গল্প - অমিত কুমার দাস
Posted in গল্প।। ১ ।।
সন্তুরের টুং টাং শব্দ করে ফোনটা উপস্থিতি জানান দিতে যেন ধ্যানভঙ্গ হলো জয়ীর। এতক্ষণ একমনে ডুবে ছিলো সামনে রাখা ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে থাকা পালি গ্রুপের নতুন শপিং কমপ্লেক্সের প্ল্যানে। এখনও স্পেস অপটিমাইজেশনটা ঠিকঠাক দাঁড়ায়নি। সেন্ট্রাল স্কাইলাইটের প্রভিশন করে ন্যাচারাল আলোটা ছড়িয়ে দিতে গিয়ে বেশ খানিকটা কমার্শিয়াল জায়গা কমে যাচ্ছে। এখনই বোঝা যাচ্ছে এই প্ল্যানটা দেখতে সুন্দর লাগলেও অ্যাকসেপটেড হবে না। পালি গ্রুপের কাছে জমা পড়ার আগে ওর বসই কাটিয়ে দেবে। সবার সামনেই ছ্যাড় ছ্যাড় করে কথা শোনাতেও ছাড়বে না। সেই সঙ্গে মোনা, বিজয়দের ঠোঁটের কোণে ভেসে ওঠা বাঁকা হাসি গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেবে। ভাবনাটা মনে আসা মাত্রই মেজাজটা তিতকুটে হয়ে যায়। ফোনটা ধরবে না ভেবেও অন্যমনস্ক হয়ে রিসিভিং-এর বোতামটা টিপে কানের কাছে তুলে ধরে একটু গম্ভীর ভাবে ‘হ্যালো’ বলতেই ওধার থেকে রাহুলের পরিচিত উচ্ছ্বাস মেশানো স্বর কানে ভাসে, ‘হ্যালো ডার্লিং, আমি বাড়িতে পৌঁছে গেছি। তোমার কী অবস্থা?’
ল্যাপটপের স্ক্রিনের ডানদিকের তলায় কোণায় ভেসে থাকা সময়ের দিকে চোখ পড়ে। এখন তো সবে ছ’টা বাজে। এর মধ্যেই রাহুল বাড়িতে? বিস্ময়ের ঘোরে থাকতে থাকতেই আবার রাহুলের গলা ভেসে আসে, ‘আবার ভুলে মেরে দিয়েছো তো? মনে আছে আজ আমাদের পার্টিতে যাওয়ার কথা? তুমি তো আবার বাড়ি গিয়ে রেডি হয়ে বেরোতে টাইম নেবে। একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ো, প্লিজ।’
এতক্ষণে কাজের ঘোর কাটিয়ে বাস্তবের মাটিতে পা রাখে জয়ী। ইশ্, একবারে ভুলে গিয়েছে। আজই তো রাহুলের এক কলিগের গৃহপ্রবেশের পার্টি আছে। দু’সপ্তাহ আগে ভদ্রমহিলা নিজে ওদের বাড়িতে এসে নিমন্ত্রণ করে গিয়েছিলেন। গত উইকএন্ডেও ফোন করে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। ও নিজে সুন্দর একটা ডিনার সেট কিনে গিফট প্যাক করে রেখেছে। আজ ব্রেকফাস্টের সময় রাহুলের সাথে প্ল্যান করেছিলো যে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে সেজেগুজে দুজনে মিলে যাবে, তিথি আর স্বাতীকে বাড়িতে রেখে। উইকএণ্ডে একটু রিল্যাক্স করে পার্টিটা এনজয় করবে। কিন্তু ও নিজেই ভুলে মেরে দিয়েছে।
চমক ভেঙে দ্রুত নিজের হাতের কাজ গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে জয়ী। বেরোবার আগে বসের চেম্বারে ঢুকে জানিয়ে দিয়ে যায় ডিজাইনটা আরেকটু বাকি আছে। উইকএন্ডে ওটার ওপর কাজ করে সোমবার জমা দিয়ে দেবে। পার্কিংলটে এসে নিজের ছোট্ট জাপানী গাড়ি স্টার্ট করে বাড়ির পথে এগিয়ে চলে জয়ী।
জয়ী ঘোষ। ‘ক্রিয়েটিভ ডিজাইন’-এর অন্যতম সিনিয়র আর্কিটেক্ট। গড়পড়তা বাঙালি মেয়েদের মতোই লম্বা। একমাথা কোঁকড়ানো অবাধ্য কালো চুল নিতান্ত অবহেলায় টপ নট করে বাঁধা। ফর্সা, পান পাতার মতো মুখে উজ্জ্বল কাজল কালো চোখ দুটো এই প্রান্ত তিরিশে বহু চড়াই উতরাই পেরিয়েও অদ্ভুত সারল্য মাখা। খুব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ না হলেও একবার দেখলে মিষ্টি মুখটা মনের কোণে ভেসে থাকে।
নেহরু প্লেসের এই অফিসটা থেকে বেরিয়ে চিত্তরঞ্জন পার্কের কাছে ওদের বাড়ি পৌঁছাতে মিনিট পনেরো সময় লাগে। বাড়ি পৌঁছে জয়ী দেখে ফেডেড জিনস আর কালো টি’শার্টে রাহুল রেডি হয়ে বসে আছে। ওকে দেখে হইহই করে উঠলো, ‘তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। মেয়েরা সরমার সাথে পার্কে গেছে। এক্ষুনি এল বলে।’
রাহুলের পাতলা হয়ে আসা চুলের মধ্য দিয়ে যমুনার বুকে জেগে ওঠা চরগুলোর মতো হালকা টাকটা যেখানে উঁকি দিচ্ছে সেখানে খেলাচ্ছলে হাত বুলিয়ে নিয়ে একটু পেছনে লাগার ভঙ্গিতে জয়ী বলে উঠলো, ‘কি ব্যাপার, আজ কলিগের বাড়ির পার্টিতে যাওয়ার জন্য এত ব্যস্ততা কীসের? অন্য সময় তো অফিস থেকে একটু আগে বেরোতে বললে হাজার বাহানা দেখাও, এই কাজ আছে, মীটিং আছে, হ্যানাত্যানা। আজতো সাত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে একদম রেডি হয়ে বসে আছো। সুন্দরী কলিগ কি প্রবল আকর্ষণ তৈরি করেছে, না আরও সুন্দরী কেউ ওখানে আসছে?’
রাহুলও রসিকতার মেজাজে বললো, ‘সেই জন্যই তো বলছি, তাড়াতাড়ি চলো। ওখানে আগে গেলে একটু বেশি সময় পাবো সুন্দরীদের ফ্লার্ট করার। তবে পার্টিতে একটু চোখের আড়াল হলেই, তোমার চারিদিকে যেভাবে হুলোরা ছোঁকছোঁক করতে শুরু করে, তাতে নিশ্চিন্তে যে কোনও সুন্দরীকে নিয়ে একটু ফ্লার্ট করবো তাঁর উপায় কোথায়?’
ছদ্ম রোষের ভান করে জয়ী ওর মাথায় চাঁটি মারতে যেতেই, রাহুল পোড়খাওয়া ব্যাটসম্যানের মতো চাঁটিটাকে ডাক করে বললো, ‘এবার চট করে রেডি হয়ে নাও, প্লিজ।’
আর কথা না বাড়িয়ে, জয়ী ঘরে ঢুকে অফিসের ব্যাগ রেখে দ্রুত দু’কাপ চা করে নিলো। বাড়ি ফিরে এক কাপ লিকার চা ওর খুব প্রিয়। সেই সঙ্গে রাহুলও এই সময় এক কাপ চা পেলে খুশি হবে। চা’টা শেষ করে বাথরুমে ঢুকে গেলো। একটু স্নান করে নিলে বেশ ফ্রেশ লাগবে।
স্নান সেরে ওয়ার্ডরোবের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট সময় নিলো জয়ী ড্রেস পছন্দ করতে। এমনিতে উইকএন্ডে কোথাও পার্টিতে গেলে ক্যাজুয়াল ড্রেস ওর ভালো লাগে। কিন্তু আজ রাহুলের কলিগের বাড়ির পার্টি। ওর সাথে রাহুলের অফিস পার্টিতে কয়েকবার দেখা হয়েছে। কিন্তু ওর বাড়ির কারুর সাথে পরিচয় নেই। ওর হাজব্যান্ডকেও চেনে না। গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান। সাতপাঁচ ভেবে একটা তাঁতসিল্ক বেছে নিলো। ময়ূরকণ্ঠী রঙের এই শাড়িটা রাহুল গত পূজায় ওকে দিয়েছে।
সাজ কমপ্লিট করে বেরনোর আগে একবার মেয়েদের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে নিলো। ওরা ফিরে এসে সরমার দেওয়া স্যান্ডউইচ নিয়ে পড়ার টেবিলেই বসে খাচ্ছে। মেয়ে দুটোর এই এক স্বভাব হয়েছে। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ বা ডিনারের সময় ডাইনিং টেবিলে বসলেও এই সন্ধ্যাবেলার টিফিনটা নিজেদের পড়ার টেবিলে বসেই সারবে। ও এই সময়টা বাড়িতে না থাকায় এই অভ্যাসটা শুধরাতে পারেনি। ও ঘরে ঢুকতে মেয়ে দুটোর মুখ খুশিতে ঝকমক করে উঠলো। ছোটোটা চেয়ার ছেড়ে উঠে ওর কোমর জড়িয়ে বললো, ‘মা, তোমাকে কি সুন্দর লাগছে।’ জয়ী ওর মাথায় চুমু খেয়ে মিষ্টি হেসে বললো, ‘এই শাড়িটা এমন, তোমরা পরলে তোমাদেরও সুন্দর লাগবে।’ তারপর একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো, ‘শোনো, আমি আর বাবা একটু বাইরে যাব। বাবার এক কলিগের বাড়িতে। তোমরা পড়া শেষ করে ডিনার সেরে নেবে। আমি সরমা মাসিকে বলে রেখেছি। ডিনার সেরে আধ ঘণ্টা টিভিতে কার্টুন দেখতে পারো। তারপর কিন্তু শুয়ে পড়বে। কাল সকালে তোমাদের সুইমিং প্র্যাক্টিস আছে, মনে আছে তো?’
মেয়ে দুটো খুব বাধ্য ভঙ্গিতে ঘাড় হেলাতে, জয়ী একটু গলা চড়িয়ে সরমাকে ডাক দিলো। সরমা এসে দাঁড়াতে ওকে রাতের খাবারের ব্যাপারটা বুঝিয়ে মেয়েদের আরেকদফা আদর করে ড্রয়িং রুমে এসে দেখে রাহুল তখনও টিভির সামনে বসে। ও সামনে এসে দাঁড়াতে রাহুল কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে চেয়ে রইলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ওর কাছে সরে এসে কাঁধে হাত রেখে একটু গাঢ় স্বরে বললো, ‘ডার্লিং, তোমাকে দেখে তো নতুন করে প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। চলো, আবার কোথাও হানিমুন সেরে আসি।’
চোখ বড়ো করে ছদ্ম রাগের ভানে জয়ী বলে ওঠে, ‘এই হচ্ছেটা কী? মেয়ে দুটো ঘরে আছে, সরমা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোমার পার্টিতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে কি? নাহলে বলো, মেয়ে দুটোকে নিয়ে একটু বাইরে গিয়ে খাওয়া যেতে পারে।’
হতাশার ভান করে রাহুল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, ‘অগত্যা। কিন্তু গাড়িতে একটু দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হলে বাধা দিও না যেন।’
।। ২ ।।
মিসেস বাজাজ একবার কথা শুরু করলে থামতে চান না। ক্রমশঃ এক প্রসঙ্গ থেকে আরেকটায় এমনভাবে চলে যান যে খানিকক্ষণ পর অপরপক্ষ খেই হারিয়ে ফেলে। ঠিক কি নিয়ে কথা শুরু হচ্ছিল তাই খেয়াল থাকে না। নেহাত সেলসের কাজে এতগুলো বছর কাটিয়েছে বলে বাক্যস্রোতে ভেসে যেতে যেতেও অনীক ঠাণ্ডা মাথায় ওর ক্লায়েন্ট ভোলানো হাসিটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে চোখের কোণ দিয়ে দেখলো হাতে বেশ বড়োসড় গিফট প্যাক নিয়ে সুবীর রায় তাঁর মিসেসকে নিয়ে ঢুকছেন। ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ওদের রিসিভ করতে এগিয়ে যেতেযেতে বেশ বড়ো একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো অনীক। যাক, আজকের মতো নিশ্চিন্ত। আর মিসেস বাজাজের সামনে একা ভেড়া যাবে না। কি কুক্ষণেই না ওদের রিসিভ করতে ও একা এগিয়েছিলো, টিনার কাছে ওর ব্যাপারে এত গল্প শোনার পরও। পিকলুকে স্কুল বাসে তুলতে গিয়ে রোজ সকালে ওনার সাথে টিনার মোলাকাতের গল্প তো কম শোনেনি। উনি নাকি ছেলেকে বাসে তোলার সময় যে গল্প শুরু করেন তাঁর জাল কাটিয়ে টিনা কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারে না। এর জন্য কতদিন অফিস পৌঁছাতে লেট হয়ে গেছে বলে টিনা গাওনি গেয়েছে। আজ টিনাকে অন্যদিকে ব্যস্ত থাকতে নিজেই এগিয়ে গিয়েছিলো। মিসেসকে ওর কাছে গছিয়ে কখন যে মিস্টার বাজাজ সুড়ুত করে কেটে গিয়ে মদের গ্লাস হাতে নিয়ে মহিলাদের সাথে ফ্লার্ট করতে মাঠে নেমে পড়েছেন, তা বোঝার আগেই অনীক মহিলার খপ্পরে পড়ে গিয়েছিলো। ভাগ্যিস ঐ সময়ে সুবীর রায় ঢুকলো।
সুবীর অ্যান্ড ফ্যামিলিকে রিসিভ করে অন্য গেস্টদের সাথে ইন্ট্রোডিউস করতে না করতে আরও একটা ফ্যামিলি ঢুকলো। এদের অনীক ঠিক চেনে না। প্রতিবেশী হতে পারে, পিকলুর স্কুলের বন্ধুদের বাবা-মা হতে পারে আবার টিনার অফিস কলিগও হতে পারে। বম্বেতে চাকরি জীবন শুরু করে বছর সাতেক আগে দিল্লিতে এসে ঘাঁটি গাড়লেও, এখনও সেলসের কাজে ওকে দৌড়ে বেড়াতে হয় বিভিন্ন শহরে। এত বছর ধরে সেলসের কাজে ক্রমাগত ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে অনীক খুব কম সময়ই একটু থিতু হয়ে ওর চারপাশের লোকজনকে দেখতে, চিনতে পেরেছে। পিকলুর বন্ধুবান্ধবদের বাবা-মা, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনদের সাথে যেটুকু যোগাযোগ তা পুরোটাই সামলেছে টিনা। ওর নিজের কয়েকজন কলিগ, ওদের কয়েকজন আত্মীয়-বন্ধু আর হাতে গোনা কয়েকজন প্রতিবেশী বাদে আজকের এই জমায়েতের অধিকাংশই টিনার আমন্ত্রিত। ও নিজের ন্যাচারাল সেলস স্কিল কাজে লাগিয়ে হোস্টের ভূমিকা পালন করছে মাত্র।
সদ্য আগত ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলার সাথে টিনা পরিচয় করিয়ে দিলো। রঘুবীর আর মীরা। ভদ্রমহিলা টিনার কলিগ। নিজের রূপ সম্বন্ধে বেশ সচেতন এবং পোশাকে বেশ সাহসী। সাধারণত এধরনের মেয়েদের সাথে মোলাকাত হলে ও হালকা একটু ফ্লার্ট করে জল মেপে নেয়। তাঁর পর অবস্থা বুঝে এগোয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওর সাফল্যের হার বেশ ভালো। কিন্তু একে নিজের বাড়িতে পার্টি, আর সেই সঙ্গে মহিলা টিনার কলিগ। পুরো ডেঞ্জার জোন। মিষ্টি হেসে ওদের রিসিভ করে টিনাকে ডেকে একপাশে সরে গেলো ও। মাথার ভেতরটা কেমন যেন ঘেঁটে রয়েছে। শরীরকে একটু নিকোটিন দিলে মন্দ হয় না।ভাবনাটা মাথায় আসতেই, সিগারেট ধরানোর জন্য চুপচাপ টেরেসে উঠে এলো ও।
উনিশ’তলা অ্যাপার্টমেন্টের একদম ওপরে ওদের এই টেরেসটা খুব ভালো করে সাজিয়েছে টিনা। পুরো টেরেস জুড়ে আলাদা একটা কাঠামো করে তাঁর উপরে সবুজ ঘাসের লন। মাঝে ইতস্ততঃ কয়েকটা ফুলের গাছ লাগানো সপ্তাহে দু’দিন একজন মালি এসে গাছগুলো দেখে, সার দিয়ে যায়। এখানে এসে দাঁড়ালে নয়ডার আকাশটা সামনে পরিষ্কার দেখা যায়। যদিও দূষণের কারণে আকাশটা ধূসর, তবুও তো মাথার ওপর নীলচে রঙের অনন্ত বিস্তার। তাতে অল্প হলেও কিছু তারা ফুটে আছে। সামনে কিছুটা সবুজ গাছগাছালি। সব মিলিয়ে এই কংক্রিটের জঙ্গলে একটু অন্যরকম একটা নিজস্ব জায়গা। এই অ্যাপার্টমেন্টটা কেনার পর এখানে কবে এসে দাঁড়িয়েছিলো মনে করতে পারে না অনীক। আজ এখানে এসে দাঁড়িয়ে ও অনুভব করলো, দীর্ঘ ক্লান্তিকর মরুভূমি পেরিয়ে মরুদ্যানে পৌঁছানোর মতো, আজ সারাদিনের দৌড়াদৌড়ির পর এখানে এসে দাঁড়িয়ে বেশ ভালো লাগছে, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে।
টেরেসের এক কোণে নির্মল আর চেতন দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিলো। অনীকের কলিগ নির্মল লখনৌর ছেলে, আর চেতন দিল্লির। চেতন একটু জুনিয়র। একজন তাঁর স্কুল জীবনের কয়েকবছর আর অন্যজন তাঁর চাকরি জীবনের প্রথম বছরদুয়েক কলকাতায় থাকার কারণে বাংলা বলতে না পারলেও মোটামুটি ভালো বুঝতে পারে। বাঙালীদের স্বভাব চরিত্রের সাথেও ওরা বেশ পরিচিত এবং পছন্দ করে। অফিসে বস হলেও, এই কয়েকবছরে অনীকের সাথে বেশ একটা সখ্যতাও তৈরি হয়ে গেছে এই দুজনের। ওদের সাথে অফিসের বাইরে বাংলাতেই কথা বলে মজা পায় অনীক। ওরাও ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করে।
ও এসে দাঁড়াতেই চেতন একটা সিগারেট অফার করলো। তারপর একটা চোখ টিপে বললো, ‘বস, আভি আভি আপ জিসকে সাথ বাত কিয়ে ও ভাবিকা কলিগ হ্যায় কেয়া? চিড়িয়া বহুত হট। আপ আগর উস কো টার্গেট নেহি কিয়া তো বোল দিজিয়ে। ম্যায় থোড়া কোশিশ করতা হু। থোড়ি টাইম দেনে সে আচ্ছা রিটার্ন মিলনেকা চান্স হ্যায়।’ ওর কথায় আর ভাবভঙ্গি দেখে অনীকের হাসি পেয়ে গেলো। ছেলেটা জুনিয়র হলেও এসব ব্যাপারে কোনও রাখঢাক করে না। ও একটু মুচকি হেসে বললো, ‘যা করবি বুঝে সুঝে। ও কিন্তু তোর ভাবির কলিগ।’ চেতন কাঁধ ঝাঁকিয়ে মুখে একটা হতাশার কৃত্রিম ভঙ্গি ফুটিয়ে বললো, ‘দাদা, ভাবিকা বাত করকে আপ তো পুরা মামলামে পানি ডাল দিয়া। আভি উধার নজর দেনা পসিবল নেহি হ্যায়। অউর আজ জিতনা নেশা হুয়ি থি, ও পুরা উতার গ্যয়ি। ফিরসে দারু লেনা পড়েগা।’
ওর ভঙ্গি দেখে, আর কথা শুনে নির্মল আর অনীক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। ওদের হাসির পর্ব শেষ হতে না হতে, চেতন টেরেসের ওপর ঝুঁকে পড়ে শিস দিয়ে উঠলো, ‘আরিব্বাস। দাদা, ইয়ে কৌন আ রহি হ্যায়? ইয়ে ভাবিকা কলিগ হোনে সে ভি ম্যায় লাইন লাগাউঙ্গা। লেকিন আপ ইসমে নজর মতো দিজিয়ে।’
অনীক এগিয়ে দেখার চেষ্টা করলো না। সিগারেটে সুখটান দিয়ে ধোঁয়ার একটা রিং ছেড়ে বললো, ‘সে যেই হোক না কেন, আমি তোর ভাবিকে বলবো, তোর সাথে আলাপ করিয়ে দিতে। তারপর যদি তোর ক্ষমতায় কুলোয় তো, এগিয়ে যাস।’
।। ৩ ।।
অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার মুখেই রাহুলের কলিগ দাঁড়িয়েছিলেন। এতক্ষণে ওনার নামটা মনে পড়েছে, টিনা। ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে ওদের সাদর আপ্যায়ন করে ডেকে নিয়ে গিয়ে একে একে অনেকের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। তারপর ওদের অ্যাপার্টমেন্টটা ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন।’
অ্যাপার্টমেন্টটা বেশ সুন্দর। ফোর বেডরুম, ডুপ্লেক্স। রুমগুলো বেশ বড়ো। সেইসঙ্গে ড্রয়িং-ডাইনিং-এর জায়গাটাও বেশ বড়ো। ফ্ল্যাটটা সাজিয়েছেও বেশ সুন্দর। ফলস সিলিং, আলোর ভ্যারিয়েশন, দেওয়ালে রঙের ডিজাইন, নানা ধরনের পেন্টিং। ড্রয়িং রুমে পাতা কার্পেটটা ভারী সুন্দর ডিজাইন করা। মডিউলার কিচেনটাও বেশ সুন্দর সাজানো। বিত্ত আর রুচির ছাপ স্পষ্ট। অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার আগে কমপ্লেক্সটা ওর যেটুকু চোখে পড়েছে, বেশ ভালো লেগেছে। অনেকটা জায়গা নিয়ে বেশ ছড়িয়ে তৈরি। এন্ট্রান্সের রঙিন আলোয় সাজানো ফোয়ারা, বীনের ডিজাইনে ছড়ানো সুইমিং পুল, সবুজ লনের মাঝ দিয়ে নুড়ি বিছানো পথ, বনসাই করা গাছ, জগার্স ট্র্যাক। মাঝে টেনিস কোর্ট, ক্লাব। সব মিলিয়ে বেশ সুন্দর। জয়ীর আর্কিটেক্টের চোখ কমপ্লেক্সের পুরো ডিজাইনটা দেখে বেশ আরাম পেয়েছে।
অ্যাপার্টমেন্টটা দেখতে দেখতে রাহুল কখন এক ফাঁকে একটা স্কচ নিয়ে ওর অন্য কলিগদের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে। জয়ী পায়ে পায়ে ঘরগুলো ঘুরে দেখছে। আর্কিটেক্টের কাজ করার ফল, না নিতান্ত নারী সুলভ কৌতূহল, কে জানে? নতুন কোনও বাড়িতে এলে পুরো ফ্লোর প্ল্যান, বিল্ডিংটার আর্কিটেকচার, ইনটিরিয়ার ডেকরেশন ও দুচোখ ভরে দেখতে থাকে। তারপর আশ মিটলে ও এক কোণে দাঁড়িয়ে অন্যদের সাথে আড্ডায় মাতে। নিচের ফ্লোরটা দেখা হলে, জয়ী ড্রয়িং স্পেস থেকে উঠে যাওয়া ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ফ্লোর স্পেসটা দেখতে ওঠে। বাঃ, এ জায়গাটা তো বেশ সুন্দর প্ল্যান করা। ওপরে একটা ওপেন টেরেস। নীচ থেকে টেরেসের যেটুকু চোখে পড়ছে তাতে তো মনে হচ্ছে ওখানটা গাছ লাগানো। বেশ সুন্দর লাগছে এখান থেকেও। ওপরে উঠে টেরেসটা দেখার বেশ কৌতূহল হচ্ছে। পায়েপায়ে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে টেরেসে উঠে এল জয়ী।
সামনে ছোট্ট সবুজ গালিচার মতন লন। কোণায় কোণায় গার্ডেন লাইট লাগানো। মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো ফুলগাছ। এমনিতে অবিন্যস্ত মনে হলেও ভালো করে দেখলে বোঝা যায় সেই অবিন্যাসটা বেশ পরিকল্পনা করেই করা। বাতাসে ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আছে। গন্ধটা খুব চেনা চেনা। চোখ বুজে মনে করার চেষ্টা করলো জয়ী। সেই ছোটোবেলার খেলা। ওদের বাড়ির ফুলের বাগানে ঘুরতে ঘুরতে বাবা একটা একটা করে ফুল গাছ চেনাতেন। তারপর কোনও একসময় ওকে বলতেন, ‘মামন, চোখ বুজে শুধু গন্ধ শুঁকে বলতো কোন ফুল ফুটেছে?’ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ও ঠিকঠাক বলতে পারতো। দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে আজ স্মৃতি বোধ হয় বিশ্বাসঘাতকতা করছে। চেনা গন্ধটা ধরা দিয়েও যেন ধরা দিচ্ছে না। বন্ধ চোখের পাতায় বাবার মুখটা ভাসছে। বাগানের মাঝে ওর দিকে হাসি ভরা মুখে চেয়ে আছেন। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। পড়নে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা। যখনই ও ঠিকঠাক ফুলের নামটা বলতে পারছে, বাবা এগিয়ে এসে ওকে কোলে তুলে মাথায় চুমা খাচ্ছেন। আর যখন পারছে না, তখন সমানে উৎসাহ দিয়ে চলেছেন। ‘আবার চোখ বুজে চেষ্টা কর, তুই ঠিক পারবি।’ বাবা চলে যাবার পর, যখনই কোনও কাজে আটকে গিয়ে হতাশ লাগে, তখন মনের ভিতর থেকে যেন সেই কথাগুলো শুনতে পায়, ‘মামন, চেষ্টা কর, তুই ঠিক পারবি।’ ঐ প্রিয় স্বরটা যেন জয়ীকে গোটা জীবন ধরেই উৎসাহ দিয়ে চলেছে।
গন্ধ দিয়ে ফুলটাকে ধরা তো গেলোই না, বরং বাবার স্মৃতি মনে এসে নিজের অজান্তে চোখ দুটোকে কেমন ঝাপসা করে দিয়ে গেলো। টেরেসের অন্য কোণায় কয়েকজন দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। ওদের এড়িয়েই ঠিক উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে জয়ী নিজেকে একটু সামলে নেবার চেষ্টা করলো।
।। ৪ ।।
প্রথম সিগারেটটা শেষ করার পর আরেকটা সিগারেট ধরাবে কি ধরাবে না ভাবতে ভাবতে বেশ খানিকক্ষণ চেতনদের সাথে ভাট বকছিলো অনীক। হঠাৎ খেয়াল হলো, ও বেশ খানিকক্ষণ নীচে নেই। এর মধ্যে যদি বেশ কিছু গেস্ট এসে গিয়ে থাকে, আর টিনা সামলাতে গিয়ে একটু ল্যাজেগোবরে হয়ে পড়লে মুশকিল। তার জের বহুদিন ধরে চলবে। টিনার বাক্যবাণ সামলাতে সামলাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়বে। তাঁর চেয়ে এখন নীচে গিয়ে কিছুক্ষণ সামাল দিয়ে একটু পরে একটা বড়ো হুইস্কি নিয়ে ও আবার সিগারেট খেতে আসবে।
চেতন আর নির্মলকে আসছি বলে ঘুরে এগোতে গিয়ে সিঁড়ির পাশে এক কোণে দাঁড়ানো নারীমূর্তির দিকে নজর গেলো ওর। কে ইনি? কখন এসে দাঁড়িয়েছেন। একটু দূর থেকে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। এই কমপ্লেক্সের কেউ, না কোনও আত্মীয়া বা বন্ধুর স্ত্রী?
সিঁড়ির কাছে পৌঁছে ভালো করে ঘাড় ঘুড়িয়ে একবার দেখলো অনীক। গার্ডেন লাইট আর শুক্লা চতুর্দশীর চাঁদের আলোতে মুখটার একটা পাশ চোখে পড়ছে। বড্ড চেনা ঠেকছে। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে দু’পা এগিয়ে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে অনীক জিজ্ঞেস করেই ফেললো, ‘আপনি?’
আস্তে আস্তে ভদ্রমহিলা মুখটা ফেরালেন। পান পাতার মতো মুখে উজ্জ্বল কাজল কালো চোখ, আবছা আলোয় কেমন যেন জলে ভরা লাগছে। ঐ চোখ দুটো, ঐ দৃষ্টি, যেন বড্ড চেনা। আচমকা কেমন যেন একটা ধাক্কা খেলো অনীক। দমকা হাওয়ায় ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যাওয়ার মতন বুকের মাঝে স্মৃতির পাতাগুলো একসাথে অনেকটা পিছনে টেনে নিয়ে গেছে। পনেরো, ষোলো, সতেরো, আঠারো বছর।
রেসিডেন্সিয়াল ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে ওর প্রথম দিন। ফার্স্ট হাফে ব্রেকের পর কলেজ ক্যান্টিনের সামনে সারি দিয়ে দাঁড়ানো বকুল গাছগুলোর তলায় সিনিয়ারদের ছুটকো র্যাগিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আড়চোখে প্রথম দেখা ওদের। ও নিজে মেকানিক্যালের ছিলো। একদম নারী বর্জিত ডিপার্টমেন্ট। তখনও অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের মেয়েদের চিনতো না। কিন্তু সিনিয়রদের কাছে ওর মতোই র্যাগড্ হচ্ছে দেখে বুঝতে পেরেছিলো মেয়েটি ওর ব্যাচমেট।
প্রথম পরিচয় ফ্রেসারস ওয়েলকামের প্রোগ্রামের রিহার্সালে। ‘আমি অনীক, মেক্যানিকাল। তুই?’
কপালের ওপর এসে পড়া অবাধ্য কোঁকড়ানো চুলের গোছাকে মাথার উপরে ক্লিপ দিয়ে আটকাতে আটকাতে, পান পাতার মতো মুখে আকর্ষণীয় কাজল কালো চোখে মিষ্টি হাসিতে উত্তর এসেছিলো, ‘জয়ী, আর্কিটেকচার।’
চোখের দৃষ্টিও যে বুকের গভীরে গিয়ে তীরের মতো বিঁধতে পারে তা ঐ মুহূর্তেই অনুভব করেছিলো অনীক।
ফ্রেসারস ওয়েলকামের ঐ সময়টা টুকটাক কথা হলেও কেমন যেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছিল জয়ী। বিকালে লেডিস হস্টেলে গিয়ে ওর ব্যাচের মেয়েদের সঙ্গে আড্ডা মারা, সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে এসপ্ল্যানেডে সিনেমা দেখার প্রোগ্রামে অন্যদের পাওয়া গেলেও ওকে কিছুতেই সামিল করতে পারা যাচ্ছিলো না। আস্তে আস্তে নিজের মধ্যে একটা মরিয়া ভাব টের পাচ্ছিল অনীক।
অনীক গিটার বাজিয়ে গান গাইত। ‘মহীনেরঘোড়া’, পিট সিগার, বিটলস। স্কুলের শেষ বছর দুয়েকে ও বুঝতে শুরু করেছিলো ওর মধ্যে মেয়েদের আকর্ষণ করার একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। ওর একমাথা কোঁকড়ানো চুল, কপালে ফেট্টি বেঁধে গিটারে ঝংকার দিয়ে জীবনমুখী গান, পালিশ করা কথা, ব্যবসায়ী বাবার দৌলতে মোটামুটি ভারী পার্স। অল্প কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ মেয়েই ওর সাথে মিশতে পছন্দ করতো। কলেজে ওদের ব্যাচের জনা তিনেক মেয়ে পরিচয় হবার মাস ছয়েকের মধ্যেই ওকে যেচে প্রপোজ করে দিয়েছে। তাঁরা কেউই ফেলনা নয়। ওদের কাউকে বেছে নিলে কলেজের এই খোরো দিনগুলো বেশ ভালোভাবে কাটতো। কিন্তু যার জন্য ওর এই হাপিত্যেশ করে বসে থাকা, প্রায় রোজ বিকেল থেকে রাত্রি অবধি নিজের ডিপার্টমেন্ট বা হস্টেলের বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে লেডিস হস্টেলে মাটি কামড়ে পরে থাকা, সে একদমই পাত্তা দিচ্ছে না। মেয়ে পটানো নিয়ে ওর এতদিনের গর্ব প্রায় ধূলিসাৎ। বাইরে যতই স্মার্টনেস বজায় রাখুক না কেন, নিজের কাছে নিজেই যেন কোনও উত্তর দিয়ে উঠতে পারছিলো না অনীক।
ফার্স্ট ইয়ার শেষ করে সেকেন্ড ইয়ারের অর্ধেক হয়ে গেলো। কলেজে ভর্তি হবার পর এই দীর্ঘ দেড়বছর কোনও মেয়েকে নিয়ে ও মাতেনি। জয়ীর দিকে থেকেও কোন সাড়া নেই। ক্রমে বিকেলে লেডিজ হস্টেলে যাওয়া অনিয়মিত হয়ে পড়লো। শুরু হলো হস্টেলের বন্ধুদের সাথে সন্ধ্যার মুখে বেড়িয়ে ফেরার পথে কলেজের গেটের বাইরে ভাবীর ঠেক থেকে গাঁজার পুরিয়া তুলে আনা। হস্টেলের ছাদে বসে সিগারেট থেকে তামাক বার করে নিয়ে গাঁজা ভরা। তারপর এক বুক ধোঁয়া ভরে নিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখা। মুড হলে, গিটার বাজিয়ে গান। উইকএন্ডে সল্টলেকে মামাবাড়ি ফেরার বদলে অন্য কোনও বন্ধুর বাড়ি যাওয়া, বা কোথাও দুদিনের জন্য বেড়িয়ে আসা। একটা অন্যরকম স্বাধীনতার স্বাদ। মাঝে মাঝে শিলিগুড়ির বাড়িতে ফিরলে মা অনুযোগ করে, ‘তোর চেহারাটা কেমন খারাপ হয়ে পড়ছে। পড়াশুনোর খুব চাপ চলছে নাকি রে, বাবা?’
মৃদু হেসে মায়ের কথা উড়িয়ে দেয় অনীক। কলেজে যাওয়া আসার পথে এখনও মাঝেমাঝে চোখে পড়ে জয়ী ওর বন্ধুদের সাথে হেঁটে ফিরছে। ওর অবয়বটা দূর থেকে দেখতে পেলেই বুকের মাঝে একটা কাঁপুনি শুরু হয়, হাঁটু দুটো’র জোর কমে যায়, চলার গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। তাকাবো না ভেবে আগে থেকে মনকে যতই শক্ত করে রাখুক না কেন, কাছে এসে চোখটা ঐ পানপাতার মতন মুখটা’র দিকে চলে যায়। প্রাণ ভরে দেখতে থাকে এক বুক আশা নিয়ে। একবার, শুধু একবার মুখ তুলে দেখুক ওর দিকে। একবার চোখাচোখি হোক ঐ কাজল-কালো চোখ দুটোর সাথে। কিন্তু একটি বারের জন্যও জয়ী মুখ তুলে তাকায় না ওর দিকে। ওরা নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টায় মেতে এগিয়ে যেতে, এক বুক আশা নিভে যায়। বুকের মধ্যে জমে থাকা কষ্টটা আরও যন্ত্রণা ভরে নিতে চায়, বুক ভরে। সন্ধ্যা নামতে না নামতে ভাবীর ঠেকে হাজির হয়ে যায় অনীক। বাড়তে থাকা রাতকে সঙ্গী করে হস্টেলের জলের ট্যাঙ্কের ছাদে শুয়ে এক বুক কষ্ট কখন যেন ধোঁয়া হয়ে উড়ে যেতে যেতে সবাইকে সুখী করতে চায়।
সেকেন্ড ইয়ারে দিনের পর দিন ক্লাস না করার ফলে ডিসকলেজিয়েট হয়ে পরীক্ষায় বসা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা। প্রিন্সিপ্যালের অফিসে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট জমা দিয়ে অপেক্ষায় বসে আছে ওরা কয়েকজন। উনি অ্যালাউ করলে পরীক্ষায় বসা যাবে, নয়তো ইয়ার লস। ক্যানটিনে দীর্ঘ অপেক্ষার মাঝেই সিগারেটে গাঁজা ভরে হাতে তুলে দিলো সিভিলের পটা, ‘গুরু একটু রিল্যাক্স করো।’
বেশ জমিয়ে একটা সুখটান দিতে যাবে, সেই মুহূর্তেই যেন সব ঘেঁটে দিতে দৃপ্ত পায়ে কলেজ ক্যানটিনে ঢুকে এল জয়ী। মুহূর্তের মধ্যে সিগারেটে টান দেওয়া তো দূরের কথা, নিঃশ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেছে ও। অবাক হয়ে দেখে সেই পান পাতার মতো মুখ, সেই কাজল কালো চোখ এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর চোখের দিকেই। ডুবে যাচ্ছে ও, ভেসে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে, কোন অতলে। কেঁদুলির মেলায় শোনা সেই গানটা যেন বেজে চলেছে অবিরাম, ‘আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে, অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে ...।’
চমক ভাঙে এক ধমকে। ধমক না, অনুনয়। নাকি দুর্লঙ্ঘ্য আদেশ। নাকি অন্য কিছু?
‘এটা কী করছিস তুই?’
পায়ে পায়ে ক্যান্টিনের বেঞ্চ ছেড়ে উঠে এসেছিলো অনীক, জয়ীর পিছনে হেঁটে। বকুলতলায় মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে জড়ানো স্বরে শুধু বলতে পেরেছিলো, ‘আমি ভালো হয়ে যাব, জয়ী। তুই শুধু আমার সাথে একটু কথা বলিস মাঝে মাঝে।’
জয়ী একটা কথাও বলেনি। শুধু প্রিন্সিপ্যালের সম্মতি আসা অবধি একসাথে অপেক্ষা করেছিলো বকুলতলায় দাঁড়িয়ে। সেইদিন বকুলতলায় দাঁড়িয়ে যতবার ওর দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিলো অনীক, ততবার চোখে পড়েছে ঐ কাজল কালো চোখ দুটোর নীরব আশ্বাস। প্রতিবার নতুন করে সাহস খুঁজে পেয়েছিলো ও।
তারপর কেমন যেন বদলে গিয়েছিলো দিনগুলো। পড়াশুনায় খানিকটা সিরিয়াসনেস, বন্ধুদের সাথে প্রাণ খোলা আড্ডা। থেমে গিয়েছিলো ভাবীর ঠেকে যাওয়া। লেডিজ হস্টেলে যাওয়ারও কোনও প্রয়োজন ছিলো না আর। শুধু পড়ন্ত বিকালে, সূর্যের আলো যখন ওদের কলেজের ক্লক টাওয়ারটা ছুঁয়ে পশ্চিমে গঙ্গার বুকে মিশে যেত, ক্লক টাওয়ারের পাশ দিয়ে গা এলিয়ে পড়ে থাকা ঝিলের ধারের রাস্তার পাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের পাতায় যখন আলো-আঁধারির লুকোচুরি, ঠিক সেই সময় ঘোমটার মতো নেমে আসা আঁধারকে সঙ্গী করে জয়ী এগিয়ে আসতো সেই রাস্তার প্রান্ত ধরে, সবুজ মাঠের পাশ দিয়ে ব্রিটিশ আমল থেকে কলেজের প্রেমিক-প্রেমিকাদের লাভার্স লেন ধরে পায়ে পায়ে পথ চলতে চলতে কত টুকরো কথা, মান-অভিমান। অর্থহীন, তবু যেন শুক্তির বুকের মাঝে জমিয়ে রাখা মুক্তোর মতন, অমূল্য।
এর হাত ধরে কবে যেন এসে গিয়েছিলো সেই ঝোড়ো দিনগুলি। থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা শেষ। এক মাসের সামার ট্রেনিং। কলেজের পাশের একটা কারখানাতে অনীক ট্রেনিং-এর সুযোগ পেয়েছিলো। দরকার না থাকলেও অনীক প্ল্যান করেছিলো কলেজ হস্টেলে থেকে সামার ট্রেনিং করবে। সেই সময় কলেজ ছুটি থাকায় অন্য কোনও স্টুডেন্ট নেই। ওরা দু-একজন যারা হস্টেলে থেকে সামার ট্রেনিং করবে, তারাই রয়ে গিয়েছিলো। দিনের বেলায় ইচ্ছে হলে ট্রেনিংয়ে যাওয়া। রাতে বাইরে খেয়ে ফিরে হস্টেলে রাত কাটানো। এদিকে জয়ীর সাথেও দেখা হবার উপায় নেই। ও ফিরে গেছে ব্যারাকপুরে, ওর নিজের বাড়িতে। সপ্তাহ দুয়েক পর নিতান্ত বোর্ হয়ে জয়ীকে আসতে বলে ফোন করেছিলো।
নির্জন হস্টেলে মুখোমুখি হয়ে নিজেদের সামলাতে পারেনি ওরা কেউই। দু’জনে দু’জনকে চিনে নেওয়ার আনন্দে যেন মেতে উঠেছিলো। সেই সময় অনীক অনুভব করেছিলো, ওর ওপর জয়ীর কি আশ্চর্য নির্ভরতা। শরীরের পাগলামো মিটে গেলেও ওর বুকে লেপটে থাকতো জয়ী। কোনও প্রিকশন নেওয়া হয়নি জেনেও নির্বিকার থাকতো। ও যেন আশ্রয় ছিলো জয়ীর।
ফাইনাল ইয়ারের শুরুতে ওকে যেন আরও আঁকড়ে ধরেছিলো জয়ী। সেটা ওর শেষ বছর। জয়ীর কোর্স শেষ হতে আরও এক বছর বাকি। ফাইন্যাল ইয়ারের হস্টেলের সিঙ্গেল রুমে শরীর নিয়ে খেলা, খুনসুটির মাঝে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা।
মসৃণ ছন্দটা ভেঙে গেলো, যেদিন জয়ী এসে খবরটা দিলো। ও পিরিয়ড মিস করেছে। কয়েকদিন পরে কলেজের বাইরেই একটা প্যাথল্যাবে করা ইউরিন টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ। সেই প্রথম জয়ীর মুখে সামান্য চিন্তার ছাপ। সেই সঙ্গে একটু ভালোলাগা, একটু কৌতুকের আভাস।
‘এই ভালো হলো। আমরা ইয়ংগেস্ট পেরেন্টস। এখন আমার সিঙ্গল সিটার রুম। আমার তো পাঁচ বছরের কোর্স। আরও প্রায় দেড় বছর বাকি আছে। ততদিনে ও আমার কোলে চলে আসবে। এ বছর তুই চাকরি পেয়ে যাবি। এখন আমি সামলে নেবো। আমার সাথে এই ক্যাম্পাসেই ছোটোটা থাকবে। সামনের বছর আমার চাকরি খোঁজার সময় তুই সামলে নিস। তখন তো পুঁচকেটা একটু বড়োও হয়ে যাবে। আমি ঠিক করেছি মাসখানেক পরে বাড়িতে জানিয়ে দেবো। মা একটু রাগারাগি করবে ঠিকই। তবে বাবা ঠিক সামলে নেবে। তুইও বাড়িতে জানিয়ে দে। বেশ মজা হবে, তাই না?’
জয়ীর খুশিতে ভরা মুখের দিকে চেয়ে শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গিয়েছিলো অনীকের। মেয়েটা পাগল হয়ে গেলো নাকি। এমনিতে এত বাস্তববাদী, এত ঠাণ্ডা মাথার মেয়ে। কিন্তু এখন পাগলের মতন কথা বলছে। ও কি বুঝতে পারছে না, এটা হলে কত বড়ো হাসির খোরাক হয়ে যাবে গোটা কলেজ জুড়ে। আর কলেজ ছাড়া বাড়িতেও কি অনীক আর কোনওদিন মুখ দেখাতে পারবে?
কোনও রকমে জয়ীকে শান্ত করে ভাবতে থাকে অনীক। পরের দিন থেকে শুরু পাগলের মতন খোঁজ খবর করা। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে পৌঁছে যায় মন্দিরতলায়, সিনেমা হলের পাশের একটা গলিতে। খোঁজ খবর নিয়ে কথাবার্তা বলে আসে। এখন টাকার দরকার। আর দরকার জয়ীকে বোঝানোর।
বইপত্র কেনা, পরীক্ষার ফি, ইত্যাদি ভুজুংভাজুং দিয়ে বাড়ি থেকে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে ফেলে ও। আরও কিছু হলে ভালো হয়। একটা ফন্দি মাথায় ঘুরছে কয়েকদিন থেকেই। হস্টেলে ওর আশেপাশের ঘরের বন্ধুরা বেশ অগোছালো। পার্স, ঘড়ি, ক্যালকুলেটর কখনও বিছানায়, কখনও টেবিলের ওপর ছড়ানো ছিটানো থাকে। বিশেষত রাতে ক্যান্টিনে খেতে যাবার সময়।
পরের দিন ভোরবেলা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো। জয়ীকে দেখা করতে বলেছিলো মন্দিরতলায়, সিনেমা হলের সামনে। ওর সাথে গল্প করতে করতে পৌঁছে ছিলো সিনেমা হলের পাশের গলির নার্সিং হোমটায়। জয়ী জানতো ও মেডিক্যাল চেক আপে যাচ্ছে। বরাবরের মতো ও ভরসা রেখেছিলো।
বেচারী খুব কষ্ট পেয়েছিলো। ওকে নিয়ে যখন বেড়িয়ে এসেছিলো ঐ আয়া মতন মহিলা, তখন ওর মুখ পুরো রক্তশূন্য। সদা উজ্জ্বল চোখ দুটো কেমন অচেনা। জলে ভরা চোখ দুটো ওপরে তুলে যখন শেষবার ওর দিকে চেয়েছিলো তখনও যেন এরকম লেগেছিলো। জয়ী দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনেই, তবু সরে গেছে যেন কতদূরে।
সেদিন অনীক ওর হাতটা ধরতে গেলে সরে গিয়েছিলো। ফেরার পথে বাসে বসে সারাক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে বসেছিলো। অনীক অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও একটা কথাও বলেনি। আর কোনও দিনই।
।। ৫ ।।
মুখটা ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই চোখে পড়েছিলো ভদ্রলোককে। সামনে থেকে পিছনে ঠেলে দেওয়া কোঁকড়ানো চুল দিয়ে মাথা জোড়া টাক ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা। হাল আমলের ফ্যাশান অনুযায়ী রঙিন ডাঁটি সহ কালো ফ্রেমের চশমা। অবাক চোখে চেয়ে আছেন। এক মুহূর্ত তাকিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিতে গিয়েছিলো ও। হঠাৎ কেমন যেন মনে হলো, ঐ কালো ফ্রেমের মধ্যে দিয়ে দেখতে পাওয়া চোখ দুটো যেন বহুদিনের চেনা। আরও একবার মুখ ফেরানো।
ঢেউ উঠছে, ঢেউ নামছে। বুকের মধ্যে জলতরঙ্গের শব্দ। সিঙ্গল সিটার রুমের জানলার বাইরে দিয়ে চোখে পড়ে শীতের বার্তা পাওয়া আমলকি গাছটা। একটা একটা করে পাতা ঝরে যাচ্ছে, আর ডালে ডালে ধরে থাকা আমলকিগুলো একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে। ডালের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে কবরখানা, রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লক টাওয়ার, গা এলিয়ে থাকা রোদ ঝলমলে ঝিল, আর তাঁর পাশে এক এক করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো। সবাই একসাথে, কিন্তু একা। কি ভীষণ রকম নিঃসঙ্গ।
বাবার মুখটা আবার ভেসে আসে চোখের সামনে। একটু একটু করে প্রস্ততি নিচ্ছিলো মানুষটার সামনে দাঁড়ানোর। কল্পিত কথোপকথন, প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা রিঅ্যাকশন্, একটু একটু করে মনের মধ্যে তুলে নিয়েছিলো দিনের পর দিন ধরে। অথচ সুযোগও পেলো না একবার মানুষটার সামনে দাঁড়ানোর। সেই পালিয়ে বাঁচতে হলো। যেটা ওকে একটু একটু করে অপছন্দ করতে শিখিয়েছিলেন ঐ সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পড়া, কালো ফ্রেমের চশমা পরা প্রিয় মানুষটা। একটু একটু করে চুরমার হয়ে গেছে সমস্ত ভরসা, বিশ্বাস। এতদিন ধরে এই ছেলেটাকেই ও ভালোবেসে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে!
হস্টেলের ঘরে ঘরে, ক্যান্টিনে ফিসফাস। ও সামনে যেতেই সব চুপ। তবুও কানে ভেসে আসে কিছু কথা। হস্টেলে যাদের বয়ফ্রেন্ড আছে তাঁদের কানাকানিতে, কখনও বা অন্যকে শোনানোর ভঙ্গিতে। বয়েজ হস্টেলে ব্যাচমেটদের ঘরে চুরি, আর তাতে ধরা পড়ে, দায় স্বীকার করা ছেলেটার কথা। ওর খুব প্রিয় বন্ধু শ্রেয়া, সুপ্রীতিরাও ওর সাথে অনীকের ব্যাপারে কথা বলছে না। অথচ এরা কয়েকদিন আগেও প্রায়ই ইয়ার্কি মারতো, ওকে আর অনীককে নিয়ে। ভাবতে অসহ্য লাগে, ঐ ঠগ, ঐ চোরটাকে বিশ্বাস করে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিলো ও। তারপর আবার মনে পড়ে ঐসব সোনাঝরা মুহূর্তগুলো।
ফ্রেসারস ওয়েলকামের রিহার্সালের সময় শোনা কপালে ফেট্টি বেঁধে গিটারে ঝংকার দিয়ে গান। ছোটো থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতির আবহে বড়ো হওয়া জয়ীর কাছে কথাগুলো নতুন, গান গাওয়ার ভঙ্গিটা নতুন। অন্যরকম হলেও খারাপ লাগছে না শুনতে। আর গায়ক ছেলেটা তো বেশ সপ্রতিভ। এগিয়ে এসে পরিচিত হয়েছে নিজেই। কোঁকড়ানো চুলে, দোহারা গড়নে, একটু বেশিই স্মার্ট। কিশোরী বয়স থেকে টিউশনে গিয়ে টের পেয়েছিলো, পড়ার বইয়ের বাইরে ওর চারিদিকে উৎসুক চোখের ভিড় কম নয়। মেয়েদের সহজাত অনুভূতিতে সেটা এড়ানোর জন্য একটা আত্মমর্যাদার বর্ম পড়তে শিখে নিয়েছিলো সেই সময়েই। কলেজে সিনিয়র দাদা থেকে শুরু করে অন্য ব্যাচমেটদের সামনে সেটাই ঢাল হিসাবে রেখে ছিলো। এই সপ্রতিভ ছেলেটার সামনে সেই বর্মটা সামান্য আলগা হয়ে গিয়েছিলো, নিজের অজান্তেই। কিন্তু এই ছেলেটার ভাবে ভঙ্গিতে ওর সামনেও নিজের বর্মটা পরে নেবার প্রয়োজন অনুভব করে জয়ী।
রোজ কলেজ থেকে লাঞ্চ ব্রেকে, ছুটিতে হস্টেলে ফেরার সময় চোখে পড়ে বকুলতলায় বন্ধুদের সঙ্গে বসে হ্যাংলার মতো চেয়ে আছে। হস্টেলে ফিরেও নিস্তার নেই। গেস্ট রুমে এসে বসে নানা ছুতোয় দেখা করার অনুরোধ পাঠায়। প্রথম প্রথম দু’একবার নেমে এসে দেখেছে, পুরোটাই ওকে নিচে গেস্ট রুমে নামিয়ে এনে গল্প করার ফন্দি-ফিকির। বড্ড বিরক্ত লেগেছে। তারপর থেকে নানা ভাবে অনুরোধ এলেও স্পষ্ট না বলতে বাধেনি।
তবুও রোজ কলেজ থেকে হস্টেল আসা যাওয়ার পথে দৃষ্টির বিনম্র অর্ঘ্য। উপেক্ষার জবাবেও সেই একই নিবেদন। নিজের অজান্তে কবে যেন বুকের মাঝে একটু একটু করে জমেছিলো দুর্বলতা নিজের কাছে সেটা ধরা পড়লো সেকেন্ড ইয়ারের শেষদিকে, যখন কলেজ আসা-যাওয়ার পথে পরিচিত সেই চেহারাটা অনিয়মিত হয়ে পড়লো। মাঝে মাঝে ক্যান্টিনে দেখা যায় কলেজের একদল বখে যাওয়া ছেলের সাথে মৌজ করে সিগারেট টানছে। শ্রেয়ার কাছ থেকে জানা গেলো ওরা নাকি সিগারেটে গাঁজা ভরে খায়।
সেদিন হস্টেলে ফিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলো জয়ী, বেশ কিছুক্ষণ। এই পাগলামোর জন্য কি দায়ী ও নিজে? ও কী করতে পারে? নিজের কাছে কোনও স্পষ্ট জবাব খুঁজে পায়নি। পরদিন থেকে আবার জীবন এগিয়েছিলো স্বাভাবিক ছন্দে।
তবু মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যেত, কখনও বকুলতলায়, কখনও কলেজ ক্যান্টিনে, কখনও বা কলেজের গেটের বাইরে কোনও দোকানে। উসকোখুসকো চুল, পুরানো চশমা, কোঁচকানো জামাপ্যান্টে অযত্নের ছাপ পরিষ্কার। সেই কপালে ফেট্টি বাঁধা, ঝকঝকে ভাবটা উধাও। চেহারাটাও কেমন যেন ভেঙে গিয়েছে। চোখে-মুখে একটা আধপাগলভাব। দু’আঙুলের ফাঁকে ধরা বিড়ির টুকরো। শুধু ওর সামনে পড়লেই চোখ দুটো তুলে ধরে কেমন যেন চেয়ে থাকে, সেই প্রথম দিনের মতোই। বুকের মাঝে একটা কষ্ট জমতে থাকে।
এখন কলেজ থেকে ফেরার পথে বকুলতলার দিকে চোখ চলে যায় আপনা-আপনি। পরিচিত চেহারাটা চোখে না পড়লে কোনও ছুতোয় ক্যান্টিনে ঢুকে খুঁজে চলা। দেখা হলে, চোখে চোখ পড়লে সেই চোখ সরিয়ে নেওয়া। তবু তিরতিরে একটা ভালোলাগার স্রোত নীরবে বয়ে চলে বুকের মধ্যে। দেখা না হলে নিজের মধ্যে একটা অস্থিরতা, একটা ছটফটানি ভাব। যেটা আবার হস্টেল থেকে ওকে বার করে নিয়ে যায় সন্ধ্যায় কলেজ গেটের বাইরের দোকানগুলোয়। কোথাও যদি দেখা হয়ে যায়, একবার।
সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষার আগে বেশ কিছুদিন দেখা নেই তাঁর। বকুলতলায়, ক্যান্টিনে, গেটের বাইরের দোকানে কোথাও সে নেই। নিজের ভিতর একটা অস্থিরতা, একটা উদ্বেগ কুরে কুরে যাচ্ছে। নিজের বন্ধু-বান্ধব কারুর সাথে বেশিক্ষণ গল্প করতে ভালো লাগছে না। পড়ায় মন বসছে না। বইয়ের পাতায় চেয়ে থাকতে থাকতে ভেসে উঠছে সেই উসকোখুসকো চুলে ভরা মুখটা, আর সেই দৃষ্টি। কাউকে কিছু বলার নেই। বাড়িতে একবার ঘুরে এলে ভালো লাগবে ভেবে স্টাডি লিভের মাঝে বাড়ি যাওয়া। যতক্ষণ বাবা-মা’র সাথে গল্প করছে একরকম। একা হলেই মনের মধ্যে সেই মুখটা ভেসে ওঠে। হয়তো এখন বকুলতলায় বা ক্যান্টিনে গাঁজা ভরা সিগারেট হাতে রাস্তার দিকে চেয়ে বসে আছে। দু’দিন যেতে না যেতেই অনেক পড়া আছে বলে হস্টেলে ফেরা। সন্ধ্যায় ঘরে ঢুকে কোনওরকমে ব্যাগটা ঘরে রেখেই রুমমেট শ্রেয়াকে নিয়ে কলেজ গেটের বাইরে দোকানে দোকানে ছুতোনাতায় ঘোরা। না, সে নেই কোথাও।
পরের দিন লাঞ্চের সময় হস্টেলের মেসে আলোচনা কানে এল। ডিসকলেজিয়েট হওয়া কিছু ছেলে এবার আর শুধু ফি দিয়েই পরীক্ষায় বসতে পারবে না। নতুন প্রিন্সিপ্যাল খুব কড়া। উনি প্রত্যেকের কেস ব্যাক্তিগতভাবে দেখে তবে অনুমতি দেবেন। এবার বোধহয় কিছু ছেলের ইয়ার লস হবে। কয়েকজন বেশ উত্তেজিত। ইয়ার লস হয়ে গেলে কলেজে একটা গণ্ডগোল হবার চান্স আছে।
আলোচনাটা চলতে চলতে জয়ীর মাথায় একটা সম্ভাবনা ঝিলিক মারলো। এর মধ্যে ও নেই তো? থালা রেখে দ্রুত ঘরে ফিরে শ্রেয়াকে ধরলো, ‘একবার একটু কলেজের দিকে যাবি, প্লিজ?’
‘এখন, এই দুপুর রোদে!’
‘চল না, একটু দরকার আছে। আর্জেন্ট।’
শ্রেয়া কি বুঝলো কে জানে। কথা না বাড়িয়ে রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়লো ওর সাথে।
পায়ে পায়ে ক্লক টাওয়ারের পাশ দিয়ে বকুলতলা। সামনে ইতস্তত জটলা। সন্ধানী চোখ দ্রুত খুঁজে চলে। না এখানে নেই। ক্যান্টিনের দিকে তাকিয়ে ভেতরে আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলো একবার জয়ী। বাইরে থেকে ক্যান্টিনের ভেতরটা কেমন অন্ধকার লাগছে। শ্রেয়াকে নিয়ে কয়েক’পা এগিয়ে এসে ঢুকে এধার ওধার তাকাতে তাকাতে চোখে পড়লো, একদম শেষের দিকে একটা টেবিলে বসে আছে মূর্তিমান। হাতে হাতে ঘুরছে একটা সিগারেট।
মনস্থির করে ফেলে জয়ী। অবশেষে ও বুঝতে পেরেছে নিজেকে। শ্রেয়াকে হতভম্ব অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রেখে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যায় জয়ী। সামনে ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে দিয়ে দেখে ওর দিকে চেয়ে আছে সেই দুটো চোখ। বুকের মাঝে দোলা লাগে। হৃদয়ের কোন গভীর থেকে উঠে আসতে চাইছে একদলা কষ্ট। আর তাকে ছাপিয়ে তিরতির করে বয়ে চলা আনন্দের ফল্গুধারা। নিজেকে যথাসাধ্য সংযত করে বেড়িয়ে আসা স্বর নিজের কাছেই অচেনা ঠেকে, ‘এটা কী করছিস তুই?’
।। ৬ ।।
পার্টি শেষ হবার পর সারা বাড়ি লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছিলো। কাজের মেয়েটার সাথে হাত লাগিয়ে টিনা আরও মোটামুটি ঘণ্টাখানেক লড়ার পর এখন একটু ভদ্রস্থ হয়েছে। কাল আরও খানিকটা সময় দিতে হবে। আপাতত বিশ্রাম।
পিকলু অনেকক্ষণ আগেই বিছানায়। ঘুমিয়ে কাদা। কাজের মেয়েটা ওর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার পর ড্রয়িং রুমে ও আর টিনা মুখোমুখি বসে। টিনা এর মধ্যেই রাত পোশাকে চেঞ্জ করে একটা ক্রিম নিয়ে হাতে মুখে ঘষছে। স্কচের বোতলটা খুলে নিজের জন্য একটা বড়ো পেগ ঢেলে নিয়ে অনীক টিনাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি একটা নেবে, ছোটো করে?’
‘দাও। একটু জল দিও।’
হালকা সোনালি তরলে ছোট্ট চুমুক দিয়ে টিনা মম্তব্য করে, ‘যাক শেষ অবধি সব ভালোভাবেই উৎরে গেলো। গত কয়েকদিন ধরে যা টেনশন হচ্ছিলো।’
মৃদু হেসে অনীক বলে, ‘সুনিপুণা গৃহকর্ত্রী বলে কথা। সবাই তোমার বাড়ি সাজানোর প্রশংসা করছিলো।’
গর্বিত গ্রীবা হেলিয়ে টিনা জবাব দেয়, ‘এর পিছনে কম পরিশ্রম গেছে গত এক বছর ধরে? এখানে অ্যাপার্টমেন্টটা নেবার পর পাশের বিল্ডিং-এ টেন্যান্ট হিসাবে থেকে একটু একটু করে এটা সাজানোর প্ল্যানিংটা করেছি পুরো একা। তুমিতো মশাই, অফিসের কাজের অজুহাত দেখিয়ে বেশ গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরেছো। এদিকে আমি অফিস ঠেলে, পিকলুকে সামলে, ইনটেরিয়র ডেকরেটরকে দিয়ে একটু একটু করে সাজিয়েছি। তাঁর সঙ্গে মালিটাকে দিয়ে টেরেসটা। এখন এটা এমন দাঁড়িয়েছে যে মিসেস বাজাজ থেকে শুরু করে সব্বাই হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছে। এমনকি আমার কলিগ রাহুলের মিসেসও তো নিজে ভালো আর্কিটেক্ট। কি যেন নাম ওর, জয়ী। ও অ্যাপার্টমেন্টটার ইনটিরিয়র দেখে বেশ প্রশংসা করে বললো, ‘তোমার পছন্দ ভারি সুন্দর।’ তবে টেরেসটা দেখে ফেরার পর আর কিছু বলেনি। একটু গম্ভীর হয়েই ছিলো। বাড়ি ফিরে রাহুলকে নিশ্চয় চাপ দেবে ওরকম একটা টেরেস বানানোর জন্য। হয়তো, ওর পরের ডিজাইনটাতে এই কনসেপ্টটা কপিও করে দেবে।’
আচমকা টিনার মুখে জয়ীর নামটা যেন সোজা ধাক্কা মারলো। টিনা এমনিতে খুব পরিশীলিত হওয়া সত্ত্বেও যেভাবে শেষ কথাটা বললো, তাতে মুখের ভিতরটা কেমন যেন বিস্বাদ লাগছে। স্কচের পেগটা এক চুমুকে শেষ করে বড়ো করে আরেকটা পেগ বানিয়ে গ্লাসটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো অনীক।
‘আমি টেরেস থেকে একটা সিগারেট খেয়ে আসছি।’
নিজের গ্লাসটা শেষ করে বেডরুমের দিকে যেতে যেতে টিনা বললো, ‘বেশি দেরি কোরো না কিন্ত। কয়েকদিন বেশ চাপ গেছে। আজ একটু রিল্যাক্স করে শোবো।’
টেরেসে উঠে অনীক সেই কোণটায় এসে দাঁড়ালো, যেখানে কয়েক ঘণ্টা আগেও জয়ী দাঁড়িয়েছিলো, ওর বাড়িতে, এত কাছে, এতগুলো বছর পার করে। আজও কোনও কথা না বলে নীরবে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে নীচে নেমে গিয়েছিলো জয়ী। সিগারেটটা ধরিয়ে স্কচে চুমুক দিতে দিতে মনে হয়, জয়ী যেন ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। খুব কাছে। কলেজে ওর সিঙ্গল সিটার রুমটার ভিতরে যেন।
ওর নিঃশ্বাসের সুগন্ধ একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে । চোখ বুজে ওকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অনীক। সেই পানপাতার মতো মুখ, সেই কাজল কালো চোখ। সেই হালকা ভেজা ভেজা নরম ঠোঁট দুটো। ওর কবোষ্ণ শরীরের ওম যেন একটু একটু করে ঘিরে ধরছে অনীকের সারা দেহ। একে একে ওর সমস্ত আবরণ, খুলে ফেলছে অনীক। তিরতির করে কাপছে জয়ী, অসহ্য কোনও সুখের প্রত্যাশায়। উপর পাটির দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁটের কোণটা কামড়ে ধরা। একটু একটু করে জেগে উঠছে ওর সারা শরীর। শরীরের সমস্ত রোমকূপে যেন তারই প্রকাশ। বিন্দুবিন্দু স্বেদ জমছে সদ্য যৌবনে পা রাখা ঈষৎ কঠিন স্তনবৃন্তের চারিধারে। গভীর নাভিতে অতলে হারিয়ে যাবার হাতছানি। অনীকের সমস্ত শরীর যেন অসহনীয় বিস্ফোরণে ফেটে পড়তে চায়।
দ্রুত পায়ে বেডরুমে ফিরে আসে অনীক। ঘরের মায়াবী নীল আলোয় বিভ্রমটা ভাঙতে চায় না। বালিশে মাথা রেখে রাত পোশাকে শয়ান, বোধ হয় সেই চিরস্বপ্নের নারীই। চরম আশ্লেষে পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে অনীক। লেহনে, মর্দনে প্রায় ঘুমন্ত শরীরটা ধর্ষিতা হতে থাকে বারবার, অন্য কারুর ওপর সমস্ত আক্রোশকে শুষে নিতে নিতে।
সেই একই সময় জুড়ে, ধোঁয়াটে আকাশ ছুঁয়ে লাগোয়া শহরের অন্যপ্রান্তে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা নারীর কাজলকালো স্বপ্নময় দু’চোখে, ক্লক টাওয়ারের পাশ দিয়ে গা এলিয়ে শুয়ে থাকা ঝিলের বুকে অস্তগামী সূর্যের আলো মিশে যেতে থাকে। হস্টেলের সিঙ্গল সিটার রুমের জানলার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়া শীতের শেষের আমলকি গাছের বুকে অনেক নতুন পাতা। পাতা ঝরা অতীতকে পিছনে ফেলে অন্য এক জীবনের আশ্বাস। কানে ভেসে আসে সেই সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা প্রিয় মানুষটার জলদ গম্ভীর স্বর, ‘কখনও কখনও ভুল হয়ে যায়। সেটা পেরিয়ে এগিয়ে চল। মামন, চেষ্টা কর, তুই ঠিক পারবি।’ চোখে ভেসে থাকা জল মুছে ঘরের দিকে পা বাড়ায় জয়ী।