ধারাবাহিক - অসিত কর্মকার
Posted in ধারাবাহিকদুই
দুপুরের খা খা রোদে তাড়া খাওয়া এক বেদম পশুর দশা দুলকি গাঁয়ের। পোড়া বাতাসের আর চলাচলের শক্তি নেই। দম খিঁটে থেকে শেষ নিশ্বাস বায়ুটুকুকে আটকে রেখে বাঁচার চেষ্টা করছে মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ আর গাছপালা। ঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে শুয়ে গয়ান। আজ আর ভাতঘুমের দেখা নেই গয়ানের। বাইরের পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অতীত জীবনের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে থাকে গয়ান। নিজের অতীত জীবনের সঙ্গে বাপ-পিতামহর অতীত দিনের কথা জুড়ে জুড়ে সে এক দীর্ঘ পরিক্রমা। গয়ানের ঠাকুর্দার বাপ নাকি তারও আগের ইতিহাস, এখন আর ঠিকঠাক মনে ধরা দেয় না গয়ানের, তবে বংশ পরম্পরাগত যত কাহিনির হাত ধরে তাদের এই বাদার দেশে জীবন-জীবিকার পত্তন পর্যন্ত এক দীর্ঘ সময়কে ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে গয়ানের মন গোলকধাঁধায় হাঁপিয়ে মরে। স্মৃতিকাতর গয়ানের মনে গান জাগে,
মইলিলিন গে, মইলিলিন গে,
কাঁহা মইলিন বাজে করতাল।
কাঁহা মইলিন বাজে
নাগরালি সান সুঁদার
কাহা মইলিন...।
যে ভরি জানলি
হেরি গুনি গাওলি
মইলিলিন গে...।
এ গান কত শত বছরের পুরনো তা জানে না গয়ান।
গয়ানের ছেঁড়া ছেঁড়া মনে পড়ে বাপ-পিতামহর মুখে শোনা সেই অতীতদিনের কথা, এই বাদার দেশে তাদের থিতু হওয়ার কাহিনি। দু’বেলার দু’মুঠো ভাত আর শ্রমের ক্লান্তি ভুলে থাকার জন্য একটু নেশার জিনিসের বিনিময়ে বন কেটে বসতভূমি গড়ে মানুষগুলো, চাষাবাদের জন্য জমি তৈরি করে, ভেড়িবাঁধ তৈরি করে নোনাজল রোধ করার ব্যবস্থা করে। জনবসতি আর চাষের জমি বাঁচায়। নিজেদের জন্যও মাথা গোঁজার মতো একটু ঠাঁই আর কোনওরকমে খেয়ে বাঁচার জন্য সামান্য চাষের জমি জোটে। এই বাদাভূমি নদী, নালা, খাঁড়ি, সোঁতা আর সুঁড়িখালের জালিকাময় ম্লেচ্ছের দেশ, রসাতল ক্ষেত্র। পাণ্ডব বর্জিত কিরাত, শবর, পুলিন্দ, যবনদের ভূমি। এ ভূমিতে আর্যের পা রাখা অনাচার, মহা পাপ! পুন্নোষ্টম যজ্ঞ করে তবেই নির্ঘাত নরকবাস থেকে উদ্ধার পেতে হয়। ভূঁইয়া প্রতাপাদিত্যের অত্যাচারে এই বাদার দেশ একসময় জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। মানুষের উপদ্রবহীন সুদীর্ঘ অখণ্ড অবসরে গাছপালা, লতাগুল্ম, পশুপাখি, জলজপ্রাণি, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি দেদার বংশবিস্তারে সামিল হয়ে এক ভয়াল সুন্দর অরণ্যভূমির জন্ম দেয়। প্রকৃতির তিন শতাধিক বছরের সাধনার ফসল। কিন্তু সময়ের দাবিতে ইতিহাস আবর্তিত হয়। এল ইংরেজ আমল। দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে। আরও খাদ্যের ব্যবস্থা চাই। চাই বাসস্থানের ব্যবস্থা। সেইসঙ্গে চাই রাষ্ট্রের কোষাগারে আরও আরও রাজস্ব আদায়ের উপায়। এসবের জন্য চাই প্রচুর চাষের জমি আর বসতভূমি। জঙ্গল হাসিল করে কৃষিজমি আর মনুষ্যবসতি গড়ে তোলার ঘোষণা দেয় ইংরেজ সরকার। যত বেনিয়া, জমিদার, মুৎসুদ্দি আর ভুঁইফোঁড় বড়োলোকরা জমি বন্দোবস্তের ইজারা নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওদের নিয়োগ করা চকদার, লাটদার, গাঁতিদাররা জঙ্গল হাসিল করার উপযুক্ত শ্রমিকের জন্য আড়কাঠিয়া নিয়োগ করে। আড়কাঠিয়ারা শ্রমিক জোগান দিতে ছোটনাগপুর, ছত্তিসগড়, বিলাসপুর, সুন্দরগড়, ময়ূরভঞ্জ, হাজারিবাগ, সিংভূম, রাঁচি, কেঁওনঝড়, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ইত্যাদি অঞ্চল থেকে হাজার হাজার আদিবাসী কৌম মানুষকে সুখে শান্তিতে বাঁচার লোভ দেখিয়ে ভারতবর্ষের পূবের এই প্রান্তভূমিতে আনে বন কেটে বসত গড়ার কাজে। সাঁওতাল, ওঁরাও, লোধা, মুন্ডা, কুর্মি, গোন্ড, ভূমিজ, খেড়িয়া ইত্যাদি আরও কত না সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর বুকের মধ্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নানা বিদ্রোহ আর আন্দোলনের আগুনের শিখা তখনও ধিকিধিকি জ্বলে। জ্বলে যত দিকু মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে আগুন। ওই আগুনের পরশটুকুই সম্বল করে ওরা ভাগ্যান্বেষে ছিন্নমূল হয়। দাঁ, কুড়ুল, হাঁসুয়া, খন্তা ওদের হাতের অস্ত্র। অদম্য মনের জোর আর সাহস ওদের সম্বল। মাথার ওপর উপযুক্ত ছাউনি নেই, খাদ্য নেই, পানীয় জল নেই। আছে শুধু অশ্রু, ঘাম আর রক্ত ঝরা শ্রম দান আর মৃত্যুর কোলে যেকোনও সময় ঢলে পড়ার ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা। বাঘ, কুমীর, সাপ, রোগজারি, অপুষ্টি, অনাহারের সঙ্গে নিত্যদিনের লড়াই করে ওরা জঙ্গল হাসিল করে যায়। ইজারাদারদের রক্তচক্ষু, বঞ্চনা আর অত্যাচার তো বাড়তি পাওনা হিসেবে আছেই! ওরা ভেড়ি বেঁধে নদীর নোনাজল প্রতিহত করে বসতি গড়ে। ওদের হাতের জাদুতে বন্ধ্যা নোনামাটি চাষযোগ্য হয়। হয় উর্বর। শর্তসাপেক্ষে ওরাও কিছু জমি পায়। পায় মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই। বৃষ্টিনির্ভর চাষবাস। খরা আর বন্যায় চাষ মার খায়। নিত্যদিনের অভাব, অসুখবিসুখ, শোক, দুঃখকষ্ট ভুলে থাকতে নেশা চাই। কিন্তু নেশার পয়সাই বা জোটে কোত্থেকে। ক্ষুধায় এক থালা ভাত, নেশায় সামান্য একটু হাঁড়িয়ার জন্য সাধের জমি হাতছাড়া হয়ে যায়। টিপছাপ নিয়ে মহাজনরা জমি কাড়ে, ভিটি কাড়ে। দাদনি প্রথার জাঁতাকলে পড়েও পেষাই হয় মানুষগুলো। একে একে সব হারিয়ে প্রান্তিক মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়। নয়া বসতি গড়ার জন্য মাটির খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। যে মাটিতে অন্য মানুষের আইনি অধিকার এখনও কায়েম হয়নি। নদীর বুক ফুঁড়ে জেগে ওঠা কোনও কুমারী ভূমি কিংবা তুচ্ছ পরিত্যক্ত কোনও ভূমিখন্ড ওদের আশ্রয় হয়। সময়ের সঙ্গে এমন হতভাগ্য মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলে। ফলে এমন তথাকথিত ভাগাড়ভূমির জন্যও একসময় হাহাকার পড়ে যায়। একটু মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য বাধে মারামারি, লাঠালাঠি, রক্তক্ষয়ী খুনখারাবি।
বেলা মজে আসায় প্রকৃতি এখন একটু ঠান্ডা, শান্ত। হলুদ গোলা জলের রঙ আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। তাপে জর্জর ধুকপুক বুকে তৃষ্ণা নিয়ে যে পাখিগুলো পাতার আড়ালে আশ্রয় নিয়েছিলো তারা এখন বেরিয়ে এসে আজকের মতো কিচিরমিচির ডাকে মেতেছে। ঘরে ফেরার সময় ঘনিয়ে আসছে ওদের। তন্দ্রা মতো এসেছিলো গয়ানের। ঝগড়ুর ডাকে চোখ মেলে গয়ান। উঠে বসে। তার কথায় সকাল থেকে তেতে আছে ঝগড়ু। বাজার থেকে ফিরে কোনওরকমে স্নান খাওয়াটুকু সেরেই গয়ানের কাছে চলে এসেছে সে। আজ তার দুপুরে ঘুমের বালাই নেই। নেই বিড়ি বাঁধায় মন। অস্থির মন নিয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে অপেক্ষায় ছিলো কখন রোদটা মজে আসে। আসতেই সে গয়ানের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।
তুমহার লিদট লষ্ট করহলাম লাকি গ খুড়া? ঝগড়ু জিজ্ঞেস করে।
লা রে ঝগড়ু। অই চখট টুকুস লাগি আসিছিলহ। হামার আর কাঝট কী বল। শরীলট জুতহের লাই রে ঝগড়ু।
বয়সজনিত কারণেই নানা উপসর্গে ভুগছে গয়ান। মনের জোরটুকুই যা তার তাগদ এখন।
ঝগড়ু বললো, ডাগদরট দিখাও, ভালমন্দট টুকুস খাও গ খুড়া। ভাল তুমহায় ঝে থাকতে হবে গ খুড়া। তুমহি হলহে হামাদের লিতা মানহুষট বটহে! বুলছি খুড়া, সময়ট হাতহে বেশিট লাই। তুমহি মিটিনট ডাকহ, গাঁয়হের মানহুষগুলানরে একজোটট ত করতে হবেক, লাকি? বিরিজটর লাগি কে কোন পাট্টিট করে তা সব ভুলতেহ হবেক। বলহ ত খুড়া কালহি বটগাছটর লীচহে মিটিনটর বেবস্থাট করহি। হামি ঘর ঘরট যাছহি বুলতে। আর তুমহি যে হামাদের দাবহিগুলান লিখার কথহা বুলহে তার ঝইনহ বাজার থিকহে কিছহু খবরের কাগজট চাইহে আনহিছি গ। বুধনির আলতাটর শিশিট ইখনহ ঘরেট আছহে। রঙট শুকাই গিইছে, জলট দিলহে ফির রঙট মিলবেক।
গয়ানের বউ বাহামনি দাওয়ার আরেক পাশে বটি নিয়ে বসে নারকেলের পাতা থেকে শলা তুলছে। পাতার কাছটিতে শুয়ে দুটো বিড়াল অকাতরে ঘুম যাচ্ছে। উঠোনের একপাশে বাড়ির ছোটোরা খেলায় মেতেছে। কোথায় বসে একটা ঘুঘু থেকে থেকে ডেকে ওঠে। ঝগড়ুর কথাগুলো বাহামনির কানে যায়। ঝগড়ুর জন্য বাহামনির মনের কোণে খানিক কোমল জায়গা আছে। ল্যাংড়া মানুষ ঝগড়ু, ছোট্ট বয়স থেকে খুব কষ্টে বড়ো হয়েছে। যাও একটা বিয়ে করলো সে বউ পরপুরুষের হাত ধরে কোথায় পালিয়ে গেলো। ঝগড়ু এখন পৃথিবীতে একরকম একাই। আত্মীয়স্বজন দু-এক ঘর ভিনগাঁয়ে থাকলেও তারা ঝগড়ুর খোঁজখবর রাখে না। বাহামনি অবাক হয়ে বললো, বা হ রে ঝগড়ু, বউট লাই কিন্তুক উয়ার আলতাট লয়ে ইখনও ঘরট করছিস তু?
কষ্টের হাসি হেসে ঝগড়ু বললো, কী করবক গ খুড়ি, বউট ত আছিলা মোর ঘরটয়, লয়? আমি ত উয়ারে পিরানট দিইহে ভালবাসিছিলম লাকি। পিরানটয় ধইরে ফিলহে দিতহে কি পারি গ! ইবার উয়ার আলতাট ভাল কাজহে লাগুক গ খুড়ি।
সে ভালহ কুথা, কিন্তুক এ বুঢঢাটকে আর উয়ার মুধধে টানছিস কিনহ? ইখন আর উয়ার কথাট কেহ শুনহে লা। উয়াকে মানহে লা। মানলে ইত দিনহে বিরিজট হইত লাই? গাঁভর মানহুষগুলা শোর আর নিশায় সব ভুইলহে গিল গ! বাহামনির কণ্ঠে দুঃখ আর ক্ষোভ উগড়ে ওঠে।
শুনে ঝগড়ুর মনে বড়ো কষ্ট বাজে। দুলকিগাঁয়ের এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মানুষগুলো জীবনভর বঞ্চিতই থেকে গেলো। জীবনের আর কতটুকুই বা বাকি আছে এদের। আশাহত অতৃপ্ত আত্মা বয়ে নিয়েই হয়তো জীবনের ওপারে চলে যেতে হবে ওদের। হতাশার মধ্যেও মনটাকে শক্ত করে ঝগড়ু। অনেক দুঃখদুর্দশা সয়েছে ওরা। আর নয়। দিন বদলানোর অঙ্গীকার মনে প্রবলভাবে জেগে ওঠে ঝগড়ুর। দৃঢ় গলায় বললো, ইবার আর ভুলতে দিবক লাই গ খুড়ি। উয়াদের বুঝহায়ে খুড়ার কথাগুলান মানহাইতে হবেক। ই গাঁয়ে ভোটারট ত কম লাই গ। হামরা একজোটট হইয়ে লড়াইট দিলহে ভোটবাবুগুলানের টনকট লইড়ে ঝাবেক গ খুড়ি।
হা দিখিস, ইবারও শোর আর নিশার কাছহে হারিট লা ঝায়!
বাহামনির কণ্ঠস্বরে এখন আর ক্ষোভ নয়, অবিশ্বাস আর তাচ্ছিল্যের ছোঁয়া। বয়স তারও তো কম হয়নি, অল্পে সন্তুষ্ট সরলমতি মানুষগুলো কীভাবে সংকল্প ভুলে আনন্দ, উৎসবে নিজেদেরকে ভাসিয়ে দেয় তা সে অনেক দেখেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে বলে বাহামনির বিশ্বাস হয় না।
অই ঝনহই ত খুড়াকে বুলছি, মিটিনট ডাকহ খুড়া, মানহুষগুলানরে খুব কইরহে বুঝাইতে হবেক ইবার। দরকারট হয় ত বারবারট মিটিনট ডাকহি উয়াদের মনট শক্ত করবার লাগবেক গ খুড়ি।
গয়ানের মনে ধরে ঝগড়ুর কথাগুলো। শুভ কাজ ফেলে রাখা ঠিক না। হ্যাঁ, আজ থেকেই কাজে নেমে পড়তে চায় গয়ান। বললো, তু কথাট ঠিকহই বুলেছিস রে ঝগড়ু। হামাদের দাবির কথহাগুলান কাগজটয় লিখহে গাঁভর টাঙাই দিতহে লাগবেক। গাঁয়ের কিছহু চ্যাংড়া ছিলাপুলা লিখহাপড়াট ত শিখহেছে লয়, দাবিগুলান পড়হে ঘরহের আনপড় মানহুষগুলানরে বলবেক। উয়ারাও বুঝবেক, হামরা ই বার জোর লড়াইট দিবহ। তার আগহে মিটিনট হওয়া লাগহে। গয়ান তার ছোটো নাতনিকে ডাকে, অ লুপসি, টুকুসখান কাগহজ আর তর কলমট লিয়া আয় ত। তর ঝগড়ু খুড়া উয়াতে আমার কথাগুলান লিখহে লিবে।
লুপসি কাগজ আর কলম হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সদ্য যৌবনে পা দিয়েছে। ঢলঢলে শরীর। আট ক্লাশে পড়ছে সে। ঝগড়ু তার হাত থেকে কাগজ আর কলমটা হাতে নিয়ে বললো, তু হামার পাশটয় টুকুস বস। লিখাপড়হাট ছাড়ি দিছহি মিলা দিনট হলহ। দিখ হামার লিখাটয় কুনহ ভুলট হয় কিনহা।
খুব খুশি হলো লুপসি। ঝগড়ুর পাশে বেশ গর্ববোধ নিয়ে বসে সে। এতগুলা বয়স পর্যন্ত সে পড়াশোনার ব্যাপারে এতটা গুরুত্ব পায়নি।
গয়ানের পাশে বসে ঝগড়ু সাদা কাগজের টুকরোটার উপর কলম বাগিয়ে ধরে বললো, বলহ গ খুড়া, হামাদের দাবির কথাগুলান, লিখহে লিই।
গয়ান ভেবে ভেবে একটাই দাবিকে বিভিন্ন বাক্য গড়ে বলতে থাকে। ঝগড়ু বাক্যগুলোকে এক দুই তিন..., নাম্বার বসিয়ে লিখে যেতে থাকে। লেখা শেষ হলে কাগজটাকে যত্ন করে ভাঁজ করে কোমরে বাঁধা গামছার ভেতরে গুঁজে নেওয়ার আগে সে লুপসিকে জিজ্ঞেস করে কোনও ভুল হয়েছে কিনা। লুপসি হতাশ। না, সে তার ঝগড়ু খুড়ার লেখায় একটা ভুলও বার করতে পারেনি। সব একদম ঠিক আছে। মুচকি হেসে বললো, খুড়া, তুমহার মাথাট সরেসট আছহে। কিচ্ছুট ভুল লাই!
শুনে হো হো করে হেসে ওঠে ঝগড়ু। কলমটা লুপসির দিকে বাড়িয়ে ধরে।
হামি ইখন আসি গ খুড়া। অ খুড়ি, বাঁচিট থাকহি বিরিজট দিখহেই তমরা সগ্গেট ঝাবেক গ। আসহি ইখন। মেলা কাজট আছে লয়।
শুন ঝগড়ু, তু ইকা কতহ হাঁটবিক, হামার বড়হ লাতি দুটাকে লিয়া ঝা। উয়ারাই ঘর ঘরট গিইহে মিটিনটর কুথা বুলহে দিবেক। তার আগহে একট কামট করিস, বড়হ লাতিটকে দিইহা একট গাছহের ডালট ভেঙহে হাতেট লিস।
কিনহ খুড়া, ডালট হাতহে লিব কিন? ই গাঁটয় মিটিন ত হামাদের কমট হয় লাই তখহন তুমহি ত ডালটর কুথা বলহ লাই। ইখন তুমহার মাথাট কি বিগড়াই গিল খুড়া? একরকম বিস্মিত হয়েই জিজ্ঞেস করলো ঝগড়ু। মনে তার প্রবল কৌতূহল। চলে যেতে গিয়েও যেতে পারে না। ফের দাওয়ায় বসে পড়ে।
হামার মাথাট বিগড়াই লাই রে ঝগড়ু। হামি ঠিকটই বুলছি। হামাদের বাপপিতামহ ঝে মুলুকট ছাড়ি ই বাদার দেশহে আসিছে সিই মুলুকটয় হামাদের লিয়মট ছিলহ, হাটহে হাটহে, গাঁয়ে গাঁয়ে ডালট লয়ে কেওহ ঘুরলে বুঝহে লিতে হবেক জমায়েতটর ডাক দিয়াছে সমাজটর মাথাগুলান। সিখানে হামাদের সমাজটর কুনহ ভালমন্দটর বিচার হবেক। মারাংবুরুর নামহে শপথট লিয়ে গাঁওবুঢ়া মাঝি, জগমাঝিরা ল্যাহ্য বিচারট করবেক। সমাঝট রক্ষার উপদেশট দিবেক। বাঁচহার ঝন্যহ লড়হাই আন্দোলনটর ডাকট ভি দিবেক। হামাদের লিতা তিলকা মাঝি, সিধু, কানহু আর বীরসা মুন্ডা। দিকু মহাজন আর ইংরাজদের সঙ্গে লড়াইট করহে উয়ারা পিরাণট দিলহ। উয়ারা হামাদের ভগমানট আছহে। দেওতা মারাংবুরু হামাদের রক্ষাট করতেহে উয়াদের পিথিবিটয় পাঠাইছে রে ঝগড়ু। ই বাদার দেশটয় আসহি হামরা উয়াদের কুথা সব ভুলহে গিছহি। বড় দুখ লাগহে রে ঝগড়ু। ইখানে কোনহ পাহাড়ট লাই ঝে উয়ার পূজাট করবক। কিন্তুক মারাংবুরু হামাদের ঠিকহি দিখেট রাখিছে বুলেই ইখনহ হামরা বাঁচহি আছহি। এক লপ্তে কথাগুলো বলাতে হাঁপিয়ে ওঠে যেন গয়ান।
মারাংবুরু, সি আবার কেমনট দেওতা গ খুড়া? কুনওদিন উয়ার নামট ত শুনহি লাই! প্রবল কৌতূহলী হয়ে ঝগড়ু জিজ্ঞেস করে। তাদের সমাজের পূর্ব ইতিহাস শুনতে শুনতে কেমন এক ঘোর লাগে ঝগড়ুর। আরও শোনার আগ্রহ প্রবল হয়ে ওঠে তার মধ্যে।
মারাংবুরু, সি এক মস্ত বড়ো পাহাড়। হামাদের ইক দেওতা। আকাশট ভেদ করহে সি পিথিবিটয় দাঁড়হায়ে আছহে। উত উঁচহা বলিহই দেওতা হামাদের সবহাইকে দিখতে পায়।
কিন্তুক, আকাশট পানহে চায়হে হামরা উয়ার দিখাট পাই লা কিন গ খুড়া, দেওতাট কুথায় আছহে গ?
উ দেওতাট তুর হামার মনহের মধ্যহেটয় আছহে রে ঝগড়ু। মনট ঝতহ উঁচা করবিক দেওতাটভি তর ততহ বড়ো হবেক। খানিক চুপ থেকে গয়ান ছোট্ট এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের বলে, ই সব হামার কথাট লয় রে ঝগড়ু। বাপপিতামহটর মুখহে শুনা।
আরহ বলহ গ খুড়া। শুনহে হামার মনট ভারি ভালহ লাগছে। হামরা কুথা থিকে এ পিথিবিটয় আসহিলাম গ খুড়া? বড় কৌতূহলী হয়ে পড়ে ঝগড়ু।
গয়ান মুখ তুলে ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে অনন্ত আকাশ দেখায়। বললো, ওখান থিকহে রে ঝগড়ু। সি এক মস্ত কিসসা।
গয়ানের দেখাদেখি ঝগড়ুও কী দেখার আশায় আকাশের দিকে তাকায়। পোড়া একপয়সা, দু’পয়সার মতো খটখটে আকাশ। কালো কালো বিন্দুর মতো গোটা কয়েক চিল আর শকুন মাত্র। যেন এই ভাগাড়ভূমির দিকে ওদের ক্ষুধার্ত দৃষ্টি তিরের ফলা হয়ে নেমে আসে। আর কিচ্ছু নেই। ওটুকু দেখাতেই ঝগড়ুর বুকের ভেতরটা কেমন আগুনের ছ্যাঁকা খেলো যেন। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না।
হুই আকাশট থিকে হামরা মাটিটয় পড়হলাম! ঝগড়ু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।
ঝগড়ুর মনে অবিশ্বাসও। আকাশ থেকে চাঁদ, তারার আলো নামে। অন্ধকার নামে। জল নামে। কুয়াশা নামে। বজ্রবিদ্যুৎ নামে। ঘরে ফেরার জন্য পাখিরাও নেমে আসে। কিন্তু অত উপর থেকে মানুষ কী করে নামে? নামলে সে কি আর আর বাঁচে? সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু যে অবধারিত!
লয় লয় রে ঝগড়ু। হংস আর হংসি পক্ষি দুটয় হল হামাদের আদি মাতাপিতা রে ঝগড়ু। এক হাঁস আর এক হাঁসি, দুইয়েটয় মিলহে ওই আকাশটয় মিলনট হল। লীচে তখনহ মাটিটর সিষটি হয় লাই। শুধু জল আর জল। মিলনট হইলে লুতন জন্মট হয়, লয়? তা উয়ারা জন্মট দিবেক কুথায়? তখহন হামাদের ঠাকুরটয় মারাংবুরুকে আদেশট দিলহ, মাটিটর সিষটি করতে। মারাংবুরু ভূমিটর জন্ম দিলহ। তাতহে জন্ম দিল বিন্নি ঘাসহের। ওই ঘাসময় ভূমিটয় হংসহংসি দুটয় বাসাট বাঁধলহ। সি বাসায় উয়ারা দুটহা ডিম প্রসবট করল।
ফের মাঝে কথা বলে ওঠে ঝগড়ু। তার মন যে বিস্ময় আর জানার ক্ষুধায় আরও তাড়িত এখন। বললো, খুড়া, তুমি বলহে, শুধহু জল আর জলট ছিলহ, তবহে ওই পক্ষি দুটহা কুথা থিকহে আইল গ?
উয়ারা পিথিবিটর ছিলহ লয় রে। হামাদের ঠাকুরটর মনট থিকহে তৈরহি হংসহংসি। পিথিবিটয় পিরানের জনমট দিতহে তৈয়ার করলহ।
তারপর খুড়া?
উয়ারা বাসাটয় দুটহা ডিমট পোসব করলহ। তা থিকহে পিথিবিটয় প্রথম ছিলে আর, মেইয়েটর জনমট হলহ। পিলচু হড়ম আর পিলচু বুড়হি।
গয়ান আরও বলে যেতে থাকে। পিলচু হড়ম আর পিলচু বুড়ির বড়ো হয়ে ওঠার কথা। মারাংবুরু শামা ঘাস থেকে ওদের নেশার পানীয় তৈরি করতে শেখালো। ওরা সে পানীয় তৈরি করে মারাংবুরুরকে প্রথমে উৎসর্গ করলো। তারপর নিজেরা খেলো। নেশার প্রবলতায় ওরা নিজেদের মধ্যের সম্পর্ক ভুলে গেলো। যৌনমিলনে মাতলো। হুঁশ ফিরলে ওরা লজ্জিত এবং শঙ্কিত হলো। মারাংবুরু সব দেখেছে, নিশ্চয়ই তাদের অভিশাপ দেবে। তাতে করে দু’জনের জীবনে ঘোর বিপদ ঘনিয়ে আসবে। কিন্তু না, মারাংবুরু বললো, সৃষ্টির প্রয়োজনেই ঠাকুর এমন ঘটনা তোমাদের দিয়ে ঘটিয়েছে। এতে তোমাদের কোনও দোষ নেই। পিলচু বুড়ির গর্ভে সাত পুত্র আর সাত কন্যার জন্ম হলো। মারাংবুরুর নির্দেশে ছেলে আর মেয়েদের আলাদা করে রেখে পালপোষ করে বড়ো করে তোলা হতে লাগলো। ওরা যার যার এলাকায় থাকে। এলাকার বাইরে হিংস্র প্রাণীদের উপদ্রব। সুতরাং ওদের সাবধান করে দেওয়া হলো যাতে এলাকা ছেড়ে বাইরে না বেরোয়। কিন্তু একদিন এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো, ছেলেরা শিকার করতে বেরিয়ে আহত এক হরিণের পিছু নিলো এবং একসময় বেখেয়ালে কখন মেয়েদের এলাকায় ঢুকে পড়লো। সেখানে ওরা সাতটি যুবতী মেয়ের দেখা পেলো। ওদের রূপে ওরা মুগ্ধ হলো। মেয়েরাও ওদের পৌরুষে আকৃষ্ট হলো। ওরা একসঙ্গে নাচ, গান, আনন্দফুর্তি আর আড্ডায় মেতে সারাদিন কাটালো। সন্ধ্যায় ছেলেরা যে যার পছন্দমতো জীবনসঙ্গীনী নির্বাচন করে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফিরে এল। ওদের মা বাবা, পিলচু হড়ম ও পিলচু বুড়ি বুঝলো, এ ঘটনাও তাদের ঠাকুরের ইচ্ছেয় হয়েছে। এরপর তাদের কী করণীয় তা জানতে তারা মারাংবুরুর শরণ নিলো। মারাংবুরুর নির্দেশে ছেলেরা আলাদা আলাদা সংসার পাতলো। তৈরি হলো সাত ছেলের সাতটি গোষ্ঠীর। সাঁওতাল সমাজ এই সাত গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে সময়ের সঙ্গে বিপুল জনসংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লো।
তাদের পৃথিবীতে আসার কিসসা জানলো, এখন ঝগড়ুর মনে তাদের আদি নিবাসের খোঁজ জাগে। গয়ান তাকে হিহিরি পিপিরি নামক এক জায়গার কথা বলে।
ঝগড়ু জানতে চায়, সি কুথায় গ খুড়া?
গয়ান বলে, সি হল চাইচম্পার দিশে রে ঝগড়ু।
ঝগড়ুর মনে বিস্ময়ের উত্তাপ লাগে, চাইচম্পার দেশ! ই ভারি মিঠা নাম গ খুড়া। সি দেশ কুথায় গ খুড়া?
গয়ান বড়ো করে নেতিবাচক মাথা নাড়তে থাকে। সে দেশ যে সত্যিই কোথায় তা আজও সঠিক করে কেউ বলতে পারে না। তবে লোকে অনুমান করে, সে দেশ বিহার মুলুকে। জাওরা নামে এক সাঁওতাল ছিলো সে দেশের রাজা। সে রাজার রাজত্ব ধ্বংস হলে সাঁওতাল সমাজ দিকু অর্থাৎ বহিরাগতদের অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনা আর প্রতিনিয়ত আগ্রাসনের শিকার হতে থাকে। ফলে ভাগ্যান্বেষে ওই স্থান ছেড়ে অন্য স্থানের জন্য পাড়ি দেওয়া তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। হিহিরি পিপিরি থেকে চাইচম্পার দেশ পর্যন্ত সে এক দীর্ঘ পরিক্রমা। হিহিরি পিপিরি থেকে হারা। হারা থেকে শশাংবেড়। শশাংবেড় থেকে জার্পি। জার্পি থেকে আহিরি। আহিরি থেকে কেন্দি। অবশেষে তাদের ঠাঁই হয় এই চাইচম্পার দেশে। এখানে তাদের সমাজকে সামাজিক অনুশাসনে বাঁধা হয়। নির্ধারিত হয় উৎসব অনুষ্ঠানাধি পালনের নিয়মবিধি। কিন্তু এখানেও বিধি বাম। আবার আগ্রাসন আর শোষণ। আবার পাড়ি, সামন্তভূমিতে ঠাঁই নেয় তারা। দীর্ঘদিন সেখানে বসবাসের পর বাধ্য হয়ে ফের ঠাঁইনাড়া হতে হয়। মানভূমের পথে যাত্রা করে। এখানে তাদের রাজা ধর্মত্যাগী হলে সাঁওতাল সমাজ ক্ষুব্ধ হয়ে রাজাকে ত্যাগ করে এ দেশও ছাড়ে। স্থানান্তরে তাদের সুবৃহৎ বসতি গড়ে তোলে। তৈরি হলো সাঁওতাল পরগনা। ছোটনাগপুর, ছোটো ছোটো পাহাড় আর টিলাময় ঘন সবুজ জঙ্গলময় ভূমি। এমন বাসস্থানই তো তাদের জীবনযাপনের জন্য উপযুক্ত। বড়ো প্রিয়। বন তাদের অন্নমাতা। বনজসম্পদে তাদের রুজিরুটি। বনচারি জীবনেই তাদের সুখশান্তি। কিন্তু সেখানেও জঙ্গল কেটে বসতি আর চাষবাসের ব্যবস্থার রাজসূয় যজ্ঞ শুরু হতে দিকু অর্থাৎ বহিরাগতদের স্রোত লাগলো। ফের দেশান্তরী হওয়ার পালা এল..., গয়ানের কিসসা বলা এগিয়ে চলে। প্রবাহমান জীবনের মতো। বেলা আরও মজে আসে।
একসময় ঝগড়ু বললো, হামাদের ইত কিসসা! ইতদিন কিন বল লাই গ খুড়া? ইসব ত হামাদিরই কিসসা গ, না ঝানলে হবেক কিন!
আছহে আছহে আরহ অনেক আছহে। ই শেষট হবার লয় রে ঝগড়ু। তু কত্ত শুনবিক! পিথিবিটয় হামরা যত্তদিনট আছি লয় তত্তদিনট লাগবেক ই কিসসা শেষট হতেক। ইখন দিনকালট পালটাই গিইছে রে ঝগড়ু। ইসব শুনবার মনট লাই কারহর। সময়ট ভি লাই। খালি বুলে মেলা কাজট আছহে। ঝতহ অকম্মহা কাজ! ছিলামাইয়া, লাতিলাতনি গুলানরে ঝতহ বুলি হামাদের পুবপুরহুষ আর দেওতাদের কিসসা গুলান শুনহে মনটয় গাঁথা রাখ, শিকড়ট ছাড়হা গাছট বাঁচহে লা তিমনহি উয়াদের কুথা ভুলিট গিলহে মারাংবুরু পাপট দিবেক। কিন্তুক উয়ারা খালহি বলহে, শিকড়ট মাটি থিকহে উপড়াই গিইছে বহু বছরট আগহে, উ মরহা শিকড়টর ইখন আর কী দামট আছহে! বলতে বলতে গয়ানের কণ্ঠস্বর নরম হয়ে আসে। তাতে মিশে যেতে থাকে তার মনের যত কষ্ট বেদনা।
শুনে বাহামনির মনটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। তার মনেও কষ্ট কম নয়। বলে, ই বার চুপট ঝাও গ বুঢ়া। ইত বকহ কিনে তুমহি? একরকম ধমকই দেয় সে গয়ানকে। সে যে ঘরের মানুষটার কষ্টটা বোঝে। বুঝেও এসব ব্যাপারে মানুষটার বিরুদ্ধেই যেতে হয় তাকে। মানুষটাকে কেউ অগ্রাহ্য করলে তার মনেও যে ঘা লাগে। তখনই সে মানুষটাকে একতরফা বকাঝকা করে থামিয়ে দেয়। যা হোক, অন্য কোনও এক প্রসঙ্গ তুলে পরিস্থিতি পাল্টে দেয়।
গয়ান আপসোস করে বলে, হামি মরিট গিলহে হামাদের কিসসাগুলান হারাইয়ে ঝাবেক গ!
সি ঝাবেক ত ঝাবেক, তুমহি ইকা মানহুষ সব রক্ষহা করবার ঠিকহা লিছ লাকি? ইবার ঝগড়ুটকে ছাড়িট ত দাও। আনধারট লাবতে ঝায়, তমার লাতি দুটা কুত্থায় গিল দিখহ! ডালট ভাঙহতে লাগবেক লাই?
হা গ খুড়া, খুড়ি ঠিকটই বুলছে, হামার ইখন মিলহা কাঝ গ। হামি ফির আসবক, বিবাক কিসসাগুলান শুনহে ই মনটয় গাঁথি রাখবক।
বাহামনি হাঁক পেড়ে নাতি দুটো, ভুলন আর ফকরাকে কাছে ডাকে। ঝগড়ুর সঙ্গে গিয়ে ওদের কী কী কাজ করতে হবে তা ভালো করে বুঝিয়ে দেয়। শুনে ওরা প্রবল উৎসাহিত হয়ে ওঠে। এমন মজার কাজ তারা এর আগে কোনওদিন করেনি যে! দু’জনেই বড়ো করে ঘাড় কাৎ করে এমন ভাব করলো যেন ওরা এসব কাজ খুব ভালোভাবেই করতে পারবে। বাহামনি ওদের ঝগড়ুর সঙ্গে ভিড়িয়ে দেয়। তিনজনে বাড়ির সীমানা পেরিয়ে রাস্তায় এসে পড়ে।
সেদিকে তাকিয়ে থাকে একা গয়ান। আরও কত কত কিসসা যে বলা বাকি থেকে গেলো! পাহাড়ঘেরা পাথুরে এক অরণ্যময় দেশের ছবি মনে করার চেষ্টা করতে গিয়ে কেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ে গয়ান। মনের চাতালে কিছুতেই যেন সবুজের পোঁচ পড়ে না। অরণ্যঘেরা এক শান্তির বসতির ছবি ফুটে ওঠে না। চারিদিক কেমন খা খা, ঊষর মরুভূমিময়। সেখানে খাদ্য নেই, পানীয় নেই, মাথার ওপর ছায়ার ঢাল নেই। মানুষের অস্তিত্বের টুকরোটাকরা ইঙ্গিতও নেই। সেই কত পুরুষ আগের বসতি ছিলো তাদের। এখন হয়তো সে দেশ গয়ানের কল্পনার সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে। আজ আর কোনও পার্থক্য নেই তার কল্পনায় আর বাস্তবে। নদীর জালিকায় ঘেরা দ্বীপময় এই বাদার দেশও এমনটা হয়তো থাকবে না। নদী মজে মজে মাটি হবে। সে মাটি শুধু মানুষের বসতির জন্য হবে। গাছপালা সব নিকেশ হয়ে যাবে। ঘন অরণ্যই তো জলভরা মেঘেদের তার বুকে টেনে জল নামায় পৃথিবীর বুকে। নতুন করে বাঁচার আনন্দে মেতে ওঠে জীব ও প্রকৃতি। উর্বরা হয় মাটি। সৃষ্টির উল্লাসে মেতে ওঠে ধরিত্রী। কয়েক পুরুষ পরে এই বাদার দেশও ঊষর মরুভূমি হলে তাদের উত্তরপুরুষরা তখন তাহলে কোথায় ঠাঁই নেবে? এরপরে তো আর এই দেশের মাটি আর নেই। আছে জল আর জল। অনন্ত জল। ওই জলে কবে আবার নতুন ভূমি জেগে উঠবে। তারা আবার লাঞ্ছিত বঞ্চিত হয়ে নতুন করে পাড়ি দেবে ওই দ্বীপভূমির উদ্দেশ্যে, বাঁচার আশায়। যেমন করে এদেশের কোথায় কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে তারা। নতুন দেশ, অপরিচিত প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষজন। থিতু হয়ে শরীর মন মাটিতে শিকড় চাড়াতে না চাড়াতে কখন যে ফের ভিটি ছাড়া হতে হয়! ছিন্ন হয়ে যায় সম্পর্ক, রক্তের বন্ধন, প্রেম, প্রীতি ভালোবাসার আবহমানকালের টান। দেশান্তরী তো সবাই হয় না, কিছু মানুষ ভালোভাবে করে কম্মে খেয়ে পরে থাকার ব্যবস্থা করতে পারায় থেকে যায়। যারা না পেরে হতভাগ্য হয় তারা বাঁচার আশায় দেশান্তরী হয়। পূর্বপুরুষদের দেশ, সে দেশ কোথায়, কত দূর, কেমন সে দেখতে তা কল্পনায় দেখার চেষ্টা করে গয়ান। বাপপিতামহর কাছ থেকে শোনা আরও কত কিসসা! সব কি একদিনে বলে শেষ করার! কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া মনে পড়ে গয়ানের। সব ঝগড়ুকে বলে যেতে চায় গয়ান। তার মনের মধ্যে কিসসাগুলো এই ধরা দেয়, এই হারিয়ে যায়। বারবার এমনটা চলতেই থাকে...
ক্রমশ