিটি গার্ড! মালিক মাইনেটা অর্ধেক করে দিল! ডিউটি অর্ধেক করল না! দ্বিগুন করল!! লোকজন নেই! সুতরাং সাবধান! সবসময় পাহারা!

এই পাহারা দিতে দিতে কখন যেন মনটাকেও পাহারা দিতে শুরু করল বাচ্চু আলম!

মুসলিম মানেই পাকিস্থানের সমর্থক! দেশদ্রোহী! ম্লেচ্ছ! অপবিত্র! এখানে বেশির ভাগ মানুষেরই এটাই ধারণা!

সব মুসলমানই পাকিস্তান হওয়াটাকে মান্যতা দিয়েছিল! মুসলমান শাসকেরা হিন্দুদের মন্দির ভেঙ্গে দিয়েছিল! ভগবান রামের জন্মস্থানে মন্দির বানিয়েছিল! বাবরি মসজিদ! বাবরি মসজিদ ভেঙ্গেছি - বেশ করেছি! আরও ভাঙব! শালা মুসলিম!

কিন্তু বাচ্চু আলম তো কখনো এমন করে ভাবে নি! ওর বাপ-ঠাকুর্দার মুখেও এ ধরণের কথা শোনেনি! ওর এখনও মনে পড়ে ভাঙ্গনের আগে কালিয়াচকের কাকরবন্ধা ঝাউবনের পাশে আম বাগানে ওরা খেলত! বাঞ্জিতলা হাই স্কুলে যেবার ভর্তি হল, ২০০৫ সালে, সেবারই ওদের গ্রামটা গঙ্গার ভাঙ্গনে তলিয়ে গিয়েছিল! যাদের ভিটেমাটি হারিয়েছিল, বিঘের পর বিঘে চাষের জমি নদীতে তলিয়ে গিয়েছিল, তারা সবাই একসাথে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করেছিল! বেশির ভাগ মুসলমান হলেও কিছু ঘর ছিল বর্ন হিন্দু! দু-তিন ঘর ব্রাহ্মণও ছিল! দুর্গাপুজো আর ইদে হিন্দু-মুসলমান সবাই একসাথেই তো আনন্দ করত! ওর এক বন্ধু ছিল আনন্দ! আনন্দ সেন! ওদের দুই বন্ধুকে একসাথে সবাই ডাকত বদ্রেআনন্দ!

এসব কথা ভাবতে ভাবতে বদ্রে আলমের ছোটবেলায় শোনা এক ফকিরের কথা মনে হত! ওই ফকিরকেই জিজ্ঞেস করেছিল- “ফকির কথার মানে কী ফকির?”

ফকির কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন! তারপর চোখ বুজে ধীরে ধীরে পরিস্কার আরবী উচ্চারনে বললেন- “ইয়া আইউহান নাস। আন্তুমুল ফুকারাউ ইলাল্লহ, ওআল্লাহু হুওয়াল গনিয়ুল হামিদ’- অর্থাৎ, হে মানবসকল, নিশ্চয়ই তোমরা সবাই আল্লাহু’র প্রতি মুখাপেক্ষি, রিক্ত নিঃস্ব ফকিরের ন্যায়; আর আল্লাহু তায়ালাই’ হলেন একমাত্র ধনী ও স্বনির্ভর এবং সদা প্রশংসিত! বুঝলা কিছু?” ফকির জিঞ্জেস করেন!

তারপর আবার বলেন- “আসলে ফকির শব্দটি আরবী! অর্থ হল-অভাবী, যে দরজায় অপেক্ষামান থাকে! যারা মানুষের দরজায় অপেক্ষা করে তারা হলেন ভিক্ষুক; আর সাধু পুরুষেরা যেহেতু সদা আল্লাহুর দরবারের দরজায় নিজেকে অপেক্ষামান রাখেন, তাই তাদের ফকির নামেই অভিহিত করা হয়! আর আমার কাজকর্ম হল ফকিরি” কথাটা বলে একটু হাসলেন!

সেই ফকিরের কাছ থেকেই বদ্রে আলম জেনেছিল আল্লা বখশের কথা! নিজের জীবন বিপন্ন করে ধর্ম নিরপেক্ষ ও ঐক্যবদ্ধ ভারতের জন্য লড়াই করেছেন! মুসলিম লীগের দেশভাগের বিরোধিতা করেছিলেন! ফলস্বরুপ, ১৯৪৩ সালে মুসলিম লীগের ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে খুন করা হয়!

ফকির আবারও বলতে শুরু করলেন- “সমস্ত মুসলমানরা দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না! সব মুসলমানরা পাকিস্থানের পক্ষে ছিল আর সব হিন্দুই একটি স্বাধীন ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতের স্বপক্ষে ছিল-এই কথাটা ভুল! ডাহা মিথ্যা!” বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন ফকির! কিছুক্ষন চুপ করে বসেছিলেন! চোখ বুজে কিছু ভাবছিলেন! তারপর সেই জলদ গম্ভীর স্বরে আবৃত্তি করলেন-

“হামকো বাতলাও তো কিয়া মতলব হ্যায় ইয়ে পাকিস্থানকা! জিস্‌ জাগাহ্‌ ইস ওয়াক্ত্‌ মুসলিম হ্যাঁয়, নাজিম হ্যায় কিয়া হুজা! নেশ-ঈ তোহমত সে তেরে, চিসতি কা শিনা ঢাক্‌ হ্যায়, জলদ্‌ বাতলা কিয়া জমিন আজমের কী না পাক হ্যায়?

ব্যাটা, এর মানে কী বুঝলা? বল আমাকে পাকিস্থানের অর্থ কী? এই মাটি, যেখানে আমরা মুসলমানেরা থাকি, সে কি কম পবিত্র? তোমার নিন্দা চিস্তির বুক ভেঙ্গে দেয়! তাড়াতাড়ি আমাকে বল আজমীর কি অপবিত্র?”

বদ্রে আলমের কাছ থেকে সাবির আলী ফকিরের গল্প শুনে ভাবতে থাকে এখন থেকে ভাবনাটাকে পাল্টাতে হবে! চুপ করে থাকলে চলবে না! এই ঘৃণার অরাজনীতির বিরুদ্ধে চিৎকার বলতে হবে এই মাটি আমাদের কাছে পবিত্র!

ভেঙ্গে পড়া বদ্রে আলমকে নিয়ে সাবির আলী রাস্তায় নামে! হাঁটতে শুরু করে! এখনও অনেকটা পথ বাকি!

অন্য এক পরিযানের পরিকথার শুরু!

0 comments:

0

গল্প - অচিন্ত্য দাস

Posted in




অফিস থেকে ফিরে গোমড়া মুখে সরোজেশ বলল –“ছুটি বাতিল। মানে এক হপ্তা পিছিয়ে দিতে হোলো..”

-“তাহলে?”

-“তাহলে আবার কী, তোমার ছুটিও পেছিয়ে নাও। আবার নতুন করে টিকিট করতে হবে”

-“অসম্ভব। আমাকে এখনই ছুটি নিতে হবে, নয়তো পরে দেবে না..”

বিয়ের পর থেকেই আমেরিকায় রয়েছি। এতদিনে মানে পাঁচ বছরে এই দ্বিতীয়বার দেশে যাচ্ছি। এত আয়োজনের পর বাতিল করতে একটুও মন চাইল না। ঠিক করলাম আমি আগে চলে যাই, সাতদিন পরে নয় সরোজ চলে আসবে। তবে একটা কথা। দেশে শ্বশুরবাড়ি ছাড়া আমার যাবার জায়গা তেমন নেই। মাকে হারিয়েছি ছোটবয়সে। আর আমার বিয়ের কয়েকদিন পরেই বাবা মারা গেলেন, যেন মেয়ের বিয়ে দেওয়াটাই তাঁর সংসারের শেষ দায়িত্ব ছিল।

আজকাল চারদিকে যা আকছার হচ্ছে আমাদের বাড়িতেও তাইই হলো। বাবা মারা যাবার পর দাদা-বৌদি সুযোগ বুঝে চালাকি করে বাবার সম্পত্তি হাতিয়ে নিল। আমাকে কিছু দেয়নি। আমার সঙ্গে সম্পর্কও কেটে দিল – যদি আবার কোনদিন আমি আমার ন্যায্য ভাগ চেয়ে বসি। দাদার কাছে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

দেশে সেরকম আপনজন বলতে একজনই আছে – আমার পিসীমা। বাবার দিদি, বাবার থেকে বছর দশেকের বড়। ভীষণ ভালবাসে আমাকে। এখনও। পিসেমশায় মারা গেছেন বহুদিন আগে। ছেলে আছে মুম্বাই না নাগপুর কোথায় যেন। তবে সে ছেলে, মানে সানুদা শুনেছি একটুও দেখাশোনা করে না। পিসীমার বয়স আশির কাছাকাছি। বারাসতের কাছে একলাই থাকে। ঠিক করলাম ওখানেই উঠব। তারপর কটা দিন পরে, সরোজেশের আসার সময় হলে শশ্বুরবাড়ি চলে যাব। আসছি বলে পিসীমাকে খবর পাঠিয়ে দিলাম।

*****

জায়গাটা এয়ারপোর্ট থেকে খুব বেশি দূরে নয়। গাড়ি নিয়ে সোজা পিসীমার বাড়ি চলে এলাম। বাড়িটা পিসীমার নিজের, পিসেমশায় ভাগ্যিস করে গিয়েছিলেন। নয়তো কী যে হতো। তা পিসীমার বাড়িটা বেশ – দুটো শোবার ঘর। তার একটাতে কাচা চাদরে বিছানা-টিছানা পেতে আমার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। পেছনে উঠোন। বাথরুম। সামনে বারান্দা আর এক ফালি বাগান।

পৌঁছোতে পৌঁছোতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। আমাকে এতদিন পর দেখে পিসীমা কী যে খুশি হলো কী বলব। আমারও খুব ভালো লাগছিল। তবে হ্যাঁ, পিসীমার চেহারাটা দেখলাম বেশ খারাপ হয়ে গেছে। বয়সের ছাপ সর্বাঙ্গে। লাঠিতে ভর করে কোনো রকমে পা ফেলছে। সে যাই হোক, পিসীমা খুব সুন্দর করে মাছ রান্না করেছিল আমি আসছি বলে । সর্ষেবাটা দিয়ে পার্শে মাছের ঝাল – উফ কতদিন পরে যে খেলাম!

আমেরিকা দেশটা আমাদের দেশের উল্টোপিঠে। ওখানকার দিন মানে এদেশের রাত। সেই জন্যই ওদেশ থেকে এলে প্রথম কটা দিন বিচ্ছিরি গা ম্যাজম্যাজ করে, যাকে ‘জেট-ল্যাগ’ বলে। ভারি ক্লান্ত লাগছিল, তাই একপেট খেয়ে সটান শুয়ে পড়লাম। তোষকটা কড়া হলেও জেট-ল্যাগের ঘোরে মনে হল দারুন আরামের বিছানা। শুলাম আর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

ঘুম ভাঙলো যখন তখন বিকেল শেষ হয়ে সন্ধে নামছে। ঘড়িতে দেখলাম ছটা বেজে গেছে। পিসীমার গলা শুনতে পেলাম – সামনের বারান্দায় পিসীমা কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। যাক, বাবা ভালো। সঙ্গীসাথী তো সকলেরই দরকার। উঠে একটু ধাতস্থ হয়ে ভাবলাম যাই ওদের আড্ডায় আমিও একটু যোগদান করি। একা ঘরের ভেতর কীই বা করব।

দরজার ফাঁক দিয়ে পিসীমাকে দেখে আমি কিন্তু হকচকিয়ে গেলাম। এ আবার কী !

পিসীমা রসিয়ে রসিয়ে হরিদ্বারে বেড়াতে যাবার গল্প করছে। - “ আরে না গেলে বুঝতেই পারবি না যে জল কত ঠাণ্ডা হতে পারে। কিন্তু জানিস তো, সাহস করে জলে নেমে একটা ডুব দিতেই কী আরাম যে লাগল তোকে কী বলব! তবে হ্যাঁ, যা স্রোত না, ওই লোহার শিকলগুলো ধরে না থাকলে ভেসে যাবে মানুষ … ও মা এ কী রে … তোর হরিদ্বারের গল্প ভালো লাগছে না, আচ্ছা, তোকে কন্যাকুমারীর গল্প বলি। জানিস, নৌকো করে আমরা সমুদ্রের ওপর দিয়ে বিবেকানন্দ শিলায় গেছিলাম। দ্বীপের মাঝখানে কী সুন্দর মন্দির যে করেছে না রে …”

শ্রোতা কেউ নেই। একটা বাদামী রঙের নেড়ি কুকুর একটু তফাতে বসে আছে। পিসীমার হাতে একটা প্লাসটিকের থালায় দুটো রুটি, পিসীমা মাঝেমাঝে তা থেকে রুটির টুকরো দিচ্ছে ওকে। গল্পের টানে না হোক রুটির টানে প্রাণীটি বাধ্য শ্রোতা হয়ে বসে আছে।

আমি দরজা ঠেলে বারান্দায় আসতেই সে চার-পাঁচ পা পেছিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সন্দেহের চোখে আমাকে দেখছিল। এ আবার কে এলো? একে তো দেখিনি কখনো। আমার রুটিতে ভাগ বসাবে না তো!

আমি পিসীমার কাঁধে হাত রাখলাম। বললাম –“ পিসীমা, তুমি যে এতসব জায়গায় বেড়াতে গিয়েছ জানতাম না তো! তা তোমার সঙ্গীটি কিন্তু বেশ..”

আমি যে এখন এসে পড়বো, পিসীমা আন্দাজ করেনি।। ভেবেছিল আমি ঘুমোচ্ছি। আমাকে দেখে লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল –“ না রে না”

-“ তাহলে?”

-“ আমার অত ভাগ্য কোনোদিন হয়নি রে। জানিস, আমার না বরাবর বেড়াতে যাবার ভীষণ সখ। তোর পিসে আপিসের বন্ধুদের সঙ্গে একবার কেদার-বদ্রি গেল। কত করে বলেছিলাম, আমাকে নিয়ে চল না গো। তা কানই দিল না। বলে – ও নাকি আমি পারব না। অনেক হাঁটতে হবে। আরও একবার পুরী গেলো, তাও আমাকে নিল না। তারপর তো সে আমাকে ছেড়ে সত্যিসত্যিই চলে গেল ওপারে”

আমি পিসীমার পাশে মোড়াটায় বসে পড়লাম। পিসীমা একটা রুটির টুকরো দিল বন্ধুকে তারপর আমার হাত ধরে বলল –“ জানিস তারপর আমার যে কী কষ্ট গেছে কী বলব। পেনশনের টাকা অনেকদিন পাইনি। ছেলেকে মানুষ করার জন্য লোকের বাড়িতে বাড়িতে রান্নার কাজ করতাম। তা সানু কলেজ পাশ করলো। চাকরিও পেল। তখন সবকিছু একটু সামলেছে দেখে আমার ইচ্ছেটা আবার চাড়া দিয়ে উঠল। সানুকে বললাম – চল, তোতে-আমাতে কাশীধাম, মথুরা, বৃন্দাবন সব দেখে আসি। যাবি? সে বলল – আরে পাগল হলে নাকি? এই শরীরে তুমি পারো কখনো। তাছাড়া সে অনেক খরচ। আরো বার দুয়েক কাছাকাছি নিয়ে যাবার কথা বলেছিলাম, সে আমলই দিত না। তারপর তো নিজে বিয়ে করলো। বৌমা তো আমাকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না। কদিনেই তারা আলাদা হয়ে গেল। তারপর তো দূরের শহরে কাজ নিয়ে ওরা চলে গেছে। আসা-যাওয়াও আর তেমন নেই ...”

আমি পিসীমার আরও কাছঘেঁষে বসলাম। বললাম তাহলে তুমি যে এত জায়গার কথা বলছ …

টের পেলাম পিসীমা আমার হাতটা আর একটু জোরে চেপে ধরেছে। বলল –“ এই টিভিতে যা দেখায়, কাগজে মাঝেসাঝে ফটো দিয়ে লেখা বার হয় – সেগুলো থেকেই যা পাই তাই নিয়ে এর সঙ্গে গল্প করি রে। যাওয়া তো হয়নি, মনে মনে তাই চলে যাই আর একে বলি…”

পিসীমার গলাটা একটু ধরে গেছে কি, না আমার মনের ভুল? বয়স্ক মানুষদের বেড়াতে নিয়ে যাবার তো অনেক সংস্থা আছে … কিন্তু পিসীমার তো সে বয়সও পেরিয়ে গেছে। শরীরের যা অবস্থা তাতে আর তো যেতে পারবে না। আমি চুপ করেই রইলাম।

পিসীমা বলল – “ এই শোন, আমি যে এই ঝুড়িঝুড়ি মিথ্যে বলছি বানিয়ে বানিয়ে – ঠাকুর আমাকে পাপ দেবে না তো রে?”

আমি পিসীমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম – “ না গো না। একটুও না। তোমার কাছের মানুষেরা কেউ তোমার ইচ্ছেগুলো একটি বার কানেও নেয়নি, দামও দেয়নি। তাই তোমার মানুষ-নয় বন্ধুটির সঙ্গে মনের ইচ্ছেটুকু ভাগ করে বেড়াতে যাও রোজ। ভগবান কক্ষনো তোমার কোনো দোষ ধরবে না গো পিসীমা...। মনের ইচ্ছে তো মনের ইচ্ছে। তার আবার সত্যিমিথ্যে কি! এই বিকেল বেলায় সাধ মিটিয়ে যত খুশি ঘুরে বেড়াও না তুমি …

0 comments: