গল্প - মনোজ কর
Posted in গল্পত্রয়োদশ পর্ব
একদিনের যুদ্ধ।
সিলেক্ট কমিটির যুদ্ধ বিভাগের তিন সদস্য রজার ড্রেক, চার্লস ম্যানিংহাম এবং রিচার্ড বেকার মিরজাফরের যোগদানের ব্যাপারে সুনিশ্চিত না হয়েও অনতিবিলম্বে যুদ্ধ শুরুর সিদ্ধান্ত জানিয়ে ক্লাইভকে চিঠি পাঠাল। কিন্তু সেই চিঠি ক্লাইভের হাতে পৌঁছোনোর আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ২৩শে জুন, ১৭৫৭ সকাল আটটায় সিরাজের দিক থেকে উড়ে এলো প্রথম গোলা। এই গোলার আঘাতে নিহত হলো একজন ইংরেজ সৈন্য এবং আহত হলো একজন। ব্রিটিশদের কাছে খবর ছিল সিরাজের সৈন্যদের কাছে কামান নেই। কিন্তু সেই খবর মিথ্যা প্রমাণ করে আমবাগানের সামনে ব্রিটিশ সৈন্যরা জড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওদিক থেকে শুরু হলো বিপুল গোলাবর্ষণ। ব্রিটিশবাহিনী তড়িঘড়ি দু’টো ছোট কামান জোগাড় করলেও তা ছিল সিরাজের কামানবাহিনীর তুলনায় অতি সামান্য। ব্রিটিশ কামানের গোলায় নবাবের কয়েকজন সৈন্য নিহত হলেও ব্রিটিশ সৈন্যদের নিহত হবার সংখ্যা ছিল তার দশগুণ। প্রথম একঘন্টার যুদ্ধ থেকে ক্লাইভের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে নবাবের সৈন্যসংখ্যা এবং যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনা ব্রিটিশদের থেকে অনেক বেশি। প্রথমত, নবাবের বাহিনীর দুই তৃতীয়াংশ সৈন্য তখনও যুদ্ধে যোগ দেয়নি। মাত্র এক তৃতীয়াংশ সৈন্যবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছে সিরাজ এবং প্রথম আধ ঘন্টায় ব্রিটিশবাহিনীর দশজন ইংরেজ সৈনিক এবং কুড়িজন সেপাই নিহত হয়েছে অর্থাৎ গড়ে প্রতিমিনিটে একজন। অনেক যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ক্লাইভ কালবিলম্ব না করে সেনাবাহিনীকে পিছু হটার আদেশ দিল। সামনের সৈনিকদের গাছের আড়ালে থাকতে বলা হল যাতে গাছগুলোকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা যায়। অগ্রসরমান নবাবের সৈন্যদের ওপর আঘাত হানবে পিছনের সারির কামানবাহিনী। ব্রিটিশ সৈন্যদের পিছু হটতে দেখে নবাবের সৈন্যরা উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলো। সামনে বিশাল মহিষবাহিনীকে রেখে এগিয়ে আসতে লাগলো নবাবের সৈন্যরা। গুলিবর্ষণের মাত্রা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। কিন্তু তাতে লাভ খুব একটা হলোনা। বেশিরভাগ গুলি গাছে আটকে গেল। ব্রিটিশ সৈন্যরা গাছের আড়ালে শুয়ে রইল। বেলা এগারোটা নাগাদ ক্লাইভ সিদ্ধান্ত নিল যে আগামী দু-তিন ঘন্টা সৈন্যরা গাছের আড়ালেই থাকবে, কোনওরকম প্রতিআক্রমণে যাবে না। পিছনের দিক থেকে সীমিত কিন্তু অবিরত গোলাবর্ষণ করতে থাকবে কামানবাহিনী। দুপুর বারোটা নাগাদ ক্লাইভ পলাশি হাউস থেকে বেরিয়ে সেনাপ্রধানদের সঙ্গে পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য কিছুদূর এগিয়ে হঠাৎ কী ভেবে আবার পলাশি হাউসে ফিরে গেল। অস্থিরচিত্ত ক্লাইভকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার আবহ ক্লাইভের নজর এড়ায় নি।দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ঘনিয়ে এল ক্লাইভের মনে। এই চরম মুহূর্তে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন বরুণদেব। শুরু হল বৃষ্টি। এইসময়ের বাংলার আবহাওয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা এবং অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও সিরাজের সেনাপ্রধানেরা কোনওরকম সাবধানতা অবলম্বন করেনি। প্রচুর পরিমাণে গোলাবারুদ জলে ভিজে নষ্ট হয়ে গেল। ক্লাইভের বাহিনীর সৈন্য এবং বন্দুকের সংখ্যা অনেক কম হলেও বৃষ্টির হাত থেকে গোলাবারুদ বাঁচানোর জন্য আগে থেকেই ব্যবস্থা নিয়েছিল ক্লাইভের সেনাপ্রধানেরা। প্রচন্ড বৃষ্টিতে আমবাগান জলে ভরে গেল আর গোলাবারুদের অভাবে নবাবের দিক থেকে গোলাবর্ষণ কমতে কমতে প্রায় থেমে গেল। কিন্তু ব্রিটিশদের দিক থেকে গোলাবর্ষণ চলতে থাকলো অবিরত।
এই পুরো সময়টা ধরে মিরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রাইদুর্লভের সেনাবাহিনী নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ক্লাইভ এবং সিরাজ দু’জনের মনে একই প্রশ্ন, এরা কি যুদ্ধে যোগ দিতে চায়? যদি চায় তবে কোন পক্ষে? এরা এতক্ষণ যুদ্ধে যোগ দেয়নি কেন? ক্লাইভ কোনওদিনই মিরজাফরকে বিশ্বাস করতে পারেনি। ক্লাইভের মনে আর একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল। তবে কি এই সুগভীর চক্রান্ত এবং চুক্তির খবর সিরাজের কাছে পৌঁছেছে? মিরজাফর কি শেষ মুহূর্তে সব চুক্তি অমান্য করে সিরাজের পক্ষেই যুদ্ধ করবে? মিরজাফরের পক্ষে সবই সম্ভব। তবুও আশার আলো এই যে তার পক্ষে সরাসরি যোগ না দিলেও মিরজাফর কিন্তু এখনও পর্যন্ত সিরাজের সেনাপতি হওয়া সত্ত্বেও সিরাজের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়নি। মিরজাফরের ভূমিকা এই মুহূর্তে নিরপেক্ষ। কে জানে কি অপেক্ষা করছে সামনে? দৃশ্যতই দ্বিধাগ্রস্থ ক্লাইভ। সিরাজের চিন্তিত হবার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে। তার সন্দেহকে সত্য প্রমাণ করে প্রায় চার ঘন্টা যুদ্ধ চলার পরেও তার তিন প্রধান সেনাপতি তাদের জায়গা থেকে এতটুকু নড়েনি। ব্রিটিশ সৈন্যরা পিছু হটার সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ জোরদার করে নিশ্চিত এবং অনায়াস যুদ্ধজয়কে যারা প্রতিহত করলো তারা যে সিরাজের বিরুদ্ধতা করছে সে কথা দিনের আলোর মত স্পষ্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে সিরাজ সেই সমস্ত নবাবদের মতই একজন যারা স্তাবক পরিবৃত হয়ে নিজেদের সমস্ত বিপদের থেকে দূরে রেখে সেনাপ্রধানদের হাতে যুদ্ধের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়। এইসমস্ত স্তাবকেরা যাদের মধ্যে অধিকাংশই লোভী এবং বিশ্বাসঘাতক তারা নবাবকে পরিস্থিতি সম্বন্ধে ভুল খবর দিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। বিভ্রান্তির মেঘ সরিয়ে যখন সত্য সামনে এসে উপস্থিত হয় তখন আর কিছু করার থাকে না।
গোলাবর্ষণ কমে আসছে দেখে সিরাজের দুই বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর মদন এবং মোহনলাল সেনাবাহিনীসমেত আমবাগানের দিকে এগিয়ে চলল। ব্রিটিশদের দিক থেকে অবিরত গোলাবর্ষণে বেশ কয়েকজন সৈনিক নিহত হলেও ওরা জানে যে সংখ্যায় নবাবের সৈন্য এত বেশি যে যুদ্ধজয় অবশ্যম্ভাবী। আধুনিকতার নিরিখে ইংরেজদের অস্ত্রশস্ত্র এবং রণকৌশল এগিয়ে থাকলেও যুদ্ধে সৈন্যসংখ্যাই শেষ কথা বলে। এছাড়াও আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত কিছু ফরাসি সেনাপ্রধানও এই যুদ্ধে নবাবের পক্ষে সামিল হয়েছে। সিরাজের বাহিনী যত এগিয়ে আসতে থাকে ক্লাইভের কপালের ভাঁজ গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। যুদ্ধের সমীকরণ অভিজ্ঞ সেনাপতি ক্লাইভের অজানা নয়। ক্লাইভের অসহায় চোখের সামনে মীর মদন আর মোহনলাল যখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে যুদ্ধকে অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তখনই ঘটলো অঘটন। একটা কামানের গোলা উড়ে এসে আঘাত করল মীর মদনকে। সাঙ্ঘাতিক আহত মীর মদনকে নিয়ে আসা হলো সিরাজের তাঁবুতে। কিন্তু চিকিৎসা শুরুর আগেই সিরাজকে অন্তিম অভিবাদন জানিয়ে চিরকালের জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিদায় নিল মীর মদন। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মত একা লড়াই চালাচ্ছে মোহনলাল। সিরাজের বিশ্বাসঘাতক তিন সেনাপতি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। মীর মদন মৃত। একা মোহনলাল যে এই যুদ্ধ জেতাতে পারবে না সে কথা না বোঝার কিছু নেই। যতটা না মীর মদনের মৃত্যুর জন্য তার চেয়ে অনেক বেশি এই তিন সেনাপতির নিষ্ক্রিয়তার জন্য অধিক শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও এই যুদ্ধ হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে মিরজাফরের কাছে দূত পাঠাল সিরাজ। যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাবার প্রস্তুতি চললেও শেষ সিদ্ধান্ত নেবার আগে শেষ চেষ্টা তো করতেই হবে। আত্মাভিমান প্রদর্শনের সময় এটা নয়। নিজের জীবনরক্ষার জন্য মাথা নত করতে এই মুহূর্তে প্রস্তুত নবাব সিরাজউদ্দৌলা। কিন্তু খবর তো পাঠানো হয়েছে অনেকক্ষণ তাহলে এত দেরি করছে কেন মিরজাফর? তবে কি অতর্কিত আক্রমণে তাকে হত্যা করার কথা ভাবছে ওরা? নাকি এই দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে আরও খানিকটা সময় নষ্ট করে দিতে চাইছে ওরা? অস্থির সিরাজ একবার ভাবলো সে নিজেই বেরিয়ে পলাশি হাউসে গিয়ে ক্লাইভের সঙ্গে কথা বলবে কিন্তু মনে হল সেটা ঠিক হবে না। এই নিরাপত্তার বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে গেলে বাঁচার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
অবশেষে মিরজাফর এল, সঙ্গে পুত্র মিরান এবং খাদিম হুসেন খানসহ অস্ত্রশস্ত্রসজ্জিত প্রচুর লোকলস্কর। সিরাজ অত্যন্ত বিনীত এবং বিনম্রভাবে মিরজাফরকে অভিবাদন জানালো। কিছুক্ষণ কথা বলার পর নিজের মাথার মুকুট মিরজাফরের সামনে নামিয়ে রেখে বললো,’ আমি আপনার প্রতি যে আচরণ করেছি তার জন্য আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত। আমাদের মধ্যে যে বৈরিতা সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য আমি দায়ী এবং সে জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমি জানি আমার পূর্বসুরী মাতামহ আলিবর্দি খান আপনার সমর্থন সবসময় পেয়েছেন এবং নানাসময় নানাভাবে তিনি আপনার প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। আমি বিশ্বাস করি যে নবাববংশের প্রতিনিধি হিসাবে এবং আমার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক মাথায় রেখে নবাব আলিবর্দি খানের কাছ যে সম্মান এবং সম্পদ আপনি পেয়েছেন তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আপনি আমার এবং রাজমুকুটের সম্মান এবং জীবন রক্ষা করবেন।‘ সিরাজের এই আবেগময় অনুরোধ মিরজাফরের মনে কোনও দাগ কাটতে পারলো না। অতীতের কথা তো মিরজাফর কবেই ভুলে গেছে এখন শুধু ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর সে। যে সুযোগের সন্ধানে এত রাত বিনিদ্র কাটিয়েছে সে সেই সুযোগ আজ তার সামনে উপস্থিত। দিনশেষের আলোয় হীরকখচিত রাজমুকুটের দিকে তাকিয়ে রইল মিরজাফর। তারপর কঠিনস্বরে বললো,’ দিন শেষ হয়ে আসছে। নতুন করে আক্রমণ করা আজ আর সম্ভব নয়। যুদ্ধরত সেনাবিহিনীকে আজকের মত যুদ্ধ বন্ধ রেখে ফিরে আসতে বলুন। কাল সকালে আমরা সমস্ত সেনাবাহিনীকে একত্রিত করে ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে নতুন করে আক্রমণ শুরু করবো।‘ সিরাজের মনের সন্দেহ আন্দাজ করে মিরজাফর বললো যে রাত্রে যাতে শত্রুপক্ষ কোনওভাবে আক্রমণ না করে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তার। সিরাজের আতঙ্ক তীব্র হতে থাকলো। সিরাজের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ দেখে রাইদুর্লভ বললো,’ যুদ্ধবন্ধের আদেশ দিয়ে আপনি মুর্শিদাবাদ ফিরে যান। বাকিটা আমরা দেখছি।‘
ওদিকে মোহনলাল এবং তার সেনাবাহিনী তখন প্রবল পরাক্রমে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর দিকে এগিয়ে চলেছে। ফরাসি সৈন্য এবং নিজের বাহিনীর মনোবল এখন তুঙ্গে। লক্ষ্যে অবিচল মোহনলাল যখন যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছে তখন তার কাছে এসে পৌঁছলো সিরাজের আদেশনামা। যে নিরাপত্তারক্ষী আদেশনামা নিয়ে এসেছিল তার হাত দিয়েই চিঠি লিখে মোহনলাল জানালো যে তারা এইমুহূর্তে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে এবং যুদ্ধ বন্ধ করা একদমই ঠিক হবে না। যা হবার আজকেই হবে। এই সুযোগ হারালে আর ফিরে পাওয়া যাবেনা। প্রবল পরাক্রমে এগিয়ে চলা সেনাবাহিনীকে থামিয়ে দিলে তাদের মনোবল ভেঙে পড়বে এবং ছত্রভঙ্গ সেনাবিহিনীকে আবার একত্রিত করা অসম্ভব হতে যাবে। সিরাজ মোহনলালের উত্তর মিরজাফরকে পড়ে শোনাল। মিরজাফর বললো,’ আমি আপনাকে যে উপদেশ দিয়েছি তা পালন করা বা না করা আপনার সিদ্ধান্ত। আপনি নবাব হিসাবে যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই করুন।‘ মিরজাফরে বরফকঠিন কন্ঠস্বর শুনে ভয়ে হিম হয়ে গেল সিরাজের মেরুদন্ড । আসন্ন মৃত্যুর আশংকায় নিজের যুদ্ধচালনার অভিজ্ঞতা এবং সাধারণ বোধবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে মোহনলালকে বারবার যুদ্ধবন্ধের আদেশ পাঠাতে থাকল সিরাজ। একেই বোধহয় বলে নিয়তি। যুদ্ধজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে রাজাদেশে বাধ্য হয়ে যুদ্ধবন্ধের হুকুম দিল মোহনলাল। হতচকিত এবং বিভ্রান্ত সেনাবাহিনী কিছু বুঝতে না পেরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকলো। তারা বিশ্বাসই করতে পারছিল না। কিন্তু বারবার মোহললালের আদেশ শুনে বন্ধ হয়ে গেল গোলাবর্ষণ। বিস্মিত ফরাসি সৈনিকেরা পিছুহটা সেনাদের বাঁচাবার জন্য গুলিবর্ষণ বন্ধ করলো না। সৈন্যদের একেবারে সামনে যে বিশাল মহিষবাহিনী এগিয়ে যাচ্ছিল তাদের উল্টোদিকে ঘোরাতে একটু বেগ পেতে হলেও তারা যখন উল্টোদিকে এগোতে শুরু করল তাদের পিছন পিছন সিরাজের সেনাবাহিনী তাঁবুর দিকে রওনা দিল। বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিদের অধীনস্থ সৈন্যবাহিনীরাও সারাক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে তাঁবুর দিকে রওনা দিল। নবাবের সেনাবাহিনীর এই অদ্ভুত পশ্চাদপসরণে অবাক হয়ে ইংরেজরা ভাবলো হয়ত মীর মদনের মৃত্যুতে অথবা ইংরেজদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের ভয়ে পিছু হটছে নবাবের বিশাল সেনাবাহিনী। পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি দেখে মেজর ক্লিপট্রিকের মনে হল এটাই প্রতিআক্রমণের উপযুক্ত সময়। এই সুযোগ হাতছাড়া করার মত বোকামি আর হয়না। দু’কোম্পানি সৈন্য আর কয়েকটা কামান নিয়ে নবাবের সৈন্যদের ধাওয়া করার অনুমতি চেয়ে পাঠাল মেজর ক্লিপট্রিক। ক্লাইভ ক্লিপট্রিককে এত কম সৈন্য নিয়ে আক্রমণের অনুমতি দিলনা। সেই সময় ক্লাইভের আদেশে কুটে তার সেনাবাহিনী নিয়ে যোগ দিল এবং ক্লাইভ নিজে এই আক্রমণে নেতৃত্বে রইলো। ফরাসিরা আপাতভাবে যুদ্ধ বন্ধ করেছে মনে হলেও তারা গোপনে আবার আক্রমণ চালানোর জন্য প্রস্তুত রইল। যুদ্ধ এখনও বাকি। মোহনলালের জামাতা বাহাদুর আলি খান তখনও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছু হটেনি। ব্রিটিশবাহিনী যখন সিরাজের তাঁবুতে এসে পৌঁছল তখন মিরজাফরের চিঠি এসে পৌঁছল ক্লাইভের কাছে। সময় তখন বিকাল পাঁচটা।
আমার সঙ্গে নবাবের দেখা হয়েছে। নবাব দৃশ্যতই ভীত এবং সন্ত্রস্ত। সে আমার কাছে লোক পাঠিয়েছিল এবং নিজের মাথার মুকুট আমার সামনে রেখে কোরানের উপর আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে যে আমি যেন আপনার পক্ষে না যাই। আপনি হয়ত জানেন এই মুহুর্তে পরিস্থিতি বদল হয়ে আপনার অনুকূলে এসেছে। মীর মদন মৃত। বক্সি হাজারি নিহত। আমি, রাইদুর্লভ এবং খান ডানদিক থেকে বামদিকে চলে এসেছি। আমরা একসাথে ওদের ধাওয়া করলে পালানো ছাড়া ওদের আর কোনও রাস্তা থাকবে না। কিন্তু তার আগে আমাদের তিনজন এবং আপনার একসাথে দেখা করার প্রয়োজন আছে। আমরা ব্যাপারটা আজ রাত্রেই শেষ করতে চাই। প্রত্যেকে চুক্তি অনুযায়ী তাদের কর্তব্য পালন করছে। নবাব কাল সকালে মুর্শিদাবাদ ফিরে যাবে বলে মনে হয়। আমরা আজ রাত্রে আক্রমণ করব। আপনি সেসময় ওখানে থাকলে নবাবকে বন্দি করতে পারবেন।
অপরদিকে সিরাজের আদেশে মোহনলাল অনিচ্ছাসত্ত্বেও যুদ্ধ বন্ধের হুকুম দিয়েছে। ফরাসিরা তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। যে সমস্ত বিশ্বাসী সেনারা লড়াই চালাচ্ছিল তারা যখন দেখলো মিরজাফর, রাইদুর্লভ এবং ইয়ার লতিফের বিশাল সেনাবাহিনী এই যুদ্ধে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে তখন তাদের মনোবল ভেঙে গেল এবং পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে তারাও পিছু হটতে শুরু করল। আতঙ্কিত সিরাজের কাছে যখন খবর এসে পৌঁছল যে মিরজাফর পরের দিন যুদ্ধ শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও তাকে সাহায্য করা তো দূরের কথা উল্টে আরও দু’জন সেনাপতির সঙ্গে জোট বেঁধে তাকে আক্রমণের পরিকল্পনা করছে তখন যে বিশ্বাসঘাতকতার কথা সে এতদিন বিশ্বাস করেনি তা তার সামনে প্রকট হয়ে উঠলো। সিরাজ বুঝতে পারলো সব শেষ। হাজার হাজার সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাচ্ছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তাদের ধাওয়া করে তাঁবুতে এসে পৌঁছবে।আগে থেকে সবই প্রস্তুত ছিল। কালবিলম্ব না করে একটা উটের পিঠে উঠে দু’হাজার অশ্বারোহী সৈন্য সঙ্গে নিয়ে তীব্রগতিতে মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা দিল সিরাজ। ক্লাইভ এবং তার বাহিনী যখন সিরাজের তাঁবুতে এসে পৌঁছল তখন তাঁবু জনশূন্য । ক্লাইভ বুঝতে পারলো যুদ্ধজয় সম্পন্ন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিরজাফরের আর একটা চিঠি ক্লাইভের হাতে এল। ‘ যুদ্ধজয়ের জন্য এবং পরিকল্পনার সার্থক রূপায়নের জন্য আপনাকে অভিনন্দন।আপনি ওয়াটস বা অন্য কোন অফিসারকে আমার কাছে পাঠান। আমি দীঘির ধারে অপেক্ষা করছি।‘ ক্লাইভ উত্তরে জানালো,’ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কাল সকালে দাউদপুরে আমাদের দেখা হবে। এখনও কিছু কাজ বাকি। আমাদের সুনিশ্চিত করতে হবে যে নবাবের সৈন্যরা যেন কোথাও গোপনে একত্রিত না হয়।‘
ক্লাইভ তার সেনাবিহিনীকে আদেশ দিল যে কোনভাবেই যেন নবাবের সৈন্যরা আশেপাশে জড়ো না হতে পারে। সিরাজের তাঁবুতে পরিত্যক্ত মূল্যবান জিনিসপত্র তারা অবাধে লুন্ঠন করতে পারে। এছাড়াও পরেরদিন দাউদপুরে তাদের সকলকে পুরষ্কৃত করা হবে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নবাবের পরিত্যক্ত সামগ্রী অবাধে লুঠ করতে থাকলো। পরিত্যক্ত এবং ছত্রভঙ্গ মহিষবাহিনীকে যতদূর সম্ভব একত্রিত করে তাদের পিঠে জিনিসপত্র চাপিয়ে দাউদপুরের দিকে রওনা দিল। মেজর কুটে যে এতক্ষণ সিরাজের তাঁবু অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছিল সে এখন তার বাহিনী নিয়ে নবাবের যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে আসা সৈন্যদের তাড়িয়ে নিয়ে চলল। রাত্রি যখন আরও একটু গভীর হল এবং কুটে নিশ্চিত হলো যে নবাবের সেনাবাহিনীর আর একসাথে জড়ো হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই তখন তার সৈন্যদের বিরতির নির্দেশ দিল। সবাই এখন পলাশির থেকে দশ কিলোমিটার উত্তরে দাউদপুরে এসে পৌঁছেছে। ইতিমধ্যে মেজর ক্লিপট্রিকের সৈন্যরা এসেও যোগ দিয়েছে। রাত্রি তখন আটটা।
এমনি ভাবেই হঠাৎ শেষ হয়ে গেল পলাশির যুদ্ধ। শুরু হলো ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের যা চলবে পরবর্তী প্রায় দু’শ বছর।
এত কম সময়ে এবং এত কম মৃত্যুর বিনিময়ে ব্রিটিশরা এর আগে কোনও যুদ্ধজয় করেনি বলে দাবি জানালো ক্লাইভ। ২রা জুলাই সিলেক্ট কমিটিকে লেখা ক্লাইভের রিপোর্টে বলা হয়েছে এই যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মাত্র বাইশজন নিহত এবং পঞ্চাশজন আহত হয়েছিল যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল ভারতীয়। নবাবের সেনাবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি তবে ক্লাইভের রিপোর্ট অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা আনুমানিক পাঁচশো। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা স্পষ্টতই কম করে দেখানো হয়েছে সবসময়।
যুদ্ধজয়ের পরেও একাধিকবার সিলেক্ট কমিটির সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল ক্লাইভকে। যুদ্ধজয়ের তিনদিন পর অর্থাৎ ২৬শে জুন সিলেক্ট কমিটির উদ্দেশ্যে এক চিঠিতে ক্লাইভ লেখে,’ আমি আমার চিঠির উত্তরে মিঃ ড্রেকের লেখা চিঠি পেয়েছি। বিজয় উৎসবের সময়ে এই ধরণের চিঠি অনভিপ্রেত এবং আশ্চর্যজনক। চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে যদি কোনও কারণে এই যুদ্ধে আমাদের পরাজয় হত তাহলে তার সমস্ত দোষ আমার ওপর চাপানো হতো।‘ক্লাইভ এবং সিলেক্ট কমিটির এই বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল।