ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(৯)
সমুদ্ররা সেদিন যে রাজনৈতিক দাবানলে পতঙ্গের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সময়ের স্থিতাবস্হা আর জেল থেকে বেরোবার পর সবকিছুর রাতারাতি ভোল বদলে যাওয়ার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে ওর বেশ কিছু বছর সময় লেগেছিল। ছাড়া পেয়ে বাড়িতে গিয়ে বাবার সামনে প্রথমবার দাঁড়ায় সমুদ্র'র মনে হয়েছিল ছোটবেলায় সী -বীচে দাঁড়ালে পায়ে ঢেউ লাগলে যেমন মনে হত পাএর নীচের মাটিটা কেমন সরে যাচ্ছে, সেদিনও ঠিক তেমন মনে হচ্ছিল।
ততদিনে বাবাও রিটায়ার করেছে। অন্য একটা দৈনিকে সাপ্তাহিক কলম লেখেন আর কি সব প্রাচীন সামাজিক ব্যবস্থার ওপর সারা জীবন গবেষণা করে নাকি একটা বই লিখছে। সংসারটা চলছে মূলতঃ মা এর একার রোজগারে। আর রিমির উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে। বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সাথে সাথে ক'বছরে সব কিছু এতটা বদলে গেছিল বলেই সমুদ্র বাড়িতে মানিয়ে নিতে পারছিল না। অথচ বাবা কিন্তু ওকে কোনরকম খারাপ কথা বা ব্যঙ্গ করেনি। বরং ভারী চশমার ফাঁক দিয়ে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল -
"তুমি তাহলে অন্য কিছু করার কথা ভাবছ আশাকরি! সরকারী গ্রান্টের টাকায় একটা রিসার্চ করছি। তোমার মা'ও আছেন উপদেষ্টা হয়ে। তুমি চাইলে আমাদের সাথে কাজ করতে পারো। প্রান্তিক মানুষকে আমাদের চাইতে আরও কাছ থেকে দেখেছ তুমি! তাই না ?"
সমুদ্র সেদিন সরাসরি কোন উত্তর দিতে পারেনি। খালি মা'কে আলাদা ডেকে জানিয়েছিল সে নিজের মত করে কিছু করতে চায় আর সেটা বর্তমানের এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে চ্যালেঞ্জ করেই।
************
সুখমণি ভোটে দাঁড়াবে না। সমুদ্রও তাকে আর জোর করেনি। দুপুরবেলা খাওয়ার সময় সুখমণি বলল, " আপনি আমায় নিয়ে ভাবছেন না সেবায়তন নিয়ে বলুন তো? আমার ভোটে না দাঁড়ানোর জন্য সেবায়তনের কোন ক্ষতি হোক তা আমি চাইবো না। আপনি নিজে থেকে ছুটি দিলে আমি নিজেই না হয়...." সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে খপ্ করে সুখমণির হাতটা ধরে ফ্যালফ্যাল করে কালো পাথরকোঁদা মুখশ্রীর সুখমণির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। আজ লম্বা বিনুনী করেছে সুখমণি। ওর মুখটায় একটা ভূমিজ আয়না আছে। সুখমণির চোখ দিয়েই গোটা ভারতবর্ষটাকে সমুদ্র আজকাল দেখতে পায়।
সুখমণি একটু হেসে বলে ওঠে -
" আপনি আজও মনের কথাটা দৃঢ়তার সাথে বলতে শিখলেন না দেখছি! আচ্ছা সি এম ও শুনেছি এরকম লাজুক ছিলেন! এটাও কি আপনাদের গুরু পরম্পরা?"
***********
দুপুরে ছবির অ্যালবামের পাতাটা উল্টে দেখবে বলে সাগরিকা খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুল। এখন কারেন্ট গেছে যদিও তাও শেষ বিকেলের ঠান্ডা হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পর্দাগুলো শ্রীরাধা সরিয়ে দিলেন। হাওয়ার তীব্রতায় সেগুলো নৌকোর পালের মত ফুলে ফেঁপে উঠছে। রিমি হঠাৎ করে অ্যালবাম দেখতে চাওয়াটা মোটেও পছন্দ করেননি তিনি। ও তো কাউকেই চিনবে না! ধূসর স্মৃতিবহুল মিসেস লোবোর একটা প্রাইভেসি থাকাটাই তো স্বাভাবিক সেটাকে খামোখা এনে দেখতে চাওয়ার কোনো মানে হয়না। শ্রীরাধা জানেন রিমি একটু অন্যরকমের। তবে সবকথা মেয়ের সামনে উত্থাপিত না হোক সেটাই ভাল। রিমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। ও ঠারেঠোরে অনেকবার শ্রীরাধার কাছে জানতে চেয়েছে ওর বাবার মুখে শোনা শেষ দুটো শব্দ ' মণি! মণি' র কি অর্থ। শ্রীরাধা নিজে যদিও জানেন তার অর্থ। মেয়েকে অন্য প্রসঙ্গে ভুলিয়ে দিয়ে এসেছেন এতকাল। কিন্তু আজ ছাব্বিশ বছরের সাগরিকাকে সেই সত্যটা জানাতে গেলে যদি উল্টোপাল্টা কিছু হয়ে যায়? তবে কি নিয়ে থাকবেন বাকি জীবনটা! সমু'কে তো আর সংসারের বাঁধনে ফিরে পাবেন না জানেন। সুখমণিকে বিয়ে করেও যদি ছেলে সংসারী হত তাতেও তাঁর আপত্তি ছিলনা। কিন্তু আজ রিমিও যদি ওঁকে ভুল বুঝে দূরে সরে যায় তবে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন তিনি? মিসেস লোবোর প্রতি অভিমান জমাট বাঁধে তাঁর। কি দরকার ছিল অ্যালবামটা রিমির হাতে দেখতে দেওয়ার? একটা বিপর্যয়ের মেঘ ধাওয়া করছে মনের ভিতর আজ। সবকথা সবসময় বলে বোঝানো যায়না! সাগরিকা দিব্যি পা দোলাতে দোলাতে অ্যালবামটার পাতা ওল্টাতে থাকে। সাদাকালো ছবিতেই ভর্তি। বিভিন্ন মন্দির আর গ্রামাঞ্চলের ল্যান্ডস্কেপের ছবি। খুব পটু হাতে তোলা নয় যদিও তাও! ওর বাবাও কোথাও গেলে এমন সব ছবি তুলত। আর ওদের ছবি কম তুলত বলে মা বাবাকে বকত মনে আছে। বাবা হাসিমুখে বল
" দাঁড়াও দাঁড়াও তুলছি! দেখ এই ভিউটা আর পাবে?" বলতে বলতে ক্লিক ক্লিক করে মিনোল্টা ক্যামেরার শাটার টিপত। ওর হাতে চামড়ার খাপটা ধরিয়ে দাদা ততোক্ষণে একা একা হাঁটত। ওই বয়সেই কি দাদা একাকীত্বকে বেছে নিতে চাইত? আন্টির অ্যালবামের ছবিগুলো ওর শৈশব কৈশোরের স্মৃতি মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল। মা চায়ের কাপ হাতে সাগরিকাকে দু বার ডাকল। রিমির যেন হুঁশই নেই কোন। সাদাকালো অ্যালবামের শেষ পাতার একটা ছবির দিকে একদৃষ্টে সে চেয়ে আছে। বাইরে তখন সমুদ্রের গর্জন আর জোলো নোনতা হাওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকে ওলোটপালোট করে দিচ্ছে। শ্রীরাধা ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন। সাগরিকার দুচোখে টলটল করছে অশ্রু। শ্রীরাধার ইচ্ছা করল অ্যালবামটা ওর হাত কেড়ে নিয়ে রিমিকে বুকে চেপে জড়িয়ে ধরতে। রিমিকে কেউ কোনওদিন কেড়ে নিতে পারবেনা ওঁর কোল থেকে।