প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধবর্ষার পর রসসিক্ত ধরিত্রী শস্যপ্রসবিনী হয়ে, নদীধারা পুষ্ট হয়ে যখন মানবের শারীরিক ও মানসিক স্ফূর্তি ঘটায় তখন এই উপমহাদেশে বহু প্রাচীন কাল থেকেই শক্তি আরাধনা বা মাতৃ আরাধনা প্রচলিত হয়েছিল। শরতের আরম্ভে শুরু হয় মাতৃপূজা। শেষ হয় বসন্তের অন্তে। বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন ভাবে আমরা স্মরণ করি আমাদের মাতাকে। প্রথমে আলোচনায় আসুক মাতৃ আরাধনার প্রাচীন ঐতিহ্যটি। প্রাগৈতিহাসিক যুগেও আমরা দেখেছি বেশ কিছু পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, যেগুলিতে দেবীমূর্তি যেন আরাধ্যা প্রতিমার মতই ছিলেন সমাজে। সিন্ধু সভ্যতার কালে এই শক্তি আরাধনার প্রচলন ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। মাতা আমাদের জননী। তাঁর থেকে আমরা এই দেহ পাই। তিনি আমাদের শুধু জন্ম দেন না, সঙ্গে লালন পালন ও করেন। এই দেহ দিয়েই আমরা সব কিছু সাধন করে থাকি। সে সিদ্দি জাগতিক হোক, বা আধ্যাত্মিক। এই দেহ মায়ের থেকে পাই। তাই দেহই মা। এই বিশ্বাসের মুলে আছে মায়ের আর একটি বিশ্বব্যপী ধারণা। যেখানে মা আমার এই ক্ষুদ্র দেহ ছাপিয়ে জগদাত্মক হয়ে উঠছেন। এই ধরিত্রীই মা। এই প্রকৃতিই মা। প্রকৃতির পঞ্চভূত থেকে আহরণ করে দেহ জন্ম নেয়। জন্মানোর পর প্রকৃতিই যোগান দেয় যাবতীয় দৈহিক চাহিদার। পিতার প্রত্যক্ষ ভূমিকা এত নগণ্য থাকে, যে পিতৃপুজার কথা কেউ ভাবেননি।
পিতৃপূজা আর্যদের দান। বেদের যুগে পিতৃপুজার শুরু। যদিও অনেকে মনে করেন হরপ্পার পশুপতি মূর্তি শিবের বিগ্রহ। কিন্তু সেখানে শিবের পশুপতিনাথ হিসেবে, প্রকৃতির রক্ষক হিসেবে একটা ধারণা পাওয়া যায়। অর্থাৎ পিতা রক্ষক। জনক যে, সেকথা কিন্তু মূর্তির গঠনে কোথাও নেই। লিঙ্গপূজা বহু পরের ঘটনা। বেদে আমরা নির্গুণ ব্রহ্মের ধারণা পাই। নির্গুণ, কেননা অজ্ঞাত। যিনি জ্ঞানের আলোয় নেই তিনিই নির্গুণ। পিতাকে আমরা জানিনা তখনও। এ বেশ চমৎকার। আমার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির আওতায় তিনি নেই। সুতরাং তিনি নির্গুণ, অন্ধকার। এবার সৃষ্টির সূত্রপাত। তিনি ধীরে ধীরে জ্ঞানের আলোয় আসছেন। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হচ্ছেন। সগুণ ব্রহ্ম। যতটা জ্ঞানের আলোয় আসছেন তিনি, ততটাই সগুণ। আলোকিত। এই সগুণ ব্রহ্মই সাংখ্যের মতে প্রকৃতি। নারীরূপা। মাতা। যদিও মাতৃপূজা বেদের চেয়েও প্রাচীন, তবু পরবর্তী কালে ব্রাহ্মণ্য আগ্রাসনের সময়, বৌদ্ধ ধর্মের উৎপত্তির আগে, শক্তিপূজার ধারণাটি বৈদিক শাস্ত্রে আত্তীকৃত করা হয়। বিশদ আলোচনায় যাবনা। শুধু দেখে নিই কিভাবে বৈদিক সমাজকর্তারা মাতৃশক্তির ধারণাটিকে শাস্ত্রে আনলেন। বিশেষত দুর্গা। যে দেবী সরস্বতী বা বাক ঋকবেদে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন, তাঁর মধ্যেই পরবর্তী কালের রণদেবী দুর্গারও আভাস পাওয়া যায়। ঋকবেদের একাধিক মন্ত্রে দেবী সরস্বতীর সাহায্য প্রার্থনা করা হয়। একটি মন্ত্রে আছে ঘোররূপা দেবী হিরন্ময় রথে আরোহণ করে শত্রু নিধন করেন। উত স্যা নঃ সরস্বতী ঘোরা হিরণ্যবর্তনিঃ। বৃত্রঘ্নী বষ্টি সুষ্টুতিম্। (ঋকবেদ ৬/৬১/৭)
শক্তিদেবী হিসেবে এখানে অদিতিকে আরাধ্যা মহাদেবীর আদিরূপ মনে করা হয়। বাক ও আদিতি অভিন্ন। দুর্গা এই মহাদেবীরই রূপভেদ। বাক বা সরস্বতীর দুর্গাতে পরিবর্তিত হওয়ার একটি কাহিনী শতপথ ব্রাহ্মণে আছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে বাক দেবী ক্রুদ্ধ হয়ে সিংহীরূপ ধারণ করছেন। অতিপ্রাচীন কালে দেবতার পশুরূপ কল্পনা করা হত। পরবর্তী কালে সেই সেই পশু সেই সেই দেবতার বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিক দিয়ে আমরা সমাজতাত্ত্বিক বিবর্তনের একটা প্রমাণ পাই। মানবের পাশবিক প্রাণচেতনা ধীরে ধীরে সভ্যতার সংস্পর্শে মানবিক হল। পাশবিক চেতনা শুধুই তখন বাহ্যিক জীবনযুদ্ধে বাহন মাত্র। সনাতন হিন্দু ধর্মে পরবর্তীতে সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা, আর সরস্বতী হংসবাহিনী। যদিও বৌদ্ধ শাস্ত্রে সরস্বতী সিংহবাহনাই বটে। অনেক পড়ে, মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে আবার লক্ষ্মীই হলেন মহিষমর্দিনী। শাক্তদের আরাধ্যা মহাদেবী হলেন মহালক্ষ্মী। তিনি সগুনা নির্গুণা জগতপ্রপঞ্চ ব্যপ্ত করে অবস্থান করছেন। দেখা যায় সেসময়ে শাস্ত্রকারেরা দেবীর নির্দিষ্ট রূপ ও ধারণা খুঁজে পাননি। অম্বিকা কখনও রুদ্রে ভগ্নী (শুক্ল যজুর্বেদ ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ), কখনও রুদ্রের পত্নী (তৈত্তিরীয় আরণ্যক)। শেষ পর্যন্ত তৈত্তিরীয় আরণ্যকের একটি মন্ত্রে দেবী দুর্গার নামল্লেখ করা হয়েছে। মন্ত্রটির ভাবার্থ হল – যিনি অগ্নিবরনা, যিনি তপস্যার দ্বারা জ্যোতির্ময়ী, যিনি বৈরোচনী, করমফলের নিমিত্ত যিনি উপাসিতা, সেই দেবী দুর্গার শরণ নিলাম। বিরোচন হলেন সূর্য। অতএব দুর্গা অগ্নিকন্যা বা সূর্যকন্যা। এই বেশ একটি সমন্বয় সাধন হল। অবৈদিক শক্তিপুজার সঙ্গে বৈদিক পূজা মিলিয়ে নেওয়া হল। ব্রাহ্মণ গণ প্রীত হইলেন অতএব।
এবার দুর্গার রূপ এবং বর্তমান ধারণার বিশ্লেষণ করা যাক। দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। কেমন দুর্গতি? না, আধিভৌতিক, আধিদৈবিক, এবং আধ্যাত্মিক। সেই দুর্গতি নাশে তাঁকে বিপুল শক্তির অধিকারিণী হতে হয়। তাই তাঁর দশটি হাত। স্বাভাবিক মানবের চেয়ে অন্ততপক্ষে পাঁচগুণ বেশি শক্তি ধরেন। এই দশটি হাতে তাঁর দশটি আয়ুধ। এবার ভিতরে প্রবেশ করা যাক। দশটি হাত দশেন্দ্রিয়। পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়। এই ইন্দ্রিয় অন্তর্মুখ হলে আলোকবরনী দেবী আলোক দেন। শক্তি দেন অজ্ঞান নাশের। সেই দশ আয়ুধ। প্রতিটি আয়ুধের নিজস্ব কর্ম পদ্ধতি আছে। তিনি নাশ করেন অসুর কে। মহিষাসুর। মহিষ এখানে রিপুর সমার্থক। রিপু মধ্যে আবার কাম প্রবল। এই রিপুর নাশই লক্ষ। চলিত কথায়ও আমরা শত্রুকে রিপু বলে থাকি। এখন নাশ যখন, তখন তা হতে রক্তপাত স্বাভাবিক। কিন্তু এসবই যখন মানসিক বা আত্মিক দুঃখ হরনের আয়োজন মাত্র, তখন তা থেকে যে রক্তপাত তারও ভাবার্থ মায়াসঞ্জাত শোকধারা। অন্তিমে মা অবশ্য আমাদের মোক্ষ দেন। সঙ্গে আনন্দময়ী আনন্দও দেন। সে আনন্দের ভেদ আছে। অধিকারী ভেদ নয়। চাওয়ার ভিন্নতা।
দুর্গা রূপের এই বিশ্লেষণ একান্তই অনুভুতিলব্ধ। অনেকেই এখন দুর্গাপূজা সম্বন্ধে নানা বিরূপ মন্তব্য করেন। মুক্তচিন্তার ফসল। তবে নিজের জননী এবং জগজ্জননীকে যদি কেউ শ্রদ্ধার চোখে দেখেন তাঁর পক্ষে এই উক্তি সম্ভব হয়না।
দুর্গাপূজা একান্ত ভাবেই বৃহৎ বঙ্গের একটি ঐতিহ্য। কামরূপ থেকে পশ্চিমে পূর্ব বিহার পর্যন্ত। উত্তরে তরাই থেকে দক্ষিণে সাগর সঙ্গম পর্যন্ত। কেউ কি সাংখ্যর এলাকার সঙ্গে সাদৃশ্য পাচ্ছেন? সাংখ্যের প্রকৃতিই যে দুর্গা! আর সাংখ্য যে বৃহৎ বঙ্গেরই এক মুনি। কপিল মুনি।
এই শারদ লগ্নে আরও একবার তাই জননীকে, আদি জননীকে স্মরণ করি। তিনি আমাদের অজ্ঞান নাশ করুন।
[শব্দের মিছিল, শারদীয়া ২০১৭]