গল্প - উপাসনা ভট্টাচার্য
Posted in গল্পরঙ্গনকে দেখতে অনেকটা অ্যন্টিক ছবির মতন হয়ে যাচ্ছে। রাশভারি অ্যালবামগুলোর তিন নম্বর পাতায় যে ছবিগুলো অবহেলা পায়, পেয়ে এসেছে... তেমন। যখন রঙ্গন ঘুমায়, ওর চুলের মেহগনিতে মুগ্ধ হয়ে পাতা ঝরে। বেডরুমের জানলা খুললে জোৎস্নায় ওর হাতের লোম ভিজে আসে। নন্দিনী তাকিয়ে দেখে, কীভাবে কপালের ভাঁজে ফুটে উঠেছে তুঙ্গভদ্রা। অসংলগ্ন নিঃশ্বাস পড়ে, ভারী, উষ্ণ। বুকের ভিতর থেকে আলগা চাবুক মেরে বার হয় এলোমেলোভাবে। রঙ্গন পাশ ফেরে। বাঁ-হাতের মধ্যমায় যে কাটা দাগটা, ওটা অন্ধকারে থাবা মারতে থাকে। নন্দিনী চায় ওই দাগের ডগা বেয়ে তার ঠোঁট বোলাতে। কিন্তু রঙ্গনের আউটলাইন জুড়ে এক অপরিচিত পাঁচিল। পাঁচিল পেরোতে লাগবে স্পর্ধা, ঐশ্বর্য আর একটা গোটা বোতল শ্যাম্পেন।
ভোর রাতে উশ্রী যোগাযোগ করা বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলন-সময়কালীন চট্টগ্রামের গুপ্তচরের মতন রঙ্গন ফোন কানে নিয়ে বেরিয়ে যায়। কোথায় যায়, কোনও দেওয়ালও জানে না। ওর শরীরের ভারে বেডের এক কোণে বসে আদলহীন ছাপ। নিঃশেষ করে দেওয়া গন্ধটা মোজাইক টুকরো হয়ে মিলিয়ে যায় অযাচিত কোনগুলোয়। নন্দিনীও তো অযাচিত, তবু ওরা তাকে চিনতে পারেনা। যে সময় চিনতো, সেই অবেলাগুলোয় ঘর ভর্তি থাকতো পরিচিত মেহগনি আর পরিশ্রম। নখের ডগা দিয়ে পিঠের ওপর এঁকে দিত টান টান লক্ষণরেখা। উরু ভেঙে খসে পড়তো রঙ্গনের শহরে। সেখানে আছে লাল নীল আঘাত, আছে শব্দ, আছে ঔদ্ধত্য। আছে চণ্ডালের তীরের ফালির মতন বিস্ময়বোধক স্তুতি। এখন যাদের লেশমাত্র তোষকের নাভি ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেললেও আর পাওয়া যায় না। নন্দিনী এখন একা। একাকীত্বের এপিফ্যানি বহু রাতে তার কাছে নেমেছে গন্ধর্বের স্বপ্ন হয়ে। গন্ধর্বটা রঙ্গন। তবে উশৃঙ্খল, উন্মুখ। বীণার ঝঙ্কারে ফেটে পড়ে তার পৌরুষত্ব।
নন্দিনী অতিমানবীয় ভঙ্গিতে অপেক্ষা করে বিস্তৃত মরুভূমিতে বেমানান শেফালী ফুলের মতো দিনবদলের। রঙ্গনের মুখ, যেন ধ্রুবতারা। সক্ষম হাতের বন্ধনীতে যেখানে একসময় নন্দিনীর কখনও সমর্পণ, আত্মনিবেদন ছিলো দ্বিধাহীন সূর্যালোকের মতো।
এখন নন্দিনী প্রহসন। বিচারবুদ্ধির অমাবস্যায় হারিয়েছে প্রতিবাদের হাতিয়ার। বিচারবুদ্ধি বলে, সে সুন্দর; নিষিদ্ধ ভীমরুলের মতন কোল জুড়ে তার মধুভোজ। সেই দাম্ভিক গহ্বর ভেদে আছে অভূতপূর্ব রোমাঞ্চের আস্ফালন।
ব্যস্ততা এবং অভিনীত ব্যস্ততার মরশুমে আর কেঁদে ওঠা হয়না। অনেকটা জমিয়ে তৈরি করেছে বদমেজাজি, স্থাবর এক পাথুরে মানুষকে। মানুষ, না মূর্তি? রঙ্গন বলে, মূর্তির গায়ে লাল চিকনের শাড়িটা বেশ মানাচ্ছে। বলেনা, হয়তো ভাবে। হয়তো বলবে। হয়তো একদিন দুঃস্বপ্নদের ভীষণ জোরে বকে দিয়ে নন্দিনীর চোখের পাতায় লিখে রাখবে আধিপত্য। লিখবে ফিরে আসার অনুগামী জিপিএস।
হয়তোগুলো ভাবতে ভাবতে সূর্যাস্ত হয়। কাজ বাড়ে, লোকেদের ভীড় হাঁসফাঁস করে হলের ঝিকিমিকি আলোয়। উশ্রী এসে নন্দিনীকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলতে চায়। ওর ঘাড় বেয়ে ওঠানামা করতে থাকে এক বিশ্রী ভ্যাপসা গন্ধ।
অহঙ্কার, আর এক রাশ মেহগনি।