ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(৫)
আজ সকাল থেকেই রান্না ঘরে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিল রাই। সোমেশ ভালবাসে বলে বিউলির ডাল , মাখামাখা আলু পোস্ত আর পার্শে মাছের গা মাখামাখা ঝোল রান্না করছিল । কদিন্ বাইরে থেকে আসার পর এসব ঘরোয়া খাবারই সে খেতে চায় বরাবর । ভালো লাগছে এইসব রান্নার মধ্যে আজ নিজেকে ব্যাস্ত রাখতে ।সোমেশ এর মা অনেক যত্ন করে রাই কে এসব শিখিয়ে দিয়ে গেছেন । একসময় এ বাড়িতে ঘোমটা দিয়ে রাই কে চলতে হত। তিতলি হবার পর থেকে এসব নিয়ম অবশ্য শিথিল হয়ে আসে। এখন জিন্স-কুর্তিতেও আপত্তি করার কেউ নেই।সোমেশ এসব ব্যাপারে মাথা গলায় না। নন-স্টিক কড়াইতে আলু পোস্তটা বসিয়ে একটু যেন আনমনা হয়ে গেছিল রাই। এই কদিনে সে অনেক ভেবেছে , নিজেকে বুঝিয়েছে রাই , অরাতিদমনের সাথে এই ভার্চুয়াল সম্পর্কটার আসলে কোন ভবিষ্যৎ নেই ! অরাতি ওর থেকে অনেকটাই বয়সে ছোট । এরকম ভাবে একতরফা কিছু গড়ে উঠতে পারেনা। সেটাও রাই বঝে। তবু মন সহজে মানতে চায় না । অরাতির কথা ভাবতে ভাবতেই একটা কটু পোড়া গন্ধ নাকে এল। এই যা! পোস্তটা ধরে গেল বোধ হয় ! তাড়াতাড়ি অবস্থা সামাল দিতে রাই কড়াই টা নামাতে গিয়ে আঙুলে জোর ছেঁকা খেলো। আর ঠিক সেই সময়েই ইমনকল্যাণের বাঁশির টিউনে মোবাইলটা বেজে উঠল। কি আশ্চর্য!এত দিনের রহস্যময়তা ভেদ করে আজ অরাতিদমনের ভিডিও কল ?তাও এই সময়ে? পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই!আইসপ্যাকটা আঙুলে লাগাতে গিয়ে দেরি হুয়ে গেল কলটা ধরতে !খুব আফসোস হচ্ছে নিজের!কাঁপাকাঁপা হাতে আবার ডায়াল করল রাই। নাঃ দ্বিতীয়বার আর ফোন তোলার বান্দা অরাতি নয় ।
সেই থেকে খুব অভিমানে রাই ভিতরে ভিতরে ফুঁসছে । একবার ফোন করে না পেলে আর একবার ফোন করা বা ধরা কি যায়না ?অরাতির এত দেমাক কিসের ? রাই বেশ কড়া করে একটা মেসেজ টাইপ করে –
“ তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই ! এই শনিবারই! যদি নিজে আসতে চাও বা না চাও সেটা কিন্তু সরাসরি জানিও!
আমাদের সম্পর্কটার আসলে কোন ভবিষ্যৎ নেই ! তুমি অন্তত তা জানো আর তাই নিজেকে রহস্যময়তায় লুকিয়ে রেখে বারবার বুঝিয়ে দিয়েছ সেটা! আমার ব্যক্তিগত জীবনে নতুন আত্মীয় বা বন্ধু’র কোন দরকার নেই!যেটা দরকার আছে তা হল একটা বারান্দার ,একবুক লম্বা নিঃশ্বাস নেওয়ার একটা মুক্তির আকাশের আর না ফোরাতে চাওয়া গল্পের একটা মানুষের! একটা নিজের অবকাশ , ভেবো না স্বার্থপরের মত চাইছি এসব তা নয় ! এর বদলে আমিও তোমায় দিতে পারি একটা ‘ডাকনাম’ , একটা চুপিচুপি ডাকার নিজস্ব নাম, বুকের ভেতর আদর করে মখমলি কাপড় মুড়ে রাখা একটা পরিচয় ।এজন্যই একবার সামনে আসতে চাইছি ,সব লজ্জা খুইয়ে ! তুমি না আসতে না চাইলে বলে দিয়ো। জানো ,অনেক ফোন নম্বর থেকে নিয়মিত কল আসা বন্ধ হয়ে শেষে ফোন বুকে সেটা একটা দশ ডিজিট এর সংখ্যা হয়েই রয়ে যায় । তেমনি যদি আমি তোমার নাম্বারটাকেও ব্লক দিতে হয় তাহলে সত্যি করে কষ্ট হবে আমার........”
******************
কানহাইয়া এখন বেশ উভয়সঙ্কটে পড়েছে। চন্দ্রাবলীর সাথে ওই পর্বের পর রাধার ওর ওপর এক ভয়ঙ্কর অভিমান হয়েছে। যমুনার ঘাটে বা কুঞ্জের দিকে তাকে কদিন দেখাই যাচ্ছে না । সুবলসখা এসে খবর দিল যে খানিক আগে সে ললিতাসখীকে রাধার ঘর থেকে বেরিয়ে কদম্বকাননের দিকে আসতে দেখেছে! কিন্তু তাতে কি ? রাধারানী বিরূপ হলে বৃন্দাবন অন্ধকার হয়ে যায় ।ললিতাসখী কানহাইয়াকে আদর করে ‘শ্যাম” বলে ডাকে ! সেও কেন রাধার খবর এনে দিচ্ছে না !চন্দ্রাবলী আবার একদিন ওকে মাধবী কুঞ্জে ডেকে এনে অর্ঘ্য প্রদান করে সেবা করেছে। সেই অভিসারের মালা আর চন্দন যে রাধারই পাঠানো সেটা অবশ্য তাকে কেউ বলে নি! রাধার সখীরা আটজন মিলেই কানহাইয়ার সাথে এখন এক্ অন্য রকম খেলা খেলছে! রাধাই সেই আসরের প্রধানা ।তার কপট রাগের ছলনায় এখন কদিন কানহাইয়াকে এই জ্বালাতন উচাটন সব সহ্য করতে হবে । সেও দেখিয়ে দেবে প্রেমের খেলায় রাধা কানহাইয়ার চেয়ে কম যায়না । বিরস্ মনে কানহাইয়া কোঁচড় থেকে বাঁশীটি বার করে বাজাতে বসে। সে জানে তার এই বাঁশীর সুরে ব্রজাঙ্গনারা ঘর ছেড়ে পথে এসে নামে! এখন রাধাও সে বাঁশীর সুরে স্থির থাকতে পারবে কি ? একবারও কি সে উতলা হবে না ?
সনাতনের আশ্রমে সারাটা দিন নামে-গানে কাটলেও কোথাও একটা শূন্যতা মীরার মন জুড়ে ছেয়ে রইল। সনাতন মীরাকে সম্মান দেখালেও গৌড়ীয়বৈষ্ণবজাত সংস্কামুক্ত নন। একজন স্ত্রী সাধিকা এতটা গোপী প্রেমে মাতোয়ারা হতে পারে, সেটা যেন মেনে নিতে কোথাও বাধে।মীরা অনেকবার দীক্ষা নিতে চাইলেও তিনি অজুহাত দেখিয়ে বিলম্বিত করছেন অকারণে । তবে ভজন গানে মীরার সহজাত ক্ষমতা অস্বীকার করতে পারেন না । বৃন্দাবন এসে মীরা ভাবে তার অন্তরের ঐশী সম্পদ সত্যি কি কিছু বাড়ল? গিরিধারী তো আজন্মকাল তো তার আত্মার সঙ্গী। তবুও যেন প্রেমের আস্বাদন তার সম্পূর্ণ হল না কেন ? তাহলে কি মীরা’র নিজের কি কোন অসম্পূর্ণতা রয়ে গেল ! আজ পূর্ণিমা,রূপোলী নেশার আবেশ লেগেছে মদির হয়ে! নিশুত রাত্রে মীরা আর তার গিরিধারী মুখোমুখি বসে। খুব কান্না পাচ্ছে মীরার !কালো পাথরের মূর্তি্টিকে কেন আজ আর তার মনের মানুষ বলে মনে হচ্ছে না?এতদিনের খুব চাপা একটা কষ্ট যেন গান হয়ে বেরিয়ে আসছে এই অলৌকিক অন্ধকারে ,
"ম্যায় তো সাঁওরেকে রংগ রচি !
পগ ঘুঙরু বান্ধ মীরা নাচই রে,
মেরে তো গিরিধার গোপাল দুসরী ন কোঁই ,
ম্যাই রী ম্যা তাঁহ লিয়ে গোবিন্দ মোল,
ইয়া মোহনকে মে রূপ লুভানী !"