0

সম্পাদকীয়

Posted in



































'বহির্বিমুখিতা' বা 'আত্মমগ্নতা' কি অসুখ? নাকি ব্যক্তিত্বের একটা ধরন? অজ্ঞতাবশে যে ধরনটি বুঝতে ভুল হয়ে যেতে পারে আমাদের। এমন ভ্রান্তি শিক্ষাক্ষেত্রে ঘটলে তাকে কোনওভাবে ছাড় দেওয়া যায় কি? অমার্জনীয় কাজ তাহলে আর কাকে বলা হবে? 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্ম শুধু তো কতিপয় খাঁচার তোতাপাখি তৈরি করা নয়! চারপাশকে চিনতে এবং আতশকাচের তলায় জরিপ করতে শেখানোই তো ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষিত করে তোলা। তাদের মূল্যবোধের বুনিয়াদি গঠন তো নির্মিত হয় শিক্ষাক্ষেত্রের আবহেই। যে মূল্যবোধ সহজেই চিহ্নিত করতে পারে একটি ব্যাধি আর স্বতন্ত্র এক ব্যক্তিত্বের মাঝবরাবর অবস্থান করা সূক্ষ, প্রায় অদৃশ্য একটি রেখাকে। তা যদি না হত, গরিষ্ঠের স্থুল বিচারে অনেক কালজয়ী প্রতিভাই হয়ে যেতেন ব্রাত্য। কারণ তাঁরা আর পাঁচজনের মত ছিলেন না। 

তবুও তাঁদের সৃষ্টির সামনে নতমস্তকে দাঁড়াতে হয় আমাদের। এটাই স্বাভাবিক। তাই অটিজম-এর দোহাই দিয়ে যখন একটি বিদ্যালয় একটি ছাত্রকে দলবদ্ধ ভ্রমণ থেকে বাদ দিতে চায়, শরীরে রক্তস্রোত দ্বিগুণ বেগে বইতে শুরু করে।

সুস্থ থাকুন। দায়বদ্ধ থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর!

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সৈকত মণ্ডল

Posted in






বাল্মীকি রামায়ণে অনেকগুলি উপেক্ষিত চরিত্রের মধ্যে শান্তা অন্যতম। কাব্যে তিনি ঠাঁই পেয়েছেন শুধু আদিকাণ্ডেই। তার পরিধি খুবই সামান্য, কিন্তু রামায়ণ কাব্যে তাকে নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। রামায়ণে তিনি ঠিক কার কন্যা সেটাই একটা রহস্য। তিনি ঋষ‍্যশৃঙ্গের পত্নী। এই ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনির সাহায্য নিয়ে রাজা দশরথ পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেন ও ফলস্বরূপ তাঁর চারটি পুত্র হয়। রামায়ণ ব্যতীত অন্যত্র কবিরা শান্তাকে কেমন ভাবে দেখেছে এই সমস্ত দিক গুলো নিয়ে এই লেখাটির বিষয়বস্তু, তবে শুরুতে বাল্মীকি রামায়ণে শান্তার জন্ম নিয়ে আলোচনা করা যাক।

বাল্মীকি রামায়ণের লিখিত রূপে সমস্ত ভারতবর্ষে যতগুলি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়, সেটিকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই বিভাজন পন্ডিতরা করেছেন লিপি ও তাদের মধ্যে সম্পর্ক অনুযায়ী। সংস্কৃত ভাষার নিজস্ব কোনো হরফ / স্ক্রিপ্ট নেই। এটি যে কোনো লিপিতে লেখা যায়। এমনকী রোমান হরফেও। দক্ষিণ ভারতের লিপি - গ্রন্থ, তেলুগু ও মালায়লমে - যে সমস্ত বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে, তাদের একাডেমিক ভাষায় বলা হয়েছে দক্ষিণ /সাউথ রিসেন্সন। সহজ ভাবে বললে দক্ষিণ ভারতের বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপি। দক্ষিণের পাণ্ডুলিপির মধ্যে পাঠান্তর থাকলেও মোটামুটি ভাবে টেক্সটগুলির মধ্যে তেমন বিশেষ ফারাক নেই। তার উপর দক্ষিণের পন্ডিতদের (ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের) মধ্যে একটা সুদীর্ঘ্য কাল ধরে রামায়ণের উপর টীকা লেখার চল ছিল। মধ্যযুগের পন্ডিত গোবিন্দরাজ ও তিলকদের টীকা ও টেক্সট কালের প্রবাহে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর মধ্যে তিলকের টেক্সট (যার মধ্যে বাল্মীকি রামায়ণের টেক্সট ও তিলকের নিজের টীকা আছে) প্রচলিত টেক্সট / ভালগেট টেক্সট হিসেবে পরবর্তী কালে মান্যতা পায়। তেমনি ভাবে উত্তর ভারতের পাণ্ডুলিপি রয়েছে বাংলা, মৈথিলি, কাশ্মীর, ওড়িয়া, ও নেপালি লিপিতে। এরা হলো নর্থ রিসেন্সন। এই নর্থ রিসেন্সন আবার দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটি গৌড়-বঙ্গ থেকে নেপালের ধারা নিয়ে বয়ে চলেছে, অর্থাৎ ভারতের নর্থ-ইস্ট রিসেন্সন, অন্যটি কাশ্মীর থেকে পাকিস্তান (বিভাজনের আগে) হয়ে, অর্থাৎ নর্থ-ওয়েস্ট একটা আলাদা ঘরানায় গড়ে উঠেছে। দেবনাগরী লিপি নর্থ ও সাউথ দুটোতেই পাওয়া যায়। নর্থ ও সাউথের টেক্সট মোটামুটি ভাবে একই থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে কাহিনী স্তরে ও শ্লোক গঠনে তফাৎ পরিলক্ষিত হয়। ঠিকই এমনই একটি আকর্ষক অংশ হলো শান্তার জন্ম রহস্য।

প্রচলিত টেক্সটে (অষ্টম সর্গ থেকে) আমরা জানতে পারি রাজা দশরথ অপুত্রক। তিনি পুত্রলাভের আশায় সুমন্ত্র (প্রধান মন্ত্রী) ও বিভিন্ন পন্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করছেন একটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করার। সরযূ নদীর উত্তরতীরে যজ্ঞানুষ্ঠানের উপযুক্ত ভূমি নির্মাণ করে, একটি অশ্বকে ভ্রমণের জন্য ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। তারপর সুমন্ত্র রাজাকে গোপনে একটি কাহিনী বলেন। তিনি ঋষিগণকর্তৃক কথিত একটি শ্রুতি-কাহিনী শুনেছিলেন বহু পূর্বে -- ব্রহ্মার পুত্র সনৎকুমার ঋষিদের জানিয়েছিলেন কীভাবে রাজা দশরথ পুত্রলাভ করতে পারবেন। গল্পটি এরকম: কাশ্যপ মুনির একটি পুত্র আছেন, যিনি বিভান্ডক নামে প্রসিদ্ধ। তার পুত্র হলো ঋষ‍্যশৃঙ্গ যার ব্রহ্মচর্য্যের গুন সংসারে প্রসিদ্ধিলাভ করেছিল। সমসাময়িক অঙ্গদেশে রোমপাদ নামে এক মহাপ্রতাপশালী রাজা রাজ্যপালন করতেন। তার দুরাচরণের জন্য অঙ্গরাজ্যে দারুন অনাবৃষ্টি হয়। এর থেকে মুক্তির পথ একটাই বেরিয়ে আসে, সেটি হলো ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনিকে যেভাবেই হোক অঙ্গরাজ্যে নিয়ে আসতে হবে, এবং তার সঙ্গে রাজার কন্যা শান্তাকে বিধিপূর্বক সম্প্রদান করতে হবে - "প্রযচ্ছ কন্যাং শান্তাং বৈ বিধিনা সুসমাহিত (১/৯/১৩)"।

এই প্রথম আমরা জানতে পারলাম শান্তার কথা। উনি রাজা রোমপাদের কন্যা। তারপর ছলের দ্বারা (বার্বনিতা দের সাহায্যে) ঋষ‍্যশৃঙ্গকে রাজ্যে আনা হলো, এবং তিনি নগরে পা দেওয়া মাত্রই বৃষ্টি আরম্ভ হলো। ঋষিকে এভাবে ছলনাপূর্বক আনয়ন করার ফলে তার অন্তরে যেন ক্রোধের উদয় না হয়, তাই বিধি অনুসারে শান্তাকে শুদ্ধমনে সমর্পণ করে রাজা আনন্দ লাভ করলেন। সুমন্ত্র দশরথকে বলেন ঐ "জামাতা" ঋষ‍্যশৃঙ্গ আপনার পুত্রপ্রাপ্তিসম্পাদন করতে পারবেন (১/৯/১৯)। এটাকে দুটিভাবে ব্যখ্যা করা যায়। রোমপাদের মেয়ে-জামাই যেন দশরথেরও মেয়ে-জামাই তুল্য। সনৎকুমার এটাও বলেছিলেন যে ইক্ষ্বাকু বংশে দশরথ নামে একজন সত্যনিষ্ঠ রাজা জন্মাবেন, দশরথ নামে, এবং অঙ্গরাজ্যের রাজা রোমপাদের সঙ্গে তার মিত্রতা হবে। তাই মিত্রের কন্যা-জামাইকে নিজের মেয়ে-জামাই ভাবতে দোষ কোথায়? দ্বর্থক অর্থে তেমনি এটাও হতে পারে, শান্তা হয়তো রাজা দশরথের কন্যা। উনি রোমপাদকে তার কন্যা দান করেছিলেন।

সনৎকুমারের কথা অনুযায়ী দশরথ রোমপাদের কাছে গিয়ে বলবেন - "আমি নিঃসন্তান। আপনার জামাতা, শান্তার স্বামী, ঋষ‍্যশৃঙ্গকে আপনার আদেশমত যজ্ঞ করতে বলুন। সেটা হলে আমার বংশরক্ষা হয় (১/১১/৪-৫)"। ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনি আসবেন, যজ্ঞ করবেন ও রাজার চারটি পুত্র হবে। এই শুনে রাজা দশরথ তার তিন স্ত্রী ও অন্তঃপুরস্থিত মহিলাগণদের সঙ্গে নিয়ে অঙ্গদেশে উপস্থিত হলেন। ওখানে সাত-আটদিন কাটানোর পর, একদিন দশরথ তার মিত্রকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললেন - "আপনার কন্যা শান্তা পতিসহ মদীয় নগরী অযোধ্যায় গমন করুন - শান্তা তব সুতা রাজন্! সহ ভর্ত্রা বিশাংপতে (১/১১/১৯)"। রোমপাদ অনেক ভাবনা চিন্তা করে ঋষ‍্যশৃঙ্গকে বললেন - "তাই হোক, তুমি পত্নীর সহিত গমন করো।"

রামায়ণের একজন বিখ্যাত স্কলার ও অনুবাদক রালফ গ্রিফিথের এই অংশটির অনুবাদ পড়লে মনে হয় শান্তা যেন দশরথের নিজ কন্যা।

“This king,” he said, “from days of old
A well beloved friend I hold.
To me this pearl of dames he gave
From childless woe mine age to save,
The daughter whom he loved so much,
Moved by compassion's gentle touch.
In him thy Śántás father see:
As I am even so is he."

(Canto X)

শান্তা ও ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনি দীর্ঘ্য সময় অযোধ্যায় কাটিয়েছিলেন। ঋষ‍্যশৃঙ্গর তত্ত্বাবধানে অশ্বমেধ ও পুত্রেষ্টি যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। এবং তাদের দুজনই বিশেষভাবে পূজিত হয়ে আবার অঙ্গদেশে ফিরে যায়। তাহলে লক্ষ করলে দেখা যাবে প্রচলিত টেক্সটে দু-একটি জায়গায় হাল্কা ইঙ্গিত থাকলেও কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই শান্তা দশরথের মেয়ে। এমনকী তিনি রোমপাদকে তার কন্যা দান করেছেন একথা কোথাও উল্লেখ নেই।

এবার নর্থ রিসেন্সন দেখা যাক। এখানকার পাণ্ডুলিপিতে অঙ্গদেশের রাজার নাম রোমপাদ নয়, বরং লোমপাদ - "এতস্মিন্নেব কালে তু লোমপাদঃ প্রতাপবান্ (১/৮/১১)"। দশম সর্গতে সুমন্ত্র জানায় তিনি সনৎকুমারের শ্রুতিকথনে জেনেছিলেন অঙ্গরাজ লোমপাদের সঙ্গে রাজা দশরথের মিত্রতা হবে। রাজা দশরথের শান্তা নামে সৌভাগ্য-শালিনী একটি কন্যা জন্মলাভ করবে।

ইক্ষাকুবংশজো রাজা ভবিষ্যতি মহাযশাঃ।
নাম্না দশরথো নাম ধীমান্ সত্যপরাক্রমঃ॥২॥
সখ্যং তস্যাঙ্গরাজেন ভবিষ্যতি মহাত্মনঃ।
কন্যা চাস্য মহাভাগা শান্তা নাম ভবিষ্যতি ॥৩॥

অঙ্গরাজের কোনো সন্তান হবে না। তিনি রাজা দশরথের নিকট প্রার্থনা করবেন - "সখা, আমি নিঃসন্তান। তুমি প্রসন্ন মনে তোমার এই শান্তা নাম্নী অসামান্য-রূপ-লাবন্যবতী তনয়া আমাকে প্রদান কর - আমি "পুত্রিকা" করব। করুনহৃদয়ের রাজা তার হৃদয়-নন্দিনীকে প্রদান করবেন (১/১০/৫-৮)"।

দশরথ ও ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনির সামনে, লোমপাদ আরো বলেন - "ঋষিকুমার! এই রাজা দশরথ আমার পরম-প্রিয় সখা। আমার সন্তান না হওয়াতে আমি "পুত্রিকা করবার নিমিত্ত" ইঁহার আত্মজা বরবর্ণিনী শান্তাকে যাচঞা করেছিলাম। ইনিও তৎক্ষণাৎ অক্ষুব্ধ-হৃদয়ে এই প্রিয়তমা কন্যা আমায় প্রদান করেছিলেন। আমার ন্যায় এই দশরথও সম্পর্কে আপনার শ্বশুর হন। আপনি শান্তাকে নিয়ে অযোধ্যায় গমন করুন (১/১০/২৫-২৯)"।

তাহলে নর্থ রিসেন্সন (সমগ্র উত্তর ভারতের বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপিতে) রামায়ণে পরিষ্কার উল্লেখ পাই শান্তা দশরথেরই কন্যা। রামায়ণের শুদ্ধ সংস্করণ (ক্রিটিক্যাল এডিশন) এক্ষেত্রে দক্ষিণের পাঠ রেখে দিয়েছে। ক্রিটিক্যাল এডিশন রামায়ণের টেক্সট গঠনের মেথড একটু ভিন্ন ক্রিটিক্যাল এডিশন মহাভারতের টেক্সট গঠনের থেকে। মহাভারতে যেমন শারদা (কাশ্মীর) ও মালায়লম লিপিকে একটা একটা base ধরে বাকি পাণ্ডুলিপির প্রক্ষেপ ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছে (এটা খুবই সরল ভাবে বলা হলো, আসল প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল), রামায়ণের ক্ষেত্রে সেরকম নয়। এখানে দক্ষিণের টেক্সটের ৭৫% রাখা হয়েছে এবং সেই অংশগুলো দক্ষিণের টেক্সট থেকে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে যেগুলো উত্তর ভারতে সাক্ষ্য দেয় না। কিন্তু উত্তর ভারতে যদি কোনো অংশ এক্সট্রা থাকে যেটা আবার দক্ষিণে সাক্ষ্য দেয় না, সেক্ষেত্রে তারা সেটিকে বাদ দিয়েছে, তাদের মেথড এটাকে প্রক্ষেপ বলে মনে করে।

এখানে সমস্যাটি আরো গভীর। তার কারণ বহু রামায়ণ গবেষকদের মতে আদিকান্ডের বেশ অনেক অংশ পরের সংযোজন। জন ব্রকিংটন Rama the Steadfast: The Early Form of Ramayana তে লিখছেন গোটা আদিকান্ড টাই পরে যোগ হয়েছে। ওঁর মতে রামায়ণের একদম প্রাথমিক স্টেজে মূল কবির হাতে আদিকান্ড রচনা হতে পারে না, এবং এই ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত বলা যায় না। হার্মান জেকবি, কামিল বুলকে, রবার্ট গোল্ডম্যান, চিন্তামনি বৈদ্য, ক্রিটিক্যাল এডিশনের প্রত্যেকটি এডিটর ও আরো অনেক পন্ডিতরাই মনে করেন আদিকান্ডের মধ্যেও অনেক স্তর আছে যেগুলির সময়কাল ইতিহাসের মেথড দিয়ে বের করা সম্ভব। ব্রকিংটনের মতো পুরোটাই পরে রচিত হয়েছে না বলে, বেশিরভাগ পন্ডিত এটাই বলেন শুরুতে আদিকান্ডের খুব অল্প অংশ মূল কাব্যের অন্তর্গত ছিল।

জেকবি তার বিখ্যাত বই Das Ramayana তে লিখছেন রামের জন্ম ও গোটা ঋষ‍্যশৃঙ্গ অধ্যায়টাই পরের সংযোজন। উনি মনে করেন কাব্যের নায়কের জন্মের একটা সংক্ষিপ্ত কাহিনী হয়তো একটি ছিল, কেমন আকারে জানা নেই, কিন্তু সেটা কোনো অজ্ঞাত কারণে হারিয়ে গেছে। সেটাকে পূরণ করতে এরকম একটি কাহিনীর অবতারণা করতে হয়েছে যেখানে বিষ্ণু নিজে অবতার রূপ ধারণ করে দসরথের পুত্র হয়ে জন্মাবেন। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে রাম শুরুতে বিষ্ণুর অবতার ছিলেন না, এটির ধারণা টেক্সটে ঢুকছেন অনেক পরে, যখন বিষ্ণু-কাল্ট ভারতে পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ক্রিস্টপূর্ব ৭০০-৬০০ তে এই কাব্যের গোড়ার স্টেজে (গোল্ডম্যান বালকাণ্ডের ভূমিকা) লেটার-বৈদিক পটভূমিকায় বিষ্ণু অবতার রূপে কখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন না। ফলে রামের জন্মের পুরো অধ্যায়টাই হয়তো পরে রচিত হয়েছে, এমনটা অনেকেই মনে করেন। সেক্ষেত্রে, শান্তার কাহিনীও পরে যোগ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তবে এটা বলাটা খুবই মুস্কিল নর্থ রিসেন্সনে বর্ণিত অংশগুলি সম্পূর্ণরূপে প্রক্ষেপ কিনা। এটা বলা যায় না কারণ কোনো রাজা নিজের কন্যা অন্য মিত্র রাজাকে দান করেছেন, এরকম উদাহরণ আমরা মহাভারতেও দেখেছি, কুন্তীর ক্ষেত্রে। তেমনি রোমপাদ / লোমপাদ যদি পুত্রিকা হিসেবে কন্যাকে গ্রহণ করেন, সেক্ষত্রে ব্যাপারটি খুবই ইন্টারেস্টিং হয়ে যায়। একটু বিশদে আলোচনা করা যাক।

মহাভারতে রামকথার একটি অংশ পাওয়া যায় বনপর্বে। ওটি ছাড়াও সমগ্র মহাভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক উপাদান আছে যেগুলিকে রামায়ণের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। তীর্থযাত্রা পর্বে (৩/১১০) আমরা জানতে পারি অঙ্গদেশের রাজার নাম লোমপাদ। মূল কাহিনীটি মোটামুটি রামায়ণের সঙ্গে এক, শুধু এখানে ঋষ‍্যশৃঙ্গকে ছলনা করে এনে মেয়েদের কক্ষে রাখা হয়েছিল। বিভান্ডক ঋষি তার পুত্রকে না খুঁজে পেয়ে রেগে আগুন হয়ে যায় এবং বুঝতে পারে তার পুত্রকে অঙ্গরাজ নিয়ে গেছে। কিন্তু পরে তার মন গলে যায়। রাজাকে বলে শান্তার গর্ভে সন্তান আসার পর ঋষ‍্যশৃঙ্গ যেন বনে ফিরে আসে। বাধ্য সন্তানের মত ঋষ‍্যশৃঙ্গ বনে ফিরে যেতে চাইলে শান্তাও তার সঙ্গে পতিব্রতা নারীর মত সঙ্গ দিতে চায়। সেক্ষেত্রে শান্তার সন্তান অঙ্গরাজ্যেই রয়ে যায় (অনুমান করা যায়), এবং ঋষ‍্যশৃঙ্গ-র পরের সন্তান (অনুমান করা যায়) শ্বশুরের বংশের দ্বীপ হয়ে জন্মলাভ করার কথা। পুত্রিকা হলো সেই কন্যা যার সন্তান তার মায়ের বংশের উত্তরাধিকারী হবে। অনেক ক্ষেত্রে সেই নারী ক্ষতিকারক হতে পারে যে বংশে তার বিয়ে হচ্ছে তাদের কাছে। মহাভারতে এই উদাহরণ প্রচুর আছে - চিত্রাঙ্গদা, সাবিত্রী, ইত্যাদি। যেমন চিত্রাঙ্গদা ছিলেন পুত্রিকা। অর্জুন তাকে বিয়ে করতে চাইলে চিত্রাঙ্গদার বাবা বলেন তার একমাত্র কন্যার পুত্র-ই এই বংশের রাজা হবে। অর্জুন সেটি জানা সত্ত্বেও তাকে বিবাহ করে। তাদের পুত্র হয় বভ্রুবাহন। এই বভ্রুবাহন কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি। কিন্তু পরে বাবা আর ছেলের মধ্যে যুদ্ধ হয় (অনেকটা পারস্য কাব্যের শাহনামের সোহরাব ও রোস্তমের কাহিনীর মত) এবং সেখানে অর্জুন মারা যায়। আবার সে অলৌকিক ভাবে উলুপির (তার অন্য একটি পত্নী) কৃপায় বেঁচে হস্তিনাপুরে ফিরে আসে। সেখানে তার বিধবা পুত্রবধূ পরীক্ষিত নামে একটা সন্তানের জন্ম দেয় ও যুধিষ্ঠিরের পরে সেই বংশের রাজা হয়। কিন্তু যেসব ব্যক্তির অর্জুনের মত একাধিক পত্নী নেই এবং একটি মাত্র স্ত্রী-ই যদি পুত্রিকা হয়? তাই শান্তার বিষয়টি খুবই আকর্ষক। এটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার যে শান্তা তার স্বামীর সঙ্গে বনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রামায়ণে এরকম কোন ইঙ্গিত নেই। তেমনি মহাভারতের রামোপাখ্যান অংশে পুত্রেষ্টি যজ্ঞেরও উল্লেখ নেই।

তাহলে কী দাঁড়ালো?

রামায়ণের ভিন্ন রিসেন্সনে শান্তার জন্ম নিয়ে পাঠ্ভেদ আছে। প্রচলিত টেক্সট শুধু এটুকুই বলে দশরথ ও রোমপাদ ছিলেন ভালো বন্ধু, এবং শান্তা রোমপাদের কন্যা (১/৯/১৩ ও ১/১১/১৯)। যখন শান্তা অযোধ্যায় আসে ওর স্বামীর সাথে টেক্সট কিন্তু বলেনি যে সে তার বাপের বাড়ি ফিরে আসছে, বা শান্তার দিক থেকেও কোনো প্রতিক্রিয়া কবি জানায়নি, যেটা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। তেমনি টেক্সট এটাও বলে দশরথ অনপত্য (১/১১/৫) অর্থাৎ নিঃসন্তান ছিলেন। এমনকী নর্থ রিসেন্সনে শান্তাকে লোমপাদের কন্যাও বলা হয়েছে (গৌড়ীয় ১/৮/২৬; লাহোর এডিশন ১/৮/২৫)। মহাভারতে শান্তা লোমপাদেরই কন্যা এবং কবি জানাচ্ছেন না যে দশরথ তাঁর পুত্রীকে দান করেছিলেন (৩/১১০/৫; ১২/২২৬/৩৫ ও ১৩/১৩৭/২৫)। তেমনি হরিবংশ পুরাণ (১/৩১/৪৬), মৎস্য পুরাণ (৪৮/৯৫), বায়ু পুরাণ (১১/১০৩) এগুলিতে শান্তাকে লোমপাদের মেয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে দক্ষিণী পাঠের মধ্যেই সুমন্ত্রের কথায় আমরা ইঙ্গিত পাই (১/৯/১৯) যে শান্তা হয়তো দশরথের কন্যা ছিলেন। তেমনি (১/১১/২-৩) শ্লোক গুলি খুবই ইনটারেস্টিং।

ইক্ষাকূণাং কুলে জাতো ভবিষ্যতি সুধার্মিক:৷
রাজা দশরথো নাম্না শ্রীমান্সত্যপ্রতিশ্রব: II
অঙ্গরাজেন সখ্যং চ তস্য রাজ্ঞো ভবিষ্যতি৷
কন্যা চাস্য মহাভাগা শান্তা নাম ভবিষ্যতি ৷৷

ক্রিটিক্যাল এডিশন টেক্সট "অস্য" রেখেছে যেটা অঙ্গরাজকে ইঙ্গিত করে, কিন্তু দক্ষিণের প্রচুর পাণ্ডুলিপিতে এটি আছে "তস্য"। উত্তর ভারতের লিপিগুলোতে তো আছেই (ক্রিটিক্যাল এডিশন ফুটনোট - ১/১০/৩) তস্য, যেটা পরিষ্কার ইঙ্গিত করে শান্তা দশরথের কন্যা। নর্থ রিসেন্সনে ঠিক এই শ্লোকের পরে আমরা জানতে পারি কোন পরিস্থিতিতে রাজা দশরথ শান্তাকে দান করেছিলেন (পূর্বেই লিখেছি - ১/৯/৪-৫)।

এই সমস্যার মূল উৎপত্তি হয়তো অন্যত্র। হরিবংশ, মৎস, বায়ু ও ব্রহ্ম পুরাণে অঙ্গরাজার নাম চিত্ররথ। তার পুত্রের দুটি নাম - লোমপাদ ও দশরথ। এমনটি হয়তো হয়েছিল শান্তা প্রথমে অঙ্গের রাজা দশরথের কন্যা ছিল, কিন্তু ততদিনে অজের পুত্র দশরথ খুবই জনপ্রিয় রাজা হয়ে উঠেছেন। এবং তার পর থেকে শান্তা দশরথের কন্যা বলেই পরিচিতি লাভ করেছে। তেমনি বিষ্ণু পুরাণ (৪/১৪/১৪), ভাগবত পুরাণ (৯/২৩/৮), ভবভূতির উত্তররামচরিত, স্কন্দ পুরাণ, পদ্ম পুরাণের পাতালকান্ড, আনন্দ রামায়ণ (১/১/১৬-১৭), সরলা দাসের ওড়িয়া মহাভারতে শান্তা দশরথের কন্যা। ১৬-শতাব্দী বলরাম দাসের রামায়ণে আমরা প্রথম জানতে পারি শান্তা হলো কৌশল্যার মেয়ে। কৃত্তিবাস রামায়ণে (১/২৯) দশরথ তার কন্যাকে দান করেন লোমপাদকে। মেয়েটির নাম হেমলতা। অনুমান করতে অসুবিধা হয়না ইনিই শান্তা। চন্দ্রাবতীর রামায়ণে ও কাশ্মীরি রামায়ণে আমরা পাই কৈকেয়ীর একটি কন্যার কথা যে সীতাকে সহ্য করতে পারতো না। একই থিম আমরা পাই সুবর্চ রামায়ণে যেখানে সীতা শান্তাকে অভিশাপ দেয়। ইন্দোনেশিয়ার "হিকায়েত সেরি রাম" এ শান্তা হলো ভরত-শত্রুঘ্নর নিজের বোন। সিয়াম এর রাম-জাতকে শান্তার বিয়ে হয় রাবণের সঙ্গে। তেমনি প্রাচীন পালি টেক্সট দশরথ জাতকে সীতা রাজা দশরথের মেয়ে। ফলে দশরথের কন্যা ছিল এটা এনটিকুইটি সাক্ষ্য দেয় -- বাল্মীকি ও অন্যান্য রামকথায় আমরা পাই। তবে সব থেকে বিচিত্র কাহিনী পাওয়া যায় মাধবদাসের বিচিত্র রামায়ণে। ওখানে এক ঋষি রাজাকে অভিশাপ দেন ও বলেন সে নিঃসন্তান হবে। পরে আবার দেখা হলে ও রাজা ক্ষমা চাইলে, ঋষি অভিশাপ পাল্টে ফেলে বলেন তার প্রথম সন্তান একটি কন্যা হবে এবং তার বিয়ে হবে ঋষ‍্যশৃঙ্গের সঙ্গে। তারপর ঋষ‍্যশৃঙ্গ যজ্ঞ করলে তার চারটি সন্তান হবে। তারপর শান্তার বিবাহের বয়স উপস্থিত হয়ে স্বয়ম্বর আয়োজন করা হয়। সেখানে হঠাৎ উপস্থিত হন পরশুরাম। তিনিই বলেন শান্তার সঙ্গে ঋষ‍্যশৃঙ্গের বিবাহ দেওয়া হোক।


পাঠ্যসূচী

কৃতজ্ঞতা স্বীকার - যে দুজন ব্যক্তি আমাকে উপকার করেছেন এটি লিখতে, রবার্ট গোল্ডম্যান ও কনাদ সিংহ।

১) আকর সূত্র

পঞ্চানন তর্করত্ন - রামায়ণম
আর্য্যশাস্ত্র - বাল্মীকি রামায়ণ
রামায়ণ সারানুবাদ - রাজশেখর বসু
বাল্মীকি রামায়ণ ক্রিটিক্যাল এডিশন - Vol 1
রবার্ট গোল্ডম্যান - The Ramayana of Valmiki vol 1
ভগবৎ দত্ত - The Ramayana of Valmiki (North West Recension)
অমরেশ্বর ঠাকুর - বাল্মীকি রামায়ণম
এম এন দত্ত - দি মহাভারত (vol 2)
বিষ্ণু সুকথঙ্কর - ক্রিটিক্যাল এডিশন মহাভারত (আরণ্যক পর্ব)
জন স্মিথ - দি মহাভারত
রালফ গ্রিফিথ - The Ramayana of Valmiki
এম এন দত্ত - হরিবংশ
সাইমন ব্রডব্রেক - Krishna's lineage: The Harivamsa of Vyasa's Mahabharata
শান্তি লাল নগর - আনন্দ রামায়ণ

২) রামায়ণের টেক্সট গঠন

জন ব্রকিংটন - Rama the Steadfast: The Early form of Ramayana
হার্মান জেকবি - Das Ramayana
এল এ ভ্যান ডালেন - Valmiki's Sanskrit
রবার্ট গোল্ডম্যান - Vol 1 ভূমিকা
জি এস আলটেকর - Studies on Valmiki Ramayana

৩) পুত্রিকা

কনাদ সিংহ - From Dasrajana to Kurukshetra
সাইমন ব্রডবেক - Putrika interpretation of the Mahabharata
সাইমন ব্রডবেক - The Mahabharata Patriline

৪) ভিন্ন রামকথা

ভি রাঘবন - The Ramayana tradition in Asia
ভি রাঘবন - The Greater Ramayana (পুরাণ নিয়ে আলোচনা)
শ্রীনিবাস আইয়েঙ্গার - Asian variations in Ramayana
কামিল বুলকে - অনুবাদ প্রদীপ ভট্টাচার্য: The Rama Story - Origins and Growth
অভদেশ কুমার সিংহ - Ramayana through the ages

0 comments:

0

প্রবন্ধ - পিয়ালী বসু

Posted in





















“The end is in the beginning and yet you go on.” ― Samuel Beckett, Endgame .

১৯০৬ সালের ১৩ এপ্রিল। আয়ারল্যান্ডের রাজধানী 'ডাবলিন ' শহরে জন্মগ্রহণ করেন অনন্য এক নাট্যকার ... স্যামুয়েল বার্কলে বেকেট ( Samuel Barclay Beckett ) ... বিংশ শতকের সাহিত্যিকদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসেবে তাঁর নাম আজও অমর।
.
বেকেটের বাবা উইলিয়াম ফ্রাঙ্ক বেকেট ছিলেন একজন স্বখ্যাত মানুষ । বাবা'র প্রভাব বেকেটের জীবন এবং সৃষ্টিতে বেশ স্পষ্টমান ।
.
১৯২৩ -১৯২৭ সাল ...এই পাঁচ বছরে বেকেট তাঁর শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ট্রিনিটি কলেজ থেকে । স্বাভাবিক ভাবেই বেকেটের প্রতিটি সৃষ্টিতে শিক্ষার এই আলোক গভীরতা বিশেষভাবে দৃশ্যমান |
.
১৯২৯ সালে প্রকাশের আলো দেখে তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা ... ' দান্তে...ব্রুনো...ভয়েজ জেমস জয়েস'... , অগ্রজ লেখক জেমস জয়েসের লেখার দুর্বধ্যতা নিয়ে সে সময়ে সমালোচনায় তোলপাড় সাহিত্য মহল , বেকেটের উদ্দেশ্য ছিল , জয়েসকে সহজবোধ্য করে আপামর সমালোচকদের সামনে হাজির করা ... এবং সে প্রয়াসে সার্থক ছিলেন তিনি ।
.
১৯৩৮ সাল । প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস 'মুরফি ' । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ন্যাৎসিদের চূড়ান্ত বর্বরতা এবং অমানুষীকতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেকেট যোগ দেন ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীতে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মমতা, অনৈতিকতা, এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সুস্পষ্ট চিত্র ফুটিয়ে তোলেন বেকেট তাঁর উপন্যাসে ।
.
বেকেটের শ্রেষ্ঠ নাট্যকর্ম 'ওয়েটিং ফর গডো' প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে ... ১৯৫৩ সালে প্যারিসের থিয়েটার ডে ব্যাবিলনে মঞ্চস্থ হয় 'ওয়েটিং ফর গডো । প্যারিসের নাট্যপ্রেমীদের জন্য নাটকটির ফরাসি নাম রাখা হয় 'এন অ্যাটেনডেন্ট গডো'... অর্থাৎ গডো 'র জন্য প্রতীক্ষা । বেকেটের অন্যতম প্রিয় বন্ধু জেমস নেলসনের কথায় ... নাটকটির শো ছিল হাউসফুল ! প্রিয় বন্ধুর রচিত নাটকটির বিখ্যাত হবার অন্যতম কারণ হিসেবে নেলসন জানান , ... নাটকটি'র ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করেছেন ভিন্ন ভিন্ন নাট্যপ্রেমী মানুষ , আর এই কারণেই বিশেষ কোন কালের গণ্ডীতে আবদ্ধ না থেকে দর্শকদের কাছে এ নাটক হয়ে উঠেছে কালোত্তীর্ণ ,সর্বজনীন ।
.
১৯৫৪ সালে নিউইয়র্কে প্রকাশিত হয়'ওয়েটিং ফর গডো'র ইংরেজি অনুবাদ, ... তারপর থেকে সম্ভবত ২৩টিরও বেশী দেশে মঞ্চস্থ হয়েছে এ নাটক এবং ৩২-৩৩ টি ভাষায় অনূদিতও হয়েছে । এই কাল্ক্রমিক ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে 'ওয়েটিং ফর গডো'র অনন্যতা ।
.
১৯৫৫ সালে লন্ডনের আর্ট থিয়েটারে চব্বিশ বছরের তরুণ পরিচালক পিটার হল'এর পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় ওয়েটিং ফর গডো' । নাট্য সমালোচক কিনিথ টাইনান এক প্রেসমিটে জানান --- " Waiting for Godot frankly jettisons everything by which we recognise theatre. It arrives at the custom house, as it were, with no luggage, no passport and nothing to declare: yet it gets through as might a pilgrim from Mars. It does this, I believe, by appealing to a definition of drama much more fundamental than any in the books. A play, it asserts and proves, is basically a means of spending two hours in the dark without being bored. " (August 7, 1955)
.
রূপকাশ্রয়ী এবং প্রতীকী এই নাটকটিতে bleak themes এর সার্থক প্রয়োগ করেন বেকেট|

দুটি অ্যাক্টে পরিবেশিত এ নাটকটিকে 'ট্র্যাজিক কমেডি' হিসেবেও চিহ্নিত করা হয় । ESTRAGON এবং VLADIMIR এর চরিত্র দুটি আসলে সমকালীন বিধ্বস্ত মানুষের দুঃখের প্রতীক হিসেবেই খ্যাত । নাটকের শুরুতে দেখা যায়, ভবঘুরে ছন্নছাড়া দুই লোক ভলাডিমির ও এস্ট্রাগন তেমনি এক ছন্নছাড়া ধূসর এক প্রান্তরে কোন এক মি. গডোর জন্য অপেক্ষা করছে। নাটকের শেষেও তারা প্রতীক্ষাই করে; কিন্তু মনে হয় যেন তারা অনন্তকাল ধরে প্রতীক্ষা করছে... অর্থহীন এই প্রতীক্ষা, কারণ গডো আসেন না , কোনদিন আসবেন সে নিশ্চয়তাও নেই , তবু মুক্তি নেই তাদের... প্রকারান্তরে আমাদের । যাবতীয় ধর্মবিশ্বাসের বিসর্জনে, মানুষের বিপর্যস্ত অবস্থায় একটি সামগ্রিক শূন্যতার মধ্যে এই নাটক আসলে মানব সত্তাকে তার চূড়ান্ত বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে চায়... দেখিয়ে দিতে চায় ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত সবকিছুই অবলুপ্ত ... আঁকড়ে ধরার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই ।
.
১৯১৩ সালে 'ওয়েটিং ফর গডো'র ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান আবারও মনে করিয়ে দেয় , কাল্পনিক চরিত্র নয় , এ নাটক আসলে কালজয়ী চরিত্র সৃষ্টিতে চূড়ান্ত ভাবে সার্থক ।
.
আয়ারল্যান্ডের গলওয়ে'র Druid থিয়েটারে Garry Hynes এর পরিচালনায় সম্প্রতি মঞ্চস্থ হয় 'ওয়েটিং ফর গডো'। Druid থিয়েটারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ব্রশিওরে জানানো হয় -- " On a bare road in the middle of nowhere, two world-weary friends await the arrival of the mysterious Godot. While waiting, they speculate, bicker, joke and ponder life’s greater questions. As dusk begins to fall, two figures appear on the horizon "
.
অ্যাবসার্ড নাটক হিসেবে আজও উজ্জ্বল ভাবে উল্লেখ্য ওয়েটিং ফর গডো'র নাম । গোটা নাটক জুড়ে শুধুমাত্র কিছু ঘটেনা... নেই কোন সংঘাত অথবা দ্বন্দ্ব ...প্রধান দুই Protagonist চরিত্র শুধু একটি কাজই করে আর তা হলো অপেক্ষা। তারা অপেক্ষা করে গডো’র জন্য , তারা বিশ্বাস করে গডো এলে তাদের সব সমস্যার সমাধান হবে, তারা মুক্তি পাবে এই প্রাত্যহিক অভিশপ্ত জীবন থেকে। আমরা যে কী ভীষণভাবে নিঃসঙ্গ এবং অসহায় তারই এক একটি জ্বলন্ত উদাহরণ থিয়েটার অব দ্য অ্যাবসার্ডের নাটকগুলি ,

সার্থক অ্যাবসার্ড নাটক হিসেবে আজীবন আমাদের মনের মণিকোঠায় স্বযত্নে বাস করবে 'ওয়েটিং ফর গডো' ।
.
" We are all born mad. Some remain so"' ― Samuel Beckett

মানুষ হিসেবে বেকেট ছিলেন স্পর্শকাতর, অনুভূতিপ্রবণ এবং প্রচারবিমুখ ... নিজের মধ্যেই ডুবে থাকতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি , ... অনেকে বেকেট কে দুঃখবাদী ' বলে অভিহিত করেন , দুঃখবিলাসিতা অবশ্যই তাঁর জীবন যাপনে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে তবুও বেকেট আশাবাদী মানুষ হিসেবেই চিহ্নিত ... " Ever tried. Ever failed. No matter. Try Again. Fail again. Fail better. " তাঁর এ প্রখ্যাত উক্তি প্রমাণ করে শৈল্পিকতা বিরাজ করতো তাঁর মনের অলিন্দে ।
.
" Nothing matters , but the writing . There has been nothing else worthwhile .. a stain upon the silence " ― Samuel Beckett ১৯৮৯ সালের ২২ শে ডিসেম্বর । ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নাটকে উত্তর আধুনিকতার ধারক স্যামুয়েল বার্কলে বেকেট ।

--------------------------
ছবি - (১) -- আয়ারল্যান্ডের গলওয়ে'র Druid থিয়েটারে Garry Hynes এর পরিচালনায় সম্প্রতি মঞ্চস্থ হয় 'ওয়েটিং ফর গডো'... এটি তারই পোস্টার ছবি -(২)-- স্যামুয়েল বেকেট ছবি -(৩) -- মঞ্চে 'ওয়েটিং ফর গডো


তথ্যসূত্র :
--------
Samuel Beckett : The Complete Dramatic Works . ______Faber & Faber

Wating For Godot : Analysis .

____ Mateuez Brodowicz








0 comments:

0

প্রবন্ধ - রূপশ্রী ঘোষ

Posted in






প্রেম কি শুধুমাত্রই অপর একজনের প্রতি মনের আর্তি? অপর একজনের সঙ্গে গভীর সংযোগের আবিষ্কার? না কি প্রেম এমন একধরনের মহাজাগতিক সংযোগ, যা আবিষ্কার করলে এই মহাজগতের এক ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো অস্তিত্ব হিসেবে অনুভব করা যায় নিজস্ব অবস্থানের মাহাত্ম্য। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, এই যে মাহাত্ম্য শব্দটি উচ্চারণ করলাম, তা কি নিজের অহংকে এক বিন্দু হলেও বাড়িয়ে দিল? না কি এই অনুভূতিমালা নিজেকে আরও ক্ষুদ্র এক অস্তিত্বেই পরিণত করল? এমন এক ক্ষুদ্র অস্তিত্ব, যা আসলে এক অখণ্ড অস্তিত্বের অংশ। নিজের খণ্ড অস্তিত্বকে অখণ্ড অস্তিত্বের মধ্যে প্রকাশিত হতে দেখাই মনে হয় এই জীবনের এক মহার্ঘ্য অনুভূতি। প্রেম, এই অনুভূতি দেয় আমাদের। যেমন দেয় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা, যেমন দেয় একাকী এই প্রকৃতির মধ্যে অবগাহন। কিন্তু কীভাবে? আমাদের চারপাশে শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা বা প্রেমের কবিতার সংকলন প্রচুর দেখতে পাই আমরা। অনেকের অনেক প্রেমের কবিতার সংকলন রয়েছে আবার রয়েছে কবিতার সংকলনের মধ্যে বহু প্রেমের কবিতা। সেই সব প্রেমের কবিতা কালজয়ী। কিন্তু এখানে একটা ছোট্ট অভিযাত্রা হতে আমাদের। তিনজন কবির মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ এবং বিনয় মজুমদার। তবে, আলোচনার প্রসঙ্গে যে অন্য কবিদের আমরা ছুঁয়ে যাব না, তাও নয়।

রবীন্দ্রনাথের কথাই যদি ধরি, তিনি প্রেম এবং পূজাকে একত্র করে দিয়েছিলেন। এই একই অনুভূতি আমরা বৈষ্ণব পদাবলীতে বা মীরার ভজনেও পাই, পাই সূরদাসের ভজনে বা কবীরের দোঁহায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রেম শুধুই ভগবৎ দর্শনের মধ্যে একাত্ম হওয়া নয়। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের মধ্যে যে ‘তুমি’, সেই ‘তুমি’ আমারই তো এক অখণ্ড অংশ। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর কবিতায় বা গানে এই তুমির মধ্যে সমগ্রের এক বিস্তার ঘটান, তখন সেই ‘তোমার’ মধ্যে নিজেকেও প্রসারিত হয়ে যেতে দেখি। এ প্রসঙ্গে ‘তুমি আমার সাধের সাধনা’ যখন রবীন্দ্রনাথ বলছেন ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ শীর্ষক গানে, তখনই বুঝতে অসুবিধা হয় না, কীভাবে, রবীন্দ্রনাথ প্রেমিকার সঙ্গে এক অদ্বৈত সম্পর্ক তৈরি করে নিচ্ছেন। কিন্তু এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমি তো তার জন্যই সাধনা করছি, যে ‘আমি’ নই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রেমে নিজেকে তার মধ্যে খুঁজে পাওয়ার বেদনা এবং চেতনাই মনে হয় সেই কবিতা, যা আমাদের প্রেমের এক বিস্তারিত আকাশের দিকে নিয়ে চলে গেল। এখানে এসে প্রশ্ন আসতেই পারে, তবে প্রেমের কবিতা মানেই আধ্যাত্মিক কবিতা? এখানে বলতে বাধ্যই হচ্ছি, আধ্যাত্মিকতা এবং ধার্মিক ভাবনার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রেম অবশ্যই এক আধ্যাত্মিক সম্পর্ক, যে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক আমাদের শরীরকে সাধনার এক অংশ হিসেবেই ব্যবহার করে। ঠিক যেমন, এই শরীরটা আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি, তেমনই, শরীর আছে বলেই প্রেমের প্রকাশ সম্ভব হচ্ছে। একটি অব্যক্ত অনুভূতি, ব্যক্ত হচ্ছে। এই অব্যক্ত অনুভূতির তো ব্যক্ত হয়ে ওঠার প্রয়োজন আছে বলেই জগতের সৃষ্টি এবং তার প্রকাশ। এই দেখুন, এই কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মনে পড়ে যেতে পারে জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত পংক্তি- ‘ আমরা যাইনি মরে আজো, তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’। কিংবা মনে হতে পারে, জীবনানন্দ যে হাজার বছর ধরে পথে হেঁটে যাওয়ার কথা বলছেন, বলছেন, সব পাখি ঘরে ফেরে, সব নদী, আর তারপর থাকে পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। ভাবুন আকাশলীনা কবিতাটির কথাও, যেখানে জীবনানন্দ প্রায় তার্কোভস্কির দ্য স্যাক্রিফাইসের লং শটের মতো ‘আকাশের ওপারে আকাশ/ বাতাসের ওপারে বাতাস’-এর রচনা করেছেন। জীবনানন্দের প্রেম কি আধ্যাত্মিক নয়? অনেক গভীর ভাবে আধ্যাত্মিক, তা না হলে তিনি প্রায় উত্তরাধুনিক এক প্রশান্তিতে এমন এক দৃশ্যের ব্যঞ্জনা তৈরি করেছেন –“ এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে—জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা”। এই যে ‘-‘- এর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জীবনানন্দ এক অব্যক্তকে ব্যক্ত করলেন, তা আধ্যাত্মিকতার সংযোগ ছাড়া সম্ভব ছিল না।

তবে, আমরা মনে হয় এই জায়গা থেকে প্রেমের কবিতার দিকে তাকাতে পারি। সার্থক প্রেমের কবিতা কিংবা গান, আধ্যাত্মিক হতে বাধ্য। তা আধ্যাত্মিক, কারণ তা সময় স্থান কালের যে সীমাবদ্ধতা তা পেরিয়ে মানুষকে এবং মানুষের অনুভূতিমালাকে সংযুক্ত করে। প্রেম এক সংযোগ বলেই কি তাই বিনয় মজুমদার বারবার বলেছেন অঘ্রাণের অনুভূতিমালার কথা,যে অঘ্রাণ নিয়ে জীবনানন্দ লিখেছিলেন, “ লীন হয়ে গেলে তারা তখন তো মৃত/ মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনো/ মৃতেরা কোথাও নেই, আছে?/ কোনো কোনো অঘ্রাণের অন্ধকারে হেঁটে যাওয়া শান্ত মানুষের/ হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও নেই বলে মনে হয়”। এই অঘ্রাণ আমাদের কাছে বিষাদের বার্তা নিয়ে আসে। আর এই বিষাদকে রবীন্দ্রনাথ বলেন বড়ো দুঃখের আধার”। বড়ো দুঃখ এবং করুণ রাগিনী ছাড়া প্রেমের গভীরতম প্রদেশে আলো ফেলা যায় না। বিনয় মজুমদার তাঁর ‘ফিরে এসো চাকা’ কাব্যগ্রন্থে এই বিষাদ এবং করুণ রাগিনীকেই এবং এই সংযোগকেই আবিষ্কার করে গেছেন নিয়ত। “ আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমেষেই/ গলাধঃকরণ তাকে না করে ক্রমশ রস নিয়ে/ তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ফুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে”। আমরা এই কবিতা পড়তে পড়তে আশ্চর্য হই, কারণ বিনয় মজুমদারের কবিতা, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতোই একে অপরের সঙ্গে সুরের হারমনি তৈরি করতে করতে উঠে যায় অর্থের চূড়ায়। বিনয় মজুমদার আসলে কাব্যের এই সংযোগের ভাষাটি তৈরি করে গেছেন নিপুণভাবে তাঁর প্রতিটি কবিতার মধ্য দিয়েই। গভীর এক আধ্যাত্মিকতার রচনা তিনি করেছেন। কিন্তু তাকে আধ্যাত্মিকতার কোনও চেনা ছকের মধ্যে ফেলা যাবে না। কারণ বিনয় এক প্রকৃত ভাস্করের মতো সেই বুনন রচনা করেছেন, যা এক অখণ্ড সমগ্র। প্রত্যেক মহৎ কবিই আসলে এই সংযোগের সাধনাই করে থাকেন। “ নিষ্পেশণে ক্রমে ক্রমে অঙ্গারের মতন সংযমে/ হীরকের জন্ম হয়, দ্যুতিময়, আত্মসমাহিত”। প্রেম আমাদের এই আত্মসমাহিত এক জায়গাতেই নিয়ে চলে যায়। যেখানে আমি আর আমি হয়ে থাকি না। নিজেকে তোমার মধ্যেই আবিষ্কার করি শুধু তাই নয়, তোমার মধ্য দিয়েই আমি নিজেকে দেখি। আর তুমি তো প্রকৃতিরই এক রূপ। আমিও প্রকৃতির এক রূপ। যখন তোমার মধ্য দিয়ে আমি এই প্রকৃতির দিকে তাকাই, তখন আমি নিজেকেও দেখতে পাই। আর ধীরে ধীরে আমি আলাদা ভাবে কাউকেই দেখতে পাই না। যেমন,প্রকৃতি কি পারে নিজের সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে? কিন্তু প্রকৃতিরও তো নিজেকে প্রকাশ করার ব্যাকুলতা আছে। আর তাই তো সে একটি ফুলের মধ্য দিয়ে, একটি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে, একটি কবিতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে। তার নিজেকে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন হয় আধারের। আমাদের সমস্ত শিল্প সাধনা হল প্রকৃতি এবং প্রকৃতির নিজেকে প্রকাশের আধারের মধ্যে সংযোগসাধনটুকু তৈরি করা। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিনয় মজুমদার তাঁদের কাব্যে এই প্রেমের অরূপটুকুকেই নির্মাণ করে গেছেন।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in






বাংলা কবিতায় জীবনানন্দই প্রথম কবি, যিনি নারীর দিকে তাকিয়েছিলেন আধুনিক দৃষ্টিতে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় নারী ঘোর রহস্যঘন, তার দেহরূপ, আর অলঙ্কারের বর্ণনার তলে চাপা পড়ে যায় তার মানস, আর রবিঠাকুরের গানগুলিকে যদি প্রেমের গান ধরি, তাহলে, রবীন্দ্র কবিতায় নারী তেমন নয়, যেমন তার জীবনে; রবীন্দ্র কবিতায় নারী এক কল্পলোকের জগতের আলোছায়া।
নজরুলের কবিতায়ও তাই, নজরুল একধাপ এগিয়ে। তার কবিতায় নারীকে করে তুলেছে দেবীতুল্য হিসাবে। মোটকথা, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতার নারী ইহজগতের কেউ নন। তারা ‘প্রিয়া’, ‘স্বপ্ন-সহচরী’, ‘প্রিয়তমা’; তাদের কোন নাম নাই, নামহীন এক দূরতম রূপের জগত তারা। নারী তাদের কবিতায়, অতিশয় পবিত্রও বটে! তারা ব্যথা দিলেও, হৃদয় ভাঙলেও, তাদের পদতলে পড়ে থাকাই যেন প্রাপ্তি, যেন তারা ঈশ্বরী, যেকোন মূল্যে তাদের খুশি করাই প্রেমিক তথা পুরুষের অভীষ্ট! রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের এহেন ‘নারীবাদ’ বঙ্গে যে নারীদর্শনের জন্ম দিয়েছে, সেখানে, নারীর প্রসঙ্গ এলে সকলেই অপার্থিব জগত থেকে নামিয়ে আনেন শব্দমালা, আর মালা গাঁথেন মহান কল্পলোকের রূপকথায়। তারপর, সেই দেবীটিকে পুজা করতে থাকেন।
জীবনানন্দ আমাদের কবিতায় তো বটেই, মননে-মস্তিষ্কেও, এ ভূখণ্ডের প্রথম পরিপূর্ণ আধুনিকতম পুরুষ। খেয়াল করুন, জীবনানন্দের দাম্পত্যের কথা, যা আমাদের আধুনিক দাম্পত্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। জীবনানন্দ সেই যুগে বিয়ের কন্যাকে যেন বলি দেয়া হত।
সেই যুগে তিনি, কাদামাখা একটা শাড়িসমেত কলেজফেরত লাবণ্যকে একঝলক দেখে পছন্দ করেছিলেন, যাতে আশ্চর্য হয়েছিলেন স্বয়ং লাবণ্যও! যৌতুকও নেননি, সেইসময়, যৌতুক যখন গায়ে হলুদের মতই, বিয়ের কার্যবিধিরই অংশ। নারীর ব্যাপারে জীবনানন্দের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় তার দাম্পত্যজীবনের আরো খুঁটিনাটি ঘটনায় ।

জীবনানন্দ কবিতায় প্রথম, নারীকে তার দৈহিক রূপের জন্য যে পুজো দেয়া হয়েছে বিগত শতাব্দীতে, তাকে মনুষ্যসমাজ থেকে আলাদা করে যে কল্পলোকের দেবীর আসনে বসানো হয়েছে, সেই কল্পলোকটিকে ভেঙে দিয়ে, নারীকে নিয়ে আসেন মাটির পৃথিবীতে, মানুষের ভীড়ে। অধিকাংশ বাঙালি কবির দিস্তা দিস্তা কাগজ নষ্ট হয়েছে, কেবল, নারীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর গয়নাগাটির জৌলুশের বর্ণনায়, তাদের নারীরা অনুভবনীয় না, হয়ে উঠেছেন দর্শনীয়, তাদের যা কিছু প্রশংসা করা হয়েছে, তা ওই সবেধন নীলমনি দেহটির কারণেই, তাদের মননের, মেধার, স্বভাবের কোন বিশ্লেষণ বা উপস্থাপন, সেসবের প্রতি আগ্রহ কারো হয় নাই। কিংবা তাদের ক্লেদ, পাপ; তাদের দেবীতুল্য দেহের ভেতরে যে মানুষ তার সহজাত স্খলনের কথা, কেউ বলে নাই। জীবনানন্দের নারীদর্শন আশ্চর্যরকম নির্মোহ। সেখানে নারীকে দেবী করার প্র‍য়াস নাই, তার কাছে নিজেকে জলাঞ্জলি দেয়ার প্রতীতি নাই, বিংশ শতকের নারীবাদে সায় নাই, নারীর প্রতি কুটিল বিদ্বেষেও মতি নাই-এক আশ্চর্য নিরপেক্ষতায় দাঁড়িয়ে পৃথিবীর নারীদের তিনি দেখেছেন বাস্তবজগতের একজন, ‘পুরুষ’ না, ‘মানুষ’ হিসেবে। আর তাই, ‘প্রিয়া’, ‘স্বপ্ন-সহচরী’, ‘প্রিয়তমা’ বা ‘দেবী’দের নয়, জীবনানন্দ ভালোবেসেছেন ‘মেয়েমানুষেরে’! ভালোবাসা জীবনের অতলান্তিক সমুদ্রে একবিন্দু জলের মত ঘটনা, প্রেয়সী আরো দশটা মেয়ের মতই মেয়েমানুষ। প্রেমিক তার পুজারী না। জীবনানন্দ অকপটে বলছেন, তিনি ঘৃনাও করেছেন ‘মেয়েমানুষেরে’! কারণ, তারা দেবী নন, তারা মর্ত্যের মানুষ, তারা বিংশ শতকের সমূহ বিনষ্টের চিৎকারকে ধারণ করে। জীবনানন্দ নারীকে আর কী কী বলে ডেকেছেন? ‘মানুষী’, নারীর জন্য মানুষের বিপরীতে এই আশ্চর্য শব্দ প্রথম তিনিই ব্যবহার করেছিলেন। জীবনানন্দের নারী ‘মানসী’ নয়, যার বাস মানসজগতের কল্পরাজ্যে, তার নারী এই মর্ত্যলোকের ‘মানুষী’।
জীবনানন্দের নারী ‘পুজা’ নেয় না। নারী রূপকথার দেশে না, মানুষের ভীড়েই হারিয়ে যায়! ‘তোমার শরীর,/তাই নিয়ে এসেছিলে একবার, তারপর মানুষের ভীড়/তোমারে নিয়াছে কবে টানি!’
জীবনানন্দ জানেন, ধ্রুব অমর প্রেম বলে বিংশ শতকের পৃথিবীতে কিছু নাই, বা, আসলে প্রেম কখনো ধ্রুব নয়, হয় না। প্রেমের ইতিহাসে বেদনাই বিজয়ী। ফলে জীবনানন্দ জানেন, ‘প্রেম শুধু একদিন এক রজনীর’! আর তাই, প্রেমিকার বিট্রেয়াল, তার চলে যাওয়াকে এক দার্শনিক মহিমায় বিশ্লেষণ করে, খুব সহজে গ্রহণ করেন তিনি, মাটির নারীর জন্য কাতর হন না, রবীন্দ্র -নজরুলের মত, এগুলোকে গ্রহণ করেন জীবনের সাবালক স্বাভাবিকতায়, বলেন-‘যেতে হবে বলে/তুমি গেছ চলে/সবাই চলিয়া যায়/সকলের যেতে হয় বলে!’ কেউই আসলে যায় না, যেতে হয়-এই সত্য আজ আমাদের সামনে কত পষ্ট !

রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের নারীপুজা আর কামনার অর্ঘ্যদানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, নারীর দেহরূপের পুজা। নারীর দেহখানা তাদের কবিতায় যত এসেছে, মন তত নয়, যেটুকুওবা এসেছে, তা খণ্ডিত। বিপরীতে দাঁড়িয়ে, জীবনানন্দই খুব শাদামাটাভাবে নারীকে বলেছিলেন, ‘সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত।’ যে রূপের জন্য নারীর এত বন্দনা, সেই রূপকে তিনি ‘মৃত’ ঘোষণা করছেন। সুদর্শনাকে বলছেন ‘তোমার মতন এক মহিলা!’ রূপের বর্ণনা যে দেন নাই জীবনানন্দ, তা নয়। তা কেমন তার নারীর রূপ?

‘বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা’ দেহ, ‘কড়ির মতন শাদা মুখ’, হিম হাত, চোখে হিজল কাঠের রক্তিম চিতা, পাশাপাশি সেই আগুনের তলেই ‘শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার’, ‘করুণ শঙখের মত’ স্তন-এরকম প্রেমিকা এ পৃথিবী একবার পায় না শুধু, এ পৃথিবীর একজনই এরকম প্রেমিকার কথা ভাবতে পারেন, তিনি জীবনানন্দ। খেয়াল করার ব্যাপার, রবীন্দ্র-নজরুলের প্রেমিকাদের প্রতি লোকের মুগ্ধ হওয়ার মতন যদি কিছু থাকে, তা হলো তাদের দৈহিক রুপ, তাদের দেবীর মত মহিমা। অথচ জীবনানন্দের ‘নারী’-র প্রেমিকা নয়। তার রূপ রহস্যময়, এই বর্ণনা থেকে খুব সুদর্শন কোন নারীর ধারণা আমরা পাই না, কেবল অস্পষ্ট, রহস্যময় একটি নারী অস্তিত্বের ধারণা পাই।

বাঙলা কবিতার পাঠককে নারীর দেহপুজা থেকে কীভাবে তার মনের রহস্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন জীবনানন্দ, বাঙালি নারীদের কীভাবে গয়নাগাটি আর ফর্শা ফর্শা মুখশ্রী ছাড়াই অপরূপ করে তুলছেন জীবনানন্দ। তিনি মননশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, টের পাওয়া যাচ্ছে কী? আশ্চর্য হলো, স্তনের মত সেন্সুয়াল অঙ্গটির উল্লেখ করেও জীবনানন্দ পাঠককে নারীর শরীরের প্রতি কামোন্মত্ত হতে দেন না, ‘করুণ শঙখের মত’ উপমার পরে, স্তন দুধে আর্দ্র হোক বা না হোক, বোধের অতলান্ত থেকে নারীদেহের প্রতি সস্তা ক্ষুধা জাগে না অন্তত। জীবনানন্দ স্তনের উপমায় ব্যবহার করেছেন আরো বিপন্ন বিস্ময়কর উপমা, ‘সেই জলমেয়েদের স্তন/ঠাণ্ডা, শাদা বরফের কুচির মতন!’ অশ্লীলতা-শ্লীলতার প্রশ্ন না, সেসব ভেবে কবিতা লেখা জীবনানন্দের ধাতে ছিলও না। কিন্তু নারীকে দেহের উর্ধ্বে এক মননশীল জায়গায় তুলে ধরতে তার এই প্রয়াস, বিমুগ্ধচিত্তে প্রশংসার্হ!

নারীকে জীবনানন্দ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। কাউকে মানুষ বানাতে গেলে, তাকে শয়তান বা জন্তুর বা ভোগ্যপণ্যের পর্যায় থেকে উঠিয়ে আনা যেমন জরুরি, তেমনি এঞ্জেল, হুর, দেবী বা ঈশ্বরীর জায়গা থেকে নামিয়ে আনাও জরুরি। সে কাজটিও করেছেন জীবনানন্দ। উপন্যাসে ও গল্পে তো করেছেনই, সেদিকে যাব না। পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়ানো সুন্দরীদের কানে জ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, মানুশের অর্জন, কবিতা-এসব অমূল্য জিনিষের কথা বলে যে লাভ নাই, ওনারা যে সেগুলো বোঝেন না, সেকথা তিনিই প্রথম বলেছেন। সুন্দরীদের তিনি বলেছেন ‘মূর্খ’, ‘সোনার পিত্তলমূর্তি’! অনেকে ভাবতে পারেন, প্রেমের ব্যর্থতা থেকে এই কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জীবনানন্দ প্রেমিক হিসেবে এ যুগের অনেক রোমিওর চেয়ে সফল ছিলেন। কাজিনকে বিয়ে করা হিন্দুধর্মে নিষেধ, সেই বোনকে বদ্ধ ঘরে চুমু দিয়েছেন, তার সাথে ওরাল সেক্স করেছেন। তার সাহস ছিল বলতে হবে! এবং, একদিন নয়, অনেকদিন! ফলে, প্রেমে ব্যর্থতা তার থাকলেও, ‘প্রাপ্তি’ যে কিছু ছিল না, তা নয়! যাহোক, নারীকে তিনি ঘৃনাও করেছেন, সেকথাও আমরা তার ‘বোধ’ কবিতায় দেখি। ‘পরী নয়, মানুষও সে হয়নি এখনো’-নারী তার যোগ্য মর্যাদা পায়নি, ঠিক, তবে সে পরী নয়, আর পরী করা রাখলে যোগ্য মর্যাদা সে পাবেও না, একথা জীবনানন্দ ছাড়া কে বলতে পারতেন! নারীর ভেতরের পাপ, পতন, ক্লেদ, স্খলন, তার সৌন্দর্যের অনিত্যতা বারবার উঠে এসেছে তার লেখায়। নারীকে মানুষ হিশেবে পেতে হলে, আগে ‘পরী’র ধারণা ভাঙা জরুরি, এই বোধ জীবনানন্দের স্বোপার্জিত।
জীবনানন্দের কবিতায় নারীচরিত্রের মহত্তম প্রতিনিধি যিনি, বনলতা সেন, তিনিও রবিঠাকুরের পূর্বজন্মের প্রিয়ার মত ‘মুখে তার লোধ্ররেণু, লীলাপদ্ম হাতে/কর্ণমূলে কুন্দকলি কুরুবক মাথে’টাইপ সাজসজ্জায় অতিশয় নিমজ্জিত কোন নারী, কিংবা নজরুলের ‘তোমারে বন্দনা করি, স্বপ্ন-সহচরী/ লো আমার অনাগত প্রিয়া’-র মত দেবীটাইপ কেউ নন। জীবনানন্দ নাম ধরে ডেকেছেন, বনলতা সেন, ‘প্রিয়া’, ‘দেবী’, ‘প্রিয়তমা’, ‘আফ্রোদিতি’টাইপ কিছু বলেন নাই। এই যে নাম ধরে ডাকা, এর মধ্যে আছে নারীকে বাস্তবপৃথিবীর এক পুরুষ বা মানুশের চোখে দেখার ইঙ্গিত। ‘প্রিয়া’ বললে কেবল প্রেমের, অধিকারের সম্পর্ক তৈরি হয়, স্বাভাবিক মনুষ্যপরিচয় তৈরি হয় না। বনলতা সেনকে জীবনানন্দ সেই পরিচয় দিয়েছেন, যেকারণে, রবীন্দ্র-নজরুলের কবিতার প্রিয়াদের কেউ চেনে না, অথচ বনলতা আজ জীবনানন্দের চেয়েও বিখ্যাত! জীবনানন্দ তার কবিতায় প্রায় সব নারীকেই নাম ধরে ডেকেছেন-বনলতা, শ্যামলী, মৃণালিনী ঘোষাল, অরুনিমা স্যানাল- এই নামগুলো নারীকে যে বাস্তবতায় তুলে ধরেছেন ।

রবিঠাকুরের প্রেমিকার মত ভারী ভারী গয়নায় সাজিয়ে, তার নিজের চে ওই গয়নার বর্ণনায় দশলাইন বেশি খরচ করেন নাই, নজরুলের মত না-পাওয়ার বেদনায় ভক্তের মত পুজার ভেট হাতে পড়েও থাকেন নাই জীবনানন্দ। তিন প্যারার কবিতার একটিমাত্র প্যারায় রূপের বর্ণনা এসেছে, তাও মাত্র তিনটি অঙ্গের। গয়নাগাটির বালাই নাই। তাও সে কেমন রূপ? বনলতার চুল ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে থাকা এক প্রাচীন নগরীর রাতের অন্ধকারের মত, মুখও ইতিহাসের পাতায় জেগে থাকা বিখ্যাত এক শহরের স্থাপত্যশৈলীর কথা মনে করিয়ে দেয়। বনলতার আর একটি মাত্র অঙ্গের বর্ণনা জীবনানন্দ দেন, চোখ। পাখির নীড়ের মত। এসব উপমায় খুব সুশ্রী কোন নারীর চেহারা ভাসে না। নারীকে সুশ্রী দেখানোই যেখানে কবিদের যাবতীয় উপমার আরাধ্য ছিল, জীবনানন্দ সেখানে, নারীর সৌন্দর্যকে উপস্থাপন করলেন ইতিহাসচেতনা আর বোধের সমান্তরালে! এর মাধ্যমে নারীও কি কোন মেসেজ পেতে পারে না? যারা তাদের দেহবন্দনায় মেতে তাদের চোখকে অন্ধ করে রেখেছে ইতিহাস, দর্শন, শিল্প, রাজনীতি-পৃথিবীর যাবতীয় মহৎ বিষয় থেকে, তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নারীদের ইতিহাসের সমান্তরালে উপস্থাপন, এ যে তাদেরকে প্রচ্ছন্নভাবে ইতিহাসের উত্তরাধিকার গ্রহনের আহ্বান, ভাবতে খুব কি দোষ!

জীবনানন্দের কবিতা পড়ে অনেক মূর্খ নারীবাদী কিংবা টিপিকাল বাঙালি মূর্খতাপ্রিয় নারী কষ্ট পেতে পারেন। কিন্তু, ‘পরী নয়, মানুষও সে হয়নি এখনো’- বলে শিল্পসাহিত্যে নারীকে যে পূর্ণ মানবিক প্রতীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জীবনানন্দ, তাতে নারীর প্রতি পুরুষের গত শতাব্দীর মেকি দরদের স্বরুপ ধরা পড়ে গেছে, ধরা পড়ে গেছে পুঁজির যুগে নারীকে পণ্য বানানোর পেছনে এইসব শিল্পী-সাহিত্যিকদের বুদ্ধিবৃত্তিক মদদও! আর অন্যদিকে, সাহিত্যের নারী বাস্তবের নারীর কাছাকাছি যেতে পেরেছে। ফলে বলা যায়, আমাদের সাহিত্যে, রবীন্দ্র-নজরুলের প্রেমকাতরতামূলক পদ্যের বিপরীতে, জীবনানন্দের কবিতাই প্রেম ও নারী বিষয়ক সবচেয়ে বাস্তব ও মানবিক কবিতা।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in





















১. বিভূতিভূষণের মৃত্যুচেতনা



জ্যোৎস্না-ধোয়া সাদা বাড়ির ভেতর থেকে কেউ চাপা গলায় হেসে উঠল যেন! খটকা লাগল। থামলাম। নাহ্‌, মনের ভুল- আমি ফের পা চালাাই। সেই বিশেষ অসমান জায়গাটার কাছে এসেই হুমড়ি খেলাম। জায়গাটার সিমেন্ট, বুনো ফুল এবং অযত্নে বাড়া ঘাসের ঝাড় হাপিস হয়ে গেছে। আামি বাসু মনে পড়ছে আমার কথা? দশ বছর ধরে আমি এই একই রাস্তায় সকাল-সন্ধ্যা মাইলের পর মাইল হাঁটছি কিন্তু অদ্যাবধি এক মুহূর্তের জন্যেও আরেকটি প্রাণের দেখা মেলে নি। সুস্মির কথা মনে আছে নিশ্চয়? আমি এবং সুস্মি প্রেমিক- প্রেমিকা। ও আমাকে ওর ছেলেবেলার অনেক গল্প শোনাত। ওর বাবা প্রতিদিন ইউনিভার্সিটিতে যেতো। ওর মা ওর সব জামাকাপড় বানিয়ে দিতো। ওর দিদার গা থেকে সবসময় ডিল ব্রেড ও ভ্যানিলার গন্ধ মৌ মৌ করে ভেসে আসতো। আমি হা করে এসব গল্প গিলতাম। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হোত যদিও সেটা করতে পারতাম না। আর সেইসব রূপকথা যেগুলোকে ও ভাবতো যে সবার জীবনেই আছে সেগুলোর জন্য মুখিয়ে থাকতাম। সুস্মি অনেক বছর দেশের বাইরে আমাদের ঠিক কেন কবে কোন কারণে কথা বন্ধ হয়েছিল আমার মনে নেই। মৃত একটা সম্পর্ক নিয়ে দিব্যি বেঁচে আছি, কিন্তু এতবছর পরে সু্স্মির হাতে লেখা চিঠি যখন হেমন্তের এক বিকালে ধূলোমাখা ডাকবাক্সে আলো ছড়াচ্ছিল তখন ফেলে আসা দিনগুলো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছিল শীতার্ত মনে।

খাম খুলে বেশ অবাক হলাম। চারটি সাদার পৃষ্ঠার পরে পঞ্চম পাতার শেষে লেখা-

‘সুন্দর জ্যোৎস্না ভেঙেচে নদীজলে- কি অপূর্ব্ব শোভা! ভগবানকে ডেকে বললুম- তোমার নিত্য সঙ্গী হয়ে থাকতে চাই- ঐ সন্ধ্যাতারার মত রহস্যের মধ্যে, জ্যোৎস্নালোকিত আকাশের উদার ব্যাপ্তির মধ্যে, বনপুষ্পের সুবাস ও বিহঙ্গকাকলীর মধ্যে আমায় তোমার খেলার সঙ্গী করে রেখো যুগে যুগে। তুমি আপন মনে বিশ্বের বনতলে নবীন কিশোর সেজে বনফুলের মালা গলায় উদাসী হয়ে বেড়াও- কে তোমায় পোঁছে? কেউ না। সবাই ধন, জন, মান, যশ নিয়ে ব্যস্ত। কে দেখেচে এই জ্যোৎস্নাময়ী নিশার অপূর্ব্ব মনমাতানো শোভা! আমায় দেখবার চোখ দিও জন্মে জন্মে।’

– ইতি, সুস্মি

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুস্মির প্রিয় কথাসাহিত্যিক। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৭ মে ১৯৪৩ সালে লেখা ডায়েরি থেকে সুস্মি এটা লিখেছে, এটা লিখতে গিয়ে চারটি পাতা খালি রাখার রহস্য বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে খামে জ্বলজ্বল করা সুস্মির ঠিকানায় একটা চিঠি লেখার লোভ সহসা পেয়ে বসলো। মোহাচ্ছন্ন আমি খাতা কলম নিয়ে বসে পড়লাম।

সুপরিচিতাষু সুস্মি,

এক যুগ পরে তোমাকে লিখছি। কেমন আছো? হেমন্তের পড়ন্ত বিকালে তোমার চিঠি পেলাম। চার পাতায় যা যা লিখবে ভেবেছিলে আমি যেন তা পড়তে পারছি সাদা পাতায়। আমার মনে হলো তোমার চিঠির উত্তর তোমার প্রিয় লেখকের কথাতেই দেই। ২৮ অগাস্ট, ১৯২৫-এ, ‘স্মৃতির রেখা’ দিনলিপিতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন: ‘…Sadness জীবনের একটা অমূল্য উপকরণ- Sadness ভিন্ন জীবনে profundity আসে না- যেমন গাঢ় অন্ধকার রাত্রে আকাশের তারা সংখ্যায় ও উজ্জ্বলতায় অনেক বেশী হয়, তেমনই বিষাদবিদ্ধ প্রাণের গহন গভীর গোপন আকাশে সত্যের নক্ষত্রগুলি স্বতঃস্ফূর্ত্ত ও জ্যোতিষ্মান হয়ে প্রকাশ পায়। তরল জীবনানন্দের পূর্ণ জ্যোৎস্নায় হয়ত তারা চিরকালই অপ্রকাশ থেকে যেত।’

প্রকৃতিপ্রেমিক, রোম্যান্টিক এমন নানা অভিধায় বিভূতিভূষণকে ধরা যায়, এ কথা ঠিক। কিন্তু বিভূতিভূষণের সৃষ্টি মৃত্যুর কথাও বলে, যে মৃত্যু শাল-পিয়ালের বনে সন্ধ্যা নামার মতো নিবিড়। তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে মন চাইছে, খুব খুব জানতে ইচ্ছে করছে তরুণী সু্স্মির মনে দোলা দেয়া বিভূতিভূণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃতিপ্রেম ছাপিয়ে কি বিগতা যৌবনার মনে কোথাও বিভূতিভূষণের মৃত্যুচেতনা ছায়া ফেলেছে? যা ভাবছি তা যদি সত্যি হয় তবে বলতেই হবে বয়স হয়েছে তোমার! তোমার মনে আছে কিনা জানিনা। কলেজের দিনগুলোয় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় মৃত্যুচেতনা নিয়ে কথা বলায় তুমি খুব রেগে বলেছিলে জীবনানন্দ দাশ ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি গুলিয়ে ফেলেছি। সেইদিন বলতে না পারলেও আজ এতগুলো বছরের শেষে তোমাকে লিখতেই পারি আমার ভাবনা। রাগ করবে না আশা করি।

বিভূতি-সাহিত্যে মৃত্যুর ধারণাটির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করলে ‘বৃহদারণ্যক’ উপনিষদের একটি কাহিনির কথা মনে পড়ে। ঘটনাচক্রে, সৌরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে বিভূতিভূষণ বলছেন, ‘আমি সারা জীবন ধরে জন্ম-মৃত্যু রহস্যের আলোচনা করেছি ও রহস্য জেনে ফেলেছি।’ ওই চিঠিতেই তিনি বিশেষ ভাবে ‘বৃহদারণ্যক’ ও ‘ঈশোপনিষদ’-এর কথা উল্লেখ করছেন। এই সূত্রেই ওই কাহিনিটির অবতারণা। সেখানে মৈত্রেয়ীর প্রশ্ন, ‘ধরা যাক, গোটা পৃথিবী বিত্তে পরিপূর্ণ। তা আমার নিজস্ব সম্পত্তি হলে, আমি কি ‘অমৃতা’ হব?’ যাজ্ঞবল্ক্যের উত্তর, ‘বিত্তের দ্বারা ‘অমৃতত্ত্বের’ আশা করা নিরর্থক।’ বস্তুত, অমৃতের একটি অর্থ যদি অমরত্ব হয়। অন্য একটি নিগূঢ় অর্থ, আনন্দ।— জীবন-মৃত্যুর ধারণা নিয়ে বিভূতিভূষণ এই আনন্দেরই পিয়াসী। সেই তেষ্টা থেকেই তাঁর ‘আর্টের’ জন্ম।

জীবনের শেষ পর্বে বিভূতিভূষণ যখন ব্যারাকপুরে ছিলেন তখন সেখানে দেখা পেয়েছিলেন এক ভৈরবীর। বিভূতি মেতেও উঠেছিলেন তাঁর সঙ্গে। ভৈরবী শবসাধনা করতে এসেছেন জেনে, বিভূতিও তাঁর কাছে নিত্য যাতায়াত বাড়িয়েছিলেন। রেগে যেতেন কল্যাণী। তবু কী এক মায়ায় নাছোড় বিভূতিকে আগলে রাখতে পারতেন না! বিভূতিভূষণ রাতভর সাধনায় মেতে থাকতেন স্ত্রী-সংসার ভুলে। তাঁর দিনলিপির পাতায় পাতায় পরলোক নিয়ে বিশ্বাসের কথা রয়েছে। তারই সংশ্লেষ ‘দেবযান’ উপন্যাস। মৃত্যুর পর আত্মার উপস্থিতি নিয়ে বিভূতির বিশ্বাস যেন প্লটের বাঁকে বাঁকে। মৃত্যুর পর কোথায় থাকে আত্মা? শবের কাছেই কি দাঁড়িয়ে থাকে? কী ভাবে উড়ে যায়? ফিরে আসে কি? সব প্রশ্নের উত্তর যেন মিলে যায় যতীন চরিত্রটিকে নিয়ে তাঁর লেখায়। মৃত্যুর আগের জীবন সম্পর্কে আমরা সকলেই ওয়াকিবহাল কিন্তু মৃত্যুর পরবর্তী জীবন কেমন হবে এটাই মানুষের চির-কৌতূহলের বিষয়। এই চিন্তা থেকেই জন্ম নিয়েছে দেবযান। উপন্যাসটা পড়া শেষ করে মনে হয়েছে, এ তো শুধ মৃত্যু চেতনা নয় এর ভিতরে ধরা আছে স্রষ্টার গভীর চিন্তা ও বিশ্বাসের জগৎ। আছে সুগভীর রোমান্টিক চেতনাবোধ। তোমার সতের কিংবা আঠারতম জন্মদিনে তোমাকে উপহার দিয়েছিলাম দৃষ্টিপ্রদীপ ও দেবযান। বইগুলো কি তোমার সঙ্গে আছে নাকি বন্ধ বাড়ির বুকসেলফে উদাস তাকিয়ে আছে? এখনো নিয়ম করে রোজ রাতে কবিতা পড়ো? নাকি কর্মব্যস্ত কর্পোরেট জীবনে কবিতারা বই বন্ধি হয়ে পড়ে থাকে ল্যাপটপের পাাশে নিঃসঙ্গতায়? তুমি তো জন্মান্তরবাদ বিশ্বাস করতে। তাই না? ভারতীয় নিয়তিবাদ দুটি স্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে আছে— জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদ। প্রথমে উদ্ভূত হয় জন্মান্তরবাদ, এবং লক্ষণীয় যে, প্রথম উল্লেখে এটি পুনর্জন্ম নয়, পুনমৃত্যু। এবং আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, এই ধারণাটি প্রথমে মানুষকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত হয়নি, দেবতাদের সম্পর্কেই এর আদিমতম উল্লেখ। জন্মান্তরবাদ প্রবর্তিত হল কেন? একটা সহজ কারণ হল, মানুষের জীবনপ্রীতি; মৃত্যুর ওপারে জীবনকে বিস্তারিত করে দেখার বাসনা এবং সে কারণেই যুক্তিগত ভাবে জন্মের পূর্বেও তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, জন্মান্তরে বিশ্বাস করলে এক জীবনে যত অভিজ্ঞতা হওয়া সম্ভব তার চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞতালাভের সম্ভাবনা দেখা দেয়। তৃতীয়ত, এ বিশ্বাস অনুসারে মানুষের এ জীবনের ভুলত্রুটি জন্মান্তরে সংশোধনের একটা অবকাশ পাওয়া যেতে পারে। চতুর্থত, এ বিশ্বাসে চূড়ান্ত অন্তিমতা বা আত্যন্তিকতার আতঙ্ক মন থেকে অন্তর্হিত হয়, যে-আতঙ্ক মানুষকে সর্বদেশে সর্বকালে তাড়া করে ফিরছে। কিন্তু এ-ও সত্য যে কেবলমাত্র জন্মান্তরবাদ মানুষের আধ্যাত্মিক বা ব্যবহারিক উন্নতির আশ্বাস বহন করে না। যাই হোক ধান ভাঙতে এসে শিবের গাজন গাওয়ার মতো কথা বলছি। বিভূতিভূষণের লেখায় মৃত্যুচেতনা বারবার চোখে পড়ে।

‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ এবং ‘দেবযান’ পরলোক এবং জন্মান্তরবাদ বিশ্বাসের কথা বলে। জীবনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়তো অবিশ্বাস করার উপায়ও ছিলনা। প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’-র প্রকাশের সময় (পরে এই অংশটি বাদ যায়) তার মধ্যেও ছিল সেই অপার্থিবের ছায়া – ‘‘এ আমি কাকে দেখলুম বলব? আমাদের এই পৃথিবীর জীবনের বহু ঊর্ধ্বে যে অজ্ঞাত রাজ্যে অনন্তের পথের যাত্রীরা আবার বাসা বাঁধবে, হয়তো সে দেশের আকাশটা রঙে রঙে রঙিন, যার বাতাসে কত সুর, কত গন্ধ, কত সৌন্দর্য, কত মহিমা, ক্ষীণ জ্যোৎস্না দিয়ে গড়া কত সুন্দরী তরুণীরা যে দেশের পুষ্পসম্ভার-সমৃদ্ধ বনে উপবনে ফুলের গায়ে বসন্তের হাওয়ার মতো তাদের ক্ষীণ দেহের পরশ দিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই অপার্থিব দিব্য সৌন্দর্যের দেশে গিয়ে আমাদের এই পৃথিবীর মা-বোনেরা যে দেহ ধারণ করে বেড়াবেন – এ যেন তাঁদের সেই সুদূর ভবিষ্যৎ রূপেরই একটা আভাস আমার বউদিদিতে দেখতে পেলুম।’’

‘দেবযান’- উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল, সারান্ডার জঙ্গলে ভ্রমণের সময়। অরণ্যের ‘সমাহিত স্তব্ধতায়’ লেখা উপন্যাসটির পরিকল্পনা বিভূতিভূষণ সম্ভবত সব থেকে বেশি দিন ধরে করেছিলেন। জন্ম-মৃত্যুর ভাবনাকে এক সূত্রে বাঁধতেই কি তাঁর এই সময় নেওয়া? আবার ‘তৃণাঙ্কুর’-এ যেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো করে তিনি প্রত্যাশা করছেন, অন্ধকার ‘জ্যোতির্ময় হউক’। এ ভাবেই হয়তো মৃত্যুও একটি প্রাণচক্রের অংশীভূত হয়ে এক বিরাট পরিধিতে ধরা দেয়। এখান থেকেই অভীষ্ট ‘অমৃত’ তথা আনন্দের সঙ্গে এক সরলরৈখিক গাঁটছড়া বাঁধে মৃত্যু ও জন্ম।

স্বভাব-উদাসীন এই মানুষটি নিজের লেখার বিরূপ সমালোচনা নির্লিপ্তভাবেই নিতেন, কিন্তু অতিলোকচিন্তা নিয়ে তর্ক উঠলে নিজের অভিজ্ঞতায় ভর করে সোচ্চার হয়ে উঠতেন। সজনীকান্ত দাস তাঁর আত্মস্মৃতিতে বলেছেন – “আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, আচারে ব্যবহারে কালাপাহাড় বলে অখ্যাতিও আছে।” পরলোকচর্চার জন্য বিভূতিভূষণকে তীব্র ব্যঙ্গ করতেন জানিয়ে তিনি আরো বলেছেন – “পথভ্রষ্ট(?) বৈজ্ঞানিকদের আলোচনায়ও দেখিয়াছি এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে অনেক তত্ত্ব জানিয়াছি। বিভূতিকে বাহির হইতে কখনও আমল দিই নাই, ঠাট্টা করিয়া তাহার দৃঢ় বিশ্বাসকে উড়াইয়া দিয়াছি ; কিন্তু ভিতরে ভিতরে ফল্গু ধারার মতো মৃত্যু পরপারের এই টুকরা রহস্যটি আমাকে বরাবরই প্রভাবিত করিয়াছে আর বিভূতিকে স্বীকার করিয়াছি।”

পথের পাঁচালীর দুর্গার মৃত্যু মাইলফলক হয়ে আছে। বিভূতিভূষণের উপন্যাসে মৃত্যু সর্বদা একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে এসেছে। মহাভারতের মতো অতি বড় বীর, অনিবার্য যার প্রয়োজন সেও অবলীলায় ঝরে যাচ্ছে। কিন্তু দুর্গা ও অপুর বেড়ে ওঠা, পাঠকের হৃদয়ের মধ্যে দুর্গা ধীরে ধীরে পরিণতি পায়। আকস্মিক দুর্গা দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গেলে কণ্ঠ ছিঁড়ে কান্না আসে। মৃত্যুকে বিভূতিভূষণ তার উপন্যাসে এক প্রতীকী মাত্রায় তুলে ধরেছেন,—‘দুর্গা আর চাহিল না। আকাশের নীল আস্তরণ ভেদ করিয়া মাঝে মাঝে অনন্তের হাতছানি আসে—পৃথিবীর বুক থেকে ছেলেমেয়েরা চঞ্চল হইয়া ছুটিয়া গিয়া অনন্ত নীলিমার মধ্যে ডুবিয়া নিজেদের হারাইয়া ফেলে—পরিচিত ও গতানুগতিক পথের বহুদূর পারে কোনো পথহীন পথে—দুর্গার অশান্ত, চঞ্চল প্রাণের বেলায় জীবনের সেই সর্বাপেক্ষা অজানা ডাক আসিয়া পৌঁছাইছে।’ দুর্গার মৃত্যুর অবব্যহিত পরে ‘নতুন কাপড় পরাইয়া ছেলেকে সঙ্গে লইয়া হরিহর নিমন্ত্রণ খাইতে যায়। একখানা অগোছালো চুলে-ঘেরা ছোট মুখের সনির্বন্ধ গোপন অনুরোধ দুয়ারের পাশের বাতাসে মিশাইয়া থাকে—হরিহর পথে পা দিয়া কেমন অন্য মনস্ক হইয়া পড়ে।’ পাঠক চোখে অশ্রু না এনে পারে না।

‘অপরাজিত’-য় নদীর পাড়ের আসন্ন সন্ধ্যায় মৃত্যুর এক নব-রূপ প্রতীত হয়। মনে হয় জন্ম-মৃত্যুর চক্রটি এক ‘দেবশিল্পীর হাতে আবর্ত্তিত হইতেছে...সবটা মিলিয়া অপূর্ব রসসৃষ্টি— বৃহত্তর জীবনসৃষ্টির আর্ট।’

ইছামতী উপন্যাসে অত্যাচারী নীলচাষি শিপটন সাহেবের মৃত্যুদৃশ্যও আমাদের নাড়া দেয়। সুদূর ইংল্যান্ডের কোনো এক গ্রাম থেকে আসা। মৃত্যুকালে রক্ষিতা গয়া মেম আর রাম কানাই কবিরাজ মুচি বাগদিরা ছাড়া তেমন কেউ তার পাশে ছিল না। যখন সাহেবের কথা বন্ধ, শ্বাসকষ্ট—দেওয়ান হরকারী বলল, এ কষ্ট আর দেখা যায় না। মৃত্যুর চূড়ান্তপর্বে কষ্ট হয় কি না—মানুষের জানা সম্ভব নয়। বিভূতিভূষণ লিখলেন—

শিপটন সাহেবের কষ্ট হয় নি। কেউ জানত না সে তখন বহুদূর স্বদেশের ওয়েস্টমোরল্যান্ডের অ্যান্ডসি গ্রামের ওপরকার পার্বত্যপথ রাইনোজ পাস দিয়ে ওক আর এলম গাছের ছায়ায় ছায়ায় তার দশ বছর বয়সের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে চলেছিল খরগোশ শিকার করতে, কখনো বা পার্বত্য রদ এল্টার-ওয়াটারের বিশাল বুকে নৌকায় চড়ে বেড়াচ্ছিল, সঙ্গে ছিল তাদের গ্রেট ডেন কুকুরটা...

হয়তো মৃত্যুর আগে মানুষের অবচেতনে তার শৈশবের স্মৃতিই বেশি ভেসে ওঠে।

আসলে ‘মৃত্যুকে কে চিনিতে পারে, গরীয়সী মৃত্যু-মাতাকে? পথপ্রদর্শক মায়ামৃগের মতো জীবনের পথে পথে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে সে, অপূর্ব রহস্যভরা তার অবগুণ্ঠন কখনো খোলে শিশুর কাছে, কখনো বৃদ্ধের কাছে..।’

মানুষ নিজের মধ্যেও অনেকবার মরে যায়, তার দেহ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকে। শারীরিক অস্তিত্ব বিলয়ের জন্য যদি দুঃখবোধের উদয় হয়। কিন্তু কোন সে শরীর, মৃত্যুর সময় আমরা কোন শরীরের কথা বলি। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, এমনকি বার্ধক্যেও মানুষ এক রূপ থেকে অন্য রূপে যায়।

অশনি সংকেত নতুন করে পড়ে দেখতে পারো, পড়তে পড়তে মৃত্যুকে বিজয়ের প্রতীক মনে হবে কিংবা মৃত্যুর কাছে বর্ণের হার দেখে শত কষ্টেও সুখ অনুভব করবে।

মতির মৃতদেহ আমতলাতেই পড়ে আছে। কত লোক দেখতে আসচে। দূর থেকে দেখে ভয়ে ভয়ে চলে যাচ্চে। আজ যা ওর হয়েচে, তা তো সকলেরই হতে পারে! ও যেন গ্রামের লোকের চোখ ফুটিয়ে দিয়ে গেল। একটি মূর্তিমান বিপদের সংকেত স্বরূপ ওর মৃতদেহটা পড়ে রয়েচে আমগাছটার তলায়। অনাহারে প্রথম মৃত্যুর অশনি সংকেত।

কিন্তু মৃত্যু থেকেই এক নবজন্মের শুরু হয়। এই আখ্যান সেই কালের যে কালে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নীচু জাতের তফাৎ ছিল খুব বেশি। কিন্তু এই দুর্ভিক্ষের মৃত্যু যেন সেই তফাৎকে ঘুচিয়ে দিল। অনঙ্গর অনুনয়কে ফেলতে পারেনা গঙ্গাচরণ, ব্রাহ্মণ ভটচাযও যোগ দেয়। সঙ্গে কাপালীদের ছোট বৌ। দুর্ভিক্ষের মৃত্যু এক নতুন সমাজের জন্ম দিল, জাতপাতের ঊর্ধে মানুষ মনুষ্যত্বকে স্থান দিতে পারলো। অনঙ্গ-বৌ এর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে হার মানতে হয়েছে গঙ্গাচরণের ব্রাহ্মণত্বের অহমিকাকে।

তেমার খুব প্রিয় আরণ্যক উপন্যাাসে আছে কলেরা নামক মহামারীর ছোবলের কথা। কী নির্মমভাবে মহামারীতে গ্রামের অগণিত মানুষ অকালে ঝরে পড়ছে; চিকিৎসার অভাব, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাব- এ জনপদে কী ভয়াবহ ইতিহাস গড়ে তুলছে, তারই বিশ্বস্ত ভাষ্য নির্মাণ করেছেন বিভূতি পরম মমতায় আর অভিজ্ঞতার নির্যাসে। প্রকৃতপক্ষে আরণ্যক এমন এক উপন্যাস যেখানে জীবনের বৃহৎ পরিসরে বিচিত্র রূপে মৃত্যুই হলো মানুষের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। মৃত্যু ভালো না জীবন ভালো আমরা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারি না। বিভূতিভূষণের উপন্যাস ছাড়া ছোটগল্পেও মৃত্যুর নানা প্রতীকী ব্যবহার যেমন আছে তেমন বিশালভুবন তাঁর মৃত্যু দিয়ে গড়া। ‘পুঁইমাচা’ গল্পটির উল্লেখ না করলে এ আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ক্ষেন্তির মৃত্যু কিন্তু মরণের গল্প নয়, এ জীবনেরই গল্প, যখন দেখি লেখক মাচার উপর দিয়ে পুঁইঝাড়ের দৃশ্য রচনা করলেন। বিভূতিভূষণ মৃত্যুভীতি থেকে মুক্তি পেতেই হয়তো কথাসাহিত্যে শ্রমের নিরলস তাজমহল নির্মাণ করে চলেছিলেন।

সব ঘরেই মৃত্যু আছে, মৃত্যু ছাড়া প্রাণ নেই। একদিন এক বৃদ্ধ মা তার একমাত্র সন্তানের মৃতদেহ নিয়ে বুদ্ধের কাছে মাতম করে বললেন, ‘হে মহাস্থবির আমার পুত্রের জীবন ভিক্ষা দিন। বুদ্ধ বললেন, যাও, একটি বিল্বপত্র নিয়ে এসো—সেই বাড়ি থেকে, যে বাড়িতে কেউ মারা যায় নি।’ যেখানে বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায় আটটি পথের ক্রমাগত অনুশীলন বলে দর্শানো হয়েছে, বিভূতিভূষণ সেই দুরূহ পথের প্রতিস্থাপন করেন প্রকৃতিকে দিয়ে। আরেকটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রসঙ্গটিকে বোঝা যাক। বিভূতিভূষণ লিখছেন,

‘জগতের অসংখ্য আনন্দের ভান্ডার উন্মুক্ত আছে। গাছপালা, ফুল, পাখী, উদার মাঠঘাট, সময়, নক্ষত্র, সন্ধ্যা, জ্যোৎস্না রাত্রি, অস্ত সূর্য্যের আলোয় রাঙা নদীতীর, অন্ধকার নক্ষত্রময় উদার শূন্য… এসব জিনিস থেকে এমন সব বিপুল, অবক্তব্য আনন্দ, অনন্তের উদার মহিমা প্রাণে আসতে পারে, সহস্র বৎসর ধরে তুচ্ছ জাগতিক বস্তু নিয়ে মত্ত থাকলেও সে বিরাট অসীম, শান্ত উল্লাসের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই কোন জ্ঞান পৌঁছয় না।… সাহিত্যিকদের কাজ হচ্ছে এই আনন্দের বার্ত্তা সাধারণের প্রাণে পৌঁছে দেওয়া… তাদের অস্তিত্বের এই শুধু সার্থকতা।’

সংসার যদি দুঃখের সাগর হয়, তা হলে তার প্রতিকার, এই অসীম আনন্দের চাবি তিনি তুলে দিলেন প্রকৃতির হাতে। আর সাহিত্যিকের কী ভূমিকা? সাহিত্যিক হলেন যাজক। তিনি প্রকৃতি আর বিস্মৃত সাধারণ মানুষদের যোগস্হাপন করেন, মার্গপ্রদর্শক। অসীম আনন্দের আকরের সন্ধান দেওয়া তাঁর কাজ। আশ্চর্যের বিষয়, স্বভাববিনীত বিভূতিভূষণের প্রত্যয় এই ব্যাপারে বেশ দৃঢ়, বিশ্বের প্রেক্ষিতে তাঁর ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে তাঁর কোনও দ্বিধা নেই। একটা কথা এখানে বলা হয়তো প্রয়োজন। দুঃখের অনুভুতিকে বিভূতিভূষণ অবাঞ্ছিত রূপে দেখেননি, বরং জীবনের প্রয়োজনীয় একটি উপাদান হিসাবে দেখেছেন।

সময় অণুক্ষণ হাঁটে তার পায়ে ধূলো ওড়ে না। ক্লান্তি নেই, ঘুম নেই তার! সন্ধ্যা গড়িয়ে কখন রাত নেমে এসেছে বুঝতেও পারিনি। তোমার উত্তর পাবো কিনা জানিনা তবে অপেক্ষায় থাকবো। চিঠির শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছে- ‘এই জীবনের ওপারে সেই বিরাট জীবনের জন্যে সকলে অপেক্ষায় থাকুক।’— এই অপেক্ষাতেই আমরা না হয় দু’দণ্ড রইলাম!

ভালো থেকো নিরন্তর।


ইতি-

বাসু

০৩ নভেম্বর,২০২৪

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





















বের্শেন ইনেসের কথাই ভাবছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে তার বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন…

‘তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না যে তোমার বন্ধুর গ্লাস একেবারে খালি? আরেকটু মনোযোগী হও। এইসব বিষয়ে আরও শিখতে হবে তোমাকে।’

বের্শেনের চোখমুখ লাল হয়ে গেল। সে একটা গবলেট নিয়ে গের্টের জন্য ওয়াইন ঢালতে শুরু করলো (গের্ট একটা গ্লাস ভর্তি জল নিয়ে বসেছিল)। কেন জানা নেই, হঠাৎ তার একটা অস্বস্তি হতে লাগল এবং মনে হল এটা নিয়ে পরে গের্ট তার সঙ্গে তামাশা করবে। তাড়াহুড়ো করে গের্টের দিকে ওয়াইন ভর্তি গবলেটটা ঠেলে রাখবার সময় এক দু’ ফোঁটা ওয়াইন চলকে পড়ল টেবিলক্লথে। বের্শেনের মা সেটা লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি বোতলটা রেখে দিলেন ওয়াইনের দাগ ধরা জায়গাটার উপরে।

খাবার পর কালো কফি খেতে খেতে বের্নহার্ড ভাবছিল যে এবার ঘুমোতে গেলেই হয়; আসলে সেভাবে তার দিকে কারো নজর নেই। তার অভিমান হচ্ছিল, কিন্তু সে প্রকাশ করল না। তবে সে খুবই খুশি হয়েছে এটা দেখে যে তার বন্ধুবান্ধব সম্পর্কে বাড়িতে সবার মনে একটা ভাল ধারণা তৈরি হয়েছে। সে ফ্লকের সঙ্গে মেঝেতে বসে খেলতে শুরু করল। নানা আদুরে নামে তাকে ডাকতে লাগল। রান্নাঘর থেকে রুটি নিয়ে এল সে ফ্লকের জন্য। তবে রুটির মাঝে সসেজের টুকরো গুঁজে দিয়েছিল সে, নাহলে ফ্লক শুধু শুকনো রুটি একেবারেই খাবে না।

সে যখন ফ্লকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার নোংরা পশম ঝেড়ে দিচ্ছিল, তখনি কে যেন এসে তার ঘাড়ে হাত রাখল। বের্শেন মুখ ফিরিয়ে দেখল যে ইনেস। ইনেস নিচু হয়ে অনুচ্চকণ্ঠে বলল যে তাদের এখন বেরতে হবে। বের্শেন মনে মনে চমকে উঠল। সে তার বন্ধুদের চলে যাবার ব্যাপারটা এতক্ষণ ভাবেনি। তার মাথাতেই আসেনি যে ওরা এখন ফিরে যাবে ওকে এখানে রেখে। যদি ওরা অন্তত ফ্লককে রেখে যেতেও রাজি হয়…

পরে, নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বের্শেনের মনে পড়ল যে তার হোমওয়ার্কের ফাইলটা শহরেই পড়ে আছে এবং সে আগামীকাল নিজের হোমওয়ার্ক করতে পারবে না।

‘ধুত্তোর’… বলেছিল গের্ট। কিন্তু নিজের কাজ তার কাছে কতটা দরকারি, সেটা গের্ট বুঝবে কী ভাবে? এখন গের্ট ইনেস আর ফ্লককে নিয়ে ড্রাইভ করে ফিরছে। হঠাৎ ভীষণ রাগ, অভিমান একসঙ্গে এসে বের্শেনের মন ভারি করে দিল। সে বালিশে মুখ লুকিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে শুরু করল।


বের্নহার্ড থিয়েটারস্ট্রাসে* ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। সবে সাতটা বেজেছে। ওর সঙ্গীসাথির দল কেউই এসে এখনও পৌঁছায়নি। সাড়ে সাতটার আগে অবশ্য কেউ আসবেও না। আজকে ওরা সবাই মিলে কোণের ছোট পাবে খেতে যাবে, তারপর যাবে গের্টের বাড়িতে। আজ ফার্দিনান্দের ফেয়ারওয়েল পার্টি, যে আগামীকাল বার্লিনে চলে যাবে। ফার্দিনান্দের তেইশ বছর বয়স; সে মিউজিক কন্ডাকটর হতে চায়। সে ভীষণ ভাল বেহালা বাজায়। শহরের থিয়েটার হলে বেহালাবাদকের চাকরি তার পাকা। এমনকি সঙ্গীতশিক্ষকেরাও তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এই চাকরিটা নিয়ে নেবার জন্য। কিন্তু ফার্দিনান্দের ভেতরে একটা অদ্ভুত একগুঁয়ে অদম্য আবেগী উচ্চাশা আছে। যে চাকরি পাওয়ার জন্য তার সঙ্গীসাথিরা সবাই তাকে ঈর্ষা করছিল, সে কিনা সেই চাকরিটা হেলায় ছেড়ে চলে যাচ্ছে! জেদ ধরে প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায় বার্লিন চলে যাচ্ছে সে। সে বলে সে ফুর্টভ্যাংলার এবং ব্রুনো ওয়ালটারের সঙ্গীত শুনতে চায়। আরও শুনতে চায়, আরও শিখতে চায় সে। বলে যে পড়াশুনার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করে সে পয়সা রোজগার করবে। খুব রোগা আর লম্বা চেহারা ফার্দিনান্দের। এত রোগা যে ওর জামার কলারগুলো পর্যন্ত বিরাট বলে মনে হয় ওর অবয়বের উপরে। সুদর্শন বলা যাবে না তাকে। মুখটা এত ফ্যাকাশে যে ধূসর বলে মনে হয় মাঝে মাঝে। মুখে দৃঢ় একটা অভিব্যক্তি সবসময়। সে যখনই ঠোঁটদুটো ফাঁক করে, মনে হয় যেন খুব তেষ্টা পেয়েছে তার। শুধু তার চোখগুলো তার মুখে অদ্ভুতরকম বেমানান। শুধু বড় নয়, চোখগুলো বিশাল আয়তাকার, কিন্তু লাজুক এবং বিষণ্ণ। ইনেস বলে যে শুধু চোখ দেখেই ওই ছেলেটার প্রেমে পড়ে যাবে যে কেউ।

তাহলে ফার্দিনান্দ আগামীকাল যাচ্ছে। সঙ্গে থাকবে বেহালা, একটা পুরনো হাতব্যাগ আর ছোটখাট কিছু প্যাকেট যেগুলো বন্ধুরা স্টেশনে নিয়ে যাবে। কেক, আপেল, রুমাল, নানা ছোটখাট জরুরি জিনিসপত্র থাকবে সেই উপহারের প্যাকেটে। বের্শেন এমন একটা উপহার নিয়ে যাচ্ছে, যেটা ফার্দিনান্দকে একইসঙ্গে অবাক এবং খুশি করবে। সে নিয়ে যাবে ইনেসের একটা ছবি, যেটা সে চুপিচুপি ইনেসের কাছ থেকে চুরি করেছে। কারণ ফার্দিনান্দও ইনেসকে ভালবাসে। হ্যাঁ, নিশ্চিত ভালবাসে!

বের্শেন ঘড়ির দিকে তাকায়। এখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে এবং তার খিদে পেয়ে গেছে। সে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রেস্তোরাঁর আলোআঁধারি ঘরটায় ঢুকে পড়ল। ছোট ছোট টেবিলে ছাত্ররা বা মোটা মোটা সরকারি কর্মচারীরা বসে তাস খেলছে। সে সঙ্গীতশিক্ষার্থীদের জন্য রিজার্ভ করে রাখা টেবিলে গিয়ে বসে পড়ল। তারপর বাঁধাকপির স্যালাদ আর সসেজ অর্ডার করল বেশ উচ্চস্বরে।


‘স্যার, আপনি কি খাবারের সঙ্গে বিয়ার পান করবেন?’ ওয়েট্রেস জিজ্ঞেস করল তাকে।

বের্শেনের একটু অস্বস্তি হলেও সে পাল্টা একটা ধন্যবাদ দিল পরিবেশনকারিনীকে।


ফার্দিনান্দের হয়তো পাবে বসেই একটু একটু নেশা হয়ে গিয়েছিল। এখন সে গের্টের বাড়িতে একটা বিশাল চেয়ারে এলিয়ে পড়ে আছে সিলিঙের দিকে চেয়ে। তার চোখেমুখে এক বিষণ্ণ অভিব্যক্তি। বাকিরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে খোশমেজাজে জোরে জোরে আড্ডা মেরে যাচ্ছে। গের্ট, যে কিনা এখন বাড়ির মালিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ, সে সমানে এদিক ওদিক যাচ্ছে, সিগারেট নিয়ে আসছে এবং এখন একটু অনুকম্পামিশ্রিত সৌহার্দের সঙ্গে ফার্দিনান্দের সঙ্গে কথা বলছে। এই পার্টিতে মেয়েরা কেউ আসেনি। যদিও সঙ্গীত শিক্ষালয়ের ছাত্রদের অনেকেরই মেয়েবন্ধু আছে, তাছাড়া শিক্ষালয়ে একই ক্লাসে ছাত্রীরাও আছে; কিন্তু এই ধরণের পার্টিতে সাধারণত মেয়েদের ডাকা হয় না। যদিও তথাকথিত প্রগতিশীল মানুষদের কাছে ব্যাপারটা একটু হুমকির মত শোনাবে, যদিও ব্যাপারটা পুরুষদের নিজেদের যথেষ্ট আধুনিক হিসেবে প্রমাণ করবার পরিপন্থী, তবুও এটা এখানে পুরুষ ছাত্রদের বিয়ার টেবিলের প্রচলিত রীতি। অবশ্য সব রীতির ব্যতিক্রম আছে। এখানে এই ব্যতিক্রমের নাম ইনেস। ইনেসকে সব সময় আমন্ত্রণ করা হয়। যদিও সে অনেক মেয়েদের চেয়ে গম্ভীর আচরণ করে এবং স্বল্পবাক, তবুও সে এই জমায়েতে যোগদান করতে অস্বস্তিবোধ করে না। দশ পনের জন পুরুষের মাঝে একমাত্র মহিলা হিসেবে তাকে সবসময় অসাধারণ দেখায়। কিন্তু আজ সে আসেনি।

এদিকে ফার্দিনান্দ বার বার ইনেসের কথা জিজ্ঞেস করছে। এখন আবার বলছে যে ইনেসকে নাহয় আবার ফোন করে ডাকা হোক। বাকিরা গের্টের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

‘এখন প্রায় রাত এগারোটা, ওই বুড়ো… ওর বাবা ওকে বেরতে দেবে না এখন। তাছাড়া ইনেসও ভাববে যে আমরা অভদ্র আচরণ করছি’… গের্ট অসহায় কণ্ঠে নিজের দ্বিধা ব্যক্ত করে।

‘তাহলে বের্নহার্ড ফোন করুক।’ ফার্দিনান্দ বলে

‘আহা, সেটাও কি খুব ভাল হবে?’

‘অবশ্যই ভাল হবে। কারণ ইনেস বের্শেনের উপর রাগ করবে না।’

‘খুব ভাল। বের্শেন!’


বের্নহার্ড এত কথা কিছুই শোনেনি। তাকে জোর করে আধা গেলাস বিয়ার খাইয়ে দিয়েছে। তার বিয়ার খেতে খুব বিশ্রী লাগছিল। কেমন টক টক স্বাদ। কিন্তু গের্ট এবং ফার্দিনান্দ চেপে ধরে খাইয়ে দিয়েছে তাকে। সে এখন গের্টের বিছানায় আধোঘুমন্ত অবস্থায় শুয়ে আছে। সে এখন ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে নানা কথা ভাবছে। গের্ট তাকে মডেল করে যে ছবিগুলো এঁকেছিল, তার মধ্যে চার পাঁচটা গের্টের ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে। সেগুলো সবাই দেখেছে এবং সেগুলো নিয়ে খিল্লি করছে। বের্নহার্ড বুঝতে পারছে না কেন তার এত বিরক্ত লাগছে। তার কিচ্ছু ভাল লাগছে না। কেমন যেন লজ্জা করছে সবার মাঝে থাকতে। তবে ছাত্ররা সবাই তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে। কিন্তু এই মুহূর্তে বের্নহার্ড একা একা একটু ঘুমোতে চায়। সে চায় যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এরা যেন এই ঘর ছেড়ে চলে যায়। তার বদলে এরা চারদিকে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি চালিয়ে যাচ্ছে। সবাই চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সে জোরে চেঁচিয়ে ওঠে… ‘আরে, তোমরা চাও কি শুনি? কি চাও?’ চুপ করার বদলে সবাই আরও জোরে হেসে ওঠে।



(চলবে)



*স্ট্রাসে (straße) শব্দের অর্থ সরণী।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৭

রাতের প্রথম পহর। বৈদ্যজীর ঘুম চটে গেছে, কারণ বড্ড শীত করছে। চব্যনপ্রাশ, স্বর্ণভস্ম, এবং বাদাম পাকের ব্যারিকেড ভেঙে ঠান্ডা ওনার চামড়ার নীচে ঢুকে পড়েছে আর মাংসের বেশ ক’টি পরত ভেদ করে হাড়মজ্জায় সেঁদিয়েছে। লেপটাকে ভাল করে গায়ে জড়াতে জড়াতে ওনার মনে পড়ল—বিছানায় একলা শুলে শীতের অনুভূতি বেশি হয়। এরপর ধেয়ে এল স্মৃতির মিছিল। তাতে লাভ হল এই যে একটু যেন চোখ লেগে গেল। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় একটু শান্তি। কিন্তু একটু পরেই শুরু হল পেটের ভেতর দুরন্ত হাওয়ার ক্রান্তি।

পেটের মধ্যে হাওয়ার চাপ দেহের নীচের ভাগ থেকে ঘন ঘন ঘোর নিনাদে বেরোতে লাগল। উনি লেপচেপে কয়েকবার পাশ ফিরলেন এবং শেষে বিপ্লবের এক ভয়ানক বিস্ফোটের পর ঘুমিয়ে পড়লেন। দেখতে দেখতে বিপ্লবের হাওয়া এক পোষা কুকুরের মত লেজ নাড়তে নাড়তে শুধু ওনার নাকের ফুটো দিয়ে শব্দ করে যাতায়াত করতে লাগল। উনি ঘুমিয়ে পড়লেন এবং ঘুমের মধ্যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতে লাগলেন।

দেখলেন গণতন্ত্র ওনার খাটের পাশে মাটিতে উবু হয়ে হাত জোড় করে বসে আছে। ওর চেহারাটা খেতে হাল জোতা চাষির মত, আর ইংরেজির কথাছেড়েই দিলাম, ওতো ঠিক করে হিন্দিও বলতে পারে না। তবু ও কাকুতিমিনতি করেই চলেছে আর বৈদ্যজী শুনছেন। উনি বারবার ওকে চৌকির উপর বিছানাতে উঠে বসতে বলছেন।ওকে বোঝাচ্ছেন—আরে গরীব তো কী হয়েছে, তুমি হলে আমার আত্মীয়; কিন্তু গণতন্ত্র তবু ওনাকে হুজুর হুজুর, সরকার--এইসব করে চলেছে।

অনেক বোঝানোর পর গণতন্ত্র উঠে এসে বৈদ্যজীর চৌকির কোণায় বসলো। আরো খানিক সান্ত্বনার পর যখন বুঝল এবার কিছু কাজের কথা বলা যেতে পারে তখন বৈদ্যজীর কাছে নিবেদন করল –আমার কাপড়চোপড় ছিঁড়ে গেছে, আমি প্রায় নগ্ন হয়ে গেছি। এই অবস্থায় কারও সামনে বেরোতে লজ্জা করে। তাই বলছি, হে বৈদ্যজী মহারাজ! দয়া করে এই অধমকে একটা সাফ-সুতরো ধূতি দিন, পরে দেখি।

বৈদ্যজী বদ্রী পালোয়ানকে বললেন ভেতর থেকে একটা ধূতি এনে দিতে, কিন্তু গণতন্ত্র মাথা নাড়তে লাগল। বলল—আমি আপনার কলেজের গণতন্ত্র। আর আপনি ওখানকার বার্ষিক সভা অনেক বছর ধরে ডাকেননি। ম্যানেজারের নির্বাচনও সেই কলেজ খোলার পর থেকে আর হয়নি। আজকাল আপনার কলেজ সব ব্যাপারে এগিয়ে চলছে, শুধু আমিই এককোণে অবহেলায় পড়ে রয়েছি। একবার আপনি নিয়মমাফিক নির্বাচন করিয়ে দিন। তাতেই আমার শরীর ঢাকার এক নতুন কাপড় হয়ে যাবে। আমার লজ্জা চলে যাবে।

এসব বলে গণতন্ত্র বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে গেল আর বৈদ্যজীর ঘুমটিও ফের ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই উনি লেপের তলায় ওনার ভেতরের ক্রান্তির এক তাজা বজ্রনির্ঘোষ শুনতে পেলেন। তখনই ঠিক করলেন যে দেখতে যেমনই ফালতু লাগুক, গণতন্ত্র লোকটা ভালোমানুষ, ওনার নিজের লোক এবং ওকে সাহায্য করা দরকার। ওকে অন্ততঃ একটা নতুন ধূতি দেয়া হোক। তাহলে ও আর পাঁচজন সভ্যভব্য লোকের সঙ্গে ওঠাবসা করতে পারবে।

পরের দিন কলেজের প্রিন্সিপালকে আদেশ দেওয়া হল—কলেজের বার্ষিক সভা ডাকা হোক এবং সমস্ত পদের সঙ্গে ম্যানেজারেরও নির্বাচন করা হোক। প্রিন্সিপাল অনেক বোঝালেন যে নতুন নির্বাচন করা দরকারী নয়, জরুরীও নয়। কিন্তু বৈদ্যজী নাছোড়, বললেন—তুমি থামো। এটা নীতির ব্যাপার।

কিন্তু প্রিন্সিপাল থামার পাত্র নন। বলে চললেন—আরে কোন খবরের কাগজে সমালোচনা হয়নি, ওপরমহলে নালিশ যায়নি, না কোন মিছিল বেরিয়েছে, না কেউ অনশনে বসেছে। সব শ্যালক নিজের নিজের গর্তে সেঁধিয়ে রয়েছে। কেউ তো বার্ষিক সভা ডাকার কথা বলছে না, আর যে বলছে সে ব্যাটা কে? সেই ব্যাটা খান্না মাস্টার, সেই রামাধীন ভীখমখেড়বী আর ওনার দু’চারটে চামচে। ওদের চালে ফেঁসে সভা ডাকার ফল ভাল হবে না।

বৈদ্যজী সব শুনলেন, তারপর বললেন—তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু এসব তোমার বুদ্ধির অগম্য। কারণ এটা হল নীতিগত সিদ্ধান্ত। যাও, গিয়ে সভা ডাকার ব্যবস্থা কর।

সেদিনই সন্ধ্যে নাগাদ গয়াদীনের বাড়িতে পাঠানো হল। উদ্দেশ্য নির্বাচনের ব্যাপারে ওনার মতিগতির একটু আঁচ পাওয়া। গয়াদীন হলেন কলেজ কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। কাজেই এখন ওনার অপরিসীম গুরুত্ব। জানা দরকার যে উনি এবার কাকে ম্যানেজার করার কথা ভাবছেন। আর যদি ওনার ভাবনা বৈদ্যজীর পক্ষে না হয়, তাহলে কী কৌশলে ওনার হৃদয়-পরিবর্তন করা যেতে পারে? রঙ্গনাথ এবং রুপ্পনবাবু প্রাথমিক কথাবার্তা শুরু করতে ওখানে গেছেন।

তবে গয়াদীন গোড়া থেকেই পুরো ব্যাপারটা সহজ করে দিলেন। উনি দু’জনকে আপ্যায়ন করে চারপাইতে বসালেন, রঙ্গনাথের শহুরে শিক্ষার ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন করলেন, ওদের বিশুদ্ধ ঘী দিয়ে তৈরি মটরী ও লাড্ডু খাওয়ালেন, তারপর নির্বাচনের কথা উঠতেই সাফ বলে দিলেন—“সব কাজ ভাল করে ভেবেচিন্তে করা উচিত। সময়ের হাওয়ার সঙ্গে বয়ে গেলে চলবে না। ম্যানেজার পদের জন্য নির্বাচন করাতে হবে, ভাল কথা। কিন্তু ম্যানেজার বৈদ্যজী মহারাজই থাকবেন, কারণ কলেজটা ওনারই। অন্য কাউকে ম্যানেজার করার প্রশ্ন উঠছে কেন? এসব ভাল করে ভাবা উচিত”।

ওনার কথাশুনে মনে হল যেন খোদ রঙ্গনাথ আর রূপ্পনবাবু বৈদ্যজীর বিপক্ষে ভোট দেওয়ার কথা ভাবছে, এবং বৈদ্যজীর তরফ থেকে নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব গয়াদীন নিজে সামলাচ্ছেন। রঙ্গনাথের মজা লাগছে। ও বলল,”আপনারা হলেন পুরানো লোক। প্রত্যেক বিষয়ে সঠিক বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু ওদিকে যে ভীখমখেড়বী আর অন্য কিছু লোকজন মামার জায়গায় অন্য কাউকে ম্যানেজার করতে চাইছে। জানি না কেন এসব করছে”?

গয়াদীনের কাশি উঠল। ধীরে ধীরে বললেন,” অভিজ্ঞতা নেই, তাই। ওরা ভাবছে ম্যানেজার অন্য কেউ হলে ওরা কিছু করে দেখাবে। কিন্তু এভাবে কোন কিছু হয় নাকি”? তারপর একটু থেমে কথা শেষ করলেন,” যেমন নাগনাথ, তেমনই সাপনাথ”।

কথাটা রঙ্গনাথের পছন্দ হল না। এই উপমায় ওর মামাজী বেশ খাটো হয়ে গেলেন যে! ও তাড়াতাড়ি বলল,”সে বুঝলাম, কিন্তু মামাজীর সঙ্গে তুলনায় ওরা দাঁড়াতে পারে?”

উনি ফের ব্যাখ্যা করতে লাগলেন, “দেখ একথাটা তো আমি আগেই বলে দিয়েছি। কলেজ বৈদ্যজীর, ওনার হাতেই থাকুক। পঞ্চায়েত রামাধীন ভীখমখেড়ীর, সেটা ওর হাতে থাকুক। সবাই নিজের নিজের ঘরে বসে সন্তুষ্ট হোক। ---

“নির্বাচনের তামাশায় আছেটা কী? নতুন লোককে ক্ষমতায় বসাবে? সেও একইরকম খারাপ হবে। সব একই ধরণের। তাই বলছি—যে যেখানে আছে, তাকে সেখানেই নির্বাচিত করে দাও। পড়ে থাকুক নিজের গুহায়। খামোকা ওলট-পালট করে কী লাভ”?

রুপ্পনবাবু বাটিতে পড়ে থাকা শেষ লাড্ডুটিকে মন দিয়ে দেখতে দেখতে “খাব-কি-খাব না” চিন্তায় মগন। যেই শুনেছেন যে গয়াদীন বৈদ্যজীকেই ম্যানেজার বানানোর পক্ষে, ওনার কথাবার্তায় আগ্রহ শেষ হয়ে গেল। উনি বুঝে গেছেন যে এরপরে খালি ফালতু বকোয়াস হবে। কিন্তু রঙ্গনাথ গয়াদীনের ভাবনায় কিছু নতুন চিন্তার খোরাক পেল।

যেমন, নির্বাচনে যারাই দাঁড়ায়, তাদের অধিকাংশই অধম এবং নীচ প্রকৃতির লোক। তাহলে যাদের বদমাইশি এবং প্যাঁচ-পয়জার লোকজন চিনে ফেলেছে, তাদের সরানো উচিত নয়। রঙ্গনাথ মনে মনে গণতন্ত্রের এই থিওরির নাম দিল ‘গয়াদীনবাদ’। ওর ইচ্ছে হল আরও কিছু শোনে।

গয়াদীন বলছিলেন, “নতুন লোক এসে কিছু করতেও যদি চায়, তো করবেটা কী? যদি লোকে কিছু করতে দেয় তবে না! আজকাল যে সময় পড়েছে, কেউ কাউকে কিছু করতে দেয়? এখন তো খালি---“।

ছংগামল ইন্টার কলেজের ছেলেদের খেলাধূলার জগতের সঙ্গে ভালরকম পরিচয় আছে। কারণ, কলেজ প্রতিমাসে ওদের থেকে খেলাধুলোর ফীস কান ধরে আদায় করে, যদিও কলেজের কাছে খেলেধুলোর জন্য কোন মাঠ নেই। কিন্তু এনিয়ে কারও হেলদোল নেই। সবাই সন্তুষ্ট। খেলাধুলোর দায়িত্ব গেমস টিচারের। ফলে তাঁর কাছে অফুরন্ত সময়। তাই তিনি মাস্টারদের দুটো দলের সঙ্গেই ভাব জমিয়ে তাদের ভেতরের খবর বের করে নেন।

এতে প্রিন্সিপালেরও খুব আরাম। এখানে হকি স্টিক নিয়ে মারপিট হয় না, কারণ এদের কোন হকি টিম নেই। আর এসব থেকে কলেজের ডিসিপ্লিনেও কোন আঁচ লাগে না। ছাত্রদের বাপও খুশি, কারণ ছেলেদের খেলার ঝামেলা শুধু ফীস দিলেই মিটে যাচ্ছে। আর ছেলেরাও সত্যি সত্যি কোন খেলোয়াড় হবে না। ছেলেদের দলও খুশো। কারণ ওরা জানে যে হাতে হকিস্টিক নিয়ে একটা ঢিলের টুকরোর মত ছোট্ট বলের পেছনে এই গোল থেকে ওই গোলপোস্ট পর্য্যন্ত পাগলের মত দৌড়তে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণে এক কুঁজো তাড়ির রস গেলা যায়। অথবা, জুয়োর আসরে দাঁও লেগে গেলে চার-ছ’টাকা পকেটে পোরা যায়।

এই ছেলেগুলোর হাতেই আজ হকিস্টিক এবং ক্রিকেট ব্যাট। সেগুলো ওরা এমন কায়দায় ধরেছে যেন ওদের হাতে কেউ রাইফেল গুঁজে দিয়েছে। প্রায় পঞ্চাশটা ছেলে এইসব হাতিয়ারে সজ্জিত হয়ে কলেজের গেটের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। রঙ্গনাথ ওদের এই অপরূপ সাজসজ্জা দেখে জানতে চাইল—হয়েছেটা কী? আজ কি স্কুল ইনস্পেক্টরের আসার কথা?

ছোটে পালোয়ান উত্তর দেবার চেষ্টা করল, অর্থাৎ কোমর থেকে আলগা হওয়া লুঙ্গির গিঁট কষে বাঁধল। তারপর বলল,”এইসব পটাপট ঝামেলার মধ্যে কার ইনস্পেকশনের দায় পড়েছে? এসব আয়োজন তো বার্ষিক সভার জন্য “।

ছোটে পালোয়ান কলেজের সমিতির সদস্য বটে। ছেলেরা ওকে দেখে হর্ষধ্বনি করল। গেটের কাছে ওর দেখা হল প্রিন্সিপালের সঙ্গে। উনি বললেন,”আসুন ছোটেলালজী! আপনারই অপেক্ষায় আছি।

--“এসেছি যখন, পালিয়ে যাব নাকি? আপনি আমার আগে চলুন”। এটা ছোটেলাল ভালো মনে বলল। রর্ষাকালে কুকুর বৃষ্টিতে ভিজলে এক বিশেষ ধরণের শব্দ করে হাঁচে। অপ্রস্তুত প্রিন্সিপালের হাসির চেষ্টায় গলা দিয়ে খানিক ওইরকম আওয়াজ বেরোল। উনি পালোয়ানের আগে আগে চলতে চলতে বলা শুরু করলেন,” রামাধীনের দলও কোমর কষেছে। বেজেগাঁওয়ের লাল সাহেবের সাহায্যে আরও কয়েকজনকে ভাঙিয়ে নিয়েছে। লালসাহেব কেন যে এই সব ঝামেলায় নাক গলিয়েছেন। থাকেন তো শহরে, কিন্তু গাঁয়ের সব বিষয়ে নাক গলানো চাই”। রামাধীনের দেমাক বেড়েছে। এখন বোঝা যাচ্ছেনা যে কতজন এদিকে আর কতজন ওদিকে”।

ছোটে পালোয়ান কলেজ বিল্ডিংয়ের সামনে ফুলের কেয়ারির দিকে তাকিয়ে রইল। প্রিন্সিপাল বিড়বিড় শুরু করলেন –‘বৈদ্যজী মহারাজও মাঝে মাঝে এমন সব কাণ্ড করে বসেন যে কী আর বলি—কী দরকার ছিল এই নির্বাচন-টির্বাচন করানোর---‘?

পালোয়ান তখন একটা জনপ্রিয় কীর্তনের লাইন আউড়ে দিল—‘কেন শুনি বাকি লোকেদের কথা, আমার কৃষ্ণ যে প্রাণাধিক—‘!

গেট পেরিয়ে ভেতরে যেতে যেতে প্রিন্সিপাল বললেন—‘আপনিও আসুন রঙ্গনাথ বাবু, আপনার কোন মানা নেই’।

রঙ্গনাথ মাথা হেলিয়ে জানালো যে ও আসছে, কিন্তু ভেতরে গেল না। এবার একজন দু’জন করে কলেজ পরিচালক সমিতির সাধারণ সদস্যরাও ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়ে আসতে শুরু করেছেন। কো-অপারেটিভ ইউনিয়নের একজন ডায়রেক্টর এলেন পায়ে হেঁটে। কিন্তু এমন বেগে এলেন এবং এত তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে গেলেন যে ছোকরার দল ওনাকে না দেখে নিজেদের মুখ দেখতে লাগল। কয়েক মিনিট পরে ঠিকেদার সাহেব এলেন –কলেজের ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে, ফসল পায়ে দলে। কিন্তু উনি গেলেন অন্যদিকে, যেখানে কিছু মজুর কোন কাজ করছে। সেখানে দাঁড়িয়ে কিছু জিনিস আকাশে তুলে মাটিতে পটকে দেওয়ার অভিনয় করে উনি হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলেন। একটু পরে এলেন বাবু গয়াদীন, ধীর পায়ে এসে গেটের কাছে কালভার্টের উপর ছোট সিমেন্ট বাঁধানো জায়গাটায় বসে পড়লেন। উনি উদাসী চোখে দেখতে লাগলেন---ছেলেদের হাতে হকিস্টিক আর ব্যাট এবং একটি ছেলের হাতে ক্রিকেট বল। তারপর ওই বলের দিকে এমন একাগ্র হয়ে তা্কিয়ে রইলেন যেন সম্মোহন করছেন।

প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন—চলুন মেম্বার সাহেব, অন্য সবাই এসে গেছেন।

উনি এমনভাবে তাকালেন যেন ডাকাতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন, আর ওনাকে সাক্ষীদের সামনে আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডে যেতে বলা হয়েছে। অসুস্থ গলায় বলেন, ‘চলুন’। তারপর পেঙ্গুইনের মত পা ফেলে ফেলে উনি গেট পেরিয়ে কলেজ ভবনের মধ্যে অন্তর্হিত হলেন।

আরেকটু পরে সড়কে এক ঘোড়সোয়ারের আবির্ভাব হল, তার মাথায় পাগড়ি। দেখলে মনে হবে যেন ইতিহাসের দ্বাদশ শতাব্দীর পাতা থেকে এক্ষুণি ফরফর করে বেরিয়ে এসেছেন। ছোকরাদের মধ্যে একজন বলে উঠল—“এখন আর কেউ বৈদ্যজীর একগাছিও ছিঁড়তে পারবে না। ঠাকুর বলরাম সিং এসে গেছেন”।

বলরাম সিং এসেই ঘোড়ার লাগাম একটি ছেলেকে ধরিয়ে দিলেন। এখন উনি অষ্টাদশ শতাব্দীর চরিত্র। যেন দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহের খবর দিতে আগ্রার কেল্লায় ঢুকেছেন এমনি গতিতে কালভার্ট অব্দি এসে একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন—‘মারপিট হয়নি তো’?

--‘কিসের মারপিট? আমরা প্রিন্সিপালের দলে, অহিংসাবাদী’।

বলরাম সিং গোঁফে তা’ দিতে দিতে হেসে ফেললেন।

--‘তোরাও কিছু কম যাস না। হাতে হকিস্টিক আর ডান্ডা, আবার গান্ধীজির চেলাগিরি’!

ছেলেটা-‘মহাত্মাও লাঠি নিয়েই চলাফেরা করতেন। আমাদের হাতে কোন লাথি নেই। আর হকিস্টিক? এতে একটা বলও মরে না, মানুষ কোত্থেকে মরবে’?

প্রিন্সিপাল আবার বাইরে এসেছেন। ‘চলুন মেম্বার সাহেব, ভেতরে চলুন। কোরাম পুরো হয়ে গেছে। এবার মিটিং শুরু হবে’।

বলরাম সিং পাগড়ির কোনা দিয়ে ঘাম মুছলেন। বললেন,’কোন চ্যালাকে বলে দিন, ঘোড়াকে দানাপানি দিতে। আমি ভেতরে গিয়ে কী করব? আমার যত কোরাম, সব এখানেই’।

প্রিন্সিপাল খুশি হয়ে মাথা নাড়লেন। বলরাম সিং পাঞ্জাবীর পকেটটা শক্ত করে ধরে বললেন,’বিশ্বাস না হয় ছুঁয়ে দেখুন। কেমন কড়া! এটাই আসল কোরাম’।

প্রিন্সিপাল না ছুঁয়েই বললেন,’ ধরে নিন, ছুঁয়েছি। আরে আপনার কথা কি মিথ্যে হতে পারে’?

বলরাম সিং—‘ আসলী বিলেতি মাল, ছ’ঘরা। দেশি দোনলা নয় যে একবার ফুট্ট্‌ হয়ে থেমে যাবে। ঠাঁয় ঠাঁয় শুরু করে দিলে রামাধীনের দলের ছ’জন চড়াই পাখির মত ফুরুৎ হয়ে যাবে’।

--“ আহা, আপনার জবাব নেই! লা-জবাব”! প্রিন্সিপাল এমন ‘বাহ্‌ বাহ্‌’ করে উঠলেন, যেন বলরাম সিং কোন মুশায়েরাতে কাব্যপাঠ করছেন। উনি যেতে যেতে বললেন—“আমি ভেতরের মিটিংয়ে যাচ্ছি। বাইরেরটা আপনি সামলাবেন”। ফের পেছন ফিরে মহাত্মা বিদুরের বাণী ঝাড়লেন, “যাই করুন, শান্তিপূর্ণ ভাবে”।

বলরাম সিং ফের গোঁফে তা’ দিলেন। “ এখানে সব শান্তি। আমার উড়ুর নীচে গোটা পঞ্চাশেক শান্তি বিরাজ করছে”।

প্রিন্সিপাল সাহেব ভেতরে গেলেন। বলরাম সিং ফের কালভার্টের উপর পুলিয়াতে বসে পড়লেন। খানিকক্ষণ পিচির পিচির করে পানের পিক ফেললেন। তারপর যে ছেলেটা নিজেকে মহাত্মা গান্ধীর থেকে বড় অহিংসাবাদী ডায়লগ ঝেড়েছিল তাকে বললেন,” যাও তো ছেলে; একবার গোটা কলেজ চক্কর মেরে এসো। দেখে এস, আমার লোকজন ভেতরে ঠিক ঠিক জায়গা আটকে পাহারা দিচ্ছে কিনা? আর ব্যাটা রমেসরাকে বলে দাও—সালা যেন কারও সঙ্গে হাঙ্গামা না করে। যে বোঝালেও বুঝবে না তাকে এদিকে গেটের কাছে পাঠিয়ে দেয়, ব্যস্‌”।

ছেলেটা হালচাল বুঝতে ভেতরে চক্কর মারতে গেল। ও যেন একটা বয়স্কাউট, যে ভাবছে দেশের জয়-পরাজয় স্রেফ ওর মিশনের সাফল্যের উপর নির্ভর করছে। আশপাশের ছেলেগুলোর ছটফটানি বাড়ছে। তাই দেখে বলরাম সিং বললেন—“যাও ব্যাটারা; বেশ বড় চক্কর মেরে ঘুরে এস। আর নিশ্চিন্ত থাক, আমি যতক্ষণ পুলিয়াতে বসে আছি কোন দুশমন এদিকে ঘেঁষবে না”।

বেলা তিনটে। রাস্তা দিয়ে ট্রাক আর বলদে টানা গাড়ি আসছে যাচ্ছে। বলরাম সিং পুলিয়ার উপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে স্বপ্নিল চোখে ওই আসাযাওয়া দেখছেন। একবার ঘোড়া চিঁহি চিঁহি করে উঠল। উনি বললেন,”সাবাশ মেরে চেতক! সবুর কর। সময় হলে দানাপানি পাবি”।

চেতক সবুর করল এবং প্রমাণস্বরূপ খানিক পরে পরে জল ছাড়তে লাগল। ্কিছু ছেলে ওকে ঘিরে গোল করে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার নৈসর্গিক কাজকম্মের আগে ওপরের অবস্থা মন দিয়ে দেখে নিজেদের মধ্যে পেরাইভেট হাসাহাসি করতে লাগল।

হঠাৎ কলেজের সামনের রাস্তায় একটা ট্রাক এসে থামল। একটি লোক তার থেকে লাফিয়ে নেমে দ্রুত পায়ে কলেজের দিকে এগোতে লাগল। তার পরণে পরিষ্কার ধুতি-পাঞ্জাবী-টুপি আর হাতে একটা ছড়ি। ট্রাককে থামতে দেখেই ছেলের পাল এদিক ওদিক থেকে দৌড়ে দৌড়ে পাকলেজের সামনে পুলিয়ার দিকে দলবেঁধে আসতে লাগল। বলরাম সিং ভদ্রলোককে বাধা দিয়ে বললেন-- আপনার চরণ স্পর্শ করি পণ্ডিত!

লোকটি বিড়বিড় করে কোন আশীর্বচন বলে সিধে কলেজের গেটের দিকে এগোতে লাগলেন। বলরাম সিং বললেন—“পণ্ডিত, একটু ধীরে। কেউ তোমাকে তাড়া করছে না”।


লোকটি থতমত খেয়ে হাসল। বললেন—মিটিং শুরু হয়ে গেছে না?

বলরাম সিং উঠে দাঁড়ালেন। মাপা পায়ে পণ্ডিতের কাছে এলেন। ছেলের দল এগিয়ে আসছে, প্রায় ঘিরে ফেলছে। উনি ধমকে উঠলেন—“ ভেগে পড় ছেলের দল। একটু দূরে গিয়ে খেলাধূলো কর”। তারপর পণ্ডিতের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন-“পণ্ডিত, মিটিংয়ে তোমার হাজিরি লেগে গেছে। এবার ফিরে যাও”।

পণ্ডিত কিছু বলতে চাইল। কিন্তু উনি এবার পণ্ডিতের গায়ে গা লাগিয়ে বললেন—“কিছু ভেবেই বলছি। ফিরে যাও”।

পণ্ডিতের মনে হল জঙ্ঘার কাছে কিছু শক্ত জিনিস ধাক্কা দিচ্ছে। উনি বলরাম সিংয়ের পাঞ্জাবীর পকেটের দিকে তাকালেন এবং হড়বড়িয়ে দু’পা পেছনে হটে গেলেন।

ওনাকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বলরাম সিং ফের বললেন—“পণ্ডিত, চরণ-বন্দনা”!

লোকটি চুপচাপ ফিরে গেল। রাস্তায় কোন গাড়ি নেই, ট্রাক চলে গেছে। ও এবার কোন একদিকে দ্রুত পায়ে চলতে চলতে হঠাৎ দৌড়তে লাগল। একটা ছোকরা বলল—গেছে!

বলরাম সিং বললেন, “পণ্ডিত সমঝদার; বুঝতে পেরেছে”।

“সমঝদার তো বুঝলাম। কিন্তু অমন করে পালাবার কী হয়েছিল?” –একটি ছাত্রের প্রশ্ন।

বলরাম সিং—“এখনো চ্যাঙড়া বয়েস। একটু বড় হও তখন বুঝবে এমন সময়ে সমঝদার মানুষ এভাবেই দৌড়য়”।

একজন বিদ্যার্থী ঘোড়াকে দানাপানি দিচ্ছিল। ঘোড়া ফের চিঁহি করে উঠল। এবার বলরাম ধমকে উঠলেন—“চুপ বে চেতক”!

বয়-স্কাউট ছেলেটি ফিরে এসেছে। বলরাম ঘোড়াকে ধমকানোর সুরেই বলেন, “ কিঁউ বে, ক্যা খবর হ্যায়”?

স্কাউট গেল ঘাবড়ে। ক্লাসে ঘাবড়ে যাওয়া সাধারণ পড়ুয়ারা যেমন দাঁত বের করে তেমনি করে

হেসে বলল,” হ্যাঁ ঠাকুর সা’ব; সব ঠিকঠাক চলছে”।

“ক’জন আদমী এসেছিল”?

“সবাই বুঝে গেছে? নাকি কেউ অবুঝপনা করেছে”?

“সব্বাই বুঝে গেছে”। ছেলেটার সাহস ফিরে এল। দূরে পালাতে থাকা পণ্ডিতের দিকে ইশারা করে বলল, “ওনার মতই ধড়ফড় করে সবাই ফিরে গেল”।

ছেলেটা এবার প্রাণ খুলে হাসল। বলরাম সিং বললেন,” বেশি বুঝে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত”।


কলেজের ভেতর থেকে জয়ধ্বনি ভেসে আসছে। কেউ বলছে—‘ বোল্‌ সিয়াবর রামচন্দ্রকী জয়’!

জয় বলার ব্যাপারে হিন্দুস্তানিদের মোকাবিলা কে করবে? শুরু হল ‘সিয়াবর রামচন্দ্র’ থেকে, ফের ‘পবনপুত্র হনুমানের জয়’। ফের, কেউ জানেনা কেমন করে, ঝটপট মহাত্মা গান্ধীর জয়ে পৌঁছে গেল।

--“বোল্‌ মহাত্মা গান্ধী কী জয়”! ব্যস্‌ সবুজ পতাকা নাড়া হয়ে গেছে। পণ্ডিত জওয়াহরলাল নেহরু একবার ‘জয়’ পেলেন। তারপর প্রদেশের সব নেতাদের একটা করে। এক-একটা জেলার নেতাদের। এবার আসল জয়ধ্বনি—“ বোলো বৈদ্যজী মহারাজ কী জয়”!

বর্শায় বেঁধা শুওরের মত চিঁচিঁ করতে করতে প্রিন্সিপাল সাহেব বাইরে এলেন। উনিও চেঁচিয়ে উঠলেন—বোলো বৈদ্যজী মহারাজ কী!

‘জয়’ বলার জন্যে পরের প্রজন্ম গেটের সামনে হাজির ছিল।

কলেজের সামনে যেন মেলা বসেছে। প্রিন্সিপাল রঙ্গনাথকে বোঝাতে লাগলেন, “চলুন, বৈদ্যজী মহারাজ ফের সর্বসম্মতিতে ম্যানেজার নির্বাচিত হয়েছেন। এবার দেখুন কলেজ কেমন দ্রুত উন্নতি করে—ধকাধক, ধকাধক, ধকাধক! ্তুফান মেলের মত গতি”! উত্তেজনায় ওনার চেহারা ক্রমশঃ লাল হচ্ছে।

ছোটে পালোয়ান বলল, “এ প্রিন্সিপাল, বেশি ভড়ভড় করবে না তো। আমারও একটা কোথা শুনে নাও। এই যে ছোঁড়াগুলো হকির ডান্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এদের এক একটা বলও ধরিয়ে দাও। আর বলো কিছু লক্ষ্যভেদ করা শিখতে। এদের মধ্যে একটাও নেই যে বলে ডান্ডা মারতে পারে। সবকটা সাপমারার মত করে ধুলোর মধ্যে লাঠি পেটায়”।

-“অবশ্য, মেম্বার সাহেব, অবশ্য। খেলাধূলোর ব্যবস্থাও হবে। আগে এই ঝঞ্ঝাট থেকে রেহাই পাই —“।

ছোটে, “রেহাই তো পেয়ে গেছ। এবার আমাকে বলতে দাও। সব কথায় ‘হ্যাঁ’ বলা তোমার একটা স্বভাব। কিন্তু তোমার লাঙল-চষা ক্ষেতে একটা মূলোও জন্মায় না। খেলাধূলোর ব্যাপারটাও তাই। তোমার ছেলেগুলো শুধু হকির ডান্ডাটা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আজকেই যদি দরকার পড়ত তো ওরা খালি হাওয়াতে ডান্ডা ঘোরাতে থাকত, ব্যস্‌। কারও পিঠে নিশানা করে চালালে সেটা লাগত হাঁটুতে। দরকারের সময় নিশানা ঠিক হওয়া চাই”।

পেছন থেকে বৈদ্যজীর কন্ঠস্বরঃ “খেলাধূলোরও গুরুত্ব আছে প্রিন্সিপাল সাহেব! ছোটের কথা অনুচিত নয়”।

“হেঁ হেঁ”, প্রিন্সিপাল পালোয়ানের দেহসৌষ্ঠব প্রেমিকার চোখে দেখে বললেন, “এ পালোয়ান, নাকি হাসিঠাট্টার ফুলঝুরি! এ কখনও অনুচিত কিছু বলে না”।

(চলবে)

0 comments: