গল্প - উত্তম বিশ্বাস
Posted in গল্পবিমানের বৌ মানত করেছে। বুড়ো শিবঠাকুর তার স্বামীকে যদি সারিয়ে তুলতে পারে, তবে তাঁর নামে আস্ত একখানা সোনার কলকে বানিয়ে দেবে। আর চাঁদোয়াদের পুকুরে চার কলস দুধ ঢেলে চড়ক ঠাকুরকে চান করাবে।
বিমানের ঘরে এসে অব্দি একটা দিনের জন্যেও মাথা উঁচু করতে পারেনি ধারা! সবসময় তাঁর মনে হয়েছে, তার স্বামীকে কারা যেন ছুপে রেখেছে। একদিকে সমাজের অবজ্ঞা, অপর দিকে বিমানের কথা ভেবে ভেবে সেও আজকাল কেমন যেন উন্মনা হয়ে থাকে।
ধারা ভাবে, “মাস্টার ছেলে দেখে বাবা আমার বিয়ে দিল বটে! কিন্তু সেই সন্মান কোই?”
সত্যিই তো! ধারা লক্ষ্য করেছে, সম্মান তো করেই না। পারলে উল্টে থুতু ছিটিয়ে মানুষ তাদের মুখের খোল আকচানোর জন্যে ধারার উঠোনকে বেছে নেয়! আর যারা এতটা ভয়ঙ্কর হতে পারেনা, তারা বলাবলি করে, "বিমান ছেলেটা কেমন যেন! হাসেনা। কারোর সাথে মেশে না। এমনকি মানুষের সামনে মুখ দেখাবে না বলে সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকে!”
এমনি ধারার নিজের বাপের বাড়ির লোকেরাও টিপ্পনীও কেটে কথা বলে, “হ্যাদে ও ধারা, ও কি রাতে শুতে যাবার সময়ও এসব নেয়?”
বিমান যে একেবারে কথা বলেনা তা নয়, মাঝে মধ্যে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ গুঙিয়ে ওঠে। আর ধারাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করে, "আচ্ছা, আমি যদি মাস্টারিটা ছেড়ে দিই? তুমি আমার সংসারে থাকবে?"
-কী বোকার মতো কথা বলো!"
-"সত্যি বলছি ধারা। কোথাও একটা মস্তবড় ভুল হয়ে গেছে আমার!"
ধারা স্বামীকে স্বান্তনা দিতে দিতে বলে, "জগৎ সংসারে তুমি কি একাই মাস্টার? অপমান হলে সবার হবে। আগে তুমি শক্ত হও। তাহলে দেখবে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে!"
কাল নীল। আজকে সন্ধ্যের মধ্যেই চড়ক ঠাকুরকে তুলবে। চড়ক ঠাকুর বলতে আস্ত একখান শাল গাছের খুঁটি। যেটা সারাবছর চুবানো থাকে চাঁদোয়াদের পুকুরে। সবাই বলে, ওটাই নাকি আদিনাথের খুঁটি। ওঁর কাছে আজ অনেক দাবী আছে ধারার।
আজ প্রথম স্নান। পুণ্যার্থীদের দেখার জন্যে চাঁদোয়াদের পুকুরে লোক গিজগিজ করছে। কিন্তু সবার নজর মাস্টারের দিকে। সকলে দেখছে এক শৌখিন সন্ন্যাসী, বড্ড জবুথবু! আর এই কারণেই ধারা তার স্বামীকে সারাক্ষণ আগলে আগলে রাখছে।
মানুষের কৌতূলের অন্ত নেই,"কে ও?"
-"কে আবার! পাড়ার বিমান মাস্টার।"
মেঠো পাড়ার মানুর মা শানবাঁধানো সিঁড়িতে গোড়ালি ঘষতে ঘষতে বলেই ফেলল, “মাস গেলে তোর বর মুঠো মুঠো টাকা আনে। তাও এমন ঝুম চাষের আখের মতো দেখায় কেন রে? ওর অন্য রোগ নেই তো?”
ধারা ধমক দিয়ে ওঠে, “কী বললে? হাইকোর্ট আছে কিসের জন্যে? যোগ্য না জানলে, আমার বাপ ওর হাতে দিত নাকি?”
মানুর মা নোয়ার ময়লায় নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে, “মাস্টারিতে গেল বলেই তো নীলকান্ত মুখুজ্জে তার অমন সুন্দর মেয়েটাকে বিচুলি-হাটার ব্যাপারীর সাথে বিয়ে দিল!”
ধারা বুঝতে পারে মানুর মা চাঁদোয়ার কথা বলতে চাইছে।
-“দেখি তো মেয়েটা আসে, অমনি মাস্টারের মুখে খই ফোটে! তখন কিন্তু মোটেও মনে হয়না তোমার উনি এমন অ্যালাব্যালা! জেনে দেখতে পারো, এটাই ওর একমাত্র অসুখের কারণ নয় তো?”
সম্পূর্ণ নির্জলা উপবাসে আছে ধারা। রাতে ওর উঠোনে অনেকগুলো মালসা পুড়বে। হাজরা ঠাকুরের জন্যে স্পেশাল ভোগ রান্না হবে। কেননা স্বয়ং হাজরা ঠাকুরই পারবে বিমানের বউএর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে। বিমান যে সমাজের তুচ্ছ বস্তু নয়, এটা ওকে বুঝিয়ে দিতেই হবে। বুড়ো বাবাকে আজ আচ্ছা করে ভোগ খাওয়াবে ধারা। আর ভোগ খাওয়ানোর পর ওটাকে তুলতে হবে। বিমান এবার সন্ন্যাসীদের হেড। যাকে নিয়ে এই চৈত্র সংক্রান্তিতে এত মাতামাতি সে আর কেউ নয়, কুড়ি বাইশ ফুটের একটা শালবল্লি। ওটার গায়ে সারাবছর ধরে হাজার হাজার গেঁড়িগুগলি আর শামুক লেপটে থাকে।
জলে নেমে ধারার বুকের মধ্যে ছ্যাত করে উঠল,"সামান্য একখানা শালকাঠের খুঁটি! সত্যি সত্যিই সে এমন অসীম শক্তির আধার হয়ে ওঠে?” একথা যতবার ধারা ভাবতে চেষ্টা করল, ততোবারই ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল!
সন্ন্যাসী হতে বিমানের মোটেই ইচ্ছে করছিল না। কেননা সে এসব কোনও কালেই করেনি। কিন্তু ধারার জেদ আর ইচ্ছেকে অমান্য করার মতো যে শক্তিটুকুর দরকার হয়, ইদানিং সেটাও বিসর্জন দিয়ে বসে আছে বিমান।
আজ একের পর এক অনেকগুলো নিয়ম পালন করতে হবে। প্রথমে কাদা খেলা। কাদা খেলা হয়ে গেলে খোকন বোসের খেজুর গাছের কাঁটা ভাঙতে হবে। তারপর সবশেষে আগুন ও কাটারির ওপর ঝাঁপ দিতে হবে।
-“ধারালো কাটারির ওপর ঝাঁপ দিতে হবে? মারা পড়ব তো?” বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকে বিমান।
নিমাই কাকা অভয় দিয়ে বলল “কোনও ভয় নেই মাস্টার। কিচ্ছু হবেনা। শুদ্ধু আচারে ঝাঁপ দিতে পারলে তেলের কড়াইতে ফেললেও তুমি পুড়বে না।”
কিন্তু কাদা খেলা? ওটাও তো সাঙ্ঘাতিক বিপজ্জনক! সামান্য একফালি গামছা পরে হাজার হাজার মানুষের মাঝখানে কুস্তি! না কিছুতেই সম্ভব নয়!”
ধারা ধমক দিয়ে উঠল, “কেন দিদিমণিদের সামনে ন্যাংট পরে ফুটবল খেলতে পারো। আর দেবতার কাজে এত আড়ষ্টতা?”
হঠাৎ নিমাই ঢাকি বলে উঠল, “ওই দেখ চাঁদোয়া।”
পুকুরের একপাশে কাৎ করে রাখা একটা গরুর গাড়ি। ওর ওপর বসে আকন্দ ফুলের মালা গাঁথছে এক অপরূপা!
-‘তাই বলি! মেয়ে মানুষ হয়ে সন্নেসী হবার শখ কেন?" মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠল ধারা। আগুন আনবার অজুহাত দেখিয়ে একটুখানি সরে দাঁড়াল।
বিমান একটুখানি হাসল। আর ঠিক তখনই সকলে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “বাবা তারক নাথের চরণে সেবা লাগে! দেবের দেব মহাদেব!”
সন্ন্যাসীরা মালকোঁচা মেরে মাটিতে মাথা ঠুকে হুঙ্কার ছাড়তেই চাঁদোয়া বড় বড় দুটো বাতাবি লেবু কাদার মধ্যে চেলে দিয়ে প্রণাম করল। লেবুকে লুফে নিতে কাদার মধ্যে সন্ন্যাসীরা হামলে পড়ল।
শাঁখ আর উলুতে এখন হুলুস্থুল কাণ্ড! শিবের নামে কুস্তাকুস্তি চলছে চরম। সম্ভ্রম নিয়ে সন্ন্যাসীদের কারও আর হুঁশ নেই। সবাই এখন শিবের শিরোপা পেতে মরিয়া!
দর্শনার্থীরা যে যেদিক থেকে পারছে, মন্তব্য করছে। লেবুর দখল যে পাবে, সেই হবে আদি পুরুষ। ঝোল কাদার মধ্যে লেবু পিছলে পিছলে যাচ্ছে!
সবাই বলছে, “আরে, মাস্টারকে পুঁতে ফ্যালা চাই! মাস্টার যেন লেবু না পায়! সবাইমিলে চেপে ধর!”
কথাগুলো উৎসাহ থেকে ক্রমশ উস্কানিতে নেমে আসতে লাগল। সেই বিদ্বেষমাখা কথাগুলো বিমানও যেন শুনতে পাচ্ছে। একসময় সে লেবু ছেড়ে দিয়ে কোট থেকে উঠে গেল।
কয়েকজন ধাওয়া করে এল। কেউ কেউ কাদার তাল ছুঁড়ে মারল। অনেকে খোঁচা দিয়ে বলে উঠল, “গুঁতোর নাম বাবাজি! সরকারের টাকা বসে খেয়ে খেয়ে তেল জমে গেছে! আসল পরীক্ষা তো এইখানে!”
কাদাখেলা শেষ। এখন আগুনের ওপর ঝপাঝপ ঝাঁপিয়ে পড়ছে সন্ন্যাসীর দল। কাটারির ওপরেও পড়ছে কেউ কেউ। কারোর কিছু হচ্ছে না। আগুন আর কাটারি পাল্টাতে গিয়ে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছে ধারা! কিন্তু বিমান কোথায়? সে নেই কেন?
একটা গরুর গাড়ির চালির ওপরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বিমান।
"এটার ওপর বসেই মালা গাঁথছিল বুঝি চাঁদোয়া? হয়ত হবে।"
হঠাৎ একফালি চাঁদের মতো ওর শিয়রে হেসে উঠল চাঁদোয়া, “চলে এলে যে? সত্যি বলছি, সন্ন্যাসী হিসেবে তোমাকে কিন্তু মোটেই মানায়নি !”
-“সেই জন্যেই তো সরে আসলাম।!”
-“তোমার লজ্জা লাগছে না?”
বিমান অবাক হল খুব, “কীসের লজ্জা?”
-“এই যেমন মনে করো আমি সামনে এসে দাঁড়ালাম! অথচ তুমি খালি গায়ে সামান্য একটা গামছা পরে?”
সহসা বিমানের চোখের কোনা দুটো চিকচিক করে উঠল! কিন্তু সে সামলে নিল। বলল, “আমি তো এখন সন্ন্যাসী! সন্ন্যাসীর আবার লজ্জা কীসের?”
-“শুনলাম আজ রাতে তোমরা নাকি শ্মশানে যাবে?”
-“হ্যাঁ। মালসা পোড়াতে মড়ার খুলি তো লাগবেই!”
-“আমাকে নেবে?”
-“কেন?”
-“মানত আছে। প্রথমেই যে কঙ্কালটাকে তুলবে, তার সাথে আজ আমি কন্ঠি বদল করব! এই দেখো একুশটা আকন্দ ফুল দিয়ে মালা গেঁথেছি!”
-“কী যা তা বলছ? মেয়েরা যায় নাকি?”
-“আমার যে মানত আছে বিমান!”
বিমান আরও বোবা হয়ে গেল। তবু উচ্চারণ করল, “কে সে?”
চাঁদোয়া উত্তর দিল না। সে পূর্বের মতো মালা গাঁথায় মনোনিবেশ করল।
অন্ধকারে কোদাল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিমান।
একজন চাপা স্বরে বলল, “চোখ বন্ধ কর বিমান!”
বিমান চোখ বন্ধ করল।
এবার পেছন থেকে একজন বিমানের পরনের গামছাটা এক টানে খসিয়ে নিল। বিমান চেঁচিয়ে উঠল, "আরে! ন্যাংটো করে দিলি কেন?"
শুনশান শ্মশান। কেউ কোনোকথার উত্তর দিচ্ছে না। অন্ধকারে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিমান। এক উলঙ্গ স্কুল মাস্টার!
কাদার মধ্যে বেল-কাঠের খুঁটি পুঁততে পুঁততে একজন বলে উঠল, "কী হল মাস্টার? কোপ দাও। এটাই নিয়ম। খুলি তুলবার সময় অঙ্গে একটুকরো সুতোও রাখা চলবে না। শোল তো সেদ্ধ হবেই না। সেইসাথে প্রেতযোনির কোপে পড়বার আশঙ্কা থেকে যাবার সম্ভাবনা থাকে।"
সকলে বাবার নামে হুঙ্কার ছাড়ল।
কিন্তু এ কী!
কাঁচা বডির ওপর কোপ বসিয়েছে বিমান!
অথচ শ্মশানে আসবার আগে ধারা ওকে পইপই করে বুঝিয়ে দিয়েছিল, "মাথা তুলবার সময় তুমি বেশি মাতব্বরি ফলাবে না। অন্যের ওপর ছেড়ে দেবে।"
কিন্তু কোথায় মাথা?
সবাই বলল, “তুমি মাস্টার! তুমি যেটা করবে, ওইটেই আমরা মেনে নেব!”
অন্ধকারে কোদাল নিয়ে হাতের আন্দাজে কোপাতে লাগল বিমান। যখন উঠল, গন্ধে ওর মাথা টাল খেতে শুরু করল!
সবাই ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, “কী হে মাস্টার, তোমার মা মনে হচ্ছে?”
ওদের মধ্যে একজন খেঁকিয়ে উঠল, "মাস্টারের মা মরেছে এক বছরের বেশি হল না? এখনো থাকে নাকি?"
বিমান আর বাক্যব্যয় করার শক্তি পেল না। সে ওখানেই লুটিয়ে পড়ল। সকলে ধরাধরি করে নিয়ে ওকে শ্মশান থেকে তুলে আনল।
আজ চড়ক।
বিমান শুয়ে আছে দাওয়ায়। ডাক্তার বলে গেছে, "ভেতরে প্রচুর বদ জার্ম ঢুকেছে। কখন হুঁশ ফিরবে ঠিক বলা যাচ্ছে না!”
দুই হাঁটুর ফাঁকে মাথা দিয়ে বসে আছে ধারা।
ফুটো ভাঁড় থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ছে। হয়ত ওটাই গুনছে সে।
চাঁদোয়াদের চণ্ডীমণ্ডপের চাতালে হরেক রকমের দোকান বসেছে। মেলা লাগবার আগেই তালপাতার পাখা সব বিক্রি হয়ে গেছে।
পাখা ওয়ালা গায়ে গামছার বাড়ি দিয়ে এখন মনের সুখে এর ওর উঠোন দিয়ে হেঁটে হেঁটে হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে।
ধারার উঠোন দিয়ে যাবার সময় লোকটা আজ আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “ভদ্রলোক মাস্টারি করেন শুনেছি?”
ধারা জড়ানো গলায় উল্টে প্রশ্ন করল, “কেন বলুন তো?”
-“ইস! কাল যেভাবে ন্যাংটা করে উনাকে নিয়ে মেলার মাঠে ঘোরানো হল!”
-“মানে?”
-“শ্মশানে শরীর খারাপ করেছিল শুনছিলাম? তখন অনেক রাত। আমরা দুয়েকজন জাগা। মেলায় দোকান গোছাচ্ছিলাম। এমনসময় মাস্টারকে উলঙ্গ অবস্থায় কাঁধে করে নিয়ে ওরা এল!”
-“ওরা কারা?”
-“ওই তো সন্ন্যাসীরা। সাথে একটা মেয়েও ছিল। হাতে আলো নিয়ে আগে আগে যাচ্ছিল।”
-“কোথায় কোথায় গিয়েছিল বলতে পারেন?”
-“প্রথমে পুকুরে গেল দেখলাম। আচ্ছা করে চান করালো। তারপর বলাবলি করছিল, এখুনি হাসপাতালে নিতে হবে। একজন বলল, কৈলাশের কাছে নে। কৈলাশ না কে একজন হাতুড়ে আছেন শুনেছি?”
বিকাল গড়িয়ে গেছে। মেলার মাঠে তিল ধারণের জায়গা নেই।
মাঝে মাঝেই হল্লা উঠছে, “চড়ক শুরু হবে কখন?”
এবারে ভিড়ও হয়েছে সাংঘাতিক! কেননা এবার চড়কে পবন পাড়ুই আসছে। ওর সাংঘাতিক সাহস! দীর্ঘক্ষণ বঁড়শিতে ঝুলে থাকার জন্যে অনেক খেতাব আছে ওর ঝুলিতে! ভীড় টানার জন্যে পার্বণ কমিটি বরাবরের জন্যে পবন পাড়ুইয়ের নাম প্রস্তাব করে আসছে। অতএব পবনকে হায়ার করে আনা হচ্ছে। এর জন্যে টাকা দিতে হবে এত্তোগাছি! পাচু কাকা মাইকে এতক্ষণ ধরে মন্থর লয়ে ঘোষণা করছিলেন। হঠাৎ আবেগতাড়িত হয়ে সাকলকে চমকে দিলেন, “আপনারা আর একটুখানি ধৈর্য ধরুন! এইমাত্র খবর এল, পবন রওনা দিয়েছে!”
কুড়কুড় করে ঢাক বেজে উঠল। দূরে মেয়েদের উলুধ্বনি দিল। সবাই ভাবল হয়ত ধারা আসছে। কিন্তু না। একান্নখানা নতুন গামছা বিছিয়ে ওর ওপর দিয়ে দণ্ডী খাটতে খাটতে এগিয়ে আসছে বাপন স্যাকরার মা। গত বছর সিভিকে জয়েন করেছিল বপন। এবছর হাইকোর্টের বিষ নজরে পড়েছিল বপন। এট্টুর জন্যে বেঁচে গেছে সে। বাপনের মা ও আজ বাতাসা ছড়াবে মেলা!
দুয়েকটা করে টাকা উড়ে আসতে লাগল। পাচু কাকা মাইকে অনুরোধ করলেন, “কেউ পয়সা ছুড়বেন না! আমাদের প্রণামীর থালা যাচ্ছে, অনুগ্রহ করে ওতে দিন!”
একখানা বড় পেতলের থালা হাতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে চলেছে চাঁদোয়া। মলিন মুখ। শুকনো চটা হয়ে আসা শরীর। পরনে নতুন চেকের শাড়ি। কাঁধে লাল গামছা। গলায় বাবার নামাঙ্কিত হলুদ ধাগা! এমন মুখখানি দেখে সত্যিই খ্যা হয়! এখন সবাই ওর থালায় টাকা ফেলছে। কেউ দশ টাকা, কেউ একশ টাকা। জোরে ঢাক বাজছে। ধ্বনি উঠছে মুহুর্মুহু, “বাবা তারক নাথের চরণে সেবা লাগে!”
এবার পাঁচশ টাকার নোট পড়ছে। উড়ে আসছে মুঠো মুঠো! কিছুক্ষণ বাদে বাদেই থালা উপচে উঠছে! সন্ন্যাসীদের ডেকে চাঁদোয়া ওই টাকা ওদের ডালায় ঢেলে দিচ্ছে। আর ওরা এক দৌড়ে যেখানটায় চড়কের খুঁটি পোঁতা হয়েছে, ওর গোড়ায় রেখে আসছে। আবার টাকা পড়ছে। মানুষ টাকা দিয়ে মাথা নত করে আশীর্বাদ চাইছে। এবার চাঁদোয়া খালি হাতে কাউকে ফেরাচ্ছে না। সে তার গেঁথে রাখা আকন্দ ফুলের মালা থেকে একটা করে ফুল পুণ্যার্থীদের হাতে দিয়ে একগাল হাসি ছিটিয়ে দিচ্ছে!
এমনসময় এসে পৌঁছাল মানুর মা। ওর মাথায় ধামা ভর্তি বাতাসা। সবাই জিজ্ঞাসা করছে, “এত বাতাসা কার?”
-“মাস্টারের!”
-“আরে! ওরা আসছে না কেন?”
মানুর মা এগিয়ে যেতে চেষ্টা করল। কিন্তু কেউ ওকে পাত্তা দিল না!
দূরে তখন চাঁদোয়ার বাটার ওপরে হুমড়ে পড়েছে হাজারে হাজারে পুণ্যার্থী!
এবার মানুর মা ভীড় ঠেলে এসে খপ্ করে চাঁদোয়ার হাত ধরে ফেলল, “এই মেয়ে, এসব কী হচ্ছে শুনি? কার জন্যে এত টাকা কালেকশান করছ?”
-“বিমান মাস্টারের জন্যে!”
মানুর মা জিভ কেটে বলে উঠল, “কেন রে, ওদের কি টাকার অভাব?”
-“বিমান মাস্টারি করে যে টাকা মাইনে পায়, সেই অর্থে ওর এই রোগ সারবে না!”
-“তোমাকে হুলিয়া দিয়ে টাকা তুলবার অনুমতি কে দিয়েছে? ধারা? এটা রীতিমতো অন্যায়!”
-“অন্যায় তো ধারাও তো কম করেনি পিসিমা!”
-“মানে?”
-“বিমানের ব্যক্তিগত জীবনকে ধারা বিষিয়ে দেয়নি? ধারাই তো আজ তাকে নিলামে তুলেছে!”
-“ধারা যখন শুনবে, তোর পরিণতি কী হবে ভেবে দেখেছিস?”
-“ভাবব পরে। পারলে টাকাগুলো নিয়ে যাও। ধারাকে দাও। সবাই বলাবলি করে, ওর স্বামী নাকি জটিল রোগের স্বীকার?"
চাঁদোয়া আর মানুর মায়ের চমকানিকে বিশেষ পাত্তা দিল না। সে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।
মানুর মা ধামা ফেলে দৌড়ে গেল ধারাকে খবর দিতে।
-"দেখো যেয়ে, মাস্টারের নামে আঁচল পেতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা তুলছে!"
-"কে?"
-"কে আবার! সখী সন্নেসী, চাঁদোয়া!"
কথাটা থামিয়ে দিয়ে ধারা বলে উঠল, "আমাকে একটু তাল রসের তাড়ি এনে দিতে পারো মানুর মা?"
মানুর মা ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল, "হঠাৎ তাল রসের তাড়ি কী করবি?"
-"উপোস ভাঙব!"
মানুর মা দেখল, ধারার চোখেমুখে আজ ঝড়ের ঝিলিক!
এখন ভেঁপু বাঁশি ভুভুজেলায় কানমাথা ঝাপাপালা করতে লাগল! হঠাৎ কে যে ঘোষণা করল, “দুঃখিত! পবন আসতে পারছে না!”
আসতে পারছে না মানে? কী এমন হল? এখন বিকৃত স্বরে বারুদের আগে আগে নানান সংলাপ ভাসতে লাগল, “শালা! ভাং খেয়ে উল্টে পড়েছে!”
কেউ বলল, “আরে এসব না। পুলিশ ওর বাড়ি রেট করেছে! হদ্দম বোমা ফাটছে শুনছিসনে?”
এবার একসাথে আওয়াজ উঠল, “হবে না? চড়ক হবে না?”
ভীড়ের ভক্তি ক্রমশ হুজ্জুতি আর ঠেলাগুঁতোর দিকে এগোতে লাগল। মানুষ এখন ছত্রভঙ্গ। কেউ কাউকে রেয়াত করছে না। যে যেখান থেকে পারছে হাসি হল্লা উগরে দিচ্ছে।
সন্ন্যাসীরাও একেবারে শালকাঠের খুঁটি হয়ে আছে। ওদের শরীরেও শক্তি ফুরিয়ে এসেছে। কেউ আর তারক নাথের নামে জয়ধ্বনি দিতে পারছে না। কেউ কেউ ক্ষীণ স্বরে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করে “চড়ক হবেনা?”
-“হবে!” মালকোঁচা মেরে গাছের গোঁড়ায় প্রণাম করল বিমান!।
চাঁদোয়া ছুটে এসে বিমানের হাত ধরে বলল, “তুমি এসব কেন করবে মাস্টার? অত উঁচু থেকে বঁড়শি ছিঁড়ে পড়লে বাঁচবেনা!”
বিমান চাঁদোয়ার হাত থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, “সামনে আসলে খুন করে দেব বলে দিলাম!”
বিমানের চোখ এখন রক্তজবার চাইতেও লাল!
পাচু কাকা বললেন, “তুমি পারবে তো মাস্টার?"
বিমান পিঠ চিতিয়ে দিল।
পাচু কাকা আবেগ মাখা গলায় হাঁকডাক শুরু করে দিলেন,"এই মেয়ে, সরে দাঁড়া রে! ওরে, বড়শি কোথায় তাড়াতাড়ি আন!”
নিমাই ঢাকের কাঠি উঁচিয়ে হাঁকল, “এই কে আছিস, এট্টু তেল নিয়ে আয়!”
তেল এল। মাস্টারের মোলায়েম পিঠে মালিশ করে, আরও মোলায়েম করা হল। এরপর যখন নিমাই নখ দিয়ে খিমচে বঁড়শি বিঁধিয়ে দিল, চাঁদোয়া কাঠের বার কোশের ওপরে আছাড় খেয়ে পড়ল!
এবার ভাংড়া তালে দুড়ুম ঢাক বেজে উঠল!
প্রথমে পাচু কাকা পাক দিতে শুরু করলেন। কিন্তু উনি কিছুক্ষণ দৌড়েই হাঁপিয়ে উঠলেন।
এবার নীলকান্তর পালা। সন্ন্যাসীরা সবাই বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ কান্ত দা, আপনিই পারবেন!”
নীলকান্ত কাছা মারতেই চাঁদোয়া ওর পথ আগলে দাঁড়াল। কেননা ওর কিছু শর্ত আছে। সবাই জানতে চাইল, "কী শর্ত? কী শর্ত শুনি?"
চাঁদোয়া তার নিজের ওড়না ছিঁড়ে বাপের চোখ বেঁধে দিল।
দড়িটা কোমরের সাথে শক্ত করে বেঁধে নিলেন নীলকান্ত। বিশাল বড় এক বঁড়শিতে ঝুলছে বিমান মাস্টার! ওদিকে তাকাতে মানা! এখন আখমলা বলদের মতো বনবন করে ঘুরছে কান্ত, চাঁদোয়ার বাপ!
এখন হাজারে হাজারে মানুষ মাস্টারের দিকে তাকিয়ে হাপিত্যেশ করছে, “বাবা! এবার ফুল ফ্যালো! ফুল ফ্যালো!”
এখন হাজার হাজার হাত উপরের দিকে ওঠানো। প্রায় প্রত্যেকের হাতেই মোবাইল। কেউ ভিডিও করছে, কেউ সেলফি নিচ্ছে। এখন প্রত্যেকটা পাকের সেরা সেরা শটগুলো পলকে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে! কেউ কেউ ক্যাপশন লিখছে, "বছরের সেরা শাস্তি! তবে অনুষ্ঠানটা হাইকোর্টের সামনে হলে আরও বেশি ভালো লাগতো!"
চড়াম চড়াম করে ঢাক বাজছে। জয়ধ্বনি উঠছে বিমান মাস্টার কি জয়! জয় জয় মাস্টারের জয়!
দোকানে দোকানে বিক্রিবাট্টা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক দোকানে আগে থেকেই ঝাঁপ পড়ে গেছে।
এখন মেলার মাঠ জুড়ে কেবল ধুলো আর ধোঁয়া। কেউ কারও মুখের দিকে তাকাবার ফুরসৎ পাচ্ছে না। কিন্তু সবাই বুঝতে পারছে সবাই সবাইকে দেখে হাসছে!
চড়কের চরকায় ঝুলে আছে একজন মুখচোরা স্কুল মাস্টার। একটানা ঘুরছে। মানুষের ধর্ম অধর্ম স্বপ্ন সম্ভাবনা ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা সবকিছু একত্র করে নিয়ে কালবৈশাখীর ঘূর্ণি যেমন ওঠে, সেইভাবে চক্কর কাটছে বিমান!
হঠাৎ হঠাৎ আওয়াজ উঠছে," ফুল কোথায়? ফুল তো পড়ছে না! ওর গলায় যে গাঁদাফুলের মালাটা রয়েছে ওটার থেকেও তো ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিতে পারত! কেন দিচ্ছে না?”
কেউ কেউ আর্তনাদ করে উঠল, “আরে, ওই দেখো কেমন করে মালার ফুলগুলো চিবিয়ে খাচ্ছে!”
এখন অনেক পরে পরে এক ফোঁটা দুফোঁটা রক্ত উড়ে আসছে!
সবার সব মনস্কামনা পূরণ করে দিচ্ছে বিমান। প্রথমে বেশ কয়েকটি বাটা ঘোরালো বিমান। এরপর বিধবাদের ঘট ঘোরালো। এমনকি রায় বাড়ির ল্যাংড়া ছেলেটাকেও ঘোরালো। নীল কান্ত দৌড়ে তার ক্যাশ বাক্স নিয়ে এলেন। ওটাও বিমানের ছোঁয়ায় পবিত্র হল!
সবাই চাইছে মাস্টারের হাতের সামান্য একটুখানি স্পর্শ পেতে। মানুষের আবেগ এখন এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, প্রত্যেকেরই মনে মনে একটাই আশঙ্কা, মাস্টার যদি তাকে না ছোঁয়, তবে কোনোকালেই আর মানব রূপে এই ধরাধামে আসা হবেনা!
এখন হঠাৎ হঠাৎ শিবের ধ্বনি দিচ্ছে বিমান। হঠাৎ হঠাৎ হাসছে! একইসাথে ওর আগ্রাসী হাত দুখানি এমনভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে, দেখলে বুকের পাঁজর কেঁপে ওঠে!
অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে। এমনসময় কে যেন চেঁচিয়ে উঠলেন, "ওরে কে আছিস, ওকে নামা! বেচারা মরে যাবে তো!”
কিন্তু মাস্টার নামবে না। কেউ দড়ি আটকাতে আসলেই বিমান এমন ঝটকা মারছে, যেন সে খুন করতে মরিয়া!
সকলে করজোড়ে মিনতি করতে লাগল, “মাস্টার নামো!”
বিমান হওয়ায় হল্লা ভাসিয়ে হাহা করে বলে চলেছে, "না! নামা যাবে না। মানত আছে!”
-“মাস্টার কথা শোনো! মারা পড়বে তো!”
-“কিছু করার নেই! ধারাকে ডেকে দিন প্লিজ!”
পাচু কাকা মাইকে ঘোষণা করেছিলেন। এবার উনি হাহাকার করে উঠলেন, "তোমরা কেউ একজন মাস্টারের বউকে খুঁজে নিয়ে এসো। বেচারা মারা পড়বে তো!"
সবাই হন্যে হয়ে খুঁজছে।
কে একজন বলল, "ধারা অশোক কামারের কাছে গেছে।"
মানুর মা এক দৌড়ে ছুটে গেল। দেখল, হাপরের আগুন কোলে নিয়ে চুপ করে বসে আছে ধারা।
মানুর মা ওর গায়ে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, "শিগগির চল। নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে!"
-"সবার সবকিছু নাচানো হয়ে গেছে?"
-"হ্যাঁ রে, হ্যাঁ! কেবল তোরটাই বাকি! তোর নাকি কী সব মানত আছে?"
-"আছে তো!"
নেহাইএর ওপর নরম ইস্পাত বুলিয়ে কামার অশোকও জানতে চাইল, "কী মানত শুনি?"
শেষ শব্দটি ধারা আর উচ্চারণ করল না। সে অশোকের কোল থেকে সবচেয়ে শানিত আর শক্ত একখানি হাসুয়া বেছে নিয়ে ভয়ঙ্কর এক হাসি হেসে উঠল!