প্রবন্ধ - সোমেন দে
Posted in প্রবন্ধকলকাতায় আপনি যে পাড়ায় থাকেন সেখান থেকে সব চেয়ে কাছের বড় রাস্তাটি ধরে যদি আপনি দুদিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটতে থাকেন তা হলে প্রতি এক কিলোমিটার হাঁটলেই অন্তত তিনটি এমন দোকান চোখে পড়বে যার সামনে একটি করে লাল সালু জড়ানো প্রকান্ড হান্ডি রাখা আছে।
অবশ্য আপনি যদি কলকাতার ভয়ঙ্কর যানবাহনসংকুল রাস্তায় দুদিকে তাকানোটা ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন তাহলে , হাঁটবার সময় শুধু আপনার নাকটি সজাগ রাখলেই হবে । পথে চলে যেতে যেতে অচেনা কুসুমের গন্ধ তো নাকে আসবে না এ শহরে , তবে একধরণের গন্ধ নাকে আসবে , যেটাকে ঠিক সুগন্ধ বলতে মন চায় না , আবার দুর্গন্ধ বললেও একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে । আসলে ওটা বিরিয়ানির রেডিমেইড মশলার গন্ধ । এক সময়ে উচ্চশ্রেণীর বাওয়ার্চিরা বারো তেরো রকমের নির্বাচিত উমদা মশলার গোপন কম্বিনেশনে বিরিয়ানিকে শিল্পের রূপ দিত আজ তা কলকাতার আমআদমিদের চটপট ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য জনপ্রিয়তম উপাদান হয়ে গেছে। অতঃপর যা হওয়ার তাই হয়েছে । আখতারি বাঈকে জোর করে মাচার ফাংশনে গাইতে বসালে যা হতে পারে , সেই অবস্থাই হয়েছে ।বিরিয়ানি তার কৌলীন্য হারিয়েছে ।
আপরুচি খানা বলে একটি কথা প্রচলিত ছিল । এখন কেমন যেন সবই আমরুচি হয়ে গেছে , আপরুচি বলে কিছু নেই।এখন এমন অবস্থা হয়েছে যারা সবে ইস্কুল যেতে শিখেছে এমন শিশুদেরও যদি জিজ্ঞেস করা যায় তোমার কী খেতে সব চেয়ে ভাল লাগে , তাহলে দশজনের মধ্যে অন্তত আটজন চটপট করে বলবে বিরিয়ানি । এটা নিশ্চয় ওদের মা বাবাদের কাছেই ওরা পেয়েছে উত্তরাধিকার হিসেবে।তাদের উগ্র বিরিয়ানি প্রেম তারা তাদের সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিতে পেরেছে । অথবা ওরাও তো আজকাল বড়দের সঙ্গে একই নেটওয়ারকের অংশীদার হয়েছে, তাই ওরাও ছোটো থেকেই বুঝে গেছে গেছে, সব বিষয়ে চলতি হাওয়ার পন্থী হওয়াটাই আসলে এ যুগে বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ।
মনে প্রশ্ন জাগছে বঙ্গ জীবনের এই নীরব বিরিয়ানি বিপ্লবটি ঠিক কবে এবং কি ভাবে ঘটে গেল ?
বিরিয়ানি বস্তুটি তো ঠিক নব আবিষ্কৃত কোনো বস্তু নয় , যে বলা যাবে- কোনো এক বিশেষ সময়ে বিরিয়ানি বঙ্গদেশে প্রবেশ করলও আর সগর্বে ঘোষণা করলো, এলাম ,দেখলাম আর জয় করলাম । এমনও নয় যে কলকাতায় বিরিয়ানির কোনো নাম-ও-নিশান ছিলই না কোনো কালে এবং হটাৎ করে নতুন শতাব্দীর প্রবেশের সঙ্গে এটিও কলকাতায় চুপিসাড়ে প্রবেশ করেছে।
সেই লখনৌ থেকে নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলি শা , যখন মনের দুঃখে - বাবুল মোরা নইহার ছুটো হি যায়… , গাইতে গাইতে , হাতি ঘোড়া পালকি ,লোক লস্কর পাইক বরকন্দাজ , নৌকর চাকর , তয়ায়েফ , বাইজি , গাইয়ে বাজিয়ে, ওস্তাগর, খানসামা , বাবুর্চি সব নিয়ে মেটিয়াবুরুজে এসে , প্রায় পাঁচশোটি পরিবার সহ আস্তানা গাড়লেন তখনই তো বিরিয়ানির খোসবাইয়ের সঙ্গে কলকাতার পরিচয় ঘটল । সে তো আজকে নয়, সে আজকে নয় ।সেই ১৮৫৬ সালের কথা ।কলকাতার মধ্যে মেটিয়াবুরুজ জায়গাটি নবাবের পছন্দ হয়েছিল হয়ত পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গা নদীটি দেখে । তিনি হয়ত ফেলে আসা গোমতী নদীর দুঃখ গঙ্গা নদীকে দেখে ভুলতে চেয়েছিলেন। মেটিয়াবুরুজে বর্ধমান মহারাজার একটি বাড়ি তিনি মাসিক পাঁচশো টাকা ভাড়ায় নিলেন । ইংরেজদের চালাকিতে তাঁর রাজত্ব যাওয়াতে , তিনি যতটা দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শহর লখনৌ ছেড়ে আসতে হবে বলে । তাই ইন্ডিয়াতে পোস্টেড হওয়া বৃটিশরা যেমন লন্ডন শহর মিস করতো বলে কলকাতাকে লন্ডনের মত করে সাজাতে চেয়েছিল , তেমনি ওয়াজেদ আলি শা মেটিয়াবুরুজে একটা মিনি আওয়ধ তৈরি করতে চেয়েছিলেন ।
সেই ঠুমরি , সেই কাজরি , সেই কত্থক, সেই নৌটঙ্কি, সেই ঘুড়ি ওড়ানো , সেই শের শায়রি, সেই চিকনকারির কারুকাজ, সেই মুরগির লড়াই , সেই শতরঞ্চ খেলা এবং সেখানকার সব উমদা খাবার দাবার , সব তিনি মেটিয়াবুরুজে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন । মোটকথা তাঁর নবাবিগিরির সব কিছুই বজায় রাখতে চাইছিলেন একই ভাবে । ইংরেজ সরকার তাঁকে সেই সময় এক লাখ টাকা করে পেনসন দিত ।কিন্তু তাঁর আইয়াশি এতটাই মাত্রাছাড়া ছিল যে সে টাকাও ফুরিয়ে গিয়ে প্রায়ই ধারদেনা করতে হত । আর যেহেতু এখানে তাঁর রাজ্যপাট ছিল না ,তাই বিচার ব্যবস্থা, শাসন ব্যবস্থা, রাজস্ব আদায়, এই সবের ঝুট ঝামেলা নিয়ে তাঁকে মাথা ঘামাতে হতনা । তাই এখানে তাঁর বিলাসবহুল শখ সাধ আরও বেড়ে গেছল । তার মধ্যে একটা ছিল খাবার নিয়ে নিত্য নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা। নবাবের প্রিয় খাবারে মধ্যে একটা ছিল বিরিয়ানি ।
মেটিয়াবুরুজের প্রাসাদের রান্নাঘরটি নাকি বিরাট ছিল । সেখানে এক এক পদের রান্নার জন্যে এক এক জন আলাদা বাওয়ার্চি থাকত । যে বাওয়ার্চি বিরিয়ানি বানাতো তাকে বলা হত বিরিয়াঞ্চি ।শোনা যায় নবাব নিজেই বাওয়ার্চিদের দিয়ে নানা রকম পরীক্ষা , নিরীক্ষা করাতেন ।খানদানি বিরিয়াঞ্চিরা বিরিয়ানির মশলার বিষয়ে অসম্ভব খুঁতখুঁতে ছিলেন ।নানা জায়গা থেকে আসত তাদের মশলা ।যার মধ্যে প্রধান ছিল কাশ্মীর থেকে নানা উমদা জাফরান । সব কিছুই প্রায় দই দিয়ে দম- পুখত করা হত । তাই তাদের তৈরি বিরিয়ানি হত হালকা ফুরফুরে এবং খোশবাইয়ে ভরপুর ।
আগেই বলেছি নবাব সাহেব সব ব্যাপারেই কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন । তার বাওয়ার্চিরা এটা জানত বলে তারাও নানা রকমে নতুন নতুন রান্না তাকে করে খাওয়াতেন ।
বিরিয়ানির মত খানদানি বস্তুতে আলুর মত একটি অকুলীন বস্তু কী করে জায়গা পেল এটা নিয়ে নানা রকমের মতবাদ আছে । তবে শুধু মাত্র কলকাতার বিরিয়ানিতেই আলু পাওয়া যায় , আওয়াধ বা হাইদরাবাদের বিরিয়ানি আলু নৈব নৈব চ ।
যে গল্পটা প্রচলিত আছে সেটা হল , যেহেতু নবাবের দাওয়াতখানায় কয়েক শো পাত পড়ত এবং আগেই বলা হয়েছে নবাবের এক লাখী পেনশন নবাবের আইয়াশি করতে ফুরিয়ে যেত , তাই খরচা কমানোর জন্য বিরিয়ানিতে মাংসের পরিমান কমানোর দরকার হয়ে পড়ল । তখন সম্ভবত ওয়াজেদ আলি শাহের রান্নাঘরের কোনো এক উদ্ভাবনী বুদ্ধিসম্পন্ন বিরিয়াঞ্চি কম খরচায় বেশি পরিমানের বিরিয়ানির তৈরি করার জন্যেই বিরিয়ানিতে আলু দেওয়া শুরু করেছিল । তবে মনে রাখতে হবে ১৮৫৬ সালে কলকাতায় আলু জনগনের খাদ্য হয়ে ওঠেনি । বাঙালির রোজকার রান্নায় তখনো আলু স্থান পায় নি । এ দেশে আলুর চাষবাষও তেমন ভাবে শুরু হয় নি । তাই আলু বস্তুটি হেলাফেলার করার বস্তু ছিল না । আর আলুর একটি মহৎ গুণ এই যে সে পরিবেশ অনুযায়ী নিজের স্বভাব চরিত্র পালটে ফেলতে পারে । আর আওয়াধি বিরিয়ানি যেহেতু দমপুখত পদ্ধতিতে রান্না হত , মানে যাতে করে রান্নার সময় হাঁড়ির মুখ বন্ধ রেখে রান্না থেকে বেরোনো জলীয় বাষ্প বাইরে বেরিয়ে যেতে দেওয়া হতনা তাই আলু এক পবিত্র আধারের মত, বিরিয়ানিতে দেওয়া সব মশলার খুশবাই আলু নিজের মধ্যে ধারণ করে নিতে পারত ।বলা যেতে পারে বিরিয়ানির আলু অনেক রকমের খুশবুদার উমদা সব মশলার গুণাগুণ নিজের মধ্যে আত্মসাৎ করে নিজেকে উন্নততর আলুতে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারে।
কারণ যাই হোক আলু দেওয়ার ব্যপারটা নিশ্চয় নবাবের এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে ওটাই বহাল থেকে গেল । এবং কলকাতা একটি বিশেষ ধরণের বিরিয়ানি পেয়ে গেল ।
বিরিয়ানির মূল আবিষ্কার নিয়েও একাধিক গল্প প্রচলিত আছে । কেউ বলেন বিরিয়ানি আসলে পারস্য দেশ থেকে এ এদেশে এসেছে । এর যুক্তি হিসেবে তাঁরা বলেন ‘বিরিয়ান’ শব্দের ফারসি ভাষায় মানে হচ্ছে রান্নার আগে ভেজে নেওয়া । এবং চালের ফারসি প্রতিশব্দ বিরিয়াঞ্জ । এ দেশে ১৩৯৮ সনে তৈমুরের ভারতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বিরিয়ানির এ এদেশে প্রবেশ ঘটেছিল । কেউ আবার আরো একটু পিছিয়ে গিয়ে বলেন খৃষ্টপূর্ব দুই শতকে যখন আরব ব্যবসায়ীরা মালাবার উপকুলে ব্যবসা করতে আসেন তখনই তাদের সঙ্গে বিরিয়ানি এ এ দেশে আসে । প্রাচীন তামিল সাহিত্যে উন সরু বলে একটি খাদ্যের বিবরণ পাওয়া যায় যার মধ্যে চাল , ঘি এবং মাংসের সঙ্গে নানা রকম মশলা দিয়ে রান্না করা হত ।
তবে যে গল্পটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সেটি হল , সাজাহানের প্রিয়তমা পত্নী মুমতাজ মহল একবার সৈন্যদের ব্যারাক দেখতে গেছলেন । সেখানে সৈন্যদের স্বাস্থ দেখে মনে হয়েছিল এই দুর্বল স্বাস্থ নিয়ে তারা যুদ্ধ করবে কী করে ! তাদের পুষ্টিকর কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা দরকার । তিনি ব্যারাকের বাওয়ার্চিওকে পরামর্শ দিলেন ভাত আর মাংস মিশিয়ে একটা স্বাস্থকর খাবার সৈন্যদের জন্যে বানাতে । সেই বাওয়ার্চি তখনকার মালিকা-এ-হিন্দুস্থানের হুকুম পালন করতেই বিরিয়ানি বস্তুটির আবিষ্কার করে ফেলেন । তারপর মুঘলদের হাত ধরেই তা ভারতে নানান প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে ।
তবে ঠিক যেমন মূলত পালি আর সংস্কৃত দুটো ভাষা থেকেই অঞ্চলে বেশির ভাষার সৃষ্টি হয়েছে , তেমনি বিরিয়ানিরও মূল দুই চরিত্র চাল এবং মাংস হলেও , এক অঞ্চলে স্বাদে গন্ধে এক এক রকমের চেহারা নিয়েছে।
যেমন যে শহর বিরিয়ানির জন্যে জগৎ বিখ্যাত , সেই হায়দারবাদের বিরিয়ানি প্রধানত ‘কাচ্চি’ গোত্রের। এতে সুগন্ধী জাফ্রান কেশরের ভুমিকা প্রধান ।আর হাইদারাবাদে মাংস ছাড়াও , মাছ , চিংড়ি মাছ ইত্যাদির বিরিয়ানিও বেশ প্রচলিত।
চেন্নাইতে যে বিরিয়ানি পাওয়া যায় তা দিন্দিগুল গোত্রের । এতে অন্য ধরনের মশলা থাকে ।যার মধ্যে প্রধান জিরা ও সাম্বা মশলা । সেই সঙ্গে গোলমরিচের ঝাল । এবং বড় মাংসের টুকরোর বদলে থাকে ছোটো ছোটো মাংসের পিস ।
লখনৌভি বিরিয়ানি কিছু বিশেষ মশলা দিয়ে কম আঁচে অনেকক্ষণ ধরে তৈরি করা হয় ।
মালাবার অঞ্চলে যে বিরিয়ানি পাওয়া যায় তার নাম থালাসেরি বিরিয়ানি । এতে কাইমা নামের এক ধরনের চাল , কিছু মালাবারি মশলা এবং মুর্গির ঠাং ব্যবহার করা হয় ।সেই সঙ্গে থাকে কাজু কিসমিস এবং মৌরি ।
আসামে একধরণের বিরিয়ানি পাওয়া যায় যাকে বলা কামপুরি বিরিয়ানি । এতে আগে মুরগির মাংসের সঙ্গে , গাজর বিন্স ক্যাপ্সিকাম মিশিয়ে রান্না করে নেওয়া হয় । তার পর পর এলাইচি , জায়ফল সহ চালের সঙ্গে মেশান হয় ।
ম্যাঙ্গালোর অঞ্চলের বিরিয়ানিতে চালের সঙ্গে ঘি আর সুগন্ধি মশলা মিশিয়ে সারারাত রেখে দেওয়া হয় ।সেই চাল পরের দিন মাংস , সি ফূড , এবং কিছু সবজি মিশিয়ে রান্না করা হয় ।
সিন্ধি বিরিয়ানিতে থাকে প্রচুর পরিমানে কাঁচা লঙ্কা , রোস্ট করা বাদাম , আলুবোখারা এবং টক দই ।
হায়দারাবাদে আর এক ধরণের বিরিয়ানিও পাওয়া যায় যাকে বলে দুধ কি বিরিয়ানি । যেটি হায়দারবাদের নিজামের বিশেষ পছন্দের ছিল । এতে অন্যান্য সুগন্ধি মশলার গাড় দুধের সঙ্গে বাদাম মেশানো হয় ।
আর কলকাতার বিরিয়ানির কথা আগেই বলা হয়েছে , নৈবেদ্যর নাড়ুর মত সেই বিরিয়ানির প্লেট আলো করে থাকে একটি সোনার বন্ন আলু । যে আলু অন্য যায়গায় এলেবেলে সেই আলু বিরিয়ানি চুড়ায় উপস্থিতি রীতিমর সম্ভ্রম জাগানো ।
এখন প্রশ্ন হল , নবাবের হাত ধরে কলকাতায় বিরিয়ানির প্রবেশ ঘটে থাকলেও কিন্তু বিরিয়ানি , করেকটি বিশেষ অঞ্চল ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যেতনা । কয়েক দশক আগেও হিন্দু বাঙালির বিয়ে বাড়ির মেনুতে বিরিয়ানির প্রবেশ অতি বিরল ঘটনা ছিল । তবে আজ তা স্বাভাবিক হয়েছে । নব্বইয়ের দশকেও বিরিয়ানি খেতে হলে খিদিরপুর , বা মধ্য কলকাতার হাতে গোনা কয়েকটি রেস্তোঁরাতেও যেতে হত ।আর আজকের অবস্থা তো আগেই বলা হয়েছে।
যদি একটু পিছিয়ে গিয়ে খুঁজি , ১৮২৬ সাল নাগাদ যখন হিন্দু কালেজের ছাত্ররা ডিরোজিয়োর নেতৃত্বে হিন্দু ধর্মের সব কুসংস্কার ভাঙ্গবার প্রবল উৎসাহে হিন্দু সমাজে অপ্রচলিত , নিষিদ্ধ সব খাবার খেতে আরম্ভ করেছিলেন , এমন কি তখন তারা পাবলিকলি গো মাংসও খেতে আরম্ভ করেছিলেন । তখনও তারা বিরিয়ানি খেয়েছিলেন বলে শোনা যায় না ।যদি বিরিয়ানি সে সময় কলকাতায় কোথাও পাওয়া যেত এবং হিন্দুদের মধ্যে তা নিষিদ্ধ থাকত তা হলে তারা নিশ্চয় সেই প্রথা ভেঙ্গে বিরিয়ানিও খেতেন ।
সেই সময়ের একটি মজার গল্প বলে নিই । এটি রাজনারায়ন বসুর সেকাল ও একাল বইতে পাওয়া যাবে ।
‘ একবার উইলসন হোটেলে দুই বাঙালি বাবু আহার করিতে গিয়াছিলেন । এক বাবুর গরু ভিন্ন চলেনা । তিনি খানসামাকে জিজ্ঞাসা করিলেন , বীফ হ্যায়? খানসামা উত্তর করিল ‘নহি হ্যায় খোদাওন্দ’ । বাবু পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন ‘বীফ স্টেক হ্যায় ?’খানসামা উত্তর করিল ‘ওভি নহি হ্যায় খোদাওন্দ। বাবু পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন ‘অকস টং হ্যায় ?’ খানসামা উত্তর করিল ‘ওভি নহি হ্যায় খোদাওন্দ। বাবু পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন ‘কাফস ফুট জেলি হ্যায়?’ খানসামা উত্তর করিল ‘ওভি নহি হ্যায় খোদাওন্দ।’
এই বার দ্বিতীয় বাবু বিরক্ত হইয়া বলিলেন , ওরে বাবুর জন্য গরুর আর কিছু না থাকলে খানিকটা গোবর এনে দে না ?’
এখানে লক্ষ করবার মত বিষয় , এখানে বাবুটি কিন্তু বীফ বিরিয়ানি চায় নি ।
১৯০১ সালে লেখা ঠাকুর বাড়ির কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’ নামের যে বইটি লিখেছিলেন সেটি তাতে সেই সময়ে বঙ্গদেশে প্রচলিত সব সব রকমের পদের কথাই উল্লেখ করা হয়েছিল । সেখানে অনেক রকমের পোলাও এর রন্ধন প্রণালীর বিবরণ আছে । যেমন , মোহন পোলাও , মিঠাজার্দা পোলাও, মালাই পিশপাশ পোলাও , পানি পোলাও , ছানার পোলাও , বাসন্তী পোলাও , দোলমা পোলাউ ইত্যাদি। কিন্তু সেখানে বিরিয়ানির কোনো উল্লেখ নেই ।
১৯৮৫ সালের পূর্ণিমা ঠাকুর, আর এক ঠাকুর বাড়ির বধু রচিত ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’ বই লিখেছলেন । এই বইটি আসলে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর একটি নোটবই থেকে সংগ্রহ করা রন্ধন পদ্ধতি । ইন্দিরা দেবী আসলে নিজে রান্না করতেন না , কিন্তু বাড়িতে কিছু রান্না হলে হলে সেগুলির রন্ধন পদ্ধতি লিখে রাখতেন । এর মধ্যে শুধু মাত্র বাঙালি রান্না নয় নানা রকমের বিদেশী রান্না যা ঠাকুর বাড়িতে হত , তার রন্ধন পদ্ধতির বিবরণ দিয়েছেন । তাতে মাংসের চাউমিন , মুরগির রসল্লা , আইরিশ স্টূ , ফিলিপিনি মুরগি কারি , শাহি কোর্মা এই সব মুঘলাই বা বিদেশী রান্নার রেসিপি থাকলেও বিরিয়ানির উল্লেখ নেই । এতদ্বারা এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে কিনা যে রবীন্দ্রনাথ কখনো বিরিয়ানির রসগহন করেন নি , তা পাঠক বিচার করবেন ।
সামনেই আমাদের শারদোৎসব আসছে । অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এই উৎসব বাংলার রসনা তৃপ্তিরও উৎসব ।এই সময়ে বাঙালির একটি ডিসিশন মেকিং সমস্যা হল - কী খাইব আমি কী খাওয়াইবো আজি আনন্দধামে… ।
ফাশনের জগতে এ বছর কী কী বিপ্লব আসবে , কত হাজার বা লাখ নতুন ভার্সনের মোবাইল ফোন বিক্রি হবে এ বছর , কোন ধরণের থীমপুজো এ বছরের ট্রেন্ড হবে , এ সবের অনুমান করার মত ক্ষমতা আমার অন্তত নেই ।কিন্তু খুব জোরের সঙ্গে একটি অনুমান করা যায় যে এই পাঁচ দিনে বাঙালি অন্তত কয়েক কুইন্টল বিরিয়ানি ভক্ষন করবে।
একা একা , দোকা দোকা , দল বেঁধে । পাড়ার পুজোয় , অন্য পাড়ার পুজোয়, অন্য কোথাও বেড়াতে গিয়ে । রাস্তার ধারে কয়েকটা ইঁটের উপর কাঠের পাটাতন বসিয়ে মেকসিফট আউটলেটে গিয়ে বসে খাবে , আবার বিরিয়ানি স্পেপালিস্ট এসি রেস্তোরাঁর বাইরে এবং ভীতরে ঘন্টা খানেক লাইন দিয়ে তবে গিয়ে বসতে পাওয়ার মত বিরাট অ্যাচিভমেন্টে উল্লাস করে খাবে । যাদের ভীড়ভাট্টা না- পসন্দ , যারা নিজের মুদ্রা দোষেই আলাদা হতে চান , তারা অনলাইনে অরডার করে বাড়িতে আনিয়েও খাবে।
বিরিয়ানি-শৌকীন ব্যাক্তিরা , নিশ্চয়ই এ লেখা এতক্ষণ ধৈর্য্য ধরে পড়ছেন না । যদি তাও কেউ পড়েই থাকেন তো , তাদের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ পেলে এই টুকু নিবেদন করতে পারি যে , মাঝে সাঝে বিরিয়ানি খেতে আমারও ভালোই লাগে , যদি সেই বিরিয়ানির মধ্যে রন্ধন শিল্পীর শিল্পীসুলভ নিষ্ঠার ছাপ থাকে । কিন্তু ওই যে আগে বলেছি , আখতারি বাঈকে দিয়ে মাচার ফাংশনে গাওয়াবার মত ব্যাপার হলে , আমি বরং বিরিয়ানির চেয়ে পান্তাভাত বা খিচুড়ি খেতে বেশি পছন্দ করবো ।