প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সৈকত মণ্ডল
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধবাল্মীকি রামায়ণে অনেকগুলি উপেক্ষিত চরিত্রের মধ্যে শান্তা অন্যতম। কাব্যে তিনি ঠাঁই পেয়েছেন শুধু আদিকাণ্ডেই। তার পরিধি খুবই সামান্য, কিন্তু রামায়ণ কাব্যে তাকে নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। রামায়ণে তিনি ঠিক কার কন্যা সেটাই একটা রহস্য। তিনি ঋষ্যশৃঙ্গের পত্নী। এই ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির সাহায্য নিয়ে রাজা দশরথ পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেন ও ফলস্বরূপ তাঁর চারটি পুত্র হয়। রামায়ণ ব্যতীত অন্যত্র কবিরা শান্তাকে কেমন ভাবে দেখেছে এই সমস্ত দিক গুলো নিয়ে এই লেখাটির বিষয়বস্তু, তবে শুরুতে বাল্মীকি রামায়ণে শান্তার জন্ম নিয়ে আলোচনা করা যাক।
বাল্মীকি রামায়ণের লিখিত রূপে সমস্ত ভারতবর্ষে যতগুলি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়, সেটিকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই বিভাজন পন্ডিতরা করেছেন লিপি ও তাদের মধ্যে সম্পর্ক অনুযায়ী। সংস্কৃত ভাষার নিজস্ব কোনো হরফ / স্ক্রিপ্ট নেই। এটি যে কোনো লিপিতে লেখা যায়। এমনকী রোমান হরফেও। দক্ষিণ ভারতের লিপি - গ্রন্থ, তেলুগু ও মালায়লমে - যে সমস্ত বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে, তাদের একাডেমিক ভাষায় বলা হয়েছে দক্ষিণ /সাউথ রিসেন্সন। সহজ ভাবে বললে দক্ষিণ ভারতের বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপি। দক্ষিণের পাণ্ডুলিপির মধ্যে পাঠান্তর থাকলেও মোটামুটি ভাবে টেক্সটগুলির মধ্যে তেমন বিশেষ ফারাক নেই। তার উপর দক্ষিণের পন্ডিতদের (ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের) মধ্যে একটা সুদীর্ঘ্য কাল ধরে রামায়ণের উপর টীকা লেখার চল ছিল। মধ্যযুগের পন্ডিত গোবিন্দরাজ ও তিলকদের টীকা ও টেক্সট কালের প্রবাহে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর মধ্যে তিলকের টেক্সট (যার মধ্যে বাল্মীকি রামায়ণের টেক্সট ও তিলকের নিজের টীকা আছে) প্রচলিত টেক্সট / ভালগেট টেক্সট হিসেবে পরবর্তী কালে মান্যতা পায়। তেমনি ভাবে উত্তর ভারতের পাণ্ডুলিপি রয়েছে বাংলা, মৈথিলি, কাশ্মীর, ওড়িয়া, ও নেপালি লিপিতে। এরা হলো নর্থ রিসেন্সন। এই নর্থ রিসেন্সন আবার দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটি গৌড়-বঙ্গ থেকে নেপালের ধারা নিয়ে বয়ে চলেছে, অর্থাৎ ভারতের নর্থ-ইস্ট রিসেন্সন, অন্যটি কাশ্মীর থেকে পাকিস্তান (বিভাজনের আগে) হয়ে, অর্থাৎ নর্থ-ওয়েস্ট একটা আলাদা ঘরানায় গড়ে উঠেছে। দেবনাগরী লিপি নর্থ ও সাউথ দুটোতেই পাওয়া যায়। নর্থ ও সাউথের টেক্সট মোটামুটি ভাবে একই থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে কাহিনী স্তরে ও শ্লোক গঠনে তফাৎ পরিলক্ষিত হয়। ঠিকই এমনই একটি আকর্ষক অংশ হলো শান্তার জন্ম রহস্য।
প্রচলিত টেক্সটে (অষ্টম সর্গ থেকে) আমরা জানতে পারি রাজা দশরথ অপুত্রক। তিনি পুত্রলাভের আশায় সুমন্ত্র (প্রধান মন্ত্রী) ও বিভিন্ন পন্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করছেন একটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করার। সরযূ নদীর উত্তরতীরে যজ্ঞানুষ্ঠানের উপযুক্ত ভূমি নির্মাণ করে, একটি অশ্বকে ভ্রমণের জন্য ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। তারপর সুমন্ত্র রাজাকে গোপনে একটি কাহিনী বলেন। তিনি ঋষিগণকর্তৃক কথিত একটি শ্রুতি-কাহিনী শুনেছিলেন বহু পূর্বে -- ব্রহ্মার পুত্র সনৎকুমার ঋষিদের জানিয়েছিলেন কীভাবে রাজা দশরথ পুত্রলাভ করতে পারবেন। গল্পটি এরকম: কাশ্যপ মুনির একটি পুত্র আছেন, যিনি বিভান্ডক নামে প্রসিদ্ধ। তার পুত্র হলো ঋষ্যশৃঙ্গ যার ব্রহ্মচর্য্যের গুন সংসারে প্রসিদ্ধিলাভ করেছিল। সমসাময়িক অঙ্গদেশে রোমপাদ নামে এক মহাপ্রতাপশালী রাজা রাজ্যপালন করতেন। তার দুরাচরণের জন্য অঙ্গরাজ্যে দারুন অনাবৃষ্টি হয়। এর থেকে মুক্তির পথ একটাই বেরিয়ে আসে, সেটি হলো ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে যেভাবেই হোক অঙ্গরাজ্যে নিয়ে আসতে হবে, এবং তার সঙ্গে রাজার কন্যা শান্তাকে বিধিপূর্বক সম্প্রদান করতে হবে - "প্রযচ্ছ কন্যাং শান্তাং বৈ বিধিনা সুসমাহিত (১/৯/১৩)"।
এই প্রথম আমরা জানতে পারলাম শান্তার কথা। উনি রাজা রোমপাদের কন্যা। তারপর ছলের দ্বারা (বার্বনিতা দের সাহায্যে) ঋষ্যশৃঙ্গকে রাজ্যে আনা হলো, এবং তিনি নগরে পা দেওয়া মাত্রই বৃষ্টি আরম্ভ হলো। ঋষিকে এভাবে ছলনাপূর্বক আনয়ন করার ফলে তার অন্তরে যেন ক্রোধের উদয় না হয়, তাই বিধি অনুসারে শান্তাকে শুদ্ধমনে সমর্পণ করে রাজা আনন্দ লাভ করলেন। সুমন্ত্র দশরথকে বলেন ঐ "জামাতা" ঋষ্যশৃঙ্গ আপনার পুত্রপ্রাপ্তিসম্পাদন করতে পারবেন (১/৯/১৯)। এটাকে দুটিভাবে ব্যখ্যা করা যায়। রোমপাদের মেয়ে-জামাই যেন দশরথেরও মেয়ে-জামাই তুল্য। সনৎকুমার এটাও বলেছিলেন যে ইক্ষ্বাকু বংশে দশরথ নামে একজন সত্যনিষ্ঠ রাজা জন্মাবেন, দশরথ নামে, এবং অঙ্গরাজ্যের রাজা রোমপাদের সঙ্গে তার মিত্রতা হবে। তাই মিত্রের কন্যা-জামাইকে নিজের মেয়ে-জামাই ভাবতে দোষ কোথায়? দ্বর্থক অর্থে তেমনি এটাও হতে পারে, শান্তা হয়তো রাজা দশরথের কন্যা। উনি রোমপাদকে তার কন্যা দান করেছিলেন।
সনৎকুমারের কথা অনুযায়ী দশরথ রোমপাদের কাছে গিয়ে বলবেন - "আমি নিঃসন্তান। আপনার জামাতা, শান্তার স্বামী, ঋষ্যশৃঙ্গকে আপনার আদেশমত যজ্ঞ করতে বলুন। সেটা হলে আমার বংশরক্ষা হয় (১/১১/৪-৫)"। ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি আসবেন, যজ্ঞ করবেন ও রাজার চারটি পুত্র হবে। এই শুনে রাজা দশরথ তার তিন স্ত্রী ও অন্তঃপুরস্থিত মহিলাগণদের সঙ্গে নিয়ে অঙ্গদেশে উপস্থিত হলেন। ওখানে সাত-আটদিন কাটানোর পর, একদিন দশরথ তার মিত্রকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললেন - "আপনার কন্যা শান্তা পতিসহ মদীয় নগরী অযোধ্যায় গমন করুন - শান্তা তব সুতা রাজন্! সহ ভর্ত্রা বিশাংপতে (১/১১/১৯)"। রোমপাদ অনেক ভাবনা চিন্তা করে ঋষ্যশৃঙ্গকে বললেন - "তাই হোক, তুমি পত্নীর সহিত গমন করো।"
রামায়ণের একজন বিখ্যাত স্কলার ও অনুবাদক রালফ গ্রিফিথের এই অংশটির অনুবাদ পড়লে মনে হয় শান্তা যেন দশরথের নিজ কন্যা।
“This king,” he said, “from days of old
A well beloved friend I hold.
To me this pearl of dames he gave
From childless woe mine age to save,
The daughter whom he loved so much,
Moved by compassion's gentle touch.
In him thy Śántás father see:
As I am even so is he."
(Canto X)
শান্তা ও ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি দীর্ঘ্য সময় অযোধ্যায় কাটিয়েছিলেন। ঋষ্যশৃঙ্গর তত্ত্বাবধানে অশ্বমেধ ও পুত্রেষ্টি যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। এবং তাদের দুজনই বিশেষভাবে পূজিত হয়ে আবার অঙ্গদেশে ফিরে যায়। তাহলে লক্ষ করলে দেখা যাবে প্রচলিত টেক্সটে দু-একটি জায়গায় হাল্কা ইঙ্গিত থাকলেও কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই শান্তা দশরথের মেয়ে। এমনকী তিনি রোমপাদকে তার কন্যা দান করেছেন একথা কোথাও উল্লেখ নেই।
এবার নর্থ রিসেন্সন দেখা যাক। এখানকার পাণ্ডুলিপিতে অঙ্গদেশের রাজার নাম রোমপাদ নয়, বরং লোমপাদ - "এতস্মিন্নেব কালে তু লোমপাদঃ প্রতাপবান্ (১/৮/১১)"। দশম সর্গতে সুমন্ত্র জানায় তিনি সনৎকুমারের শ্রুতিকথনে জেনেছিলেন অঙ্গরাজ লোমপাদের সঙ্গে রাজা দশরথের মিত্রতা হবে। রাজা দশরথের শান্তা নামে সৌভাগ্য-শালিনী একটি কন্যা জন্মলাভ করবে।
ইক্ষাকুবংশজো রাজা ভবিষ্যতি মহাযশাঃ।
নাম্না দশরথো নাম ধীমান্ সত্যপরাক্রমঃ॥২॥
সখ্যং তস্যাঙ্গরাজেন ভবিষ্যতি মহাত্মনঃ।
কন্যা চাস্য মহাভাগা শান্তা নাম ভবিষ্যতি ॥৩॥
অঙ্গরাজের কোনো সন্তান হবে না। তিনি রাজা দশরথের নিকট প্রার্থনা করবেন - "সখা, আমি নিঃসন্তান। তুমি প্রসন্ন মনে তোমার এই শান্তা নাম্নী অসামান্য-রূপ-লাবন্যবতী তনয়া আমাকে প্রদান কর - আমি "পুত্রিকা" করব। করুনহৃদয়ের রাজা তার হৃদয়-নন্দিনীকে প্রদান করবেন (১/১০/৫-৮)"।
দশরথ ও ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির সামনে, লোমপাদ আরো বলেন - "ঋষিকুমার! এই রাজা দশরথ আমার পরম-প্রিয় সখা। আমার সন্তান না হওয়াতে আমি "পুত্রিকা করবার নিমিত্ত" ইঁহার আত্মজা বরবর্ণিনী শান্তাকে যাচঞা করেছিলাম। ইনিও তৎক্ষণাৎ অক্ষুব্ধ-হৃদয়ে এই প্রিয়তমা কন্যা আমায় প্রদান করেছিলেন। আমার ন্যায় এই দশরথও সম্পর্কে আপনার শ্বশুর হন। আপনি শান্তাকে নিয়ে অযোধ্যায় গমন করুন (১/১০/২৫-২৯)"।
তাহলে নর্থ রিসেন্সন (সমগ্র উত্তর ভারতের বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপিতে) রামায়ণে পরিষ্কার উল্লেখ পাই শান্তা দশরথেরই কন্যা। রামায়ণের শুদ্ধ সংস্করণ (ক্রিটিক্যাল এডিশন) এক্ষেত্রে দক্ষিণের পাঠ রেখে দিয়েছে। ক্রিটিক্যাল এডিশন রামায়ণের টেক্সট গঠনের মেথড একটু ভিন্ন ক্রিটিক্যাল এডিশন মহাভারতের টেক্সট গঠনের থেকে। মহাভারতে যেমন শারদা (কাশ্মীর) ও মালায়লম লিপিকে একটা একটা base ধরে বাকি পাণ্ডুলিপির প্রক্ষেপ ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছে (এটা খুবই সরল ভাবে বলা হলো, আসল প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল), রামায়ণের ক্ষেত্রে সেরকম নয়। এখানে দক্ষিণের টেক্সটের ৭৫% রাখা হয়েছে এবং সেই অংশগুলো দক্ষিণের টেক্সট থেকে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে যেগুলো উত্তর ভারতে সাক্ষ্য দেয় না। কিন্তু উত্তর ভারতে যদি কোনো অংশ এক্সট্রা থাকে যেটা আবার দক্ষিণে সাক্ষ্য দেয় না, সেক্ষেত্রে তারা সেটিকে বাদ দিয়েছে, তাদের মেথড এটাকে প্রক্ষেপ বলে মনে করে।
এখানে সমস্যাটি আরো গভীর। তার কারণ বহু রামায়ণ গবেষকদের মতে আদিকান্ডের বেশ অনেক অংশ পরের সংযোজন। জন ব্রকিংটন Rama the Steadfast: The Early Form of Ramayana তে লিখছেন গোটা আদিকান্ড টাই পরে যোগ হয়েছে। ওঁর মতে রামায়ণের একদম প্রাথমিক স্টেজে মূল কবির হাতে আদিকান্ড রচনা হতে পারে না, এবং এই ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত বলা যায় না। হার্মান জেকবি, কামিল বুলকে, রবার্ট গোল্ডম্যান, চিন্তামনি বৈদ্য, ক্রিটিক্যাল এডিশনের প্রত্যেকটি এডিটর ও আরো অনেক পন্ডিতরাই মনে করেন আদিকান্ডের মধ্যেও অনেক স্তর আছে যেগুলির সময়কাল ইতিহাসের মেথড দিয়ে বের করা সম্ভব। ব্রকিংটনের মতো পুরোটাই পরে রচিত হয়েছে না বলে, বেশিরভাগ পন্ডিত এটাই বলেন শুরুতে আদিকান্ডের খুব অল্প অংশ মূল কাব্যের অন্তর্গত ছিল।
জেকবি তার বিখ্যাত বই Das Ramayana তে লিখছেন রামের জন্ম ও গোটা ঋষ্যশৃঙ্গ অধ্যায়টাই পরের সংযোজন। উনি মনে করেন কাব্যের নায়কের জন্মের একটা সংক্ষিপ্ত কাহিনী হয়তো একটি ছিল, কেমন আকারে জানা নেই, কিন্তু সেটা কোনো অজ্ঞাত কারণে হারিয়ে গেছে। সেটাকে পূরণ করতে এরকম একটি কাহিনীর অবতারণা করতে হয়েছে যেখানে বিষ্ণু নিজে অবতার রূপ ধারণ করে দসরথের পুত্র হয়ে জন্মাবেন। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে রাম শুরুতে বিষ্ণুর অবতার ছিলেন না, এটির ধারণা টেক্সটে ঢুকছেন অনেক পরে, যখন বিষ্ণু-কাল্ট ভারতে পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ক্রিস্টপূর্ব ৭০০-৬০০ তে এই কাব্যের গোড়ার স্টেজে (গোল্ডম্যান বালকাণ্ডের ভূমিকা) লেটার-বৈদিক পটভূমিকায় বিষ্ণু অবতার রূপে কখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন না। ফলে রামের জন্মের পুরো অধ্যায়টাই হয়তো পরে রচিত হয়েছে, এমনটা অনেকেই মনে করেন। সেক্ষেত্রে, শান্তার কাহিনীও পরে যোগ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তবে এটা বলাটা খুবই মুস্কিল নর্থ রিসেন্সনে বর্ণিত অংশগুলি সম্পূর্ণরূপে প্রক্ষেপ কিনা। এটা বলা যায় না কারণ কোনো রাজা নিজের কন্যা অন্য মিত্র রাজাকে দান করেছেন, এরকম উদাহরণ আমরা মহাভারতেও দেখেছি, কুন্তীর ক্ষেত্রে। তেমনি রোমপাদ / লোমপাদ যদি পুত্রিকা হিসেবে কন্যাকে গ্রহণ করেন, সেক্ষত্রে ব্যাপারটি খুবই ইন্টারেস্টিং হয়ে যায়। একটু বিশদে আলোচনা করা যাক।
মহাভারতে রামকথার একটি অংশ পাওয়া যায় বনপর্বে। ওটি ছাড়াও সমগ্র মহাভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক উপাদান আছে যেগুলিকে রামায়ণের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। তীর্থযাত্রা পর্বে (৩/১১০) আমরা জানতে পারি অঙ্গদেশের রাজার নাম লোমপাদ। মূল কাহিনীটি মোটামুটি রামায়ণের সঙ্গে এক, শুধু এখানে ঋষ্যশৃঙ্গকে ছলনা করে এনে মেয়েদের কক্ষে রাখা হয়েছিল। বিভান্ডক ঋষি তার পুত্রকে না খুঁজে পেয়ে রেগে আগুন হয়ে যায় এবং বুঝতে পারে তার পুত্রকে অঙ্গরাজ নিয়ে গেছে। কিন্তু পরে তার মন গলে যায়। রাজাকে বলে শান্তার গর্ভে সন্তান আসার পর ঋষ্যশৃঙ্গ যেন বনে ফিরে আসে। বাধ্য সন্তানের মত ঋষ্যশৃঙ্গ বনে ফিরে যেতে চাইলে শান্তাও তার সঙ্গে পতিব্রতা নারীর মত সঙ্গ দিতে চায়। সেক্ষেত্রে শান্তার সন্তান অঙ্গরাজ্যেই রয়ে যায় (অনুমান করা যায়), এবং ঋষ্যশৃঙ্গ-র পরের সন্তান (অনুমান করা যায়) শ্বশুরের বংশের দ্বীপ হয়ে জন্মলাভ করার কথা। পুত্রিকা হলো সেই কন্যা যার সন্তান তার মায়ের বংশের উত্তরাধিকারী হবে। অনেক ক্ষেত্রে সেই নারী ক্ষতিকারক হতে পারে যে বংশে তার বিয়ে হচ্ছে তাদের কাছে। মহাভারতে এই উদাহরণ প্রচুর আছে - চিত্রাঙ্গদা, সাবিত্রী, ইত্যাদি। যেমন চিত্রাঙ্গদা ছিলেন পুত্রিকা। অর্জুন তাকে বিয়ে করতে চাইলে চিত্রাঙ্গদার বাবা বলেন তার একমাত্র কন্যার পুত্র-ই এই বংশের রাজা হবে। অর্জুন সেটি জানা সত্ত্বেও তাকে বিবাহ করে। তাদের পুত্র হয় বভ্রুবাহন। এই বভ্রুবাহন কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি। কিন্তু পরে বাবা আর ছেলের মধ্যে যুদ্ধ হয় (অনেকটা পারস্য কাব্যের শাহনামের সোহরাব ও রোস্তমের কাহিনীর মত) এবং সেখানে অর্জুন মারা যায়। আবার সে অলৌকিক ভাবে উলুপির (তার অন্য একটি পত্নী) কৃপায় বেঁচে হস্তিনাপুরে ফিরে আসে। সেখানে তার বিধবা পুত্রবধূ পরীক্ষিত নামে একটা সন্তানের জন্ম দেয় ও যুধিষ্ঠিরের পরে সেই বংশের রাজা হয়। কিন্তু যেসব ব্যক্তির অর্জুনের মত একাধিক পত্নী নেই এবং একটি মাত্র স্ত্রী-ই যদি পুত্রিকা হয়? তাই শান্তার বিষয়টি খুবই আকর্ষক। এটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার যে শান্তা তার স্বামীর সঙ্গে বনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রামায়ণে এরকম কোন ইঙ্গিত নেই। তেমনি মহাভারতের রামোপাখ্যান অংশে পুত্রেষ্টি যজ্ঞেরও উল্লেখ নেই।
তাহলে কী দাঁড়ালো?
রামায়ণের ভিন্ন রিসেন্সনে শান্তার জন্ম নিয়ে পাঠ্ভেদ আছে। প্রচলিত টেক্সট শুধু এটুকুই বলে দশরথ ও রোমপাদ ছিলেন ভালো বন্ধু, এবং শান্তা রোমপাদের কন্যা (১/৯/১৩ ও ১/১১/১৯)। যখন শান্তা অযোধ্যায় আসে ওর স্বামীর সাথে টেক্সট কিন্তু বলেনি যে সে তার বাপের বাড়ি ফিরে আসছে, বা শান্তার দিক থেকেও কোনো প্রতিক্রিয়া কবি জানায়নি, যেটা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। তেমনি টেক্সট এটাও বলে দশরথ অনপত্য (১/১১/৫) অর্থাৎ নিঃসন্তান ছিলেন। এমনকী নর্থ রিসেন্সনে শান্তাকে লোমপাদের কন্যাও বলা হয়েছে (গৌড়ীয় ১/৮/২৬; লাহোর এডিশন ১/৮/২৫)। মহাভারতে শান্তা লোমপাদেরই কন্যা এবং কবি জানাচ্ছেন না যে দশরথ তাঁর পুত্রীকে দান করেছিলেন (৩/১১০/৫; ১২/২২৬/৩৫ ও ১৩/১৩৭/২৫)। তেমনি হরিবংশ পুরাণ (১/৩১/৪৬), মৎস্য পুরাণ (৪৮/৯৫), বায়ু পুরাণ (১১/১০৩) এগুলিতে শান্তাকে লোমপাদের মেয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে দক্ষিণী পাঠের মধ্যেই সুমন্ত্রের কথায় আমরা ইঙ্গিত পাই (১/৯/১৯) যে শান্তা হয়তো দশরথের কন্যা ছিলেন। তেমনি (১/১১/২-৩) শ্লোক গুলি খুবই ইনটারেস্টিং।
ইক্ষাকূণাং কুলে জাতো ভবিষ্যতি সুধার্মিক:৷
রাজা দশরথো নাম্না শ্রীমান্সত্যপ্রতিশ্রব: II
অঙ্গরাজেন সখ্যং চ তস্য রাজ্ঞো ভবিষ্যতি৷
কন্যা চাস্য মহাভাগা শান্তা নাম ভবিষ্যতি ৷৷
ক্রিটিক্যাল এডিশন টেক্সট "অস্য" রেখেছে যেটা অঙ্গরাজকে ইঙ্গিত করে, কিন্তু দক্ষিণের প্রচুর পাণ্ডুলিপিতে এটি আছে "তস্য"। উত্তর ভারতের লিপিগুলোতে তো আছেই (ক্রিটিক্যাল এডিশন ফুটনোট - ১/১০/৩) তস্য, যেটা পরিষ্কার ইঙ্গিত করে শান্তা দশরথের কন্যা। নর্থ রিসেন্সনে ঠিক এই শ্লোকের পরে আমরা জানতে পারি কোন পরিস্থিতিতে রাজা দশরথ শান্তাকে দান করেছিলেন (পূর্বেই লিখেছি - ১/৯/৪-৫)।
এই সমস্যার মূল উৎপত্তি হয়তো অন্যত্র। হরিবংশ, মৎস, বায়ু ও ব্রহ্ম পুরাণে অঙ্গরাজার নাম চিত্ররথ। তার পুত্রের দুটি নাম - লোমপাদ ও দশরথ। এমনটি হয়তো হয়েছিল শান্তা প্রথমে অঙ্গের রাজা দশরথের কন্যা ছিল, কিন্তু ততদিনে অজের পুত্র দশরথ খুবই জনপ্রিয় রাজা হয়ে উঠেছেন। এবং তার পর থেকে শান্তা দশরথের কন্যা বলেই পরিচিতি লাভ করেছে। তেমনি বিষ্ণু পুরাণ (৪/১৪/১৪), ভাগবত পুরাণ (৯/২৩/৮), ভবভূতির উত্তররামচরিত, স্কন্দ পুরাণ, পদ্ম পুরাণের পাতালকান্ড, আনন্দ রামায়ণ (১/১/১৬-১৭), সরলা দাসের ওড়িয়া মহাভারতে শান্তা দশরথের কন্যা। ১৬-শতাব্দী বলরাম দাসের রামায়ণে আমরা প্রথম জানতে পারি শান্তা হলো কৌশল্যার মেয়ে। কৃত্তিবাস রামায়ণে (১/২৯) দশরথ তার কন্যাকে দান করেন লোমপাদকে। মেয়েটির নাম হেমলতা। অনুমান করতে অসুবিধা হয়না ইনিই শান্তা। চন্দ্রাবতীর রামায়ণে ও কাশ্মীরি রামায়ণে আমরা পাই কৈকেয়ীর একটি কন্যার কথা যে সীতাকে সহ্য করতে পারতো না। একই থিম আমরা পাই সুবর্চ রামায়ণে যেখানে সীতা শান্তাকে অভিশাপ দেয়। ইন্দোনেশিয়ার "হিকায়েত সেরি রাম" এ শান্তা হলো ভরত-শত্রুঘ্নর নিজের বোন। সিয়াম এর রাম-জাতকে শান্তার বিয়ে হয় রাবণের সঙ্গে। তেমনি প্রাচীন পালি টেক্সট দশরথ জাতকে সীতা রাজা দশরথের মেয়ে। ফলে দশরথের কন্যা ছিল এটা এনটিকুইটি সাক্ষ্য দেয় -- বাল্মীকি ও অন্যান্য রামকথায় আমরা পাই। তবে সব থেকে বিচিত্র কাহিনী পাওয়া যায় মাধবদাসের বিচিত্র রামায়ণে। ওখানে এক ঋষি রাজাকে অভিশাপ দেন ও বলেন সে নিঃসন্তান হবে। পরে আবার দেখা হলে ও রাজা ক্ষমা চাইলে, ঋষি অভিশাপ পাল্টে ফেলে বলেন তার প্রথম সন্তান একটি কন্যা হবে এবং তার বিয়ে হবে ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে। তারপর ঋষ্যশৃঙ্গ যজ্ঞ করলে তার চারটি সন্তান হবে। তারপর শান্তার বিবাহের বয়স উপস্থিত হয়ে স্বয়ম্বর আয়োজন করা হয়। সেখানে হঠাৎ উপস্থিত হন পরশুরাম। তিনিই বলেন শান্তার সঙ্গে ঋষ্যশৃঙ্গের বিবাহ দেওয়া হোক।
পাঠ্যসূচী
কৃতজ্ঞতা স্বীকার - যে দুজন ব্যক্তি আমাকে উপকার করেছেন এটি লিখতে, রবার্ট গোল্ডম্যান ও কনাদ সিংহ।
১) আকর সূত্র
পঞ্চানন তর্করত্ন - রামায়ণম
আর্য্যশাস্ত্র - বাল্মীকি রামায়ণ
রামায়ণ সারানুবাদ - রাজশেখর বসু
বাল্মীকি রামায়ণ ক্রিটিক্যাল এডিশন - Vol 1
রবার্ট গোল্ডম্যান - The Ramayana of Valmiki vol 1
ভগবৎ দত্ত - The Ramayana of Valmiki (North West Recension)
অমরেশ্বর ঠাকুর - বাল্মীকি রামায়ণম
এম এন দত্ত - দি মহাভারত (vol 2)
বিষ্ণু সুকথঙ্কর - ক্রিটিক্যাল এডিশন মহাভারত (আরণ্যক পর্ব)
জন স্মিথ - দি মহাভারত
রালফ গ্রিফিথ - The Ramayana of Valmiki
এম এন দত্ত - হরিবংশ
সাইমন ব্রডব্রেক - Krishna's lineage: The Harivamsa of Vyasa's Mahabharata
শান্তি লাল নগর - আনন্দ রামায়ণ
২) রামায়ণের টেক্সট গঠন
জন ব্রকিংটন - Rama the Steadfast: The Early form of Ramayana
হার্মান জেকবি - Das Ramayana
এল এ ভ্যান ডালেন - Valmiki's Sanskrit
রবার্ট গোল্ডম্যান - Vol 1 ভূমিকা
জি এস আলটেকর - Studies on Valmiki Ramayana
৩) পুত্রিকা
কনাদ সিংহ - From Dasrajana to Kurukshetra
সাইমন ব্রডবেক - Putrika interpretation of the Mahabharata
সাইমন ব্রডবেক - The Mahabharata Patriline
৪) ভিন্ন রামকথা
ভি রাঘবন - The Ramayana tradition in Asia
ভি রাঘবন - The Greater Ramayana (পুরাণ নিয়ে আলোচনা)
শ্রীনিবাস আইয়েঙ্গার - Asian variations in Ramayana
কামিল বুলকে - অনুবাদ প্রদীপ ভট্টাচার্য: The Rama Story - Origins and Growth
অভদেশ কুমার সিংহ - Ramayana through the ages