গল্প - সনাতন সিংহ
Posted in গল্প(১)
এমনিতেই দুপুর। এই সময় ট্রেন একটু পাতলা। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবটা এখনো রয়েছে। প্ল্যাটফর্মে লোকজন অন্যদিনের তুলনায় কম। তবে রোদ্দুরটা বেশ আরামদায়ক। বুচন গার্ড বক্সের গায়ে হেলান দিয়ে রোদ পোহাচ্ছে।
"কিরে, এভাবে হেলান দিলি যে? কত কামালি আজ?" বলেই বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলেন সমর সমাদ্দার। শিয়ালদা মেইন লাইনের গার্ড। আজও তাঁর ডিউটি আছে। ডাউন শান্তিপুর লোকালের জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি।
বুচনের হাঁটুর নিচ থেকে দুটো পা-ই কাটা। একটু নড়ল বটে, কিন্তু আগের মতোই হেলান দিয়ে বসে রইল টায়ার কাটার উপর। যেন আস্ত একটা টায়ারের প্লেট। হাঁটু ও কোমর বেল্ট দিয়ে বাঁধা আছে সেটার সঙ্গে। ক্যাচে চলতে পারে না সে মোটেই। এটাই তার বৈতরণী, যেটা ছাড়া সে অচল। সমাদ্দার মহাশয়কে দেখেই ম্লান হাসিতে উত্তর দিল, "হয়েছে। কিন্তু বাজার খারাপ স্যার। কোথায় ভাবলাম আজ একটু…"
"দাও মারবি। তাই তো?" বলতে বলতে গিয়ে বসলেন গার্ড বক্সের উপর।
বুচন একটু লাজুক হাসল বটে, কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। বাঁ হাতটা তার ঢুকে গেল পকেটে। ত্রি-কোয়ার্টার প্যান্টের সামনে, পিছনে যতগুলো ছিল, হাতড়ালো। যা পেল রেখে দিল হেলান দেওয়া টিনের বাক্সের উপর। কয়েকটা কয়েন আওয়াজ তুলে থিতিয়ে গেল। এবার ডান হাতের পালা। ঠিক আগের মতোই হাতড়ে রেখে দিল বাক্সের উপর। সমাদ্দার মহাশয় তাকিয়ে রইলেন সেই দিকে। প্ল্যাটফর্মের দু-একজনের নজর এড়ালো না তা। তাদেরও অবসর দৃষ্টি আটকে গেল বুচনের কার্যকলাপে। সে বিষয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই বুচনের।
সমাদ্দার বাবু যেন হতাশ হলেন, "ব্যস, এই টুকুই? কী করলি তাহলে?
বিনয়ের সঙ্গে আক্ষেপ ঝরে পড়ল, "আজ একটু দেরি করে এসেছি স্যার। তাই…"
"দে… এগিয়ে দে দেখি। কত হল।"
বুচন ডান হাত দিয়ে ঠেলে দিল কয়েনগুলো। সমাদ্দার মহাশয় ঝুঁকে এলেন সামনে। গুনতে শুরু করে দিলেন। দশ টাকা, দশ টাকা করে গুছিয়ে রাখছেন বাক্সের উপর। বুচনের হাত ঢুকল আবার। তবে পকেটে নয়। কোমরের সঙ্গে আটকানো একটা পলিথিন ব্যাগে। বের করে আনল বাইরে।
সাদা প্লাস্টিকের মধ্যে তখন মুখবন্ধ হয়ে রয়েছে টেরেঙ্গার গোছা। সঙ্গে কয়েকটা চুটকিও। এটা-একটা, ওটা-একটা করে কেটে ঢেলে দিল মুখে।
"তাহলে বুচন, এখনো চালিয়ে যাচ্ছিস?" না তাকিয়ে কৌতুহল প্রকাশ করলেন সমাদ্দার বাবু। কয়েন গোনায় ব্যস্ত হয়ে রইলেন আগের মতো। বুচনের গাল ভরে গেছে টেরেঙ্গার রসে। লাল রস বেরিয়ে আসছে ঠোঁটের ফাঁক থেকে। তবুও মুখ উঁচিয়ে বলল, "বে-বেশি খা-ই-না স্যার। আগের থে-থেকে ক-কমিয়ে দিয়েছি। এ-এই ধরুন দিনে সা-ত-টা কি আটটা।"
"বাহ, খুবই কম। ক'দিন পরেই তো ছেড়ে দিবি, তাই না?" ব্যঙ্গের ঝাঁঝ বুঝতে পেরেই বুচন মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, কিন্তু কথার একটা আক্ষেপ ঝরে পড়ছে, "খোঁড়া মানুষ, কী আর করি বলুন তো? না আছে কোনো শখ, না আছে আহ্লাদ। রোজই ভাবি ছেড়ে দেব, কিন্তু সে আর হয়ে ওঠে না। বাড়িতে ফিরে ভাল লাগে না। সবাই নিজেকে নিয়ে মজে থাকে…
একটু থেমে গিয়ে আবার শুরু করল। মাথা হেঁট হয়ে গেল তার। কথা বলতে গিয়ে আটকে আটকে গেল, "বাড়িতে ভাল্লাগে না স্যার। কেমন যেন একা একা লাগে।"
টাকা গোনা বন্ধ করে দিলেন। বুচনের বিষণ্ন মুখটা দেখে প্রশ্ন করে উঠলেন সমর সমাদ্দার, "কী ব্যাপার বুচন, আজ একটু অন্য রকম লাগছে যে? বাড়িতে কিছু হয়েছে নাকি? উঁ…"
উদাস হয়ে গেল বুচন। চোখে মুখে একটা বিষাদের ছাপ। কোনো একটা কষ্ট তাকে যেন ভেতরে ভেতরে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে। বাইরের লোককে শুনিয়ে কী করবে সে?
আজ সকালেই তা যেন আরো বেশি করে পুড়িয়ে দিল। আর পাঁচটা দিনের মতো তার মা আজ চায়ের কাপটা এনে দিতে পারেনি। প্রণতি, ছোটো ভাইয়ের বউ চা দিতে এসে ঠুকে বসিয়ে দিল তার সামনে। এই ঠুকে বসানোর কম্পনটা যেন তার বুকে বেজে উঠল। কিছু বলতে গিয়ে আটকে গেল সে। বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল অভিমানে।
দূর থেকেই তার মা'র নজরে পড়ে এসব। তুলসী তলায় জল ঢালছিলেন ঘটি করে। প্রণাম করেই কারোর দিকে না তাকিয়ে বলে উঠলেন, "হে ঠাকুর, সবই আমার কপাল। নইলে এমন দিনও দেখতে হয়? কালকে যে এসেছে সেও হেলা-ছেদ্দা করে। তুমি এর বিচার করো।"
"ঐ বুড়ি, শাপ-শাপান্ত শুরু করে দিলি তো? সকাল হয়েছে কি আমার পিছনে পড়ে গেলি?"
নিজের অপমান সহ্য করে নিচ্ছিল বুচন। সংসারে পঙ্গু, অসহায় মানুষের এসব একটু আধটু মেনে নিতে হয়। তাই নীরবে বুকটা চেপে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। কিন্তু মা'কে অপমানিত হতে দেখে মুখ খুলল, "আহ মা, তুমি একটু চুপ করে থাকতে পারো না? কি দরকার যেচে অপমানিত হওয়ার?"
ফোঁস করে উঠল প্রণতি, "আমি অপমান করেছি? সকাল না হতে হতে বুড়ি যে আমার পিছনে লেগে পড়েছে, তার বেলা? কানে তালা লাগিয়ে বসে আছ নাকি?"
কাপটা মুখে তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আর পারল না। নামিয়ে রাখে আগের জায়গায়। "বলি, বুড়ি বুড়ি করছ কাকে? উনি তোমার শাশুড়ি মা হন। সম্মান দিয়ে কথা বলো। আর আমি কানে তালা দিয়ে বসে নেই, বুঝলে? চোখ দুটোও খোলা আছে। ভুলে যেও না তুমি এ বাড়ির বউ। নিজের সম্মান নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।"
"নইলে, কী করবে কী? মারবে? মারো… আপদ সব বসে বসে গিলবে, তাদের আবার বড়ো বড়ো কথা। ওমন সম্মানে ঝাঁটা মারি।"
বলেই ফরকি মেরেই চলে যাচ্ছিল রান্নাঘরে। কিন্তু থমকে দাঁড়াতে হল তার শাশুড়ির কথায়। ঠাকুর ঘরে ঘটি রেখে নেমে আসছিলেন বুড়ি। বউয়ের কথাগুলো কাঁটার মতো বিধল কানে। সংযম হারালেন হঠাৎ, "আমরা আপদ? বসে বসে গিলি? তুই কোথাকার পাট-রানী রে? সামান্য চা-টুকু আজ আমি ধরে এনে দিতে পারিনি। তাই ঠুকে বসিয়ে দিলি মানুষটার সামনে? তোকে দিলে খেতিস?"
"আমি কি ওর মতো ফেলনা নাকি? যার নিজের কিছু করার গতর নেই, অন্যের দয়ার উপর বেঁচে আছে, তাকে এসব একটু সহ্য করতে হবে। কারোর দয়ায় বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। আমি হলে তাই-ই করতুম।"
"বউমা? কাকে কীসব বলছ? তুমি জানো, কার দয়ায় বেঁচে আছি আমরা?"
নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলেন না। আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরলেন। তবুও বললেন, "সকাল সকাল ছেলেটার মরণ কামনা করলে? ও আছে বলেই ওর দয়ায় তোমার এত ফুটানি?"
তেড়ে এল হাত উঁচিয়ে, "ঐ ভিখিরির দয়ায়?"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঐ ভিখিরির দয়ায়।"
বুচন কুঁকড়ে যাচ্ছিল অপমানে অপমানে। কাকেই বা কী বলার আছে তার? যে যাই বলুক, সত্যিটা কিন্তু তার চেয়ে আর ভালো কে জানে? অক্ষম, পঙ্গু, ভিখিরি মানুষ। তার আবার সম্মান কিসে? কী করে অন্যের সেবা-প্রার্থী হয় সে? আর কতদিন অন্যের পরিষেবা নেবে?
তার সবটাই মা করে দেয়। কিন্তু অন্য বাড়ির মেয়ে এসে এসব করবে কেন? কতদিনই করবে? সুতরাং এ সত্যের মুখোমুখি তাকে হতেই হতো। সেটা কাল না হয়ে আজ হয়েছে, এটাই তো। কিন্তু সেটাই সত্যি। ঘষে ঘষে এগিয়ে এলে পোটের কাছে।
"তুমি ঠিকই বলেছ বউমা। ভিখিরি সে আবার অন্যকে দয়া করবে কী করে? এই তো তোমাদের দয়ায় দিন কাটাই… তো-তোমার আছ বলেই আজও… থাক ওসব কথা। এটা কিন্তু ঠিকই বলেছ, ভিখিরির মরণ হওয়াই ভালো।"
"কোথায় চললি খোকা?" কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে এলেন বুচনের কাছে। ধরতে চাইলেন। কিন্তু বুচন আটকে দিল।
"থাক মা, একাই নামতে পারব। কতদিন আর অন্যের ভরসায় জীবন কাটাবো বলতো?"
বলতে বলতে নেমে এল উঠোনে। ঠাকুর ঘরের দিকে একবার মুখ ফিরিয়ে দুহাত তুলে প্রণাম করল। এগিয়ে গেল সদর দরজার কাছে। হাত বাড়িয়ে টেনে নামল টায়ার কাটাটাকে। চড়ে বসল সেটায়। বেল্টটা পেঁচিয়ে বাঁধতে গিয়ে পিছনে হাতটাই যেন পৌঁছাতে চাইছে না আজ। বুচনের মা দৌড়ে এলেন। কিন্তু বুচন কিছুতেই হাত দিতে দিল না। অন্যদিন হলে তার মাই-ই টাইট করে বেঁধে দিত। আজ দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন কিন্তু হাত দিতে পারলেন না।
রাস্তায় নামল বুচন। অন্যদিন তবু কিছু খেয়ে বেরত। আজ এই প্রথম খালি পেটে রাস্তায় বেরল। হঠাৎ বাপন দৌড়ে এল। "জ্যেঠু, ও জ্যেঠু…?" ঘুরে তাকাতে ইচ্ছে করল না বুচনের।
পিছন থেকে বাপন এসেই গলা জড়িয়ে ধরল ছোট্ট হাতে। "জ্যেঠু, আমার জন্য খাবার আনবে কিন্তু। বেশি করে। এই এত্ত খাবার। মনে থাকবে?"
গলা ছেড়ে দিয়ে হাত দিয়ে পরিমাণ দেখাচ্ছে।
গলা ভারী হয়ে আসছে বুচনের। কান্না ভেজা গলায় বলল, "ফিরলে ঠিক নিয়ে আসব বাবা।"
সকালের নরম রোদ্দুর এসে পড়েছে মাটির রাস্তায়। অন্যদিন একটা টোটো এসে নিয়ে যেত বুচনকে। আজ বেরবে না বলে, তবুও বেরল। এগিয়ে চলল মেইন রাস্তার দিকে। পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন বুচনের মা। তাঁর কানে আসছে সড়ড়ড়… সড়ড়ড়…
কিছুক্ষণ পরে ঝাপসা হয়ে গেল তাঁর চোখ। ধুলোর চাদর গায়ে মেখে এগিয়ে চলল বুচন। সকাল সকাল দরজায় দাঁড়িয়ে চোখের জলে অন্তর্যামীকে প্রণাম করলেন তিনি।
(২)
টোটোয় চেপে বসেছে বুচন। কী করবে সে এখন? নিজেকে খুব, খুব অসহায় মনে হতে লাগল হঠাৎ। কাদের জন্য সে এতদিন করে মরল? রোজ রোজ লোকের কাছে হাত পেতে চাইল? এতে কি তার একটুও লজ্জা হত না? আর পাঁচজনের মতো তার কি আত্মসম্মানবোধ নেই নাকি? আছে বলেই তো প্রথম যেদিন এই লাইনে আসে, হাত পাতে, সেদিন উপার্জন ভালো হয়নি তা নয়, হয়েছে। কিন্তু রাতে ঘুমোতে পারেনি। মানুষের করুণার দান যতবার তার হাতে ঝনঝন করে উঠেছে, ততবারই আত্মসম্মানে অন্তঃকরণ বিগলিত হয়েছে অনুতাপে অনুতাপে। পয়সার প্রতিটা ঝংকারে সে যেন শুনতে পেয়েছে, "ভিখিরি… ভিখিরি… ভি-খি-রি…"
কিন্তু কাঁচা পয়সার টান অমোঘ। যে কেউ তার পদলেহন করতে প্রস্তুত। আর তার জন্য কেউ কেউ আবার আত্মসম্মান বিকিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। বুচন তো কোন ছার ! তার আত্মসম্মান তাকে যতখানি না তাড়িয়েছে, তার থেকে বেশি উপযোগী করে তুলেছে তার যুক্তিবাদী মন। কি বা করার আছে তার? উপার্জন করা তো দূরের কথা, অন্যের গলগ্রহ হয়ে তার বেঁচে থাকার কথা। সেই কিনা উপার্জন করছে? সেই কিনা টাকা এনে তুলে দিচ্ছে মায়ের হাতে?
প্রথম যেদিন ভিক্ষে করে এনে পুরো টাকাকা তুলে দিয়েছিল মায়ের হাতে।মায়ের চোখ খিলখিল করে উঠেছিল হলুদ বাল্বের তলায়। আনন্দে তাঁর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এসেছিল সহজেই। কোনোদিন কল্পনা করেননি যে অক্ষম, অসমর্থ, পঙ্গু ছেলেই তাঁর হাতের পাঁচ হয়ে উঠবে একদিন। টাকাগুলো বুকের কাছে চেপে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন, "কোনোদিন ভালো করে খেতে দিতে পারিনি তোকে। কত লোকের লাঠি-ঝাঁটা খেয়েছিস। দুবেলা দুমুঠোর জন্য লোকে কত কী বলেছে। ঠাকুরের কাছে কত কেঁদেছি। শোনেনি…
একটু থেমে চোখের জল মুছতে মুছতে আবার বললেন, "কী কপাল দেখ আমার? শেষ পর্যন্ত তোকে ভিখিরি বানিয়ে ছাড়লুম। হা ঈশ্বর, তুমি আমাকে ক্ষমা করো ঠাকুর, ক্ষমা করো…"
বুচনের চোখ ছলছল করে উঠেছিল। সারাদিনের কষ্ট, আত্মসম্মান, অভিমান জাঁকিয়ে বসেছিল বুকে। কিন্তু তার মা'র হাহাকার, ভাই-বোনদের মুখগুলো কেমন যেন সেই ভারকে নামিয়ে দিল সহজে। ভেতরে ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করলেও, একাকীত্বের কাছে হার মানল সে। চোখের ধারাও সঙ্গী হল তার। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে তৈরি হতে লাগল ভিখিরির সত্তায়।
সেদিন বুচনকে যেন বেশি বেশি যত্ন করতে শুরু করে দিল সবাই। মা, ভাই, বোনেরাও। অন্যদিন খেতে বসার জন্য কেউই অপেক্ষা করত না। মা'র সঙ্গে খেতে বসত, সবার শেষে। খুব, খুব অসহায় লাগত তখন। অবসাদ চেপে বসছিল শরীরে শরীরে। কোনো কোনোদিন মনে হতো, "রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে পালিয়ে বাঁচি।"
একদিন গভীর রাতে চুপিচুপি এসে বসেছিল ভোলা মোড়লের বাগানবাড়ির শান বাঁধানো চাতালে। কালো জলের দিকে তাকিয়ে বসেছিল অনেকক্ষণ। মায়ের জন্য মনটা দুর্বল হয়ে পড়ছিল ছিল বারবার। গাছ-গাছালি সেই মুহূর্তের জন্য উপাচার সাজিয়ে রেখেছে। কালো জলে তার শরীরটা ভেসে উঠলে তবেই তারা, তাদের গম্ভীর রূপ ত্যাগ করে আনন্দ ছড়িয়ে দেবে পাতায় পাতায়, ডালে ডালে। বুচনও যেন সেই ইঙ্গিত পাচ্ছিল। তাই আর অপেক্ষা করেনি সে। গড়িয়ে পড়েছিল শেষে। পাক খেয়ে খেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। পিছন থেকে একটা পরিচিত ডাক ভেসে আসছে কানে, "ওরে থাম… থাম বলছি… থাম… খো…"
ধাপের পর ধাপ। বুচনের মাথাটা যেন ঝিঁ ঝিঁ করছে আঘাতে।
জলে পড়েছিল সে। তারপর আর তার কিছু মনে ছিল না।
সেই থেকে চোখে চোখে রাখত তার মাই-ই। কিন্তু করুণা ঝরে পড়ত সবার থেকে। আজই যেন বদলে গেল তার সবকিছু। ক'টা টাকাই যেন তাকে অনেকখানি মূল্যবান করে তুলেছে হঠাৎই। বুচনের সেটা বুঝতে বাকি থাকেনি আর। সারাদিনের পদদলিত আত্মসম্মানকে বিছানা থেকে তুলে টেনে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছিল খাবার জায়গায়। সংসারে তার যেন গুরুত্ব বেড়ে গেল ক'টা টাকায়।
সব কিছু মেনে নিলেও রাতের একাকীত্ত্বের বিছানায় হার মানল সে। চোখের জলে বালিশ ভিজল তার। হঠাৎ এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল, পুরোপুরি ভিখিরি হবার জন্যে।
"আরে এই খোকা? খোকা? ওঠ… আর কত ঘুমাবি? ওঠ রে…"
বুচন চোখ ঘষতে ঘষতে তাকিয়ে দেখে পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে আছেন তার মা।
"ওঠ দেখি। চোখ ধোও… চা হয়ে গেছে। গেলে কি খালি পেটে যাবি নাকি? মুখে কিছু না দিয়ে বাইরে যেতে নেই। এতে অমঙ্গল হয়। যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে নে, ওঠ…"
শেষের কথাগুলোয় বুচনের অন্তরাত্মা হেসে উঠল গোপনে। অভাব, সংসারের অসচ্ছলতা, প্রিয় মানুষগুলোর একটু ভালো থাকা, হঠাৎই তার আত্মসম্মানকে টুঁটি টিপে মারল। একটা ছাপ মেরে দিল গোপনে… 'ভিখিরি'। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বুচন পা বাড়িয়ে ছিল পেশাদার ভিখিরি হতে, সকালেই।
কয়েক বছরের ভিখারি-জীবন তার। এখন রোজগার তার অনেক। বুচনের কথায়, "বাজার ভালো থাকলে দিনে সাত-আটশ তার হাতের খেল।"
তবে এ বুচনের হাতের খেল কী করে হয় জানি না, কিন্তু এ খেল মানুষের করুণার। এ খেল মানুষের সহানুভূতির। আর তার জোরেই বুচনদের দিন বলদায়। টালির চাল উঠে গেছে অনেক আগে। ছাদ উঠেছে মাথার উপর। ল্যাম্পের হলুদ আলোর জায়গায় এখন সাদা আলো। টিভি, ফ্রিজ কী নেই তাদের ঘরে?
দেখতে দেখতে দুটো বোনের বিয়ে দিয়েছে। ছোটো ভাইটাকে একটা দোকান কিনে দিয়েছে বাজারে। মুদিখানা দোকান করেছে সে। দাদা অন্ত প্রাণ তার। একদিন সেখানেও ভাঁটা পড়ে, বিয়ের মাস তিনেক পর। আখের গোছাতে শুরু করে পুচাই। সংসারের খরচ থেকেও হাত গুটায়। বলতে গেলে দেয়ই না। কত রকমের বাহানা তার। ব্যবসা ভালো নেই। ধার-দেনা ইত্যাদি।
সত্যিই সত্যিই তা একদিন প্রকাশ্যে আসে। মাঝরাত। পুচাই এল বুচনের ঘরে। সবাই ঘুমাচ্ছে। তাকে দেখে হকচকিয়ে গেল বুচন, "কি-কি হল রে? এত রাতে?"
একেবারে পা জড়িয়ে ধরার মতো, ঝাঁপিয়ে পড়ল, "দাদা, তোর পায়ে ধরি। আমাকে বাঁচা। নাতো দোকানটা আমাকে বেচে দিতে হবে।"
"আরে কেন? হয়েছেটা কি?"
"মহাজনরা আমাকে একমাস সময় দিয়েছে, ধার শোধ করার জন্য। আমি এত টাকা কোথায় পাব? না, দিতে পারলে আমি আত্ম-হত্যা করব, দেখিস।"
"এসব কী বলছিস? দেনা হল কী করে?" উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল বুচন। কিন্তু উত্তর দিতে গিয়ে চুপ করে রইল পুচাই।
"কি রে বল? চুপ করে রইলি যে?"
মাথা নিচু করে রয়েছে। বুচনের চোখে চোখ রাখতে পারল না। "দিলে দে… সে আমি কথা বলতে পারব না কিছুতেই। জোগাড় করতে না পারলে, মরব…"
"থাম, কী যা তা বলছিস? কারা পাবে? তাদের সঙ্গে কাল আমাকে একবার দেখা করিয়ে দে। এখন যা, গিয়ে শুয়ে পড়। যা…"
বিকেল হতেই বুচন দোকানে। পাওনাদার সকলেই হাজির। তাকে দেখেই চমকে ওঠে সবাই। হাত জড়ো করে তাদের কাছে মিনতি করে বুচন, "আমাকে একটু সময় দিন দয়া করে। আমি সব টাকা মিটিয়ে দেব আপনাদের।"
একজন ইতস্ততঃ করতে করতে বলে ফেললেন, "মাপ করবেন আমাকে। আপনি…"
"হ্যাঁ, আমি ওর দাদা। একটু সময় না দিলে ভাইটা আমার হয়তো…"
"না, না, আপনাকে…"
"দয়া করুন সবাই। নইলে…"
"প্ল্যাটফর্মে ভি-ভিক্ষে করতে…"
"হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছেন। আসলে আমিই ওকে দোকানটা কি…" বলতে গিয়ে আটকে গেল বুচন। এ কথা বললে যে ভাইয়ের অসম্মান হবে। তাই আবার ঘুরিয়ে বলল, "কিভাবে চলছে খোঁজও নেয়নি কোনোদিন। ও তো একাই সংসারের হাল ধরে রেখেছে। বেচারা একা আর কতদিকে টানবে বলুন তো? বোনেদের বিয়ের খরচ সব ওই করেছে। এত টাকা কোথা থেকে এল জানতে চাইনি কেউই। কোনোদিন মুখ ফুটেও বলেনি। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি টাকা কোথা থেকে এসেছে। সবই আপনাদের দয়া। নইলে এতদিন কি টাকা ফেলে রাখতেন, বলুন? ওকে একটু সময় দিন। ঠিক শোধ করে দেবে।"
সবাই উঠে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলেন সবাই। একজন বলেই ফেললেন, "শুধু আপনার দিকে তাকিয়ে ওকে সময় দিলাম। মনে থাকে যেন?"
"ধন্যবাদ আপনাদের। কথা দিচ্ছি, ও যত তাড়াতাড়ি পারে শোধ করে দেবে।"
পুচাই অবাক হয়ে তাকিয়ে শুনছিল দাদার কথা। কী বলছে এসব? সংসারের হাল কবেই বা ধরেছে সে? দেনায় দেনায় সে জেরবার? সে নাকি বোনেদের বিয়ের খরচ দিয়েছে? সে যাই হোক, এত টাকা সে দেবে কোথা থেকে? চটে গেল দাদার উপর। মুখ খিঁচিয়ে উঠল "তোর মাথার ঠিক আছে তো? এত টাকা আমি পাবো কোথায়?"
ম্লান হয়ে গেল বুচন মুখ, "ও তুই ভাবিস না। ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে। তোকে কিছু দিতে হবে না।"
প্লাটফর্মে আগের থেকে বেশি বেশি করে সময় দিত বুচন। ফেরার পথে ঘুরে যেত দোকান হয়ে। পাওনাদারদের আসাও বন্ধ হল একদিন। হাসি ফুটল পুচাইয়ের।
(৩)
ততদিনে পুচাই বাপ হয়ে গেছে। বোনেরাও এ বাড়ি মাড়ায় না খুব একটা। খুব দরকার না পড়লে এ বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষেও না কেউই। এখানে আসতে তাদের নাকি লজ্জা করে। পথে-ঘাটে তাদের নাকি মান-সম্মান যায়, বুচনের জন্য। ছোটো বোনটা সেদিন বাড়িতে এসে দু'কথা শুনিয়ে গেল মাকে।
অনেকদিন পর মেয়েকে দেখে আহ্লাদে উৎফুল্ল হয়ে উঠে ছিলেন বুচনের মা। সদর দরজার কাছে এগিয়ে গিয়েছিলেন মেয়ের জন্যে। কিন্তু তাঁকে দেখামাত্রই ঝাঁঝিয়ে উঠল তুতুল, "দাদার জ্বালায় কী আমরা কোথাও মুখ দেখাতে পারব না? শ্বশুর বাড়ির একগাদা লোকের সামনে মাথা হেঁট করে দিল একেবারে। এসে কিনা হাত পাতছে আমার কাছে?"
সব উচ্ছ্বাস মিইয়ে গেল হঠাৎ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন মেয়ের কথা শুনে। কিন্ত ঝাঁঝ কমল না তুতলের, "ঢঙের মতো দাঁড়িয়ে রইলে যে? ডাকো ভিখিরিটাকে। ওর জন্যে আর কত অপমানিত হব? লোকজনের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। খবরদার বলছি, এর পর যেন ও আমাদের সামনে না আসে?
ফরফর করে চলে যাচ্ছে তুতুল। পিছন থেকে তার মা ডাকতে গিয়ে যেন ডাকতে পারলেন না। কথাগুলো আটকে গেল সংকোচে, "বলি, ও তু… "
বারান্দা থেকে তাঁর কানে এল, "মা, কেন ডাকছ ওকে? শত ডাকলেও ফিরবে না ও। এই দেখো, শুধু শুধু কাঁদছ? সবই আমার বরাত মা। তুমি ঘরে যাও।"
হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন, "বেইমান কোথাকার? সব, সব বেইমান। ভগবান ওদের ক্ষমা করবে না কোনোদিন, এই বলে রাখলুম।"
"জানো তো মা, সেই তুতুল, যে দাদা দাদা করে হামলে পড়ত। যাকে কোলে নিয়ে গান না গাইলে ঘুমাতই না, সেই দেখো, আজ ভিখিরি বলে অপমান করে গেল!"
গলা ভারি হয়ে এল বুচনের। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে কোলের উপর। তবুও বলে চলল, "আবার আমার জন্য সবাই নাকি মু-মুখ দেখাতে পারে না? জানো তো মা, সেদিন পু-পুচাইও বলল, আমি যেন ওর দোকানে না যাই। এতে নাকি ওর-ও সম্মান যায়। কেন যে সেদিন পুকুর থেকে তুলে এনেছিল! ভালোই হতো যদি জলে ভেসে উঠতুম। তোমরা হয়তো একটু কাঁদতে। তারপর ভাবতে, যাই হোক আপদ তো গেল। তাই না?"
"চুপ কর তুই… চুপ কর… এই বয়সে আমি এসব নিতে পারছি না আর। কেন নিজেকে এত হেয় করছিস? তুই না থাকলে আমরা, আমরা সবাই ভেসে যেতুম।" কাঁদতে কাঁদতে কাছে এলেন বুচনের। আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে দিতে দিতে আবারও বললেন, "চল না খোকা, আমরা কোথাও চলে যাই। যেখানে এদের ছায়া পড়বে না। সেখানেও নয় তুই ভিক্ষে করবি। পারবি না বাবা?"
"কিন্তু এসব ছেড়ে, এদের ছেড়ে, কি বলছ মা?"
"ওরে ঠিকই বলছি। আমি আর কৎদিন? চোখ বুঝলে, তোকে দেখবে কে? এটা ভাবলে আমার…"
"এত ভেবো না মা। কেউ না থাকলে আমার প্ল্যাটফর্ম তো আছে। ঐ তো বাঁচিয়ে রেখেছে এতদিন। ঐ-ই বাঁচিয়ে রাখবে।"
সেই প্ল্যাটফর্মই আজ তার প্রাণ-ভ্রমরা। আপন করে নিয়েছে তাকে। ভরিয়ে দিয়েছে তার সংসার। অভাবের ফাঁক-ফোকরগুলো পূরণ করে দিয়েছে দিনে দিনে। কিন্তু চাহিদা বেড়েছে আগের থেকে। বুচনের চাহিদা? না না, ওর চাহিদা কোনোদিনই ছিল না। চাহিদা যা, সে তো ওর ভাই-বোনেদের। চাহিদা মেটাতে মেটাতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাদের। প্রাণান্ত হয়ে উঠেছিল তারা। আঁকড়ে ধরে রেখেছিল সবাইকে। আজ তারাই সরে সরে গেছে বুচনের থেকে। যাদের জন্য তার ভিখিরি হওয়া, তারাই তাকে দূর করে দিয়েছে দিনে দিনে।
আজ সকালে ছোটো ভাইয়ের বউ তা আরো স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে, অক্ষমের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই শ্রেয়। বাড়ি থেকে আজ আসার সময় সেই কথাগুলো বুকে বিঁধ ছিল ঠিকই, কিন্তু ততখানি নয়, যতখানি এখন এই প্ল্যাটফর্মে এসে হচ্ছে। যতই সে ভাবছে ততই জর্জরিত হচ্ছে। বাড়ির টান কমছে ততই। এতদিন বাড়ি ফিরত শুধু পাপন আর মায়ের জন্যে। কিন্তু সে রাস্তাটুকুও যেন ধীরে ধীরে সংকীর্ণ হয়ে উঠেছে। সব পথ যেন রুদ্ধ গেছে তার। মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখ ঝাপসা হয়ে গেল তার।
মনটা হঠাৎ ভিন্ন সুরে গাইতে শুরু করেছে, "ঝাঁপিয়ে পড় লাইনে। সব… সব ঠিক হয়ে যাবে নিমেষেই। কারোর জন্য কষ্ট হবে না। তোর জন্য সম্মান যাবে না কারোর। তুইও শান্তি পাবি। হাত পাততে হবেনা কারোর কাছে। ঝাঁপা লাইনে…"
শরীরও যেন সায় দিচ্ছে সে কথায়। হাতও যেন নেচে উঠছে ট্রেনের আওয়াজে। জুতো দুটো গলিয়ে নিল হাতে। টায়ারের সঙ্গে আটকানো বেল্ট শক্ত করে বেঁধে নিল কোমরে। হাত ফেলল… ঘষ… ঘষ…
"কিরে কোথায় চললি? টাকাগুলো নে। আরে এই বুচন? আমার ট্রেন আসছে রে… নে ধর… এই-ই বুচন?'
ট্রেন ঢুকছে দু'নম্বরে। বুচন এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে। এমনিতেই শীত। সারা শরীর তার ঘামছে দরদরিয়ে। সমাদ্দার বাবুর কথা যেন কানেই ঢুকছে না তার। বাঁচতে চায় সে। মরে বাঁচতে ক'জনই পারে? বুচন আজ নতুন করে বেঁচে দেখাবে। তাকে বাঁচতেই হবে।
"এই বুচন, কত ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না?" কাঁধে হাত পড়ল তার। হকচকিয়ে গেল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল গার্ডের দিকে।
"এই নে ধর… টাকাগুলো না নিয়ে চলে যাচ্ছিস যে বড়ো? ট্রেন এসে গেছে। ধর।" বলতে বলতে টাকার প্লাস্টিকটা ফেলে দিলেন তার কোলে। দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন সমাদ্দারবাবু। ঘন্টা বাজিয়ে একবার মুখ বাড়ালেন বুচনের উদ্দেশ্যে, "বাড়ি যা আজ, তোর ভাবগতিক ভালো নয়। বুঝলি?"
প্লাস্টিকের ব্যাগটা কোমরে গুঁজে নিল বুচন। চেটোর হাইই-চপ্পল দুটো নড়ে উঠল। ঘষতে ঘষতে ভিড় কাটিয়ে পঙ্গু শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলল কোম্পার্টমেন্টের কাছে। কয়েকজন মিলে তুলে নিল বুচনকে।
এই প্রথম ট্রেনে চাপল সে। চলতে শুরু করল ট্রেন। কয়েকটা মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল। মিলিয়ে গেল আবার। ঝাপসা হয়ে গেল সব।