১৭
রাতের প্রথম পহর। বৈদ্যজীর ঘুম চটে গেছে, কারণ বড্ড শীত করছে। চব্যনপ্রাশ, স্বর্ণভস্ম, এবং বাদাম পাকের ব্যারিকেড ভেঙে ঠান্ডা ওনার চামড়ার নীচে ঢুকে পড়েছে আর মাংসের বেশ ক’টি পরত ভেদ করে হাড়মজ্জায় সেঁদিয়েছে। লেপটাকে ভাল করে গায়ে জড়াতে জড়াতে ওনার মনে পড়ল—বিছানায় একলা শুলে শীতের অনুভূতি বেশি হয়। এরপর ধেয়ে এল স্মৃতির মিছিল। তাতে লাভ হল এই যে একটু যেন চোখ লেগে গেল। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় একটু শান্তি। কিন্তু একটু পরেই শুরু হল পেটের ভেতর দুরন্ত হাওয়ার ক্রান্তি।
পেটের মধ্যে হাওয়ার চাপ দেহের নীচের ভাগ থেকে ঘন ঘন ঘোর নিনাদে বেরোতে লাগল। উনি লেপচেপে কয়েকবার পাশ ফিরলেন এবং শেষে বিপ্লবের এক ভয়ানক বিস্ফোটের পর ঘুমিয়ে পড়লেন। দেখতে দেখতে বিপ্লবের হাওয়া এক পোষা কুকুরের মত লেজ নাড়তে নাড়তে শুধু ওনার নাকের ফুটো দিয়ে শব্দ করে যাতায়াত করতে লাগল। উনি ঘুমিয়ে পড়লেন এবং ঘুমের মধ্যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতে লাগলেন।
দেখলেন গণতন্ত্র ওনার খাটের পাশে মাটিতে উবু হয়ে হাত জোড় করে বসে আছে। ওর চেহারাটা খেতে হাল জোতা চাষির মত, আর ইংরেজির কথাছেড়েই দিলাম, ওতো ঠিক করে হিন্দিও বলতে পারে না। তবু ও কাকুতিমিনতি করেই চলেছে আর বৈদ্যজী শুনছেন। উনি বারবার ওকে চৌকির উপর বিছানাতে উঠে বসতে বলছেন।ওকে বোঝাচ্ছেন—আরে গরীব তো কী হয়েছে, তুমি হলে আমার আত্মীয়; কিন্তু গণতন্ত্র তবু ওনাকে হুজুর হুজুর, সরকার--এইসব করে চলেছে।
অনেক বোঝানোর পর গণতন্ত্র উঠে এসে বৈদ্যজীর চৌকির কোণায় বসলো। আরো খানিক সান্ত্বনার পর যখন বুঝল এবার কিছু কাজের কথা বলা যেতে পারে তখন বৈদ্যজীর কাছে নিবেদন করল –আমার কাপড়চোপড় ছিঁড়ে গেছে, আমি প্রায় নগ্ন হয়ে গেছি। এই অবস্থায় কারও সামনে বেরোতে লজ্জা করে। তাই বলছি, হে বৈদ্যজী মহারাজ! দয়া করে এই অধমকে একটা সাফ-সুতরো ধূতি দিন, পরে দেখি।
বৈদ্যজী বদ্রী পালোয়ানকে বললেন ভেতর থেকে একটা ধূতি এনে দিতে, কিন্তু গণতন্ত্র মাথা নাড়তে লাগল। বলল—আমি আপনার কলেজের গণতন্ত্র। আর আপনি ওখানকার বার্ষিক সভা অনেক বছর ধরে ডাকেননি। ম্যানেজারের নির্বাচনও সেই কলেজ খোলার পর থেকে আর হয়নি। আজকাল আপনার কলেজ সব ব্যাপারে এগিয়ে চলছে, শুধু আমিই এককোণে অবহেলায় পড়ে রয়েছি। একবার আপনি নিয়মমাফিক নির্বাচন করিয়ে দিন। তাতেই আমার শরীর ঢাকার এক নতুন কাপড় হয়ে যাবে। আমার লজ্জা চলে যাবে।
এসব বলে গণতন্ত্র বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে গেল আর বৈদ্যজীর ঘুমটিও ফের ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই উনি লেপের তলায় ওনার ভেতরের ক্রান্তির এক তাজা বজ্রনির্ঘোষ শুনতে পেলেন। তখনই ঠিক করলেন যে দেখতে যেমনই ফালতু লাগুক, গণতন্ত্র লোকটা ভালোমানুষ, ওনার নিজের লোক এবং ওকে সাহায্য করা দরকার। ওকে অন্ততঃ একটা নতুন ধূতি দেয়া হোক। তাহলে ও আর পাঁচজন সভ্যভব্য লোকের সঙ্গে ওঠাবসা করতে পারবে।
পরের দিন কলেজের প্রিন্সিপালকে আদেশ দেওয়া হল—কলেজের বার্ষিক সভা ডাকা হোক এবং সমস্ত পদের সঙ্গে ম্যানেজারেরও নির্বাচন করা হোক। প্রিন্সিপাল অনেক বোঝালেন যে নতুন নির্বাচন করা দরকারী নয়, জরুরীও নয়। কিন্তু বৈদ্যজী নাছোড়, বললেন—তুমি থামো। এটা নীতির ব্যাপার।
কিন্তু প্রিন্সিপাল থামার পাত্র নন। বলে চললেন—আরে কোন খবরের কাগজে সমালোচনা হয়নি, ওপরমহলে নালিশ যায়নি, না কোন মিছিল বেরিয়েছে, না কেউ অনশনে বসেছে। সব শ্যালক নিজের নিজের গর্তে সেঁধিয়ে রয়েছে। কেউ তো বার্ষিক সভা ডাকার কথা বলছে না, আর যে বলছে সে ব্যাটা কে? সেই ব্যাটা খান্না মাস্টার, সেই রামাধীন ভীখমখেড়বী আর ওনার দু’চারটে চামচে। ওদের চালে ফেঁসে সভা ডাকার ফল ভাল হবে না।
বৈদ্যজী সব শুনলেন, তারপর বললেন—তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু এসব তোমার বুদ্ধির অগম্য। কারণ এটা হল নীতিগত সিদ্ধান্ত। যাও, গিয়ে সভা ডাকার ব্যবস্থা কর।
সেদিনই সন্ধ্যে নাগাদ গয়াদীনের বাড়িতে পাঠানো হল। উদ্দেশ্য নির্বাচনের ব্যাপারে ওনার মতিগতির একটু আঁচ পাওয়া। গয়াদীন হলেন কলেজ কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। কাজেই এখন ওনার অপরিসীম গুরুত্ব। জানা দরকার যে উনি এবার কাকে ম্যানেজার করার কথা ভাবছেন। আর যদি ওনার ভাবনা বৈদ্যজীর পক্ষে না হয়, তাহলে কী কৌশলে ওনার হৃদয়-পরিবর্তন করা যেতে পারে? রঙ্গনাথ এবং রুপ্পনবাবু প্রাথমিক কথাবার্তা শুরু করতে ওখানে গেছেন।
তবে গয়াদীন গোড়া থেকেই পুরো ব্যাপারটা সহজ করে দিলেন। উনি দু’জনকে আপ্যায়ন করে চারপাইতে বসালেন, রঙ্গনাথের শহুরে শিক্ষার ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন করলেন, ওদের বিশুদ্ধ ঘী দিয়ে তৈরি মটরী ও লাড্ডু খাওয়ালেন, তারপর নির্বাচনের কথা উঠতেই সাফ বলে দিলেন—“সব কাজ ভাল করে ভেবেচিন্তে করা উচিত। সময়ের হাওয়ার সঙ্গে বয়ে গেলে চলবে না। ম্যানেজার পদের জন্য নির্বাচন করাতে হবে, ভাল কথা। কিন্তু ম্যানেজার বৈদ্যজী মহারাজই থাকবেন, কারণ কলেজটা ওনারই। অন্য কাউকে ম্যানেজার করার প্রশ্ন উঠছে কেন? এসব ভাল করে ভাবা উচিত”।
ওনার কথাশুনে মনে হল যেন খোদ রঙ্গনাথ আর রূপ্পনবাবু বৈদ্যজীর বিপক্ষে ভোট দেওয়ার কথা ভাবছে, এবং বৈদ্যজীর তরফ থেকে নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব গয়াদীন নিজে সামলাচ্ছেন। রঙ্গনাথের মজা লাগছে। ও বলল,”আপনারা হলেন পুরানো লোক। প্রত্যেক বিষয়ে সঠিক বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু ওদিকে যে ভীখমখেড়বী আর অন্য কিছু লোকজন মামার জায়গায় অন্য কাউকে ম্যানেজার করতে চাইছে। জানি না কেন এসব করছে”?
গয়াদীনের কাশি উঠল। ধীরে ধীরে বললেন,” অভিজ্ঞতা নেই, তাই। ওরা ভাবছে ম্যানেজার অন্য কেউ হলে ওরা কিছু করে দেখাবে। কিন্তু এভাবে কোন কিছু হয় নাকি”? তারপর একটু থেমে কথা শেষ করলেন,” যেমন নাগনাথ, তেমনই সাপনাথ”।
কথাটা রঙ্গনাথের পছন্দ হল না। এই উপমায় ওর মামাজী বেশ খাটো হয়ে গেলেন যে! ও তাড়াতাড়ি বলল,”সে বুঝলাম, কিন্তু মামাজীর সঙ্গে তুলনায় ওরা দাঁড়াতে পারে?”
উনি ফের ব্যাখ্যা করতে লাগলেন, “দেখ একথাটা তো আমি আগেই বলে দিয়েছি। কলেজ বৈদ্যজীর, ওনার হাতেই থাকুক। পঞ্চায়েত রামাধীন ভীখমখেড়ীর, সেটা ওর হাতে থাকুক। সবাই নিজের নিজের ঘরে বসে সন্তুষ্ট হোক। ---
“নির্বাচনের তামাশায় আছেটা কী? নতুন লোককে ক্ষমতায় বসাবে? সেও একইরকম খারাপ হবে। সব একই ধরণের। তাই বলছি—যে যেখানে আছে, তাকে সেখানেই নির্বাচিত করে দাও। পড়ে থাকুক নিজের গুহায়। খামোকা ওলট-পালট করে কী লাভ”?
রুপ্পনবাবু বাটিতে পড়ে থাকা শেষ লাড্ডুটিকে মন দিয়ে দেখতে দেখতে “খাব-কি-খাব না” চিন্তায় মগন। যেই শুনেছেন যে গয়াদীন বৈদ্যজীকেই ম্যানেজার বানানোর পক্ষে, ওনার কথাবার্তায় আগ্রহ শেষ হয়ে গেল। উনি বুঝে গেছেন যে এরপরে খালি ফালতু বকোয়াস হবে। কিন্তু রঙ্গনাথ গয়াদীনের ভাবনায় কিছু নতুন চিন্তার খোরাক পেল।
যেমন, নির্বাচনে যারাই দাঁড়ায়, তাদের অধিকাংশই অধম এবং নীচ প্রকৃতির লোক। তাহলে যাদের বদমাইশি এবং প্যাঁচ-পয়জার লোকজন চিনে ফেলেছে, তাদের সরানো উচিত নয়। রঙ্গনাথ মনে মনে গণতন্ত্রের এই থিওরির নাম দিল ‘গয়াদীনবাদ’। ওর ইচ্ছে হল আরও কিছু শোনে।
গয়াদীন বলছিলেন, “নতুন লোক এসে কিছু করতেও যদি চায়, তো করবেটা কী? যদি লোকে কিছু করতে দেয় তবে না! আজকাল যে সময় পড়েছে, কেউ কাউকে কিছু করতে দেয়? এখন তো খালি---“।
ছংগামল ইন্টার কলেজের ছেলেদের খেলাধূলার জগতের সঙ্গে ভালরকম পরিচয় আছে। কারণ, কলেজ প্রতিমাসে ওদের থেকে খেলাধুলোর ফীস কান ধরে আদায় করে, যদিও কলেজের কাছে খেলেধুলোর জন্য কোন মাঠ নেই। কিন্তু এনিয়ে কারও হেলদোল নেই। সবাই সন্তুষ্ট। খেলাধুলোর দায়িত্ব গেমস টিচারের। ফলে তাঁর কাছে অফুরন্ত সময়। তাই তিনি মাস্টারদের দুটো দলের সঙ্গেই ভাব জমিয়ে তাদের ভেতরের খবর বের করে নেন।
এতে প্রিন্সিপালেরও খুব আরাম। এখানে হকি স্টিক নিয়ে মারপিট হয় না, কারণ এদের কোন হকি টিম নেই। আর এসব থেকে কলেজের ডিসিপ্লিনেও কোন আঁচ লাগে না। ছাত্রদের বাপও খুশি, কারণ ছেলেদের খেলার ঝামেলা শুধু ফীস দিলেই মিটে যাচ্ছে। আর ছেলেরাও সত্যি সত্যি কোন খেলোয়াড় হবে না। ছেলেদের দলও খুশো। কারণ ওরা জানে যে হাতে হকিস্টিক নিয়ে একটা ঢিলের টুকরোর মত ছোট্ট বলের পেছনে এই গোল থেকে ওই গোলপোস্ট পর্য্যন্ত পাগলের মত দৌড়তে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণে এক কুঁজো তাড়ির রস গেলা যায়। অথবা, জুয়োর আসরে দাঁও লেগে গেলে চার-ছ’টাকা পকেটে পোরা যায়।
এই ছেলেগুলোর হাতেই আজ হকিস্টিক এবং ক্রিকেট ব্যাট। সেগুলো ওরা এমন কায়দায় ধরেছে যেন ওদের হাতে কেউ রাইফেল গুঁজে দিয়েছে। প্রায় পঞ্চাশটা ছেলে এইসব হাতিয়ারে সজ্জিত হয়ে কলেজের গেটের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। রঙ্গনাথ ওদের এই অপরূপ সাজসজ্জা দেখে জানতে চাইল—হয়েছেটা কী? আজ কি স্কুল ইনস্পেক্টরের আসার কথা?
ছোটে পালোয়ান উত্তর দেবার চেষ্টা করল, অর্থাৎ কোমর থেকে আলগা হওয়া লুঙ্গির গিঁট কষে বাঁধল। তারপর বলল,”এইসব পটাপট ঝামেলার মধ্যে কার ইনস্পেকশনের দায় পড়েছে? এসব আয়োজন তো বার্ষিক সভার জন্য “।
ছোটে পালোয়ান কলেজের সমিতির সদস্য বটে। ছেলেরা ওকে দেখে হর্ষধ্বনি করল। গেটের কাছে ওর দেখা হল প্রিন্সিপালের সঙ্গে। উনি বললেন,”আসুন ছোটেলালজী! আপনারই অপেক্ষায় আছি।
--“এসেছি যখন, পালিয়ে যাব নাকি? আপনি আমার আগে চলুন”। এটা ছোটেলাল ভালো মনে বলল। রর্ষাকালে কুকুর বৃষ্টিতে ভিজলে এক বিশেষ ধরণের শব্দ করে হাঁচে। অপ্রস্তুত প্রিন্সিপালের হাসির চেষ্টায় গলা দিয়ে খানিক ওইরকম আওয়াজ বেরোল। উনি পালোয়ানের আগে আগে চলতে চলতে বলা শুরু করলেন,” রামাধীনের দলও কোমর কষেছে। বেজেগাঁওয়ের লাল সাহেবের সাহায্যে আরও কয়েকজনকে ভাঙিয়ে নিয়েছে। লালসাহেব কেন যে এই সব ঝামেলায় নাক গলিয়েছেন। থাকেন তো শহরে, কিন্তু গাঁয়ের সব বিষয়ে নাক গলানো চাই”। রামাধীনের দেমাক বেড়েছে। এখন বোঝা যাচ্ছেনা যে কতজন এদিকে আর কতজন ওদিকে”।
ছোটে পালোয়ান কলেজ বিল্ডিংয়ের সামনে ফুলের কেয়ারির দিকে তাকিয়ে রইল। প্রিন্সিপাল বিড়বিড় শুরু করলেন –‘বৈদ্যজী মহারাজও মাঝে মাঝে এমন সব কাণ্ড করে বসেন যে কী আর বলি—কী দরকার ছিল এই নির্বাচন-টির্বাচন করানোর---‘?
পালোয়ান তখন একটা জনপ্রিয় কীর্তনের লাইন আউড়ে দিল—‘কেন শুনি বাকি লোকেদের কথা, আমার কৃষ্ণ যে প্রাণাধিক—‘!
গেট পেরিয়ে ভেতরে যেতে যেতে প্রিন্সিপাল বললেন—‘আপনিও আসুন রঙ্গনাথ বাবু, আপনার কোন মানা নেই’।
রঙ্গনাথ মাথা হেলিয়ে জানালো যে ও আসছে, কিন্তু ভেতরে গেল না। এবার একজন দু’জন করে কলেজ পরিচালক সমিতির সাধারণ সদস্যরাও ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়ে আসতে শুরু করেছেন। কো-অপারেটিভ ইউনিয়নের একজন ডায়রেক্টর এলেন পায়ে হেঁটে। কিন্তু এমন বেগে এলেন এবং এত তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে গেলেন যে ছোকরার দল ওনাকে না দেখে নিজেদের মুখ দেখতে লাগল। কয়েক মিনিট পরে ঠিকেদার সাহেব এলেন –কলেজের ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে, ফসল পায়ে দলে। কিন্তু উনি গেলেন অন্যদিকে, যেখানে কিছু মজুর কোন কাজ করছে। সেখানে দাঁড়িয়ে কিছু জিনিস আকাশে তুলে মাটিতে পটকে দেওয়ার অভিনয় করে উনি হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলেন। একটু পরে এলেন বাবু গয়াদীন, ধীর পায়ে এসে গেটের কাছে কালভার্টের উপর ছোট সিমেন্ট বাঁধানো জায়গাটায় বসে পড়লেন। উনি উদাসী চোখে দেখতে লাগলেন---ছেলেদের হাতে হকিস্টিক আর ব্যাট এবং একটি ছেলের হাতে ক্রিকেট বল। তারপর ওই বলের দিকে এমন একাগ্র হয়ে তা্কিয়ে রইলেন যেন সম্মোহন করছেন।
প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন—চলুন মেম্বার সাহেব, অন্য সবাই এসে গেছেন।
উনি এমনভাবে তাকালেন যেন ডাকাতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন, আর ওনাকে সাক্ষীদের সামনে আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডে যেতে বলা হয়েছে। অসুস্থ গলায় বলেন, ‘চলুন’। তারপর পেঙ্গুইনের মত পা ফেলে ফেলে উনি গেট পেরিয়ে কলেজ ভবনের মধ্যে অন্তর্হিত হলেন।
আরেকটু পরে সড়কে এক ঘোড়সোয়ারের আবির্ভাব হল, তার মাথায় পাগড়ি। দেখলে মনে হবে যেন ইতিহাসের দ্বাদশ শতাব্দীর পাতা থেকে এক্ষুণি ফরফর করে বেরিয়ে এসেছেন। ছোকরাদের মধ্যে একজন বলে উঠল—“এখন আর কেউ বৈদ্যজীর একগাছিও ছিঁড়তে পারবে না। ঠাকুর বলরাম সিং এসে গেছেন”।
বলরাম সিং এসেই ঘোড়ার লাগাম একটি ছেলেকে ধরিয়ে দিলেন। এখন উনি অষ্টাদশ শতাব্দীর চরিত্র। যেন দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহের খবর দিতে আগ্রার কেল্লায় ঢুকেছেন এমনি গতিতে কালভার্ট অব্দি এসে একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন—‘মারপিট হয়নি তো’?
--‘কিসের মারপিট? আমরা প্রিন্সিপালের দলে, অহিংসাবাদী’।
বলরাম সিং গোঁফে তা’ দিতে দিতে হেসে ফেললেন।
--‘তোরাও কিছু কম যাস না। হাতে হকিস্টিক আর ডান্ডা, আবার গান্ধীজির চেলাগিরি’!
ছেলেটা-‘মহাত্মাও লাঠি নিয়েই চলাফেরা করতেন। আমাদের হাতে কোন লাথি নেই। আর হকিস্টিক? এতে একটা বলও মরে না, মানুষ কোত্থেকে মরবে’?
প্রিন্সিপাল আবার বাইরে এসেছেন। ‘চলুন মেম্বার সাহেব, ভেতরে চলুন। কোরাম পুরো হয়ে গেছে। এবার মিটিং শুরু হবে’।
বলরাম সিং পাগড়ির কোনা দিয়ে ঘাম মুছলেন। বললেন,’কোন চ্যালাকে বলে দিন, ঘোড়াকে দানাপানি দিতে। আমি ভেতরে গিয়ে কী করব? আমার যত কোরাম, সব এখানেই’।
প্রিন্সিপাল খুশি হয়ে মাথা নাড়লেন। বলরাম সিং পাঞ্জাবীর পকেটটা শক্ত করে ধরে বললেন,’বিশ্বাস না হয় ছুঁয়ে দেখুন। কেমন কড়া! এটাই আসল কোরাম’।
প্রিন্সিপাল না ছুঁয়েই বললেন,’ ধরে নিন, ছুঁয়েছি। আরে আপনার কথা কি মিথ্যে হতে পারে’?
বলরাম সিং—‘ আসলী বিলেতি মাল, ছ’ঘরা। দেশি দোনলা নয় যে একবার ফুট্ট্ হয়ে থেমে যাবে। ঠাঁয় ঠাঁয় শুরু করে দিলে রামাধীনের দলের ছ’জন চড়াই পাখির মত ফুরুৎ হয়ে যাবে’।
--“ আহা, আপনার জবাব নেই! লা-জবাব”! প্রিন্সিপাল এমন ‘বাহ্ বাহ্’ করে উঠলেন, যেন বলরাম সিং কোন মুশায়েরাতে কাব্যপাঠ করছেন। উনি যেতে যেতে বললেন—“আমি ভেতরের মিটিংয়ে যাচ্ছি। বাইরেরটা আপনি সামলাবেন”। ফের পেছন ফিরে মহাত্মা বিদুরের বাণী ঝাড়লেন, “যাই করুন, শান্তিপূর্ণ ভাবে”।
বলরাম সিং ফের গোঁফে তা’ দিলেন। “ এখানে সব শান্তি। আমার উড়ুর নীচে গোটা পঞ্চাশেক শান্তি বিরাজ করছে”।
প্রিন্সিপাল সাহেব ভেতরে গেলেন। বলরাম সিং ফের কালভার্টের উপর পুলিয়াতে বসে পড়লেন। খানিকক্ষণ পিচির পিচির করে পানের পিক ফেললেন। তারপর যে ছেলেটা নিজেকে মহাত্মা গান্ধীর থেকে বড় অহিংসাবাদী ডায়লগ ঝেড়েছিল তাকে বললেন,” যাও তো ছেলে; একবার গোটা কলেজ চক্কর মেরে এসো। দেখে এস, আমার লোকজন ভেতরে ঠিক ঠিক জায়গা আটকে পাহারা দিচ্ছে কিনা? আর ব্যাটা রমেসরাকে বলে দাও—সালা যেন কারও সঙ্গে হাঙ্গামা না করে। যে বোঝালেও বুঝবে না তাকে এদিকে গেটের কাছে পাঠিয়ে দেয়, ব্যস্”।
ছেলেটা হালচাল বুঝতে ভেতরে চক্কর মারতে গেল। ও যেন একটা বয়স্কাউট, যে ভাবছে দেশের জয়-পরাজয় স্রেফ ওর মিশনের সাফল্যের উপর নির্ভর করছে। আশপাশের ছেলেগুলোর ছটফটানি বাড়ছে। তাই দেখে বলরাম সিং বললেন—“যাও ব্যাটারা; বেশ বড় চক্কর মেরে ঘুরে এস। আর নিশ্চিন্ত থাক, আমি যতক্ষণ পুলিয়াতে বসে আছি কোন দুশমন এদিকে ঘেঁষবে না”।
বেলা তিনটে। রাস্তা দিয়ে ট্রাক আর বলদে টানা গাড়ি আসছে যাচ্ছে। বলরাম সিং পুলিয়ার উপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে স্বপ্নিল চোখে ওই আসাযাওয়া দেখছেন। একবার ঘোড়া চিঁহি চিঁহি করে উঠল। উনি বললেন,”সাবাশ মেরে চেতক! সবুর কর। সময় হলে দানাপানি পাবি”।
চেতক সবুর করল এবং প্রমাণস্বরূপ খানিক পরে পরে জল ছাড়তে লাগল। ্কিছু ছেলে ওকে ঘিরে গোল করে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার নৈসর্গিক কাজকম্মের আগে ওপরের অবস্থা মন দিয়ে দেখে নিজেদের মধ্যে পেরাইভেট হাসাহাসি করতে লাগল।
হঠাৎ কলেজের সামনের রাস্তায় একটা ট্রাক এসে থামল। একটি লোক তার থেকে লাফিয়ে নেমে দ্রুত পায়ে কলেজের দিকে এগোতে লাগল। তার পরণে পরিষ্কার ধুতি-পাঞ্জাবী-টুপি আর হাতে একটা ছড়ি। ট্রাককে থামতে দেখেই ছেলের পাল এদিক ওদিক থেকে দৌড়ে দৌড়ে পাকলেজের সামনে পুলিয়ার দিকে দলবেঁধে আসতে লাগল। বলরাম সিং ভদ্রলোককে বাধা দিয়ে বললেন-- আপনার চরণ স্পর্শ করি পণ্ডিত!
লোকটি বিড়বিড় করে কোন আশীর্বচন বলে সিধে কলেজের গেটের দিকে এগোতে লাগলেন। বলরাম সিং বললেন—“পণ্ডিত, একটু ধীরে। কেউ তোমাকে তাড়া করছে না”।
লোকটি থতমত খেয়ে হাসল। বললেন—মিটিং শুরু হয়ে গেছে না?
বলরাম সিং উঠে দাঁড়ালেন। মাপা পায়ে পণ্ডিতের কাছে এলেন। ছেলের দল এগিয়ে আসছে, প্রায় ঘিরে ফেলছে। উনি ধমকে উঠলেন—“ ভেগে পড় ছেলের দল। একটু দূরে গিয়ে খেলাধূলো কর”। তারপর পণ্ডিতের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন-“পণ্ডিত, মিটিংয়ে তোমার হাজিরি লেগে গেছে। এবার ফিরে যাও”।
পণ্ডিত কিছু বলতে চাইল। কিন্তু উনি এবার পণ্ডিতের গায়ে গা লাগিয়ে বললেন—“কিছু ভেবেই বলছি। ফিরে যাও”।
পণ্ডিতের মনে হল জঙ্ঘার কাছে কিছু শক্ত জিনিস ধাক্কা দিচ্ছে। উনি বলরাম সিংয়ের পাঞ্জাবীর পকেটের দিকে তাকালেন এবং হড়বড়িয়ে দু’পা পেছনে হটে গেলেন।
ওনাকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বলরাম সিং ফের বললেন—“পণ্ডিত, চরণ-বন্দনা”!
লোকটি চুপচাপ ফিরে গেল। রাস্তায় কোন গাড়ি নেই, ট্রাক চলে গেছে। ও এবার কোন একদিকে দ্রুত পায়ে চলতে চলতে হঠাৎ দৌড়তে লাগল। একটা ছোকরা বলল—গেছে!
বলরাম সিং বললেন, “পণ্ডিত সমঝদার; বুঝতে পেরেছে”।
“সমঝদার তো বুঝলাম। কিন্তু অমন করে পালাবার কী হয়েছিল?” –একটি ছাত্রের প্রশ্ন।
বলরাম সিং—“এখনো চ্যাঙড়া বয়েস। একটু বড় হও তখন বুঝবে এমন সময়ে সমঝদার মানুষ এভাবেই দৌড়য়”।
একজন বিদ্যার্থী ঘোড়াকে দানাপানি দিচ্ছিল। ঘোড়া ফের চিঁহি করে উঠল। এবার বলরাম ধমকে উঠলেন—“চুপ বে চেতক”!
বয়-স্কাউট ছেলেটি ফিরে এসেছে। বলরাম ঘোড়াকে ধমকানোর সুরেই বলেন, “ কিঁউ বে, ক্যা খবর হ্যায়”?
স্কাউট গেল ঘাবড়ে। ক্লাসে ঘাবড়ে যাওয়া সাধারণ পড়ুয়ারা যেমন দাঁত বের করে তেমনি করে
হেসে বলল,” হ্যাঁ ঠাকুর সা’ব; সব ঠিকঠাক চলছে”।
“ক’জন আদমী এসেছিল”?
“সবাই বুঝে গেছে? নাকি কেউ অবুঝপনা করেছে”?
“সব্বাই বুঝে গেছে”। ছেলেটার সাহস ফিরে এল। দূরে পালাতে থাকা পণ্ডিতের দিকে ইশারা করে বলল, “ওনার মতই ধড়ফড় করে সবাই ফিরে গেল”।
ছেলেটা এবার প্রাণ খুলে হাসল। বলরাম সিং বললেন,” বেশি বুঝে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত”।
কলেজের ভেতর থেকে জয়ধ্বনি ভেসে আসছে। কেউ বলছে—‘ বোল্ সিয়াবর রামচন্দ্রকী জয়’!
জয় বলার ব্যাপারে হিন্দুস্তানিদের মোকাবিলা কে করবে? শুরু হল ‘সিয়াবর রামচন্দ্র’ থেকে, ফের ‘পবনপুত্র হনুমানের জয়’। ফের, কেউ জানেনা কেমন করে, ঝটপট মহাত্মা গান্ধীর জয়ে পৌঁছে গেল।
--“বোল্ মহাত্মা গান্ধী কী জয়”! ব্যস্ সবুজ পতাকা নাড়া হয়ে গেছে। পণ্ডিত জওয়াহরলাল নেহরু একবার ‘জয়’ পেলেন। তারপর প্রদেশের সব নেতাদের একটা করে। এক-একটা জেলার নেতাদের। এবার আসল জয়ধ্বনি—“ বোলো বৈদ্যজী মহারাজ কী জয়”!
বর্শায় বেঁধা শুওরের মত চিঁচিঁ করতে করতে প্রিন্সিপাল সাহেব বাইরে এলেন। উনিও চেঁচিয়ে উঠলেন—বোলো বৈদ্যজী মহারাজ কী!
‘জয়’ বলার জন্যে পরের প্রজন্ম গেটের সামনে হাজির ছিল।
কলেজের সামনে যেন মেলা বসেছে। প্রিন্সিপাল রঙ্গনাথকে বোঝাতে লাগলেন, “চলুন, বৈদ্যজী মহারাজ ফের সর্বসম্মতিতে ম্যানেজার নির্বাচিত হয়েছেন। এবার দেখুন কলেজ কেমন দ্রুত উন্নতি করে—ধকাধক, ধকাধক, ধকাধক! ্তুফান মেলের মত গতি”! উত্তেজনায় ওনার চেহারা ক্রমশঃ লাল হচ্ছে।
ছোটে পালোয়ান বলল, “এ প্রিন্সিপাল, বেশি ভড়ভড় করবে না তো। আমারও একটা কোথা শুনে নাও। এই যে ছোঁড়াগুলো হকির ডান্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এদের এক একটা বলও ধরিয়ে দাও। আর বলো কিছু লক্ষ্যভেদ করা শিখতে। এদের মধ্যে একটাও নেই যে বলে ডান্ডা মারতে পারে। সবকটা সাপমারার মত করে ধুলোর মধ্যে লাঠি পেটায়”।
-“অবশ্য, মেম্বার সাহেব, অবশ্য। খেলাধূলোর ব্যবস্থাও হবে। আগে এই ঝঞ্ঝাট থেকে রেহাই পাই —“।
ছোটে, “রেহাই তো পেয়ে গেছ। এবার আমাকে বলতে দাও। সব কথায় ‘হ্যাঁ’ বলা তোমার একটা স্বভাব। কিন্তু তোমার লাঙল-চষা ক্ষেতে একটা মূলোও জন্মায় না। খেলাধূলোর ব্যাপারটাও তাই। তোমার ছেলেগুলো শুধু হকির ডান্ডাটা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আজকেই যদি দরকার পড়ত তো ওরা খালি হাওয়াতে ডান্ডা ঘোরাতে থাকত, ব্যস্। কারও পিঠে নিশানা করে চালালে সেটা লাগত হাঁটুতে। দরকারের সময় নিশানা ঠিক হওয়া চাই”।
পেছন থেকে বৈদ্যজীর কন্ঠস্বরঃ “খেলাধূলোরও গুরুত্ব আছে প্রিন্সিপাল সাহেব! ছোটের কথা অনুচিত নয়”।
“হেঁ হেঁ”, প্রিন্সিপাল পালোয়ানের দেহসৌষ্ঠব প্রেমিকার চোখে দেখে বললেন, “এ পালোয়ান, নাকি হাসিঠাট্টার ফুলঝুরি! এ কখনও অনুচিত কিছু বলে না”।
(চলবে)
0 comments: