Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in























এবার ইউরোপ – ৪

সুইৎজারল্যান্ড। চিজ, চকলেট আর ঘড়ি তো বটেই, নয়নাভিরাম আল্পসের কোলে পরম যত্নে লালিত মধ্য ইউরোপের এই দেশটির আরও অনেক কারণেই ভুবনজোড়া নাম। তার একটা হলো অনন্য প্রকৃতি। সারা পৃথিবী থেকে পর্বতপ্রেমী মানুষের দল এখানে ভিড় করে ছুটি কাটানোর জন্য, স্কি এবং আরও অনেক রোমাঞ্চসঞ্চারী ক্রিয়াকলাপের জন্য। এসব কাহিনী আমরা লোকমুখে শুনেছি এবং ছোটোবেলা থেকে বইপত্রের মাধ্যমেও জ্ঞান আহরণ করেছি। বার্লিন পৌঁছনোর পরই অনেক কিছুর সঙ্গে বারবারা আমাদের উপহার দিয়েছিল একটি সুইস আর্মি নাইফ – যা অন্যতম সুইস জাতীয় প্রতীকও বটে! আর বারবারা নিজেও তো জন্মসূত্রে সুইস – তার কাছেই তো পরবর্তী তিন দশকে শিখেছি একাধিক সুইস রান্নার প্রকরণ-কৌশল। আর যেহেতু প্রথমবার তার জন্মভূমিতে পা রাখতে চলেছি, ছোটোবেলার এক বান্ধবীর নাম-ফোন নম্বর গুঁজে দিয়েছিল আমাদের হাতে। জুরিখ অত্যন্ত ব্যয়বহুল শহর, তাই আমাদের থাকার বন্দোবস্তও করে দিয়েছিল আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এক অতিথিশালায়। আমাদের জার্মান সঙ্গীরা সাময়িক সেই বাসস্থানের কাছে আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।

তখন প্রায় দুপুর। ক্রিস্টিনে (বারবারার বান্ধবী) আসবে বিকেলে, পাঁচটার সময়। আমাদের সঙ্গে রয়েছে সেই পিৎজা, যা বৌদি হির্শবার্গ থেকে রওনা হওয়ার সময় সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলেন। সুতরাং মধ্যাহ্নভোজন নিয়ে ভাবনা নেই। প্রত্যাশামতোই ঠিক পাঁচটার সময় দেখলাম সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছেন বছর পঞ্চাশের ক্রিস্টিনে। বললেন, ‘একটু আগেই এসেছি কিন্তু পাঁচটায় দেখা করার কথা তো, তাই…!’ ক্রিস্টিনের সঙ্গে গেলাম ওঁর বাড়িতে। আমাদের বসার ঘরে রেখে রান্না বসালেন ক্রিস্টিনে। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে জমে উঠল আড্ডা। আহার প্রস্তুত হওয়ার পর যখন ক্রিস্টিনে আমাদের খাবার টেবিলে ডাকলেন, আমাদের তো চক্ষু চড়কগাছ! বড় জোর এক ঘণ্টা! এই সময়ের মধ্যে এত? সেদিনই প্রথম বুঝতে পারি সুইস রান্নায় চিজের ভূমিকা কত ব্যাপক! আসলে একটা দেশ তো বটেই আর সে দেশটা ভারতবর্ষের মতো হলে তো কথাই নেই, যেখানে একটা দেশের মধ্যেই অজস্র অনেক দেশ – প্রতিটি নিজস্ব হেঁশেল সংস্কৃতির মধ্যেই আবার নিজ নিজ মহিমায় বিরাজ করে একেকটি প্রদেশ বা অনেক ক্ষেত্রে শহর। এই ভনিতার উদ্দ্যেশ্য হলো আমরা যখন অতিথি আপ্যায়ন করি, মনের গভীরে সদা জাগ্রত থাকে একটি বাসনা, তা হলো আপন বাসস্থানের সেরা পদটি বা প্রতিনিধিত্বমূলক একটি পদ অতিথির পাতে তুলে দেওয়ার।

সেদিন ক্রিস্টিনে ঠিক তাইই করেছিলেন। তিন পর্বের সেই সান্ধ্যাহারের আয়োজনে তিনি রেখেছিলেন ‘ফন্ড্যু’(Fondue), ‘ৎস্যুরখার গেশনেৎসেল্টেস’(Zuercher Geschnetzeltes) সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করার জন্য ‘র‍্যোস্তি’(Roesti) আর শেষে নানান ফলের সমাহারে সুইস আইসক্রিম। আর সেই সন্ধ্যার সারাক্ষণের সঙ্গী ওয়াইনটির জন্মস্থান সম্ভবত ছিল ইতালি। সাধারণভাবে এই বর্ণনা থেকে কিছু অনুবাদ করে নেওয়া মুশকিল আর তিন দশক আগের সেই আমাদের সেই ‘হাবা হলধর’(সৌজন্য অলোকরঞ্জন) পর্যায়ে সবকিছুই কেমন অতীন্দ্রিয় ঠেকেছিল। প্রথমত ফন্ড্যু। আজ থেকে অনেক বছর আগে, আমাদের ছোটোবেলায় বাবার প্রাণের বন্ধু নানুকাকা যখন বিলেত থেকে এক সেট ফন্ড্যু কাঁটা (ফোর্ক) বাবাকে উপহার দিয়েছিলেন (কেন দিয়েছিলেন জানবার চেষ্টা করিনি কোনওদিন) তখন এর মাহাত্ম্য সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না। ৎসুরিখ শহরের এক অভিজাত পল্লীতে ক্রিস্টিনের বাড়ির খাবার টেবিলে যখন সামনে একটি ছোটো আগুনের ওপর ঈষৎ হলুদরঙা গলন্ত বুদবুদওঠা সুইস চিজ আর একটি প্লেটে রুটির টুকরো প্রত্যক্ষ করলাম, তখন প্রথম স্পষ্ট বুঝলাম সেই কাঁটার ব্যবহার। রুটির টুকরো কাঁটায় গেঁথে নিয়ে নরম- গরম চিজে ডুবিয়ে মুখে পুরতে হবে। এই হচ্ছে ব্যাপার। মুখের ভিতর তখন যে ঠিক কীরকম স্বর্গীয় অনুভূতি হয়, তার বর্ণনা একপ্রকার অসম্ভব। ‘ফন্ড্যু’ যদিও একটি সম্পূর্ণ আহার হিসাবে বিবেচিত হতে পারে, সেদিন তার ভূমিকা ছিল ক্ষুধা-উদ্রেককারী শুরুর পদের। এর পর যার দিকে হাত বাড়াতে হবে, তার উল্লেখ ইতিমধ্যেই করেছি। ‘ৎস্যুরখার গেশনেৎসেল্টেস’ আর ‘র‍্যোস্তি’। ‘র‍্যোস্তি’ অর্থাৎ এই আলুর কেকটিকে সুইৎজারল্যান্ডের জাতীয় পদের স্থলাভিষিক্ত করা যায় কিন্তু যেকোনও মাংসের রান্নার সঙ্গে একটি স্যালাড বা ওইরকম কিছু থাকাটা প্রথাসঙ্গত। কিন্তু স্বর্নালী সেই সন্ধ্যায় স্যালাডের জায়গাটি সদর্পে অধিকার করেছিল ‘র‍্যোস্তি’। এই বস্তুটি তৈরি করার জন্য আলু সিদ্ধ করতে হয় হালকা ভাবে। তারপর তা ঠাণ্ডা জলের মধ্যে কিছুক্ষণ রেখে দেওয়া হয় যাতে বেশি নরম না হয়ে যায়। অতঃপর সেই আলুকে কুরে নেওয়া হয়, তাতে মেশানো হয় চিজ, মাখনে ভাজা বেকন এবং অবশ্যই নুন-মরিচ। এবার বেকিং এর পালা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই মিশ্রণটি প্যানে ভেজে নিয়ে প্যাটির চেহারা দেওয়া হয়। অথবা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বেক হয়ে গেলে ছুরি দিয়ে টুকরো করে নেওয়া হয়। এবার এঁর সহচরের কথায় একটু আসি। যার ঠিকঠাক উচ্চরণ শিখতে গেলেও পেরিয়ে আসতে হবে জার্মান ভাষা শিক্ষার বেশ কয়েক ধাপ। সেদিকে আর যাচ্ছি না। কলকাতার যেমন কাটি কাবাব রোল, ৎসুরিখের বা জুরিখের তেমন এই ‘ৎস্যুরখার গেশনেৎসেল্টেস’। এটির প্রস্তুতি পর্বে বাছুরের মাংস লম্বা লম্বা টুকরো করে নেওয়া হয়। তারপর সামান্য পেঁয়াজ সহযোগে মাখনে সেই টুকরোগুলো ভেজে নেওয়া হয়। এইবার প্যানে দেওয়া হয় সাদা ওয়াইন এবং ক্রিম আর নিশ্চিতভাবে ডেমিগ্লেস (এক বিশেষ ফরাসি সস) – এই তরলটি ঘন হয়ে এলে মাংসের টুকরোগুলি মিশিয়ে দেওয়া হয়, সঙ্গে দেওয়া হয় চাকা চাকা করে কাটা মাশরুম এবং কখনও সামান্য পাপরিকা পাউডার। বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ জন্মসূত্রে সুইস, ফরাসি বা ইতালীয় না হলে এই রান্নায় হাত না দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সেদিনের ডেসার্ট, যাকে আইসক্রিম বলে অভিহিত করেছি আলোচনার গোড়ার দিকেই, আসলে ছিল ইতালিয়ান জেলাতো। এও এক ঐশ্বরিক সৃষ্টি। সাধারণ আইসক্রিম আর জেলাতোর মধ্যে তফাৎ যে ঠিক কী, তা বুঝতে সময় লেগে গিয়েছিল অনেক। তাই সেকথা আলাদা পরিসরে।

অতি মানবিক সেই আহারের পর আমরা মেট্রো এবং পদব্রজে আলোকোজ্জ্বল অথচ রাতকুয়াশায় মোড়া মায়াবী ৎসুরিখ শহরে খুঁজে পেয়েছিলাম মাথা গোঁজার ঠাই। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল যখন, দেখি নিচে, লাউঞ্জে ব্রেকফাস্ট শুরু হয়ে গেছে। অসংখ্য ধরণের সসেজ, রুটি, ফলের রস, দুধ, চিজ, ডিম, কফি, চা – যত পারো খাও। কেউ কেউ দেখলাম একটা আপেল বা ওইরকম কিছু সঙ্গেও নিয়ে নিচ্ছেন। এইসব নিয়ে কোথাও কখনও কারও মাথাব্যাথা দেখিনি। এই ধরণের ছোটোখাটো অতিথিশালা বা ইয়ুথ হস্টেলে – ইউরোপের সর্বত্র একই নিয়ম দেখেছি। যাঁরা সস্তায় এই মহাদেশটা দেখতে চান, তাঁদের জন্য এর চেয়ে ভালো উপায় আর কিছু হতে পারেনা।

আবার পিছনপানে ফেরা। আবার সেই জার্মানি। এবার লিন্ডাউ, ‘বোডেনসে’ (Bodensee) হয়ে ঢুকবো। ‘বোডেনসে’ অর্থাৎ ‘Lake Constance’ – সুইৎজারল্যান্ড, জার্মানি আর অস্ট্রিয়া, এই তিনটি দেশকে একইসঙ্গে ছুঁয়ে থাকা এক বিশালাকার হ্রদ, যা এই আশপাশের দেশগুলির এক জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। ৎসুরিখ থেকে ট্রেনে আমরা এসে নামলাম লিন্ডাউ তে। সেখান থেকে ট্রেন বদল করে আমাদের যেতে হবে ম্যুনশেন বা মিউনিখে। পারমিতা আর রাইমুন্ড ম্যুলার থাকেন যেখানে। কিন্তু তার আগে হাতে যে কয়েক ঘণ্টা রয়েছে, বৌদি-অলোকদার পরামর্শ ছিল ‘বোডেনসে’-র আশপাশটা এই সুযোগে একটু দেখে নেওয়ার। এমন ঘটনা তো বারবার ঘটবে না! হ্যাঁ পরবর্তী তিন দশক আর বার আটেক ওই দেশটাকে চষে ফেলার পরও আর যাওয়া হয়নি ওদিকে। তাই করলাম। মিউনিখের ত্রেন ধরার আগে যে ঘণ্টা তিনেক সময় পেলাম অনেক দেশের অনেকরকম মানুষের সঙ্গে উঠে পড়লাম এক জলযানে। ঘণ্টাখানেকের সেই সফর হয়ে রইল জীবনের এক অনন্য প্রাপ্তি।

মিউনিখে পৌঁছলাম বিকেল নাগাদ। প্ল্যাটফর্মেই দীর্ঘদেহী রাইমুন্ড দাঁড়িয়েছিলেন। প্রাথমিক পরিচয়পর্ব (কারণ সেই ওঁকে প্রথম দেখা) মেটার পর আমাদের সঙ্গে নিয়ে রওনা হলেন ওঁদের বাসস্থানের দিকে, যেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছেন পারমিতাদি, যিনি বৈবাহিক সূত্রে অনেকদিন ওই শহরে। ওঁদের সেই চমৎকার তিন কামরার ফ্ল্যাটে যথারীতি নরক গুলজার করে ফেললাম আমরা। সেদিন পারমিতাদি আমাদের জন্য রান্না করেছিলেন ভাত, ডাল, আলুপোস্ত আর এক অসামান্য মুরগির ঝোল। ‘কম্ফর্ট ফুড’ বলে একটা ধারণা আছে না? সারাদিনের পথশ্রম, এলোমেলো খাওয়া-দাওয়ার পর সেই নৈশাহার মনটা ভরিয়ে দিয়েছিল। অসাড় হয়ে ঘুমিয়েছিলাম পরদিন অনেক বেলা পর্যন্ত।
মিউনিখ শহরটা বিখ্যাত নানান স্থাপত্য আর যাদুঘরের জন্য। এর মধ্যে যেখানে একবার পা না ফেললে বলতে পারবোনা মিউনিখে গিয়েছিলাম, বিশেষ সেই দ্রষ্টব্য স্থানটি হলো ‘আল্টে পিনাকোঠেক’ (Alte Pinakothek)। পাঁচশো বছরেরও আগে বাভারিয়ার রাজ পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয়েছিল ছবি সংরক্ষণের এই অভূতপূর্ব প্রয়াস। তার অনেক পরে অবশ্য জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় এই শিল্পভবনটি, যা শুধু স্থাপত্যের বিশেষত্বের বিচারেই ইউরোপ এবং সারা পৃথিবীতে এক পৃথক কৌলীন্যের মর্যাদাধারী এবং ইউরোপের শ্রেষ্ঠ গ্যালারিগুলির সঙ্গে একই পংতিতে বসার অধিকারী। মনে আছে প্রকৃত অর্থেই চোখধাঁধানো সেই ভবনটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর যখন আমরা ক্লান্ত, খুধার্ত, অবসন্ন রাইমুন্ড আমাদের দুজনকে সামান্য হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে উপহার দিলেন দুধসাদা বাভারিয়ান সসেজ! বাছুরের মাংস, বেকন, নানান হার্বস্‌ ইত্যাদি দক্ষ হাতের মিশ্রণে যে বস্তুটির জন্ম হয়, তারই নাম ‘হ্বাইসহ্বুর্স্ট’ (Weisswurst)। প্রতিদিন ভোরবেলা বাভারিয়া অঞ্চলে এই সসেজটি তৈরি হয় এবং প্রথা অনুযায়ী প্রাতরাশ আর মধ্যাহ্নভোজনের মধ্যে খাওয়া হয়। আজও চার্চের ঘড়িতে দুপুর বারোটার ঘণ্টা বেজে গেলে ‘হ্বাইসহ্বুর্স্ট’ স্পর্শ করেন্ না অনেক বাভারিয়ান। রাইমুন্ডের মুখে এই গল্প শুনছি যখন, দুপুর তখন বিকেল অভিমুখে। আমাদের প্লেটে অর্ধভুক্ত ‘হ্বাইসহ্বুর্স্ট’। আশপাশের টেবিল থেকে কেউ কেউ আড় চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে।