অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য
Posted in অন্তরমহলতুমি আছ আমি আছি
এসে গেল শীত। একটু উষ্ণতার জন্য আমরা সবাই। ধূমায়িত কফি, শীত বস্ত্র, মিঠে রোদ... কিন্তু সম্পর্কের উষ্ণতা? সে কি এই বছর শীতে উত্তাপ হারিয়েছে? দীর্ঘ গৃহবন্দীত্বের কারণে অনেক সম্পর্কের ছাল চামড়া ছাড়ানো উন্মুক্ত চেহারা আমাদের নিজেদের চোখেই বড়ো কুৎসিত ঠেকছে। ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন সে বিষ যাতনা কেমন করে অন্তরের সব মাধুর্য্য হরণ করে আমাদের মনকে ক্লেদাক্ত করে তুলেছে। মানব সমাজে 'সম্পর্ক' যেন সেফটি লকার। নিরাপত্তার তাগিদে আমরা বিভিন্ন সম্পর্ক যত্ন করে সাজিয়ে তুলি, বজায় রাখি। বিশেষত: ভারতীয় সমাজে বৃহত্তর পরিবারের সীমা রেখা চাচেরি ভাই কি মোউসি কি ননদ কি.....তথা বাঙালির আমার পিসতুতো ননদের মাসতুতো ভাইয়ের খুড়তুতো দিদির... এই যে সম্পর্কের ফাঁদ সে সব বাদ দিলে নিকট সম্পর্কের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক অন্যতম। এই অতিমারীর কালে দেশে বিদেশে অনেকক্ষেত্রেই সেই দাম্পত্য সম্পর্কগুলো ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছে। দাম্পত্য কলহ নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই দু:সময়ে মানুষের মন ও মনন চূড়ান্ত সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে কেমন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। একলা পথে যেন তার বাতি নিভেছে। সামনে মৃত্যুর হাহাকার আর অনিশ্চয়তার কালো পর্দায় তার সহজ চলার পথে যেন নেমে এসেছে অন্ধকার। যার প্রভাব পড়েছে তার দৈনন্দিন সম্পর্কে। কাছের মানুষকে দিনরাত খুব কাছ থেকে দেখতে দেখতে কেমন যেন চকচকে মোড়কখানা খুলে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে একটা আটপৌরে সাধারণ দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক। ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব যে পরিসর তার একান্ত ছিল সেই পরিসর হারিয়ে হঠাৎ করে পরস্পরের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে পড়ায় বিরাট এক অস্থিরতার মুখোমুখি দু' জনেই। দাম্পত্যে প্রথমত: যেটা বিশেষ করে ঘটে তা হলো চাহিদা। পরস্পরের কাছে বিভিন্ন চাহিদা তৈরি হতে থাকে। সেই চাহিদা পূরণ হতে না পারলে ( সব চাহিদা পূরণ বাস্তবে অসম্ভব ) মনে তৈরি হয় ক্ষোভ। ক্ষোভ জমা হতে থাকে পরতে পরতে। মনের অন্দরে জমে ওঠে মরা প্রবালের পাহাড়। একদিন সেই পাহাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে গরল। তার বিষ জ্বালায় ছটফট করতে থাকে বহু দিনের ভালবাসার, ভরসার, মায়ার সম্পর্ক। "ওকে আমি খুব ভালবাসি, ওকে ছাড়া বাঁচার কথা ভাবতেও পারি না"... তবু কেন যে মেজাজ রাখা যায় না সে কথা বোঝা বড়ো কঠিন ব্যাপার। এই ঘরবন্দী দশায় কত পুরোনো হিসাব নিকেশ কষা, কবে কোন না পাওয়ার ব্যথা নতুন করে বেজে ওঠা। কে দায়ী তার জন্য? মানুষের মন বড়ো বিচিত্র। তার একজন 'কেষ্টা' লাগে। নিজের আমিত্বকে আগলে রাখতে, দোষ ত্রুটি ঢাকতে। তাই সব থেকে কাছের মানুষটা কেই দায়ী করে ফেলি আমরা। নিজেদের দায়টুকু নিতে বড়ো লজ্জা আমাদের। ফলত: দাম্পত্যে নেমে আসে অসহিষ্ণুতা। কিন্তু যদি এ কথা মনে বুঝে নেওয়া যায়, যে কোনও সম্পর্কেই গোড়ার কথা হলো ভালমন্দের দায় দু পক্ষেই সমান বর্তায় তাই কানা কড়ির হিসাব কষার সময় যদি নিজের দায়টুকু মনে আনতে পারি তবে অন্যজনের প্রতি মন অনেক নরম হয়ে ওঠে। অনেক সময় বিশেষ পরিস্থিতি প্রতিকূলতার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সব সময়ে সম্ভব হয় না। সে কথাও বুঝে নিতে পারলে পরস্পরকে মেনে নিতে অনেকটাই সুবিধা হয়। আসলে সম্পর্কের ভিত্তি হলো কমিউনিকেশন। আমরা যা ভাবি, সেই মতো মনে আবেগের বুদবুদ ওঠে। সে আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার দায় আমাদের নিজেদের নয় কি? অনিয়ন্ত্রিত রাগের বশে যদি কাছের মানুষটাকে আঘাত করতে থাকি তবে সম্পর্কে ফাটল ধরবেই। প্রথমে ফাটল তারপরে ভাঙন। অনেক সময় দেখা যায় নৈকট্য দাম্পত্যে কোনও ফর্মালিটি রাখার প্রয়োজনবোধ করে না। আমার মতে সে বড়ো লঘু ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান বই তো নয়। তাই প্রাতিষ্ঠানিক সব সহবত বর্জন করার মধ্যেও একটা বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয় বই কি। ইংরাজিতে যাকে বলে taken for granted. তার চেয়ে বরং বুঝে নেওয়া ভাল উভয়েই সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তিসত্ত্বা, এবং উভয়েরই কিছু দোষত্রুটি থাকবেই। এ পৃথিবীর কিছুই নিঁখুত নয়। আমরাও নই। সেই সব দোষ গুণ নিয়ে একটা মানুষকে গ্রহন করা ও ভালবাসার মধ্যে যে উদারতা আছে তার মহত্ত্ব মনকে স্পর্শ করলে হয়তো পরস্পরকে ক্ষমা করার মতো মানসিক জোর পাওয়া সম্ভব। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কয়েকটি লাইন মনে পড়ে গেল।
---
"তোমার মাপে হয়নি সবাই
তুমিও হওনি সবার মাপে,
তুমি মর কারো ঠেলায়
কেউ বা মরে তোমার চাপে
তবু ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানা টানি?
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।"
আসলে আমরা মুহূর্তে বাঁচি। তাই বাঁচার জন্য মুহূর্তগুলো শিল্পীর মতো গড়ে তুলতে পারলে বাঁচাটা হয় সহজ, আনন্দময়। ছোট ছোট না পাওয়াগুলো থাক না দেরাজে তোলা। অসুস্থ পৃথিবী একদিন সেরে উঠবে। আবার যে যার জগতে মগ্ন হবো আমরা। ততদিন শুধু পরস্পরকে এ কথাই বলার থাক,
"উড়াব ঊর্ধ্বে প্রেমের নিশান দুর্গমপথমাঝে
দুর্দম বেগে দুঃসহতম কাজে।
রুক্ষ দিনের দুঃখ পাই তো পাব--
চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাব।
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি।
দুজনের চোখে দেখেছি জগৎ, দোঁহারে দেখেছি দোঁহে--
মরুপথতাপ দুজনে নিয়েছি সহে।
ছুটিনি মোহন মরীচিকা-পিছে -পিছে,
ভুলাইনি মন সত্যেরে করি মিছে--
এই গৌরবে চলিব এ ভবে যত দিন দোঁহে বাঁচি।
এ বাণী, প্রেয়সী, হোক মহীয়সী "তুমি আছ আমি আছি"॥