Next
Previous
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in


























মেনকা গ্রাম থেকে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এম.এ. পড়ছে। লেডিস হোস্টেলে থাকে। অনেক বান্ধবী আছে। ঠিকমতো সময়ে খেয়ে নিয়ে একসাথে যাওয়া আসা করে। মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ি যায়। ছুটি থাকলে গ্রামে যায়। একদিন সকলে চিড়িয়াখানা গেলো। সেখানে পশু-পাখিদের দেখে খুব আনন্দ পেলো সবাই। মেনকা খাবারের জোগাড় করলো। ডিম টোষ্ট আর সস, সঙ্গে স্যালাড। মেনকা বললো বান্ধবী সোমাকে, জানিস আমাদের গ্রামের বাড়ি মাটির ছোটো বাড়ি। বাবা বলেন যতই ছোটো হোক বাড়ি হলো মন্দির। জানিস আমার মা ছোটোবেলা থেকে আমাকে শেখাতেন, একটা পাখির বাসাও ছোটো। কিন্তু অবহেলার নয়। কত পরিশ্রম করে তিলে তিলে একটা বাসা তৈরি হয়। কোনও মন্দির, মসজিদ, গির্জা ছোটো-বড়ো হয় না। সবখানেই সেই একই মালিকের বাস। সোমা বললো, তোর কথা শুনতে ভালোলাগে। আমদের ভারতবর্ষ মহান।

চিড়িয়াখানা থেকে ফিরে রাতে ভাত, তরকারী আর মাছের ঝোল খেলো ওরা। তারপর ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে উঠে সকলে প্রাতঃরাশের পরে গল্প করতে বসলো। আজ ছুটির দিন। মেনকা তার গ্রামের মেলা যাওয়ার বর্ণনা করলো। সবাই মন দিয়ে শোনে তার সত্যি গল্প, তার জীবনের গল্প। বুঝলি সোমা একবার গ্রাম থেকে গোরুর গাড়ি চেপে দধিয়া বৈরাগ্যতলার মেলা যাচ্ছি। পিছনে বাঁধা রান্না করার সরঞ্জাম। মেলা গিয়ে রান্না হবে। বনভোজন। সঙ্গে মুড়ি আছে। বড়দা বললেন, গিয়ে প্রথমে মেলা ঘোরা হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। মা বললেন, তোরা ঘুরবি আমি আর মানা রান্নাবান্না করবো। তারপর দুপুরে মেলা ঘুরবো। গাড়ি চলেছে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে। গোপাল কাকা বললেন, আরে, দেখ দেখ জিম চলে এসেছে। বড়দার ভয়ে ব্যাটা গাড়ির তলায় হাঁটছে।

জিম নেড়ি কুকুর হলেও, আমরা ওকে জিম বলেই ডাকি। কুকুর ভাবি না। অনেক মানুষের থেকেও ওর ভব্যতা অনেক বেশি।


আর একটা মেলায় যেতাম। পঞ্চাননতলার মেলা যেতে একটা আল রাস্তা ছিলো। আমরা ছোটোবেলায় বারবার ওই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করতাম। দু’পাশে কাদা ভরতি ধানের জমি। কী করে কাউকে ওই কাদায় ফেলা যায়, এই কুবুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলা করতো। আর তাই হতো। ধপাধপ কাদায় পরে যেত অনেকেই। আর আমরা কি মজা, কি মজা করে চিৎকার করতাম। মার খেয়েছি খুব। বদ বুদ্ধির জন্য। যাইহোক, গোরুর গাড়ি একবার থামলো। তামালদা আর আমি জমি দিয়ে হেঁটে গেলাম। দেখলাম আখের জমি। বললাম, একটা আখ খাবো। তামালদা বললো, না পরের জমি।

— একটা তো, কিছু হবে না।

— যাও, তাড়াতাড়ি আসবা।


তারপর একগাছা সরালো আখ ভেঙ্গে খেতে খেতে চলে এলাম।


গোরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। দিগি দিগি, পা পা, করে গোরুর সঙ্গে কথা বলে চলেছে প্রিয় তামালদা।


মন্থর গতিতে পৌঁছে গেলাম সকালের টাটকা মেলায়। ভোরবেলায় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। প্রায় কুড়ি কিমি রাস্তা চার ঘণ্টা লাগলো। তবু ক্লান্তি নেই। মা বললেন, প্রথমে জল এনে এই ড্রাম ভরে ফেল।


জল ভরার পরে আমরা মেলা ঘুরতে চলে গেলাম। কাঁচের চুড়ির দোকান পার করে নাগরদোল্লা। চাপলাম। ভয় নেই। মনে মজা।


তারপর ঘুরে ঘুরে দেখার পালা। একই জিনিস ঘুরে এসে দেখে নতুন লাগছে। চির নতুন। কেউ বিরক্ত নয়। সবাই অনুরক্ত মানুষের ভিড়ে। এই প্রবাহ পুরনো হবে না কোনওকালে।


বড়দা বললেন, অনেক হয়েছে। এবার খাবে চলো। মায়ের কাছে গিয়ে দেখলাম, মুড়ি, তেলেভাজা, আর রসগোল্লা রেডি। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়েছে। খেয়ে নিলাম। জল খেয়ে ধড়ে প্রাণ এল। এল আনন্দ।


মানা পিসি বললেন, চল আমি আর তুই একবার মেলা ঘুরে আসি। পিসি প্রথমেই চিতার কাছে গিয়ে বললেন, সব থেকে সত্য, এই চিতা। পিসি খুব তাড়াতাড়ি এই সত্যের সন্ধান কিছুদিন পরেই পেয়ে গিয়েছিলেন।


তামালদা মাকে বললো, দিদিমুণি, ত্যাল দিন তো। আর ওই খোলের বাটিটা। গরুগোলাকে খেতে দি ভালো করে। ত্যাল মাকিয়ে দোবো। ওরাও তো মেলায় এয়েচে। অবিচার করলে হবে না।

মা বললেন, যাও, দাও গা। ভালো করে খেতে দাও।


মা রান্না সারার পরে একবার মেলায় গেলেন। আমার ঘুরে ঘুরে পায়ের ডিমিতে লাগছে তবু মেলা না দেখে মন মানছে না। ক্লান্তি ভুলে অবাক চোখ চালানো সারা মেলা জুড়ে। কোনও কিছু দেখা বাকি থাকলো না তো? তাহলে বন্ধুদের কাছে হেরে যাব। বন্ধুরা বলবে, কেমন মেলা দেখলি। আমরা সব দেখেছি।


আর দেখলাম মানুষের আবেগের রঙীন খেলা। কেউ নাগরদোল্লায়। কেউ খাবার দোকানে। আর অনেকে শুধু ভবঘুরের মতো চরকি পাক খাচ্ছে ভিড়ের মাঝে। মেলায় মিলন মানুষে মানুষে। জাতিতে জাতিতে, বললেন গোপাল কাকা।


এই মেলায় হরিনাম এক প্রধান আকর্ষণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ভক্তের মায়া।

আমার ঈশ্বর, আমার অনুভব, ভালোবাসা একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। আমার জ্যান্ত ঈশ্বরের পরম করুণাময়ের সঙ্গে মিলিত হবার শেষ আয়োজনের শুরু হয়েছে। মনে পরছে, আমার সামনে থেকেও রকেটের দাগের মতো মিলিয়ে গেলো বন্ধু। গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে আর উঠলো না নীলমণি। রোজ আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বল জ্বল করে আমার অশ্রু আয়নায়। হাওয়ায় ওড়া আমার বেহিসাবী মন আজও দেখতে পায় অনন্ত আকাশে তার বিচরণ।


দুপুর ঠিক দুটোর সময় মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। মা বললেন, থালাগুলো জল বুলিয়ে নিয়ে এসো সবাই।


তারপর গোল হয়ে সবাই বসে পরলাম খেতে। মাটিতে বসে খেতে শুরু করলাম। আমি কলাপাতায় খেতে ভালোবাসি। এত খাওয়া নয়, স্বপ্ন জগতে বিচরণ। এই ভালোলাগা বার বার আসে না। অকৃত্রিম আনন্দের জগৎ এই মেলা।


সবার খাওয়া হয়ে গেলে মা ও মানা পিসি বসলেন খেতে। সবাইকে প্রথমে খাইয়ে তারপর নিজের খাওয়া। তাই ভারতমাতার সন্তানরা দেশের দশের জন্য সব ত্যাগ করতেও কুণ্ঠিত হয় না। মায়ের কাছে এই শিক্ষা তারা পায় ছোটো থেকেই।


তারপর বাড়ি ফেরার পালা। অনেক মৃতদেহ আসছে শ্মশানে। বলো হরি, হরিবোল ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। তারা ফিরছে আপন ঘরে। আমরা ফিরছি গ্রীনরুমে।


সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মা চিন্তা করছেন। তামালদাকে বললেন, তাড়াতাড়ি ডাকাও। গোরু দুটোকে তামালদা বলছে, হুট্ হুট্, চ, চ দিগি দিগি। গোরু দুটো ছুটতে শুরু করলো। খুব তাড়াতাড়ি চললাম। টর্চের আলোয় রাস্তা দেখছি সবাই। হঠাৎ রে রে করে দশজন ডাকাত পথ আগলে দাঁড়ালো। দে যা আছে বার কর। হাতে তাদের বড়ো বড়ো লাঠি। মা বললেন, বললাম তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে যায় চ, তোরা শুনলি না আমার কথা।


হঠাৎ তামালদা আর বড়দা নেমে লাঠি কেড়ে নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে লাগলো। আমরা গাড়িতে বসেই দেখতে লাগলাম লাঠির ঘায়ে ডাকাতগুলোর মাথা ফেটে রক্ত পরছে। সবগুলো শুয়ে পরে হাত জোড়া করে ক্ষমা চাইছে। মা বললেন, ছেড়ে দে। উচিত শিক্ষা পেয়েছে বাঁদরগুলো। খেটে খাগা যা, পালা।


তারপর তামালদা ও বড়দা লাঠি দুটো নিয়ে সামনে বসলো। বড়দা বলছে, আয় কে আসবি আয়। সেই কেড়ে নেওয়া লাঠি আজও আছে। মা বলতেন, অন্যায় করবি না, আর অন্যায়ের সাথে আপোষও করবি না।


মনমতো পছন্দের মামা আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ, ডিম, মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া, সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল, ডাল, মুড়ি নিয়ে যেত মুরগির মালিক। নগদ টাকার টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল, ডাল, গুড় পাওয়া যেত। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে মামা নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা, মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর, গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো। আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয়ে শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো। একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বারবার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা, হোবলো, ক্যাবলা, লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। মামা কোনওদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম, বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কী? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই মামা বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুঁড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের। আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। মামা ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন, ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোঙা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেত ছেলেরা। অনেক গল্প শুনেছিলাম দাদুর বীরত্বের গল্প। মা তার নিজের গল্পও বলেছিলেন অনেক। আমার মনে পরে সেইসব কথা।




গল্প বলতে বলতে কখন যেন মেনকার চোখে জল এসে গিয়েছিলো। সোমা জল মুছে দিলো। বললো, আর পনেরো দিন পরেই পুজোর ছুটি। সবাই বাড়ি যাব। কি মজা বল। মেনকা বললো, ঠিক বলেছিস।




কথায় বলে না ভালো লোকের শত্রুর অভাব নেই। সুমন নানারকম অসুবিধা থাকলেও এদল ওদল করে না। টাকার লোভ তার নেই। আর এইসব গান-বাজনার লাইনে রাজনীতি খুব বেশি। অনেকে ভালো শিল্পীকে নিয়ে টানাটানি করে। সুমন আর রূপসী বড়ো শিল্পী। তবু তারা মুরারী অপেরা ছাড়েনি। মুরারী এখন ভালো ব্যবহার করে। আলকাপের দল খোলার পর থেকে লাভের অঙ্কটা হু হু করে বেড়ে চলেছে। তাই সে খুব খুশি।


সুমন এবার নেশা ধরেছে মদের। বাড়ির কথা মনে পড়ে তার। কিন্তু দল ছেড়ে সে থাকতে পারে না। তারপর বাড়িতে বাঁশি বাজাতে দেখলেই তার বৌ খেপে যায়। তাই অশান্তি করতে তার ভালো লাগে না। একবার তার বৌ বাঁশি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো। সেবার সুমন বৌকে একচড় মেরেছিলো ছেলের সামনে। মন খারাপ হয়েছিলো তার। ভাগীদার গণেশ হাজরা বলেছিলো, কাজটা আপনি ঠিক করেন নাই দাদাবাবু। সেবার গণেশকে বলে পালিয়ে এসেছিলো সুমন। এখন বাড়ি কম যায়। মাঝে মাঝে টাকা পাঠিয়ে দেয়।


দলে একটা নতুন মেয়ে এসেছে বিজয়া। মুরারীর সঙ্গে খুব মাখামাখি। একবার পুকুরে চান করতে গিয়ে বিজয়া সুমনকে চুমু খেয়েছিলো। বলেছিলো, কি গো নাগর। রূপসী ছাড়া আর কাউকে ভালো লাগে না। তোমার রস একদিন আমাকে খাওয়াও। সুমন এসব পছন্দ করে না। সে বললো, আর কোনওদিন আমাকে এসব বলবে না। রূপসীও আমাকে বিরক্ত করে না।


বকুনি শুনে ভিজে কাপড়ে পালিয়েছিলো বিজয়া। তারপর অনেক দিন পরে একটা যাত্রার পালা করতে সুমনরা গেলো কোপা গ্রামে। সেখানে মেনকার বাড়ি। মেনকা বাড়ি এসেছে কয়েকদিনের জন্য। আর বন্ধুরা সবাই মিলে আয়োজন করেছে এই অনুষ্ঠানে। ঠিক রাত দশটায় কনসার্ট বেজে উঠলো। সুমনের বাঁশির সুরে মাতোয়ারা হয়ে গেলো গ্রাম।


পালা শেষে মেনকা সুমনের সঙ্গে আলাপ করলো। সে বললো, আমার এখন গবেষণার বিষয় এই, আড় বাঁশি। সুমন বললো, অনেক বড়ো হও মা। আমার তো বয়স হয়েছে। রূপসীও নেই। মরে গেছে।


মেনকা বললো, কে এই রূপসী।


— আমার ঘর বাঁধার স্বপ্নের পাখি। সে আমার সঙ্গে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলো। আমি পারিনি।


— কেন, পারেননি কেন?


— আমার বৌ বাচ্চা আছে তাই।


— ও বুঝেছি।


— এই আড় বাঁশির আড়ালে অনেক কাণ্ড ঘটে গেছে মা।


— আপনি ঠিকানাটা দিন। একদিন আপনার বাড়ি যাব। প্রণাম নেবেন।




তারপর সুমন কোপা ছেড়ে চলে এল নিজের গ্রামে। এখন সবাই নতুন নায়ক নায়িকা। পুরনো কেউ নেই। দল ছেড়ে এসে সে বাড়িতে বাঁশি বাজানোর শিক্ষা দিতে শুরু করলো। বহুদূর থেকে ছাত্র ছাত্রী এল। সুমন তার স্কুলের নাম রাখলো, মধুবনি।


শত শত শিক্ষার্থী এই মধুবনি থেকে বাঁশি বাজানোর শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগলো। একদিন মেনকা এল তার গবেষণার কারণে। এসেই খেনীদেবীর নজরে পড়লো সে।


তিনি বললেন, মা তোমার কোথায় বাড়ি।


— কোপা।


— তোমার বাবার নাম কি?


— কার্তিক মাঝি।


— ও তাহলে তুমি আমার পিসির গ্রামের দাদার মেয়ে। কোপার কার্তিক মাঝিকে আমি দাদা বলতাম। যাওয়া আসা না থাকলে আপনজনও পর হয়ে যায় মা। এসো ঘরে এসো।


তারপর সুমন এসে তার জীবনের সমস্ত কথা বললো। মধুবনির স্বপ্নের কথা বললো। মেনকা বললো, আমি আপনার কাছে থাকতে চাই।


সুমন বললো, তোমার যতদিন খুশি থাকো। আমার মধুবনিকে দেখো। আরও অনেক তথ্য পাবে।


সুমনবাবুর ছেলে কালো, মেনকাকে দেখেই ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু বলতে পারছে না। সুযোগ এসে গেলো। সুমনবাবু বললেন, কালো একবার মেনকাকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাও। গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে কালোর সঙ্গে মেনকার পরিচয় হলো। মেনকা জিজ্ঞেস করলো, তুমি বাঁশি বাজানো শিখেছো। কালো বললো, বাবা আমাকে মায়ের আড়ালে সুর শিখিয়েছেন।


— কই বাজাও দেখি।


কালো বাঁশি বাজালো। এ যেন রাধার পোড়া বাঁশির সুর। মেনকা সুরের প্রেমে ধরা দিলো। সে বললো, আমিও এই সুর শিখবো, বাজাবো।


— নিশ্চয় শিখবে। বাজাবে?


তারা দু’জনে বাড়ি ফিরে দেখে প্রচুর ভিড় মধুবনি স্কুলে। ছুটে গিয়ে তারা দেখলো, সুমনবাবুর ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ। কে বা কারা মাঠে তাকে মেরে পালিয়েছে। তিনি মাঠে যেতেন বাঁশি বাজাতে। বাঁশিটাও ভেঙ্গে দিয়েছে। মেনকা সুমনবাবুর কাছে শুনেছেন কে বা কারা যেন তাকে মারার চক্রান্ত করছে। তার মধুবনি ধ্বংস করতে চাইছে।


পুলিশ এল। তারা তদন্তের ভার নিলেন।


সুমনবাবুর ছাত্র-ছাত্রী সকলে কাঁধে করে শবদাহ করতে শ্মশানে গেলো। আগুনে বিলীন হলো নশ্বর দেহ। কিন্তু তার স্বপ্ন সফল করবে শত শত মধুবনির ছাত্র-ছাত্রীরা।


এমন একটা অঘটন ঘটে যাওয়ার জন্য মেনকা কালোর কাছে থাকলো অনেকদিন। এই বড়ো শোকে যে পাশে থাকে সেইতো আসল বন্ধু। কালোর মা বললেন, মেনকা তোমার মতো একটা মেয়ে পেলে আমার জীবনে বাঁচার ইচ্ছাটা থাকবে। মেনকা বললো, একবার আমার বাবার সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি বললেন, আমরা তোমাদের বাড়ি যাব।


মেনকা আর কালো দু’জনে ঠিক করলো তারাই এই মধুবনির অপূর্ণ সাধ পূরণ করবে শত বাধা অতিক্রম করে। কালো বাঁশি বাজানো শেখাবে। আর মেনকা একটা গবেষণার গ্রন্থ প্রকাশ করবে। তার নাম দেবে, আড় বাঁশির আড়ালে। মেনকার গবেষণা তিন বছরে পড়েছে। আর এক বছরের মধ্যে পেয়ে গেলো পি এইচ ডি ডিগ্রি। এখন তার নামের আগে লেখে ডঃ মেনকা বোস।


সুমনবাবুর মৃত্যুর দু’বছর পরে কালো আর মেনকা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। ভালোবাসার জয় হলো। কালো এখন একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক।
ধীরে ধীরে মধুবনি সুরের আকাশে নক্ষত্রের জায়গা নিলো।