ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক৭
-‘ওদের মাথায় একটা করে বুলেট গেঁথে দেওয়া কিম্বা এখন এই মুহূর্তে ওদের স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে চাপিয়ে পথে পাড়ি দেওয়া--- এই দুটোর মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই!’ ডঃ স্মিৎজ প্রথমে শ্নাইডারের দিকে, তারপরে ফাইনহালস, প্রধান সার্জেন্ট এবং ওটেন –সবার দিকে এক এক করে দেখেন--- ‘মোটামুটিভাবে গতকাল জানা ছিল যে আজ আমাদের রওনা দিতে হবে, সেক্ষেত্রে অপারেশন পিছিয়ে দেওয়া হল না কেন? কীভাবে সম্ভব?’
‘অর্ডার তো আজ সকালে এসেছে। সবে এক ঘণ্টা আগে...’ বলে ওঠে প্রধান সার্জেন্ট।
‘অর্ডার! আদেশ!’ ডঃ স্মিৎজ হতাশ ভঙ্গিতে তালিকাটা টেবিলে ফেলে দিয়ে শ্নাইডারের দিকে তাকিয়ে বলেন ‘চলুন, যাওয়া যাক!’ ঘরের বাইরে থেকে শুনতে পেলো তারা যে প্রধান সার্জেন্ট বলছে... ‘আমরা আলোচনা করছিলাম... আপনারা না শুনেই বেরিয়ে গেলেন। আমি পদাধিকার বলে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমান্ডারের উপরে... আপনারা শুনলেন না’...। ডঃ স্মিৎজ তড়িৎগতিতে বড়সাহেবের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। শ্নাইডার ধীরগতিতে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগলো।
যেতে যেতে বিল্ডিংএর সবকটা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে দেখতে যেতে লাগলো সে। প্রধান প্রবেশপথের সামনে জারকার গাড়িটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে আস্বস্ত হল শ্নাইডার। আঙিনা ভরে গিয়েছে আম্বুলেন্সের ভ্যানে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বড়সাহেবের গাড়িটা। জিনিসপত্র বোঝাই করা হচ্ছে সব গাড়িগুলোতে। রান্নাঘরে ফলের ঝুরিগুলো বোঝাই করা হচ্ছে এটা সে লক্ষ্য করলো। বড়সাহেবের ড্রাইভার টিন দিয়ে ঢাকা একটা বিরাট ধূসর বাক্স আঙিনায় ঘষটে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
আঙিনায় আর বিল্ডিংএর প্যাসেজে এখানে ওখানে অনেকে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ ভিড়। শ্নাইডার নিজের ঘরে গিয়ে গ্লাসে বাকি শ্নাপটুকু ঢেলে সোডা মিশিয়ে নিলো। প্রথম চুমুকটা দিয়ে সে শুনতে পেলো প্রথম গাড়িটার এঞ্জিন স্টার্ট করবার আওয়াজ। গ্লাস হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সে প্যাসেজের জানালায় দাঁড়ালো। দেখতে পেলো যে প্রথম স্টার্ট হওয়া এঞ্জিনটা হল বড়সাহেবের গাড়ির। এঞ্জিনটা ভালো। যদিও সে গাড়ির এঞ্জিনের ব্যাপারে কিছুই বোঝেনা, তবুও আওয়াজটা শুনে তার মনে হল যে এঞ্জিনটা বেশ ভালো।
তারপরেই আঙিনা দিয়ে বড়সাহেবকে হেঁটে আসতে দেখা গেলো। না, তার হাতে কোনও মালপত্র নেই। তার ফিল্ড ক্যাপের সামনের দিকটা একটু বেঁকে আছে। সাধারণত তাকে যেমন সপ্রতিভ দেখায়, সেরকমই দেখাচ্ছে। শুধু মুখের রং অত্যধিক লালচে দেখাচ্ছে। অন্যদিন সাদাটে মুখে হাল্কা রক্তাভা দেখা যায়। আজ তার মুখমণ্ডল টকটকে লাল। বড়সাহেব সুপুরুষ, লম্বা, একহারা গড়ন। খুব ভালো ঘোড়সওয়ার। রোজ সকালে হাতে চাবুক নিয়ে ঘোড়া চড়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। গ্রামের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে সামনের ঢালু জমি ছাড়িয়ে দূরে দিগন্তরেখার দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন তিনি রোজ ভোরে। কিন্তু এখন তার মুখটা একটা লবস্টারের মত টকটকে লাল দেখাচ্ছে। শ্নাইডার অতীতে একবারই বড়সাহেবের মুখটা এরকম লাল হয়ে যেতে দেখেছে। সেবারে ডঃ স্মিৎজ একটা দুরূহ অপারেশন অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে করেছিলেন, যেটা করবার সাহস বড়সাহেবের একেবারেই ছিলনা।
এখন ডঃ স্মিৎজ বড়সাহেবের পাশে পাশে হেঁটে চলেছেন। ডঃ স্মিৎজ শান্তভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছেন, তার পাশে বড়সাহেব হাত নেড়ে কী যেন বোঝাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাকে।
ওই যে... জারকাকেও দেখা যাচ্ছে ভিড়ের মধ্যে। মেয়েটা প্যাসেজের মধ্য দিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। এত গাড়ি, লোকজন, সবাই রওনা দিচ্ছে, সবাই চলে যাচ্ছে এই জায়গাটা ছেড়ে। এসব হট্টগোলের মধ্যে হয়তো মেয়েটা এরকম কাউকে খুঁজছে যে এখন যাবে না। এমন কাউকে খুঁজছে যে এখন এখানে থাকবে। মেয়েটা হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় কী যেন বললো। শ্নাইডার বুঝতে পারছে না। সে মেয়েটাকে হাত নেড়ে তার ঘরের দিকে আসতে বললো।
বাইরে বড়সাহেবের গাড়িটা চলতে শুরু করলো। পুরো বাহিনী সেই গাড়িটাকে অনুসরণ করতে লাগলো।
মনে হচ্ছে যে মেয়েটা শ্নাইডারকে ম্যানেজারের কিম্বা কোষাধ্যক্ষের কোনও প্রতিনিধি ঠাউরেছে। মেয়েটাকে চেয়ার এগিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও বসলো না। শ্নাইডার টেবিলের ধারে বসলো। মেয়েটা কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখে বেশ রাগত দৃষ্টি। শ্নাইডার ভেবে দেখল যেহেতু সে মেয়েটার ভাষা বুঝতে পারছে না, সেহেতু মেয়েটার কথার দিকে কান দেবার কোনও মানে নেই। বরঞ্চ এখন কান বন্ধ করে একদৃষ্টে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকা সম্ভব। শ্নাইডার মেয়েটাকে থামানোর চেষ্টাও করলো না। মেয়েটা কথা বলে যেতে লাগলো। সে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটাকে সে দূর থেকে যতটা কমবয়সী ভেবেছিল, মেয়েটার বয়স তার চেয়েও অনেক কম। বেশ রোগা, ছোট বুক। মুখটা ভারি মিষ্টি। কথা বলতে বলতে চোখ পিটপিট করছিল মেয়েটা। চোখের বড় বড় পাতাগুলো বাদামি গালের উপরে পড়ছিল, শ্নাইডার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখছিল। অল্পক্ষণের জন্য যখন মেয়েটা মুখ বন্ধ করছিল, পাতলা লালচে ঠোঁটগুলোর দিকে তাকিয়েছিল সে। সে একদৃষ্টে দেখে যাচ্ছিল মেয়েটিকে। কিছুটা খেদ হচ্ছিল তার, কারণ সে দূর থেকে মেয়েটিকে যতটা পূর্ণযৌবনা ভেবেছিল, মেয়েটা সেই তুলনায় একেবারে বাচ্চা। কিন্তু দেখতে খুব মিষ্টি, খুব সুন্দর। সে হঠাৎ তার হাত একটু তুললো আর মাথাটা ধীরে একটু ঝাঁকালো। মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেলো। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চাইল তার দিকে। সে খুব নরম গলায় বলে উঠলো, ‘আমি তোমাকে একটা চুমু খাবো, বুঝতে পেরেছ তুমি আমার কথা?’ যদিও সে সত্যিই জানে না যে সে আদৌ মেয়েটাকে চুমু খেতে চায় কিনা! সে অস্বস্তির সঙ্গে লক্ষ্য করলো যে মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। সে খেয়াল করলো মেয়েটা একটাও শব্দ হয়তো বোঝে নি, কিন্তু তার উদ্দেশ্য ঠিক বুঝতে পেরেছে।
মেয়েটা পিছিয়ে যেতে লাগলো। চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি। সরু গলায় শিরাটা তিরতির করে কাঁপছে। শ্নাইডার থমকে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকালো, বলে উঠলো, ‘ক্ষমা করে দাও, ভুলে যাও দয়া করে-- বুঝতে পেরেছ তুমি আমার কথা?’ কিন্তু মেয়েটার চোখের দৃষ্টি আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। শ্নাইডার ঘাবড়ে গেলো। মেয়েটা যদি চিৎকার করে ওঠে? মেয়েটা তার কথা একেবারেই বুঝতে পারছে না। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলো। মেয়েটার ছোট রোগা হাতের পাতাদুটো নিজের হাতে তুলে নিলো। হাতদুটো নিজের মুখের উপরে রেখে সে লক্ষ্য করলো, হাতে অনেক ময়লা লেগে আছে। মাটির গন্ধ, ঘোড়ার চাবুকের চামড়ার গন্ধ, শাকসব্জির গন্ধ, পেঁয়াজের গন্ধ মিলেমিশে আছে হাতে। সে ছোট করে একটা চুমু খেলো তার হাতে। তারপর একটু হাসবার চেষ্টা করলো। মেয়েটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার দিকে। সে মেয়েটার কাঁধে একটু টোকা মারলো, তারপর হাতের মুদ্রা করে বোঝাবার চেষ্টা করলো, ‘চলো দেখি, তোমার টাকাটা উদ্ধার করা যায় কিনা!’ মেয়েটার চোখের সামনে জোরে জোরে টাকা গুনবার ভঙ্গি করে কথা বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলো শ্নাইডার। মেয়েটা বুঝতে পেরে হেসে ফেললো। প্যাসেজে বেরিয়ে এলো শ্নাইডার। মেয়েটা পেছন পেছন আসতে লাগলো। প্যাসেজে স্মিৎজ আর ওটেনের সঙ্গে দেখা হল তাদের।
‘এখন আবার কোথায় চল্লেন?’ ডঃ স্মিৎজ প্রশ্ন করলেন।
‘ম্যানেজারের কাছে’ উত্তর দিল শ্নাইডার, ‘এই মেয়েটার টাকা বাকি!’
‘ম্যানেজার চলে গেছে’... বলে উঠলেন স্মিৎজ... ‘গতকাল সন্ধেতেই চলে গেছে জোলনকের দিকে। সামনের দিকের দলটার সঙ্গে গেছে’... এক মুহূর্তের জন্য চোখটা নামিয়ে আবার চলমান মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি।
কেউ কোনও কথা বললো না। মেয়েটা সবার দিকে তাকাতে লাগলো।
ওটেন!’ স্মিৎজ আবার কথা বলে উঠলেন... ‘একটু দেখবে? আমার এক দু জন লোক দরকার জিনিসপত্র সরাবার জন্য। ওরা আমাদের খাবার দাবারও কিছু রেখে যেতে ভুলে গেছে।’ তিনি বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আঙিনায় এই মুহূর্তে একটাই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
‘মেয়েটার টাকা?’ শ্নাইডার প্রশ্ন করলো... ‘সেটার কী হবে?’
স্মিৎজ কাঁধ ঝাঁকালেন, ‘আমি জানিনা। আমি কোত্থেকে দেব?’
‘তাহলে কি ওকে আগামীকাল সকালে আসতে বলব?’
‘নাহ, মনে হয় আজ বিকেলেই এলে ভাল।’
স্মিৎজ আঙিনায় গিয়ে গাড়িটার কাছে দাঁড়ালেন। শ্নাইডার মেয়েটাকে নিয়ে গেলো প্রবেশপথের কাছে, যেখানে মেয়েটার ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সে মেয়েটাকে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলো বিকেলে আবার আসবার জন্য। মেয়েটা জোরে জোরে ঘাড় নাড়তে লাগলো। টাকা না নিয়ে সে যাবেনা। শ্নাইডার দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটা লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠলো। বসবার জায়গার বাক্সটা খুলে নানা জিনিসপত্র বের করতে লাগলো। ঘোড়াটার সামনে ঝুলিয়ে দিলো খাবারের দানা ভর্তি ঝোলা। একটা বাদামি কাগজে মোড়া প্যাকেট খুলে নিজেও খেতে শুরু করলো, একটা রুটি, মাংসের বড়া আর স্যালাড। একটা মোটা সবুজ বোতলে আছে নিজস্ব পানীয়। মেয়েটা খেতে খেতে তার দিকে চেয়ে একবার হাসলো। হঠাৎ খাবার খাওয়া থামিয়ে মেয়েটা বলে উঠলো, ‘নাগিভারাদ’। হাওয়ায় এক দু বার হাত মুঠো করে ছুঁড়ে দিলো, ফুঁ দিলো তারপর মুখটা বিকৃত করলো। কী বোঝাতে চাইছে মেয়েটা? শ্নাইডারের মনে হল মেয়েটা বোঝাতে চাইছে যে কেউ বক্সিং ম্যাচে হেরে গেছে। ধ্যাত, না, নিশ্চয়ই অন্য কিছু বলছে মেয়েটা। কী বলছে? বলছে যে কেউ ওর টাকা মেরে দিয়েছে। ও প্রতারিত হয়েছে। হ্যাঁ, তাইই হবে। শ্নাইডারের জানা নেই ‘নাগিভারাদ’ শব্দটার অর্থ। উফফ, হাংগেরিয়ান ভাষা খুব কঠিন। ‘তামাক’ শব্দটাও বোধহয় এই ভাষায় নেই।
(চলবে)