Next
Previous
0

প্রবন্ধ - রূপশ্রী ঘোষ

Posted in






প্রেম কি শুধুমাত্রই অপর একজনের প্রতি মনের আর্তি? অপর একজনের সঙ্গে গভীর সংযোগের আবিষ্কার? না কি প্রেম এমন একধরনের মহাজাগতিক সংযোগ, যা আবিষ্কার করলে এই মহাজগতের এক ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো অস্তিত্ব হিসেবে অনুভব করা যায় নিজস্ব অবস্থানের মাহাত্ম্য। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, এই যে মাহাত্ম্য শব্দটি উচ্চারণ করলাম, তা কি নিজের অহংকে এক বিন্দু হলেও বাড়িয়ে দিল? না কি এই অনুভূতিমালা নিজেকে আরও ক্ষুদ্র এক অস্তিত্বেই পরিণত করল? এমন এক ক্ষুদ্র অস্তিত্ব, যা আসলে এক অখণ্ড অস্তিত্বের অংশ। নিজের খণ্ড অস্তিত্বকে অখণ্ড অস্তিত্বের মধ্যে প্রকাশিত হতে দেখাই মনে হয় এই জীবনের এক মহার্ঘ্য অনুভূতি। প্রেম, এই অনুভূতি দেয় আমাদের। যেমন দেয় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা, যেমন দেয় একাকী এই প্রকৃতির মধ্যে অবগাহন। কিন্তু কীভাবে? আমাদের চারপাশে শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা বা প্রেমের কবিতার সংকলন প্রচুর দেখতে পাই আমরা। অনেকের অনেক প্রেমের কবিতার সংকলন রয়েছে আবার রয়েছে কবিতার সংকলনের মধ্যে বহু প্রেমের কবিতা। সেই সব প্রেমের কবিতা কালজয়ী। কিন্তু এখানে একটা ছোট্ট অভিযাত্রা হতে আমাদের। তিনজন কবির মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ এবং বিনয় মজুমদার। তবে, আলোচনার প্রসঙ্গে যে অন্য কবিদের আমরা ছুঁয়ে যাব না, তাও নয়।

রবীন্দ্রনাথের কথাই যদি ধরি, তিনি প্রেম এবং পূজাকে একত্র করে দিয়েছিলেন। এই একই অনুভূতি আমরা বৈষ্ণব পদাবলীতে বা মীরার ভজনেও পাই, পাই সূরদাসের ভজনে বা কবীরের দোঁহায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রেম শুধুই ভগবৎ দর্শনের মধ্যে একাত্ম হওয়া নয়। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের মধ্যে যে ‘তুমি’, সেই ‘তুমি’ আমারই তো এক অখণ্ড অংশ। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর কবিতায় বা গানে এই তুমির মধ্যে সমগ্রের এক বিস্তার ঘটান, তখন সেই ‘তোমার’ মধ্যে নিজেকেও প্রসারিত হয়ে যেতে দেখি। এ প্রসঙ্গে ‘তুমি আমার সাধের সাধনা’ যখন রবীন্দ্রনাথ বলছেন ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ শীর্ষক গানে, তখনই বুঝতে অসুবিধা হয় না, কীভাবে, রবীন্দ্রনাথ প্রেমিকার সঙ্গে এক অদ্বৈত সম্পর্ক তৈরি করে নিচ্ছেন। কিন্তু এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমি তো তার জন্যই সাধনা করছি, যে ‘আমি’ নই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রেমে নিজেকে তার মধ্যে খুঁজে পাওয়ার বেদনা এবং চেতনাই মনে হয় সেই কবিতা, যা আমাদের প্রেমের এক বিস্তারিত আকাশের দিকে নিয়ে চলে গেল। এখানে এসে প্রশ্ন আসতেই পারে, তবে প্রেমের কবিতা মানেই আধ্যাত্মিক কবিতা? এখানে বলতে বাধ্যই হচ্ছি, আধ্যাত্মিকতা এবং ধার্মিক ভাবনার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রেম অবশ্যই এক আধ্যাত্মিক সম্পর্ক, যে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক আমাদের শরীরকে সাধনার এক অংশ হিসেবেই ব্যবহার করে। ঠিক যেমন, এই শরীরটা আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি, তেমনই, শরীর আছে বলেই প্রেমের প্রকাশ সম্ভব হচ্ছে। একটি অব্যক্ত অনুভূতি, ব্যক্ত হচ্ছে। এই অব্যক্ত অনুভূতির তো ব্যক্ত হয়ে ওঠার প্রয়োজন আছে বলেই জগতের সৃষ্টি এবং তার প্রকাশ। এই দেখুন, এই কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মনে পড়ে যেতে পারে জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত পংক্তি- ‘ আমরা যাইনি মরে আজো, তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’। কিংবা মনে হতে পারে, জীবনানন্দ যে হাজার বছর ধরে পথে হেঁটে যাওয়ার কথা বলছেন, বলছেন, সব পাখি ঘরে ফেরে, সব নদী, আর তারপর থাকে পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। ভাবুন আকাশলীনা কবিতাটির কথাও, যেখানে জীবনানন্দ প্রায় তার্কোভস্কির দ্য স্যাক্রিফাইসের লং শটের মতো ‘আকাশের ওপারে আকাশ/ বাতাসের ওপারে বাতাস’-এর রচনা করেছেন। জীবনানন্দের প্রেম কি আধ্যাত্মিক নয়? অনেক গভীর ভাবে আধ্যাত্মিক, তা না হলে তিনি প্রায় উত্তরাধুনিক এক প্রশান্তিতে এমন এক দৃশ্যের ব্যঞ্জনা তৈরি করেছেন –“ এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে—জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা”। এই যে ‘-‘- এর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জীবনানন্দ এক অব্যক্তকে ব্যক্ত করলেন, তা আধ্যাত্মিকতার সংযোগ ছাড়া সম্ভব ছিল না।

তবে, আমরা মনে হয় এই জায়গা থেকে প্রেমের কবিতার দিকে তাকাতে পারি। সার্থক প্রেমের কবিতা কিংবা গান, আধ্যাত্মিক হতে বাধ্য। তা আধ্যাত্মিক, কারণ তা সময় স্থান কালের যে সীমাবদ্ধতা তা পেরিয়ে মানুষকে এবং মানুষের অনুভূতিমালাকে সংযুক্ত করে। প্রেম এক সংযোগ বলেই কি তাই বিনয় মজুমদার বারবার বলেছেন অঘ্রাণের অনুভূতিমালার কথা,যে অঘ্রাণ নিয়ে জীবনানন্দ লিখেছিলেন, “ লীন হয়ে গেলে তারা তখন তো মৃত/ মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনো/ মৃতেরা কোথাও নেই, আছে?/ কোনো কোনো অঘ্রাণের অন্ধকারে হেঁটে যাওয়া শান্ত মানুষের/ হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও নেই বলে মনে হয়”। এই অঘ্রাণ আমাদের কাছে বিষাদের বার্তা নিয়ে আসে। আর এই বিষাদকে রবীন্দ্রনাথ বলেন বড়ো দুঃখের আধার”। বড়ো দুঃখ এবং করুণ রাগিনী ছাড়া প্রেমের গভীরতম প্রদেশে আলো ফেলা যায় না। বিনয় মজুমদার তাঁর ‘ফিরে এসো চাকা’ কাব্যগ্রন্থে এই বিষাদ এবং করুণ রাগিনীকেই এবং এই সংযোগকেই আবিষ্কার করে গেছেন নিয়ত। “ আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমেষেই/ গলাধঃকরণ তাকে না করে ক্রমশ রস নিয়ে/ তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ফুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে”। আমরা এই কবিতা পড়তে পড়তে আশ্চর্য হই, কারণ বিনয় মজুমদারের কবিতা, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতোই একে অপরের সঙ্গে সুরের হারমনি তৈরি করতে করতে উঠে যায় অর্থের চূড়ায়। বিনয় মজুমদার আসলে কাব্যের এই সংযোগের ভাষাটি তৈরি করে গেছেন নিপুণভাবে তাঁর প্রতিটি কবিতার মধ্য দিয়েই। গভীর এক আধ্যাত্মিকতার রচনা তিনি করেছেন। কিন্তু তাকে আধ্যাত্মিকতার কোনও চেনা ছকের মধ্যে ফেলা যাবে না। কারণ বিনয় এক প্রকৃত ভাস্করের মতো সেই বুনন রচনা করেছেন, যা এক অখণ্ড সমগ্র। প্রত্যেক মহৎ কবিই আসলে এই সংযোগের সাধনাই করে থাকেন। “ নিষ্পেশণে ক্রমে ক্রমে অঙ্গারের মতন সংযমে/ হীরকের জন্ম হয়, দ্যুতিময়, আত্মসমাহিত”। প্রেম আমাদের এই আত্মসমাহিত এক জায়গাতেই নিয়ে চলে যায়। যেখানে আমি আর আমি হয়ে থাকি না। নিজেকে তোমার মধ্যেই আবিষ্কার করি শুধু তাই নয়, তোমার মধ্য দিয়েই আমি নিজেকে দেখি। আর তুমি তো প্রকৃতিরই এক রূপ। আমিও প্রকৃতির এক রূপ। যখন তোমার মধ্য দিয়ে আমি এই প্রকৃতির দিকে তাকাই, তখন আমি নিজেকেও দেখতে পাই। আর ধীরে ধীরে আমি আলাদা ভাবে কাউকেই দেখতে পাই না। যেমন,প্রকৃতি কি পারে নিজের সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে? কিন্তু প্রকৃতিরও তো নিজেকে প্রকাশ করার ব্যাকুলতা আছে। আর তাই তো সে একটি ফুলের মধ্য দিয়ে, একটি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে, একটি কবিতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে। তার নিজেকে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন হয় আধারের। আমাদের সমস্ত শিল্প সাধনা হল প্রকৃতি এবং প্রকৃতির নিজেকে প্রকাশের আধারের মধ্যে সংযোগসাধনটুকু তৈরি করা। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিনয় মজুমদার তাঁদের কাব্যে এই প্রেমের অরূপটুকুকেই নির্মাণ করে গেছেন।