Next
Previous
3

প্রবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in






সদ্য কৈশোরে উপনয়ন পর্বের পর আহ্ণিক উপবাস ইত্যাদি পালন করেছি নিতান্তই গতানুগতিকভাবে। তাতে কিছুটা ছিল একটা নবলব্ধ অভিনবত্বের আস্বাদ, বেশিটাই পারিবারিক বাধ্যবাধকতা। আনুষ্ঠানিক ব্যাপারগুলোই মুখ্য ছিল, তার তাৎপর্য বা গুরুত্ব অনুধাবন করার মত বিচারবুদ্ধি তখন হয়নি।

পরবর্তী সময়ে কিছুটা সচেতন হলেও, বিভিধ ব্যস্ততার জন্যেই হোক বা হয়তো তেমন আগ্রহের অভাবেই হোক, এ সম্বন্ধে বিশেষ কোন অনুসন্ধিৎসা জাগেনি। সম্প্রতি সংবাদে কয়েকটি ঘটনার বিবৃতি পড়ে কৌতুহল জাগল। উপনয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে ততটা নয়। বরং যে মন্ত্রে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত করা হয়, সেই গায়ত্রী মন্ত্র সম্বন্ধে। এই মন্ত্র বিষয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যেটুকু জানতে পারলাম, তা যাতে ক্রমে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে না যায়, তাই মনে হলো তাড়াতাড়ি যেটুকু পারি, লিখে রাখাই যুক্তিযুক্ত। আর হয়তো বা কিছু আগ্রহী পাঠকের সামান্য উপকারেও আসতে পারে, এই ভাবনা থেকেই এই আলেখ্যের অবতারণা।

প্রথমেই একটি সতর্কীকরণ। এই আলেখ্যতে যদি কেউ জাতিবাদ বা বর্ণবাদের গন্ধ খোঁজেন, তা কিন্তু নিতান্তই ভুল হবে। একটি প্রাচীন, এবং জ্ঞানী পন্ডিতদের মতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, বৈদিক মন্ত্রের উৎপত্তি, তৎসম্বন্ধীয় পৌরাণিক কাহিনী, তার অর্থ বা গূঢ়ার্থ ইত্যাদি নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে যা পেয়েছি, তাই এ বৃত্তান্তের অনুপ্রেরণা। তার বেশি কিছু নয়। রামকৃষ্ণ মিশনের শ্রদ্ধেয় স্বামী সমর্পণানন্দ মহারাজ বলছেন, গায়ত্রী মন্ত্র পৃথিবীর যে কোন দেশের, যে কোন ধর্মের, যে কোন জাতি বা বর্ণের মানুষ নির্দ্বিধায় সশ্রদ্ধায় জপ করতে পারেন। কোনরকম বৈষম্য বা বিধিনিষেধের কোন প্রশ্নই নেই।

গায়ত্রী শ্লোকের কথা বলতে গেলে বেদ সম্বন্ধে দু-চার কথা সংক্ষেপে বলতে হয়।

বেদের উৎপত্তিকাল নিয়ে বহু মত আছে। তবে অনেক ভারততত্ববিদদের গবেষণাপ্রসুত মত হল, মোটামুটিভাবে ১৫০০ থেকে ১২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ঋগ্বেদ সংহিতার অধিকাংশ রচিত হয়েছিল, এবং এর উৎস স্থল ছিল অধুনা উত্তর-পশ্চিম পঞ্জাবের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে, যার বেশির ভাগ এখন পাকিস্তানে। সেই সময়কাল থেকে শুরু করে ৪০০ থেকে ১৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত পর্যায়কে বৈদিক কাল বলা হয়। অর্থাৎ উত্তর কাংস যুগ থেকে লৌহ যুগ জুড়ে। এবং এই সময়ে সমগ্র উত্তর, পশ্চিম এবং অধিকাংশ পুর্ব ভারতে বৈদিক সভ্যতার বিস্তার ঘটে। বৌদ্ধ মহজনপদের আবির্ভাব এবং অধিকতর প্রচলনের সাথে সাথে বৈদিক সাহিত্য স্তিমিত হয়ে পড়ে।

বৈদিক শ্লোকগুলির আবির্ভাব কিভাবে হয়েছিল, তা নিয়ে অনেক তত্ব আছে। সে কথায় পরে আসছি। সে যুগে তো লিখন পদ্ধতি ছিল না। তাই ‘শ্রুতি’ এবং ‘স্মৃতি’, এই দুই সম্মিলিত প্রকারে বেদের সম্প্রচার হয়। অর্থাৎ গুরু থেকে শিষ্য, এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে, শুনে, বারংবার আবৃত্তি করে এবং স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে বৈদিক বিদ্যার প্রসার হয়। অনেক পন্ডিতের মতে এর সঙ্গে অভিনয়, মুখভঙ্গি এবং বিভন্ন মুদ্রারও প্রয়োগ হতো। মৌখিক শিক্ষণপদ্ধতি ও আবৃত্তিতে উচ্চারণ, ছন্দ, স্বরবিরাম, অক্ষর বা শব্দবিশেষে জোর দেওয়া ইত্যাদি কৌশল অপরিহার্য ছিল যা কোন লিখিত লিপিতে সম্ভব নয়। বেদগুলি লিপিবদ্ধ করা শুরু হয় আনুমানিক ৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে। ততদিনে দুর্ভাগ্যবশত স্বাভাবিক কারণেই অধিকাংশ শ্লোকই বিস্মৃতির অতলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

এসব হল একাডেমিক বেদ বিশেষজ্ঞদের মত। হিন্দু অধ্যাত্মবাদী পন্ডিতরা বিভিন্ন পুরান, উপনিষদ এবং মহাভারত ইত্যাদি প্রাচীন মহাকাব্যের ভিত্তিতে বিশ্বাসধারা ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ প্রদান করেছেন। তবে এই সব বিশ্বাস ও দর্শনের মধ্যে কোন এক বিষয়েও বিবিধতা আছে, এবং কখনও কখনও আপাতবিরোধী মনে হলেও, একাধিক মতের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়।

এই শাস্ত্রজ্ঞদের বিশ্বাস, মহর্ষিদের অনুভুতিপ্রসুত বেদের স্তোত্রগুলি ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় অবিন্যস্তভাবে উদ্ভুত হয়ে যাচ্ছিল, শিক্ষার্থীদের শেখানোও হত বিশৃঙ্খলভাবে। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন নামের এক ঋষি অন্যান্য বেদজ্ঞ জ্যেষ্ঠ ঋষিদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ বেদ শিক্ষা করেছিলেন। তাঁর মনে হয়, এই সুবিশাল জ্ঞানভান্ডারকে সুবিন্যস্ত করে, বিষয়ানুসারে বিভক্ত করা প্রয়োজন। পরিনত জীবনে তিনি এই সম্পাদনার কাজে ব্রতী হন, এবং অবশেষে সমগ্র বেদকে চার ভাগে বিভাজন করেন – ঋক, যজুর, সাম এবং অথর্ব। মতান্তরে তিনি প্রথম তিনটি বেদেরই সংকলন করেছিলেন, অথর্ব বেদ পরে সংযোজিত হয়। এই মহৎ কীর্তির জন্য তিনি বেদব্যাস (‘ব্যাস’ শব্দের অর্থ বিভাজন) নামে পরিচিত হলেন। এ ছাড়াও পুরাণ, মহাভারত, ব্রহ্মসুত্র ইত্যাদি গ্রন্থেরও রচয়িতা ব্যাসদেব।

বেদকে বলা হয় ‘অপৌরুষেয়’, অর্থাৎ মনুষ্যসৃষ্ট নয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কোথা থেকে এর উৎপত্তি হল ? কেনই বা তবে বিভিন্ন বেদমন্ত্রের শ্রেয় বিভন্ন মহর্ষিদের দেওয়া হয়ে থাকে ? এর এক গভীর তাত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যা অনেকটা এই রকম।

মানুষের মন বড়ই চঞ্চল। সর্বদাই বহু চিন্তাভাবনায়, নানা আবেগে উদ্বেগে ভারাক্রান্ত থাকে। তবে নিবিড় ধ্যানযোগের মাধ্যমে এই অশান্ত চিত্তকে শান্ত করার প্রকৌশল আমাদের মহর্ষিরা সিদ্ধ করেছিলেন। এখন, যত পার্থিব শক্তি আছে, তার মধ্যে হিন্দু দর্শনে শব্দকে বলা হয় ব্রহ্মস্বরূপ। সৃষ্টির আগের থেকে, আদি, বর্তমান, এমনকি বিলয়ের পরও মহাজাগতিক শব্দতরঙ্গ ছিল, আছে এবং থাকবে। তার কিছু আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, অধিকাংশই নয়। তাত্বিকরা বলছেন, সমাহিত চিত্তে এই অধরা ধ্বনিই পুঞ্জীভুত বাক্যসমূহরূপে মহর্ষিদের অন্তরাত্মায় প্রকাশ পেয়েছিল এবং অনুভূত হয়েছিল। সেই জ্ঞানই গীত হয়েছিল বেদবাক্যরূপে। সেই কারণেই বেদের বাণীও শাস্বত, অবিনশ্বর। যুগে য়ুগে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং হবে। সমর্পণানন্দ মহারাজ সহজ কথায় বুঝিয়েছেন, মাধ্যাকর্ষণের আবিষ্কর্তা নিউটনকে বলা হলেও মাধ্যাকর্ষণ কিন্তু বরাবরই ছিল এবং থাকবে। তেমনই বেদের জ্ঞান, সনাতন এবং অবিনশ্বর। যে যুগমানব এই জ্ঞান আহরণ করতে পারেন, তিনিই যুগান্তরে ও কালান্তরে সত্যদ্রষ্টা, ব্রহ্মর্ষি।

এমনই এক ঋষি ছিলেন বিশ্বামিত্র। অবশ্য পূর্বাশ্রমে তিনি ছিলেন এক দোর্দন্ডপ্রতাপ ক্ষত্রিয় রাজা। পরে অনেক তপস্যাবলে ঋষি, রাজর্ষি ও দেবর্ষি হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মন ছিল কলুষিত। ক্রোধ, অহংবোধ, জিগীষা, কামনা, বাসনায় ভরা। জীবনে তিনি বহু কুকর্ম করেছিলেন। তপস্যা করে দুর্লভ বরপ্রাপ্ত হয়েও সে সব শক্তির অপচয় করেন হীন চরিতার্থতায়। বলা বাহুল্য, এই জন্য তিনি বার বার পরাজিতই হলেন, চিত্তশান্তি হল না। অবশেষে, সহস্র বর্ষব্যাপী এক অসাধারণ কৃচ্ছ্রসাধনা ও ধ্যানযোগের পর তিনি এমন এক অবস্থায় পৌঁছলেন, যখন তাঁর মন সম্পূর্ণ ভারশূন্য, চিত্তে আর কোন পার্থিব আকাঙ্খা অবশিষ্ট নেই। এ এক অতুলনীয় রূপান্তর। সেই দিব্য তুরীয় অবস্থায় তিনি পরিনত হলেন এক ব্রহ্মর্ষিতে, যখন তাঁর অন্তরাত্মায় আকুলস্বরে রণিত হল এক অসীম ক্ষমতাশালী, অনন্য প্রার্থনা :

तत्सवितुर्वरेण्यं
भर्गो देवस्य धीमहि
धियो यो नः प्रचोदयात्

[ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি
ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ ]

এই হল গায়ত্রী স্তোত্র, বা ঋগ্বেদে যাকে ঋক বলা হয়। ঋক হল এক একটি শ্লোক। একাধিক শ্লোক সন্নিবেশে গঠিত হয় একটি সম্পূর্ণ সূক্ত। ঋক এবং মন্ত্র অনেক সময় সমার্থক হিসেবে উল্লেখ হয় বটে, কিন্তু এই স্তোত্র কিভাবে মন্ত্রে রূপান্তরিত হয়ে গেল, আর কেমন ভাবে আরও গভীর অর্থবহ হয়ে উঠল, সে আলোচনায় আসছি একটু পরে।

ঋগ্বেদের একাধিক শাখা ছিল বলে মনে করা হয়, যার একটিই মাত্র শাখা, যার নাম ‘শাকল’, এবং অন্য একটি শাখা ‘বাষ্কল’-এর সামান্য অংশ, এ যুগে অবশিষ্ট আছে। এখনকার উপলব্ধ ঋগ্বেদে ১০টি মন্ডল, ১০২৮টি সূক্ত এবং ১০,৬০০টি ঋক পাওয়া যায়। এক একটি মন্ডল এক এক জন ব্রহ্মর্ষির দিব্য অনুভূতির সংকলন। এর মধ্যে দ্বিতীয় থেকে নবম মন্ডল হল সর্বপ্রাচীন বেদ, এবং তৃতীয় মন্ডল ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের নাম বহন করে। ঋগ্বেদের এই তৃতীয় মন্ডলে ৬২টি সূক্ত এবং ৬১৭টি ঋক আছে। ৬২তম সূক্তের ১০ম ঋক হল গায়ত্রী স্তোত্র।

গায়ত্রী স্তোত্র ঋক অথবা মন্ত্র রূপে ঋগ্বেদে তো আছেই, যজুর্বেদেও চার বার এবং সাম বেদে একবার ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন উপনিষদ, শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা, হরিবংশ, মনুস্মৃতি ইত্যাদি সব প্রাচীন গ্রন্থাবলীতে বারংবার উল্লেখিত হয়েছে। এমন কি, বৌদ্ধ গ্রন্থ সূক্ত নিপাতে ভগবান বুদ্ধ স্বয়ং তাঁর অনুগতদের বলেছেন এই মন্ত্র অধ্যয়ন করতে। এর থেকে ধারণা করা যেতে পারে মন্ত্রটির মাহাত্ম্য কত ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। সাম্প্রতিক কালে রাজা রামমোহন রায় প্রতিটি ব্রাহ্ম সভার শুরুতে গায়ত্রী মন্ত্রের সমবেত ধ্যান প্রথার প্রববর্তন করেন।

কিন্তু এই ‘গায়ত্রী’ আদতে কে, বা কী ?

গায়ত্রী আসলে একটি ছন্দের নাম। আগেই জেনেছি, বেদের স্তোত্র মৌখিক গায়ন বা আবৃত্তির মাধ্যমেই প্রচারিত হত। স্বভাবতই ছন্দের প্রয়োগ আবশ্যিক ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সমগ্র বেদে সাতটি প্রধান ছন্দের দেখা পাওয়া যায়। এগুলি হল গায়ত্রী, উষ্ণিক, অনুষ্টুপ,বৃহতী, পংক্তি, ত্রিষ্টুপ ও অগতী। এগুলির প্রত্যেকটির নিজস্ব কাঠামো আছে। অন্য আরও কিছু কম ব্যবহৃত ছন্দও আছে।

সবথেকে বেশি শ্লোক গঠিত হয়েছে ত্রিষ্টুপ ছন্দে, তারপর গায়ত্রী ছন্দে। কিন্তু মান্যতায় গায়ত্রী সর্বাগ্রে। গীতায় বলা হয়েছে, “ছন্দসমূহের মধ্যে আমিই গায়ত্রী”। আমাদের সময়ে, কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার রেশ থেকে, বোধহয় সমকালীন কবিতায় ছন্দের অপ্রাসঙ্গিকতা নিয়েই, লিখেছেন, “সকল ছন্দের মধ্যে এই যে গায়ত্রী, তুমি নাও। গায়ত্রীর মত নারী শুয়ে আছে”। ছন্দপতনের জন্যও তিনি গায়ত্রীকেই নির্বাচন করলেন।

সে যা হোক, আমরা তো রয়েছি বৈদিক যুগে। তাই এইখানে গায়ত্রী ছন্দের গঠনটি একটু জেনে নিই। এই ছন্দে সমগ্র শ্লোক রচিত হয় মোট ২৪টি শব্দাংশ বা সিলেবল নিয়ে। এই ২৪টি সিলেবল আবার তিনটি সমান অংশে বিভক্ত হয়, যার প্রত্যেকটিকে বলা হয় এক একটি পাদ। অর্থাৎ প্রত্যেক পাদে ৮টি করে শব্দাংশ বা সিলেবল থাকতে হবে। নীচে এই কাঠামোটি বোঝানো হয়েছে।









অন্যাান্য আরো অনেক দেব-দেবীদের, যেমন বিষ্ণু, কৃষ্ণ, শিব, গণেশ, দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষী ইত্যাদি, স্তুতিতে গায়ত্রী মন্ত্র রচিত হয়েছে। কিন্তু গায়ত্রী মন্ত্র বলতে সাধারণত আপামর ভক্তদের কাছে উপরোক্ত স্তোত্রই প্রাধান্য এবং পরিচিতি পেয়ে এসেছে।

অবশ্যই গায়ত্রী নামের এক দেবীও বর্তমান। ইনি পৌরাণিক দেবী। বিভিন্ন পুরাণে এঁর পরিচিতি ও বর্ণনার রকমফের আছে। মৎস্য পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মার দেহ ভেদ করে অর্ধেক পুরূষ এবং অর্ধেক নারীরূপে তাঁর জন্ম, শতরূপা নামেও পরিচিত। মদনদেবের কামশরে বিদ্ধ হয়ে ব্রহ্মা এঁকে বিবাহ করেন, এবং মনু-সহ সাত সন্তানের জন্ম হয়। এই দেবীকেই আবার সরস্বতী ও সবিতা নামেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। স্কন্দ পুরাণে ব্রহ্মার স্ত্রী ও সরস্বতী পরিচয়ে তো বটেই, পার্বতী রূপেও বিদ্যমান। ব্রহ্মা অজাচারে লিপ্ত হতে গেলে মহাদেব নাকি তাঁকে বধ করেন ও পরে এই গায়ত্রী দেবীর অনুরোধে পুনর্জীবিত করেন। কূর্ম পুরাণে তিনি গৌতম ঋষিকে বরদান করে তাঁর জীবনের বাঁধা-বিপত্তির অবসান করেন। পদ্ম পুরাণের কাহিনীটি অধিক প্রচারিত। ব্রহ্মা একবার এক যজ্ঞ করছিলেন, তখন তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী বা সরস্বতীর যজ্ঞস্থলে প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কোন কাজে ব্যস্ত থাকায় সাবিত্রী আসতে অসমর্থ হলে, যজ্ঞ সম্পূর্ণ করার জন্য ব্রহ্মা এক সর্বগূণলক্ষণা সুন্দরী অভিরা নারীকে তৎক্ষণাৎ বিবাহ করেন এবং তাঁর সহায়তায় যজ্ঞ সম্পন্ন করেন। এই নারীই গায়ত্রী। স্বাভাবিকভাবেই সাবিত্রী ক্রোধবশে যজ্ঞস্থলে সকলের শাপান্ত করতে লাগলেন। তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ইত্যাদি সকলে তাঁকে তুষ্ট করলে সাবিত্রী শেষে গায়ত্রীকে ব্রহ্মার দ্বিতীয় স্ত্রী রূপে স্বীকৃতি দেন। আসলে গায়ত্রী নাকি সাবিত্রীরই রূপভেদ। এইভাবে সাবিত্রী, সবিতা, সরস্বতী, গায়ত্রী সব সমার্থক হয়ে গেছেন। প্রধানত ব্রহ্মার স্ত্রীরূপে পরিচিত হলেও শৈব পূরাণগুলিতে আবার অন্য চিত্র পাওয়া যায়। লিঙ্গপুরাণে মহাদেবের অঙ্গ থেকে তাঁর জন্ম, শ্বেতকল্পে শ্বেতবর্ণা, পীতকল্পে পীতবর্ণা, লোহিতকল্পে লোহিতবর্ণা ও কৃষ্ণকল্পে কৃষ্ণবর্ণা। তিনি বেদমাতা। বরাহ পুরাণে আবার ভীষণা রূপ ধারণ করে তিনি বেত্রাসুরকে বধ করেন। শৈব মান্যতায় তিনি সদাশিবের পত্নী মনোমণি। সরস্বতী, লক্ষী এবং পার্বতীর সম্মিলিত রূপ, গায়ত্রী মন্ত্রের দৈবী প্রকাশ। তাঁর পাঁচ মাথা ও দশ হাত, প্রস্ফুটিত লাল পদ্মে আসনা। বর্তমানে উত্তর ভারতে তিনি এই মুর্তিতেই পূজিত হন।

গায়ত্রী মন্ত্রে যাঁর ধ্যান করা হয়েছে, তিনি কিন্তু এই গায়ত্রী দেবী নন, তিনি হলেন সবিতৃ দেব। ইনি বৈদিক দেবতা। এইখানে জানা দরকার যে বৈদিক দেবতা ও পরবর্তী পৌরাণিক দেব-দেবীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। অধিকাংশ পৌরাণিক দেব-দেবীদের কোন উল্লেখ বেদে নেই। যে সব বৈদিক দেবতারা কোন জাগতিক বা প্রাকৃতিক ঘটমান বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন, ইনি তাঁদের মধ্যে একজন। সূর্যোদয়ের আগে পূর্ব দিগন্ত যে স্বর্ণাভ আভায় আলোকিত হয়ে ওঠে, সবিতৃদেব হলেন তারই প্রতিভূ দেবতা।

সবিতৃ ঋষি কাশ্যপ ও তাঁর এক পত্নী অদিতির ১২ পুত্রের একজন। তাই তিনি একজন আদিত্য। তাঁর করমন্ডল ও কেশ স্বর্ণাভ। যখন হলুদ বর্ণের পোষাক পরিধান করে সোনার রথে বিচরণ করেন, তখন তাঁর অবয়ব থেকে এক উজ্জ্বল স্বর্ণালী দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয়। তিনি মিষ্টভাষী ও শিষ্টাচারী। সকল সদাচারী ব্যক্তিদের তিনি অমৃতলোকের দিকনির্দেশ করেন। তাঁর আগমনে সূর্যোদয় হয়, এবং তাঁরই নির্দেশে সন্ধ্যাগমন ঘটে। তাই উভয়কালে তিনি পূজ্য। সকল জীবের নিদ্রাভঙ্গ ও বিশ্রামকাল নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। মর্ত্যলোক এবং অন্তরিক্ষের মধ্যবর্তী অঞ্চল তাঁর প্রভাবে চালিত হয়, তাই বায়ুপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাতও তিনিই সৃষ্টি করেন।

সবিতৃ ও সূর্য কি অভিন্ন ? এই প্রশ্নের পক্ষে ও বিপক্ষে বিবিধ পন্ডিতের অনেক মত আছে।

ঋগ্বেদের ১১টি সূক্তে এবং অন্যান্য গ্রন্থাদিতে প্রায় ১৭০ বার যে সবিত্রের উল্লেখ রয়েছে, তাঁকে প্রায়শই সূর্য বা সূর্যের নামান্তরের সঙ্গে সমান্তরাল বা সমার্থক বলে মনে হতে পারে। তাঁর যে সব বৈশিষ্ট্য এবং ক্রিয়াদির বর্ণনা রয়েছে, তা সূর্যের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায়। কিন্তু অনেকে আবার প্রভেদও দেখতে পান। এমনও উদাহরণ আছে যেখানে ইন্দ্রাদি কয়েক অন্য দেবতার সঙ্গেও সবিত্রের একীকরণ করে বোঝানো হয়েছে।

পঞ্চম খ্রীষ্টপূর্বাব্দের নিরুক্তিকার যাস্কের মত হল, আকাশ থেকে রাত্রির অন্ধকার চলে গিয়ে যখন রশ্মি বিকীর্ণ হয়, সেই হল সবিতৃ (বা সবিতা)র কাল। চতুর্দশ শতকের বেদ ভাষ্যকার সায়নাচার্য্য বলছেন, উদয়ের পূর্বে তিনি সবিতা, উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত সূর্য। যাঁরা সবিতৃ ও সূর্যকে এক বলে মানেন, তাঁরা এই দুই টীকাকে সমর্থন মনে করেন। আবার অন্যরা বলেন, সাকার সূর্য এবং নিরাকার রশ্মি, যা শক্তির প্রকাশ, এই দুইয়ের প্রভেদ এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

যাস্ক এও বলেছেন, ‘সু’ ধাতু থেকে সবিতৃ শব্দের উৎপত্তি, তাই সবিতা অর্থে প্রসবিতা। আবার সায়নাচার্য্যের ব্যাখ্যায়, ‘তৎসবিতুঃ’র অর্থ হল জগৎ-প্রসবিতুঃ। সমগ্র বিশ্বজগতের জন্মদাতাই তো পরম ব্রহ্ম। যজুর্বেদের টীকায় আবার সবিতৃকে বলা হয়েছে প্রজাপতি, যা ব্রহ্মর অপর নাম। স্থানান্তরে এমন উল্লেখও আছে যে সমস্ত সৃষ্টিশক্তির ধারক একমাত্র সবিতৃ। শুধু তাই নয়, অন্য দেবতারা তাঁর অমান্যতায় অপারগ। এই সব যুক্তি দিয়ে ব্রহ্মবাদীরা বলেন যে সবিতৃ নেহাতই সূর্য নন, তিনিই সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বর।

বৈদিক ধর্মে যে অর্থই করা হোক, পরবর্তী ব্রহ্মবাদী ঋষিরা কিন্তু নিরাকার একেশ্বর পরমাত্মায় বিশ্বাসী। তাঁরা বেদকেই অবলম্বন করলেন, কিন্তু যোগ করলেন গভীর দার্শনিক তত্ব। আধুনিক কালের পন্ডিতরাও বেদবাণীসমূহের নিজ নিজ দার্শনিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। এখন কথা হল, এই সব বিজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা কেমন করে স্বীকার করতে পারেন যে গায়ত্রী মন্ত্রের মাধ্যমে সকাল সন্ধ্যে তাঁরা সূর্যেরই স্তব করে চলেছেন যা এক জড়পদার্থমাত্র ? বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘সবিতা ও গায়ত্রী’ শীর্ষক প্রবন্ধে সুন্দর মীমংসা দিয়েছেন। প্রথমে বিভিন্ন সাক্ষ্য আলোচনা করে তিনি বলছেন, “বোধ হয় এখন স্বীকার করিতে হইবে যে, সবিতা, পরব্রহ্ম নহেন, জড়পিন্ড সূর্য্য”। অবশেষে তিনি বললেন, “ইহাতে ক্ষতি কি ? ব্রাহ্মণেরাই বা লাঘব কি ? গায়ত্রীরই বা লাঘব কি ? যে ঋষি গায়ত্রী প্রণয়ন করিয়াছিলেন, তিনি যে অর্থই অভিপ্রেত করিয়া থাকুন না, যখন ব্রহ্মপক্ষে তাঁহার বাক্যের সদর্থ হয়, আর যখন সেই অর্থেই গায়ত্রী সনাতন ধর্ম্মোপযোগী এবং মনুষ্যের চিত্ত-শুদ্ধিকর, তখন সেই অর্থই প্রচলিত থাকাই উচিত। তাহাতে ব্রাহ্মণেরও গৌরব, হিন্দুধর্ম্মেরও গৌরব। এই অর্থে ব্রাহ্মণ শূদ্র, ব্রাহ্ম, খ্রীষ্টীয়ান্ সকলেই গায়ত্রী জপ করিতে পারে।“

সুতরাং গায়ত্রী মন্ত্রের ব্রহ্মপক্ষে থাকাই যুক্তিযুক্ত। সজাগ পাঠকরা কিন্তু বলবেন, এই রচনায় তো এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ গায়ত্রী মন্ত্রের অবতারণাই হয়নি। ঠিক কথা। আসলে ঋষি বিশ্বামিত্র প্রণীত সবিতৃ-গায়ত্রীর ঋক থেকেই যাত্রা শুরু। এই ঋক মন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে আরও পরে। শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতার ৩৬তম অধ্যায়ের তৃতীয় মন্ত্র হল সম্পূর্ণ গায়ত্রী মন্ত্র, যেখানে বিশ্বামিত্রের ঋকের পূর্বে যুক্ত করা হল শব্দগুচ্ছ:

ॐ भूर्भुवः स्वः

সুতরাং পূর্ণ রূপে মন্ত্রটি হল: ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ। লক্ষ্যণীয় যে প্রাথমিক এই শব্দগুলি কিন্তু গায়ত্রী ছন্দে বদ্ধ নয়। মন্ত্রাকার সাধনেই এগুলি যুক্ত করা হয়েছে।

এইবার সময় এসেছে এই মন্ত্রের আক্ষরিক অর্থ এবং অন্তর্নিহিত ভাবার্থ বা গূঢ় তত্ব বিশ্লেষণের প্রয়াস করার। প্রয়াস মাত্র। কারণ যে গভীর আধ্যাত্মিক দর্শন এর মধ্যে নিহিত বলে মান্যতা পেয়েছে, তার সম্যক উপলব্ধি সাধারণের কাছে উপস্থাপন করার মত প্রয়োজনীয় যোগ্যতার দাবিদার আমি নই। তা ছাড়া, বিভিন্ন তাত্বিকেরা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাই এখানে আমরা সায়নাচার্য্যের শরণাপন্ন হব, এবং তাঁর কাছে অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে কিঞ্চিত সরলীকরণের চেষ্টা করব।

প্রথম শব্দ ওঁ। সকলেই জানেন, সৃষ্টির প্রারম্ভে ধ্বনিত তিন আদি স্বর অ, উ এবং ম মিলিত হয়ে ওঁ-কারের উৎপত্তি। হিন্দু ধর্মের পবিত্রতম প্রতীক। যে কোন ঋকের শুরুতে ও শেষে ওঁ ব্যবহার করলে তা মন্ত্রে পরিনত হয়।

পরবর্তী তিনটি শব্দকে বলা হয় ব্যাহৃতি। ব্যাহৃতি নিয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়ে শুধু বলা যায় যে ওঁ-কারের মতই পবিত্র এবং আদি সাতটি শব্দকে ব্যাহৃতি বলা হয়, যার মধ্যে আবার প্রথম এই তিন শব্দ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রে ব্যাহৃতির প্রয়োগ অনিবার্য। এখানে এই তিন শব্দের স্বতন্ত্রভাবে ব্যাখ্যা প্রয়োজন, কারণ এদের প্রয়োগ মন্ত্রের ব্যাপ্তিকে প্রসারিত করেছে।

ভূ – পৃথ্বীলোক বা স্থূল বা ভৌতিক জগৎ; ভাবান্তরে স্থূল শরীর।

ভুব: - অন্তরীক্ষ লোক; ভাবান্তরে সূক্ষ শরীর, যা না তো সম্পূর্ণ শারীরিক, না আধ্যাত্মিক।

স্ব: - স্বর্গলোক বা কারণ-জগৎ; ভাবান্তরে আত্মার ক্ষীন আবরণ, যার পেছনে আত্মা, পরমাত্মা বা পরমেশ্বর বিরাজমান। বৈদিক আধ্যাত্মবাদ অনুসারে সকলের অন্তরেই পরমেশ্বর আসীন, অজ্ঞানতার কারণে যাঁর উপলব্ধি থেকে মানুষ বঞ্চিত।

তৎ - সেই (দেবতা; ঈশ্বর)।

সবিতু – সবিতা; বা অন্তর্যামী। লক্ষণীয়, যে সবিতৃদেবকে আগে আমরা মর্ত্য ও অন্তরীক্ষের মধ্যাঞ্চলের দেবতা বলেই বর্ণনা করেছিলাম, এই ব্যাহৃতি ত্রয়ী সেখান থেকে তাঁকে ত্রিলোকের অধীশ্বর পরম ব্রহ্মের মর্যাদায় রূপান্তরিত করেছে।

বরেণ্যং – বরণীয়, পূজনীয়।

ভর্গো দেবস্য – এক অর্থে অন্ধকার নাশক দীপ্তির দেবতাকে; ভাবার্থে চেতনার উন্মেষকারী পরমেশ্বরকে। ভর্গ মানে অন্নও হয়। তাই অন্য অর্থে জাগতিক সম্পন্নতা প্রদানকারী দেবতাকে। শব্দটি এই মন্ত্রকে তিন মাত্রায় ব্যবহার করার উপয়োগী করেছে। জাগতিক সম্পদ, পাপনাশক আধ্যাত্মিক শক্তি, এবং সর্বোচ্চ স্তরে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে চেতনার দ্যুতি, এই সর্বস্ব প্রদান করেন যে ঈশ্বর, তাঁকে।

ধীমহি – ধ্যান করি; ভাবার্থে ধারণ বা প্রতিষ্ঠিত করি।

ধিয়ো – বুদ্ধি; কর্ম ও ধর্মজীবনের প্রজ্ঞা।

য়ো – সেই, অর্থে সেই দেবতা বা পরমেশ্বর।

ন: - আমাদের।

প্রচোদয়াৎ - নিয়ে যান, বা দিগ্দর্শন করান; প্রেরণা প্রদান করেন।

এই সমস্ত শব্দার্থকে একত্রিত করে যদি অতি সাধারণ গদ্যে মন্ত্রটিকে প্রকাশ করার চেষ্টা করি, তবে অনেকটা এইরকম দাঁড়ায়:

“সেই সর্বব্যাপী, বরেণ্য, সর্বস্ব-প্রদায়ী, জ্যোতির্ময় ঈশ্বরের ধ্যান-প্রতিষ্ঠা করি, যেন তিনি আমাদের জ্ঞান ও বুদ্ধির আলোক উন্মোচিত করে দিকনির্দেশ করেন”।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু গূণী পন্ডিত, দার্শনিক ও সাহিত্যিক অনেক ভাষায় গায়ত্রী মন্ত্রের অনুবাদ বা ভাবানুবাদ করেছেন। কিন্তু অল্প কথায় অনেক কথা বলে যাওয়ার মত দক্ষতা ও শৈলী আমাদের রবি ঠাকুরের মত আর কার ? তাঁর “বেদ: সংহিতা ও উপনিষদ”এ সরল পদ্যে গায়ত্রী ঋকের যে ভাবানুবাদ তিনি করেছিলেন, তা এইখানে উল্লেখযোগ্য:

যাঁ হতে বাহিরে ছড়ায়ে পড়িছে
পৃথিবী আকাশ তারা,
যাঁ হতে আমার অন্তরে আসে
বুদ্ধি চেতনা ধারা –
তাঁরি পূজনীয় অসীম শক্তি
ধ্যান করি আমি লইয়া ভক্তি।

তবে মনে রাখতে হবে যে এই অনুবাদ মন্ত্রের নয়, কারণ এতে প্রারম্ভের ব্যাহৃতি অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

শাস্ত্রজ্ঞানী বিদ্বজন গায়ত্রী মন্ত্রকে এক অতি উচ্চ মর্যাদার স্থান দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, এই মন্ত্র নিয়মিত জপ করলে অতুল সুফল পাওয়া সম্ভব, অন্য মন্ত্রের প্রয়োজন নেই। গায়ত্রী মন্ত্রের শক্তি নাকি অপরিসীম। আমার এক অগ্রজ সহকর্মী বলতেন, দৈনিক জীবনে যখনই কোন কঠিন পরিস্থিতি এসেছে, মনে মনে গায়ত্রীর শরণাপন্ন হয়ে সর্বদাই তিনি অশেষ মনোবল ও উপকার পেয়েছেন। এই প্রত্যয় নিছকই অটুট বিশ্বাসপ্রসূত, না বাস্তব অভিজ্ঞতানির্ভর, তা বলা মুশকিল। তবে মন্ত্রটির এই আভিজাত্যের কারণ বোধহয় মন্ত্রের মধ্যেই নিহিত।

প্রথমত, এখানে কোন বিশেষ দেবী-দেবতার স্তবগাথা নেই। এই ঈশ্বর যে কোন বিশ্বাসের মানুষের ঈশ্বর হতে পারেন। তাই এই মন্ত্র কোন ধর্ম বা জাতি ভেদে সীমাবদ্ধ নয়, সার্বজনীন।

দ্বিতীয় কারণ, শুধুমাত্র অতি উচ্চমার্গের সাধনা অর্থাৎ ঈশ্বরানুভূতির জন্যেই যে এই মন্ত্র উপযোগী, তা নয়। যে কোন পার্থিব অথবা আধ্যাত্মিক লক্ষ্যে গায়ত্রী মন্ত্রে সমানভাবে নির্ভরশীল হওয়া যায়।

তৃতীয়, এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই মন্ত্রে কিন্তু সরাসরিভাবে কোনই চাহিদা নেই, যা সাধারণত আমাদের অন্যান্য পুজা মন্ত্রে থাকে। এখানে ঈশ্বরের কাছে অর্থ-মোক্ষ ইত্যাদির প্রত্যাশা নেই। যা ভিক্ষা করা হয়েছে তা হল অকলুষিত বুদ্ধি। নিষ্কলঙ্ক বুদ্ধিবলে মানুষ যে কোন সাফল্য অর্জনে সক্ষম, কারণ তখন নিরপেক্ষ বিচারে সঠিক পথের সন্ধান মেলে। এমন সুচিন্তিত আবেদন আর কোন প্রার্থনায় আছে বলে আমার জানা নেই।

গায়ত্রী মন্ত্রের শক্তি সর্বসাধারণকে বুদ্ধিবলে বলবান করুক, এই কামনাই করি।