Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২০.২

ওই তিন নম্বর কিসসার জাদুতেই রঙ্গনাথ আজকাল ভয়ডর শিকেয় তুলে বেলাকে নিয়ে কল্পনা করতে শুরু করেছে। ক’দিন আগে মেলা থেকে ফেরার সময় রুপ্পনবাবুর প্রেমপত্র নিয়ে যে কিসসাটি শুনেছিল তারপর আর রুপ্পনের সঙ্গে এ’নিয়ে কোন কথাবার্তা বলার হিম্মৎ হয়নি। এখন এই খালি সময়ে বেলাকে নিয়ে ওর মনে যে ঝড় উঠেছে সেটা শান্ত করতে ওর সহায় শুধু কল্পনা, হস্তমৈথুন আর কুন্ঠা ছাড়া উপায় কি! তবে এইসব যুগে যুগে শিল্পীদের প্রেরণা যুগিয়েছে। তাই এখন রঙ্গনাথ এক শিল্পীর জীবনযাপন করছে বলা যেতে পারে।

ও দেখতে কেমন?

“মধুমতী” সিনেমার বৈজয়ন্তীমালার মত? নাকি “গোদান”এর শুভা খোটে? অথবা “অভিযান” এর ওয়াহিদা রহমান? না না, এরা সব তো অনেক আগেই ভারতমাতা হয়ে গেছে। বেলা এখনও বেশ তাজা। কেমন হবে? জানা নেই। কিন্তু যাই হোক, যেমনই হোক, হবে তো “ খুদা কী কসম লাজবাব”! চৌধবী কা চাঁদ সিনেমার গানের কলি রঙ্গনাথের গলায় হাড়ের মত আটকে গেছে, তবু মুখে হাসি ফুটেছে। অন্ধকারে প্রায় দেড় ইঞ্চি চওড়া মুচকি হাসি, বড় মধুর।

বেলাকে নিয়ে অনেক ভেবেছে। এত ভেবেছে যে নানান মাপের এবং ওজনের শ’খানেক নিতম্ব ও স্তন ওর মাথায় ভাসছে আর ডুবছে। ওগুলো জোড়ায় জোড়ায় হাজির হয়, গোছা গোছা ফুটে ওঠে, তারপর একে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। রঙ্গনাথের খুব ইচ্ছে যে এগুলো থেকে একটা ভরন্ত নারী শরীর দেখা দিক, কিন্তু সে গুড়ে বালি! ওর কল্পনায় একবার একটি নারীদেহ এল বটে, কিন্তু তাতে চেহারা গায়েব! ওর মনে খানিকক্ষণ কুছ বাতিল স্তনের গোলা আকার খেলা করতে লাগল। শেষে, উত্তিষ্ঠত-জাগ্রত শরীরকে ঢিলে করার পর ও লেপের ভেতর সেঁধিয়ে গেল।

পরের রাত। রঙ্গনাথ ছাতে একা শুয়ে রয়েছে। কিন্তু বেলার কথা ভুলে গিয়ে ওর মামা বৈদ্যজীর ক্রোধে তমতম করা বীর্যময় চেহারা মনে পড়ছে।

দিনের বেলা শনীচর আর কালিকাপ্রসাদের চেষ্টায় তৈরি কো- অপারেটিভ ফার্মের উদ্বোধন হয়েছিল। মুখ্য অতিথি হয়ে যে অফিসার এসেছিলেন বৈদ্যজী তাঁকে নিজের সমবায় ইউনিয়নে টাকা তছরুপের ঘটনার উল্লেখ করলেন। তারপর ওনাকে মনে করিয়ে দিলেন যে তছরুপ হওয়া টাকা যাতে সরকার অনুদান হিসেবে সমবায় ইউনিয়নকে দিয়ে দেয় সে’ বাবদ একটি প্রস্তাব ওনাদের দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

বৈদ্যজী শীতল স্বরে ওনাকে বোঝাতে চাইলেন যে সরকার ওই অনুদান না দিলে এটাই বোঝা যাবে যে সরকারি আমলারা সমবায় আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উৎসুক নন।

অফিসারটি বোধহয় ডেল কার্নেগীর বিখ্যাত “প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ” বইটি সদ্য সদ্য পড়েছেন। উনি বৈদ্যজীর প্রত্যেকটি কথায় বলতে লাগলেন “আপনি ঠিক বলেছেন, কিন্তু ----“। এই বাক্যটি উনি সাতবার আউড়েছিলেন। আটবারের সময় ওনার গলার থেকে “আপনি অনুদান পেয়ে যাবেন” গোছের সুমধুর গান ঠিক বেরয় নি। বরং সেই পুরনো হেজে যাওয়া বাক্য-- “আপনি ঠিক বলেছেন, কিন্তু—“।

এবার শোনামাত্র বৈদ্যজীর মধ্যে দুর্বাসা মুনির ক্রোধ, হিটলারের একনায়কত্ব এবং নেহেরুর বিরক্তি একসঙ্গে জেগে উঠল। আর উনি সেই অফিসারের আদ্যশ্রাদ্ধ করতে লাগলেন—“এভাবে দেশোদ্ধার করবেন? এইসব ‘কিন্তু’,’পরন্তু’, ‘অধিকন্তু’, ‘তথাপি’ দিয়ে? এসব কী? শ্রীমান্‌ এগুলো নপুংসকের ভাষা। অকর্মণ্য ব্যক্তি এভাবেই নিজেকে এবং দেশকে বঞ্চিত করে থাকে। আপনার নির্ণয় স্পষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু! পরন্তু! থুঃ”!

বৈদ্যজী থামলেন না। দেশের দুর্দশা নিয়ে এক পেল্লায় লেকচার ঝাড়লেন। তাতেও পুরোপুরি শান্ত না হয়ে খানিকক্ষণ গজগজ করতে লাগলেন। অফিসারটিও অনেক বিনম্র, কিন্তু খানিকক্ষণ গজগজ করলেন। তারপর বাকি সবাই গজগজ করতে লাগল। শনিচরের জলসা তো অনেক আগেই শেষ। কাজেই এই সব গজগজানিতে ওর সাফল্যে কোন কলংকের দাগ লাগেনি। তবে শেষ পর্য্যন্ত গজগজানিরই জয়!

রঙ্গনাথ ওর শহরবাসের সময় এ’ধরণের গজগজানি অনেক শুনেছে। সব সময়, সব জায়গায়। ও জানত যে আমাদের দেশ হল গজগজানির দেশ। অফিসে, দোকানে, কলকারখানায়, পার্ক এবং হোটেলে, খবরের কাগজে, গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধে—যেদিকে তাকাও লোক গজগজ করছে তো করছেই। ও ভাল করে বুঝে গেছল—এটাই আমাদের যুগের চেতনা।

তবে এখানে গাঁয়ে এসেও সেই গজগজানি! চাষিরা সরকারি আমলাদের নিয়ে গজগজ করে। আমলারা প্রথমে জনতার থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়ে জনতার বিরুদ্ধে গজগজ করে। তারপর এক নিঃশ্বাসে নিজেকে সরকার থেকে আলাদা করে সরকারের বিরুদ্ধে গজগজ করে। সবারই কোন না কোন কষ্ট, কিন্তু কেউ দুঃখকষ্টের মূলে যেতে রাজি নয়। কষ্টের যা কিছু তাৎক্ষণিক কারণ চোখে পড়ছে শুধু সেটা নিয়েই যত গজগজানি!

কিন্তু বৈদ্যজী ছিলেন ব্যতিক্রম, কখনও গজগজ করতেন না। আজ রঙ্গনাথের বুক ভেঙে গেল। ও ভেবেছিল মামাজী প্রথমে পবিত্র ক্রোধে গর্জে উঠবেন, ফের শুরু হবে প্রচন্ড বৃষ্টি, মুষলাধার। উনি গর্জে তো উঠেছিলেন, ফের গজর গজর করে বসে পড়লেন।

কেন?

ওই অফিসারটি লেজ নাড়াতে নাড়াতে এবং গজগজ করতে করতে ইশারা করল যে কো-অপারেটিভের তবিল তছরুপের ব্যাপারে স্পেশ্যাল অডিট করানো জরুরী।

রঙ্গনাথ ভাবল—এটা গর্জে ওঠার নয়, বরং গজর গজর করার দেশ।


রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে এক স্থুল কর্কশ আওয়াজ রঙ্গনাথের কানে থাপ্পড়ের মত আছড়ে পড়ল। কুশহরপ্রসাদ নিজের ঘরের চৌকাঠে বসে কাউকে গাল পাড়ছে। ও গজগজকরার দলের বুড়ো নেতা বটেন। কিন্তু ও কান্নাকাটি করছে না এবং ওর গালাগালের লক্ষ্য ওর ছেলে ছোটে পালোয়ান নয়, অন্য কেউ। কাকে গালি দিচ্ছে বোঝা মুশকিল। কারণ, কুশহর যখন ছোটেকে গালি না দিয়ে অন্য কাউকে দেয়, তখন অস্পষ্ট ভাববাচ্যে বলে। যেমন জঙ্গলে ময়ুর নাচে, উদবোধনের সময় নেতাগণ বলে থাকেন।

শব্দ! নিতান্ত জুমলা মাত্র। কুশহরপ্রসাদ থেকে থেকে গরজায়, ফের চুপ মেরে যায়। গাঁয়ের অন্য মুড়োয় একটা নেড়ি কুকুর ভৌ ভৌ করে, তারপর হঠাৎ ক্যাঁ ক্যাঁ করে ওঠে। মনের ভেতর কুকুরটার যে ছবি ফুটে ওঠে তাহল-- লেজ পেছনের দু’পায়ের ফাঁকে, মুখটা বুকের উপর ত্যাড়া হয়ে লটকে আছে, আর ডানদিক থেকে কারও লাঠির বাড়ি খেয়ে এঁকে বেঁকে চলছে। আরও ক’টা কুকুর ডেকে ওঠে।

রামাধীন ভীখমখেড়বী’র বাড়ির দরজা থেকে কোন নবযুবকের চড়া সুরে মিনমিন করে গাওয়া গান ভেসে আসছে। কান পেতে শুনলে বোঝা যায় ওটা কোন যাত্রাপালার গানের কলি।

“তোর মুখের কথা শুনে আমি এই বুঝেছি সার,

প্রেমে পড়েছিস কোন কাঙালের—চিত্ত চমৎকার”।

ও বারবার ওই একটা লাইন গেয়ে চলেছে। গাইতে গাইতে ওর গলা ধরে যায়, স্বর কেঁপে ওঠে। এটা হয়ত দেশি চোলাইয়ের প্রভাব, অথবা সত্যিই সে নিজের প্রেমিকার দুর্ভাগ্যে কাঁদছে। কেন যে এক ভিখিরির প্রেমে পড়ল! গাঁয়ের চার-পাঁচটা বখাটে ছোঁড়া নীচের গলি দিয়ে চলে গেল। গয়াদীনের ঘরে চুরি হওয়ার পর থেকে ওরা পালা করে রাত-পাহারা দেয়। আর “জাগতে রহো” হাঁক পাড়তে পাড়তে কিছু নতুন শ্লোগান তৈরি করে নেয়।

“জাগতে রহো!

সিকি আধুলি রূপোর চাঁদি,

জয় হোক তোমার মহাত্মা গাঁধী”!

সব শ্লোগানই মহা ফালতু। এখন সিকি আধুলির চলন কোথায়? সব তো পঁচিশ আর পঞ্চাশ নয়া পয়সা। সিকি খতম, আধুলি খতম, মহাত্মা গান্ধীও খতম। এরা বুঝে না বুঝে, কিছু না ভেবে স্লোগান দিয়ে যায়। কোথাও একটা রেলগাড়ি যাচ্ছে। ইঞ্জিনের তীব্র সিটি দূরে মিলিয়ে যেতে যেতে এসব শ্লোগানের উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত স্বরকে খানিকক্ষণ চেপে দেয়।

ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসা আওয়াজ আর গাঢ় অন্ধকারের মাঝে কখন যে ঘুম এসে গেছল! ঘুমের মধ্যে রঙ্গনাথের মনে হল ও একটা লিফটে চড়ে দ্রুত বেশ ক’টা তলা ছাড়িয়ে নীচে নামছে। হঠাৎ লিফট এক ঝটকায় তিন চার তলা ছাড়িয়ে উপরে উঠতে লাগল। রঙ্গনাথ ছটফটিয়ে উঠল।

নারকেল তেল আর কোন শস্তা সেন্টের গন্ধ ওর নাকে ঢুকছে। গন্ধটা না ভাল, না বিচ্ছিরি—শুধু গন্ধ মাত্র। চুড়ির হালকা রিনিঠিনি ওর ঘুমন্ত চেতনায় এক ধাক্কা দিল। এক মুহুর্তে ওর এমন অনুভূতি হল যা সারাজীবন খাজুরাহো কোণার্কের শিল্পকলা অধ্যয়ন করেও মানুষ শিখতে পারে না।

মেয়েটি এসে খাটিয়ার এক কোণায় বসেছে। ওর এক হাত রঙ্গনাথের অন্য পাশে। রঙ্গনা্থে বুকে এক জোড়া স্তনের ভারী চাপ। যদিও ওই যুগল স্তন আর ওর বুকের মাঝখানে স্তন ঢাকা কাপড় এবং রঙ্গনাথের লেপ রয়েছে। তবু স্তনের দৃঢ় স্পর্শ এবং উষ্ণতা সব বাধা পেরিয়ে ওকে স্পর্শ করছে। রঙ্গনাথের নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়।

কেউ রঙ্গনাথের মুখের থেকে লেপ সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ঘুরঘুট্টি আঁধারে কেউ কাউকে ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। ওর বুকে বারুদ ভরা উষ্ণ স্পর্শের ছোঁয়া আর চাপ যেন আরও বেড়ে গেছে। তখনই ওর গালের উপর এক কোমল রেশমী গাল নেমে এল। কেউ গহন নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল- ওমা, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?

রঙ্গনাথের ঘুম হাওয়া হয়ে গেছে। ও মাথা নাড়ল আর মুখ থেকে এক অস্বাভাবিক স্বর বেরিয়ে এল—কে? কে তুমি?

এক মুহুর্তের জন্য বুকের উপর চেপে বসা যুগল স্তনের ধুকধুকি থেমে গেল। কেউ এক লাফে খাটিয়া থেকে সরে ছাদের এক কোণে চলে গিয়েছে। চাপা গলায় মেয়েলি স্বরে শোনা গেল—‘হায় মেরী মাইয়া’!

ও মাগো!

মাকে স্মরণ করা খুব ভালো। কিন্তু এখন শুধু ঘাবড়ে গিয়ে মুখ থেকে মাতৃনাম বেরিয়েছে। রঙ্গনাথ লেপ ছুঁড়ে ফেলে উঠে বসেছে। কিন্তু ততক্ষণে অজানা অদেখা মেয়েটি এই ছাত থেকে ওই ছাত, সেখান থেকে সেই ছাত করে-টরে আর কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেছে।

খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ও বারান্দায় এল। বাইরে ঠান্ডা। ও কান খাড়া করে চেষ্টা করল—যদি কিছু শোনা যায়। কিন্তু হাওয়ার সরসরানি ছাড়া আর কিছু পেল না। যে এসেছিল তার “‘হায় মেরী মাইয়া’ বলে মাতার পবিত্র নাম স্মরণের পরে আর কিছু বোঝার বাকি ছিল না।

দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে ফের খাটিয়ায় শোয়ার সময় ওর কিছু ব্যাপার মাথায় ঢুকল।

প্রথম, কোণার্ক, ভুবনেশ্বর, খাজুরাহোর নারীমূর্তির উরোজ যদি পাথরের রূপ ছেড়ে কারও বুকে চেপে বসে তাহলে কাউকে পাগল করার জন্যে যথেষ্ট।

দ্বিতীয়, পুরাতত্ত্ব এবং ভারতীয় শিল্পকলা নিয়ে আজ অব্দি যা পড়েছে সব ফালতু, ভুলে ভরা।

তৃতীয়, ভারতীয় শিল্পকলায় ডক্টরেট করার চেয়ে সুরলোকের সুন্দরীদের মত দুই জীবন্ত স্তনের আশ্রয় পাওয়া সফলতার পরাকাষ্ঠা।

আর এসব হালকা এলোমেলো কথার আড়ালে যে আসল কথা, যে আফশোস ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে তা হল—শ্রীমান, আপনি একটা বোকাপাঁঠা! চেঁচানোর কী দরকার ছিল? ঘাবড়ে গেলে কেন? ওকে আরও কিছু করার সুযোগ দিয়ে দেখতে? তা না---!

শ্রীমান, আপনি শুধু বোকাপাঁঠাই নন, একটা গাধাও বটেন।

শ্রীমান, আপনি ওসব কিস্যু না। শুধু একজন সাধারণ হিন্দুস্তানী ছাত্র, ব্যস্‌। যার কপালে শুধু মেয়েদের ছবিই সম্বল।

অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও ঘুম এল না। একবার কিছু না ভেবেই নিজের বুক ছুঁয়ে দেখল। নাঃ, ওখানে কিছু নেই। শুধু নিজের রোমশ বুক।

কে মেয়েটি? ভাবার চেষ্টা করল, কিন্তু বৃথা। ওর চেতনা আচ্ছন্ন করে জোড়া পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে যে!

(চলবে)